Sunday, August 17, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 103



স্বর্ণকেশী মায়াবিনী পর্ব-৫+৬

0

#স্বর্ণকেশী_মায়াবিনী
#লেখনীতে-বর্ণ(Borno)
#পর্ব-৫

প্রখর রোদ বিরাজমান তার মাঝে হঠাৎই ক্ষণে ক্ষণে রং পাল্টায় নীলাকাশ। চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসেছে।নীল গগণ ঢেকে যায় কালো মেঘে। যেনো এই বুঝি এলো অবিরাম বৃষ্টি।

আজ মায়া কলেজ যায়নি মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে আছে।বাড়ির পাশের খালের ঘাটের পাটাতনের ওপর পা পানিতে চুবিয়ে আজও বসে আছে।আবহাওয়া মোটেও ভালো নয় যখন তখন বৃষ্টি নামবে কিন্তু সেদিকে ওর মোটেও খেয়াল নেই।আকাশে মেঘের এমন ঘনঘটায় পাখির উড়াউড়ি দেখে অনুমেয় জনজীবন বিপর্যস্ত করতে নামছে শ্রাবণের বারিধারা।আশেপাশের গাছের উপর ছুঁয়ে যাওয়া মেঘ আকাশের বুক চিরে বৃষ্টি হয়ে নামতে লাগলো।

বৃষ্টির মোটা জলকণা মায়াকে ছুয়ে দিতেই গা কেপে উঠলো।জায়গা থেকে সরলো না এক চুল পরিমান।মনে হচ্ছে এই বৃষ্টির অপেক্ষায় ছিলো ও।বৃষ্টির পানির সাথে মায়ার চোখের নোনা পানি গুলো মিশে যাচ্ছে।প্রকৃতি হয়তো বুঝতে পেরেছে ওর মনের কথা গুলো।তাইতো ওর সমস্ত দুঃখ কষ্ট গুলো ধুয়ে মুছে শেষ করে দিচ্ছে কিন্তু আদৌ সেটা সম্ভব হবে?

বৃষ্টির এ সময়টাতে ঘরের কোথাও বোনকে দেখতে না পেয়ে পুষ্পএকটা বড়ো পলিথিন পেচিয়ে বাইরে বের হয়।কয়েকবার ডাকলেও সাড়া পায়নি বোনের।শেষে সামনে এগিয়ে খালপার গেলে সেখানেই মায়াকে দেখতে পায়।পুষ্প মায়াকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে যায় ও বুঝতে পারে মায়া ইচ্ছে করেই ভিজছে।হাত ধরে টান দিতেই মায়ার ধ্যান ভাঙ্গে।

“বুবু এখানে কি করছো দেখছো মেঘ ডাকছে চলো।

“তুই যা আমি পরে যামুনে।

“না তুমি আমার সাথেই যাবা চলো।

মায়াকে এক প্রকার জোড় করেই পুষ্প দাঁড় করায়।

“বুবু এমন পাগলামি কেনো করছো ?শরির খারাপ হবে না কও?

তাছ্যিল্যের হাসি দিয়ে মায়া মনে মনে বলতে থাকে

“যেখানে মনটাই শতো আঘাতে জর্জরিত সেখানে শরির খারাপের চিন্তা করাটাই বোকামি।

“কি হলো বুবু কিছু কইছো না যে?

মায়া এখনও চুপ কি বলবে ?ওর এখন কিছু বলতে মন চায় না।

“বুবু তুমি কিছু না কইলেও আমি আইজ চুপ থাকুম না।মায়ের লগে আমি কথা কমু।এই বিয়াতে তোমার মত নেই।তার ওপর ঐ বেডা রমজান ওয় তো একটা খারাপ জঘন্য একটা মানুষ।

পুষ্পর কথা শুনে মায়া ওকে থামিয়ে দেয়

“নাহ বইন তুই মায়রে কিছুই কইবি না।আমি রাজি তো এই বিয়াতে।হেয় যেইটা ভালো মনে করছে ওইটাই হইবো।

“কিন্তু বুবু তুমি সবটা জানো তারপর ও রাজি হও কেমনে আমার বুঝে আসে না।

“তোর বুঝতে হইবো না আমি জানি বাজান ও রাজি না তয় তারে ও বুঝানোর দায়িত্ব আমার।

পুষ্প আরো কিছু বলতে গেলে মায়া বলতে নিষেধ করে।বোনের হাত ধরে মায়া ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

———

আগামীকাল মেহরাবের শহরে ফেরার কথা থাকলেও আজ ফিরোজের সাথে কথা বলে জানিয়েছে আরো দুই/তিন দিন পর যাবে।ফিরোজ ওর কথা শুনে টাস্কি খায়।যে মানুষটা একটা দিন ছুটি কাটাতে চায় না সেই মানুষটার কাজ শেষ অথচ সব কিছু ফেলে আরো দু তিন থাকতে চাইছে?ব্যাপারটা সন্দেহ জনক লাগলো।ফিরোজ কিছু একটার আভাস পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো

“ঘটনা কি বড়োভাই যেই কাজের জন্য গিয়েছেন সেই কাজ তো শেষ হলো কিন্তু আসবেন না কেনো?

মেহরাব ওর কথা শুনে সোজা সাপ্টা উওর দেয়

“নানু বাড়ি এসেছি শুধু কি কাজের জন্য ?মন ভরে কি একটু বেড়ানো যাবে না?

“অবশ্যই যাবে ‘ বড়োভাই মন ভরে বেড়ান আমি তো আছি এখানে নো টেনশন।আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে বলবেন সোজা চলে আসবো।

“ঠিক আছে এখন রাখছি ।

আজ সকালে জমির ঐ জায়গাতে ঘর উঠানোর জন্য কাজ শুরু করা হয়েছে।মেহরাবের ইচ্ছা ছিলো আরো কয়েকদিন পরে করার কিন্তু মতামত পরিবর্তন করে কলিমউল্লাহ মামু কে বলে নিজে দাড়িয়ে থেকে কাজটা শুরু করিয়েছে।মনে এক অন্যরকম ভালো লাগা অনুভূত হচ্ছে আরো কয়দিন থাকবে বলে।এরই মধ্যে ও মায়ার সব ডিটেইলস্ জানতে পারবে এটাই আশা করছে।শুধু তাই না মেহরাব রিতিমতো পাগল প্রায় তার মায়াবিনীকে আরেক নজর দেখার জন্য।

জমির ওখান থেকে বাসায় আসার পথেই বৃষ্টি নামে।মোটামুটি ভিজে বাড়ির ভেতর ডুকে পরে।এই মুহূর্তে রাসেল বাড়িতে নেই ওদের বাড়ি গেছে ।আর বলে গেছে আসার সময় ওর জন্য দুপুরের খাবার নিয়েই ফিরবে।মেহরাব রুমে ডুকে শার্ট খুলে হ্যাঙ্গারে রেখে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশ রুমে যায়।পরনের প্যান্ট চেন্জ করে ট্রাউজার পরে উদাম গায়ে শরির মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়ায়।হঠাৎ আয়নায় মনে হলো কিছু একটা দেখেছে।মোছা বাদ দিয়ে সামনে তাকায় কই কিছু না।দৃষ্টি সরিয়ে মুছতে লাগলে আবারও চোখ যায় আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বর জায়গায় এ কাকে দেখছে ও?
আয়নার অতি নিকটে গিয়ে “মায়াবিনী” বলে হাত বাড়িয়ে দেয়।কিন্তু কই সে? এটা যে নিজেরই প্রতিবিম্ব।নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা মে রে হেসে ফেলে।সত্যিই মাথা খারাপ হয়ে গেছে ওর।তাই তো যখন তখন হ্যালুসিনেশন হচ্ছে ওর সাথে।

——-

অন্যদিকে বিয়ের তারিখ পাকা পাকি হওয়াতে বেজায় খুশি রমজান।হওয়ারই কথা ওর মতো মানুষ এই গ্রামের সবচাইতে সুন্দর মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে এটাতো ওর সাতজনমের কপাল।কিন্তু মায়া তো ওকে দুচোখের বি”ষ মনে করে।সেটাতে ওর কিছুই যায় আসে না।ও মায়াকে জোর করে হলেও পাবে এটাই অনেক।রমজানের এমন খুশিতে মনে হচ্ছে এই প্রথম বিয়ের পিড়িতে বসতে যাচ্ছে।খুশির জোয়ারে আর একটা দিনও দেরি করতে চায় না কালই বিয়ে করবে বলে মদন মুন্সির কাছে আবদার করে।
কথাটা শুনে মদন মুন্সি ছেলেকে বোঝাতে গেলেও ব্যর্থ হয়।হবে না কেনো এমন রগচটা নে”শা খোর ছেলে তার যা বলবে তাই করিয়ে ছাড়বে।অগত্যা মায়াদের বাড়ি খবর পাঠায় মদন মুন্সি।অবশেষে আয়মন সেটাতেই রাজি হয়।ঠিক করা হলো আগামীকাল বিয়ে করে একবারে সাথে করে নিয়ে যাবে।

আয়মন মদন মুন্সির থেকে বিয়ে বাবদ বাকি টাকাটা আজ পেয়েছে আর তাই ওর মনের আনন্দ দেখে কে।এসব দেখে কাশেম মিয়া বউ কে অনেকক্ষণ যাবত গা”লা গা”লি আর খারাপ কথা শুনায়।সেটাতে আয়মন তেমন রিয়েক্ট করে না।কাশেম মিয়া এক পর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে হাতের কাছে থাকা মোটা লা”ঠি নিয়ে বউকে মা”রতে গেলে মায়া আর পুষ্প তাকে ঠেকায়।
বাবাকে একটু শান্ত করে মায়া বাবাকে বলে

“বাজান তুমি শান্ত হও আমি তো রাজি তাই তুমিও রাজি হইয়া যাও।হয়তো এইটাই আমার নিয়তিতে আছে।তয় তুমি উপর ওয়ালার প্রতি ভরসা রাখো।সে যদি চায় আমার খারাপ কিছু হইবো না।

মেয়ের কথা শুনে কাশেম মিয়া কান্না করে দেয়

“মারে এইটা কেমন নিয়তির খেলা।তোর মায় তোরে ইচ্ছা কইরা আ”গুনে ফেলাইতাছে আর তুই সেইটাই মাইন্যা নিছোস?ওয় তোর মা না সৎ মা

“এমন কথা কইয়ো না তুমি।একটু চুপ থাকো বাজান তোমার এমনিতেই শরির খারাপ।এমন করলে শরির আরো খারাপ হইবো যে।

“শরির দিয়ে কি করবো রে মা?বাইচ্যা থাইক্যা মাইয়্যার এমন সর্বনাশ আমি দেখতে পারুম না আল্লাহ আমারে তুলে নিয়া যাক।

এসব কথা বলে আহাজারি করছে কাশেম মিয়া।মায়া বাবাকে শান্তনা দিয়েই যাচ্ছে।অথচ এ সবে আয়মন কোনো পাওাই দিচ্ছে না।টাকার কাছে যে ওর আত্মসম্মান আর মনুষত্ব্য বিক্রি করে দিয়েছে।

——-

বিকেলে মেহরাব রাসেল কে নিয়ে গ্রামের পাশে বয়ে যাওয়া নদীর পার ঘুরতে আসে।জায়গাটা সত্যিই সুন্দর রাসেল ওকে ঘুরে ঘুরে চারদিকটা দেখাতে লাগলো।নদীর পারে অনেকটা অংশ জুড়ে পার বাঁধানো।এখানে যারা ঘুরতে আসে অনেকেই পারে বসে নদীর দৃশ্য উপভোগ করে আর আড্ডা দিয়ে থাকে।রাসেল আর মেহরাব ও এই জায়গায় বসে কথা বলছে।কথার ফাকে মেহরাব রাসেল কে জিজ্ঞেস করে

“রাসেল এই গ্রামের অনেককেই তো তুমি চিনো তাই না?

মেহরাবের কথা শুনে রাসেল বলে

“হুম অনেকরেই চিনি কিন্তু ক্যান ভাইজান?

“আচ্ছা এই গ্রামের মায়া নামের কাউকে চিনো তুমি?

রাসেল মেহরাবের মুখে এই গ্রামের কোনো মেয়ের কথা শুনে অবাক হয়।সেটা না হয় ঠিক আছে কিন্তু মেয়ের নামটা পর্যন্ত বলে দিলো এটা কেমনে সম্ভব?

“ভাইজান আপনে কোন মায়ার কথা বলছেন?

“রাসেল তুমি কোন মায়াকে চিনো আর কয়টা মায়া আছে এই গ্রামে বা আশেপাশের কোথাও?

“এই গ্রাম আর আশপাশ মিলায়ে মোট একটাই মায়াই আছে।আর এর মতো ভালো মেয়ে এই একটা গ্রামে খুঁজে পাওয়া যাবে না।কিন্তু..

“কিন্তু কি রাসেল বলো আমায়।

“ওরা খুব গরিব।আচ্ছা ভাইজান এইটা বলেন ওরে চিনলেন কেমনে আর নামই জানলেন কেমনে?

