Thursday, July 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1091



তনয়া পর্ব-১৭ও১৮

0

#তনয়া
#পর্ব-১৭+১৮
সিফাতী সাদিকা সিতু

আয়রা প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে বুঝিয়ে যাচ্ছে অথচ তনুর কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। মায়ের ফোন পাওয়ার পর থেকে তনু অস্থির হয়ে আছে। রাফাত কাল সকালের টিকিট কেটেছে।দ্রুত ঢাকা ফিরতে হবে।ফিরেই সোজা গিয়ে আরাফের গালে কষে একটা চড় বসাবে।অতিরিক্ত করে ফেলেছে সবকিছু। কি প্রয়োজন ছিল তনুর আর মিশকাতের সম্পর্ক নিয়ে আজে বাজে কথা বলার?ওরা নিজেরাই নিজেদের নিয়ে ভাবে না মাঝখান থেকে আরাফ ঝামেলা তৈরী করলো।

মিশকাত নিবির্কার ভঙ্গিতে বসে আছে সোফায়।দেখে বোঝা যাচ্ছে সে খুব ভালো মুডে আছে।সেজন্যই বোধহয় আয়েশ করে ফোনে গেম খেলছে।বরং বোঝা যাচ্ছে তনুর ফোঁপানোর আওয়াজে বিরক্ত হচ্ছে সে।মনোযোগ হারাচ্ছে এবং সেই বিরক্তিটা সে প্রকাশ করছে।এতে তনুর কষ্টের থেকে রাগটা বেশি হচ্ছে। সব হয়েছে এই বদমাশ মিশকাতের জন্য। এই জন্যই সে এতদিন এড়িয়ে চলেছে।কিন্তু কি হলো, শেষে এসে সেই একি ঘটনার সম্মুখীন হতে হলে।এতদিন ধরে এত কষ্ট সব বানচাল করে দিলো মিশকাত ভাই।তনু মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিলে ফেলল,মিশকাত ভাইকে সে সময় মতন কঠিন কোনো শাস্তি দেবে!

তানভীর সাহেব মিশকাতকে ফোন করছে।তাই মিশকাত ইশারায় রাফাত কে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

“কি হয়েছে মিশকাত,তোর ফুপি এত রেগে আছে কেন তোর আর তনুর ওপর?”

“ফুপি সব জেনে গেছে যদিও যা জেনেছে তা আংশিক সত্যি, বাকিটা বানোয়াট।”

“সেটা আমি জানি।কি হয়েছে সেটা আগে বল?”

“তুমি রাফাত ভাইয়ের থেকে শুনে নাও।” মিশকাত ফোনটা রাফাতকে এগিয়ে দিলো।

রাফাত ধীরে ধীরে সবটা বলল তানভীর সাহেবকে।সব শুনে তিনি বললেন,

“এগুলা কোনো ঝামেলা হলো?বরং ভালোই হলো সবারই জানা দরকার।আমি মিশকাতের বাবার সাথে কথা বলব। আমার বিশ্বাস ও কথাগুলো শুনে অনেক খুশিই হবে। তোমরা সাবধানে ফিরে এসো।”

রাফাতের একটু হালকা লাগলো।ফিরে গিয়ে শুধু আরাফের মুখোমুখি হওয়া।কবে যে এত বেয়াদব হয়ে গেল ছেলে?আগে তো ভালোই ছিল,এরকম ডেস্পারেট তো ছিল না কখনও!

ডিনার সেরে ওরা সবাই রুমে ফিরে এলো।মারুফ মিশকাত ওদের রুমে চলে গেল।আয়রা তনুকে চিন্তা না করে ঘুমোতে বলে নিজের রুমে চলে গেল।শান্তাও শুয়ে পরল তনুর পাশে।দুজনেই টুকটাক গল্প করছে যদিও তনুর মাথায় বিভিন্ন ভাবনা ঘুরছে।শান্তা একসময় ঘুমিয়ে পরলেও তনুর চোখে ঘুম নামল না।ঠিক রাত বারোটার সময় তনুর ফোনে মেসেজ আসলো,

“আমি তোর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”

তনু দীর্ঘশ্বাস ফেলল।এটার মানে তনুকে এখন দরজাটা খুলে দিতে হবে।তনু বিছাড়া ছাড়ল। বিরক্তি চেপে রেখে দরজা খুলতেই মিশকাত টেনে নিয়ে গেল তাকে।আকস্মিক এমন কান্ডে তনু হা হয়ে গেছে।সেই সুইমিংপুলের ধারে নিয়ে এসেছে মিশকাত।তনু মনে মনে কয়েকটা ফাঁকা ঢোক গিলল।তাকে কি আজও পানিতে চুবাবে মিশকাত ভাই!তনু ভয়ে ভয়ে সিদ্ধান্ত নিল সে একটা ভোঁদৌড় দেবে।তাই মনে মনে প্রস্তুতি নিতে চোখ বন্ধ করলো।ভাবলো এবার সে বিসমিল্লাহ বলে দৌড় দেবে কিন্তু তার আগেই বাহুতে টান পরল।সামনে তাকাতেই তার চক্ষু ছানাবড়া হবার যোগার হলো।সবাই দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।কি সুন্দর করে সাজানো সবকিছু।ছোট একটা টেবিল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো।তার ওপর সুন্দর একটা কেক।কেকটায় লেখা “শুভ জন্মদিন তনয়া”।

তনু নিজের জন্মদিনটাও ভুলে গেছে অথচ সবাই মনে রেখেছে।সবাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো শুধু মিশকাত ছাড়া।মিশকাত সরে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা হাই তুলে বলল,তাড়াতাড়ি কেটে ফ্যাল ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।

মারুফ বলল,

“তুই তনুকে উইশ করলি না?”

আমার শুধু ওকে ডেকে নিয়ে আসার দায়িত্ব ছিল।এখন তোরা যা খুশি কর।আমায় শুধু কয়েক পিস কেক দিস তাহলেই হবে।সবাই ঠোঁট চেপে হাসলেও তনু বুঝে গেল এসব আয়োজন মিশকাত ভাই করেছে।কিন্তু খুশি হতে পারল না। ইদানীং মিশকাত ভাইয়ের জন্য দীর্ঘশ্বাস টা বেশি হয়ে যাচ্ছে!

***

মিশকাত বসে আছে বাবা মায়ের সামনে।যদিও সে মায়ের সাথে তনুকে নিয়ে কোনো আলোচনা করছে না।বাবাকেই সবটা বলছে।সেই শুরু থেকে প্রতিটা বিষয় বুঝিয়ে বলছে।তনুর আর তার কখনোই কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠে নাই।কিন্তু তবুও ওরা দুজন দুজনে ভালোবাসে।এই জটিল সমীকরণ টা বুঝিয়েছে। মিশকাতের মা কিছু বলে নি শুধু শুনেছে চুপ করে।তিনি তো জানেন তনু আর তার ছেলে কোনো সম্পর্কে এগোয়নি।কিন্তু এতদিন পরে এসেও যে তার ছেলে তনুতে আঁটকে থাকবে তা সত্যি ভাবতে পারেন নি।তনু তো নিজের জায়গায় ঠিক আছে অথচ তিনি নিজের ছেলেকে ধরে রাখতে পারলেন না।তিনি তো একজন মা।তনুকে ভালোবাসলেও ছেলের বউ করে আনার কথা ভাবতেই পারেন না।মিশকাত কখনও বাবা হতে পারবে না তনুকে বিয়ে করলে।মিশকাত এখন না বুঝলেও ঠিক একদিন কষ্ট পাবে এ নিয়ে। তখন তিনি ছেলের কষ্ট কিভাবে কমাবেন?আবেগে ভেসে গিয়ে তো তিনি হুজুগে মাততে পারেন না?

মিশকাতের বাবা বললেন,

“এখন তাহলে তুই কি করতে চাচ্ছিস?”

“আমি তনুকে বিয়ে করতে চাই বাবা তবে সেটা এখনই নয়।তুমি শুধু কথা গুলো ফুপিকে বুঝিয়ে বললেই হবে।”

“এখন বিয়ে করতে চাচ্ছিস না ভালো কথা।কিন্তু বিষয়টা তো এভাবে ফেলে রাখলে হবে না? এর একটা সমাধানে আসতে হবে।”

“সমাধান করলেও কিছু হবে না বাবা।তনু বেঁকে বসবে আর মা তো আছেই!”

“তোর মা বেঁকে বসবে কেন?”

“কারণ তনুর সাথে বিয়ে হলে তোমার ছেলে কখনও বাবা হতে পারবে না।” মিশকাতের মা এবার বলে উঠল।

“আশ্চর্য!সেটা তো আমিও জানি।আমি নিজেই তো তনুর সাথে হসপিটালে ছিলাম তোমায় আর নতুন করে সে কথা আমায় শোনাতে হবে না।”

“মিশকাতের বাবা তুমি কি বুঝতে পারছো?”

“কি বুঝতে বলছো?”

মিশকাত বাবা মায়ের কাছ থেকে উঠে দাঁড়াল।সে সবটা বলে দিয়েছে এখন মা বাবই ঠিক করুক আর সে নিজে তো আছেই অন্যদিক গুলো সামাল দেয়ার জন্য। মিশকাত নিজের ঘরে যেতে যেতে ভাবলো,

তনুর জন্য তাকে কতকিছুই না করতে হচ্ছে। এর থেকে পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো সহজ ছিল।সময় আসলে সব সুধে আসলে ফেরত নেবে সে।বড্ড জ্বালিয়েছে তনু,এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

“তোমার বোনের মেয়ে জন্য কিছুই চোখে পড়ছে না, তাইনা?”

“তনু যদি তোমার বোনের মেয়ে হতো তবুও আমি একি কথা বলতাম।শোনো মিশকাতের মা,সন্তান দানের মালিক সৃষ্টিকর্তা।তা নিয়ে তুমি ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারো না।ছেলে মেয়ে গুলো সুখি হলে আমরাও সুখি।বিয়ের পর দেখা যাবে কি হয়?দরকার হলে বাচ্চা দত্তক নেবে ওরা।এতে খারাপের কিছু নেই।তুমি নিজে তো একজন নারী,একজন মা একটু ভেবে দেখত জন্মদিলেই কি শুধু মা বাবা হওয়া যায়।একটা সন্তানকে কতটা কষ্ট করে মানুষ করতে হয়?তাই বলছি একটু ভেবে দেখ,তোমার কি মনে হয় মিশকাত এতদিন পরে এসেও যখন তনুকে ভুলতে পারছে না সবটা জানার পরেও তখন তোমার অমতে কতটা কষ্ট পাচ্ছে।ছেলেটা তোমার তুমি ওকে ভালো জানো।তোমার মতামত ছাড়া ও কিছুই করবে না যতই কষ্ট হোক না কেন।তাহলে তুমি কি চাইবে মিশকাত সারাজীবন কষ্টে থাকুক?” মিশকাতের বাবা কথা গুলো বলে থামলেন।একবার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন।মিশকাতের মা উঠলেন না। বসে থেকে স্বামীর বলা কথা গুলো ভাবতে লাগলেন।সত্যি কি তিনি কোনো ভুল করছেন?

***
সময় পেরিয়েছে অনেকটা।শায়লা বেগম স্বামীর কাছে সবটা শোনার পর তনুকে কোনো বকাবকি করেন নি।বড়ভাইও সবটা বুঝিয়ে বলেছেন।তবে সেদিনের পর থেকে তার দুশ্চিন্তা বেড়েছে।একে তো তনু বিয়ে করতে চায় না তার ওপর মিশকাতকে ভালোবাসে।এই মেয়ের ভবিষ্যতে কি হবে কে জানে?তনু অবশ্য নিয়মিত ভার্সিটিতে যাচ্ছে,বাসায় থাকলে মায়ের সাথে টুকটাক কাজে সাহায্য করছে, আয়রা ঘুরতে এলে বোনের সাথে আনন্দ করছে, তন্ময়কে রাতে নিয়মিত পড়াচ্ছে সব মিলিয়ে তনু বেশ ভালো আছে।এখন সবাই ওর ব্যাপারটা জেনে যাওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।নিজেকে আর আগের মতন গুটিয়ে নেয় না।এর মাঝে কেটে গেছে অনেকটা সময়।সিলেটে কাটানো সুন্দর স্মৃতি গুলোতে ধুলো জমতে শুরু করেছে। সবাই ব্যস্ত সময় পার করছে।মিশকাতের সাথে প্রায় সাত আটমাস ধরে দেখা হয় না তনুর।অবশ্য তনু সেসব নিয়ে ভাবেও না।যেমন চলছে চলুক না ক্ষতি কি?

অন্যদিকে আরাফকে রাফাতই বাড়াবাড়ি করতে দেয়নি।প্রথমদিকে আরাফ তনুর কলেজ পর্যন্ত চলে আসতো পরে রাফাতের সহযোগিতায় সবটা সামলে নেয়া গেছে।আরাফের বাবা ছেলেকে কঠিন বাঁধনে বেঁধে ফেলেছেন।বাড়ি এমনকি ব্যবসা থেকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন।আরাফকে তিনি দুটো অপশন দিয়েছিলেন, তনুর ব্যাপারে সব ভুলে যাওয়া আর নাহয় বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া।আরাফ জানে বাবা তাকে বিদেশ পাঠালে সে সহজে ফিরতে পারবে না তাই চুপচাপ সবকথা মেনে নিয়েছিল।

মিশকাতের একটা বেশ ভালো চাকরি হয়েছে।এত তাড়াতাড়ি সে চাকরি পেয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি।অবশেষে সে নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোতে পারবে।অনেকটাই শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। তার পরিকল্পনার কথা শুধু রাফাত আর মারুফ ছাড়া কেউ জানে না।মিশকাতের চাকরি পাওয়ায় তার বাবা মা খুব খুশি।মিশকাতের মা ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে শুরু করেছেন গোপনে।ছেলেকে তনুর থেকে দূরে সরাতে তিনি ভালো পাত্রীর খোঁজ করছেন।মিশকাতের বাবাকে না জানিয়ে সবটা করছেন।সবাই সবার ভাবনা চিন্তায় ব্যস্ত কিন্তু মিশকাত আর তনুর যে আত্মার সম্পর্ক তা দিন দিন যেন গভীর হচ্ছে। মিশকাত আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তনুর কাছাকাছি পৌঁছোনোর জন্য।
যতদিন যাচ্ছে তনুর থেকে দূরে দূরে থাকতে ততো কষ্ট হচ্ছে। মিশকাতের বাবা তো প্রায় তানভীর সাহেবের সাথে আলাপ করেন ছেলে মেয়ে দুটোকে নিয়ে।ওরা কি করতে চাইছে সেটাই বুঝে উঠছেন না কেউই।

***

ইদানীং প্রচুর গরম পরেছে।তনু আছরের নামাজ আদায় করে একটু ছাঁদে উঠল।হাতে ছোট বালতি মগ।উদ্দেশ্য ফুলের গাছ গুলোর একটু পরিচর্যা করা।এখন সে ছাঁদে বেশি সময় কাটাতে পারে না।ভার্সিটি থেকে ফিরে খেয়ে ঘুমিয়ে পরে।সন্ধ্যায় উঠে নাস্তা বানায় মাঝে মাঝে।তন্ময়কে পড়ায়,ছেলেটা এবার নাইনে উঠল।এই সময় পড়ায় ফাঁকি দিলে রেজাল্ট ভালো হবে না।তাই তনু নিয়মিত ধরে বেঁধে পড়তে বসায়।এরপর নিজে একটু পড়াশোনা করে।রাতে তানভীর সাহেব ফিরলে সবাই মিলে গল্প করে আড্ডা দেয়।আজ ভার্সিটি বন্ধ থাকায় সকালেই ভেবে রেখেছিল ছাঁদে কিছুক্ষণ সময় দেবে। সে সাথে হুমায়ুন আহমেদ এর ময়ূরাক্ষী উপন্যাস টাও নিয়ে এসে।তনুর অবশ্য হিমু চরিত্র কে ভালো লাগে না তবে ময়ূরাক্ষী বইটা তার খুব প্রিয়।সে সময় পেলেই বারবার পড়ে।তনু বালতিটা নামিয়ে রেখে ওরনাটা ভালো ভাবে পেঁচিয়ে নিলো।সবগুলো গাছে পানি দেবার আগেই তন্মায় হাঁপাতে হাঁপাতে ছাঁদে দৌড়ে এসে বলল,

“আপা, মিশকাত ভাই এক্সিডেন্ট করেছে!হাসপাতালে আছে অবস্থা খুব খারাপ তুমি তাড়াতাড়ি নিচে আসো মা কাঁদছে। ”

তনুর কোনো ভাবান্তর হলো না।শুধু হাতে থাকা বালতিটা পরে গেল।নোংরা পানি দিয়ে পরনের জামাকাপড় ভিজে গেল।সেদিকে খেয়াল না করে শুধু অস্পষ্ট গলায় বলল,

“তুই যা আমি আসছি।”

হসপিটালের করিডরে বসে কান্নায় অস্থির হয়ে আছে মিশকাতের মা।তার পাশেই বসা শায়লা বেগমও কাঁদছেন। সবাই এসেছে গেছে।রাফাতও আয়রাকে নিয়ে এসেছে।মারুফ আর রাফাত ছোটাছুটি করছে রক্তের জন্য। মিশকাত বাইক এক্সিডেন্ট করেছে।মারাত্মকভাবে যখন হয়েছে।রক্ত লাগবে জরুরি ভিত্তিতে।সমস্যা হচ্ছে ও নেগেটিভ রক্ত আপাতত কোথাও মিলছে না।ডোনার যোগার করতে সবার গলদ ঘাম হচ্ছে। টেনশনে সবার অবস্থা খুব খারাপ।সন্ধ্যার মধ্যেই রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে।রাতে মিশকাতের অপারেশন। মিশকাত এখনও অজ্ঞান।

তানভীর সাহেব ঢাকার বাইরে ছিলেন কাজে। রাফাতের কাছে মিশকাতের খবর পাওয়ার সাথে সাথেই ঢাকায় ফিরছেন এবং সেই সাথে সবাইকে আস্বস্ত করেছেন, রক্ত পাওয়া গেছে কোনো সমস্যা হবে না।তিনি সব ব্যবস্থা করছেন।

বাবার কথা শুনে আয়রার চট করে মনে পরে গেল,তনুর ব্লাড গ্রুপ ও নেগেটিভ!এত চিন্তায় এতক্ষণ মনেই আসে নি। আচ্ছা, বাবা কি তনুর কথাই বোঝাতে চাইছে?আয়রার মনটা হঠাৎ শান্ত হয়ে আসলো।সে যা ভাবছে তাই যদি হয় তাহলে অনেক কিছুই পাল্টে যাবে।

তানভীর সাহেব বাড়ি ফিরে দেখলেন সমস্তবাড়ি অন্ধকারে ডুবে আছে।তানভীর ধীরে ধীরে তনুর ঘরের দিকে এগোলেন।তনুর ঘরটাও পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে আছে।তিনি ঘরের লাইট জ্বালালেন।তনু বিছানায় ঠেস দিয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে।চোখ গুলো লাল হয়ে আছে।চুলগুলো সব উসকোখুসকো ।তানভীর সাহেব অবাক হলেন।এতটুকু সময়ের মধ্যে মেয়েটার একি অবস্থা হয়েছে!সকালেই তো বেশ হাসিখুশি মেয়েটাকে দেখে বের হয়েছেন।তিনি তনুর মাথায় হাত রেখে ডাকলেন,

“তনয়া?”

