Wednesday, July 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1090



স্নিগ্ধ প্রেমের মায়ায় পর্ব-০১

0

#স্নিগ্ধ প্রেমের মায়ায়
#সুচনা পর্ব
#লেখিকা-সাদিয়া জান্নাত সর্মি

মাত্র কয়েক ফুট দুরত্বের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আছে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নেহা আর আর আমার বয়ফ্রেন্ড আয়াশ যে কিনা বর্তমানে নেহার স্বামী। জন্মদিনে নিজের বয়ফ্রেন্ড কে অন্য একজনের হাজব্যান্ড হিসেবে দেখতে পাবো এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।স্তম্ভিত হয়ে দেখছি ওদের দুইজন কে, মুখে কোন কথা নেই আমার। আমাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নেহা বললো,, স্নিগ্ধা ও আমার হাজব্যান্ড আয়াশ। বলেছিলাম না আমি তোকে তোর জন্মদিনে অনেক বড় একটা সারপ্রাইজ দিবো এটাই সেই সারপ্রাইজ। খুশি হয়েছিস তো তুই?
আমি নেহার কথা শুনে অনেক কষ্টে একটু হাসলাম, বুকের ভেতর ঝড় উঠেছে আমার নেহার কথাগুলো শুনে কিন্তু বাইরে তা বুঝতে দিলাম না। হাসি মুখে বললাম,
হ্যা রে আমি খুব খুশি হয়েছি এমন সারপ্রাইজ পেয়ে, সত্যিই খুব খুশি হয়েছি আমি,আরো বেশি খুশি হয়েছি যে তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে আমার ভালবাসার মানুষ টি কে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলি এটা দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি রে।আর আয়াশ তুমি তো আমাকে ভালবাসতে তাহলে তুমি আমাকে ছেড়ে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে বিয়ে করলে কি করে? লজ্জা করছে না তোমার, আমাকে ছেড়ে আমারই বেস্ট ফ্রেন্ড কে বিয়ে করতে।
আয়াশ আমাকে কিছু বলতে যাবে তখনি নেহা ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
আয়াশ তোকে ভালোবাসে না স্নিগ্ধা,ও আমাকে ভালোবাসে। আসলে আমাদের দুজনের সম্পর্ক টা অনেক দিনের কিন্তু তুই সেটা জানতি না। আমাদের পরিবার যখন জানতে পারলো আমাদের সম্পর্কের কথা তখন ওরা মেনে নেয়নি।তাই আমরা পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই কিন্তু তার জন্য টাকার দরকার ছিল।আর আমাদের কাছে টাকা ছিল না তখন আমিই আয়াশ কে বলি তোর সাথে সম্পর্কে জড়াতে যাতে তোর থেকে আমাদের টাকার ফায়দা হয়। আসলে আয়াশ টাকার জন্য তোর সাথে রিলেশন করে ছিল তোকে ভালোবেসে নয়।

নেহার কথাশুনে রাগে শরীর জলে গেল আমার,ঠাস করে একটা থা*প্প*র বসিয়ে দিলাম নেহার গালে। নেহা আমার এমন আকস্মিক থা*প্প*রে*র জন্য প্রস্তুত ছিল না তাই অনেক টা অবাক হয়ে গেল। গালে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকালো, আমার রাগ ক্রমশ বাড়ছে তাই আরেক টা থা*প্প*ড় মারলাম ওকে।আয়াশ আমাকে আটকাতে আসলে ওর গালেও দু’টো থা*প্প*ড় বসিয়ে দিয়ে বললাম, লজ্জা করা উচিত তোদের দুজনের। ছিঃ এতো টা নিচ মানসিকতা তোদের আমি ভাবতে পারছিনা। নেহা তুই তো আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলি তাহলে তুই কেন আমার পিছন থেকে ছুরি মারলি? আমার সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে এতো বড় একটা নাটক করলি,আরে তোদের টাকার দরকার ছিল তা বলতে পারতি আমাকে। কত টাকা লাগতো আমি দিতাম তোদের,তা না করে আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেললি কেন রে?আর আয়াশ তুই, তোকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি খুব বিশ্বাস করেছি তোকে, তার এই দাম দিলি তুই?আর আমিও কি বোকা, তোদের দুজনের চালাকি আমি একটুও ধরতে পারিনি। তোর মতো একটা ছেলে কে আমি ভালোবাসি এটা ভাবতেই লজ্জা লাগছে আমার। আমার সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তোরা যা করেছিস তার জন্য আমি তোদের কখনো ক্ষমা করবো না, তবে এটা ভাবিস না যে আমি তোদের অভিশাপ দেবো, আমি তোদের কোনোদিন অভিশাপ দেবো না বরং এটা চাইবো যেন আল্লাহ তোদের খুব সুখে রাখে, কেউ যেন কখনো তোদের কোন কষ্ট না দেয়, আমার মতো এইভাবে যেন তোদের কোনোদিন ঠকতে না হয়। ভালো থাকিস তোরা, পরবর্তী জীবন টা খুব আনন্দের সাথে কাটাস।এই কথা গুলো বলে আমি চোখের কোণা বেয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল সেটা মুছে নিয়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে এলাম।পার্কের বাইরে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছে, আমি তাড়াতাড়ি করে এসে গাড়িতে উঠে বসে ড্রাইভার কে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাসার দিকে যেতে বললাম। গাড়ি চলতে শুরু করলে আমি গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম,যাদের আপন ভাবতাম তাদের কাছ থেকে এতো বড় আঘাত পেয়ে বেহায়া চোখ গুলো বাধা মানছে না আর,আপনা আপনি চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। খুব ভালো বাসতাম আয়াশ কে এক কথায় নিজের থেকেও বেশি। বাবা এটা জানতে পেরে আমাকে অনেক বার বলেছিল যে আয়াশের সাথে যেন আমি সম্পর্কে না জড়াই,আয়াশ ভালো ছেলে নয়, একটা খারাপ ছেলে ও।আমি বাবার কথা না শুনে বাবাকে বলেছিলাম যে আমি একদিন প্রমান করে দিবো আয়াশ খারাপ ছেলে না,ও বাবার মেয়ের যোগ্য একটা ছেলে। কিন্তু আয়াশ আমার সব ভুল ধারণা ভেঙ্গে দিয়ে আজ এটা প্রমাণ করেই দিলো যে ও সত্যিই একটা খারাপ ছেলে, আমার যোগ্য ও হয়ে উঠতে পারে নি। কেন যে তখন আমি বাবার কথা শুনিনি, তখন বাবার কথা শুনলে আজ হয়তো আমাকে এইভাবে ঠকতে হতো না।চোখ মুছে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম, কিছুক্ষণ পর গাড়ি বাসার সামনে এসে দাড়ালো। আমি গাড়ি থেকে নেমে বাসায় ঢুকলাম, বাসায় ঢুকেই অনেকটা অবাক হয়ে গেলাম,পুরো বাসা অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আমি কিছু বুঝতে না পেরে ছোট চাচ্চুর মেয়ে আফিয়া কে জিজ্ঞেস করলাম, এই আফিয়া আজ বাসা টা এইভাবে সাজিয়েছে কেন রে?
আফিয়া মুখ ভেংচে উত্তর দিলো, তোমাকে বলতে মানা আছে তাই বলতে পারবো না।
একটা চকলেট আফিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, এবার তো বল?
আফিয়া আমার কান এগিয়ে দিতে বললো, আমি এগিয়ে দিলে ও কানের কাছে ফিসফিস করে বলল আপু আজ তো তোমার জন্মদিন, সেজন্যই বাসা এইভাবে সাজানো হয়েছে। তুমি এখন তোমার রুমে চলে যাও আর আমি যে তোমাকে বলে দিয়েছি সবকিছু এটা আবার কাউকে বলো না যেন।
আমি আফিয়ার কথা শুনে একবার ওর দিকে তাকালাম আরেক বার নিজের চারদিকে তাকালাম। তার পর নিজের রুমের দিকে চলে গেলাম আমি। রুমে এসে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে হাতটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, এই হাত দিয়ে একটা ছুঁ*চো কে ছুয়েছি আমি ছিঃ। এক্ষুনি ধুয়ে ফেলতে হবে হাত টা, নাহলে গন্ধ করবে। ওয়াশরুমে গিয়ে পুরো আধঘন্টা সময় লাগিয়ে হাত ধুয়ে বাইরে এলাম। অনেক ঘসাঘষির কারনে হাতের ফর্সা চামড়ার উপর লাল দাগ পড়ে গেছে,একটা জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বেডে বসে পড়লাম।

চলবে…………… ইনশাআল্লাহ

স্নিগ্ধ চাহনি পর্ব-০৭(অন্তিম পর্ব)

0

#স্নিগ্ধ চাহনি
#পর্বঃ৭(অন্তিম পর্ব)
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘আমি আফনান’ শুধু মাত্র এই দুটি শব্দেই যেন তছনছ করে দিল মৃন্ময়ীর সকল অনুভূতি। চিরচেনা সেই কন্ঠস্বর শুনে দুমড়েমুচড়ে গেল তার ভেতরটা। মুগ্ধ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো মৃন্ময়ীর মুখের পরিবর্তন হওয়া।
ফোনের ওপাশ থেকে আবারও করুন কণ্ঠ ভেসে আসলো-

‘মৃনু শুনছো! কথা বলবে না!’

মৃন্ময়ী রাগ করতে চাইলো। ভীষণ রাগ নিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু কিছুতেই রাগ প্রকাশ করতে পারলো না। থমথমে গলায় নিম্ন স্বরে প্রশ্ন করল-

‘আমাকে কল করেছেন কেন আফনান?’

মৃন্ময়ী কন্ঠস্বর শুনেই আফনান উত্তেজিত হয়ে পরে। হড়বড়িয়ে একনাগাড়ে কথা বলা শুরু করলো-

‘মৃনু প্লিজ আমার কথাটা শোনো। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি মৃনু। তুমি তো জানো আম্মু কি পরিমাণ জেদি একজন মানুষ। ওনার সামনে আমার কথার কোনো মূল্যই নেই। নানানরকম কছম টছম কাটিয়ে আমাকে জোর করে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে। প্লিজ তুমি এ নিয়ে রাগ করো না।’

‘আমাকে এসব কেন শোনাচ্ছেন আপনি!’

মুগ্ধ ছোঁ মে’রে মৃন্ময়ীর হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নেয়। মৃন্ময়ী বিস্মিত চোখে চাইলো মুগ্ধর দিকে। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই ফোন নিজের কানের কাছে ধরে রেখেছে। যেন ফোনটা তার-ই। আর ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটা যেন তার সঙ্গেই কথা বলতে চাইছে।

‘মৃনু আমি চাই না আমাদের মধ্যে কোনো প্রকার ভুলবোঝাবুঝি থাকুক। আমি খুব দ্রুত ফ্লোরিনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরে আসবো। প্লিজ তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করো মৃনু।’

আফনান একদমে কথা গুলো বলেই থামলো। মুগ্ধ অতি ভদ্রতার সঙ্গে বলল-

‘আমি মৃন্ময় আহসান মুগ্ধ। যদিও আমি একজন নামকরা এডভোকেট তবে এর থেকেও বড় পরিচয় হলো আমি মৃন্ময়ীর হাসবেন্ড। পুরোপুরি হাসবেন্ড হইনি তবে খুব শীগ্রই হয়ে যাচ্ছি।’

‘মানে কি বলছেন আপনি এসব! বিয়ে ঠিক হয়েছে মানে কি? মৃনু কোথায়! ওর কাছে ফোনটা দিন। ওর ফোন আপনার কাছে কেন!’

মুগ্ধ মৃন্ময়ীর নির্বিকার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো৷ কড়া গলায় বলল-

‘বার বার মৃনু.. মৃনু ডাকবেন না। আমার বউকে এসব নিক নেইমে ডাকার পারমিশন আমি অন্য কাউকে দিচ্ছি না। আর হ্যাঁ একটা কথা। আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর প্রয়োজন ছিল।’

আফনান আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে-

‘ধন্যবাদ! কিন্তু কেন!’

মুগ্ধ ভীষণ গম্ভীরমুখে বলল-

‘সেদিন কাজি অফিসে না এসে মায়ের আঁচল ধরে দেশ ছাড়ার জন্য ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে এত বড় একটা সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। ভালো হয়েছে আপনি মৃন্ময়ীকে ধোঁকা দিয়ে কান্না করিয়েছিলেন। ও যদি কান্না না করতো তাহলে আমি কার চোখে বশীভূত হতাম! কাছে থাকলে নিশ্চিত আপনাকে একটা টাইট হাগ দিতাম।’

‘পাগলের মতো কি সব যা-তা বলছেন!’

মুগ্ধ মৃন্ময়ীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আফনানের উদ্দেশ্যে নরম গলায় বলল-

‘যা-তা নয়। মৃন্ময়ীকে আমার সঙ্গী করে রেখে যাওয়ার জন্য। আমি সত্যিই আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। একটা কথা বলছি মনোযোগ দিয়ে শুনে রাখুন। ভালোবাসলে এত ভীতু হতে হয় না। সব কিছুতে মায়ের দোষ দেওয়া ঠিক না। আপনি নিজেই মৃন্ময়ীকে পাওয়ার যোগ্য না।’

আফনান ক্ষিপ্ত গলায় বলল-

‘আপনি কিন্তু বেশ বারাবাড়ি করছেন। আমি এখনো মৃন্ময়ীকে ছাড়িনি।’

মুগ্ধ নিজেকে যথাসাধ্য গম্ভীর করে বলল-

‘অনেক কথা হলো এবার রাখছি। আমাদের ডেটে বাধা দিলেন আপনি এজন্য খুব রাগ হচ্ছে আমার। আর হ্যাঁ আরেকবার যদি নিজের বউকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছেন তাহলে এমন মিথ্যা মামলায় আপনাকে ফাঁসাবো যে সারাজীবন জেলের শুকনো রুটি খেয়ে দিন কাটাবেন। তখন বউকে তো কাছে পাবেনই না আর বাচ্চাকাচ্চার মুখও দেখা হবে না। একটা কথা তো জানেন এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার এন্ড লাভ। আর আমি কিন্তু আপনার মতো ভীতু নই। আমি মৃন্ময়ীর জন্য সব করতে রাজি।’

আফনানের কথার অপেক্ষা না করেই মুগ্ধ ফোন কেটে দিলো। তার সাথে সাথেই আফনানের নাম্বার ব্লাক লিস্টে ফেলে দেয়। বিশ্বজয়ী একটা হাসি দিয়ে মৃন্ময়ী দিকে তাকায়। মৃন্ময়ী অবাক চোখে কিছুক্ষণ স্থির চেয়ে রইলো। পরক্ষণেই খিলখিল করে হেসে উঠলো। মানুষ গম্ভীরমুখে এসব কথা কিভাবে বলতে পারে!! মৃন্ময়ী হেসেই যাচ্ছে। মুচকি হাসি নয় শব্দ করে, ঝর্নার পানি বয়ে যাওয়ার মতো তরল হাসি। এই প্রথম বুঝি মুগ্ধর সামনে খিলখিল করছে হাসলো। এখন আর সব সময়ের মতো মুগ্ধর মুখে হাসি নেই। সে অদ্ভুত চাহনিতে একমনে দেখছে মৃন্ময়ীর হাসি।

অর্পির প্রতি ভীষণ রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। মনে মনে কয়েক দফা অর্পির গুষ্টি শুদ্ধো উদ্ধার করে ফেলছে। তবুও রাগ কমছে না। রাগের ফলে চিরবির করছে তার শরীর। মেয়েটা একটা কাজও ঠিক মতো করে না। একে-তো আফনানের কথায় গলে তার নাম্বার দিয়ে দিয়েছে। যদিও অর্পি এর জন্য অনেকবার ক্ষমা চেয়েছে। আর সে-ও ক্ষমা করে দিয়েছে। কিন্তু আজকের ভুলের জন্য কিছুতেই সে ক্ষমা করবে না। তার পা ধরে কান্নাকাটি করলেও না। জীবনে প্রথম ঘটা করে তাকে ছেলে পক্ষ দেখতে এসেছে অথচ আজকের দিনেই অর্পি তার মামুর বাসায় গিয়ে ঘুপটি মে’রে আছে। আজকের দিনেই কেন যেতে হলো!! কে থাকবে এখন তার সাথে!
হঠাৎই তার রাগ কমে গেলে। ঝেঁকে বসলো মন খারাপ। বিষন্নতায় অন্ধকার হয়ে আসলো তার মুখ। যদি আজ তার মা-বাবা বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো তাদের দুই ভাইবোনকে এতটা অস্থির হতে হতো না৷ এই বিষয় গুলো তারাই হয়তো তাদের পাকাপোক্ত হাতে সামলিয়ে নিতো। মেহমানদের আপ্যায়নের জন্য ধ্রুব আর রঞ্জনকে এমন উতলা হওয়া লাগতো না। বোকাদের মতো বার বার একই কাজ ঘুরেফিরে এলোমেলো করছে। তার মা থাকলে নিশ্চয়ই সব সামলিয়ে নিতেন। মেয়েকে ধরে মেহমানদের সামনে নিয়ে বসাতেন। তার মা থাকলে এই মুহুর্তে তাকে একা একা অস্বস্তি আর ভয় নিয়ে বসে থাকতে হতো না। নিজেকে বড্ড অসহায় হিসেবে উপলব্ধি করলো মৃন্ময়ী। চোখদুটো আপনাআপনি ঝাপসা হয়ে আসছে। মনের গহীন কোণে অসহ্য চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল সে।

‘খুব নার্ভাস লাগছে তাই না!!’

মিষ্টি মধুর এক নারী কণ্ঠস্বরে চমকে উঠে মৃন্ময়ী। ঝট করে দৃষ্টি দেয় দরজার দিকে। মধ্যবয়স্কা এক অতি রূপবতী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মুখে অদ্ভুত সুন্দর হাসি। ভদ্রমহিলা এগিয়ে আসতে আসতে বললেন-

‘আমিও এই দিনটায় খুব নার্ভাস ছিলাম। উনি যেদিন আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন সেদিন কিভাবে তাদের সামনে যাবো একথা ভেবেই আমার শরীর থরথর করে কাঁপছিল। কিন্তু মা আর বড় আপা মিলে আমাকে সামলিয়ে নিয়েছিল। মুগ্ধ আমাকে বলেছে তোমার কথা। আমার মনে হলো এই মুহুর্তে তুমিও আমার মতো অবস্থাতেই আছো। কিন্তু তুমি একা। একদমই একা। তোমাকে সামলানোর জন্য কিংবা সাহস দেওয়ার জন্য কেউ নেই। তাই আমি চলে আসলাম তোমার সেই অভাবটা পূরণ করতে।’

মহিলার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে ইনি মুগ্ধর আম্মু। এনাকে দেখেও মৃন্ময়ী অবাক হলো। প্রথম দেখাতেই এতটা আন্তরিকতার সাথে কিভাবে কথা বলছেন!! মুগ্ধ কি তাহলে ওনার মতোই হয়েছেন!!
মুগ্ধর আম্মু খুব সহজ সরল ভাবে কথা বলে যাচ্ছেন। কথা বলতে বলতে মৃন্ময়ীর পাশে এসে বসলেন। বেশ আগ্রহ নিয়ে বললেন-

‘আমি মুগ্ধকে বলে দিয়েছে আজ তুই আর তোর বাপ একা একা থাক। আমি আজ তোর পক্ষের না বরং মেয়ের পক্ষের হয়ে কথা বলবো। তাই সাবধানে থাকিস তোরা বাপ ছেলে। আমার কথা শুনে মুগ্ধ একদম চিমসে গিয়েছিল। ওর মুখটা দেখার মতো ছিল।’

ভদ্রমহিলা হাসছেন। তরল ভঙ্গির হাসি। তার হাসির মাঝেও ভালো লাগা জড়িয়ে আছে। তাদের মা ছেলের হাসিতে যেন চারপাশে ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। একজনের হাসিতেই আশেপাশের সবার মন ভালো হয়ে যায়। মৃন্ময়ীকে চুপ থাকতে দেখে তিনি ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করলেন-

‘কথা বলছো না যে! আমি একা একাই কত কথা বলে ফেললাম। তুমি নিশ্চয়ই অস্বস্তিবোধ করছো তাই না!’

