Thursday, June 26, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 104



সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-০৮

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্য-০৮
ফারিহা জান্নাত

ভোর পাঁচটা, পৃথিবীর সকল মানুষ এখনো জাগে নি। পাখির কলকাকলিতে মত্ত প্রকৃতি। পৃথিশার হাতে প্লাস্টার করে দেওয়া হচ্ছে। ভোর বেলায় একবার বাসার দিকে গিয়েছিল সে। আসার সময় সিএনজির ধাক্কায় পড়ে হাত মচকে গিয়েছে, যেহেতু সে জার্নি করবে তাই হাতটা আপাতত প্লাস্টার করে দেওয়া হচ্ছে। কিছুসময় পরই পৃথিশা ডাক্তারের কেবিন থেকে বেরিয়ে মণিদীপার কেবিনে ঢুকলো। গতকাল রাতের পর থেকে মণিদীপা পুরো শান্ত হয়ে গেছে। কারো সাথে কোন কথা বলছে না। মণিদীপা চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে আছে। পৃথিশা তার দিকে এগিয়ে গেলো। কপালে হাত বুলিয়ে ধীর স্বরে ডাকতেই চোখ মেললো। তারা এখনই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে। মণিদীপা বেশি হাঁটতে পারবে না তাই তাকে হুইল চেয়ারে নেওয়া হবে। তার গলায় ও ঘাড়ে কামড়ের দাগ, মাথায়,হাতে,পায়ে ব্যান্ডেজ। এই অবস্হায় তাকে বাহিরে নেওয়ার ইচ্ছা ছিলো না পৃথিশার।কিন্তু আজ না গেলে কথা উঠবে, মণিদীপাও যাওয়ার জন্য জেদ করছিলো। পৃথিশা ওড়না দিয়ে তার মুখ, গলা ঢেকে দিলো। শক্ত করে পিনআপ করে দিলো যাতে না সরে। পৃথিশাদের সাথে তার মামা যাবে।

দীর্ঘ জার্নি শেষে অবশেষে তারা গ্রামে পৌঁছালো। তাদের আসতে দেখে পৃথিশার চাচা নাফিজ চৌধুরী দৌড়ে আসলেন। বাড়ির উঠোনের সামনে রান্না হচ্ছে। মণিদীপা হুইল চেয়ারে দেখে সবাই ছুটে এলো। এক এক করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে লাগলো তাদের দিকে। পৃথিশা মণিদীপার দিকে বলল,

– রাস্তায় এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। পড়ে গিয়ে হাত-পায়ে ব্যাথা পেয়েছে তাই হুইলসচেয়ারে। এজন্যই সেদিন আসতে পারি নি।

– আমাদের একটাবার খবর দিলি না?

পৃথিশার চাচী বলে উঠলেন। পৃথিশা কোন উত্তর দিলো না।হুইল চেয়ারটা ঠেলে মণিদীপাকে নিয়ে চললো বাড়ির থেকে একটু সামনে। যেখানে তাদের পারিবারিক ক”ব”র”স্হান। নিজের বাবার ক”ব”রের সামনে এসে হুইলচেয়ারটা রাখলো পৃথিশা। চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ছে। মণিদীপা কাঁপা শরীরে উঠার চেষ্টা করলো।পৃথিশা সাহায্য করলো তাকে। কিছুটা দুরত্ব রেখে দাঁড়ালো। মণিদীপা কান্নারত স্বরে বলে উঠল, ‘বাবা’। পরপরই হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। পৃথিশার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো রাস্তার উপর। পাগলের মতো বিলাপ করতে লাগলো সে।

– তোমার মণির উপর এত অভিমান করলে বাবা যে তাকে রেখে চলে গেলে। একটাবার শেষ দেখাও দেখতে দিলে না বাবা। আমার কি হবে বাবা।আমি কি করব, কোথায় যাবো বাবা। যদি ফিরে আসতে বাবা, যদি আসতে আর যেতে দিতাম না। আমি তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকবো বাবা,কীভাবে থাকবো?দয়া করো বাবা, ফিরে আসো, ফিরে আসো।

পৃথিশা বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মণিদীপা থেকে থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। হুট করে পৃথিশার দিকে তাকিয় বলল, ‘আমাদের আর কেউ থাকলো না রে পৃথি,কেউ থাকলো না।’

___________

সময় বহমান। সময়ের স্রোতে সবকিছুই ফিকে হয়ে যায়। পৃথিশারা নতুন বাসা নিয়েছে। মণিদীপাকে সে বাসায় আনা হয়েছে। মণিদীপাকে নিয়ে পৃথিশা পুরোনো এলাকায় যায় নি। মণিদীপা আপাতত ভার্সিটিতে যায় না। পৃথিশা এবারের ভর্তি পরীক্ষার্থী ছিলো।কিন্তু এতসব ঝামেলার মাঝে সে কোন প্রস্তুতি নিতে পারেনি। আপাতত তারা রাশেদুল চৌধুরীর পেনশনের টাকায় চলছে।কিন্তু এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে তা দিয়ে চলা মুশকিল। পৃথিশা ছোটবেলায় নাচ শিখতো,একটা সময় তা ছেড়ে দিয়েছিলো।তবে আজ এতবছর পর সেটাকেই হাতিয়ার করেছে সে। একটা একাডেমিতে পার্ট টাইম টিচার হিসেবে জয়েন করেছে। কাজটাতে যদিও পরিশ্রম বেশি টাকার তুলনায় তবে এই পরিস্থিতিতে ওটাই তাদের জন্য ভরসা। মণিদীপা আগের থেকে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। শরীরের ক্ষতগুলো শুকিয়ে গেলেও কালসওটে দাগ পড়ে আছে।পৃথিশা ভেবেছিলো ওই ছেলেগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করবে কিন্তু মণিদীপার নিশ্চুপতা দেখে তা জিজ্ঞাসা করার সাহস পায়নি।

আজ পৃথিশার এইচএসসির রেজাল্ট দিবে। এতগুলো দিন ব্যস্ততায় কেটে যাওয়ায় এ নিয়ে ভাবার সুযোগ পায় নি। আজ সকাল থেকেই মণিদীপার কোলে গুটিয়ে আছে। মণিদীপা বিরক্ত হয়ে কয়েকবার ঠেলেছে তাকে। বার বার বিরক্ত গলায় বলছে,

– পৃথি এত ঘেষাঘেষি করছিস কেন? দূরে গিয়ে বস। যা পরীক্ষা দিয়েছিস তাই হবে রেজাল্ট। এ নিয়ে চিন্তার কি আছে?

পৃথিশা মন খারাপ করে সরে গেলেই আবার মণিদীপার মন নরম হয়। আদুরে গলায় বোঝাতে শুরু করে। পৃথিশা বোনকে স্বাভাবিক হতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। ভয়ে সে মণিদীপার ভার্সিটি যাওয়ার কথা তুলতে পারে না। কিন্তু খুব করে চায়,সব স্বাভাবিক হয়ে যাক।
বারোটা বেজে গেছে।অনলাইনে রেজাল্ট এতক্ষণে বের হয়ে গেছে। পৃথিশা রেজাল্ট বের করার সাহস পাচ্ছে না। তার রেজাল্ট মণিদীপা ও রাশেদুল চৌধুরী বের করে দেয় সবসময়। মণিদীপার কোলেই মুখ গুজে শুয়ে ছিলো সে। মণিদীপা তখন ব্যস্ত হাতে মোবাইলে টাইপ করে যাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেতেই মুখ উজ্জবল হয়ে উঠলো তার। পৃথিশাকে হাত দিয়ে ঠেললো বারকয়েক। ঝুমঝুম কন্ঠে বলল,

– এই বাবু উঠ, তোর রেজাল্ট দেখ।

পৃথিশা মোবাইলের স্ক্রিনে তাকালো।

Prithisha Chowdhury
Result: passed
GPA: 5.00

– তুমি যদি থাকতে বাবা!

_______

রেজাল্ট দিবে বলে আজকের দিনটা ছুটি নিয়েছিল পৃথিশা। এখন বাসায় বসে সময় কাটাতে বিরক্তি বোধ হচ্ছে পৃথিশার। চা হাতে বারান্দায় বসে ছিলো সে। হুট করেই মণিদীপা রুমে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলো,

– পৃথি তোর আদিদের সাথে কথা হয়েছিলো?

পৃথিশা হকচকিয়ে গেলো।মণিদীপার কন্ঠস্বর তীক্ষ্ণ। কোন কিছু নিয়ে রেগে আছে সে। পৃথিশা থতমত হয়ে বলল,

– হ্যাঁ হয়েছিল,যখন তুই হাসপাতালে ছিলি। ভাইয়া অনেকবার ফোন দিয়েছিলো তাই..

– তুই তাকে সব বলেছিস?

– রিপোর্ট দেখিয়েছিলাম। কিছু বলেনি। আমি বলেছিলাম পরে উত্তর জানাতে।

– আমার সাথে জিজ্ঞাসা না করে এ সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে পারিস তুই? আমাকে একটাবার বলিস-ও নি এ কথা।

– সে তোমার উডবি আপু। তাকে এ কথা বলন না কেন? আর আমি তো যেচে যাই নি। সে নিজেই এসেছিলো।তুমি তখন কথা বলার অবস্হায় ছিলে না, ভাইয়াকে দেখলে আরও ভেঙ্গে পড়তে তাই আমি তোমাকে কিছু বলি নি।

মণিদীপা রেগে গেলো। হাতের ফোনটা আছড়ে ফেলে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,

– আমার জীবনটা খেলা বানিয়ে ফেলেছে সবাই। কোন কিছুতে আমার কথার মূল্য নেই।

পৃথিশা মণিদীপার আচরণে অবাক হলো না। সেই ঘটনার পর থেকে মণিদীপার আচরণে বেশ পরিবর্তন এসেছে।হুট করেই রেগে যায় আবার হুট করে ঠিক হয়ে যায়। কিছুসময় পরই মণিদীপা তার রুমে আসলো। পৃথিশা কাছে এসে নিম্নস্বরে বলল,

– সরি বাবু, বেশি রাগ দেখিয়ে ফেলেছি।কি যে হয়েছে আমার।

পৃথিশা কিছু বলল না। বোনকে জড়িয়ে তার সাথে মিশে থাকলো। হুট করেই মণিদীপা বলল,

– আমি থানায় কেস করতে চাই পৃথি।

চলবে,,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-০৭

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-০৭
ফারিহা জান্নাত

সাজানো-গুছানো এক ক্যাফেতে বসে অপেক্ষা করছে পৃথিশা। কিয়ৎক্ষণ পরই মণিদীপার হবু বরে আদিদের দেখা মেলে তার। হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করছে সে। পৃথিশার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

– সমস্যা কি মণির? কোন খবর নেই দুইদিন ধরে। বাসায় গিয়েও তোমাদের পেলাম না, কেউ কোন খবর বলতে পারলো না। তোমার ফোনও বন্ধ। কি হয়েছে?

– আপনি বসুন ভাইয়া,তারপর কথা বলছি।

পৃথিশার কন্ঠ শীতল। আদিদ শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলো। চেয়ার টেনে বসলো। পৃথিশা আজ ক্যাফেতে আসতে বলায় অনেকটা অবাকই হয়েছে সে। কোন দিন পৃথিশার সাথে খুব একটা আলাপ করা হয় নি, পৃথিশা নিজেই দুরত্ব বজায় রাখতো। চিন্তা-ভাবনা একপাশে ঠেলে পৃথিশার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো সে,

– এবার কথা বলো। মণি কোথায়? ওর ফোনে কি হয়েছে?

– আপু হাসপাতালে ভর্তি..

মূহুর্তেই উত্তেজিত হয়ে উঠলো আদিদ। পৃথিশার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলেই পৃথিশা হাত উঠিয়ে থামতে বললো তাকে।

– কথা শেষ করি। বুবুর রিপোর্ট দিচ্ছি এখন,আপনি দেখে তারপর উত্তর দিবেন কি করবেন?

পৃথিশা মণিদীপার রিপোর্টগুলোর কপি আদিদের দিকে এগিয়ে দিলো। ভ্রু কুঁচকে সেগুলো হাতে নিলো সে। তবে রিপোর্টগুলো পড়তে পড়তে কুঁচকানো ভ্রু সহসাই সোজা হলো, বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে উঠলো। পুরোটা পড়ার দুঃসাহস করতে পারলো না। পৃথিশার দিকে তাকিয়ে রইলো প্রবল বিস্ময়ে। পৃথিশার মুখ কঠিন। দৃঢ় গলায় বলল,

– আপনি যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন সেটা আপনার উপর। তবে আমাকে আগে সিদ্ধান্ত জানাবেন, তারপর বুবুর সাথে দেখা করার অনুমতি পাবেন।

আদিদ তখনো ঘোর কাটাতে পারছে না। তার ফুলের মতো মণির এই অবস্হা কেন যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না। বাবা নেই তার, মা একাই। দুনিয়া উল্টে গেলেও মণিদীপাকে ছাড়তে রাজি নয় সে। কন্ঠনালি দিয়ে শব্দ বের হতে চাইছে না। কাঁপা স্বরে বলল,

– কীভাবে হলো এসব? মণি কেমন আছে? জ্ঞান ফিরেছে?

– বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার সময়। টিউশনি থেকে ফিরতে দেড়ি হচ্ছিলো বলে আমি ও বাবা খুঁজতে গিয়েছিলাম। পরে একটা গ..গলির মধ্যে এই অবস্হায় পাই।

– আমি দেখা করবো তার সাথে। আমাকে একবারও জানালে না এমন অবস্হার কথা।

আদিদ তড়িঘড়ি করে উঠে যেতে লাগলো। পৃথিশা রিপোর্টটা ব্যাগে ঢুকিয়ে তার পেছন পেছন হাঁটা ধরলো। গতি বাড়িয়ে আদিদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। জোর গলায় বলল,

– আপনি এখন বুবুর সাথে দেখা করবেন না। বুবু এখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। আপনি গেলে নিজেকে আরও দোষারোপ করবে। বুবুকে বাসায় নেওয়ার পর তার সাথে দেখা করবেন যদি তাকে বিয়ে করেন। আন্টিকে সাথে নিয়ে আসবেন। যদি রাজি থাকেন তবেই আসবেন।

আদিদ কিছু বলল না। পৃথিশার দিকে তাকিয়ে নিম্নস্বরে প্রশ্ন করল,

– মণিকে এই অবস্হার জন্য আমি ছেড়ে দিবো বলে তুমি মনে করো?

