Saturday, July 19, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1085



কুহেলিকা পর্ব-০৫

0

#কুহেলিকা (পর্ব-৫)
#লেখক_আকাশ_মাহমুদ

–‘আপনি আমার মধ্যে কি পেয়েছেন বলেন তো?
আপনি আমার উপরে আক্রমণ করে কেন আমায় আপনার প্রতি এভাবে দূর্বল করছেন?’

দিশার কথার উত্তরে আকাশ খুব জোরে একটা শ্বাস নিয়ে দিশাকে বলে উঠে,

–‘আমি জানিনা!’

–‘আমি তো শেষ হয়ে যাচ্ছি আপনার মাদকতায়।
এই জীবনের প্রথম কাউকে এভাবে নিজ থেকে কাছে টেনেছি।’

–‘জানো আমারো না খুব অস্বাভাবিক একটা অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেনো তুমি আমার বিয়ে করা বউ। তোমার সাথে আমি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। আর তুমি আমায় অধিকার খাঁটিয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়েছো। আচ্ছা তুমি কি আমার জীবন সঙ্গিনী হতে পারো না?’

আকাশের কথা শুনে দিশার শরীরের শিহরণ আরো বেড়ে যায়। সে এক কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেছে। তার সারা শরীর মাদকতার রেষ বহন করছে। এরমধ্যে আবার আকাশ তাকে আকাশচুম্বী স্বপ্নের রাজ্য বিচরণ করাতে নিয়ে যেতে চাইছে। সে মুহূর্তের জন্য হারিয়ে গেছে নিজের কল্পনার জগতে, কিন্তু সেই জগতে তার বেশি একটা সময় ঠাঁই হয় না। কারন স্বপ্ন আর বাস্তবার তফাৎ আকাশ-পাতাল। সে চাইলেও নিজের পরিচয় মুছে ফেলে আকাশের সহচর হতে পারে না। তাই সে নিজেকে সামলে নিয়ে আকাশকে বলে,

–‘আপনি হয়তো মাদকতার কারনে নিজের হুঁশ-জ্ঞান হারিয়ে বসেছেন। দেখুন আপনার কথা গুলো জ্বরের মুখে প্রলাপ করার মতন। মানুষের যখন অতিমাত্রায় জ্বর হয়, তখন অনেকেই অনেক কিছু বকতে আরম্ভ করে। আপনার বেলাতেও এমনটা হয়েছে। অবশ্য আপনার অতিমাত্রায় জ্বর হয়নি, কিন্তু আপনি মাদকতায় এটা সেটা বকতে আরম্ভ করেছেন। তাই আমি বলি কি আপনি আমার সাথে যা ইচ্ছে হয় করুন, কিন্তু এসব আকাশচুম্বী স্বপ্নকে বাস্তব করার চিন্তা-ভাবনা প্লিজ মাথায় আনবেন না।’

–‘দিশা আমার হুঁশ-জ্ঞান ঠিক ঠাক মতোই আছে। আর শুনো আমাকে একদম জ্ঞান দিতে আসবা না। আমি তোমার মধ্যে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে শুরু করেছি।’

–‘কিসের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন শুনি?’

–‘পেয়েছি অনেক কিছুই। সেসব তোমায় পরে কোনো এক সময় বলবো। কিন্তু তোমায় নির্লজ্জের মতন একটা কথা বলি। দিশা তুমি জানো তুমি একটা নৈষাক্তময় গাছ? দিশা তুমি জানো তোমার মধ্যে দুনিয়ায় সব চাইতে দামী খাজনা লুকিয়ে আছে? দিশা আমি কোনোদিন কোনো নারীর কাছে যাইনি। এই জীবনের প্রথম আমি কোনো নারীকে স্পর্শ করেছি। হয়তো আমার অভিজ্ঞতা বাকিদের মতন এতোটা উন্নত নয়। তবে তার পরেও আমার বিশ্বাস তোমার পেটের পরতে দুনিয়ার সমস্ত মাদকতা লুকিয়ে আছে। তোমার শরীরে যেই পরিমাণ মাদকতা দেখেছি আমি, আমার মনে হয় না এতোটা মাদকতা দুনিয়াতে আর অন্য কোনো নারীর মাঝে আছে। তোমার এই মাদকতার কাছে পুরো দুনিয়ার সমস্ত কিছু ফিকে পড়বে। আমি চাইনা তোমায় হারাতে। তুমি অলিখিতভাবে আমার হয়ে যাও দিশা।’

–‘আমায় লিখিত ভাবেও মানুষ নিজের কাছে রাখবে পারবে না, সেখানে আপনি অলিখিত ভাবে আমায় নিজের কাছে রাখতে চাইছেন? বলুন তো সম্ভব এটা কখনো? আপনার পরিবার আর উন্নত সমাজ এই বিষয়টাকে কোন চোখে দেখবে একবার ভেবে দেখেছেন আপনি?’

–‘দিশা আমি কোনো কিছু ভাবতে চাই না। আর আমার তোমার মতন এতো আজাইরা ভাবনা করার সময় নেই।’

–‘সময় না থাকলেও আপনাকে ভাবতে হবে। না ভেবে হুটহাট যেটা মুখে আসে সেটা বলে দিলেই হয় না। আপনি যতোটা সহজ ভাবে এই বিষয়টাকে মনে করছেন, ততোটা সহজভাবে যদি সমাজ ও মেনে নিতো, তাহলে পল্লীর নারীকে মানুষ কোনো দ্বিধাবোধ ছাড়াই বিয়ে করে সমাজের সামনে স্বকৃীত দিতো।

–‘দিশা সমাজ আমায় খাওয়ায় না পড়ায় ও না। আমার নিজের সমাজ আমার নিজের মধ্যে। আমি যেটাতে কম্ফোর্ট ফিল করবো আমি সেটাই করবো। আমি বর্তমানে তোমায় নিয়ে কম্ফোর্ট ফিল করছি। এখন সমাজ আমায় নিয়ে কি বলবে সেটা দেখার সময় আমার নাই। কিন্তু তুমি অন্তত চুপ থাকো। বাকি আট-দশটা মানুষের মতন তুমি অন্তত আমায় জ্ঞান দিও না। আমি কিছু সময় আগে তোমার মাঝে পুরোপুরি হারিয়ে গিয়েছিলাম। তবে তুমি আমায় সেখান থেকে জোরপূর্বক টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসলে। দিশা তোমার আচরণে বেশ কষ্ট লাগলো। কতো সুন্দর একটা মুহূর্তকে তুমি আজেবাজে কথা বলে নষ্ট করে দিলে। ধ্যাৎ দুনিয়ার সমস্ত মানুষজন এই নোংরা। কারোর ভালো কেউ দেখতে পারে না। কেউ নিজেকে ভালো রাখার জন্য একটু খানি আশ্বাস পেলে সেই আশ্বাস কি ভাবে কেঁড়ে নেওয়া যায় সবার মাঝেই এই চিন্তাই বিরাজমান। আমি আর কাউকেই বিশ্বাস করি না। উঠে গেলাম তোমার কোল থেকে। লাগবে না আর আমার মানসিক প্রশান্তি। জিএফ অন্য লোককে নিয়ে পল্লীতে ঘুরে শান্তির খোঁজ করে বেড়ায়। আর আমি সময় এবং টাকা নষ্ট করে অশান্তি খুঁজে নিলাম।’

আকাশ দিশাকে এসব বলে চোখ-মলিন করে দিশার কোল থেকে উঠে যায়, কিন্তু আকাশ পুরোপুরি উঠার আগেই দিশা আকাশের মাথা ধরে তাকে জোরপূর্বক আবার নিজের কোলে শুইয়ে দেয়। নিজের কোলে শুইয়ে দেওয়ার পর শাড়ীর কিছুটা অংশ দিয়ে আকাশের মুখমন্ডল ঢেকে কিছুটা রাগান্বিত ভঙ্গিমায় আকাশকে বলে,

–‘কোল থেকে উঠবার চেষ্টা করলে একদম গলা টিপে মেরে ফেলবো। একদম উঠবেন না কোল থেকে বলে দিলাম। চুপচাপ কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকুন। আর আমি ক্ষমাপ্রার্থী আপনাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলার জন্য। এবারের মতন ক্ষমা করে দিন। আগামীতে কখনো আর এমনটা হবে না।’

–‘দিশা আমার জোর করে শুইয়ে দিলেই তো মনের কষ্ট দূর হবে না তাই না?’

–‘আমি জানি আপনার মনের কষ্ট দূর হবে না, তবে আপনি চাইলে যে কোনো পায়তারা করতে পারেন নিজের কষ্ট দূর করার জন্য। আমি আপনার মুখমন্ডল শাড়ী দিয়ে ঢেকে দিয়েছি। কেউ এখন আর আপনাকে দেখবে না। আপনি অগণিত চুমু খান আমার পেটের পরতে। আপনি আপনার ঐ গোলাপি ঠোঁট আমার পেটের পরতে লেপ্টে দিন। আমি আপনাকে না আর কিছু বলবো, না আর ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবো। ধরে নিন আমি আপনার। ধরে নিন আমি আপনার বিয়ে করা বউ। যা ইচ্ছে হয় করুন আমার সাথে। আপনাকে এই বিষয় নিয়ে আর কেউ বাঁধা দিবে না। যতো ইচ্ছে হয় চুমু খান। যা খুশি হয় করুন আমার সাথে। আমিও এটা ধরে নিব আমি আপনার বউ। আর আমার স্বামী আমায় স্পর্শ করছে।’

–‘আমার মন রক্ষার্থে সাময়িক বউ সেজে লাভ কি?’

–‘সাময়িকের জন্য নয়, সারাজীবন আমি আপনার বউ হয়ে থাকবো। আমার উপরে শুধু আপনার অধিকার থাকবে। সমাজ যাক জাহান্নামে, কিন্তু আমি চাই না আপনি আমার জন্য কোনো কষ্ট পান।’

–‘দিশা আমি জানি তুমি আমার কষ্ট দূর করার জন্য এসব বলছো, কিন্তু পল্লীতে ফিরে গেলে তখন তো টাকার জন্য অন্য লোকের কাছে যাবে।’

–‘বাহ আপনি আমায় এই চিনলেন? আমার যদি এতোই টাকার প্রতি লোভ হতো, তাহলে আমি আপনার বিনাকারণে দেওয়া টাকাটা খাবলা দিয়ে আপনার থেকে নিয়ে নিতাম। শুনুন আমার মধ্যে এসবের কোনো লোভ নেই। আমি নিজের প্রাণ বাঁচানোর পাশাপাশি মাথা গুঁজবার একটা স্থানের জন্য এই পল্লীতে রয়ে গেছি। না হয়তো আমি বহু আগেই এখান থেকে চলে যেতাম।’

–‘যাবে না তো অন্য পুরুষের কাছে আর?’

–‘মরে গেলেও যাবো না। যেই পুরুষ আমায় দুনিয়ায় সব চাইতে মাদকতাময় নারীর খেতাব দেয়, আমি তার মনে আঘাত দিয়ে অন্য পুরুষের কাছে কি করতে যাবো বলেন? আমি যাবো না আর কারোর কাছে। আমি শুধু আপনার। আমার পুরো দেহ আপনার পার্সোনাল প্রোপার্টি। কেউ আপনার এই প্রোপার্টিতে দখলদারি করতে পারবে না। আপনি আমার উপরে বিশ্বাস রাখুন। আমি নিজের সব টুকু দিয়ে আপনার আমানত হেফাজত করবো। কিন্তু একটা কথা,

–‘কি কথা?’

–‘কোনো টাকা ওয়ালা হিংস্র পশুর কবলে পড়লে হয়তো আমি হাজার চাইলেও বাঁচতে পারবো না। কারন পল্লীর একটা নিয়ম আছে। পল্লীতে থাকতে হলে সেই পল্লীর সর্দারনীর কথা শুনতে হয়। সর্দারনী যদি মোটা অংকের টাকার জন্য আমায় অন্য লোকের কাছে শপে দেয়, তাহলে তখন আমার আর কিছুই করার থাকবে না।’

–‘তোমার সর্দারনীর ব্যবস্থা আমি করবো। তার মুখে টাকার বান্ডিল ছুঁড়ে মেরে তোমায় নিজের নামে লিখিত করে নিব। তাহলে সে আর তোমায় জোর করতে পারবে না।’

–‘তাহলে আমি আর কারোর কাছেই যাচ্ছি না। আমি আপনার আছি আপনারই থাকবো। এবার গুমরো মুখে হাসি ফুটিয়ে আপনার নৈশ্বর্যের রাজ্যে ডুব দিন।’

দিশার এমন কথা শুনে আকাশকে আর কে আঁটকে রাখে। আকাশ দিশার শাড়ীর অভ্যন্তরে থেকে অকপটে দিশার শরীরে চুমু খেতে থাকে। এভাবে আধঘন্টা খানিক আকাশ দিশাকে নিয়ে ডুবে থাকে। আধঘন্টা পর আকাশ দিশাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে বসে। দিশার চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে আছে। শাড়ীর অভ্যন্তরে থেকে আকাশ কি অত্যাচারটাই না দিশাকে করেছে। আকাশ উঠে যাওয়ার পর দিশার কপালে একটা চুমু একে দেয়। দিশা লজ্জায় আরো লাল হয়ে যায়। তখনি আকাশ দিশাকে বলে,

–‘দিশা মনি লজ্জা পেয়ে লাভ নেই। আমি তোমায় মাঝের মধ্যেই এমন লজ্জায় ফেলবো। তুমি এখন থেকে এসবের প্রাকটিস করে নাও। আর এখন চলো আমার সাথে। পার্কের বাহিরে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে বসে দু’জন খাবার খাবো। তারপর তোমায় পল্লীতে পৌঁছে দিয়ে আসবো।’

–‘আচ্ছা।’

আকাশ দিশাকে নিয়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে একটু রেস্টুরেন্টে যায়। সেখানে গিয়ে দু’জন খাওয়া দাওয়া করে। খাওয়া দাওয়া শেষে আকাশ বিল পে করে দিয়ে দিশাকে নিয়ে এসে গাড়িতে বসে। এরপরেই আকাশ দিশাকে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে পল্লীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পল্লীতে পৌঁছে আকাশ গাড়ি থেকে নেমে দিশাকে বলে তাকে পল্লীর সর্দারনীর কাছে নিয়ে যেতে। দিশা আকাশের কথা মতন তাকে পল্লীর সর্দারনীর কাছে নিয়ে যায়। পল্লীর সর্দারনী থাকে দু’তালা একটা বাড়ির সেকেন্ড ফ্লোরে। দিশা আকাশকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে সোজা সর্দারনীর কাছে পৌঁছায়। আকাশের কাছে কেমন যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে নিষিদ্ধ নগরীতে ঢোকার পর থেকেই। কিন্তু দম বন্ধ হলেও কিছু করার নেই। দিশাকে তার নিজের নামে করতে হবে। পল্লীর সর্দারনী দু’জনে দেখে দিশাকে প্রশ্ন করে,

–‘কিরে কতো দিয়া কাস্টমার ধরলি?
হবে নাকি পাঁচ-ছয় হাজার?’

দিশা সর্দারনীর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়, তখনি আকাশ সর্দারনীকে বলে উঠে,

–‘আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’

–‘কি কথা কইবেন কন।’

–‘আমার এই মেয়েকে পার্মানেন্ট লাগবে। আপনি এই মেয়েকে আর কারোর কাছে দিতে পারবেন না। আমি তার জন্য আপনাকে টাকা পে করবো।’

–‘সাহেব ক্ষমা করবেন আমারে। আমার পক্ষে এইডা সম্ভব না। কারন আমাগোর ধান্দার একটা উসুল আছে। যে যতো বেশি টাকা দেয় আমরা তার পছন্দ মতোই মাইয়া তারে দেয়। কিন্তু আপনি কইতাছেন তারে আপনার পার্মানেন্ট লাগবো। সাহেব এইডা কহনোই সম্ভব না। আপনার পাঁচ- দশ হাজার টাকার লাইগা এই মাইয়ারে আমি আপনার লাইগা বহায় রাখুন নাকি। সাহেব আমি ধান্দা করতে বইছি। আপনার কথা হুনলে আমার ধান্দা বন্ধ হইবো। দ্বিতীয়ত উসুলের খেলাফ হইবো। আমাগো ধান্দায় কোনো মাইয়ারেই পার্মানেন্ট কারোর লাইগা রাখা হয় না। যে টাকা দিব আমার মাইয়া তার লগেই শুইবো।’

–‘সবই ঠিক আছে, কিন্তু কে বলেছে আমি আপনাকে পাঁচ-দশ হাজার টাকা দিব?’

–‘তো কতো দিবেন স্যার?’

–‘পুরো পাঁচ দিব।’

–‘মানে বুঝলাম না স্যার?’

–‘মানে পুরো পাঁচ লাখ টাকা দিব। কিন্তু এই মেয়েকে আমার লাগবেই।’

আকাশের কথা শুনে পল্লীর সর্দারনী থতমত খেয়ে যায়! সর্দারনী আকাশের কথা শুনে আকাশের দিকে চোখ বড় বড় করে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে। তখনি আকাশ পল্লীর সর্দারনীকে আওয়াজ দিয়ে বলে,

–‘ও সর্দারনী কথা বলছেন না যে?

আকাশের কথায় সর্দারনীর হুঁশ ফিরে আসে। হুঁশ ফিরে আসার পর সর্দারনী আকাশকে বলে,

–‘সাহেব এতো টাকার লাইগা আমি হাজারটা উসুল ভঙ্গ করতেও রাজি আছি। আমার দরকার টাকা। আপনি আমারে পাঁচ লাখ টাকা দিলে শুধু দিশা ক্যান দিশার মতন আরো একটারে আইনা আপনার সামনে হাজির করমু।’

–‘নাহ আমার শুধু দিশাকেই চাই।’

–‘ঠিক আছে সাহেব আপনার যেমন ইচ্ছা।’

–‘হুম এবার আপনি আপনার ব্যাংক একাউন্টের নাম্বার দিন।’

সর্দারনী আকাশের কথা মতন তাকে ব্যাংক একাউন্টের নাম্বার দেয়। আকাশ তৎক্ষনাৎ এই পাঁচ লাখ টাকা সর্দারনীর একাউন্টে ট্রান্সফার করে। টাকা বুঝে পাওয়ার পর সর্দারনী আকাশকে বলে,

–‘টাকা আসছে আপনি দিশারে লইয়া যান।’

–‘নাহ আমি ওকে নিয়ে যাবো না। সে এখানেই থাকবে।’

–‘সাহেব দিশা তো এহন আপনার। তাইলে ওর ভরনপোষণের দায়িত্ব ক্যান আমরা নিমু?’

–‘সেই দায়িত্ব আমিই নিব। আপনি ওর ভালোমন্দ দেখভাল করবেন। আর প্রতিমাসে ওর পিছনে যতো টাকা খরচ হবে সব টাকা আমি আপনাকে মাস শেষে পাঠিয়ে দিব।’

–‘তাইলে ঠিক আছে।’

–‘হুম এবার আমি চললাম। আপনি ওর ভালো করে খেয়াল রাখবেন।’

–‘সাহেব ওসব নিয়া আপনি টেনশন করবেন না। আমি ঠিকঠাক ভাবে ওর দেখাশোনা করুম।

–‘হুম এবার আমি চললাম। আর দিশা তুমি আমায় পল্লীর মুখ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসো। কারন এখানের পরিবেশ দেখে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আর তাছাড়া রাস্তায় আবার কোন মেয়ে আমায় ধরে বসে তার কোনো ঠিক নেই।’

আকাশের কথা শুনে দিশা পল্লীর দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে আকাশকে পল্লীর মুখ পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। এখন আকাশের গাড়ি করে চলে যাওয়ার পালা। কিন্তু আকাশ না গিয়ে দিশাকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে কয়েকটা চুমু একে দেয়। দিশাও আকাশের স্পর্শ চুপচাপ অনুভব করে। আকাশ চুমু খাওয়া শেষ করে দিশাকে বলে,

–‘নিজের খেয়াল রেখো। আমি চললাম। আবারো তোমার সাথে আমার দেখা হবে।’

–‘আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন।’

এরপর আকাশ দিশাকে ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। পরে গাড়ি স্টার্ট করে বাসায় এসে পৌঁছায়। বাসায় আসার পর গাড়ি পার্কিং করে যখনি বাড়ির মেইন দরজায় আসে, তখনি দেখে বাড়ির মেইন দরজার সামনে প্রভা দাঁড়িয়ে আছে….

চলবে….

কুহেলিকা পর্ব-০৪

0

#কুহেলিকা (পর্ব-৪)
#লেখক_আকাশ_মাহমুদ

আকাশ দিশাকে নিয়ে কিছুটা পথ অগ্রসর হওয়ার পর কেউ একজন আকাশ আর দিশার সামনে এসে দাঁড়ায়। আকাশ তাদের সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে দৃষ্টিপাত করতেই চমকে উঠে! কারন তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা তার খুব পুরোনো বন্ধু। যার নাম হচ্ছে সুমন। ব্যস্ততার কারনে একে অপরের সাথে বেশ অনেকদিন ধরে কথাবার্তা হয় না। তাই আকাশ সুমনকে পার্কের সামনে দেখতে পেয়ে চমকে উঠে! অপরদিকে সুমন ও আকাশদের দিকে অবাক করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একে অপরের দিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকার পর আকাশ নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে সুমনকে বলে,

–‘কিরে তুই এখানে কি করছিস?’

–‘আরেহ ঘুরতে এসেছিলাম। কিন্তু তুই এখানে কি করছিস? আর তোর সঙ্গে মেয়েটা কে?’

–‘আরেহ আমিও দিশাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছি। আর দিশা হচ্ছে আমার খুব কাছের একজন মানুষ।’

–‘আকাশ তোর কাছের মানুষ মানে বুঝলাম না ঠিক! তুই কি এই মেয়েকে চিনিস? বা এই মেয়ে সম্পর্কে জানিস?’

–‘হুম আমি এই মেয়েকে চিনি এবং তার সম্পর্কেও জানি।’

–‘আকাশ তোর কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কারন তুই যদি এই মেয়েকে সত্যিই চিনতি তাহলে ওর সাথে এভাবে ঘুরে বেড়াতি না। তুই কি জানিস এই মেয়ে কি করে?’

আকাশ সুমনের কথা শুনে দিশা সম্পর্কে জেনেও সুমনকে ভুল উত্তর দেয়,

–‘হুম জানি সে একটা কোম্পানিতে জব করে। কিন্তু কেন বল তো?’