মৃন্ময়ী ঝাপসা চোখে ওনার দিকে চাইলো। ধরা গলায় বলল-

‘আপনি অনেক ভালো।’

কথাটা বলেই মৃন্ময়ী চোখের পানি ছেড়ে দেয়। ভদ্রমহিলা মৃদু হাসলেন। মৃন্ময়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-

‘আমার ছেলে ঠিকই বলেছে তোমার চোখে কিছু একটা আছে। তোমার চোখদুটো মানুষকে বাধ্য করে তোমাকে ভালোবাসতে।’

——————

❝তোমার ওই নির্মল চোখদুটোতে কেবলই মাত্র স্নিগ্ধতা,
তোমার মাঝেই দেখতে পাই আমি এক আকাশ মুগ্ধতা।❞

মুগ্ধর মুখে এমন ছন্দ শুনে মৃন্ময়ী বিস্ময়ের চোখে চাইলো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে। বরাবরের মতোই মুগ্ধর মুখে মনকাড়া হাসি। সে মৃন্ময়ীর দিকে শীতল চাহনি নিক্ষেপ করে বলল-

‘বিয়ের তারিখ হয়তো এই সপ্তাহের মধ্যেই পরবে৷ আম্মু চাচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে বাসায় নিয়ে যেতে।’

মৃন্ময়ী কিছু বলল না। আবারও নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায় নিচের পিচঢালা রাস্তায়। মুগ্ধ আর সে ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। আর বাকিরা ভেতরে বিয়ের তারিখ নিয়ে আলোচনা করছে না।
মৃন্ময়ীকে চুপ থাকতে দেখে মুগ্ধ আবারও বলল-

‘তুমি খুব সাংঘাতিক মেয়ে। আমাকে তো বশ করিছিলে ভালো কথা। কিন্তু এখন দেখি আম্মুকেও বশ করে ফেলেছো। ছেলের জন্য বউ দেখতে এসে উনি পাত্রী পক্ষের লোক হয়ে গেছে। ভাবা যায় এগুলো!! কি সাংঘাতিক ব্যাপার স্যাপার।’

‘আপনি খুব লাকি আপনার এত ভালো একটা মা পেয়েছেন।’

‘লাকি আর রইলাম কোথায় আম্মুকে তো তুমি নিয়েই গেলে।’

মুগ্ধর হতাশা দেখে মৃন্ময়ী ঠোঁট চেপে হাসলো। কিছুটা সময় পর মুগ্ধ বেশ গম্ভীর কণ্ঠে ডাকলো-

‘মৃন্ময়ী!’

মুগ্ধর ডাকে মৃন্ময়ী ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। মুগ্ধ অতি গম্ভীর কণ্ঠে বলল-

‘একটা অন্যায় কাজ করতে ইচ্ছে করছে। মনের মধ্যে খুব ভয়ংকর একটা ইচ্ছে জেগেছে। ইচ্ছেটা খুবই অন্যায় তবুও ইচ্ছে করছে। সব জেনেও অন্যায় কাজ করতে চাচ্ছি।’

মৃন্ময়ীর সরু চোখে চেয়ে রইলো। মুগ্ধর গম্ভীর কথা মানেই উল্টাপাল্টা কিছু। দু’দিন আগের কথা এখনও মনে আছে তার। কিভাবে তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল৷ আর আফনানাকেও হুমকি দিয়েছিল কি অদ্ভুত ভাবে।
মৃন্ময়ী সন্দেহের গলায় ছোট করে প্রশ্ন করে-

‘সেই অন্যায় কাজটা কি?’

মুগ্ধ কোনো জবাব দিলো না। ধীর পারে এগিয়ে এলো মৃন্ময়ীর নিকটে। মৃন্ময়ী কপাল কুচকালো। মুখ ফুটে আগ্রহের সঙ্গে কিছু বলবে তার আগেই বাধা দেয় মুগ্ধ। ডান হাতে ঢেকে ফেলে মৃন্ময়ীর স্নিগ্ধ চোখদুটো। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই উষ্ণ স্পর্শে মূর্তি ন্যায় রূপ ধারণ করল। স্তব্ধ হয়ে গেল তার মন, মস্তিষ্ক, শরীর সব কিছুই। ডান গালে একজোড়া তপ্ত ঠোঁটের গাঢ় স্পর্শ অনুভব করলো। মুহুর্তেই বরফের ন্যায় জমে থরথর করে কেঁপে উঠলো তার হৃদয়। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। গলার মাঝেই যেন আটকে যাচ্ছে নিঃশ্বাস। এভাবেই কিছুক্ষণ কেটে গেল। পাড় হয়ে গেল অবাঞ্ছিত কিছু মুহুর্ত। গালের উপর চেপে রাখা ওষ্ঠদ্বয়ের উষ্ণ অত্যাচার কমে এলো। মুগ্ধ সরিয়ে নিল তার ঠোঁট জোড়া। তবে হাত এখনও মৃন্ময়ীর চোখ ঢেকে রাখা। মৃন্ময়ী নড়ছে না। আগের মতোই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুগ্ধ শীতল গলায় কিছুটা ফিসফিসিয়ে বলল-

‘আজ আর তোমার চাহনিতে নিজেকে বন্দী করতে পারবো না। এই অন্যায়ের পর তোমার নিষ্ঠুর চোখের দিকে তাকানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এইমুহূর্তে তোমার স্নিগ্ধ চাহনিতে আমি নিজেকে ঘায়েল করার সাহস দেখাবো না। তোমার বশীকরণ চোখদুটিতে নিজেকে বশ করতে চাচ্ছি না। ক্ষমা চাচ্ছি নিজের করা অন্যায় কাজের জন্য। খুব শীগ্রই আসবো তোমাকে বউ বানিয়ে নিতে৷ তোমরা চোখের নিষ্ঠুরতার জন্য তোমাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতে। তৈরি থেকে এই পাগলাটে মৃন্ময়ের সঙ্গে মৃন্ময়ীকে যুগলবন্দী করতে।’

মৃন্ময়ীর মস্তিষ্ক সচল হতেই হাল্কা নেড়েচেড়ে উঠলো। মুগ্ধর বুকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে অস্পষ্ট কন্ঠে বলল-

‘মৃন্ময় সরুন।’

মুগ্ধ মুচকি হাসলো। কন্ঠে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বলল-

‘যাক অবশেষে তোমার মুখে মৃন্ময় ডাক শুনতে পেলাম।’

মুগ্ধ মৃন্ময়ীর চোখ থেকে হাত সরালো। মৃন্ময়ী পিটপিট করে আস্তে ধীরে চোখ মেলে সামনে তাকায়। নাহ.. সামনে কেউ নেই। মুগ্ধ চলে গেছে। সিড়ি দিয়ে নামার শব্দ হচ্ছে। মৃন্ময়ী স্থির হয়ে রইলো কিছুক্ষন। পরক্ষনেই ঠোঁটের কোণে ক্ষীন হাসির রেখা ফুটে উঠলো। এর কারণ তার অজানা।

আর মাত্র পাঁচ দিন পর বিয়ের দিন ঠিক করা হয়েছে। একটু আগেই মুগ্ধর বাবা-মা বিয়ের ফাইনাল তারিখ ঠিক করে বিদায় নিলেন। মুগ্ধকে আর দেখা যায়নি। সে পালিয়েছে মৃন্ময়ীর চাহনি থেকে। মৃন্ময়ী এখনো ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।

‘অবশেষে মাটির তৈরী রাজকুমারীর জন্য একটা রাজকুমার খুঁজে পেলাম। এবার তুই খুশি তো!! সারাজীবন তোর পাশে থাকার জন্য মুগ্ধ আছে। মায়ের অভাব পূরণ করার জন্য মুগ্ধর মা আছে।’

ধ্রুবর কথায় মৃন্ময়ী মনে মনে হাসলো৷ তবে মুখে গম্ভীর ভাব এনে বলল-

‘নাহ এখনো খুশি না। আমার আরেকটা গিফট লাগবে।’

ধ্রুব ক্লান্ত গলায় প্রশ্ন করে,

‘আবার কি!!’

‘সারাজীবন তোমার পাশে থাকার জন্য আমার একটা ভাবি লাগবে। একটা সানসাইন লাগবে। যে কি-না আমি না থাকা অবস্থায় তোমার জীবনটা খুশিতে উজ্জ্বল করে দিবে।’

মৃন্ময়ী কথাগুলো বলেই মিষ্টি করে হাসে। ধ্রুব সন্দিহান কন্ঠে বলল-

‘তা না হয় পরেই দেখা যাবে। আপাতত তোর বিয়ে নিয়ে চিন্তা কর।’

বেশ কিছুটা সময় দুজনে চুপচাপ কাটিয়ে দেয়। মৃন্ময়ী দোলনায় বসে নরম গলায় বলল-

‘আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি ভাইয়া। আব্বু আম্মুর থেকেও বেশি ভালোবাসি। একা একা এত কিছুর দায়িত্ব নিয়েছো। ছোট থেকে আমাকে এতটা ভালোবাসা দিয়ে আমাকে বড় করেছ। এসবের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ বলে ছোট করবো না। তবে আমার দেখা শ্রেষ্ঠ পুরুষ তুমি। আর সব সময়ই আমার চোখে তুমিই সেরা থাকবে।’

ধ্রুব মৃন্ময়ীর পাশে বসে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল-

‘আম্মুর কাছ থেকে পাওয়া সবচেয়ে সেরা উপহার হলি তুই। আম্মু চলে যাওয়ার সময় এই মূল্যবান উপহারটা আমাকে দিয়ে গেছে। এই উপহারটাকে ভালোবেসে আগলে রাখার দায়িত্ব তো আমারই তাই না! তাই এসব ধন্যবাদ টন্যবাদ বাদ। তুই আমাকে ভালোবাসিস আমিও তোকে ভালোবাসি হিসেব বরাবর।’

মৃন্ময়ী স্মিত হেসে ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে। দুঃখবিলাসী বাগানটা আজ তাদের খুশিতে জ্বলজ্বল করে আলো ছড়াচ্ছে। মৃন্ময়ীর সকল দুঃখ কষ্ট যেন শুষে নিয়েছে এই বাগানের গাছ গুলো। শুরু হয়েছে মৃন্ময়ীর সুখের দিন। মন ভালোর দিন। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ আগামী মৃন্ময় যুগলপ্রেমের দিন।

সমাপ্ত__🌻

স্নিগ্ধ চাহনি পর্ব-০৬

0

#স্নিগ্ধ চাহনি
#পর্বঃ৬
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘কেমন আছিস মৃন্ময়? কত বছর পর দেখা হলো তোর সাথে। এটা কে ভাবি না-কি!’

‘নাহ তবে খুব শীগ্রই হবে। অবশ্য এখনও ভাবি ভাবতে পারিস।’

মুগ্ধ কথাটা বলেই মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলো। মুগ্ধকে দেখে মনে হলো সে বুক ফুলিয়ে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়েই কথাটা বলেছে। মৃন্ময়ী হতবাক হয়ে স্থির বসে রইলো। তাকে কি বলে পরিচয় দিচ্ছে না দিচ্ছে এসব নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছে না। সে ভাবছে মৃন্ময় নামটা নিয়ে। চরকির মতো মৃন্ময় নামটা ঘুরছে তার মস্তিষ্কে। লোকটা মুগ্ধকে মৃন্ময় বলে ডেকেছে কিন্তু সে যতটুকু জানে তার নাম মুগ্ধ।
মুগ্ধ মৃন্ময়ীকে উদ্দেশ্য করে বলল-

‘ওর নাম জিসান। আমার কলেজ ফ্রেন্ড।’

কথাটা বলেই জিসানের কাধে হাত রাখে। জিসান মৃন্ময়ীর দিকে চেয়ে বিনয়ী ভঙ্গিতে হাসলো। মুগ্ধ মৃন্ময়ীকে দেখিয়ে জিসানের উদ্দেশ্যে বলল-

‘আর জিসান ও হলো মৃন্ময়ী আমার হাফ স্ত্রী। হাফ থেকে ফুল হওয়ার পথে গাড়ি চলছে এই আরকি।’

মুগ্ধ সশব্দে হাসলো। সে নিজের কথাতেই যেন বেশ মজা পেল। সে হাসছে কিন্তু জিসান আর মৃন্ময়ী কারও মুখেই হাসি নেই। এতে যেন মুগ্ধ আরও বেশি মজা পাচ্ছে। সে শুধু মৃন্ময়ীকে চমকাতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন দু দুজন মানুষকে একসঙ্গেই বিভ্রান্ত করতে পেরেছে। জিসান ভীষণ কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে-

‘ভাবির নাম মৃন্ময়ী? মানে সত্যিই মৃন্ময়ী?’

মুগ্ধ বরাবরের মতোই হাসলো। তার চরিত্রের স্বভাবজাত হাসি। আর মৃন্ময়ী! সে তো আগের মতোই হতচকিত। কেউ একজন তার নাম শুনে হতভম্ব আর সে হতভম্ব আরেকজনের নাম শুনে। তবে কি মুগ্ধ এই যুগলবন্দী হওয়ার কথাই বলেছে?? মুগ্ধ লুকিয়ে রেখেছিস তার নাম!

‘হ্যাঁ তোর ভাবির নাম আসলেই মৃন্ময়ী।’

জিসান তার কৌতুহল ভাব মুহুর্তেই একরাশ ভালো লাগায় রূপান্তর করলো। চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল করে উল্লাসিত গলায় বলল-

‘বাহ তোদের জুড়ি দেখছি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে। মৃন্ময়ের বউ মৃন্ময়ী৷ ব্যাপারটা খুব বেশিই ইন্টারেস্টিং। সবাই তোদের দু’জনের নাম শুনেই চমকে যাবে। আর তোর তো স্বভাবই মানুষকে চমকানো।’

মুগ্ধ আর জিসান নানানরকম কথা বলে হাসাহাসি করছে। জিসানকে কেউ একজন ডাক দিতেই সে হড়বড়িয়ে বলল-

‘দোস্ত যাই রে আমার কলিগ দাঁড়িয়ে আছে। ভাবি যাই ভালো থাকবেন। আপনার সাথে তো কথাই হলো না ঠিক মতো। যাইহোক বিয়েতে দাওয়াত দিতে ভুলবেন না কিন্তু।’

মৃন্ময়ী অপ্রস্তুত হয়ে বলল-

‘জ্বি জ্বি অবশ্যই। ভালো থাকবেন।’

জিসান চলে গেল। আবারও সামনা-সামনি মুখোমুখি হয়ে বসে আছে তারা দু’জন। আবারও যেন নিস্তব্ধতা মুড়িয়ে নিয়েছে নিজেদেরকে। মৃন্ময়ীর মুখ গম্ভীর গম্ভীর ভাব৷ আর মুগ্ধ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চাপা হাসি হঠাৎই বিস্ফোরিত হলো। উচ্চস্বরে হু হা করে হেসে উঠলো মুগ্ধ। আশেপাশের মানুষ মুগ্ধর হাসির শব্দে এক নজর তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় নিজেদের মতো। বাকি রইলো একজোড়া বিরক্তি মাখানো ডাগর ডাগর চোখ। মুগ্ধর আচরণে সে ভীষণ বিরক্ত। একটা মানুষ এতটা উদ্ভট প্রকৃতির কি করে হয়! এই ছোট একটা প্রশ্নেই বার বার মনে মনে আওড়াচ্ছে মৃন্ময়ী।

‘আপনি থামবেন নাকি আমি চলে যাবো!’

‘এই না না চলে যেতে হবে না। এই তো আমি থেমে গেছি।’

মুগ্ধ হাসি থামিয়ে বুক টান টান করে বসলো। মুখে গম্ভীরতা আনার চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো মতেই পারছে না। মুগ্ধর এমন আচরণে মৃন্ময়ী মনে মনে হাসলো। অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল-

‘আপনার নাম মৃন্ময় এটা প্রথমদিন বলেননি কেন?’

মুগ্ধ টেবিলের উপর দু হাত তুলে খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল-

‘তখন বললে হয়তো তুমি বিশ্বাস করতে চাইতে না। ভাবতে আমি ফ্লার্টিং করার চেষ্টা করছি। আর তার চেয়েও বড় কথা হলো আমি তোমাকে চমকাতে চেয়েছিলাম।’

মৃন্ময়ী চুপ করে রইলো। কিছুটা সময় পর মুগ্ধ শান্ত গলায় বলল-

‘জানো তো! মৃন্ময়ী যুগলবন্দী হবে শুধু মাত্র মৃন্ময়ের সঙ্গে। এটাই নিয়তি। আমাদের যুগলপ্রেমের যুগলবন্দী হওয়ার নিয়তি।’

‘তা না হয় পরেই দেখা যাবে। এখন আমি উঠছি। রাত হয়ে যাচ্ছে।’

মৃন্ময়ী ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই মুগ্ধ বলল-

‘আমি বাসায় পৌঁছে দেই তোমাকে!!’

‘নাহ দরকার নেই। রঞ্জন হয়তো বাহিরেই আছে। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।’

‘আচ্ছা তা না হয় মানলাম কিন্তু অন্য কিছু তো বলে যাও।’

মৃন্ময়ী ভ্রু কুচকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-

‘অন্য কিছু মানে! কি বলে যাবো?’

মুগ্ধ উদাসীন গলায় বলল-

‘দেখা দেখি কোন পর্যায়ে গেল! পজিটিভ নাকি নেগেটিভ! পাত্র দেখতে আসলে অথচ পাত্র পছন্দ হয়েছে কি-না তা তো বললে না!!’

‘আপাতত কিছু বলতে পারছি না। পাত্র তাড়ছিড়া টাইপের তাই আমাকে ভাবতে হবে। ভীষণ ভাবতে হবে।’

মৃন্ময়ী চলে গেল। মুগ্ধ হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। বিষন্ন চোখে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়ীর যাওয়ার পথে।
মৃন্ময়ী বাসায় এসে মুগ্ধর প্রসঙ্গে কোনো কথাই বলেনি। ধ্রুবকে এসব নিয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। আর ধ্রুবও তার কাছে কিছু জানতে চায়নি। সব কিছুই চলছিল স্বাভাবিক ভাবে প্রতিদিনের মতো।

‘হ্যালো দোস্ত!’

‘ হুম বল। এত রাতে কল করেছিস কি মনে করে?’

মৃন্ময়ীর বিরক্তিমাখা কন্ঠ অর্পির গাঁয়ে লাগলো না। সে স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো-

‘এগারোটা বাজেই ঘুমিয়ে পরলি না-কি!!’

‘আমি তোর মতো রাত জেগে চ্যাট করি না যে এখনো চোখ মেলে তাকিয়ে থাকবো। আর বাসায় তো একটা ডাক্তার সাহেব আছেই অনিয়মের প্রশ্নই ওঠে না। যাইহোক এখন কথা না বাড়িয়ে বল ফোন করেছিস কি জন্য?’

মৃন্ময়ী তিক্ত গলায় কথা গুলো বলে। অর্পির প্রতিত্তোরের অপেক্ষা করছে সে। কিন্তু ফোনের ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। অর্পি হয়তো কিছু একটা নিয়ে ইতস্ততবোধ করছে। মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শোয়া থেকে উঠে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে নরম গলায় বলল-

‘কি হলো কথা বলছিস না কেন? কিছু কি হয়েছে!’