– আমার মনে হওয়াতে কিছু যায় আসে না। আপনি কি করবেন সেটা আপনার ব্যাপার। তবে বুবুকে আর কোনরূপ কষ্ট আমি পেতে দিবো না।

পৃথিশা আদিদকে রেখেই বেরিয়ে গেলো। আদিদ কি করবে না করবে তা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই তার। ফোন বের করে চাচাকে ফোন দিলো সে। আগামীকাল বাবার মিলাদ। কিভাবে কি করবে তা জানাতে হবে। বাবার কথা মাথায় আসতেই তার মনে পড়লো মণিদীপা এখনো কিছুই জানে না। সে জানলে কি রকম প্রতিক্রিয়া করবে তা ভাবতেই ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো পৃথিশার।

________

গোধুলি বেলা। লাল রঙে সেজেছে আকাশ। পৃথিশা মুখ ঘেমে-নেয়ে একাকার। খোপা করা চুলগুলো ভারে কাঁধের উপর হেলে পড়েছে। চাবি নিয়ে বাসার দরজা খুলতেই বাজে গন্ধ এসে নাকে ঠেঁকল। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা সোফায় রাখতেই দেখলো ফ্রিজের দরজা খোলা,পুরোপুরি লাগানো নেই। তৎক্ষনাৎ বুঝলো, খিচুড়ি নেওয়ার পর ফ্রিজটা ভালোমতো লাগানো হয় নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে লেগে পড়লো সে। বাসায় এসেছিলো মূলত আগামীকাল গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য গোছগাছ করতে। মণিদীপাকে এখানে আনা যাবে না কোনভাবেই, তাই সে ভেবেছিল জামা-কাপড় নিয়ে যাক হাসপাতালে।তারপর সেখান থেকেই গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা দিবে তারা। সব কাজ শেষ করে ঝটপট গোসল সেরে নিলো সে। মা’কে ফোন করে একবার মণিদীপার খবর নিয়ে নিলো। সে ঘুমাচ্ছে শুনে আপাতত আর হাসপাতালে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। পা’দুটো ব্যাথায় টনটন করছে।সারাদিন আজ বাসা খুঁজতে বেশ হাঁটতে হয়েছে,তবুও মনমতো বাসা পায়নি। বাসায় সবচেয়ে আদরের ছিলো পৃথিশা। ছোট মেয়ে হওয়ায় রাশেদুল চৌধুরী তাকে মাথায় করে রাখতেন।মণিদীপা পুতুলের মতো আগলে বড় করেছে তাকে। কখনই এতো দৌড়-ঝাপ করা হয়নি একসাথে। মাথায় উপর ছায়া দেওয়া দু’জন মানুষ আজ আর নেই। একজন মাটির বিছানায় আরেকজন হাসপাতালে শুয়ে। বিছানায় শুয়ে পিঠটা লাগাতেই মনে হলো যেন কতবছর যেন ঘুমোয় না সে। শরীর কাঁপিয়ে কান্না এলো তার। জীবন বড্ড প্যাঁচ ঘুরাতে ভালোবাসে। কালকে সবাই জানবে মণিদীপার কথা। বাবা থাকলে সে এটা নিয়ে চিন্তাই করতো না। বাবা তাদের দুই বোনের জন্য বর্ম ছিলো। কোন কিছুর আঁচ লাগতে দিতো না গায়ে। বাসা পাল্টিয়ে ফেললেই কি সত্য পাল্টানো যাবে। সবকিছু কি আগের মতো আদতেও হবে।কখনোই হবে না, মণিদীপা তার পড়াশোনা শেষ করতে পারবে? পৃথিশা-কি এডমিশনের প্রস্তুতি নিতে পারবে নতুন করে ঘুরে। রিস্টার্ট কি এতই সোজা!
পৃথিশার শীত অনুভব করতে লাগলো। বুঝতে পারলো জ্বর আসছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো তার কেউ নেই এই জ্বরে মাথায় হাত বুলানোর জন্য। হুট করে দেখতে পেলো দরজা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে মণিদীপা ঢুকছে। সাইড টেবিলে ঔষধ রেখে ধমকের স্বরে বলল,

– জ্বর হয়েছে কিন্তু এখনো টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা কথাও শোনে না আমার। দেখি বাবু, জ্বর কতটা বেড়েছে।

ঝট করে চোখ খুললো পৃথিশা। দেখতে পেলো ঘর সম্পূর্ণ ফাঁকা। কেউ নেই। চোখের কোণে থাকা পানি মুছে ফেললো। রাত হয়ে আসছে দেখে রেডি হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা দিলো সে। যাওয়ার পথেই দেখতে পেলো সেদিনের বখাটে ছেলেগুলো। কোণা চোখে তাদের দিকে তাকাতেই তারা চোখ নামিয়ে সরে গেলো সেখান থেকে।

হাসপাতালের কেবিনে ঢুকতেই মণিদীপার মুখস্রী দৃষ্টিগোচর হলো। সে করুণ মুখে সামনে থাকা খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। পৃথিশা ঢুকতেই তার দিকে তাকালো। মণিদীপা আগের থেকে এখন অনেকটা ভালো। তাকে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। পৃথিশা হাত ধুয়ে ব্যাগ থেকে টিফিনকারি বের করতেই মণিদীপার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। পৃথিশার দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,

– তুই রান্না করেছিস পৃথি? কি করেছিস?

পৃথিশা টিফিনকারি খুলতেই মণিদীপা হেসে দিলো। তার প্রিয় খিচুড়ি, বেগুনভাজা ও ডিমভাজা। পৃথিশা বলল,

– বেশি কিছু করতে পারি নি।

– চুপ থাক। খিদে পেয়েছে।খায়িয়ে দে।

পৃথিশা মণিদীপাকে খাওয়াতে শুরু করলো।হুট করে মণিদীপা জিজ্ঞেস করলো,

– আচ্ছা, বাবা কোথায়? তাকে দেখলাম না একবারও।

পৃথিশার হাত থেমে গেলো। মায়ের দিকে একপলক তাকালো, তিনিও তার দিকেও চেয়ে। সে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করলো,

– বুবু, খাওয়ার সময় কথা বলতে নিষেধ করেছি কতবার। গলায় আটকাবে।

মণিদীপা পৃথিশার মুখ ধরে নিজের দিকে ফিরালো। শক্ত কন্ঠে বলল,

– বাবা কোথায়? ঠিক করে বল। আমার সাথে চালাকি করবি না।

পৃথিশা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালালো। খাবার প্লেটটা রেখে হাত ধুয়ে নিলো। মণিদীপার হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

– বাবা নেই বুবু।

মণিদীপা আঁতকে উঠল। পৃথিশার হাত ঝাঁকিয়ে বলল,

– নে..নেই মানে? নেই মানে কি হ্যাঁ?

– তুই যেদিন অ্যাক্সিডেন্ট করলি ধকল সামলাতে না পেরে সেদিন রাতে বাবা হার্ট অ্যাটাক করে আর..

পৃথিশা আর বলতে পারলো না। তার কন্ঠরোধ হয়ে এলো। মাথা নিচু করে আটকে থাকা অশ্রু মুছে ফেললো। মণিদীপা বুদ্ধিমতী, পৃথিশার না বলা কথাটা বুঝে নিতে বেগ পেতে হলো না।কথাটা তার কানে বাজলো একবার কিন্তু হৃদয়ে বাজলো হাজারবার। মস্তিষ্ক যেন বারবার বলছে, “তুই দোষী,তোর জন্য তোর বাবা আজ নেই,তোর জন্য আজ এত সমস্যা। তুই সব সমস্যার মূল”। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে। পৃথিশা বোনকে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু মণিদীপা শান্ত হলো না। হাত-পা ছুড়তে লাগলো বিক্ষিপ্তভাবে। চিৎকার করে বলতে লাগলো, আমি ন//ষ্টা, আমার জন্য বাবা নেই। আমিই খারাপ, আমার দোষ সব। বাবা, প্লিজ একবার আসো আমার কাছে। ও বাবা,একটা বার প্লিজ। পৃথিশা মণিদীপার সাথে পেরে উঠলো না। হাত-পা ছুড়োছুড়ি করাতে কিছু ক্ষত থেকে রক্ত বের হতে শুরু করেছে। পৃথিশা মা’কে ইশারায় ডাক্তার ডাকতে বলল। মণিদীপা তখনো কেঁদেই যাচ্ছে। পৃথিশা মণিদীপার মুখ তুলল,চোখের পানি মুছিয়ে দিলেও লাভ হলো না আবারও অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

– বুবু, কথা শোন আমার বুবু। তোর এখানে কি দোষ,বল। তুই কি জানতি এমন কিছু হবে? ব্যাপারটা কি ইচ্ছাকৃত? তুই বল? এভাবে কাঁদিস না বুবু, বাবা কষ্ট পাবে।

মণিদীপা তাও থামে না। কোন কথাও বলে না। কিছুসময় পরই ডাক্তার এসে তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দেয়। ক্লান্ত থাকায় দ্রুতই ঘুমিয়ে যায় সে। পৃথিশা সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হাত জ্বলুনি অনুভব করতেই তাকিয়ে দেখলো মণিদীপার হাতের আঁচড়ে জায়গায় জায়গায় চামড়া উঠে গেছে কিছুটা। পৃথিশা মায়ের দিকে তাকালো, তিনি নত মুখে বসে আছেন। তার চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে। পৃথিশা তার পাশে গিয়ে বসলো। মায়ের কোমড় জড়িয়ে বুকে মুখ গুজলো। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো তার। বিড়বিড়িয়ে বলল,

– সবকিছু এভাবে উলোটপালোট হয়ে যাওয়ার খুব কি প্রয়োজন ছিল মা।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-০৬

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-০৬
ফারিহা জান্নাত

পৃথিবীতে এখন ক্ষমতাধরদের রাজত্ব। যেদিকে টাকা ঢালে,সেদিকেই তাদের জয় জয়কার। টাকা ছাড়া আজকাল কিছু চলে নাকি! মণিদীপাকে হাসপাতালে রাখতে পারবে না বলে কতৃপক্ষ জানিয়েছে। মূলত নির্দেশ এসেছে হাসপাতালের উপরমহল থেকে। জল অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে তারা সবার সামনে মণিদীপাকে দোষী বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। মণিদীপার অবস্হা স্থিতিশীল। তার মানে এই নয় যে তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে। শরীরের অধিকাংশ জায়গায় এখনো ক্ষত। একটু হেরফের হলে সেখানে ইনফেকশন হতে সময় নিবে না। মাথার ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়া হলেও মাথায় চাপ লাগানো নিষেধ। কিন্তু এর মাঝেই তারা মণিদীপাকে বের করে দিতে চাইছেন। পৃথিশা হাসপাতালে এসে এমন কথা শুনে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এই অবস্হায় এত দ্রুত তারা কোথায় যাবে। আর যেহেতু এই হাসপাতালে রাখতে চাচ্ছে না তার মানে অন্য কোথাও গেলেও তাদের ভর্তি নিবে না। পৃথিশা ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে ডাক্তারের চেম্বারের দিকে গেলো। পৃথিশার মা মেয়ের পেছন পেছন আসলেন। পৃথিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললে, ‘ শান্ত হ মা। রাগারাগি করিস না।’
পৃথিশা তাকে কেবিনে যেতে বলে ডাক্তারের কেবিনে ঢুকলো। ডাক্তার নেই এখন।অ্যাসিসটেন্টকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো, আজ আসবে না ডাক্তার। পৃথিশা এবার হাসপাতাল অথোরিটির রুমের দিকে এগোলো। সহজ কথায় বললে খুব লাভ হবে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সে দেখা করার সুযোগ পেলো। রুমে ঢুকতেই দেখতে পেলো ভদ্রলোক ফোনে কাউকে ধমকাচ্ছেন। রুমের দিকে চোখ বুলালো পৃথিশা। পরিপাটি গুছানো রুম,একপাশের দেয়ালে কিছু ক্রেস্ট ও খবরের কাগজ বাঁধাই করে লাগানো।তাতে গুছিয়ে হাসপাতলের সুনামের কথা লিখা। পৃথিশা মৃদু হেসে শব্দ করে চেয়ারে বসলো। ভদ্রলোক ফোনে কথা বলা শেষ করে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন, মুখটা এমন কোমল করে রাখলেন যেন কিছুক্ষণ আগে ধমকা-ধমকি করা ব্যক্তিটি তিনি নন। যথাসম্ভব নরম স্বরে বলল,

– আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি ম্যাম? আমাকে বলা হলো আপনি সমস্যায় পড়েছেন।

– মিস মণিদীপা চৌধুরী, কেবিন নং -৪২০ তাকে কেন বের করে দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন?

ভদ্রলোকের মুখভঙ্গি পাল্টে গেলো। তিনি কপালে কিছুক্ষণ হাত ঘষলেন। অতঃপর উঠে চলে যেতে নিলেই পৃথিশা তাকে আটকালো।

– কি হলো কোথায় যাচ্ছেন? আমার প্রশ্নের জবাব দিন।

ভদ্রলোক কাউকে ফোন দিলেন।কিছুক্ষণ পরই এক যুবক এলো। “ডিল উইথ হার” – বলে লোকটা বেরিয়ে গেলো।

– বলুন কী সমস্যা?

– মণিদীপা চৌধুরী, কেবিন নং -৪২০ তাকে কেন বের করে দেয়া হচ্ছে?

– দেখুন, আমরা হেল্পলেস। যা করতে বলা হয়েছে তাই করছি।

– কী করতে বলা হয়েছে আপনাদের? টাকার বিনিময়ে যে এমন করছেন তা খুব ভালো করেই জানা আছে সবার।

– জাস্ট শাট আপ। আমরা কী পরিমাণ প্রেশারে থাকি ধারণা আছে আপনার? এসেছেন নিজের গীত শোনাতে। শুনুন,যা বলা হয়েছে তাই করতে হবে। আমরা কিছু করতে পারবো না।

– আপনি আমাকে প্রেশারে থাকার কথা বলছেন? আমি কি অবস্হায় আছি তা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না।একজন রোগীকে আপনারা গুরুতর অবস্হায় অর্ধেক চিকিৎসা করিয়ে বের করে দিচ্ছেন।তার উপর আবার আমার উপরই চেঁচাচ্ছেন? আপনাদের হাসপাতালের অনেক সুনাম তাই না? তাহলে এখন আপনি শুনুন আমার কথা। এখন পর্যন্ত যা যা বললেন, সবই রেকর্ড করা হয়েছে।ইভেন এই কথাটাও রেকর্ড হচ্ছে। খুব নামীদামী একটা চ্যানেলে যদি এটা দিয়ে দেই কেমন হবে?

– আপনার এসব ফালতু হুমকিতে কাজ হবে না বুঝলেন। এখন যান আপনি।

পৃথিশা তার ফোনটা বের করলো। রেকর্ডটা প্লে করতেই সবগুলো কথা স্পষ্ট স্বরে শোনা যাচ্ছিলো। যুবকের এবার বোধ হলো। পৃথিশা উঠে চলে যেতে চাইলে তাকে আটকালো। শান্ত স্বরে বলল,

– আমরা ব্যাপারটা বসে ডিসকাস করি। ইট উইল বি বেটার।

– আ’ম নট ইন্টারেস্টেড। সো প্লিজ!

পৃথিশা চলে যাচ্ছিলো।দরজায় হাত দিতেই পেছন থেকে বলে উঠলো,

– আপনারা থাকতে পারেন এখানে। বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নিবো। বাট রেকর্ড যেন ডিলিট হয়ে যায়।

পৃথিশা মুচকি হাসলো। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,

– রেকর্ড বাহিরের কারো হাতে যাবে না বাট মণিদীপার বেস্ট চিকিৎসা করা চাই।

– উই উইল ট্রাই আওয়ার বেস্ট।

পৃথিশা বেরিয়ে মণিদীপার কেবিনের সামনে আসলো। বাহিরে তার মামা বসে। পৃথিশা তার দিকে তাকিয়ে আশ্বাস দিতেই তিনি বুঝলেন আর কোন সমস্যা হবে না। কিছু সময় পরই অন্য ডাক্তার এসে মণিদীপাকে চেক করে গেলো। পৃথিশা কেবিনে ঢুকতে নিলোই তখনকার সেই যুবক এসে বলল,

– হু আর ইউ মিস পৃথিশা? আপনি এত পরিকল্পিতভাবে কীভাবে আমাদের সত্য জানতে পারলেন?

