“হ্যাঁ তা তো জানি।তবে এখন তো সামলানো শিখতে হবে।আমার মতো তোরও তো কয়দিন পরে বিয়ে হয়ে যাবে।”
“বিয়ে হলে ঠিকই শাড়ি সামলাতে পারবো।তোর ওতো ভাবতে হবে নাহ্!”
ঈশার কথায় সবাই হেসে দিলো।কিছুক্ষণ পরে কাজি আসলেন।শশির বিয়ে হয়ে গেলো।ঈশা আর শশি একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেছে।বেস্টফ্রেন্ড বলে কথা!
আরহান পাশে দাঁড়িয়ে সবটা দেখতেছে।তবে তার এইসব কান্নাকাটি বিরক্ত লাগে।তাই সে খানিকটা দূরে সরে আসলো।
শশিকে নিয়ে চলে গেলো।ঈশা একটা চেয়ারে বসে নখ কামড়াচ্ছে।
“আমি এখন কিভাবে বাসায় যাবো!দুই গাধী তো চলে গেলো হোস্টেল বন্ধ হয়ে যাবে বলে।কিন্তু আমাকে তো ওই শিশুর বাচ্চা যেতে দিলো না।নিজে তো বিয়ে করে চলে গেছে।আর আমাকে একটা ঝামেলায় ফেলে দিয়ে গেছে।”
ঈশা মাথা তুলে উপরে তাকালো।আয়েশা বেগমকে চিনতে ঈশার সমস্যা হলো নাহ্।কারণ আয়েশা বেগম মির্জা সাহেবের সাথে তাদের বাসায় গিয়েছিলো।ঈশা হাসি দিয়ে আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“সেই ছোট্ট মেয়েটা এতো বড় হয়ে গিয়েছে!তা মা তুমি এমন একা একা বসে আছো যে?”
“আসলে আন্টি কালকে পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম। তার জন্য আমি ঠিকভাবে হাঁটতে পারছি না।আর আব্বু-আম্মু কেউ আসেনি তো তার জন্য যাবো কিভাবে সেটা ভাবছি!”
“তা তোমার আব্বু আম্মু আসেনি কেন?”
“আব্বু আমাকে এখানে দিয়ে কুমিল্লায় গিয়েছে একটু কাজে। আর আম্মুর শরীরটা ঠিক ভালো নেই।”
“আচ্ছা এক কাজ করো তুমি আমাদের সাথে চলবো।আমি আরহান আর আরিশাকে ডেকে আনতেছি।”
আয়েশা বেগম কথাটা বলে চলে গেলেন।ঈশা চুপচাপ তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।আয়েশা বেগম একটু পরে আরহান আর আরিশাকে ডেকে আনলেন।আলভি আরিশার কোলে ছিলো।ঈশাকে দেখে আলভি আরিশার কোল থেকে নেমে ঈশার কাছে দৌড়ে আসলো।
“আন্টি কেমন আছো তুমি?”
ঈশা আলভির হাত ধরে বললো,
“এই তো আমি ভালো আছি।তুমি কেমন আছো বাচ্চু?”
“আমিও অনেক ভালো আছি।”
আয়েশা বেগম অবাক হয়ে বললেন,
“ঈশা তুমি আলভিকে চিনো?”
আরহান ঈশাকে কিছু বলতে না দিয়ে বললো,
“আম্মু আমি বলতেছি।উনি যা বকবক করতে পারেন।উনি যদি বলা শুরু করেন তাহলে আজকে আর বাসায় যাওয়া লাগবে নাহ্।”
“আচ্ছা আন্টি মি.অভদ্র না মানে আরহান সাহেরের ওয়াইফ কোথায়?”
আয়েশা বেগম হাসি দিয়ে বললেন,
“ওর তো বিয়েই হয়নি।বউ আসবে কোথা থেকে!”
“তাহলে আলভি?”
“আলভি হলো…..”
আরহান আয়েশা বেগমকে থামিয়ে বললো,
“আলভি আমার ছেলে।এটাই ওর একমাত্র পরিচয়।আর একজন বাইরের মানুষকে এতো কিছু জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই আম্মু।”
আরহানের কথায় ঈশার মুখটা মলিন হয়ে গেলো।সে আর কোনো কথা না বলে চুপ করে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো।
আয়েশা বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“আরহান কথাবার্তা ঠিকভাবে বলো।ইদানীং তুমি মানুষকে অনেক কষ্ট দিয়ে কথা বলতেছো।আর ঈশা মা তুমি কিছু মনে করো নাহ্।”
ঈশা হাসি দিয়ে বললো,
“ইট’স ওকে আন্টি।উনি তো ঠিকই বলেছেন।আসলেই তো আমি বাইরের মানুষ।”
আরহান ঈশার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।তার বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো।আয়েশা বেগম আর আরিশা নেমে গেলো।
“আরিশা’ আলভিকে আমার রুমের বিছানায় শুইয়ে দিস।”
“ওকে ভাইয়া।”
আরহান আবার গাড়ি চালানো শুরু করলো।দুজনের মধ্যে নিরবতা।সারা রাস্তায় কেউ কোনো কথা বলেনি।আরহান ঈশাদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো।ঈশা গাড়ি দিয়ে নামতে গেলে আরহান বললো,
“স্টপ।”
আরহান তারপরে গাড়ি থেকে নেমে যেই ঈশার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামাতে যাবে সেই ঈশা হাত সরিয়ে ফেললো।
“বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।আপনার আর কষ্ট করতে হবে নাহ্।”
ঈশা গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে গিয়ে পড়ে যেতে গেলে আরহান ধরে ফেললো।আরহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে।আরহান ঈশাকে কোলে তুলে নিলো।ঈশা অবাক হয়ে বললো,
“কি করছেন আপনি?”
আরহান কিছু না বলে হাঁটা শুরু করলো।সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আরহান বললো,
“হাঁটতে পারেন না আবার ভাবের শেষ নেই।”
“আমি ঠিকই চলে যেতে পারতাম।”
“হয়েছে এতো কথা বলা লাগবে নাহ্।”
আরহান ঈশাকে নিয়ে তাদের বাড়ির দরজার সামনে কোল থেকে নামিয়ে দিলো।
“আই এম সরি।তখন ওভাবে বলা ঠিক হয়নি।”
“বাহ্ মি.অভদ্র আবার সরিও বলতে পারে!”
আরহান আর কিছু বললো নাহ্।ঈশা কলিংবেল বাজাতে গেলে শাড়ির আঁচলে টান খেলো।সে ভেবেছে আরহান তার শাড়ির আঁচল টেনে ধরেছে।ঈশা চোখ রাঙিয়ে পিছনে ফিরে ঠাস করে আরহানের গালে একটা চড় মারলো।আরহান গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।ঈশা ভালো করে তাকিয়ে দেখলো তার শাড়ির আঁচল সিঁড়ির গ্রিলের সাথে আটকে গেছে।যা দেখে ঈশা জিহ্বায় কামড় দিলো।তারপরে আরহানের দিকে তাকিয়ে দেখলো আরহান চোখ লাল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
আরহানের রাগে মাথা ঠিক নেই।সে ঈশাকে কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেলো।
ঈশা ভয়ে ভয়ে বললো,
“হায়রে!আমার কপালে শনি আছে।এরপরে দেখা হলে আমাকে আস্ত গিলে খাবে।”
“আপনি কি আমার সামনে বসে আছেন নাকি যে আপনাকে চিনতে পারবো?”
মেয়েটা হালকা হেসে বললো,
“তুই এক রকমই রয়ে গেলি।”
“সকাল সকাল এতো কথা না বলে আসল কথা বলেন আপনি কে?”
“আমি মিষ্টি।”
আরহান কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলো।তার মুখে অজান্তেই হাসি ফুটলো।তারপরে সে বললো,
“মিষ্টি কেমন আছিস তুই?তোর হাসব্যান্ড কেমন আছে?”
“আমরা ভালোই আছি।তবে জানিস আমি এখনো কিন্তু তোকেই ভালোবাসি।”
মিষ্টির কথা শুনে আরহানের হাসি মিলিয়ে গেলো।
“মিষ্টি তুই বিবাহিত।আগে যা বলতি সেগুলো মানা যেতো কিন্তু এইসব মানা যায় নাহ্।”
“আই এম সিরিয়াস আরহান।আমি আগেও সিরিয়াস ছিলাম।এখনি আমি সিরিয়াসই।খালি তুই বুঝলি নাহ্।”
“আমি বুঝতেও চাই না।ফোন রাখ।এইসব বাজে কথা বলতে আমাকে কখনো কল করবি।”
কথাটা বলে আরহান কলটা কেটে দিলো।তারপরে মোবাইলটা সুইচ অফ করে রেখে দিলো।রাগে তার মুখ লাল হয়ে গেছো।
“এই মেয়ে কখনোই ঠিক হবে নাহ্।”
//🌼//
“এই ঈশা ঘুম থেকে উঠ!”
ঈশা চোখ টিপটিপ করে তাকালো।তারপরে মুখ গোমড়া করে বললো,
“আপু এতো সকালে ডাকছো কেনো?”
“আজকে যে শশির গায়ে হলুদ ভুলে গেলি নাকি!আবার রাতে তো বিয়েও আছে।তোকে কত বার কল করতেছে।”
ঈশা এক লাফে উঠে বসে বললো,
“আরে আমি তো ভুলেই গেছিলাম আম্মু।তবে এই খোঁড়া পা নিয়ে আমি কিভাবে যাবো?আর তোমরা যাবে না?”
“তোর বাবা গিয়ে তোকে দিয়ে আসবে।তারপরে উনার আবার কুমিল্লা যেতে হবে কি কাজে জানি!আর আমার শরীরটা ভালো না।তাই যাবো নাহ্।আর তুই আসার সময় না হয় তোর বান্ধবীদের বলিস একটু পৌঁছে দিতে।”
“ওকে আম্মু।”
ঈশা আস্তে আস্তে হেঁটে ওয়াশরুমে চলে গেলো।ওয়াশরুন থেকে বের হয়ে একটা হলুদ লেহেঙ্গা পড়লো।চুলগুলো খোলা,চোখে কাজল,ঠোঁটে লিপস্টিক আর হালকা মেকআপ।সাজা শেষ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে ঈশা।
“হায় মে কিতনি সুন্দার হু!”
কথাটা বলেই ঈশা ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকলো।তারপরে বিয়েতে পড়ার জন্য শাড়ি প্যাকিং করে নিলো।তৈয়ব সাহেব ঈশাকে নিয়ে বের হলো শশিেদর বাড়ির উদ্দেশ্যে।
||🌼||
আরহান নিজে ব্রেকফাস্ট করছে আর আলভিকে খাইয়ে দিচ্ছে।আয়েশা বেগম এসে আরহানের পাশের চেয়ারে বসলো।
“আম্মু তুমি নাস্তা করেছো?”
“না রে বাবা এখন করবো।আজকে আমার বান্ধবীর মেয়ের বিয়ে।আমাদের সবাইকে দাওয়াত করেছে।”
“তোমরা চলে যাও।জানোই তো আমি এইসবে যাই না।”
“একদিনই তো বাবা চল না!মিতা অনেক বার বলেছে তোর যাওয়ার কথা।”
আরহান কি যেন ভেবো বললো,
“কখন যাবে তোমরা?”
“সকালে গায়ে হলুদ।আমরা ভেবেছি সন্ধ্যায় একেবারে বিয়েতে যাবো।আরিশা তো পরীক্ষা দিতে গিয়েছে।”
“আচ্ছা তুমি রেডি হয়ে থেকো।আমি অফিস থেকে এসে নিয়ে যাবো।”
আরহান ব্রেকফাস্ট করা শেষ করে আলভির গালে একটা চুমু দিয়ে অফিসে চলে গেলো।
আরহান অফিসে গিয়ে দেখলো হিয়া তার কেবিনে বসে আছে।আরহান হিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“হাউ ডেয়ার ইউ?আপনি আমার কেবিনে ঢুকার সাহস পেলেন কিভাবে?কেবিনে কেনো আপনি এই অফিসে আসার সাহস পেলেন কিভাবে?”
“ইউ নো আরহান আমার সাহস একটু বেশি বুঝলে।আর আমি তোমার বাড়িতে গিয়ে কিছু বলিনি কারণ সেখানে আলভি ছিলো।কিন্তু এখানে আলভি নেই।সো তোমার সাথে আমি গলাবাজি করতেই পারি।”
আরহান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“আপনি কি সিনক্রিয়েট করতে আসছেন?”
“আরে নাহ্।জাস্ট তোমাকে এটা বলতে এসেছি যে হিয়া চৌধুরীর সাথে একটু বুঝে শুনে কথা বলবে।নাহলে এর পরিণাম কিন্তু ভালো হবে নাহ্।”
আরহান মৃদু হেসে বললো,
“আপনার এইসব ব্রেইনলেস কথা কথাবার্তা শুনে আমিও মোটেও ভয় পাই নাহ্।তবে প্রচুর হাসি পায়।”
হিয়া রাগে ফুসতে ফুসতে বললো,
“আরহান আমার সাথে অ্যাটিটিউড দেখানো বন্ধ করো।”
“তাহলে আপনিও আমার চোখের সামনে আসা বন্ধ করুন।”
হিয়া আর কিছু নাহ্ বলে আরহানের কেবিন থেকে বের হয়ে চলে গেলো।আরহান টেবিলে রাখা পানি গ্লাস থেকে পানি খেলো।তারপরে চেয়ারে বসে অফিসের কাজ মন দিলো।
“শিশু আমাকে বিয়ের পরে যদি ভুলে যাস তাহলে তোর খবর আছে!”
“বইন এখন যা ইচ্ছা ডাক।আমার জামাইয়ের সামনে এভাবে শিশু ডাকিস নাহ্।মানসম্মান থাকবে নাহ্।”
“একশো বার ডাকবো!কেনো রে তোর জামাই কি গুন্ডা নাকি যে তার সামনে এইসব ডাকা যাবে নাহ্।”
“গুন্ডা হবে কেনো আমার জামাই তো ডাক্তার।তবে এইসব ডাকলে আমার প্রেস্টিজ শেষ হয়ে যাবে।”
পাশে থেকে রুমকি বললো,
“ইশ্!নিজেট বরকে আবার কেউ এতো লজ্জা পায় নাকি?”
শশি মুখ গোমড়া করে বললো,
“সবাই কি তোর মতো নাকি?”
“আমি আবার কি করলাম?”
এই যে একের পর এক বয়ফ্রেন্ড চেঞ্জ করিস।”
শশির কথায় সবাই হেসে দিলো।শশি আর রুমকির মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে গেলো।
ঈশা চিৎকার করে বললো,
“চুপপপপপপপ…….”
ঈশার চিৎকারে সবাই চুপ হয়ে গেলো।ঈশা তারপরে বললো,
“এখন কি ঝগড়া করার সময়!এখন হলো এনজয় করার সময়।So let’s start!”
নিহা বললো,
“কি আর শুরু করবো!তুই তো নাচতেই পারবি নাহ্।”
“আসলেই এটাই কষ্ট।আচ্ছা সমস্যা নাই।তোরা নাচ আমি বসে বসে দেখি।”
–
–
–
সন্ধ্যাবেলা,
আরহান বাসায় এসে দেখে সবাই রেডি হয়ে বসে আছে।আরহান তার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটা ব্লাক শার্ট আর ব্লাক জিন্স পড়ে রেডি হলে নিচে নামলো।আরহানকে এই কাপড়ে দেখে আরিশা বললো,
“ভাইয়া আজকে অন্তত একটা পাঞ্জাবি পড়তি।”
“তুই ভালো করেই জানিস আমি ওইসব লাইক করি না।সো বেশি কথা বলবি নাহ্।”
আরহানের কথা শুনে আরিশা মুখ ভেঙচি দিলো।আয়েশা বেগম আরিশাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আরে ওই ছেলেকে বলে লাভ নেই।ও কথা শোনার পাত্র নাহ্।”
আরহান মুচকি হেসে বললো,
“হ্যাঁ আম্মু তুমি একমাত্র ঠিক বুঝেছো।আচ্ছা এখন চলো সবাই।”
আরহান আলভিকে কোলে নিয়ে গাড়িতে উঠলো।তারপরে শশিদের বাড়িতে গেলো।আলভি আরিশার সাথে শশিদের কাছে গেলো।আয়েশা বেগম মিতা বেগমের সাথে গল্পে বসেছেন।আর এদিকে আরহান একা।আরহান এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে।হঠাৎ করে আরহান একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা খেলো।মেয়েটা পড়ে যেতে গেলে আরহান ধরে ফেললো।মেয়েটাকে দেখে আরহান হা হয়ে তাকিয়ে আছে।কারণ এটা ঈশা।ঈশারও এক অবস্থা।সেও অবাক হয়ে আরহানের দিকে তাকিয়ে আছে।আরহান ঈশাকে দাঁড়া করিয়ে বললো,
“আমি বুঝি না।আমি যেখানে যাই আপনি সেখানে এসে কিভাবে হাজির হোন!”
“আমারও তো একই প্রশ্ন!আমাদের দুজনের কেনো এভাবে দেখা হয়ে যায়।আর শুনেন আমি এখানেই থাকবো।কারণ বিয়েটা আমার বেস্টফ্রেন্ডের।আপনি এখানে কি করছেন মশাই?”
“আমার মায়ের বান্ধবীর মেয়ের বিয়ে।অনেক দূরের সম্পর্ক।আর শুনেন আমি যদি জানতাম আপনি এখানে আছেন আমি জীবনেও আসতাম নাহ্।এমন একটা বাচাল মেয়ের সাথে দেখা হওয়ার আমার একদমই ইচ্ছা নেই।”
আরহান কথাটা বলে চলে যাচ্ছিলো।ঈশা পিছন দিয়ে বললো,
“আমি যদি বাচাল হই আপনি তাহলে মি.অভদ্র।
ঈশার কথায় আরহান পিছনে ফিরে তাকালো।তারপরে ঈশার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমি কি অভদ্রতা করেছি?”
“সেটা আমি আপনাকে বলতে বাধ্য নই।”
ঈশা কথাটা বলে চলে যেতে গিয়ে শাড়ি প্যাঁচিয়ে নিচে পড়ে গেলো।ঈশা কিছুটা উচ্চস্বরে বললো,
“একদিকে পা তো খোঁড়া হয়েছে।আরেক দিকে কোমরটাও গেলো!”
ঈশার অবস্থা দেখো আরহান জোরে হেসে দিলো।আরহানের হাসির দিকে ঈশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।ঈশা মুখ গোমড়া করে বললো,
“একটা মানুষ পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে আর আপনি হাসছেন!”
আরহান হাসি থামিয়ে ঈশার হাত ধরে উঠালো।তারপরে বললো,
“পড়ে যাওয়া মনে হয় আপনার হবি!”
“আপনাকে কে বলেছে এই কথা?আমি শাড়ি সামলাতে পারি না।তাই পড়ে যেতে যাচ্ছিলাম।”
“আমার তো মনে হয় না আপনি কালকে শাড়ি পড়ে ছিলেন!”
“কালকে তো শাড়ি পড়িনি।তবে কালকে তো আমার পায়ের উপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে গেছিলো।”
“হয়েছে এখন এতো কথা বাদ দিয়ে আপনার বান্ধবীর কাছে যান।একটু পরেই তো বিয়ে।”
“ভাবি আসেনি?”
আরহান কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো,
“ভাবিকে দিয়ে আপনি কি করবেন?”
“একটু পরিচিত হতাম।”
“আপনার পরিচিত হওয়ার দরকার নেই।”
আরহান কথাটা বলে হেঁটে চলে গেলো।ঈশা ভ্রু কুচকে বললো,
“এতোক্ষণ মুড তো ঠিক ছিলো।যেই ভাবির কথা জিজ্ঞেস করলাম হনহন করে ভাব দেখিয়ে চলে গেলো।”
“আমি যদি কোলে তুলে নেওয়ার ইচ্ছা স্থাপন করি তখন আর আপনার মত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করবো নাহ্।আমার এমন আটার বস্তাকে চৌদ্দবার কোলে নেওয়ার শখ নেই।”
ঈশার রাগে মুখ লাল হয়ে গেছে।ঈশা দাঁত চেপে বললো,
“আমি মোটও আটার বস্তা নাহ্।আমার ওজন মাত্র পঞ্চাশ কেজি।হাফ সেঞ্চুরি করেছি।আর আপনি বলেন আমি আটার বস্তা!”
“দেখুন এতো কথা বাদ দিয়ে হাতটা ধরুন আর হাঁটা শুরু করুন।আমার আরো কাজ আছে।”
ঈশা বিড়বিড় করতে করতে আরহানের হাতটা ধরলো।সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ঈশা বললো,
“আচ্ছা আপনি কি হাসতে জানেন না?”
“আমি অকারণে দাঁত ক্যালাবো কি জন্য!”
আরহানের কথার কোনো উত্তর দিলো নাহ্ ঈশা।তার বোঝা হয়ে গেছে আরহান প্রচন্ড পরিমাণ ঘাড়ত্যাড়া লোক।তবে সে নিজেও কম নাহ্।সে আরহানের দ্বিগুণ ঘাড়ত্যাড়া।
আরহান ঈশাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজালো।মাসুমা বেগম এসে দরজা খুলে দিলেন।ঈশার পায়ে ব্যান্ডেজ দেখে তিনি কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন,
“কি হয়েছে মা তোর?পায়ে ব্যান্ডেজ কেনো?”
ঈশা কিছু বলার আগেই আরহান বললো,
“রিলাক্স আন্টি আপনার মেয়ের তেমন কিছু হয়নি।উনাকে আগে নিয়ে বসান দ্যান সব জেনে নিয়েন।”
মাসুমা বেগম আর আরহান’ ঈশাকে ধরে নিয়ে সোফায় বসালো।আরহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাসুমা বেগম বললেন,
“বাবা তুমি বসো।”
“না আমি এখনি চলে যাবো।আমার একটু কাজ আছে।”
“কাজ তো করতে পারবে।আগে একটু পরিচিত হয়েনি আমরা!”
আরহান আর কিছু না বলে একটা সোফায় বসলো।মাসুমা বেগম ঈশাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“কিভাবে হলো এমন?”
ঈশা সব ঘটনা মাসুমা বেগমকে বললো।
“রাস্তাঘাটে দেখে শুনে চলতে হয় ঈশা।আর বাবা তোমাকে ধন্যবাদ এতো উপকার করার জন্য।তা বাবা তোমার নাম কি?”
“আরহান মির্জা।”
“আরহান মির্জা মানে মির্জা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রির মালিক?”
“হ্যাঁ।”
“ওহ্ আচ্ছা।তোমার বাবাকে আমি চিনতাম।ঈশার বাবার বন্ধু ছিলেন।উনার মৃত্যুর খবরটা পেয়ে ঈশার বাবা অনেক ভেঙে পড়েছিলেন।আমারও খুব খারাপ লেগেছিলো।মানুষটা অনেক ভালো ছিলেন।”
আরহান কিছু না বলে চুপ করে বসে আছে।ঈশা অবাক হয়ে বললো,
“তারমানে আপনি মির্জা আঙ্কেলের ছেলে?আঙ্কেল তো অনেক ভালো মানুষ ছিলেন।কি সুন্দর হাসি খুশি মানুষ!তা আপনি এমন মুখবোজা হয়েছেন কেনো?”
ঈশার কথা শুনে আরহান ঈশার দিকে তাকালো।রাগের কারণে সে চোয়াল শক্ত করে ফেললো।তবে মাসুমা বেগম থাকার কারণে ঈশাকে কিছু বললো নাহ্।মাসুমা বেগম ঈশাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আহ্!ঈশা উল্টাপাল্টা কথা বলা বাদ দে।সবাই তো এক হয় না।আর ও কি তোর মতো বকবক করবে নাকি?”
মাসুমা বেগমের কথায় আরহান মুচকি হাসলো।ঈশা মুখে হাত দিয়ে বললো,
“যাক আপনি তাহলে হাসতে পারেন।”
মাসুমা বেগম বসা থেকে উঠে চলে গেলো।মাসুমা বেগম যাওয়ার পরে আরহান বললো,
“আপনি এতো কথা কিভাবে বলেন?মুখের মধ্যে কি অটোমেশিন লাগিয়ে রাখছেন নাকি!”
“দেখুন আমি একটু কথা বেশি বলি ঠিকই।তবে মানুষ খারাপ নাহ্।”
“ডিসকাস্টিং!”
আরহান মুখ ঘুরিয়ে ফেললো।ঈশাও মুখ ভেঙচি কেটে বসা থেকে উঠতে গেলে পারলো নাহ্।আবার বসে পড়লো।
“ওফ!নিজের পা-ও এখন শত্রু হয়ে গেছে।”
ঈশার কথা শুনে আরহান মৃদু হাসলো যা ঈশার চোখের আড়ালে।কিছুক্ষণ পরে মাসুমা বেগম নাস্তার ট্রে নিয়ে আসলেন।যা দেখে আরহান বললো,
“আন্টি এইসবের কি দরকার ছিলো!”
“প্রথম বার এসেছো খালি মুখেই চলে যাবে নাকি?একটু খাও।”
আরহান কফির কাপ নিয়ে চুমুক দিলো।কফি খাওয়া শেষ করে আরহান মাসুমা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে ঈশাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো।আরহান যেতেই ঈশা সোফায় হেলান দিয়ে বসে বললো,
“যাক বাঁচলাম।এই অভদ্র লোকের সামনে এতোক্ষণ বসে থাকা যায় নাকি!”
“ঈশা তুই চুপ কর।”
||🌸||
আরহান ঈশাদের বাড়ির নিচে এসে গাড়িতে উঠলো।
“না অনেক দেরি হয়ে গেছে।আজকে আর অফিসে যাওয়া হবে নাহ্।এখন বরং বাড়িতেই চলে যাই।”
আরহান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তার বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলো।আরহান বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখে আলভি’ আরিশার(আরহানের ছোট বোন) সাথে খেলা করছে।আরহান গিয়ে আলভিকে কোলে নিয়ে বললো,
“পাপাই কি খবর তোমার?”
“তোমার সাথে রাগ করছি।তুমি আমার জন্য চক্কেট আনো নাই আজকে।”
আলভি কথাটা বলে মুখ গোমড়া করে ফেললো।আরহান হাসি দিয়ে তার পকেট থেকে চকলেট বের করে আলভির হাতে দিয়ে বললো,
“এটা আনতে আমি কি কখনো ভুলতে পারি!”
আলভি চকলেট পেয়ে খুশি হয়ে আরহানকে জড়িয়ে ধরলো।
“ভাইয়া তুই যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে হিয়া ভাবির বাবা আসছিলো।”
“আরিশা আমি তোকে অনেকবার বলেছি ওই মেয়েটাকে ভাবি ডাকা বন্ধ কর।তুই কিছুতেই তা শুনিস নাহ্।”
“অনেকদিনের অভ্যাস তো ভাইয়া।কি আর করবো বল!”
“তা মিনিস্টার সাহেব এসেছিলো কি কারণে?”
“ওই যে তুই হিয়া ভা……না মানে আপুকে অপমান করেছিস তাই।”
“তা উনার মেয়ে ন্যকামি করতে এই বাড়িতে আসে কেনো!এই বাড়িতে না আসলে তো আর অপমানিত হবে নাহ্।”
আরহান কথাটা বলে আলভিকে কোলে নিয়ে তার রুমে চলে গেলো।আরহান ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো আলভি ঘুমিয়ে গেছে।
“পাপাই তাহ্ মনে হয় অনেক টায়ার্ড।নাহলে এই সন্ধ্যাবেলায় তো কখনো ঘুমায় নাহ্।”
“সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করলে টায়ার্ড তো হবেই।”
আরহান দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো আয়েশা বেগম দাঁড়িয়ে আছে।
“আম্মু ভিতরে আসো।”
আরহান গিয়ে সোফায় বসলো।আয়েশা এসে তার পাশে বসলো।আরহানের কাঁধে হাত রেখে বললো,
“এতো রাগ ভালো না রে!তোর বাবার-ও এমন রাগ ছিলো।যার ফলেই সে আজকে আমাদের মাঝে নেই।”
“আম্মু বাবার রাগ দেখানোটা একদম স্বাভাবিক ছিলো।আমি বাবার সাথে একমত ছিলাম।তবে এভাবে বাবাকে হারাবো তা কখনো ভাবিনি!উনি আমার আইডল ছিলেন।”
আরহান কথাটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারপরে আয়েশা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আম্মু তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শুবো?”
“এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়!”
আরহান আয়েশা বেগমের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো।আয়েশা বেগম আরহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।আরহান চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
“একটা বিয়ে করে ফেল বাবা।”
আরহান চোখ খুলে আয়েশা বেগমের দিকে তাকালো।
“আম্মু তুমি আর যাই বলো এই বিয়ে নিয়ে কথা বলবে নাহ্।আর আমি আমার ছেলেকে নিয়ে অনেক ভালো আছি।আমার বিয়ে করার কোনো দরকার নেই।”
“আলভি দাদুভাইয়েরও তো একটা মায়ের দরকার তাই-না!”