রাসেলের এমন জানার আগ্রহ দেখে মেহরাব মুচকি হাসে।

“শোনো এ সব পরে বলবো আগে একটা কাজ করে দেও আমার।তুমি ওর সম্পর্কে ডিটেইলস্ জেনে আমাকে জানাবে আর সেটা কালকের মধ্যেই ওকে।

“ওকে ভাইজান আপনি একটা মহৎ কাজ দিছেন আর আমি সেইটা করুম না এমনটা হয় বলেন।ধরেন আপনের নব্বই পার্সেন্ট কাজ হয়ে গেছে।

“ঠিক আছে চলো এবার যাই”
তখনকার মতো ওরা বাড়ি ফিরে আসলো।

~~

পরদিন মেহরাব সকাল থেকেই ওর গৃহনির্মাণ প্রকল্পের কাছেই আছে।কয়েক দিন হলো অফিসের কাজ গুলো করতে পারছে না আবার এখনই ফিরে যাবে সেটাও পারছে না।তাই বসে বসে বোর না হওয়ার চাইতে এখানে এসে কাজের খোঁজ খবর নেওটা উওম মনে হয়েছে।তা ছাড়া এটাতো ওর নিজের কাজ।এই অল্প সময়ে এখানের লেবার গুলোর সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক হয়েছে ওর।
শুধু ওর কাজ বলে নয় নানু বাড়ির এলাকার লোকজন হিসেবে ও সবার সাথে বেশ আন্তরিকতার সাথে কথা বলে,সব কিছুর খোঁজ খবর নিচ্ছে।তারাও মেহরাবের ব্যাবহারে খুশি।

মেহরাবের কাছে নিজের বিজনেস এর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখন মায়ার সম্পর্কে জানাটা।তাই ইচ্ছা থাকলেও এই মুহূর্তে শহরে ফিরতে চাইছে না।
সেই সকাল থেকে মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে কখন রাসেল আসবে সেটা ভেবে।এমনিতেই বেচারা এই দু তিন ঠিক মতো খেতে পারছে না।মাঝে মাঝে নিজের এমন অবস্থা ভেবে হেসে দেয় মেহরাব।টিনএজারদের মতো নতুন নতুন প্রেমে পরলে যা হয় আরকি।কিন্তু ও তো পরিপূর্ণ যুবক তাতে কি হইছে প্রেমে তো নতুন পরেছে তাই অস্থিরতা আর ভাবনা টা ওকে বেশ ঝেকে বসেছে।

অস্থিরতার অবসান ঘটিয়ে দুপুরের আগ মুহূর্তে রাসেল আসে।মেহরাব বেশ উৎসাহ নিয়ে রাসেল এর সামনে যায়।কিন্তু রাসেল ওকে যেটা বলে তাতে মনে হলো ওর মাথায় পুরো আকাশটাই ভেঙ্গে পরছে।কি শুনলো এটা হয়তো ভুল শুনেছে।কিন্তু না পর পর কয়েক বার রাসেল এর মুখ থেকে একই শব্দটা শুনতে পায় ভাইজান “মায়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে আর আজই ওর বিয়ে।”

চলবে……

#স্বর্ণকেশী_মায়াবিনী
#লেখনীতে-বর্ণ(Borno)
#পর্ব-৬

বিয়ে বাড়ি অথচ সাজসজ্জার ছিটে ফোটাও নেই।থাকবে কি করে হুট করেই বিয়ের প্রস্তুতি চলছে।বাড়িটিতে শুধুমাত্র আয়মনের বাপের বাড়ির লোকজন আর আশেপাশের কিছু মানুষ জনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

আয়মনের দুই ভাইয়ের বউ,পুষ্প আর কয়েকজন মহিলারা মিলে গ্রামের নিয়ম অনুযায়ী মায়াকে গায়ে হলুদ লাগিয়ে গোসল করিয়ে দেয়।গাছ থেকে সদ্য তুলে আনা মেহেদী পাতা পাটায় বেটে এনে রাখা হয়েছে।আয়মনের কথা মতো পুষ্প মায়ার হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছে।
অনিচ্ছা থাকা সত্বেও সেই মেহেদীর রঙে দু হাত রাঙিয়েছে মায়া।নকশাবিহীন মেহেদীতে ফর্সা হাত দুটো দেখতে অপূর্ব লাগছে।মায়া মনে মনে চেয়েছিলো এ হাতের মেহেদীর রঙ যেনো গাড়ো না হয়।ও চাইছে না এ গাড়ো রঙ টা ঐ নিকৃষ্ট মানের লোকটার চোখে পরুক।কিন্তু না মনের উইশ টা পূর্ন হলো না।মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে আছে।

মদন মুন্সি আগেই লোক মারফত বিয়ের জিনিস পএ মায়াদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু মায়া সে সব জিনিস ছুয়ে ও দেখেনি।বিয়ের শাড়ি গয়না পরাতে গেলে ও পরবে না বলে জানিয়ে দেয়।আয়মন এক দফা কটু কথা শুনিয়ে যায় মায়াকে কিন্তু মায়া সেটাতে ভ্রুক্ষেপ করে না।ওর একটাই কথা শাড়ি পরবে কিন্তু ওদের বাড়ির নয়।পরতে হলে ওর মায়ের শাড়ি পরবে।
কাশেম মিয়া তার প্রথম বউয়ের বিয়ের শাড়িটি রেখে দিয়েছিলো।মেয়ে যখন একটু বড়ো হয় তখন মায়ের জিনিস মেয়েকে দেয় কাশেম মিয়া।মায়া সেটা পরম যত্নে আগলে রাখে।মায়ের মুখটা ওর জানা নেই কিন্তু এই শাড়িটি দেখলে মায়ের কথা ভাবতো মাকে অনুভব করতো।আজ ওটা বের করেছে।কমলা রঙের শাড়ি একটা সময় গাড়ো বর্ণের থাকলেও এখন সেটার রং অনেকাংশে হালকা বর্ণের হয়ে গেছে।তবুও মায়া এটাই পরবে।
পুষ্প ওকে শাড়ি পরিয়ে নিজের সাজের প্রসাধনি দিয়েই হালকা সাজগোজ করিয়ে দেয়।আর লম্বা সোনালী চুল গুলো খোপা করে ওর কাছে থাকা সোলার গাজরা ফুল টা খোপায় পরিয়ে দেয়।

মাথায় ঘোমটা দিয়ে বোনকে সামনে বসিয়ে মায়া দেখতে থাকে।

“ইশ বুবু তোমারে দেখতে ঠিক রাণীর মতো লাগছে।এখন শুধু একটা রাজার দরকার।

মায়া কোনো কথা বলছে না চোখ থেকে টপ টপ করে পানি বের হচ্ছে।ও ভাবতেই পারছে না আজকের পর থেকে কোনো এক অমানুষের নিকট তাকে সপে দিতে হবে।চোখ বন্ধ করে উপর ওয়ালার কাছে প্রাথর্না করছে এ বিয়েটার হাত থেকে রক্ষা করো প্রভু।
পুষ্পের মনে পরে রাজা তো নয় এ তো সয়ং শয়”তানের ভাই আসতেছে। মায়ার কান্না ভরা মুখ দেখে বোনকে শান্তনা দিতে লাগে