তনু না তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,”তোমার এখন হসপিটালে যাওয়া দরকার বাবা। তুমি বাড়িতে এসেছো কেন?”

“আমার থেকেও তোর যাওয়াটা বেশি প্রয়োজন যে, মা!”

“আমি যাব না বাবা।সবাই তো আছে।তুমিও চলে যাও আমি একদম ঠিক আছি।”

“সেটা তো আমি দেখতেই পাচ্ছি।চল একটু ফ্রেশ হয়ে নিবি।আমরা এক সাথে যাব।”

“প্লিজ বাবা জোর করো না,আমি যাব না।”

“মিশকাতের জন্য না হয় না গেলি।কিন্তু মা, হসপিটালে যে একজন মুমূর্ষু রোগী আছে এমুহূর্তে তার ও নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন। সৃষ্টিকর্তা যে তোকে উসিলা করে দিয়েছেন।এবার তুই কি যাবি না?”

তনু কেঁপে উঠলো। অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালো।তার একটুও বুঝতে অসুবিধা হয়নি বাবা কি বলতে চাইছে!সে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।

***
আরাফ খুশিমনে বাড়িতে ফিরলো।তার পরিকল্পনা এভাবে সত্যি হয়ে যাবে এতটাও আশা করেনি সে।যা ভেবেছিল তার থেকে দ্বিগুণ হয়েছে।অবশেষে মনের সমস্ত রাগ ক্ষোভ গুলো কেটে গেছে। কিছু তো তাকে করতেই হতো।সারাজীবন সবকিছুতে টপে থাকা ছেলেটা এত সহজে কি করে হেরে যাবে?এটা কি মেনে নেয়া সম্ভব? হাসলো আরাফ, বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো।এখন একটা লম্বা শান্তির ঘুম দেবে।অনেক রাত সে ঘুমাতে পারেনি ঠিক মতো।

চলবে..

তনয়া পর্ব-১৬

0

#তনয়া
#পর্ব-১৬
সিফাতী সাদিকা সিতু

আরাফের রাগী মুখটা দেখে মিশকাত মনে মনে একচোট হেসে নিলো।বেচারা রাগে টগবগিয়ে ফুটছে!বেলা এগারোটা বাজে।সকালের নাস্তা শেষ করে সবাই রাফাতের ঘরে জড়ো হয়েছে আরাফের জন্য।সকলে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে আরামে।কারও মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। আরাফের সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে।

অবশ্য তনু লজ্জা পাচ্ছে সেই সাথে বিরক্ত হচ্ছে। মিশকাত এবং আরাফ দুজনেই চরম অসভ্য।তনুর ভালো লাগছে না এত সুন্দর জায়গায় এসে দুটো ফাজিলের সাথে সারাক্ষণ থাকতে। সত্যি দুটোই অসহ্যকর!কিন্তু কিছুই করার নেই।একটু পরেই ওরা বের হবে ঘুরতে।অথচ আরাফ সেই পুরোনো কাসুন্দি নিয়ে বসেছে।যা খুব বিরক্তিকর! আজ নিশ্চয়ই এসব কথার মাধ্যমে মিশকাত ভাই সবটা জেনেই যাবে?সুইমিংপুলের ব্যাপারটা নিয়ে এমনিতেই লজ্জায় কাবু হয়ে আছে সে।তখন যেন ঘোরের ভেতর ছিল।মিশকাতকে ছেড়ে উঠে আসতে পারছিল না।

“প্লিজ তোমরা সবাই একটু বলবে আমায়?”

“কি বলব আমরা? বলার মতন কি আছে সবটাই তো সবার জানা।”রাফাত অলস ভঙ্গিতে জবাব দিলো।

” আমাকেও জানতে হবে?তনয়া তো নিজে বলবে না, তাহলে তোমরা কেউ বলো?”

“তনু না বলুক আমি তো বলতে পারি?তুমি আমায় জিজ্ঞেস করে দ্যাখ?”মিশকাত সোজা কথা বলে বসলো।

আরাফ রাগটা সামলে নিয়ে বলল,

“তাহলে বলো?”

“অবশ্যই বলব। তবে এখানে নয় বাইরে এসো আমার সাথে।সবাই সবটা জানলেও এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায় না এমন খোলামেলা ভাবে।”

“বাইরে কোথায় যাব?এখানে কেন বলা যাবে না?আমি তো তনয়ারর থেকেও সবটা শুনতে চাই।আমায় ওর দুর্বলতার দোহাই দিয়ে সরিয়ে রেখেছে অথচ ঠিকি তোমার সাথে..!”

তনু শিউরে উঠল।আরাফ কেমন ভাবে কথাটা বলল?পুরোপুরি শেষ করল না কেন?কি বোঝাতে চাইছে আরাফ?

“রাফাত ভাই তোমার ভাইকে চুপচাপ আমার সাথে বাইরে আসতে বলো।শুধু শুধু তনুকে যেন এসবের মধ্যে টেনে না আনে?”মিশকাতের কথায় রাগের বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট। তাই রাফাত দ্রুত বলল,

“আরাফ তোর সবটা জানা দরকার তাই তো, তাহলে এতো ঝামেলা কেন করছিস?মিশকাতের কাছেই সবটা জানতে পারবি।আমিও বলছি এসবের মাঝে তনুর কোনো ভূমিকা নেই। তাই, প্লিজ তুই তনুকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করবি না।”

আরাফ চোয়াল শক্ত করে দাঁড়াল। হিসহিসিয়ে বলল,

“কোথায় যাব?”

“সেই সুইমিংপুলের কাছেই চলো!”

মিশকাতের এমন কথায় বাকিরা মুখ টিপে হাসলেও আরাফ হনহনিয়ে চলে গেল।মিশকাত একবার তনুর দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে সেও চলে গেল ঠোঁটের কোণে ফিঁচেল হাসি নিয়ে।

ওদের যাওয়ার পর সবাই জোরে হেঁসে উঠল।তনুর তো অবস্থা খারাপ লজ্জায়।আসলে ভোরবেলা আরাফ ওদের দুজনকে সুইমিংপুলের ধারে দেখেছিল এসে।মিশকাত তখন তনুর হাত চেপে ধরে ছিল।খুব কাছাকাছি দুজনে থাকায় আরাফ উল্টো পাল্টা ভেবে বসেছে।

রাফাত সবাইকে তাড়া দিলো জলদি তৈরী হয়ে নিতে।আজ ওরা অনেক জায়গায় ঘুরবে।রাফাত একটা ব্যাগে সবার এক্সট্রা জামাকাপড় নিতে বলেছে।সেই সাথে শুকনো খাবার, পানি তো আছেই।ঘুরতে গেলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে রাখলে ভালো হয়।অচেনা জায়গায় কোনো বিড়ম্বনায় পরতে হয় না।

সবাই দ্রুত তৈরী হয়ে এসে দেখল,আরাফ ব্যাগ নিয়ে রেগে বেরিয়ে গেল।রাফাত দুএকবার আটকানোর চেষ্টা করলেও তেমন জোর করলো না।যা হবার হবে, ঢাকায় ফিরে সবটা সামলে নেয়া যাবে।মিশকাত নিশ্চয়ই সব বলেছে। আরাফ রাগের মাথায় সবকিছু নিয়ে আবার বাড়াবাড়ি না করে বসে?রাগের সময় তো মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।অথচ এই ট্যুরটা নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না।আরাফের এমন হুট করে আসা আবার হুট করে চলে যাওয়ায় অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে সেই সাথে তনুর মন খারাপ হয়ে গেছে।পরিস্থিতিটাই পুরো অন্যরকম এখন।তবু সবাই গাড়িতে বসলো জাফলং এর উদ্দেশ্যে।যাওয়ার পথেই সবার মন ফুরফুরে হয়ে গেল।যখন ওরা প্রকৃতি কন্যার কাছে পৌঁছুলো তখন কেউই আর সকালের ব্যাপারটা মনে রাখলো না।অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। স্বচ্ছ পানির ধারা পাহাড় আর নদীর কি অপূর্ব সংযোগ। পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানিতে পা ভেজাতে তনুর মনটা ছটফট করছিল।সে শান্তা আয়রাকে ডেকে এনে পানিতে নামলো।রাফাত মারুফ এসে ওদের কাছে পাথরের ওপর বসলো।

মিশকাত শুধু দূরে ওদের থেকে।ও নিজের মতন ঘুরছে।আসলে ঘোরাঘুরির ফাঁকে তার দুঃচিন্তাও হচ্ছে অনেকটা।তাই একটু ভাবছে।আরাফ কেমন রেগে মেগে চলে গেল, ছেলেটা নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকবে না?ওর মাথায় এখন তনু চেপে বসেছে এত সহজে তা নামবে বলে মনে হয় না।আরাফকেই বা কি দোষ দেবে তার নিজেরই তো একি অবস্থা। এত বছরেও তনুকে তো ভুলতে পারে নি।এমনকি তনুর সত্যিটা জানার পরে আরও বেশি ভালবাসা বেড়ে গেছে।তনুদের বাড়ি থেকে চলে আসার আগের রাতে তনু যখন ছাঁদে জ্বরের চোটে জ্ঞান হারিয়েছিল তখন তনুকে নিচে নিয়ে এসেছিল মিশকাত।অচেতন তনুকে ঘরে শুয়ে দিতে এসে বালিশের নিচে লেখা খাতাটা পেয়েছিল সে।তনুর পাশে বসে সবটা পড়েছিল।সেদিন যেন জীবনের মানেটাই অন্য হয়ে গিয়েছিল।সেদিনের কথা ভাবলে এখনও তার চোখের কোণে জল আসে।সবথেকে বেশি কষ্ট হয়েছিল তনুর কথা ভেবে।একজন নারী মা হতে পারবে না এটা খুব একটা সাধারণ ব্যাপার নয়।সবকিছু নীরবে সয়ে এসেছে মেয়েটা। তনয়া নামের অর্থই তো নারী।সেই নারীর স্বার্থকতা থেকে বঞ্চিত! অথচ এখানে কিছুই করার নেই।সৃষ্টিকর্তা না চাইলে কখনও এই স্বার্থকতা সম্ভবও নয় কিন্তু সে জন্য তনু তো অপরাধী হতে পারে না?তাছাড়া এসবে যে নিজের মায়ের একটা ভূমিকা আছে তা জেনে সত্যি অবাক হয়েছিল।অথচ ছোট থেকে দেখে আসছে তার মা তনুকে খুব আদর করতো।আয়রা আপা খুব বেশি আসত না তাদের বাড়িতে ফুপিকে ছাড়া।তনুই তন্ময়কে নিয়ে প্রায় আসতো।কিছুদিন থেকে যেত।তখন তনুর সাথে ওর মায়ের বন্ধন টা কত সুন্দর ছিল!অথচ শুধুমাত্র মা হতে পারবে না জন্য তনু নিজের ছেলের ভালোবাসা জেনেও এভাবে দূরে সরিয়ে রেখেছে।অবশ্য মায়ের এতে দোষ নেই।শুধু তার মা কেন সমাজের সবাই একি কাজ করবে।সমস্যাটা তো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির।একটা প্রকৃতিগত সমস্যা বড় হয়ে যায় বাকি সব চোখে পড়ে না।তখন রূপ গুন কিছুই কাজে আসে না।এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।মিশকাত তারই চেষ্টা করে চলছে।সবটা ধীরে ধীরে গুছিয়ে আনছে।কিন্তু তার আগেই যদি আরাফ বাড়াবাড়ি করে তাহলে একটু ঝামেলা তৈরী হবে।ঝামেলা মুলত দুজন করবে।মা এবং তনু!এনারা কেউ সমঝোতা করবে না।তনু এই দোহাই দিয়ে সবসময় দূরে ছিল এবং থাকছে।কারণ বড়মামি কখনও মেনে নেবে না কথা টা সে খুব ভালো ভাবে মাথায় গেথে নিয়েছে।অন্যদিকে নিজের মা ছেলের জন্য তনুকে বউ করবে না।এই দুজনকে অন্যরকম ভাবে সামলাতে হবে!মাঝখান থেকে আরাফ নামের উৎপাত।সব হয়েছ ওই তনুর জন্য। যেমন হেসে হেসে কথা বলেছে এখন বুঝুক মজা!সে তো ঝামেলা পাকিয়ে ঠিকি ভাব দেখিয়ে চুপচাপ আছে।সব এখন তাকে সামলাতে হবে!

“তুমি আরাফের কথা ভাবছো?”রাফাত এসে পাশে দাঁড়াল।

“হুম,ভাবছি ফিরে গিয়ে কি করবে?আমি সত্যি সুন্দর ভাবে সবটা বুঝিয়ে বলেছি। তনুর যদি ওই সমস্যা টা না থাকত তবে এতদিন আমাদের সম্পর্কের বয়স পাঁচ বছর হতো।আরাফ বুঝতে চাইলো না তনু আমায় ভালোবাসে।”

“রাগের সময় মানুষ ভুল করে বসে।পরে ঠিকি বুঝতে পারে।যা করে করুক না।আরাফ যখন বুঝতে পারবে তখন দেখবে লজ্জিত হবে।”

“সেটাই আমিও জানি রাফাত ভাই।কিন্তু কিছু সমস্যা তো তৈরী হবেই।”

“তা ঠিক।তবে সমস্যা থাকলে সমাধানও থাকবে।আয়রার বাবা তো জানেন।অনেক কিছু উনি সামলে নিতে পারবেন।”

“হুম,আচ্ছা চলো ওদের কাছে যাই। এরপর লালাখাল যাব।ওদের জিজ্ঞেস করিও ঝুলন্ত ব্রিজে যাবে কিনা?”

***
আরাফ বিকেলে ঢাকায় পৌঁছে মায়ের কাছে এসে বলল,

“তনয়ারা মিথ্যা বলেছে আমাদের মা।ওর হয়ত কোনো সমস্যাই নাই।”

“চুপ কর।আবার তুই আজে বাজে কথা শুরু করলি?কেউ ওরকম একটা ব্যাপার নিয়ে মিথ্যা বলে কখনও?”

“তনয়ার যদি সমস্যাই থাকে তাহলে ও প্রেম করে কিভাবে?তখন কি ওই সমস্যার কথা মাথায় থাকে না?”

“কি বলছিস, তুই? ”

“ঠিক বলতেছি।তনয়ার মামাতো ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক আছে।ওদের অনেক দিনের সম্পর্ক। তনয়া যদি কোনো সমস্যা থাকত তাহলে কি ছেলে সম্পর্ক রাখতো?ওরা দুজনে মিলেই এমন গল্প ফাঁদছে।”

“আমি তো কিছুই বুঝতেছিনা।ওনারা আমাদের এতবড় মিথ্যা কেন বলবে?”

“এইজন্যই তোমায় বলেছিলাম ওসব কোনো সমস্যা নয়।বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“চুপ কর আরাফ! মানলাম ওরা মিথ্যা বলেছে মেয়েটার অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে ওরা খারাপ এসবে তোর মাথাব্যাথা কেন?যা খুশি করুক ওরা।”

“নাহ্ ওরা আমাদের এভাবে মিথ্যা বলবে আর আমরা কিছুই করবো না?তুমি এখনই তনয়ার মাকে ফোন করবে জানতে চাইবে নিজের মেয়ের সম্পর্কের কথা গোপন করে মিথ্যা কেন বলেছে?”

“না, আমি ফোন করবো না।তুই যা ফ্রেশ হয়ে নে।গতরাতে বেরিয়ে গেলি আবার আজকেই ফিরে আসলি।রাফাতের সাথে নিশ্চয়ই খুব চোটপাট করেছিস?”

“তুমি ফোন করবে এরপর আমি যাব।” আরাফ বজ্রকন্ঠে বলে মায়ের ফোনটা হাতে তুলে নিলো।

***
সারাদিন অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে সবাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে হোটেলে ফিরলো।খিদেয় নাজেহাল অবস্থা।জাফলং মায়বী ঝর্নায় সবাই গোসল করেছে।শরীর না চললেও মনটা ভিষণ ফুরফুরে হয়ে আছে তনুর।শান্তাকে বলল,

“কিছু না খেয়েই শুয়ে পরলি কেন?

“তুই ঘরেই খাবার নিয়ে আসতে বলে দে।আমার শক্তি নেই নিচে নামার।”

“এত দেখি করুণ অবস্থা তোর?”

“তবে যাইহোক এতদিনে সিলেটে আসার ইচ্ছে টা পূর্ণ হয়েছে।অসম্ভব সুন্দর জায়গা।আমার তো ঢাকায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না।”

তনু কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর ফোনটা বেজে উঠল।মায়ের নম্বর দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করল।তবে শায়লা বেগমের কথা শুনে মুখটা শুকিয়ে গেল।যা ভেবেছে তাই হলো।তনুর চোখজোড়া ছলছল করছে। খুব চেষ্টা করছে কান্না আটকাতে। এখন সে মাকে কিভাবে বোঝাবে সত্যি টা?

চলবে…

তনয়া পর্ব-১৫

0

#তনয়া
#পর্ব-১৫
সিফাতী সাদিকা সিতু

রাতে খাবারের সময় আরাফ ফোন করলো রাফাতকে।কয়েকবার কেটে দেয়ার পরেও আরাফ বারবার ফোন করছে তাই বাধ্য হয়ে ধরলো।

“হ্যালো, ফোন দিচ্ছিস যে এত সবকিছু ঠিকঠাক আছে?”