“ওর মায়ের প্রয়োজন নেই।ওর বাবাই ওর জন্য ঠিক আছে।”
“তোকে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই।”
“বোঝানোর দরকার নেই।মাথায় হাত বুলিয়ে দেও তাতেই চলবে!”
/🌼/
ঈশা টানটান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে।তৈয়ব সাহেব এসে তার পাশে বসে বললেন,
“মা তোর পায়ে কি বেশি ব্যথা করছে?”
“না বাবা আমি ঠিক আছি।”
“কিন্তু হাঁটতে তো সমস্যা হচ্ছে।”
“একটু সমস্যা আছে কালকের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।”
“রাস্তাঘাটে একটু দেখেশুনে চলতে হয় মা।”
“দেখে শুনেই চলেছি বাবা।ওই আবুল যে হঠাৎ করে সাইকেল এনে আমার পায়ে উঠিয়ে দিবে তা কি আমি জানতাম নাকি!”
“তা হ্যাঁ রে মা আরহানের সাথে তোর কিভাবে দেখা হলো?”
“তা অনেক কাহিনী বাবা।ওই লোক যেমন ভালো তার দ্বিগুণ খারাপ।উনাকে নিয়ে কিছু বলার ইচ্ছা নেই আমার।এমনিতেও আমি পরের জামাইকে নিয়ে কথা বলি না।”
“এতোকিছু বলার পরেও বললি বলিস নাহ্!”
মাসুমা বেগমের কথায় ঈশা পাশে ফিরে তাকালো।সে দেখলো মাসুমা বেগম তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে।
“আম্মু আমি খাবো না।আমার ভালো লাগছে নাহ্।”
“না খেয়ে খেয়ে দিন দিন পাটকাঠির মতো হয়ে যাচ্ছিস।তোকে তো আজকে খেতেই হবে!”
“আম্মু আমি যথেষ্ট খাই।আর তুমি পাটকাঠি বলছো আর তোমার আদরের অতিথি তো আটার বস্তা বলছে।”
মাসুমা বেগম বললেন,
“কে আরহান নাকি?”
“হ্যাঁ।”
“ও হয়তো মজা করে বলেছে।”
তৈয়ব সাহেব বললেন,
“আচ্ছা তোমরা মা-মেয়ে গল্প করো আমি গেলাম।”
তৈয়ব সাহেব ঈশার রুম থেকে চলে গেলেন।ঈশা আস্তে করে উঠে বসলো।
“আম্মু প্লিজ আমি খাবো না।”
“আজকে কোনো কথা শুনছি নাহ্।পায়ে ব্যথা পেয়ে একদিক থেকে ভালোই হয়েছে খাওয়াতে গেলে এখন আর দৌড় দিতে পারবি নাহ্।”
“আম্মু তুমি আমার মা নাকি শত্রু?”
“তোর যা মনে হয়।”
মাসুমা বেগম জোর করে ঈশাকে খাইয়ে দিলো।তরপরে ওষুধ খাইয়ে রুম থেকে চলে গেলো।ঈশা চোখ বুজতেই তার ঘুম চলে আসলো।
–
–
–
আরহান’ আলভিকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ডিনার করিয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিলো।তারপরে নিজে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে আরহানের ঘুম ভাঙলো মোবাইলে কল আসার কারণে।আরহান চোখ ডলতে ডলতে কল রিসিভ করলো।ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে আসলো।
মেয়েটার কোল থেকে পাঁচ বছরের ছেলেটাকে এক প্রকার জোর করেই নিয়ে নিলো আরহান।মেয়েটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আরহানের দিকে।আরহান রাগে ফুসছে।ছেলেটার গালে একটা চুমু দিয়ে মেয়েটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।মেয়েটাও চোখ রাঙিয়ে বললো,
“এভাবে বাচ্চাটাকে কেড়ে নিলেন কেনো?”
আরহান চিৎকার করে বললো,
“আমার বাচ্চাকে আমি যেভাবে ইচ্ছা কেড়ে নিতে পারি।আর আপনি কে!একজনের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাঁটা শুরু করে দিলেন।তারপরে আবার জিজ্ঞেস করছেন কেড়ে নিলাম কেনো!”
“ওহ্ তার মানে ছেলেটা আপনার।বাচ্চাটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে ছিলো আর আমি ওর কান্না থামালাম আর আপনি এমন বিয়েইভ করছেন!বাবা হতে হলেও যোগ্যতা লাগে।এভাবে জোরে চিৎকার করতে জানলেই হয় নাহ্।”
আরহান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“জাস্ট সার্টআপ।আপনার জন্য কি এখন আমার বাবা হওয়ার সার্টিফিকেট আনতে হবে নাকি!”
“যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আনতে হবে।আপনি কেমন বাবা যে রাস্তার মাঝখানে বাচ্চাকে দাঁড়া করিয়ে চলে যান।”
“এই যে শুনুন….আলভিকে আমি রাস্তার পাশেই দাঁড়া করিয়ে গিয়েছিলাম।ও আইসক্রিম খাচ্ছিলো।তবে ওর হঠাৎ কান্নার কারণ যে আপনি সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারতেছি।হয়তো আপনি ও-কে জোর করে কোথায় নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন।আর আমি গিয়েছিলাম ওই পাড়ে একটা বৃদ্ধ মহিলাকে রাস্তা পাড় করিয়ে দিয়ে আসতে।মহিলাটা অনেকক্ষণ যাবৎ রাস্তা পাড় হতে পারছিলেন না।”
“খুব ভালো করেছেন জনসেবা করে।আর শুনেন ওর কান্নার কারণ আমি না।আপনি ও-কেই জিজ্ঞেস করুন ও কেনো কান্না করতে ছিলো।যত্তসব!মানুষের ভালোও করতে নেই।”
মেয়েটা হেঁটে চলে যেতে যাবে তখন আলভি পিছন থেকে ডাক দিলো,
“ঈশা আন্টি।”
ঈশা পিছনে ফিরে তাকালো।আলভি আরহানের কোল থেকে নেমে ঈশার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“সরি আন্টি আমার জন্যই তোমার অনেক বকা খেতে হলো।”
ঈশা আলভির গালে একটা চুমু দিয়ে বললো,
“ইটস ওকে বাচ্চু তাহ্।”
আলভি আরহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বাবাই আন্টি আমাকে কান্না করায়নি।আমি কান্না করতে ছিলাম আমার আইসক্রিম রাস্তায় পড়ে গেছিলো দেখে।আর আন্টিই তো আমাকে মজার মজার কথা বলে হাসালো।”
আরহান ঈশার দিকে তাকালো।ঈশা চোখ ফিরিয়ে আলভির দিকে তাকিয়ে বললো,
“আচ্ছা বাচ্চু আমি আজকে যাই।আল্লাহ চাইলে আমাদের আবার দেখা হবে।”
ঈশা কথাটা বলে চলে গেলো।আলভি এসে আরহানের হাত ধরে বললো,
“বাবাই তুমি আন্টিকে সরি বললে না কেনো?”
আরহান আলভিকে কোলে নিয়ে বললো,
“সরি বলার মতো কিছুই হয়নি পাপাই।এইসব মেয়েদের আমি ভালো করে চিনি!প্রথমে আদর করে দ্যান কিডন্যাপ করে নিয়ে চলে যায়।এখন বাসায় চলো তোমার দিদুন না হয় চিন্তা করবে।”
আরহান আলভিকে কোলে করে নিয়ে গাড়িতে বসালো।আরহান গাড়ি ড্রাইভ করে বাসায় আসলো।তার রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় হাত মুথো করে বসে আছে।
“ওই মেয়েটা আমার সাথে এমন বিয়েইভ করলো।আজ পর্যন্ত কারো সাহস হয়নি আরহান মির্জার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার।আর এই মেয়েটা!ও না হয় আলভির কান্না থামিয়েছে তাই বলে আমার সাথে এমন ভাব নিয়ে কথা বলবে।এই আরহান মির্জা আর যাই পছন্দ করুক ভাব নেওয়া একদমই পছন্দ করে নাহ্।ওই মেয়ের সাথে যেন আমার আর কখনো না দেখা হয়!”
আরহান উঠে দাঁড়িয়ে নেভি ব্লু শার্ট,কালো ব্লেজার আর কালো প্যান্ট পড়ে রেডি হলো।সে রুম থেকে বের হয়ে নিচে গিয়ে দেখলো হিয়া আলভিকে কোলে নিয়ে বসে আছে।যা দেখে আরহানের রাগ মাথায় উঠে গেলো।সে গিয়ে হিয়ার সামনে দাঁড়ালো।আরহানের দিকে তাকাতেই হিয়ার মুখটা শুকিয়ে গেলো।সে আলভিকে সোফায় বসিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আসলে আমি একটু আলভি কে দেখতে এসেছিলাম।”
“আপনাকে আমি একবার না হাজার বার নিষেধ করেছি এই বাড়িতে আসতে।আপনি তারপরেও এই বাড়িতে পা রেখেছেন।এখন কি আমি আপনার ঘাঁড় ধরে ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিবো!”
আরহান কথাগুলো বলে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।হিয়া কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে বললো,
“ছেলেটা আমারও!আমার সাথে এমন ব্যবহার করা বন্ধ করো।নাহলে তোমাদেরই ক্ষতি।”
হিয়া আর কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে গেলো।আয়েশা বেগম এসে আরহানের কাঁধে হাত দিয়ে বললো,
“এতো রাগ ভালো নাহ্ বাবা।এমন করতে হয় না মানুষের সাথে।”
“আমি এমনই আম্মু।আর আমাকে এমন করতে বাধ্য করেছে এই সমস্ত মানুষজনই।”
আরহান কথাটা বলে আলভিকে টাইট হাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে গেলো।আরহান যাওয়ার পরে আয়েশা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আরহান গাড়ি ড্রাইভ করছে হঠাৎ আরহান দেখলো রাস্তার মাঝখানে একটা মেয়ে বসে আছে।আরহান কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো।সে গাড়ি থেকে নেমে দেখে একটা মেয়েটা পায়ে হাত দিয়ে বসে আছে।তবে চুলের কারণে মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছে নাহ্।আরহান মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আপনার কি কিছু হয়েছে?”
মেয়েটা আরহানের দিকে তাকাতেই আরহান মুখ ঘুরিয়ে ফেললো।কারণ মেয়েটা আর কেউ নাহ্ ঈশা।আরহান চলে যেতে গেলে ঈশা চিৎকার করে বললো,
“এই যে মানবদরদী…..সবার জন্য তো এক নিয়ম হওয়া উচিত।একজন বৃদ্ধাকে রাস্তা পাড় করিয়ে দিতে পারেন আর একটা মেয়ে রাস্তায় এক্সিডেন্ট করে বসে আছে তাকে দেখেও মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছেন!”
“বেশ আমার থেকে সাহায্য নিতে হবে নাহ্।সো রাস্তা থেকে সরে যান।নাহলে আপনার উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে বাধ্য হবো।”
ঈশা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,
“আপনি এমন কেনো!”
“আপনাকে ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি নাহ্।”
আরহান চলে আসতে গেলে ঈশা পিছন থেকে বললো,
“ওই শুনেন…..”
ঈশার ডাকে আরহান পিছনে ফিরে তাকালো।ঈশা আরহানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“একটু হাতটা ধরে তুলবেন।”
আরহান আর কিছু না বলে ঈশার হাত ধরে তাকে বসা থেকে দাঁড়া করালো।তবে ঈশা হাঁটতেই পারছে নাহ্।আরহান ঈশার পায়ের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো।পায়ের বেশখানিকটা জায়গা লালচে হয়ে আছে।হয়তো রক্ত জমাট বেঁধেছে।আরহান একটা নিশ্বাস ফেলে ঈশাকে কোলে তুলে নিলো।আরহানের এহেন কাজে ঈশা চমকে গেলো।সে হা হয়ে আরহানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।তবে আরহানের চোখ গাড়ির দিকে।আরহান ঈশাকে কোলে করে নিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসালো।তারপরে নিজে গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং করা শুরু করলো।
“আরে আপনি আমাকে গাড়িতে এনে বসালেন কেনো?”
“আপনি তো হাঁটতেই পারছে না।যাবেন কি করে?”
“সে আমি কোনো ভাবে চলে যেতাম।”
“চুপ করে বসে থাকুন।আপনার পায়ের অবস্থা ভালো নাহ্।আপনাকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে।”
“আমার জন্য এতো কিছু করতে হবে না।”
“আমি মানুষের সেবা করতে পছন্দ করি।আর আপনি যদি এলিয়েন হতেন তাহলে ভেবে দেখতাম করবো নাকি করবো নাহ্!”
আরহান কথাটা বলে গাড়ি চালানোতে মন দিলো।
“আচ্ছা আপনি যে আমাকে এভাবে কোলে তুলে নিলেন ভাবি জানলে রাগ করবে না?”
আরহান ঈশার দিকে না তাকিয়েই বললো,
“কোন ভাবি?”
“আপনার বউ।”
“সেটা আপনার জানার দরকার নেই।”
ঈশা মনে মনে বললো,
“ভাবের কারণে বাঁচে নাহ্।”
কথাটা বলে ঈশা মুখ ভেঙচি কেটে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো।
আরহান হসপিটালের সামনে গাড়ি থামালো।তারপরে টলিতে করে ঈশাকে ডক্টরের ক্যাবিনে নিয়ে গেলো।ডক্টর ঈশার পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো আর কিছু ওষুধ দিলো।আরহান ঈশাকে এনে গাড়িতে বসিয়ে বললো,
“এই কয়দিন বেশি তিড়িংবিড়িং করবেন নাহ্।নাহলে কিন্তু আরো সমস্যা হবে পায়ে।”
ঈশাকে চোখ রাঙিয়ে বললো,
“ওই আপনি জানেন আমি তিড়িংবিড়িং করি?”
“আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়।এতো ডিটেইলসে জানা লাগে নাহ্।”
সোফার রুমের বড় সোফাটার মাঝে চোয়াল শক্ত করে বসে আছে উজান। দৃষ্টি তার লাল কার্পেটের দিকে রাখা। তাকে ঘিরে বসে আছে বাকি সবাই। বিহান আছে তারই ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে। সাথে আছে মেহু৷ হিয়াকে রুমে তালা দিয়ে রেখে আসছে উজান। বড্ড ছটফট করছিলো সে। এখন একটু শান্ত হয়ে বসে থাকুক কিছুক্ষণ। এদিকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যস্ত বিহান। সাথে তো রস ঢালতে মরিয়া মেহু।
– ভাইয়া বিশ্বাস কর,ঔ মেয়ে টা একদম সুবিধের না। ও তোকে ফাঁসাতে এই বাড়িতে এসেছে। হ্যা আমি মানছি আমি তোদের মতো সৎ না। মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করা মজা করা আমার স্বভাব কিন্তু বিশ্বাস কর আমি কখনো কোনো মেয়েকে জোর করে। হিয়া নিজেই আমাকে ওর শরীরের লোভ দেখিয়ে ওর কথাতে…
বিহানের সাথে তাল মিলিয়ে ফোড়ন কাটলো মেহু,
– আমি তো সেই প্রথম দিনই সন্দেহ করেছিলাম ঔ মেয়েটা নির্ঘাত এ বাড়িতে কিছু না কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে তো বটেই। কিন্তু আমার দাদিমণি তো হিয়া বলতেই অন্ধ। আরেএএ পর কখনো আপন হয় না আর কবে বুঝবা তোমরা।
– ভাইয়া বিশ্বাস কর হিয়া মেয়েটা খুবই বাজে একটা মেয়ে। নাহলে তুই দেখ ওহ কি বললো যে ও নাকি এ বাড়িতে সব সত্যি জানতে এসেছিলো তা যখন জেনে গেলো তখন কি ও পারতো না এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। তুই এখনো চোখে পট্টি দিয়ে রাখবি। আর কিসের বিয়ে আমি কোনোদিন ওকে বলিনি আমি ওকে বিয়ে করবো। তোর তোর আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো। ওয়েট ওর বাড়ির লোকের সাথে আমি তোর কথা বলে দিচ্ছি থাম
বলেই বিহান হিয়ার ফুফুর মেয়ে বুলিকে ফোন করলো। উজান বুলির নাম্বার চিনে একবার হিয়া বাড়িতে ফোন করাতে সে এই নাম্বার নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলো। বুলির স্পষ্ট উওর হিয়া নাকি সত্যি ছেলেধরা টাইপ। বিহান নাকি তার বুবুকে সত্যি মন থেকে কাছে পেতে চেয়েছিলো কিন্তু যখন হিয়া শুনলো আপনি এই শাহরিয়ার কুঞ্জের একরওি মালিক তখন ওহ ঠিক সুযোগ বুঝে আপনার কাছে গিয়ে একটা ছলনার আশ্রয় নিলো। এদিকে উপস্থিত সবাই এতোক্ষণ যাওবা বিহান আর মেহুকে বিশ্বাস করতে চাইছিলো না তারাও এখন হিয়ার নিজের বাড়ির লোকের মুখে এ-ই কথা গুলো শুনে ছি চিৎকার করতে থাকলো। কারো কারো তো অভিমত এসে জুটলো দাদিমণি নাকি এতোদিন দুধ দিয়ে হিয়ার মতো একটা কালসাপ পুষে রেখেছে। দাদিমণি কিছু বলতে পারলেন না তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না হিয়া এ বাড়িতে তার কিছু উদ্দেশ্য সফল করতে এসেছিলো বা তার প্রিয় নাতি উজানের থেকে প্রতিশোধ তুলতে। সাথে উনি এটাও মানতে পারছিলেন না যে হিয়া সত্যি এ-তো খারাপ কি? হিয়ার প্রতি উজানের মা’র যেই দূর্বলতা তৈরি হয়ে এসেছিলো নিমিষে সেটা ভেঙে গিয়ে ছন্নছাড়া হয়ে আসলো। তাতে আরো বিষ ঢাললো মেহু,
– যার নিজের বোনই তার সম্পর্কে এরকম মন্তব্য করছে তাহলে সে কতোটা জঘন্য হতে পারে তোমরা শুধু একবার ভাবো আন্টি। সেদিন না খুব আত্মসম্মান এর কথা বলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলো তাহলে আজ কি হলো সেই বড় বড় কথা গুলোর। গেলো তো সব চুপসে। বাজে মেয়ে একটা।
সবার এতো কথার মাঝে উজান উঠে দাঁড়ালো। পেছন ঘুরে দাদিমণিকে উদ্দেশ্য করে বললো তুমি কি চাও দাদিমণি,তোমার মন কি বলে?
দাদিমণি গম্ভীর কন্ঠে উওর করলেন “” তুই সবসময় সবকিছু চিন্তাভাবনা করে সঠিক প্রমাণের উপর ভিওি করে তারপরই সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছিস উজান। আশা করবো এ ব্যাপারেও তুই নিজের বিচক্ষণতার পরিচয় দিবি””
উজান আর কিছু বললো না। সোজা হেঁটে উপরে উঠতে শুরু করলো। এদিকে তো বিহান চিৎকার করেই যাচ্ছিলো “ভাইয়া হিয়া মেয়েটা সত্যি চরিএহীন। এরা নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে আমাদের মতো বড়লোক ছেলেদের ফাঁসাতে চায় ভাইয়া। একটু বিশ্বাস কর, ভাইয়া”
!
!
উপরে এসেই তালা খুলে রুমে ঢুকলো উজান। আবার দরজার খিল লাগিয়ে বিছানায় এসে হিয়ার পাশে বসে যেতেই হিয়া উঠে দাঁড়ালো। হিয়ার মনে হাজার টা চিন্তা এসে ঘুরপাক খাচ্ছে এ-ই মুহুর্তে। নিচে কি হলো এতোক্ষণ, কি বুঝালো বিহান তাকে, উজান বিহানের কথা বিশ্বাস করে নিলো না তো। আর বললেই বিশ্বাস করে নিতে হবে তাহলে কি ভালোবাসলো সে এতোদিন হিয়াকে। ভয়,ক্ষোভ,আর্তনাদ সব এসে জড়ো হচ্ছে হিয়ার সারা শরীর জুড়ে!
– আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন তো উজান। আমি আপনাকে সব বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি প্রতিবারেই আমাকে সেটা বলতে দেন নি
উজান একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলতে শুরু করলো
-তাই বলে প্রতিশোধ হিয়া। সবাই আমাকে শুধু স্বার্থের জন্য ব্যবহার করে হিয়া। সবাই। আজ আপনিও আমাকে
-না আমি আপনাকে ব্যবহার করিনি। আমি সত্যি আপনাকে মন থেকে..আর একটা সুযোগ দিয়ে দেখুন না আমায়। আমি তো আপনাকে সব বলতেই চেয়েছিলাম।
উজান উঠে এসে কান্নারত হিয়াকে বুকে আগলে নিলো। আজ সত্যি তার খুব কষ্ট হচ্ছে। জীবনে প্রথম কাউকে এতোটা ভালোবাসার পর সেই মানুষটাই যখন তাকে সত্যি ভালোবাসে কি না এই প্রশ্ন উঠে আসে তখন সত্যি সেটার মতো যন্এনাদায়ক কিচ্ছু হয় না কিচ্ছু না। উজান হিয়ার মাথায় হাত রাখলো,রেখে বললো
– আর কখনো আমাকে কষ্ট দিবেন না তো আপনি?
– এবারো কি দিয়েছি সব তো বলতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি তো।
উজান হু বলে হিয়ার চোখের পানি টা মুছিয়ে দিয়ে নিচে আসলো। সবাই উজানের সিদ্ধান্ত শোনার অপেক্ষায় ছিলো। উজান নামাতে সবাই এসে ঘিরে ধরলো তাকে। সবার চোখে কৌতূহল স্পষ্ট! দাদিমণি এসে উজানের কাঁধে হাত রাখলেন,,উজান তার হাতে নিজের হাত রেখে বললেন
– তুমি হিয়ার বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে যাও দাদিমণি। আমি সামনের সপ্তাহেই হিয়াকে বিয়ে করতে চাই।
দাদিমণি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তার বিশ্বাস ছিলো হিয়া কখনো এরকম হতেই পারে না। উজান নিবিড়কে ইশারা করে তার সাথে উপরে আসতে বললেন৷ মেহু এসে উজানের সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলো বিয়ে করবো মানে টা কি? ঔ মেয়েকে শাস্তি না দিয়ে তুমি কি করে ওকে এ বাড়ির বউ বানিয়ে আনতে চাইছো উজান। উজান মেহুর প্রশ্নের কোনো উওর দেবার প্রয়োজন মনে করলো না। বরং উপস্থিত সবাইকে তুচ্ছ করে নিবিড়কে নিয়ে উপরে উঠে গেলো। আর নিবিড়কে দায়িত্ব দিলো হিয়ার বোন থেকে শুরু করে বাড়ির সবার ডিটেইলস নিতে। তার কেনো জানি মনে হচ্ছে বিহান জোর করে হিয়ার বোনকে দিয়ে ওসব বলে নিয়েছে। নিবিড়কে বিদায় দিয়ে হিয়ার রুমে আসতে যাবে কিন্তু তার আগে সেখানে পৌঁছে যায় বিহান। দরজা খোলার শব্দে দূত পায়ে এগিয়ে আসে হিয়া। বিহান রুমে এসেই হিয়ার দিকে আসতে যাবে ওমনি হিয়া দু কদম পিছিয়ে গেলো,
_খবরদার বিহান একদম আমার কাছে আসবে না। তোমাকে দেখলেই এখন ঘেন্না লাগে আমার
-বিশ্বাস করো হিয়া। আমি সেদিন আসতেই চেয়েছিলাম কিন্তু উজান ভাই আমাকে। উজান ভাইকে তুমি চেনো না হিয়া উনি আমাকে সহ্য করতে পারেন না তাই জন্য তো। আমি আজো তোমাকে খুব ভালো বাসি হিয়া বিলিভ মি
– বিশ্বাস আর তোমাকে। আর একটা কথা উজান ঠিক কি রকম আমাকে তুমি বলতে এসো না বিহান। আর যা-ই হোক সে তোমার মতো পশু না
বিহান হাসলো৷ একটা ডেভিল টাইপ চোখ মুখ করে হিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো।
– ইসস এ কয়দিনে দেখছি ভাইয়ের সব জেনে বসে আছো তুমি। খুব এ বাড়ির উপর টান দেখছি তা নিজের বাড়িতে কি হচ্ছে সেটা খেয়াল রাখো নিশ্চয়ই
বিহানের কথার ইঙ্গিতে একটা ধাক্কা খেলো হিয়া। কি বোঝাতে চাইলো বিহান ওর পরিবারের কথা তুলে।
-কি মিন করতে চাইছো তুমি বিহান?
-তোমার একটা ছোট বোন ছিলো না বুলি। খুব আহ্লাদী একটুতে ইমোশনাল হ’য়ে পড়তো। সে ঠিক আছে তো হিয়া!
-তুমি হঠাৎ আমাদের মাঝে বুলিকে কেনো আনছো বিহান। কি ক্ষতি করেছে তুমি আমার বোনের। আমার বোনের যদি কিচ্ছু হয় আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়বো না বিহান
-যা ভয় পেয়ে গেলাম তো। কতো বোকা তুমি হিয়া। আজো সেই বোকাই আছো। শুনলাম ভাই নাকি কিছু দিনের জন্য ব্যবসার কাজে সিলেট যাচ্ছে তা সে নিরাপদে আবার এ বাড়িতে ফিরবে তো সে হিয়া! বলা তো যায় না মানুষের কখন…
বলেই বিহান চুল গুলো উঁচুতে মেলে দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়লো,তার কিছু মুহুর্ত পর উজান রুমের কাছে এসে দেখলো রুমের দরজা খোলা। তাহলে কি দাদিমণি। উজান রুমে আসতেই হিয়ার ভয়ার্ত মুখ দেখে নিজেও অনেকটা ভয় পেয়ে গেলো, দূত পায়ে হিয়ার দিকে এগোতেই হিয়া উজানকে ধরে কিসব বলতে থাকলো।
– বিহান ওসব কি বলে গেলো। আমার বোন টার কি হয়েছে। ও কেনো বললো বুলি বুলি ঠিক নেই। ওহ উজান আমি বাড়ি যাবো। আমার বোনের কাছে যাবো। ফুফু ঠিক আছে তো? কোথায় আজ যে সকালে কথা হলো কেউ তো আমায় কিছু বললো না।
উজান হিয়াকে ধরে তাকে শান্ত করতে চাইলো,
-চুপ কিচ্ছু হয়নি কারোর। সবাই ঠিক আছে। আমি নিজে সবাইকে ফোন করে দেখলাম। ওল ওকে
-না কিচ্ছু ওকে নেই। আমার মন বলছে আমার বোনটা ভালো নেই। বিহান ওকে…
– বিহানকে নিয়ে সমস্যা তো। আমি ওর কাছে গিয়ে বলছি যে..