অর্পি নিচু গলায় থেমে থেমে বলল-

‘আফনান ভাই আমাকে কল দিয়েছিলেন। তোর কথা জানতে চেয়েছে। তোর নতুন নাম্বারও অনেক বার চেয়েছে।’

মৃন্ময়ী অতি ঠান্ডা গলায় বলল-

‘তা তুই কি করলি?’

‘আমি কিছু বলিনি। তোর নাম্বারও দেইনি।’

মৃন্ময়ী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নরম সুরে বলল-

‘এই প্রথম একটা ভালো কাজ করলি। প্রসংশা করার মতো কাজ করেছিস। তবে এই ভালো কাজটা সব সময় টিকিয়ে রাখিস। পথ হারা হয়ে যাস না। এখন রাখছি আমার ঘুম পাচ্ছে।’

অর্পির কোনো কথার অপেক্ষা না করেই মৃন্ময়ী ফোন কেটে দিল। চোখ বন্ধ করে বুক ভরে একটা শ্বাস নিয়ে আবারও শুয়ে পরলো। এসব নিয়ে ভাবার ইচ্ছে করছে না মোটেও না। যে চলে গেছে তাকে নিয়ে ভেবে কান্নাকাটি করে বুক ভাসালে কি হবে! মানুষটা ফিরে আসবে!! নাহ আসবে না। সে তার নতুন বউ নিয়ে হয়তো ভালোই আছে। আর এখন ভালো না থাকলেও কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো ভালো থাকা শুরু করবে। তাহলে কেন আবারও যোগাযোগ করতে চাইছে!! বিয়ের খবর দিতে না-কি পরকীয়া করতে??

————————

নির্জন পথ ধরে হাঁটছে মুগ্ধ আর মৃন্ময়ী। মুগ্ধর নানানরকমের কথাবার্তায় মৃন্ময়ী নিজেকে কিছুতেই গম্ভীর করে রাখতে পারছে না। মুগ্ধ কথা বলছে আর সে হাসছে। কখনো মুচকি হাসি কখনো বা প্রাণখোলা হাসি। এই হাসিতে নেই কোনো বিষাদ। আর না আছে কোনো মন খারাপের কারণ। ধ্রুবর পর এই একটা মানুষের সামনে সে নিজেকে ভীষণ খুশি মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করে। এই দুটো মানুষের সামনে আসলে যেন নিজের সকল দুঃখ কষ্টের কথা নিমিষেই ভুলে যায়। দুনিয়ায় সকল কিছুই তখন রূপান্তরিত হয় আনন্দে। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতম কারণেও তখন আনন্দিত হয়ে ওঠে তার৷ মন। মুগ্ধকে সে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। একটা মানুষ এতটা প্রাণবন্ত কিভাবে হয়!! সব সময় এত হাসিখুশি কিভাবে থাকতে পারে!!

‘মৃন্ময়ী!’

মুগ্ধর গম্ভীর ডাকে মৃন্ময়ী ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। হঠাৎ করেই এমন গম্ভীর ডাক হজম করতে কিছুটা সময় নিচ্ছে। মুগ্ধ সামনের সরু পথের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দারুণ গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল-

‘অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি। সব শেষে মস্তিষ্ক একটা কথাই বলল তোমাকে ইমপ্রেস করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই হার মেনে নেওয়াটা-ই আমার জন্য সুখকর। আর তার চেয়েও বড় কথা এসব প্রেম ট্রেম আমাকে দিয়ে হবে না। শুধু শুধু সময় নষ্ট।’

মৃন্ময়ী হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো। মুগ্ধ হাঁটছে। কিছুটা সামনে এগিয়ে গেছে। কিন্তু মৃন্ময়ী একজায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। মুগ্ধর কথাগুলো ঠিক মানতে পারছে না। হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে যাওয়া আর এমন নিষ্ঠুর কথাবার্তা বলা এসব কোনোটাই মুগ্ধর চরিত্রের সাথে যায় না। এ নিয়ে মুগ্ধর সাথে দেখা হয়েছে আট বার। লাস্ট পনেরো দিনেই দেখে হয়েছে পাঁচদিন। প্রতিবারই দেখা হয়েছে হুটহাট করে। এই লোকটা কখনই বলেকয়ে আসে না। হঠাৎ করেই তাকে চমকে দেয়। তাকে চমকে দেওয়া যেন মুগ্ধর স্বভাবগত অভ্যাস হয়ে গেছে। মুগ্ধর এসব অদ্ভুত অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের কারনেই মৃন্ময়ী আনন্দ পায়। তবে তা প্রকাশ্যে নয়। আনন্দটা সে লুকিয়ে রাখে তার মনের ভেতরেই। একদম গহীন কোণে। কিন্তু আজ মুগ্ধর মুখে এসব কথা শুনে তার আনন্দ মুহুতেই কালো মেঘে ঢেকে গেল। মুখ হয়ে গেল আমাবস্যার চাঁদের মতো অন্ধকার।

‘ভাবছি এবার বিয়েটা করেই ফেলবো। অনেক তো সময় নষ্ট করলাম। বাকি প্রেম না হয় বিয়ের পরেই করবো। তুমি কি বলো বউ!’

মৃন্ময়ীর চোখদুটো বড় বড় হলো। মনে হচ্ছে এখনই অক্ষিকোটর থেকে চোখ দুটো বেরিয়ে আসবে। হঠাৎ করে যেন সে প্রান ফিরে পেল। বউ ডাক শুনে লজ্জাও পেল কিন্তু সেটাও অপ্রকাশ্যই রয়ে গেল। মুখে রাগী রাগী ভাব এনে বলল-

‘আপনি এমন উদ্ভট আচরণ করেন কেন? আপনি আদৌও স্বাভাবিক একজন মানুষ নাকি পাগল আমি বুঝতে পারছি না।’

মুগ্ধ পেছন ঘুরে ধীর পায়ে মৃন্ময়ীর কাছে এসে দাঁড়ালো। মৃন্ময়ীকে অবাক করে দিয়ে খানিকটা ঝুঁকে এসে মুখোমুখি হলো। দুজনের চোখাচোখি হলো। শীতল হাওয়া বয়ে গেল মুগ্ধর হৃদয়ে৷ তপ্ত নিঃশ্বাস গিয়ে আছড়ে পরলো মৃন্ময়ীর মুখে। তীব্র থেকে তীব্রতর হলো মৃন্ময়ীর হৃদ স্পন্দন। তপ্ত নিঃশ্বাসের স্পর্শে পুরো শরীরে শিহরিত হলো লজ্জার উষ্ণ অনুভূতি। ভারী হয়ে এলো তার নিঃশ্বাস। চোখ জোড়া বিষ্ময়ে বড় হলো। গলার কাছেই সকল কথা দলাপাকিয়ে রইলো। মুগ্ধ এক দৃষ্টিতে মৃন্ময়ীর চোখের দিকে চেয়ে সহজ গলায় বলল-

‘এই যে, তোমার এই চোখদুটো আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী। তোমার চোখ দুটো হয়তো আমাকে খুব কঠিন এবং খারাপ ভাবেই বশ করে ফেলেছে। তা না হলে একজন লোয়ার তোমার সামনে আসলেই কেন এলোমেলো হয়ে যাবে৷ একজন প্রফেশনাল যুক্তিবাদী লোয়ার তোমার সামনে আসলেই কেন আবেগী, সাহিত্যিক কথাবার্তা বলবে? এটা কি তোমার স্নিগ্ধ চাহনির বশীকরণের জন্য না!! আমার কি উচিত না তোমার চোখদুটোর নামে মামলা করা! আমাকে দেওলিয়া করার দায়ে তোমাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া?? তোমার কি উচিত না নিজের ভুক স্বীকার করে মৃন্ময়ের সাথে নিজেকে যুগলবন্দী করে ফেলা?’

মৃন্ময়ীর হতভম্ব মস্তিষ্কে মুগ্ধর কথা গুলো এলোমেলোভাবে এদিক ওদিক ছুটে চলল। বিস্ময়ে বড় হয়ে আসা চোখ দুটো ঘন ঘন পলক ফেলছে। কিছুটা সময় কেটে গেল এভাবেই। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে সচল হলো মৃন্ময়ীর হতভম্ব মস্তিষ্ক। মুগ্ধকে সরিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ করতে চাইলো। কাঁপা কাঁপা হাতে ধাক্কা দিল মুগ্ধর বলিষ্ঠ বুকে। মৃন্ময়ীর প্রতিবাদে তেমন কোনো কাজ হলো না। পুরুষালি দেহের কাছে তার শক্তিকে তুচ্ছ করে দিয়ে আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলো মুগ্ধ। আচমকাই সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ভুবন ভুলানো হাসিতে ফেটে পরলো সে। মৃন্ময়ীর স্পর্শ পাওয়া বুকের ঠিক সেই স্থানে হাত রেখে মুগ্ধ গলায় বলল-

‘অবশেষে তুমি আমাকে ছুঁয়েই দিলে। অবশেষে আমাদের প্রেম হয়েই গেল। যাক প্রেম প্রেম খেলা তাহলে পূরণ হলো। এবার শুধু বিয়েটা-ই বাকি।’

মুগ্ধ হাসছে। মৃন্ময়ী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তার এখন রাগ করা উচিত না-কি চুপ থাকা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। মুগ্ধর অদ্ভুত আচরণে তালগোল পাকিয়ে গেল তার মস্তিষ্ক। এলোমেলো অনুভূতিতে ক্লান্ত হয়ে গেল তার মন। হতাশ হলো সে। উদাসীন হলো তার চাহনি।
মৃন্ময়ীর ফোনের রিংটোনের শব্দ আকর্ষিত হলো দুজনের ধ্যান। অস্থিরতার সাথে ব্যাগ হাতড়িয়ে ফোন বের করলো মৃন্ময়ী। তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করে কানের কাছে ধরলো। ক্লান্ত গলায় বলল-

‘হ্যালো!’

‘কেমন আছো মৃনু? আমি আফনান।’

চলবে…

স্নিগ্ধ চাহনি পর্ব-০৫

0

#স্নিগ্ধ চাহনি
#পর্বঃ৫
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

ধ্রুব বেশ ইতস্তত করে বলল-

‘আমি তোর জন্য একটা ছেলে দেখেছি তরূ। তুই আবার ভাবিস না আমি তোকে না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি। আমি চাই ছেলেটার সাথে তোর আলাদা ভাবে দেখা-সাক্ষাৎ হোক। তারপর তুই হ্যাঁ বললে হ্যাঁ আর না বললে না ব্যাস এইটুকুই। আমি কোনো প্রকার জোর খাটাচ্ছি না তোর উপর।’

মৃন্ময়ী অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো তার ভাইয়ের থমথমে চেহারার দিকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই বিষয় নিয়ে কথা বলায় ধ্রুবর মাঝে আতংকিত একটা ভাব এসে পরেছে। তার কি উচিত হবে এখন কিছু কঠিন কথা বলে তার ভাইকে ভয় দেখানো! হয়তো তার কঠিন কথা শুনে ধ্রুব ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পরবে। তাকে নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার মানুষ নেই বললেই চলে। তাই ধ্রুবকে উত্তেজিত হতে দেখলে তার বেশ ভালো লাগে। মৃন্ময়ী সেরকম কিছুই করল না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল-

‘এই সামান্য একটা কথা বলতেই তোমার মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল!!’

ধ্রুব অবাক চোখে তাকা। মৃন্ময়ী কথাটা বলেই খিলখিল করে হেসে ওঠে। মনে হচ্ছে তার এমন বিধস্ত অবস্থা দেখে বেশ মজা পেয়েছে মেয়েটা। মাঝে মাঝে মৃন্ময়ীর এমন বাচ্চামো দেখতে খুব ভালো লাগে তার। অল্পতেই প্রান খোলা হাসি ক’জনেই বা হাসতে পারে?

‘আচ্ছা এখন যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। ভেজা জামাকাপড় পরে এখানে বসে থাকতে হবে না। তারপর দেখা যাবে দুজনেই জ্বরে কাঁত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছি।’

মৃন্ময়ী শাসনের গলায় কথা গুলো বলল। ধ্রুব নির্মল হেসে মৃন্ময়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মৃন্ময়ী সেদিকে চেয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে।

রাত তখন ন’টা। ধ্রুব খাবার রেডি করে এসে দেখলো মৃন্ময়ী তার রুমে নেই। বারান্দায় কিংবা ওয়াশরুমে খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল। ধ্রুব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এল মৃন্ময়ীর উদ্দেশ্যে। সে জানে মৃন্ময়ী এখন কোথায় থাকতে পারে।
দুঃখবিলাসী বাগানের দোলনায় পা তুলে উদাসীন ভঙ্গিতে বসে আছে মৃন্ময়ী। ধ্রুব নিঃশব্দে মৃন্ময়ীর পাশে এসে দাঁড়ায়। মৃন্ময়ীর দৃষ্টি আকর্ষণে মিহি কন্ঠে ডাকল-

‘তরূ!’

মৃন্ময়ী ধ্রুব দিকে তাকালো না। আগের ভঙ্গিতেই বসে থেকে বলল-

‘আমার পাশে বসো ভাইয়া।’

ধ্রুব চুপচাপ মৃন্ময়ীর কথা অনুযায়ী বসে পরলো। তবে কেউ কোনো কথা বলছে না। দু’জনের মনেই চলছে নানাবিধ চিন্তা ভাবনা। আর কিছু পুরনো স্মৃতির খেলা। বাবা মারা যাওয়ার প্রায় পনেরো দিন পর মৃন্ময়ী মুখ ফুটে কথা বলেছিল। বিষন্ন গলায় আবদার করেছিল ধ্রুব ভাইয়ের কাছে,

‘বাবা আমাকে জন্মদিনের গিফট দেয়নি। তুমি কি বাবার পক্ষ থেকে আমাকে এমন একটা গিফট দিবে যা সব সময় আমার পাশে থাকবে!’

ধ্রুব তখন কোনো কিছু বলতে পারেনি। তবে তার ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যেই এই বাগানটা সুন্দর করে সাজিয়ে উপহার দিয়েছিল। নাম রেখেছিল দুঃখবিলাসী। আর বাড়ির বাহিরে খুব সুন্দর করে নেইম-প্লেট লাগিয়ে দিয়েছিল ‘মৃন্ময়ীর ইচ্ছে তরূ’। মৃন্ময়ী এসব দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল-

‘এসব কেন ভাইয়া?’

‘দুঃখবিলাসীতে তুই তোর সব দুঃখ-কষ্ট এই গাছগুলোর সাথে ভাগাভাগি করে নিবি। দেখবি তোর মন খুব হাল্কা লাগবে। আর এই যে বাড়িটা! এটাও সব সময়ই তোর পাশে থাকবে। আর সেই সাথে আমি তো সব সময়ই আছি তোর সঙ্গে আর কি লাগবে!’

সেদিন ছোট্ট মৃন্ময়ী খুশি মনেই ধ্রুবর কথা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তার ভাই ঠিক বলেনি। মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল তাকে।

‘তুমি মিথ্যা কথা বলেছিলে যে তুমি সব সময় আমার পাশে থাকবে তাই না ভাইয়া! আমার বিয়ে হয়ে গেলেই আমাকে আলাদা হয়ে যেতে। এই বাড়ি, এই বাগান আর তুমি। সব কিছু থেকেই দূরে চলে যেতে হবে আমাকে।’

ধ্রুব হাসার চেষ্টা করে বলল-

‘বিয়ে তো সবারই হয়। আর আমি তো তোকে বনবাসী করে দিচ্ছি না যে এখানে আসতে পারবি না, আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবি না। আমি সব সময়ই তোর পাশে থাকবো। তাই এসব উল্টাপাল্টা কথা ভেবে শুধু শুধু মন খারাপ করিস না তো তরূ।’

ধ্রুবর কথায় মৃন্ময়ীর ভাবভঙ্গিতে কোনো প্রকার পরিবর্তন হলো না। ঘাড় নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো ধ্রুবর দিকে। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো-

‘আমি না থাকলে তো তুমি একা হয়ে যাবে। তোমার অনেক কষ্ট হবে তাই না?’

ধ্রুব রসিকতা করে বলল-

‘হুহ্ একদমই কষ্ট হবে না। আমি তো বিয়ে করে বউ বাচ্চা নিয়ে বিন্দাস আনন্দ থাকবো।’

ধ্রুব হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়ীর নির্লিপ্ত দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। কনুই দিয়ে ধ্রুবর পেটে গুতা মে’রে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-

‘দেখে নিবো আমাকে ছাড়া কেমন আনন্দে থাকো।’

ধ্রুব উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। বেশ কিছুক্ষন পর হাসি থামিয়ে বলল-

‘এখন চল ডিনার করবি। আর আমি কাল তোকে রেস্টুরেন্টের ঠিকানা আর সময় বলে দিবো তোর ইচ্ছে হলে যাবি আর নাহলে না।’

মৃন্ময়ী কিছু বলল না। চুপচাপ উঠে তার ভাইয়ের সাথে ভেতরে চলে যায়।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। সূর্যের হলদেটে আভা ছড়িয়ে পরেছে বাহিরের পিচঢালা রাস্তায়। রেস্টুরেন্টের জানালার পাশের টেবিলটা দখল করে বসে একজোড়া নিশ্চুপ মানব-মানবী। নিস্তব্ধতায় যেন মুড়িয়ে রেখেছে দু’জনকে। মৃন্ময়ী অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে। কফির মগে চুমুক দিয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায় তার ঠিক সামনের মানুষটার দিকে। এখানে এসে মুগ্ধকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিল সে। তবে বিস্ময়ভাবটা প্রকাশ করেনি। লোকটাকে আগে থেকেই পাগলাটে টাইপের মনে হয়েছে তার কাছে।
মুগ্ধ তার চোখ দুটো ছোট ছোট করে মৃন্ময়ীকে দেখছে। খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করছে মৃন্ময়ীকে। বোঝার চেষ্টা করছে মৃন্ময়ীর হাবভাব। এই মুহূর্তে মৃন্ময়ীর চোখে ভয়াবহ বিস্ময় থাকার কথা ছিল। কিন্তু সে এতক্ষন ধরে মৃন্ময়ীর মাঝে একটুও বিস্ময় ভাব দেখতে পেল না। চরম হতাশায় মুখটা মলিন হয়ে গেল তার। মৃন্ময়ীকে চমকাতে চেয়েছিল সে তবে তা আর হলো না। মেয়েটা চমকে উঠবে তো দূরের থাক বিস্ময়ে নিয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞাসাও করলো না এখন পর্যন্ত।

‘এবার বলুন আসল কাহিনী কি! ভাইয়ার সাথে আপনার পরিচয় কি করে হলো?’

মৃন্ময়ী নম্রতা সহকারে প্রশ্ন করল মুগ্ধকে। মুগ্ধ তার উদাসীনতা লুকিয়ে সহজ গলায় বলল-

‘সেদিন রাতে আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পর রঞ্জনের সাথে দেখা হয়। আপনাকে ওই লোকের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ জানায়। আর তখনই রঞ্জনের ফোনে আপনার ভাইয়ের সাথে কথা প্লাস পরিচয়। আমরা একই বয়সী তাই খুব ভালো বন্ধুত্বও হয়ে গেছে।’

‘সামান্য পরিচয় বিয়ের কথাবার্তা আর দেখাদেখি পর্যন্ত আসলো কি করে?’