পৃথিশা তার দিকে তাকালো। উপরমহল থেকে কে হাসপাতাল অথোরিটিকে টাকা ও চাপ দিয়েছে তা খুঁজতে আমিরুল ইসলাম তাকে সাহায্য করেছে। সেটাই সে তাদের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলো। সেটার রেশ ধরেই হয়তো প্রশ্নটা করা।

– নো ওয়ান, জাস্ট পৃথিশা চৌধুরী।

________

মণিদীপার জ্ঞান ফিরেছে।তবে সে কারো সাথেই কথা বলছে না। চোখ বন্ধ করে আছে আর সেই চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। পৃথিশা কেবিনে প্রবেশ করে ইশারায় সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলল। তারা যেতেই পৃথিশা মণিদীপার পাশে এসে বসলো। যত্ন করে মাথায় হাত বুলালো। মণিদীপা চোখ খুলে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বোনের চোখের ভাষা যেন বুঝতে পারলো পৃথিশা। বোনের হাত শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখজোড়া বন্ধ করলো। তার ভেতরে অনেক কথা রয়ে গেছে। এই কথাগুলো সে অনেকবার মনে মনে আওড়েছে।চোখে বিন্দুমাত্র পানি না আনার কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। পৃথিশা চোখ খুলে মণিদীপার দিকে তাকালে দেখলো সে এখনো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

– বুবু তোর মনে আছে আমি কালো ছিলাম বলে ছোটবেলায় সবাই কথা শোনাতো। আমি কাঁদতাম বলে তুই আমাকে বুঝাতি বাহিরের শরীরে এই আবরণ কিছুই না। বরং এই চামড়ার আবরণে যে মন লুকিয়ে আছে তাই আসল। বুবু তোর জীবনে একটা অঘটন ঘটে গেছে। এটা শুধু তোর জীবনের না বুবু। এটা আমাদের জীবনে ঘটেছে কারন তুই’তো আমাদের জীবন। তোর শরীরটাকে ওরা ছুঁতে পেয়েছে বুবু, কিন্তু তোর মন? সেটা তো আগের মতোই আছে। বাহিরের আবরণের এই ক্ষত কখনো তোর মনকে নষ্ট করতে পারে না বুবু। তোর মন পবিত্র বুবু, তাই তুইও পবিত্র। এই শরীর পবিত্র- অপবিত্র বলে কিছু নেই। সবটাই মন আর হৃদয় বুবু। তুই সেই মণিই আছিস বুবু, আমাদের চোখের মণি।

পৃথিশা থামলো।বড় করে একটা শ্বাস নিলো। হাতের মুঠোয় থাকা মণিদীপার হাত তখন কাঁপছে। মণিদীপার চোখে পানি, হালকা স্বরে বলল,

– তুই তো বড় হয়ে গেলি আমার বাচ্চাটা।

পৃথিশার চোখ টলমল করে উঠলো। মণিদীপা তার কাছে মায়ের মতো, দ্বিতীয় মা। সবসময় ছায়ার মতো আগলে রেখেছে। পৃথিশা তার একটা দিনও কল্পনা করতে পারতো না তাকে ছাড়া। সবকিছুতেই তার বুবুকে চাই। আজ সেই মা সমতুল্য বোনকে এমন ভঙ্গুর অবস্হায় দেখতে পারছে না সে। বুক ভেঙ্গে কান্না আসছে। পৃথিশা উঠে বসলো। শব্দহীন হেসে বলল,

– আমার পেটে হাজার কথা জমে আছে। ব্লান্ডার ফাটবে ফাটবে করছে। তাড়াতাড়ি সুস্হ হয়ে যা।এজন্য খেতে হবে বুবু।

হাসপাতাল থেকে লাঞ্চ দেয়া হয়েছে। সেদ্ধ সব খাবার। মণিদীপা যে ওসব খায়না তা জানে পৃথিশা। কিন্তু বাসায় কিছুই রান্না করা নেই।এই অবস্হায় বাহিরের খাবারও খাওয়ানো যাবে না। অনেকটা জোর করেই মণিদীপাকে খওয়াতে হলো তার। খাওয়া শেষ হতেই মণিদীপাকে ঔষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো। হাসপাতালের দিকটা সবকিছু ঠিকঠাক রেখে বেরিয়ে এলো সে। নতুন বাসা খুঁজতে হবে অতি দ্রুত। মণিদীপাকে তো সবসময় হাসপাতালে রাখা যাবে না। হাসপাতাল থেকে বের হতেই হাতে থাকা মোবাইল ভাইব্রেট করে উঠলো। স্ক্রিনে তাকাতেই চমক খেলে গেলো তার চোখে-মুখে। আবার নতুন ঝামেলা শুরু হতে যাচ্ছে তাহলে। এদিককার ঘটনায় ওসব ভুলেই গিয়েছিলো প্রায়। আবারও কল আসলে স্ক্রিনে নজর দিলো। ইংরেজি অক্ষরে লিখা উঠেছে – ‘Dulabhai’

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-০৫

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-০৫
ফারিহা জান্নাত

মণিদীপা ও পৃথিশা বরাবরই ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। যেকোন পরিস্থিতিতে যতটুকু শান্ত থাকা যায় ততটুকু শান্ত থাকার চেষ্টা করে। মণিদীপার জ্ঞান ফিরেছে। সে কিছুক্ষণ সময় চুপ ছিল,কোথা থেকে কোথাও এসেছে বুঝে ওঠতে পারছিলো না। ডাক্তার চেকাপ করতে আসলো,তখনও চুপ-ই ছিলো। তবে বিপত্তি বাঁধলো চেকআপের পর। কোন মতে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতে সে ডেস্কে টানানো রিপোর্ট দেখতে পায়। গোটা গোটা ইংরেজি অক্ষরে লিখা-

Patient name: Monideepa Chowdhury
Age: 24
Case: R*ape and s*exual Abusement

থমকে দাঁড়ালো সে। মস্তিষ্ক ভার হয়ে আছে। চাপ প্রয়োগ করতেই দুইদিন আগের সন্ধ্যার ঘটনা মনে পড়তে লাগলো। টিউশনি করিয়ে বাড়ি ফিরছিলো সে। গলির সম্মুখে আসতেই ভেতর থেকে কয়েকজন মিলে তাকে টানা-হেঁচড়া করে গলির ভিতরের পরিত্যক্ত জায়গায় নিয়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সর্বনাশ হয়ে যায়। ছেলেগুলোর চেহারা ঠিকমতো দেখতে পায় নি সে, তবে গলার স্বর শুনে বুঝেছিল পাড়ার বখাটেগুলো। নিজেকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টা সে করেছিলো। পারেনি, পারে নি নিজেকে রক্ষা করতে। সে ধ//র্ষি/* কথাটা মাথায় আসতেই উত্তেজিত হয়ে উঠলো মণিদীপা। পুরো শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা, মাথা নাড়াবার ক্ষমতা নেই। তবুও তাকে ছটফট করতে দেখে নার্স এগিয়ে এলেন। হাত ধরে শান্ত করতে চাইলেই ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিলো। ব্যাথাটা যেন আরো গায়ে চেপে বসলো, তবে তাতে কিছু যায় আসে না তার। কোমড় থেকে পা পর্যন্ত যেন অসাড় হয়ে গেছে। বিছানার চাদর মুচড়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সে। পৃথিশা ততক্ষণে দৌঁড়ে কেবিনে ডুকেছে। বোনের কান্নারত মুখস্রী দেখে হৃদয়ে যেন ছুরিকাঘাত লাগলো তার। বুঝ হবার পর কখনো মণিদীপাকে এত ভেঙ্গে পড়তে দেখেনি। ঢোক গিলে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো সে। বোনের কাছে গিয়ে তার হাত ধরলো শক্ত করে। মণিদীপা তার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো। কথা বলার চেষ্টা করলো, তবে গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।কি বলবে সে? ডাক্তার এসে পড়েছে। হাতের ঘুমের ইনজেকশন। চটপট মণিদীপাকে ইনজেকশন দিয়ে দিলো। এই অবস্হায় এত উত্তেজিত হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। পৃথিশা গেলো না। মণিদীপার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুসময় পর নার্স ডাকলে বেরিয়ে এলো। চেয়ারে মাথা চেপে বসে রইলো। বিপদ যখন আসে সবদিক থেকেই আসে একেবারে। অনলাইন নিউজ, মণিদীপার অবস্হা, মানুষের কটুক্তি সবকিছু কীভাবে সামাল দিবে সে? মায়ের কথা মনে আসতেই চটপট মামাকে ফোন লাগালো সে। জলদি আসতে বলল তাদের।
পৃথিশার কথার অতিদ্রুত আমিরুল ইসলাম পৃথিশার মা’কে নিয়ে এসে পড়েছেন। তাদের হাসপাতালে রেখে বাড়ির উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়লো সে। এলাকায় পৌঁছাতেই দেখলো সবকিছু স্বাভাবিক। সে বুঝলো, খবর এখনো এতটা ছড়িয়ে যায়নি।

বাসার চাবি নিয়ে দরজা খুলতেই অদ্ভুত এক শূন্যতা ঘিরে ধরলো তাকে। বাসায় আগের মতোই সব রাখা যেভাবে রেখে গিয়েছিলো। টেবিলে বাবার আধ-খাওয়া চায়ের কাপ পড়ে আছে। পাশে খবরের কাগজ। নিজ রুমে ঢুকতেই দেখতে পেলো বিছানায় শাড়ি, চুড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। যেদিন অ্যাক্সিডেন্টটা হলো সেদিন তার আর মণিদীপার এক জায়গায় দাওয়াত ছিলো, সেখানেই একই রকম শাড়ি পড়ে যেতে চেয়েছিলো তারা। বিছানায় বসে মাথা ঝাঁকালো পৃথিশা।এখন এসব ভাবার কোন মানে নেই। যা হয়েছে তা বদলাতে পারবে না। সর্বোচ্চ চেষ্টা করলে ভবিষ্যত-টা ভালো করতে পারবে। দ্রুত গোসল সেরে ফেললো সে। ফ্রিজ থেকে বাসি খিচুড়ি বের করে গরম করতে দিলো। ঘর-দোর চটপট গুছিয়ে খেয়ে রেডি হয়ে নিলো। পরবর্তী গন্তব্য সেই অনলাইন নিউজ অফিস।

_____

নিউজ স্টুডিও-তে পৌঁছাতেই দেখলো সবাই নিজ কাজে ব্যস্ত। সে রিসেপশনে গিয়ে যে মহিলাটি নিউজ করেছে তার সাথে দেখা করতে চাইলো। প্রথমে দেখা করতে দিতে দিলো না কিন্তু পরবর্তীতে যখন বলল সে মণিদীপার বোন তখনই তারা ব্যস্ত হয়ে উঠলো। কিছু সময় পরই সেই নিউজ প্রেজেন্টার আসলো। পরিপাটি ভদ্র মেয়ে,তাকে দেখে বুঝার সুযোগ নেই যে তিনি এমন কাজ করেছেন। পৃথিশার মন চাইলো এক্ষনি উঠে গিয়ে থাপ্পড় লাগাতে তারপর কথা বলতে। নিজেকে শান্ত করলো সে। মেয়েটি ততক্ষণে ক্যামেরা রেডি করতে বলছে,সে ইন্টারভিউ নিবে। পৃথিশা শান্ত স্বরে বলল,

– আপনি বসুন, আমরা আগে কথা বলি।

– সরাসরি ক্যামেরারা সামনেই কথা বলি। তাহলে ভালো হবে।

– আমি আপনাকে বসতে বলেছি।

পৃথিশা কড়া কন্ঠস্বর শুনে দমে গেলেন মেয়েটি। ক্যামেরা সেটাপ করতে থাকা লোককে বললেন পরে আসতে। অতঃপর পৃথিশার সামনাসামনি থাকা চেয়ারে বসলেন।

– আপনাকে মণিদীপা চৌধুরী সম্পর্কে যে নিউজ দেওয়া হয়েছে তার সোর্স কী?

– আপনাদের পাড়ার কয়েকজন ছেলেই এসে এ কথা বলল। এছাড়াও তার বন্ধুরাও বলেছে তারা মণিদীপার খোঁজ পাচ্ছে না।

– আচ্ছা, ভালো কথা। পাড়ার ছেলেদের একথা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য আপনার কাছে? মেয়েটা নিজে কোন তথ্য দিলো না,তার পরিবার থেকে কোন কথা বলা হলো না। কোথাকার কোন ছেলে এসে বলেছে আর আপনি তাদের কথা বিশ্বাস করে নিউজ করে ফেললেন।

– দেখুন আপনি..

– আমার কথার মাঝে কথা বলবেন না। কথা শেষ করতে দিন। মণিদীপা চৌধুরী কি খুব ফেমাস কেউ? কিংবা কোন ইম্পরট্যান্ট ব্যক্তিত্ব যার কারনে সে দুইদিন নিখোঁজ থাকায় আপনারা তাকে নিয়ে নিউজ করবেন? আপনি, আমি দু’জনেই বুঝতে পারছি টাকার খেলায় আপনারা এমন নিউজ করেছেন।

– আপনি আমাদের অফিসে এসে আমাদের এমনভাবে অপমান করতে পারেন না।

– অবশ্যই পারি। আমি কেন পারব না, যেখানে আপনি একজন অপরিচিত মেয়ের সম্পর্কে এরকম বাজে মন্তব্য করতে পারেন ।আপনাকে কি সে বলে গিয়েছিলো সে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে? এখন কথা বলছেন না কেন? উত্তর দিন?

– দেখুন, আমরা আমাদের ট্রাস্টেড সোর্স থেকেই এ খবর পেয়েছি। সো..

– কথা ঘুরানোর চেষ্টাও করবেন না আমার সাথে। আপনাকে ২৪ ঘন্টা সময় দিচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে আপনারা মণিদীপা চৌধুরীকে নিয়ে করা সবগুলো পোস্ট ডিলিট করবেন।

– আপনার কথা আমরা মানব কেন?

– এই যে কথাগুলো বললেন, সবগুলো রেকর্ড করা হয়েছে। নতুন চ্যানেল, সবেমাত্র পরিচিতি পাচ্ছেন।এর মধ্যেই যদি আপনাদের বিরুদ্ধে এমন স্টেপ নেই বুঝতেই পারছেন আপনার চাকরি তো যাবেই,সাথে এই চ্যানেল যা পরিচিতি পেয়েছিলো সবই খোয়াবে। আমজনতা কখনও আপানদের পরিস্হিতি বোঝার চেষ্টা করবে না। জানেনই তো, ট্রাম্পকার্ড সবসময়ই ভিক্টিমের হাতে থাকে।

পৃথিশা আর কোন কথা না বলে বেরিয়ে আসলো। রিকশা নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হলো সে। পরবর্তী পরিকল্পনা সে ইতিমধ্যে ভেবে ফেলেছে। বাসা পাল্টাতে হবে সবার আগে। মনিদীপাকে নিয়ে ওই জায়গায় যাওয়া যাবে না কোনভাবেই। হাসপাতালে ঢুকতেই মায়ের অন্ধকার মুখ নজরে এলো তার। বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠলো। মণিদীপার কি কিছু হয়েছে?