উজান কিছু বলার আগেই হিয়া উজানের হাত ধরে বললো না আপনি যাবেন না বিহানের কাছে।
– আরে কেনো যাবো না৷ কিচ্ছু হবে না আমার।
হিয়া অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,
-আপনি কেনো বুঝতে চাইছেন না বিহান আপনাকে জানে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে গেছে। আপনি তারপরো কি করে,,
উজান হাসলো। সে খুব ভালো করে জানে বিহান এরকমই। এর আগেও এরকম হুমকি সে দিয়েছিলো কিন্তু পারে নি। এবারো হিয়াকে ভয় দেখাতে সে। হিয়া উজানকে বুঝিয়ে যাচ্ছিলো তার বিপদ খুব বিপদ। উজান বুঝতে চাইছিলো না কিছুই। বললো সে থাকতে ভয় নেই আর কিছুর। হিয়া শান্ত হতে পারলো না। আপনজন হারানোর ভয় এসে চেপে ধরতে শুরু করলো তাকে।
সেদিন টা কোনোরকমে পাড় করে হিয়া দাদিমণি সহ তার বাড়িতে আসলো। হিয়ার উদ্দেশ্য ছিলো বাড়িতে সবাই ভালো আছে কিনা তার খোঁজ নেওয়া কিন্তু দাদিমণির উদ্দেশ্য ছিলো হিয়ার ফুফুর সাথে কথা বলে হিয়াকে সব আয়োজন করে ঘরে তুলে নেওয়ার সব কথা সেরে ফেলা। যথারীতি হিয়ার বাড়িতে আসলো সবাই। দাদিমণি খুব সৌজন্যেতার সাথে হিয়ার বাড়ির সবার সাথে কথা বললেন। সবাই সুস্থ আছে দেখে হিয়াও কিছুটা স্বস্তি পেলো। কিন্তু হিয়ার এই স্বস্তি বেশিক্ষণ বহাল থাকলো না। তার ছোট বোন বুলি তাকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে এমন কিছু কথা বললো যার জন্য মোটেও তৈরি ছিলো না হিয়া। বুলি অঝোরে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে নিজের অসহায়ত্বের কথা সব খুলে বললো হিয়াকে। বিহানের ফাঁদে পা দিয়ে সে কি মারাত্মক ভুল টাই না করে এসেছিলো এতোদিন। বুলি প্রেগন্যান্ট। তাও আবার বিহানের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে এটা যেনো কিছুতেই হজম হচ্ছিলো না হিয়ার। বুলি তো জানতো যে বিহান হিয়ার সাথে তারপরো সে কি করে। হিয়ার মুখে বুলিকে বলার কোনো ভাষা ছিলো না। একদিকে নিজের বোনের করুন পরিণতি তো অন্য দিকে আপনজনদেরই এরকম প্রতরণা চুপসে ফেললো হিয়াকে। বুলির কথা মতে বিহান তাকে এতোদিন ভোগের পণ্য হিসাবে ব্যবহার করেছিলো কিন্তু যেই জানতে পারলো বুলি প্রেগন্যান্ট তখনি নিজের আসল রুপ দেখাতে শুরু করলো। বুলিকে ফোর্স করলো বাচ্চা টাকে নষ্ট করতে। কিন্তু আর সময় নেই। এটা জানার পর বিহান একদম যোগাযোগ ওফ করে দিলো। শুরু করলো বুলির উপর মানসিক নির্যাতন।
এ মুহুর্তে পাথর হয়ে আছে হিয়া। হিয়া জানতো তার বোনের একটু বেশি রঙীন দুনিয়ার প্রতি আগ্রহ। তাই বলে কিছু প্রাচুর্যের লোভে সে এরকম জঘন্য কাজ করবে এটা তার কল্পনারো অতীত ছিলো। হিয়ার ফুফু হিয়ার সামনে এসে দু-হাত পেতে অনুরোধ করলো হিয়া কিছু একটা কর। উজানকে বলে যদি! হিয়ার মস্তিস্কের সব নিউরন কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। আর যাই হোক তার ফুফু কোনোদিন তাকে তার অনাথ হবার জন্য কোনো কমতি করেন নি। নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছিলেন। আজ তাদেরই এরকম করুন অবস্থায় সে হেঁসে খেলে বিয়ে করে নিজের জীবনটা সাজাবে এটা যেনো তার বিবেকে এসে বাঁধছিল। এদিকে বিহানের মতো একটা পশুর সাথেও যে সে বুলিকে কোনো মতে বিয়ে দিতে দিবে না এটাও সে ঠিক করলো।
নিজেকে শান্ত করে এ বাড়িতে ফিরলো হিয়া। এ-ই একদিনেই বাড়িতে বিয়ের অনেকটা আয়োজন শুরু হয়েছে দেখে মনটা মুহুর্তে ভারাক্রান্ত হয়ে আসলো তার। রাতের দিকে স্পর্শকে ঘুম পাড়িয়ে হিয়া উজানের রুমে আসলো। খুলে বললো ঘটনার আদ্যপান্ত সব কিছু। রাগ ক্ষোভ লজ্জা অনুতাপ সব এসে জমা হলো উজানের মাঝে। পারলে এখনি সে বিহানকে খুন করে দিয়ে আসে এরকম। উজান হিয়াকে শান্ত করতে চেয়েও ব্যার্থ হলো। উপরন্তু হিয়ার এক প্রস্তাবে হতবাক হতে হলো তাকে।
– আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি হিয়া। আপনার বোনের সাথে কোনো অন্যায় হবে না। বিহান তাকে স্ব সম্মানে এ বাড়িতে বিয়ে করে নিয়ে আসবে।
-কিন্তু আমি যে চাই না বুলি বিহানের বউ হয়ে এ বাড়িতে আসুক। আচ্ছা আপনি না হয় আজ জোর করে বিহানকে ভয় দেখিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করালেন কিন্তু এরপর। এরপর আমার বোনের সারাজীবনের নিরাপত্তা দিতে পারবেন তো আপনি৷ বিহানের যা চরিএ সে তো বুলিকে ঘরে রেখে বাহিরে অন্য মেয়ের সাথে,
উজান কিছু বলতে পারলো না কারণ বিহান যে এরকমই চরিএের তা সে খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু এ ছাড়া বুলিকে এ মুহুর্তে বাঁচানোর উপায় টাই বা কি!
– আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করবো উজান,রাখবেন। আমি চাই আপনি বুলিকে বিয়ে করুন!
হিয়ার কথা শুনে বিস্ময়ে তাকিয়ে উঠলো উজান। একি কি করতে বলছে হিয়া তাকে। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো উজানের। নিজের বোনকে বাঁচাতে হিয়া কি-না তাদের সম্পর্ক টাকেই!
– এ অবস্থায় আমার বোনকে কেউ গ্রহন করবে না কেউ না। শুধু আপনি পারেন তাকে এ-ই বিপদ থেকে বাঁচাতে। আমি জানি আপনার কাছে বুলি সারাজীবন নিরাপদ থাকবে। ওর কোনো অবহেলা আপনি হতে দিবেন না।
উজান রাগান্বিত কন্ঠে এবার গর্জে উঠে হিয়ার দু বাহু এসে শক্ত করে চেপে ধরলো। কাঠ কাঠ কন্ঠে জানালো,
– যা বলেছেন সেটা আর কখনো মুখে আনবেন না। আপনাকে ভালোবেসেছি অন্য কাউকে বিয়ে করবার জন্য না। আর আপনি কি হ্যা আপনার বোন নিজের স্বার্থে আপনাকে দিনের পর দিন ব্যবহার করে যাচ্ছে আর আপনি তারই জন্য
– আমি ছোট থেকে ওদের বাড়িতে মানুষ উজান। ফুফুর এ-ই কষ্ট টা আমি কিছুতেই..
হিয়া আর কিছু বলতে পারলো না। তার আগে গলা ধরে আসলো তার। কান্নারত হিয়াকে বুকে আগলে নিলো উজান। আশ্বাস দিলো সব ঠিক করে দেবার।
!
!
উজানের আশ্বাসে শান্ত হতে পারলো না হিয়া। তারউপর বিহানের আকার ইঙ্গিতে করে যাওয়া সেই হুমকি সব দিক দিয়ে একটা চাপা আর্তনাদ এসে ঘিরে ধরলো হিয়াকে। সে কিছুতেই বিহানের সাথে তার বোনের বিয়ে দিবে না। আবার উজানকে বিয়ে করলে যদি বিহান উজানের ক্ষতি করে দেয় তখন। এদিকে উজান এই সমস্যার সমাধানো কিছু খুঁজে বের করতে পারছিলো না৷ সে ঠিক করলো সে বিহানকে পুলিশে দিবে এতো বড় ক্রাইমের শাস্তি তার প্রাপ্য। হিয়ার সাহস জুটলো না। সে উজানকে এই কাজটা আপতত রেখে তার বোনের বিষয় টা ভাবতে বললো। এদিকে সময়ো ফুরিয়ে আসতে যাচ্ছে আর কিছু দিন দেড়ি হলেই কথাটা পাঁচ কান হয়ে আসবে। হিয়া উজানকে ফোর্স করতে থাকলো বুলিকে বিয়ে করে নেবার জন্য। বলতে থাকলো আপনি তো সবার সমস্যা কতো সহজে দূর করে দেন তাহলে আমার বোনের এই অবস্থার জন্য যে আপনার ভাই দায়ী তার কি করবেন৷ দু এক কথাতে লেগে যেতে থাকলো দু’জনের। কি করা উচিৎ কিছুই মাথায় আসছিলো না তার। শেষমেশ উজান বাধ্য হলো এটা বলতে যে হ্যা আপনি এটাই চান তো আমি বুলিকে বিয়ে করি তাহলে তাই হোক। শুরু হলো বিয়ের আয়োজন। কোনো জমকালো কিছু না জাস্ট ঘরোয়া আয়োজন। বিহানকে সবকিছু থেকে ত্যাগ করলো উজান। সাথে রাগের বশে বলে দিলো এরপর থেকে ব্যবসায় যার যা প্রাপ্য নিজে পরিশ্রম করে নিয়ে যাবেন৷ অনেক অন্যায় সহ্য করা হয়েছে কিন্তু আর না।
বিয়ের আগের দিন হিয়া স্পর্শকে নিয়ে কাউকে না জানিয়ে শাহরিয়ার কুঞ্জ থেকে বেড়িয়ে আসলো। যদিও এ-ই কথাটা শুধুমাএ দাদিমণি জানতো। হিয়া ঠিক করলো সে এমন কোথাও পারি জমাবে যেখানে তাকে আর স্পর্শকে আর কেউ কখনো খুঁজে পাবে না কেউ না। উজানকে হারানোর কষ্ট চুবিয়ে খাচ্ছিলো তাকে। সে জানে সে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলছে উজানের সাথে। নিজের বোনের সম্মান রক্ষাতে সে অপমান করছে তার প্রতি উজানের ভালোবাসা টাকে। হয়তো এরপর আর কখনো সে উজানের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস মুখ কোনোটাই তার থাকবে না।
!
!
আজ প্রায় পাঁচ মাস পর,
হিয়া এতোদিন যাবৎ ঔ যে চলে গেলো আর পেছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজনটুকু মনে করলো না। সে তো ভেবে নিয়েছে উজান এখন আর তার নেই। আর উজানের সাথে সে যে অন্যায় করেছে তাতে তার সামনে গিয়ে হাসি মুখে কয়েকটাব কথা বলাও মানায় না তার। স্পর্শকে নিয়ে নিজের একটা আলাদা জগৎ তৈরি হয়েছিলো হিয়ার। বেশ ভালোই চলছিলো সবকিছু তবে উজানের জন্য প্রতিরাতে বালিশ ভিজিয়ে কাঁদতে একটুও কার্পণ্য করতো না সে।
আজ এতোদিন বাদে ফুফুর অসুস্থতার কথা শুনে বাড়িতে আসে হিয়া। হিয়ার সাথে বাড়িতে আসে বুলি নিজেও। পাশাপাশি বসে আছে হিয়া আর বুলি। মাতৃত্বের পুরো বৈশিষ্ট্য ভরে আছে তার শরীর জুড়ে হয়তো আর কিছু মাস বাদে ডেলিভারি তার। বুলিকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক কিছু বলতে চাইছে সে হিয়াকে কিন্তু কি যেনো একটা তাকে বাঁধা দিচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে হিয়াকে অবাক করে দিয়ে রুমে প্রবেশ করলো নিবিড়। হিয়ার চোখে চোখ পড়তেই শুধু সৌজন্যের খাতিরে মুচকি হাসলো সে। তার যে হিয়ার উপর অনেক অভিমান তা তার চোখে স্পষ্ট।
ফুফুমণিকে দেখে বাড়ি ফিরতে তৈরি হচ্ছিলো হিয়া এমন সময় ফুফুমণি বলে উঠলো এসেছিস যখন তখন দুটোদিন থেকে যা না মা। বুলিও তো জামাইয়ের সাথে আসলো দুদিন হচ্ছে তুই যদি থেকে যেতি ভালো লাগতো আমার। হিয়া একটু অবাক হলো জামাইয়ের সাথে এসেছে কিন্তু কোথায়, উজানকে তো সে দেখলো না একবারো বুলির সাথে। হিয়া কৌতূহল মনে ফুফুকে জিজ্ঞেস করলো জামাই কোথায় তোমার। ওনাকে তো দেখলাম না একবারো। ফুফু অবাক হয়ে গেলেন বললেন, দেখলি না মানে একটু আগেই তো তোর সাথে কথা বলে গেলো, হিয়া হতবাক হয়ে জানতে চাইলো কোথায় উজান এসে কথা বললো আমার সাথে, কি দেখতে কি দেখেছো তুমি শুধু শুধু। ফুফু অবাক কন্ঠে বললেন উজান কেনো আসতে যাবে। বুলিকে তো নিবিড় বিয়ে করেছে উজান এখানে কোথায় থেকে আসলো!!!!
থমকে গেলো হিয়া। নিবিড় বুলিকে বিয়ে করেছে মানে। কিন্তু বিয়ের আগের দিন তো। হিয়া ছুটে এসে বুলিকে বললো এসবের মানে কি। বুলি হিয়াকে সেদিনের সব কথা খুলে বললো। তাকে যে উজান না বরং উজানের কথা রাখতে নিবিড় বিয়ে করেছিলো কথা টা শুনেই হিয়ার সাড়া শরীর কেপে উঠলো। সারা শরীরের রক্ত জমে গিয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো তার। হিয়া কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জানতে চাইলো তাহলে এ-ই কথাটা আমাকে জানাসনি কেনো তোরা কেউ এতোদিনে। বুলি বললো উজান ভাইয়ার কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিলো যাতে কোনোভাবে এ-ই কথাটা তোর কানে না পৌঁছানো না হয় উনি৷ তুই তো তাকে একা করে রেখে চলে গিয়েছিলি তাই সে আর চাই নি তোকে কিছু জানাতে দিতে।
পাশে থাকা বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো হিয়া। চারপাশের সবকিছু তাকে চেপে ধরতে শুরু করলো। বুলি বললো বুবু তুই ফিরে যা ওনার কাছে,ভাইয়া হয়তো অনেক অভিমান পুষে রেখেছে কিন্তু সে আজো তোর ফেরার অপেক্ষায় আছে। কবে তুই নিজে থেকে ওনার কাছে ফিরে আসবি। ওনার বিশ্বাস তুই আসবি!
নিজেকে আর নিজের মধ্যে রাখতে পারলো না হিয়া। স্পর্শকে নিয়ে সেই সময়ের গাড়িতে উঠে পৌঁছালো উজানের কাছে। দাদিমণি তখন সোফায় বসে ওনার সেলাই করাতে ব্যস্ত। হিয়াকে আর হিয়ার কোলে তাদের স্পর্শকে দেখে থেমে গেলেন উনি। মুহুর্তে চোখ ভিজে গেলো তার। সাথে অঝোরে কেঁদে দিলো হিয়া নিজেও। হিয়াকে আর স্পর্কে আগলে উনি হিয়া আর স্পর্শকে চুমু এঁকে দিলেন। গলা ধরে আসলো তার। কান্নারত কন্ঠ আর অভিযোগের সুরে হিয়া বললো
– উনি তোমাদেরকে জানাতে বারণ করেছে আর তোমরাও আমাকে জানালে না, জানো ওনাকে হারানোর কষ্ট টা কতো টা শেষ করে দিয়েছে আমাকে,
– তাহলে চলে কেনো গিয়েছিলি তুই। দায় দায়িত্ব গুলো মেটাতে নিজের ভালোবাসাকে শেষ করে দিতে তোর মনে বাঁধলো না
– কি করবো পারতাম না তো ওনাকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে,তাই চলে গিয়েছিলাম। ওনাকে হারিয়ে কি খুব সুখে ছিলাম৷ এই বাচ্চা টা না থাকলে তখনি আত্মহত্যা করে মরে যেতাম
দাদিমণি রেগে গেলেন,রেগে গিয়ে বললেন
– এসব কি বাজে কথা হ্যা। কেউ তোর থেকে হারিয়ে যায় নি। গিয়ে একটু মান ভাঙ্গিয়ে দে দেখবি আবার আগের মতো হিয়া হিয়া করে আমার কান টাতে ব্যাথা তুলে দিবে
হেঁসে দিলেন দাদিমণি৷ লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো হিয়া। দাদিমণি ইশারায় বললেন ছাঁদে আছে এখন তোমার উনি। হিয়া কিছু বললো না। লজ্জায় ভেঙে গিয়ে স্পর্শকে দাদিমণির কোলে দিয়ে এক দৌড়ে ছাঁদে এসে পৌঁছালো।
গাছ গুলোতে পানি দেবার কাজে মগ্ন ছিলো উজান। উজানের দিকে চোখ পড়তেই বিলম্ব না করেই দৌড়ে এসে উজানকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরলো হিয়া। হাতে থাকা পানি দেবার পট টা ধপাস করে নিচে গড়িয়ে গেলো উজানের হাত থেকে৷ অঝোরে কেঁদে দিলো হিয়া।
– আমি না হয় কিছু দায় মেটাতে এরকম একটা কাজ করতে বলেছিলাম তাই জন্য আপনি। এটা আপনি ঠিক করেননি উজান। এতোদিন আমাদেরকে দূরে সরিয়ে রেখে একদম ঠিক কাজ করেননি আপনি। একটুও না।
উজান বুকের কাছে রাখা হিয়ার হাত গুলোকে জাপ্টে ধরলো। অভিযোগের কন্ঠে বললো,
– আর একটু ভরসা করতে পারলেন না আপনি আমাকে। চলে গেলেন আমাকে রেখে। গেলেন তো গেলেন স্পর্শকে নিয়েও চলে গেলেন। একবারো ভাবলেন না আমার দিক টা।
উজানকে আরো জোরো জাপ্টে নিলো হিয়া।
– কি করতাম আমি পারতাম না তো আপনাকে অন্য মেয়ের সাথে সহ্য করতে তাই জন্য তো। আর বিহান বারবার আমাকে আপনার প্রাণের হুমকি দিচ্ছিলো। ভয়ে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো সে সময়টাতে।
উজান হিয়ার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। হিয়ার দু গালে আলতো হাতে হাত রাখলো তার।
– আপনার মনে হয় বিহান আমার থেকেও ক্ষমতাবান৷ চাইলেই ক্ষতি করে দিতে পারে আমার।
– আমি জানি না। আমার শুধু ভয় হচ্ছিলো যে আমার অজান্তে আমার বোনের এ অবস্থা করতে পারে সে তো আপনাকে..
আবারো কান্নায় ভেঙে গেলো হিয়া। উজান হিয়াকে তার বুকের মাঝে শক্ত করে জাপ্টে নিলো। হিয়ার মাথা টা শক্ত করে চিপে ধরে রাখলো অনেকক্ষণ।
– তাহলে বোঝেন প্রিয় মানুষকে হারানোর কষ্ট টা কি? আপনি ভাববেন না আমি আপনাকে এতো সহজে ক্ষমা করে দিয়েছি। অনেক শাস্তি পাওনা আছে আপনার। অনেক হিসাব মেটানো বাকি আছে,
– পাঁচ মাস দূরে রেখেও শান্তি মিটেনি আপনার। আরো কি শাস্তি দিতে চান বলুন। সব মাথা পেতে নিবো শুধু দূরে সরিয়ে রাখবেন না দয়া করে।
উজানের হিয়ার কপালে স্নেহের পরশ বুলে দিয়ে বললো না রাখবো না তবে শাস্তি আপনাকে দেবো। বিয়ে করে সারাজীবন শাস্তি দেবো। খুব শাস্তি!
সাদা শাড়ি লাল পাড়ে নিজেকে রাঙিয়েছে আজ হিয়া। যদিও এই লাল সাদা রঙ টুকু পড়ে যে নিজেকে আলাদা করে সাজাতে হবে এই সময় টুকু তার হয়ে আসে নি। স্পর্শ যেনো আজ একটু বেশি তার মা ঘেঁষে আছে। বাড়িতে এতো অতিথি থাকার আনন্দে কোথায় সবার সাথে ঘুরে ঘুরে খেলবে তা না করে সবার ঔ নতুন নতুন মুখ দেখে ভয়ে সে তার হিয়া মা’র কাছেই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে ব্যস্ত। দাদমণি কতো করে বললো হিয়া একটু সেজেগুজে নে৷ ঠোঁটে একটু রঙ দে। চুলে একটা ফুল লাগা। আর কিছু না করিস অনন্ত কপালে একটা টিপ পড়। কিন্তু হিয়ার আর সেসময় কোথায়, স্যুটকেস থেকে মেকআপ বক্স টা বের করার সময় টা স্পর্শ তাকে দিলে না। উপরন্ত কাজের চাপে,ভ্যাপসা গরমের তেজে খুলে রাখা চুল গুলোও খোপা করে কাটা দিয়ে রাখলো সে। স্পর্শকে সকালের খাবারটুকু খাইয়ে হিয়া তাকে আজ বারোটার আগেই গোসল দিয়ে দিলো। পড়িয়ে দিলো একটা লাল সাদা ছোট্ট পাঞ্জাবি। স্পর্শের নাদুসনুদুস শরীরে বেশ মানালো সেটা। স্পর্শকে পাউডার দিয়ে তার কপালে একটা কালো টিপ পড়িয়ে দিলো হিয়া। সেটায় একটু পাউডার লাগিয়ে স্পর্শের গালে একটা ইয়া বড় চুমু আকঁলো সে। বাড়িতে আসা দুটো ছয় সাত বয়সী বাচ্চা স্পর্শকে নিতে আসলো নিচে তাকে নাকি সবাই ডাকছে। হিয়া বললো বেশ নিয়ে যাও কিন্তু সাবধানে। স্পর্শ যেতে চাইলো না কিন্তু তাকে ছাঁদের বায়না দিয়ে নিচে নিয়ে আসা হলো।
এদিকে উজান গোসল সেরে তৈরি হয়ে নিতে খেয়াল করলো তার বিছানায় রাখা একটা প্যাকেটের উপর। হাতে নিয়ে খুলতে গিয়েই দেখলো একটা লাল রঙা টুকটুকে পাঞ্জাবি। একটু অবাক হলো উজান। কারণ সে বরবরি হালকা রঙ পড়তে অভ্যস্ত। এরকম ডীপ কিছু না সে কখনো পড়েছে না কেউ তাকে গিফট করবার সাহস পেয়েছে। তাহলে কে দিয়ে গেলো এটা ওকে! পাঞ্জাবি টা ভালো করে দেখতে গিয়েই খেয়াল করলো সাইড পকেটে কি যেনো একটা ঝুলছে। উজান সেটা হাতড়াতেই বেড়িয়ে আসলো হিয়াকে গিফট করা সেই পায়েল টা। উজানের আর বুঝতে বাকি থাকলো না হিয়াই তাকে এ-ই পাঞ্জাবি টা গিফট দিয়েছে তাহলে। কিন্তু সে যে এতো কড়া রঙ কখনো পড়ে না। একবার তো দাদিমণিই তার জন্য নিয়ে এসেছিলো এরকমই কড়া রঙের দুটো শার্ট তখনো সে সেটা পড়েনি কিন্তু আজ! কিছুক্ষণ বাদে উজানের নাম্বারে একটা টেক্সট আসতেই উজান সেটা ব্যবসায়িক জরুরি কিছু ভেবে পড়তে গিয়েই দেখে হিয়ার নাম্বার! আরো অবাক হলো উজান। কারণ আজ অবধি একই বাড়িতে থাকার দরুন কখনো টেক্সট এ তাদের কথা বলতে হয়নি যা দরকার হতো সেটা ডিরেক্ট কল বা সামনাসামনি কথার মাধ্যমেই হয়ে উঠতো। আজ প্রথম হিয়া টেক্সট করেছে মানে স্পেশাল কিছু তো বটেই। উজান টেক্সট টা ওপেন করতেই মোটা মোটা বাংলা হরফে লেখা কয়েকটি লাইন বেরিয়ে এলো” দেখুন আমি এ কদিনে যেটুকু যা পেরেছি আমার সব দিয়ে আপনার জন্য এই পাঞ্জাবিটা নিজ হাতে সেলাই করেছি। এখন আপনি যদি না পড়েন তাহলে আপনার দেওয়া এই পায়েলো আমি পড়বো না। ওটা আপনি আপনার কাছেই রাখুন,হিয়া”
মুখটা বাংলার পাঁচের মতো হয়ে গেলো উজানের। চুপসে গিয়ে বেচারা ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। এক হাতে পাঞ্জাবি তো আরেক হাতে ফোন নিয়ে হিয়ার ঔ টেক্সট, বেচারা এখন হাসবে না কাঁদবে উপর মাবূদ ই ভালো জানেন।
!
!
নিচে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে বসে বাড়ির সব আত্নীয় স্বজন নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলো। সবার পড়নেই লাল সাদার সমাহার। নানা স্বাদের গল্পের ফুলঝুরিতে মেতে উঠেছে বড় থেকে মাঝবয়সী সবাই। দেখতে ভারী মিষ্টি লাগছে এ-ই মুহুর্ত টাকে যেনো সুখের রাজ্যের এক ফালি সুখ এসে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলছে শাহরিয়ার কুঞ্জকে। কিন্তু কে বলবে এই এতো আনন্দ মুখোর পরিবেশের আড়ালে লুকিয়ে আছে সবার কিছু পাওনার চাহিদা।
দাদিমণির পাশে স্পর্শকে কোলে নিয়ে সবার সাথে গল্পে হিয়াও মেতে উঠেছে। কেউ কেউ খুব বিনয়ী ভঙ্গিতে হিয়ার সাথে কথা বলছে কেউ বা গল্প করছে নিজেদের নিয়ে। মেহু ব্যস্ত তার সময়বয়সী এক কাজিনের সাথে তার গল্প সারতে। বাচ্চা গুলো ব্যস্ত ছোটাছুটি করতে। সবার এই গল্পের মাঝে উপর সিঁড়ি বেয়ে লাল পাঞ্জাবির হাতা টা গোটাতে গোটাতে নিচে নেমে আসছিলো উজান। উজানকে আসতে দেখে কথার মাঝে কথা থামিয়ে দিলো সবাই। লাল পাঞ্জাবি সাদা চুড়িদার হাতে একটা ব্লাক ঘড়ি চুল গুলোও নিয়ম করে আছড়ানো, এইতো ব্যাছ সুপুরুষ মার্জিত সাজে নিজেকে উপস্থাপন করতে তৈরি উজান। হিয়া উজানের দিকে তাকাতেই বুকে হালকা ব্যাথা অনুভব করলো মনে মনে বললো লোকটা এতো সুন্দর না হলেও পারতো ধুর। হিয়া মুচকি হাসলো উজানের চোখে চোখ পড়তেই মাথা নুইয়ে নিলো। উজান এসে সোজা বসে গেলো পাশেই অফিস ঘরের বড় চেয়ার টাতে। বাড়ির বাকি ছেলেরা এসে বসলো উজানকে ঘিরে। উজান নিবিড়ের দেওয়া ফাইলপএ গুলো খুলে দেখতে থাকলো। ফ্রেম বিহীন চিকন চশমা টা উজানের গাম্ভীর্য টাকে যেনো একটু বেশি বাড়িয়ে তুললো। খুব গভীর মনোযোগে উজান সবার কি পাওনা কতোটুকু বাকি আছে বুঝিয়ে দিতে থাকলো। এর মাঝে আবার স্পর্শ এক পা দু পা করে হেঁটে হেটে তার মামার কাছে এসে তার কোলে উঠবে বলে বায়না শুরু করলো। উজান স্পর্শকে কোলে নিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। স্পর্শ কখনো তার কলম কেড়ে নিচ্ছে কখনো বা উল্টে দিচ্ছে সব কাগজপত্র। হিয়া দৌড়ে আসলো। দৌড়ে এসে সবার মাঝে উপস্থিত হয়ে আমতাআমতা করতে থাকলো। ভুল সময়ে অফিস ঘরে এসে পৌঁছালো না তো! হিয়া স্পর্শকে কোলে নিতে চেয়েও হতাশ হতে হলো তাকে উপরন্তু অফিস ঘরের কোনায় গিয়ে স্পর্শ শুরু করলো হিয়ার সাথে তার লুকোচুরি খেলা। বড্ড অস্বস্তিতে পড়ে গেলো হিয়া। উজান আবার মনোযোগ দিলো তার কাজে। সবাই চুপ হয়ে শুনতে থাকলো সেই হিসাব। এদিকে উজানকে আজ যতো দেখছে ততোই অবাক হচ্ছে হিয়া৷ এতো সূক্ষ্ম করে সব কিছু পরিমাপ করে সে সবাইকে বিতরণ করছে,কি গাম্ভীর্য সেই কন্ঠে,কি শক্ত কিন্তু ন্যায়ের চাহনি উজানের চোখ দুটোতে,বসার ভঙ্গিটাও কতো পরিমার্জিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একটা মানুষ এতো পারফেক্ট না হলেও বুঝি কোনো কমতি থাকতো না। হিয়া উজানের থেকে চোখ নামিয়ে আবার মনোযোগ দিলো স্পর্শের দিকে। আজ বড্ড পাখা গজিয়েছে বাচ্চা টার বুঝি,ইয়া মার সাথে মজা করে খেলতে তার বেশ লাগছিলো। অনেক কষ্টে স্পর্শকে নিয়ে অফিস ঘর থেকে বের হতে সক্ষম হলো হিয়া। এরপর আর কিছুক্ষণ আলাপচারিতা চালানোর পর শেষ হলো পুরানো বছরের সব হিসাবনিকাশ। শুরু হলো নতুন হাল খাতার সূচনা। সেই সুবাদে উজান দাদিমণিকে বললো সবার মুখ মিষ্টি করিয়ে দেও। দাদিমণি সবাইকে মুখে মুখে মিষ্টি বিলিয়ে দিতে থাকলেন। কেউবা প্যাকেট হতে নিজেই হাত দিয়ে নিজের মিষ্টি টা তুলে মুখে ঢুকে নিলেন। দাদিমণি এবার প্যাকেট হতে একটা মিষ্টি তুলে হিয়াকে খাইয়ে দিতে যাবে ওমনি উজান দাদিমণিকে থামিয়ে দিলেন,হিয়া মুখ টা হা করেও পর মুহুর্তে বন্ধ করে নিলেন। মনটা খারাপ হয়ে আসলো তার। হিয়া ভাবলো হয়তো ওদের খুশির মিষ্টি তাই হয়তো ওর এতে কোনো ভাগ থাকতে নেই। হিয়া একটা মেকি হাসি দিয়ে ড্রয়িংরুম ত্যাগ করতে যাবে ওমনি উজান হিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
-কোথায় যাচ্ছেন আবার?_দেখি হা করুন _কি হলো হা করুন।
হিয়া একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসলো। একটু আগেই তো মিষ্টি খেতে দিবে না বলে বারণ করলো এখন আবার কিসের জন্য হা করতে বলছে উনি। উজানের আরেকবার মোটা গলা শুনেই হিয়া টপাটপ হা করে নিতেই উজান ওর হাতে থাকা মিষ্টির প্যাকেট থেকে একটা কালোজাম বের করে হিয়ার মুখে ঢুকে দিতে দিতে বললো,
-তুমি কি ভূলে গেছো দাদিমণি উনি সাদা মিষ্টি খেতে পছন্দ করেন না!