মৃন্ময়ীর প্রশ্নে মুগ্ধ অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলো। নরম গলায় বলল-

‘বলেছিলাম তো আমি প্রেমে নয় বিয়েতে বিশ্বাসী। ভালোবাসলে তাকে ডিরেক্ট বিয়ে করে ফেলব।’

‘আমাকে ভালোবাসেন? আমার সম্পর্কে কতটুকু জানেন যে হুট করেই বিয়ে করতে চাচ্ছেন।’

‘তোমার সম্পর্কে ধ্রুব আমাকে সব কিছুই বলেছে। বাকি টুকু না-হয় বিয়ের পর জেনে নিবো। আর বাকি রইলো ভালোবাসা? সেটা আমি নিজেও জানি না। তবে তোমার স্নিগ্ধ চাহনি আমাকে খুব করে টানে। প্রথম তোমাকে রিকশায় বসে কান্না করতে দেখেছি। তোমার এই সিক্ত চোখ দুটো দেখেই গাড়ি থেকে নেমে তোমার পিছু নিয়েছিলাম। কিন্তু কেন নিয়েছি তা আমি নিজেও জানি না।’

মৃন্ময়ী চুপ করে রইলো। মুগ্ধ তার সাথে বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলা শুরু করেছে। খুব সহজেই আপনি থেকে তুমি সম্মোধনে চলে এসেছে। মৃন্ময়ী ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুঞ্চিত করে গম্ভীরমুখে বলল-

‘আপনার কি মনে হচ্ছে না আপনি অল্প বয়সী ছেলেদের মতো ভীষণ আবেগি কথাবার্তা বলছেন! এসব আবেগ দিয়ে জীবন চলবে না মিস্টার মুগ্ধ।’

মুগ্ধ মৃদু হেসে খানিকটা ঝুঁকে আসে। শীতল কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল-

‘তুমি পাশে থাকা অবস্থায় জীবন এক জায়গায় থমকে গেলেও আমি ভীষণ খুশি।’

মৃন্ময়ী রেগে গেলে। ক্ষিপ্ত হয়ে বলল-

‘আপনি কি পাগল?’

‘হুম তবে সব সময় না। তুমি সামনে আসলে তোমার চাহনিতেই নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়। খুবই চিন্তার বিষয় তাই না!!’

মৃন্ময়ী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে। এই লোকের সাথে সে কিছুতেই পেরে উঠেবে না। নাছোড়বান্দা টাইপ মানুষ। না না নাছোড়বান্দা থেকেও চরম পর্যায়ের মানুষ উনি। মৃন্ময়ী চুপচাপ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে রইল। মুগ্ধ আনন্দিত মুখে তার দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। এক সেকেন্ডের জন্যেও তার দৃষ্টি সরাচ্ছে না। মুগ্ধর এভাবে তাকিয়ে থাকায় মৃন্ময়ীর বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। নিজেকে যথাসাধ্য গম্ভীর করে বলল-

‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’

‘আমার চোখ তো শুধু তাকেই দেখতে চায়,, যাকে দেখলে মনে প্রশান্তির শীতল হাওয়া বয়ে যায়।’

মৃন্ময়ীর রাগ তরতর করে মাথায় চড়ে বসলো। চোখেমুখে কাঠিন্যতা এনে শক্ত গলায় বলল-

‘থামবেন আপনি? কি শুরু করেছেন এসব? এত কাব্যিক কথা বলছেন কেন? বাস্তবে ফিরে আসুন। বাস্তবতা আপনার কথার মতো এত মধুর নয়। বাস্তবতা খুবই নিষ্ঠুর।’

মুগ্ধ বরাবরের মতোই হাসলো। অত্যন্ত নরম সুরে বলল-

‘এই নিষ্ঠুর বাস্তবতাই তো তোমাকে আর আমাকে যুগলবন্দী করেছে।’

মৃন্ময়ী বিস্ময় নিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল-

‘মানে! কিসের যুগলবন্দী?’

মুগ্ধর কাছ থেকে কোনো উত্তর পাওয়ার আগেই একজন ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে মুগ্ধ’র সামনে এসে দাঁড়ায়। মুগ্ধ হাসি মুখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই লোকটা তাকে জড়িয়ে ধরে। জড়িয়ে ধরার পর যা বলে তা শুনেই কৌতুহলে মৃন্ময়ীর চোখ দুটো আপনাআপনি বড় হয়ে যায়।

চলবে…

স্নিগ্ধ চাহনি পর্ব-০৪

0

#স্নিগ্ধ চাহনি
#পর্বঃ৪
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘আফনান ভাইকে খালা বিয়ে দিয়ে দিয়েছে দোস্ত। কানাডিয়ান এক মেয়ের সাথে। ভাবতে পারছিস কেমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে খালা!’

অর্পির কথা শুনে মৃন্ময়ী মৃদু হাসলো। বিশদিন যেতে না যেতেই বিয়ের খবর! বাহ বেশ ভালোই তো। মৃন্ময়ী শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে সহজ গলায় বলে-

‘কানাডিয়ান মেয়েরা কেমন হয় রে অর্পি! নিশ্চয়ই খুব ভালো তাই না!’

‘আমি তোকে আফনান ভাইয়ের বিয়ের খবর দিলাম আর তুই আমার কাছে কানাডিয়ান মেয়েদের সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিস! তুই কি কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছিস?’

মৃন্ময়ী আবারও হাসলো। ভীষণ মিষ্টি হাসি। অর্পি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়ীর দিকে। মেয়েটার চোখেমুখে কোনো প্রকার খারাপ লাগার রেশ দেখা যাচ্ছে না। এই হাসিটা তার ভালো লাগলেও এই মুহুর্তে মৃন্ময়ীর মিষ্টি হাসি বড্ড অদ্ভুত লাগছে। প্রেমিকের বিয়ের খবর শুনে প্রেমিকার স্বাভাবিক ব্যবহার করা, মুচকি হাসা এসব নিশ্চয়ই খুব বেমানান।

‘বিয়ে করেছে এটাতো খুব ভালো খবর। খুশির সংবাদ। বিয়ে মানেই তো আনন্দ আনন্দ ভাব তা-ই না!’

‘তুই হাসছিস কেন! তোর হাসি দেখে আমার ভয় করছে। গাঁ শিউরে উঠছে আমার। প্লিজ মৃন্ময়ী বোন আমার, একটু স্বাভাবিক আচরণ কর।’

অর্পি বেশ অস্বস্তি নিয়ে কথা গুলো বলে। মৃন্ময়ী ভ্রু বাঁকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-

‘স্বাভাবিক আচরণ বলতে কেমন?’

‘আফনান ভাইকে খালা বিয়ে করিয়ে দিয়েছে এটা শুনে তোর মন খারাপ করা উচিত। রাগে শরীর জ্বলে যাওয়ার করার কথা। খালা আর ভাইকে ইচ্ছেমতো বকা দিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করার পর আবারও কান্না করা, এসব হচ্ছে স্বাভাবিক। কিন্তু তা না করে তুই হাসছিস।’

মৃন্ময়ী বেশ মনোযোগ দিয়ে অর্পির কথা শুনল। অর্পি তার মুখের নানানরকম ভঙ্গিমা করে কথা বলছে। দেখতে ভালোই লাগছে। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে তার খালার প্রতি ভীষণ ক্ষেপে আছে। মৃন্ময়ী সরল হাসি দিয়ে অতি শান্ত গলায় বলল-

‘আফনানকে বিয়ে দেয়নি সে নিজে বিয়ে করেছে। আফনান কোনো ছোট বাচ্চা না যে তাকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে যা ইচ্ছে তা করিয়ে নিবে। যে কিনা ভালোবাসি বলেও ভালোবাসার জন্য লড়াই করতে জানে না, তার জন্য কেঁদেকেটে বুক ভাসানো নেহাতই বোকামি ছাড়া অন্যকিছু নয়।’

মৃন্ময়ীর শান্ত গলায় বলা এই কথা গুলোর মধ্যে হয়তো কিছু একটা ছিল যার কারণে অর্পি আর কোনো কথা বাড়াতে পারেনি। অর্পি আহত দৃষ্টিতে মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটার সাথেই কেন নিয়তি এমন নিষ্ঠুর খেলা খেলে! সব সময় এই মেয়েটাই কেন আঘাত পায়! মৃন্ময়ী তো ঠিকই বলেছে আফনান ভাই নিজেই বিয়ে করেছে। উনি চাইলেই তো পারতেন খালাকে বোঝাতে। আজ না হয় কাল খালা হয়তো মেনেই নিতেন। আর না মেনে নিলেও এত সহজে হার কেন মেনে নিলেন! ভালোবাসা কি এতটাই তুচ্ছ! হয়তো না। ভালোবাসা তুচ্ছ না তবে ভালোবাসা আগলিয়ে রাখার ক্ষমতাটা সবার থাকে না। হয়তো আফনান ভাইয়েরও সেই ক্ষমতা নেই। ভালোবাসার মানুষটাই সঠিক না।

‘কিরে তুই আবার কোথায় হারিয়ে গেলি?’

মৃন্ময়ীর হাল্কা ধাক্কায় অর্পির হুশ ফিরে। অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল-

‘হারিয়ে যাইনি এখানেই আছি।’

মৃন্ময়ী কপাল কুচকে কিছুক্ষন অর্পির দিকে তাকিয়ে রইলো। ধ্রুবর পর যদি কেউ তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে থাকে তাহলে সে হলো এই অর্পি। বন্ধুর সকল পরিস্থিতিতে কীভাবে পাশে থাকা যায় তা শুধুমাত্র এই মেয়েকে দেখেই বোঝা যায়।
অর্পি মৃন্ময়ীর হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে ভার্সিটির অন্যদিকে। ২৬শে মার্চ। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভার্সিটিতে বিশাল আয়োজন। স্টেজ থেকে দেশাত্মবোধক গানের সুর ভেসে আসছে। সেই গানেই এক দল মেয়ে লাল সবুজ শাড়ি পরে নাচ পরিবেশন করছে। চারপাশ ছেলেমেয়েদের হৈচৈয়ে গরম একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ছেলেরা গায়ে রংবেরঙের পাঞ্জাবি জড়িয়ে হৈ-হুল্লোড় করছে। আর মেয়েরা লাল, সবুজ আর সাদা আরও বিভিন্ন রঙের শাড়ি পরে এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থেকে আড্ড দিচ্ছে বন্ধুদের সাথে। কেউ বা আবার সেলফি তুলছে। কিছু কিছু মেয়ে অস্বস্তি নিয়ে এক পা দু পা করে হাঁটছে আর শাড়ির কুচি ধরে বার বার নিচে তাকাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শাড়ি পরার অভ্যাস তাদের নেই। মৃন্ময়ী নিখুঁত চোখে সব কিছু এক পলকেই দেখে নেয়। মাঠের এ-ই দিকটায় অনেক ভিড়। ভিড়ের মধ্যে অর্পির হাত ধরে তাল মিলিয়ে হাঁটা খুবই অস্বস্তির। তবুও তারা একে অপরের হাত ছাড়ছে না। হাত ধরেই ভিড়ের মাঝে হেঁটে যাচ্ছে। কিছু কিছু জিনিস অস্বস্তির হলেও তা ভরসার হয়। ভালো লাগার কারণ কারণ হয়।

দুপুরের শেষ। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে। মেঘের আড়ালেই লুকিয়ে গেছে শান্তশীতল সূর্য। চারপাশে আধার নেমে এসেছে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ একটু পর পর গম্ভীরভাবে গর্জন করে উঠছে। গাছপালাকে এলোমেলো করে দিয়ে দমকা হাওয়া বইছে। খুব সম্ভবত বছরের প্রথম বৃষ্টি শুরু হবে কিছুক্ষনের মধ্যেই। মৃন্ময়ী ফুটপাত ধরে হাঁটছে। আচমকাই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোটা পরতে লাগল। মৃন্ময়ী আকাশের দিকে তাকালো। তারপর আবার ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে দৃষ্টি দেয়। মানুষ ছুটোছুটি করে আশ্রয় খুঁজছে। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পরেছে প্রতিটি মানুষ। শুধু সে নিজেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদমই ব্যস্ত হচ্ছে না। ভালো লাগছে বছরের প্রথম বৃষ্টির ফোটায় নিজেকে বিলীন করতে। মৃন্ময়ী এক হাতে শাড়ির কুচি ধরে হাঁটা শুরু করল। কিছুটা পথ যেতেই কেউ একজন তার পাশাপাশি তাল মিলিয়ে হাঁটা শুরু করেছে। মৃন্ময়ী অবাক চোখে তাকায় পাশের মানুষটার দিকে। মৃন্ময়ীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেই মানুষটা মুচকি হেসে থেমে থেমে বলল-

‘কেমন আছেন মিস মৃ-ন্ম-য়ী??’

মৃন্ময়ীর চাহনি তীক্ষ্ণ হলো। সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করছে মানুষটাকে। কিছুটা চেনা চেনা লাগছে। বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে আসা সাদা রঙের শার্ট গায়ে লেপ্টে যাচ্ছে। মুখের উপর বিন্দু বিন্দু পানির কণা জমে আছে। ডান গালের একদম সাইডের বড় কালো তিলটা আরও গাঢ়তর হল। খুব সম্ভবত এটা জন্মচিহ্ন। বিদ্যুৎ ঝলকের মতই মানুষটার সাথে দেখা হওয়া প্রথম রাতের কথা মনে পরল। এই জন্মচিহ্নটা মৃন্ময়ীর মাথায় খুব পাকাপোক্ত ভাবেই বসে গেছে। মুগ্ধ আবারও সন্দেহের গলায় বলল-

‘আমাকে চিনতে পারছেন না তাই তো!’

মৃন্ময়ী মুগ্ধর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। ক্ষীণ স্বরে বলল-

‘চিনেছি তো! রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া জামাই আপনি।’

মৃন্ময়ীর কথায় মুগ্ধ লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো৷ মিহি কন্ঠে বলল-

‘এই কথাটাই মনে রাখতে হলো আপনার!’

‘সবটাই মনে আছে। আপনাকে আবারও ধন্যবাদ সেদিনের জন্য।’

‘বার বার ধন্যবাদ বলতে হবে না। তা মিস মৃন্ময়ী বৃষ্টিতে ভিজে কোথায় যাচ্ছেন?’

মৃন্ময়ী সহজ ভঙ্গিতে বলল-

‘বাসায় যাচ্ছি। আপনি কেন বৃষ্টিতে ভিজিছেন?’

মুগ্ধ হাল্কা হেসে কন্ঠে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বলল-

‘বৃষ্টি হচ্ছে, ঠান্ডা হওয়াও বইছে। বেশ রোমান্টিক একটা ওয়েদার। এই সময় বৃষ্টিতে না ভিজে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।’

মৃন্ময়ী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধর মুখে স্কুল পড়ুয়া ছেলেদের মতো কথা শুনে খানিকটা বিভ্রান্ত হলো। মুগ্ধ উৎকন্ঠিত হয়ে বলল-

‘আপনি এখানেই একটু দাঁড়ান আমি আসছি।’

কথাটা বলেই মুগ্ধ ডান পাশের কদম গাছের দিকে এগিয়ে গেল। সব থেকে নিচের ডাল থেকে কয়েক কদম ফুল ছিঁড়ে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। মুখে বিশ্বজয়ী হাসি ঝুলিয়ে ফিরে আসে মৃন্ময়ীর কাছে। হাত বাড়িয়ে সব গুলো ফুল মৃন্ময়ীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-

‘ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। সাদা শাড়ি পরা এক বৃষ্টিকন্যা বৃষ্টিতে ভিজছে। অথচ তার হাত খালি এটা ঠিক মানাচ্ছে না। বৃষ্টি ভেজা রমনীর হাতে একগুচ্ছ বৃষ্টি ভেজা কদম থাকবে এটাই মানানসই। নিন এই গুলো ধরুন। নিজের হাতে নিয়ে হাঁটুন।’

মৃন্ময়ী ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধর কর্মকাণ্ডে সে বার বার বিস্মিত না হয়ে পারছে না। বিস্ময় ভাবটা নিজের মাঝে চেপে রেখে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বলল-

‘যদি না নেই তাহলে কি রাগ করবেন?’

মুগ্ধ বেশ ভাব নিয়ে বলল-

‘উহুম.. শাড়ি পরা মেয়েদের উপর রাগ করতে হয় না। আর রাগ করলেও রাগটা বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না।’

মুগ্ধর কথায় মৃন্ময়ী ঠোঁট চেপে হাসল। হাসি মুখেই ফুল গুলো নিজের হাতে নিয়ে নেয়। ফুলগুলো দেখতে দেখতে বলল-

‘আপনার কথাবার্তা সাহিত্যিক মানুষের মতো। যেমন তেমন সাহিত্যিক না। ভয়ংকর রোমান্টিক ধাঁচের। আপনি নিশ্চয়ই খুব গভীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন তা-ই রোমান্টিকতা মুখ দিয়ে খইয়ের মতো ফুটছে।’

মুগ্ধ হো হো করে হেসে উঠলো। শক্তপোক্ত বিশালাকার শরীরটা কাঁপিয়ে তুলে হাসছে। হাল্কা ভেজা চুল গুলো ডান হাতে পেছনে ঢেলে দিয়ে মুখ মুছলো। কন্ঠে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল-

‘আমি প্রেমে নয় বিয়েতে বিশ্বাসী। প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার মতো বোকামি আমি করবো না। ভালোবাসলে ডিরেক্ট তিনবার কবুল বলে নিজের করে ফেলব।’

মৃন্ময়ী হতভম্ব। মানুষটাকে তার কাছে বড্ড বেশিই অদ্ভুত লাগছে। লোকটা ধ্রুবর বয়সী হবে হয়তো। সাতাশ আটাশের কাছাকাছি। এই বয়সে এসব উদ্ভট কথায় মানায়?? এসব কথা তো অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের মুখে মানায়। যাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে আবেগ। আবেগের বশেই এসব কথাবার্তা বলা অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদেরই অভ্যাস।
বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগলো। তখনই পেছন থেকে একটা রিকশা এসে তাদের সামনে থামল। রিকশার ভেতর বসে থাকা রঞ্জন উত্তেজিত হয়ে বলল-

‘আপু তাড়াতাড়ি রিকশা উঠে আসুন। বেশি ভিজলে আপনার জ্বর আসবে।’

মৃন্ময়ী হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে রিকশা উঠে রঞ্জনের পাশে বসল। বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-

‘তোর ধ্রুব ভাইজান এখনও আমার পেছনে তোকে লাগিয়ে রেখেছে??’

রঞ্জন বরাবরের মতোই দাঁত কেলিয়ে হাসলো। মৃন্ময়ী রাগী দৃষ্টিতে কিছুক্ষন রঞ্জনের তাকিয়ে থেকে মুগ্ধর দিকে তাকায়। যথাসাধ্য বিনীত ভঙ্গিতে বলল-

‘আজ আসছি, ভালো থাকবেন।’

মুগ্ধ চোখের ইশারায় সম্মতি জানাতেই তারা চলে গেল। মুগ্ধ স্থির চোখে রিকশার দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই রিকশা তার দৃষ্টির বাহিরে চলে গেল। মুগ্ধ আবারও হাসলো। অদ্ভুত হাসি।

ধ্রুব হসপিটাল থেকে বাসায় এসে সোজা মৃন্ময়ীর রুমে চলে আসে। বিছানার ঠিক মাঝখানে গুটিশুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে মৃন্ময়ী। দু’দিনের জ্বরে যেন একদম দূর্বল হয়ে গেছে মেয়েটা। চোখের নিচে কালি পরেছে। মুখ শুকিয়ে বির্বণ হয়ে গেছে। ঠোঁট গুলোকে যেন প্রানহীন লাগছে। ধ্রুব চিন্তিত মুখে মৃন্ময়ীর পাশে বসল। ডিউটির জন্য ঠিক মতো মেয়েটার খেয়ালও রাখতে পারছে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃন্ময়ীর কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা করছে। এখন আর জ্বর নেই। মৃন্ময়ী তার কপালে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে পিটপিট করে চোখে মেলে তাকায়। হাল্কা ভেজা শরীরে ধ্রুবকে দেখে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে-

‘বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে?’