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-০৪

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-০৪
ফারিহা জান্নাত

– মিস মণিদীপার উপর অ’ক’থ্য নি’র্যা’ত’ন চালানো হয়েছে। তার মাথার জায়গায় জায়গায় চুল ওঠা, চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। বাম চোখে ধা/রা/লো কিছু দিয়ে আঘাত করেছে, শুধু আঘাত-ই করেনি চোখটা তুলে ফেলা হয়েছে। মাথায়-ও আঘাত লেগেছে।স্মৃতি চলে যাওয়ার আশঙ্কা ইন্টারনাল পার্ট’সে গুরুতর জ/খ/ম হয়ে আছে, ধারণা করা-ই যায় কয়েকজন মিলে এই কাজ করেছে। এছাড়াও শরীরের জায়গায় জায়গায় অনেক ক্ষত আছে। যারা এই কাজ করেছে তাদের মনে হয় কষ্ট সম্পর্কে কোন ধারণা নেই।

সমস্ত শরীর থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো পৃথিশার। শরীর ঝিম ধরে গেছে। তার ননীর পুতুল বোনটার এ অবস্হা হয়েছে তা ভাবতে ইচ্ছে করছে না। পলক ফেলতেই টপটপিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ল।

– প্লিজ, কন্ট্রোল ইউরসেল্ফ। তার জ্ঞান ফিরার আশায় আছি আমরা। তবে ও পুরোপুরি একটা ট্রমায় থাকবে। তখন আপনাদেরই ওকে সামলাতে হবে। ওই সময় একটি শিশুর মতো ওকে দেখে রাখতে হবে।

– আর কোনদিন কি বাম চোখে দেখতে পাবে না?

– চোখ না থাকলে কি দিয়ে দেখবে বলুন তো?

– চিকিৎসা বিজ্ঞান কত উন্নত হচ্ছে আজকাল। কোন উপায় কি নেই।

– আমাকে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। তবে বাংলাদেশে নেই, উন্নত দেশগুলোতে পেতে পারেন।

পৃথিশা মাথা নাড়িয়ে ডাক্তারের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। কিছু একটা মনে হতেই পিছন ফিরে বলল,

– ফিজিক্যাল রিপোর্টগুলো আমি ছাড়া যেন আর কারো হাতে না যায়,এই বিষয়টা দেখবেন প্লিজ।

– সিউর, তবে পুলিশ জানাজানি হলে

– ওটাও আমি হ্যান্ডেল করব।ডোন্ট ওয়া’রি।

পৃথিশা বেরিয়ে গেল। মণিদীপা এখনো আইসিইউতে। বড় একটা টেলিভিশনে সর্বক্ষণ দেখানো হয় তাদের। পৃথিশা সেদিকে এক পলক তাকিয়ে কেবিনের সামনে দাঁড়ালো।লুকিং গ্লাস দিয়ে মণিদীপাকে দেখলো সে। সারা শরীরে থাকা ব্যান্ডেজের মধ্যে কয়েকটা খুলে দেওয়া হয়েছে। একটা চোখ এখনো বাধা। মাথায়ও ব্যান্ডেজ করা এখনো। অচেতন শরীরটার দিকে তাকিয়ে বুক ভার হয়ে এলো পৃথিশার। নব মোচড়ে ভেতরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই দায়িত্বরত নার্স এসে আটকে দিলো। ঠোঁট চেপে পৃথিশা বলল,

– একটু দেখেই চলে যাব। বেশি সময় নিব না। একটু যেতে দিন প্লিজ।

নার্স বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলো। বোঝাতে চাইলো তার কোনভাবেই এখন ভেতরে যাওয়া সম্ভব নয়। ভিজিটিং আওয়ার ছাড়া অন্য সময় কোনভাবেই ঢুকতে দেওয়া হয় না। সেই সময়ই কারো আওশাজ পেয়ে নার্স থেমে গেলো। নম্র স্বরে ভিতরে যেতে বলল। পেছন ফিরে কথার মালিককে দেখার ইচ্ছে পৃথিশার ছিল না। তবে পুরুষালি ভারী স্বরের গলা সে শুনেছিল।সে নিশ্চুপে বোনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তার থেকে বেশ খানিকটা দূরেই নার্স দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিশা পাশে পড়ে থাকা রিপোর্ট দেখলো। ডাক্তার যা বলেছে তাই বিস্তারিত ভাবে লিখা। পড়ার ইচ্ছা হলো না তার। বোনের মাথায় হাত বুলাতে চাইলো তবে নার্স সেটা করতে দিলো না। মাথায় হাত লাগানো নিষেধ। পৃথিশা আলতো করো বোনের আঙুলে হাত ছোঁয়ালো। মনে মনে বলল, “ডাক্তারের কথা যদি সত্যি হয়,তুই যদি সবকিছু ভুলে যাস তাহলে তোকে আমি নতুন জীবন দিবো বুবু। সেখানে এসব বিশ্রী সত্য থাকবে না।” পৃথিশা পরপরই বেড়িয়ে গেল। বাহিরে থাকা চেয়ারে বসে মামাকে ফোন করলো মায়ের খবর নিতে। কথা বলা শেষে চেয়ারে গা এলিয়ে বসলো সে। এদিক-টায় তেমন কেউ নেই। রাত বাড়ছে, সবাই নিজ নীড়ে ফিরে গেছে। পৃথিশা সামনের দিনগুলো ভাবার চেষ্টা করলো। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। অবসর নিয়েছেন বছর দু’য়েক হবে। পেনশন, মণিদীপার টিউশনির টাকা দিয়ে ভালোভাবেই দিনকেটে যেত। তবে এখন তাদের কি কি ঝামেলায় পড়তে হবে তা এখনো সে ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারছে না। এই ঘটনা যদি ভুলেও জানজানি হয় তাহলে বাড়িওয়ালা যে তাদের তাড়িয়ে দিবেন তা স্পষ্ট। এছাড়া ঘটনা জানাজানি হলে ওই এলাকায় থাকা যাবে না। পৃথিশা এমনিতেও ভেবেছিলো সে ওখানে আর থাকবে না। মণিদীপাকে নিয়ে অবশ্যই নতুন এলাকায় উঠতে হবে। ভাবনা শেষে মোবাইলে ডাটা ওন করলো। ফেসবুকে ঢুকতেই বুক কেঁপে উঠলো তার। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। মণিদীপার খবর এখন ভাইরাল নিউজ। সবাই এটা নিয়েই তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত। চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলো পৃথিশা। মাথা ঝাঁকিয়ে হেডলাইন পড়ার চেষ্টা করলো সে।

— পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী ধ/[র্ষি]/ত : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মণিদীপা চৌধুরী। গত শুক্রবার রাতে তাকে এক গলিতে বি//ব/স্ত্র পড়ে থাকতে দেখা যায়। এলাকায় থাকা কিছু ছেলে এ সংবাদ দিয়েছে। এছাড়াও তার সহপাঠীরা বলেন তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোন সোস্যাল মিডিয়া কিংবা ফোনে। ধারণা করা যাচ্ছে প্রেমিকের সাথে আড়ালে দেখা করতে গিয়ে এ অবস্হা হয়েছে তার। যদিও মণিদীপার পরিবার সম্পর্কে কোন তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি তবে…

আর পড়তে পারলো না পৃথিশা। মস্তিষ্ক আর লোড নিতে সক্ষম হলো না। জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো সে।

____

পৃথিবী গোল,বলা হয় এখানে সবাই সমান প্রাপ্য ভোগ করে নিজ কর্মগুণে। তবে সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সমান ক্ষমতা দিয়ে পাঠাননি। ক্ষমতার বৈষম্য আছে বলেই মানুষের বৈষম্য গড়ে ওঠে। পৃথিশা এই মূহুর্তে একটি কক্ষে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। জ্ঞান ফিরেছে কিছুসময় পূর্বেই। মাথায় এখন তার অনেক কিছু ঘুরছে। মণিদীপার খবর বাহিরে গেলো কীভাবে? তারা এত বিখ্যাত কেউ নয় যে তাদের নিয়ে নিউজ করতে হবে। তার এই মূহুর্তে একজনের কথাই মাথায় আসছে সেই এমপি। হুমকির কারনে হয়তবা তার আত্মসম্মানে লেগেছে কিংবা ভাগ্নীর কর্মকাণ্ড ঢাকার জন্য হয়তবা তিনি এ কাজ করেছেন। তাকে ছাড়া আর কাউকে সন্দেহ হচ্ছে না পৃথিশার্ মণিদীপা যে রাস্তায় পড়ে ছিলো তা ছিল সরু চিপা গলি।সেখানে সচরাচর কেউ আসে না। তাই অন্য কারো দেখার সুযোগ নেই। দেখলে আরও আগেই ঘটনা ছড়িয়ে পড়তো। পৃথিশা ভাবনার মাঝে খেয়ালই করেনি কখন নার্স এসেছে। তার হাতে ব্রেকফাস্ট। পৃথিশা জানিয়ে দিলো, সে এখন কিছু খেতে পারবে না

– আপনার শরীরে কোন স্ট্রেন্থ নেই। কাল পড়ে গেছিলেন। ইমিউনিটি সিস্টেম লো হয়ে গেছে। স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছিলো। ভয় পায়িয়ে দিয়েছিলেন আমাদের, আপনার জন্য স্যার সারারাত এখানে ছিলেন। এখন প্লিজ খেয়ে নিন। নাহলে আবার অসুস্থ হয়ে যাবেন

পৃথিশা জবাব দিলো না। হাত বাড়িয়ে জুসের গ্লাসটা হাতে নিলো। নার্স তা দেখে চলে গেলো। আবারও ভাবনায় ডুবে গেলো পৃথিশা। তবে তাকে বেশি ভাবার সুযোগ না দিয়েই আরেকটি নার্স তড়িঘড়ি করে এসে বলল,

– মিস মণিদীপা আপনার পেশেন্ট?
– জি..
– তাড়াতাড়ি আসুন,ওনার জ্ঞান ফিরেছে।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-০৩

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা:০৩
ফারিহা জান্নাত

পৃথিশার কান্না থামছে না। কোনভাবেই তাকে লা’শে’র সামনে সরানো যাচ্ছে না। এদিকে জা”না”যা”র সময় এগিয়ে আসছে। পৃথিশার মামা এগিয়ে তাকে টেনে সরিয়ে আনলেন। পৃথিশা মামার হাত থেকে ছুটে মা’র দিকে এগিয়ে গেল। পৃথিশার মা যেন পাথর বনে গেছেন। একদিকে মেয়ের এমন অবস্হা তারউপর আবার স্বামীর আকস্মিক মৃ”ত্যুতে তিনি শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। পৃথিশা মা’কে ঝাঁকিয়ে বলল,

– কাঁদছো না কেন মা? কাঁদো আজ, আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে মা,সব শেষ হয়ে গেছে।

পৃথিশার মা পৃথিশার ধরে কেঁদে উঠলেন। কিছু সময় পরই লা”শ সরিয়ে নেওয়া হলো জানাযার জন্য। পৃথিশা ও তার মা’কে ঘরে এনে বসানো হলো। পৃথিশার চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে। সে চুপচাপ ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। হুট করে পৃথিশার চাচী জিজ্ঞেস করলো,

– আচ্ছা, মণিদীপা কোথায়? তাকে তো একবারও দেখলাম না।

পৃথিশা ঝট করে মাথা তুললো। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনি আগে থেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছেন। পৃথিশা বুঝলো,মণিদীপার খবর কেউ এখনো জানে না। পৃথিশা বলল,

– বুবু অসুস্থ। প্রচন্ড জ্বর,তাই হাসপাতালে ভর্তি ছিল। জ্ঞান নেই তার। তাকে বোধহয় মামা আনে নি।

– কিন্তু তুই কোথায় ছিলি? তোকে পরে আনা হলো কেন? তুই লা”শে”র সাথে আসিস নি কেন?

ফের প্রশ্ন করে উঠলো চাচী। পৃথিশার একটা ধাক্কা খেল। লা”শ! বাবা মা””রা গেছে কয়েক ঘন্টা হলো এখনি তারা এভাবে কথা বলছে।

– তুমি যাকে লা””শ বলছো সে আমার বাবা চাচী। আর এই মূহুর্তে তোমাকে এসব কথার জবাব দিতে আমি ইচ্ছুক নই।

পৃথিশা উঠে মায়ের পাশে বসলো। তাকে আস্তে করে বলল, “কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। পরে দেখা যাবে বিষয়টা।”

জানাযা পড়ানো শেষে শেষবারের মতো মুখ দেখানোর জন্য পৃথিশা ও তার মাকে নিয়ে যাওয়া হলো। পৃথিশার মা খাটিয়া ধরে কাঁদছেন। তার পেছনে পৃথিশা দাঁড়িয়ে আছে শান্তভাবে। কিছুসময় পর খাটিয়া নেওয়ার জন্য তৈরী করা হলো। সেই মূহুর্তে পৃথিশার মনে প্রচন্ড একটা ধাক্কা লাগলো। কানের পাশে কে যেন বলল, পৃথিশা তোর বাবা চলে যাচ্ছে,তাকে আর কোনদিন দেখতে পাবি না। তোকে বুঝার মতো আর কেউ নেই এ পৃথিবীতে। পৃথিশা হুমড়ি খেয়ে পড়ল খা’টিয়ার উপর। কান্নারত স্বরে বলতে লাগল, “বাবাকে নিয়ে যেও না তোমরা। বাবা একটু রাখো আমার কাছে। “পৃথিশাকে টেনে সরিয়ে আনা হলো। অবশেষে দা” ফ”ন করা হলো রাশেদুল চৌধুরী তথা পৃথিশার বাবাকে। সব আত্মীয়-স্বজন যাওয়া শুরু করেছে দা”ফনকার্য শেষে। পৃথিশাদের পরিবারই আছে একমাত্র। হুট করেই পুলিশের গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। পৃথিশার চাচা ও মামা বেরিয়ে এলেন। পৃথিশাকে একেবারে ছেড়ে দেওয়া হয় নি। বাবার মৃ’ত্যুর জন্য সাময়িক ছাড়া পেয়েছিল। এখন আবার পুলিশ এসে পড়েছে তাকে নিতে। অথচ পৃথিশার মামা বলে এসেছিলেন তিনিই দিয়ে আসবেন। পুলিশের কথা শুনে পৃথিশাও ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। পৃথিশা তাদের দকে এগিয়ে গেল।পৃথিশাকে দেখে পুলিশটি বলে উঠলেন,

-ওহ আপনি এসে গেছেন। তাহলে এবার আমরা চলি ভাইসাহেব। আপনি বিষয়টা এমপি মহাশয়ের সাথে ডিসকাস করে নিয়েন।

পৃথিশা দেখলো পুলিশের সাথে সেই এমপি আর ছেলেগুলোও আছে।একটা ছেলে এমপির কানে কিছু বলতেই তিনি এগিয়ে এসে বললেন,

– ওই মেয়েকে সহজে ছাড়া যাবে না। কত বড় সাহস আমার ভাগ্নিকে সে মেরেছে।

পৃথিশা এগিয়ে ছেলেটার গালে থাপ্পড় লাগিয়ে গেল। তার কান্ডে সবাই চমকে উঠলো।পৃথিশার মামা তাকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য আসতেই পৃথিশা তাকে বলল, “থামো মামা। আমাকে কথা বলতে দাও।” এরপর পৃথিশা ছেলপটার চুল মুঠি করে ধরে বলল,

– সত্য কথা বল শ”য়”তা”নের বাচ্চা। আমি তোদের অকারণে মেরেছি? সত্য না বললে ওইটার মতো তোকেও এখানে মেরে তারপর জেলে যাবো।

পৃথিশা একটু মারকুটে ধরনের মেয়ে। মেয়েকে রাশেদুল চৌধুরী নিজেই এসব করতে সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন। ছেলেটা মুখ খুললো না। এমপি এতক্ষণে মুখ খুলল,

– তোমার এত সাহস,তুমি আমার সামনে আমারই ছেলেদের মারছো।

– হে মা”র”ছি।আরও একশবার মারব। তারা যে কাজ করেছে তার মামলা আমি আজই থানায় করবো। তখন দেখবো ভাগ্নির কাজে আপনি কোথায় মুখ লুকান।খুবই তো জনগণের জন্য দরদ দেখান সবার সামনে। এখন একটা সাধারণ মেয়েকে হেনস্তা করছেন? আপনার এই দু’মুখো ব্যবহারের কথা আমি যদি সামনে টেনে আনি? তখন কি হবে?