“বুবু কাইন্দো না আমার মন কইতাছে এ বিয়ে হইবো না।দেখে নিও।

মায়া এ সবে থামে না বোন তাকে মিথ্যে সান্তনা দিচ্ছে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু এতে কি কোনো প্রকার মিরাকেল ঘটার সম্ভাবনা আছে?

~~~~

দুপুরের পর থেকেই মেহরাব রুমের খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে।চেন্জ তো দূর পায়ের সু টাও খোলেনি।বেচারার মনে প্রেম জাগার আগেই ছ্যা’কা খেয়ে নিলো ভাবতেই পারছে না এমনটা হবে।মনে মনে মায়ার জন্য কতো কিছুর অনুভব সৃষ্টি হয়েছিলো জাস্ট একটা কথা শুনে সবটাই শেষ হয়ে গেছে।কিন্তু শেষ বললেই কি শেষ করে দেওয়া যায়?

তখন রাসেলের মুখে এ সব শুনে ওর মনে হয়েছিলো মায়াদের বাড়ি ছুটে যেতে।জোড় করে হলেও ওকে নিয়ে আসবে কিন্তু যেখানে একবারের দেখায় একতরফা ভালো লাগা ভালোবাসার জন্ম সেখানে না যাওয়াটাই ভালো।যদি গিয়ে উল্টো অপমানিতো হতে হয় তা ছাড়া মেয়েটা তো আর ওকে ভালোবাসেনা।জোড় করে তো আর এ সব করা যায় না।ভাবছে বিকেলেই শহরে চলে যাবে।শোয়া থেকে উঠে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে ফিরোজ কে কল দিতে যাবে সেই মুহূর্তে কলিমউল্লাহ মামুর ডাক শুনতে পায়।
ড্রইংরুমে বসে আছে কলিমউল্লাহ ওকে দেখে হাসি মুখে বললো

“আজ বিকেলে আমার সাথে একটা জায়গায় যাবে।

“কোথায় মামু?

“একটা বিয়ে বাড়ি যাবো।তোমাকে তো তেমন কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতে পারিনি।আমাকে দাওয়াত দিয়ে গেলো তাই ভাবলাম তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো।

মেহরাবের ইচ্ছে হলো না আবার মুখে নাও বলতে পারছে না।মামু আবার কি মনে করে তাই হা বলে দিলো।

“তা হলে তুমি রেডি থেকো আমি নিজে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।

“ঠিক আছে মামু।

কলিমউল্লাহ চলে গেলে মেহরাব ভাবছে আজও থাকা লাগবে কিন্তু এই বিষন্ন ভরা মন নিয়ে এ গ্রামে আর মন টিকছে না।কি আর করার মামুকে কথা দিয়েছে তাই যেতে হবে।আজ থেকে কালই শহরে রওয়ানা হবে সেটাই ভেবে রেখেছে।

“বরপক্ষের লোক চলে আসছে বাড়ির উঠানে সবাইকে বসতে দেওয়া হয়েছে।কাশেম মিয়ার বিয়েতে মত না থাকলেও মেয়ের বাবা হিসেবে যে সব দায়িত্ব পালন করার কথা সে টুকু বাধ্য হয়ে করছে।অল্প সময়ের মধ্যে বিয়ের আয়োজন হলেও গ্রামের কয়েকজন সম্মানিত ব্যাক্তিকে দাওয়াত দিতে ভোলেনি সে।তার মধ্যে কলিমউল্লাহ একজন।
বর বেশে রমজান এসেছে কিন্তু ওকে দেখে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।কেমন ঢুলু ঢুলু অবস্থা ওর সাথে আসা ভাই বোনরা ওকে নিয়ে বসে আছে।সামনেই মদন মুন্সি বসে পান খাচ্ছে আর চিপটি ফেলছে।মনে তার অনেক আনন্দ কাশেম মিয়ার এমন সুন্দর মাইয়্যা তার এমন অকর্মা ছেলের লগে বিয়া দেওনের জন্য।

মেহরাব কে সঙ্গে নিয়ে কলিমউল্লাহ কাশেম মিয়ার বাড়িতে আসে।কাঠের বেড়া বিশিষ্ট টিন সেড ঘর।মেঝে পুরাটাই মাটির।দেখেই বুঝা যায় কাশেম মিয়ার আর্থিক অবস্থাটা কেমন।কলিমউল্লাহ কে দেখে কাশেম মিয়া বেশ খুশি হয়।হাসিমুখ বজায় রেখে দুটো চেয়ার এনে বসতে দেয়।মেহরাব কে বসতে বলে কলিমউল্লাহ নিজেও বসে।

“কাশেম মিয়া তুমি ব্যাস্ত হইয়ো না আমরা বসছি।

কাশেম মিয়া ব্যাস্ত হয়ে ঘরের ভেতরে গেলেন কিছু চা নাস্তার ব্যাবস্থা করতে কেনোনা এখনও বিয়ে বাকি আর খেতে একটু দেরি হবে তাই।

মেহরাবের এখানে এসে মনটা কেমন দুরুদুরু করছে।অজানা এক অস্থিরতা বিরাজ করছে মনে কিন্তু কেনো সেটা ও বুঝতে পারছে না।মনে পরছে আজ তো মায়ার ও বিয়ে।মেয়েটা নিশ্চই এতো ক্ষণে বধু বেশে অপেক্ষায় আছে ওর হবু বরের জন্য।ইশ মেয়েটাকে নিশ্চিত বধু রূপে পরীর মতোই লাগছে।কি সব ভাবছে মেহরাব নাহ
আর বসে থাকতে পারছে না।তাই মামুকে বলে উঠে যায় একটু মুক্ত বাতাসে হাঁটা দরকার।মায়াদের ঘরের সাথে লাগোয়া পথ ধরে হাটতে থাকে মেহরাব।
মায়া ওর রুমের সাথে থাকা জানালা দিয়ে আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।আজ মায়ের কথা ভিষণ মনে পরছে।মা বেচে থাকলে জেনে শুনে এমন অনলের বুকে মেয়েকে নিক্ষেপ করতে পারতো না।মায়ার দু চোখ বেয়ে পানি পরছে।

মেহরাব এদিক ওদিক নজর বুলিয়ে চারপাশটা দেখছে হঠাৎ ওর চোখ যায় মায়ার জানালার দিকে।এক নজর দেখে নজর সরিয়ে ভাবলো কি দেখলো ও আবার তাকিয়ে ভাবলো হ্যালুসিনেশন হচ্ছে ওর সাথে।কিন্তু নাহ চোখ মুছে কয়েকবার নজর বুলিয়ে দেখলো এটা কোনো ভ্রম নয় সত্যি।ওর চোখের সামনে মায়া ? হুম মায়াকেই দেখছে বউ সাজে তারমানে ওরা মায়াদের বাড়িতে এসেছে?
কিন্তু ও তো চায়নি মায়ার বাড়ি আসতে।কি করবে তাই ভাবছে এখন চলে যাওয়াটাই ভালো আর কিছুক্ষণ বাদে মায়ার বিয়ে আর সেটা মেহরাব নিজে থেকে এ সব সহ্য করতে পারবে না তাই এখন চলে যাওয়াটাই মঙ্গলজনক।

সেখান থেকে ঘুরে চলে যেতে লাগলে রাস্তার পাশেই বর বেশে রমজানকে দেখতে পায়।মেহরাব ওকে একটু আগে বরের বসার জায়গায় দেখতে পেয়েছিলো তাই চিনতে সমস্যা হয়নি।কিন্তু এখানে কি করছে?সামনে এগিয়ে দেখতে পায় কি একটা খাচ্ছে।কাছে যেতেই পরিষ্কার বুঝতে পারে এই মা”ল টা বাংলা ম”দ খাচ্ছে আর ঢুলছে।মেহরাবের সারা গা রাগে কাঁপতে লাগে এই নে”শা খোঁড় মা”তাল টার সাথে মায়ার বিয়ে ঠিক করেছে এটা ভেবেই।এক সেকেন্ড দেরি না করে ওর সামনে গিয়ে পরনের পান্জাবীর কলার ধরে টানতে টানতে এনে বাড়ির উঠানে ফেলে দেয়।

উঠানে মুরুব্বিরা সবাই কথা বলছিলো হঠাৎ কিছু পরার আওয়াজে সেখানে উপস্থিত মদন মুন্সি সহ সবাই আৎকে ওঠে।কি হলো এটা?মদন মুন্সি কাছে এসে ছেলেকে ধরে আর মেহরাবের দিকে প্রশ্ন ছুরে দেয়

“আমার ছেলেরে এইভাবে ধরে আইন্যা ফেলাইছো ক্যান?

মেহরাব দাঁতে দাঁত পিশে বলতে থাকে

“কেনো করেছি সেটা আবার কোন মুখে জিজ্ঞেস করছেন?
নে”শা খোঁড় ছেলেকে সাথে করে এনেছেন আবার সে লুকিয়ে নে”শা করছে।আপনার লজ্জা করে না এমন একটা ছেলেকে দিয়ে নিষ্পাপ একটা মেয়ের জীবন জেনে শুনে নষ্ট করতে যাচ্ছেন?

কাশেম মিয়া আর কলিমউল্লাহ সহ অনেকেই এতোক্ষণ ধরে এ সব দেখছে প্রথমে তারা কিছু না বুঝলেও মেহরাবের কথায় পরে বুঝতে পারছে।আয়মন এসে মেহরাব কে বলতে লাগে

“দেখেন আপনি স্যারের লগে আইছেন মেহমান হইয়্যা ওই ভাবেই থাকেন।আমাগো এ সবে আপনার কথা কওয়া লাগবো না।মায়ার বাপ আপনে জামাইরে নিয়া বসাইয়া দেন।

কলিমউল্লাহ আর চুপ থাকতে পারলেন না

“ছি ছি কাশেম মিয়া এ তুমি কার সাথে মেয়েটার বিয়া ঠিক করছো?যে কিনা একটা নে”শা খোর?অন্তত জেনে শুনে মেয়েটার জীবন নষ্ট করতে তোমার বুক কাপলো না কাশেম মিয়া?

কাশেম মিয়া লজ্জায় মাথা নত করে ফেলে।আজ তার বউয়ের লোভের জন্য এসব কথা শোনা লাগছে।সম্মান আর থাকলো না বুঝি।বাইরের এ সব হট্টগোলের আওয়াজে ঘরের ভিতর থাকা সবাই বের হয়ে আসে।মায়া আর পুষ্প ও বের হয়ে বারান্দায় এসে দাড়িয়ে যায়।
কাশেম মিয়া আর চুপ থাকতে পারে না।নিজেকে প্রস্তুত করে বলে ফেলে

“ এই রমজানের লগে আমার মাইয়ার বিয়া দিমু না।এইটাই আমার শেষ কথা।

কাশেম মিয়ার কথা শুনে আয়মন তেরে আসে স্বামীর নিকট।

“আপনে পা”গল হইছেন বিয়া দিবেন না কইলেই হইলো

বউয়ের কথা শুনে কাশেম মিয়া ঠাস করে আয়মনের গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়।

“আর একটা কথাও কইবি না এতোদিন ধরে সহ্য করছি আর না আমার মা মরা মাইয়্যাডারে মেলা কষ্ট দিছোস।শেষে কিনা ওর জিবনডাই নষ্ট করতে তুই একবার ও ভাবোস নাই।

আয়মন সবার সামনে স্বামীর হাতের চড় খেয়ে রাগে গোজরাতে থাকে।পাশ থেকে মদন মুন্সি বলে ওঠে

“বিয়া হইবো না এইডা কইলেই হইলো নাকি মেলা টাকা দিছি কি এমনি এমনি?

মেহরাব এ সব শুনে স্তব্ধ আর বিমূর হয়ে রয়।প্রথমত মায়ার মা নেই দ্বিতীয়ত সৎ মা টাকার বিনিময়ে এমন একটা নে”শা খোরের সাথে ওর বিয়া ঠিক করছে?উফ ইনি কি মা নাকি
ডা”ইনি? মাথায় কিছু ধরছে না নিজেকে এই মুহূর্তে
পা”গল পা”গল লাগছে এ সব কি শুনছে ও।

কাশেম মিয়া বউকে গিয়ে ধরে

“যে টাকা নিছোস সব বাইর কর ফিরায়ে দে সব।

আয়মন আমতা আমতা করে বলে

“সব তো কাছে নাই অর্ধেক টাকা কাছে আছে

বউয়ের এ সব কথা শুনে কাশেম মিয়ার রাগ আরো বাড়তে থাকে

“বাকি টাকা কি করছোস ?

“আমার বাপের বাড়ি পাঠাইছি ভাইয়ের লেইগ্যা।

কাশেম মিয়া কি বলবে ভেবে পায় না বউয়ের থেকে কাছে থাকা টাকা নিয়া মদন মুন্সির মুখে ছুরে মা রে।মদন মুন্সি এই টাকা পেয়ে বলতে থাকে

“আমার সব টাকা একলগে চাই না হলে ছেলের বিয়া দিয়া বউ নিয়া যামু।

মেহরাবের রাগের মাএা বাড়তে থাকে আর সহ্য করতে পারে না।আয়মন কে জিজ্ঞেস করে কতো টাকা নিছে ?আয়মন ছোটো আওয়াজে পুরো টাকার অংকটা বলে।মদন মুন্সির কাছ থেকে টাকার বান্ডিল টা এনে আয়মনের হাতে দেয় আর মেহরাবের ব্যাংকের একটা চেক প্যান্টের পকেটে ছিলো।যেটা ও কার্ডের সাথে সবসময় কাছে রাখে।মদন মুন্সির দেওয়া টাকার দ্বিগুন টাকার অংক চেকে লিখে সাইন করে মদন মুন্সির হাতে ধরিয়ে দেয়।নগদ টাকা কাছে না থাকায় এই মুহূর্তে মেহরাবের নিকট এটা করা ছারা আর উপায় ছিলো না।

“এই নিন আর এক্ষুনি বিদায় হোন।রমজান ও রাগে গজ গজ করতে থাকে কিন্তু কিছু বলে না মাইর খাওয়ার ভয়ে।মদন মুন্সি হুমকি ধামকি দিয়ে কাশেম মিয়ার আর মেহরাবের ওপর রাগ ঝেরে সবাইকে নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে।

মায়া এতোক্ষণ সবই দেখলো।বিয়েটা হবে না ভেবেই আনন্দে নিরবে কান্না করে।মনে মনে উপরওয়ালার নিকট শুকরিয়া আদায় করে।চোখ মুছে সামনের দিকে নজর দেয়,মেহরাব কে প্রথমে চিনতে পারেনি পরে মনে পরে যায়।সেদিন এই মানুষটার সাথেই তো পথে ধাক্কা লাগে।কিন্তু এই অজানা অচেনা মানুষটা ওর জন্য এতো কিছু করলো কেনো?
বোনের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে ওর

“বুবু দেখছো কি সুন্দর দেখতে মানুষটা এক্কেরে নায়কের মতো।আল্লাহ আমি তো এর আগে এতো সুন্দর পুরুষ দেখি নাই।আমার তো তাকে দেখে কোনো রাজার রাজপুএ বলে মনে হইতেছে।