–‘আকাশ তুই যেটা জানিস সেটা পুরোটাই ভুয়া। মেয়েটা একটা প্রস্টিটিউট। লজ্জাহীন ভাবে তোকে সত্যিটা বলছি। আমি নিজের শারীরিক চাহিদা মিটাতে মাঝেমধ্যে নিষিদ্ধ নগরীতে বিচরণ করি।
আমি সেখানে এই মেয়েকে দেখেছি। দ্যাখ আমার বিষয়টা ভিন্ন। আমি নিজে খারাপ তাই মেয়েটাকে নিয়ে বেশি কিছু বলার অধিকার রাখি না। তবে তুই কেন ওকে নিয়ে ঘুরাফেরা করছিস? তুই তো এমন না। আজ পর্যন্ত তোর মধ্যে কোনোদিন কোনো অসৎ আচরণ দেখিনি। তুই বরাবরের মতোই ভালো পথ ধরে হেঁটেছিস। কিন্তু আজ এই মেয়েকে তোর সাথে দেখে আমার মাথা উলট-পালট হয়ে যাচ্ছে।’

–‘যাক আমায় নিয়ে পজিটিভ চিন্তা-ভাবনা করিস এটাই আমার জন্য অনেক। তবে বন্ধু তোকে একটা জিনিস আজ খোলামেলা বলি। আসলে দুনিয়ায় ভালো হলে দাম নাই রে। প্রেমিকা পুষে রেখে তাকে বিয়ের পর হালাল ভাবে স্পর্শ করার চিন্তা মাথায় রাখাটা আমার মতে নেহায়েত বোকামী। কারন কিছু কিছু নারী তোর সততাকে কাপুরুষত্ব মনে করবে। তারা ভাববে তোর কাছে মেশিন নেই। তারা ভাববে তুই শারীরিক দিক থেকে পুরোপুরি সুস্থ না। তাই অধিকতর দেখা যায় মেয়েরা প্রেমিক ছেড়ে অন্য পুরুষের সাথে লীলায় মগ্ন হয়। আমার বেলায় ও সেম হয়েছে রে। তাই আমি দিশাকে নিয়ে এখানে এসেছি।’

–‘মানে কি আকাশ একটু ক্লিয়ার করে বল।’

–‘মানে হলো আমি কাউকে ভালোবেসে ঠকেছি বলতে পারিস। আমি সততা দিয়ে রিলেশন করেছি, কিন্তু সে সেটাকে হয়তো আমার দূর্বলতা ভেবে পরপুরুষের স্পর্শ গিয়েছে। তাই আমি এই মেয়ের সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে এসেছি। তবে তুই চিন্তা করিস না। আমি দিশাকে এখানে খারাপ কোনো উদ্দেশ্যে নিয়ে আসিনি। আমি ওকে নিয়ে এসেছি কিছুটা সময় কাটাতে ওর সাথে। আমি ওকে নিয়ে এসেছি মনের ভিতরে যেই পাহাড় সমান বোঝা চেপেছে সেটাকে কমাতে।’

–‘কিন্তু বন্ধু এই মেয়ের চরিত্রের কারনে তো মানুষ তোর দিকে আঙ্গুল তুলবে। তখন তোর কষ্টের বোঝা আরো দ্বিগুণ হবে।’

–‘সুমন চুপসে যা। ওর সামনে দাঁড়িয়ে তুই এসব কথাবার্তা বলাটা ঠিক হচ্ছে না। কারন মানুষ যতো যাই করুক না কেন, সেটা তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিন্দনীয় ভাবে অন্য কাউকে বললে অবশ্যই দোষ করা মানুষটার খারাপ লাগবে। তাই তুই অনুগ্রহ করে এসব কথাবার্তা বন্ধ কর। আর ওকে নিয়ে কে কি বলে সেটা আমি দেখে নিব। আমায় বলুক তাতে আমার আপত্তি নেই। তবে আমার সামনে কেউ দিশাকে কিছু বললে তার অবস্থা নাজেহাল করে দিব।’

–‘ঠিক আছে বন্ধু আমি চুপ হয়ে গেলাম। আর তোর যা ভালো লাগে তুই তাই কর।’

–‘ধন্যবাদ।’

–‘আচ্ছা দোস্ত এখন আমি চললাম। তুই নিজের আর দিশার খেয়াল রাখিস।’

–‘হুম।’

এরপর সুমন চলে যায়। সুমন চলে যাওয়ার পর আকাশ দিশাকে তার সঙ্গে সামনে অগ্রসর হতে বলে, কিন্তু দিশা সামনে অগ্রসর না হয়ে মুখ মলিন করে দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশ দিশার চেহারার ধাঁচধরন দেখে বুঝে নেয় সুমনের কথায় দিশার উপরে এফেক্ট পড়েছে। তাই আকাশ দিশাকে বলে,

–‘দিশা তুমি ওর কথা এতোটা কানে নিও না। সে এমনিতেই এসব বলে গেছে।’

–‘দেখুন সে এমনিতে বলুক আর যাই বলুক না কেন, কথাগুলো কিন্তু সত্যি ছিল। তিনি নিজের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে আঁধার নগরীতে প্রবেশ করে। আর আপনি নিজের বিপদ ডেকে আনার জন্য আমায় এখানে নিয়ে এসেছেন। কখন হুট করে কোথা থেকে কেউ এসে আপনাকে আমার জন্য এটা সেটা শুনিয়ে যাবে না সেটার কোন নিশ্চয়তা নেই।’

–‘দিশা আমায় কে কি বলবে সেসব নিয়ে আমার এতো মাথাব্যথা নেই। আর সুমন সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ ছেড়ে আঁধার নগরীতে গিয়ে অসামাজিক ভাবে নারীর নেশার মেতে উঠে। সে নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করে আঁধারেই নিজের কাজ চালিয়ে যায়। তার বেলায় কোনো সমস্যা হয় না। আর আমি তোমায় নিয়ে মেতে না উঠে সেই অসামাজিক পরিবেশ থেকে তোমায় বের করে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে এসেছি এতে মানুষের আপত্তি হবে কেন?’

–‘কারন সেটা আঁধার নগরী। সেখানে কে গেলো কে আসলো দেখবার মতন মানুষ খুবই কম। তাই তার বেলাতে তেমন কোনে সমস্যা নেই। তবে আপনার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা রয়েছে। আপনি আঁধার নগরীর এক নষ্টাকে নিয়ে সামাজিক পরিবেশে ঘুরাঘুরি করলে মানুষ অবশ্যই আপনাকে এটা সেটা বলবে।’

–‘দিশা মুখ সামলে কথা বলো। আমি কিন্তু তোমায় আগেও বলেছি, যে নিজেকে বাজে ভাবে উপস্থাপনা করবে না আমার সামনে। কিন্তু তুমি আবারো সেটা করেছো।’

–‘ক্ষমাপ্রার্থী আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আর আগামীতে এমনটা কখনোই বলবো না। কিন্তু সুমন নামক লোকটার তো সত্যি বলেন?’

–‘তার কথা সত্যি হলেও আমার কাছে সেসবের কোনো মূল্য নেই। সে নিজেই কতো ভালো তার প্রমাণ দিয়ে গেছে। আর তাছাড়া আমি যাকেই সঙ্গে নিয়ে ঘুরাফেরা করি না কেন আমি সৎ থাকলেই হয়েছে। তুমি খামোখা এতো টেনশন নিও না। কেউ কিছু বললে সেটা তখন দেখা যাবে।’

–‘আপনি সত্যিই একরোখা একটা মানুষ। যেটা বুঝেন তো বুঝেন এই। আপনি যেটা বলেন বা ভাবেন সেটাই সঠিক। আপনার কথা বা চিন্তা-ভাবনাকে কখনো কেউ পিছনে ফেলতে পারবে না।’

–‘হুম আমি একরোখা। এবার দিশা মনি আপনি আমার সঙ্গে চলেন।

দিশা আকাশের মুখে দিশা মনি ডাকটা শুনতেই দৌড়ে আকাশের কাছে গিয়ে তার হাতের খাঁজে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে চেপে ধরে। দিশা খুশিতে আত্মহারা আকাশের মুখে এমন দিশা মনি নামটা শুনে। তার মলিন চেহারাটা আকাশের এক নাম ডাকেই গায়েব হয়ে গিয়েছে। আর গায়েব হবে নাই বা কেন, এর আগে দিশাকে কখনো কেউ এতো সুন্দর করে দিশা মনি বলে ডাকেনি। আজ প্রথম কেউ তাকে এভাবে ডেকেছে। তাই সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে আকাশের কাছে গিয়ে নিজেকে আকাশের কাছে শপে দেয়। আকাশ ও আপন মনে দিশার হাতের খাঁজে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিশার হাত মুঠো করে ধরে। এরপর দু’জন হাঁটতে হাঁটতে পার্কের ভিতরে প্রবেশ করে। পার্কের ভিতরের প্রবেশ করে দু’জনে একটা ফাঁকা বেঞ্চের উপরে গিয়ে বসে। আকাশ আর দিশা বেঞ্চে বসে শুরুতে দু’জনে স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করে, কিন্তু কথা বলার এক পর্যায়ে আকাশ দিশার কোলে মাথা রেখে বেঞ্চের উপরেই শুয়ে পড়ে। আকাশের এমন আচরণে দিশা পুরো শকট হয়ে গিয়েছে! সে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে এতোটা সময় আকাশের সাথে যেটুকু কথা বলেছে এখন সেটাও বলতে পারছে না। আকাশের এমন অদ্ভুৎ আচরণ দেখে তার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেছে। থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করেছে দিশা। দিশার এমন কাঁপা-কাঁপি দেখে আকাশ দিশার কোলে মাথা রেখেই বলে উঠে,

–‘একটু তো রোমান্টিক হও। তোমার কোলে মাথা রেখেছি কই তুমি আমার চুল ধরে একটু স্পর্শ করবা তা না, তুমি কাঁপা-কাঁপি করতে শুরু করেছো।’

–‘আসলে আমার সাথে এর আগে কখনো এমনটা হয়নি। তাই কেমন যেনো নার্ভাস লাগছে।’

–‘দিশা নার্ভাস লাগলে হবে না। সবেমাত্র শুরু করেছি। সামনে আরো কতো কি করি তা উপর ওয়ালাই ভালো জানেন।’

–‘কি করবেন আপনি?’

–‘সেটা সময় হলেই দেখতে পাবে। এখন তুমি আগে আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গল্প শোনাও।’

–‘আমি তো কোনো গল্প জানি না।’

–‘গল্প না জানলে নিজের জীবন কাহিনীটাই শোনাও।’

–‘আচ্ছা।’

দিশা আকাশের কথা মতন নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে আকাশের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে নিজের জীবন কাহিনী শোনাতে আরম্ভ করে,

–‘জানেন আমার জীবনটা সেই জন্মের পর থেকেই নড়ক হয়ে আছে। আমার মায়ের বিয়ের কিছুদিন পর আমার বাবা নাকি আমার মা’কে অন্ধকার নগরীরে বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছে। মানুষটার নাকি অনেক টাকার লোভ ছিল। সারাদিন কাজকর্ম ফেলে রেখে লোকদের সাথে জুয়া খেলতো। ভিটা সম্পত্তি সব কিছুই এই জুয়া খেলে খেলে শেষ করেছে। মায়ের প্রতি তার কোনো খেয়াল ছিল না। তার জীবনে যেনো জুয়া খেলাটাই আসল কাজ ছিল। মা প্রথম প্রথম এসব সহ্য করে নিতো। কিন্তু একটা মানুষের আর সহ্য ক্ষমতা কতো থাকে। না দেয় কাপড়-চোপড়, না করে বাসার কোনো বাজার সদাই। মা এসব নিয়ে নাকি একদিন বাবার সাথে বেশ রেগে যায়। বাবাও মায়ের উপরে চেতাচেতি করে। চেতাচেতি করার এক পর্যায়ে বাবা মা’কে বেশ মারধর করে। সেই জালিম লোকটা মা’কে মেরে আধমরা করে সেভাবেই গাড়িতে তুলে এনে পল্লীতে বিক্রি করে দেয়। তখন মা চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মায়ের গর্ভে আমার অস্তিত্বের প্রতিক্রিয়া প্রায় তখন ত্রিশ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেই জালিম লোকটা আমার মায়ের উপরে একটুও রহম করেনি। নির্দয় ভাবে আমার মা’কে পল্লীতে বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছে। বাবার এমন নির্দয় আচরণে মায়ের মনে এতোটা কষ্ট জমে, যে মা রাগ করে এই পল্লীতেই থেকে যায়। আর এই পল্লীতে থেকেই মা আমায় প্রসব করে। জানেন আমার বয়স যখন তেরো, তখন থেকেই আমি মনে মনে কল্পনা করতাম আমি এই পল্লী থেকে বেরিয়ে সুন্দর একটা জীবনযাপন করবো। আমারো একটা মনের মানুষ হবে। যে কিনা আমার বাবার মতন জালিম না হয়ে মাটির মতন একটা মানুষ হবে। আমায় ভালোবেসে সেই মানুষটা আমায় সব সময় আগলে রাখবে। আমার মা’ও এটা চাইতো। পল্লীর মাজেদা খালা মা’কে অনেকবার বলেছে আমায় কাজে লাগিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি এক কথায় বলে তিনার মেয়ের শরীরে তিনি এই পল্লীর দূষিত বাতাস লাগতে দিবে না। মা বেশ কয় বছর পল্লীতে থাকায় মায়ের একটা পাওয়ার ছিল এই পল্লীতে। যার কারনে মায়ের কথার উপরে মাজেদা খালা আর কথা বলেনি। মা আমায় বলেছিল এই বছর আমায় একটা ভালো ছেলের হাতে তুলে দিয়ে পল্লীর দূষিত বাতাস থেকে আমায় মুক্ত করবে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস বছর শেষ হয়ে নতুন বছর আসার আগেই মা দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছে। মা মারা যাওয়ার পর আমি চেয়েছিলাম এই পল্লী থেকে বেরিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো। কিন্তু যাবো তো যাবো কোথায়। বাহিরের পরিবেশ তো এর চাইতেও আরো নোংরা। এই নগরীতে শরীরের বস্ত্র খোলা হলেও প্রাণের নিশ্চয়তা আছে, কিন্তু বাহিরের মুক্ত পরিবেশে তো ভোগ করার পাশাপাশি মানুষকে মেরেও ফেলে। আর তাছাড়া মায়ের হাজারো সৃতি রয়েছে এই পল্লীতে। তাই আমিও নিজের সত্যিত্বকে বিসর্জন দিয়ে পতিতার সিলমোহর লাগিয়ে নিয়েছি নিজের শরীরে। আমার ছোট কালের সমস্ত স্বপ্ন আধুরা রয়ে গেছে। আমি জানি সেসব শুধু স্বপ্নই ছিল। সেসব কোনোদিন আর বাস্তব হবে না।

দিশা আকাশকে নিজের জীবন কাহিনী শোনাতে শোনাতে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। অপরদিকে আকাশ দিশার চোখের পানি দেখার পাশাপাশি তার ভিতরের অবস্থাটাও উপলব্ধি করতে পারে। তাই সে দিশাকে শান্ত করতে দিশার কোলে শোয়া অবস্থাতেই দিশার পেট থেকে আলতো করে শাড়ীর কিছুটা অংশ সরিয়ে তার পেটের পরতে মুখ ডুবিয়ে দেয়। আকাশের এমন আচরণে দিশার কান্না থেমে গিয়ে তার মধ্যে ঐশ্বর্যের নৈষাক্ততা এসে হানা দিয়েছে। দিশা পুরো উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। তার ইচ্ছে করছে আকাশকে গিলে খেয়ে নিতে। সে নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে আকাশের চুল গুলো শক্ত করে চেপে ধরে আকাশের মুখমন্ডল তার পেটের পরতের সাথে ঠেসে ধরে। এরপর আকাশকে বলে,

–‘আপনি আমার মধ্যে কি পেয়েছেন বলেন তো?
আপনি আমার উপরে আক্রমণ করে কেন আমায় আপনার প্রতি এভাবে দূর্বল করছেন?’

দিশার কথার উত্তরে আকাশ খুব জোরে একটা শ্বাস নিয়ে দিশাকে বলে উঠে,

–‘আমি জানিনা……

চলবে…..

কুহেলিকা পর্ব-০৩

0

#কুহেলিকা (পর্ব-৩)
#লেখক-আকাশ মাহমুদ

আকাশের মনে হচ্ছে যেনো তার প্রিয়তমা প্রভা নয়, তার প্রিয়তমা হচ্ছে নিষিদ্ধ নগরীর দিশা নামক মেয়েটি। আর তার প্রিয়তমা তাকে ছেড়ে অন্য লোকের কাছে যাওয়ার জন্য তার কাছ থেকেই সেই লোকটাকে পারমিশন নিতে বলছে। আকাশের প্রচন্ড পরিমানে রাগ হয়। কিন্তু কেন হয় সেই ব্যাখ্যা আকাশের কাছে নেই। আকাশের রাগান্বিত চেহারা দেখে দিশা ভয় পেয়ে যায়। তাই সে ভয়ের চোটে নজর নামিয়ে ফেলে। দিশার পাশের লোকটা এখনো অবাক করা দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় হুট করেই আকাশ দিশার কাছে এসে একহাত দিয়ে তার চুলের মুঠি চেপে ধরে অন্য আরেক হাত দিয়ে তার গালের মধ্যে কোষে থাপ্পড় লাগিয়ে দেয়। এরপর দিশাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ রাঙিয়ে সেই লোকটাকে বলে,

–‘ভাই ওর পিছে না ঘুরে অন্য কোনো রমণী ধরেন। সে আপনার সাথে যাবে না।’

লোকটা খেঁকিয়ে ওঠে, রাগান্বিতস্বরে বলে,

–‘কেন ভাই যাবে না কেন? সে কি আপনার পার্সোনাল প্রোপার্টি নাকি? আর আপনি এই মেয়েকে মারার সাহস কোথায় পেয়েছেন?’

আকাশ দাঁতে দাঁত ঘষে, রাগে গজগজ করতে করতে বলে,

–‘ধরে নিন সেটাই, ও আমার পার্সোনাল প্রোপার্টি। আর তাকে মারার জন্য আমার সাহসের প্রয়োজন নেই।’

–‘ভাই আপনি আমাকে গান শিখাবেন না। আপনার থেকে ভালো গান আমি গাইতে পাড়ি। শুনেন পল্লীর মেয়েরা কখনো কারোর পার্সোনাল প্রোপার্টি হয় না। কিন্তু আপনি তাকে নিজের পার্সোনাল প্রোপার্টি বলে থাপ্পড় দিয়েছেন, এটার জন্য আপনাকে এখন পস্তাইতে হবে।’

–‘কি করবেন শুনি?’

–‘কি করবো এখন দেখতেই পাবেন। এই মেয়ে তুমি কি নিয়ে এতো ভয় পাচ্ছো হ্যাঁ? তোমায় কি লোকটা কোনো ভয় দেখিয়ে এমন বলাচ্ছে? যদি এমন হয় তাহলে আমায় বলতে পারো। বেটাকে মেরে এখানেই মাটিতে শুইয়ে দিব। অনেক পাওয়ার বেড়েছে দেখি বেটার।’

দিশা আমতা আমতা করে বললো,

–‘না উনি আমায় কোনো ভয় দেখায়নি। আর আপনার উনাকে কিছুই করতে হবে না। উনি যেমন ইচ্ছে হয় করুক আমার সাথে। সবে তো একটা থাপ্পড় মেরেছে। বাকি আরো হাজারটা থাপ্পড় মারলেও আমি হাসি মুখে উনার হাতে মা’র খেয়ে নিব।’

–‘নাহ তোমায় কোনো ধরনের ভয় দেখিয়েছে আমি একশো পার্সেন্ট সিওর। নাহয় কোনো মানুষ মার খাওয়ার পরেও এভাবে কথা বলে না।’

লোকটার কথা শুনে দিশার চরম রাগ উঠে যায়। তাই সে লোকটার উপরে চেঁচিয়ে বলে,

–‘ভাইয়া খামোখা এতো দরদ দেখানোর প্রয়োজন নেই। আমি একবার বলেই দিয়েছি যে উনি আমায় কোনো ভয় দেখায়নি। তাহলে বারবার এক প্রশ্ন করে আমার মাথা খাওয়ার মানে কি?’

–‘তুমি সত্যি বলছো তো?’

–‘হ্যাঁ আমি সত্যি বলছি। আপনি এবার দফা হন আমার চোখের সামনে থেকে। এতেই আমি আপনার কাছ থেকে উপকৃত হবো।’

–‘ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি।’

লোকটা এরপর চলে যায়। লোকটা চলে যেতেই আকাশ দিশাকে রাগান্বিত কন্ঠে বলে,

–‘সমস্যা টা কি তোর? তুই আমার সামনেই অন্য লোকের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিস, আবার আমার থেকেই সেই লোক টাকে পারমিশন নিতে বলে তার সাথে বিছানায় যাইতে চাইছিস। কাহিনী টা কি তো?’

–‘কেন আমি কি খদ্দের ধরবো না? আমার তো পেশাই এটা। এটা না করলে আমার পেট চলবে কি করে?’

–‘কিহহ! কথা গুলো আবার বল?’

–‘না…না কিছু না। ‘

–‘আজকের পর তুই আর কোনো লোকের সাথে যাবি না। কোনো খদ্দের ও ধরবি না।’

–‘কেন রোজ রোজ কি আপনি আমার কাছে আসবেন?’

–‘দরকার হলে তাই করবো। কিন্তু তুই ভুলেও আজকের পর আর কোনো কাস্টমারের কাছে যাবি না।’

–‘দেখুন আমি পাকাপোক্ত কথা দিতে পারছি না। কারন পল্লীতে আশা লোকদের চাহিদার উপরেই নির্ভর করবে সবকিছু। তারা যদি নিজ থেকে আমায় খোঁজে তখন আর আমার কিছু করার নেই। তবে আমি এটা বলতো পারি, যে আমি নিজ থেকে কারোর কাছে যাবো না।’

আকাশের চোখগুলো রাগে ধপধপ করছে, সে দুহাতে মাথার চুল টেনে পায়চারি করতে থাকে। একসময় দিশার সামনে এসে বলে,

–‘দিশা আমি এতো কথা শুনতে চাচ্ছি না তোর থেকে। আমি একবার যেটা বলে দিয়েছি সেটাই তোকে করতে হবে। আমার কথার অমান্য করলে তোর জন্য অনেক বেশি খারাপ হবে।’

–‘আরেহ আপনি এমন করছেন কেন? আপনি প্লিজ আমার বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করুন। দেখুন আমি আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নই, আমাদের মতো মেয়েদের কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি হবার যোগ্যতাও নেই। আমি অন্ধকার পল্লীর হাই রেট প্রস্টিটিউট, আমি চড়া দরে প্রেম বিক্রি করি। আমিও সাধারণ মেয়েদের মতো প্রেম করি, পার্থক্য এই যে তাদের প্রেমিক একজন আর আমার প্রতি মুহূর্তের প্রেমিক ভিন্ন।’

দিশার কথা শুনে আকাশের আবারও রাগ উঠে যায়। কারন সে দিশাকে কেন জানি অন্যকারো শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে মানতে পারছে না। যার কারনে সে আবারো দিশার চুল মুঠো করে ধরে তাকে বলে,

–‘দ্যাখ আমায় বাধ্য করিস না তোর সাথে খারাপ আচরণ করতে। এমনিতেই কিন্তু সেই লোকের কথা শুনে রাগ চুড়ায় উঠে আছে। এরপর আর একটা কথা বলে সেই লোকের উপরে উঠা সমস্ত রাগ তোর উপরে মিটাবো।’

–‘এই না…না আমি কারোর কাছেই যাবো না।’

–‘হুম মনে থাকে যেনো। এবার চল আমার সাথে।’

–‘কেন কোথায় নিয়ে যাবেন আমায়?’

–‘জাহান্নামে নিয়ে যাবো তোর কোনো সমস্যা? ‘

–‘না আমার কোনো সমস্যা নেই।’

–‘তাহলে চুপচাপ আমার সাথে চল।’

–‘হুম।’

আকাশ দিশাকে তার সঙ্গে করে নিয়ে গাড়ির কাছে আসে। গাড়ির কাছে আসার পর পকেট থেকে এক হাজার টাকার নোট বের করে ড্রাইভারকে দিয়ে বলে,

–‘মালেক ভাই আপনি এই টাকাটা দিয়ে দুপুরের খাবার বাহিরে খেয়ে বাড়ি চলে যাবেন। আর আমাদের বিষয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করলে কিছুই বলবেন না।’

–‘স্যার এসব নিয়ে আপনি একদম টেনশন করবেন না। কারন আমি জানি আপনি কেমন। আপনার যদি খারাপ কোনো উদ্দেশ্য থাকতো তাহলে আপনি পল্লীর ভিতরেই যেতেন। উনাকে নিয়ে এখানে আসতেন না। আর তাছাড়া আপনি এমনটা কেন করছেন সেটাও আমি জানি। আপনি হয়তো আপনার প্রিয় মানুষটার থেকে পাওয়া আঘাত গুলো দূর করার জন্য এই পন্থা অবলম্বন করেছেন। যাই হোক স্যার আমি আপনার কথা মতন বাহিরে খেয়ে একটা রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে যাবো।’

–‘ধন্যবাদ মালেক ভাই মনের বিষয়টা বুঝার জন্য।’

ড্রাইভার মালেক আকাশ থেকে টাকাটা নিয়ে গাড়ির চাবি আকাশকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায়। ড্রাইভার চলে যেতেই আকাশ দিশাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। দিশা গাড়িতে বসে বেশ নার্ভাস ফিল করছে। তবে তার পুরোপুরি বিশ্বাস আছে পাশের মানুষটার প্রতি। আর বিশ্বাস থাকলেও কি না থাকলেও কি, তার কাছে হারানোর মতন তো আর কিছু নেই। সতিত্ব তো সেই বহুকাল আগেই সে হারিয়েছি। এখন খালি প্রাণের ভয় টাই আছে। সে চুপচাপ আকাশের পাশের সিটে বসে আছে। আর আকাশ গাড়ি স্টার্ট করে অজানা এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। আকাশ কিছু সময় গাড়ি ড্রাইভ করার পর দিশার ডান হাতটা টেনে স্টিয়ারিং এর উপরে রাখে। তারপর আলতো করে নিজের হাতটা দিশার হাতের উপরে রেখে স্টিয়ারিং টা চেপে ধরে। দিশা আকাশের এমন আচরণে বেশ অবাক! তবে সে আকাশকে কিছুই বলে না। কারন সে আকাশের ব্যাপারে আর কিছু না জানলেও ইতিমধ্যে এটা ভালো করেই বুঝে গেছে, যে আকাশ একটা বদরাগী লোক। তাকে কিছু বলা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। তাই সে আকাশের আচরণে চুপচাপ সাড়া দিতে থাকে। আকাশ দিশার হাতটা স্টিয়ারিংয়ে রেখে বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি ড্রাইভ করে। কিছুক্ষণ পর আকাশ নিজেই দিশার হাতটা স্টিয়ারিং থেকে সরিয়ে দিশার হাতের খাঁজে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেয়। তারপর দিশার হাতটা নিজের ঠোঁটের কাছে টেনে এনে দিশার হাতে চুমু খেতে আরম্ভ করে। আকাশের এমন আচরণে দিশা পুরো শিউরে উঠেছে। তার গায়ের পশম পুরোপুরি দাঁড়িয়ে গেছে। দিশার মনে হচ্ছে যেনো সে এই প্রথম কোনো পুরুষের সাথে এভাবে কাছে এসেছে। তার এই অল্প জীবনে কোনো পুরুষ তার সাথে এতোটা রোমান্টিক আচরণ করেনি। সে শিউরে উঠার পাশাপাশি চোখ পাকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। দিশার চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকা পাশ থেকে আকাশ দেখে ফেলে। তাই আকাশ দিশাকে প্রশ্ন করে,

–‘কি হয়েছে দিশা? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’

–‘আপনাকে দেখে না বেশ অবাক হচ্ছি জানেন।’

–‘কেনো?’