– খুব বড় গলা করে কথা বলছো দেখি।তা কি করেছে তারা শুনি? যে তুমি আমার ভাগ্নিকে এভাবে ছুরিকাঘাত করলে? সে এখন হাসপাতালের আইসিইউ -তে আছে।

– দলএবার তো সত্যি কথা মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলো।মার্ডার কেসের আসামী করলেন অতচ কোন মার্ডার হয় নি। আপনার ওই শ”য়”তান ভাগ্নি এখনো বেঁচে যে আছে সেটাই পৃথিবীর জন্য অভিশাপ। আপনার চ্যালা’দের জিজ্ঞেস করুন কি করেছে তারা।

এমপি ইশারা করতেই এলজন ছেলে তাকে আস্তে করে সব বলল। শুনে তিনি রেগে গেলেন।

– তোরা আমাকে আগে এসব জানাস নি কেন? এতবড় ঘটনা ঘটিয়ে রেখেছিস এখানে?

– জানালে কি করতেন? মেয়েটাকে সরিয়ে দিতেন আগেভাগেই?

এবার পৃথিশার চাচা মুখ খুললো। তাদের আসলে কিছু জানানো হয় নি বলেই তিনি কিছু বুঝতে পারছেন না। তবে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন তিনি।

– সমস্যাটা কি কেউ আমাকে বলবেন? কি নিয়ে কথা হচ্ছে?

এমপি কিছু বললেন না। পুলিশকে কিছু একটা বলে তিনি গাড়িতে উঠে পড়লেন। পুলিশটি তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

– বিরক্ত করার জন্য মাফ চাই ভাইসাহেব। আপনাদের আর থানায় যেতে হবে না। আসি।

বলেই তিনি চলে যেতে লাগলেন। তবে পৃথিশার ডাকে তাকে পিছন ফিরে তাকাতে হলো। পৃথিশা তাদের উদ্দেশ্য করে বলল,

– আমাকে জেলে না দেওয়ার জন্য ধন্যবাদস্বরূপ যে আমি আপনার ভাগ্নির বিরুদ্ধে মামলা করবো না তা নয়। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব জনাব মাহবুব উদ্দিন।

পৃথিশার চাচা এবার পৃথিশার দিকে অবাক চোখে তাকালেন।

– কি নিয়ে কথা বলছিস তোরা? তুই কি নিয়ে মামলা করবি।

– সময় হলে তোমরা জানতে পারবে চাচা। এখন এ নিয়ে কথা নয়

তারপর মামাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– বাসায় যেতে চাই মামা। এখনি।

পৃথিশার চাচা তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন,

– মানে কি? এখনি কোথায় যাবি? আজ রাতটা থেকে যা।

– থাকতে পারবো না মামা। বুবু অসুস্থ জানোই তো। মিলাদের দিন আসবো। আর খাওয়ানোর টাকার ব্যাপারে ফোনে কথা বলে নিবো।

পৃথিশার চাচা আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। খুব দ্রুতই পৃথিশারা চলে গেল। গাড়ি চলছে, পৃথিশা ও তার মা পেছনে বসা। সামনে তার মামা গাড়ি চালাচ্ছে।

– আমি হাসপাতালে যাবো মামা।তুমি মা’কে নিয়ে বাসায় যাও। কাল সকালে এসো।

– কিন্তু তোর রেস্টের দরকার বেশি।

– আমি বুবুর কাছে থাকি মামা। মা কাহিল হয়ে গেছে।

পৃথিশার মামা কিছু বলতে পারলেন না। লুকিং গ্লাসে ঘুমন্ত বোনের দিকে তাকালেন। তিনি জানেন কিসের জন্য তাদের একসাথে এত শাস্তি পেতে হচ্ছে। মেয়ের করুন অবস্হা সহ্য করতে না পেরে রাশেদুল চৌধুরী মারা গেছেন।এছাড়া ডাক্তার বলল তার নাকি আগে থেকে হার্টে চারটা ব্লক ছিলো, এটা ধরা না পড়ায় অবস্হা এত খারাপ হয়ে গেছিলো। পৃথিশাকে নামিয়ে দিয়ে তার মামা চলে গেলেন। পৃথিশা প্রথমেই হাসপাতালের ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হবার জন্য।
আয়নায় থাকা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো সে। দুই দিনে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে সে। তার লম্বা চুলগুলো মণিদীপার খুব পছন্দের। পৃথিশার চুলের ধরন সুন্দর ছিলো বলে সে নিজেই যত্ন নিতো অনেক। তারই যত্নে চুলগুলো কোমড় ছেড়ে হাঁটু ছুঁইছুঁই। পৃথিশা নিজের দিকে তাকিয়ে হাসলো।নিজের ভাগ্যের উপর হাসি পেলো তার।

– তোর আর কেউ থাকলো না পৃথি।আজ থেকে তুই একা, একদম একা।

বলেই হেসে উঠলো পৃথিশা।হাসতে হাসতে চোখে পানি এলো তার। পরপরই আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,

– যে হাত পৃথিবীর সকল নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচিয়ে আমার বড় করেছিল সে হাত আজ আমায় ছেড়ে গেছে। বাবা তুমি যে বলতে তুমি আমাকে কখনো একা রেখে যাবে না, আজ আমি একা বাবা।দেখো,আজ আমি একা।কেউ নেই আমার।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-০২

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-০২
ফারিহা জান্নাত

– মিস পৃথিশা, দয়া করে আমাদের কাজে কোন বাধা দেবেন না। আপনার নামে করা মা’র্ডা’র কেসের সাক্ষীও আছে। তারাই থানায় অভিযোগ করেছে। আপনি আমাদের সাথে চলুন।

পৃথিশা হতভম্ব হয়ে গেলো। বুঝতে পারলো যে ছেলেটাকে তখন ছুরিকাঘাত করেছিলো তার সাঙ্গপাঙ্গরা-ই অভিযোগ করেছে।

– বিশ্বাস করুন,আমি কিছু করি নি। ছেলেটা আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিলো বলেই আমি নিজেকে সেভ করেছি। আমার বোন এখানে ভর্তি। বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছে, আমার বোনকে তারা..

পৃথিশার কথা আটকে গেলো। চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,

– আমার বোনকে তারা রে”’প করেছে। আমি আজ এখানে দাঁড়িয়ে তাদের উপর অভিযোগ করছি। আপনি তাদের অ্যারেস্ট করুন। আমাকে নয়।

পুলিশটি বিরক্ত হলো। সাথে থাকা মেয়ে পুলিশটিকে ইশারা করতেই তিনি এগিয়ে পৃথিশার হাতে জোর করে হাতকড়া পড়াতে লাগলো। পৃথিশার মামা এতক্ষণ হাসপাতালের একাউন্ট সেকশনে ছিলেন। এখানে আসতেই এ দৃশ্য দেখে তিনি এগিয়ে এলেন। পুলিশটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– কি সমস্যা এখানে? ও কি করেছে?

– আপনি কে বলুন তো? মাঝখান থেকে এসে প্রশ্ন করা শুরু করলেন? আমাদের কাজ আমাদেরকে করতে দিন।

– লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমিরুল ইসলাম। বলুন কি সমস্যা? কি করেছে আমার ভাগ্নি?

পুলিশের মুখের রং পাল্টে গেলো। মেয়ে পুলিশটিকে বলল সরে দাঁড়াতে।

– আসলে স্যার,ওনার (পৃথিশাকে দেখিয়ে) উপর মার্ডার কেসের অভিযোগ আছে। তাকে একবার থানায় যেতেই হবে। ছেলেটার মামা এমপি তো,বুঝতেই পারছেন উপরমহলের প্রেশার। এক রাত থাকুক, তারপর জামিন করিয়ে নিয়েন।

পৃথিশার মামা কিছু বলার আগেই তারা পৃথিশাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। পৃথিশা তার মামার দিকে চেচিয়ে বলল,

– বুবু আর বাবাকে দেখে রেখো মামা। মা’কে কিছু খায়িয়ে দিয়ো।

পৃথিশার মামা তার পিছু পিছু এলেন। পুলিশগুলোকে থামানোর চেষ্টা করেও পারলেন না। শেষে পৃথিশাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– আমি তোকে বের করে আনবো পৃথি মা। তুই চিন্তা করিস না।

পৃথিশাকে গাড়িতে উঠানো হলো। তার মামা বাহির থেকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন। হুশ ফিরতেই মোবাইল বের করে তার ভাইকে কল করলেন।

– ভাইজান,পৃথিশাকে পুলিশ নিয়ে গেল আমার চোখের সামনে দিয়ে। আপনি কিছু করুন তাড়াতাড়ি। আজ রাতে বের করতে পারলে ভালো। যত টাকা লাগে দেব। আপনি ওদের একটু বলে দিন,যাতে সমস্যা না হয়।

পৃথিশাকে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে আপাতত সেলে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। পৃথিশা সেলের এক কোণে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে বোনের র’ক্তা’ক্ত দে’হটা। বাবা হুট করে এত মেজর হা’র্ট অ্যা’র্টা’ক করলো কেন,তার তো হার্টের সমস্যা ছিলো না। হুট করে এক রাতের মধ্যে কি হয়ে গেলো। পৃথিশা বুঝতে পারলো,সে সহজে জেল থেকে বের হতে পারবে না। যে ছেলেটা মারা গেছে তার মামা এমপি। ছেলেটাকে বেশ
ভালোভাবেই চেনে সে। পথে-ঘাটে মেয়েদের প্রায়ই বিরক্ত করতো। মণিদীপার কথা মনে হতেই চোখ বেয়ে জল গড়ালো তার। মণিদীপার এবার গ্রাজুয়েশন করার কথা ছিলো।সামনের মাসেই ইয়ার ফাইনাল হতো। কিন্তু এখন এসব ভেবে লাভ নেই। বোনের কথা মনে হতেই পৃথিশার মন আতঙ্ক ভর করলো। মণিদীপার বিয়ের কথা চলছে। তার প্রায় পাঁচ বছরের প্রেম। হবু বর মণিদীপাকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসে। কিন্তু এই অবস্হায় নিশ্চয়ই পরিবার মেনে নিবে না। পৃথিশা আর ভাবতে পারলো না। ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। বিড়বিড়িয়ে বলল,

– “আমাদের সব শেষ, সব শেষ হয়ে গেলো বুবুরে। সব শেষ হয়ে গেলো। তুই কি নিয়ে বাঁচবি বুবু,তুই কীভাবে বাঁচবি? তোকে যে কেউ মেনে নেবে না। কেউ তোর কষ্ট বুঝবো না’রে বুবু। তুই কীভাবে থাকবি বুবু? তোর না পৃথিবী দেখার শখ? তুই কীভাবে দেখবি। শ’য়’তা’ন-গুলো যে তোর চোখ-ও গে’লে দিয়েছে। তুই কেমনে বাঁচবি বুবু?কেমনে বাঁচবি?”

__

পরদিন সকালেই পৃথিশাকে সেল থেকে বের করে আনা হলো। পৃথিশা বুঝলো মামা-ই সব ব্যবস্হা করেছে। বের হতেই মামাকে বসা দেখলো সে। তবে মামার মুখ অন্ধকার দেখে মনে ভয় জাগলো তার। বাবা কিংবা বুবুর কি কিছু হয়েছে – মনে প্রশ্ন উঁকি দিলো পৃথিশার।
পৃথিশার মামা এগিয়ে এলেন তার দিকে। মাথায় হাত রেখে আদর করলেন। তারপর পৃথিশাকে ধরে বললে,

– “আমার সাথে চল মা। ঠিক আছিস তো?”
– “ঠিক আছি।”

পৃথিশা কথা না বাড়িয়ে মামার সাথে চলতে লাগলো। মামা গাড়ি নিয়ে এসেছেন।পৃথিশা সামান্য টলছে। কাল সন্ধ্যার পর কিছু মুখে তুলেনি। গাড়িতে উঠে পৃথিশা মাথা এলিয়ে দিলো। এসি চলছে। ঘামে ভেজা শরীরে বাতাস লাগায় ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে। ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বসলো সে। মামা গাড়ি চালাতে শুরু করলেন। পৃথিশা বেশ কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলো গাড়ি হাসপাতালের দিকে না গিয়ে অন্য দিকে যাওয়া শুরু করেছে। পৃথিশা ক্লান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,

– কোথায় যাচ্ছো মামা? এটা তো হাসপাতালের রাস্তা নয়।

পৃথিশার মামা উত্তর দিলেন না। পৃথিশাও আর প্রশ্ন করলো না। করতে ইচ্ছা করলো না। শরীর আর মনটা নিতে পারছে না এসব।
হুট করেই পৃথিশার মামা বললেন,

-নিজেকে সামলাবি পৃথি। তোকেই কিন্তু এখন সব দেখতে হবে। ভেঙ্গে পরবি না। এখন তোদের দেখার কেউ নেই।