মায়া পুষ্পের কথা শুনে ভালো করে খেয়াল করে হা পুষ্পের কথাই ঠিক।মানুষটা সত্যিই সুন্দর।নিশ্চই অনেক বড়োলোক ঘরের কেউ হবে।
কলিমউল্লাহ নিরবে বিস্ময়ে সবটা দেখলেন।সে জানে মেহরাব কতো বড়ো মনের মানুষ।তাই বলে চেনা নাই জানা নাই এখানেও এতো টাকা দিতে দ্বিতীয়বার ভাবলো না?
কাশেম মিয়া মেহরাবকে উদ্দেশ্য করে বললো

“বাবা তুমি আমাদের জন্য এতো টাকা ক্যান দিলা।বাকি টাকাটা আনিয়ে পরে দিয়ে দিতাম ।

“হুম সেটা করতে পারতেন কিন্তু এই অমানুষের দল কি আপনাদের সে সুযোগটা দিতো?

কাশেম মিয়া মেহরাবের কথা শুনে ভাবে হা এটা তো সত্যি।
আয়মন এবার সুযোগ বুঝে ম”রা কান্না জুড়ে দেয়

“হায় হায় এহোন কি হইবো মেয়েটার এই ভাবে বিয়াটা ভাইঙ্গা গেলো যে।
এসব শুনে উপস্থিত সবাই আয়মনের দিকে দৃষ্টি দেয়।বাড়িতে আসা আশেপাশের মহিলারা কানা ঘুষা করতে লাগলো।কাশেম মিয়া বউকে ধমক দিয়ে থামানোর চেষ্টা করলেও ব্যার্থ হয়।

আয়মনের স্বামীর প্রতি চাপা রাগ টা বাড়তে থাকে।ও চায় মায়ার বিয়ে ভাঙ্গছে এ নিয়ে বদনাম হোক মানুষের কাছে।তাই আবার ও কান্না করে বিলাপ করতে থাকে।

“হায় হায় এইবার কে আমার মাইডারে বিয়া করবো?সবাই তো ওরে অপয়া কইয়া অপবাদ দিবো আল্লাগো এইডা কি হইয়্যা গেলো?

এবার পুষ্প বিরক্ত বয়ে মায়ের কাছে আসতে লাগলে মায়া ওকে বাধা দেয়।এতোক্ষণ ধরে মেহরাব চুপ ছিলো কিন্তু এখন আর থাকতে পারছে না।এমনিতেই এ সব ঘটনা ঘটাতে ওর মাথা এলো মেলো হলেও সেটা প্রকাশ করার সময়ই বা পেলো কোথায়।এই মুহূর্তে ওর কিছু একটা করা দরকার সামনে তাকাতেই মায়ার দিকে নজর যায়।চোখ আটকে যায় মুহূর্তে কেমন মায়া মায়া মুখটা মলিন বিষন্নতায় ছেয়ে আছে।হয়ত মেয়েটা ও এই বিয়েতে রাজি ছিলো না তাই নিরবে কান্না করেছে।মায়ার দিকে চোখ স্থির করে কোনো প্রকার ভনিতা ছাড়াই বলে ফেলে

“আপনারা রাজি থাকলে আমি মায়াকে বিয়ে করতে চাই এক্ষুনি এই মুহূর্তে”

চলবে……

স্বর্ণকেশী মায়াবিনী পর্ব-০৪

0

#স্বর্ণকেশী_মায়াবিনী
#লেখনীতে-বর্ণ(Borno)
#পর্ব-৪

“ভাইজান ও ভাইজান ওঠেন সকাল হইয়া গেছে অনেকক্ষণ আগেই।আপনের না জরুরী কাজ আছে ওঠেন।

এভাবে প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে রাসেল মেহরাব কে ডেকেই যাচ্ছে।কিন্তু মেহরাবের কানে ওর কোনো কথাই যাচ্ছে না।

“যাবে কি করে সে তো রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারেনি।গতোকাল বিকেলের পর থেকেই বাসায় এসে মনে এক অস্থিরতা বিরাজ করতে থাকে মেহরাবের।যেটা সাতাশ বছরের জীবনে এই প্রথম অনুভূত হলো।ও বুঝে যায় এতো বছরে যে প্রেম ভালোবাসা নামক জিনিস টা ওকে ছুতে পারেনি সেটাই ওকে ঘায়েল করেছে।এটার চিকিৎসা একটাই যে জাদুকারিনী তাকে তার মায়ার জালে আটকিয়েছে সেই মায়াবিনীকে যে মেহরাবের প্রয়োজন শুধু তাই না লাগবে তো লাগবেই।
হুম”এটা বলেই মন কে বহু কষ্টে মানিয়েছে।
মায়ার সোনালী চুলের কাঠিটা হাতে নেয় আর ভাবে”এই সেই কাঠি যেটাতে ওর চুলের স্পর্শ,ওর হাতের স্পর্শ লেগে আছে।সেটা অনুভব করে কাঠিটি পরম যত্নে ছুয়ে দেখছে।

ফিরোজের কথাটা ওর মনে পরে যায়।আসার সময় বলেছিলো কিন্তু সেটা ও ইয়ার্কি স্বরুপ নিয়েছিলো।আর গ্রামে সুন্দর মেয়ে থাকতেই পারে তাই বলে এতোটা সুন্দর যেটার বর্ণনা মুখে বললেও কম হবে।কতো সুন্দর মেয়ে ই তো মেহরাব দেখেছে তবে মনে ধরেনি।শেষে কিনা এই অজপাড়া গায়ের একটা মেয়ে এক দেখাতেই ওকে এতোটাই সম্মোহিতো করেছে যে এটা ভেবেই ও অবাক হচ্ছে।অথচ এই মেয়েটা জানে ই না তার জন্য একজনের আরামের ঘুম পর্যন্ত হারাম হচ্ছে।
এভাবে এপাশ ওপাশ করতে করতে ভোররাতের দিকে মেহরাবের চোখে ঘুম আসে।”

মেহরাবের সারাশব্দ না পেয়ে অবশেষে রাসেল দরজায় নক করতে লাগে।দরজার কড়া নাড়ার শব্দে মেহরাবের ঘুম ভাঙ্গে।ঘুম ঘুম চোখে সময় দেখলে বুঝতে পারে অনেক বেলা হয়ে গেছে।রাসেলের আওয়াজ পেয়ে বলে

“উঠেছি তুমি যাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

মোবাইল চেক করে দেখে অনেক গুলো মিসড্ কল জমা হয়ে আছে।তার মধ্যে ফিরোজের আর বিজনেস ক্লাইন্টদের কল ছিলো।তখন মনে পরে আজ ওর অনলাইনে একটা মিটিং হওয়ার কথা যদিও দেরিতে ঘুম ভেঙেছে তারপরও যথেষ্ট সময় আছে হাতে।এই সময়ের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে বসতে হবে।টাওয়াল হাতে নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে যায়।এর মধ্যে রাসেল রুমে এসে রুম টা একটু গুছিয়ে ফেলে।
সকালের নাস্তা কলিমউল্লাহর স্ত্রী নিজ হাতে তৈরি করে রাসেল কে দিয়ে পাঠিয়েছে।টিফিন বক্স থেকে সে গুলো টেবিলে একটা একটা করে বের করে সবটা গুছিয়ে রাখছে।আগের দিন মেহরাব কে জিজ্ঞেস করেছিলো সে কি কি খেতে পছন্দ করে সেই মোতাবেক মামী তার জন্য নাস্তা বানিয়েছে।

ওয়াশ রুম থেকে মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো মেহরাব।টেবিলে কয়েক ধরনের খাবার দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে

“এতো খাবার আর এই সকালের জন্য?

“হুম ভাইজান চাচি তার স্পেশাল হাতে বানাইছে।আর দুপুরের টা পরে পাঠাইবো কইছে।

“এতো খাবার তো এখন শেষ করতে পারবো না রাসেল,তারপর আবার পাঠাবে শুধু শুধু খাবার নষ্ট হবে।

“অতো কিছু আমি জানি না চাচার নির্দেশ আছে।

“আচ্ছা তুমি খেয়েছো?

“না পরে খামুনে।

“একটা প্লেট নিয়ে আসো একসাথে খাই।

রাসেল না করলেও মেহরাবের জোড়াজুড়িতে একসাথেই খেয়ে নেয়।নাস্তা খেয়ে মেহরাব অনলাইন মিটিং সেরে নিয়ে ফিরোজ কে কল করে।

“আসসালামু আলাইকুম বড়োভাই

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম কেমন আছো ফিরোজ?

“ভালো বড়োভাই।

“আন্টির শরির এখন কেমন ?

“এখন একটু ভালো তা কেমন লাগছে ওখানে?

“হুম খুব ভালো ।এটা বলে মেহরাব কিছু একটা ফিরোজ কে বলতে গেলে পরক্ষণে আর বলে না।ভেবে নিয়েছে পরে বলবে।

“আর কয়দিন থাকা লাগবে ভাই?

“এই তো তিন চারদিন আর তুমি একটু কষ্ট করে সবটা সামলাও আর একটু আগে বিদেশী ক্লাইন্টদের সাথে মিটিং টা সেরে নিয়েছি বাকিটা তুমি দেখো।

“আমি থাকতে কোনো চিন্তা নেই বড়োভাই নো চিন্তা ডু ফূর্তি।

ফিরোজের কথা শুনে মেহরাব মুচকি হাসে ও জানে ফিরোজ ওর সবটা দিয়ে সবকিছু দেখে রাখবে।

“বড়োভাই গ্রামের পথে ঘাটে কোনো জ্বী’ন পরীর দেখা পেয়েছেন?

“ফিরোজ তুমি কি এ সবে বিশ্বাস করো?

“অবশ্যই করি আমিও কিন্তু গ্রামের ছেলে আর এ সব তো কতো দেখেছি।

“তুমি সত্যি বলছো ফিরোজ কাল্পনিক জ্বী’ন পরীর দেখা না পেলেও বাস্তবের পরীর দেখা আমি পেয়েছি।

ওর কথা শুনে ফিরোজের কিছু বুঝে আসে না।

“বড়োভাই কি বললেন পরীর দেখা পাইছেন?

কথায় কথায় মেহরাব কি বলে ফেললো তাই ভাবছে তবে ও এখনই কিছু জানাতে চাচ্ছে না তাই বললো

“ফিরোজ তোমার সাথে আমার কথা আছে এখন না পরে সবটা বলবো।
বলে কল কেটে দেয়।মেহরাবের কথার মর্ম ফিরোজ প্রথমে কিছু না বুঝলেও এটা বুঝতে পেরেছে কিছু তো একটা ঘটেছে আর সেটা নিশ্চিত মেয়ে রিলেটেড।যদি তাই হয় তা হলে ফিরোজ তো খুশি হবেই সাথে আরেকজন আছে সে সবচাইতে বেশি খুশি হবে যে কিনা মেহরাবের জীবনের অন্যতম বিশেষ একজন”

——-

এক গাল পান খেয়ে একটু পর পর পানের চিপটি থু দিয়ে ফেলছে মদন মুন্সি।আর হাতে থাকা একটি রুমালের সাহায্যে মুখ মুছে ফেলছে।বর্তমানে সে মায়াদের বাড়ির উঠানে পাতানো একটি চেয়ারে বসে আছে।ঠিক তার সামনে জলচকি পেতে আয়মন বসে আছে।মদন মুন্সি থু ফেলার ফাকে ফাকে মায়ার সৎ মা আয়মনের সাথে কথা বলছে।

“দেখো মায়ার মা তুমি যা চাও দিমু তয় মাইয়াডারে আমার বাড়ির বউ করবার চাই।

আয়মনের মন খুশিতে নেচে ওঠে।এই বিয়ে টা হলে আয়মনের অনেক লাভ হবে।মেয়ে বিয়ে দিতে গেলে কতো খরচ হতো ওর জানা নেই কিন্তু উল্টো খরচ না করে টাকা পাবে।লোভি মনটা আর দেরি করতে চাইছে না।

“আপনে যেমনে চাইবেন তেমনেই হইবো শুধু টাকাটা বিয়ার আগেই দিলেই হইবো।

“হুম খালি টাকা না তোমার এই ঘর ও পাকা কইরা দিমু।তয় কাশেম মিয়া আর তার মাইয়্যা রাজি হইবো তো?

এসব কথা শুনে আয়মনের খুশি আর দেখে কে,খুশিতে বলে দেয়

“এসব সামলানোর জন্য আমি আছি তো।

“হেইডা ঠিক আছে তয় বিয়াডা দু এর দিনের মধ্যেই সারতে হইবো কইলাম।

“আপনে যেমনে কইবেন তেমনেই হইবো।

আয়মনের কথা শুনে মদন মুন্সি বেজায় খুশি হয়।মদন মুন্সি তার সাথে করে আনা ছোটো ব্যাগ থেকে একটা টাকার বান্ডিল বের করে আয়মনের হাতে দেয়।আয়মন তো এতো টাকা একসাথে পেয়ে আনন্দে আত্নহারা হয়ে গেছে।

“হুনো মায়ার মা আইজ এই অর্ধেক টাকাটা রাখো।কাইল বাকিটা পাইয়্যা যাইবা।কোনো চিন্তা কইরো না।এহোন আমি যাই মেলা কাম গুছাইতে হইবো বিয়া বইলা কথা।

বলতে বলতে উঠে পরে,পায়ে সমস্যা থাকায় খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটে মদন মুন্সি।সেভাবেই হেটে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।

ঠিক তখনই জমির কাজ শেষ করে কাশেম মিয়া বাড়ির পথ দিয়ে ডুকতে যাবে ঠিক সে সময় বাড়ি ঢোকার রাস্তায় মদন মুন্সির সাথে তার দেখা হয়।থু দিয়ে পানের চিপটি ফেলে একটা হাসি দিয়ে মদন মুন্সি কাশেম মিয়াকে বলে

“কেমন আছো কাশেম মিয়া শরির ভালা আছে নি?

কাশেম মিয়া মদন মুন্সিকে একদমই পছন্দ করে না।সে হারে হারে চিনে তাকে।কিন্তু আজ মদন মুন্সি তার বাড়ি থেকে বের হইছে এটা দেখে তার কিছু একটা সন্দেহ হয়।কারন ছারা তো মদন মুন্সি কারো বাড়ি যাবার লোক না।
মদন মুন্সির কথার জবাব না দিয়ে পাশ কেটে বাড়ির ভেতর ডুকে যায় কাশেম মিয়া।মদন মুন্সি তার যাওয়ার পানে চেয়ে একটা বিদখুটে হাসি দেয় আর মনে মনে বলে

“যতই অপছন্দ করো আমারে দুদিন পর ঠিক সুর সুর করে আমার পিছেই ঘোরা লাগবে কাশেম মিয়া।এই বলে সে আবার খোড়াতে খোড়াতে হাঁটা দেয়।

কাশেম মিয়া বাড়ির ভেতরে ডুকে সাথে থাকা সরন্জাম ঘরের পাশে রেখে আয়মনের দিকে এগিয়ে যায়।আয়মন খুশি মনে টাকা গুনতেছিলো এ সব দেখে বিস্ময়ে কাশেম মিয়া জিজ্ঞেস করলো

“এতো টাকা কই পাইলা?