দাদিমণি হাসলো। সাথে চোখ বড় বড় করে তাকালো হিয়া। উজান কিছু বললো না। প্যাকেট টা আরেকটা সার্ভেন্টের হাতে দিয়ে উপরে চলে আসলো। এদিকে সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হিয়ার দিকে। মেহুর শরীর তো রাগে ঝনঝন করছে। সবার এরকম চাহনিতে হিয়া লজ্জায় পুরো তলিয়ে যেতে থাকলো। এ-ই কাজ টা উজান সবার সামনে না করলেও পারতো! হু
!
!
এদিকে সবার সাথে গল্প হাসি মজা করতে করতে কখন যে দুপুর দুটোর কাছাকাছি হয়ে আসলো কারোই তেমন হুঁশে নেই। সবাই বসে গেছে ডাইনিংএ বৈশাখের নিয়ম অনুযায়ী পান্তা-ইলিশ খেতে। যদিও দাদিমণি সহ কিছুজন পান্তাকে বেছে নিলেও বাকি সবাই গরম ভাত টাই পেফার করলো। ইলিশের মোহ মোহ গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো শাহরিয়ার কুঞ্জে। বাড়িতে তো মাছ রান্না হলেই কোথা হতে এক হুলোবেড়াল এসে লেজ তুলে তার অস্তিত্বের জানান দিতো, তার উপর আজ আরো দুটো বিড়াল রান্নাঘরের দেওয়া টপকে শাহরিয়ার কুঞ্জে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে অস্থির। যাগ এদের একটা বিড়ালকে মাছের লোভ দেখিয়ে তার সাথে খেলা করে স্পর্শকে খাওয়ানো তো যাবে। আপাতত ডাইনিং এ মহিলাদের রাজ চলছে, ছেলেরা বাহিরে সবার মাঝে মিষ্টি আর নতুন বস্এ বিতরণে ব্যাস্ত। সেই সব বিতরণের সমাপ্তি ঘটলে সবাই বাড়ি ফিরে। কেউ বা এসে বসে যায় পান্তা-ইলিশের মজা নিতে কেউ বা ভাজা ইলিশের সাথে সর্ষে ইলিশেরও স্বাদ মেটাতে। দাদিমণি উজানকে ডেকে বললো তুই ও তোর চাচাদের সাথে বসে যা” উজান বললো না তোমরা খেয়ে উঠে আমি উপর থেকে আসছি। সাথে চোখের ইশারায় জানতে চাইলো হিয়া কোথায় দাদিমণি? দাদিমণি কথার ছলে বলে দিলেন “এই হিয়াটাও না বড্ড অবাধ্য আমার,কতো করে বললাম একসাথে বসে খাই কিন্তু তারতো আগে স্পর্শকে খাওয়ানো চাই। এখন এই স্পর্শকে খাওয়ানো যে কখন হবে তার” উজান হাসলো। তারমানে ম্যাডাম উপরে স্পর্শকে খাওয়াচ্ছে। উজান উপরে আসতেই সোজা স্পর্শের রুমে আসলো। হিয়া উজানকে দেখেও চোখ নামিয়ে নিলো। লজ্জা রাগ দুটোই হচ্ছে তার আজ। কেনো উজান ডাইনিং এ সবার সামনে তখন ওরকম করলো। হিয়া একবার হুলোবেড়াল টাকে মাছের কাটা ছিটিয়ে দিচ্ছে তো কখনো সেই বেড়ালের লোভ দেখিয়ে স্পর্শের মুখে খাবার ঢুকে দিচ্ছে। উজান এসে বিছানায় বসে দেখতে থাকলো হিয়ার কান্ড। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে মাথা টা খোঁপা করে রাখা হিয়ার। কিছু চুল সামনে বের করে দেওয়া এ-ই যা। না আছে কোনো রঙের আবরণ না একটা টিপের ছোঁয়া। এতেই এ-ই লাল সাদা শাড়িতে স্নিগ্ধতার মতোই শীতল লাগছে হিয়াকে যেনো। স্পর্শকে খাওয়াতে গিয়ে কাহিল হিয়া। একটু দম নিয়ে এসে বসলো সে উজানের পাশে। উজানের এই বা সাইডের বাহু টা বড্ড প্রিয় হিয়ার। তাইতো আজো সেখানে কপাল ঠুকে দিলো হিয়া। উজান ওর ডান হাত রাখলো হিয়ার মাথায়!
– সকাল থেকে উঠে এতো ছোটাছুটি করছেন শরীর তো ক্লান্ত হবেই,একটু কি বসে থাকা যায় না।
হিয়া হাসলো। উজানের বাহু থেকে মুখ তুলে ক্লান্তি মুখে বললো,
-আমি ঠিক আছি আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আপনি ফিরলেন কখন? খেয়েছেন দুপুরে?
-না এখনো খাইনি,
-সেকি কটা বাজে। আপনি না ঠিক সময়ে খেতে না পারলে কতো রাগারাগি করেন। দাদিমণি নেই নিচে। আমি বলবো আপনাকে খেতে দিতে।
-ইচ্ছে নেই খাওয়ার।
-কেনো হঠাৎ। শরীর ঠিক আছে তো, দেখি?
– আমি একদম ঠিক আছি। আপনি অস্থির হবেন না। আসলে ইলিশে খুব কাটা আমি বাছতে পারি না। তবে কেউ যদি স্পর্শের মতো বেছে বেছে খাইয়ে দেয় তাহলে….
হিয়া কপাল কুঁচকে উজানের দিকে তাকালো। তারমানে সাহেবের আজ হিয়ার হাতে খেতে ইচ্ছে করছে। তা সেটা সোজাসুজি বললেই তো হচ্ছে না-কি। হিয়া হেঁসে দিয়ে বললো একটু বসুন আমি এক্ষুনি আসছি। হিয়া দৌড়ে গিয়ে উজানের জন্য আরো একটু গরম ভাত দুটো ইলিশ ভাজা আর একটা সর্ষে দেওয়া ইলিশ নিয়ে আসলো। মধুর হাতে,পরম যত্নে খাওয়াতে থাকলো উজান স্পর্শ দু’জনকেই। স্পর্শো লায় পেয়ে গেলো, মামার সাথে মজার সুখে খেতে থাকলো মাছ ভাজা। হিয়া তো বড্ড ভয় পাচ্ছে যদি একটা কাটা ঢুকে যায় বাচ্চাটার গলায়। কিন্তু কেউ শুনলে তো তার কথা। পাছে তো কেউ দেখে ফেলারো ভয় আছে প্রচন্ড। দু’জনকে খাইয়ে দিয়ে হিয়া প্রথমে স্পর্শের মুখ মুছে দিলো এরপর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিলো উজানের,,
-হয়েছে না খাওয়া। আমি তো ভাবলাম একটা মাছ খেয়েই আর খেতে চাইবেন না আপনি কিন্তু দেখুন পরপর তিনটেই গপ-গপ করে খেয়ে নিলেন। এতো রাক্ষস আপনি!
-আমি রাক্ষস! আর আপনি যে এতো স্বাদ করে খাইয়ে দিলেন লোভ সামলাতে পারলাম কোথায়.
– ওহ! স্বাদ করে খাইয়েছি বলে খেলেন আপনি। আর রান্না টা বোধহয় ভালো লাগেনি!
– রান্না টা আপনি করেছিলেন?
-না আমার ভূত করেছিলো। এবার যান তো এ রুম থেকে। অনেকক্ষণ হলো ঢুকেছেন এরপর কেউ দেখলেই বিপদ,
-কেউ কিচ্ছু বলবে না,
-আপনি তো সব জানেন তাই না। যাবেন কি! আমি এখন বাচ্চা টাকে ঘুম পাড়াবো।
-যাচ্ছি এতে এতো রেগে যাবার কি হলো। বিকেলে কিন্তু তৈরি থাকবেন বের হবো আপনাদের দু’জনকে নিয়ে।
-আমি বের হলে তো আপনার সাথে। যাবেন কি আপনি এবার না আমি তাড়িয়ে দেবো!যান নাআআ
!
!
স্পর্শকে দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে হিয়াও একটু তার শরীর টা বিছানায় মেলে দিতেই দাদিমণির গলা শুনে হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লো সে। নিচে নেমে এসেই শুনতে পেলো দাদামণি নিবিড় সাহেব কে বলে কিসের যেনো ঔষধ আনতে পাঠাচ্ছে। হিয়া ভয় পেয়ে গেলো কার আবার কি হলো এসময় হঠাৎ। হিয়া দৌড়ে এসে দাদিমনির কাছে জানতে চাইলো কি হয়েছে দাদিমণি।দাদিমণি উওর করলো,
– কি আর হবে। উজানের সাড়া শরীরে এ্যালার্জি ফুটে উঠেছে। কি রকম বড় বড় লাল চাকা হয়ে যাচ্ছে দেখলেই গা শিউরে উঠছে,
হিয়া হতবাক হয়ে গেলো,অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,
– হ হঠাৎ এরকম হলো কেনো। উনি উনি কোথায় এখন?
– কি জানি। ইলিশে তো ওর বড্ড এ্যালার্জি তাই জন্য তো আজ আলাদা করে অন্য মাছ রান্না করা হলো। ভূলে আবার খেয়ে নিয়েছে কি না কে জানে।
হিয়া থমকে গেলো। তাহলে এ-ই জন্যই। কিন্তু উজানকে খাইয়ে দেবার সময় সে তো কিছুই বললো না যে তার। হিয়া উপরে আসতেই দেখলো উজানকে ঘিরে ওর মা বোন চাচিরা সবাই অস্থির হয়ে কি থেকে কি না কি করছে। কেউ হলুদ এনে লাগাচ্ছে কেউ বা যা পাচ্ছে সেই ক্রীমই ডোলে দিচ্ছে উজানের শরীরে। হিয়া সাহস করে ভেতরে যেতেও পারছে না। এদিকে উজানের এ-ই করুন অবস্থার জন্য নিজেকে একমাত্র দায়ি মনে হচ্ছে তার। ইশশ তার একটা ভুলের জন্য কি না। হিয়ার তো খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো সবাইকে পাশ কাটিয়ে একটু উজানকে দেখতে। তাকে ছুঁইয়ে দেখতে সে ঠিক আছে তো। কিন্তু সে সাহস করে রুমে যেতে পারলো না। একটা অস্বস্তি এসে ঘিরে ধরতে শুরু করলো তাকে। আধাঘন্টা বাদে নিবিড় ঔষধ আর মলম নিয়ে আসতেই সেগুলো উজানকে দিয়ে তার শরীরে মলম লাগিয়ে দিলেন উজানের মা। উজান বললো হয়েছে এবার যাও তোমরা আমি একটু বিশ্রাম নিতে চাই। সবাই এক এক করে বেড়িয়ে নিজের রুমে বিশ্রামের জন্য চলে আসলো৷ সবাইকে নিজের রুমে বিশ্রামরত অবস্থায় দেখে হিয়া সুযোগ বুঝে পা টিপে টিপে উজানের রুমে আসলো। উজান তখন ওর হাতে ওঠা এ্যালার্জি টাকে খুতিয়ে দেখতে ব্যস্ত। উজানের গায়ে ছিলো না কোনো কাপড়। বুকে পিঠে সব জায়গায় ঔষধ মাখিয়ে রাখা। হিয়া আসতেই উজান উঠে গিয়ে ওর শার্ট খুঁজতে শুরু করলো। কিন্তু তার আগেই হিয়া অঝোরে কেঁদে উঠলো। উজান হিয়ার এই কান্নার কারণ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলো। দূত হাতে ঘরের গেট লাগিয়ে দিয়ে এসে হিয়াকে ধরতেই হিয়া তার সব কিছু উজার করে উজানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।
– সব আমার জন্য। আমি না বুঝে না জেনে আপনাকে। আপনি কেনো বললেন না যে ইলিশে আপনার এরকম এ্যালার্জি হয়। খুব খুব খুব খারাপ আপনি খুব বাজে। এটা আপনি একদমই ঠিক করেননি উজান। আজ যদি একটা বড় কিছু হয়ে যেতো আপনি জানেন কিছু কিছু এ্যালার্জি কতো খারাপ হয়। আমি ঔষুধ জ্যেঠুর সাথে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে এ-ই এ্যালার্জির জন্য কতো….
হিয়ার ননস্টপ কথাতে মাথা ঘুরে গেলে উজানের। মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু বলার আগে হিয়া আরো ডুকরে কেঁদে উঠলো। উজান হেঁসে দিলো অনেক কষ্টে হিয়াকে শান্ত করে নিজের বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজে নিচে বসে পড়লো। মুখটা আলতো করে রাখলো হিয়ার দু হাঁটুর উপর। হিয়া মাথা নুইয়ে নিলো। হাত দিয়ে নাক মুছতে মুছতে আবারো বলে উঠলো,
-কেনো আপনি আমাকে একেবারের জন্য বললেন না আপনার ইলিশে এ্যালার্জি। কতো কষ্ট হচ্ছে আপনার। আমার আরো সচেতন থাকা লাগতো। আমি কি করে..
-হিয়া হিয়া হিয়া চুপ। আর না। আমি যদি বলতাম আমার এরকম এ্যালার্জির কথা তাহলে নিশ্চয় আপনার হাত থেকে এ-তো সুন্দর করে খাইয়ে নেবার স্বাদ পেতাম না নিশ্চয়ই।
-একদম বাজে কথা বলবেন না। আমার হাতে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে তাহলে অন্য কিছু খেতেন তাই জন্য। দেখি। কি রকম হয়েছে। তখন তো আমি ঢুকতেই পারলাম না রুমে দেখি এখন,
হিয়া উঠে দাড়ালো। সাথে উজানো। হিয়া উজানের সারা শরীর খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে দেখতে শুরু করলো। ইসস সাদা শরীরে এ্যালার্জির লাল লাল চিহ্ন একটু বেশি মানিয়েছে মনে হয়। হিয়া চিন্তিত কিন্তু উজান লজ্জিত!
-মিস মুনতাসীর আপনি কিন্তু এবার আমাকে লজ্জা পাইয়ে দিচ্ছেন। এভাবে খালি গায়ে আমাকে দেখতে থাকলে কিন্তু আমিইই..
হিয়া হুঁশে ফিরলো। ধ্যাত কি করছিলো সে এতোক্ষণ। লজ্জায় রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে ধরবে ওমনি উজান হিয়ার হাত ধরে হিয়াকে থামিয়ে দিয়ে নিজের বুকের কাছে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দেয়। উজানের নিশ্বাস এসে পড়তে শুরু করে হিয়ার খোলা পিঠ জুড়ে। মুহুর্তে লজ্জার রক্তিম আভায় ছেয়ে যায় হিয়া। হিয়া উজানের থেকে পালাতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। উজান তাকে আরো কাছে নিয়ে এসে তার মুখ টা ছুঁইয়ে দেয় হিয়ার কানে আর বলতে থাকে,
– ঠিক করেছি বাড়িতে যখন সবাই আছেই তাই এরই মধ্যে দাদিমণিকে বলে আপনার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠিয়ে দিয়ে আসবো। কি রাজি তো আপনি?
হিয়া শিউরে উঠলো ভাললাগার পাশাপাশি এক অদ্ভুত অনুভূতি এসে ঘিরে ধরলো তাকে। হিয়া মুখ ঘুরিয়ে উজানের দিকে ফিরলো,
– উজান আপনি আমার থেকে অনেক ভালো কাউকে পাবার যোগ্যতা রাখেন। আমার অতীতটা জানলে আপনি কখনো আপনাকে.
-চুপ,আমি বলেছি না আপনার অতীত সম্পর্কে জানার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। এরপরো কেনো বারবার এ-ই কথাটা আপনি নিয়ে আসুন বলুন তো আমাদের মাঝে। দিলেন তো মুমেন্ট টা নষ্ট করে,
– আপনার ইচ্ছে না থাকলেও আজ আপনাকে সবটা শুনতে হবে। বিবাহের মতো একটা পবিএ সম্পর্কে যাবার আগে আপনার আমার সম্পর্কে সত্যি টা জানা উচিৎ। প্লিজ আপনি আজ সেটা শুনতে বারণ করবেন না।
-কি শুনবো বলুন তো,বারবার এক কথা আপনার। বলেছি না আপনার অতীত সম্পর্কে কোনো ইন্টারেস্ট নেই আমার,
-আমি যদি বলি অতীতে আমি একশোটা বিয়ে করেছি তাও না,
-আপনি যদি বলেন অতীতে আপনার একশোটা বাচ্চা ছিলো তাও না।
শুনে রেগে গেলো হিয়া। কেনো উজান ওর কথাটাকে গুরুত্ব না দিয়ে এরকম হেলাফেলা করছে। রাগান্বিত হিয়াকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো উজান। হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো যা হয়েছে সব ভুলে যান হিয়া। এতো কিসের চিন্তা আপনার আমি আছি তো৷ হিয়া কিছু বলতে গিয়েও উজান হিয়ার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলো। নিজের ঠোঁটে উজানের হাতের পরশ পেতে কেঁপে উঠলো হিয়া। কি অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে দেখো। উজান নিজের মুখ টা হিয়ার দিকে ঝুঁকে নিতেই হিয়া তার চোখ বন্ধ করে শাড়ির আঁচল চিপে ধরলো। দু’জনের নিশ্বাস জড়ো হতে হতে সেটা একসাথে বাঁধা পড়ার আগেই উজান তার ঠোঁট দুটোকে হিয়ার কপালে ছুঁইয়ে দিয়ে বললো “পাগলি,ছিচঁকাদুনে পাগলি একটা,চোখ গুলো কেঁদে ফুলে কেমন গোল হয়ে আছে দেখো” হিয়া হাসলো,বললো দরজা খুলুন এরপর কেউ এসে দেখলেই বিপদে পড়তে হবে। উজান আর কথা বাড়ালো না শার্ট টা গায়ে দিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো মেহু দাঁড়িয়ে। হাতে তার একটা ল্যাপটপ। একটা ডেভিলমার্কা হাসি দিয়ে মেহু ঘরে ঢুকতেই বলে উঠলো
-আমি জানতাম তুমি এ ঘরেই আছো,,, তা হিয়া দেখো তো এদিকে,এদেরকে চিনতে পারো কি না?
হিয়া অবাক চোখে ল্যাপটপের স্ক্রীনে তাকাতেই কেঁপে উঠলো। তার আর বিহানের একটা ছবি জ্বলজ্বল করছে সেই স্ক্রীনে। হিয়ার সাথে দাঁড়িয়ে ছবিটা দেখছে উজান নিজেও!
দাদিমণি কে তার হাঁটুর ডক্টর দেখিয়ে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে তখন রাত সাড়ে আটটা।বাড়িতে ঢুকেই স্পর্শকে তার মায়ের কোলে দেখে খুব একটা অবাক না হয়ে বরং খুশি হলো উজান। যাগ সারাদিনে তার মায়ের মুখে হাসি ফুটেছে তাহলে। কিছুক্ষন তার মা, মেহু দাদিমণির সাথে একান্তে একটা মিষ্টি মুহুর্ত কাটিয়ে উজান ফ্রেশ হতে তার রুমে আসলো। ফ্রেশ হয়ে কিছু ব্যাবসায়িক কাগজপএ দেখে নিতে থাকলো উজান। এদিকে রাতে তখন খাবারের সময়ো হয়ে আসলে উজান সব গুছিয়ে ডাইনিং এ এসে তার চেয়ারে বসে যায়। সাথে তার এপাশে লম্বালম্বি বসে যায় তার মা, মেহু দাদিমণি। নিবিড় এসে উজানের পাশে বসলো৷ নিবিড়ের চোয়াল শক্ত। রাগে দুচোখ জলজল করছে তার। একটু আগে হিয়াকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসলো সে। কতোবার সে তার স্যারকে ফোন করলো কিন্তু স্যারের কি একটু সময় হলো না তার ফোন টা রিসিভ করার। উজান নিজের মতো কথা বলে যাচ্ছিলো সবার সাথে। যথারীতি সার্ভেন্ট এসে খাবার দিতেই উজান খেয়াল করলো দাদিমণির পাশে আজ হিয়া নেই। একটু অবাক হলো উজান। সোজা হ’য়ে বসে দাদিমণিকে প্রশ্ন করলো হিয়া কোথায় দাদিমণি?দাদিমণি অবাক চোখে উওর করলো,
-হিয়া কোথায় মানে। আমি তো ভাবলাম স্পর্শকে নিয়ে সে তোর রুমে আছে।
-আমার রুমে আছে মানে। কোথায়,উনি তো আমার রুমে নেই!
-তাহলে আছে হয়তো কোথাও। ছাঁদে গিয়ে দেখ এই রাতেও বসে বাচ্চা টাকে নিয়ে গল্প দিচ্ছে।
-তাই বলে খাবার সময় খেতে আসবেন না উনি। আচ্ছা তোমরা বসো আমি গিয়ে ওনাকে ডেকে আনছি। ইদানীং বড্ড অবাধ্য হয়ে যাচ্ছেন উনি আমার। একটু যদি নিজের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে যত্নবান হোন।
উজান উঠতে যাবে ওমনি নিবিড় বলে উঠে”হিয়া ম্যাম ছাঁদে নেই।খুঁজতে হলে অন্য কোথাও গিয়ে খুঁজেন,এখানে নয়”উজান হতবাক হয়ে গেলো।যেনো মনে হলো নিবিড় কি বলছে তা সে বুঝতে পারেনি।
নিবিড় কিছু বলার আগে উজানের মা দূঢ় হয়ে বলতে শুরু করলেন,
-হিয়া আর এ বাড়িতে নেই।
উজান অবাক দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো,
-বাড়িতে নেই মানে?
-বাড়িতে নেই মানে আমি ওকে বাদ দিয়ে দিয়েছি। দেখ উজান এখন তো আমি এসে গিয়েছি তাই না আর আমি ঠিক করেছি আমি এখন থেকে এ বাড়িতেই থাকবো তাই স্পর্শের জন্য আলাদা করে কাউকে তোকে রাখতে হবে না। আমি পাড়বো তাকে সামলাতে।
উজান ক্ষেপে উঠলো। এরকম একটা কথার জন্য সে মোটেও তৈরি ছিলো না।
-তুমি আমাকে না জানিয়ে কি করে এই সিদ্ধান্ত টা নিতে পারলে। তোমার কি একবারো মনে হয় নি যে কথাটা আমাকে একবার জানানো কতো টা জরুরি। প্রথমদিম এসেই তুমি কি করে,
– কি করে মানে। আমি থাকতে স্পর্শের জন্য কোনো আয়ার প্রয়োজন নেই বলে আমি মনে করি তাই আমি!
-হিয়া স্পর্শের কোনো আয়া না। হিয়া স্পর্শের মা!
কথাটা কাঠ কাঠ কন্ঠে উজান সবাইকে জানিয়ে দিলো।
-হিয়া কোথায় নিবিড়? আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি নিবিড় এ্যান্সর মি ড্যাম ইট।
-চলে গেছে। সে আর কখনো আসবে না বলেছে। ঠিকি আছে তার চলে যাওয়াই ভালো হয়েছে। কি পেলো আপনাদের জন্য এতো করে। এ-ই এতো অপমান। আমি তো ভাবতেও পারছি না আমি আপনাদের মতো মানুষদের বাড়িতে কাজ করে এসেছি এতোদিন। যাদের কাছে মানুষের কর্মের কোনো দাম নেই ছিঃ
– কোথায় রেখে আসছো তুমি হিয়াকে নিবিড়?
-স্টেশনে রেখে দিয়ে আসছি।
-কয়টার ট্রেন?
-দশ-টা দশ। যাগ চলে ম্যাম। তখন দেখবো স্পর্শ বাবাকে কে সামলে রাখে। কে আপনাদের স্পর্শকে সারারাত জেগে সুস্থ করে তুলে।
উজান একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। গাড়ির চাবিটা টেবিল থেকে তুলে রওনা দিলো সোজা স্টেশনের উদ্দেশ্যে।
ঘড়িতে তখন নয়টা চল্লিশ। আর কিছুক্ষণ বাদে ট্রেন ছাড়ার সময়। কিন্তু দেশের ট্রেন যে আধা ঘণ্টা দেড়িতে হলেও ছাড়বে এটা এ দেশের নিয়মই। সবাই প্লাটফর্মে যার যার লাগেজ নিয়ে ট্রেন আসার অপেক্ষায় বসে আছে। কেউ কেউ ফাঁকা চেয়ার পেয়ে গা এলিয়ে শুইয়ে আছে কেউ বা সময় কাটাতে টিপছে ফোন৷ কেউ বা হাঁটাহাটি করছে তার প্রিয় মানুষ টার সাথে। এ-তো ভীড়ের মধ্যে এক কোণে একটা ছোট্ট বসার জায়গায় বসে আছে হিয়া। লাগেজ টা ডান দিকে রেখে মাথা টা সেখানে দিয়ে চুপ হয়ে আছে। এতো কোলাহলের মাঝেও বুকে তার আকাশ সমান শূন্যতা এসে জোড়ো হচ্ছে। একদিকে উজানের মায়ের সেই নোংরা অপবাদ তো আরেকদিকে স্পর্শের চিন্তা চুবিয়ে খাচ্ছে হিয়াকে। উজানের মায়ের কথাটা যাও বা হিয়া ভুলতে চেষ্টা করলো কিন্তু স্পর্শের কথা ভেবেই তার বুক খালি হ’য়ে আসছে। তার অনুপস্থিতিতে দাদিমণি,উজান,নিবিড় এরা পারবে তো তার বাচ্চা টাকে ভালো রাখতে। বের হবার পথে সে যাও বা বাচ্চা টাকে কোলে নিয়ে একটু আদর করতে চাইলো কিন্তু মেহু কিরকম করে তার কোল থেকে বাচ্চা টাকে কেঁড়ে নিয়ে নিলো। বাচ্চা টার সেই চিৎকারো কি মেহুর মন গলাতে পারলো না। চোখের পানি অঝোরে বয়ে পড়ছে হিয়ার। বারবার সেই পানি গুলো মুছে নিয়ে হিয়া নিজেকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই স্পর্শকে রেখে আসার যন্ত্রণা তার সহ্য হচ্ছে না। আচ্ছা স্পর্শের নিজের মা হলে কি এটা করতে পারতো। হিয়া কি পারতো না সব অপমান সহ্য করে বাচ্চা টার জন্য থেকে যেতে। হিয়া কি স্পর্শের কাছে স্বার্থপর মা হ’য়ে পরিচয় দিয়ে বসলো। এসব আকাশকুসুম চিন্তা ভাবনা এসে ঘিরে ধরতে থাকলো হিয়াকে। বুক ফেটে চিৎকার করে কাঁদতে পেলে হয়তো একটু শান্তি মিটতো তার। ফোন টা বের করে ওয়ালপেপারে রাখা স্পর্শের খালি গায়ের নাদুসনুদুস ছবি টা বের করে দেখতে গিয়ে কান্নার বাঁধ পুরোটাই ভেঙে গেলো হিয়ার। ফোনটা বুকে চাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করলো সে।
-আমার বাচ্চাটার তো খাওয়ার সময় হইছে। কেউ কি আছে ওকে খাওয়ানোর। দাদিমণি কি আসছে। উনি পারবে তো ধর্য্য ধরে তাকে খাওয়াতে। আমার বাচ্চা টা নিশ্চয় এতোক্ষণে আমাকে দেখতে না পেয়ে কাঁদছে। আমি কি যাবো ফিরে তার কাছে। আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিবে ওরা…
হিয়া স্পর্শের ছবিটা বুকে জড়িয়ে নিজ মনে কথা গুলো বলতে বলতে কান্না করতে থাকে।কিছু সময় বাদে উজান আসে। এতো ভীড়ের মাঝেও তাকে তার হিয়াকে খুঁজে পেতে খুব একটা খাটনি করতে হয় না। হিয়াকে খুঁজে হিয়ার পাশে বসে হিয়ার মাথায় নিজের একটা হাত রাখে উজান। হিয়া চোখ না খুলেই অনুভব করতে পারে এটা ঠিক কার নিশ্বাসের গন্ধ। হিয়া অকপটে জড়িয়ে ধরে উজানকে। ডুকরে কেঁদে উঠে উজানকে গায়ের সর্বশক্তিদিয়ে জাপ্টে ধরে হিয়া,কান্না রত কন্ঠে বলতে থাকে,
-আমার বাচ্চা টার তো খাওয়ার সময় হয়ে গেছে উজান। আপনারা কি খেতে দিয়েছেন ওকে। ওহ তো আমি ছাড়া কারো কাছে খেতে চায় না। দাদিমণি পারবে আমার বাচ্চা টাকে খাওয়াতে। দাদিমণি কে বলে দিন না স্পর্শকে ফো ফোনে কার্টুন চালিয়ে না দিলে সে খায় না। ও উজান বলুন না আমার বাচ্চা টা ঠিক আছে তো!