–‘কারন এই যে আপনার এতো রাগ, কোনো মানুষ আপনাকে প্রথম দেখলে বুঝতেই পারবে না আপনার রাগের ভিতরেও কতো শত কোটি ভালোবাসা রয়েছে।’

–‘আরে ধুর তেমন কিছুই না। আমি সত্যিই বদরাগী। আমার ভিতরে রাগ দিয়ে ভরপুর।’

–‘দেখুন আমি নিষিদ্ধ নগরীর নারী হতে পারি, তবে মানুষকে বিচার-বিবেচনা করার শক্তিটা কিন্তু আল্লাহ আমায় ও দিয়েছে। যেমন দেখুন এই যে আপনি আমার উপরে রেগে গিয়ে শুরুতে তুই তুকারি করেছেন। আর এখন রাগ কমার পর তুমি করে বলার পাশাপাশি কি সব রোমান্টিক আচরণ করছেন। তাহলে বলেন কি করে যে আপনি বদরাগী?’

‘দিশার প্রশ্ন শুনে আকাশ রাস্তার মাঝেই গাড়ি থামিয়ে দিয়ে দিশাকে বলে,

–‘দিশা তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি পরে দিচ্ছি, কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা কথা স্পষ্ট ভাবে
জানিয়ে দেই। তুমি আজকের পর সেই নিষিদ্ধ নগরীর কথাটা আমার সামনে তুলবে না। আর না নিজেকে সেই নিষিদ্ধ নগরীর নারী বলে দাবী করবে। মনে থাকবে কথাটা?’

–‘মনে থাকবে।’

–‘এবার তোমার প্রশ্নের উত্তরটা দিচ্ছি। আসলে আমি রাগতেও জানি, মানুষকে ভালোবাসতেও জানি।’

–‘ইশ আপনার মতন কেউ একজন যদি সময় মতন এসে আমার হাতটা ধরতো, তাহলে হয়তো আমি আজ এই পজিশনে থাকতাম না। আপনি না সত্যিই খুব ভালো।’

–‘দিশা তোমার হাত কিন্তু এখনো আমি ধরে আছি কথাটা মাথায় রেখো। আর কিছু মানুষ জীবনে অনেক লেইট করেই আসে। তোমার জীবনেও আসবে। তুমি আমার কথাটা মিলিয়ে নিও।’

–‘আসুক আমার জীবনেও কোনো পরপুরুষ। কিন্তু মানুষটা যেনো আপনার মতোই হয়। হাজারো রাগের মাঝে তার ভালোবাসার পরিমাণটা যেনো আপনার মতন বিশাল হয়।’

–‘উপর ওয়ালার উপরে বিশ্বাস রাখো। তিনি তোমার মনের আশা অবশ্যই পূর্ণ করবেন।’

–‘হুম।’ আচ্ছা এখন কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

–‘পার্কে যাবো। তোমায় নিয়ে আজ সারাটা দুপুর ঘুরে বেড়াবো। তোমার সাথে হাজারটা স্মৃতি তৈরি করবো আজ।’

হঠাৎই দিশার হাস্যোজ্জ্বল বদনে বিষন্নতা ভর করে, নিভে যাওয়া স্বরে প্রশ্ন করে,

–‘কি হবে আমার সাথে স্মৃতি তৈরি করে? আমি তো আপনার প্রেমিকা নই। আমি তো কলুষিত একজন সামান্য নারী। আমার সাথে এসব করে তো আপনার কোনো লাভ হবে না।’

আকাশের দৃষ্টি সামনে স্থির, সে উদাসীন অথচ গম্ভীর স্বরে বলে,

–‘হয়তো কোনো লাভ হবে না, তবে তোমার চোখে কি যেন একটা আছে। একবার তাকালে বারবার তাকাতে মন চায়। মনে হয় ওটা চোখ নয়, এক গভীর সমুদ্র। আমি নাবিক হয়ে সেখানে ঘুরে বেড়াই… এ অনুভূতিটা আমার জন্য নতুন, তাই আমি নিজেও বুঝতে পারছি না তোমার প্রতি এই অদ্ভুত টানের কারনটা কি। আমাকে একটু সময় দাও, আমি নিশ্চিত উত্তরটা আমি খুঁজে পাবোই। কিন্তু তার আগে যদি তুমি কারো কাছে যাও তবে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। জানে মেরে ফেলবো তোমাকে।’

–‘না…না যাবো না। কারন আপনার এই তিক্ত রাগ বরদাস্ত করার ক্ষমতা আমার নেই। আপনার রাগান্বিত আঁখি দেখেই আমার কলিজার পানি শুকিয়ে গিয়েছিল শুরুতে। পরেরবার কি হবে তা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। তাই আমি নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনতে চাইছি না।’

–‘যাক ধন্যবাদ, আমার ভিতরের ক্রোধ টাকে বুঝার জন্য। এখন গাড়ি স্টার্ট করলাম আর একটু দূরেই পার্ক।’

–‘হুম।’

আকাশ আবার গাড়ি স্টার্ট করে দিশাকে নিয়ে সামনের একটা পার্কে পৌঁছায়। পার্কে পৌঁছানোর পর গাড়ি থেকে নেমে আকাশ দিশার হাত চেপে ধরে। মনে হচ্ছে যেনো কোনো সদ্য বিবাহিত প্রেমিক যুগল তাদের দাম্পত্য জীবনের শুভ সূচনার পর পার্কে ঘুরতে এসেছে। আকাশ দিশার হাত চেপে ধরে পার্কে প্রবেশ করার জন্য সামনের দিকে অগ্রসর হয়। কিছুটা পথ অগ্রসর হওয়ার পর কেউ একজন আকাশ আর দিশার সামনে এসে দাঁড়ায়। আকাশ তাদের সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে দৃষ্টিপাত করতেই চমকে উঠে…

চলবে….

কুহেলিকা পর্ব-০২

0

#কুহেলিকা (পর্ব-২)
#লেখক-আকাশ মাহমুদ

আকাশ মানিব্যাগ থেকে বের করা সেই পাঁচশত টাকার নোট টা দিশার হাতে শক্ত করে গুঁজে দিয়ে দিশার কানে কানে বলে,

–‘আমি তোমার উষ্ণতা গ্রহণ করেই এই টাকাটা তোমায় দিলাম। এটা রেখে দাও তোমার কাছে। চললাম এখন…

‘আকাশ দিশাকে চুমু একে দিয়ে গাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। “অপরদিকে নিষিদ্ধ নগরীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সমস্ত রমণীরা চোখ পাকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা আকাশের আচরণে বেশ অবাক! কিন্তু আকাশ তাদের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে নিজের মতন হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। আকাশ গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভার আকাশকে জিজ্ঞাস করে,

–‘স্যার কিছু মনে না করলে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাস করবো?’

–‘জ্বি বলেন?’

–‘স্যার আপনি হুট করে গাড়ি থামিয়ে নিষিদ্ধ নগরীতে প্রবেশ করে আবার জলদি ফিরেও আসলেন। এছাড়া নগরীর মুখে রমণীরা আপনাকে নিয়ে উদ্ভট আচরণ করলো। স্যার কিছু হয়েছে কি?’

–লোকমান ভাই আমি অসাধু মতলব নিয়ে সেখানে যাইনি। আমি আমার কাজের জন্যই সেখানে গিয়েছেলাম। আর আপনি হয়তো প্রায় খেয়াল করেছেন আমি প্রায় গাড়িতে বসে কারোর সাথে কথা বলি?’

–‘স্যার আমি শুধু খেয়াল এই করিনি, আমি জানিও বটে, যে আপনি আপনার প্রিয়তমার সাথে কথা বলেন। আর সেজন্যই আপনাকে ছোট মুখে এসব প্রশ্ন করলাম। কারন আপনার প্রিয়তমা থাকার পরেও আপনার নিষিদ্ধ নগরীতে প্রবেশ করাটা আমার কেমন যেনো লেগেছে।’

–‘লোকমান ভাই আমি আমার প্রিয়তমাকে অপরিচিত একটা লোকের সাথে এই নিষিদ্ধ নগরীতে প্রবেশ করতে দেখেছি। তাই আমি আপনাকে গাড়ি থামাতে বলে সেখানে গিয়েছিলাম’

–‘কি বলেন স্যার! আপনার প্রিয়তমাকে নিষিদ্ধ নগরীতে দেখেছেন মানে কি?’

–‘মানেটা এখনো আমার অজানা। তবে জলদিই আমি এসবের রহস্য খুঁজে বের করবো।’

–‘স্যার আপনার কথা শুনে আমার গা পুরো শিউরা উঠেছে!’

–‘মালেক ভাই বাদ দিন এখন এসব। বাবা হয়তো আমার জন্য অফিসে অপেক্ষা করছেন। আপনি জলদি গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে চলুন। এসব বিষয় নিয়ে পরে দেখা যাবে।’

–‘ঠিক আছে স্যার।’

‘এরপর ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে। কিছুক্ষণ সফর করার পর তারা অফিসে পৌঁছে যায়। অফিসে পৌঁছানোর পর আকাশ দেখে সবাই ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ অফিসের ভিতরে প্রবেশ করতেই সবাই কংগ্রেস করতে করতে এসে আকাশের হাতে একেক করে ফুল গুলো তুলে দেয়। সবার এমন শোভনীয় আচরণ দেখে আকাশের ভিতরটা খুশিতে ভরে উঠে। আকাশ সবাইকে ধন্যবাদ জানায় তাকে এভাবে বরণ করে নেওয়ার জন্য। এরপর অফিসের সবাই যে যার মতন গিয়ে কাজে লেগে পড়ে। তখনি অফিসের ম্যানাজার এসে আকাশকে বলে,

–‘বড় স্যার আপনার জন্য ভিতরে কেবিনে অপেক্ষা করছে। আপনি আমার সাথে ভিতরে চলুন।’

–‘জ্বি চলুন।’
ম্যানাজার আমায় তার সঙ্গে করে একটা কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করলো। যেই কেবিনের ভিতরে বাবা আগ থেকে থেকেই বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করতেই বাবা আমায় বলে উঠলো,

–‘আকাশ আসতে এতো দেরি করলে যে?
আমি বুড়ো হয়েও সেই সকালে অফিসে চলে এসেছি। কারন আজ আমার ছেলের বিশেষ একটা দিন। কিন্তু তুমিই এসেছো দেরি করে। এমন করলে হবে বলো?’

–‘আসলে আব্বু রাস্তায় প্রচুর জ্যাম ছিল। তাই আসতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছে।’

–‘আচ্ছা সমস্যা নেই। তবে তুমি এবার বলো, যে কেবিনটা তোমার কেমন লেগেছে? এই কেবিনটা আমি স্পেশালি তোমার জন্য বানিয়েছি। আমি মাঝেমধ্যে অফিসে আসলে আমার পুরাতন কেবিনেই বসবো। কিন্তু তোমার জন্য আমি নতুন কেবিন বানিয়েছি।’

–‘আব্বু বেশ সুন্দর হয়েছে কেবিন টা।’

–‘তোমার পছন্দ হয়েছে তো?’

–‘হুম আব্বু অনেক পছন্দ হয়েছে।’

–‘যাক শুকরিয়া। এবার মন দিয়ে অফিস টাকে সামলাও। আমি অফিসের সমস্ত ডকুমেন্ট তোমার নামে করে দিয়েছি। আজ তুমি বাসায় গেলে তোমার মা তোমার হাতে অফিসের সমস্ত ডকুমেন্ট তুলে দিবে।’

–‘ঠিক আছে আব্বু।’

–‘এবার আমি বাসায় চলে গেলাম। আজ থেকে আমি মুক্ত। বেশ কয়েক বছর অফিসটাকে আমি সামলেছি। কিন্তু এখন আমি প্যারা মুক্ত।’

‘আকাশের বাবা আকাশকে সমস্ত দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। আকাশের বাবার পিছন পিছন ম্যানাজার ও কেবিন থেকে বেরিয়ে গেছে। তিনারা চলে যেতেই আকাশ কেবিন টাকে খুঁটে খুঁটে দেখতে আরম্ভ করে। এভাবে কিছু সময় পেরিয়ে যেতেই ম্যানাজার এক গাদা ফাইল নিয়ে এসে আবার আকাশের কেবিনে হাজির হয়। প্রথম যাত্রায় আকাশ এতোগুলা ফাইল দেখে ঘাবড়ে উঠে। আকাশের ঘাবড়ে যাওয়া চেহারাটা দেখে ম্যানাজার আকাশকে বলে,

–‘স্যার আপনি একদম ঘাবড়াবেন না। আমি সমস্ত কাজকর্ম আপনাকে বুঝিয়ে দিব। আর এই যে ফাইল গুলো এনেছি, এসবের মধ্যে খালি আপনার সিগনেচার প্রয়োজন। আপনার সিগনেচার হয়ে গেলে একটা ফাইল বাদে সব আমি নিয়ে যাবো। আপনার কাজ খালি একটা ফাইল দেখে দেওয়া।

‘ম্যানাজারের কথা শুনে আকাশের অস্থিরতা কিছুটা কমে। এরপর ম্যানাজার একে একে আকাশকে দিয়ে সব কয়টা ফাইলে সিগনেচার করিয়ে নেয়। সিগনেচার করানোর পর একটা ফাইল আকাশকে দিয়ে কি ভাবে কি করতে হবে সব বুঝিয়ে দেয়। তারপর ম্যানাজার বাকি ফাইল গুলো হাতে উঠিয়ে নিয়ে আকাশের কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। আর বেরিয়ে যাওয়ার আগে ম্যানাজার আকাশকে বলে কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে বা কোনো সমস্যা হলে সে যেনো তাকে অনুসরণ করে। ম্যানাজার যাওয়ার পর আকাশ ফাইলটা ওপেন করে কাজ করতে আরম্ভ করে। ম্যানাজার তাকে যেভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে, আকাশ সেভাবেই কাজ করছে। কাজ করার এক পর্যায়ে হুট করেই আকাশের সেই দিশা নামক মেয়েটার কথা মনে পড়ে। যার কারনে আকাশ বেখেয়ালি হয়ে কাজ বন্ধ করে সেই মেয়েটার কথা ভাবতে আরম্ভ করে।’

–‘আচ্ছা আমি কি কাজটা ঠিক করেছি! আজ অব্দি নিজের প্রেমিকাকেও তো কখনো ছুঁয়ে দেখিনি। সেখানে নিষিদ্ধ নগরীর একটা মেয়েকে এভাবে আমি চুমু খেলাম। অন্ধকার পল্লীর রমণী গুলো ঐ সময়টাতে আমার দিকে কেমন অদ্ভুৎ নজরে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু সব কিছুর ভিড়ে আমি এটাই বুঝে উঠতে পারছিনা, যে মেয়েটা হুট করে আমায় স্বামী বলে কেন পরিচয় দিয়েছে! আর সে আমায় কেনই বা সবার থেকে এভাবে বাঁচালো! সে তো পারতো বাকি সবার মতন আমার উপরে মজা নিতে। কিন্তু সে সেটা নিলো না কেন! বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ বিষয়টাকে নিয়ে ভাবলাম, কিন্তু কোনো উত্তর এই আমি খুঁজে পেলাম না। তবে আমি উত্তর না পেলেও ভাবনা চিন্তা টাকে বহাল রাখলাম। কারন মেয়েটাকে নিয়ে ভাবতে আমার কেমন যেনো বেশ ভালো লাগছে। আর ভালো লাগবে নাই বা কেন, নিজের প্রিয়তমা আমায় পল্লীতে টেনে নিয়ে গেছে। যেই পল্লীর নাম শুনলেও আমার ঘৃণা হতো। সেখানে প্রভার জন্য আমাকে সেই নোংরা জায়গায় কদম ফেলতে হয়েছে। আমি তো আজ প্রিয়তমার পিছু নিয়ে ফেঁসেই গিয়েছিলাম, কিন্তু দিশা নামক মেয়েটা আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করেছে। প্রিয়তমার কারনে ক্ষুন্ন হতে চলেছিল আমার সম্মান। সেখানে নিষিদ্ধ নগরীর অচেনা এক রমণী আমার সম্মান টাকে নষ্ট হতে হতে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তার থেকেও বড় কথা মেয়েটার মনুষ্যত্ব দেখে আমি বিমোহিত হয়েছি। নিষিদ্ধ নগরীর নারীরা টাকার জন্যই নিজের দেহের উষ্ণতা বিলিয়ে বেড়ায়। সেখানে এই মেয়েকে আমি টাকা দেওয়ার পর সে নিতেই চাইলো না। ইশ মেয়েটা কেন যে এই পথে গেলো। দেখতে শুনতে তো মাশাল্লাহ। সে তো না গেলেও পারতো এই পথে। এসব নিয়ে ভাবছিলাম, এমন সময় হুট করেই ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের আওয়াজে ভাবনায় বাঁধা পড়েছে। তাই চিন্তা-ভাবনা করা বাদ দিয়ে রেখে পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম। পকেট থেকে ফোন বের করতেই দেখি প্রভা ফোন দিয়েছে। এই অসময়ে প্রভার ফোন দেখে ভিতরটা কেমন যেনো কুচকুচ করতে আরম্ভ করেছে। কারন সে আমায় কখনোই এই অসময়ে ফোন দেয় না। তবে যাক ফোন দিয়েছে ভালোই হয়েছে। আমি আমার প্রশ্নের উত্তর গুলো হয়তো এখন খুঁজে পাবো। ফোনটা জলদি রিসিভ করে হ্যালো বলতেই অপরপাশ থেকে প্রভা তিক্ত আওয়াজে বলে উঠলো,

–‘এই আকাশ তুই নাকি নিষিদ্ধ নগরীতে গিয়েছিলি? এটা কি সত্যি নাকি?’

–‘প্রভার কথা শুনে মুহূর্তের মধ্যেই আমার চোখ মুখ কুঁচকে গেছে! কারন এই প্রশ্নটা আমি তাকে করার কথা ছিল। কিন্তু সে দেখছি উল্টো আমায় প্রশ্ন করছে। প্রভার প্রশ্নের উত্তরে কি বলবো বুঝে উঠতে পারছি না! তখনি সে আবার আমায় বলে উঠলো,

–‘কিরে কথা বলছিস না কেন? তুই সেই নিষিদ্ধ নগরীতে কি কারনে গিয়েছিলি? আমায় দিয়ে কি তোর হচ্ছে না, যে তোর নিষিদ্ধ নগরীতে গিয়ে নিজের লালসা মিটাতে হচ্ছে?’

–‘প্রভার কথায় এবার কাঁপুনি শুরু হয়ে গেলো!
তবে সেটা প্রভাকে বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললাম, প্রভা তুমি যেমন ভাবছো তেমন কোনো কিছুই না। আসলে আমি একটা কাজের কারনে সেখানে গিয়েছিলাম।’

–‘আকাশ আমায় একদম শেখাতে আসবি না। আমি জানি তুই সেখানে নিজের খুদা মিটাতে গিয়েছিলি।’

–‘প্রভা বিশ্বাস করো আমি সেখানে বাজে মতলব নিয়ে যাইনি।’

–‘তাহলে কি কারনে গিয়েছিলি আমায় বল?’

–‘ঠিক আছে বলছি। কিন্তু তার আগে তুমি আমায় এটা বলো, যে আমি সেখানে গিয়েছি সেই খবর তুমি কই পেলে?’

–‘পেয়েছি যেভাবেই হোক সেটা তোকে বলা যাবে না। সেটা সিক্রেট। কিন্তু তুই এখন নিজের বিষয়টা ক্লিয়ার কর।’

–‘প্রভা আমি যদি বলি আমার তোমার পিছু নিতে নিতে সেই আঁধার নগরীতে গিয়েছি তাহলে তুমি কি বলবে?’

–‘মা…মা… মানে কি আকাশ?’

–‘মানে টা তো তুমিই আমার থেকে ভালো জানো প্রভা। আজ এক বছর তোমার সাথে আমার সম্পর্ক। আজ অব্দি কখনো তোমার শরীরের দিকে খারাপ নজরে তাকাইনি। সেখানে তুমি আমায় বেহুদা সন্দেহ করছো? সেখানে তুমি আমার কাছে কারন জানতে চাইছো? প্রভা সন্দেহ তো তোমাকে করা উচিৎ আমার।’

–‘আকাশ একদম ফালতু কথা বলবি না।’

–‘তো আমায় নিয়ে যে তুমি ফালতু কথা বলছো?’

–‘ধুর তোর সাথে কথা বলতেই আমার বিরক্ত লাগছে। আমি ফোন রাখলাম। পরে কথা হবে তোর সাথে আমার।’

‘প্রভা হুট করেই ফোন রেখে দেয়। আর আকাশ প্রভার এমন আচরণ দেখে কিছু একটা ভেবে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। এভাবে কিছুক্ষণ সময় কেটে যায়। আকাশ সমস্ত চিন্তা-ভাবনাকে সাইডে রেখে কাজ করতে আরম্ভ করে। কাজ করতে করতে দুপুর হয়ে এসেছে। পুরো ফাইল কমপ্লিট আকাশের। এমন সময় ম্যানাজার অনুমতি নিয়ে আবার কেবিনে প্রবেশ করে। ম্যানাজারের আগমন দেখে আকাশ বুঝে নেয় তিনি ফাইল নেওয়ার জন্যই এসেছেন। তাই আকাশ নিজ থেকেই ম্যানাজারকে বলে,

–‘ফাইল রেডি আপনি নিয়ে যেতে পারেন।’

‘আকাশের কথায় ম্যানাজার ফাইল হাতে উঠিয়ে নিয়ে আকাশকে বলে,

–‘স্যার আজকে আপনি বাড়ি চলে যান। বড় স্যার আমাকে বলে দিয়েছিল আপনি যেনো আজ দুপুর বেলায় বাসায় চলে যান।’ কারন প্রথম দিন আজ আপনার।’

–‘আচ্ছা।’

‘ম্যানাজারের কথায় আকাশ অফিস থেকে বেরিয়ে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। কারন তার ও আজকে মন ভালো লাগছে না তেমন একটা। তাই বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে। কিন্তু বাসায় যাওয়ার পথে ড্রাইভার পল্লীর সামনে দিয়ে গাড়ি অতিক্রম করতেই আকাশ দিশাকে দেখতে পায়। দিশা একটা লোকের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আকাশ দিশাকে দেখে ড্রাইভারকে আবার গাড়ি থামাতে বলে। ড্রাইভার আকাশের কথা মতন রাস্তার একপাশে গাড়ি দাঁড় করায়। গাড়ি দাঁড় করাতেই আকাশ গাড়ি থেকে নেমে দিশার কাছে চলে যাওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করে। আকাশ দিশার প্রায় কাছাকাছি চলে গিয়েছে। এমন সময় সে কিছুটা দূর থেকেই দিশার সাথে কথা বলা লোকটার কথা শুনতে পায়। লোকটা দিশাকে বলছে সে নাকি তাকে ভালোবাসে। লোকটার কথার উত্তরে দিয়া হাসতে হাসতে সেই লোকটাকে জিজ্ঞাস করে,

–‘আপনি আমাকে ভালোবাসেন? কেনো ভালোবাসেন আমাকে? আমার সুগঠিত দেহের জন্য, ঠোঁটে যত্ন করে আঁকা গাঢ় লিপস্টিকের স্বাদ পাবার জন্য, বুকের খাঁজে মুখ ডুবিয়ে শান্তি লাভের জন্য, নাকি আমার সতিত্বে স্পর্শ করে নিজের পুরুষত্বের প্রমান দেবার জন্য?

‘দিশার কথা শুনে আকাশ হাঁটা থামিয়ে দেয়। “অপরদিকে সেই লোকটা দিশাকে বলে,

–‘তুমি যেটাই ভাবো না কেন আমার শুধু তোমাকেই চাই। তোমার সাথে নিজের অস্তিত্ব মিলাতে চাই।’

‘লোকটার কথায় দিশা লোকটাকে আবারো হাসতে হাসতে বলে,

–‘দেখুন আজ আমার কোনো কিছুই ইচ্ছে করছে না। তবে আপনার যেহেতু আমাকেই চাই, তাইলে আপনি একটা কাজ করেন। ঐ যে দেখছেন আমাদের থেকে কিছুটা দূরে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে, আপনি তার থেকে পারমিশন নিয়ে আসুন। সে যদি হ্যাঁ বলে তাহলে ফ্রিতে আজ আমি পুরো দিনটা আপনার সঙ্গে কাটাবো। আমার শুধু তার অনুমতি চাই। আমি জানিনা আজ আমার কি হয়েছে! তবে সেই লোকটা যদি অনুমতি দেয়, তাহলে আজ পুরো দিনের জন্য আপনি আমায় পাবেন।

‘দিশার কথায় লোকটা তাজ্জব হয়ে আকাশের দিকে ঘুরে তাকায়। “অপরদিকে দিশার কথা শুনে আকাশের ভিতরে কেমন যেনো ভয়ানক একটা রাগ কাজ করে। মনে হচ্ছে যেনো তার প্রিয়তমা প্রভা নয়, তার প্রিয়তমা হচ্ছে দিশা। আর তার প্রিয়তমা তাকে ছেড়ে অন্য লোকের কাছে যাওয়ার জন্য তার কাছ থেকেই সেই লোকটাকে পারমিশন নিতে বলছে….