পৃথিশা হঠাৎ এরূপ কথার মানে বুঝলো না। কিছু সময় গাড়ি থেমে গেলো। পৃথিশা চারপাশে তাকিয়ে দেখলো এটা তাদের দাদা বাড়ি। এখানে সচরাচর আসা হয় না। কেউ মা’রা গেলে কিংবা দাওয়াতে আসা হয়। মনটা কু ডেকে উঠলো পৃথিশার। আবার কার কি হলো। কিন্তু নিজের বাবা কিংবা বুবু’র কিছু হওয়ার কথা মেয়েটার আসলো না। পৃথিশার মামা তাকে ধরলেন। আস্তে-ধীরে হাঁটা শুরু করলেন। কিছুদূর যেতেই নাকে আগরবাতির- গোলাপজলের গন্ধ এসে ঠেকলো। সচকিত দৃষ্টিতে আশ-পাশ দেখলো। আরেকটু সামনে যেতেই দেখলো বাড়ির উঠোনে মানুষের ভীড়। পৃথিশার মামা ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন। উঠোনের মাঝখানে একটা খাটিয়া। তার সামনেই পৃথিশা মা, দাদী,চাচীরা বসে। পৃথিশার দৃষ্টিতে বিস্ময়। সে এগিয়ে গেলো খা’টি’য়ার দিকে। লা””শে””র মুখ ঢাকা। পৃথিশা এসে দাঁড়াতেই একজন মুখ খুলে দিলো। পায়ের তলা কেঁপে উঠলো পৃথিশার। দুনিয়া যেন ঘুরে উঠলো। ধকল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলেই তার মামা ধরে নিলেন। সিক্ত গলায় বললেন, “নিজেকে সামলা মা। ”
পৃথিশার মনে হলো কানে কিছু সে শুনছে না। আশে-পাশে ঘটে যাওয়া কোন কিছু তার বোধগম্য হচ্ছে না। বিড়বিড়িয়ে ‘বাবা’ বলে খাটিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো সে। তার কান্নার ধ্বনি যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে গেলো। গুনগুন কান্নার যে আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো তা-ও থেমে গেলো। পৃথিশা পাগলের মতো কাঁদছে। বাবা পাগল মেয়ে ছিলো তার। মায়ের থেকে বাবার সাথেই তার বনে বেশি। সব কথার সঙ্গী বাবা। এই বাবাই তাকে হাতে ধরে সব শিখিয়েছে। এইতে গতকালও এই সময় তারা গল্প করছিলো। তার বিলাপ সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেল।

– তুমি চলে গেলা বাবা,তুমিও একা ফেলে গেলা। এখন তো মাত্র শুরু বাবা আমাদের,এই মাঝপথে এসে ছেড়ে যাবা বাবা। বাবা ফিরে আসো প্লিজ। আমাদের তোমাকে দরকার বাবা। তুমি ছাড়া তো কেউ নাই বাবা৷ তুমি ছাড়া তো কেউ নাই। এত তাড়তাড়ি এ’তি’ম করে দিও না বাবা। পৃথিবীর কঠোরতা তো সহ্য করতে পারি না বাবা।ফিরে আসো, ফিরে আসো।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-০১

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
ফারিহা জান্নাত
পর্বসংখ্যা:০১

ন’গ্ন অবস্হায় নিজ বোনকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো পৃথিশা। দৌড়ে বোনের কাছে যেতেই বুঝলো যা হওয়ার হয়ে গেছে। এদিকে পৃথিশার মতো একা একটা মেয়েকে আসতে দেখে গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো বখাটে ছেলেগুলো। পৃথিশা তখন বোনের মাথা কোলে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। কাঁধে পুরুষালি হাতের ঘৃণ্য ছোঁয়া পেতেই গা শিরশিরিয়ে উঠলো তার। মূহুর্তেই তা ক্রোধে পরিণত হলো। বোনকে রাস্তায় শুয়িয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। ওড়নার নিচ থেকে লুকানো ছুঁড়িটা বের করলো। মূহুর্তেই তা ছেলেটার পেটে বসিয়ে দিলো। গগনবিদারী চিৎকারে যেন আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠলো। ছেলেটার এরূপ অবস্হা দেখে অন্যরা আর সেখানে দাঁড়ানোর সাহস পেলোনা। জলদি পালিয়ে গেলো।
পৃথিশা গায়ের ওড়না খুলে বোনকে ঢেকে দিলো। কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে বাবার নাাম্বার ডায়াল করলো।

– বাবা বুবুকে খুঁজে পেয়েছি। মোড়ের পিছনের গলিতে আসো বাবা। মা’কে আনার দরকার নেই।তুমি মামাকে নিয়ে আসো। গাড়ি এনো।

– মেয়েটা ঠিক আছে মা? হুট করে হারিয়ে গেল কেমনে বলেছে কিছু?

মুখ চেপে কান্না আটকালো পৃথিশা। রাস্তায় পড়ে থাকা বোনটার দিকে তাকিয়ে বলল,

-তুমি তাড়াতাড়ি আসো বাবা। সব ঠিক করে দাও এসে।

ফোন রেখে বোনের দিকে নজর দিলো পৃথিশা। পৃথিশার বড় বোন মণিদীপা, সুন্দর দেখতে বলে তার এক দাদী এই নাম দিয়েছিলেন। মণিদীপা আসলেই সুন্দর ছিলো অনেক। শ্যামলা গায়ের পৃথিশা তার পাশে দাঁড়ালে কেমন বেমানান লাগে সবার কাছে। অথচ এই বড় বোনই তাকে আগলে রাখতো কড়া বাস্তব জগৎ থেকে। ছোট বোনকে আগলে রাখতে গিয়ে নিজেকেই সামলে রাখতে পারলো না। পৃথিশা বোনের মাথা কোলে তুলে নিলো। গলায়,ঘাড়ে ক্ষ’ত চিহ্ন, খা’ম’চি’র দাগ, মাথা ফেটে র’ক্ত পড়ছে, গায়ের কাপড় নেই, মাথার জায়গায় জায়গায় চুল নেই। হুট করে পৃথিশা খেয়াল করলো মণিদীপার বাম চোখ বেয়ে গড়িয়ে র’ক্ত পড়ছে। চোখের পাতাটা খুলতেই চিৎকার করে উঠলো সে। মণিদীপার এক চোখ নেই,ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। নিজেকে আর আটকাতে পারলো না পৃথিশা। বোনের দে’হ জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো সে। কিছুসময় পরই গাড়ির হেডলাইটের আলো চোখে পড়লে সেদিকে তাকালো সে। তার বাবা ও মামা এসেছে। পৃথিশার বাবা রাশেদুল চৌধুরী গাড়ি থেকেই নেমেই মেয়েদের দিকে ছুটলেন।

– মণি কোথায়, ওকে দেখি। মেয়েটা হুট করে হাওয়া হয়ে গেলো। আমাদের কি চিন্তা হয় না?

তিনি এগিয়ে আসছিলেন। কাছাকাছি এসে পৃথিশার কোলে থাকা অচেতন মণিদীপাকে দেখেই তিনি থেকে গেলেন। পা টলমলিয়ে উঠলো তার। পড়ে যেতে নিলেই পৃথিশা মামা আমিরুল ইসলাম তাকে ধরে নিলেন। পৃথিশা তখনো বোনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলছে। রাশেদুল চৌধুরী ধাক্কা সামলাতে পারছেন না। তার আদরের সোনা মেয়ের এই অবস্হা তিনি সহ্য করতে পারছেন না। পৃথিশাকে ধাক্কিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

– কি, কি হয়েছে আমার মণির? মণি, মা আমার কথা বল।

পৃথিশা উত্তর দিতে পারলো না। তারপর কিছু একটা মনে পড়তেই বাবাকে বলল,

– বাবা বুবুকে বাঁচাতে হবে বাবা। তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। উঠো বাবা। তাড়াতাড়ি করো।

রাশেদুল চৌধুরীকে টেনে তুলল পৃথিশার মামা।

– বাবা তোমার ফতুয়া দাও তাড়াতাড়ি।

রাশেদুল চৌধুরী শরীর থেকে ফতুয়া খুললেন। তার মনে হলো তিনি মারা যাচ্ছেন। পৃথিশার মামা তাকে নিয়ে দূরে গিয়ে দাঁরালো। এদিকে পৃথিশা তার বোনকে ফতুয়া দিয়ে ঢাকলো। পৃথিশার মামা এসে মণিদীপাকে কেলো তুলে গাড়িতে বসালেন। রাশেদুল চৌধুরী কথা বলার অবস্হায় নেই। তিনি নিশ্চুপ হয়ে মণিদীপার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছুসময় পর তারা হাসপাতলে পৌঁছালো। জরুরী বিভাগে নেওয়া হলো মণিদীপাকে। পৃথিশার ব
মামাই সব করলেন। পৃথিশার বাবা চেয়ারে বসে আছেন। পৃথিশা ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। ডাক্তারের নির্দেশে কিছুসময় পরই মণিদীপাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো। মণিদীপার অবস্হা খারাপ ছিলো। যৌ’ন নি”পী”ড়”ন ও আ”ঘা”তের কারনে তার গাঁয়ে বেশ ইনজুরি হয়েছিলো। অপারেশন শেষ হলো, কিন্তু ডাক্তাররা খুব একটা আশা দিলেন না। মণিদীপাকে আইসিউ-তে নেওয়া হলো। নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে তাকে।
এদিকে পৃথিশার বাসার সবাই খবর পেয়ে হাসপাতালে এসেছে। পৃথিশার মা হাসপাতালে আসার পরই মেয়েকে দেখার জন্য পাগালমি শুরু করলেন। তাকে কেউ কিছু জানায় নি। পৃথিশার মা’কে কেউ সামলাতে পারলো না। শেষমেশ পৃথিশা তার মার সাথে আইসিইউ এর রুমে ঢুকলো।

মণিদীপার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ব্যান্ডেজে মোড়ানো। চোখটাও বাঁধা। পৃথিশার মা মেয়েকে দৌঁড়ে ধরতে গেলেন। কিন্তু ডাক্তাররা যেতে দিলো না। পৃথিশার মা বেডের পাশের বোর্ডে লাগানো পেশেন্টের কেইস হিস্ট্রি খেয়াল করলেন। সেখানে বোল্ড লাইনে লিখা ‘রে””ই””প”” কেস’। তিনি ঝট করে পৃথিশার দিকে তাকালেন। পৃথিশা তাকে বাহিরে টেনে আনলো। পৃথিশার মা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি বারবার পৃথিশাকে ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলেন,

– মণির কিছু হয় নি। ওরা ভুল লিখেছে তুই বল।ওরা ভুল লিখেছে তাই না? আমার মেয়ের সাথে এটা কেন? না না,আমার মেয়ের সাথে এটা হতেই পারে না। কোনভাবেই না, এটা মিথ্যা।সব মিথ্যা, তোরা সবাই মিথ্যুক,সবাই মিথ্যুক।

পৃথিশা মা’কে বুকে চেপে ধরলো। ভাঙ্গা গলায় বলল,

– চুপ করো মা।দোহাই লাগে চুপ থাকো। বুবু পবিত্র মা,সে পবিত্র। তোমার মেয়ের কিছু হবে না। কিছু না।

পৃথিশার মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। পৃথিশা তাকে উঠে বসালো। রাশেদুল ইসলামকে সে ধাক্কা দিতেই তিনি ঢলে পড়লেন। মূহুর্তেই তাকে জরুরী বিভাগে নেওয়া হলো। জানা গেলো অতিরিক্ত শকে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। পৃথিশা যেনো নিজেকে আর শক্ত দেখাতে পারলো না। মা’কে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। বেশ কিছুটা সময় পর রাশেদুল ইসলামের হার্টের অপারেশন শুরু হলো।

পৃথিশা ডাক্তারের পারমিশন নিয়ে নিজের বোনকে আবারে দেখতে গেলো। আশেপাশে আরো অনেক রোগীই আছে। কিন্তু মণিদীপার মতো এমন শোচনীয় অবস্হায় কেউ নেই। পৃথিশা তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।

– বুবু, তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? তুই তো ভালো বুবু,তাহলে তোর সাথে কেন হলো এটা? তুই-ই কেন বুবু? বুবু,বাবা অসুস্থ হয়ে গেছে। ডাক্তার বলল প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে। বুবু তুই কেন সন্ধ্যা বেলায় বের হলি? আমি, আমি পারছি না বুবু। আমার মনে হচ্ছে আমার ভেতরা কেউ খুব যত্ন করে প্রতি মূহুর্তে থেঁতলে দিচ্ছে। তোর চোখগুলো কত সুন্দর ছিলো। তারা…তারা কি করে এমন কাজ করতে পারলো?

পৃথিশা একটু থামলো। মণির মাথায় হালকা করে হাত ছুঁইয়ে বলল,

– তুই ম’রে যা বুবু। ওটাই তোর মুক্তি। বেঁচে থাকলে তুই প্রতি মূহুর্তে ম’র’বি। এর থেকে ভালো তুই এখনই চলে যা বুবু।

পৃথিশা চোখ মুছে বাহিরে আসলো। মায়ের পাশে বসে কাঁধে মাথা রাখলো। মাত্র কয়েকটা ঘন্টা। অথচ এই কয়েকটা ঘন্টাই তাদের জীবনের উথালপাতাল করা সময়। হুট করেই করিডোরে হইচই আওয়াজ পাওয়া গেলো। একদল পুলিশ এসে ঘিরে ধরলো পৃথিশাদের। তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

– মিস পৃথিশা চৌধুরী কে?

পৃথিশার মা কথা বলার অবস্হায় নেই। তিনি মলিন চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে বসে থাকলেন। পৃথিশা এগিয়ে গেলো তাদের দিকে।

– আমি-ই পৃথিশা চৌধুরী। কি সমস্যা?

– আপনার নামে মার্ডারের অভিযোগ আছে। আপনি আমাদের সাথে থানায় চলুন,সেখানেই বাকি প্রসেসিং হবে। এই, হাতকড়া পড়াও।

চলবে

ফিরে পাওয়া পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0

#ফিরে_পাওয়া
– মারিয়া আফরিন নুপুর
(শেষ পর্ব)

সেই প্রথম ছিল তার ঠোঁটের আলতো পরশ পাওয়া।
সারা শরীরের রক্ত ছলকে উঠছিল মাতালের মত, তাকে পাওয়ার আবেশে। এর কিছু দিন পরেই শিহাব চলে যায় ঢাকায়। মাঝে মাঝে যোগাযোগ হতো। বেশ কিছুদিন পরে বাসা থেকে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। উপায় অন্ত না পেয়ে তাকে জানিয়ে ছিলাম, আমার বিয়ে ঠিক করেছে বাবা। আসলে বাবার মুখের উপর কথা বলার সাহস কখনও হয় নি আমার। তাই শিহাব কে বলেছিলাম, আমাকে যেন তার কাছে নিয়ে যায়। উত্তর এসেছিল তার পড়াশোনা এখনও কমপ্লিট হয় নাই। নিজেই চলতে পারে না, আমাকে নিয়ে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে। তাই আমি যেন বাবাকে বলে আর কিছু দিন সময় নেই। কিন্তু বাবা আর সময় দেয় নাই আমাকে। বিয়ে দিয়ে দেয় খ্যাতনামা এক ইঞ্জিনিয়ার এর সাথে।
শুরু হয় জীবনের ভয়ংকর অধ্যায়। বাসর রাতেই বুঝেছিলাম আমার মনের না; শরীর নামক জিনিসের বড়ই কদর এই লোকের কাছে।
নিজের যে একটা আত্মসম্মান ছিল সেটা ভুলেই গেছিলাম।
বুকের উপরে, গলার নিচের, বুকের উপরিভাগের দগদগে লাল দাগ গুলোই সাক্ষী দিত অত্যাচারের।
এর মধ্যেই আমার কোল জুড়ে এলো ঝিনুক।
তখন রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটার অযুহাতে রুম আলাদা করে নিল সে। নিজের যখন প্রয়োজন হতো, তখন হিড়হিড় করে রুমে টেনে নিয়ে যেত। প্রয়োজন শেষ তো, ছুঁড়ে ফেলে দিত। রাস্তার পতিতাদের মত লাগত নিজেকে। হঠাৎই একদিন স্ট্রোক করে বসে ঝিনুকের বাবা। তিনদিন যমে মানুষে টানাটানি করার পরে আর বাঁচানো গেল না তাকে…