উজান একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো,
-এতো যখন কষ্ট হচ্ছে নিজের বাচ্চার জন্য তাহলে ওকে এভাবে রেখে চলে আসলেন কিসের জন্য আপনি। আপনি জানেন না পরশ তার এই ইয়া মা’কে কতোটা ভালোবাসে।
-এতো অপমান নিয়ে ও বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না উজান। এতোটা মেরুদণ্ডহীন আমি নই।
উজান নিজের বুক থেকে হিয়ার মুখ তুলে হিয়ার দু গালে হাত রাখলো। হিয়ার চোখের পানি গুলো মুছে দিয়ে বললো “আমি জানি আপনি কিরকম। আর কারো না জানলেও চলবে। চলুন এখন বাড়ি ফিরবো আমরা” হিয়া দুহাতে তার চোখ মুছে বললো না সে ফিরবে না। উজান অনেক বার হিয়াকে অনুরোধ করলো,স্পর্শের দোহাই দিয়ে হলেও বললো বাচ্চা টার জন্য ফিরুন একবার। হিয়া শুনলো না। আর যা-ই হোক এ-তো অপমান হয়তো বিহান বিয়ে ভেঙে দিয়েও তার সাথে করে নি।
-আমি আপনার ভোগের বস্তু নই উজান। আপনার মা আমাকে বাজারের মেয়ের সাথে তুলনা করেছে এরপরো আপনি বলছেন ওরকম একটা বাড়িতে ফিরে যেতে।
-আর কি বলেছে মা আপনাকে?
-আমি বলতে পারবো না। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে আমায় ফিরতে হবে।
– আপনি কোত্থাও যাবেন না হিয়া!
-আপনি আমাকে আর দূর্বল করবেন না দয়া করে। আমাকে যেতে দিন এমনিতেও আমার বৈশাখের পরে ইনকোর্স হবার কথা।আমাকে তখন এমনিতেও ঢাকা ফিরতে হতো। হয়তো এজন্যই আজ। আমি আসছি শুধু একটা অনুরোধ করবো আর যা-ই হোক বাচ্চা টাকে আপনি কখনো একা করে দিবেন না৷ ওর জন্য আমার চাইতেও একটা ভালো মা নিয়ে এসে দিবেন। কথা দিন।
– আমি আপনাকে কোথাও যেতে দিবো না হিয়া।
-জেদ করবেন না আপনি। ভালো থাকবেন।
হিয়া নিজের চোখের পানি টা কোনো রকমে আড়াল করে তার সীটে গিয়ে বসে পড়লো। উজান দেখতেও গেলো না হিয়া ঠিক কোন জায়গায় বসে কিভাবে ফিরছে৷ ট্রেন তার নিজের গন্তব্যে রওনা দিলো। আস্তে-ধীরে ফাঁকা হতে থাকলো প্লাটফর্ম। এটাই হয়তো রাতের শেষ ট্রেন ছিলো তাই সেখানে থাকলো না আর যাএীদের কোনো আনাগোনা। উজান এখনো পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে হিয়াকে এখন হাজার জোর করলেও সে ফিরতো না৷ হিয়া যে তার চাইতেও কঠিন, খুব কঠিন! উজানের শরীর রাগে গটগট করে কাঁপছে। রাগ, অভিমান, অভিযোগ সব এসে ভর করছে তার পুরো শরীরে। কপালের রগ থেকে সারা শরীরের রগ বেড়িয়ে তার এ-ই পাহাড় সমান রাগের জানান দিচ্ছে। গাড়ি ড্রাইভ করে উজান বাড়িতে আসলো। সবাই ড্রয়িংরুমে বসে তখন উজানের ফেরারই অপেক্ষা করছিলো। কারো আর খাওয়া হয়ে উঠে নি উজান চলে যাবার পর। ড্রয়িংরুমে এসেই উজান সর্বপ্রথমে আছাড় মারলো সেন্টার টেবিলে সাজিয়ে রাখা বড় কাঁচের ফুলদানি টা। সবাই উঠে দাঁড়ালো। মেহু ভয়ে উজানের মা’র শাড়ির আঁচল চিপে পেছনে দাঁড়ালো। উজানের মা আজ ছেলের এ-ই অগ্নিরুপ দেখে হতবাক হ’য়ে শুধু তাকিয়ে রইলেন৷ নিবিড় হেঁসে দিলো। কটাক্ষ করে বলতে শুরু করলো,
– আসে নি হিয়া ম্যাম তাই না। আমি জানতাম আমি জানতাম উনি আসবেন না। নির্লজ্জ, বেহায়া, বাজারের মেয়ে আরো কি কি বললেন আপনারা। এতোটাও অপমান কি উনি ডিজার্ভ করতো স্যার!
নিবিড়ের কথা গুলো যেনো আরো কাটা গায়ে নুন ছিটিয়ে দিলো। এতো অপমান কি সত্যি হিয়ার প্রাপ্য ছিলো। রাগের পাহাড় টা আরো একটু নড়েচড়ে বসতেই উজান কাচের ঔ সেন্টার টেবিল টাকেই আছড়ে গুড়ো গুড়ো করে রাখলো। শুধু কি তাই হাতের কাছে যা আসলো সব একদম ভেঙে নিজের রাগ টাকে জাহির করতে মরিয়া হয়ে উঠলো। দাদিমণির কথাও আজ উজান শুনতে চাইছে না। উজানকে থামানোর সাধ্য,সাহস কোনোটাই জুটছে না কারো। যা পাচ্ছে সব ত*ছনছ করে রাখছে উজান। পারলে বুঝি বাড়ির প্রত্যেককে সে খু*ন করে দেয় এমন। একজন সার্ভেন্টের কোলে ছিলো স্পর্শ। সার্ভেন্ট টা স্পর্শকে উজানের কাছে নিয়ে আসতেই স্পর্শ কেঁদে উঠলো তার কান্নার সুরে এটা স্পষ্ট মামা আমার ইয়া মা কোথায়। কোথায় রেখে আসছো তুমি আমার ইয়া মা’কে। উজান আর কিছু ভাঙ্গতে গিয়েও ভাঙ্গতে পারলো না। স্পর্শকে দেখে তার শরীরের সব শক্তি ফুরিয়ে আসলো। দাদিমণি স্পর্শকে কোলে নিয়ে চুপ করাতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো আর কোথায়।
– তুমি মুনতাসীর সম্পর্কে কতো টা জানতে মা। একটা মেয়ের সম্পর্কে না জানে…হিয়ার কথা বাদ দেও আমি তো তোমার ছেলে আমি ঠিক কতোদূর যেতে পারি এটা তুমি আন্দাজ করতে পারলে না। আমাকে আর হিয়াকে কাল ওভাবে দেখে তুমি ভেবে নিলে আমরা খারাপ কিছু করছি!
উজানের মা সামনে এসে উজানকে কিছু বলতে যাবে কিন্তু উজান শুনলো না। তার কাছে তার মায়েই এ-ই ব্যবহার বড্ড অচেনা!
– তুই একটা বাহিরের মেয়ের জন্য আমাকে ভুল বুঝে এরকম করবি। এভাবে এভাবে বাড়ির সব কিছু ভেঙে..
-উনি বাহিরের কেউ না মা। উনি স্পর্শের মা।
-একদম বাজে কথা বলবি না। দুদিন কি বাচ্চা টাকে সামলেছে ওমনি মা হ’য়ে গেলো। আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে তুই নিজের বোনের সাথে কি করে এরকম একটা আয়া’র তুলনা করছিস ছিঃ
– বাহ! আজকে তোমার কথার শ্রী দেখে সত্যি খুব অবাক হচ্ছি মা। তোমার মনে এতো বিষ কে তৈরি করলো মা,মেহু?……দাদিমণি আমার মনে হয় মোহিনীকে এবার বিয়ে দিয়ে এ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া উচিৎ। আর কতো পুষবে মানুষের বাচ্চাকে। ওনাদেরতো কিছু দায় দায়িত্ব আছে তাই নয় কি!
উজানের কথাটা মেহুর বুকে গিয়ে লাগলো। উজান তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলছে। মেহু কিছু বলার আগে উজানের মা বলে উঠলো।
– বিয়ে দিয়ে মেহু এ বাড়িতেই থাকবে। আমি ঠিক করেছি বৈশাখ টা চলে গেলেই আমি তোর সাথে মোহিনীর বিয়ের আয়োজন করবো।
উজান হাসলো। এ মুহুর্তে তার মায়ের এই কথা গুলো শুনে বড্ড হাসি পাচ্ছে তার।
– আমি তো মেহুকে বিয়ে করবো না মা।
– তাহলে কাকে করবি ঔ আয়া টাকে। দেখ উজান আমি যা করেছি তোর ভালোর জন্য করেছি। একটা অশিক্ষিত নির্লজ্জ গেয়ো মেয়ে কিনা হবে তোর বউ তুই ভাব তো!
সাথে সাথে পাশে থাকা অর্ধ ভাঙ্গা ফুলের টব টা আবারো তুলে আছাড় মারে উজান।
উজানের মা অবাক হ’য়ে গেলো কারণ মেহু তো তাকে বলেছিলো হিয়া পড়াশোনা করে না।বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,
-আমাকে যে মেহু বললো মেয়েটা উচ্চ ম্যাধমিকো পাস করে উঠতে পারেনি।
– আর তুমি বিশ্বাসো করে নিলে। তা মেহু আর কি কি বানিয়ে বলা হয়েছে হিয়া সম্পর্কে তোমার_____হিয়া ঢাকা শহরে মানুষ মা চাইলেই আমার চাইতে ভালো কাউকে বেছে নিতে পারেন উনি৷ কি আছে আমার এই পারিবারিক ব্যবসা আর শাহরিয়ার বংশের তকমা তাই তো। আমি তো শুধু এটা ভেবে অবাক হচ্ছি আমার মা হয়ে তুমি কি করে একটা মেয়ের সাথে।
আর কিছু বলতে পারলো না উজান। রাগে গটগট করে নিজের রুমে চলে গেলো। এদিকে দাদিমণি এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেহুর দিকে। তার কাছে এখন সবটা পরিষ্কার!
!
!
ভোরের দিকে হিয়া এসে পৌঁছালো ঢাকায়। নিজের বাড়িতে না গিয়ে উঠলো অর্পার ওখানে। ঘটনার আদ্যপান্ত সব খুলে বললো অর্পাকে। শুনেই রেগে উঠলো অর্পা। আর সব থেকে রাগ এসে জমা হলো উজানের জন্য। হিয়া বললো উনি সেসময় বাড়ি ছিলেন। উনি আমাকে নিতে এসেছিলেন আমি যাই নি। অর্পা বললে বেশ করেছিস আর যেতেও হবে না তোকে। পরের বাচ্চাকে আপন করতে গিয়ে দেখলি তো কি হলো। হিয়া অর্পাকে থামিয়ে দিয়ে বললো আমি একটু একা থাকতে চাই অর্পা। এসব কিছু এখন আর আমার শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। হিয়া অর্পার রুমে গিয়ে শুইয়ে পড়লো। স্পর্শের জন্য মন টা ছিঁড়ে খাচ্ছে তার। এদিকে কাল রাত থেকে উজান,দাদিমণি সবাই হিয়াকে ফোনে হাজারবার চেষ্টা করতে থাকলো কিন্তু হিয়া ফোন রিসিভ করলো না উপরন্ত মাঝরাতে সব নাম্বার ওফ করে রাখলো। না তাকে দূর্বল হলে চালবে না। কিছুতেই না।
কিন্তু হিয়ার এই মনোবল বেশিক্ষণ থাকলো না। গোটা একটা দিন পাড় হ’য়ে আসলো। স্পর্শের জন্য হিয়ার মায়ের মন পাগল হ’য়ে যাচ্ছিলো। আজকে সারাদিন শুধু হিয়া চোখের পানি ফেলেছে৷ ফোনটা নিয়ে বারবার কল করবে বলেও রেখে দিচ্ছে। কোথায় সকালের পর থেকে তো আর কেউ ফোন করলো না তাহলে সবাই কি তাকে ভুলে গেলো এক রাতেই। রাত তখন এগারোটার কাছাকাছি। অর্পার বাড়ির ছাঁদে বসে আছে হিয়া। সেই সন্ধ্যা থেকেই সে ছাঁদে বসে আছে আর স্পর্শ স্পর্শ করে কেঁদেই যাচ্ছে। অর্পা আসলো। এসে হিয়ার কাঁধে হাত রাখতেই হিয়া চিৎকার করে কেঁদে দিয়েই অর্পাকে জড়িয়ে ধরলো।
-আমার খুব কষ্ট হচ্ছে অর্পা। আমাকে এনে দে না আমার বাচ্চা টাকে। আমার কি কোনো অধিকার থাকতে নেই ওর উপর। আমি যে নিজের হাতে ওকে নাড়াচাড়া করেছি____আমি আমি কি ঠিক করেছি জানিস আমি গিয়ে স্পর্শকে চুরি করে নিয়ে আসবো। হু। কেউ জানবে না৷ তারপর আমি আর আমার বাচ্চা অনেকদূরে একটা কোথাও হারিয়ে যাবো। কেউ খুঁজে পাবে না উজানো না। বল এটা ঠিক হবে না।
অর্পা মুচকি হাসলো। বললো তার আর দরকার নেই পাগলি। ওদিকে দেখ। হিয়া অর্পার হাতের ইশারায় গেট বরাবর তাকাতেই দেখতে পেলো উজান দাঁড়িয়ে আছে! আর উজানের কোলে স্পর্শ। হিয়াকে দেখেই স্পর্শ তার মামার কোলে খুশিতে হাত পা ছড়াতে থাকলো। ইয়া মা বলে বলে ডাকতে থাকলো হিয়াকে। হিয়া এদিক ওদিক না তাকিয়েই দৌড়ে এসে স্পর্শকে জাপ্টে ধরে তার কোলে জড়িয়ে নিলো। স্পর্শের পুরো মুখে তার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে মায়ের কোলের সব আদর ঢেলে দিতে থাকলো। স্পর্শো হিয়াকে জাপ্টে নিলো। বাবুনি একে দিলো হিয়ার গালে। হয়তো মায়ের জন্য তারো মনটা ছিঁড়ে আসছিলো।
-ফিরে চলুন হিয়া। আপনাকে ছাড়া আমরা কেউ ভালো নেই।
হিয়া চোখ মুছলো। স্পর্শকে আরো কিছুক্ষণ আদর করে বললো আপনি ফিরে যান উজান। স্পর্শ থাক আমার কাছে। চিন্তা করবেন না আমি আমার বাচ্চা টাকে খুব ভালো রাখবো। উজান অভিযোগের সুরে বললো আর আমার ভালো থাকা টা। হিয়া উওর খুঁজে পেলো না। সে যে কিছুতেই তার ঔ অপমান নিয়ে সে বাড়িতে ফিরবে না। উজান হিয়াকে আস্বস্ত করে বললো আপনি আর একবার আমাকে ভরসা করুন আপনাকে আমি আর হতাশ করবো না। হিয়া রাজি হলো না৷ হিয়া যে কতোটা আত্নমর্যাদা সম্পূর্ণ মেয়ে তা বুঝতে পেরেই উজান তার মা’কে দিয়ে হিয়াকে ফোন করে কথা বলালো। উজানের মায়ের কন্ঠে অনুতপ্তের ছোঁয়া ছিলো। মেহু যে ইচ্ছে করে হিয়ার নামে তার কান ভারি করেছে সেটা বুঝতে পেয়েই উনি লজ্জিত হলেন। অকপটে ক্ষমা চেয়ে নিলেন হিয়ার কাছে। হিয়ার মন একটু শান্ত হলো। উজান হাসলো। এরকম একটা জেদী মেয়েকে নিয়ে তার সারাজীবন পাড় করতে হবে ভেবেই অবাক হলো সে!
!
!
হিয়াকে নিয়ে সেদিনই বাড়িতে ফিরলো উজান। এদিকে উজানের মা’র সাথে মুখোমুখি হতে সংকোচ হচ্ছিলো হিয়ার। হিয়ার সব সংকোচ কাটিয়ে উনি নিজে থেকে হিয়াকে পাশে বসিয়ে কথা শুরু করলেন। মেহু বাড়িতে নেই। উজানের সেই অপমান গুলো সইতে না পেরে সে সেদিনই বাড়ি ছেড়ে ঢাকার চলে এসেছে। বলেছে সামনের মাসে বৈশাখের অনুষ্ঠানে বিহানদের সাথে বাড়িতে আসবে নয়তো না।
দিন গুলো দেখতে দেখতে বৈশাখের আগমন হলো। এ কদিনে মেহুর অনুপস্থিতিতে উজান হিয়া অনেকটা কাছাকাছি চলে আসেছে। সকাল থেকে শুরু হলো বৈশাখের যাবতীয় আয়োজন। দাদিমণি যা বলেছিলো তার চাইতেও দ্বিগুণ আনন্দ বিরাজ করতে থাকলো বাড়িতে। সব আত্মীয় স্বজন কিছুদিন আগে থেকে এসেই জোড়ো হতে থাকলো। ফাঁকা বাড়িটা মুহুর্তে কিরকম ভরা আসরে জমে উঠলো। ছোট ছোট নাতি নাতনিদের বিচরণে পূর্ণতা লাভ করলো পুরো শাহরিয়ার কুঞ্জ। দাদিমণি হিয়ার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবাই হিয়াকে পছন্দ করলেও কেউ কেউ হিয়াকে নিয়ে দাদিমণির এতো আদিক্ষ্যেতা সহ্য করতে পারছিলেন না। মেহুও এসেছে। কিন্তু তাকে না কেউ গুরত্ব দিয়েছে না সে নিজে কাউকে গুরত্ব দিচ্ছে। বিহান আসে নি এখনো। সবার কথা শুনে যা বোঝা গেলো সে হয়তো কাল পরশু আসবে। কিন্তু সে আসবে। হালখাতায় সব পাওনা মেটানো হবে আর সে তার পাওনা নিতে আসবে না। তা কি হয় নাকি!
সময় গড়িয়ে হিয়ার এ বাড়িতে আসার আট মাসের কাছাকাছি হয়ে আসলো। এই এতো গুলো মাসে স্পর্শ যেমন নিজের মা’কে হিয়ার মাঝে খুঁজে নিয়েছে হিয়াও তেমনি তার সব কিছু উজার করে স্পর্শকে নিজের বাচ্চার মতোই তার বুকে আগলে রেখেছে। হিয়া আর স্পর্শকে দেখে বোঝার উপায় নেই তাদের সম্পর্কের কোনো ভিওি নেই। এই সম্পর্ক যেনো রক্তের সম্পর্ক কেও হার মানিয়ে দিবে।
!
!
আজ ভোর রাত থেকেই স্পর্শের শরীর টা হালকা খারাপ করতে শুরু করে। সকালে ৮টার আগেই তার ঘুম ভেঙে গিয়ে হিয়ার কোলে নেতিয়ে পড়ে সে। হিয়া খেয়াল করে স্পর্শের গা গরম। বুকটাও ধরফর করছে যেনো শ্বাস নিতে বাচ্চা টার খুব কষ্ট হচ্ছে। হিয়া সেই ভোর রাত থেকে জাগনা। কোনো মতে মুখটা ব্রাশ করে এ-ই যে স্পর্শকে কোলে নিয়ে সে বসে আছে তো আছে। এদিকে যে তার কাল রাত থেকে ঘুম হয়নি আর সকাল থেকে পেটে কিছু যাই নি এদিকে তার কোনো হুঁশ নেই। উপরন্তু হিয়াকে জাপ্টে ধরে স্পর্শের কান্না যেনো ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে চলছে। হিয়া স্পর্শকে তার বুকে শক্ত করে জাপ্টে ধরে আছে আর দাদিমণি হিয়ার পায়ের কাছে বসে বারবার বলছে হিয়া একটু খেয়ে নে আর কতোক্ষন এভাবে না খেয়ে থাকবি তুই।
-কি হইছে আমার বাচ্চা টার। আর কাঁদে না বাবা। ওলেএ। ইয়া মা আছে তো। ইয়া মা তোমাকে কোলে নিয়ে আছে তো। এ-ই যে। মামা আসবে তারপর আমরা ডাক্তারের কাছে যাবো। তারপর আমার বাচ্চা টা আবার আগের মতো হ’য়ে যাবে। তাই নাআআ।
-না দাদিমণি বাচ্চা টা আমার কেনো এরকম করছে সকাল থেকে। আমার যে কিচ্ছু ভালো লাগছে না। উনি কখন আসবে আর। আমি তো শুনেছি তোমাদের মতো এরকম পরিবারে ফ্যামিলি ডক্টর থাকে। ফোন দিলেই চলে আসে। তাহলে সেই ডাক্তার টাকে ফোন দিয়ে নিয়ে আসো না তুমি।
-না তুমি বুঝতে পারছো না। এটা একটু আধটু জ্বর না। আমি তো বুঝছি আমার বাচ্চা টার খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমাকে যে বললাম একটু রসুন সরিষার তেলে গরম করে আনতে৷ কেনো তুমি এতো অবহেলা করছো বলবা। (অভিযোগের কন্ঠে)
– আনছি রে মা আনছি। মনে তো হচ্ছে স্পর্শ তোর নিজেরই বাচ্চা আমাদের কেউ না।
-আমার নিজের বাচ্চাই তো ও বুঝছো তুমি। এখন এরকম করে না থেকে যাও গিয়ে আমার কথা শুনো।
দাদিমণি হিয়ার কথামতো রসুন তেলে গরম করে নিয়ে এসে হিয়াকে দেয়। হিয়া স্পর্শকে সোজা করে আলতো হাতে সেই তেল মালিশ করে দেয় স্পর্শের বুকে। স্পর্শের কান্না একটু থামে। হিয়া চেষ্টা করে শক্ত কিছু না খাক অন্তত এক ফিডার দুধ টা খেলেও তো পেটে থাকবে বাচ্চা টার। অনেক কষ্টে স্পর্শকে অর্ধেক ফিডার খাইয়ে হিয়া তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। এখন শুধু উজানের অপেক্ষা কখন আসবে সে আর। হিয়া স্পর্শের মাথার কাছে একদম গা ঘেঁসে শুইয়ে আছে। দাদিমনি হিয়ার পায়ের কাছে হেলান দিয়ে কি জেনো একটা সেলাই করছে। আজ তার মনটা অনেক হালকা লাগছে। তিনি আর উজানের মা তো স্পর্শকে নিয়ে অনেক চিন্তায় ছিলো। যাক স্পর্শের একটা যোগ্য মা জুটেছে কপালে। সেলাই করতে করতে দাদি গল্প জুড়ে দিলো। টেনে নিয়ে আসলো অতীতকে। যা শোনার জন্য মোটেও তৈরি ছিলো না হিয়া, এরকম একটা মুহুর্তে তো নয়ই।
– আগে ছোট বেলায় উজান,বিহান মেহু এদের যখন এরকম জ্বর আসতেো,সর্দি হতো তখন আমিও এরকম করে তেল মালিশ করে দিতাম। সারারাত বাচ্চা গুলোকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতাম৷ তারপর তো সবাই বড় হয়ে গেলো, যে যার মতো জীবন বেঁচে নিলো। আমাকে, তোদের রাহেলা খালাকে সবাই এখন সৌজন্যের খাতিরে মান্য করে এ-ই যা
-আর উনি?(আনমনে)
-কে উজান! উজান একদম আলাদা। সে তো হয়েছে ঠিক আমার বড় ছেলের মতো৷ যেমনি আদর্শবান ওমনি ভদ্রতার গুনে সম্পূর্ণ। তার কথার আঘাতে কখনো আঘাত করে নি আমাকে। বৈশাখে তো আসবে সবাই তখন তুই নিজেই বুঝতে পারবি উজান কি রকম আর তার সব ভাই বোন গুলো ঠিক কতোটা ভিন্ন।
হিয়ার আজ উজানের পরিবার সম্পর্কে জানার কোনো আগ্রহ নেই। তবুও সে হতাশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-তোমরা সবাই আলাদা কেনো হয়ে গেলে দাদিমণি?
দাদি মনি সেলাই থামিয়ে দিলেন হতাশ সুরে বলতে শুরু করলেন এই বিবাদের আসল কাহিনী।
– ঔ জমিজমা নিয়ে যা হয় প্রতি বাড়িতে। আমার তো তিন ছেলে উজানের বাবা বড় সব থেকে। শমসেদ মারা যাবার পর দুই ছেলেই অনেকদিন এ বাড়িতে থেকে ঢাকা শহরে পাড়ি জমায়। তার বেশ কিছুদিন পর সম্পতি ভাগের কথা উঠলো। উজান নিয়ম করে যার যতোটুকু পাওনা মিটিয়ে দিলো। কিন্তু আমার মেজো ছেলের যে ছেলে বিহান তার স্বাদ মিটলো না। তার পাওয়া জমিজমা গুলো বিক্রি করে করে সে আবার সম্পতিতে ভাগ চেয়ে বসলো। উজান কিছু বললো না তার দাবি দেওয়ার চাইতেও বেশি দিয়ে দিলো। যাতে হোক কারো যেনো কোনো কিছুতে কমতি না থাকে। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। আবার কিছু দিন পর বিহানের আরো টাকার প্রয়োজন হলো উজান সেবারো তাকে কিছু বললো না। কিন্তু শেষমেশ যখন সব কিছু সীমার বাহিরে চলে আসতে শুরু করলো উজান আর সহ্য করতে পারলো না। শুরু হলো দু ভাইয়ের রেশারেশি। সাথে চাচাদের সাথে সম্পর্ক গুলোও খারাপ হয়ে আসলো সবাই আলাদা হয়ে গেলাম। তারা চেয়েছিলো আমাকে নিয়ে ঢাকাতে ভীড়তে কিন্তু নিজের স্বামীর খুটি ছেড়ে আর কিছুতেই কোথাও যেতে মন চাইলো না রে মা আমার।
হিয়া উঠে বসলো। বিহান তো তাকে বলেছিলো যদি তাদের বিয়ে টা হয় উজান নাকি তাকে তাদের সবকিছু থেকে বঞ্চিত করবে কিন্তু দাদিমণি যে বলছে! হিয়া কৌতূহলী মনে জিজ্ঞেস করলো,
-বিহান এতো টাকা পয়সা দিয়ে কি করতো দাদিমণি!
– কি আর করতো আগে তো জুয়ার খুব বাজে নেশা ছিলো বিহানের। জুয়া তে টাকা জিতলে মেয়ে নিয়ে ফূ*র্তি করতো আর হারলে বাড়ির টাকাতে ভাগ বসাতো। উজান অনেক চেষ্টা করেছিলো তার মেজো চাচা কে বলে বিহানকে শুধরে নিতে কিন্তু সে আর শুনলে কারো কথা। তবে এখন অবশ্য ওর এসব নেশা কমেছে কিন্তু টাকার চাহিদা কমে নেই। আজো প্রতি মাসে বিহানের পাশাপাশি ছোট চাচার দুই ছেলেকে উজান ব্যবসা থেকে টাকা পাঠিয়ে দেয়।
হিয়া রেগে গেলো। হাড় ভা*ঙা পরিশ্রম করে উজান। আর সবাই কিনা বিনা পরিশ্রমে এভাবে!
-পরিশ্রম তো করে উনি। নিজের রাতের ঘুম ন*ষ্ট করে তোমাদের পারিবারিক ব্যবসাটাকে টিকিয়ে রাখতে কতো কি না করে। আর টাকা এলে উনি এভাবে,কে বলেছে ওনাকে এতো উদার হতে?