আয়মন স্বামীর কথা শুনে থতোমতো খেয়ে বলতে লাগলো

“আরে এসব তো উপহারের টাকা।আমার তো কপাল খুইল্যা গেছে।

কাশেম মিয়ার সন্দেহ ঠিক ছিলো মেজাজ বিগরে যায় তার।বউকে বসা থেকে টান দিয়ে উঠিয়ে বলতে থাকে

“কোন সবর্নাসে পা দিছোস ক দেখি আর মদন মুন্সি আমার বাড়িতে ক্যান আইছিলো?

“আরে মায়ার বাপ রাগ হইয়ো না মাইয়্যা বড়ো হইছে বিয়া দিতে হইবো না হেরলেইগ্যা মদন মুন্সির পোলা রমজানের লগে মায়ার বিয়া ঠিক করছি।আর দেহেন মদন মুন্সি মেলা টাকা দিছে আরো দিবো কইছে।খালি টাকা না ঘর ও নতুন কইরা বানাইয়া দিবো কইছে।

কথাটা শুনে কাশেম মিয়ার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পরে।বিস্ময়ের স্বরে বলে ওঠে

“কি কইলি আমারে না জিগাইয়া আমার মাইয়ার বিয়া তুই ওই ল”ম্পট রমজানের লগে ঠিক করছোস?

“আরে এমনে কও ক্যা হেয় এহোন আমাগো হবু জামাই।

কথাটা শুনেই কাশেম মিয়ার শরিরে যেনো আ গুন জ্ব”লে উঠে।

“কি সর্বনাশের কথা শুনাইলি আমি বাইচ্যা থাকতে আমার মাইয়ার বিয়া ওর লগে হইতে দিমু না।এই তুই জানিস না এর আগেও ওয় যে দুই তিনটা বিয়া করছে।

স্বামীর কথা শুনে আয়মনের রাগ লাগে কই স্বামী অতো টাকা দেখে খুশি হবে তা না উল্টো রাগ দেখাচ্ছে।এতো বোকা মানুষ কেমনে হয়।

“আরে তাতে কি হইছে বউ তো একটা ও নাই হের লেইগ্যা তো মায়ারে দিতে চাই।আর ওরা তো মায়ারে নেওয়ার জন্য পা’গোল হইয়া গেছে।

কাশেম মিয়া আয়মনের এমন কথায় স্তব্দ হয়ে যায়।এসব কি বলছে তার বউ।আত্মসম্মান বোধ তো নেই টাকার লোভে একেবারে অ’মানুষ হয়ে গেছে।রাগে তেরে আসে বউয়ের কাছে

“তোর এতো বড়ো সাহোস আমার মাইয়ারে বিয়া দেওনের নাম কইরা বেইচ্যা দিতে চাস?

“আরে কি কন ভুল বুঝতেছেন আর শুনেন যদি এই বিয়াতে আপনি বাধা দেন তা হইলে কিন্তু আমি খারাপ কিছু কইরা ছারমু কইয়া দিলাম।

বউয়ের সাথে আর পারবে না ভেবে রাগে সামনে থাকা জলচকিটা লাথি মে’রে ঘরে চলে যায়।আয়মন সে সবে ভ্রুক্ষেপ না করে আবার টাকা গুনতে লাগে।

কাশেম মিয়া আর আয়মনের সব কথা বার্তা আড়াল থেকে পুষ্প শুনে ফেলে।স্কুল থেকে আসছে বাড়ি ডুকতে যাবে তখনই এ সব কথা বার্তা ওর কানে গেলে সামনে আর এগোয় না।সবটা শোনার পর বাড়িতে ডোকে মাকে পাশ কাটিয়ে ঘরের মধ্যে ডুকে যায়।এ সব কি শুনলো ও মাথাটা রাগে দপ করে উঠলো।মনে মনে ভাবতে থাকে এমন মায়ের পেটে জন্মাইছিলাম ছি!বোনের জন্য চিন্তা হচ্ছে ওর এ সব শুনলে বুবু সহ্য করতে পারবে তো?ছোটো থেকে এ পর্যন্ত অনেক অন্যায় অ ত্যাচার সহ্য করে মুখ বুঝে আছে আবার এখন এই খারাপ লোকের সাথে নিজের বোনের বিয়ে ঠিক করেছে এটা পুষ্প কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছে না।

মায়া কলেজ থেকে বাড়ি আসার পর থেকে কাশেম মিয়া হাসফাস করছে কেমনে মেয়েকে এ সব কথা বলবে।আবার এ সব কথা শুনলে মেয়ের অনুভূতিটা কেমন হবে সে সব ভাবছে।বাবা হয়ে কিছুই করতে পারছে না বউ তাকে চিপায় ফেলে দিলো হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছে।তবে কাশেম মিয়ার আর কিছু বলতে হয়নি আয়মন নিজেই রাতের বেলায় মায়াকে সবটা বলে।এসব কথা শুনে মায়া কোনো টু শব্দটি করেনি।পাশ থেকে পুষ্প বোনকে নিয়ে চিন্তায় শেষ ও জানে বোন মুখে কিছু না বললেও তার মনের অবস্থাটা এখন কেমন।
আয়মন চলে যেতেই মায়া যেনো একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়।কি সব শুনলো যেই মানুষ টাকে ও মন থেকে ঘৃণা করে তাকেই বিয়ে করতে হবে?এই জীবন টাকে জলান্জলি দিতে হবে আজীবনের জন্য ঐ খারাপ মানুষটার কাছে?

পুষ্প বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে আর বলে

“বুবু তুমি এইখান থেইক্যা পালিয়ে যাও না হইলে তোমার জীবন টা শ্যাষ হইয়া যাইবো।

বোনের কথা শুনে মায়া স্বাভাবিক স্বরেই বলে

“না বোন তোদের সবাইরে ছাইরা পালাবো ক্যান?আমার মা সে আমার ভালোর জন্যই এতো কিছু করতাছে।যদি উপর ওয়ালা সহায় হয় কোনো খারাপ কিছু আমার হইবো না”

“মুখে বোনকে এটা বললেও মনে মনে ওর মনটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।গরিব হলেও মনে তো কতো স্বপ্ন ছিলো পুষ্প বলতো ওর জন্য কোনো রাজপুএ আসবে।যে কিনা ওকে ভালোবেসে আপন করে তার রাজ্যে নিয়ে যাবে।ও সব স্বপ্ন বাস্তবে কি এমন কেউ আছে যে কিনা ওকে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করে সুন্দর একটা জীবন উপহার দিতে ?

চলবে…..

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন)

স্বর্ণকেশী মায়াবিনী পর্ব-০৩

0

#স্বর্ণকেশী_মায়াবিনী
#লেখনীতে-বর্ণ(Borno)
#পর্ব-৩

সময়টা সূর্যদয়ের আগ মুহূর্ত-

স্নিগ্ধ ভোরের মুক্ত হাওয়ায় পাকা রাস্তা ছেরে মাটির রাস্তায় কেউ দৌড়াচ্ছে।তার পিছু আরেক জন চলছে কিন্তু সামনের ব্যাক্তিটির সাথে পেরে উঠতে না পেরে রাস্তার ঘাসের ওপরই বসে পরে।হাঁক ছেরে ডাকে “মেহরাব ভাইজান আমি আর পারছি না আপনেই যান।মেহরাব তার কথায় কর্ণপাত না করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।এতো সুন্দর সকাল ও শহরে দেখতে পায় না যেটা এখানে এখন উপভোগ করছে।
মেহরাবের ভিষণ ভালো লাগে।এমনিতেও সকালে হাঁটার অভ্যাস আছে ওর।আর আজ হাটা কম দৌড়াচ্ছে বেশি।

মেহরাব সকাল সকাল বেরোবে বলে ট্রাউজার পরে রেডি হয়ে নিলো।ফজরের নামাজ শেষ করে কলিমউল্লাহ মামুও তখন এ বাড়িতে চলে আসে।তার সম্পর্কে চাচাতো ভাইয়ের ছেলে রাসেল কে ডাকে।রাসেল এর পরিবার দরিদ্র হওয়ায় কলিমউল্লাহ ছোটো থেকেই রাসেল কে তার বাড়িতে রেখে বড়ো করেছেন।যখন যেটা বলবে তখনই সেটা করে।কিন্তু ছেলেটাকে লেখা পড়া করাতে পারেনি এ বিষয়ে রাসেলের একদমই মন নেই।
রাসেল চাচার কথা মতো সামনে আসতেই তার নির্দেশ মতো মেহরাবের সঙ্গে বের হয়।মেহরাব নিষেধ করা স্বত্বেও কলিমউল্লাহ শোনেনি ,তার কথা হলে মেহরাব এখানের তেমন কিছুই চিনে না।রাসেল ছেলেটা সাথে থাকলে ভালো হবে।এর পরে মেহরাব আর কিছু বলে না।দুজনে একসাথে বের হয়ে যায়।

অনেকটা পথ সামনে চলে আসলে মেহরাব দৌড় থামিয়ে পিছন ফেরে।দম ফেলে ভালো করে পরখ করে রাসেল ওর চক্ষু সীমানার মধ্যে নেই।বুঝতে পেরেছে ছেলেটা হাফসিয়ে গিয়ে হয়তো কোথাও বসে আছে।গ্রামের ছেলেপেলে হলেও এভাবে সকাল সকাল যৌগিন করার অভ্যাস নেই তাই হয়তো কষ্ট হয়ে গেছে।মনে মনে ভাবলো থাক আর সামনে যাবে না।এমনিতেই অনেকটা পথ সামনে চলে আসছে এবার ফেরা যাক।আবার আগের পথ ধরে দৌড়াতে লাগলো,সামনে এসে দেখে রাসেল ঘাসের ওপরই শুয়ে আছে।রাসেল ওর উপস্থিতি টের পেয়ে উঠে বসে “ভাইজান আরো দৌড়াবেন নাকি বাড়িতে যাইবেন? মেহরাব ওর কথা শুনে বললো “আর নাহ চলো এবার ফেরা যাক”

সকালের নাস্তা সেরে কলিমউল্লাহর সঙ্গে বের হলো মেহরাব।উদ্দেশ্য আজ জমি গুলো দেখতে যাবে।বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ শেষ করেই জমির সীমানায় পৌছে যায়।রাস্তার সাথে লাগোয়া জমি গুলো পজিশন মতো।মেহরাব ভেবে ফেলে এখানে বাড়ি করলে বেশ সুন্দর হবে।কলিমউল্লাহ কে উদ্দেশ্য করে বলে
“মামু এই মাসেই বাড়ি গুলোর কাজে হাত দিতে চাই আপনি কি বলেন?
মেহরাবের কথা শুনে কলিমউল্লাহ অমত করে না বরং খুশি মনে বলে
“তুমি যেটা ভালো মনে করো সে মতেই হবে”

মেহরাব আবার বলে “তবে হা আমি চাই এই পুরো কাজের দায়িত্ব ও আপনিই নিবেন।আমি তো সব সময় আসতে পারবো না সবটা আপনিই দেখা শুনা করবেন যেমনটি আগেও করেছেন।

কলিমউল্লাহ আর না করতে পারে না মেহরাব কে কথা দেয় তা ছাড়া এমন একটা মহৎ কাজে নিজেকে নিয়োজিতো করতে পারলে তার কাছেও ভালো লাগবে।
এরপর কলিমউল্লাহ ফুলপুরের স্থানিয় বাজারে ওকে নিয়ে যায় সেখানটা ঘুরিয়ে দেখায়।ওখানের চেয়ারম্যান মেম্বার আরো নাম ডাক ওয়ালা লোকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় মেহরাব এর সাথে।সবাই বেশ আন্তরিকতার সাথে মেহরাবের সাথে কথা বলে।সব কিছু মেহরাবের বেশ ভালো লাগে।মেহরাবের মহৎ কাজের উদ্যোগের কথা শুনে তারাও খুশি হয়।
আরো ভালো লাগতো যদি এই সময়টাতে পরিবারের প্রিয় মানুষগুলো কাছে থাকতো।মনের মধ্যে চাপা একটা আর্তনাদ বয়ে যায় “প্রিয় মানুষ বলতে এখানের ঐ এক মামাই আছে সেও দূরে।যাদের উছিলায় আজ এখানে আসা সেই নানা নানি বাবা মা কেউ নেই সবাই পরপারে চলে গেছে।

কলিমউল্লাহর ডাকে মেহরাব নিজেকে স্বাভাবিক করে।
“চলো এবার যাওয়া যাক।
“হুম চলেন মামু

দুপুরে কলিমউল্লাহর বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হলো।আগে থেকেই মেহরাব কে বলা ছিলো তাই গোসল সেরে বেশ পরিপাটি হয়ে অপেক্ষা করছে কখন যাবে।ঠিক তখনই রাসেল এসে ডাকতে লাগলো “ভাইজান ও ভাইজান কই আপনি?
রাসেলের ডাক শুনে মেহরাব বের হয়ে আসে।ওকে দেখে রাসেল বলতে লাগে” ভাইজান আপনেরে তো পুরাই হিন্দি ছবির নায়ক এর মতো লাগে।
ওর কথা শুনে মেহরাব মুচকি হাসি দেয় ছেলেটা আসলেই সরল মনের মনে যা আসে বলে দেয়।
“কি হিন্দি ফিল্ম দেখো বুঝি?

মাথা চুলকে রাসেল বলতে থাকে “ঐ একটু আধটু দেখি আমার তো বাটন মোবাইল তাই পাশের বাড়ির এক ভাইয়ের টাচ মোবাইলে দেখি।অনেক ভালো লাগে ছবি গুলান।
“ওহ তাই বুঝি?
“হুম
“রাসেল তুমিও কিন্তু দেখতে সুন্দর যখন আরো বড়ো হবে তখন হিরোদের মতোই লাগবে তোমাকে দেখতে।

কথা গুলো শুনে রাসেল তো মহা খুশি লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বললো “সত্যি ভাইজান কিন্তু এতো সুন্দর হওয়াতেও পাশের বাড়ির বিলকিস কেনো আমারে পাওা দেয় না হেইডাই বুঝলাম না।

ওর বলা কথা গুলো শুনে মেহরাব বললো “কি বললে ?
বোকা হাসি দিয়ে মাথা চুলকে রাসেল বললো না ভাইজান তেমন কিছু না বাদ দেন এহোন চলেন চাচা আমাগো লাইগ্যা অপেক্ষা করতেছে।