“কিছুই ঠিক নেই।তুই এত বড় স্বার্থপর কবে থেকে হয়ে গেছিস সেটা আগে আমায় বল?”আরাফের কন্ঠে ক্ষোভ ঝরে পরছে।রাফাত জানত এমনটাই হবে তাই সে বেশি রাগলো না।বলল,

“কি করেছি আমি যে তোর কাছে স্বার্থপর হয়ে গেলাম?”

“তুই আমায় একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?হানিমুনেও তো যাস নাই, সবাইকে নিয়ে ঘুরতে গেছিস অথচ আমি কিছুই জানি না!”

“তোর সাথে কত ঘুরেছি বলত তাই এবার ভাবলাম তোকে আর বিরক্ত না করি।এমনিতেও খালু তোকে অফিস থেকে ছুটি দিতো ভেবেছিস?”

“সেটা আমি বুঝতাম।তবে তোর থেকে এটা আশা করিনি আমি?”

“দেখ তোকে খুলেই বলি,আয়রা আর আমার এটা বিয়ের পর প্রথম ঘুরতে আসা।জানিস তো তোর ভাবি একটু ইনট্রভার্ট!একা আমার সাথে আসলে তেমন খুশি হতো না।তাই ওর ভাইবোনদের নিয়ে এসেছি।পরের বার তোদের সাথেও ঘুরবো।তাছাড়া তনু আসবে জন্য তোকে আমি ইচ্ছে করেই জানাই নি।পরিস্থিতি তো তুই খারাপ করে রেখেছিস।দুজনের কেউই তোরা স্বাচ্ছন্দবোধ করতি না।বিশেষ করে তনুর খুব অসুবিধা হতো।”

“তোর কি মনে হয় আমি তনুর সাথ হ্যাংলামো করেছি কখনও?”

“যা করেছিস তাতেই অনেক হইছে।তা না হলে তনুর মত নেই জানার পরও তুই ওর আশায় বসে আছিস।এটা কি হ্যাংলামো নয়?”

“আচ্ছা,বাদ দে কোন হোটেলে উঠেছিস? ”

“কেন তুই শুনে কি করবি?”

“আমি আজ রাতের গাড়িতে উঠব।সকালে সিলেট পৌঁছাব।”

রাফাত এবার ঝটকা খেল।আরাফ সত্যি বেশি বেশি শুরু করেছে।আসবে মানেটা কি?

“কি বলছিস, তুই আসবি কেন?”

“তোদের সাথে ঘুরতে।”

“দেখ রাফাত তোকে সবটা খুলে বলার পরও তুই পাগলামি করছিস কিন্তু? ”

“তুই পাগলামির কি দেখলি এখানে?তোরা সবাই ঘুরছিস আর আমি যদি তোদের সাথে যোগ হই তাহলে সেটা পাগলামি?”

“তুই কেন আসতে চাইছিস সেটা বুঝতে পারছি জন্যই তো মনে হচ্ছে পাগলামি ছাড়া কিছুই না।তোকে মানায় না এসবে বোঝার চেষ্টা কর একটু?”

“আচ্ছা ঠিক আছে সিলেটে নেমেই না হয় শুনে নেব কোন হোটেলে উঠেছিস?”

রাফাত চাইলেও কিছু বলতে পারলো না আরাফ ফোন কেটে দিয়েছে।মেজাজ চটে গেল রাফাতের। সবাই ততোক্ষণে সবটা বুঝে গেছে।মিশকাত মনে মনে হাসছে।সে জানতো এরকম কিছু হবে তাই অনেক সমস্যা রেখেও এসেছে।মানুষ চিনতে খুব একটা ভুল হয় না তার।আরাফ যে সহজে তনুর পিছু ছাড়বে না তাও বুঝে গেছে।তনু তো তার থেকে দূরে এমনকি এখনও দূরে সরে আছে তবু সে এমন হ্যাংলামো করেনি।তনুর ওপর কোনোরকম চাপ প্রয়োগ করে নি।ভালোবাসা তো মনের ব্যাপার জোর করে কখনও হয়না।তনুর সবটা জানার পরেও আরাফের এমন জেদ সত্যি দৃষ্টিকুটু।কারণ বাস্তবতা খুব কঠিন।এত সহজে তনুর ব্যাপারটা মেনে নিয়ে সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে তনুকে ভালোবাসতে ভালো রাখতে পারবে?সে নিজেকে দিয়েই তো বুঝে!সবটা জানার পর তো সে খুব সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এতবছর ধরে পুড়ে পুড়ে খাঁটি হওয়া ভালোবাসাও ক্ষনিকের জন্য বিপাকে পরেছিল।তাই তো খুব দ্রুত তাকে অনেক কিছুর জন্য প্রস্তুত হতে হচ্ছে। সেও যদি আরাফের মতন স্বাভাবিক ভাবে ব্যাপারটা নিতে তাহলে তনু আরও বেশি দূরে সরে যেত।

“ওকে আসতে দাও ভাই?আসুক না সবাই এক সাথে ঘুরবো মজা করবো ভালোই হবে।”

সবাই চমকালো মিশকাতের কথায়।সবথেকে বেশি তনু অবাক হলো।কি চলছে মিশকাতের মনে সেটা বুঝতে পারছে না।

“কি বলছো ভাই?”

“কেন সমস্যা কি আসলে?তনুকে নিয়ে তো আর পালিয়ে যাবে না।আর যদি পালায় আমরা বেঁচে যাব।ফুপার কত গুলো টাকা বেঁচে যাবে বলতো?

এমন সিরিয়াল সময়ে মিশকাতের এমন ফালতু কথায় তনুর প্রচন্ড রাগ উঠে গেল। সে হনহনিয়ে চলে গেল নিজের রুমে।

মিশকাত জোরে হেসে উঠল।আয়রা বলল,

“এটা কি করলি?ওমন ভাবে বললি কেন?”

“বললাম কারণ তনু যেন রেগে এখান থেকে চলে যায় আর আমরা সবাই মিলে আলোচনা করতে পারি। ওর সামনে আরাফকে নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না।”

“ওয়াও, ভাই তুই তো পুরো জমিয়ে দিচ্ছিস!মারুফ হাত তালি দিয়ে বলে উঠল।

রাফাত জানতে চাইলো,

“কি করতে চাইছো তুমি মিশকাত?”

মিশকাত বলল,

“আরাফকে বুঝিয়ে দেব তনুকে আমি ভালোবাসি।তাই তনুর থেকে দূরে থাকাই ওর জন্য ভালো হবে।আমার জানা মনে আমার আর তনুর বিষয়টা আরাফ এখনও জানে না।জানলে নিশ্চয়ই এতদূর এগোতে চাইতো না?ওকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে তনুও আমায় ভালোবাসে!যদি তাতেও কাজ না হয় তাহলে অন্যপথ ভাবতে হবে। আমি থাকতে তনুকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া হতে পারে না।”

***
সারারাত ছটফট করেছে তনু।পাশেই শান্তা বেঘোরে শান্তি মতন ঘুমিয়ে আছে।ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই তনু বিছানা ছেড়ে উঠল।বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলো পুরো হোটেল কেমন ভুতুড়ে হয়ে আছে।কোথাও কেউ নেই।একটু ভয় করলেও সে হেটে এসে সুইমিংপুলের ধারে বসলো।কয়েক বছর ধরে নির্জনতা খুব পছন্দ তার।এইরকম পরিবেশে সে নিজেকে খুঁজে পায় যেন।সবার মাঝে থেকেও আজকাল খুব একা লাগে নিজেকে।আনমনে হয়ে যায় মন হুট করেই।যেন কারও জন্য অপেক্ষায় থাকে বেহায়া মনটা।সবসময় মনে হয় এই বুঝি কেউ এসে বসবে তার কাছে!পরম আদরে হাতটা ধরে বলবে,

” তনু তুমি একা নও,আমি আছি তেমার পাশে!”

হুট করে পুরুষ কন্ঠ পেয়ে ভয়ে কেঁপে উঠল।পুরো শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে।তাই দেখে মিশকাত মিটিমিটি হাসছে।

তনুর ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তে মিশকাতকে সুইমিংপুলের পানিতে চুবিয়ে মারতে।কি অসভ্যতা শুরু করেছে তার সাথে?এভাবে কেউ ভয় দেখায়?আর কিভাবে বলল কথাটা?তনুর পাশে থাকবে যেন বাংলা সিনেমার সস্তা ডায়গল!

“শোন,যেটা ভাবছিস সেটা করেই ফ্যাল। ভাবছি ভোরে সুইমিংপুলে নামতে নিশ্চয়ই ভালো লাগবে!”

“তুমি দিন দিন কেমন অসভ্য হয়ে যাচ্ছো মিশকাত ভাই?”

তনুর কথাটা শেষ হবার সাথে সাথেই মিশকাত তনুর হাতটা ধরে ঝাপ দিলো সুইমিংপুলে।বিষ্ময়ে তনুর চোখ দুটো রসগোল্লা হয়ে গেছে।এমন অদ্ভুত কান্ড জীবনে কমই হয়েছে তার।

কিছুটা চিৎকার করে বলল,

“এটা কি করলে তুমি?”

“শোনেন, নবাবজাদী এই মিশকাত কখনও কারও খারাপ করে না।সারারাত তো ঘুমাস নাই এখনে কিছুক্ষণ থাক।এরপর ঘরে গিয়ে একটা লম্বা ঘুম দিবি দেখবি কতটা ভালো লাগছে।এরপর তো আমরা ঘুরতে বের হবো।তখন ক্লান্ত লাগবে না।”

“আমার হাত ছাড়ো তুমি?”

“আমি তো কখনও তোর হাত ধরতে যাই নি রে!আজ একটু ধরতে দে প্লিজ?”

কি নিঃসংকোচ আদেবন!তনুর শিরদাঁড়া বেয়ে অজানা অনুভূতির শ্রোতা বয়ে গেল।দুজনেই নীল স্বচ্ছ পানিতে দাঁড়িয়ে আছে।কথা নেই কারও মুখেই।শুধু চলছে অনুভূতিদের দৌরাত্ম্য!মিশকাত শুধু তনুর হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো।

আরাফ খুব সকালে পৌঁছে গেছে।রাত এগারোটায় গাড়িতে উঠেছিল সাড়ে চারটা নাগাদ সিলেটে পৌঁছেছে।হোটেলে আসতে পাঁচটা পার জয়ে গেছে।এত সকালে চেক-ইন হয় না।রাফাত থাকায় কোনো সমস্যা হবে ভেবেই সে এসেছে।রাফাতকে বারবার ফোন দিচ্ছে হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে।রাফাত ফোন তুলছে না।বিরক্ত হয়ে রাফাত হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের পেছনে চলে আসলো।সুইমিংপুলের কাছাকাছি আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল!

চলবে..

তনয়া পর্ব-১৪

0

#তনয়া
#পর্ব -১৪
সিফাতী সাদিকা সিতু

তনুর পাশের সিটে বসে খুব করে দাঁতে দাঁত চেপে রেখে হাসছে মিশকাত।একদম মিচকে শয়তানী হাসি।এই মুহূর্তে খুব জোরে হাসতে ইচ্ছে করলেও সেটাকে কষ্ট করে দমিয়ে রাখতে হচ্ছে।তনুর মুখখানা দেখার মতো হয়েছে।বেচারী না পারছে সহ্য করতে না পারছে কিছু বলতে।মিশকাত যে ওদের সাথে যাবে তা তনুকে মোটেও বুঝতে দেয়া হয়নি।রাফাত শান্তা মারুফের সবটা জানা থাকায় ওরা টিকিট সেভাবেই কেটেছে।শান্তার সাথে মারুফ বসে পরেছে।তনু হাজার বলেও মারুফকে শান্তার পাশ থেকে সরাতে পারেনি।এমনিতেই বাসে উঠে মিশকাতকে দেখে একটা ঝটকা খেয়েছে তার ওপর মিশকাতের পাশের সিটে ওকে বসতে হয়েছে।সব মিলিয়ে করুণ দশা।অন্যদিকে মিশকাত বিজয়ী ভঙ্গিতে বসে আছে। আয়রা ছাড়া সবাই মিটিমিটি হাসছে যা তনু বুঝতে পারলেও আয়রা বুঝতে পারল না।রাফাতের কাছে জানতে চাইলে রাফাত চুপ করিয়ে দিয়েছে। বলেছে সিলেট পৌঁছে সবটা বলবে।তানভীর এসেছিলেন সবাইকে বিদায় দিতে।মিশকাতকে দেখে মোটেও অবাক হন নি।বরং বড় মেয়ে জামাইকে একটু ইশারায় ওদের দিকে খেয়াল রাখতে বলেছেন।সবাই খুব মজার মুডে থাকলেও তনুর সব অসহ্য লাগছে।পাশে বসা মিশকাত নিজের মতোন বসে আছে।তনুর দিকে তাকাচ্ছে না।দুহাত বুকের মাঝে নিয়ে সিটে শরীর এলিয়ে দিয়ে আরামে আছে।তনু চুপ থাকতে না পেরে বলল,

“তোমার না পরিক্ষা?”

“হুম, তো?”

“তুমি তাহলে যাচ্ছো কেন?”

“কেন, পরিক্ষা থাকলে সিলেট যাওয়া যাবে না এটা কোথাও লেখা আছে?”

“নাহ্ লেখা নেই।তবে কেউ যদি যায় তখন ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু হয়!” তনু একটু ঝাঁজের সাথে বলল।

“তোর সমস্যা হচ্ছে নাকি আমায় দেখতে উল্টো লাগছে।মাথার দিকে পা আর পায়ের দিকে মাথা আছে মনে হচ্ছে যে দৃষ্টিকটু লাগবে?”

তনু চুপ করে রইলো।সে কার সাথে কথা বলতেছে তা ভুলেই গেছিলো।এটা তো ছেলে মানুষ নয় যেন আস্ত খাটাসমার্কা ঝগড়ুটে!

গ্রীন লাইন পরিবহনে বসে তনু রাগে লাল নীল সবুজ রং ধরন করছে।ইচ্ছে করছে মিশকাতের মাথার সব চুল গুলে ছিড়তে।প্রায় ছয় সাত ঘন্টা এই অসহ্য মিশকাত ফিসকাত কে সহ্য করতে হবে!এখন বুঝতে পারছে সবাই যেন তার বিরুদ্ধে এক যোগে ষড়যন্ত্র করেছে!মিশকাত চোখ বন্ধ করেও তনুর রাগটা উপভোগ করছে।

তনু রাগটা সামলানোর জন্য জানালার বাইরে মন দিলো।কিছুক্ষণ পর তনু অনুভব করলো মিশকাতের মাথাটা তার ঘাড়ের দিকে ঝুঁকে এসেছে।চট করে ঘুরে তাকাতেই দেখলো মিশকাত ঘুমিয়ে পরেছে।বাসের ঝাঁকুনিতে তনুর দিকে ঝুঁকে এসেছে। তনু একটু ঠেলে দিলো মিশকাতকে কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো মিশকাতকে নড়ানো গেল না।ঠিক আগের মতন ঝুঁকে আছে।তনুর হাসফাস লাগলো।এতকাছে মিশকাতের এর আগে কখনো আসা হয়নি।মিশকাতের নিশ্বাসের শব্দ গুনতে পারছে যেন।তনু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো মিশকাতের পানে।ঝাঁকড়া চুলের গোল গাল ফর্সা ছেলেরটার মাঝে কি এমন আছে?যে তনুকে ভুলে থাকতে দেয় না, দূরে থাকতে দেয় না।এই ছেলেটাই বা তার মাঝে কি এমন দেখেছে যার জন্য এতসব পাগলামি!
মিশকাত তনুর কাঁধে মাথা এলিয়ে ঘুমোচ্ছে অন্যদিকে তনু ভাবনায় ডুবে আছে।ছেলেরাও যে বাসে এভাবে হাবার মতন ঘুমোয় তা আগে জানা ছিল না তনুর।বুকের ভেতর কি হচ্ছে সেটা ইচ্ছে করেই বুঝতে চাইছে না সে।কি হবে বুঝে?বুঝতে গেলেই তো সব তালগোল পাকিয়ে যায়।যা হচ্ছে হোক না?এই মুহূর্ত গুলো কখনও হয়ত জীবনে আর ফিরে আসবে না।কৈশোরের ভালোলাগা থেকে ধীরে ধীরে ভালোবাসা তৈরী হওয়া,সম্পর্ক শুরুর আগেই ভেঙে যাওয়া,দূরে দূরে থাকা এসব অনেক হয়েছে।কিন্তু আজকের এই আকস্মিক ভাবে এত কাছাকাছি দুজনের থাকাটাও তো অন্যরকম একটা ব্যাপার!সে তো এসব কল্পনাও করেনি।তনু এতদিন ভেবেছিল সে তার মনকে বাঁধতে পেরেছে কিন্ত না সে কখনোই পারেনি!তা না হলে মিশকাতকে দূরে সরিয়ে দিতে পারছে না কেন?সে কথা ভাবতেই বুকের ভেতর জ্বলছে কেন?

“তুমি অনেক আগে থেকেই ওদের ব্যপারটা জানতে তাই না?”
শান্তার প্রশ্নে মারুফ ফোনের স্ক্রীন থেকে দৃষ্টি সরালো।

“হুম সেই শুরু থেকেই।”

“তবে ওদের মাঝে এত ঝামেলা কেন?”

“সব সম্পর্কের ধরণ এক হয় না রে পাগলি!ভালোবাসি মুখে বলেই সব সম্পর্কের সূচনা হয় না।”

“তাহলে ওদের ভবিষ্যৎ কি?”

“সেটা তো সৃষ্টিকর্তা ভালো জানে।মিশকাত প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেখবি একদিন তনু চাওয়ার থেকেও অনেক বেশি কিছু পাবে।সেদিন ও আর মিশকাতকে ফেরাতে পারবে না!”

“আমার কিন্তু বড় মামিকে নিয়ে ভয় হয়।”

“এখন আর সেই ভয় নেই।মিশকাত সবটা জানে।ও সবটা সামলে নেবে সে বিষয়ে নিশ্চিত থাক।”

“কিভাবে জানে?”