ধ্রুব গম্ভীর গলায় বললো-

‘কেন আবার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে?’

‘আমি কি তা বলেছি না-কি! শুধু শুধু রেগে যাচ্ছো কেন?’

মৃন্ময়ী মলিন কন্ঠে কথা গুলো বলেই উঠে বসলো। ধ্রুব নরম গলায় বলল-

‘এখন কেমন লাগছে?’

‘একদম ফিটফাট সুস্থ। আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করার কিছু নেই।’

ধ্রুব চুপ করে রইলো। কিছুটা সময় পর বেশ সিরিয়াস হয়ে বলল-

‘তরূ! তোর সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে। এখন বলবো!’

মৃন্ময়ী বিস্ময় নিয়ে তাকায় তার ভাইয়ের দিকে। কি কেমন কথা বলবে যে আগে পারমিশন নিয়ে নিচ্ছে। আগে তো কখনো এমন করে কথা বলেনি তার ভাই।

চলবে…

স্নিগ্ধ চাহনি পর্ব-০৩

0

#স্নিগ্ধ চাহনি
#পর্বঃ৩
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

মৃন্ময়ী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো ধ্রুবকে। আচমকাই এভাবে জড়িয়ে ধরায় কিঞ্চিত বেসামাল হয়ে পরে সে। তার গলা দিয়ে আপনাআপনি মৃদুস্বরে ‘আহ’ করে আর্তনাদ বেরিয়ে আসল। পরক্ষনেই নিজেকে সামলিয়ে নেয়। ঠোঁট প্রসারিত করে মুচকি হাসলো। মৃন্ময়ী তার বুকে মুখ গুজে দিয়ে কান্না করছে। বাচ্চাদের মতো নাক টেনে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। হয়তো এই আশ্রয়টা-ই তার প্রয়োজন ছিল। এই মানুষটাকেই খুব করে পাশে চাচ্ছিল। এখন এই মানুষটাকে কাছে পেয়ে যেন কান্নার বাধ ভেঙেছে। নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে নিজের সকল কষ্ট গুলোকে মানুষটার কাছে প্রকাশ করছে। ধ্রুব আলতো করে মৃন্ময়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সে জানে এই মেয়ের কান্না এত সহজে কিছুতেই থামবে না। তার বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। আশেপাশের কয়েক জোড়া কৌতূহলী চোখ তাদের দিকে স্থির। ভার্সিটির দারোয়ান ধ্রুব আর মৃন্ময়ীকে দেখে তার পান খাওয়া লালচে দাঁত বের করে তাদের হাসি উপহার দেয়। ধ্রুব দারোয়ানের উদ্দেশ্যে ডান হাত উঁচু করে নাড়ালো। মৃন্ময়ী এখনও কান্না করেই যাচ্ছে। এবার তার একটু খারাপ লাগছে। তার জন্যই মেয়েটা এতদিন কত কষ্ট পেয়েছে। একা একা থেকেছে কয়েকটা মাস। ধ্রুব পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য রসিকতা করে বলল-

‘উফফ! তরূ তুই এমন ছিঁচকাঁদুনি হলি কিভাবে বল তো! কার মতো হয়েছিস তুই? আমার মতো তো একদমই না। কই এতদিন পর আসলাম একটু ভালো করে আমাকে স্বাগতম জানাবি তা না, উল্টো আমার এত্তো সুন্দর শার্টটা তোর নিজস্ব সমুদ্রের পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছিস। এটা কেমন কথা! দেখি দেখি সোজা হয়ে দাঁড়া তো!’

ধ্রুব এক প্রকার জোর করেই মৃন্ময়ীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। চোখেরজলে মৃন্ময়ীর চোখমুখের বারোটা বেজে গেছে। সারা মুখে চুল লেপ্টে আছে। ধ্রুব তার দু’হাতের মাঝে মৃন্ময়ীর মুখ চেপে ধরে। গাল দুটো চটকাতে চটকাতে ভীষণ হতাশা নিয়ে বলল-

‘হায় হায় এটা আবার কোন পেত্নি? আমি তো একটা মাটির তৈরি রাজকুমারীকে রেখে গিয়েছিলাম, এখন দেখি সে পেত্নির রূপ নিয়েছে। ছিঃ ছিঃ কেমন বাজে লাগছে রে তোকে। আমার তো তোকে দেখেই ভয় লাগছে।’

মৃন্ময়ী এক ঝাটকায় ধ্রুবর হাত সরিয়ে দেয়। হাতের তালুতে চোখের পানি মুছে কঠিন গলায় বলল-

‘ভাই!!…’

ধ্রুব শব্দ করে হেসে উঠলো। মৃন্ময়ী কান্না করতে করতেও রাগে ফুসতে লাগলো। ভীষণ রাগ আর অভিমান নিয়ে গজগজ করেই হাঁটা শুরু করে। ধ্রুব হাসি থামিয়ে ভার্সিটির দারোয়ানের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বলল-

‘চাচা থ্যাঙ্কিউ। এই কয়েকমাস তরূকে দেখে রাখার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আজ আসি পাগলিটা রাগ করেছে খুব।’

দারোয়ান চাচা হাসতে হাসতে বললেন-

‘আইচ্ছা আইচ্ছা। বাজান এবার যাও।’

ধ্রুব পেছন ফিরে ছুটে চলল মৃন্ময়ীর কাছে। দৌড়াতে দৌড়াতে আসলো মৃন্ময়ীর কাছে। সে তাকাল তার অভিমানী তরূর দিকে। মৃন্ময়ী থেমে হিচকি তুলছে আর বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। চোখের পাপড়ি গুলো একটা আরেকটার সাথে লেগে আছে। খুব মোহনীয় লাগছে। বৃষ্টি ভেজা সতেজ ফুলের মত স্নিগ্ধ।

‘তরূ! একটু আস্তে আস্তে হাঁট না প্লিজ। এত রেগে আছিস কেন? অদ্ভুত।’

ধ্রুব তার কথার প্রতিত্তোরে মৃন্ময়ীর কাছ থেকে কোনো জবাব পেল না। সে জানে মৃন্ময়ী এখন কোথায় যাবে। প্রায় দশ মিনিট চুপচাপ হাঁটার পর মৃন্ময়ী তার গন্তব্যে এসে পৌঁছায়। চিরচেনা, কিছু মধুর স্মৃতি জড়ানো ছোট্ট একটা পার্ক। আশেপাশে কিছু পথশিশুরা খেলা করছে। মৃন্ময়ী ছাউনির নিচে এসে বসল। তার পাশেই বসেছে ধ্রুব। কিছুক্ষণ পথশিশুদের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃন্ময়ী নিম্নস্বরে ডাকল ধ্রুবকে-

‘ভাই!..’

ধ্রুব তার শীতল দৃষ্টি মৃন্ময়ীর দিকে স্থির করে। মৃন্ময়ী ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে বিষন্ন গলায় বলল-

‘সবার বাবা-মা আছে তাহলে আমাদের নেই কেন? আমিই কেন মা কে দেখার সুযোগ পেলাম না!’

ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মৃন্ময়ীর মাথায় হাত রেখে আদুরে গলায় বলল-

‘কারণ তুই খুব স্পেশাল।’

‘তুমি তো মা’কে দেখেছো। তোমাকে খুব ভালোবাস তো তাই না ভাই! খুব বেশিই আদর করতো! কিন্তু আমি তো একদিনের জন্যেও সেই ভালোবাসার ভাগ পেলাম না।’

মায়ের কথা মনে পরতেই শূন্যতায় হাহাকার করে উঠলো ধ্রুবর বুক। মায়ের সাথে কাটানোর অল্প কিছু মধুর স্মৃতি গুলোই ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে। এই স্মৃতি গুলো ভেবেই যেন তার মরুভূমির মতো উত্তপ্ত হৃদয়ে শীতল হাওয়া বয়ে যায়। কিন্তু মৃন্ময়ী! তার কাছে তো মা’কে নিয়ে খুব ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর স্মৃতিটুকুও নেই৷ মা’য়ের ভালোবাসা পাওয়ার আনন্দই তার কাছে নেই। তাহলে সে কি ভেবে নিজেকে স্বান্তনা দিবে! ধ্রুব তার বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল-

‘তুই মা’র ভালোবাসা পাসনি তো কি হয়েছে! আমি তো সব সময়ই ছিলাম তোর পাশে।’

‘আচ্ছা ভাই! তোমার রাগ হয় না আমার উপর? ঘৃণা হয় না?’

ধ্রুব বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে-

‘এমন কথা বলছিস কেন?’

‘এই যে আমার জন্মের জন্য তুমি আম্মুকে হারিয়েছ আর আমার ভুলের জন্যই আব্বুকে হারাতে হয়েছে। আমি যদি জন্মদিনের সময় আব্বুকে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে না বলতাম তাহলে হয়তো আব্বুর কার এক্সিডেন্ট হতো না। তোমার কি মনে হয় না আমার জন্মটাই তোমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে! আমার জন্মদিনেই তুমি সবাইকে হারিয়ে ফেলছো!’

ধ্রুব চুপচাপ মৃন্ময়ীর সব গুলো কথা শুনল। তবে ধৈর্য্য হারালো না। মৃন্ময়ীর দিকে চেয়ে নরম গলায় বলল-

‘কে বলল সব হারিয়েছি! তোকে পেয়েছি তো! তুই জানিস আমি তোর নাম তরূ কেন রেখেছি! তরূ মানে হচ্ছে গাছ। গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয় বলেই আমরা বেঁচে আছি। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য গাছ যেমন ইম্পর্ট্যান্ট। তেমনি আমার কাছে তুই আমার জীবনের চেয়েও বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। আর বাকি রইলো আব্বু আম্মুর মৃত্যুর কথা! তাহলে জেনে রাখ যার যার মৃত্যু যেভাবে লেখা আছে সেভাবেই হবে। এটাই নিয়তি। এতে আমার কিংবা তোর কারও কোনো হাত নেই।’

মৃন্ময়ী চুপ করে বসে রইল। নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে পার্কের বাচ্চা গুলোর দিকে। ছোট বেলায় তার বাবার হাত ধরে এসেছিল এই পার্কে। কত মজা করেছে একসাথে। তার বাবা আর ভাই কখনই তাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। কিন্তু নিয়তি বুঝি তার বেলাই খুব নিষ্ঠুর হয়ে গেল। তার চৌদ্দতম জন্মদিনেই চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলল তার বাবাকে। তার বাবার মৃত্যুতে কোনো না কোনো ভাবে সে নিজেকেই দায়ী মনে করে। এই তো সেদিন সন্ধ্যায় তার বাবাকে ফোন করে খুব অভিমানী কন্ঠে বলছি-

‘বাবা!! রাত হয়ে যাচ্ছে। তুমি আজ আমাকে নিয়ে ঘুরতে গেলে না। আমি আর ভাই কেক নিয়ে বসে আছি এখনও যদি না আসো তাহলে আর কথাই বলবো না তোমার সাথে।’

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে তার বাবা খুব মিষ্টি গলায় বলল-

‘এই তো মা এসে পরবো আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। অফিসে অনেক চাপ যাচ্ছে তো আমার কি দোষ বল!’

‘আচ্ছা আরেকটু অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু!’

ফোন কেটে গেল। দুই ভাইবোন বসে অপেক্ষা করতে লাগলো তার বাবার। রাত প্রায় বারোটায় ধ্রুব খবর পেয়েছিল তার বাবার গাড়ি এক্সিডেন্টের কথা। আর সাথে তার বাবার মৃ’ত্যুর কথা। মৃন্ময়ী তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। ধ্রুব ভেঙে পরেছিল কান্নায়। কিন্তু তার বোনকে ঘুম থেকে তোলেনি। সকাল হলো। মৃন্ময়ীর ঘুমও ভাঙলো। ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই বাবার প্রতি প্রচন্ড অভিমানে অন্ধকার হয়ে আসলো তার মুখ। রুম থেকে বের হতেই শোকের ছায়ায় পাথর হলো সে। একুশ বছর বয়সী ধ্রুব তখন চারদিক সামলাতে সামলাতে দিশেহারা৷ তার ছোট্ট বোনটার নিস্তব্ধতা আর বাবার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃ’ত্যু সব কিছুর ধাক্কা সামলে নিতে নিতে যেন নিজের কষ্টটা-ই প্রকাশ করতে ভুলে গেল সে। নিজের পড়াশোনা, বাবার ব্যবসা, এই বাড়ি আর ছোট্ট একটা মাটির তৈরি রাজকুমারী সব কিছুর দায়িত্ব তখন এসে পরল তার নাজুক কাধে। প্রথম প্রথম সব কিছুতে হাঁপিয়ে উঠলেও আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়৷ আর তাদের দেখাশোনা করতে দিনরাত এক করে দিয়েছেন তার বাবার ম্যানেজার রসিদ মিয়া। মানে রঞ্জনের বাবা। তিনিই ব্যবসায়ের সকল কিছু দেখাশোনা করেন। আর ধ্রুব ব্যস্ত হয়ে পরে তার বোনের দায়িত্ব পালনে আর বাবার স্বপ্ন পূরণে। ছেলেকে একজন ভালো ডাক্তার হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন ধ্রুবর বাবা। ধ্রুব সেই ইচ্ছে পূরণ করেছে। জরুরি কাজেই তিন মাসের জন্য গিয়েছিল অন্য শহরে। এই প্রথম বুঝি মৃন্ময়ীকে রেখে কোথাও গিয়েছিল। চাইলেই মৃন্ময়ীকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু সে চেয়েছিল মৃন্ময়ী একা চলতে শিখুক। নিজেকে সামলিয়ে নিতে শিখুক। কিন্তু কে জানতো তার এই অভিমানী পাগলিটা তার সাথে একেবারেই সব যোগাযোগ বিছিন্ন করে দিবে। সব জায়গায় থেকে ব্লক করে নিজের নাম্বারই চেঞ্জ করে দিবে! মেয়েটা যে এত অভিমানী হয়েছে তা সে বুঝতেই পারেনি।

‘দেখ তো আমার এত প্রিয় একটা শার্টকে ভিজিয়ে কি অবস্থা করেছি!’

ধ্রুবর কথায় মৃন্ময়ী আড় চোখে তাকায়। হাল্কা গোলাপি রঙের শার্ট ধ্রুবর গায়ে জড়ানো। শার্টের রঙের কারণে যেন ধ্রুবকে অল্প বয়সী ছেলে মনে হচ্ছে। এই কালার ধ্রুবর মোটেও পছন্দ না। তার ভাষ্যমতে এটা বাচ্চা মেয়েদের কালার। ধ্রুবর জন্মদিনে মৃন্ময়ী নিজেই এই শার্টটা গিফট করেছিল। তার পর থেকেই এটা ধ্রুবর প্রিয় শার্ট।

‘চুপ করে আছিস কেন! আচ্ছা এবার বল তো তুই আমাকে সব জায়গায় ব্লক করে রেখেছিস কেন? আর ব্লক করেছিস তো করেছিস এতেও কি তোর মন শান্ত হয়নি যে নাম্বারই পালটে ফেললি! আমি কিভাবে তোর খোঁজ নিতাম বল তো!’

মৃন্ময়ী এবার মুখ খুলল। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল-

‘চারপাশে তো স্পাই লাগে-ই রেখেছিলে। তারা নিশ্চয়ই আমার নাড়িভুড়ি থেকে শুরু করে সব কিছুর খবর তোমাকে জানিয়েছে।’

ধ্রুব হাসতে হাসতে বলল-

‘আচ্ছা এবার বাসায় চল। প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। সকাল থেকে কিছু খাইনি। ঠিক করেছি বাসায় এসে একেবারে তোর হাতের বিরিয়ানি খাবো।’

‘আফনান চলে গেছে এই খবর পেয়েই তুমি তাড়াতাড়ি এসেছো তাই না ভাই!’

মৃন্ময়ীর কন্ঠস্বর জড়িয়ে যাচ্ছে। চোখদুটো আবারও চিকচিক করে উঠেছে। ধ্রুব হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল-

‘একদম চোখের পানি ফেলবি না৷ যারা তোকে সম্মান করে না, তোর চোখের পানির মূল্য দেয় না তাদের জন্য কক্ষনও চোখের পানি ফেলবি না। আমাদের বাবা-মা নেই বলে কি আমাদের পরিচয় নেই! নাকি আমরা রাস্তার ছেলে মেয়ে যে ওই মহিলা তোকে তুচ্ছ মনে করবে! আর আমার তো রাগ হচ্ছে আফনানের উপর। ওর তো উচিত চুড়ি পরে মায়ের আঁচল ধরে ঘুরা। একটা ছেলে হয়েও নিজের ভালোবাসাকে পূর্নতা দিতে পারে না। নিজের মা’কে বুঝিয়ে বলতে পারে না তাকে তো ছেলে না মেয়ে বলা উচিত। সাধারণ মেয়ে না ন্যাকা টাইপের মেয়ে।’

ধ্রুবর কথায় মৃন্ময়ী খিলখিল করে হেসে উঠলো। ধ্রুব চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়ীর দিকে। কতদিন পর মেয়েটার মুখে হাসি দেখেছে।

চলবে..

স্নিগ্ধ চাহনি পর্ব-০২

0

#স্নিগ্ধ চাহনি
#পর্বঃ২
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

মুগ্ধ হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষন মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষনেই বিস্ময় ভাব কাটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। আবারও হাঁটা শুরু করে। মৃন্ময়ী তার পাশের মানুষটার দিকে দৃষ্টি দিয়ে ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞেস করল-

‘আপনার নাম!’

মুগ্ধ অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। খানিক্ষন সময় নিয়ে নিম্ন স্বরে থেমে থেমে বলল-

‘মুগ্ধ। আমার নাম মুগ্ধ। এত রাত করে বাসায় ফিরছেন আপনার বাসার কেউ চিন্তা করবে না!’