মুয়াজ্জিন এর আজানের শব্দ কানে আসতেই চোখ খুলে ফেললাম। কখন যে সকাল হয়েছে টেরই পাই নাই।
উঠেই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ঝিনুককে উঠিয়ে নাস্তা করালাম। বুয়াকে ঘর সামলাতে দিয়ে মা মেয়ে চললাম স্কুলে। বাসা থেকে বের হতেই দেখি শিহাব সামনে দাঁড়িয়ে। ক্রিম কালার আর ব্লু কালারের ব্লেন্ড পাঞ্জাবিতে কেমন যে তাকে দেখাচ্ছিল বুঝাতে পারব না।
শুধু এতটুকুই বলতে পারব যে, চোখ ফেরানো দায়।
তাকে দেখে এগিয়ে গেলাম। ঝিনুকের হাত ধরে দাঁড়ালাম শিহাবের সামনে। মেয়েটাকে দেখেই বলল ‘এটা তোমার মেয়ে দেখলেই বোঝা যায়। অবিকল তোমার মত হয়েছে।’
তখনই ঝিনুকের প্রশ্ন,
___ ‘মা মনি উনি কে?’
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই ঝিনুককে শিহাব টেনে নিয়ে বলল,
___’আমি তোমার আম্মুর ফ্রেন্ড আর তোমার আংকেল।’
মেয়েটা আমার সবার সাথে মেশে না, কিন্তু কেন জানি না শিহাবকে জড়িয়ে ধরে বলল, ___’আংকেল আমি শুক্রবার বাসায় থাকি, তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে।’
শিহাব ও সানন্দে রাজি হয়ে গেল।

পরের শুক্রবার সকাল থেকেই রান্না ঘরে ঢুকলাম।
বুয়া আর আমি মিলে রান্না শুরু করলাম। শিহাব পুডিং খুব পছন্দ করে তাই পুডিং, নুডুলস, পাকোড়া আর দুই এক পদের নাস্তা বানালাম। সে কখনোই বেশি ভারি খাবার খেত না। তাই পুরোদস্তুর বাঙালিয়ানা খাবার রান্না করলাম। ছোট মাছের চচ্চড়ি, বেগুন ভাজি, মুসুড়ের ডাল, সাদা ভাত, গরুর মাংস, চিংড়ি মাছ ভুনা আর লাউ চিংড়ি।
রান্না শেষ করতে করতে প্রায় ১২ টা বেজে গেল।
শিহাব এলো নামাজের পরে। হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুল আর দুটো গিফট বক্স। রাগ দেখিয়ে বললাম এত তাড়াতাড়ি আসার কি দরকার ছিল? আর একটু দেরি করে আসলেই তো রাতের খাবার খেতে পারতে। মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘অনেক খুঁজে পেয়েছি আর হারানোর ইচ্ছা নেই।’
ঝিনুককে ডেকে নিয়ে আসলাম। তিনজনে মিলে খেতে বসলাম। এত খাবার দেখে তো শিহাবের মাথায় হাত!
বলল, ‘করেছ কি এত এত খাবার!!!’
পরম তৃপ্তিতে তাকে খেতে দেখে শুধু চোখ না মনটাও জুড়িয়ে গেল আমার।
‘কি ব্যাপার শিমু, তুমি খাচ্ছ না কেন?’
শিহাবের প্রশ্নে যেন ধ্যান ভাঙল আমার।
বললাম পেট ভরে গেছে। খাওয়ার পরই ঝিনুকের ঘুমের অভ্যাস। ওর আংকেলকে বলে ও ঘুমাতে চলে গেল।
আমি শিহাবকে আমার রুমে নিয়ে আসলাম। ঘুরে দেখে বলল,
___ ‘শিমু তোমার রুমটা তো তোমার মতই গুছানো।’
বিছানা দেখিয়ে বললাম একটু রেষ্ট করে নেও।
___’এখন আর বসব না। পরশু পহেলা বৈশাখ তোমাকে আর ঝিনুককে নিয়ে ঘুরতে যাব মেলায়, রেডি থেকো।’
এই বলেই বের হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও ছিল না আমার কাছে যে, আমি রাজি কি না!
র‍্যাপিং পেপার মোড়ানো বক্স গুলো খুলতেই, সোনালি আর কালোর মিশেলে সুন্দর একটা জামদানি শাড়ি পেলাম। ছোট্ট একটা চিরকুটেও ছিল সাথে লেখা
“প্রিয়জনকে, তার হারিয়ে যাওয়া কাছের মানুষ”।
চিরকুটটা পড়ে এক অন্য ভালো লাগায় মনটা ভরে গেল।
আবার কেন জানি না ভয়ও লাগছিল।
মনটা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিল, আমি কি ঠিক করছি???

বৈশাখী মেলার দিন দুপুরের পরেই শিহাব আমাদের বাসায় চলে এলো। তাকে একটু বসতে বলে মা মেয়ে রেডি হতে চলে গেলাম। শিহাবের সেই শাড়িটা পরে হালকা একটু সাজলাম। চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিলাম আর কপালে ছোট একটা কালো টিপ দিলাম।
ঠোঁটে হালকা করে লিপবাম লাগিয়ে যখন ড্রয়িংরুমে আসলাম, দেখি শিহাব আর ঝিনুক দুই জনেই হা করে চেয়ে আছে আমার দিকে।
ঝিনুক দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, ___’মামনি তোমাকে কত্ত সুন্দর লাগছে তুমি নিজেও জানো না’।
শিহাবের দিকে তাকিয়ে দেখি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে।
বললাম,
___”যাবে না নাকি?? ”
ঘোর লাগা চাউনি নিয়ে বলল,
___ ‘নতুন করে সব শুরু করতে চাই আবার’।
যখন আবার প্রশ্ন করলাম, কিছু না বলে এড়িয়ে ঝিনুককে কোলে নিয়ে আগে আগে চলল।
সামনে যেয়ে আবার পিছনে এগিয়ে এসে সাদা পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা রক্তলাল গোলাপের কুঁড়ি হাতে দিয়ে বলল, ___”খোঁপায় দিও। ফুল ছাড়া খোঁপা খালি দেখাচ্ছে।”
সারা বিকেল মেলায় ঘুরলাম, সন্ধ্যায় ফুসকা-ঝাল মুড়ি খেয়ে বাসায় আসলাম। ঝিনুককে একগাদা খেলনা কিনে দিয়েছে শিহাব। মানা করার পরেও শোনে নাই।
শিহাবকে দেখে ভুলেই গিয়েছিলাম যে, এটা একটা মফস্বল শহর। দুইদিন পরে আম্মু আর ছোট বোন আসলো। দুজনেই আমতা আমতা করতে লাগল। জিজ্ঞেস করলাম,
___” কি হয়েছে? ”
তারপর আস্তে আস্তে শিহাবের কথা জানতে চাইল। আম্মুর কথা ছিল, আমি যেন আমার সংসার শুরু করি। কিন্তু ঝিনুকের কথা ভেবে আম্মুকে মানা করে দিয়েছিলাম।

বেশ কিছুদিন শিহাবের কোন খবর নেই। আমিও আর কোন খোঁজ নেই নি। মিছে মায়া বাড়িয়ে কি লাভ?
স্কুল বন্ধ ছিল, ঝিনুক ওর নানুর বাসায় গিয়েছে।
বুয়াকে পাঠিয়েছি আনতে। বুয়া যেই দরজা চাপিয়ে বের হয়েছে সেই শুরু হল অঝোর বর্ষন। মন জানি কেমন করে উঠলো। সোজা চলে গেলাম ছাদে। বৃষ্টি বরাবরই ভীষন প্রিয় আমার। বাচ্চাদের মতো বৃষ্টি পেলে পাগল হয়ে যাই। বৃষ্টিতে ভিজেছি কতক্ষন খেয়াল নেই। হঠাৎই দেখি ছাদের দরজায় শিহাব। তাকে দেখেই মনটা কেন জানি না অজানা ভালো লাগায় ভরে গেল। হাত দিয়ে ইশারা করে শিহাব ডাকল আমাকে। কাছে যেতেই বলল,
___’বৃষ্টিতে ভিজতেছ জ্বর আসবে তো, এক্ষুনি নিচে নেমে গোসল করে নেও।’
চলে আসলাম নিচে।
গোসল করে বের হলাম, হালকা গোলাপি পাড় কালো শাড়ি আর গোলাপি ব্লাউজ পরে। এসে দেখি তখনও ভিজে শরীর নিয়ে বসে আছে। টাওয়াল এগিয়ে দিয়ে বললাম,
___” মাথা মুছে ফেলছ না কেন?”
শিহাব অভিমানের সুরে বলল
___’মুছিয়ে দিলেই হয়'”
হাতে তোয়ালে নিয়ে মাথা মুছে দিতে দিতে বললাম,
___” একটা বিয়ে করে নেও। ”
হালকা হাতে কোমর ধরে কাছে টেনে নিল সে,
___” ‘অনেক আগেই অন্য কারো হয়ে গেছি, চাইলেও এখন আর অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না।”
এই বলেই বুকে মুখ গুজল আমার। তার উষ্ণ নিশ্বাসে বুকটা পুড়ে যাচ্ছিল।
মন সায় দিচ্ছিল বারবার কিন্তু আমিত্ত্ব সত্ত্বাটা বিদ্রোহ করে উঠল।
হাতের ধাক্কায় সরিয়ে দিলাম তাকে। মানুষটা উঠেই মাথা নিচু করে চলে গেল সেই ঝুম বৃষ্টিতে। বারবার ইচ্ছা হচ্ছিল হাতটা ধরে ফিরিয়ে আনি, কিন্তু হাতটা যে বাঁধা ছিল।

প্রায় তিন চারদিন যাবত খোঁজ নেই শিহাবের।
না ঘুমাতে ঘুমাতে চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। ঝিনুক একদিন সকালে গুঁটি গুঁটি পায়ে আমার রুমে এলো। কোলে মাথা দিলে বলল,
___ ‘মামনি কিছু কথা বলি?’
মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
___” হ্যাঁ মামনি বলো। ”
___’মামনি আমি কিন্তু জানি তুমি আংকেলকে পছন্দ করো, আংকেলও তোমাকে পছন্দ করে। নানুমনি বলেছে আমাকে। তাহলে কেন তুমি আংকেলকে আমাদের বাসায় আসতে মানা করেছ??'”
মেয়ের এই কথা শুনে আমি থরথর করে কেঁপে উঠলাম।
মেয়েটা আবার বলতে লাগল,
___ ‘মামনি তুমি আংকেলকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসো, এক্ষুনি যাবে না হলে আমি আর কথা বলব না তোমার সাথে। সবই ঠিক আছে কিন্তু আংকেলকে আমি বাবাই বলে ডাকব কি করে?’
এই বলে হেসে কুটি কুটি হতে লাগল ঝিনুক।
জড়িয়ে ধরে বললাম,
___”তবে রে পাজি মেয়ে।”

শিহাবের দেওয়া শাড়ি পরে, মাথার খোঁপায় ফুল গুজে আস্তে আস্তে গেলাম শিহাবের বাসায়। কলিংবেল টিপ দিতেই দরজা খুলল মাঝবয়সী এক লোক। শিহাবের কথা জিজ্ঞেস করতেই অন্য একটা রুমে নিয়ে গেল সে।
কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে শিহাব। লোকটা বলল গতকয়েক দিন যাবত জ্বর। কিছুই খায় না চুপ করে পড়ে থাকে। আস্তে করে ডাক দিতেই উঠে বসল শিহাব। শুকিয়ে গেছে অনেক খানি। আমাকে দেখেই চুপ করে মাথা নিচু করে বসল। মাথার চুলে আঙুল বুলিয়ে বললাম,
___” খাও না কেন? ”
অজানা এক অভিমানে আমার দিকে চেয়ে বলল,
___ ‘আমি ট্রান্সফারের জন্য আবেদন করেছি, এই শহর ছেড়ে তোমাকে ছেড়ে আবার অনেক দূরে চলে যাবো।’
আমি বললাম,
___”ঝিনুক তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে। ”
চোখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ‘তোমার ফ্যামিলি, ঝিনুক এরা কি বলবে?’
শুধু বললাম,
___” ঝিনুক তোমাকে আংকেল থেকে বাবাই কি করে বলবে তা নিয়ে ভীষন টেনশনে আছে।”
এই বলেই তার বুকে মুখ লুকোলাম।
আর শিহাব দুই হাতের বাধঁনে জড়িয়ে বলল ‘,”হারিয়ে আবার ফিরে পেয়েছি তোমাকে, আর কখনোই হারাতে দেবো না।”

সমাপ্ত

ফিরে পাওয়া পর্ব-০১

0

#ফিরে_পাওয়া
– মারিয়া আফরিন নুপুর
(১ম পর্ব)

বইগুলো সারারাস্তায় ছড়িয়ে পড়ল ধাক্কা লেগে।
ভেবেছিলাম মাথা উঁচু করে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেবো।
কিন্তু চোখ তুলে মুখের দিকে তাকাতেই বরফের মত জমে গেলাম।
আরেক জোড়া চোখ যে আমার মুখের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। এই সেই চোখ জোড়া, যার দিগন্ত ছড়ানো মায়ায় আমি হারিয়ে ছিলাম।
___’কি ব্যাপার শিমু, তুমি এখানে?’
এই বলেই শিহাব হাঁটু ভেঙে আমার সাথে বই উঠাতে লাগল।
আমি তখনও অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি।
___’তুমি কি রাস্তায়ই বসে থাকবে নাকি শিমু?’
মুচকি হেসে বলল সে।
সম্বিত ফিরে পেতেই বই তাড়াতাড়ি গোছাতে লাগলাম। বই উঠানো শেষে দাঁড়িয়ে পড়লাম দুজনেই। এই প্রথম আমি কথা বললাম,
___” তুমি এখানে? কবে আসলে?”
শিহাব উত্তরে বলল,
___ ‘এসেছি সপ্তাখানেক হল, সরকারি কলেজের সহকারী ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে জয়েন করেছি’
বলল উনি।
___”আমি এখানেই স্কুলে জয়েন করেছি প্রায় সাত বছর হল।”
___ “এখানে তো রিক্সাও পাবো না।”
___ ” সামনে আর একটু হাঁটলে পেতে পারো। ”
এই বলেই আমি হাঁটা শুরু করলাম।
আমার পাশাপাশি সেও হাঁটতেছে। হঠাৎ তার সেই বিখ্যাত হাসির আওয়াজ আসল কানে। থেমে বললাম,
___” হাসছো কেন?”
আমার দিকে ঘুরে শিহাব বলল,
___” ‘আচ্ছা শিমু বলতো, কত বছর পরে আমাদের দেখা?আগে যখন দেখা হত, তুমি তো অস্থির হয়ে যেতে ভয়ে। কে কখন দেখে ফেলবে!'”
চোখ কুঁচকে বললাম,
___”এই হলো তোমার হাসির কারণ? আচ্ছা তুমিই বল, কতদিন পরে দেখা আমাদের?”
___”‘আট বছর তিন মাস বারো দিন পরে দেখা।”
এই বলেই দুই পকেটে হাত দিয়ে উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল সে।
স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষন রইলাম। পরে কথা খুঁজে না পেয়ে বললাম,
___” আচ্ছা এখন আছো কোথায়? ”
___ “এই তো কলেজের পাশেই একটা বাসায় উঠেছি। একজন লোক রেখেছি রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সব কাজ ওই করে।”
তার উত্তর শুনে আরেকটা প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে না পেরেই বললাম,
___”বউ কে এখানে আনো নি?”
উত্তর না দিয়েই শিহাব হাঁটতে শুরু করল।
একটু পরেই আমার বাসার সামনে চলে আসলাম,বললাম,
___”চলো আমার বাসায়। ”
অন্যদিন আসবে কথা দিয়েই, সোজা রাস্তায় হাঁটা শুরু করল সে।