চলবে…

কুহেলিকা পর্ব-০১

0

#কুহেলিকা (পর্ব-০১)
#লেখক-আকাশ মাহমুদ

প্রভা একটা দোকান থেকে মদের দু’টো বোতল কিনে নিয়ে অপরিচিত একটা লোকের সাথে আঁধার নগরীতে প্রবেশ করলো। যেই আঁধার নগরী সম্পর্কে জানেনা এমন একটা লোক এই শহরে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কারন এই গলির মুখেই অতিরঞ্জিত সাজে মহিলারা দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের গায়ে নামমাত্র পোশাক। শরীরের আকর্ষণীয় স্থানগুলো লোকসম্মুখে উন্মুক্তই বলা চলে। কারো বক্ষবন্ধনীর মাঝ বরাবর দেখা যাচ্ছে গভীর খাঁজ, কারো স্রোতের ন্যায় কল্লোলিত কোমরের বাঁক, কারো নাভীর গভীর খাদ পুরুষদের চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণ করছে। এটা খদ্দেরের দৃষ্টি আকর্ষণের সনাতন কৌশল। এই আঁধার নগরীকে মানুষ আরেকটা নামেও চেনে অন্ধকার পল্লী। এই অন্ধকার পল্লীতে একটা মায়া ভ্রমর বাস করে। যেই মায়া ভ্রমরটা এই অন্ধকার পল্লীর আশপাশ দিয়ে যাতায়াত করা আশি শতাংশ পুরুষকেই অন্ধকার পল্লীর নারীদের উপরে ভ্রম খাইয়ে দেয়। বাকি বিশ শতাংশ পুরুষ নিজের দৃঢ় ঈমানের বলেই বেঁচে যায়। কিন্তু প্রভা মদের বোতল নিয়ে অচেনা একটা লোকের সাথে এই অন্ধকার পল্লীতে কি করছে। ট্রাফিকজ্যামে আঁটকে থাকা আকাশের মাথায় এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ আকাশের অফিসে জয়েনিং করার প্রথম দিন। আকাশের বাবা লোকমান সাহেব রিটায়ার্ড করবে সব কিছু থেকে। তাই তিনি অফিসের সমস্ত দায়দায়িত্ব আকাশকে বুঝিয়ে দিতে চায়। আকাশ বাসা থেকে রেডি হয়ে গাড়ি নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। কিন্তু মাঝপথে ট্রাফিকজ্যামে আঁটকে পড়ায় প্রভার ছলনাময়ী দৃশ্য তার চোখে পড়েছে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সে একদম স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু বর্তমানে প্রভার অদ্ভুৎ আচরণ দেখে তার মাঝে দুনিয়ায় সমস্ত অস্থিরতা এসে হানা দিয়েছে। ট্রাফিকজ্যামের মতন করে তার মাথাটাও জ্যাম হয়ে গেছে। সে প্রভার এসব আচরণের কোনো মাহাত্ম্য খুঁজে পাচ্ছে না। এই তো গতরাতে মেয়েটা তার সাথে কতো সুন্দর করে কলে কথা বলেছে। প্রভা হচ্ছে আকাশের প্রিয়তমা। আজ বছর খানিক ধরে তাঁদের দু’জনের মাঝে রিলেশন চলছে। কিন্তু হুট করেই আকাশ প্রভাকে মদের বোতল নিয়ে অন্ধকার পল্লীতে যেতে দেখে সে যেনো নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারাতে বসেছে। আকাশ প্রভাকে নিয়ে চিন্তায় বিভোর। এমন সময় ট্রাফিকজ্যাম ছুটে গিয়েছে। ট্রাফিকজ্যাম ছুটতেই ড্রাইভার অফিসের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছুটিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার জন্য কিছুটা সামনে এগোতেই আকাশ ড্রাইভারকে বলে,

–‘মালেক ভাই গাড়ি থামান।’ (মালেক ড্রাইভারের নাম)

–‘কেন স্যার কি হয়েছে?’

–‘কি হয়েছে সেটা আমারো অজানা। আপনি গাড়ি থামান। আমি একটা জায়গায় যাবো কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। তারপর উত্তর জেনে এসে না হয় আপনার প্রশ্নের উত্তর দিব।’

–‘ঠিক আছে স্যার।’

–‘ড্রাইভারকে রেখে গাড়ি থেকে নেমে আঁধার নগরীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আঁধার নগরীর মুখেই মাছির সংখ্যায় রমণীরা ভো…ভো করছে। আমি কারোর দিকে দৃষ্টিপাত না করে নগরীর ভিতরে ঢোকার জন্য আপন মনে ছুটে চললাম। কিন্তু গলির মুখে যেতেই রমণীরা আমার দিকে মৌমাছির ঝাঁকের ন্যায় এগিয়ে আসতে লাগলো। এমন সময় হুট করেই কোথা থেকে যেনো দৌড়ে এসে অল্প বয়সী একটা মেয়ে আমার হাত খপ করে চেপে ধরলো। মেয়েটা আমার হাত চেপে ধরতেই রমণীর ঝাঁকটা থেমে গেলো। আমি অবাক চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি! কারন মেয়েটার বয়স সর্বোচ্চ হলে সতেরো কি আঠারো। আর তাছাড়া মেয়েটাকে দেখে বোঝাও যাচ্ছে না সে এই আঁধার নগরীর বাসিন্দা। স্মার্ট করে শাড়ী পড়েছে। তার পাশাপাশি ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। চোখের কোনে মোটা পরত করে কাজল দিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ ভালো বংশের একটা মেয়ে। আমি মেয়েটাকে নিয়ে ভবাছিলাম, এমন সময় মেয়েটা আমার হাত ধরে টানতে টানতে পল্লীর মুখ ছেড়ে আঁধার নগরীর কিছুটা ভিতরে নিয়ে রাস্তার পাশে একটা দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়ালো। এটুকুতেই শেষ নয়। দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়ানোর পর আমার এক হাত টেনে নিয়ে গিয়ে তার কোমরের মাঝে রাখলো। অপর আরেক হাত ও টেনে নিয়ে গিয়ে ঘাড়ের সাইড করে দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে দিল। মেয়েটার এমন আচরণে আমি রীতিমতো অবাক হয়েই চলেছি। তখনি সে আমায় বলে উঠলো,

–‘সাহেব আমার মতন করে রোমান্টিক স্টাইলে এই পল্লীর কেউ খদ্দের সাথে ডিল করে না। একমাত্র আমিই খালি ব্যাক্তি, যে কিনা কাস্টমারের সাথে রোমান্টিক অঙ্গভঙ্গিতে ডিল করি। তো বলুন কতো দিবেন?’

–‘মেয়েটার কথা শুনে আমার সারা শরীর কাঁপতে আরম্ভ করেছে। আমি যেনো আর নিজের মধ্যে নেই। আমি ছলছল করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি, তখনই সে আবার বলে উঠলো,

–‘কি হলো সাহেব আমায় কি আপনার ভালো লাগেনি? আপনার কি অন্য কোনো নারী পছন্দ হয়েছে?’

–‘এবার আর চুপসে থাকতে পারলাম না। কারন চুপসে থাকলেই কথা লতার মতন বড় হবে। তার থেকে ভালো নিজের আসল উদ্দেশ্যটা মেয়েটাকে জানিয়ে দেই। দেখুন আসলে আমি এসবের জন্য এখানে আসিনি।’

–‘তাহলে কি জন্য এসেছেন এই নিষিদ্ধ নগরীতে আপনি?’

–‘আমি একজনের তালাশ করতে এখানে এসেছি।’

–‘কে সে?’

–‘আমার প্রেমিকা। সে মদের বোতল নিয়ে অন্য একটা পুরুষের সাথে এই নগরীতে প্রবেশ করেছে। তাই আমি তার পিছু নিতে নিতে এখান পর্যন্ত এসেছে। আপনি কি জানেন সে এখানে কি করতে এসেছে?’

–‘সাহেব আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কার কথা বলছেন। আসলে দেখুন সেই নারী সম্পর্কে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। কারন সেই নারীকে কুহেলিকা বললেই চলে। সে কুয়াশার মতন এই নগরীতে প্রবেশ করে। তারপর ধোঁয়ায় মিশে যায়।’

–‘মানে কি?’

–‘সোজা বাংলায় মানে হলো সে এই পল্লীতে এসে কিছু সময় কাটিয়ে আবার চলে যায়। কারোর সাথে কখনো কোনো কথা বলে না। চুপচাপ একটা লোকের সাথে আসে। আবার চুপচাপ সেই লোকটার সঙ্গেই পল্লী থেকে বেরিয়ে যায়।’

–‘মেয়েটার কথা শুনে গায়ের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে গেছে! কারন মেয়েটার কথা শুনে স্পষ্ট ভাবে বুঝাই যাচ্ছে, যে প্রভা এখানে প্রায় সময় আসে। কিন্তু কেন আসে সে এখানে! তখনি সেই মেয়েটা আমায় জিজ্ঞাস করলো,

–‘সাহেব মেয়েটা কে হয় আপনার?’

–‘আমার প্রিয়তমা। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি।’

‘মেয়েটা আকাশের কথা শুনে মুচকি একটা হাসি দেয়। আকাশ মেয়েটার হাসির রহস্য জানতে না চেয়ে মেয়েটার কোমর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মেয়েটাকে বলে,

–‘আমি পল্লীর ভিতরে যাচ্ছি। আমি জানতে চাই আমার প্রিয় মানুষটা এখানে কি করছে। চললাম আপনি থাকুন।’

‘আকাশ মেয়েটাকে চললাম বলে পল্লীর ভিতরে যাওয়ার জন্য কদম বাড়ায়। এমন সময় মেয়েটা পিছন থেকে আকাশকে বলে উঠে,

–‘সাহেব আপনি ভিতরে যাবেন না।’

–‘কেন যাবো না?’

–‘না যাওয়ার দু’টো কারন। প্রথমটা হলো আপনি পল্লীর ভিতরে গেলে আপনার পবিত্র শরীরে কলঙ্ক লাগিয়ে দিবে পল্লীর লোকজন। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে আপনি পল্লীর ভিতরে গিয়ে নিজের প্রিয়তমাকে অপ্রস্তুত ভাবে দেখতে পেলে নিজেকে সামলাতে পারবেন না। তাই আমার মতে এই বিষয় নিয়ে আপনার প্রিয়তমার সাথে পল্লীর বাহিরে অন্য কোনো সময় কথা বললেই ভালো হবে।’

–‘মেয়েটার কথা শুনে নিজের উদ্দেশ্য টাকে পাল্টে ফেললাম। মেয়েটা ঠিক কথাই বলেছে। আমাকে এই পল্লীর ভিতরে কেউ দেখতে পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই মেয়েটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মানিব্যাগ থেকে পাঁচশত টাকার একটা নোট বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলাম। কিন্তু মেয়েটা আমার হাত থেকে টাকা না নিয়ে শব্দ করে হাসতে আরম্ভ করলো। তবে হাসিটা তার চেহারায় বেশিক্ষণ সময় থাকে না। খানিক বাদেই হাসি থামিয়ে সর্পিল আঁখিতে ঘৃণার দৃষ্টিতে আমার দিকে একপা, দু’পা করে এগোতে এগোতে বলে,

–‘আমার টাকার প্রতি লোভ নেই, আমি শরীরের উষ্ণতা দেওয়ার পরেই টাকা হাতে তুলে নেই। আমরা হলাম উষ্ণতা বিক্রেতা। তবে বাকিরা কি করে আমার জানা নেই, কিন্তু আমি কখনো অহেতুক টাকা নেই না খদ্দের থেকে। আর সাহেব আপনাকে একটা মূল্যবান কথা বলি। আপনার প্রিয়তমাও হয়তো ভালোবাসা বিক্রেতা। সে টাকার বিনিময়ে হয়তো আপনার অগোচরে ভালোবাসা বিক্রি করে। কারন আমাদের এখানে প্রচলিত একটা ছন্দ আছে। টাকা থাকলে আজ কাল কাঠের পুতুল কথা কয়, টাকা ওয়ালা কাকুরা সব জুয়ান,জুয়ান মাইয়া লয়। আপনার প্রিয়তমা হয়তো টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। না হয়তো আপনি দেখতে শুনতে সেই ছেলে থেকেও সুন্দর এবং স্মার্ট। যদি আমার কথা ভুল না হয় তাহলে আপনার প্রিয়তমা আপনাকে রেখে পরপুরুষের সাথে এই নিষিদ্ধ নগরীতে কি করছে বলতে পারেন? অবশ্যই পারেন না। কারন আপনি উত্তর জানার জন্যই এখানে এসেছেন। আর আমি আপনাকে উত্তর খুঁজতে সাহায্য করেছি। আমার কথাটা আপনি মিলিয়ে নিয়েন।’

–‘মেয়েটার মুখে এসব কথাবার্তা শুনে কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠেছে! নাহ আর এক সেকেন্ড ও এখানে থাকা যাবে না। না হয়তো মানসিক ভারসম্য হারিয়ে বসবো। চিন্তা-ভাবনা মোতাবেক আর কথাবার্তা না বাড়িয়ে সোজা নিষিদ্ধ নগরী থেকে বেরিয়ে আসার জন্য রওয়ানা হলাম। কিন্তু আমার সাথে আবারো সেই সমস্যাটা হলো। নিষিদ্ধ নগরীর মুখে আসতেই গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রমণী গুলো আবারো মৌমাছির ঝাঁকের ন্যায় এসে আমাকে ঘিরে ধরলো। আগের বার পিছনে রেখে আসা মেয়েটা আমায় বাঁচিয়েছিল, কিন্তু এবার আমি ফেঁসে গেছি। সবাই এক সাথে আমায় ঘিরে ধরে এটা সেটা বলতে আরম্ভ করলো। বেশ বিব্রতকর একটা অবস্থার মধ্যে ফেঁসে গেছি। কি করে এখান থেকে পালাবো সেই রাস্তাটা খুঁজে বেড়াচ্ছি। এমন সময় একজন রমণী আমার হাবভাব দেখে আমায় বলে বসলো,

–‘কিরে তুই কি তৃতীয় লিঙ্গের নাকি রে?
নাকি তোর মাঝে শক্তি নেই? এই তো সবে একটু আগেই পল্লীতে প্রবেশ করলি। ঘড়ির টাইম হিসেব করলে মিনিট দশেক ও হবে না। এতো জলদি বেরিয়ে আসলি যে? আবার এখন দেখি আমাদের প্রশ্নের সম্মুখীন হবি দেখে চোরের মতন পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছিস। বাহ বেশ হাস্যকর তো ব্যাপারটা।

–‘রমণীর কথা শুনে কথা বলার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। তার উপরে লজ্জায় মাটি থেকে নজর উঠাতে পারছি না। এমন সময় আমার হাত ধরে নিয়ে যাওয়া সেই অল্প বয়সী মেয়েটা এসে সবার সামনে হাজির হলো। এবার রমণীটা তাকেও প্রশ্ন করলো,

–‘কিরে দিশা ছেলেটা কি তৃতীয় লিঙ্গের? নাকি শরীরে বেশিক্ষন টিকে থাকবার শক্তি নেই?’ (আকাশের হাত ধরে নিয়ে যাওয়া মেয়েটার নাম দিশা)

–‘বেহুদা কথাবার্তা না বলে তোমরা উনাকে যেতে দাও।’

–‘কেন রে দিশা, সে কি তোর জামাই লাগে? মনে হচ্ছে তাই। শোন তুই যতোই বলিস না কেন আমরা তার বিষয়ে জেনেই তারপর তাকে যেতে দিব। কারন সে এতো গুলো টাকা নষ্ট করে এখানে এসে অল্প সময় থেকেই চলে যাচ্ছে, তার সেই বিষয়ে আমাদের অবগত হওয়া দরকার।

‘রমণীটার কথা শুনে দিশা রাগান্বিত দৃষ্টিভঙ্গিতে আকাশের দিকে এগিয়ে এসে আকাশকে সবার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। তারপর আকাশকে সবার সামনেই আলতো পিঠে জড়িয়ে সবাইকে বলে,

–‘হ্যাঁ উনি আমার জামাই লাগে। আর উনি এখানে কারোর সাথেই কিছু করতে আসেনি। উনি এসেছে আমার সাথে কথাবার্তা বলতে। তাই তোমরা এই বিষয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে সবাই উনার আশপাশ থেকে কয়েকশত হাত দূরে সরো। না হয় তো আমি এই পুরো অন্ধকার পল্লীকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিব। আর তোমরা ভালো করেই জানো আমার পাওয়ার কতোটুকু এই অন্ধকার পল্লীতে। তাই আমার কথা টাকে ভালো ভাবে সবাই মাথায় ঢুকিয়ে নিয়ে উনার যাওয়ার পথ ক্লিয়ার করে দাও।’

‘দিশার রাগান্বিত কন্ঠ শুনে সবাই আকাশের আশপাশ থেকে দূরে সরে যায়। সবাই আকাশের আশপাশ থেকে দূরে সরে যেতেই দিশাও আকাশকে ছেড়ে দিয়ে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে আকাশের যাওয়ার পথ ক্লিয়ার করে দেয়। আকাশের যাওয়ার পথ এখন ক্লিয়ার। কিন্তু সে না গিয়ে দিশার নিকটে এগিয়ে যায়। এগিয়ে যাওয়ার পর সবার সামনেই দিশার কাঁধের পাশ থেকে চুল গুলো সরিয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে আকাশ দিশার কাঁধে একটা চুমু একে দেয়। এরপর মানিব্যাগ থেকে বের করা সেই পাঁচশত টাকার নোট টা দিশার হাতে শক্ত করে গুঁজে দিয়ে দিশার কানে কানে বলে,

–‘আমি তোমার উষ্ণতা গ্রহণ করেই এই টাকাটা তোমায় দিলাম। এটা রেখে দাও তোমার কাছে। চললাম এখন….

চলবে….

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে পর্ব-০৫(শেষ পর্ব)

0

#যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

শেষ পর্ব

🖋️রিয়া সেন দত্ত 🖋️

রবিবারের সকাল, অপর্ণা একটা ঢোলা পায়জামা আর কুর্তা পড়ে বাইরের ঘরে বসে চা খেতে খেতে খবর কাগজে চোখ বোলাচ্ছে | হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠতেই খবর কাগজ থেকে চোখ তুলে নিজের মনেই বললো, “এই সময় আবার কে এলো “| দরজাটা খুলে সামনে তাকাতেই অপর্ণার চোখ কপালে ওঠার জোগাড় | মৈনাক এসেছে |

মৈনাক অপর্ণাকে এভাবে দেখে খানিক ইতস্ততবোধ করে | অপর্ণা ভীষণভাবে অবাক হয়ে ভাবছে কি করবে | বাধ্য হয়ে মৈনাক নিজেই জিজ্ঞেস করে “আসতে পারি?” চোখের সামনে এভাবে মৈনাককে দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়ে অপর্ণা বলে “দিদি জামাইবাবু তো নেই, আপনি?…”, মৈনাক খানিক হাসার চেষ্টা করে বলে সে জানে |

তারপর বাধ্য হয়েই প্রায় নিজে অপর্ণার পাশ দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে চোখের সানগ্লাসটা খুলে পকেটে রাখতে রাখতে চারদিকটা দেখে নেয় | অপর্ণা দরজা বন্ধ করে এসে মৈনাককে বসতে বলে | মৈনাক একটা চেয়ার টেনে বসে | অপর্ণা কি করবে কি বলবে নিজের স্বামীকে ভেবে পায় না | হঠাৎ আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে “চা খাবেন?” মৈনাক অপর্ণার দিকে দৃষ্টিপাত না করেই বলে, “না, আমি এই সময় চা খাই না |” এরপর দুজনেই চুপচাপ | ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভূত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে তখন | সময় যে কিভাবে কাটছে তা নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা সিলিং ফ্যানটাই সাক্ষ্মী |

-বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর অপর্ণা নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করে, “আপনি হঠাৎ এখানে?” অপর্ণার সরাসরি প্রশ্নের জবাব সেই অর্থে কিছু না থাকলেও মৈনাক বললো, “আসলে এই দিকে এসেছিলাম…”, অপর্ণার চোখের দিকে তাকাতেই একটু থেমে বললো ঢোক গিলে , “না মানে কতগুলো কথা জানার ছিল, আপনি না মানে তোমার থেকে, একটু জল খাব |” এবার অপর্ণা উঠে রান্নাঘরে জল আনতে গেলে মৈনাক অপর্ণার যাওয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে | আজ থেকে সাড়ে ৯ বছর আগের মেয়েটা আর আজ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা কি আদৌ এক? আজও সেরকম নিষ্পাপ সরল চাহনি তবে আগের চেয়ে অনেক গভীর | বিয়ের পড়ে একরাতে একবারই মৈনাক দেখেছিলো ওকে |

….জল নিয়ে ফিরে এসে মৈনাককে ডাকলে মৈনাকের সম্বিত ফেরে | চা এর আধখাওয়া কাপ টা হাতে নিয়ে খেতে খেতে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো “বলুন, কি বলবেন?” অপর্ণার শান্ত স্নিগ্ধ চোখদুটো মৈনাক দেখলো | এখনকার মেয়েদের এতো চুল অনেকদিন মৈনাক দেখেনি | তার মায়ের এমন কোমর ছাড়িয়ে চুল ছিল এককালে |

মৈনাকের চুলে একটু পাক ধরেছে অপর্ণা লক্ষ্য করলো | কোর্টে মন দিয়ে দেখার সুযোগ হয় না একে অপরকে, তাই সামনে থেকে দেখার এমন সুযোগ অপর্ণা হাতছাড়া করতে চায় না | অপর্ণা যে মনে মনে মৈনাককেই চায় | চেহারাটা একটু খারাপ হয়ে গেছে দাড়ি -গোঁফ এর জঙ্গল তৈরী হয়েছে মুখে | চোখ থেকে সানগ্লাস টা নামানোর পর অপর্ণা দেখেছে মৈনাকের কোটরগত চোখদুটো | বাইরে থেকে যতই কঠিন হক না কেন ভেতরে ভেতরে চোখ দুটো বড়ো অসহায় |

কিন্তু অপর্ণাও নিজের আত্মভিমান ছাড়তে রাজি নয় | বড়ো অভিমান তার মৈনাকের প্রতি | যদিও অপর্ণা বোঝে এ প্রেম একতরফা, এ অভিমান একতরফা | মৈনাক তার অভিমান কোনোকালেই ভাঙাবে না | বড়ো কষ্ট হয় অপর্ণার | কাছের করে পেতে ইচ্ছে করে নিজের স্বামীকে | কিন্তু মৈনাক যে এ সম্পর্কে দেওয়াল তুলে দিয়েছে যা ভেদ করে যাওয়া অপর্ণার কাছে কঠিন মনে হয় | এতো তিরস্কারের পরেও সে মৈনাককেই ভালোবাসে আর সারাজীবন বাসবেও | একতরফা প্রেম যে বড়ো যন্ত্রণার | দাম্পত্য এই সম্পর্কে একতরফা প্রেম যে কত যন্ত্রণার তা অপর্ণা তিলে তিলে অনুভব করে |

নিজেকে যতদূর সম্ভব সংযত রেখেই অপর্ণা জিজ্ঞেস করে “আপনি নিশ্চয়ই কোনও কারণে আমার কাছে এসেছেন, সেটা কি কেস সংক্রান্ত?” তারপর অপর্ণা থেমে দৃঢ় ভাবে বলে, ” যদি তাই হয় তবে আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতে বা আলোচনা করতে চাই না ” অপর্ণার এরকম তির্যক স্পষ্টভাষণের জন্যে মৈনাক খুব একটা প্রস্তুত ছিল না | সে খানিক ভ্রু কুঁচকে ভালো করে অপর্ণাকে একবার দেখে নিয়ে ভনিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো “তীর্থ তোমার কে হয়? বন্ধু? ” খানিক আমতা আমতা করে বললো “নাকি তোমার প্রেমিক বা বলা ভালো তুমি ভালোবাসো তাকে?” এতক্ষন অপর্ণা মন দিয়ে মৈনাকের কথা শুনছিলো, হঠাৎ এমন প্রশ্নে তার অভিমানের আগুনে যেন ঘৃতাহুতি হলো, সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “মানে, কি বলতে চান আপনি?”