“সে অনেক কথা।আয়রা আপার বিয়ের সময়ই জেনেছিল।”

“ওমা তাই নাকি?তাহলে মিশকাত ভাই যে ওমন হুট করে চলে গিয়েছিল?”

“কি জানিস তো?কখনও কখনও চলে যেতে হয় ফিরে আসার জন্যই।মিশকাতের চলে যাওয়াটা দরকার ছিলো।ও সেদিন চলে গিয়েছে জন্য দেখ সবটা কিন্তু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে!”

শান্তা একবার পেছন ফিরে তাকালো।তনুর কাঁধে মাথা রেখে মিশকাতকে ঘুমাতে দেখে হেসে ফেলল। মারুফকে ফিসফিসিয়ে বলল,

“মিশকাত ভাই কি সত্যি সত্যি ঘুমোচ্ছে?”

মারুফ হেসে উঠল।বলল,

“তুই বুঝে নে।”

পৌঁছানোর ঠিক বিশ মিনিট আগে মিশকাত উঠল।তনুর কাঁধ শক্ত হয়ে গেছে।প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে।মিশকাত আড়মোড়া ভেঙে বলল,

“তোর খিদে পেয়েছে খুব? মুখটা ওমন করে রেখেছিস কেন?শোন,তুই সিলেটে এসেছিস এখানে সবকিছুতেই সজীবতা মাঝখান থেকে তুই এমন মরা মরা হয়ে থাকবি না বলে দিলাম!”

তনু হাসবে না কাঁদবে না রাগবে কিছু বুঝে উঠল না তার।গন্তব্য আসায় নেমে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। রাফাতও ইশারায় ওদের নামতে বলল।তনু ঘাড় ঠিকমতো সোজা করতে পারছে না।মিশকাতকে বসে থাকতে দেখে বলল,

“নামবে না? ”

মিশকাত অলস ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। তনুর খুব কাছে মুখটা এনে বলল,

“তোর শরীরে বিয়ে বিয়ে গন্ধ! এটার কারণ কিরে?”

তনু স্তব্ধ হয়ে রইলো।মিশকাত হাসতে হাসতে নেমে গেল। সে একটুও ঘুমোয় নি।জেগে থাকলে তনু সহজ হতে পারতো না এমনি কি এই সুন্দর সময়টাও ওদের ঝুলিতে জমা হতো না।তাই ঘুমের ভান ধরেছিল।ইচ্ছে করেই তনুর কাঁধ থেকে মাথা সরায় নি।এত বছরের দূরত্ব সে পইপই করে সবটার হিসেব তুলবে,হু।হোক না কষ্ট তাতে কি? তনু এতদিন ধরে কি তাকে কম কষ্ট দিয়ে এসেছে?

সবাই “রেইনবো গেস্ট হাউজে”উঠেছে।রাফাত দুদিন আগেই তিনটে রুম বুক করে রেখেছে।
সবাই রুমে গিয়েই ধুপধাপ করে শুয়ে পরল।আয়রা সারাটা পথ ঘুমিয়ে এসেছে তাই এখন তার ক্লান্ত লাগছে না।ওয়াশরুমে।ঢুকলো ফ্রেশ হতে।মারুফ আর মিশকাত একরুমে। শান্তা তনু এক রুমে।বিকেলে ওরা বের হবে সিলেট সদরে যে কয়টা চা বাগান আছে তার যেকোনো একটা দেখতে।তনু সবথেকে বেশি উত্তেজিত চা বাগান দেখার জন্য। এর আগে কখনও সিলেট আসা হয়নি।

তনু ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করছে।শান্তা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে তনুকে দেখে হেসে বলল,

“তোর কাঁধটা একটু টিপে দেব? ”

তনু শিউরে উঠল।লজ্জায় কথা বলতে পারলো না।দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।ঘন্টাখানেক আরাম করে খেয়ে ওরা বের হলো!” মালনীছড়া চা-বাগানের” উদ্দেশ্যে।গাড়িতে বসে তনু একবারও মিশকাতের দিকে তাকায়নি এমনকি খাবার সময় সবাই গল্পগুজব করলেও সে চুপচাপ ছিল।

চারপাশে উঁচু নিচু টিলা সাথে সবুজের সমারোহ! কারো মুখে কোনো কথা নেই।সবাই প্রকৃতির মাঝে বিভোর। রাফাত মিশকাত মারুফ আগেও সিলেট এসেছিল অথচ মনে হচ্ছে নতুন করে সব দেখছে।সৃষ্টিকর্তার কি অপরূপ সৃষ্টি! মালনীছড়া চা বাগানের প্রবেশ গেট অনেক গুলো।ওরা অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।আনন্দে তনুর চোখে পানি চলে এসেছে।এত সবুজের সমারোহ এই প্রথম কাছ থেকে দেখছে!বাকি সবার অবস্থাও একি।এই জন্যই বোধহয় সিলেটকে” দুটি পাতা একটি কুঁড়ির” দেশ বলা হয়!বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ চা বাগান এই সিলেটেই অবস্থিত।তনু এতটাই বিভোর ছিল যে মিশকাত কখন এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে।মিশকাত তনুর অনেকটা কাছে এসে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

“আমায় ছাড়া তোর এই প্রকৃতির বুকে হারিয়ে যাওয়া কি উচিত?”

তনু চমকে উঠে পেছন ফিরতে মিশকাতকে দেখল। কিছু বলল না সে তো বলার মতো ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।তবে মিশকাতের চোখের ভাষা খুব করে বুঝলো।সে এতক্ষণ যে মুগ্ধতা নিয়ে সবকিছু দেখছিল ঠিক তেমনই মুগ্ধতা নিয়ে মিশকাত অপলক তাকিয়ে আছে তার দিকে!

আয়রা খুশিতে লাফাচ্ছে প্রায়।রাফাতের শার্ট ধরে ঝুলছে বারবার।রাফাতের বুকের কাছটা কুঁচকে গেছে তবু হাসি মুখে আয়রার পাগলামি গুলো দেখছে।আয়রার যেন খুশি ধরে না।ইচ্ছে করছে রাফাত কে নিয়ে এখানেই সংসার করতে।দুজনে মিলে এই চা বাগানে কাজ করবে!রাফাত বোধহয় সেই ভাব বুঝতে পারলো।হেসে বলল,

“আয়রা এখানেই থেকে যাবে?”

“হ্যাঁ, আমার খুব ইচ্ছে করছে।”

“তাহলে আমার কি হবে?”

“আপনিও তো আমার সাথেই থাকবেন।”

“আমাদের বাবু কোথায় থাকবে?”

আয়রা সবকিছু দেখতে দেখতে উত্তর দিলো

“আমাদের সাথে।”

রাফাত জোরে হেসে উঠল।আয়রা একটু পর বুঝতে পেরে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল।মুখ লুকোনোর জায়গা হিসেবে রাফাতের বুকটাই পেল।

চলবে..

তনয়া পর্ব-১৩

0

#তনয়া
#পর্ব -১৩
সিফাতী সাদিকা সিতু

“আমি চেয়েছিলাম এক ফোঁটা জল,
তুমি দিয়েছ বিশাল এক সমুদ্র।
অথচ আমি ভাসতে চাইলেই,
তুমি যত্ন করে দিচ্ছো ডুবিয়ে।”

ব্যাগের ভেতর ছোট চিরকুট টা পেয়ে অবাক হলো তনু।কে রেখেছে এটা? কখনই বা রাখলো?দুদিন থেকে তো সে ভার্সিটিতে যায় না।আজ তৈরী হয়ে ব্যাগ গোছানোর সময় দেখতে পেল চিরকুটটা।কে লিখতে পারে এটা ভাবতে ভাবতেই বের হলো সে।রিকশা থেকে নেমে ভীড়ের মাঝখানে পরে গেল।ভার্সিটির সামনের রাস্তায় অনেক ভীড়। ধীরে ধীরে এগোচ্ছো সে।লোকজনের থেকে গা বাঁচিয়ে হাঁটছে।ঠিক সে সময় সে খেয়াল করলো তার পাশ ঘেঁষে কেউ হাঁটছে!পাশ ফিরে তাকিয়ে মিশকাত কে দেখে চমকালো না।বরং একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,

“আজকাল তোমায় একটু বেশি দেখা যাচ্ছে!”

মিশকাত জবাবও দিলো না এমনকি তনুর দিকে তাকালো না।কিন্ত হাঁটছে তনুর ঠিক পাশ ঘেঁষে।তনু মিশকাতের নতুন ধরনের হাবভাব বুঝে উঠতে পারছে না। হুট করেই কেমন যেন হয়ে গেছে?আচ্ছা, চিরকুটটা মিশকাত রাখে নি তো?সেদিন যে ব্যাগটা টেনে নিলো!

“তুমি আমার ব্যাগে চিরকুট রেখেছিলে মিশকাত ভাই?”রাস্তা পার হয়ে এসে দুজনেই দাঁড়াল।

“সবসময় তোর উল্টা পাল্টা কথা বলাই লাগবে, তাই না?এখনও ভদ্রতা শিখতে পারলি না আবার আমায় বলিস স্কুলে ভর্তি হতে?”

“মোটেও উল্টো পাল্টা কথা বলি না আমি। তোমার সাথে কথা বলাই ভুল।”

“আমার বড় ভুল তোর সাথে দেখা হওয়া।শোন,তোর সাথে দেখা না করতে না পারলে কেউ মরে যাচ্ছে না!”

“আশ্চর্য তো!আমি কখন বলেছি কেউ আমায় দেখার আশায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে?”

“তোর মুখে বলতে হবে কেন?ভাবখানা তো তাই দেখাস!”

“মিশকাত ভাই তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মহিলাদের মতো ঝগড়া করছো কেন? ”

“চুপ থাক।” মিশকাত ধমক দিলো।তনুর চোখ মুখ আরও কঠিন হয়ে উঠল।

তনু মনে মনে বলল,
“আমার সাথে একটু সুন্দর করে কথা বললে কি হয় মিশকাত ভাই?আমি যে খুব হাপিয়ে উঠেছি।তোমায় কিছুতেই মন থেকে সরানো যায় না।এত কঠিন অনুভূতি নিয়ে কেন গেড়ে বসেছ আমার মনে?”

মিশকাত তার হাতে থাকা শপিং ব্যাগটা তনুর হাতে দিয়ে বলল,

“ধর তো একটু?”

“কি এটা?”

“এই জন্যই তোর সাথে সুন্দর ভাবে কথা বলা যায় না।সবকিছুতেই তোর হাজারটা প্রশ্ন? ”

তনু দীর্ঘশ্বাস চেপে ব্যাগটা হাতে নিলো।

“তুই একটু দাঁড়া আমি আসছি।”

তনু এবার প্রশ্ন করল না, কোথায় যাবে?কিছু বললেই তো আবার ঝাড়ি খেতে হবে।কি দরকার যেচে পড়ে ঝাঁজ সহ্য করার?হাতে থাকা ফোনে সময় দেখলো।প্রথম ক্লাসটা বোধহয় আর করা হবে না।মিশকাত না চাইতেও তনুকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলছে অজানা কোনো বাঁধনে।এমন কেন হচ্ছে? যত দূরে থাকতে চায় ততই যেন কাছে আসা হয়!

দাঁড়িয়ে থেকে পা ধরে গেল অথচ মিশকাতের দেখা মিললো না।তনু যা বোঝার বুঝে গেল।মিশকাতের সাথে দেখা হওয়ার আসল কারণ এই ব্যাগটা!এটা তনুকে দেয়ার জন্যই এসেছে?কিন্তু কি আছে এতে?

তনু আর ভার্সিটিতে গেল না। ফিরে এলে বাড়িতে।

ব্যাগটা খুলে একটু চমকালো।অনেক সুন্দর একটা শাড়ি।শুধু শাড়ি নয় সাথে চুড়ি গাজরা সবকিছু।সাদা রংয়ের শাড়িটার সাথে একটা চিরকুট আটকানো!

“শোন,তোর কাছে ব্যাগটা ভালো ভাবে রাখিস।হলে থাকি এসব মেয়েদের জিনিসপত্র কিভাবে রাখি বলতো?একজনকে দেয়ার জন্য কিনেছি কিন্তু দিতে পারছি না কিছু কারণে। সেই একজনটা কে তোকে বলব সময় করে, খুব বিশেষ কেউ।বাড়িতেও রাখা যাবে না মা দেখে ফেলবে।তাই তোর কাছে রাখলাম।দেখিস আবার নিজের মনে করে পড়ে ফেলিস না যেন?একদম হাত দিবি না, যেমন ব্যাগটা দিয়েছি ঠিক সেভাবেই রাখবি, কেমন?এর জন্য তোকে বকশিসও দেব ভাবিস না।তুই শুধু যত্ন করে রাখিস।”

শাড়িটা হাতে নিয়ে তনু কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো।বুকের ভেতর কি হচ্ছে সেটা শুধু সেই জানে।মানুষটা এত অন্যরকম কেন? তনুকে দিয়েছে সেটা সোজা ভাবে বলতেও পারল না?বলবেই বা কি করে সেই সম্পর্ক কি আছে দুজনের মধ্যে?
ইশ!এখনও তনুতেই বিভোর হয়ে আছে মিশকাত ভাই।খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে তনুর,খুব।যে কান্না গুলো তাকে শান্তনা দেবে!বুকের ভেতর ওঠা ঝড়টাকে সামলে দেবে!

***

আরাফ গত এক সপ্তাহ ধরে মায়ের সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করে চলেছে।তনুকে তার পক্ষে কিছুতেই ভুলে থাকা সম্ভব নয়।অন্যদিকে আরাফের মা ছেলের জেদের কাছে হার মানবেন না।এই নিয়ে অশান্তির শেষ নেই।আরাফের বাবা তো বলেই দিয়েছেন তার একমাত্র ছেলের জন্য তনুকে বউ করে আনবেন না।আরাফের বোন দুলাভাই অনেক বুঝিয়েছে।যেখানে মেয়ে নিজেই রাজি নয় সেখানে আরাফের এমন জেদ সত্যি অমূলক।কি দরকার আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করার?তনুর পরিবার সত্যি ভালো শুধু মেয়েটার যদি সমস্যা টা না থাকতো তাহলে এতকিছু ভাবতে হতো না।অনেক আগেই বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে যেত। লজ্জায় তো আরাফের বাবা মা পরেছেন।নিজেদের ছেলেকেই সামলাতে পারছেন না।এত আবেগ দিয়ে কি জীবন চলে?রাফাত তো আরাফের সাথে ঠিকমতো কথাই বলে না।

আজ আরাফ এসেছে তনুর বাবার অফিসে।অনেক ভেবে তানভীর সাহেবের সাথে কথা বলতে এসেছে।তানভীর সাহেবের পিয়ন এসে জানিয়ে গেছে কিছুক্ষণ বসতে হবে। তাই আরাফ অপেক্ষা করছে। ঠিক সেসময় মিশকাত এসে হাজির হলো।আরাফকে দেখে অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে সৌজন্য বজায় রেখে কথা বলল।

“আপনি এখানে?”

“একটু আংকেলের সাথে কথা বলতে এসেছি।”

“কেনো কাজের ব্যাপারে নাকি?”

“নাহ্ সেরকম কিছু নয় একটু কথা বলতে এসেছি শুধু। ”

“ওহহ,তাহলে বাসায় চলে যেতেন?”

“না বাসায় যাওয়ার সময় নেই।আমি অফিস থেকে সোজা এখানে এসেছি। তা আপনি এইদিকে?”

“আমাকে বাবা পাঠিয়েছে ফুপার কাছে আমাদের কিছু কাগজপত্র থাকে তাই নিতে।”

“আংকেল বোধহয় খুব ব্যস্ত।আমায় ওনার পিয়ন এসে একটু অপেক্ষা করতে বলল।আপনিও বসেন?”

“সমস্যা নেই আপনি বসেন।আমাকে প্রায় আসতে হয়।”

তানভীর সাহেবের সাথে আলাদা ভাবে দেখা করতে আসা বিষয়টা মিশকাতকে ভাবিয়ে তুললো।সবটাই শুনেছিল মারুফের কাছে।তনুর পেছনে এই ছেলে এত দৌড়াচ্ছে কেন বুঝতে পারছে না।তনুর জন্য গভীর ভালোবাসা কি আছে আরাফের মনে?ক্ষনিকের দেখায় ভালো লেগে গেছে তনু তো ভালো লাগারই মতো।সাধারণের ভীড়ে অসাধারণ। মিশকাত মনে মনে হাসলো,তার ছয় বছরের ভালোবাসা পুড়তে পুড়তে খাঁটি হয়েছে।এত সহজে তা অন্যকারও হয়ে যাবে?তনুর থেকে সবসময় দূরে ছিল তবু তারা যেন কত কাছে!একজন অন্যজনকে খুব করে অনুভব করতে পারে।মনের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা ইচ্ছে গুলো মুখে বলতে হয় না।দূরত্ব কখনও তাদের ভালোবাসায় ধুলো জমতে দেয় নি।সবসময় সজীবতা বিরাজমান!

মিশকাতের পিয়নের পরিচয় অনেক আগে থেকেই।তানভীর সাহেবের মিটিং শেষ হয়েছে। ব্যবসা নিয়ে প্রায় সময়ই ব্যস্ত থাকতে হয়।কিন্তু মিশকাতকে কখনও অপেক্ষা করতে হয় না।সে সোজা রুমের ভেতর ঢুকে বলল,

“খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে? আফসার সাহেব ফেরেন নি কানাডা থেকে?”

“না রে ও ফিরলেই আমার ব্যস্ততা কমে যায়।আরও দুসপ্তাহ ওকে থাকতে হবে বাইরে।তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

“বসবো না আজ।কাগজ গুলো দাও।তোমার সাথে কথা বলার জন্য বাইরে আরেকজন খুব আগ্রহ নিয়ে বসে আছে দেখছি!”