– উজানের সম্পর্কে তোকে যতই বলবো তোতোই কম হবে মা। আসলে সে তার ভাই বোনদের খুব ভালোবাসে। দেখিস না মেহু এতো কিছু করে বের হবার পরো মেহুর জন্য সব করে দেয়। কিসে মেহু ভালো থাকবে কি করলে মেহুর চাহিদা পূরণ হবে সব মিটিয়ে দেয়। তার উপর স্নিগ্ধার মৃত্যুতে উজান অনেক ভেঙে পড়েছিলো। তার আর কোনো ভাই বোনের যাতে এরকম কোনো কষ্ট না হয় তাই সে নিজে পরিশ্রম করে হলেও সবার চাহিদা টা মেটাবার চেষ্টা করে। সে তো হয়েছে একদম আমার বড় ছেলের মতো কারো কষ্ট স*হ্য করতে পারতো না।
!
!
দাদিমণির ডাক আসলো। উনি সেলাই থুইয়ে নিচে নেমে আসলেন। এদিকে হিয়ার কাছে আজ সবটা পরিষ্কার হলো যদিও সে আগেই অনেকটা আন্দাজ করেছিলো কিন্তু আজ তো সব কিছু সে__হিয়ার মনে যেমন ঘে*ন্না আর রাগের পাহাড় জমা হতে থাকলো ওমনি উল্টোদিকে উজানের কথা মনে পড়তেই হিয়ার বুক কেঁপে উঠলো। এ-ই মানুষ টার সাথে প্রতিশোধ নিতে না-কি সে। হিয়া কান্নায় ভেঙে পড়লো কি করে এতো বড় ভূল সে করতে পারলো কি করে। হিয়া কাঁদছে খুব কাঁদছে। সে জানে উজান প্রতর*ণা মি*থ্যে একদম সহ্য করতে পারে না। যদি কখনো তার সত্য সামনে আসে উজান কি মাফ করতে পারবে তাকে। হিয়ার কান্নার মাঝে অর্পার ফোন আসলো। হিয়া কান্নারত কন্ঠে ফোনটা রিসিভ করে বড় করিডোরে এসে কথা বলতে গিয়েই আরো অঝোরে কেঁদে উঠলো,
-তুই কাঁদছিস হিয়া? হেই মেয়ে_হিয়া। কিছু হয়েছে। স্পর্শ ঠিক আছে তো। আরে না কেঁদে বলবি তো কি হয়েছে। হিয়া?
-আমি অনেক বড় ভূল করে ফেলেছি অর্পা অনেক বড়। বিহান আমাকে মিথ্যে বলেছে সব। বিহান বিহান আমাকে কি বলেছিলো মনে আছে তোর যে আমাকে বিয়ে করলে নাকি উজান শাহরিয়ার তাকে তার সব সম্পতি থেকে বঞ্চিত করবে এটা পুরোটাই ভূল। বরং উনি তো বিহানকে তার পাওনার চাইতেও
-হিয়া হিয়া হিয়া। চুপ কর প্লিজজ। আমি তোকে আগেই বলেছিলাম বিহান কে ঠিক আমার সুবিধের মনে হয় না। দেখলি মিললো তো।
-আমি কি করে এতো বড় একটা ভুল করে বসলাম অর্পা কি করে। বিহানের প্রতি আমার অন্ধ বিশ্বাস আমাকে ওনার মতো একটা মানুষের সাথে এভাবে প্রতরণা করতে বাধ্য করেছে। আমি কিভাবে ওনার সামনে!
-আচ্ছা একটু শান্ত। আমাকে একটা কথা বল তো তুই উজান বলে লোকটাকে ভালোবেসে ফেলেছিস তাই না?
– এখন আর সেসব বলে কি লাভ তুই বলতে পারবি। তুই বিশ্বাস করবি কি না অর্পা, তুই তুই জানিস আমি বিহানের সাথে সম্পর্কে ছিলাম ঠিকই কিন্তু বিহানের প্রতি আমি যেই অনুভূতি টা অনুভব করতে পারিননি ওনার জন্য সেই অনুভূতি আমার মনে তৈরি হয়েছে। বিহান আমার হাত টা ধরলেও আমার গা টা কিরকম জানি একটা করতো কিন্তু আমি ওনার কতো কাছাকাছি চলে আসি মাঝেমধ্যে কিন্তু কখনো তার জন্য আমার একটুও খারাপ লাগে না বিশ্বাস কর।
-আমি তো সেই প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম সবটা, তুই প্র*তিশোধ তুলতে গিয়ে লোকটাকে ভালোবেসে ফেলেছিস খুব ভালো।
– উনি আমার সত্যি টা জানলে কখনো আমাকে গ্রহন করবেন না অর্পা। উনি যদি জানতে পারেন আমি ওনার থেকে প্র*তিশোধ নিতে এতো বড় ছ*লনার আশ্রয় নিয়েছি উনি তো আমাকে..
হিয়া আর বলতে পারে না। কান্নায় ভেঙে যায় পুরোপুরি।
-আচ্ছা শোন এটা কোনো ছলনা না৷ আর তুই তো ওনাকে সবটা বলতে চেয়েছিলি উনি শুনতে চায় নি….হ্যালো হিয়া শুনতে পারছিস হ্যালো…হ্যালো হিয়া
অর্পার কোনো কথা হিয়ার কানে পৌঁচ্ছাছে না। সামন থেকে হেঁটে আসা উজানের দিকে চোখ পড়তেই হিয়া থমকে যায়। কি করে এই মানুষটাকে সে এতোদিন খারাপ ভেবে এসেছিলো। হিয়া একটু থেমে এক ছুটে উজানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। দিক বিদিক ভুলে উজানকে দু’হাতে জাপ্টে ধরে। শুরু হয় চোখের পানির বর্ণা। উজান হতবাক হ’য়ে যায়। সাহস করে যেই মেয়ের হাত টা সে কোনোদিন ধরতে পারে নি সেই মেয়ে কি না এখন ঠিক তার বুকে। উজান কাঁপা হাতে ওর এক হাতে রাখে হিয়ার মাথায়।রেখে দিয়ে বলে
– কি হয়েছে হিয়া। আপনি কাঁদছেন কেনো?___কেউ কিছু বলেছে আপনাকে? মেহু কিছু বলে নি তো। হিয়া?
উজানের কন্ঠে হিয়া যেনো আরো আহ্লাদী হয়ে উঠলো। আরো জোরে জাপ্টে নিলো উজানকে। উজানের চওয়া বুকের ঠিক বা পাশে রাখা হিয়ার মাথা। উজানের হৃৎকম্পন আবেগি হিয়াকে আরো কাঁদিয়ে দিচ্ছে। উজানের হাত তখনো হিয়ার মাথায় রাখা। কিছুক্ষণ বাদে হিয়ার হুশ ফিরলো। দূত হাতে উজানকে ছাড়িয়ে হিয়া মুখ ফিরে এপাশে তাকালো।
– না কিছু হয়নি আমার। আমি ঠিক আছি। কিন্তু আমার, আমার বাচ্চা টার খুব কষ্ট হচ্ছে এটা আপনার আসার সময় হলো।
-এজন্য এভাবে কাঁদতে হয়। আমি এসে গিয়েছি তো না-কি আর কিচ্ছু হবে না আপনার বাচ্চার। দেখি আসুন তো।
উজান কান্নারত হিয়ার কান্না থামিয়ে হিয়াকে নিয়ে স্পর্শের কাছে আসে। বাচ্চা টা তো এখন ঘুমোচ্ছে। হিয়া বললো ঔ ডক্টর এসে দেখে গেলে তার না-কি হবে না আপনি শহরের বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান তারপর তারা কি বলে,কি পরীক্ষা করতে দেয় দেখুন। উজান হিয়ার হাত টা শক্ত করে চেপে ধরে বললো আপনি এতো অস্থির হবেন হিয়া, কিচ্ছু হবে না আপনার স্পর্শের কিচ্ছু না। হিয়া শান্ত হতে পারলো না। উপরন্তু স্পর্শের নেতিয়ে পড়া শরীর, কান্নার ধ্বনি তার মনকে আরো কেঁপে তুললো। স্পর্শকে শহরের বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার দেখে পরীক্ষা করে বললেন বাচ্চা টার হালকা নিউমোনিয়া হয়েছে। ভাগ্যিস হেলাফেলা না করে ঠিক সময় নিয়ে এসেছিলেন। নাহলে আর এক দুদিন গেলে সেটা মারাত্মক আকারে পৌঁছে যেতো। স্পর্শকে ডাক্তার কিছু ঔষধ আর চারটে ইনজেকশন দিয়ে বললো প্রত্যেক রাতে একটা করে দিতে চারদিন৷ আর ঔষধ গুলো টানা দশদিন খাবারের সাথে গুলিয়ে যদি সে খেতে না চায়। স্পর্শকে নিয়ে বাড়ি ফেরা হলো। এতো বড় ডাক্তার দেখিয়েও হিয়ার মন শান্ত হতে পারলো না।দাদিমণি আর উজানকে আঁকড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলো আমার বাচ্চা টাকে সুস্থ করে দিন আপনারা আমার বাচ্চা টাকে সুস্থ করে দিন। এদিকে স্পর্শ নিজেও হিয়া ছাড়া কিছু বুঝতে চাইছিলো না। আজ দুদিন হলো সে হিয়ার কোল ছাড়া কারো কোলে পাঁচ টা মিনিটের জন্যেও গিয়ে থাকতে চাইছিলো না। কেউ কোলে নিতে আসলেই চিৎকার করে কেঁদে উঠতো। তার হিয়া মা’র কোল ছাড়া অন্য সবার কোলই তার কাছে অনিরাপদ বলে মনে হচ্ছিলো। এদিকে তো হিয়ার নাওয়াখাওয়া ঘুম সব হারাম হ’য়ে আছে। বা পাশে স্পর্শ কে নিয়ে থাকতে থাকতে বা সাইড টা অবশ হ’য়ে যাচ্ছে তবুও হিয়ার ক্লান্তি নেই। এদিকে হিয়া তো ঔষধজ্যেঠুর সাথে কাজ করতে গিয়ে কতো মানুষকে ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু কিছুতেই এই ছোট্ট ইনজেকশন চারটা সে স্পর্শের শরীরে পুশ করতে পারছিলো না। আবার বাহির থেকে নার্স এনেও সেটা পুশ করতে দিচ্ছিলো না যদি তারা তার বাচ্চা টাকে আঘাত দিয়ে বসে। কাপা কাপা হাতে স্পর্শকে ইনজেকশন দিতে গিয়েই হিয়া নিজেই ডুকরে কেঁদে উঠছিলো। উজান হিয়ার এই পাগলামি তে হাসবে না কাঁদবে না বিরক্ত হবে কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারছিলো না। পাঁচ দিনের মাথায় স্পর্শ একটু সুস্থ হয়,একটু হেঁসে উজানের কোলে উঠতে রাজি হয়। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য না। একটু পর পরই তার হিয়া মা’কে দেখার জন্য তার মন কেঁদে ওঠে। দুপুরের দিকে স্পর্শ কে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে হিয়াও চোখ টা বন্ধ করেছিলো। এতোদিন স্পর্শের চিন্তায় মাথার ব্যাথা টা সে বুঝে উঠতে পারে নি। কিন্তু আজ যেনো বড্ড খারাপ লাগছে মাথার এই যন্ত্রণাটা। নিবিড়কে বলে একটা মাথা ব্যাথার ঔষধ আনতে বললো হিয়া। নিবিড় ঔষধ আনতে গিয়ে উজানের সাথে তার দেখা হলো। উজান জানতে চাইলো ঔষধ কিসের জন্য। নিবিড় বললো হিয়া ম্যাডাম আনতে পাঠালো স্যার,ম্যামের নাকি মাথা টা ভীষণ ব্যাথা করছে। উজান বললো ঠিক আছে আমাকে দেও। নিবিড় উজানকে ঔষধ দিয়ে তার কাজে চলে গেলো। উজান ঔষধ নিয়ে রুমে এসে দেখলো হিয়া তার বা হাত টা স্পর্শের মাথার কাছ দিয়ে সোজা করে দিয়ে সেখানে ভর রেখে একদম স্পর্শের গা ঘেঁষে শুইয়ে আছে। উজান হাসলো। না এ-ই মেয়ে তো দেখছি স্পর্শকে কেঁড়েই নিয়ে নিবে। একদম গা ছাড়া করে না। উজান হিয়ার পাশে গিয়ে বসতে হিয়া ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলো। উজান পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে মাথা ব্যাথার ঔষধ টা হিয়ার হাতে দিলো। হিয়া সেটা খেয়ে নিতে উজান গ্লাস টা আবার আগের জায়গায় রেখে হিয়ার পাশে এসে বসলো। হিয়া ঘুমন্ত চোখে উজানের কাঁধে তার কপাল ঠেকালো। উজান হিয়াকে রাগানোর জন্য বললো,
-আপনি কি পরশকে আমাদের থেকে কেড়ে নিতে চাইছেন না-কি মুনতাসীর। এরকম করলে তো স্পর্শ আর আমাদের কাউকে চিনতে পারবে না।
উজান হাসলো। হিয়া রেগে যাবার বদলে কেঁদে দিলো। উজান বুঝতে পারলো না হিয়া হঠাৎ কাঁদছে কেনো। উজান কি করবে বুঝতে পারছিলো না। হিয়াকে কি একটু ধরবে। যদি হিয়া কিছু মনে করে।
– দাদিমণি বলে আমি না-কি স্পর্শের দ্বিতীয় মা। কিন্তু মা’রা এরকম হয় না। আমি স্পর্শের ভালো মা হতে পারিনি। আজ আমার জন্য তাকে কতো কষ্ট পেতে হলো। সব সব সব আমার জন্য। আমি পারিনি তাকে ঠিক মতো দেখে রাখতে।
– আরে কি মুশকিল। বাচ্চাদের তো এরকম হবে। কিন্তু আপনি যেভাবে ওর যত্ন নিয়েছেন সবসময় চোখে চোখে রেখেছেন তাই জন্য না ও এতো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলো।
-না ওহ সুস্থ হইনি। আপনি আমার স্পর্শকে ঠিক করে দিন। আগের মতো করে দিন। ওহ কেনো আগের মতো হাসছে না৷ কেনো খেলছে না। ডাক্তার কি ওকে ঠিক মতো দেখে নি
-চুপ চুপ। কাম ডাউন কাম ডাউন হিয়া। স্পর্শ আগের চাইতে অনেক বেটার এখন। দেখলেন না আজ নিজে থেকে আমার কোলে আসতে চাইলো। কতোক্ষন খেললো। দেখি আর না। দেখুন আপনি কাঁদছেন ওদিকে স্পর্শ নড়ছে। আপনি চান আপনার জন্য বাচ্চা টার ঘুম নষ্ট হোক।
হিয়া চোখ মুছে মাথা নাড়িয়ে বললো না সে চায় না। উজান হিয়ার চোখের পানি গুলো মুছে দিয়ে একটা বালিশ মেলে হিয়াকে শুইয়ে দিলো। বললো এবার আপনি যদি না ঘুমোন আমি কিন্তু স্পর্শ কে নিয়ে আমার ঘরে চলে যাবো। হিয়া আর অবাধ্য হলো না,সে যে কোনোভাবেই স্পর্শকে গা ছাড়া করবে না। হিয়া স্পর্শের মশারি টা ঠিক করে দিয়ে নিজে শুইয়ে চোখ বন্ধ করলো আর উজানকে বললো এবার যান আপনি গিয়ে দাদিমণিকে পাঠিয়ে দিন। উজান গেলো না বরং দুটো বালিশে হেলান দিয়ে তার দু হাত রাখলো হিয়ার কপালের দু’দিকে। হিয়া অবাক হয়ে চোখ খুলে উজানের দিকে তাকালো,
বিস্মিত কন্ঠে বললো,
-আপনি কি করছেন এসব। প্লিজ এরকম করবেন না। মেহু দেখলে ব্যাপারটা সত্যি খুব খারাপ দেখাবে
-আপনি চুপ করুন৷ কালকেও সারারাত ঘুমোনননি৷ আমি মাথা টিপে দিচ্ছি ভদ্রবাচ্চার মতো একটা ভাত ঘুম দিন।
-না দেখুন এরকম করবেন না। মেহ..
হিয়া আর কথা বাড়াবার আগে উজান চোখ বড় বড় করে তাকালো। হিয়া দমে গেলো। এদিকে মাথাটাও অসহ্য যন্ত্রণা দিচ্ছে একটু কেউ টিপে দিলে সত্যি ভালো লাগতো। হিয়া চোখ বন্ধ করলো। উজান হিয়ার মাথা টিপে দিতে থাকলো। একটা পর্যায় হিয়া গভীর ঘুমে ডুবে গেলো। এদিকে হিয়ার মাথা টিপে দিতে উজানের চোখ টাও হালকা লেগে আসাতে সেও তার অজান্তে হিয়ার পাশে ঘুমিয়ে গেলো। ঘুমের ঘোরে হিয়া উজানের হাত টা চিপে ধরে উজানের পেট বরাবর তার মুখ টা রাখলো। আর তাদের এই পবিএ মুহুর্ত টাকে অপবিত্র করে তুলতে বিন্দুমাত্র দেড়ি করলো না মেহু।
আজ উজানের মা বাড়িতে আসছে কথাটা মেহু ছাড়া আর কেউ জানতো না। মেহু তো আবার এরি মধ্যে উজানের মায়ের মনে হিয়ার সম্পর্কে যতো বি*ষ আছে সব ঢেলে তি*ক্ততা তৈরি করে দিতে চেষ্টা করেছে। আর সেই তিক্ত*তাকে ঘে*ন্নার রুপান্তর করতে বাড়িতে আসতে না আসতেই মেহু তাকে সোজা নিয়ে আসলো স্পর্শের রুমে। আর নিজের ছেলেকে এভাবে একটা মেয়ের সাথে বিছানায় দেখে ব্যাপারটা কিছুতেই হজম করতে পারলেন না তিনি। মেহু বললো দেখলে তো আন্টি কি বলেছিলাম এ-ই মেয়ের চরিত্রের ঠিক নেই,তোমার উজানকে নিজের সব দিয়ে সে….উজানের মা মেহুকে থামিয়ে দিলো। নিজের ছেলে সম্পর্কে এরকম নোং*রা কিছু তার সহ্য হচ্ছিলো না। মেহু তো তার মনে হিয়া সম্পর্কে যা মিথ্যে বলার সব বলে ঘেন্না জন্মাতে বাধ্য করেছিলো সাথে বাড়িতে এসেই এই দৃশ্য সেটাতে যেনো ঘী ঢেলে আরো আগুন জ্বালিয়ে তুললো।
!
!
পরের দিন, উজানের মা একটা গম্ভীর ভাবে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। তার যে হিয়াকে বেশি একটা পছন্দ হয়নি তা বুঝতে আর বেশি দেড়ি হয়নি দাদিমণির। তিনি ঠিক করলেন আজ উজানের সাথে ডক্টর টা দেখিয়ে নিয়ে এসেই তিনি উজানের মা’র সাথে বসে সবটা পরিষ্কার করে কথা বলে নিবেন। উজান দাদিমণিকে নিয়ে হসপিটালে আসতেই মেহু শুরু করলো তার আসল চাল। উজানের মা’কে কনভিন্স করে সে হিয়াকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হলো। হিয়ার কাছে এটা ছিলো সম্পূর্ণ অনা*কাঙ্ক্ষিত। উজানের মা যে প্রথম দিন এসেই তার সম্পর্কে কিছু না জেনে এতো বাজে মন্তব্য করবেন এটা ছিলো তার কাছে পুরোপুরি অবিশ্বাস্যযোগ। একটা পর্যায় হিয়াও তার সব ধর্য্য টুকু হারিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়লো,
– ঠিক করে কথা বলুন আন্টি। আপনি আমার সম্পর্কে কতোটুকু জানেন। না জেনে এভাবে একটা মেয়েকে আপনারা দুজন মিলে হ্যা*রেজ করছেন। আর উল্টে প্রশ্ন তুলছেন আমার শিক্ষার ব্যাপারে
– দেখো মেয়ে। আমি একজন শিক্ষক মানুষ কার রুচি কিরকম তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি কাল। কি ভাবো, নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে আমার ছেলের মন জুগিয়ে এ বাড়ির বউ হয়ে আসবে। তোমার পরিচয় কিন্তু একটা আয়া’র কথা টা মাথায় রেখো।
-বলতে বাধ্য হচ্ছি আন্টি আপনি শিক্ষিকা হতে পারেন ঠিকই কিন্তু আসল শিক্ষা টাই আপনি অর্জন করতে পারেন নি। আয়া’রা কি মানুষ হয় না। তারা সেবা করেই বলে আপনারা সুস্থ হোন। আমার তো এটাই ভেবে অবাক লাগছে আপনার মতো একটা মায়ের ছেলে নাকি উনি।
-বড্ড সাহস তোমার। অনেক হয়েছে তুমি এ-ই মুহুর্তে এই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবে ব্যাছ। তোমার মতো একটা নি*র্লজ্জ বে*হায়া যে নিজের ই*জ্জতের ঠিক করে মান রাখতে পারে না তার কোনো জায়গা নেই এই শাহরিয়ার কুঞ্জে।
– এতো অপমান নিয়ে আমি এ বাড়িতে আর থাকতেও চাই না আন্টি। (একটু থেমে গিয়ে)বাচ্চা টা অসুস্থ তাকে একটু দেখে রাখবেন।
হিয়ার গলা ধরে আসলো। একদিকে এই অপমান তো অন্য দিকে স্পর্শের মলিন মুখ হিয়াকে একবারে চেপে ধরলো। স্পর্শকে রেখে চলে আসতে বুক ছিঁড়ে যাচ্ছিলো হিয়ার। কিন্তু সে নিজেকে বুঝিয়ে নিলো স্পর্শের উপর তার কোনো অধিকার থাকতে নেই কোনো না। হিয়া নিজের মনে পাথর চাপা দিয়ে তার সব কিছু গুছিয়ে বেড়িয়ে আসলো। নিবিড় সাহেব কে ডেকে বললো তাকে স্টেশনে রেখে আসতে।
-না ম্যাম আপনি উজান স্যারের মায়ের কথা গুলো শুনে এভাবে চলে যেতে পারেন না। আপনি বিশ্বাস করুন বড় ম্যাডাম এরকম না। উনি কখনো কাউকে এভাবে আঘাত করেননি। আমি সিউর যে মেহু ওনাকে আপনার সম্পর্কে
-নিবিড় প্লিজ আমি এ বিষয়ে আর একটা কথা বাড়াতে চাই না।আর আমি আপনাকে এর আগেও বলেছি আমাকে এভাবে ম্যাম বলে ডাকবেন না। আমি এ বাড়ির কেউ হই না। একটু বুঝুন।
– সে বুঝলাম। কিন্তু আপনি এখন এভাবে চলে যাবেন না প্লিজ। স্যার যদি এসে আপনাকে না দেখতে পারে বাড়িতে কিন্তু একটা তুলকালাম বেঁধে যাবে। স্যার রেগে গেলে কিন্তু অন্যরকম রুপ ধারণ করে আপনি হয়তো সেটা জানেন না।
-সেটা আপনাদের পারিবারিক সমস্যা নিবিড়। আমার এখানে কিছু করার নেই। স্পর্শের জন্য আমার কতো টা কষ্ট হচ্ছে আমি আপনাকে সেটা ভাষায় বলতে পারবো না। আমার বাচ্চা টাকে একটু দেখে রাখবেন। কিন্তু এতো কিছু অপ*মান সহ্য করে এ বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। ক্ষমা করবেন।
প্যাকেট টা হাতে নিয়ে হিয়া থ হয়ে গেলো। এই লোকটা তো তার সামনেই বসে ছিলো তাহলে এটা রাখলো কখন তার বালিশের তলে এভাবে। ধুর ওসব পড়ে ভাবা যাবে কি আছে আগে তাই দেখে নেওয়া যাক। যেই ভাবা সেই কাজ প্যাকেট টা খুলতেই হতবাক হ’য়ে গেলো হিয়া। পায়েল! আরে এটা তো সেই পায়েল যেটা সেদিন দাদিমণির সাথে বাজারে গিয়ে পছন্দ হয়েছিলো তার। কিন্তু হাতে টাকা না থাকাতে মুখ ফুটে বলতে পারে নি সে। স্পর্শ তখন উজানের কোলে ছিলো কিন্তু উজান কি করে আর কখন’ই বা! হিয়ার অজান্তেই হিয়া খুশি হয়ে লাফিয়ে উঠলো। ঝটপট পায়ে পায়েল টা দিয়েই দাদিমণিকে গিয়ে বলতে থাকলো দাদিমণি দেখো কেমন মানিয়েছে পায়েল টা পায়ে আমার!
!
!
নির্ঘুম এক রাত কাটিয়ে ফেললো হিয়া। না এই কৌতূহল মনের জানার আগ্রহ টা যেনো আজ ক্ষণে ক্ষণে বেড়েই চলছে। কোথায় নিয়ে যেতে পারে উজান তাকে। ভোরে হাঁটতে বের হতে চাইলে নিশ্চয়ই উজান এতো আবেদনময়ী কন্ঠে তাকে অনুরোধ করতো না। সারারাত আর ঘুম আসে না হিয়ার। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে কখন যে রাত ফুরিয়ে ভোরের আগমন ঘটতে থাকে তা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয় হিয়াকে। হিয়া উঠে গিয়ে ওর ব্যাগ থেকে কি পড়ে বের হবে তাই খুঁজতে থাকে। কিছুই যেনো তার মনে ধরছে না৷ উপরন্ত আজ তার নিজেকে আবেদনময়ী সাজে উজানের কাছে মেলে ধরতে ইচ্ছে করছে। যদিও হিয়া জানে এটা ঠিক না৷ অর্পার কাছ থেকে চেয়ে আনা নীল শাড়িটা এ-ই নিয়ে তিনবার বের করেও কি মনে করে হিয়া রেখে দিলো। না মনকে আশকারা দিলে যে চলবে না। কিন্তু মন টাও আজ বড্ড বেহায়াপনা করছে। ঠিক একটা সময় হিয়াকে রাজি করিয়ে নিলো শাড়িতে নিজেকে মুড়ে নিতে। নীল শাড়ি হাত ভর্তি নীল চুড়ি পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই লজ্জায় নিজের চোখ থেকেই চোখ নামিয়ে নিলো হিয়া৷ না আর সাজগোছ কিচ্ছু করা যাবে না কিচ্ছু না মানে কিচ্ছু না। স্পর্শকে ঘুমের মধ্যে আরো এক ফিডারের অর্ধেক খাবার খাইয়ে হিয়া তাকে আবারো ঘুম পাড়িয়ে দিলো। দাদিমণিকে আবারো ডেকে বললো আমি আসছি তুমি একটু দেখে রেখো আমার বাচ্চা টাকে। দাদিমণি হাসলেন সাথে হিয়াকে দিয়ে প্রমিসো করিয়ে নিলেন তার নাতি আর সে মিলে কি কি করলো তার পুরোটা এসে তাকে শোনাতে। হিয়া হাসলো। লজ্জারত মুখে নিচে নামলো। নেমে এসে খুব সাবধানে সদর দরজা পেড়িয়ে উজানের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো হিয়া। আপাতত আকাশে আলো অন্ধকার নিজেদের মধ্যে কম্পিটিশনে নেমেছে কে থাকবে আর কে মিলিয়ে যাবে। হিয়াকে দেওয়া সময় অনুযায়ী উজান নিজেও তৈরি হয়ে নিচে নামলো। হিয়ার সামনে এসে দাঁড়াতেই খেয়াল করলো হিয়ার পড়নে শাড়ি। আবছা আলো আবছা অন্ধকারের মিশেল থাকায় উজান ঠিক বুঝতে পারছিলো না শাড়িটার রঙ টা ঠিক কি রকম। কৌতূহল চাহনি মেটাতে জিজ্ঞেস করলো আপনি কি রঙের শাড়ি পড়েছেন হিয়া,নীল? হিয়া নিজের দিকে তাকালো। হঠাৎ সে কি রঙের শাড়ি পড়েছে এটা কেনো জানতে চাইলো উজান। হিয়া বললো হু নীল,কেনো? উজান উওর দিলো না। এপাশের দরজা টা খুলে দিয়ে হিয়াকে সামনের সীটে বসিয়ে দিলো আর বললো আপনি একটু বসুন আমি উপর থেকে আসছি। হিয়া কথা বাড়ালো না। চুপচাপ গাড়ির মধ্যে বসে রইলো। গাড়িতে এসি ওন করা কিন্তু এসির এই ঠান্ডা হাওয়া টা হিয়ার গায়ে সইছিলো না। ভোরের এমনিতেই একটা ঠান্ডা শিহরণ থাকে তার সাথে এই কৃত্রিম এসি বড্ড বেমানান। পাঁচ মিনিট বাদে উজান আসলো। ড্রাইভিং সীটের দরজা খুলে সীটে বসতেই হিয়া উজানের দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিলো। ওহ তাহলে এ-ই জন্যেই শাহরিয়ার সাহেব উপরে গিয়েছিলেন। হিয়াকে নীল শাড়ি তে দেখে নিজেকে তার বড্ড হিমু সাজতে মন চেয়েছিলো তাই আর কিচ্ছু চিন্তা না করে উজান তার ঘিড়ে রঙের শার্ট টা পাল্টে হলুদ পাঞ্জাবি টা ঝটপট পড়ে নিচে নামলো। গাড়ি চলতে থাকলো গন্তব্যে। দু’জনে আপাতত চুপচাপ আছে। হিয়ার পাশের জানালা টা বেশি অর্ধেক খুলে রাখা৷ সেই খুলে রাখা জানালা দিয়ে হিমেল বাতাস এসে পরতে পরতে রাঙিয়ে দিচ্ছে হিয়াকে। দু হাতে হিয়া মুড়ে নিলো নিজেকে। হিয়াকে ঠান্ডায় জর্জরিত দেখে উজান নিজে থেকেই গাড়ির এসি টা বন্ধ করে দিলো। হিয়া একটু উষ্ণতা অনুভব করলো। এদিকে প্রতিযোগীতায় নামা আলো আর অন্ধকারের মধ্যে আলো বিজয়ী লাভ করলো। অন্ধকারকে ঢেকে দিয়ে আস্তে আস্তে পুরো আকাশ জুড়ে তার তেজ দেখাতে শুরু করলো। হিয়া সীটে মাথা এলিয়ে দিয়েই উজানের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কথার ফোড়ন কাটতে শুরু করলো;
-তাহলে ব্যবসার ফাঁকে গল্প উপন্যাসও পড়া হয় দেখছি।
– কেনো,সাহিত্য কি শুধু আপনি পড়তে পারেন আমি বোধহয় মানুষ না। আমার বুঝি অনুভূতি থাকতে নেই।
– তা তো বলি নি আমি৷ তবে আপনার মতো কঠিন একটা মানুষ যে বইয়ের মোলাটে নিজেকেও মোড়াতে পারে এটা জানা ছিলো না।
-আমি কি সত্যি খুব কঠিন,হিয়া! (অস্ফুটে)
– লোকে তো তাই বলে,
-আপনি কি বলেন?