মৈনাক থতমত খেয়ে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বলে “না আসলে, আমি…”, অপর্ণা মৈনাককে থামিয়ে বলে চলে “কোথায় ছিলেন এতগুলো বছরে?আমাকে চিনলেন কবে বুঝলেনই বা কবে স্ত্রী হিসেবে? আর কতটা যন্ত্রণা দিলে আপনি শান্তি পাবেন বলতে পারেন, আপনি সেদিন বিয়ে করতে না চেয়েও বিয়ে করেছিলেন আর আমি কি অপরাধ করেছিলাম? কিসের পরীক্ষা দিচ্ছি আমি?” অপর্ণার রাগে চোখে জল আসে | আবার বলে “একজন স্ত্রী তার স্বামীর থেকে যে সম্মানটুকু চায় আপনি তার সিকিভাগও কখনো দেননি, পরিচয় দিতেই লজ্জা পেয়েছেন, আমাকে আপনি একফোঁটাও চেনেন না কাজেই এমন প্রশ্ন করার স্পর্ধা আপনাকে কে দিয়েছে?” মৈনাক অপর্ণাকে এভাবে রেগে যেতে দেখে খানিক থতমত খায় | অপর্ণার ভেতরে এতো তেজ মৈনাক সেদিনই দেখেছিলো কোর্টে অথচ এতো রাগ যে থাকতে পারে এই মেয়েটার মধ্যে তা মৈনাক বুঝতে পারে নি | অথচ কত স্নিগ্দ্ধ, শান্ত মেয়েটা | চুপচাপ করে থেকে মৈনাক বলে “তোমাকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি জানি, তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছি তুমি কি সত্যিই তীর্থ কে ভালোবাসো, যদি বাসো আমি নির্দ্বিধায় তোমাকে আইনিভাবে মুক্তি দেবো | ”

অপর্ণা শান্ত ভাবে মৈনাকের খুব কাছে এসে চোখে চোখ রেখে বলে “আরেকটা ভাবেও মুক্তি দিতে পারেন, সেদিন হাতটা চেপে ধরেছিলেন আজ গলাটা ধরুন সব জ্বালা আপনারও জুড়োবে হয়তো আমারো, আমার বাবা কোনোদিন আমাকে মেয়ে বলে গ্রহণ করেনি, আপনি স্ত্রী বলে গ্রহণ করেননি | সমাজে আমি কুমারী বিবাহিতা নাকি বিধবা কোনটা আমি বলতে পারেন? সেদিন বাবা বিয়ে দিয়ে দিলো জানতেও পারিনি কার সাথে বিয়ে হচ্ছে আমার, আমি সবার জীবনের বোঝা হয়ে আর বাঁচতে চাই না তবে এটুকু বলতে চাই আর যাই করুন এতো বড়ো কালী মুখে লেপে দেবেন না আমি আপনার স্ত্রী, ভালোবাসার সুযোগ দিলেন কোথায় আপনাকে? এতগুলো বছরে কতবার খোঁজ নিয়েছেন আমার? কেমন আছি জিজ্ঞেস টুকুও করেননি, কি মনে করেন নিজেকে?”

… একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্নের মুখে অপর্ণার চোখে আর চোখ রাখতে পারে না মৈনাক | অপর্ণার চোখদুটো মুছতে বড্ডো ইচ্ছে করলেও ছুঁতে পারে না মৈনাক | তারপর লজ্জায় মাথা নিচু করে বলে “আমি এভাবে বলতে চাইনি, তোমাকে কয়েকটা কথা বলার আছে তীর্থ দোষী নয় আমি জানি | সত্যিটা যাতে সামনে আসে আমি চেষ্টা করব, আর আমি চাই মৃতা রেবা সোরেন ন্যায় পাক, তুমি সাবধানে থেকো অপর্ণা |” এই প্রথম মৈনাকের মুখে নিজের নাম শুনে অপর্ণা অবাক হয়ে একবার তাকায় |

মৈনাক দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো তারপর পেছনে তাকিয়ে অপর্ণাকে বললো “তোমার বাবা মারা গেছেন আমি সব জেনেছিলাম. ওনার থেকে, তুমি যেদিন বসু ভিলায় ফিরতে চাইবে আমি নিজে আসব তোমায় নিতে ” এই বলে মৈনাক দরজা খুলে বেরিয়ে যায় | অপর্ণা তাকিয়ে থাকে ওর চলে যাওয়ার দিকে | বাবার খবর সে দীর্ঘদিন নেয়নি | জানত ও না জানতে চাইতও না | কিন্তু মৃত্যুর খবরটা অপর্ণাকে একটু নাড়া দিলো | বাবা নামটাও মুছে গেলো জীবন থেকে | যদিও অনেক আগেই তা মন থেকে মুছে গেছে |

মৈনাক এর বিচক্ষণ চোখও সেদিন বুঝেছিল অপর্ণা হয়তো তাকে ঘৃণা করে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

মৈনাক ফিরে এসে যাহোক খেয়ে দুপুরে চেম্বারে চোখ বন্ধ করে চেম্বারে নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে | সকালের অপর্ণার ওই মুখখানা বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে | সাথে মল্লিকার সাথে কাটানো মুহূর্ত | সব যেন তোলপাড় হচ্ছে মনের মধ্যে | কোনটা ঠিক কোনটা ভুল কিছু ঠাওর করতে পারছে না সে | বড়ো অধৈর্য হয়ে চোখ খোলে বাড়ির কাজের লোকের ডাকে |

এম এল এ সত্যেন ঘটক এসেছে | মৈনাক ওনাকে বিকেলে আসতে বললেও উনি আগেই এসে গেছেন | মৈনাক ওনাকে দেখে প্রথমে বিরক্ত হলেও সেটা বুঝতে না দিয়ে জিজ্ঞেস করে এতো আগে আসার কারণ
—সত্যেন ঘটক বলে “ওই মেয়েছেলেটা! কি যেন নাম ? হ্যাঁ, অপর্ণা তা দুদিনের মেয়েছেলে কিনা আপনার মতো উকিলকে ঘোল খাইয়ে দিচ্ছে! এটা কেমন হলো উকিল বাবু?”,
মৈনাক শুরুতেই ধমক দিয়ে বললো “মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ মিস্টার ঘটক, একজন মহিলা সম্পর্কে কি ভাষায় কথা বলছেন? ভদ্র ভাষায় কথা বলুন |”,
—– সত্যেন ঘটক একটু চুপ করে থেকে একটা ফিচেল হাসি দিয়ে বললো, “সে আপনি যাই বলুন, মিডিয়ার লোকগুলো তো বলছে ওর সঙ্গে নাকি আপনার বিয়ে হয়েছিল! আপনি নাকি মেনে নেননি তাই…”
——মৈনাক কড়াভাবে তাকিয়ে টেবিলে ঝুকে বললো, “দ্যাট ইজ নান অফ ইওর বিজনেস, পয়সা দিচ্ছেন মানে মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি” বলে জোড়ে ধমকের সুরে বলল “গেট লস্ট আপনার কেস আমি লড়বো না, আর দেখি কে আপনার ছেলেকে বাঁচায়, আপনি নেতা আপনার নিজের এলাকায়, আপনার পার্টি অফিসে, এখানে নন মনে রাখবেন এখানে আর পাঁচজন মক্কেল এর মতো আপনিও আমার মক্কেল, কাজেই সেই জায়গাটা বুঝে কথা বলতে আসবেন সত্যেন বাবু, নাহলে এর ফল ভালো হবে না!”
—— মৈনাকের ওরকম ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে সত্যেন ঘটক খানিক ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বললো ” না মানে আমি কিছুই বলছি না ওই কানাঘুষ চলছিল সেটাই বললাম আর কি!”
—— মৈনাক সোজা হয়ে তাকালে সত্যেন ঘটক বলে “না মানে ওই তীর্থ বলে ছেলেটির সাথে ওই মেয়েছেলেটার সাথে ওহ ভুল হয়ে গেছে মহিলার নাকি একটু আবার ইন্টু মিন্টু ছিল একসময় ” বলেই আবার একটা খিকখিক করে ফিচেল হাসি দিয়ে “নাহ , ওখানে তো কেউ জানতো না ও বিবাহিতা, তাই একটু ছেলেটার বাড়িতে ঘুরে বেরিয়েছে, নাহ বন্ধু তো বন্ধুর বাড়ি যেতেই পারে তাই না…. একটু গাঢ় বন্ধুত্ব হলে আবার….”

মৈনাক চেঁচিয়ে বলে “গেট আউট, গেট আউট এই বাড়ির চারপাশে যদি দেখি….” সত্যেন ঘটক মৈনাকর ওরকম ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে ভয় পেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দরজার সামনে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন “তীর্থ ছাড়া পেলে আপনার ও ক্ষতি আমার ও ক্ষতি, ভেবে দেখবেন ব্যাপারটা |” মৈনাক ঘা খাওয়া বাঘের মতো গর্জন করে বললো “গেট আউট!”

বাইরে বেড়িয়ে সত্যেন ঘটক রাগে নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকে “কি করতে যে এই উকিলকে ধরলাম কে জানে আর যদি বা ধরলাম তাও আবার ওই মেয়েছেলেটার বরই হতে হলো, শালা আপদ কপাল! ছেলেটাও তেমনি হয়েছে একটা কাজ বললাম সে আর হয় না ” সত্যেন বাবুকে বিড়বিড় করতে দেখে তার সহকারী বাবলা কানের কাছে বলেন আপনি চিন্তা করবেন না ও মাল সামনের দিন কোর্টে উঠবে না |”

সত্যেন থামিয়ে দিয়ে বললেন, “না রে বাবলা, এ উকিল এর অনেক দূর হাত, ওই মেয়েছেলেকে কিছু করতে গেলে নিজেরাই ফেঁসে যাবো |” তারপর বিড়বিড় করতে করতে একটা সিগেরেট ধরিয়ে টানতে টানতে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

অপর্ণা বেশ কয়েকদিন লক্ষ্য করলো সে কোর্টে বেরোনোর সময় একটা গাড়ি তাকে অনুসরণ করে | ব্যাপারটা বাড়ি ফিরে সুপ্রতীককে সে জানায় | সুপ্রতীকের বুঝতে অসুবিধা হয় না অপর্ণার বিপদ পায়ে পায়ে ঘুরছে | সে দেরি না করে তার মৈনাককে ফোনে সব জানায় |

সেদিন কোর্টে বেরোনোর সময় ট্যাক্সি ধরতে গেলে একটা বড়ো ট্রাক গায়ের পাশ দিয়ে এমন ভাবে বের হয় যে আরেকটু এদিক ওদিক হলেই অপর্ণার দুর্ঘটনা হত | সাথে সাথে অপর্ণা দেখে একজন লোক ওই গাড়িটিকে অনুসরণ করে মোটর বাইকে | কিন্তু কে এই লোকটা? অপর্ণা বুঝে ওঠার আগেই নজরের বাইরে চলে যায় | ধাঁধায় পড়ে যায় অপর্ণা | কে করছে কেনই বা করছে বুঝতে পারে না |

ভরা এজলাসে একপ্রস্থ শুনানি হয়েছে |
জজ সাহেব একটু রিসেসে যাওয়ায় অপর্ণা পাবলিক প্রসিকিউটর এর সাথে কথা বলছে | মৈনাক ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে | সত্যেন ঘটক ও এজলাসে উপস্থিত | তার মতলবটা বুঝতে অপর্ণার অসুবিধা হচ্ছে না | অপর্ণার ওপর যেন রাগ ফেটে পড়ছে |

কোর্টে মৈনাকের সাথে অপর্ণা একেবারেই অপরিচিতের মতো ব্যবহার করে | চোখে চোখ পড়লেও সরিয়ে নেয় | কোনোপ্রকার সৌজন্যমূলক হাসি বা কথা কিছুই বিনিময় করে না মৈনাকের সাথে, মৈনাকের বেশ অদ্ভূত লাগে |

সুপ্রতীক এর তদারকিতে কলকাতা ক্রাইম ব্রাঞ্চের দেবেন্দ্র বর্মন যিনি একসময় সুপ্রতীক এর ভালো বন্ধু ছিলেন তাকে এই কেসে সাহায্য করার জন্যে সুপ্রতীক অনেক করে অনুরোধ করে | দেবেন্দ্র বর্মনের অনেক ওপরতলা পর্যন্ত হাত |তাই কান আর মাথা দুটো টানতেই অসুবিধা হয়নি |

এজলাসে জজ সাহেব এসে পড়ায় মামলার শুনানি আবার শুরু হয় | পক্ষে বিপক্ষে প্রমাণ আদালতে পেশ হয় | ইতিমধ্যে এমন একটি মেডিকেল রিপোর্ট কোর্টের কাছে এসেছে যেখানে বলা হয়েছে তীর্থর ডি এন এ এর সাথে ধর্ষণকারীর ডি এন এ কোনোভাবে মেলেনি | ট্রায়াল কোর্টে উত্তরবঙ্গ পুলিশ কোনও মেডিকেল রিপোর্ট জমা করেনি | এরজন্যে তাদেরকে শো কস করার আবেদন জানিয়েছে অপর্ণা | পূর্ণাঙ্গ তদন্তের ওপর ভিত্তি করে রিপোর্ট তৈরী করা হয়েছে | রিপোর্ট অনুযায়ী রেবার ধর্ষণ একজন নয় বেশ কয়েকজন করেছে | রেবার ভ্যাজাইনাতে যে সেমেন এর নমুনা পাওয়া গেছে তার সাথে তীর্থর সেমেন এর সাথে কোনোপ্রকার মিল নেই কাজেই এই ধর্ষণের সাথে যে তীর্থর জামিন যেন মঞ্জুর করা হয় | অপর্ণা এই আবেদন
জানিয়েছে |

ঘটনার তদন্তের পরে আরো একটা চমক সামনে আসে | এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আছে | মহামান্য আদালত ট্রায়াল কোর্টকে এ বিষয়ে যেন নির্দেশ দেন তাকে যথাপযুক্তভাবে যেন কোর্টে পেশ করা হয় এতে এই কেসের একটা নতুন দিক খুলবে অপর্ণা আর্জি জানায় মহামান্য কোর্টের কাছে |

সবদিক বিচার করে জজসাহেব তীর্থর জামিন মঞ্জুর করেন | সাথে পুলিশকে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দেন | সাথে উত্তরবঙ্গ পুলিশ এর এ ধরণের গাফিলতির জন্যে শো কস এর নোটিশ দেওয়া হবে | তীর্থ এ বিষয়ে কোনোভাবে জড়িত কিনা খতিয়ে দেখারও নির্দেশ দেন সাথে ট্রায়াল কোর্টকে নির্দেশ দেন দীর্ঘ শুনানি পর্বে এই কেসটি যেন আটকে না যায় |

তীর্থর জামিন হতেই তীর্থ ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ জানায় | তারপর অপর্ণার সাথে দেখা করে দুটো হাত ধরে বলে “আমি তোকে কি বলে ধন্যবাদ দেবো জানি না, তোর এই ঋণ শোধ করতে পারবো না হয়তো শুধু বলবো তু্ই সুখী হোস ” তীর্থর চোখে জল দেখে অপর্ণা বলে “তোর গায়ে যে কালি লেগেছে তোকে বেকসুর খালাস প্রমাণ করে তোর গা থেকে সেই কালি তুলে তবে রণে ভঙ্গ দেবো – মাসিমা তো আমার মা এর মতো তারতো তু্ই ছাড়া কেউ নেই রে তাই লড়াইটা লড়তেই হবে, গুই আমার খুব ভালো বন্ধু যে, কয়েক মাস অপেক্ষা কর | ”

মৈনাক দূর থেকে অপর্ণা আর তীর্থকে দেখছিলো | মনের মধ্যে চাপা রাগটা যেন ফুটে উঠলো | তড়িঘড়ি করে নিজের সব জিনিসপত্রগুলো নিয়ে কোর্টের বাইরে এসে ড্রাইভারকে নিজের কোর্ট আর গাউনটা দিয়ে রুক্ষভাবে বললো “গাড়ি বার করো আমি বেরিয়ে যাবো ” মৈনাকের এই চেহারা দেখে ড্রাইভার রামদুলাল আর কিছু বলার সাহস পেলো না | নাহলে তার দাদাবাবু কোনোকালেই এই দুপুরবেলা কোর্ট থেকে বেরিয়ে এভাবে বাড়ি যায় না |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

গত দুদিন ধরে মৈনাকের জ্বর | সেদিন কোর্ট থেকে ফেরার পরেই শরীরটা ঝিমঝিম করছিলো | সেই যে এসে নিজের ঘরে শুয়ে পড়েছিল সন্ধেবেলাতে যখন বাড়ির কাজের লোক ঘরের আলো জ্বালে তখন দেখে মৈনাক কুঁকড়ে শুয়ে আছে সেই দেখে মনপ্রভা দেবীকে খবর দিলে তিনি এসে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দেখেন ছেলের গা পুড়ে যাচ্ছে | জ্বরের ঘোরে ভুল বকছে | দেরি না করে ডাক্তার ডাকেন তিনি |

… একই শহরে অপর্ণা আছে মনপ্রভা জানেন কিন্তু তাকে ডাকার ইচ্ছে একেবারেই মনপ্রভার নেই | কারণ সে কলকাতায় এসে আসার পর একবারের জন্যেও বসু ভিলায় আসেনি | অপর্ণার এতো বড়ো স্পর্ধা দেখে তিনি অবাক হয়েছেন | তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছেন নিজের ছেলের বিরুদ্ধে তাকে কোর্টে লড়তে দেখে | তিনি কল্পনা করতে পারেননি | যাকে গ্রাম থেকে তিনি তুলেছে এনে এতো বড়ো বাড়ির বৌ করেছেন তার কিনা এতো স্পর্ধা!

ডাক্তার এসে ওষুধ দিয়ে গেছে | রিপোর্ট করতে দিয়ে গেছে | মনপ্রভা ইন্দ্রানীকে ফোনে সব জানিয়েছে | ওষুধ পড়লেও খুব দুর্বল | রিপোর্টে টাইফয়েড এসেছে | ইন্দ্রানীর কাছ থেকে খবর পেয়েও অপর্ণা বসু ভিলায় যেতে চায়নি | কিন্তু যখন সুপ্রতীক এর থেকে সে শোনে তার প্রাণ সেদিন মৈনাকের জন্যেই বেঁচেছিলো | কারণ মৈনাককে খবর দেওয়ার পর মৈনাকই পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এর কাছে জানিয়ে একজনকে নজর রাখার জন্যে জানিয়ে ছিল | এটা শোনার পর অপর্ণা বুঝে উঠতে পারছিলো না কি করবে |

দুদিন চরম মানসিক টানাপোড়েন এর পর অপর্ণা এসেছে মৈনাককে দেখতে | কিন্তু মনপ্রভা রাজি নন অপর্ণা তার ছেলের কাছে যাক | বাইরের ঘরে অপর্ণা অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু মনপ্রভা মৈনাকের ঘরে যাওয়ার অনুমতি কিছুতেই দিতে নারাজ | বাধ্য হয়ে অপর্ণা বাইরের ঘরেই সারা রাত থাকে | মৈনাককে না দেখে সে কিছুতেই ফিরে যাবে না |

বাইরের ঘরের সোফায় হেলান দিয়ে অপর্ণা চোখ বুজে আছে রাতে খায়নি কিছুই | কাজের লোকের থেকে মৈনাকের খোঁজ নিয়েছে | মনপ্রভার কানে সবই গেছে | বাধ্য হয়ে সে খানিকক্ষণের জন্যে দেখতে যেতে দেয় | নিজের স্বামীকে একবার দেখার সুযোগ পেয়ে অপর্ণা গিয়ে দেখে একদিন যে ঘরে তার প্রথম রাত একা একা কেটেছিল সেই ঘরে সেই বিছানায় মৈনাক ঘুমোচ্ছে | গায়ে মোটা চাদর | মুখটা এই কদিনেই শুকিয়ে গেছে | বড়ো মায়া হয় অপর্ণার | কাছে বসে মাথায় হাত বোলায় | মৈনাক তখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছে |

সেদিন রাতে প্রচন্ড বৃষ্টিতে সারা কলকাতায় জল জমে গেছে | ওদিকে মৈনাকের জ্বরটা বাড়লে একটানা বসে জলপট্টি দিতে থাকে | বেহুঁশ অবস্থায় মৈনাক শুধুই “মলির “নাম ধরে ডাকতে থাকে বারবার যখন বলে “আমি আসছি মলি ” অপর্ণার বুকটা যেন কেঁপে উঠতে থাকে | সে যে কোনোভাবেই মৈনাককে হারাতে চায় না | ওদিকে মনপ্রভা ঠাকুর ঘরে বসে ছেলের জন্যে কাঁদতে থাকে | ডাক্তার আসতে পারছে না | মাঝরাতে যখন কোনও ভাবেই জ্বর কমছে না উপরন্তু বেড়ে চলেছে তখন বাধ্য হয়ে অপর্ণা মৈনাকের মাথায় জল ঢালতে শুরু করে | এই কান্ড দেখে বাড়ির কাজের লোক মনপ্রভাকে খবর দিলে তিনি এসে অপর্ণাকে তীব্রভাবে ভৎসনা করেন এতো রাতে এভাবে জল ঢালার জন্যে | অপর্ণা কোনও দিকে কান না দিয়ে জল ঢেলে যায় | এরপর আস্তে আস্তে মৈনাকের জ্বরটা নামতে থাকে | ভোরের দিকে ক্লান্ত অপর্ণা দেখে মৈনাকর জ্বরটা আপাতত নেই | সাথে সাথে ডাক্তারকে ফোন করলে তিনি এসে মনপ্রভা দেবীকে বলেন | অপর্ণা মাথায় জল না ঢাললে বিপদ হতে পারত | ওদিকে মৈনাক চোখ খুলে অপর্ণাকে দেখে প্রথমে অবাক হয় | তারপর তার মনে পড়ে সেদিন তীর্থর অপর্ণার হাত ধরার কথাটা সে সাথে সাথে মুখে ঘুরিয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে | ওদিকে মনপ্রভা অপর্ণার প্রতি এরকম ব্যবহার করার জন্যে খুব লজ্জায় পড়ে গিয়ে অপর্ণার কাছে ক্ষমা চাইলে | অপর্ণা বিনীত ভাবে জানায় এটা তার কাজ ছিল |

গত কয়েকদিনের অক্লান্ত সেবা যত্নে মৈনাক সুস্থ হয়ে এসেছে | এই কদিনে বহু রাত জেগেছে অপর্ণা | কিন্তু দুজনের মধ্যে কথা হয়েছে দু -একটা | বলতে চেয়েছে দুজনেই কিন্তু পারেনি | ফিরে যাবার জন্যে মনপ্রভাকে জানালে তিনি কিছুতেই রাজি হন না | এই কদিনে অপর্ণাকে তিনিও একটু একটু করে বুঝেছেন, চিনেছেন | এই মেয়েই পারবে তার ছেলেকে একদম ঠিক করতে | এ বিশ্বাস তার হয়েছে |

ঘুম থেকে উঠে মৈনাক দেখে স্নান সেরে অপর্ণা শাড়ি পড়ে চুল খুলে তার ঘরের আয়নায় সিঁদুর পড়ছে | মৈনাকের ইচ্ছে করে স্ত্রীর কাছে যেতে কিন্তু পারে না | মৈনাকের চা দেওয়ার সময় অপর্ণার হাতটা স্পর্শ করতে মৈনাকের ইচ্ছে করে কিন্তু পারে না | ওদিকে অপর্ণা নিজের ভালোবাসা আর সেবায় মৈনাককে সুস্থ করে এবার ফ্ল্যাটে যাবার জন্যে মৈনাককে জানালে মৈনাক বাধা দিতে চাইলেও পারে না | মাথা নেড়ে শুধু বলে “তোমার যা ইচ্ছে ” | মৈনাকের এমন কথায় অপর্ণার আরো অভিমান হয় | অভিমানে পোড়া চোখ দুখানা মৈনাক কি দেখতে পাচ্ছে না নাকি চাইছে না এটা অপর্ণা বুঝে উঠতে পারে না | মৈনাক এখন পুরোপুরি সুস্থ | তবে দুর্বল |

অপর্ণা তিন দিন হলো ননদের ফ্ল্যাটে ফিরে গেছে | মনটা অবশ্য বসু ভিলাতেই সে রেখে এসেছে এবার | মৈনাক এই বারো দিনে অনেক কিছুই দেখেছে | অপর্ণার মতো ওই টুকু মেয়ের মৈনাক জানে মলি ও কে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল আর অপর্ণা ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে শিখিয়েছে | অতটুকু মেয়ের কাছে মৈনাক বসু পরাস্ত সবদিক দিয়ে | এমনকি ভালোবাসায় ও হারিয়ে দিয়েছে সে | ওর ধৈর্যের কাছে হেরে মস্তা নত হয়ে আসে | লক্ষ্যে স্থির অবিচল একটা মানুষ | মৈনাকের সময় কাটছে না এই তিন দিন অপর্ণাকে বড্ডো দেখতে ইচ্ছে করছে | মৈনাকের মনে হয় কত সুন্দর করে যত্ন নিয়ে সে এই ঘর আর তার ওই স্টাডি রুম পরিষ্কার করে রেখেছে |

মনপ্রভা ছেলেকে সকালে দেখতে এসে বুঝেছেন এবার অপর্ণার আসাটা প্রয়োজন | এতে ওদের দুজনেরই মঙ্গল | ছেলের উদাসীন চোখ তাকে বুঝিয়েছে আর দেরি করা ঠিক না | খানিক দূরত্ব কাছে এনে দেবে বেশি হলেই বিপদ | ছেলের সাথে কথা বলেও তিনি বুঝেছেন অপর্ণাকে ছাড়া আর এ সংসার ও চলবে না আর মৈনাক বসু ও চলবে না | কাজেই অগত্যা ইন্দ্রানী আর সুপ্রতীককে ফোনে করে সব জানিয়েছেন | পুজোয় তার ঘরের লক্ষ্মীকে এবার ঘরে ফেরাতে চান |