“হ্যাঁ,আয়রার খালা শ্বাশুড়ির ছেলে। ওকে ওভাবে বসিয়ে রাখতে খারাপ লাগছে।কিন্তু কিছু করার নেই।কেবল মিটিং শেষ হলো।”তানভীর টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফাইলটা বের করে দিলো।

মিশকাত সেটা নিয়ে বলল,

“ওকে বসিয়ে রাখায় খারাপ লাগছে সেটা পর্যন্ত ঠিকিই আছে কিন্তু ওকে তোমার আমার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটা দিতে না পারায় যেন মোটেও খারাপ না লাগে তোমার।”

মিশকাত বেরিয়ে গেল।তানভীর সাহেব একরাশ বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। তবে বুঝতে পারলেন বুকে থাকা কষ্টের ভারী পাথরটা হঠাৎ সরে গেছে।আনন্দে চোখে পানি চলে আসার আগেই সেটা মুছে নিলেন।পিয়নকে বললেন,আরাফকে আসতে বলতে।ছেলেটাকে আজ ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে।

***
বিয়ের পর আয়রার হানিমুন হয় নি।তাই রাফাত ভাবছে গরমের ছুটিতে কোথা থেকে ঘুরে আসা যায়?আয়রা একা গেলে তো শান্তি পাবে না তাই সবাই মিলে একটা ছোট খাটো ট্যুরের প্লানিং করাই যায়।আয়রার কাজিন তো অনেক।তনু তো আছেই।আয়রা শুনে তো মহাখুশি। তবে বেশি কাউকে নেয়া যাবে না। বেশি গ্যাদারিং হবে যাবে।আয়রার কথা মতো রাফাত ঠিক করলো তনু, শান্তা, মারুফ আর মিশকাতকে।এদের সবাইকে বলাও হয়ে গেল।মিশকাত শোনার সঙ্গে সঙ্গে বলে হ্যাঁ বলে দিয়েছে।যদিও সামনে তার ফাইনাল পরিক্ষা তার ওপর ইন্টারভিউয়ে টিকে গেলে ডাক আসতে পারে এসব নিয়ে না ভেবে সে রাজি হয়ে গেছে।তনু যাবে আর সে যাবে না সেটা তো হতে পারে না?তাছাড়া আরাফের যাওয়ার একটা চান্স আছে!তিনদিনের জন্য সিলেট ঘুরে আসলে মন্দ হয় না।সেই সাথে প্রকৃতির বুকে তনুর কাছাকাছি থাকা!এমন একটা সুযোগ ভবিষ্যতে নাও হতে পারে।আগে হলে মিশকাত দূরেই থাকতো। কারণ সবটা তো জানতো না।এখন তো দূরে থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না।
শুধু রাফাতকে বলে রাখলো তার যাওয়ার ব্যপারটা যেন তনুকে না জানানো হয়।রাফাত কারণ জানতে চাইলে বলেছে,দেখা হলে সবটা খুলে বলবে।তবে রাফাত যা বোঝার বুঝে গেছে।তাই সহজেই ব্যাপারটা সামলে নিয়েছে।

তনুর ব্যাগপ্যাক করা শেষ।শায়লা বেগম মেয়ে জামাইর এমন সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছেন। তনুর এই সময় একটু বাইরে ঘুরে আসার দরকার ছিলো।তিনি বুঝতে পারেন মেয়েটার মাঝে মাঝে দমবন্ধ আসে।

শান্তা মারুফ বিকেলে চলে আসলো তনুদের বাড়িতে।আগামিকাল সকালে ওরা রওনা দেবে সিলেটের উদ্দেশ্যে।তনুর মনটা সত্যি খুব ফুরফুরে লাগছে।একটু ভেবে মিশকাতের দেয়া শাড়িটাও সাথে নিয়ে নিলো। হঠাৎ মুক্ত হাওয়ায় উড়তে ইচ্ছে করছে।প্রিয় মানুষকে বা নাই পেল সাথী হিসেবে তার দেয়া শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে তো প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে পারবে!

চলবে..

তনয়া পর্ব-১২

0

#তনয়া
#পর্ব -১২
সিফাতী সাদিকা সিতু

“তোমার জন্যই মারুফ ভাইয়া আমায় কিছু না বলে এখানে নিয়ে এসেছে, তাই না?”

“চ্যাটাং চ্যাটাং কথা না বলে চুপচাপ বসে থাক।তোর মতন নবাবজাদীকে এভাবেই আনতে হয়।”

তনু মিশকাতের কথার পিঠে কথা না বলে চুপ করেই বসে থাকলো।হঠাৎ মিশকাত কই থেকে উদয় হলো কে জানে?এখন মিশকাতের সাথে ঠিক মতন কথা বলাই যায় না।সব কথা ত্যাড়া ভাবে বলবে।বিশেষ করে তার সাথে।আজ মিশকাতের সাথে দেখা হবে জানলে চিঠিটা সাথে করে আনতো।এখন মনে হচ্ছে ইহজনমে মিশকাতকে জানানো হবে না। অবশ্য ধীরে ধীরে অনেকেই জানতে পারবে এখন।মিশকাত ভাই ঠিক এক সময় জানবে।দেখা যাবে মামি বলে বসবে।তার আর কষ্ট করতে হবে না।মা বাবা দুজনেই খুব সুন্দর ভাবে তাকে সামলাচ্ছে। তানভীর সাহেব খুব কষ্ট পেয়েছেন।তনুর একদিক থেকে কপাল খুব ভালো সে তানভীর সাহেবের মতো বাবা শায়লা বেগমের মতো মা পেয়েছে।পরিবারকে খুব প্রয়োজন হয় এমন পরিস্থিতিতে।পরিবার পাশে থাকলে সব সীমাবদ্ধতা জয় করা যায়।

“তোর সাথে এনআইডি কার্ড আছে নিশ্চয়ই? একটু দে তো।”

“কেন? ”

মিশকাত নিজেই ব্যাগটা টেনে নিলো।কাগজটা খুঁজে নিয়ে আবার চলে গেল।তনু কিছুই বুঝতে পারছে না।ভার্সিটি থেকে একটু দূরের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে মারুফ। এখানে এসে দেখলো মিশকাত বসে আছে।তনুকে দেখে মিশকাত একটা লম্বা হাই তুলে বলল,

“মহারানীকে কোথায় খুঁজে পেলি মারুফ?তা মহারানী আপনি কি এখানে রাজভোগ খেতে এসেছেন?এসেছেন যখন বসে পরেন।আপনার সাথে আমরা গরীব প্রজারাও একটু খেতে পারবো।”

এরপর তনুকে বসিয়ে রেখে মারুফ কে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।এবার এসে এনআইডি কার্ড নিয়ে আবার চলে গেল।কি হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠছে না। ইতিমধ্যে ওয়েটার ফ্রাইড রাইস চিলি চিকেন দিয়ে গেছে।তনুর বিরক্ত লাগছে।দিন দিন মিশকাত খুব বিরক্তিকর হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষটার অনুপস্থিতিও তাকে বিরক্ত করে।ভালোই হয়েছে সম্পর্কটা হয়নি।এমন মাথা পাগলা ছেলের সাথে কেনো সম্পর্ক না হওয়াই উচিত ,হু।

দশ মিনিটের মধ্যে দুজনেই ফিরে এলো।মিশকাত বসতে বসতে বলল,

“খাচ্ছিস না কেন?সারাদিন এখানে বসে থাকার ইচ্ছে আছে?এরপর একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বলল খেয়ে দেয়ে এখানে একটা সই দিয়ে চলে যা।”

“কিসের কাগজ?আমি কি এখানে বসে আছি নাকি বসিয়ে রাখা হয়েছে?”

মিশকাত কথা বলল না।সে খাওয়ায় মনযোগী হয়ে গেছে।এমন ভাব তার সামনে খাবার ছাড়া কিছু নেই।সামনের নীল সালোয়ার কামিজ পরিহিত মেয়েটার কোনো অস্তিত্বই নেই।

তনু মিশকাতের এমন ভাব দেখে জ্বলে উঠল।

“মারুফ ভাই তুমি আমায় বলবে কি হচ্ছে এসব?তুমি আমায় কেন নিয়ে এলে।”

মারুফ পরলো বিপদে।এদের দুজনের ঝাঁঝে এসির বাতাসও তার কাছে গরম লাগছে।

“তুই শুধু সিগনেচার করে দে।আমি তোকে রেখে আসব বাড়িতে।”

আমি বাড়ির রাস্তা জানি।তোমরা আমায় বলো কি হচ্ছে এসব?

“মারুফ এত কথা না বলে কাগজটা পড়ে দেখতে বল।এইজন্যই মেয়ে মানুষের সাহায্য নিতে নেই?” মিশকাত খেতে খেতে বলল।তার মনোযোগ এখনও খাবারে।আশেপাশে তাকানোর প্রয়োজন মনে করছে না।

তনু কাগজটা পড়ে কিছুই বুঝল না।কিসব জায়গা কেনার কথা লেখা।এই কাগজে তনুর কেন সিগনেচার লাগবে সেটাই বুঝল না।

মিশকাত ইশারায় মারুফকে বলতে বলল।

“মিশকাতের এনআইডি হারিয়ে গেছে।এই কাজটা না হলে সমস্যা হয়ে যাবে।আজকেই করতে হবে তাই তোকে ভার্সিটিতে পেয়ে নিয়ে এসেছি আমি।মিশকাত জানত না।ও তো আমার এনআইডি কার্ড নেয়ার জন্য এসেছে।আমি আনতে ভুলে গেছি।এত না ভেবে সিগনেচারটা করে দে।”

তনুর এবার সবটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কি সব কথা? এনআইডি কার্ড হারিয়ে ফেলেছে তাই তনুকে লাগবে।কেমন জোড়াতালি কথাবার্তা!
সে আবার পরলো ভালো ভাবে কাগজটা।তাই দেখে মিশকাত বলল,

“কি ভাবছিস তোর থেকে সম্পত্তির দলিলের সই করিয়ে নিচ্ছি?”

“আজব তো ,কখন বললাম সে কথা?মিশকাত ভাই তুমি একটু সুন্দর করে কথা বলতে শেখো তা না পারলে আবার স্কুলে ভর্তি হও।”

তনু রেগে ব্যাগ থেকে কলম বের করে দ্রুত সাইন করে দিলো।মিশকাত মারুফ দুজনেই লুকিয়ে হাসলো।তনু টেবিলে কাগজটা রেখে কড়া চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল। মারুফ খাবার রেখে দৌড়ে পিছু নিলো।

***
“আয়রা তনয়ার বিষয়ে যা শুনলাম সেটা সত্যি? ”

“আমরা মিথ্যা বলব কেন?”

“আরে বাবা,রেগে যাচ্ছ কেন?আমি শুধু জানতে চাইলাম।আমার তনয়ারর জন্য খুব খারাপ লাগছে।বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। ”

আয়রা চুপ করে রইলো।তনুর জন্য সবসময় খারাপ লাগে।তার বিয়ের পর থেকে একবারই যা এসেছে তনু।এখন নিশ্চয়ই আসতে চাইবে না?
রাফাত আয়রাকে দুহাত মেলে আগলে ধরে বলল,

“পাগলি,মন খারাপ কেন করছো?এই সাধারণ ব্যপারটা তোমরা এতো অস্বাভাবিক করে কেন তুলছো বলতো?”

“মানে? ”

“দেখ ,এটা খুব সাধারণ বিষয়।মানুষের হাতে তো কিছু নেই।সৃষ্টিকর্তা কখন কাকে সন্তান দান করেন সেটা কি কেউ বলতে পারে?তাই আমার কাছে এটা খুব সাধারণ বিষয় মনে হয়।”মা” হতে পারবে না এভাবে কথাটা বলা ঠিক না।জন্ম দিলেই কি মা হওয়া যায়, বলো?আমরা শুধু বুঝি সন্তান জন্ম দিলাম তো মা হলাম।এমনটা নয়,এটা শুধু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যপার।আমরা গভীর ভাবে ভেবে দেখি না।যা আমাদের সমাজে প্রচলিত তাই আমরা নির্দ্বিধায় মেনে চলি।সেটা কতটুকু সঠিক এটা ভাবতে চাই না।ধরো,হসপিটালে তোমার জন্ম দেয়া সন্তানটা কোনো ভাবে পাল্টে গেল!তুমি বুঝতেই পারলে না।অন্যের সন্তানকে তোমার নিজের সন্তান ভেবে অজান্তেই তাকে লালন পালন করলে,মমতা দিলে,ভালোবাসলে।তুমি ভেবেছ সেটা তোমার নিজের সন্তান অথচ সে তোমার রক্তের নয়!”

রাফাত থামলো।আয়রার দিকে তাকিয়ে দেখলো আয়রা উৎসুক হয়ে শুনছে।সে আবার বলল,

“কখনো যদি জানতে পারো তোমার সে সন্তান ছিল না তাহলে কি তুমি সেই সন্তানকে ভুলে যাবে, ভালোবাসবে না?”

“সেটা সম্ভব নয়।এতদিন ধরে যাকে নিজের সন্তান ভেবে মানুষ করেছি তাকে কি করে ভুলব?”

“ঠিক এটাই হলো কথা।সেটা যদি হয় তবেই তুমি “মা”।আমাদের মানসিকতাই এমন হয়ে গেছে যে নিজের বলতে আমরা শুধু আপনজনদের বুঝি?অথচ সেই সন্তান একসময় বৃদ্ধ বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। তবু আমরা নিজেদের পরিবর্তন করতে পারি না।নিজের ঔরসজাত সন্তানই চাই।অথচ কত এতিম বাচ্চাদের কি নির্মম পরিনতি রাস্তাঘাটে কত টোকাই!এসব কি থাকতো?পৃথিবীর সব সন্তানই যার কাছে সন্তান সেই তো”মা”।

আয়রার চোখে পানি এসে গেছে।সবটাই সত্যি কথা কিন্তু সমাজ তো পরিবর্তন হতে চায় না?কখনো কি কেউ দেখেছে একজন মা তার ধর্ষক ছেলেকে নিজে আইনের হাতে তুলে দিয়েছে?সে মা হবার আগে একজন নারী এটা নিজের সন্তানের জন্য ভুলে যায়।মাতৃস্নেহ হবে নির্মল কোমল পবিত্র! সেটা অন্ধস্নেহ কেন হবে?

আয়রা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাফাতকে।এই মানুষটা এত ভালো কেন?

বিকেল বেলা আয়রাকে অবাক করে দিয়ে তনু এসেছে। সাথে মায়ের বানিয়ে দেয়া কয়েক ধরণের পিঠে নিয়ে।আয়রার খুশি দেখে কে?সন্ধ্যায় রাফাত অফিস থেকে ফিরে ওদের নিয়ে ডিনারে গেল।রাতে খেয়ে একটু ঘোরাঘুরি করে ফিরে এসে দেখল আরাফ এসেছে।তনু এসেছে জানতে পেরেছে আয়রার শ্বাশুড়ির থেকে।

তনু আরাফকে দেখে খুব বিরক্ত হলেও হাসি মুখে বলল,কেমন আছেন আপনি?

“ভালো আর রাখলে কই?”

“আরাফ ভাইয়া আমি আপার শ্বশুর বাড়ি এসেছি।নিজের কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলতে আসিনি।প্লিজ ওসব বিষয়ে কথা বলতে আসবেন না?আপনি আমার বোনের আত্মীয় তাই আমি সৌজন্যতার খাতিরে জানতে চাইলাম কেমন আছেন।আর আপনি কি উত্তর দিলেন?”

আরাফ লজ্জা পেল সত্যি সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে নাই।হুটহাট কি বলে ফেলল।নিজেকে শান্ত রেখে বলল,

আ’ম স্যরি, তনয়া।আমি তোমার সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চাই?

তনয়া একবার রাফাতের দিকে তাকালো।রাফাত ইশরায় তনুকে আশ্বস্ত করে বলল,

“আরাফ তনুর বাবা স্পষ্ট সবকিছু বলেছেন।খালাও তার মতামত জানিয়ে দিয়েছে।এ নিয়ে আর কথা না বলাই ভালো।তোর যদি কথা বলতে হয় সেটা তনয়াদের বাড়িতে গিয়ে বলিস।ও বোনের কাছে এসেছে এসব কথা বলে ওর মনটা নষ্ট করে দিস না।”

রাফাতের কথা শুনে অবাক হলো আরাফ।রাফাত এভাবে বলতে পারলো?সে ভেবেছিল সবার সাহায্য নিয়ে তনুকে বোঝাবে তাই তো এখানে আসা।উল্টো রাফাত খালা সবাই মানা করছে!তনয়াকে যে সে কতটা ভালোবেসেছে তা কেউ বুঝতেই চাইছে না?

আরাফ উঠে দাঁড়ালো। এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।কিন্ত তনু বাঁধা দিয়ে বলল,আপনি চলে গেলে আমার সত্যি আরও বেশি খারাপ লাগবে।মনে হবে আমার জন্যই আপনি চলে গেলেন। এসেছেন যখন সাবই মিলেই থাকি।গল্প করবো আড্ডা দেয়া যাবে রাতে।

আরাফ তো অবাক।খুশিতে পারলে লাফিয়ে উঠে।রাফাত শুধু হাসলো।তনয়াকে এই জন্যই খুব ভালো লাগে।তনয়া অন্য রকম।এদের দুবোনই যেন দুটো কোহিনূর!

চলবে..

তনয়া পর্ব-১১

0

#তনয়া
#পর্ব -১১
সিফাতী সাদিকা সিতু

তনয়া সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে চা বানাতে এলো।শায়লা বেগম আয়রা অবাক হয়ে তনুকে দেখছে।তনুকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সেই বিকেল থেকে ওর মনে কি ঝড় বয়ে চলছে।

শায়লা ইশারা করায় আয়রা বলল,

তনু তোর খিদে লেগেছে? কিছু বানিয়ে দেব?

না আপা শুধু চা খাব।আমি বানাচ্ছি তুমি খাবে?মা তোমাকেও দেই?

শায়লা বেগম মাথা নাড়ালেন।কেউ বুঝে উঠছে না তনু কি চাইছে?

মাথা ব্যাথা করছে তোর?

হ্যাঁ রে আপা।মাথাটা খুব ধরেছে।একটু তেল লাগিয়ে দেবে?

আচ্ছা, চল ঘরে যাই।

দাঁড়াও বাবাকে চা দিয়ে আসি।

শায়লা যা বোঝার বুঝে গেলেন।তবে মনে মনে খুশিও হলেন।তনু নিজেই কথা গুলো বলতে পারবে এটাই তো আনন্দের। শুধু শুধু কেন গুটিয়ে রাখবে নিজেকে?বিষয়টা তনুর সমস্যা কোনো অপরাধ নয়!