হুম চলো বলে চোখে সানগ্লাস টা পরে মেহরাব রাসেল কে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা দেয়।পাঁচ থেকে ছয় মিনিট হাঁটার পরেই কলিমউল্লাহর স্যারের বাড়ি পৌছে যায়।একতলা ছাদ বিশিষ্ট পাকা ঘর বেশ সুন্দর করে সাজানো গোছানো বাড়িটি।মেহরাব যেতেই ওকে নিয়ে উঠানে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলেন কলিমউল্লাহ।তার দুই ছেলে দুই মেয়ে সবাই শহরে থাকে।বাড়িতে সবসময়ের জন্য সে আর তার সহধর্মিনী থাকে।তবে আজ এক ছেলে বাড়িতেই আছেন।তার সাথে মেহরাবের পরিচয় হয় সে ব্যাংকে জব করে বেশ নম্রভদ্র একজন।সবাই দুপুরের খাবার একসঙ্গে খেয়ে আরো কিছুক্ষণ খোশ গল্প করে নেয়।মেহরাব একটু বের হতে চাইলে কলিমউল্লাহ রাসেলকে ডাক দেয়।ও আসলে মেহরাবের সঙ্গে ওকে যেতে বলে।মেহরাব ওকে সঙ্গে নিয়ে বের হয় গ্রামটি ঘুরে দেখার জন্য।

———-

কয়েকদিন ধরে মায়ার বান্ধবী আয়েশা কলেজ যাচ্ছে না।মায়া এ বিষয়ে একটু চিন্তিত আছে আর থাকারই কথা একমাএ আয়েশা ই ওর বেস্টু তাই আজ ও মনে মনে স্থির করেছে ওর বাড়ি যাবে।মেয়েটার খারাপ কিছু ও তো হতে পারে।
দুপুরে খেয়ে দেয়ে মায়া আয়েশার বাড়ি চলে যায় সেখানে গিয়ে জানতে পারে সত্যিই মেয়েটার খারাপ কিছুই হয়েছে।আজ পাঁচ দিন ধরে ওর জ্বর।মায়াকে দেখে আয়েশা অনেক খুশি হয় শোয়া থেকে উঠে বসে।মায়ার বেশ খারাপ লাগে ওর এমন অবস্থা দেখে।মায়া প্রায় বিকেল পর্যন্ত আয়েশার কাছে থাকে।এবার বাড়ি যাওয়া দরকার তাই আয়েশার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওদের বাড়ি থেকে বের হয়।
কিছু দূর আসতেই সামনে কেউ দু হাত মেলে পথ আগলে দাঁড়ায়।হঠাৎ এমনটা হওয়াতে মায়ার বুকটা ধক করে ওঠে।সামনে দিকে নজর দিতেই দেখে ওদের এলাকার মদন মুন্সির ছেলে রমজান।ওরা জাতে মুন্সি হলেও কাজে কর্মে একেবারেই দুষ্টু প্রকৃতির।মদন মুন্সির অনেক গুলো বিয়ে আর এইটা তার বড়ো ঘরের ছেলে।যেমন বাপ তেমন তার ছেলে বলতে গেলে পুরাই চরিএহীন ল”ম্পট প্রকৃতির।দিন আর রাত নেই মেয়ে দেখলেই ওদের জি”বে জল আসে।

একটা শ”য়”তানি হাসি দিয়ে মায়ার উদ্দেশ্যে বলতে লাগে”কি গো সুন্দরী এই ভর বিকেলে একা একা কোন জায়গা থেইক্যা আইলা?
কথা গুলো শুনে মায়ার শরির ঘৃণায় রি রি করে উঠলো।গায়ের ওরনাটা টেনে ভালো করে মাথা আর চারপাশ পেচাতে লাগলো।
“কি হলো কথার উওর দিবা না?
মায়া এবার ও কিছু বলে না শুধু ও যাওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজছে কিন্তু রমজান সেই সুযোগ দিচ্ছে না মনে হচ্ছে মায়াকে এমন ভিতু হওয়া দেখে ও খুব মজা পাচ্ছে।

এবার না পেরে মায়া বলতে লাগে

“পথ ছাড়েন আমারে যাইতে দেন।

আবারও কুৎসিত হাসি দিয়ে রমজান বলতে লাগে

“যাও তোমারে কি আমি আটকাইয়া রাখছি ?বলেই জোড়ে হাসতে লাগে।
আর সহ্য হয় না মায়ার একটু পাশ কেটেই কোনো প্রকার দৌড় দেয় তবে রমজান ওর পিছু নেয় না।ওর উদ্দেশ্য ছিলো এভাবে ভয় দেখানোর।

প্রায় আধ ঘন্টা হাঁটার পর ওরা আরেক টি এলাকায় চলে আসে।তখন রাসেলের পরিচিতো এক ভাইর সাথে দেখা হলে রাসেল তাকে ডাক দিয়ে কথা বলতে লাগে।মেহরাবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে মেহরাব ওদের বলে

“তোমরা কথা বলো আমি সামনে যাই।
রাসেল মেহরাব কে দশ মিনিট এর কথা বললে মেহরাব সায় দিয়ে সামনের দিকে আগাতে থাকে।
কিছুদূর আসতেই হঠাৎ মেহরাব দেখতে পায় একটি মেয়ে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে আর সামনের দিকে দৌড়ে আসছে।মেয়েটিকে কিছু বলার আগেই ওর সাথে ধাক্কা লাগে এর ফলে মেয়েটি পরে যেতে লাগলে মেহরাব ওর ডান হাত দিয়ে তার পিঠ জড়িয়ে রাখে।হঠাৎ ধাক্কা আবার কেউ তাকে পরে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচালো এসব দ্রুতই ঘটে যাওয়ায় ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।কি থেকে কি ঘটে গেলো?থরথর করে শরির কাঁপছে যেনো।

এদিকে মেহরাব মেয়েটিকে একনজর দেখেই ওর মনের মধ্যে ঝড় তুফান শুরু হয়ে গেছে।মনে মনে বলে ফেলেছে মা শাহ আল্লাহ এতো সুন্দর পরী এই গ্রামেও থাকে?মুহূর্তে যেনো ওর হৃদস্পন্দন থেমে গেছে মনে হচ্ছে ওর অক্সিজেনের অভাব দেখা দিয়েছে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর।মনে হচ্ছে কোন মায়া জালে ফেসে গেছে ও।কি একটা মনে করে সামনের পরীটির দিকে একটু গাড়ো নজরে ঝুকে বাম হাতের সাহায্যে মেয়েটির চুলের খোপার কাঠিটি এক টানে খুলে ফেললো।আর তখনই তার খোপায় পেচানো চুল গুলো ছুট পেয়ে হাটু অব্দি গিয়ে পরেছে।হালকা সোনালী রংয়ের দীর্ঘ চুল দেখে মেহরাবের সত্যিই এবার হার্ট এটাক হওয়ার উপক্রম।একটু শব্দ করেই বলে ফেলে “স্বর্ণকেশী মায়াবীনি এ কোন মায়ার বেড়াজালে আবদ্ধ করে ফেললে আমায়”

পুরো কথাটা মেয়েটার কানে না গেলেও মায়া কথাটা শুনতেই মেহরাবের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওড়না টেনে ঠিক করে বলতে লাগলো

“আমার নাম জানলেন কি করে?
মেহরাব এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলতে লাগলো

“ওহ তোমার নাম মায়া বুঝি?

এবার মায়া মুখে না বলে মাথা নাড়িয়ে বুঝায়।মেহরাব স্পষ্ট বুঝতে পারছে এই মেয়ের নাম মায়াই।সত্যি নামের মতো মেয়েটা কে এক দেখায় যে কারোর মায়ায় পরে যাবার মতো।তবে যে কারোর নয় ওর মনে ধরেছে মানে ওরই একান্ত চাওয়া পাওয়া হবে এই মেয়ে আর কারোর নয়।এ সব ভাবনার মধ্যে মেহরাবের মনে পরে যায় মায়া দৌড়ে আসছিলো কিন্তু কেনো?

আর কিছু না ভেবে বলেই ফেললো আচ্ছা তখন দেখলাম তোমাকে দৌড়ে আসতে কি হয়েছে বলো তো?মায়া এ কথা শুনেই চমকে যায় ।কিছুক্ষনের জন্য ও তো ভুলেই গিয়েছিলো রমযানের কথা।তবে ও চায় না অপরিচিতো কারোর সাথে এসব কথা শেয়ার করতে তাই বলে

“না এমনি কুকুর দেখে দৌড় দিয়েছিলাম ।

কিন্তু কথাটা মেহরাবের কেমন জানি বিশ্বাস করতে মন চায় নি।তাই আবার বলে

“গ্রামের মেয়েরা কুকুর দেখেও ভয় পায় জানতাম না তো?

মায়া কিভাবে ওকে বলবে এই রমজান একটা কুকুরের চেয়েও খারাপ।তবুও আবার বলে

“আসলে ওইটা পাগলা কুকুর তাই।

“ওহ তাই বুঝি?

মায়া এবার আর কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলে মেহরাবের ডাকে থেমে যায়।কিন্তু মায়া পেছন ফিরে চায় না মেহরাব ওখানেই স্থির হয়ে মনে মনে বলে “মেয়ে তুমি জানো না প্রথম দর্শনেই একজনের মন নিয়ে নিছো”

“কিছু বলবেন?
মেহরাব কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না তাই বললো
“কিছুনা তুমি যেতে পারো আর হা কুকুর থেকে সাবধানে থেকো।

মায়া এবার হাফ ছেরে বাচে ভেবেছিলো ধাক্কা লাগার ফলে হয়তো বেশি কথা শুনতে হবে কিন্তু না লোকটি সে রকম কিছু বললো না।মায়ার মেহরাব কে ভালো মানুষ বলেই মনে হয়েছে।আর বেশি কিছু না ভেবে বাড়ির পথে হাঁটা দেয় মায়া।

মেহরাব মায়াকে দেখতে থাকে চোখের আড়াল হওয়া পর্যন্ত।হঠাৎ বাম হাতে মায়ার চুলের কাঠিটি দেখতে পায়।”ইশ এটা তো দিতে মনে নেই তবে মনে মনে বেশ খুশি হয়।একটা তার প্রথম চিহ্ন এ সব ভাবনার মাঝেই রাসেলের ডাক শুনতে পায়।মেহরাব ওর প্যান্টের পকেটে কাঠিটি রেখে দেয়।রাসেল ওর সামনে আসতেই মেহরাব বলে
“আজ আর না চলো ফিরে যাই রাসেল ও সায় দিলে দুজন মিলে বাড়িতে চলে আসে।”

——
রাতে পড়তে বসে মায়া ঠিক ঠাক পড়ায় মনোযোগ দিতে পারে না।শুধু ঐ তিক্ত সময়টাকে কথা মনে পরছে।রমজান ওকে প্রায়ই পথ আটকে দাঁড়ায় আর লোলুপ দৃষ্টিতে নজর দেয়।মায়া এ সব কথা কাউকে বলতে পারে না।কিন্তু আজ আর পারছে মারে না হয় এ সব বলে লাভ নেই কিন্তু বাবাকে বলতে হবে আবার চিন্তা করে বাবার শরির ভালো নেই বলবে না।এ সব ভাবনার মাঝে পুষ্প এসে মায়ার সামনে বসে।বোনকে কেমন চিন্তা যুক্ত দেখে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে ?প্রথমে মায়া কিছু নি বলতে চাইলে পুষ্পের জোড়াজুড়িতে সব বলে দেয়।শুনে পুষ্প রাগে গজগজ করতে থাকে।আর বলে

“ধা’মরা খাটাশ একটা বাপের মতো দুই তিন টা বিয়া কইরাও মাইয়্যা মানুষ দেখলে হুঁশ থাকে না।ওরে পাইলে একটা না দুইডা চর দিতাম আমি।
বোনের কথা শুনে মায়া আৎকে ওঠে এসব করলে যে হিতে বিপরীত সেটা ও জানে কিন্তু মায়া ভিতু হলেও পুষ্প ঠিক এটাই করে ছাড়তো।
“বুবু একটু সাহোস আনো মনে আর কতোদিন এমনডা থাকবা প্রতিবাদ করা লাগবো।
কিন্তু এ সব কথা মায়া কানে নেয় না ওর যে সত্যিই ভয় লাগে।
ভয় পায় এসব মানুষ রূপি জা”নো”য়ারদের।

চলবে…..

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

স্বর্ণকেশী মায়াবিনী পর্ব-০২

0

#স্বর্ণকেশী_মায়াবিনী
#লেখনীতে-বর্ণ(Borno)
#পর্ব-২

“স্যার গাড়িতে আপনার প্রয়োজনীয় সব কিছু রাখা হয়েছে এবার আপনি উঠে বসেন।”

ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসে মেহরাব।কান থেকে মোবাইল সরিয়ে কল কেটে গাড়ির সামনে এসে দাড়ায়।এক নজর মেহরাব কে দেখে সামনের ব্যাক্তিটি বুঝতে পারলো মেহরাবের চেহারায় বিরক্তির ছাপ।মেহরাব একটু দম ছেড়ে বলতে লাগলো
“ফিরোজ এটা অফিস টাইম নয় আর সবসময় স্যার শুনতে ভালো লাগে না।সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো তারপরও কেনো বলো বলোতো?

“সরি বড়ো ভাই আর ভুল হবেনা।মেহরাব আবার বলে
“বুঝতে পারছি ভাইকে আপন করে নিতে পারলে না তাইতো?
এবার ফিরোজ অসহায় দৃষ্টিতে মেহরাবের পানে চায়।কিন্তু মেহরাব সেটা ভ্রুক্ষেপ না করে গাড়ির দরজা খুলে ডুকতে চাইলে ফিরোজ বাধা দেয়।মেহরাবের একটি হাত ফিরোজ ওর দু হাতের মুঠোয় নেয়।খুব নমনীয় কন্ঠে বলতে লাগলো
“বড়ো ভাই আপনি রাগ হবেন না সেদিন যদি আপনি আমার পাশে না থাকতেন তা হলে হয়তো এই দিনটি আমার আর দেখা লাগতো না।এতো সুন্দর একটা জীবন নিয়ে আজ আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না।আজকাল মায়ের পেটের ভাই ও নিজের ভাইয়ের জন্য এতো কিছু করে না যেটা আপনি করেছেন।
মেহরাব লক্ষ্য করলো কথা গুলো বলে ফিরোজের দু চোখ ছলছল করছে।পরিস্থিতি সামাল দিবার জন্য তখনই মেহরাব বলে

“আরে করছো কি আমি কি একটু মজা ও নিতে পারবো না।আচ্ছা এ সব বাদ দাও,কতো করে বললাম চলো আমার সাথে কিন্তু রাজি হলে না।একসাথে গেলে কিন্তু সুন্দর একটা বাস ভ্রমন হতো।আর সময়টাও বেশ কাটতো কিন্তু এখন একা একাই যেতে হচ্ছে।

মেহরাবের কথার প্রক্ষিতে ফিরোজ বললো