– কঠিন প্রশ্ন করে ফেললেন! যদি বলতেই হয় তাহলে আমার কাছে আপনি ঠিক নারকোলের মতো। বাহির টা শক্তপোক্ত ভেতর টা একদম নরম!
হিয়ার কথায় উজান একটা প্রশান্তি অনুভব করলো। যাগ দাদিমণির পরে তাহলে কেউ তো আছে যে তার ভেতর টা ঠিক চিনতে পেরেছে!উজান হেঁসে দিয়েই হিয়াকে বললো,
-ধন্যবাদ! তা হিমু হিসাবে আমাকে কি রকম লাগলো বললেন না তো?
হিয়া মুচকি হাসলো। হেঁসে দিয়েই বললো,
_ দুঃখিত হিমু আমার পছন্দের চরিত্র না!
উজান হালকা ভীষম খেলো। গাড়িটা আলতো করে ব্রেক দিয়ে আবার চালাতে শুরু করলো। হিয়ার হিমু হতে তার এই হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে আসা আর সেই হিয়ারই নাকি হিমুকে পছন্দ না। হতাশ কন্ঠে উজান বলে উঠলো,
-তাহলে আপনার কাকে পছন্দ মিস?
-শুভ্রকে!
উজান বিস্মিত কন্ঠে বললো শুভ্রকে! উজানের এই বাংলার পাঁচের মতো মুখ দেখে হিয়া হাসলো শুধু। ভীষণ মায়া হলো তার উজানের মুখটার দিকে চেয়ে।কি একটা ভেবে নিয়ে উজান বললো,
-দেখুন মিস মুনতাসীর আমার হয়তো চুল গুলো শুভ্রর মতো কোঁকড়ানো নয় তবে বেশি স্লিকিও নয় কিন্তু, ধরে দেখতে পারেন। ঠোঁট গুলো দেখুন অনেকটা শুভ্রের সাথে মিল খুঁজে পাবেন৷ সাথে আমার শরীরের রঙ টাও কিন্তু ধবধবে সাদা এ-ই দেখুন। আর হ্যা আমি হয়তো শুভ্রের মতো হাই পাওয়ারের চশমা পড়ি না কিন্তু আমার একটা রিডিং চশমা আছে। যখন হিসাব নিকাশ দেখতে বসি তখন পড়ি। এখন কেউ যদি সত্যি শুভ্রকে চায় তাহলে আমি আমার চোখের পাওয়ার টাকে বাড়িয়ে রেগুলার চশমা ইউস করতে পারি সেটা ব্যাপার না!
উজানের কথায় হিয়া কিছুক্ষণ থ হয়ে জমে গেলো। লোকটা কি সত্যি পাগল নাকি। হিমু হতে না পেরে শুভ্র হবার জন্য তার কতোই না জলপনা৷ কিছু মুহুর্ত থেমে পরমুহূর্তেই হিয়া খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। হিয়ার জোড়ালো কন্ঠের খিলখিল হাসি ভোরের প্রকৃতিতে বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে উজানের কানে এসে পৌঁছাতে শুরু করলো। উজান লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। না মেয়েটা তো তাকে অর্ধেক পাগল বানিয়ে দিয়েছে এবার তার এ-ই জোড়ালো হাসিতে না সে খু*ন হ’য়ে যায়। হিয়া নিজের হাসি থামাতে পাড়লো না। উজানের শুভ্র হবার প্রচেষ্টা তার সাড়া অঙ্গ জুড়ে হাসি ছড়িয়ে দিলো। শেষমেশ উজান বাধ্য হ’য়েই বললো আপনি কি থামবেন মিস!
!
!
গাড়ি এসে গন্তব্যে থামলো। জানালার থাই খুলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে ইশারা করলো উজান৷ লোকটা উজানকে দেখে সালাম দিলো। জ্বী স্যার বলে লোহার বড় গেইট টা মেলে দিতেই উজান তার গাড়ি নিয়ে অনেক ভেতরে গিয়ে গাড়িটা থামালো। জায়গাটা ছিলো শহরের সার্কিট হাউস। সার্কিট হাউস টা যেমনি বিশাল তেমনি সু পরিকল্পিত ভবনে মোড়া। সেই সুবিশাল সার্কিট হাউজের একদম পেছনে বৃহৎকার বনাঞ্চলের মতো জায়গা। যার পুরোটা জুড়ে বিরাজ করছে নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি। একটু দূরে দেখা মিলছে পর পর বেড়ে ওঠা সাত টা মোটা তাজা কৃষ্ণচূড়া গাছের সাড়ি!
গাড়িটা থামিয়ে উজান আগে নিচে নামলো। এপাশের দরজা লক করে হিয়ার দিকে এসে দরজা খুলে হিয়াকে বের হতে বললো। হিয়া বের হয়ে নামতে উজান গাড়ি লক করেই হিয়াকে নিয়ে সেই কৃষ্ণচূড়া গাছ গুলোর মাঝে এসে দাঁড়ালো।
সবুজ রঙের প্রতিটি পাতার গোড়ায় আগুন হয়ে ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া। রক্তিম আবরণে নিজেকে রাঙিয়ে দিয়ে জানান দিচ্ছে তার লাল রঙা সমাহারের। শুধুকি উপরের দিকে কৃষ্ণচূড়া তার আল আভা ছড়াচ্ছে তা কিন্তু নয় একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে মাটিতে এক লাল গালিচা বিছিয়ে দিয়ে হিয়াকে সে তার বন্দনা উপহার দিয়ে স্বাগতম জানাচ্ছে। হিয়া স্তব্ধ। কৃষ্ণচড়ার এই রঙ রুপ গন্ধে মন্ত্রমুগ্ধ। এ কেমন সৌন্দর্যে ভাসিয়ে দিতে নিয়ে আসলো উজান তাকে!…….হিয়া উজানকে রেখে সামনে হেঁটে দাঁড়িয়ে গেলো। আকাশপানে চেয়ে চোখ বন্ধ করলো। একটা কাক ভোরের দমকা বাতাস এসে হিয়াকে ছুঁইয়ে দেবার পাশাপাশি কৃষ্ণচূড়া ভর্তি ডাল গুলোকে নাড়িয়ে দিলো। মুহুর্তে টপ টপ টপ বৃষ্টির মতো লাল ফুল গুলো ঝড়ে পড়লো হিয়ার সাড়া শরীর জুড়ে। উজান হিয়ার পাশে এসে দাঁড়ালো। হিয়ার সাথে সেও আকাশ পানে তাকিয়ে কৃষ্ণচূড়া পড়ার অপেক্ষায় রইলো। কিন্তু কৃষ্ণচূড়া ফুলের তাকে বোধহয় একদমই পছন্দ হয়নি। তাই তো বাতাস থেমে গিয়ে যাও একটা টুপ করে ঝড়ে গেলো সেটা উজানকে পাওা না দিয়ে হিয়ার মুখে এসে আঁটকে গেলো। উজান মুখ নামিয়ে,ঘাড় ঘুড়িয়ে হিয়ার দিকে তাকিয়ে ভূকূঁচকে নিলো। এটা কোনো কথা। এই লাল আভাতে হিয়াকে নিয়ে আসলো কে? সে! তাহলে কৃষ্ণচড়ার এই দল বদলানোর কারণ….উপরের দিকে তাকিয়ে উজান মাথা নাড়ালো যার মানে কাজ টা তুমি মোটেও ঠিক করলে না কৃষ্ণচূড়া। টোটালি আনফেয়ার! মুখ নামিয়ে হিয়ার দিকে তাকালো উজান। চোখ আঁটকে গেলো তার। হিয়া এখনো কৃষ্ণচূড়ার স্বাদ নিতে চোখ বন্ধ করে আছে। ভোরের আলো অনেকটা ফুটে গেছে সেই মলিন আলো এসে পড়ছে হিয়ার মুখে। রক্তিম পরিবেশে আরো স্নিগ্ধ করছে হিয়ার মুখ। হিমেল বাতাসে খুলে রাখা কিছু চুল এসে হিয়ার নাকে আঁটকে গেলো। যার শিহরণ মুহুর্তে গিয়ে লাগলো উজানের বুকে। মেহু সেদিন হিয়ার সামনের এই চুল গুলো কেটে দিয়ে ভালোই করেছিলো এতো গুলো সময়েও যেনো সেগুলো বড় হতে না পেরে জড়ো হলো হিয়ার মুখে।
না তার মনের এই রুপবতীর রুমে নিজেকে আর বেশিক্ষণ ভাসিয়ে দিলে উজানের পুরুষ সত্বা বিপাকে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। উজান আর তাই নিজের মনকে আশাকারা না দিয়ে হাত বাকিয়ে হিয়ার মুখে লেগে থাকা কৃষ্ণচূড়া টা আলতো করে তুলে নিতেই হিয়ার ঘোর কাটলো। চোখ মেলে তাকালো হিয়া। বড্ড বিরক্ত সে। কেনো এ-ই বসন্ত বন্দনা উজান তাকে সর্বাঙ্গে গ্রহন করতে দিলো না,আজব!
হিয়ার চোখের ভাষা পড়তে পেয়ে উজান বললো আর কতোক্ষন এভাবে থাকবেন চলুন সামনে হাঁটি। হিয়া হাঁটার উদ্দেশ্য পা বাড়াতে উজান তাকে থামিয়ে দিলো। একটা গাছের গোঁড়ায় নিজের পায়ের চামড়ার ফ্লাট জুতো গুলো খুলে রেখে দিলো। হিয়াকে চোখের ইশারায় বললো তার পায়ের জুতোটাও খুলতে। হিয়াও সহমত পোষণ করে জুতো টা খুলে উজানের পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো।
দু’জনে এই অবলীল সৌন্দর্য উপভোগ করতে খালি পায়ে পাশাপাশি হাঁটছে। উজানের খুব ইচ্ছে হচ্ছে হিয়ার হাতটা যদি একটা বার সে ধরে হাঁটতে পারতো। কিন্তু থাক। হিয়ার অনুমতি ব্যতীত তার এ মুহুর্তে কিচ্ছু করার ইচ্ছে জাগলো না। একটু হাঁটতে হাঁটতে হিয়া পা উঁচু করে লাফ দিলো। পায়ের তলে লাল ফুল গুলোকে পিষে দিতে বেশ মজাই লাগছিলো তার। হিয়া একটু হাঁটছে একটু লাফাচ্ছে বেশ মজা লাগছে তার। মনে হচ্ছে একটু হাত ছড়িয়ে নাচ করতে পারলে মনের আনন্দ টা জাহির হতো ভালো মতো।এদিকে উজান প্রাণবন্ত হিয়ার এই চাঞ্চল্যের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছে পুরোটা। হারিয়ে যাচ্ছে হিয়ার নারীত্বের মাধুর্যে।…….এদিকে আরেকবার লাফাতে গিয়ে ফুলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইটে পা লেগে হিয়ার পা টা পিছলে যায়। খুব ব্যাথা লাগে হিয়ার। আহ বলে উঠতেই উজান দৌড়ে এসে হিয়ার দু বাহু ধরে হিয়াকে সামলে নেয়। সর্তকভাবে হিয়াকে নিয়ে বসিয়ে দেয় পাশে এক বসার জায়গায়। অস্থির কন্ঠে প্রশ্ন করে আপনি ঠিক আছেন তো হিয়া? হিয়া উওরে বলে তার পায়ে কি যেনো একটা বিঁধে ছিলো। উজান নিচে এক হাটু গেড়ে বসে হিয়ার সেই পা টা নিজের হাঁটুতে তুলে নিতেই হিয়া সংকোচে কি বলবে বুঝতে পারলো না। উজান হিয়ার পা টা বাকিয়ে নিয়ে দেখতে থাকে সব ঠিক আছে কি না। দেখলো না সব ঠিক আছে। পা পরিষ্কার শুধু মাটি লেগে আছে হালকা। উজান হিয়ার পা টা বুলে দিয়ে উঠতে যাবে ওমনি খেয়াল করলো শাড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকা পায়েলের দিকে। যাগ হিয়া পড়েছে তাহলে তার দেওয়া উপহার। উজান হিয়ার শাড়িটা একটু উঁচু করে তুললো। মুহুর্তে কেঁপে উঠলো হিয়া। ফর্সা পা দুটোতে লাল সবুজ স্টোনের পায়েল টা সত্যি অনেক আকর্ষনীয় লাগছে। উজান মুচকি হাসলো উঠে এসে হিয়ার পাশে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করে উজানই কথা শুরু করলো।
– আমরা বাঙালিরা শুধু বাহিরের দুনিয়ার চেরি ফুলে মগ্ন হয়ে থাকি এদিকে আমাদের দেশেও যে এতো সুন্দর কৃষ্ণচূড়া রাজ করে তা আমরা দেখেও বুঝতে পারি না।
-হুম আজ আপনি আমার ভুল ভেঙে দিলেন। ধন্যবাদ।
উজান মুচকি হাসলো কিছু বললো না।
-আচ্ছা এটা তো সার্কিট হাউস তাই না। প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া আপনাকে এভাবে এলাও করলো কি করে?
-বুঝতে পাবারো কোনো প্রয়োজন নেই। বংশ দিয়ে কি হবে কর্মই যদি হয় না মনুষ্যত্বের,তখন!
-আপনার কি মনে হয় আমি অমানবিক কাজে যুক্ত!
-না মিস্টার শাহরিয়ার আপনি তো দয়ার ভান্ডার।
-ব্যঙ্গ করলেন তো____আচ্ছা বাদ দিন জানেন আমি দেখেছি আমাদের দেশে মেয়েদের অনার্স লেভেলে পড়তেই বিয়ে দিয়ে দেয় আপনারো নিশ্চয় বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।
-আপনি আসলে ঠিক কি বলতে চাইছেন খুলে বলুন তো?
– না মাস্টার্স তো শেষ করেছি অনেকদিন হলো। বিয়ে করবার বয়স পেড়িয়ে যাচ্ছে তাই আর কি,
-আপনার বিয়ের বয়স হয়েছে আপনি বিয়ে করুন আমাকে কেনো বলছেন। দাদিমণিকে কি বলবো তার আদরের নাতির জন্য মেয়ে দেখতে?হুম?
-আপনি কি সত্যি কিছু বুঝতে পারেন না হিয়া(অস্ফুটে)
হিয়া কিছু বললো না একটা দীর্ঘ শ্বাস টানলো।না এর চাইতে বেশি হবার আগেই মানুষটাকে সত্যি টা জানানো জরুরি। পরিবেশ টাতেও তারা ছাড়া কেউ নেই এটাই হয়তো সুযোগ!
-একটা কথা বলি আপনাকে…….আমার একটা অতীত আছে। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি যখন সেটা জানবেন আপনি কখনো আমাকে গ্রহন করতে চাইবেন না।
হিয়ার কথায় উজান একটু অবাক হলো।কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
-আপনার কোনো অতীত সম্পর্কে আমার জানার কোনো আগ্রহ নেই হিয়া।
-না থাকলেও আপনাকে শুনতে হবে। কারণ আমি জানি আমার অতীত জানলে আপনি আমাকে গ্রহন তো দূর শাহরিয়ার কুঞ্জ থেকে ইভেন নিজের জীবন থেকেও দূর ছাই করে তাড়িয়ে দিবেন,
-তাহলে তো আমি সেটা আরোও শুনবো না।যেই অতীত আপনাকে আমার থেকে কেঁড়ে নেবার ক্ষমতা রাখে সেই অতীত আমি কখনোই শুনতে চাই না হিয়া,কখনোই না❤️
-কিন্তু আপনাকে জানতে হবে।
উজান হিয়ার হাত টা এবার হিয়ার অনুমতি ছাড়াই চেপে ধরলো। চাপা হাতেই বললো না হিয়া এই অতীত আপনি আপনার কাছেই রাখুন।যেই অতীত আপনাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার শক্তি রাখে সেই অতীত সে কখনেই জানতে চায় না কখনোই না। হিয়া দমে গেলো। উজান হিয়াকে বললো আপনার যতোটা সময় লাগে আপনি নিন। আমি অপেক্ষা করবো। হিয়া শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো উজানের দিকে। লোকটা তাকে এতো কেনো ভালোবাসে!
-কিছু ভাবছেন মিস?
-হুম। ভাবছি আপনার কি দুটো আত্মা?
উজান ভূ কুঁচকে বললো,
-এক্সকিউজ মি!
হিয়া হাসলো, হেঁসে উওর দিলো,
-না যখন বাড়িতে থাকেন একটা গোমড়ামুখে থাকেন, কিসব কঠিন কঠিন কথা বলেন, সবাইকে কি কঠিন কঠিন কাজ করতে দেন, কিন্তু যখন আমার কাছে আসেন তখন আমার কি মনে হয় জানেন?
-কি!
-মনে হয় আপনার রাগী আত্না টা বেড়িয়ে একটা শান্ত নরম আত্মা ঢুকে যায়। মুহুর্তে কেমন পাল্টে যান আপনি। এক অন্য শাহরিয়ার সাহেবকে দেখতে পারি আমি! একদম একটা বাচ্চা যাকে বলে।
উজান হাসলো হেঁসে উওর দিয়ে বললো বাচ্চাই তো। আপনার আর স্পর্শের জন্যই তো বাচ্চা হ’য়ে যাই আমি মাঝেমধ্যে। হিয়া মুখ ঘুরিয়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসলো। বললো চলুন এবার অনেক হয়েছে মেহু উঠে দু’জনকে না দেখতে পেলেই রেগে যাবে। আবার ওদিকে স্পর্শ উঠেই তো আগে তার পটি করতে বসে যায়,ওকে ধুইয়ে মুছে দিতে দাদিমণির কষ্ট হবে ভীষণ। উজান বললো ঠিক আছে আসুন ফেরা যাক। দু’জনে আবার হাঁটছে। হিয়া আবার লাফাচ্ছে। উজান আর কিছু বলছে না। ফোনে জরুরি কথা বলতে বলতে উজান সামনে হাটছিলো আর এদিকে এবার হিয়া লাফাতে গিয়ে বাঁধলো ঘোর বিপদ। শাড়ির নিচে পা আঁটকে গেলো হিয়ার। সাথে সাথে কুঁচি গুলো খুলে আসতেই হিয়া ব্যস্ত হয়ে উঠলো সেগুলো ধরে নিতে। কিন্তু পারলো না। সব খুলে যাচ্ছে তাই অবস্থা। এখন! উজান কথা বলা শেষে হিয়ার কাছে আসতেই হিয়ার নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে চোখ সারিয়ে নিলো। হিয়া কাঁপা হাতে কোনোমতে কুঁচি গুলো কোমড়ে গুঁজে নিতেই সেগুলো পটলা হয়ে গেলো। হিয়া চেষ্টা করেও আগের মতো করতে পারলো না। বাধ্য হয়ে ওভাবেই উজানের সামনে এসে দাঁড়াতেই উজান হিয়াকে দেখে হেঁসে দিলো৷ রাগ হলো হিয়ার। রাগে গটগট করে সে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হিয়ার শাড়ির এই বারো তেরো অবস্থা দেখে উজান নিজের হাসি টা আর থামাতে পারছিলো না। হিয়া আরো রেগে গেলো। উজান ওদের জুতো গুলো নিয়ে এসে হিয়ার সামনে রাখলো। উজান গেট খুলে দিতেই হিয়া সেগুলো পড়ে নিয়ে সীটে বসে গেলো। উজান নিজের জুতো গুলো পড়ে ড্রাইভিং সীটে এসে গেট লাগিয়ে দিলো। সীট বেল্ট লাগাতে লাগাতে ফোড়ন কাটলো,
-আমার কথা না শুনে চললে এরকমই হয়। বললাম লাফালাফি না করতে দেখলেন তো।
হিয়া ভেংচি কেটে সীটে মাথা এলিয়ে দিলো। খুব ঘুম পাচ্ছে তার। সারারাতের ঘুম যেনো এখন গভীরভাবে হানা দিচ্ছে তার দু চোখে। উজান গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলো। ভোরকে সকালে পরিণত করে সূর্য্যিমামা তার আলো বিলিয়ে দিচ্ছে। সরু আলো জানালা ভেদ করে গাড়ির সামনে এসে জোড়ো হচ্ছে। যানজটে ঢাকা পড়তে শুরু করলো পথঘাট। চলতে চলতে ট্রাফিকে আঁটকে পড়লো গাড়ি। গাড়ি থামলো। হঠাৎই নিজের মাথা টা উজানের বা হাতের বাহুতে এলিয়ে না বরং স্ব ইচ্ছায় তার কপাল ঠেকে দিলো হিয়া। দীর্ঘ শ্বাস এসে পড়তে থাকলো উজানের বাহু জুড়ে। উজান হিয়ার মাথায় ওর ডান হাত টা রাখলো❤️ রেখে বললো “খুব ঘুম পাচ্ছে তাই না” হিয়া উজানের বাহুতে তার নাক টা ঘষে নিয়ে আদুরে কন্ঠে বললো হু। উজান হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবারো বললো ” কাল আমিও সারারাত ঘুমোয়নি” হিয়া এবারো উওর দিলো হুম। উজান হাসলো। হিয়া যে নিজের মধ্যে নেই বেশ বুঝতে পারলো উজান। হিয়াকে আর ডাকলো না। তার হাত তখনো হিয়ার মাথায় রাখা। গাড়ির হর্ণের শব্দে হুশ ফিরলো হিয়ার। কি করছে কি এটা সে। ধ্যাত। হুঁশে আসতেই হিয়া সোজা হয়ে বসলো। লজ্জায় নিজের মাথায় নিজে বারি মারতে ইচ্ছে করছিলো তার। উজান সামনে না থাকলে তাই করতো হয়তো সে। হিয়া তার ঘাড়ে হাত রাখলো মনে হচ্ছে ঘাড় টা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। হিয়াকে ঘাড়ে হাত রাখতে দেখে উজান বললো,
উজানের কথায় হিয়া একটু অবাক হলো। সে যে বালিশে ঘুমোয় না এটা উজান কি করে জানলো।
-আপনি কি করে জানলেন আমি বালিশে ঘুমোতে পারি না? তারমানে আপনি রাতে চুপিসারে রুমে এসে আমাকে দেখতেন!
-সন্দেহ আছে আপনার!
হিয়া লজ্জা পেলো ভীষণ। এই লোকটা তারমানে রাতে এসে তাকে দেখে যেতো ইসস!
গাড়ি এসে থামলো শাহরিয়ার কুঞ্জে। উজান নেমে গেলো। সাথে হিয়াও। হাঁটতে হাঁটতে কি মনে করে থেমে গেলো হিয়া। মাথায় হঠাৎই নাড়া দিলো এক প্রশ্ন “সে তো বালিশে ঘুমোতে পারে না ঠিকই কিন্তু প্রতি সকালে সে তার নিজেকে বালিশের মাথায় আবিষ্কার করে কি করে। বুঝে আসতে মুখ দু হাত ঢেকে লজ্জায় লুটে পড়লো হিয়া। তারমানে উজান প্রতিরাতে এসে তার মাথাটা বালিশে দিয়ে দেয়❤️ ইসস জামাকাপড় কি রকম হয়ে থাকে তখন কে জানে। গায়ের ওড়নাটাও তো খুলে মাথার কাছে রেখে দেয় সে। ধ্যাত উজান কি না তাকে ওভাবে! আর ভাবতে পারলো না হিয়া। দৌড়ে দরজা ডিঙিয়ে উজানের নাগাল পেতে ভেতরে প্রবেশ করে থমকে গেলো সে। উজানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহু। চোখে তার আগুনের দাবানল। ভয়ে আঁতকে উঠলো হিয়া!
-কোথায় গিয়েছিলে তোমরা এই সাত সকালে উজান?
উজানের সোজাসাপ্টা উওর সে হিয়াকে নিয়ে বাহিরে গিয়েছিলো কিছু জিনিস দেখাতে কোনো সমস্যা? মেহু কিছু বলার আগেই উজান বলে উঠলো হিয়াকে আমি নিয়ে বেড়িয়েছিলাম, আশা করবো এই নিয়ে বাড়িতে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলবে না আর। বলেই উজান সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। মেহুকে পাশ কাটিয়ে হিয়া উপরে যাবে কিন্তু মেহু হিয়ার বাহু খামচে ধরে হিয়াকে আঁটকে দিয়ে বললো,
-তোমার শাড়ির এই অবস্থা কিসের জন্য!
মেহুর কথায় নোংরা ইঙ্গিত অনুভব করলো হিয়া। মেহুর চাইতেও কোটিগুন আগুনের লাভা এসে জমা হলো তার দু চোখে।মেহু হিয়ার এই চোখের আগুন সহ্য করতে পারলো না৷ আরো জোরে হিয়ার হাত চিপে ধরে বললো,
-নিজেকে বিলিয়ে দিতে গিয়েছিলা তাই না। কি ভাবো শরীর দিয়ে আমার উজানকে নিজের করে নিতে পারবে তুমি।
-ঠিক করে কথা বলেন মেহু। মাএা ছাড়াবেন না। আপনি এর আগেও আমাকে অনেক অপমান করেছেন আমি কিচ্ছু বলি নি কিন্তু
-আমি আপনাকে শেষ বার বলছি। আজ যা বলেছেন বলেছেন নেক্সট টাইম আমার সম্পর্কে এরকম বাজে মন্তব্য করলে এই আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না কেউ না।বলে রাখলাম।
ব’লেই নিজের বাহু থেকে মেহুর হাত টা ছাড়িয়ে উপরে চলে গেলো হিয়া!
-তুমি আমাকে চোখ রাঙালে তো হিয়া। এরপর দেখো আমি কি করি। আন্টি আসছে তো সামনের সপ্তাহে। আমি ওনার কানে তোমার নামে এতো বিষ ঢালবো যে উজানকে অগ্রাহ্য করে হলেও উনি তোমাকে এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হবে।
চলবে,,
আকাশ কাপিয়ে এখনো অবিরত বৃষ্টি ঝরে পড়ছে। কখন গিয়ে এই বৃষ্টি থামবে তা জানা নেই। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে উজান আর হিয়া। রিকশা দাদু একটু দূরে দাঁড়িয়ে তার ভেজা পলিথিনের ব্যাগ থেকে টাকা গুলো বের করে দেখছে সেগুলো অক্ষত আছে কি না। পরিবেশের এ-ই শীতল আমেজে গা শিরশির করছে হিয়ার। তার উপর তারা দু’জনই ভিজে গিয়েছে অনেকটা। হিয়া এক কোণে দাঁড়িয়ে গায়ে লেগে থাকা পানি গুলো ঝারছে। সাথে ভেজা চুল গুলোও হাত দিয়ে চিপে ঝেড়ে নিতে থাকলো হিয়া। যার ফলপ্রসূ সেগুলো থেকে পানি ছিটকে এসে উজানের মুখে পড়তেই উজান হিয়ার দিকে চোখ তুলে তাকালো। বৃষ্টির ছাট এর সাথে হিয়ার ভেজা চুলের পানি এসে জড়ো হতে থাকে উজানের মুখে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে উজান। হিয়ার এ-ই কাক ভেজা শরীর এক অন্য রকম স্নিগ্ধ শীতল মার্ধুযতে ভরিয়ে দিচ্ছে হিয়াকে। মেঘ গুলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে গুরুম গুরম ডাকছে। তাদের ঝলকানিতে কিছু আলো এসে জড়ো হচ্ছে হিয়ার মুখে। বজ্রপাতের অগ্নিমূর্ত আলোর এই ঝলকানি হিয়ার উপর পড়ে যেনো জানান দিচ্ছে এ-ই প্রেয়সী শুধু তোমার জন্যোই লিখে রাখা উজান। শুধু তোমার জন্য। উজানের চোখে চোখ পড়তে চোখ নামিয়ে নিলো হিয়া৷ চুল গুলো হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। উজান পেছনের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে একটা পা ভাঁজ করে তুলে দিলো সেই দেওয়ালে। তার পাশে এক পা দূরে দাঁড়িয়ে হিয়া। একটা হিমেল বাতাস এসে ছুঁইয়ে দিলো দুজনকে। পাশে বেড়ে ওঠা গন্ধরাজ ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়লো আর মনোমুগ্ধকর গন্ধে উজান আর হিয়াকে জানিয়ে দিলো যে আজ বৃষ্টি শুধু তোমাদেরকে ভিজিয়ে দিতেই এই বসুন্ধরার পতিত হচ্ছে। শুধু তোমাদেরকে ভিজিয়ে দেবার জন্যই! সব নিরবতা কাটিয়ে উজান নিজে থেকে কথা শুরু করলো।
-আমি সাথে না আসলে কি হতো বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই?