বাবা একটু আগে চা খেয়েছে।তুই চল আমি তেল দিয়ে দেই।

তনু কিছু বলার আগে শায়লা বললেন,চা টা নিয়ে যা।তোর বানানো চা খুব পছন্দ করে।

তনু অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। শায়লা বেগমের চোখের কোণ চিকচিক করছে।তনুর সস্তির শ্বাস ফেলে বাবার কাছে এলো।

তনুকে দেখে খুশি হলেন তানভীর সাহেব। ভেবেছেন মেয়েটা হয়ত মন খারাপ করেছে।হুট করেই এমন অভাবনীঅভাবনীয় প্রস্তাব পেয়ে তিনি কোনো কিছু চিন্তা না করেই মোটামুটি মত দিয়েই ফেলেছেন।না করার তো কারণ নেই।রাফাতকে যদি পছন্দ হয় তাহলে আরাফ কে কেন অপছন্দ হবে?আরাফও ভালো ছেলে।তবু তিনি খোঁজ খবর না নিয়ে এগোবেন না।তাছাড়া রাফাত ভালো জন্য আরাফও ভালো হবে এমনটা নাও হতে পারে।কিন্ত আত্মীয়দের মুখের ওপর না করে দেয়াটা খুব খারাপ হয়ে যেত।

তানভীরের পাশে বসে তনুর নিরবে চায়ে চুমুক দিচ্ছে।

তুমি কি আমায় কিছু বলবে বাবা?

তানভীর এতক্ষণে সুযোগ পেলেন।বললেন,

তুই কি আমার ওপর রেগে আছিস?

উহু, আমি তো কখনো রাগী না।বলতে পারো আমার রাগ খুব কম।যেটুকু আছে তাও অপ্রকাশ্য।

তা অবশ্য ঠিক।তুই তো রেগে থাকিস নীরবে।কিন্তু জানিস কি তোর চাপা রাগটাকে আমি আর তোর মা খুব ভয় পাই।

তনুর মনটা আসলেই ভালো হয়ে গেল।বাবার কাছে কিছুক্ষণ থাকলেই মন ভালো হয় তার।এর আগেও এমন হয়েছে।একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল,

সবকিছু তো আমাদের হাতে থাকে না বাবা।তাহলে অপ্রত্যাশিত কিছু বিষয় নিয়ে রাগ অভিমান করার মতো বোকা আমি নই।তুমি তো জানতে না ওরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে।

আয়রা তো আমাদের সেভাবে কিছু বলে নি।আমি সত্যিই কিছু জানতাম না।

তুমি আরও একটা সত্যি জানো না বাবা! তোমার মেয়ে কোনোদিন “মা” হতে পারবে এই কথাটা এখনও তোমার অজানা।তোমার মেয়ের রিপোর্টে Polycystic Ovarian Syndrome এ সমস্যা লেখা আছে।এটা শোনার পর কি তোমার খারাপ লাগবে বাবা?

তানভীর স্থীর হয়ে বসে আছে।বোঝার চেষ্টা করতে চাইছে তনু কি বলছে!সব কথা গুলো জট পাকিয়ে উঠছে।

তনু আবার বলল,

আমি জানি তোমার খারাপ লাগবে।রাগও হবে প্রচুর এতদিন এই বিষয়টা গোপন রাখার জন্য।সবথেকে যেটা বেশি হবে সেটা হলো কষ্ট!তোমার মনে আছে বাবা,অফিস থেকে ফিরে আগে আমার হাতে চকলেট তুলে দিতে এরপর আয়রা আপাকে দিতে।ছুটির দিন গুলোতে তুমি আমায় বেশি সময় দিতে।সবসময় ছায়ার মতোন ছিলে আমার পাশে।মা বাবার কাছে সব সন্তান এক হলেও আয়রা আপাকে যেভাবে মা আঁকড়ে রেখেছে তুমিও সে ভাবেই আমায় স্নেহের চাদরে জড়িয়ে রেখেছ।তুমি পারবে না বাবা তোমার তনয়াকে এভাবেই আগলে রাখতে?

তনু বাবাকে প্রশ্ন করলো কিন্তু উত্তর শুনতে চাইলো।কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন হয় না।প্রশ্নটাই উত্তর হয়ে যায়।তনু উঠে দাঁড়াল। তানভীর সাহেবের সামন থেকে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপটা নিয়ে চলে গেল।

***
মিশকাত ইন্টারভিউ শেষ করে বেরিয়ে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়াল।প্রচন্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সে।আজ দুটো ইন্টারভিউ ছিল।একটা খুব খারাপ হয়েছে অন্যটা বেশ ভালো হয়েছে। ঠিক তনু যেরকম।বেশি খারাপ আবার খুব ভালো।টক ঝাল মিষ্টির সংমিশ্রণ। মিশকাতের ফাইনাল পরিক্ষার মাসখানেক বাকি।এরই মাঝে সে চাকরির পেছনে ছুটছে।পরিক্ষা নিয়ে ভাবছে না।তার এখন অন্যকিছু ভাবনা!শুধু ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ নয় সেটা বাস্তবায়নেও নেমে পরেছে।এখান থেকে সোজা সে বাস টার্মিনালে যাবে।দুদিনের জন্য বাড়ি যাবে সে।রাস্তায় দাঁড়িয়ে মারুফের অপেক্ষা করছে।মারুফ এইদিকেই কাজে এসেছিল।দুজনে একসাথে বাড়ি ফিরবে।বাড়িতে থাকবে একদিন এরপর মারুফের কাছে যাবে।ওখানে সমস্ত কাজকর্ম সেরে আবার হলে ফিরবে।

পকেট থেকে টিস্যু বের করে গলায় জমা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছে নিলো।

কয়েক মিনিটের মধ্যে মারুফ এলো।দুজনেই রিকশা নিলো।

কিছু জানিস ওই দিকের খবর?

তুই বললেই জানতে পারব।

আরাফ বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।ফুপা বোধহয় মত জানিয়ে দিয়েছে।

মিশকাত হাসলো দুপা ছাড়িয়ে আরাম করে বসলো।

এতসব কবে হলো?

গতকালই হয়েছে।আয়রার শ্বশুর বাড়ির কথা ভেবেই বোধহয় ফুপা এত দ্রুত রাজি হয়েছেন।তা না হলে দেখিস নি রাফাতের সময় কতদিন ধরে খোঁজ খবর চালিয়েছেন।

এবার খোঁজ নিয়ে কি করবে বিয়ে টাই তো হবে না!

কি বলছিস?কেন হবে না?তুই কি এখন বিয়ে ভেঙে দিবি তনুর?মারুফ অবাক হয়েছে ভীষণ।

মিশকাত এত সামান্য কিছু করে না।যা হবে তা এমনিই হয়ে যাবে।দুদিন পর শুনিস বিয়ের প্রস্তাব যেভাবে এসেছে সেভাবে ফিরে গেছে।

এত নিশ্চিত হচ্ছিস কিভাবে?তোর ধারনা তো ভুলও হতে পারে।

তনুর ব্যাপারে আমার কখনো ভুল হয়েছে?

মারুফ একটু ভেবে বলল,তা হয়নি।তুই বলেছিলি তনু তোর মাকে নালিশ করতেই পারে না!যদি করেও থাকে এর মধ্যে অন্য কোনো কারণ আছে।

আমার বিশ্বাসটা ঠিক মিলে গেছে।এখন দেখবি এটাও মিলে যাবে।কি বলতো,কাউকে ভালোবাসলে নিজের মাঝে সুপারন্যাচারাল পাওয়ার চলে আসে।তবে আমার দেরিতে এসেছে।তা না হলে অনেক আগেই বুঝে যেতাম তনু সেদিন রাতে দেখা করতে আসবে না!

তুই যে পথে হাঁটছিস তাতে কি মনে হয়?

মিশকাত সে কথা জবাব না দিয়ে বলল,

খোঁজ নে তো।তনু এ দুদিন ভার্সিটিতে আসবে কিনা?

তনুর সাথে দেখা করবি?

নাহ।ঠিক দেখা করবো না অন্যকিছু করবো!

ভালোভাবে বলতো কি চাইছিস তুই?

বলব,আগে কিছু খেয়ে নেই।বাসে উঠে তোকে সবটা বলছি।সকালে কিছু খেয়ে বেরোই নি আজ।

মারুফ রিকশাওয়ালা কে বলল,মামা সামনে কোনো ভালো রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ায়েন তো।

আইচ্ছা মামা।

আরাফ মায়ের ঘরে মাথা নিচু করে বসে আছে।তার মা সমানে বকাঝকা করে চলেছে।কারণ,একটু আগেই তনুর বাবা জানিয়েছেন সবকিছু।তানভীর সাহেবে বলেছেন,

ওনার মেয়ের এই সমস্যাটা মানতে রাজি হলে হলে তবেই ওরা বিয়ের বিষয়ে ভাববে।তনুর সবটা ওনারা খোলামেলাই জানিয়েছেন।আরাফকেও বলে দিয়েছিলেন, তুমি বাবা বিয়ে করতে না চাইলে আমরা কিছু মনে করবো না।তবুও আগেই সব ভেবে চিন্তে নিও।বিয়ের পর আমার মেয়েকে অসুখী দেখতে পারব না।

তনুর বাবার এমন ব্যবহার ভালো লেগেছে আরাফের মায়ের।সত্যি লুকোনো হয় তাদের কাছে।আয়ারার পরিবার যে সত্যি ভালো পরিবার তা বুঝতে পেরেছেন।কিন্তু ছেলের কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেছেন।

আরাফ বলছে,সে তনয়াকেই বিয়ে করবে।বাচ্চা লাগবে না তার।যদি প্রয়োজন হয় দত্তক দেবে।কত নিষ্পাপ শিশু এতিমখানায় বড় হচ্ছে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনা দরকার।নিজের ঔরসজাত সন্তান হতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই।এরকম সমস্যা তো তার নিজেরও হতে পারতো।

ছেলের এমন আবেগী ভাষণে গলে না গিয়ে বরং রেগেমেগে চড় বসিয়ে দিয়েছেন।একমাত্র ছেলের গায়ে হাত তুলেছেন অনেকদিন পর।এই যে এতবড় কথা বলছে ঠিক একদিন বলবে তার নিজের সন্তান চাই।তনুর সমস্যাকে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে দেবে।যতই হোক তিনি একজন নারী।নিজেকে দিয়েই তো বোঝেন।আরাফ তার বিয়ের পাঁচ বছর পর এসেছে।এরপর তো অপারেশন করতে হলো।আরাফের বাবা প্রথম প্রথম ঠিক এমন কথাই বলেছিল।অথচ পাঁচটা বছরে কতশত ডাক্তার দেখিয়েছেন,কত মান অভিমান,অপমানের পালা চলেছে সেটা শুধু তিনিই জানেন।আরাফ একমাত্র ছেলে এখন যদি ছেলের বউও সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয় তাহলে কি করে হবে?

***
তনু ভার্সিটির থেকে বেরিয়ে মারুফকে দেখতে পেল।হেসে এগিয়ে এসে বলল,

কেমন আছো ভাইয়া?

ভালো আছি, তোর খবর কি?

এইতো ভালোই।কাজে আসছিলে?

উহু,তোর কাছে এসেছি?

তনু একটু অবাক হয়ে বলল,

আমার কাছে কেন?

প্রয়োজন আছে।চল আমার সাথে একটা জায়গায় তোকে নিয়ে যাব।

কোথায় যাবো?

গেলেই দেখতে পাবি।

তনুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টেনে নিয়ে গেল মারুফ।

চলবে..

তনয়া পর্ব-১০

0

#তনয়া
#পর্ব -১০
সিফাতী সাদিকা সিতু

বেশ কিছু মাস পার হয়েছে আয়রার বিয়ের।এরই মধ্যে আয়রা বেশ গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে।একটু একটু করে সংসার বুঝে উঠতে শিখছে।রাফাতের পুরো পরিবার তাকে আগলে রাখে সবসময়।বাড়ির জন্য মন খারাপ হলেই রাফাত প্রায় সময় অফিসে যাওয়ার পথে আয়রাকে নামিয়ে দিয়ে যায় আবার ফেরার পথে নিয়ে আসে।তবে আজ আয়রা বেশ চিন্তিত হয়ে আছে। একটু আগেই শ্বাশুড়ি ডেকেছিল।শ্বাশুড়ির ভাষ্যমতে,

“আজ বিকেলে রাফাতের বড় খালা আসবেন।আয়রাকে নিয়ে আগামীকাল তনুকে দেখতে যাবেন।আরাফ নাকি তনুকে খুব পছন্দ করেছে।যদিও একি ঘরে দুবোনের আত্মীয়র সম্পর্ক হোক তাতে নাকি আয়রার খালা শ্বাশুড়ির আপত্তি ছিল।আরাফ একমাত্র ছেলে হওয়ার দরুন না করতে পারেননি।তাছাড়া তনুকে অপছন্দও হয়নি।সবমিলিয়ে কথা হচ্ছে, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আয়রাদের বাড়িতে যাবে।”

কথা গুলো শোনার পর থেকেই আয়রা অস্থির হয়ে আছে।শ্বাশুড়িকে কিছু বলতে পারেনি।তনুর কথা ভেবে কান্না পেয়ে যাচ্ছে। এসব ব্যাপার নিয়ে তনুকে ঘাটানো মানে পুরোনো ক্ষতয় আঘাত করা।বাবা এখনো কিছুই জানে না তনুর বিষয়টা নিয়ে।এরকম ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে বাবা নিশ্চয়ই খুশি হবে।আরও একটা ব্যাপার আছে,বলতে গেলে প্রস্তাবটা আয়রার শ্বশুর বাড়ি থেকেই যাচ্ছে!এটা নিয়ে তেমন আপত্তি করা মানে ঝামেলা তৈরি হওয়া।সমস্যাটা খুলে বলতে হবে না হয় একদম মানা করে দিতে হবে।সরাসরি মানা করে দেয়াটা আয়রার শ্বশুড় শ্বাশুড়ি ভালো ভাবে নেবে না।এসব ব্যাপার আয়রা আগে বুঝত না।বিয়ের পর অনেক বিষয় এখন বুঝতে শিখেছে। আয়রা ঠিক করেছে মাকে আগে জানিয়ে রাখবে।এখন প্রায়ই এই ধরনের পরিস্থিতিতে পরতে হবে।তাই বাবাকে সবটা জানানো প্রয়োজন। দূ্র্বলতা কখনো ঢেকে রেখে চলা যায় না।প্রকাশ করতেই হয়।আর সম্পর্কের মধ্যে স্বচ্ছতা থাকা খুব প্রয়োজন।যে তনুকে ভালোবাসবে সে সবটা জেনেই ভালোবাসবে।সৃষ্টিকর্তা চাইলে তনুর জীবন অনেক সুন্দর হবে।যেটা দেয়ার ক্ষমতা মানুষের নেই সেটা নিয়ে আঘাত দেয়ার অধিকারও নেই।

তনুর দিনগুলো ভালোই কাটছে।নিয়মিত ভার্সিটিতে যাওয়া,মাঝে মধ্যে বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে যাওয়া,বাড়িতে থাকলে পড়াশোনা, মায়ের সাথে টুকটাক কাজ করা,ছাঁদের দোলনাটায় বসে বই পড়া এভাবেই বেশ ভালো সময় পার করছে।আয়রার বিয়ের পর প্রায় একা হয়ে গেছে।তন্ময় দিনের বেশি সময় স্কুলে থাকে,বাবা অফিসে। শায়লা বেগম সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকেন।সময় চলছে তার নিজস্ব গতিতে সেই সাথে তনুও এগিয়ে চলছে নিজের মতন।নতুন করে ওঠা ঝড়টা খুব দ্রুত সামলিয়ে নিয়েছে।মিশকাত নামটা খুব করে ভুলে থাকতে চাইছে।তনু নিজের মতো বাঁচতে চায়।সামাজিক নিয়মের বাইরে বেরিয়ে নিজের নিয়মে চলতে চায়।পড়াশোনা শেষে চাকরি করবে।কাজের মধ্যে থাকলে ভালো থাকবে সে।সময় পেলে শহরের কোলাহল থেকে দূরে যাবে।কিছুটা সময় প্রকৃতির বুকে শুয়ে কাটিয়ে দেবে।এইতো,জীবনে আর কি চাওয়া?সবাইকেই যে ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে,পরিপূর্ণ থাকতে হবে এমনটাও নয়।কিছু অপূণর্তা থাকুক না,ক্ষতি কি?

বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে জানতে পারলো, আয়রার শ্বশুর বাড়ি থেকে মেহমান আসবে । তাই আজ কিছু রান্নাবান্না করে রাখছে।তনুকে শুধু বলেছে ড্রয়িংরুমটা ভালোভাবে গোছাতে।

তনু ঘরে এসে শুয়ে পরলো।ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।ভার্সিটি থেকে ফিরলে খুব ক্লান্ত লাগে।কাল আপা আসবে ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেল।গোসল করার জন্য উঠে কার্বাড থেকে কাপড় বের করতেই ফোনটা বেজে উঠলো।অচেনা নম্বর দেখা ফোনটা রিসিভ করবে কিনা ভাবতেই বন্ধ হয়ে গেল।সাথে সাথেই আবার ফোনটা বেজে উঠলো।এবার সে রিসিভ করে সালাম দিলো,

ওপাশ থেকে কোনো জবাব পেল না।তনু কয়েকবার হ্যালো বললেও কোনো সাড়া না পেয়ে কেটে দিলো।বিরক্ত হয়ে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

ওপর প্রান্তে থাকা মিশকাত তখনও ফোনটা কানে চেপে ধরে আছে।অনেকদিন পর তনুর কথা শুনতে পেল,নিশ্বাসের শব্দ অনুভব করতে পারলো!সেই রাতে ছাঁদে বলা তনুর কথাতেই আঁটকে ছিল এতদিন।মনটাকে আর দমিয়ে রাখতে না পেরে আজ তনুকে ফোন করে বসলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারেনি।কি দরকার তনুর তিক্ততা বাড়িয়ে তোলার?