“বড়ো ভাই আপনি তো জানেন মায়ের শরির ভালো নেই তাছাড়া এই বাসা আবার অফিস এ সব তো দেখতে হবে।তাই আপনি একাই যান।অন্য আরেক সময় না হয় একসাথে ভ্রমন করা যাবে।
ফিরোজের কথায় মেহরাব মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়।ও জানে ফিরোজ কে যতোই বলুক ও কিছুতেই ওর কাজ আর দায়িত্ব রেখে যাবে না।
“ঠিক আছে সাবধানে থেকো”
“ওকে বড়ো ভাই আর একটা কথা
“হুম বলো
“বড়ো ভাই গ্রামে যাচ্ছেন আর ওখানের মেয়েরা কিন্তু সুন্দর হয় তাই পছন্দ হলে সোজা ভাবি বানিয়ে নিয়ে আসবেন।আর কোনো প্রয়োজন হলে কল মি সাথে সাথে বান্দা হাজির হবে।

ওর কথা শুনে মেহরাব একটু শব্দ করে হেসে দেয় আর বলে

“ফিরোজ আজকাল বাংলা সিনেমা একটু বেশিই দেখো মনে হচ্ছে?শোনো ও সব সিনেমাতেই হয় বাস্তবে নয় যাই হোক থাকো আর আন্টির দিকে খেয়াল রেখো যাচ্ছি বলেই গাড়িতে ওঠে বসে।ড্রাইভার কে নির্দেশ দিতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো।গাড়ি চলছে বাসস্টান্ড এর উদ্দেশ্যে।
মেহরাব সব সময়ই কাছের কিংবা দূরের পথ হোক নিজের গাড়ি নিয়েই যাতায়াত করে।কিন্তু আজ ফুলপুরে নিজের গাড়িতে করে নয় বাসে যাবে।খুব ইচ্ছে হয়েছে ওর ,গ্রামে সেই ছোটো বেলায় গিয়েছে আর এই পরিপূর্ণ বয়সে এসে এই প্রথম ও নানু বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে।

জন্ম,বেড়ে ওঠা আর দাদু বাড়ি সবমিলিয়ে ওর সবটাই এই শহরে।কিন্তু ওর মায়ের বাবা বাড়ি ফুলপুর গ্রামে।একদম ছোটো বেলায় গিয়েছিলো আর যাওয়া হয়নি।এক দূর্ঘটনায় বাবা মা পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয়।হয়তো তারা বেচে থাকলে সবসময় যাওয়া আসা হতো।নানু বাড়িতে বলতে গেলে কেউ নেই।একমাএ মামা সেও বিদেশ থাকে তার সাথে ফোনেই আলাপ হয় ওর।

গাড়ি এসে বাসস্টান্ড থামে আগের দিনে করা টিকিট অনুযায়ী নির্দিষ্ট বাসে ওঠে পরে মেহরাব।ড্রাইভার ওর লাগেজ ও ব্যাগ উঠিয়ে দিয়ে চলে যায়।বাসের বাম পাশের দ্বিতীয় সারিতে ওর দুটো সিট বুক করা।কাধের ছোটো ব্যাগটি পাশের সিটে রেখে জানালার পাশে বসে পরে।গাড়ি ছারতে আর মাএ দশ মিনিট।সঙ্গে করে আনা ব্যাগ থেকে খবরের কাগজ বের করে এক মনে পড়তে লাগলো।কিছু ক্ষণ পরে কারোর ডাকে সামনে থেকে খবরের কাগজটি সরিয়ে ব্রু কুচকে জানতে চাইলো কি হয়েছে?সে জানায় ওদের বাসের সব টিকিট বুক হয়ে গেছে কিন্তু একজন বয়স্ক লোক টিকিট পাচ্ছে না।আর তার এই মুহূর্তে যাওয়াটা খুবই দরকার।পরের গাড়ি যেতে বিকেল হবে।এ সব শুনে মেহরাব বললো”তো আমি কি করতে পারি?আর আপনি কে?

লোকটি জানায় সে এই বাসের কন্টাকটার আর ওর দুটো সিটের একটি যদি ঐ বয়স্ক লোককে দেয় তো তার জন্য খুবই উপকার হবে।যেহেতু মেহরাব একাই দুটো টিকিট নিয়েছে আর এমনিতেও সিটটি সারা পথ ফাঁকা যাবে।আর এটাও জানায় সিটের যা ভারা সেটাও দিয়ে দিবে।মেহরাব কিছু একটা ভেবে লোকটিকে জানায়

“ঠিক আছে আমি একটি সিট ছেরে দিচ্ছি আর হা আমি সিটের টাকা ফেরত নিচ্ছি না”বলে আবার পেপার পড়ায় মনোযোগ দেয়।কন্টাকটার হাস্যোজ্জল মুখে নিচে নেমে মিনিট দুয়েক পরে একজন বয়স্ক মানুষকে সাথে করে এনে মেহরাবের পাশে বসায়।
কিছুক্ষণ পরে বাসটি তার রুটিন মাফিক চলতে লাগলো।আস্তে আস্তে চেনা শহর রেখে একের পর এক নতুন নতুন জায়গা দিয়ে বাসটি চলতে লাগলো।মেহরাব খবরের কাগজটি সামনে থেকে সরিয়ে ভাজ করে যথা স্থানে রেখে দিলো।এতোক্ষণ ওর খেয়ালে ছিলো না পাশে যে একজন আছে।
পাশ ফিরে দেখলো একজন বয়স্ক লোক যার বয়স আনুমানিক ষাটের উর্ধে হবে।চেহারা দেখে মনে হলো একসময় বেশ সুদর্শন ছিলো বটে।কিন্তু বয়সের ভারে ও সেটা ভালোই বুঝা যাচ্ছে।এমন একজন পাশে আর ও কথা না বলে থাকবে এমন মানুষ মেহরাব নয়।তাইতো ভদ্রতা বজায় রেখে লোকটিকে সালাম দিয়ে ডান হাত এগিয়ে দেয় মেহরাব।বেশ নমনীয় কন্ঠে ওর সালামের প্রতিউওর দিয়ে সেও হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে নেয়।”আমি মীর মেহরাব হুসাইন।

লোকটি ওর আচরনে যে খুশি হয়েছে সেটা তার হাস্যোজ্জল চেহারা দেখেই বুঝা গেছে।
“মা শাহ আল্লাহ আপনি দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি আপনার নামটাও সুন্দর।আর আমি আসলাম তালুকদার।তার কথা শুনে মেহরাব ও বলে ওঠে “আপনি ও এ বয়সে যথেষ্ট হ্যান্ডসাম আর নামের মধ্যেও জোশ আছে কিন্তু।

ওর কথা শুনে বৃদ্ধ লোকটি হেসে দিয়ে বললো “ভালো মজার মানুষ তো আপনি।তা আপনি কোন জায়গায় যাবেন?
বৃদ্বার কথা শুনে মেহরাব বলতে লাগলো”আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন আমার ভালো লাগবে আর আমি ফুলপুর গ্রামে যাবো আপনি?
লোকটি বললো আমি চন্দন নগর গ্রামে থাকি আর ফুলপুর সে তো আমার গ্রামের পাশের গ্রাম।তবে এটা বলেই তার মুখটা কেমন অন্ধকারে ছেয়ে গেলো।মেহরাব কারনটা জানতে চাইলে সে কিছু না বলে এরিয়ে যায়।মেহরাব ও আর কিছু বলে না।
সে আবার বলতে লাগলো”সেখানে কে থাকে?

এবার মেহরাব বলতে লাগলো”আমার নানুবাড়ি ওখানে আসলে আমার আপন বলতে কেউ নেই সেখানে।এক মামা সেও বিদেশে স্যাটেল।নানুর অনেক সম্পওি সেখান থেকে মায়ের ভাগের যে সম্পওি ওটা আমি পেয়েছি।এতোদিন জানতাম না এসবের কিছু।হঠাৎই খবর পাই আর মামাও জানায় এটাও বলে আমি যা পেয়েছি সে গুলো যেনো আমি দেখে শুনে রাখি।মায়ের থেকে পাওয়া আর এসবের মালিক এখন থেকে আমি তাই দেখতে যাচ্ছি।

“ওহ আচ্ছা।
“হুম তবে আমার এ সবের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই আল্লাহ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে তাই আমি ঠিক করেছি এসব সম্পওি গৃহহীন গরিবদের জন্য বাসস্থান তৈরি করে দিবো।অন্তত কয়েকজন পরিবার তো স্থায়ি ভাবে বসবাস করতে পারবে।”কথা গুলো শুনে বৃদ্ধ লোকটির মন ভরে গেলো ।
“সত্যিই তুমি একজন সৎ ও উদার মনের মানুষ।

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুজনের মাঝে অনেক কথাবার্তা চলে।মেহরাবের প্রথমে একটু মন খারাপ হয় ফিরোজ না আসাতে।হয়তো ও আসেনি তাই পুরো পথ ওকে একাই বোরিং সময় পার করতে হবে বলে।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না সময়টা খুব ভালো ই কেটেছে।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে প্রায় একটা সময় বৃদ্ধ লোকটির গন্তব্য স্থান আগে চলে আসলে মেহরাবের থেকে বিদায় নিয়ে নেমে যায়।মেহরাব জানালার বাইরে মাথা বের করে যতোদূর পর্যন্ত লোকটিকে দেখতে পেয়েছে দেখেছে।ওর মনে হলো এ মানুষটা ওর অনেক দিনের চেনা জানা কেউ একজন।এটা নিছকই ওর মনের ভাবনা ছাড়া আর কিছু নয়।

ফুলপুর স্টান্ডে এসে নেমে পরে মেহরাব।কয়েক মিনিট বাদে একজন মাঝ বয়সী লোক এসে ওর নাম মেহরাব কিনা জিজ্ঞেস করলে মেহরাব সালাম দিয়ে বলে কলিমউল্লাহ মামু ?
লোকটি খুশি হয়ে মাথা নাড়ায়।আর বলে
“পথে আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো বাবা?
“একদমই না অনেক ভালো একটা জার্নি ছিলো মামু।চলো এবার যাওয়া যাক।

কলিমউল্লাহর সাথে এর আগে কয়েকবার মেহরাবের সাথে ফোনে কথা হয়েছে।নিজ মামার মাধ্যমে পরিচয় ওর।গ্রামের নামডাক ওয়ালা লোকদের মধ্যে সে একজন।মেহরাবের নানু বাড়ির সাথে তার অনেক আগ থেকেই একটা গভির সম্পর্ক সে জন্যই ওর মামার অনুপস্থিতিতে সব কিছুর দায়িত্ব কলিমউল্লাহর ওপর ন্যাস্ত আছে।কলিমউল্লাহর আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো।এক সময় সে কলেজ এর প্রফেসর ছিলো অনেক আগেই চাকুরি থেকে অবসরে এসেছেন।তবে নিজের গ্রাম সহ আসে পাশের অনেক গ্রামের লোকজন তাকে অনেক মান্য করে।কোথাও কোনো সমস্যা বিচার শালিস এর জন্য এসব জায়গাতেও তার ডাক পরে।
মূলত কলিমউল্লাহ মেহরাবের মায়ের যে সব সম্পওি সে গুলো বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটাও তার ওপর পরেছে।আর আজ অন্য লোক না পাঠিয়ে নিজেই মেহরাব কে নিতে স্টান্ডে এসেছে।

গ্রাম হলেও এখানে সিএনজি,অটো,অটো ভ্যান ,রিক্সা সবই চলে।ওরা একটা সিএনজি নিয়ে ওঠে পরে।এই অল্প সময়ে গ্রামের যতোটুকু দেখেছে তাতেই মেহরাবের বেশ ভালো লাগছে।মায়ের জন্মস্থান বলে কথা ,আজ মা নেই তারপরেও এই শূন্যতা ওর মনে কোনে একটা পূর্ণতার প্রশান্তি অনুভব করতে পারছে এটাই কম কিসের।আধঘন্টা পরেই ওর নানু বাড়ি পৌছে যায়।

———

রাতের খাবার শেষ করে কাশেম মিয়া চৌকির ওপর গিয়ে বসে।আয়মন স্বামীর পাশে গিয়ে বসে।আয়মনের মুখ দেখে কাশেম মিয়া বুঝতে পারে আয়মন কিছু বলতে চায়।কাশেম মিয়া জিজ্ঞেস করলে বেশ নরম গলায় বলে “মাইয়া বড়োডার তো বিয়ার বয়স পার হইয়া যাইতাছে এহোন বিয়া দেওয়া দরকার নইলে এর পরে কিন্তু বিয়া দিতে মেলা কষ্ট হইবো।
কাশেম মিয়া বউয়ের কথায় বেশি একটা খুশি হতে পারে না।তারপর ও অনিচ্ছা স্বত্বেও বলে”এহোনই এইসব আমি ভাবি নাই সময় হোক তারপরই বিয়া দিমুনে।

কিন্তু আয়মন যেনো নাছোড়বান্দা সে বলে”আপনের ভাবা লাগতো না যা ভাবার আমিই ভাইব্যা রাখছি সময় হলেই দেখবেন।বলেই স্বামীর পাশ থেকে ওঠে যায়।কাশেম মিয়া আর এসবে কান না দিয়া শুয়ে পরে।এমনিতেই শরির ভালো নেই তারওপর বউ মানসিক ভাবে চিন্তায় রাখে।
মায়া বাইরে বের হতে গিয়ে এ সব কথা ওর কানে যায় ।পুষ্প ও পাশ থেকে এসব শুনে।বেনের দিকে তাকালে মায়া কিছু বলে না নিঃশব্দে বাইরে বের হয়।বোন কে অনুসরন করে পুষ্প ও বের হয়ে যায়।উঠানোর পাশে সফেদা গাছের সাথে লাগোয়া একটি কাঠের বসার জায়গা বানানো আছে।মায়া সেখানে গিয়ে বসে আজ পূর্ণ জোস্না রাত।এ সময়টা মায়ার বেশ প্রিয় ,মন খারাপ আর ভালো যেটাই থাকুক না কেনো ও এই সময়টা একান্ত ভাবে জোস্নাবিলাস করে থাকে।তবে মাঝে মাঝে পুষ্প ওর সঙ্গি হয়।আজও পুষ্প ওর পাশে এসে বসে।

“বুবু”মায়া হু বলে বোনের ডাকে সারা দেয়
“একটু জড়াইয়া ধরি তোমারে?
মায়া হা সূচক মাথা নাড়ালে পুষ্প ওকে জড়িয়ে ধরে রাখে।এই একটা মানুষকে ও ওর জীবনে পেয়েছে যার স্পর্শে ওর সমস্ত দুঃখ কষ্ট বিলীন হয়ে যায়।ও জানে বোনের মন ভালো করতে কথা নয় এতোটুকু স্পর্শই ওর জন্য যথেষ্ট।