-কি আর হতো। তখন শুধু আমি আর এই দাদু একা একা দাঁড়িয়ে থাকতাম এভাবে। আর কি?
-তাই। আপনি কি জানেন আপনার সাহস স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই।
-সমস্যা কি তাতে। সাহস থাকা তো গুনের কথা তাই নয় কি।
-মাঝে মাঝে অতিরিক্ত সাহস দেখাতে গেলে হিতে বিপরীত হয়ে যায় আপনি বোধহয় সেটা জানেন না____আচ্ছা বাদ দিন ওসব কথা। এই কদিনে এটা বেশ বুঝতে পেরেছি আপনার সাথে কথায় আমি পারবো না।
হিয়া মুচকি হাসলো,হেঁসে দিয়েই বললো,
– মেয়ে মানেই একটু বেশি কথা। আপনি হয়তো এর আগে খুব একটা মেয়েদের সাথে মেলামেশা করেননি তাই জানেন না।
-তা ঠিক। তা আপনার সম্পর্কে তো খুব একটা জানার সুযোগ হলো না। সেদিন বললেন ফুফুর কাছে মানুষ আপনি?
-জ্বী।খুব ছোটতে বাবা মাকে হারিয়ে ফুফুর কাছে বড় হওয়া। আমাদের ছোট্ট পরিবার আমি ফুফা ফুফু আর তাদের এক মেয়ে বুলি আর আমার দাদি।
-অনার্স থার্ড ইয়ার?
-জ্বী। আপনার পড়াশুনা?
-জ্বী হিসাববিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছি তিন বছর হলো। পারিবারিক এতো বড় বিজনেসের জন্য আর চাকরির দিকে মনোনিবেশ করতে মন চায় নি।
-ওহ! ঠিকই আছে এতো বড় পারিবারিক ব্যবসা থাকতে আর চাকরির জন্য এপ্লাই করবার কি প্রয়োজন৷ আমাদের মতো কিছু শিক্ষিত বেকারদের কেও তো একটু সুযোগ দেওয়া উচিৎ তাই না বলুন?
-শিক্ষি–ত বে–কার। আপনি একটা চাকরি করছেন তবুও বলছেন আপনি বেকার?
– এই চাকরিটা নিশ্চয়ই আমার সারাজীবন থাকবে না?
-অবশ্যই পারে, আপনি চাইলেই থাকতে পারে! কেনো পারবে না?
হিয়া বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,এই কথাটার মানে?
-না কিছু না। আসুন বৃষ্টি টা ধরে গেছে অনেকটা, এবার ফেরা উচিৎ।
হিয়াকে আর কিছু বলতে না দিয়ে উজান রিক্সায় গিয়ে উঠে পড়লো। রিক্সা দাদু এসে প্যাডেল তুলতেই হিয়াও পেছন পেছন এসে উজানের পাশে বসে গেলো। মাএারিক্ত বৃষ্টি না থাকলেও এখনো ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। উজান পলিথিনের ব্যাগ টা আবার হুটে গুঁজে দিলো। কোথা হতে এক অদৃশ্য আলো এসে পড়তে থাকলো দু’জনের শরীরে। উজান হিয়ার মুখের দিকে অনেকক্ষণ যাবৎ তাকিয়ে আছে। হিয়া নিজেও বুঝতে পারছে উজান তার দিকে তাকিয়ে আছে। হিয়ার মনে এ মুহুর্তে ঘোর পাক খাচ্ছে উজানের বলা শেষ কথা টা। কোনো কিছুতেই হিয়া এর রহস্য ভেদ করতে পারছে না। তার উপর উজানের এই অপলক তার দিকে তাকিয়ে থাকা বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। না এবার আর চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। এ-ই লজ্জা নাহলে শেষ করে দেবে হিয়াকে। হিয়া উজানের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে ভূ কুঁচকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি সমস্যা? উজান মুচকি হাসলো কিছু না বলে তার চোখ নামিয়ে নিলো। এখনো উজানের ঠোঁটে এক ভালোলাগার হাসি ঝুলছে।
-আপনি কি সব মেয়েদের দিকেই এভাবে তাকিয়ে থাকেন?
-না আপনি প্রথম!
স্বাভাবিক উওর উজানের৷ কিন্তু এই স্বাভাবিক উওর টাই বড় অস্বাভাবিক লাগলো হিয়ার কাছে।একটা বড়সড় রকমের ভীষম খেলো হিয়া। কি বলছে কি এই লোকটা। হিয়া গোয়েন্দা ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
-বাড়িতে আপনি যেভাবে থাকেন আপনাকে দেখে কিন্তু এটা বোঝার উপায় নেই আপনি মেয়েদের সাথে এভাবে ফ্লাট করতে পারেন।
-আমি আপনার সাথে ফ্লাট করছি?
-তা কি করছেন,চড়ুইভাতি খেলছেন?
উজান হাসলো শুধু।প্রতিউওরে কিছু বলতে যাবে তার আগে রিক্সা এসে থামলো বাড়ির কাছে। উজান কিছু বলতে পারলো না না পারলো হিয়া নিজে। দুজনে বাড়িতে ঢুকলো। এদিকে বাড়িতে এসে দেখা মিললো উজানের সেই চিরচেনা গম্ভীর রুপ। হিয়া তো অবাক এটা কি সেই মানুষ যে একটু আগে তাকে লজ্জার সাগরের একদম গভীরে ডুবে নিয়ে যাচ্ছিলো। রাগে মাথার চুল খামছে ধরে হিয়া৷ না এ-ই লোকটাকে চেনা বড় মুশকিল!
!
কিছুদিন বাদে;
খাবার টেবিলে ঠিক সময় এসে যে যার মতো বসে গিয়েছে। উজান নিবিড়ের সাথে টুকিটাকি কথা বলছে। দাদিমণি কথা বলছে এ বাড়িতে থাকা আরেকজন ভদ্রমহিলার সাথে উনিও এ বাড়ির পুরাতন কাজের মানুষ কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নাই।উপরন্তু উনি শিক্ষিত আবার সৌন্দর্য মন্ডিতোও। পাশের চেয়ারে স্পর্শকে নিয়ে বসে আছে হিয়া। বুঝাই যাচ্ছে আজও স্পর্শ ঠিক মতো হিয়াকে খেতে দিবে না কিন্তু কি করার এ-ই মুহুর্তে হিয়া ছাড়া যেনো তার আর কারো কোল পছন্দ হচ্ছে না। কিছুক্ষণ বাদে মোহিনী আসলো। পড়নে একটা শর্ট স্কাট উপরের কটি টাও চোখে লাগার মতো। বুকের অনেকটাই বেড়িয়ে আছে তার। হিয়া মেয়ে হয়েও মোহিনীর দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছে এরকম। দাদিমণি কিছু বললেন না কারণ মোহিনীর এই সব পোশাকে উনি অভ্যস্ত। যদিও এই ব্যাপারে উজানের ছিলো কঠোর নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু মোহিনী কি আর তা শোনার মেয়ে।
খাবার খাওয়ার মাঝপথে নিজের টুকু শেষ করেই মোহিনী বলে উঠলো তার হয়ে গেছে সে এখন একটু বাহিরে ফ্রেন্ডদের নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে। সন্ধ্যার আগে হয়তো ফিরে আসবে। মেহুর কথায় খাবার থামিয়ে দিলো উজান। মুখ তুলে কঠিন চোখে মেহুর উপর প্রশ্ন তুললো।
-তুমি এই পোশাকে বাহিরে বের হবে মেহু?
-এই পোশাকে মানে! আমি তো এর আগেও এই পোশাক পড়ে বেড়িয়েছিলাম উজান। তাতে কি?
-তাতে কি মানে। আমি এর আগেও অনেকবার নিষেধ করেছিলাম তুমি ঢাকা গিয়ে যা ইচ্ছে করো কিন্তু এসব এখানে চলবে না। তুমি তারপরো কেনো? এসব আমার একদম ভালো লাগে না মেহু।
-এখন তো তোমার আমার কোনো কিছুই ভালো লাগবে না উজান!
বলেই ভাতের প্লেট টা সামনে চটকে দিয়ে মেহু তার রুমের দিকে পা বাড়ালো। দাদিমণি ঠান্ডা গলায় উজানকে বোঝাতে চেষ্টা করলো কিন্তু উজান শুনলো না। মেহুর জন্য এর আগেও তাকে কথা শুনতে হয়েছিলো কিন্তু এবার যেনো একটু বেশি লাগামহীন হ’য়ে যাচ্ছে সে। হিয়া এবার ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো,
-দিলেন তো মেয়েটার খাওয়া টা নষ্ট করে। আমি এর আগেও দেখেছি আপনি মেহুর উপর সবসময় এরকম করেন। এভাবে না রাগ করে শান্ত ভাবে তাকে বোঝালেই সে ঠিক বুঝবে।
-আপনি কতোটা জানেন মেহু সম্পর্কে?।
-দেখুন জানা টা বড় কথা না। এতদিনে এতটুকু তো আমি চিনেছি মেহু ঠিক কি রকম। মেহুর পোশাক নিয়ে সমস্যা তো আপনার। ঠিক আছে আমি বলছি মেহু এ পোশাকে আর কখনো বাহিরে যাবে না।
উজান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো তা কখনোই সম্ভব নয় মিস মুনতাসীর ৷ হিয়া হাসলো সে জানে মেহুকে ঠিক কি করে রাজি করানো যায়। সে দাদিমণির কানে কানে গিয়ে বললো দাদিমণি যাতে মেহুকে গিয়ে বলে এই জামা টা সে হিয়ার জন্য কিনেছিলো তাকে ভীষণ মানাবে নাকি। মেহু তো এসব পড়ে না,কি বুঝবে তার মর্ম। দাদিমণিও হিয়ার কথা অনুযায়ী তাই করলো। আরো রস ঢেলে মেহুকে কথা গুলো বলতেই সাথে সাথে কথাগুলো গিয়ে লাগলো মেহুর কলিজাতে,এই পোশাকে নাকি তার চাইতে হিয়াকে বেশি সুন্দর লাগবে। অসম্ভব। সে দাদিমণিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বললো সে এই পোশাক পড়বে আর তাকে হিয়ার থেকে ঠিক কতো টা সুন্দর লাগে তাই সে দেখাবে…….হিয়ার উদ্দেশ্য সফল। মেহু হিয়ার থেকে নিজেকে বেস্ট প্রভ করতে দাদিমণির দেওয়া জামা পড়ে বেড়িয়ে পড়লো বাহিরে। এদিকে উজান হতবাক। সাথে নিবিড় সাহেবও অবাক। দাদিমণি হেঁসে দিয়ে উজানকে ঘুতো দিয়ে বললো এতোদিনে বাড়িতে একটা যোগ্য মানুষ ঢুকেছে,হিয়া যেমন কথার জালে মেহুকে ফাসালো ওমনি তোকেও দেখিয়ে দিলো তুই কতো অক্ষম হু। দাদিমণির কথায় উজান হাসলো। হিয়ার কাছে নিজের অপারগতা স্বীকার করে নিলো অকপটে। হিয়া মুচকি হেসে বিজয়ী ভঙ্গিতে স্পর্শকে খাওয়াতে উপরে উঠে আসলো। হিয়ার এই এক ফালি হাসি উজানের ভেতরের স্বত্বা টাকে জাগিয়ে তুললো। চুপিসারে উজানকে এসে বললো এরপরো তোমার কোনো সন্দেহ আছে উজান…!!
!
!
দেখতে দেখতে সময় গুলো ফুরিয়ে তিনটে মাসের কাছাকাছি হয়ে আসলো। এই তিন মাসে স্পর্শ আর হিয়া দুজন যে দু’জনকে এতো টা আপন করে কাছে টেনে নিবে এটা উজান বা দাদিমণি সবার জন্য ছিলো অবিশ্বাসযোগ্য। স্পর্শ যেনো হিয়ার মাঝে তার মায়ের কোল খুঁজে পেতে থাকলো। এদিকে হিয়াও এক অজানা টানে তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত সেই মাতৃত্বকে বিলিয়ে দিতে থাকলো স্পর্শের মাঝে। দু চারদিন নিজের ঠিক করে দেওয়া রুমে থাকলেও পরে স্পর্শকে ছাড়তে কিছুতেই মন চাইলো না হিয়ার। সে ঠিক করলো সে দাদিমণির রুমে সে স্পর্শ আর দাদিমণি থাকবে। দাদিমণি দ্বিমত পোষণ করলেন না বরং কথাটা শুনে উনি আরো খুশি হলেন। স্পর্শকে ঘুম থেকে তুলে,খাওয়া থেকে শুরু করে আবার রাতে ঠিক মতো খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া সবটা হিয়া একা হাতে করতো। দাদিমনি চাইলেও কিচ্ছু করতে দিতো না। এর বেশি এ বাড়িতে তেমন আর কাজ ছিলো না হিয়ার। স্পর্শ ঘুমালে বা নিবিড়ের সাথে বাহির হাঁটতে বের হলে হিয়া কিছু সময় ওর বই গুলো নাড়াচাড়া করতো কখনো বা সেলাইয়ের কাজে দাদিমণিকে সাহায্য করতো।
এদিকে উজানো এই কটা মাসে হিয়ার ব্যবহার থেকে শুরু করে হিয়ার মুখের এক ফালি হাসিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করলো। সব মেয়ে তো তাকে,ঠিক না তাদের এই বিশাল শাহরিয়ার কুঞ্জে আসার জন্য একটু বেশি হেংলামোপোনা করতো। যেচে এসে গায়ে ঝুলতো কিন্তু হিয়া,হিয়া যেনো একটু বেশি অবাধ্য তার। উজান বাড়ির সবার সামনে একটা গাম্ভীর্যের বিস্তার ঘটালেও হিয়ার সামনে এমন সব কাজকর্ম করতো যে হিয়ার বুঝতে বাকি থাকতো না এই লোকটা তার নিজেকে হিয়ার মাঝে ধীরে ধীরে বিলিয়ে দিচ্ছে।
_______________________________
হিয়ারই সমবয়সী হিয়ার ফুফাতো বোন বুলবুলি। সবাই ছোট্ট করে বুলি বলেই ডাকে।অতি সুন্দর উপাধি দিতে গেলে যা দরকার হয় তার পুরোটাই তার মাঝে বিদ্যমান। এই সৌন্দর্য যেকোনো ছেলেকে কাবু করতে যথেষ্ট। তার এই সৌন্দর্য পেতে মরিয়া হয়ে থাকে অনেক পুরুষই। সেই তালিকা থেকে বাদ যায় না বিহান নিজেও। হিয়ার থেকে যখন কিচ্ছু পেতে পারলো না তখন চাকচিক্যের আড়ালে মুড়ে নিলো সে বুলিকে। বুলির অপরিপক্ক মস্তিষ্কে একটা নেশা তৈরি করে দিলো হিয়ারই অগোচরে। সেই বিহানের সাথে ফোনে কথা বলতে গিয়েই একদিন বুলি মুখোমুখি হলো অর্পার। অর্পা কিছু বললো না তবে সে বেশ বুঝতে পারলো হিয়ার বিয়ে ভাঙা নিয়েই কিছু কথা বলছিলো বুলি। যার রহস্য জানতে এবার হিয়ার পাশাপাশি গোয়ান্দার খাতাতে নাম লিখতে প্রস্তুত হলো অর্পা নিজেই।
______________________________
দুপুরে স্পর্শকে ঘুম পাড়িয়ে বিছানায় একটা বড় কাথা নিয়ে বসেছে দাদিমণি আর হিয়া। দু’জনে দুদিক থেকে ধরে কাঁথায় সেলাই বুনছে আর হাজারো কথার ফুলঝুরি ফুটাচ্ছে। হঠাৎই গল্পের মাঝে দাদিমণি হিয়াকে একটা প্রস্তাব দিয়ে বসলো যেটা ছিলো হিয়ার কাছে সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত একটা বিষয়!
– আমার নাতি টাকে বিয়ে করবি হিয়া?
দাদিমণির এই কথা শুনে সেলাই থামিয়ে দিলো হিয়া। হিয়া স্তব্ধ সাথে কম্পিত। এটা কি বলে দিলো দাদিমণি! নিজেকে সামলে নিয়ে হিয়া স্বাভাবিক ভাবে তার মুখে এক ফালি হাসি টেনে বললো,
-ধ্যাত পাগল তুমি দাদিমণি__তোমার নাতির মতো একটা কঠিন মানুষকে বিয়ে করবো আমি। সারাজীবন না শাসন এর উপর দিয়ে থাকতে হবে। এটা করা যাবে না। ওটা ঠিক না। এটা সময় মতো কেনো হয়নি। আরো কতো কঠিন কঠিন জিনিস
-ধুর পাগলি। আমার উজান মোটেই কঠিন না। সে শুধু সঠিক টাকে সঠিক আর ভূল টাকে ভূল ব’লেই বিচার করে চলতে চেষ্টা করে। এছাড়া ওর মন টা একদম নরম।
-কচু নরম। ফাজিল একটা লোক। তুমি তো জানো না উনি আসলে ঠিক কি রকম। আসলে আমি না নিজেও বুঝতে পারি না উনি আসলেই ঠিক কি রকম। এরকম না ওরকম।
-কি বলছিস বল তো একা একা। ছাড় ওসব আমি উজানের চোখে তোর জন্য ভালোলাগা দেখেছি। তুই রাজি থাকলে আমি তোর ফুফুকে বলে না হয়
-বাদ দেও তো দাদিমণি এসব কথা। এটা কখনো সম্ভব না। ওসব ছাড়ো তুমি যে বললা প্রতি বছর বৈশাখে নাকি বাড়িতে সব আত্মীয় স্বজন এক হয়। তো আর এক মাস বাদে তো বৈশাখ এবার আসবে না সবাই?
-আসবে মানে। বৈশাখে আমাদের বাড়িতে কতো মজা হয় তুই শুধু তাই দেখবি। যতোই রেশারেশি চলুক এই দিনে ঐতিহ্য অনুযায়ী হাল খাতার আয়োজন হয়।আর নিয়ম অনুযায়ী উজান সব হিসাব করে যার যার ব্যবসায়িক পাওনা মিটিয়ে দেয়। তাই না চাইতেও সবাই এসে জড়ো হয় এই শাহরিয়ার কুঞ্জে।
-রেশারেশি কেনো বলছো দাদিমণি? বাড়িতে কি সবার সাথে সবার মনোমালিন্য আছে?
-শুধু কি মনোমালিন্য রে মা আরো যে কতো কি চলে। বাদ দে ওসব মনে করলেও কষ্ট হয় আমার।
-কেনো দাদি তুমি যে বললে ঔ ওনার সব কাজিন’রা নাকি একসাথে এ বাড়িতে থাকতো। বিহান নিলয় স্নেহা আর কি কি নাম বললে ওদের সাথে কি ওনার সম্পর্ক ভালো না। না মানে কখনো সেভাবে…
হিয়া আর কিছু বলতে যাবে সেই মুহুর্তে মোহিনী রুমে এসেই হিয়াকে জেড়া করতে শুরু করলো।ভয়ে আঁতকে উঠলো হিয়া।
-তুমি তো এ বাড়িতে নার্স হিসাবে জয়েন করেছো তাই না। তাহলে এ বাড়িতে কে কোথায় থাকে,কার সাথে কার কি সম্পর্ক এতে এতো নজরদারি কিসের তোমার?
মোহিনীর কথায় দাদিমণি রাগ করে তার দিকে ঝারি দিয়ে উঠলো। এ কেমন আচরণ করছে মেহু হিয়ার সাথে। মেহু দাদিমণিকে পাওা দিলো না বরং উল্টে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলো
-তোমার মনে হয় না দাদিমণি ইদানীং তুমি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করো এই মেয়ে টাকে নিয়ে। আর তোমাকে বলছি,আমার কিন্তু নজর তোমার উপর সবসময়ই থাকে। সেদিন ও দেখলাম নিবিড়ের সাথে বাড়ির সবার ব্যাপারে কথা বলছিলে।
-আপনি আমাকে ভুল ভাবছেন।
-তাই,সময়ই বলবে সেটা।
আরো অনেক কথা শুনিয়ে মেহু রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।দাদিমণি বললো মেহুর কথায় মন খারাপ না করতে ওহ কেনো জানি প্রথম দিন থেকেই তোকে সহ্য করতে পারে না। হিয়া কিছু বললো না শুধু একটাই ভয় বাসা বাঁধলো তার মেহু যদি কখনো সত্যি সত্যি তার উদ্দেশ্য জানতে পারে। হিয়ার কাছে এই তিন মাসে সবকিছু অনেকটা পরিষ্কার এখন শুধু সে একবার মুখোমুখি হতে চায় বিহানের!
!
!
রাতের দিকে স্পর্শকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের বই টা খুলে স্পর্শের গা ঘেঁষে শুইয়ে ছিলো হিয়া। সে তো বই পড়ছে কম পাতা উল্টোছে বেশি। হালকা করে কাশি দিয়ে উজান রুমে ঢুকলো। হিয়া সোজা হয়ে বসে গায়ের ওড়না টা ঠিক করলো। উজান বিছানায় বসে স্পর্শের মাথায় হাত বুলে দিলো। আজ বড্ড হিংসে হচ্ছে তার। আগে স্পর্শ উজান বলতেই পাগল ছিলো উজানই ছিলো তার মা তার বাবা কিন্তু হিয়া আসার পর স্পর্শের কাছে তার গুরুত্ব কিছুটা হলেও কমে গিয়েছে। উপরন্তু আগে তো সময় সুযোগ পেলেই স্পর্শকে নিয়ে ঘুমোতো সে এখন তো হিয়া তার সেই অধিকার টাও কেঁড়ে নিয়েছে।
-খুব তো বাচ্চা টার জন্য চিন্তা করেন। তা সারাদিনে তার কাছে আসার এখন নিয়ে সময় হলো আপনার?
উজান মুচকি হেসে উওর দিলো,
– কি করবো বলুন। মাঝেমধ্যে কাজের এতো চাপ এসে যায়। আর তাছাড়া পরশও তো এখন সারাক্ষণ ইয়া ইয়া (হিয়া হিয়া স্পর্শের আধো আধো স্বরে উচ্চারিত হয় ইয়া ইয়া) করে আমার আর প্রয়োজন টা কোথায় তার।
-এতে বুঝি আপনার খুব হিংসে হয়?
– হিংসে হওয়া টা কি স্বাভাবিক নয়_____ঘুমোননি কেনো এখনো। বই পড়ছিলেন?
-হুম
উজান হিয়ার হাত থেকে বই টা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে থাকলো। ইংলিশ লিটারেচার এর বই ছিলো একটি।
-ওহ আপনি তো আবার ইংলিশ এর স্টুডেন্ট। আমি অবশ্য ইংলিশ কম পাড়ি। আপনার কথা স্মরণে থাকবে। এরপর ফরেন থেকে কোনো প্রডাক্টের জন্য ইমেইল আসলে আপনাকে দিয়ে পড়াবো। মাঝেমধ্যে কিছু ওয়ার্ডের মিনিং জানা থাকে না। আপনি হেল্প করবেন…….কি করবেন তো, স্যালারিও দেবো সমস্যা নেই,কতো দিতে হবে বলুন?
হিয়া হাসলো, হেঁসে উওর দিলো
-আপনি তো এ্যাকাউন্টিং এর স্টুডেন্ট। হিসাব নিকাশ ভালোই পারেন। আপনি একটু হিসাব করে দিয়ে দিয়েন।
-বেশ! তাহলে তাই হবে?
– তবে যখন আমি থাকবো না তখন কি করবেন।
-কেনো থাকবেন না বলছেন?
-আরে,স্পর্শ কি সবসময় ছোট থাকবে,একদিন বড় হবে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। আমিও তখন এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।
-স্পর্শের প্রয়োজন ফুড়াবে না আপনার, কোনটা?
-মানে!
-আপনি চাইলেই সারাজীবন এ বাড়িতে স্পর্শের মা বাবা যাই বলি সেটা হ’য়ে থাকতে পারেন। আমাদের কারো কোনো আপওি হবে না।
-বালাইষাট। আপনাদের বাড়িতে অহেতুক থাকতে কেনো যাবো আমি। আমার কি কখনো বিয়ে হবে না সংসার হবে না।
-হবে কেনো হবে না?
-তাহলে কিভাবে হবে? আমার যে হাসবেন্ড হবে সে যদি স্পর্শকে গ্রহন করতে না চান তখন?
– এমন কাউকে বিয়ে করে নিলেই তো হচ্ছে যে আপনার পাশাপাশি স্পর্শকেও গ্রহন করবে!
উজানের কথার মানে বুঝতে দেড়ি হলো না হিয়ার। কিন্তু এটা যে কখনোই সম্ভব নয়। হিয়া প্রসঙ্গ বদলাতে চাইলো।
– ছাড়ুন ওসব কথা। অনেক রাত হচ্ছে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
-যাবো বলছেন?
– হ্যা যান।
-আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?
-না অবাক হচ্ছি। আপনি অন্য সবার সাথে কতো মেপে ঝুঁকে কথা বলেন আর আমার কাছে আসলেই কিরকম ভাঙ্গা রেডিও হয়ে যান। টিয়া পাখির মতো কথা বলতেই থাকেন। তখন আপনার সেই গাম্ভীর্য কোথায় হারিয়ে যায় শুনি?
-বিশ্বাস করুন আমি নিজেও জানি না সেগুলো কোথায় হারিয়ে যায়। আপনাকে দেখলেই মনে হয় সারাক্ষণ কথা বলি।
-তাই, কথাটা মেহুকে গিয়ে বলতে পারবেন আপনি?
-আপনি সুযোগ দিলে মেহু কেনো বাড়ির সবাইকে বলতে পারবো।
উজানের কথায় হিয়া লজ্জা পেলো ভীষণ।স্পর্শের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো “যান তো আপনি,একটু বেশি কথা বলে ফেলেন আজকাল” উজান মুচকি হাসলো। উঠে দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে এসে নিজেকে একবার দেখে নিলো। রুম থেকে বেড়িয়ে পড়তে যাবে ওমনি কি মনে করে আবার এসে হিয়ার পাশে বসলো। হিয়া বিরক্তি নিয়ে বললো আবার কি চাই, স্পর্শ উঠে যাবে তো।
-কাল একবার ভোরের দিকে আমার সাথে বের হতে পারবেন!
হিয়া বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো কেনো? ভোরে হঠাৎ!
-আমাকে বিশ্বাস করেন তো আপনি। কোনো ক্ষতি হবে করবো না আপনার।
– আমি সে কথা বলেছি একবারো। কিন্তু এতো ভোরে মেহু জানতে পারলে,
– মেহু কখনোই ভোরে ওঠে না। আপনি উঠেন, নামাজ পড়তে আমি জানি৷ প্লিজ না করবেন না।
-হ্যা কিন্তু। ওতো সকালে কোথায় যাবো আমরা?
– আপনি সেদিন ছাঁদে কি জানি বললেন আপনার পছন্দের ফুল জারুল সোনালু তাই তো। কাল আমি আপনাকে এর চাইতেও সুন্দর কিছু দেখাবো। তৈরি থাকবেন। আসছি আমি___শুভ রাএি।
বলেই উজান চলে যেতে হিয়া খানিকটা ভাবনার জগৎ এ হারিয়ে গেলো। কোথায় নিয়ে যেতে পারে উজান তাকে এই কাক ভোরে। ভেবেও কিছু কূল কিনারা বিহিত করতে না পেরে হিয়া ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিতে উঠে দাঁড়ালো। আর পায়ের কাছে বালিশ টা তুলতে গিয়েই আবিষ্কার করলো একটা নীল রেপিং পেপারে মোড়া প্যাকেট!