মৃন্ময়ীর মনে ক্ষীন সন্দেহ ছিল লোকটা হয়তো তাকে চেনে। কিন্তু এই প্রশ্ন শুনে নিমিষেই তার সন্দেহ কেটে গেছে।

‘আমি একাই থাকি। আমার বাবা-মা নেই।’

মৃন্ময়ীর সহজ ভঙ্গিতে বলা এই ছোট কথাটা শুনেই মুগ্ধ’র বুক ধক করে কেঁপে উঠল। কিন্তু মৃন্ময়ীর বলার ভঙ্গিতে তেমন কোনো খারাপ লাগার চিহ্ন দেখা গেল না। মনে হচ্ছে সে এই বিষয়টা খুব সহজে মেনে নিয়েছে। হয়তো এইসব প্রশ্ন শুনে আর উত্তর দিয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।

‘এই তো আমার বাসা। আমি আসছি। ভালো থাকবেন। আর হ্যাঁ আবারও ধন্যবাদ।’

মৃন্ময়ী কথা গুলো বলেই আবারও সরু চোখে আশেপাশে তাকাল। এবারও কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছে। পরমুহূর্তেই ডান পাশের দোতলা বাড়ির ভেতরে চলে যায় মৃন্ময়ী। মুগ্ধ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাড়িটার দিকে। গেইটের ডান পাশে বড় একটা নেইম-প্লেট লাগানো। তাতে খুব সুন্দর করে বাংলা বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘মৃন্ময়ীর ইচ্ছে তরূ’। কেন যেন মনে হচ্ছে এই নাম রাখার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য কিংবা কারণ আছে। মুগ্ধ নির্বিকার ভঙ্গিতে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে নিজের বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। আর দশ-বিশ মিনিট হাঁটলেই হয়তো তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাবে।

মৃন্ময়ী সিড়ি বেয়ে দোতলায় আসলো। সব সময়ের মতো আজও দরজার কাছে খাবারের পার্সেল রাখা। মৃন্ময়ী তপ্ত শ্বাস ফেলে। খাবারের পার্সেল গুলো হাতে নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। নির্লিপ্ত চোখে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের ক্লান্ত শরীরটা এক নজর দেখে নেয়। অলস ভঙ্গিতে ওয়াশরুমে গিয়ে ঝর্ণা চালু করে। ঝর্নার পানিতে তার সকল সাজগোজ ধুয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে। গায়ে জড়ানো লাল শাড়িটা খুলে ছুড়ে ফেলে দিল অন্য পাশে। ঝর্নার নিচে বসে দু হাটুতে মুখ গুজে অঝোর কান্না করতে লাগলো। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে আর্তনাদ করছে। একজন মানুষকে খুব করে কাছে চাইছে এই মুহুর্তে। কিন্তু সেই মানুষটা এখন তার পাশে নেই। এই মুহুর্তে তাকে আগলে নেওয়ার মতো কেউ নেই। তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলানোর মানুষটা তার কাছে নেই। আবারও কষ্টের তালিকায় আরেক ধাপ এগিয়ে গেল সে। কষ্টে পরিমাণ কমার বদলে যেন দফা দফায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দশটা বেজে পাঁচ মিনিট। বাগানের ঠিক মাঝখানের দোলনায় বসে আছে মৃন্ময়ী। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। কান্নার ফলে চোখ মুখ ফুলে স্নিগ্ধতায় মোড়ানো এক মোহনীয় রূপ এসেছে তার চেহারায়। উন্মুক্ত চুল গুলো থেকে টপটপ করে বৃষ্টির মতো পানি ঝরে পরছে। দোতলায় ছোটখাটো একটা ফ্ল্যাট, আর বাকি খালি জায়গাটুকুতে বিশাল এক বাগান করা। হলদেটে বাতির আলোতে রাতের আঁধার যেন স্পর্শ করতে পারছে না মৃন্ময়ীকে। সে এই বাগানটার নাম দিয়েছে ‘দুঃখবিলাসী’। তার একাকী জীবনের বিশাল এক জায়গা জুড়ে আছে দুঃখবিলাসী বাগান।

আচমকাই নিচ থেকে কিছু একটা পরে যাওয়ার শব্দ আসল। মৃন্ময়ী বেরিয়ে আসল তার ভাবনার জগৎ থেকে। রেলিঙের কাছে এসে ঝুঁকে নিচে শব্দে উৎসটা খুজতে চেষ্টা করল৷ কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গলা খেকরিয়ে কন্ঠস্বর পরিষ্কার করে স্পষ্ট গলায় বলল-

‘আমি জানি তুমি এখানেই আছো। চুপচাপ উপরে চলে আসো।’

মৃন্ময়ী কথাটা বলেই আগের জায়গায় এসে বসল। তার ঠিক দু মিনিটের মাঝেই ছাদে এসে উপস্থিত হলো ঝাকড়া চুলের এক সুদর্শন যুবক। তার ফর্সা উজ্জ্বল ত্বকে খয়েরী রঙের ফতুয়াটা দৃষ্টি কাড়ার মতো ফুটে আছে। ছেলেটা ডান হাতে তার ঝাকড়া চুল গুলো গুছিয়ে নেয়। আঁকাবাঁকা দাঁত গুলো বের করে বোকা বোকা কন্ঠে বলল-

‘আপনি কেমনে জানলেন আমি নিচে আছি!’

মৃন্ময়ী চোখ ছোট ছোট করে তাকাল রঞ্জনের দিকে। শক্ত গলায় বলল-

‘তোমার ধ্রুব ভাইজানকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। আর তুমি তো তার-ই কথায় নেচে বেড়াও সারাক্ষণ।’

রঞ্জন দাঁত কেলিয়ে হাসলো। মৃন্ময়ী হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বলল-

‘ভেতর থেকে টেবিল নিয়ে এসে বসো এখানে।’

রঞ্জন মৃন্ময়ীর কথা মতো ভেতর থেকে একটা টেবিল এনে বসলো।

‘কখন থেকে লেগেছো আমার পিছু?’

‘হারামজাদা বদমাশটায় যখন আপনার পথ আটকাইছে তার কিছুক্ষন আগেই।’

‘তোমার ভাইজানকে নিশ্চয়ই ফোন করে সব বলে দিয়েছ!’

রঞ্জন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। মৃন্ময়ী ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে। এই ছেলে ঝড়ের গতিতে চলে তা তার আগে থেকেই জানা।

‘পড়তে বসেছিলে আজ?’

রঞ্জন উপর নিচে মাথা দুলাল। মৃন্ময়ী এবার ক্ষিপ্ত হয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-

‘সামনে এইচএসসি এক্সাম। টেস্টের রেজাল্টে যদি কোনো উনিশ বিশ দেখি তাহলে তোকে আর তোর ভাইজানকে পিটিয়ে পিঠে ছাল তুলব মনে রাখিস।’

‘আচ্ছা মনে থাকবে।’

রঞ্জন আবারও দাঁত কেলিয়ে হাসলো। কিছুটা সময় চুপ থেকে মিহি কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-

‘আপু আপনার কি মন খারাপ?’

‘নাহ আমি ঠিক আছি। তুমি বাসায় চলে যাও। দারোয়ান আংকেল আছে আর নিচের ফ্ল্যাটেও মানুষ আছে তাই আমাকে নিচে চিন্তা করতে হবে না। আমি একা থাকতে পারবো। তোমার ধ্রুব ভাইজান ফোন করলে বলবা আমি বলেছি তোমাকে চলে যেতে। আর আমি ঠিক আছি।’

রঞ্জন এখনো বসেই আছে। মৃন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-

‘আমি ঠিক আছি রঞ্জন। তুমি বাসায় যাও। বাসায় যেয়ে একঘন্টা পড়বে তারপর ঘুমাবে মনে থাকে যেন।’

রঞ্জন উঠে দাঁড়ালো। বিনীত ভঙ্গিতে বলল-

‘আচ্ছা ঠিক আছে যাচ্ছি। আপনি সাবধানে থাকবেন। আর কোনো দরকার হলে সাথে সাথেই আমাকে কল দিয়েন।’

মৃন্ময়ী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। রঞ্জন কিছুক্ষন মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে চলে যায়।

———————

‘খালা আফনান ভাইকে নিয়ে কানাডা ফিরে গেছে। গতকাল বিকেলের ফ্লাইটে চলে গেছে।’

মৃন্ময়ী বই থেকে দৃষ্টি তুলে অর্পির দিকে তাকাল। অর্পিকে বেশ উত্তেজিত লাগছে। চোখেমুখে ভয়াবহ উত্তেজনা। তার চেয়েও বেশি দুঃখী দুঃখী গলায় বলল-

‘আমি ভাবতেও পারিনি খালা এমনটা করবে।’

মৃন্ময়ী কিছু বলল না। আবারও বইয়ের মাঝে মুখ গুজালো। অর্পি এবার খানিকটা বিরক্ত হলো। চোখমুখ কুচকে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়ীর দিকে। ছোঁ মেরে মৃন্ময়ীর হাত থেকে বইটা নিয়ে নেয়। বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল-

‘তুই চুপ করে আছিস কেন! আর কাল থেকে তোর ফোন অফ কেন! জানিস কতটা চিন্তায় ছিলাম আমি। ভাইয়া আর খালা যাওয়ার আগে আমাদের বাসায় এসেছিলেন। তখনই ভাইয়া সুযোগ বুঝে আমাকে সব বলেছে। ভাইয়া নাকি কাল তোকে বিয়ে করবে বলেছিল। কিভাবে যেন খালা জেনে গিয়েছিল বিয়ের কথা। তাই ভাইয়াকে নানান ভাবে কথা বলে মাথা হাত রেখে কসম কাটিয়ে কানাডা যাওয়ার জন্য ভাইয়াকে রাজি করায়। আর খালা তো যাওয়ার সময় আমাকে একপ্রকার হুমকি দিয়ে গেছেন আমি যেন ভাইয়ার সাথে তোর বিষয়ে কোনো প্রকার কথা না বলি। আম্মুর কাছেও আমার নামে বিচার দিয়ে গেছে। জানিস আম্মুও কত করে খালাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু খালা তো নাছড়বান্দা কারও কথাই শুনতে রাজি না। আস্তো এক ঘাড়ত্যাড়া মহিলা।’

(মৃন্ময়ীর বেস্ট ফ্রেন্ড অর্পি। আফনান! সম্পর্কে অর্পির খালাতো ভাই। আজ থেকে এক বছর আগে অর্পির বার্থডে’তে প্রথম দেখা হয়েছিল আফনানের সাথে। মৃন্ময়ীকে প্রথম দেখেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিল আফনান। যাকে বলে প্রথম দর্শনেই ভালোবাসা। মৃন্ময়ী বরাবরই চুপচাপ শান্তশিষ্ট স্বভাবের মেয়ে ছিল। প্রেম ভালোবাসার প্রতি কোনো আগ্রহ না থাকলেও দিন দিন আফনানের পাগলামিতে তার মায়ায় জড়িয়ে যায়। খুব ভালোই চলছিল তাদের প্রেম। কিন্তু একদন হঠাৎ করেই আফনানের মা তাদের সম্পর্কের কথা জেনে যায়। তিনি এই সম্পর্কের বিরুদ্ধে ঘোর আপত্তি জানান। তার একমাত্র কারণ হলো মৃন্ময়ীর বাবা-মা নেই। বাবা মা নেই এরকম ফ্যামিলির মেয়েকে তিনি কিছুতেই নিজের পুত্রবধূ করতে রাজি নন। ঠিক তার কিছুদিন পরেই আফনান মৃন্ময়ীকে বিয়ে জন্য রাজি করাতে উঠে পরে লাগে। মৃন্ময়ী কোনো মতেই বড়দের অমতে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিল না। তবুও আফনানের আকুতিভরা কথায় রাজি হয়ে যায়। বিয়ে নিয়ে একটা বড়সড় ঝামেলা হবে মৃন্ময়ী এই বিষয়ে কিছুটা হলেও অবাগত ছিল।)

‘অদ্ভুত তো! তুই কথা বলছিস না কেন! আসার পর থেকেই চুপ করে বসে আছিস। আমি বুঝতে পারছি তোর পরিস্থিতি কিন্তু তাই বলে কি কথা বলবি না আমার সাথে?’

অর্পির ঝাঁঝালো কণ্ঠে মৃন্ময়ী মলিন হাসলো। নরম গলায় বলল-

‘এসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না অর্পি। প্লিজ.. ‘

অর্পি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। উদাসীন ভঙ্গিতে বলল-

‘আচ্ছা আচ্ছা আর বলবো না এসব। কিন্তু দয়া করে চুপ করে থকিস না। আমার সাথে অন্তত কথা বল।’

‘ওকে, কিন্তু এখন চুপ থাক। টিচার আসবে।’

মৃন্ময়ীর কথা মতো অর্পি চুপ করে বসে রইল। মৃন্ময়ীর এমন নিস্তব্ধতা তার কাছে মোটেও ভালো লাগছে না। আহত দৃষ্টিতে মৃন্ময়ীর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে গোমড়া মুখে ক্লাসের দরজার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। টিচার আসার অপেক্ষা করা ছাড়া এই মুহুর্তে আর কোনো কাজ তার নেই। আজ যেন সময় একদমই যাচ্ছে না।

অর্পি তার গাড়ি নিয়ে চলে আছে। মৃন্ময়ী একা একা অলস ভঙ্গিতে হেঁটে ভার্সিটির গেইট থেকে বের হলো। কোনো কিছুতেই যেন তার মন টিকছে না। শুধু শুধুই কান্না করতে ইচ্ছে করছে। আফনানের জন্য এমনটা হচ্ছে কিনা তা সে জানে না। তবে তার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

‘তরূ..’

খুব কাছের, খুব চেনা একজন মানুষের কন্ঠ। মানুষটার দেওয়া ভালোবাসার নাম তরূ। মৃন্ময়ী ঝাপসা চোখে পেছন ফিরে তাকাল। হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা। ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসি। মানুষটাকে দেখেই মৃন্ময়ীর চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরল নোনাজল। দু’হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকছে মৃন্ময়ীকে।

চলবে…

স্নিগ্ধ চাহনি পর্ব-০১

0

#স্নিগ্ধ চাহনি
#সূচনা_পর্ব
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

কাজি অফিসের বাহিরে প্রায় পাঁচঘণ্টা ধরে অপেক্ষারত অবস্থায় বসে আছে মৃন্ময়ী। গায়ে জড়ানো টকটকে লাল রঙের জামদানী শাড়ি। কাজল কালো চোখ দুটোতে হাজারো ভয়, আশংকা আর বিষন্নতার ছড়াছড়ি। সময় চলছে নিজের গতিতে। তবে মৃন্ময়ী মূর্তির ন্যায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছে পুরনো এই কাঠের বেঞ্চিটাতে। ঠিক যেন এক প্রানহীন মাটির পুতুল বসে আছে। এই প্রানহীন পুতুলটাকে একটু চমকে দিয়ে এখনও উপস্থিত হলো না তার কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার মানুষটি। এখনো পর্যন্ত কেউ এসে বলল না “মৃনু তাড়াতাড়ি চলো আমাদের বিয়ের সময় চলে যাচ্ছে।” দু’দিন আগেই দীঘির পাড়ে তার দু’হাত আঁকড়ে ধরে বেশ আকুতি মিনতি করে বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছিল আফনান। ভীষণ ভীষণ ভীষণ আবেগি কন্ঠে বলেছিল-

‘শোন না মৃনু!! চল আমরা এখন বিয়েটা করে ফেলি৷ পরে না হয় সময় বুঝে আমি আম্মুকে জানিয়ে দিবো। তোমাকে নিয়ে আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না। তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমার ভেতরটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। একবার আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলে তোমাকে হারানোর ভয় থাকবে না আমার। প্লিজ মৃনু রাজি হয়ে যাও।’

মৃন্ময়ী এভাবে বিয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষের জোড়াজুড়িতে বিয়ের জন্য রাজি হতে বাধ্য হয়৷ কিন্তু এখন কেন আসছে না আফনান! তাকে লাল শাড়িতে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল আফনানের তাহলে কেন এখনও উপস্থিত হলো না এখানে!
কথা গুলো ভেবেই ঝাপসা হয়ে এলো মৃন্ময়ীর দৃষ্টি। অসহ্য ব্যথায় বুকের ভেতরটা বিষিয়ে উঠলো। সারা গায়ে যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে এই অপেক্ষা নামক বি’ষের য’ন্ত্রণা।।

‘মা গো! সেই কহন থেইক্কা দেখতাছি তুমি এহানো বইসা রইছো। আর কত অপেক্ষা করবা মা? মানুষটা আসার হইলে সে কহন-ই আইসা পরতো। রাত্র হইয়া যাইতাছে এইবার তুমি বাড়ি যাও মা। এতো রাইতে বাইরে থাকা ঠিক হইবো না।’

মৃন্ময়ী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মাথা তুলে তাকালো মানুষটার দিকে। বেঞ্চির অপর কোণে বেশখানিকটা দূরত্ব নিয়ে বসে আছেন সফুরা বেগম। খুব সুন্দর, মায়াবী ক্লান্ত একটা মুখ। পাঁক ধরানো উশখুশ চুল। গায়ে জড়ানো ধুলো বালিতে মাখা ময়লা সুতি কাপড়। পায়ের কাছে রাখা বাশের তৈরি একটা খালি ঝুড়ি। মৃন্ময়ী যখন এসেছিলো তখন এই ঝুড়ি ভর্তি ছিল তাজা ফুলের মালা৷ মালা গুলো বিক্রি হয়ে ঝুড়িটা খালি হয়ে গেছে, অথচ মৃন্ময়ীর অপেক্ষার প্রহর গুনা এখনও শেষ হলো না। সফুরা বেগম মৃন্ময়ীর কাছে এসে মাথায় আলতো করে হাত রেখে আবারও বললেন-

“কষ্ট পাইও না মা। ভাগ্যে যা আছিলো তা-ই হইছে। মানুষটা মনে হয় তোমার কপালে আছিলো না।”

মৃন্ময়ী স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। কেন যেন মনে হচ্ছে মহিলাটার মধ্যে মাতৃভাব অন্ত্যত প্রবল৷ কিছু মানুষ থাকে যাদের এক নজর দেখলেই খুব কাছের মনে হয়। এনাকেও তাই মনে হচ্ছে। মৃন্ময়ী কোনো সংকোচ ছাড়াই হুট করে ওনাকে জড়িয়ে ধরলো। সফুরা বেগম প্রচন্ডরকম অবাক হলেন। হয়তো নিজের পেশা আর ধুলোবালিতে মাখা এই ময়লা শরীরটাই হলো তার সংকোচিত হওয়ার কারণ। মৃন্ময়ীর শরীর থেমে থেমে কেঁপে উঠছে। নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা সকল কষ্ট চোখের পানিতে বিসর্জিত হচ্ছে। তিনি পরম মমতায় মৃন্ময়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। খানিকটা সময় পর মৃন্ময়ী শান্ত হয়। হাতের উল্টো পিঠে চোখেরজল মুছে সোজা হয়ে বসে। অশ্রুসিক্ত চোখে সফুরা বেগমের দিকে চেয়ে একটা নির্মল হাসি দিয়ে বলল-

‘আমি তোমাকে মা ডাকি! আমি আমার মা’কে কখনো দেখিনি। উনি থাকলেও হয়তো আমাকে এভাবে তোমার মতো আগলে রাখতেন৷’

মৃন্ময়ীর আবদার শুনে তার দুচোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠলো। যেন খুব সাধনার পর কিছু একটা পেয়েছেন। তিনি জড়ানো কন্ঠে বললেন-

‘খুব শখ আছিলো একটা সন্তানের কিন্তু কি করার আল্লাহ হয়তো চায় না আমগো পোলাপান। আইজ তোমার মতো এমন পবিত্র একটা মাইয়া দিয়া আল্লাহ আমার শখ পূরণ কইরা দিছে।’

মৃন্ময়ী ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো৷ ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া ভগ্নহৃদয়ের ব্যথা খানিকটা সময়ের জন্য ভুলে এখন মায়ের মমতা আর ভালোবাসায় সিক্ত হলো মৃন্ময়ী।

রাত প্রায় সাড়ে আটটা। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট এই সময় ভীষণ ব্যস্ত থাকে। মুগ্ধ তপ্ত শ্বাস ফেলে। বা হাত উঁচু করে ঘড়িতে টাইম দেখলো৷ প্রায় দশ মিনিট ধরে গাড়িটা ঠিক এই জায়গাতেই সুপার গ্লু’র মতো আটকে আছে। চরম বিরক্তিতে ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুঞ্চিত করে বাহিরে তাকালো। চারপাশের হর্নের তীব্র আওয়াজে মনে হচ্ছে মাথার ভেতরে মগজ গুলো লাফালাফি করছে। আচমকাই তার অস্থির, ক্লান্ত চোখ দুটো ডান পাশের খানিকটা দূরের একটা রিকশায় স্থির হলো। সোডিয়ামের আলোয় রিকশায় বসে থাকা এক তরুণীকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুগ্ধর দৃষ্টি মায়া কাড়া সেই মায়াবিনীর চেহারাতেই আটকে আছে। লাল শাড়ি পড়া, হাত খোপা করা এলোমেলো চুল। অদ্ভুত কারণে তার গাল দুটো চিকচিক করছে। খুব সম্ভবত চোখের পানি। সোডিয়ামের উজ্জ্বল আলোয় চোখের পানি গুলো যেন মুক্তোর মতো ঝলঝল করে জ্বলে উঠেছে।