বেশ কয়েকদিন পর পুজোর ছুটিতে ইন্দ্রানী আর সুপ্রতীক এসেছে মৈনাককে দেখতে | বিকেলে বারান্দায় শালা জামাইবাবুর চা পর্ব চলছে সাথে চুটিয়ে আড্ডা | কিন্তু মাঝেমধ্যে মৈনাক উদাস ভাবে আকাশ দেখছে | সুপ্রতীকের নজর এড়ায় না | সুপ্রতীক আলাদা করে শালাবাবুকে নিজের ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবিটি দিয়ে বলেছে “এই সুযোগ শালাবাবু, সংযুক্তা একা আছে, হৃদয় হরণটা করে নাও, বাড়িতে নাহয় জানাবো কয়েকদিন একটু কাজেই গিয়েছ” বলে চোখ টিপে ইশারা করে রসিকতা করলো | তারপর বললো “জীবন একটাই শালাবাবু অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকলে বাঁচতে পারবে না, সেটাকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে চলো এগিয়ে চলার নামই জীবন, তুমি যদি বিয়ে না করতে সেদিন তাহলে আমি তোমায় কিছুই বলতাম না কিন্তু বিয়ে করে একটা মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট করো না, সে সত্যিই তোমায় ভীষণ ভালোবাসে, এমন ভালোবাসা পেয়েও হারিয়ে যেতে দিও না, ও খুব অভিমানী, ওর অভিমান তোমাকেই ভাঙাতে হবে |” মৈনাক বারান্দায় বসে দূরের রঙবেরঙের বিকেলের আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো | সাথে সাথে ওর মনে হলো দূরের আকাশে যেন মলির সদাহাস্য মুখখানা ভেসে উঠলো |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

পঞ্চমীর সকাল অপর্ণার ফ্ল্যাটের সামনেই ঠাকুর এসে গেছে প্রত্যেক বছর পুজোর মতো এবারেও সে একা | মা ছিল যখন তখনকার কথা গ্রামের কথা মনে পড়ে যায় | হঠাৎ কলিং বেলটা বাজতেই অপর্ণা “কে?” জিজ্ঞেস করে, চুল এর একটা আলতো খোঁপা করতে করতে এসে খোলে দরজাটা | দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে অপর্ণার চোখ স্থির | এই প্রথম পুজোর সময় সে মৈনাককে দেখছে | মুখের দাড়ির জঙ্গল সাফ করে চোখে সানগ্লাস পড়ে অদ্ভুতভাবে সুপুরুষ লাগছে মৈনাককে এতবছর পর |

… খানিক ইতস্তত হয়ে জিজ্ঞেস করলো “আপনি? এই শরীর নিয়ে এসেছেন?”, মৈনাক মৃদু হেসে বললো, “এখানেই সব উত্তর দেবো? ভেতরে আসতে দেবে না?” অপর্ণা খানিক লজ্জায় বললো “ও, হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আসুন | ” মৈনাক ঢোকার পর অপর্ণা লক্ষ্য করল মৈনাকের হাতে একটা ব্যাগ, সে ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কোথাও যাচ্ছেন? জানি বলার অধিকার আপনি আমাকে দেননি তাও বলছি এই শরীরে ধকল পড়বে বাইরে গেলে |”
মৈনাক বললো “কই না তো, আমি এখানেই থাকবো বলে এসেছি,” বলে সরাসরি অপর্ণার দিকে তাকালো | অপর্ণা এই উত্তর পাবে আশা করেনি | এই অপ্রত্যাশিত উত্তরে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মৈনাকের দিকে |
হালকা গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজে অপর্ণাকে বেশ মিষ্টি লাগছে | মৈনাক ভালো করে দেখলো তারপর খুব কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, “থাকতে দেবে আমাকে তোমার কাছে, অপু? আমার যে আর ভালো লাগছে না তোমায় ছাড়া |”

অপর্ণা যেন আকাশ থেকে পড়ছে এটা স্বপ্ন না সত্যি সে বুঝতে পারছে না | ফেরার পর থেকে কোর্টে আর দেখা হয়নি দুজনের | হঠাৎ খেয়াল পড়তে সে বললো, “আপনি দাঁড়ান, আমি একটু আসছি |” অপর্ণা যেতে গেলে হাতটা ধরে টেনে কাছে নিয়ে আসে মৈনাক, তারপর অপর্ণার কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলটা সরিয়ে দিয়ে বললো, “কোথাও যেতে দেবো না, মলিকে হারিয়েছি তোমাকে হারাতে পারবো না অপু, তুমি মলির বিকল্প নও কিন্তু আজ আমার মনের অনেকখানি জুড়ে জায়গা করে নিয়েছ | যা শাস্তি দেবে দাও কিন্তু ফিরিয়ে দিও না, আমি তোমায় নিয়ে বসু ভিলায় ফিরতে চাই |” অপর্ণার দুচোখ বেয়ে জল নেমেছে মৈনাক চোখের জল মুছিয়ে বললো, ” তুমি আমাকে ক্ষমা করো অপু, তোমার ভালোবাসার কাছে আমি হেরে গেছি, আমি অন্যায় করেছি, আসলে মলির চলে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারিনি তার সব শাস্তি তোমায় দিয়েছি, আমাকে একবার সুযোগ দাও তোমার স্বামীর হওয়ার ফিরিয়ে দিও না |” অপর্ণা শুধু বলে ” আমাকে আর কষ্ট দেবেন না |” মৈনাক শুধু বলে, ” আর আপনি নয় তুমি বলো বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা |”

অপর্ণা যেন এই দিনটারই প্রতীক্ষায় ছিল, অপর্ণা কোনও কথা বলতে পারছে না এত কাছ থেকে কখনো মৈনাককে সে দেখতে পায়নি | মানুষটার মধ্যে এতো ভালোবাসা তার জন্যে! অপর্ণা চোখ বুজে ফেলেছে, সে চায়না এ স্বপ্ন ভেঙে যাক | চোখ বন্ধ করা অপর্ণাকে কাছে টেনে মন দিয়ে দেখতে থাকে মৈনাক | অপর্ণার চোখ খোলার সাহস নেই যদি স্বপ্নভঙ্গ হয় তার | সে শুধু মৈনাক এর গভীর নিশ্বাস অনুভব করতে পারছে | মৈনাক এর ঠোঁট ধীরে ধীরে অপর্ণার ঠোঁট ছুঁয়েছে গভীর প্রেমঘন মুহূর্তে অপর্ণার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে | এ মুহূর্ত যেন দীর্ঘস্থায়ী হয় | বাইরে ঢাকের আওয়াজে বোঝা যাচ্ছে মা দুর্গা আসছে |

তিনদিন পর মৈনাক তার অপুকে সাথে নিয়ে বসু ভিলায় ফেরে | বৌমাকে নতুন করে বরণ করে ঘরে তোলেন মনপ্রভা | ইন্দ্রানী আর সুপ্রতীক দুজনেই খুব খুশি | বাড়িতে ঢোকার পরেই চোখের ইশারায় শালাবাবুকে রসিকতার ইঙ্গিত | অপর্ণা লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে | অপর্ণা মৈনাকের সাথে নিজেদের ঘরে ঢুকলে তার চোখ সামনে আটকে যায় | দেওয়ালে তার একটা ছবি, মৈনাকের আঁকা | মৈনাক আবার আঁকা শুরু করেছে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

একবছর পর…

অপর্ণা সন্তানসম্ভবা | কোর্টে প্রতিদিন যেতে পারে না | মৈনাক তার যাবতীয় খেয়াল রাখার জন্যে লোক রেখেছে সাথে মৈনাক তো আছেই | কোর্ট থেকে ফিরে যাবতীয় চেম্বার এর কাজা তাড়াতাড়ি সেরে অপর্ণার সাথে সময় কাটায় | মনপ্রভাও ভীষণ খুশি | ঘরে বসে টিভিতে খবরে দেখছে সত্যেন ঘটক, তার ছেলে সুবীর ঘটককে জেল হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে | সবাই মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে যাচ্ছে | অপর্ণা মৃদু হাসলো |

তীর্থ বেকসুর খালাস | এই ঘটনার সাথে তীর্থ কোনোভাবে জড়িত নয় সেটা প্রমাণিত হয় আদালতের কাছে | ঘটনার তদন্ত করে জানা যায় সত্যেন ঘটক আর তার ছেলে ও তার বন্ধুদের দোষী সাব্যস্ত করা হয় | সেদিন সন্ধেবেলা দীঘির পাড় থেকে মুখে বেঁধে তারা রেবাকে এনে চা বাগানের মধ্যেই ধর্ষণ করে মেরে ফেলতে যাচ্ছিলো পাথর দিয়ে কিন্তু সেই সময় তীর্থর সাইকেলের শব্দে রেবাকে আধমরা করে ফেলে রেখে পালায় | যখন তীর্থ সেখানে পৌছায় তখন রেবা তাকে জানায় এটা এম এল এ র ছেলের কান্ড | এরপর রাজ্য পুলিশের তরফ থেকে তদন্ড চালিয়ে জানা যায় তীর্থকে ফাঁসানোর জন্যেই এই প্ল্যান করে এ কাজ করেছিল এম এলে এ সত্যেন ঘটক আর তার ছেলে |

সুপ্রতীক অনেকভাবে মামলায় সাহায্য করেছিল | সাথে মৈনাক ও অনেক চেষ্টা করে তীর্থকে ন্যায় দেওয়ার জন্যে | মৈনাক নিজেকে এই মামলা থেকে সরিয়ে নিয়েছিল | তীর্থর সাথে নিজেই আলাপ করেছিল | মৈনাকের মনে হয় তীর্থর মতো সৎ ছেলেকে আজ রাজনীতির কাজে ভীষণ প্রয়োজন | তাই ওকে মুক্তি দেবার জন্যে পেছন থেকে মৈনাক ও অনেকভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছে | তাছাড়া তীর্থ ওর অপূর
বন্ধু |

এই খবরটা ইন্দ্রানীর থেকে অপর্ণা পেয়েছে | মৈনাকের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দুইই বেড়ে যায় অপর্ণার | বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের আসন্ন সন্তানের কথা ভেবে দুচোখ ভরে ওঠে অপর্ণার | যে আসছে সে যে তার আর মৈনাক এর ভালোবাসার ফসল |
❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

সমাপ্ত

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে পর্ব-০৪

0

#যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

পর্ব ৪

🖋️রিয়া সেন দত্ত 🖋️

—দুপুরে ইন্দ্রানী আর সুপ্রতীক বসু ভিলায় এসেছে | সেখানে কয়েকদিন থেকে আবার অপর্ণার সাথে দেখা করে আলিপুরদুয়ার ফিরে যাবে | সুপ্রতীককে যা করতে হবে, তা এর মধ্যেই করতে হবে | তীর্থ ছেলেটি সৎ, যতদূর সম্ভব নিরপরাধও | কাজেই এই লড়াই তে অপর্ণাকে সাহায্য সুপ্রতীককে করতেই হবে |

ওদিকে মৈনাক এর সাথে সুপ্রতীক এর দীর্ঘদিন পর দেখা | অপর্ণা আসবে না | এতো কাছে থেকেও সে আসতে চায় না | কিন্তু কেন? মৈনাক তো তাকে মেনে নিতে প্রস্তুত তাও কেন? এসবই বসে বসে ভাবছিলো মৈনাক | অপর্ণাকে সেদিন কোর্টে দেখার পর থেকেই মৈনাক একবার তার সাথে দেখা করতে চায় কিন্তু আজ আর সেটা সম্ভব না | ওরা একে অপরের প্রতিপক্ষ মামলাগত কারণে | তার ওপর অপর্ণার প্রতি স্বামী হিসেবে নিজের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা তাকে লজ্জিত করে | তাই আজ জামাইবাবুর থেকেই অপর্ণার যাবতীয় খোঁজ সে নেবে |

…..আজ অনেকদিন পর সারাদুপুর শালা – জামাইবাবুর আড্ডা চলবে | গত কয়েকবছরে এই চিত্রটা বাড়ির সবাই ভুলতে বসেছিল | এককালে সুপ্রতীক বাড়ি আসা মানেই মৈনাক এর পোয়া বারো | সারাদিন জামাইবাবুর সাথে বাড়ির পেছনে বাড়ির পুকুরে মাছ ধরা, গাড়ি নিয়ে কাছে পিঠে যাওয়া এসবই চলতো | মৈনাক নিজের যাবতীয় কথা সব বলতো সুপ্রতীককে | মল্লিকার সাথেও খুব ভালো সম্পর্ক ছিল সুপ্রতীকের |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

—সেরাতে যখন অপর্ণার সাথে মৈনাক ওভাবে ব্যবহার করলো তখন মনপ্রভা একটাই সমাধান পেয়েছিলো সুপ্রতীক | কিন্তু সুপ্রতীক আসবে শুনে মৈনাক নিজেকে কাজের মধ্যে এতটাই ব্যস্ত করে রাখলো যাতে জামাইবাবুর মুখোমুখি তাকে না হতে হয় | যতদিন বাড়িতে সুপ্রতীক ছিল মৈনাক রাতেও চেম্বারে থাকত | অপর্ণার বেহুঁশ জ্বরের সময় ও মৈনাক দেখতে যায়নি | জ্বর কমলে সুপ্রতীক অপর্ণার সাথে কথা বলে স্বাভাবিকভাবেই |

অপর্ণার মনে তখন সেই রাতের প্রভাব এতটাই পড়েছিল যে সে দিনদিন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিলো | মৈনাক তাকে ভালোবাসে না সে জানে, কিন্তু এতটা ঘৃণার পাত্র কেন সে তা একবার সুপ্রতীককে জিজ্ঞেস করলে সুপ্রতীক ও কোনও জবাব দিতে পারে না |

— ফিরে যাওয়ার দুদিন আগে বাধ্য হয়ে সুপ্রতীক নিজেই চেম্বারে গিয়ে মৈনাকের সাথে কথা বলে | মৈনাকের সাথে কাজ নিয়ে কথা বলতে বলতেই তার নতুন স্ত্রী এর সাথে কেমন সময় কাটছে জানতে চাইলে মৈনাক বিরক্তির সাথে উত্তর দেয় তাকেও | সুপ্রতীক শেষ অবধি শুধু বলে ”বিয়ে হয়ে গেছে এখন তো আর কিছুই করার নেই, তুমি নিজেই রাজি হয়েছিলে বিয়েতে বরং ওর মতামতটাই কেউ নেয়নি – মেয়েটি অসহায় ওর মা নেই বাবা দায়িত্বজ্ঞানহীন – ওর যদি কেউ থেকে থাকে তা কেবল তুমিই আছ, ওর ভরসা হয়ে দাঁড়াও, ও ভালো মেয়ে |”

মৈনাক জানিয়ে দেয় সুপ্রতীককে, তার পক্ষে মল্লিকার জায়গায় ওই মেয়েটিকে বসানো সম্ভব নয় | আর অপর্ণা মিথ্যে বলছে | যা হয়ে গেছে তার জন্যে তার মা দায়ী, সে নিজে নয় | এমন উত্তর শুনে সুপ্রতীক কোনও কিছু না বলে চলে যায় | সে বোঝে মৈনাক এখন সবরকম বোঝানোর উর্দ্ধে চলে গেছে |

এদিকে আরেক বিপত্তি বাধে ইন্দ্রানী সুপ্রতীকের ফিরে যাওয়ার দিন যত এগোয় অপর্ণা ততই ইন্দ্রানীকে আঁকড়ে ধরে | কিছুতেই ছাড়তে চায় না তাকে | সুপ্রতীক বাধ্য হয়ে একাই ফিরে যায় | মনপ্রভা অপর্ণার ব্যাপারে নিজেকেই দোষারোপ করে চলেন | সুপ্রতীক যাওয়ার পর মৈনাক ও মগ্ন হয়ে ভাবতে থাকে সে যা করেছে তা ঠিক না ভুল!

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

ওদিকে অপর্ণা আস্তে আস্তে শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেও মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে | ঐটুকু মেয়ে তার ওপর গ্রামের | এতো কিছু সে জানবে কি করে? ইন্দ্রানীর খুব রাগ হয় নিজের ভাই এর ওপর | তার থেকেও বেশি রাগ হয় নিজের মা এর ওপর | ছেলে ছেলে করেই মনপ্রভা ছোট থেকে একটু ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন | ছেলের দোষ ধরার সময় খানিক অন্ধ হয়ে যান |

–ইন্দ্রানী অপর্ণার আরো কাছের হওয়ার জন্যে মৈনাকের আর তার নিজের ছোটবেলার গল্প শোনাতে থাকে | কিন্তু অপর্ণা সে রাতের পর থেকে সবসময় চুপচাপ থাকে | মৈনাককে দূর থেকে দেখলে ভয়ে লুকিয়ে পড়ে | ব্যাপারটা মৈনাক ও লক্ষ্য করে | বাধ্য হয়ে ইন্দ্রানী তার মা এর সাথে আলোচনা করে অপর্ণাকে একজন মনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তিনি অপর্ণাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে বলেন | এই কাজটা মৈনাক করলে সবচেয়ে ভালো হত কিন্ত সে তো রাজিই হবে না | কাজেই বাধ্য হয় ইন্দ্রানী নিজের সাথে অপর্ণাকে আলিপুরদুয়ার নিয়ে যেতে | মনপ্রভা না করেননি এতে | অপর্ণা চলে যায় আলিপুরদুয়ার |

…..প্রকৃতির সানিধ্যে এসে অপর্ণা ধীরে ধীরে ঠিক হতে শুরু করে | সুপ্রতীক আর ইন্দ্রানীর কোনও সন্তান নেই | কিন্তু স্বামী-স্ত্রী র মধ্যে কি যে অগাধ ভালোবাসা সেটা অপর্ণা অনুভব করতো | দেখে খুব ভালো লাগতো | মৈনাকের কথা মনে পড়ে অপর্ণার | ওই রাগী মুখটার আড়ালে একটা অন্য মানুষকে যেন ও দেখতে পায় | কিন্তু এখানে আসার পর প্রায় একমাস হতে চললো তাও মৈনাক একবারও তার খোঁজ নেয়নি | অপর্ণার মনে একটা শূন্যতা তৈরী হয় | উদাস হয়ে দূরে চেয়ে থাকে | আগের থেকে কথা একটু আধটু বলে | সুপ্রতীক মাঝেমধ্যেই ছোট গিন্নী বলে নিজের কাজের গল্প শোনায় অপর্ণাকে | অপর্ণাও মন দিয়ে শোনে সেসব গল্প | তার ইচ্ছে হয় আবার পড়াশোনা করার |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

— ইন্দ্রানীর কাছ থেকে মল্লিকার ব্যাপারে জেনেছে অপর্ণা | মৈনাক মল্লিকাকে ভালোবেসে “মলি” ডাকতো | মলি চলে যাওয়ার পর থেকেই মৈনাকের এমন পাগল পাগল দশা | সে কাজের মধ্যেই বেঁচে আছে | চলমান যন্ত্রের মতো সে শুধু কাজ করে | কোনোদিকে খেয়াল রাখে না – কিন্তু মৈনাক ছিল হাসি খুশি মানুষ – এমনিতে কম কথা বললেও মিশুকে ভদ্র স্বভাবের ছেলে ছিল – ছোট থেকে ওকালতি করার বিশেষ ইচ্ছে না থাকলেও পরবর্তীকালে বাবার কথায় এই পেশার সাথে যুক্ত হয় | মৈনাক খুব ভালো আঁকত | মলি চলে যাবার পর সেসবের পাঠ চুকেছে |
স্টাডি রুমে মলির ছবিটা মৈনাকের নিজের হাতে আঁকা | ওটা মলিকে প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে মৈনাক দিয়েছিলো | দুজন যেন দুজনের জন্যেই তৈরী হয়েছিল | অগাধ ভালোবাসা ছিল একে অপরের প্রতি |

বিয়ের দুবছরের মাথায় গাড়ি দুর্ঘটনায় মল্লিকা মারা যায় | মৈনাক তখন কাজের জন্যে এলাহাবাদে | একটু একটু করে সবে পসার শুরু হয়েছে | হঠাৎ ঝড়ে ওর জীবনটা ওলোট পালট হয়ে যায় | নিজেকে একটা শক্ত আবরণে ঢেকে রেখে যাহোক করে বেঁচে আছে |
মল্লিকার সাথে মৈনাকের আলাপ হয় ওদেরই এক বন্ধুর বিয়েতে | তারপর প্রেম পর্ব | মল্লিকার বাবা প্রফেসর, মা ফ্যাশন ডিসাইনার | মল্লিকা নিজেও ছিল তার মা এর মতো ফ্যাশন ডিসাইনার | আধুনিকা, সুন্দরী, শিক্ষিতা, মার্জিত একেবারে বসু ভিলার আদর্শ বৌ | আর মৈনাকের চোখের মণি |

—কিন্তু যেদিন দুর্ঘটনাটা হয় সেদিন ওর কাজে যাওয়ার সময় ড্রাইভার ছুটিতে থাকায় বাড়ির গাড়ি না নিয়ে রাস্তা থেকে ট্যাক্সি ধরে বেড়িয়ে যায় | একটা বাসের সাথে ট্যাক্সিটার রেষারেষি করতে গিয়ে দুর্ঘটনাটা ঘটে | মৈনাক ফিরে এসে ওর মল্লিকার সাদা চাদরে ঢাকা শরীরটা দেখেছিল | মৈনাক একফোঁটা চোখের জল ফেলেনি সেদিন | পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দেখেছিলো ওর মলির শরীরটা পুড়ে যেতে | সেই যে চুপ করে গেল আর কথা বলতো না কারোর সাথে | একমুখ দাড়ি নিয়ে বসে থাকতো | জীবন থেকে বাঁচার ইচ্ছেটুকু চলে গেলো | সারাদিন শুধু কাজে ডুবে থাকলো | মদ ধরলো | চোখের সামনে ছেলের এরকম অবস্থা কোন মা মেনে নিতে পারে | মনপ্রভাও পারেনি | সব শুনে অপর্ণার চোখে জল চলে আসে |

ইন্দ্রানী অপর্ণাকে ওর পড়াশোনার ব্যাপারে জানতে চাইলে অপর্ণা সব খুলে বলে | সব শুনে ইন্দ্রানী অপর্ণাকে আবার পড়াশোনা শুরু করার কথা বলে | অপর্ণা নিজেই ইন্দ্রানী আর সুপ্রতীককে জানায় সে আইন নিয়ে পড়তে চায় | ভবিষ্যতে ওকালতি করার ভীষণ ইচ্ছে তার | শুনে ইন্দ্রানী আর সুপ্রতীক ভীষণ খুশি হয় | সুপ্রতীক বুঝতে পারে এই মেয়েই পারবে মৈনাক বসুকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে | অপর্ণা ইন্দ্রানীর বাড়িতে থেকেই আবার পড়াশোনা শুরু করে | তাকে যে পারতেই হবে | নিজের সম্মান আদায় করে নিতেই হবে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

মৈনাক ইন্দ্রানীর কাছ থেকে পরে খবর পেয়েছিলো অপর্ণা আইন নিয়ে পড়াশোনা করছে যদিও এবিষয়ে জানার তার খুব একটা আগ্রহ ছিল না | এরমধ্যে গ্রামে অপর্ণার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হলে চিঠি আসে বসু ভিলায় | চিঠিটা সেদিন বাড়ির কাজের লোক মৈনাকের হাতেই দেয় | বিয়ের পর একবারও মৈনাক সে মুখো হয়নি | কিন্তু এবার কৌতূহলবশত কিছু জানার জন্যে অদৃষ্টের টানেই একপ্রকার গ্রামে অপর্ণাদের বাড়ি যায় | সেখানে দেখে অপর্ণার বাবা মৃত্যুশয্যায় | মেয়ের বিষয়ে সব ঘটনা সেদিন মৈনাককে খুলে বলে | মৈনাক অবাক হয়ে যায় সেটা শুনে যে অপর্ণা সত্যি কিছুই জানত না | সম্পূর্ণ দোষ তার বাবার | যেমন তার নিজের মা এর ক্ষেত্রে |

এরপর অপর্ণার বাবার হাতে কিছু টাকা দিয়ে মৈনাক ফিরে আসে বসু ভিলায় | সারাদিন ভাবে যেদিন অপর্ণা তার দিদি ইন্দ্রানীর সাথে চলে যাচ্ছিলো | একবার শুধু তাকে বলতে এসেছিলো | চোখে একরাশ ভয় নিয়ে | সেদিন তার স্টাডি রুম এর বাইরে দাঁড়িয়ে বলেছিলো “আমার কেন দোষ নেই আমি সত্যিই কিছুই জানতাম না | ” মৈনাক সিগরেট খেতে খেতে শুধু আড়চোখে একবার দেখেছিলো কিছুই বলেনি |

… অপর্ণাকে নিয়ে যাওয়া নিয়ে মৈনাক কোনও মন্তব্যই সেদিন করেনি | মনে মনে চেয়েছিলো অপর্ণা বাড়ি থেকে, ওর চোখের সামনে থেকে চলে যাক | কিন্তু পরবর্তী সময় অপর্ণার বাবার কাছ থেকে সব জানার পর এক তীব্র অপরাধবোধে ভুগতে থাকে মৈনাক | একেই ওইটুকু মেয়ে বয়সে প্রায় কুড়ি বছরের ছোট তার চেয়ে এর ওপর এভাবে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে তার বাবা | মৈনাক নিজের ব্যবহার এর কথা মনে করে নিজেকেই ভৎসনা করে | মল্লিকার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা |

…. অপর্ণার ছবি নেই বিশেষ ওই বৌভাতের দিনের কয়েকটাই যা আছে – সেগুলো মন দিয়ে দেখে মৈনাক | এই প্রথম মৈনাক অপর্ণাকে মন দিয়ে দেখলো | নিষ্পাপ চোখ দুটো দেখে বড়ো মায়া হয় মৈনাকের | কিকরে পারলো সে এতো নিষ্ঠুর হতে?