সেদিন জ্বরের ঘোরে তনু যখন লুটিয়ে পরেছিল মিশকাতই তাকে আঁকড়ে ধরেছিল।তনুর শরীরের তীব্র উষ্ণতা খুব করে টের পাচ্ছিলো।সেই প্রথম ছিল দুজনের উষ্ণ আলিঙ্গন। না ভুল হলো,দুজনের নয় তার একার।তনু তো নিজের জ্ঞানেই ছিল না।ছিল না জন্যই মিশকাত তনুর কাছাকাছি আসতে পেরেছিল।তনুকে অসুস্থ দেখে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল।তনুকে পাঁজাকোলা করে ছাঁদ থেকে নামিয়ে ঘরে নিয়ে এসেছিল।ঘন্টাখানেক পাশে বসে তনুর হাত চেপে ধরেছিল।পরে মারুফের সাহায্য নিয়ে শান্তাকে ডেকে এনেছিল।ব্যাগ থেকে ওষুধ এনে শান্তাকে দিয়েছিল তনুকে খাইয়ে দেয়ার জন্য। এরপর সে রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে পরেরদিন সকালেই বেরিয়ে পরেছিল ফুফু আর বাবাকে বলে।পরিক্ষার অযুহাত দেয়ায় খুব সহজ হয়েছে আসাটা।অসুস্থ তনুকে ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হয়েছিল।সে কষ্টটাও সহ্য করে নিয়েছিল শুধুমাত্র তনুর জন্য!একদিন সে ঠিক তনুকে বুঝিয়ে দেবে তার ভালোবাসা কোনো ঠুনকো বিষয় নয়।মিশকাতের কাছে তনুকে ভালোবাসা গোটা একটা জীবনের নাম!

***

শায়লা বেগম মনে মনে ছটফট করছেন।এমন একটা সময় তনুর জন্য এমন ভাবে বিয়ের প্রস্তাব আসবে তা কি ভাবতে পেরেছিল?তনুর বাবা নিশ্চয়ই খুব খুশি মনেই প্রস্তাবটা গ্রহণ করবেন!তনুর মতামত জানতে চাইলে তখনই হবে আসল সমস্যা। তনু কিছুতেই রাজি হবে না।বিয়ে বিষয়টা ভাবলেই তনু অন্যরকম হয়ে যায়।এবার বোধহয় তনু চুপ করে থাকবে না?বাবাকে সবটা জানিয়ে দেবে মেয়েটা।মেয়েটার বুকে যে কষ্টের পাহাড় জমে আছে!

“মা, তনুকে তো কিছুই বলা হয়নি?ওরা এখন হয়ত বাবার সামনে কথা গুলো বলবে।তনু যে কি কান্ড ঘটিয়ে বসে কে জানে?আয়রা ফিসফিসিয়ে মায়ের কানের কাছে এসে বলল।”

“তাই তো ভাবছি।এতদিন যা চেপে ছিল তা আজ বলে বসবে?তনু রেগে গেলে তোর শ্বশুর বাড়ির মানুষজন কি ভেবে বসে কে জানে?”

“আমি বা কি করবো? নিজের বোনের কথা তো ওভাবে বলা যায় না!আর তনুকে ছোট করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।ওরা যা ইচ্ছে ভাবুক, তনু শুধু কষ্ট না পেলেই হয়।”

“কষ্ট নতুন করে আর কি পাবে?আমার এত ভালো মেয়েটার জীবনে এতকষ্ট কেন আসলো বলতো?বড় ভাবীর কাছ থেকে যেদিন জেনেছিল সেদিন থেকেই ওর সমস্ত সুখ হারিয়ে গেছে?মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।হুট করে এসে আমায় প্রশ্ন করে বসতো,মা আমার বাচ্চা না হলে কি খুব সমস্যা হবে?বাচ্চা না থাকলে কি সুখ থাকে না?এটা কি খুব বড় দোষ আমার?ও যখন নিজেকে বোঝাতে পারতো না তখন এসব বলতো।এখন দ্যাখ, এসব প্রশ্ন ভুলেও কখনও করে না।ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছে,স্বাভাবিক হয়েছে।ভুলেও বুঝতে দেয় না ওর কষ্ট গুলো।”শায়লা বেগম শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন।

আয়রাও প্রায় কেঁদে ফেলেছে। তনুর জীবনটা কেন এত এলোমেলো?আয়রা মনে মনে ঠিক করে নিলো যতদিন না তনুর জীবনটা সুন্দর হচ্ছে ততদিন সে বাচ্চা নেবে না!তনুর দুর্বল জায়গায় আঘাত সে কখনো করবে না।নিজের বোনটা গুমরে গুমরে শেষ হয়ে যাবে আর সে হাসি আনন্দে জীবন কাটাবে তা হতে পারে না!

আরাফের মায়ের পাশে বসে তনু উসখুস করছে। সেই কখন থেকে বসে আছে!ভদ্রমহিলা তার হাত ছাড়ছেই না।অথচ বড়দের কথার মাঝে একটু থাকতে ইচ্ছে করছে না তার।তনু খেয়াল করেছে ভদ্রমহিলা নিজের ছেলের গুনগান করছেন খুব।আরাফের ছোট বেলা থেকে পড়াশোনা চাকরি,প্রমোশন সবকিছু বলা শেষ করেছেন।তনু বুঝতে পারছে না কেন এত আরাফের কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকে শোনানো হচ্ছে। বিয়ের দিন উনি অনেক প্রশ্ন করছিল কথাটা মনে হতেই তনু খুব সহজেই বিষয়টা বুঝে গেল।সাথে সাথেই শিরদাঁড়ায় শিরশিরে অনুভূতি হলো।বুকের ভেতর কাঁপন ধরলো।চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

আন্টি আপনারা বসেন আমি একটু আসছি।কথাটা বলে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।এমন পরিস্থিতিতে যে তাকে পরতে ত অনেক আগে থেকেই বুঝেছিল।।মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিল এসবের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। তবু আজ নিজেকে হঠাৎ অসহায় লাগছে।আরাফের মায়ের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বিধ্বস্ত হয়ে গেল কেন?কেন নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলো না?

এরপরের ঘটনা গুলো খুব দ্রুতই ঘটে গেল।তনুর বাবা খুশি মনে প্রস্তাবটা গ্রহণ করলেন।আয়রার খালা শ্বাশুড়ি সবাই নিজের বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন।তনুর মতামত থাকলেই দ্রুত সবকিছু করার ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন।তনুর বাবাও আস্বস্ত করেছেন,তনুর মতামত অবশ্যই থাকবে।

শায়লা বেগম আয়রা অসহায় হয়ে সবটা দেখে গেল।শায়লা বেগম নিজের ভুলটা এতদিনে বুঝতে পারলেন।তনুর বাবার থেকে এতবড় একটা বিষয় লুকোনো মোটেও ঠিক হয়নি।এই ব্যাপারটা লুকিয়ে তিনি তনুকেও কষ্ট দিয়েছেন।কারণ,মা হতে না পারাটা কোনো অন্যায় বা দোষের নয়!এই বিষয়টা তনুর গোটা জীবন হতে পারে না বড়জোড় জীবনের একটা অংশ হতে পারে।সত্যি তো এতবড় দুর্বলতাও নয় যে এভাবে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক করে তুলতে হবে?যেটা মানুষের হাতে নেই তা নিয়ে দুর্বল হওয়ারও কিছু নেই!

চলবে..

তনয়া পর্ব-০৯

0

#তনয়া
#পর্ব -৯
সিফাতী সাদিকা সিতু

ঘুম ভেঙে মায়ের মুখটা চোখে পরলো তনুর।শায়লা বেগম বসে আছেন তনুর মাথার পাশে।কপালে জলপট্টি দেয়া।তনুকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে শায়লা বেগম বললেন,

“কিভাবে এমন জ্বর বাঁধালি?রাতে আমার কাছে আসলি না কেন?”

“খুব সমস্যা হয়নি তো।হঠাৎ জ্বর এসে যাবে বুঝতে পারিনি।আপা ফোন করেছে,মা?”

“হুম করেছে।তোর জ্বরের কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠেছে।তুই যেতে পারবি না বুঝতে পেরে বোধহয় খুব মন খারাপ করেছে।”

“কেন যেতে পারবো না?তুমি শুধু শুধু আপার মন খারাপ করিয়ে দিলে।এমনিতেই তো নতুন পরিবেশে গিয়ে আপা খুব নার্ভাস হয়ে আছে!”

“পাগল নাকি তুই,এই শরীর নিয়ে কিভাবে যাবি?বেশি অসুস্থ হলে তখন কে দেখবে?আমি তোকে কিছুতেই যেতে দেব না।আয়রাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলব।”

‘ফুফুরা তো সবাই থাকবে।এখন তো আমার জ্বর কমে গেছে।”

“বেশি বুঝিস না তনু?তোর শরীরে এখনো জ্বর আছে।দূর্বল হয়ে গেছিস।তোর বাবাও বলে দিয়েছে তোর যাওয়া হবে না।”

“আপা খুব কাঁদবে আমায় দেখতে না পেয়ে।যখন দেখবে সবাই আছে কিন্ত তুমিও নেই,আমিও নেই তখন দেখবে সত্যি সত্যি খুব মন খারাপ করবে।তুমি তো জানো আপা কেমন?”

“সেটা জানি জন্যই তোর বাবাকে পাঠাচ্ছি।তোর বাবা গেলে অনেকটা সামলে নিতে পারবে।”

“বাবা যাবে!”

“হুম,তুই যেতে পারবি না জন্যই তোর বাবাকে যেতে বলেছি।তা না হলে তো যেত না।মেয়ের শ্বশুর শ্বাশুড়ি কেউ এখনো আমাদের বাড়িতে আসলো না তার আগে আমরা কিভাবে যাই?তবু আয়রার জন্যই যাওয়া।আমাদের কাউকে দেখতে না পেয়ে মেয়েটা সত্যি সত্যি পাগলামি করবে।তাও তন্ময়কে সাথে দেয়াতে একটু ভরসা ছিল।ওর সময় লাগবে অনেকটা আমাদের ছেড়ে থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে।”

তনু মায়ের কোলে মাথা রাখলো।মায়ের কষ্টটা খুব করে অনুভব করতে পারছে সে।মেয়েরাই বোধহয় মায়ের কষ্ট গুলো বুঝতে পারে!সে নিজে তো মা হতে পারবে না তাই সন্তানের জন্য মায়ের কেমন কষ্ট হয় তা খুব করে বোঝার চেষ্টা করছে।

আয়রাকে সাজানো হচ্ছে।অথচ আয়রা ছটফট করছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মাকে ফোন করেছিল।তখনই তনুর জ্বরের খবর পেল।সেই থেকে মনটা খারাপ হয়ে আছে ।তনু নিশ্চয়ই আসবে না আজ!এটা ভেবেই অস্থির হয়ে আছে।

রাফাত ঘরে ঢুকে আয়রাকে দেখে হাসলো।সে বেশ বুঝতে পারলো আয়রার কি চাই?

রাফাত তনুকে ফোন করলো।তনুর ফোনটা শান্তার কাছে ছিল।শান্তা ফোন এনে তনুকে দিলো।

“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া,কেমন আছেন?”

“রাফাত সালামের জবাব দিয়ে বলল,ভালো আছি।কিন্তু তোমার আপা বোধহয় ভালো নেই?তোমাকেও নিয়ে আসা উচিত ছিল।”

তনু হাসলো।গলার স্বর বসে গেছে তাই হাসিটা রাফাত শুনতে পেল না।সে বলল,

“ভাইয়া আপনি ভিডিও কলে আসেন।”

রাফাত বিনাবাক্য ব্যয়ে তনুকে ভিডিও কল করলো।তনু ইশারায় আয়রাকে ফোনটা দিতে বলল।রাফাত আয়রার সামনে ফোনটা রেখে বলল,

“তোমার সাজ বোনকে দেখাও।তা না হলে দেখা যাবে মেকআপ কালো হয়ে গেছে খুব তাড়াতাড়ি।”

আয়রা লজ্জা পেল।রাফাতের দিকে ছলছলে চোখে তাকালো। রাফাত বিনিময়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে গেল নিজের কাজে।আয়রাকে হাসিখুশি রাখার জন্য সে সবসময় চেষ্টা করে যাবে।সে জানে আয়রা নামের মেয়েটা সবাইকে ভালোবাসতে জানে,ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখতে পারে।রাফাতের তো শুধু ভালোবাসা চাই!মায়ায় ভরপুর মেয়েটার মায়ার সাগরে ডুবে থাকা চাই!

“আপা এত নার্ভাস কেন হচ্ছো?তোমায় বলেছিলাম না তোমার মতোই আরেকজন ভালোমানুষ রাফাত ভাইয়া!তুমি খুব ভাগ্যবতী আপা!তোমার কোমলতা কখনো কঠোরতায় পরিনত হতে দেবে না! ”

“ধুর,কি বলছিস?”

“সত্যি বলছি, তুমি ভেবে দেখতো,ভাইয়া কিভাবে বুঝলো তুমি আমাকে দেখার জন্য ছটফট করছিলে?”

আয়রার ভেতরটা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল।রাফাত যে অন্যরকম একটা মানুষ তা সে গতরাতেই বুঝতে পেরেছে।একজন নারী তো তখনই পরিপূর্ন যখন সে একজন ভালো জীবনসঙ্গী পায়।সেই জীবনসঙ্গী ধীরে ধীরে আত্মার সঙ্গী হয়ে ওঠে।আয়রার এই প্রথম বাবা,ভাই ছাড়া কোনো পুরুষকে ভালোবাসার হাতেখড়ি হলো রাফাতের মাধ্যমে।জীবন নামক বইয়ে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।

***

মিশকাত সকাল সকাল বেরিয়ে এসেছে তনুদের বাড়ি থেকে।সে এখন বাসে বসে আছে।সোজা ভার্সিটিতেই যাবে।তনুর কথা সে রেখেছে।অনেক দূরে চলে এসেছে সে তনুর থেকে,অনেকটা দূরে!
বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে।তনুর সাথে কৈশোরের কাটানো সুন্দর স্মৃতি গুলো মানসপটে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। তনুর ঝর্ণার মতো প্রানবন্ত চমৎকার হাসির ফোয়ারা যে খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তার মন চুরি করে নিয়েছিল!কি সুন্দর ছিল মুগ্ধ হওয়ার দিন গুলো,প্রেমে পড়ার দিন গুলো!মিশকাতের সামনের সিটে দুটো ছেলে মেয়ে বসেছে।মেয়েটা ছেলেটার ঘাড়ে মাথা রেখেছে।দুজনে হাতে হাত রেখে বসে আছে।মিশকাতের বুকটা চিনচিন করে উঠলো। তারও তো এরকম কতশত স্বপ্ন ছিল তনুকে ঘিরে।

“বাদল দিনে তনুর হাত ধরে সারা শহর হাঁটবে।মেঘের গুড়গুড় শব্দ ভালোবাসাময় শব্দ হয়ে উঠবে।তনুর কাজলদিঘী চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকবে অপলক,খুঁজতে চাইবে ভালোবাসা।হুট করেই তনুকে নিয়ে পাড়ি জমাবে মেঘেদের দেশে।তনুর কাঁধে মাথা রেখে সূর্যদয় দেখবে,পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে তাদের ভালোবাসার চিহ্ন আঁকবে, গল্প রচনা করবে!কখনো বা তনুর প্রতি অভিমানের পাহাড় জমাবে একটু ভালোবাসা কম পরলেই।ঘুমিয়ে থাকা তনুর পা দুটো কোলে নিয়ে আলতায় রাঙিয়ে দেবে।ঘুম ভাঙার পর তনুর যখন আনন্দে চোখে জল আসবে তখন সে খুব যত্ন নিয়ে তা মুছে দেবে।গভীর রাতে হুটহাট ঘুম থেকে জাগিয়ে তনুর কাছে আবদার জুড়ে দেবে বিরিয়ানি খাবার জন্য!তনু যখন ঘুম চোখে তাকে বকবে আর রান্না করবে তখন সে মিটিমিটি হাসবে!শীতের রাতে বারান্দায় বসে গায়ে চাদর জড়িয়ে দুজনে কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে থাকা চাঁদকে খুঁজবে।অবসরে তনুর কোলে মাথা রেখে কল্পনার রাজ্যে ডুবে যাবে।বুড়ো হলে দুজনকে কেমন লাগবে দেখতে সেই ভাবনায় ব্যকুল হবে।তনুর লম্বা ঘন রেশমি চুলগুলো সাদা হবে,মসৃণ ত্বক কুঁচকে যাবে তখন তনুকে কেমন লাগবে সেই কল্পনায় বিভোর হবে।কল্পনা শেষে চমকে উঠে বলবে,বুড়ি তনুকে তো দেখতে অসাধারণ লাগবে!তনু তখন তার বুকে মৃদু কিল বসিয়ে দেবে লজ্জা পেয়ে।”

মিশকাতের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো অজান্তেই। ছেলেরা কাঁদে না কে বলল?প্রতিটা ছেলেকেই ভালোবাসার কাছে পরাজিত হতে হয়,প্রিয়তমার অবহেলার কাছে অসহায় হতে হয়।ভালোবেসে গুমরে গুমরে মরতে হয়!আচ্ছা, সে কি চেয়েছিল এমন যন্ত্রণাময় ভালোবাসা?

ফোনের শব্দে মিশকাত নিজেকে স্বাভাবিক করলো। ফোনের স্ক্রীনে বাবার নম্বর দেখে রিসিভ করলো।

“তুই পৌঁছে গেছিস, বাবা?”

“নাহ্,একটু পরেই পৌঁছাব। তুমি চিন্তা করো না।আমি হলে পৌঁছে তোমায় ফোন করবো।”

“তোর মা কিন্তু খুব রেগে গেছে। পরে কথা বলিস একটু।এভাবে হুট করে চলে গেলি,পরিক্ষা না থাকলে তোকে মানা করতাম যেতে।”

“কিছু করার নেই বাবা।মাকে বুঝিয়ে বলো।” মিশকাতের গলাটা ধরে এলো।

“তোর গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন রে?”

“কেমন আবার শোনাবে?বাসে আছি তো তাই হয়ত নেটওয়ার্কের সমস্যা হচ্ছে।”

“কোনো সমস্যা হলে আমায় জানাস।” টাকা লাগলে সেটাও বলিস?”

“বাবা, তোমার কাছে যদি কখনো খুব বেশি কিছু চেয়ে বসি যেটা হয়ত তোমার সাধ্যের মধ্যে নেই তাহলে কি সেট জিনিসটা আমায় দেবে?”