আমার বাসাটা খুব বড় জায়গা নিয়ে না। একতলা বিল্ডিং, বেশ খানিকটা ঘিরে বাউন্ডারি ওয়াল দেয়া। সামনেই বেশ বড় একটা উঠানের মতো। মফস্বল শহর গুলোতে যেমন হয় আর কি। মেইন গেটের সামনেই বিশাল কামিনী ফুলের ঝাড়। বাসায় ঢোকার রাস্তার দুই পাশে গোলাপ আর গাঁদা ফুলের গাছ। আসলে বাসাটা আমি আমার মত করেই সাজিয়েছি। অতি চাকচিক্য কখনোই আমার ভালো লাগে না। তাই সব কিছু সাদাসিধে রাখতেই ভালোবাসি।
বাসায় ঢুকেই ডাক দিলাম ঝিনুককে। ঝিনুক আমার মেয়ে, এবার সাড়ে ছ’তে পড়েছে,ক্লাস টু এ পড়ে। বাসায় ও আর আমার এক দূরসম্পর্কের খালা থাকে। বলতে গেলে উনিই ঝিনুককে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। খালাকে জিজ্ঞেস করলাম,” ঝিনুক কই?” খালার উত্তর দিল রুমেই আছে।
দরজা হালকা ফাঁকা করে দেখলাম মামনিটা মন দিয়ে ড্রইং করছে। আস্তে করে চলে আসলাম নিজের রুমে।

রাতে খাওয়ার পরে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের রুমে আসলাম। সমরেশ মজুমদার বরাবরের মতই আমার প্রিয় লেখক। তার ‘সাতকাহন’ বইটা নিয়ে বারান্দায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলাম। পাতা উল্টাচ্ছি কিন্তু চোখের সামনে যেন আজ থেকে দশ বছর আগের ছবি সেলুলয়েড ফিতার মত একের পর এক সামনে আসছে।
তখন সবে ইন্টার পাশ করে বাংলা নিয়ে অনার্সে ভর্তি হয়েছি। নবীন বরন অনুষ্ঠান উপলক্ষে স্টেজের মাঝামাঝি সারির চেয়ারে বসে আছি। প্রিয়া ফোনে ছবি তুলছিল। ইচ্ছা না থাকা স্বত্তেও দাঁত কেলিয়ে পোজ দিতে হচ্ছিল। হঠাৎই ভরাট গলার আওয়াজ আসলো। সবার দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য। সামনে চেয়ে দেখি পাক্কা পাঁচ ফুট এগারোর কম হবে না, মাথায় একরাশ চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, একহারা শরীর, ডিপ ব্লু পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরে অনুষ্ঠান উপস্থাপন করতে আসছে একটা ছেলে।
প্রথম দেখায় যারে বলে প্রেমে পড়ে গেছিলাম।
পাক্কা সাড়ে তিন ঘন্টার অনুষ্ঠানে কি হয়েছিল না হয়েছিল বলতে পারব না কিন্তু উপস্থাপক কি করেছে না করেছে সব মুখস্ত বলে দিতে পারব।
পরে জানতে পেরেছিলাম, নাম তার শিহাব।
ফুটবল খেলত কলেজের হয়ে। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টর তুখোড় স্টুডেন্ট ছিল।
বিতর্ক থেকে শুরু করে কলেজের সব ফাংশনে তার উপস্থিতি ছিল বাধ্যতামূলক।
সে নাই মানে অনুষ্ঠান বন্ধ। এমন করেই যাচ্ছিল দিন।
মাঝে মাঝে কোন কারন ছাড়াই ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট এর সামনে অহেতুক ঘোরাঘুরি করতাম, শুধু তারে একপলক দেখার জন্য। এমন করেই চলে গেল প্রথম বর্ষটা।
আমার এই একতরফা প্রেম কাহিনী কি করে যেন প্রিয়া জেনে গেল। কতক্ষন রাগ করল কতক্ষন বকা দিল। পরে জিজ্ঞেস করল আমি শিহাব ভাইকে বলেছি কি না যে, আমি তাকে পছন্দ করি। মিনমিনিয়ে বললাম, এটা কি বলার কোন বিষয় নাকি?

প্রিয়া সাপের মত ফোঁস করে বলল, “তুই মনে মনেই মন কলা খেয়ে যা।”‘ এই বলেই আল্লাহর বান্দা আমাকে ফেলে সোজা হাঁটা শুরু করল।
আমি তখনও থ হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, এত রাগের কি বললাম আমি? পরের শুক্রবার প্রিয়া এসে আমাদের বাসায় হাজির। এসেই আম্মুকে তেল মাখতে শুরু করল যে আমাকে নিয়ে যাবে ওর সাথে ওদের বাসায়।
আম্মু প্রথমে রাজি না হলেও পরে, প্রিয়ার চাপাচাপিতে রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। তখন আমার আর প্রিয়ার খুশি দেখে কে!
আমাকে বলল, ‘দোস্ত খুব সুন্দর করে রেডি হবি আজকে, যাতে তোরে দেখলে পরীও লজ্জা পায়।’
ওর মাথায় একটা গাট্টা মেরে বললাম, ___”পরীরা যদি আমাকে দেখে লজ্জা পায় সেটা খুব টেনশনের ব্যাপার।তাদের বয়ফ্রেন্ড জ্বিনরা, ওদের রেখে আমার সাথে ডেটিং মারবে। ”
এই কথা বলার পরে ও খিল খিল করে হেসে দেয়।
হালকা গোলাপি রঙ এর জামা আর সাদা ওড়না পাজামা পরে যখন চুল খুলে এসে দাঁড়ালাম প্রিয়া দেখেই বলল,
___’ওরে শিমুরে! তুনে তো মুঝে মার ডালা! একদম গোলাপের মত লাগছে তোকে।'”
চোখ কুঁচকে বললাম,
___তুই কি যাবি? নাকি আম্মুর মত ঘুরে যাওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবি?
তাড়াতাড়ি দুইজনে প্রিয়াদের বাসায় আসলাম।
আন্টির হাতের মজার মজার খাবার খেয়ে দুপুরে দুজন অনেক মজা করলাম। বিকালে হঠাৎই প্রিয়া বলল,
___’শিমু আমাদের ছাদে যাবি? খুব ভালো লাগবে তোর।”
আমি রাজি হয়ে বললাম,
___” চল এক্ষুনি চল। ”
ও আমাকে বসতে বলে কই যেন গেল… একটু পরেই লাফাতে লাফাতে এসে বলল, ___”‘চল চল, তুই এখনও বসে আছিস কেন? ছাদে যাব চল।”
দুই জনে ছাদে যাওয়ার জন্য উঠতেই ও বলল,
___”‘তুই ছাদে যা আমি আম্মুকে চা দিতে বলে আসি।”

আমি আস্তে আস্তে ছাদে এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম কার্নিশ ঘোরানো কোমর অব্দি উঠানো দেওয়াল। পুরোটাই গোলাপের টব দিয়ে ঘেরা। অনেক গোলাপ আর গোলাপের কুঁড়িও আছে। একটা গোলাপের কুঁড়ি দেখে এতটাই ভালো লাগল যে, সোজা আলতো করে কুঁড়িটাকে ধরে গালের সাথে লাগালাম। মুখ যখনই ঘুরিয়েছি হঠাৎই দেখি ছাদের কোনায় কে জানি দাঁড়য়ে আছে। সোজা হয়ে তাকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! এ তো দেখি শিহাব!
সাদা শার্টের স্লিভ ভাঁজ করে কনুই পর্যন্ত উঠানো, কালো প্যান্ট। এলোমেলো চুল, মুখে সেই খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।
আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে উদাস মনে।
তখনই মনে হলো, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? উনি এখানে কেন? ঘুরেই বলতে গেলে ছোট খাটো এক ম্যারাথন দৌড় দিলাম। ওই দিন হয়ত উসাইন বোল্টও আমার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করলে হেরে যেত। কিন্তু সিঁড়ির ঘরে যেয়েই হার্ড ব্রেক কষতে হল। রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়া।
___”‘কি হয়েছে, ভূত দেখেছিস নাকি তুই?”‘ বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললাম,
___” ছাদের কোনায় কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। ”
প্রিয়া টানতে টানতে আমাকে নিয়ে গেল। এসে দাঁড় করালো শিহাবের সামনে। তখন বুঝলাম যে, আমি সত্যিই দেখেছি এটা শিহাবই।
প্রিয়া যখন টেনে আমাকে তার সামনে নিয়ে আসলো, সে তখন হাসতেছে আর আমি লজ্জায় মনে মনে বলছি, হে ছাদ তুমি দ্বিখণ্ডিত হও আমি নিচতালায় চলে যাই!
___”‘শিহাব ভাইয়া শিমু না অনেক কিছু তোমাকে বলতে চায়, কিন্তু বেচারীর বলার সুযোগই পায় না।”
এই বলেই খিল খিল করে হেসে উঠলো প্রিয়া।
পরে ‘চা আনি’ বলেই ঘুরে চলে গেল।
মনে মনে বকছিলাম প্রিয়াকে, চা আনতে কয় বার যেতে হয়? আস্তে আস্তে শিহাব আমার একদম সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়েছিল। বুঝতে পারছিলাম মাতাল মাতাল এক জোড়া চোখ আমাকে গভীর ভাবে দেখছে।
চোখে না দেখলেও সেই চাহনির তীব্রতায় আমি পুড়ে যাচ্ছিলাম।
___”‘এই মেয়ে, যাকে এত ভালোবাসো অন্তত একবার বলতে তো পারো নাকি? অহেতুক ইংলিশ ডিপার্টমেন্টর সামনে ঘোরাঘুরি, ডিবেট ক্লাবে না থেকেও দৈনিক হাজিরা, এতই যখন ভালোবাসো বললেই পারো।”
আমি তখনও মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছি। সে ধীর পায়ে আরো এগিয়ে এলো, ফিস ফিস করে কানের কাছে বলল,
___”‘এত সুন্দর একটা মেয়ে যদি প্রতিদিন সামনে ঘোরাঘুরি করে, আমি তো ভালোই দেবতারাও চোখ ফেরাতে পারবে না। কেন জানি না আজকে গোলাপের চে’ও সুন্দর লাগছে তোমাকে। এখনও কি চুপ থাকবে, নাকি কিছু বলবে?'”
তখন আমার কাছে মনে হচ্ছিল খুব বড় একটা ভূমিকম্প হচ্ছে আর বিল্ডিং সহ নড়তেছে খুব জোরে জোরে।
মনে আছে শুধু এটুকুই বলতে পেরেছিলাম যে, “আমি পানি খাবো।” এই ছিল আমার ভালোবাসার প্রথম দিন।

এরপরে কলেজ ক্লাসের ফাঁকে, ছুটির পরে দেখা হত।
অত কথা তো হত না কিন্তু দুজন দুজনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
ভালোবাসার প্রতিটা কথা, বেশিরভাগ চোখ দিয়েই আদান প্রদান হত। মফস্বল শহর, যদি আব্বু শুনতে পায়, এই ভয়েও খুব বেশি কথা বলতাম না।
এমন করেই যাচ্ছিল দিনকাল। দেখতে দেখতে শিহাবের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। মাস্টার্স কমপ্লিট ঢাকায় করবে। পয়লা ফাল্গুনের দিন প্রিয়া এসে হাজির।
আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে বাইরে। আম্মু বারবার বলছিল আব্বু শুনলে রাগ করবে। প্রিয়া কিভাবে জানি আম্মুকে রাজি করিয়ে ফেলে আবার।
সেদিন বাসন্তী কালারের শাড়ি পরেছিলাম বাসন্তী কালারের ব্লাউজের সাথে।
কপালে লাল টিপ, মাথায় হালকা হাতে একটা এলো খোপা। হাতে পরেছিলাম লাল কাঁচের চুড়ি। আমাকে দেখে প্রিয়া হাঁ করে চেয়ে বলেছিল, ‘শিমু করেছিস কি, বেচারা ঢাকা যাচ্ছে পড়তে তার মাথাটা খারাপ না করলেই কি নয়?’
চোখ মটকে বলেছিলাম, “যাবি, নাকি পুলিশ ডাকবো?”
দুই বান্ধবী রিক্সা নিয়ে কাঠেরপুলে আসছিলাম। পরে আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকি। একটু হাঁটার পরেই দেখি শিহাব ঢেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ব্লাক শার্ট আর হোয়াইট প্যান্ট পরে। পায়ে ব্ল্যাক স্নিকারস। শার্টের হাতা বরাবরের মতই একটু গোটানো।
হাতে রিষ্টওয়াচটা দেখলে মনে হয় শুধু তার জন্যই বানানো হয়েছে।
প্রিয়া আমাকে ঠেলে দিয়ে বলল, তুই যা আমি আছি।
গুঁটি গুঁটি পায়ে তার সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম আমি।
আমাকে দেখেই সে এগিয়ে আসলো, আমার যেন হার্টবিট বন্ধ হয়ে আসছিল। কাছে আসতেই পারফিউমের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে উঠল আমার চার পাশ।
হাত ধরে বলল, ‘”চলো সামনে যেয়ে বসি।'”
হাঁটতে হাঁটতে কিছু দূর আসলাম। একটা বড় পুকুরের মতো। তার কিনারে বসতে যাব এমন সময় থামিয়ে দিল সে, পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে বিছিয়ে দিয়ে বলল, “এখানে বসো।”
দুজনেই বসে চুপ করে আছি অনেক্ষন।
সে হাসি দিয়ে বলল,
___” ‘আমি কি তোমার নিরবতা শুনতে এখানে এসেছি না কি?'”
আমি যখন মুখ তুলে তাকালাম, তখন আমার চোখ ভর্তি পানি।
___” ঢাকাতে অনেক অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে। তুমি ওখানে গিয়ে আমাকে ভুলে যাবে না তো?”
হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করে সে। টের পাই কপালে তার উষ্ণ ঠোঁটের আলিঙ্গন। শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেই স্পর্শ যেন অনুভব করছিল। সে এক অন্য অনুভূতি।
___”নিজেকে হয়ত ভুলে যাবো, তোমাকে কখনও না। মাত্র তো দুই বছর এরপরেই চাকরি পেয়ে তোমাকে আমার করে নেবো।”
‘ এই বলেই বড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
পকেট থেকে একটা আধফোটা গোলাপ কুঁড়ি বের করে খোঁপায় গুজে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল
“‘আমার জন্য অপেক্ষা করো…”

চলবে।