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

এদিকে অপর্ণা কলেজে ভর্তি হবার পর থেকেই মন দিয়ে নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে | এরই মধ্যে তীর্থর সাথে অপর্ণার আলাপ হয় কলেজে | সেখান থেকেই বন্ধুত্ব | অপর্ণা নিজেকে সবসময় একটু গুটিয়ে রাখতো | সবার সাথে মেলামেশা করতে পারতো না | অপর্ণার কলেজের কেউই জানতো না সে বিবাহিতা | সুপ্রতীক – ইন্দ্রানী সবাইকেই জানিয়েছিল তাদের এক আত্মীয়র মেয়ে এখানে থেকে পড়াশোনা করে | ছোট জায়গা সবাই তাই জানতো |

কোচিং ক্লাসের নোটস সব কিছুতেই অপর্ণা তীর্থকে সাহায্য করতো | তীর্থ কলেজে যেত ঠিকই কিন্তু ইউনিয়ন রুমে কাটাতো বেশিক্ষন | মাঝে মধ্যে ক্লাসে আসতো | আগাগোড়াই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল | আসলে তীর্থ মানুষের জন্যে কিছুই করতে চাইতো | তীর্থর বাড়িতে শুধু মা আছে বাবা অন্য জায়গায় সংসার পেতে চলে গেছে | তার মা বাড়িতে খাবার হোম ডেলিভারি দেয় | তীর্থ মনে মনে অপর্ণাকে পছন্দ করে সেটা জানায় | প্রথমে অপর্ণা রাগ করে বেশ কয়েকদিন কথা বন্ধ করলেও পরে তীর্থ নিজের এসে ঠিক করে সব | অপর্ণা সব কথা জানায় তীর্থকে |

তীর্থ ভীষণ কষ্ট পেলেও অপর্ণাকে বুঝতে দেয় না শুধু বলে যদি কখনো কোনও সমস্যা হয় তার দরজা অপর্ণার জন্যে চিরকাল খোলা থাকবে | কিন্তু অপর্ণা নিজের প্রতিজ্ঞায় অবিচল | শুধু বাড়ি এসে ইন্দ্রানীকে তীর্থর ব্যাপারে জানালে, ইন্দ্রানী অপর্ণাকে বলে জীবনে এমন কোনও ভুল যেন না সে করে যাতে তার নিজের বিবেককে জবাবদিহি করতে হয় | ইন্দ্রানী বিষয়টি সুপ্রতীককে জানালে সে বলে অপর্ণার ওপর তার ভরসা আছে |

এদিকে ধীরে ধীরে সময় কাটলো | অপর্ণা আর তীর্থ ভীষণ ভালো বন্ধু হয়ে উঠলো একে অপরের | তীর্থর বাড়ি ও অপর্ণা গিয়েছিলো | যদিও ব্যাপারটা ইন্দ্রানীর সেদিন খুব একটা ভালো লাগেনি | এরপর থেকে ইন্দ্রানী অপর্ণাকে ছেলেটির সাথে খুব বেশি মেলামেশা করতে দিতে চাইতো না | যদি অপর্ণা কোনও ভুল করে বসে | বছর কাটতে লাগলো এক এক করে | তীর্থ আস্তে আস্তে দলের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো | ফাইনাল ইয়ারে অপর্ণা পরীক্ষায় বসলো ঠিকই কিন্তু তীর্থ দলের কাজের জন্যে বসতে পারে না | কলেজ ছাড়ার পর অপর্ণার সাথে তার যোগাযোগ ফোনেই হত | ধীরে ধীরে সেটাও কমলো | আসলে তীর্থ নিজে থেকেই সরে গেছিলো সেদিন কারণ সে জানত অপর্ণাকে ফিরে যেতে হবে মৈনাকের কাছে | তাই মনের ভালোবাসা মনে রেখে সে নিজের কাজ নিয়ে নতুন উদ্যোমে লেগে পড়লো |
অপর্ণার পরীক্ষা শেষ হয়ে রেজাল্ট বেরোলে খুব ভালো ফল করে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

সুপ্রতীকের কাছে থেকে হাতে কলমে সব শেখে অপর্ণা | সুপ্রতীকের সাথে প্রতিদিন কোর্টে গিয়ে বসে দেখত কোর্টের কাজ | এভাবে কয়েক বছর কেটে গেলে অপর্ণা কলকাতায় চলে আসে কিন্তু বসু ভিলায় ফেরে না | সে সুপ্রতীকের ফ্ল্যাটে থাকা শুরু কিরে সব ব্যবস্থা সুপ্রতীক করে | যদিও এ বিষয়ে ইন্দ্রানী নিমরাজি ছিল তাও অপর্ণার কথা ভেবে তার সিদ্ধান্তে সায় দেয় |

এরপর মৈনাকের কাছে অপর্ণার বাবার মৃত্যু সংবাদ আসে | সে আরেকবার সেই গ্রামে যায় | ফিরে আসার পর কাউকে এ সংবাদ সে জানায়নি এমনকি অপর্ণাকেও না | এতগুলো বছরে দিদি জামাইবাবু দু একদিনের জন্যে আসলে নিজেকে চেম্বারে বন্দী রাখত | অপর্ণা ওকালতি পড়ছে জেনে প্রথমে একটু অবাক হলেও বিশেষ গুরুত্ব দেয় না | কিন্তু অপর্ণার বাবার সাথে দেখা করার পর থেকে মৈনাকের অপর্ণা সম্পর্কে ধারণার খানিক বদল ওদের শেষ হতে যাওয়া সম্পর্ককে নতুন আলোর দিশা দেখাতে শুরু করে | অপর্ণা কলকাতায় তার ই জামাইবাবুর ফ্ল্যাটে থাকে | মৈনাকের ইচ্ছে করে একবার যাওয়ার | চরম দ্বন্দ্ব নিয়ে নিজের মনকে বোঝায় সে যা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য | তাই ওই মেয়েটিকে আইনত মুক্তি দেওয়াই হয়তো তার উচিত কাজ হবে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

(চলবে )

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে পর্ব-০৩

0

#যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

পর্ব ৩

🖋️রিয়া সেন দত্ত 🖋️

—- কোর্ট থেকে ফেরার পর দরজায় ননদ আর নন্দাই কে দেখে ভীষণ খুশি হলো অপর্ণা | কতদিন পর দেখা! সেই কবে আলিপুরদুয়ার থেকে অপর্ণা এসেছে | তারপর তো শুধু ফোনেই কথা হয় | এই মানুষ দুটোর গুরুত্ব অপর্ণার জীবনে অপরিসীম |

-ঘরে ঢুকেই অপর্ণাকে জড়িয়ে ধরে ইন্দ্রানী বললো “তু্ই পারবি, আমি জানতাম “,
অপর্ণা বললো “দিদি! আজ তুমি আর জামাইবাবু সাথে না থাকলে আমি কবেই হেরে যেতাম – তোমাদের এই অবদান কোনও দিনও ভোলার নয়…”
ইন্দ্রানী অপর্ণার গাল টিপে ধরে ঠাট্টার সুরে বললো “বাব্বা! মেয়ে একেবারে কত বড়ো হয়ে গেছে !”

সুপ্রতীক বেশ রসিক মানুষ, পেছনে দাঁড়িয়ে মজা করে বললো, “আমাকে এমনভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে দুই গিন্নী গল্প জুড়লো, বলি বসতেও কি বলবে না ছোট গিন্নী?”
অপর্ণা কপট রাগ দেখিয়ে বললো “এতদিন পর এসেছেন তাই বসতেই দেবো না ঠিক করেছি..”, অপর্ণার কথায় তিনজনেই হেসে উঠলো |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

সন্ধেবেলা চা নিয়ে সুপ্রতীক – ইন্দ্রানী বসে আছে বসার ঘরে, অপর্ণা গরম গরম পকোড়া ভেজে নিয়ে এসে বসলো, সুপ্রতীক বললো “তাহলে ছোট গিন্নী চা খেতে খেতেই আলোচনাটা হোক…”
অপর্ণা বললো “হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম, তীর্থর জামিনটা আদৌ হবে তো ? রেবা সোরেন এর মা বাবা কে সামনের তারিখে কোর্টে তোলা হবে…”

সুপ্রতীক বললো, “তোমার কি মনে হচ্ছে উকিল সাহেবা ?”, অপর্ণা বললো, “তীর্থ এমন করতে পারে না জামাইবাবু!…”
সুপ্রতীক অপর্ণার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো “তুমি আমার থেকে কি সাহায্য চাও?”,
অপর্ণা মৃদু হেসে বললো, “আমি জানি এ বিষয়ে আপনি ছাড়া আর কেউ আমাকে সাহায্য করতেই পারবে না, কলকাতা পুলিশ এর ক্রাইম ব্রাঞ্চ এ আপনার অনেক চেনাশোনা আছে” ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিলো অপর্ণা, সুপ্রতীকের বুঝতে অসুবিধা হলো না অপর্ণা কি বলতে চাইছে, |
অপর্ণা বললো “ফালাকাটা পুলিশ একটা মিথ্যে গল্প সাজিয়ে একজন নির্দোষকে দোষী প্রমাণিত করতে চাইছে- তার ওপর এ বিষয়ে ওখানকার এম এল এ সত্যেন ঘটকের মদত আছে, আমি একশো ভাগ নিশ্চিত, লোকটা যে দুনম্বরি সেটাতো বলাই বাহুল্য ,,,”,
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অপর্ণা বলতে থাকলো,
” জেলা আদালতে তীর্থর জামিন না মঞ্জুর হওয়ার খবরটা পেপারে দেখতে পেয়েই ভেবেছিলাম কিছু করতে হবে | ওর বয়স্কা মা ছাড়া আর কেউ নেই – ও কলেজ থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল, ওর মতো সৎ ছেলে এমনটা করতেই পারে না | “,

সুপ্রতীক অপর্ণাকে পরীক্ষা করার জন্যে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি তো অনেকদিন যোগাযোগ রাখনি তীর্থর সাথে তাহলে এই কবছরে যে ওর পরিবর্তন হয়নি, তা বুঝলে কিকরে? এমন অনেক সময়তেই হতে পারে যাকে দোষী ভাবছ না সে-ই হয়তো আসল দোষী |”

অপর্ণা আস্তে বলতে শুরু করলো,
এ বছর তীর্থর ভোটে টিকিট পাওয়ার কথা ছিল | দলের হয়ে খুব সক্রিয়ভাবে মানুষের জন্যে কাজ করছিল | গোটা আলিপুরদুয়ারে ওর নাম হতে শুরু করেছিল | মানুষের মধ্যে ওর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছিলো | চা বাগানের শ্রমিকদের বস্তিগুলোর উন্নতির জন্যে অনেক করেছে | ওখানকার আদিবাসীদের জন্যেও ও কাজ করছিলো | কিন্তু এসবই দলের ভেতরে অনেকের মনে জ্বালা ধরাচ্ছিলো | শত্রুর সংখ্যাও তলে তলে বাড়ছিলো | তাদের মধ্যে লোকাল এম এল এ সত্যেন ঘটক একজন, লোকটা রেশন কারচুপি থেকে শুরু করে বেআইনি কনস্ট্রাকশন সবই চালাতো | এগুলো তীর্থর নজরে আসলে ও দলের উপর মহলে বিষয়টা জানানোর চেষ্টা করে | দলের উপর মহলের নজর সত্যেন ঘটকের ওপর পড়ে | এতেই আরো বিপত্তি বাধে | দল থেকে এবারের নির্বাচনে সত্যেন ঘটককে সরিয়ে তীর্থকেই টিকিট দেওয়ার কথা ভাবা হয় | ব্যাস রাস্তার কাঁটা সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সত্যেন |

যেদিন ঘটনাটা ঘটে সেদিন দলের কাজ সেরে রাতের অন্ধকারে তীর্থ যখন লাল বস্তি চা বাগানের পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ফিরছিলো | হঠাৎ গোঙানীর শব্দ শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে | ওর টর্চটা চা বাগানের ওপর ফেলতেই দেখে একটি মেয়ে নগ্ন অবস্থায় পড়ে গোঙাচ্ছে পাশে রক্ত ভেসে যাচ্ছে | বোঝাই যাচ্ছে ধর্ষণ করা হয়েছে |
তীর্থ দৌড়ে গিয়ে মেয়েটার মাথাটা কোলে তুলে ধরতেই বুঝতে পারে মেয়েটি লাল বস্তির, তীর্থ জিজ্ঞেস করে, “রেবা তু্ই! কে করলো এমন?”, তখনো একটু প্রাণ রয়েছে, রেবা শুধু বলেছিলো “এম. এল. এ -র ব্যাটা ” |
মুহূর্তের মধ্যে কিছু লোকজন এসে টর্চ ফেলে দেখে তীর্থ রেবাকে নিয়ে বসে আছে ওভাবে | প্রথমে তীর্থ ভেবেছিলো গ্রামের লোকেরা হয়তো ভুল বুঝে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় পরে অবশ্য বুঝেছে এতে এম এল এ সত্যেন ঘটক এর হাত আছে | তীর্থ দলের ভেতরের গন্ডগোলের শিকার | দল থেকে ওকে বহিস্কার করা হয় | দল থেকে কোনওপ্রকার সাহায্য করা হবে না জানিয়ে দেওয়া হয় |
ওদিকে এম. এল. এ সত্যেন ঘটক কলকাতার স্বনামধন্য উকিল মৈনাক বসুকে এই কাজে নিযুক্ত করে, কারণ রেবার বাবা- মা এর পক্ষে সেটা করা কখনোই সম্ভব নয় | ওরা চা বাগানে খেটে খাওয়া শ্রমিক | সহজ সরল | যা বোঝায় তাই বোঝে | অভাবের সংসার |

“তীর্থ ভালো ছেলে, ও আর যাই করুক খুন বা এধরণের কাজ করতে পারে না, আমি কলেজ থেকে ওকে চিনি ” অপর্ণা জোর গলায় বলে |
সুপ্রতীক আর ইন্দ্রানী একে অপরকে একবার দেখলো |

সুপ্রতীক এতক্ষন খুব মন দিয়ে সব শুনছিলো তারপর বললো “সবই তো বুঝলাম কিন্তু নিম্ন আদালতে একবার জামিন না মঞ্জুর হলে উচ্চ আদালতে পাওয়াটা খুব চাপের, তবু দেখছি কি করতে পারি আমার ছোট গিন্নির জন্যে |”

ইন্দ্রানী বললো “তু্ই ছেলেটিকে কলেজ থেকে চিনিস? কই ফোনে আগে বলিসনি তো?” অপর্ণা বললো, “শুধু চিনি বললে ভুল হবে, কলেজে আমরা দুজন খুব ভালো বন্ধু ছিলাম, আর ফোনে অতো বলতে পারিনি ” বলে অপর্ণা থামলো |

অপর্ণাকে তীর্থ প্রেম নিবেদন করেছিল একসময় | তীর্থকে সে ভালো না বাসলেও তীর্থ ওকে ভালবেসেছিলো | অপর্ণার প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও তীর্থ নিজেদের বন্ধুত্বকে কখনোই অসম্মান করেনি |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

মৈনাক রাতে খেতে পর্যন্ত ওঠেনি | লোককে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে চেম্বারে |
“দিদি জামাইবাবু বাবু কলকাতায় এসেছে কিন্তু এখানে আসেনি | ওদের ফ্ল্যাটেই অপর্ণা আছে, তাহলে কি জামাইবাবু এ বিষয়ে অপর্ণাকে সাহায্য করতেই কলকাতায় এসেছেন!” এসব চিন্তা মৈনাকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে |

ওদিকে এম. এল. এ সত্যেন ঘটক তাকে এ কাজে নিযুক্ত করেছে ভিক্টিম এর হয়ে লড়ার জন্যে | কিন্তু সত্যেন এর ছেলেই ধর্ষণ আর খুন করেছে | ছেলেটা গুণধর বললেও কম বলা হবে | এসব কেস মৈনাকের কাছে জলভাত | সে জানে কি করে এসব কেসে মক্কেল কে বাঁচাতে হয় | পেশার জন্যে সে সব পারে | কিন্তু আজ বিবেকে বাঁধছে | তার লড়াইটা যে এবার তার নিজের বিবেকের সঙ্গে |

নিজেই মনকে প্রশ্ন করে অপর্ণাকে তো সে ভালোবাসে না তবে তাকে সামনে দেখে বুকের ভেতর কেন এমন হলো? এই তীর্থই কি সেই ছেলে যে অপর্ণাকে ভালোবাসতে চেয়েছিলো? ইন্দ্রানী কি এর কথাই বলেছিলো, তখন মনে হয়েছিল অপর্ণা যদি ছেলেটির সাথে প্রেম করেও তাকে ডিভোর্স দেয় সে শান্তি পাবে | কিন্তু অপর্ণা তা করেনি | তবে কি অপর্ণা তাকে ভালোবাসে?
মৈনাক জেনেছিলো পরে অপর্ণার কোনও দোষ ছিল না বিয়েতে তার মতামত টুকু নেয়নি তার বাবা, শুধু টাকার লোভে মা হারা মেয়েটাকে মৈনাকের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে | এতো বছর ধরে মেয়েটা শাস্তি পাচ্ছে তার থেকে |

প্রশ্নে নিজেকে জর্জরিত করে তুললো, আজ যখন ছেলেটার হয়ে লড়ছিলো মনে হচ্ছিলো একবার বলি “অপর্ণা তুমি আমার, তোমার ওপর সব অধিকার শুধু আমার |”
কিন্তু যে আঘাত সে দিয়েছে অপর্ণাকে, তার জন্যে কি কখনো অপর্ণা তাকে ভালোবাসবে?

মল্লিকাকে হারানোর যন্ত্রণাটা আজও আছে কিন্তু ওইটুকু মেয়েকে দূরে সরানোর ক্ষমতা বা সাহস কোনোটাই নেই মৈনাকের | অপর্ণা ওর স্ত্রী, এতগুলো বছর ধরে সে মৈনাকের যোগ্য হবার পরীক্ষা দিচ্ছে | সে একবার আসুক আর একবার আসুক |
মনে মনে বললো “কিন্তু তীর্থকে কি করবো, ওর জামিন করা যাবে না | ” মৈনাকের জেদ চেপে বসেছে | তীর্থকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বি ভাবতে শুরু করেছে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

সেদিন রাতে সুপ্রতীক আর ইন্দ্রানী অপর্ণার সাথে থেকে গিয়েছিলো | ফ্ল্যাটের একটা ঘরে স্বামী -স্ত্রী অন্য ঘরে অপর্ণা একা | ইন্দ্রানীর কোনও কারণে ঘুমিয়ে আসছিলো না | সে এপাশ ওপাশ করছে দেখে সুপ্রতীক জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে বলতো? সেই কখন থেকে এপাশ ওপাশ করছ | “, ইন্দ্রানী বললো ” আচ্ছা তীর্থ বলে ছেলেটি তো আমাদের ওখানকার,ওকে কি তুমি চেনো? “, সুপ্রতীক আলতো করে হেসে বললো, “আলাপ নেই তবে মুখ চিনি – ভয় পেয়ো না তুমি যা চিন্তা করছ সেটা অমূলক -ও মেয়ে খাঁটি সোনা ” ইন্দ্রানীর মনোভাব ধরা পড়ে যাওয়ায় একটু লজ্জিত হয়ে পড়লো সে |

পরদিন সকালে অপর্ণা যখন চা করছিলো ইন্দ্রানী ঘুম থেকে উঠে সোজা রান্না ঘরে এলো | ইন্দ্রানীকে দেখে অপর্ণা এক গাল হেসে বললো “সুপ্রভাত, জামাইবাবু কি উঠেছে?- তাহলে চা -টা দিয়ে আসি ” সাথে সাথে ইন্দ্রানী বললো “না এখনো ওঠেনি তু্ই আর আমি বরং বারান্দায় গিয়ে বসি ” আজ ছুটির দিন কোনও তাড়া নেই অপর্ণার | দুটো চেয়ার এনে বসলো দুজনে | এই ফ্ল্যাটটা সুপ্রতীকের | কলকাতায় কাজে এলে কয়েকদিনের জন্যে যাতে সবসময় শশুরবাড়ি উঠতে না হয় তাই বেশ কয়েক বছর আগে কিনে রেখেছে | এখন সেখানেই অপর্ণা থাকে |

ইন্দ্রানী চা খেতে খেতে অপর্ণাকে তীর্থর কেসটা নিয়ে এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে থাকে | তারপর হঠাৎ অপর্ণার হাত দুটো ধরে বলে , “অপু, একটা সত্যি কথা বলবি? তু্ই কি উত্তরবঙ্গে থাকার সময় এই ছেলেটির কথাই বলেছিলি? তু্ই বলেছিলি একজন তোকে ভালোবাসে – এ কি সেই ছেলেটা?” , অপর্ণা এতক্ষনে ইন্দ্রানীর এতো প্রশ্নের আসল কারণ বুঝলো, শুধু মুচকি হেসে বললো, “এই কেসটায় যেমন তীর্থকে নির্দোষ প্রমাণ করা আমার লক্ষ্য তেমনই এটা আমার জন্যে মৈনাক বসুর যোগ্য স্ত্রী হয়ে ওঠার লড়াই, যদিও আমি চাইলে এই পরীক্ষা নাও দিতে পারতাম, কিন্তু আমি তোমার ভাইকে ভালোবাসি দিদি, – সেই দিন থেকে বাসি যেদিন আমাকে উনি ঘৃণা করা শুরু করেছেন – আমি শুধুই ওনাকে ভালোবাসি, আমার এতো লড়াই ওনার জন্যে | তীর্থ আমার খুব ভালো বন্ধু | ” ইন্দ্রানীর চোখে জল চলে এসেছে, এতো ঘৃণার পরেও অপর্ণা যেন সত্যিই অপর্ণা | তার ধ্যান জ্ঞান শুধুই তার মনের পরমেশ্বরকে পাওয়া | অপর্ণা সত্যিই ভালোবাসে মৈনাককে | আজ অপর্ণার মতো লেখাপড়া জানা সুশিক্ষিতা মেয়ে শুধু ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে লড়ছে | ও চাইলে অনায়াসে অন্যকাউকে এতো বছরে ভালোবাসতে পারতো, কিন্তু বাসেনি | অন্য কোনও পুরুষকে সীমা লঙ্ঘন করতে দেয় নি | এ ভালোবাসার তল খুঁজে পাওয়া মুশকিল | মৈনাক এ ভালোবাসাকে আবার আঘাত করলে নিজেই বোকামি করবে | যে গেছে তাকে মনে রেখেই এগিয়ে যাওয়ার নাম জীবন | মল্লিকা মৈনাকের অতীত, অপর্ণাই বর্তমান |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

(চলবে )

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে পর্ব-০২

0

#যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

পর্ব ২

🖋️রিয়া সেন দত্ত 🖋️

বিয়ের পর প্রথম রাতেই অপর্ণা বুঝেছিলো এ বিয়ে একতরফা হয়েছে | শুভদৃষ্টির সময় মৈনাকের দিকে এক ঝলক দেখতেই সে বুঝতে পেরেছিল তার বাবা তাকে তার থেকে বয়সে অনেক বড় ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে…

…মা হারা মেয়েটা বুকে অনেক কষ্ট নিয়ে সেদিন বাপের বাড়ি ছেড়েছিলো | এই ছিল তার অদৃষ্টে…! পথে যাওয়ার সময় একবারের জন্যেও অপর্ণা – মৈনাক একে অপরকে দেখেনি |

মৈনাকের গাড়িটা যখন তাদের বাড়ির গেট পেরিয়ে ঢুকছে তখন অপর্ণার চোখ ক্ষনিকের জন্যে আটকে গেছিলো বাড়ির দিকে তাকিয়ে | এতো বড়ো বাড়ির বৌ সে..!
…অপর্ণা কল্পনাও করতে পারেনি | বাড়ির চারপাশে বিশাল বাগান, ফুলে সুসজ্জিত | তার মাঝখান দিয়েই পিচের রাস্তা চলে গেছে বাড়ির সামনে পর্যন্ত | একটা ঝুল বারান্দার নিচে গাড়িটা এসে দাঁড়ালো |

মৈনাক আগেই গাড়ি থেকে নেমে ভেতর ঢুকতে গেলে, রাস্তা আটকে গম্ভীরভাবে তার দিদি ইন্দ্রানী বললো , “আগে বরণ হোক তারপর ঢুকবি |” দিদির মুখের ওপর মৈনাক আর কিছু বলতে পারলো না |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

অপর্ণার বাবা সেই যে দুদিন বাড়ির বাইরে কাটালো তখনি খোঁজখবর নিয়ে মেয়ের বিয়ে পাকা করেই ফিরলো | বাড়ি এসে মেয়েকে পর্যন্ত বিয়ের কথা জানায়নি , পাছে মেয়ে পালিয়ে যায় | হবু স্বামীকে দেখা তো দুরস্ত বিয়ের ঠিক দুদিন আগে পাড়ার লোক মারফত অপর্ণা জানতে পারে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে |

আশ্চর্য হবার তখনো বাকি ছিল | যখন বিয়ের আসরে কানাঘুষো শুনলো যে তার স্বামী দোজবরে | অপর্ণা ভাবতেও পারেনি তার বাবা তার জন্যে এমন পাত্র আনবে….!