মিশকাতের বাবা একটু চুপ করে থেকে বললেন,

“আমার ছেলেকে আমি জানি।সে আমার সাধ্যের বাইরে কিছুই চাইবে না।যদি কখনো চাস তাহলে বুঝে নিবো খুব প্রয়োজনীয় কিছু যা তোর জীবনের সাথে জড়িত!আমি বাবা হয়ে সেই জিনিসটা তোকে দেয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করবো।”

মিশকাত নিজেকে আর স্বাভাবিক রাখতে পারলো না।কোনোরকমে বলল,

“থ্যাংক ইউ বাবা,রাখছি।”

এত কষ্টের মাঝেও মিশকাতের হাসি পেল।মানবমন কত বিচিত্র। সবাই নিজের মতো করে সম্পর্ক গুলোকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়।অথচ সবাই ভুলে যায় প্রতিটি সম্পর্কেরই নিজস্বতা আছে!

সবাই আয়রার বউভাতে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। তনু বালিশে ঠেস দিয়ে বসে দেখছে।সকাল থেকেই সে মিশকাতের কথা ভাবছে।গতরাতে কি হয়েছিল ছাঁদে কিছুই মনে নেই।ছাঁদ থেকে একা কি করে ঘরে এসেছে সেটাও জানে না।ঘর ছেড়ে বের হতে ইচ্ছে করছে না।উঠলেও মায়ের বকুনির খেতে হবে।অথচ মনটা ছটফট করছে মিশকাত ভাইকে দেখার জন্য। হঠাৎ খাতাটার কথা মনে হলো তার।বিছানায় ভালোভাবে দেখলো কিন্তু পেল না।তার স্পষ্ট মনে আছে সে গতরাতে তার শোয়ার বালিশের নিয়ে রেখেছিল।তাহলে নেই কেন? শান্তাকে ডেকে বলল,

“আমার খাতাটা তুই নিয়েছিস?”

“নাহ,তোর খাতা তো আমি সকালবেলা টেবিলে দেখেছিলাম।”

তনু দ্রুত বিছানা ছেড়ে টেবিলের কাছে আসলো।হুড়মুড়িয়ে পরতে ধরলে চেয়ারের হাতল ধরে নিজেকে আঁটকালো।শান্তা তাই দেখে রাগী চোখে তাকালো।তনু হেসে বলল,

“মাকে বলিস না প্লিজ!আর উঠবো না বিছানা ছেড়ে।”

“তুই এই খাতাটায় কি পেয়েছিস বলতো?মনে হচ্ছে তোর প্রান ভ্রমরা এই খাতাটা!”

তনু কিছু না বলে শুধু হাসলো।

“তাহলে বোধহয় আমার ধারনাই ঠিক তুই প্রেমপত্র লিখছিস? ”

“ধুর,এসব কথা বলা ছাড়া তুই থাকতেই পারিস না।আচ্ছা শোন,তোরা তো সবাই এক গাড়িতেই যাবি, তাহলে মিশকাত ভাইকে বলিস তো ফিরে এসে যেন আমার সাথে দেখা করে।”

“মিশকাত ভাই তো সকালে চলে গেছে, জানিস না?”

তনুর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো।নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

“কেন হঠাৎ চলে গেল?”

“শুনলাম পরিক্ষার ডেট দিয়েছে নাকি । তাড়াতাড়ি হলে ফিরতে হবে।তাই তো সকালেই বেরিয়ে গেছে।”

“ওহহ।বড়মামা মামি আছে? ”

“হ্যাঁ আছে।মামি নাকি আয়রা আপার শ্বশুর বাড়ি থেকে সোজা চলে যাবে।এখানে আর আসবে না।ওনার নাকি শরীরটা খারাপ।”

তনুর কেমন যেন খটকা লাগলো।মিশকাত ভাই চলে গেল মামিও থাকতে চাইছে না!নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে।সে এবারও মিশকাত ভাইকে কথা গুলো জানাতে পারলো না!দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো তনু।মিশকাত ভাই কাছে এসে আবার চলে গেল অথচ কিছু বলা হয়ে উঠলো না।এই বিষয়টা গলার কাঁটার মতো বিঁধে থাকবে মনে।নিমিষেই মনটা খারাপ হয়ে গেল।কান্না গুলো গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে! এত কেন কষ্ট হচ্ছে তার?

চলবে..

তনয়া পর্ব-০৮

0

#তনয়া
#পর্ব -৮
সিফাতী সাদিকা সিতু

“সেদিন রাতে তোমার সাথে দেখা করতে যাইনি আমি।জানতাম অপেক্ষায় ছিলে।নিশ্চয়ই ছটফট করেছিলে খুব!যাইহোক তোমার অনুভূতি গুলো তোমার মধ্যেই থাকুক। আমি চাইলেও সেই অনুভূতির যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারব না কখনো।তবে কি জানত,তোমার আমার মনের ভেতর কি চলছে সেটা বড়মামি খুব সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন।মায়েরা সবটা বুঝতে পারে! হয়ত তোমার আমার না হওয়া সম্পর্কের কারণ এটাই!কি ভাবছ, বড়মামিকে দোষারোপ করছি?উহু,মোটেও না।নিজের এত দোষের ভীড়ে অন্যকে কি দোষ দেব।ভুল বলো,অন্যায় বলো যদি কিছু হয়েই থাকে সেটা আমার হয়েছে।তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না কি বলতে চাইছি, তাইনা?

আচ্ছা বলছি,
তুমি তো জানো বড়মামা বড়মামির কত আদরের ছিলাম আমি।সেদিন সন্ধ্যা বেলা বড়মামি আমায় ডেকে তার কাছে বসিয়ে বললেন,

“আয় তোর চুল গুলো ভালো ভাবে বেঁধে দেই।সারাদিন খুলে রেখেছিস জট লেগে গেছে।”

আমি খুশি মনে বসেছিলাম চুল বাঁধতে ।মামি প্রথমেই বললেন,

“এই যে এত সুন্দর চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াস আমার ছেলের মাথাটা নষ্ট করতে বুঝি?”কি সুন্দর ভাবে হেসে বলেছিল কথাটা!প্রথমে আমি সত্যি বুঝতে পারিনি মামির কথা।সদ্য কলেজে পা দেয়া আমি তখনও এই কথাটার গাম্ভীর্য বুঝে উঠেনি।

মামি আবার বললেন,”আমি জানি মিশকাতের মনে কি চলছে তোকে নিয়ে।তবে তোকে সাবধান করে দেই তনু, ভুলেও মিশকাতের দিকে পা বাড়াস না!এরবেশি কিছু আমি বলতে চাইনা।”

আমি অবাক হয়ে মামির দিকে তাকিয়ে ছিলাম।ধীরে ধীরে সবটা বোঝার পর লজ্জা সেই সাথে ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম।আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মামি বলেছেন,

“খুব অবাক হচ্ছিস তাই না?ভাবছিস আমি কিভাবে জানলাম তোদের দুজনের মনের খবর?জেনেছি জন্যই চেপে যেতে বলছি তোকে।ভুলেও মিশকাতের কাছাকাছি যাবি না।যে সম্পর্কটা তোদের শুরু হবার কথা তা যেন কখনোই না হয়।”

আমার বুকের ভেতর তখন তোলপাড় চলছে। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না।লজ্জা দূরে রেখে মামির পায়ের কাছে বসে বললাম,

“কেন এমন বলছ বড়মামি?মিশকাত ভাইয়ের কাছে যেতে কেন বাঁধা দিচ্ছো?মিশকাত ভাই আমায় পছন্দ করে!”

“পছন্দ যখন করে তখন একদিন অপছন্দও করবে।তোকে যেটা বলেছি সেটা মাথায় রাখিস।”

আমি মামির পা দুটো আঁকড়ে ধরে বলেছি,

“তোমার আদরের তনু তোমার ছেলের বউ হোক তা চাও না কেন?”

“কারণ,তুই কখনো আমার মিশকাতের জীবনে সুখ এনে দিতে পারবি না তাই।”

“কি বলছ,কেন পারব না?আমি মিশকাত ভাইকে ভালোবাসি। ”

“ভালোবাসা আর সুখের পার্থক্য বোঝার মতো বয়স,জ্ঞান তোর কোনটাই হয়নি তনু!জীবনে ভালোবাসা না থাকলেও চলে কিন্তু সুখ, সেটা লাগে রে।আমি আমার সংসারে সুখ চেয়ে এসেছি, আমার ছেলের জীবনেও তাই চাইবো।”

“কিসের সুখ আমায় বলো, দেখবে আমি ঠিক পারব।”

“পারবি না তুই?”

আমি নাছড়বান্দার মতোর বলেছিলাম,

“পারব,তুমি বলে দেখ আমি ঠিক পারব।”

মামি কিছুক্ষণ কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।এরপর বলেছিলেন,

“তুই কখনো মা হতে পারবি না তনু!তোর সাথে বিয়ে হলে আমাদের সংসারটা শেষ হয়ে যাবে।”

আমি তখন বজ্রাহত হয়ে বসেই রয়েছি।মামির কথা আসলেই কিছু বুঝতে পারছি না।”মা “হতে পারব না কেন?বিয়ের পর তো সব মেয়েরাই মা হয়।আমি তখন এতটাও ছোট নই যে বিয়ে, নারী পুরুষের সম্পর্ক, সন্তান এসব বিষয়ে বুঝবো না।

“কি বলছ মামি?”মা “কেন পারবো না?আমার বিয়ে হলেই তো মা হতে পারব।তুমি আগেই কেন এসব বলছ?

আমি জানি তাই বলছি।তোর আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোর মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। তোর মনে নেই কিছুদিন আগে পেট ব্যাথা নিয়ে হসপিটালের ভর্তি ছিলি দুইদিন।আমিও তো ছিলাম।দুলাভাই বাইরে থাকায় তোর মামা তোকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিল।তখন রিপোর্টে এসেছিল তুই কখনো মা হতে পারবি না।এ জন্যই তোর পিরিয়ডের সমস্যা হতো।আজ তোর মিশকাতের সাথে সম্পর্ক হলে কাল আমি ছেলের সুখের কথা ভেবে তোদের বিয়ে দিয়ে দিলাম। বিয়ের পর যখন তুই মা হতে পারবি না, তখন মিশকাতকে কি জবাব দিবি?”

মামির এই কথাটাই আমায় প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল।সত্যি তো, কে না চায় নিজের সন্তান। তোমায় আমি কি জবাব দিতাম?এখন যতটা কষ্ট হচ্ছে তখন তো আরও বেশি কষ্ট হবে।সেই কষ্টের সীমানা থেকে বের হতে পারব না।

আমি ছুটে মায়ের কাছে গিয়েছিলাম।প্রশ্ন করেছিলাম আমায় এই কথা কেন জানানো হয়নি?পরে এই নিয়ে বড়মামির সাথে মায়ের কথা কাটাকাটি হয়। সেই থেকে বড়মামির সাথে মায়ের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে।তার পরেরদিন সকালেই মা আমায় নিয়ে চলে আসে।তোমায় কিছুই জানাতে পারিনি।তোমার সামনে দাঁড়ানোর সাহসটুকুও সেসময় আমার ছিল না।সদ্য পাওয়া আঘাতটা সামলিয়ে ওঠার মতো মানসিক দৃঢ়তা ছিল না।তবে একটা কাজ আমি করেছিলাম,

মামিকে বলে গিয়েছিলাম তোমায় এমন কিছু বলতে যাতে আমার মতো তুমিও নিরবে সরে যাও।না হওয়া সম্পর্কের রেশ টেনে নিয়ে না চলো।

আমি জানতাম না মামি তোমায় কি বলেছিল।নতুন বাড়িতে ওঠার সময় মারুফ ভাই এসেছিল।তার কাছ থেকেই জানতে পারি,

মামি তোমায় বলেছিল,আমি নাকি তার কাছে তোমার নামে নালিশ করেছি।তুমি আমায় বিরক্ত করো খুব,আমি তোমায় নিজের ভাইয়ের চোখে দেখি অথচ তুমি নাকি আমায় অন্য চোখে দেখ।এমন ধরনের অনেক কিছুই বলেছিল হয়ত।তুমি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছিলে!কষ্ট পেয়েছিলে কিনা সেটা না হয় নাই বা জানতে চাইলাম।অবশ্য ভালোই হয়েছে তুমি অনেকটা সরে গেছ আমার কাছ থেকে।এরপর কোথাও দেখা হলেই আমি তোমায় এড়িয়ে চলেছি তোমার প্রশ্নবাণে জর্জড়িত হবার ভয়ে।

মারুফ ভাই বলেছিল,আমি নাকি ছোট ছিলাম তাই তুমি আমায় মাফ করে দিয়েছ?কেন দিয়েছ মিশকাত ভাই?তুমি বোধহয় বিশ্বাস করতে পারোনি আমি মামিকে তোমার নামে নালিশ করেছিলাম, তাই তো?

আমার বাবাও আজ পর্যন্ত জানে না এই ব্যাপারটা।হয়ত জানবে একদিন। আমার সবচেয়ে বড় দোষের কথা একদিন পুরো পৃথিবী জানবে।সবচেয়ে বড় দোষই তো,এই কারনেই তো ভালোবাসা হারাতে হয়েছে।সেদিনের পর অনেকটা সময় লেগেছিল নিজেকে স্বাভাবিক করতে।দুটো মাস ঘরবন্দী হয়েছিলাম।কলেজ যেতাম না,বাইরে বের হতাম না,পড়াশোনা করতে পারতাম না।শুধু মনে হত আমি “মা” নামক পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর অনুভূতির সাথে কখনো পরিচিত হতে পারব না।নারীর সার্থকতা যে অনুভূতিতে তা থেকে আমি বঞ্চিত।

তুমি বলতো আমায় মিশকাত ভাই,আমার কি করা উচিত?ভালোবাসলেই কি ঘর বাঁধতে হয়?তুমি হয়ত বলবে এটা কোনো সমস্যা নয়, ভালোবাসায় বাঁধা হতে পারে না। তোমার ভাবনায় সমাজ,পরিস্থিতি কখনো থেমে থাকবে না।কখনো না কখনো তুমি নিজের সন্তানের আশা করবে!হয়ত আমায় বুঝতে দেবে না কখনোই তবু দুজনের মধ্যে যোজন বিয়োজন থাকবে।প্লিজ মিশকাত ভাই আমি আর তোমায় ভাষায় বোঝাতে পারছি না।আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে।সম্পর্কের জটিলতা কেউ পছন্দ করে না। তোমার জীবন তুমি সুন্দর ভাবে সাজিয়ে তোলো।কেন পেছন ফিরে চাও বারবার?অতিত কখনো ভবিষ্যৎ হয়?সবটা জানার পর আশা করি তুমি নতুন কোনো ঝামেলা করবে না।সবার আগে তোমার মায়ের কথাটা ভেব।নিজের সুখের চিন্তা করার আগে সবার সুখের কথাটা একবার ভেবে নিও।”

তনু খাতাটা বন্ধ করে বুকে চেঁপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। বুকের ভেরতটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই আয়রাকে বিদায় দিয়ে পুরো পরিবারে বিষাদের ছায়া ভর করেছে।শায়লা বেগম নিজের ঘরে কাঁদছেন। চাচী ফুফু সবার মনই খারাপ।সবাই শায়লা বেগমকে সবাই শান্তনা দিচ্ছে। তনু আয়রাকে বিদায় দিয়ে এসে খাতাটা নিয়ে বসেছে লিখতে।তনুর কান্নার শব্দে শান্তা এসে জড়িয়ে ধরলো।সবাই ভাবছে বোনের জন্য কাঁদছে তনু।শুধু তনুই জানলো, সে কেন কাঁদছে! কোথায় তার কষ্ট হচ্ছে!

“আচ্ছা, তনুর মনের এই হাহাকার কি মিশকাত অব্দি পৌঁছেছে?”

***

রাত অনেকটাই গভীর।সবাই ক্লান্ত হওয়ার দরুন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।ঘুম শুধু নেই তনুর চোখে।জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর।বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে।শুয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। বাধ্য হয়ে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকলো।সময় নিয়ে মাথায় পানি ঢাললো।শরীর দূবল হয়ে গেছে।ঘুম আসবে না তাই সে পা বাড়ালো ছাঁদের উদ্দেশ্যে।ঘরের গুমোট ভাবে মাথা ধরে যাচ্ছে। ছাঁদের খোলা পরিবেশে এসে দাঁড়াল তনু।মৃদুমন্দ বাতাস বইছে।

মিশকাত আজ শুতে যায়নি।মায়ের সাথে রাগারাগি হয়েছে বেশ।আজ মাকে নিয়ে না যাওয়ায় অনেকটা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। মা তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।উপায় না পেয়ে মিশকাত বাধ্য হয়েছে আগামিকাল চলে যাওয়ার জন্য।মনটা প্রচন্ড ভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।দুচোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। বিয়ে বিদায়ের পর সে আর ঘরে যায়নি।সোজা ছাঁদে উঠে এসেছিল।সেই থেকেই ছাঁদেই সময়টা পার করে দিচ্ছে আর তনুর কথাই ভাবছে।হঠাৎ ছাঁদের একপাশে ছায়ামূর্তি দেখে একটু অবাক হলো।উঠে দাঁড়াল সে।ধীরে ধীরে এগোতেই অবাক হলো।ছায়ামূর্তিকে চিনতে পরেছে।তনু দাঁড়িয়ে আছে! রাত দুটোর সময় তনুকে মোটেও ছাঁদে আশা করেনি সে।

আচ্ছা, তারই মতো কি তনুর চোখেও ঘুম নামেনি আজ?

“কি করছিস এখানে?তোর দেখছি ভুতের ভয় নেই?”

তনু কেঁপে উঠে।মিশকাতকে দেখে অবাক হয়।একটু এগিয়ে আসতে চাইলে মাথাটা ঘুরে যায়।তনু টলছে দেখে মিশকাত এগিয়ে আসে ধরতে।তনু হাত নেড়ে মানা করে।মিশকাত থমকে দাঁড়ায়।তনুকে দেখে মনে হচ্ছে অসুস্থ।

কাঁপা গলায় তনু বলে উঠে,

তুমি চলে যাও মিশকাত ভাই,যত তাড়াতাড়ি পারো আমার থেকে দ্রুত চলে যাও!

রাতের গাঢ় আধার ভেদ করে তনুর বলা কথা গুলো মিশকাতের কানে এসে ডানা ঝাপটায়।অভিমানে টলমল করে ওঠে চোখের কোণ।মিশকাত ঘুরে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য।তার আগেই তনুর শরীরটা লুটিয়ে পরে যায় নিচে।

চলবে…