মৃন্ময়ী রিকশা থেকে নেমে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট রিকশাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দিল। বৃদ্ধলোক টাকা হাতে না নিয়ে বিনয়ের ভঙ্গিতে বললেন-

‘আপা আরেকটু অপেক্ষা করতেন! এহনি মনে হয় জাম ছুইট্টা যাইবো।’

‘অনেক দেরি হয়ে গেছে দাদু। তুমি টাকাটা রাখো।’

বৃদ্ধলোকটা টাকা হাতে নিলেন। বাড়তি টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পকেট থেকে টাকা বের করতেই মৃন্ময়ী বলল-

‘টাকা দিতে হবে না, তুমি রাখো পুরোটা। অনেকক্ষন ধরেই তো জ্যামে বসে আছো। ওটা তোমার পাওনা।’

বৃদ্ধলোক মৃন্ময়ীর কথা বলার ভঙ্গিতে মোহিত হলেন। আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন-

‘একলা যাইতে পারবা তো দাদুমনি! ওইদিকের রাস্তাটা কিন্তু নির্জন।’

মৃন্ময়ী অদ্ভুত রকমের এক হাসি দিয়ে বলল-

‘পৃথিবীতে সবাইকে একাই চলতে হয় দাদু। ভালো থেকো।’

মৃন্ময়ী চলে গেল। মুগ্ধ এতক্ষণ যাবত পুরো বিষয়টা লক্ষ্য করেছে। হর্নের শব্দে কথা গুলো শুনতে না পারলেও মৃন্ময়ীর কথা বলার ভঙ্গিতে কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে। মৃন্ময়ী চলে যেতেই খানিকটা অস্থির হয়ে পরে সে। গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল-

‘জ্যামে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। আমি হেঁটেই যাচ্ছি।’

মুগ্ধ আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করল। উদ্দেশ্য সেই মায়াবতী তরুণীকে দেখা। অজানা কারণেই মেয়েটার চোখেরজল দেখে মুগ্ধ’র মাঝে বেশ কৌতুহল জেগেছে। কিন্তু মেয়েটার দেখা পাওয়া গেল না। হয়তো অন্য কোনো গলিতে ডুকে পরেছে।

নির্জন পিচঢালা রাস্তা৷ খানিকটা দূর দূর ল্যাম্পপোস্টের বাতি জ্বলছে। রাত বাতির নিয়ন আলোয় রাস্তাটা পুরোপুরি আলোকিত না হলেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আশপাশ। এই নির্জন গলি দিয়ে মৃন্ময়ী আগে কখনও রাতেরবেলা আসেনি। সব সময় মেইন রাস্তা দিয়েই আসা-যাওয়া করেছে। কিন্তু আজ হেঁটে আসার জন্য এই শর্টকাট রাস্তা দিয়ে আসা। কিছুটা পথ যেতেই এক লোক মৃন্ময়ীর পথ আটকে দাঁড়ালো। দেখতে পেটুক টাইপের। খাটো করে মধ্যবয়সী লোক। কুচকুচে কালো বর্নের চেহারায় বিদঘুটে বিশ্রী হাসি।

‘এক রাতের জন্য নিবা সুন্দরী?’

মৃন্ময়ী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। তার মস্তিষ্ক এই কথাটা বুঝতে কিছুটা সময় নিচ্ছে। এমন বিশ্রী কথাটার মানে বুঝতেই তার গাঁ গুলিয়ে আসলো। ঘৃণার চোখে লোকটার দিকে চেয়ে আছে। মুখ ফুটে কিছু তিক্ত কথা বলার আগে-ই পেছন থেকে পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে আসল।

‘শরীরের তৃষ্ণা মেটাতে চাইলে নি’ষিদ্ধ পল্লিতে যান। কিন্তু দয়া করে রাস্তাঘাটে ঘুরবেন না। এখানে সবাই আপনার মতো ক্ষুধার্ত অবস্থায় আসে না।’

লোকটা ভড়কে উঠল-

‘আপনে আপনের রাস্তায় যান। এত জ্ঞান দিতে আহেন কে?’

মুগ্ধ লোকটার কথা গাঁয়ে মাখালো না। মৃন্ময়ীর দিকে চেয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল-

‘বউ! তুমি একা একাই এসে পরলে কেন? রিকশা ভাড়া দিতে দেরি হচ্ছিল তাই বলে একটু অপেক্ষা করতে পারলে আমার জন্য!’

মৃন্ময়ী অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ সেই চাহনিকে উপেক্ষা করে লোকটার দিকে হাসি মুখে তাকালো। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ধরে রেখেই কঠিন গলায় বলল-

‘যাবেন না-কি পুলিশকে ফোন করতে হবে! আর হ্যাঁ এই রাস্তায় যেন নেক্সট টাইম আপনাকে না দেখি।’

লোকটা ভয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল পাশের চিপা গলিতে। মুগ্ধ তাকালো মৃন্ময়ীর দিকে। স্বাভাবিক লাগছে মেয়েটাকে। এই মুহূর্তে অন্য কোনো মেয়ে হলে ভীষণ উত্তেজিত দেখাতো। কিন্তু এই মেয়েটার ভাবভঙ্গিতে তেমন কোনো কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না। মৃন্ময়ী দৃষ্টি নামিয়ে রেখেই কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিতে ছোট করে বলল-

‘থ্যাঙ্কিউ।’

মৃন্ময়ী পেছনের রাস্তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছে। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে মুগ্ধ নিজেও পেছনে তাকাল। কোনো কিছু দেখতে না পেয়ে সামনে তাকাতেই দেখল মৃন্ময়ী হাঁটা শুরু করেছে। মুগ্ধ ভীষণ অবাক হলো। অচেনা একটা ছেলে তাকে বাঁচিয়েছে এমনকি বউ বলে পরিচয়ও দিয়েছে। অথচ মেয়েটার মধ্যে বিন্দুমাত্র কৌতুহল কিংবা বিস্ময় দেখা যাচ্ছে না!! অদ্ভুত, ভীষণ অদ্ভুত। মুগ্ধ কিছুক্ষন অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে পেছন পেছন হাঁটা শুরু করল। এক পর্যায়ে তারা দু’জন পাশাপাশি চলে আসে। দুজনেই চুপচাপ হাঁটছে। কিছুটা পথ হাঁটার পর মুগ্ধ আপনমনেই বিড়বিড় করে বলে উঠে-

‘সোডিয়ামের আলোয় আলোকিত এই অন্ধকার শহরের আলোর আভা পড়ছে তোমার গায়,
শূন্য মনের অনুভূতি গুলো ভাসছে তোমার ওই সিক্তচোক্ষু দুটায়।’

‘জ্বি! কি বললেন?’

মৃন্ময়ী কপাল কুচকে সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করে। মুগ্ধ অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে মাথা চুলকে বলল-

‘তেমন কিছু না। আসলে আইস ব্রেক করার চেষ্টা করছি।’

‘ওহহ..’

মৃন্ময়ীর মধ্যে কথা বলার কোনো আগ্রহ না দেখে মুগ্ধ হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। ভদ্রতার সঙ্গে প্রশ্ন করে-

‘আপনার নাম কি মিস?’

‘মৃন্ময়ী’

মৃন্ময়ী সামনের দিকে তাকিয়েই নির্লিপ্ত কণ্ঠে নিজের নাম বলল। মৃন্ময়ী দেখতে পায়নি তার সাথের মানুষটার চমকে ওঠা। হঠাৎ করেই মুগ্ধর থমকে যাওয়া। বিস্ময়ে ঝলঝল করে ওঠা মুগ্ধ’র চোখ দুটো। দেখতে পায়নি কোনো কিছুই।

চলবে..??

তনয়া পর্ব-২১(শেষ পর্ব)

0

#তনয়া
#পর্ব-২১(শেষপর্ব)
সিফাতী সাদিকা সিতু

তনু আর মিশকাতের বিয়ে নিয়ে বড়রা প্রায় আলোচনা করলেও এ ব্যাপারে কোনো হেলদোল নেই দুজনের।তনু তো মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। বিয়ে সম্পর্কিত কোনো কথা তার মুখ থেকে শোনা যায় না।কেউ কিছু বললে চুপচাপ শুনে। মিশকাতের মা তো তাড়া দিয়েই চলেছেন।শায়লা বেগম তনুকে প্রতিনিয়ত বোঝাতে গিয়ে হাপিয়ে উঠছেন।তিনি ভেবে পান না মিশকাতকে যদি ভালোবেসেই থাকে তনু তাহলে বিয়েতে রাজি না হওয়ার কি আছে?বিয়ে তো করতেই হবে।একটা সমস্যার জন্য কারও জীবন থেমে থাকে কখনও?সমস্যা থাকলে সমাধানও থাকে।অন্যদিকে তনু নিজের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত।সে মিশকাতের বেড়াজাল থেকে রেহাই পাচ্ছে না।বিয়ের কথা ভাবলেই অন্যরকম একটা ভয়ে কাঁপন ধরে যায়।সাহস কুলায় না।যদি চলতে চলতে মাঝপথে থমকে দাঁড়াতে হয়?নতুন আশা নিয়ে প্রস্বস্ত পথে হাটতে গিয়ে হঠাৎ কাঁটার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়?তখন কি করবে সে?এভাবে নিজেকে সামলাতে পারবে তো?রাঙিয়ে দেয়া স্বপ্ন গুলো যদি কোনো একসময় দুঃস্বপ্নে পরিনত হয়?এসব ভাবনা তাকে দিনরাত তাড়া করে বেরোচ্ছো।কাউকে কিছু বলতে পারছে না।মাঝে মাঝে তো দমবন্ধ হয়ে আসে।দোটানায় দুলে ভালো থাকা যায়?একটা সমস্যার জন্য কি সে কখনও সুখি হতে পারবে না?

মিশকাতের চুপচাপ থাকার কারণ সে মোক্ষম সময়ে কথা বলবে।তনুকে কিছুদিন সময় দিচ্ছে। যত সময় লাগুক না কেন,সমস্যা নেই দিন শেষে তনু তারই হবে।তনু অবশ্য তার সাথে কথা বলে না।সেদিন আয়রা আপার পার্টিতে আরাফ ঠিকই ঝামেলা করেছিল।এ নিয়ে তনুর সাথে মিশকাতের একচোট হয়েছে।তনুকে বলেছিল যাতে কোনোরকম সাজগোজ না করে অনুষ্ঠানে, কিন্তু তনু সে কথা শোনেনি।গাঊন পরে হালকা মেকআপ করে নিজেকে অপ্সরা সেজে ঘুরে বেরোলে আরাফের মনে কুবুদ্ধি তো উদয় হবেই!তনু উজ্জ্বল শ্যামলা হলেও মায়াবি চেহারার অধিকারী।তনুর কাজলদিঘী চোখ দুটোর দিকে তাকালেই শান্ত হয়ে যায় মনটা।ইচ্ছে করে দীঘির শান্ত নিটোল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আজীবন পার করে দিতে।আরাফে সেদিন সবসময় নজরে রেখেছিল সে।তাই তো আরাফ যখন লুকিয়ে তনুর ছবি তুলছিল সেসময় তার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল।আরাফের শার্টের কলার চেপে ধরে সাবধান করে দিয়েছিল।আরাফ শোনেনি বরং মিশকাতকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল।তখনই আসলে ঝামেলাটা শুরু হয়।দুজনের প্রায় মারামারি লেগে যাবার যোগার হয়েছে।মিশকাত নিজেকে কন্ট্রোল করেছে আয়রার শ্বশুর বাড়ির কথা ভেবে।রাফাত নিজ দায়িত্বে আরাফের ফোন থেকে ছবি গুলো ডিলিট করেছিল।তনুর তো লজ্জায়,ভয়ে জান যায় অবস্থা।তাকে নিয়ে এভাবে দুটো ছেলের মাঝে ঝামেলা হচ্ছে ভাবলেই কেমন লাগে?কোথাও একটু শান্তি নেই তার।সেদিন রাগের মাথায় মিশকাত তনুকে থাপ্পড় মেরে বসেছিল।সেই থেকে তনু কেমন নিরব অভিমানে মিশকাতের সাথে সবরকমের সংযোগ কমিয়ে দিয়েছে।মিশকাত আসলে ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকে।ভার্সিটির সামনে দেখলে পাশ কাটিয়ে দ্রুত রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরে।ফোন দিলে কখনও রিসিভ করে না।অবশ্য এই ঝামেলার একটা ভালো দিক হয়েছে। আরাফের বাবা ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে মিশকাত বেশ খুশি।আরাফ দেশে থাকলে সবকিছুতেই ঝামেলা পাকাতো।

আজ শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় মিশকাতকে ডাকা হয়েছে।সবাই তনুদের বাড়িতে এসেছে।ওদের দুজনের বিয়ের ব্যাপারটা আর ফেলে রাখা যাচ্ছে না।দুজনে খাপছাড়া এভাবে অভিমান নিয়ে তো জীবন কাটিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছে।বড়রা তো তা হতে দিতে পারে না।তাই আজ দুজনকেই পাকড়াও করা হয়েছে।শায়লা বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ত।আজ সবার জন্য ভালোমন্দ রাঁধবেন।মিশকাতের মা টুকটাক সাহায্য করেছেন ননদ ভাবীর পুরোনো বন্ধুত্ব ফিরে এসেছে।তানভীর সাহেব একবার তনুর ঘরে আসলেন।তনু বিছানায় বসে আছে।হাতে একটা বই।হয়ত উপন্যাসের কিন্তু তনুর দৃষ্টি বইয়ের পৃষ্ঠায় নেই।বিছানার পাশের খোলা জানালাটার দিকে তাকিয়ে আছে।জানালাটা দিয়ে খোলা আকাশ ছাড়া কিছু দেখতে পাওয়া যায় না।তনুর দৃষ্টি খোলা আকাশের পানে।তানভীর সাহেব তনুর পাশে বসলেন।তনু বইটা বন্ধ করে বলল,

“তুমি বোধহয় কিছু বলতে এসেছো, বাবা?”

“আমি শুধু তোর মতামত জানতে এসেছি।তুই আমার “তনয়া” তোকে এত ভয় পাওয়া মানায় না।”

তনু করুন চোখে চেয়ে রইলো বাবা দিকে।সত্যি সে নতুন সম্পর্কে জড়াতে ভীষণ ভয় পাচ্ছে। বিয়ের কথা ভাবতে গেলেই মনে পরে যাচ্ছে অনেক কিছু।

তানভীর সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,

“দেখ মা সমস্যা থেকে কি কখনও পালিয়ে বাঁচা যায়?যত পালিয়ে বেরোবি সমস্যা তত তোর পিছনে ধাওয়া করবে।তুই একবার ঘুরে দাঁড়া। সমস্যাটার সাথে লড়াই কর দেখবি নিজেকে শক্তিশালী মনে হবে।তোর নামটা আমি খুব শখ করে রেখেছিলাম।সেই নামের মর্যাদাটা তোকে রাখতে হবে।জীবনে সমস্ত ঘাত প্রতিঘাত শক্ত হাতে মোকাবিলা করবি।তোর বাবা তো আছে তোর পাশে কখনও হারতে দেবে না। মিশকাত তোকে সেই পরিস্থিতিতে পরতেই দেবে না।দেখিস না ছেলেটা তোর জন্য গোটা পৃথিবীর সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত। আমার পরে যদি তোকে কেউ খুব ভালোবাসতে পারে সেটা একমাত্র মিশকাতই পারবে!

“সেখানেই তো আমার ভয় বাবা।সেই প্রবল ভালোবাসা বইবার শক্তি যে আমার নেই?সেই ভালোবাসা যদি আমায় কখনও প্রশ্নবিদ্ধ করে বসে আমার অক্ষমতাকে নিয়ে তখন যে আমি ভেঙে গুঁড়িয়ে যাব বাবা!”

তানভীর সাহেব হাসলেন।মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,

“সবাই এক হয় না রে, মা। কিছু কিছু পুরুষ সত্যি হয় যে নিজের সমস্ত সত্তা দিয়ে একজন নারীকে ভালোবাসতে পারে আগলে রাখতে পারে। মিশকাত তেমনি একজন।তোর বাবা তোকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছে না?তুই আজ নিজের যে অক্ষমতার কথা ভাবছিস দেখবি মিশকাত তোর সেই অক্ষমতাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। ”

তনু বাবার বুকে মাথা রাখলো।বলল,

“আমার কি করা উচিত বাবা?”

“অবশ্য রাজি হওয়া উচিত।বেচারাকে আর কত অপেক্ষায় রাখবি।কখন না পাগলামি শুরু করে দেয়!

তনু লজ্জা পেয়ে মুখ লুকোলো বাবার বুকে।মিশকাত ভাইকে কি সে সত্যি সত্যি পেতে যাচ্ছে? তনু কেঁপে উঠলো অজানা শিহরনে।

এরপর গোটা বাড়িতে ধুম পরে গেল আনন্দের।মিশকাতই সবাইকে ধরে ধরে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। মিশকাতের কান্ডে রাফাত মারুফ আয়রা হাসছে।এই ছেলের লজ্জা শরমের বালাই নেই।তনু তো সেই যে ঘরে ঢুকেছে বের হওয়ার নাম নেই।আগামী শুক্রবার ওদের বিয়ে। দুপুরে সবাই খেতে বসে তনুকে ডাকল।

শায়লা বেগম বললেন,

তনু লজ্জায় খেতে আসতে পারছে না। তোমরা সবাই খেয়ে নাও।আমি ওকে সাথে করে খেয়ে নিবো।

মিশকাত খেতে খেতে ভেংচি কাটলো।তনুর আবার লজ্জা!সব ঢং এতদিন তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে আর এখন লজ্জা পাওয়া হচ্ছে?মনে যদি ছিলই তাহলে শুধু শুধু এত কষ্ট করলো কেন সে?তনু কি একবারও বলতে পারলো না মিশকাত ভাই, আমি তোমার হতে চাই! তুমি সব বাঁধা ডিঙিয়ে আমায় তোমার করে নাও!

তনু যদি একবার মুখ ফুটে বলতো সে আরও আগেই সবকিছু জন্য প্রস্তুত হতো।ভাগ্যিস নিজের অভিমান গুলো সরিয়ে সে আয়রা আপার বিয়েতে এসেছিল।তা না হলে তো জানতেই পারতো না!