নমো নমো করে গ্রামের কয়েকজনকে ডেকে বিয়ে সারা হল | বরযাত্রী হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া কেউ ছিল না এই বিয়েতে | পঞ্চানন ঘাড় থেকে মেয়ে নামের বোঝা নামিয়ে বেজায় খুশি | দ্বিরাগমনেও আমন্ত্রণ জানালো না মেয়ে জামাই কে |

ওদিকে নেহাত মা-কে কথা দিয়েছিলো মৈনাক | নাহলে এ বিয়ে তার কাছে গলার ফাঁস ছাড়া আর কিছুই না |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

বসু ভিলায় আসার পর থেকেই অপর্ণা কেমন যেন আরষ্ঠ হয়ে গেছে | এতো বড়ো বাড়ির নিয়ম, আদপ-কায়দা সবইতো নতুন তার কাছে | সে গ্রামের সাধারণ ঘরের মেয়ে | এসবই অভিনব তার কাছে | শাশুড়িমা মনপ্রভা দেবী তাকে বরণ করে ঘরে তুলেছেন | শাশুড়িমা-র চেহারা ভেঙে গেলেও, অভিজাত্য বিদ্যমান | স্বামীর মৃত্যুর পর তিনিই সংসারের সর্বেসর্বা |
তিনিই ঘটক লাগিয়েছিলেন ছেলের বিয়ের জন্যে |

….আসলে প্রথম স্ত্রী মল্লিকা মারা যাবার পর মৈনাকের বাউন্ডুলে ভাব ঘোচাতেই বিয়ে দেবার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিলেন তিনি | তাই অপর্ণার মতো একটি গ্রাম্য সরল মেয়ের খোঁজ পেতেই আর দেরি করেননি |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

এরই মধ্যে বড়ো ননদ ইন্দ্রানী এসে বেশ কয়েকবার অপর্ণাকে দেখে গেছে | অপর্ণার যাতে কোনও অসুবিধা না হয় সেজন্যে দুজন কাজের লোককে অপর্ণার দেখাশোনা করতে বলে গেছে | প্রথম থেকেই সে অপর্ণাকে কাছের করে নিয়েছে |
অপর্ণাকে বলেছে “ভাই আমার থেকে ৬ বছরের ছোট আর তুমি ভাই এর থেকে প্রায় ২০ বছরের ছোট, তাই তুমি না বলে তু্ই বলতে পারি? আজ আমার মেয়ে থাকলে হয়তো তোমার বয়সী হত |” অপর্ণা একবার তার সদাহাস্যমুখী বড় ননদের মুখের দিকে দেখে মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলো |

বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই | বিশাল দলদালান বাড়ি | মৈনাকের ঠাকুরদা এবাড়ি তৈরী করেছিলেন | তাই বাড়িতে প্রচুর পুরোনোদিনের দামি আসবাব ভর্তি | এসব দেখে অপর্ণার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিলো |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

বসু ভিলায় সেদিন সাজো সাজো রব | দুপুরে ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠানে মৈনাক তখনো আসেনি | সকাল থেকে চেম্বারে মক্কেল সামলাতেই ব্যস্ত সে | অনেক ডাকাডাকির পর এসে যাহোক করে নিয়ম সেরে আবার নিজের কাজে বেরিয়ে গেছে | বাড়ির সকলে বারণ করা সত্ত্বেও, কাজের দোহাই দিয়ে বেরিয়ে গেলো | এসব থেকে পালতে পারলে যেন সে বাঁচে…স্বামীর এমন ব্যবহার অপর্ণাকে অবাক করেছে |

সন্ধ্যেবেলা কয়েকজন পারিবারিক বন্ধুদের ডেকে বধূবরণের যাবতীয় অনুষ্ঠান শেষ হলো | শাশুড়িমা নিজের গয়না দিয়ে অপর্ণাকে সাজিয়েছিলেন সেদিন | সাক্ষাৎ রাজরানীর মতো দেখাচ্ছিল অপর্ণাকে | তার বাবা যদিও এ অনুষ্ঠানে আসেনি | মৈনাক এসেছিল কিন্তু ফিরেও তাকায়নি অপর্ণার দিকে | মাঝে এসে একবার অতিথিদের সামনে নিয়মরক্ষার খাতিরে দর্শন দিয়েছে |

ফুলসজ্জার রাতে অপর্ণা মনে মনে এক অজানা ভয় নিয়ে
রয়েছে, ঠান্ডা ঘরে দাঁড়িয়েও সে ঘামছে | হঠাৎ দরজায় আওয়াজ হতে পেছন ঘুরে দেখলো মৈনাক এসেছে | সেই প্রথম অপর্ণা ভালো করে নিজের স্বামীকে দেখলো |
– লম্বা, ফর্সা, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা আর কাঁচা পাকা একটা মোটা গোঁফ যেন তার গম্ভীর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছে | অপর্ণার গোঁফটা দেখে মনে হলো কেউ মোটামুটি দুটো শুয়োপোকা ছেড়ে রেখেছে মুখের ওপর | ছেলেমানুষের মত মনে মনে হেসে ফেললো | অপর্ণার এরকম অযাচিত হাসিমুখ দেখে মৈনাক যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো
…”তুমি কি সবকিছু জেনে আমাকে বিয়ে করেছ?” মৈনাকের প্রশ্নে অপর্ণার ঘোর কাটলো | সে মাথা নেড়ে উত্তর দিলো,, “না মানে হ্যাঁ…”

…মৈনাক অপর্ণার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বিদ্রুপের সুরে বললো, ”তোমার বাবা তোমাকে টাকার বিনিময়ে বিয়ে দিয়েছে, কত টাকা জানো? পাঁচ লক্ষ টাকা ” অপর্ণা অবাক হয়ে তাকায়, “তুমি সত্যিই জানতে না, নাকি ইচ্ছে করে মিথ্যে বলছো,,,” মৈনাক আবার জিজ্ঞেস করে…

… অপর্ণা কি বলবে ভেবে পায় না | চুপ করে শুনতে থাকে মৈনাকের কথা | মৈনাক বলে চলে, “তোমাকে বিয়ে করার আমার কোনও ইচ্ছে ছিল না, শুধু মা এর কথা ভেবে বাধ্য হয়েছি এ বিয়ে করতে | আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে, আমার পক্ষে তোমাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব নয় |”

-অপর্ণার চোখে জল চলে এসেছে | বাবা তো এর চেয়ে হাত পা বেঁধে জলে ফেলে দিতে পারতো তাকে|

মৈনাক বললো “তোমার মতো একটা মেয়ে কিভাবে আমার যোগ্য হতে পারে সেটাই বুঝতে পারলাম না |”
অপর্ণা যেন অপমানে আরো জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছিলো |
মৈনাক তীব্র শ্লেষে বললো, “বিয়ে দেওয়ার নামে মা তো দেখছি ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিলো আমাকে ! মা এর ওপর আমার বিশ্বাস ছিল কিন্তু…!”

…যে রাতে প্রথম স্বামী তার স্ত্রীকে কাছের করে নেয় সেই রাতে স্বামীর কাছ থেকে তীব্র প্রত্যাখ্যান পেয়ে সদ্য বিবাহিতা অপর্ণা যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় | অবাক হয়ে দেখছে আর ভাবছে তার ভুলটা ঠিক কোথায়…!
…কথাগুলো বলে মৈনাক ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো দরজা খুলে | সারারাত চেম্বারেই কাটাবে সে |

ভোর হতেই বড়ো ননদ অপর্ণার ঘরের দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে গেলো | জানলার সামনে অপর্ণা দাঁড়িয়ে | অপর্ণার নিদ্রাহীন চোখ দুটো দূরের লাল সূর্যের দিকে | চোখের তলায় কালি বলছে বিনিদ্র রজনী কেটেছে, তবে অবহেলায় |
বড়ো ননদ ইন্দ্রানী কাছে যেতেই অপর্ণা দুহাতে তাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকলো | ইন্দ্রানী বুঝলো তার ভাই এর ব্যবহারের জন্যে অপর্ণা এভাবে কাঁদছে |
মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু বললো “আমার ভাইটা খুব কষ্ট পাচ্ছে ওকে ভুল বুঝিস না, ও এমন ছেলেই নয়, তু্ই কিছু মনে করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস | ”

বিয়ের পর থেকে মৈনাক যেন নিজেকে আরো বেশি কাজে ব্যস্ত রাখে | আগে কোর্ট থেকে ফিরে একবার হলেও মা এর সাথে দেখা করতো কিন্তু এখন সেটাও বন্ধ করেছে | মা এর ওপর তার অগাধ অভিমান | মা কি করে পারলো !
মেয়েটাই বা কি? টাকার গন্ধে গন্ধে বিয়ে করে নিলো! এসব মেয়েরা এমনই হয় |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

রাতে সবাই শুয়ে পড়লে মৈনাক খেতে আসে যাতে কারোর মুখোমুখি না হতে হয় | বিশেষ করে অপর্ণার | খাবার ঢাকা রাখা থাকে | নিজের মতো খেয়ে নেয় |

নিজের শোওয়ার ঘর লাগোয়া স্টাডি রুমে বিছানার ব্যবস্থা করে নিয়েছে মৈনাক | রাতে যখন সে খেতে বসে অপর্ণা লুকিয়ে জেগে থাকে | সে শাশুড়িমার কথা শুনে আগে খেয়ে নিলেও আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখে মৈনাকের খাওয়া | নিজের স্বামীকে সারাদিনে এই একবারই দেখতে পায় |

…লোকটা গম্ভীর, রাগী, বয়সে অনেক বড়ো তবু অপর্ণার ভালো লাগে | কিন্তু যখনই অপমানের কথা মনের পরে মনটা কষ্টে ভরে যায় | মৈনাক কি কখনোই অপর্ণার হবে না? আর তার লেখাপড়ারই বা কি হবে? মা যে কত বলতো লেখাপড়া করতে | মৈনাক কি কখনোই পড়াশোনা করতে দেবে না? এসব ভেবে তার মন আরো জট পাকিয়ে যায় |

এদিকে মনপ্রভা দেবী নিজেও বুঝতে পারছেন না তিনি ছেলের ভালোর জন্যে যা করলেন তা ঠিক না ভুল! মনের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক হয় “এ মেয়ে কি তার ওই এঁড়ে ছেলেকে বাগে আনতে পারবে?”

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

মৈনাক সে রাতে নিজের স্টাডি রুমে ঘুমোনোর সময় ঠান্ডায় কুঁকড়ে যাচ্ছে | অপর্ণা ঘুম না আসায় তখন ঘর লাগোয়া বারান্দায় যাচ্ছিলো | সেখান থেকে ঘুমন্ত মৈনাককে সে দেখতে পায় |
মৈনাককে ঠান্ডায় কুঁকড়ে যেতে দেখে ঘর থেকে তাড়াতাড়ি একটা চাদর এনে স্টাডি রুমে ঢোকে | সচরাচর এ ঘরে ঢোকা তার বারণ | মৈনাক বারণ করেছে |

ঘরের দেওয়ালে বড়ো করে একজন মহিলার ছবি আছে | মহিলা অপূর্ব সুন্দরী | অপর্ণার মনে হলো ইনিই হয়তো মৈনাক এর আগের স্ত্রী | নিজেই মনে মনে হেসে বললো কোথায় চাঁদ আর কোথায় চাঁদা মাছ!
এই ভেবে ইতস্তত করতে করতে মৈনাকের গায়ে চাদরটা দিতেই মৈনাক অপর্ণার হাতটা চেপে ধরে | ঘটনার আকস্মিকতায় অপর্ণা ভয় পেয়ে যায় |

হাতটা চেপে ধরে মৈনাক সন্দেহের চোখে জিজ্ঞেস করে “কি করছিলে এখানে? বলো কি করছিলে? – আমি তোমাকে আসতে বলেছি এ ঘরে?”, অপর্ণার হাতটা লাল হয়ে গেছে সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো সাথে সাথে চিৎকার করে বললো “চলে যাও ঘর থেকে, বেরিয়ে যাও আর কোনোদিনও এ ঘরে ঢুকবে না – তোমার মতো মেয়েরা টাকার লোভে শুধু সুযোগ খোঁজে কখন স্বামীকে হাত করবে, আমায় ওসব চেষ্টাও করো না, তুমি কোনোদিক থেকেই আমার যোগ্য নও, কথাটা মাথায় ঢুকছে? ”
মৈনাকের ওরকম ভয়ঙ্কর রূপ দেখে অপর্ণা হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে |
মৈনাক বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, তার জীবনে মল্লিকা ছাড়া আর অন্য কোন মেয়ে স্ত্রী হিসেবে থাকতেই পারে না ! তার মলি আজও হৃদয় জুড়ে রয়েছে |

এতক্ষনের চিৎকারে বাড়ির সকলে জেগে গেছে | বাড়ির কাজের লোকেরা পর্যন্ত চলে এসেছে | মনপ্রভা দেবী নিজেও হতবম্ভ হয়ে গেছেন | কি বলবেন ছেলেকে বুঝে পাচ্ছিলেন না |
চুপচাপ বাইরের ঘরে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন | এ কি করলেন তিনি! একটা এতোটুকু মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট করলেন তার নিজের ছেলের সুখের জন্যে!

ভোর হতেই মেয়ে ইন্দ্রানীকে ফোন করে সমস্ত ঘটনা জানালেন | দুদিন পর ইন্দ্রানী এলো সাথে ইন্দ্রানীর স্বামী সুপ্রতীক | বিয়েতে সুপ্রতীক আসতে পারেনি | সুপ্রতীক নিজেও উকিল | একমাত্র সুপ্রতীক এর কথা মৈনাক একটু – আধটু শোনে | সুপ্রতীক আসায় মনপ্রভা একটু আশ্বস্ত হলেন |

কিন্তু সেদিন রাতে ওই ঘটনার পর সকাল থেকেই অপর্ণা জ্বরে বেহুঁশ | ডাক্তার এসে দেখে ওষুধ দিয়ে গেছেন | কিন্তু জ্বর নামছে না |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

(চলবে )

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে পর্ব-০১

0

#যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

#পর্ব-এক

🖋রিয়া সেন দত্ত 🖋

কোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পর নিজেকে সম্পূর্ণভাবে চেম্বার এ বন্দী রেখেছে মৈনাক | গম্ভীর মুখে বসে আছে | এরকম গম্ভীর থাকলে তার সাথে কথা বলার ধৃষ্টতা কেউ দেখায় না | নিজের সমস্ত লোকদের সে জানিয়ে দিয়েছে, আজ আর কারোর সাথে সে দেখা করবে না | শরীরটা বড়ো ক্লান্ত |

মৈনাক বসু, কলকাতা হাইকোর্ট এর নামকরা ব্যারিস্টার | মৈনাকের বাবা এবং ঠাকুরদা দুজনেই উকিল ছিলেন কলকাতা হাইকোর্ট এ | কাজেই বংশপরম্পরায় ওকালতিটা মজ্জাগত মৈনাকের | চষা জমিতে পসার জমাতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি মৈনাকের | অল্প সময়েই বেশ নামডাক তার |

উত্তর কলকাতায় বাড়ির একতলায় চেম্বারটা মৈনাকের দাদুর আমলে তৈরী | দাদুও ওই একই কাঠের চেয়ারে বসে মক্কেলদের সমস্যার কথা শুনতেন | এখন মৈনাক শোনে | পরতে পরতে ঐতিহ্যর বার্তা দেয় চেম্বারটা | নিজের পেশা সম্পর্কে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী মৈনাক |

চেম্বারটা একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি বলা চলে | সেখানে একবার যখন সে ঢোকে তখন সে অন্য জগতের মানুষ | নিজের পেশা ছাড়া অন্য কিছু বোঝেনা | সেখানে সব ধরণের বই আছে | মৈনাক বই পড়তে ভালোবাসে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

চেম্বারে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসে চোখ বুজে আছে মৈনাক | আজ সে আদালতে অপর্ণার কাছে একপ্রকার পর্যদস্তু হয়েছে | তার এতো বছরের অধ্যাবসাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে ওইটুকু মেয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ও হারতে শেখেনি | স্পর্ধা তো কম নয় এ মেয়ের | গার্গী, অপালা, মৈত্রেয়ী এদের সম্পর্কে পড়েছে মৈনাক | বৈদিক যুগের বিদুষী নারী | যারা সব কিছুতে পারদর্শীনি ছিল |

এ দিন ইদ্রানীল চ্যাটার্জী এর এজলাসে অপর্ণাকে সেইরকম বিদুষী নারীদের মতোই মনে হয়েছিল মৈনাকের | অপর্ণার সাথে নিজের সহকারী বন্ধুর তর্কযুদ্ধটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলো মৈনাক | এরপর যখন সে নিজের মামলায় তর্ক শুরু করলো মনে হলো আদালত কক্ষে ঝড় চলছে |

এই প্রথম মৈনাক হারতে চায় কোন মামলা | কিন্তু নিজের পেশার সাথে এমনটা সে কখনো করেনি | মক্কেল যে দোষী তা সে নিজেও জানে | তবু পেশা তো পেশা-ই | মক্কেল কে বাঁচানোই তার লক্ষ্য | যদিও মৈনাকের মনে হচ্ছে এবারের যুদ্ধটা তার নিজের সাথে | কারণ অপর্ণা, মৈনাক বসুর দ্বিতীয় স্ত্রী |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

অপর্ণা নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে ক্লান্ত হয়ে বসে ভাবছে | এ মামলা নিছক আর পাঁচটা মামলা নয় তার কাছে | এটা যুদ্ধ, নিজেকে প্রমাণ করার যুদ্ধ | এ যুদ্ধ যোগ্য স্ত্রী হবার যুদ্ধ |

আজ প্রত্যেক ক্ষেত্রে মৈনাককে ও বুঝিয়ে দিতে পেরেছে ও কোনও দিক থেকেই মৈনাকের অযোগ্য নয় | তার প্রতি ভালোবাসার লেশমাত্র নেই মানুষটার মধ্যে |

অপর্ণার মনে কোথাও একটা দ্বন্ধ চলছে | এ মামলা যে নিছক মামলা নয় সেটা অপর্ণা সেদিনই বুঝেছিলো যেদিন কোর্টে ওর বিপরীতে মৈনাককে সামনাসামনি দেখেছিলো | সে নিজে এই পেশায় মৈনাকের চেয়ে নতুন হয়ে মৈনাকের মতো একজন উকিলকে টক্কর দেওয়ার কথা ভাবছে |

যেন মক্কেল এর হয়ে নয়, নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতে অপর্ণা আসরে নেমেছে | দীর্ঘ ন’বছর ধরে এ জ্বালা বুকে নিয়ে ঘুরছে অপর্ণা | সে সধবা না কুমারী নাকি স্বামীর পরিত্যক্তা তা সে নিজেও ঠাওর করতে পারে না | বুকের ভেতরটা জ্বলতে থাকে অপর্ণার | “কেন করলো বিয়ে? দয়া দেখাতে?স্বামীর কোনও দায়িত্ব পালন করেনি | বিয়ের রাত থেকে অবজ্ঞা ছাড়া এ পোড়া কপালে কিছুই জোটেনি |” স্ত্রী হবার খাতায় কলমে সামাজিক স্বীকৃতিটুকু ছাড়া আর কিছুই তো দেয়নি সে তাকে | কিন্তু অপর্ণা যে তাকেই…..

এমন সময় ঘরের দরজায় টোকা অপর্ণা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো তার বড়ো ননদ দাঁড়িয়ে | নন্দাই হাতে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে গলা বাগিয়ে বলছে “কি গো ছোট গিন্নী, শালা বাবু কে যে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লে, তা বুড়ো বয়সে বেচারার আবার সইবে তো এমন অত্যাচার ?” বলেই একগাল হাসলেন |

বড় ননদ আর নন্দাই অপর্ণার কাছে ভগবানের থেকে কম কিছু নয় | আজ অপর্ণা যা কিছু তার পেছনে এই দুটো মানুষের অবদান অনস্বীকার্য |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

“মেয়ের বয়স তো মাত্র আঠেরো এখনই বিয়ে দিয়ে দেবেন পঞ্চানন দা?” পাড়ার গৌড় মিত্তির বললো কথাটা | বিকেলে পুকুর পাড়ের আড্ডার ঠেকে তাস খেলতে খেলতে পঞ্চানন বললো “ইসসস দরদ দেখে আর বাঁচি না! মেয়ে আমার আমি বুঝবো | আমার পক্ষে ওই বুড়োধারীকে গলায় ঝুলিয়ে ঘোরা সম্ভব না, বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে দিয়ে দেবো ব্যাস ঝামেলা শেষ |” মুখ বেঁকিয়ে গৌড় বললো “সে তোমার মেয়ে, তাকে জলে ফেলবে না ডাঙায় রাখবে সে তোমার ব্যাপার তবু এক পাড়া, এক গাঁয়ে থাকি তাই বললাম আর কি |” অন্যরা সাথে সাথে বলে উঠলো “হ্যাঁ হ্যাঁ বিয়ের যুগ্গি মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখা ঠিক না পঞ্চানন | তুমি বিয়ের ব্যবস্থা করো |”

অপর্ণার মা বেশিদিন হয়নি মারা গেছে | এরই মধ্যে তার বাবা মদ ধরেছে | প্রতিদিন মদ গিলে আসে | অপর্ণা দুদিন বাড়িতে ঢুকতে দেয় নি | সেই রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেশ কয়েকদিন বাড়ি ফেরেনি পঞ্চানন | মেয়ের জন্যে পাত্র খুঁজে তবেই ফিরবে | কানা হোক, খোঁড়া হোক যা পাবে তার গলায় ওই মেয়েকে ঝুলিয়ে দেবে | মেয়েকে ঘাড় থেকে নামানোর ব্যবস্থা করে তবেই বাড়ি ফিরবে সে | ছোট থেকেই ছেলে না হওয়ার জন্যে পঞ্চানন তার বৌকে কম গালাগাল করেনি | মাঝে মধ্যে মারধরও করেছে |

অপর্ণা শুনেছিলো ওর জন্মের পর ওর ঠাকুমা ওর মুখও দেখতে চায়নি | প্রথম বাচ্চা মেয়ে হয়েছে শুনেই বিলাপ করতে শুরু করেছিল ঠাকুমা কপাল চাপড়ে | যদিও অপর্ণার পরে গৌরীর একটা ছেলে হয়েও বাঁচেনি | তাই অপর্ণা ছিল গৌরীর প্রাণ | ঠাকুমা যতদিন বেঁচে ছিল গৌরীকে তিষ্টতে দেয়নি ওই মেয়ের জন্যে | চেলা কাঠ দিয়ে পর্যন্ত মেরেছে গৌরীকে |

সারাদিন সংসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেও শাশুড়ি আর বরের থেকে গালমন্দ ছাড়া আর কিছুই জুটতো না গৌরীর | শাশুড়ি মারা যাবার পর গৌরী তবু প্রতিবাদ করতো | এসব দেখতে দেখতেই অপর্ণা বড়ো হচ্ছিলো | তার বাবা যে তাকে সহ্য করতে পারত না সেটা সে জানতো | আর পাঁচজন বাবার মতো তার বাবা ছিল না | তাই বাবার কাছে ছোট থেকেই সে খুব একটা ঘেঁষতও না | মা -ই ছিল তার জগৎ | মা এর কষ্ট অপর্ণার বুকে বাজতো | তার জীবনের সব কথা শোনার সঙ্গী ছিল তার মা | অপর্ণা ছোটবেলায় মা কে বলতো “আমি যখন বড়ো হবো, তখন তোমায় কোনও কষ্ট করতে দেবো না |” মা আদর করে বলতো “পড়াশোনা কর, আমার মতো হোস না | ”

অপর্ণার মা চলে যাবার পর থেকেই বাপের এমন রূপ দেখে অপর্ণার খারাপ লাগে | নিজের বাবা অথচ শত্রুর ও অধম | কিন্তু কিছুই করতে পারে না | আগে সংসার ভালো মতই চলতো | বাবা অন্যর ক্ষেতে কাজ করতো | আর মা সেলাই করতো |

অপর্ণার গায়ের রঙটা চাপা | সেই নিয়ে গাঁ-এর সবাই একটু নাক উঁচু করলেও অপর্ণার মা কখনো এ বিষয়ে ভাবতেন না | কারণ তিনি জানতেন তার মেয়ের গায়ের রং কালো হলে কি হবে পড়াশোনায় সে ভালো | গৌরী নিজে পড়াশোনা করতে পারেনি | তাই খুব ইচ্ছে ছিল মেয়ে যেন লেখাপড়া করে বড়ো হয়, ভালো মানুষ হয় | সেবারে মাধ্যমিকে সে গাঁয়ের সবচেয়ে ভালো ফল
করেছিল | তাই স্কুল থেকেই অপর্ণার উচ্চ মাধ্যমিকের জন্যে সবরকমের সাহায্য করতো | স্কুলে সে মেধাবী ছাত্রী হিসেবেই পরিচিত ছিল | কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষার আগেই অপর্ণার মা কয়েকদিনের অজানা জ্বরে চলে গেলো | তবু মেয়েটা ভালো ফল করেছিল | মা এর সব স্বপ্নপূরণ করতে চায় সে | কিন্তু তার ভাগ্য কি সঙ্গ দেবে?
সে নিজেও জানে তার বাবা তাকে এবার বিদেয় করবে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

(চলবে )