মিশকাত যাবার আগে একবার তনুর ঘরে এলো।তনু ঘুমোচ্ছে, বিকেলের রাঙা আলো এসে পড়েছে আনকোড়া মুখটায়।মাখনের মতন লাগছে দেখতে।কালোঘন চোখের পাতা গুলো সারিবদ্ধ হয়ে নিশ্চুপে তাকে যেন কাছে ডাকছে।মিশকাত এগিয়ে এলো।তার মনে হলো তনু পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। ঠিক যেন রূপকথার রাজকুমারীর মতো।যার কোনো দুঃখ দূর্দশা, দৈন্যতা নেই।মিশকাত মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলো প্রেয়সীর দিকে।জাগতিক সব নিয়মকানুন ভুলে।সময় যেন থমকে গেছে দুজনের মাঝে।

***

লাল বেনারসি শাড়ি জড়িয়ে তনু বাসর ঘরে বসে আছে।প্রচুর ক্লান্ত সে।বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আছে।বাবা মাকে ছেড়ে আসার কষ্টটা খুব করে পোড়াচ্ছে তাকে।মিশকাত এখনও আসে নি।বাইরে কি করছে কে জানে?ঘুমে দুচোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে।যদিও আজ প্রাপ্তির খাতাটা পরিপূর্ণ। মিশকাত ভাইকে সে আজ থেকে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। গলার কাছে ভারী গহনা গুলো কেমন কুটকুট করছে।

মিশকাত ঘরে ঢুকেই বলল,

“তাড়াতাড়ি সব খুলে ফ্যাল।সময় নেই আমাদের যেতে হবে।”

তনু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো মিশকাতের দিকে।

তা দেখে মিশকাত বলল,

“তোর বিয়ে হয়ে গেল তবু বুদ্ধি বাড়ল না।” শাড়ি গহনা গুলো পাল্টে নে।আমাদের একটু বেরোতে হবে।”

তনুর দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো।দশটার কাটা পার হয়েছে।এত রাতে কোথায় যাবে সে।আর আজ তাদের বাসর রাত।এ রাতে তো কোথায়ও যাওয়ার নিয়ম নেই!

মিশকাত এগিয়ে এলো তনুর দিকে।একটু ঝুঁকে দুষ্টুমি চোখে বলল,

“তুই কি বাসর করার মুডে আছিস?

তনু চট করে উঠে দাঁড়ালো।লাগেজ থেকে একটা সুতি শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমের ঢুকলো জলদি।মিশকাতের মতন সেও মনে মনে আওড়ালো,

“তোমারও তো বিয়ে হয়ে গেল মিশকাত ভাই তবু ত্যাড়ামিটা গেল না!”

মিশকাত তনুর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার স্বপ্নের জায়গায়।ছোট ছোট কয়েকটা নতুন ঘরের সামনে।সবগুলো বেলুন ছোট ছোট লাইট দিয়ে খুব সুন্দরভাবে সাজানো।তনু কাঁপছে তার চোখ ছলছল করছে।যেকোনো মুহুর্তে জল গড়িয়ে পরবে।যতবার সামনে জ্বলজ্বল করা সাইনবোর্ডটা দিকে তাকাচ্ছে ঠিক ততোবার মিশকাতের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরছে।

সাইনবোর্ডে গোটা গোটা কালিতে লেখা,”তনয়ার সুখের নীড়।”

মিশকাত ফিতে কাটার জন্য তনুর হাতে কাঁচি দিলে।তনু কাঁচিটা হাতে নিয়ে মিশকাতকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।মিশকাত তনুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

এখানে যত অনাথ শিশু আসবে সবার “মা” হবি তুই।এটা হবে তোর স্বপ্নের স্থান।একটা দুটো সন্তান জন্ম দেয়ার তোর কোনো দরকার নেই।তুই অনেক সন্তানের “মা” হবি।আমরা সবাই তোর এই পথ চলার পাশে থাকব।

তনু কেঁদেই চলেছে।চোখের পানিতে মিশকাতের শার্ট ভিজে যাচ্ছে। মিশকাত গাঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিলো প্রিয়তমাকে।ওদের শুদ্ধতম ভালোবাসার স্বাক্ষী হয়ে রইলো বিশাল আকাশ ও আকাশের বুকে থাকা একফালি চাঁদ টাও।

সমাপ্ত

তনয়া পর্ব-১৯ও২০

0

#তনয়া
#পর্ব-১৯+২০
সিফাতী সাদিকা সিতু

তনুর হাত ধরে কেঁদেই চলেছে মিশকাতের মা।তনু যে তার ছেলেকে রক্ত দেবে তা কখনও ভাবেন নি তিনি।এতকিছুর পরেও তনু আজ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।অপারেশন থিয়েটারে মিশকাতকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।তনু চুপচাপ বসে আছে।দুব্যাগ রক্ত দেয়াতে খুব দুবর্ল লাগছে।তানভীর সাহেব এক ব্যাগ দিতে বললেও সে কথা মানে নি তনু।সে তো মিশকাতের জন্য নিজের শরীরের সবটুকু রক্তই দিয়ে দিতে পারে।অনেকটা জোর করেই সে দুব্যাগ রক্ত দিয়েছে।এখন মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মিশকাত কে এক নজর দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে। নিজেকে খুব বিধ্বর্স্ত লাগছে।বারবার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে,

“মিশকাত ভাইয়ের কিছু হবে নাতো?” এই আশংকায় ভেতরটা শুকিয়ে গেছে।

অন্যদিকে সবারই একি অবস্থা।হসপিটাল ভর্তি হয়ে গেছে আত্মীয় স্বজনদের।ডাক্তার নার্সরা এ নিয়ে রাগারাগি করেছে বেশ কয়েকবার।আজ মিশকাতকে বেডে দেয়া হবে না।জ্ঞান ফিরলে বিশেষ অর্জারভেশনে রাখা হবে।সকালে কেবিনে শিফট করা হবে।সবাই এখন আপারেশন শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছে।

তনু চোখ বন্ধ করে মিশকাতকে নিয়ে ভাবছে।সিলেটে কাটানো সেই সুন্দর মুহূর্তে গুলো ডানা ঝাপটাচ্ছে চোখের পাতায়।সেই কিশোর বয়সের ভালো লাগা আজ কতটা পূণর্তা পল?!ভালোবাসা আজ জীবন মরন সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে।তনুর গাল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরল।সবার আড়ালে তা মুছেও নিলো।

ঘন্টাখানেক পর ডাক্তার এসে জানালেন, “অপারেশন শেষ হয়েছে। তবে মিশকাতের জ্ঞান ফিরেনি এখনও। পায়ের একটা হাড় ভেঙে গেছে। মাথায়ও চোট আছে।বুকের কাছের জখমটা বেশি ভয়াবহ ছিলো না জন্য মিশকাত আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেছে।তবু সুস্থ হতে অনেকটা সময় লাগবে।”

সকলে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলো।তনুর তো এখনও ভয়ে কাটছে না। বুকের ধুকপুকানি কমছে না।যতক্ষণ না মিশকাতকে নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে ততোক্ষণ সে শান্তি পাবে না।

ধীরে ধীরে অনেকে চলে গেল।তানভীর সাহেব তনু কাছে এসে বসলেন।

“বাড়ি যাবি না,মা?”

“এখন যেতে ইচ্ছে করছে না বাবা।”

“তোর শরীর তো দুর্বল হয়ে গেছে।তোর বিশ্রাম প্রয়োজন এভাবে সারারাত বসে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বি?”

“আমার কিছু হবে না বাবা।আমি এখন বাড়ি যেতে পারব না।সকাল হলে নাহয় চলে যাব।”

তানভীর সাহেব এত কষ্টের মাঝেও নিরবে হাসলেন।তনুর কষ্টটা কোথায় হচ্ছে বুঝতে পারছেন।মিশকাত সুস্থ না হলে তার মেয়েটাও সুস্থ হবেন।মিশকাত হয় আজ শারীরিক ভাবে অসুস্থ কিন্তু তনু,সে তো মানসিক ভাবে জখম হয়েছে!

***
আরাফ সকাল বেলা মিষ্টি নিয়ে এসেছে খালার বাড়িতে।এসে দেখল রাফাত আয়রা দুজনের কেউই নেই। হাসলো আরাফ, থাকবে কি করে?এখন তো ছোটাছুটির সময়।খালাকে জোর করে মিষ্টি খাইয়ে দিলো সে। খালা যখন জানতে চাইলো,

“কিসের মিষ্টি? ”

আরাফ তখন হেসে উত্তর দিলো,

“আমার একটা স্বপ্ন পূরণ হয়েছে খালা।তাই সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে এলাম। তা রাফাত আর ভাবীকে দেখছি না যে?কোথায় গেছে ওরা?”

“আর বলিস না হঠাৎ কি বিপদ!আয়রার মামাতো ভাই এক্সিডেন্ট করেছে, অবস্থা খুব খারাপ ওরা দুজনেই তো ছুটেছে সেখানে।কাল বিকেল থেকেই তো ওরা হসপিটালে।আরাফ ফোন করেছে ওইদিকটা সামলে তারপর আসবে।”

“তাই নাকি,খুব গুরুতর ভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে বোধহয়!”

“ছেলেটার বাইকের সাথে ট্রাকের ধাক্কা লেগেছে।জখম হয়েছে অনেক রক্ত লেগেছে।তার ওপর আবার সেই রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না নেগেটিভ গ্রুপের। ভাগ্য ভালো আয়রার বোনটারও একি ব্লাড গ্রুপ।তাই বেশি সমস্যা হয়নি।”

আরাফ কপাল কুঁচকে ফেলল।আয়রার বোন মানে খালা নিশ্চয় তনয়ার কথাই বলছে!রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল তার।তনয়া কেন রক্ত দেবে মিশকাতকে?এতো দেখি প্রেম উথলে উঠছে!আসলে ভুলটা তারই হয়েছে।বেয়াদবটাকে একদম মেরে দেয়াই উচিত ছিল!

“আচ্ছা, খালা আমি কি যাব একবার হসপিটালে?”

আয়রার শ্বাশুড়ি একটু চমকালেন।আরাফের তনয়াকে নিয়ে এমনিতেই বাড়াবাড়ি করার অভ্যাস আছে।তার ওপর ওখানের পরিস্থিতি এখন ভালো নয়।কি থেকে কি হয়ে যায় বলা যায়!আরাফটা নতুন কোনো ঝামেলা পাকালে আবার সমস্যা তৈরী হবে।তাই তিনি বললেন,

“তোকে যেতে হবে না।তোর বাবা শুনলে রাগ করবে।রাফাতরা তো আজই ফিরবে তখন ওদের কাছ থেকেই ভালোমন্দ শুনিস।”

আরাফ ফিচলেমি হেসে বলল,

“তুমি কি ভয় পাচ্ছো খালা?”

“শোন বাবা,ওখানে তনয়ার পরিবার সবাই আছে।তুই গেলে সবাই অসস্তিতে পরবে।তাছাড়া দুলাভাই শুনলে তোকে সত্যি সত্যি বিদেশ পাঠিয়ে দেবে এবার।”

“হুম ঠিক বলছো।আমার ওখানে গিয়ে কাজ নেই।আমার কাজ তো অনেক আগেই সেড়ে ফেলেছি।”

“কি কাজ তোর, আরাফ?”

“তোমায় বললাম না আমার একটা অনেকদিনের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে সেটাই বললাম। ঠিক আছে তুমি থাকো আমি আসলাম অফিসে যেতে হবে। ”

***

মিশকাতের জ্ঞান ফেরার ঘন্টাখানেক পর কেবিনে শিফট করা হয়েছে।ডাক্তার বেশি লোকজনকে এলাউ করছে না কেবিনে।তাই প্রথমে মিশকাতের বাবা মা গেলেন ছেলেকে দেখতে।মিশকাতের মা ছেলের এমন দুর্বস্থা সহ্য করতে পারলেন না।হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।মিশকাতের বাবা দ্রুত স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।মিশকাতের শরীরের প্রায় জায়গায় ব্যান্ডেজে মোড়া।মাথায় ব্যান্ডেজ,বুকের কাছে অনেক খানি এবং পায়েও ব্যন্ডেজ। মিশকাতের খারাপ লাগছে মায়ের কান্না দেখে।কি করে যে পেছন থেকে ট্রাকটা এসে ধাক্কা দিলো তা বুঝতেই পারেনি।সে তো ঠিকমতই বাইক চালাচ্ছিল!

একে একে সবাই এসে দেখে গেল শুধু তনু ছাড়া।মিশকাতের চোখ জোড়া শুধু তনুকেই খুঁজলো।তনু কি আসে নি তাহলে?

মিশকাত চোখ বুজলো।শরীরের ব্যাথার থেকে মনের ব্যাথায় কাতর হলো।একটা বার কি আসতে পারতো না তনু।এতটা সীমার হতে পারল মেয়েটা?ভালোবাসে যদি তাহলে কি করে এতটা দূরে সরে থাকে?

দরজার মৃদু আওয়াজে চোখ খুলল মিশকাত।তনুকে তার পাশে দেখতে পেল।তনু কেমন নির্লিপ্ত চোখে তার দিকে চেয়ে আছে।হাসলো সে অবশেষে মনোহরিণীর দর্শন মিললো।তৃষ্ণা চোখে ঝর্ণার প্রবলধারা বইলো।

“আমাকে দেখতে খুব খারাপ লাগছে নাকি রে?এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?” মিশকাত মিলিয়ে যাওয়া গলায় বলল।গলার স্বর উঠছে না তার।

“তুমি কি কখনও সিরিয়াস হবা না মিশকাত ভাই?”

“আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমি নাটক করছি।যেন এক্সিডেন্ট এর সিন করছি তাই আমায় এভাবে মেকআপ গেটআপ করে দেয়া হয়েছে।”

তনু দীর্ঘশ্বাস ফেলল।মিশকাত ভাই ভালো হবে না।হসপিটালের বিছানায় শুয়েও ত্যাড়ামি করা ছাড়ল না।

“তুই কি কেঁদেছিস তনু?”

মিশকাতের এমন হঠাৎ প্রশ্নে তনু হচকিয়ে গেল।নিজের ঠাট বজায় রেখে বলল,

“কাঁদব কেন মিশকাত ভাই?কান্না করার মতন কি কিছু হয়েছে?”

“সেটাই তো। তুই তো জানতিস তোদের কাউকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাব না আমি।তোর তো কনফিডেন্স খুব বেশি আমার ওপর!” মিশকাত গদগদকন্ঠে বলল।

“এত কথা বলছো কেন তুমি?ডাক্তার কথা বলতে নিষেধ করেছেন, তুমি বরং ঘুমোও।”

“এতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম তাতে তোদের শান্তি হয় নি? এখন আবার আমায় ঘুমোতে বলছিস?”

তনু মনে মনে কপাল চাপড়ালো।এই ছেলের ত্যাড়ামি কখনও কমবে না।বরং হসপিটালের বিছানায় শুয়ে আরও বেড়ে গেছে।

আমি আসছি মিশকাত ভাই।আমার এখানে বেশিক্ষণ থাকার পারমিশন নেই।

“তোর কি থাকতে ইচ্ছে করছে?ইচ্ছে করলে পারমিশন ছাড়াই থাকতে পারিস!”

তনু মিশকাতের কথার জবাব দিলো না।টেবিল থেকে টিস্যু নিয়ে খুব যত্নে মুখটা মুছে দিলো।এরপর দ্রুত কেবিন থেকে বেড়িয়ে এলো।

মিশকাত তনুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে হাসল।তনুর চোখে তার জন্য কষ্ট দেখতে পেয়েছে।

তনু মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। তানভীর সাহেব ওখানেই রয়ে গেছেন।রাফাতও চলে গেছে আয়রাকে নিয়ে।মারুফ থেকে গেছে সবার সাথে।মিশকাতের মা ছেলের পাশে বসে আছেন।একদিনেই তার শরীর ভেঙে গেছে।ছেলের চিন্তায় তার পাগল হওয়া শুধু বাকি ছিল।একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে ফেললে তিনি আর বেঁচে থাকতেন না।

মিশকাতের কয়েকঘন্টা শুয়ে থেকে বিরক্ত লেগে গেছে।এভাবে শুয়ে থাকলে সবকিছু উল্টে যাবে তার।নতুন চাকরিটা না হারাতে হয়।

“মা,ডাক্তার কি বলল?কতদিন থাকতে হবে এখানে?”

“চুপ করে শুয়ে থাক তো বাবা।যতদিন না সুস্থ হবি ততোদিন তুই এখানেই থাকবি।ডাক্তার তোকে বেশি কথা বলতে নিষেধ করেছেন।”

“আচ্ছা মা,আজ যদি আমার কিছু হয়ে যেত, আমি যদি মরে যেতাম তাহলে কি তনুকে নিয়ে তোমার যে সমস্যা তার কোনো ভিত্তি থাকতো?”

মিশকাতের মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।সত্যি তো আজ যদি ছেলেটাই বেঁচে না থাকত তাহলে এত জেদের ফলাফল কি হতো?

“তুই সুস্থ হয়ে যা বাবা।আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোদের দুজনকে বিয়ে দিবো।তুই যা চাস তাই হবে।কখনও আর মরে যাওয়ার কথা মুখে আনবি না।”

মিশকাত মায়ের দিকে ছলছল দৃষ্টিতে রইলো।স্বপ্ন গুলো কি সত্যি হতে যাচ্ছে?

এরপর কেটে গেছে অনেকটা সময়।মিশকাত পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে।চাকরিতেও জয়েন করেছে।অসুস্থতার জন্য মাস খানেক লিভ নিয়েছিল।পুরোদমে সব কাজ শুরু করে দিয়েছে।আর মাত্র কিছুদিনের অপেক্ষা এরপর তনুর থেকে আর দূরে থাকতে হবে না।আজ অফিস থেকে দ্রুত বেরিয়েছে।এখন সে তনুর ভার্সিটির বাইরে বসে আছে।আজ আয়রা রাফাতের প্রথম বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে আয়রার শ্বশুর বাড়িতে ঘরোয়াভাবে আয়োজন করা হয়েছে।সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান হলেও মিশকাত মারুফকে বিকেলের মধ্যে ডেকেছে।মিশকাত তনুকে নিতে এসেছে।কিছুক্ষণের মধ্যে মারুফও এসে যাবে।তনুকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কারণ হলো আরাফ!বেয়াদব টা নিশ্চয়ই আজকের সুযোগটা ছেড়ে দেবে না।তনুকে আজ সে নিজের সাথে বেঁধে রেখে দেবে ওই বাড়িতে।আরাফকে কোনোরকম সুযোগ দেবে না।

তনু ভার্সিটি থেকে বেরোতেই মিশকাত সামনে এসে দাঁড়াল।বলল,

“দ্রুত চল আমার সাথে।আয়রা আপা বারবার ফোন করছে।”

তনু কপাল কুঁচকে ফেলল।মিশকাত ভাই ইদানীং তাকে বড্ড জ্বালাচ্ছে। বড়মামি সবকিছু মেনে নেয়ার পর থেকেই অন্যরকম হয়ে গেছে।বড়মামির কারণে মিশকাত ভাই অসুস্থ থাকার বেশ বেশ কয়েকবার তাকে মায়ের সাথে যেতে হয়েছে ওদের বাড়িতে।সেই থেকে মিশকাত ভাই পেয়ে বসেছে।তনু এত সহজে সবটা ভুলে যায় নি।সে যে বিশেষ একটা ব্যাপারে অক্ষম তা যতই কেউ ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করুক না কেন সত্যি টা তো মিথ্যা হয়ে যাবে না।সে তো সত্যি কোনোদিনও মা হতে পারবে না!এই চিরন্তন কথাটা তার জীবনে দিনের আলোর মতন স্বচ্ছ। এত সহজে যদি সব ঠিক হয়ে যেত তাহলে এত কষ্টের কিছু ছিল না!

“মিশকাত ভাই,আমি বাবার সাথে সন্ধ্যায় যাব আপার বাড়ি।তোমরা চলে যাও।”

ফুপা আমায় বলেছে,”তোকে নিয়ে যেতে।এত ভাব না নিয়ে তাড়াতাড়ি আয়।তোর সাজগোজ নিয়ে ভাবতে হবে না কারণ আজ তোকে আমি সাজতে দেব না।যেমন আছিস ঠিক সেভাবেই আজ অনুষ্ঠানে থাকবি।আপার বাসায় গিয়ে মুখটা ধুয়ে নিবি।”

তনু হা হয়ে তাকিয়ে রইলো মিশকাতের পানে।কি বলতে চাইছে বোঝার চেষ্টা করলো।এক্সিডেন্ট এর পর বোধহয় মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে বেচারার!

চলবে..