“বুবু” আমি তোমারে হারাতে চাই না।ও জানে কেনো পুষ্প এসব বলছে তাই বোনের কথার প্রেক্ষিতে মায়ার কিছু বলার ক্ষমতা এই মুহূর্তে নেই।কি বলবে আর কি বা বলার আছে।নিয়তি আর ভাগ্যে যে ওর সহায়ক নয়।শুধু আকাশের দিকে নিষ্পলক চোখে একমনে চেয়ে থাকে।

“সারাদিনের রৌদ্রতেজে পুড়ে দিনের শেষে চাঁদের রূপালি জোস্না যেমন মোলায়েম এক শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়,তেমনি সমস্ত দিনের ক্লান্তি শেষে প্রিয়জনের মুখের ঐ একটু হাসি ,সমস্ত বিষাদ মুছে দেয়।
মায়ার জীবনে কি এমন একজন আসবে ?যে কিনা ওর জীবনে এই রূপালি চাঁদের জোস্না হয়ে ধরা দিবে।যে কিনা মুছে দিতে পারবে ওর সমস্ত দুঃখ কষ্ট গুলো কে?পারবে ওর মুখে পৃথিবীর সমস্ত হাসি এনে জড়ো করে দিতে?হয়তো উপর ওয়ালা চাইলে সবটা সম্ভব শুধু সময়ের অপেক্ষা।”

চলবে…….

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন)

স্বর্ণকেশী মায়াবিনী পর্ব-০১

0

#স্বর্ণকেশী_মায়াবিনী
#লেখনিতে-বর্ণ(Borno)
#সূচনা_পর্ব

অপয়া হতোভাগী এইটা কি করলি?চোক্ষে দেহোস না দিলি তো আমার স্বর্বনাশ করে।এহোন শান্তি পাইছোস তো মনে?

কথা গুলো বলেই অগ্নি চোখে মায়ার দিকে তেরে আসছে ওর সৎমা আয়মন।ভয়ে চোখ বন্ধ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মায়া।না জানি এখন কতো কি শুনতে হবে।তবে এ আর নতুন কি পান থেকে চুন খসতে দেরি হলেও আয়মন ওকে কথা শুনাতে দেরি করে না।
কিছুক্ষণ আগে,মায়া ফুরফুরে মনে ঘর থেকে বাইরে বের হতে গিয়ে খোলা বারান্দার এক পাশ থেকে কিছু একটা আনতে গিয়েছিলো।কিন্তু অসাবধানতা বশত উঁচু স্থানে রাখা পানি ভর্তি মাটির কলসিটাতে মায়ার ধাক্কা লাগে।তখনই কলসিটা বারান্দা থেকে নিচে পরে ভেঙ্গে যায়।আর আয়মন সেটা দেখেই রাগে মায়ার নিকট তেরে আসে।

সব সময়ের মতো একগাদা কথা শুনিয়ে দম নেয় আয়মন।মায়া কথা গুলো হজম করে বড়ো একটা দম ফেলে বলে “আর এমনটা হইবো না মা এবারের মতো মাফ করে দেও”আয়মন মেয়ের এমন কথা শুনে মুখ বাকিয়ে পিছন ফিরে বাইরের রান্না ঘরে ডোকে।মায়া ভাঙ্গা কলসির টুকরো গুলো গুছিয়ে বাড়ির পাশে ময়লা আবর্জনা ফেলার জায়গাতে ফেলে দিয়ে আসে।এ আর নতুন কি এসব কথা ও সবসময়ই শুনে থাকে আজও তার বযাতিক্রম হলো না।কিছু একটা হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় মায়া।

মায়ার ছোটো বোন পুষ্প অনেকটা তারাহুরো করে বাপের কাছে ছুটে এসে বললো “বাজান তারাতারি আসো বুবু পুকুর পাড়ের বড়ো আম গাছের ডালে দড়ি দিয়া কিছু একটা করতাছে।ছোটো মেয়ের এমন কথা শুনে আবুল কাশেমের কিছুই বুঝে আসে না।কি হইছে জানতে চাইলে ছোটো মেয়ে তাকে জানায় “বাজান আইজ ও মায় বুবুরে অনেক বকছে আমার তো মনে হয় বুবু গাছের ডালের লগে দড়ি দিয়া গলায়..এই পর্যন্ত বলতেই কাশেম মিয়া মেয়েকে থামিয়ে দেয়।জমির কাজ বাদ দিয়ে তখনই উঠে পরে।এক মিনিট সময় নষ্ট না করে মেয়েকে সাথে নিয়ে রওয়ানা হয় বাড়ির পাশে পুকুর পাড়ের দিকে।মনে মনে আল্লাহর নাম জপতে থাকে।আর বলতে লাগে আল্লাহ খারাপ কিছু যেনো না ঘটে এ যাএায় মেয়েকে বাচিয়ে দাও।দোয়া দূরুত যা পারে পড়ছে।মা মরা মেয়েটা আর কতো দুঃখ কষ্ট ভোগ করবে।এই টুকু সময়ের মধ্যে মেয়েকে নিয়ে কাশেম মিয়া অনেক কিছু ভেবে ফেলেছে।

আম গাছের কাছে এসে কাশেম মিয়া দেখতে পায় গাছের যে ডালটা নিচের দিকে ঝুলে আছে সেটাতে একটা মোটা দড়ি এপাশ থেকে ওপাশে ফেলে দড়ির দুই মাথা হাতে ধরে গিঁট দিচ্ছে মায়া।কাশেম মিয়া দেরি না করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলতে থাকে “মা’রে এমন কাম ভুলেও করিস না।তোরে আর কষ্ট পাইতে দিমু না।এই তোরে ছুইয়া কথা দিলাম।এতো দিন ধরে তোর মুখের দিক চাইয়া কিছু কইতে পারি নাই ।কিন্তু এহোন বুঝবার পারছি আমি ভুল করছি।এতোদিন ধইরা আমি আমার মা মরা মাইয়াডার প্রতি অনেক অন্যায় কইরা ফালাইছি।মারে তাই বইলা তুই মই’রা যাবি?এই অধম অক্ষম বাপটারে ক্ষমা কইরা দে মা।

এতোক্ষণ ধরে বাবার এ সব কথা বার্তা আর চোখের পানি ফেলার কারন বুঝে উঠতে পারছে না মায়া।আচমকা বাবার কি হলো সেটাই ভাবছে।মায়া ওর ছোটো বোন পুষ্প কে কি হইছে সেটা ইশারা করে জিজ্ঞেস করলে ও কিছু বলে না।কাশেম মিয়া এবার বলে ওঠে”চল মা বাড়িতে চল এইহানে আর থাকোন লাগবো না।পুষ্প ও বোন কে বললো”বুবু চলো এই জায়গাটা ভালা না বাড়িতে চলো।
বাবা আর বোনের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝে আসে না ওর।ও তো এখানে দড়ি নিয়ে এসেছিলো একটা দোলনা বানাবে বলে।যদিও বোন কে কিছু বলেনি ভেবেছিলো দোলনা বানিয়ে পুষ্পকে দেখাবে আর ও খুব খুশি হবে তাই।

কাশেম মিয়া মেয়েকে সরিয়ে গাছে ঝুলানো দড়িটি খুলে নিজের হাতে নিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়।ছোটো মেয়ে সময় মতো আজ তারে খবর না দিলে হয়তো বড়ো কোনো অঘটন ঘটে যেতো।
মনে মনে কয়েক শত বার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে নেয়।আর বউয়ের প্রতি এতো দিনের পুষে রাখা চাপা রাগটা বাড়তে থাকে।মা মরা মেয়েটাকে সেই ছোটো থেকে এই পর্যন্ত তার দ্বিতীয় স্ত্রী দিনের পর দিন নি’র্যাতন করেই যাচ্ছে।আর না এর একটা ফয়সালা করেই ছাড়বে কাশেম মিয়া।

“আবুল কাশেম একজন কৃষক,এলাকার মানুষ তাকে কাশেম মিয়া বলেই জানে।হতোদরিদ্র কাশেম মিয়া বিয়ে করলে সেই ঘরে কন্যা সন্তান হওয়ার এক বছর যেতেই বউয়ের ডায়েরিয়া জনিত রোগে মৃ’ত্যু হয়।বলতে গেলে টাকা পয়সার অভাবে বিনা চিকিৎসায় বউ কে হারায়।মা ম’রা মেয়েকে নিয়ে কাশেম মিয়ার দিন কষ্টে কাটতে থাকে।মেয়ে সামলাবে নাকি জমিতে কাজ করবে?কাজ না করলেও মেয়েকে নিয়ে না খেয়ে দিনযাপন করতে হবে।তাই গ্রামের আশেপাশের মানুষ জনের কথায় আবার নতুন করে বিয়ে করেন কাশেম মিয়া।কিন্তু প্রথম প্রথম মেয়েকে ভালোবাসলেও আস্তে আস্তে সেটা কমে যায়।একটা সময় কাশেম মিয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী দুই সন্তানের জননী হয়।কিন্তু প্রথম সন্তানটি বেচে নেই দ্বিতীয় সন্তানটিই পুষ্প।তবে প্রথম সন্তানটি ছেলে সন্তান ছিলো আর তার মৃত্যুর জন্য মায়াকেই দোষী মনে করে তার সৎ মা।আর তখন থেকেই মায়াকে একদমই সহ্য করতে পারেনা।

মায়া দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি তার ব্যাবহার ও।শুধু তাই না লোকমুখে শুনেছে মায়া দেখতে ঠিক ওর মায়ের মতোই হয়েছে।কিন্তু মায়াকে দেখলে সবার মায়া হলেও সৎ মা আয়মনের মনে মায়ার জন্য কোনো মায়া নেই।সব সময় আয়মন মায়াকে অত্যা’চার করে থাকে আর দিনের পর দিন যেনো ওর ওপর অত্যা’চারের মাএা বাড়তেই থাকে।মায়া সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে নেয়।কখনও কিছু বলে না।এমনকি তিনবেলা খাবারও ঠিক মতো পায়নি কখনও।
কাশেম মিয়া মেয়ের পক্ষ নিয়ে কখনও প্রতিবাদ করতে গিয়েও করতে পারেনি কারন ,তার স্ত্রী আয়মন অভাবের সংসারে বাপের বাড়ির থেকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা এনেছে।আর কাশেম মিয়ার ও কখনও এ বিষয়ে নিষেধ করেনি।তাই নিজের দূর্বলতা ভেবে বউয়ের ওপর কখনও কথা বলে সুবিধা করতে পারেনি বিধায় হাল ছেরে দিয়েছে।চোখের সামনে বড়ো মেয়ের সাথে এমন নির্দয় আচরন করাতেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি।

তবে পুষ্প হয়েছে মায়ের আচরনের সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী।ছোটো থেকেই পুষ্পের রয়েছে বোনের প্রতি অন্য রকম একটা মায়া।মায়াও পুষ্পকে অনেক ভালোবাসে।সৎ মায়ের এতো অত্যাচার সহ্য করেও সব ভুলে যায় পুষ্পের জন্য।পুষ্পের ভালোবাসার জন্য।মনে যতোই কষ্ট থাকুক শুধু বুবু বলে ডাক দিলেই মায়ার কষ্টে ভরা মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।

আজ যখন মায়া পুকুর পাড়ে গাছের সাথে দড়ি নিয়ে কিছু একটা করছে সেটা দেখে পুষ্প বুঝতে পেরেছে আগের দিন ও মায়াকে বলেছিলো একটা দোলনা বানিয়ে দিতে।কিন্তু পুষ্প কাছে না গিয়ে মনে মনে একটা ফন্দি আটে।এই সুযোগ বাবাকে এমন কিছু বলবে যেটা শুনে কাশেম মিয়া বড়ো মেয়েকে নিয়ে যেনো একটু ভাবে।সব সময় বোনের ওপর অমানবিক অত্যাচার দেখে ও অভ্যস্ত ।আজ পর্যন্ত বাবাকে কখনও দেখেনি মায়ের ওপর কথা বলতে,তাই সেই সময় পুষ্পর মনে হয়েছিলো এটা করাই ওর উচিত।মায়া বড়ো হলেও জ্ঞান বুদ্ধির দিক দিয়ে পুষ্প এগিয়ে।মায়াও বুদ্ধিমতী তবে সেটা ওর মাঝে প্রকাশ পায় না বরং সব সময় চুপ থাকাটাই ওর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।

মায়া কলেজে পড়ে প্রথম বর্ষের ছাএী আর পুষ্প দশম শ্রেণিতে পড়ে।কাশেম মিয়ার সংসারে অভাব অনটন থাকলেও দুই মেয়েকে লেখা পড়া থেকে দূরে রাখেনি।তার ইচ্ছা ছেলে নেই তো কি হয়েছে মেয়েদের শিক্ষিত বানাবে।তার মতো কষ্ট যেনো মেয়েরা না করে।বাবার ইচ্ছা পূরনে দুই মেয়েই যথেষ্ট সচেতন।মায়ার থেকে পুষ্প লেখাপড়ায় মনোযোগী বেশি।

বাড়িতে এসে কাশেম মিয়া তার বউ আয়মন কে চিৎকার করে ডাকতে থাকে।অসময়ে স্বামীর ডাক শুনে বাইরের রান্না ঘর থেকে আয়মন শাড়ির আচলে হাত মুছতে মুছতে বের হয়।স্বামী চিৎকার করে কেনো ডাকছে জানতে চাইলে কাশেম মিয়া বউয়ের সামনে এসে বলে”আইজকার পর থেইক্যা যদি শুনি আমার বড়ো মাইয়্যার গায়ে হাত দিছোস আর বেশি কথা শুনাইছোস তাইলে তোরে আমি ভিটা ছাড়া করুম কইয়্যা দিলাম।”
হঠাৎ স্বামীর এমন রূপ দেখে আয়মন একটু ভরকে গেলো।সব সময় আয়মন স্বামীকে উঁচু গলায় কথা শোনাতো কিন্তু কাশেম মিয়া কখনও বউয়ের মুখের ওপর কিছু বলতে পারেনি ।আর আজ স্বামীর উঁচু গলার আওয়াজ আয়মনের মনে এক রাশ ভয় হানা দিয়েছে।কাছে এসে ঢোক গিলে নরম স্বরে বলতে লাগলো”কি হইছে আপনের ?আমি তো কিছুই বুঝবার পারছি না।”

বউয়ের কথা শুনে কাশেম মিয়া জবাব দেয়”তোর কিছু বুঝা লাগতো না আইজ আমার মাইয়্যা মই’রা গেলে তোরে বুঝাইতাম।

স্বামীর এমন কথায় যেনো আরো ভয় পেলো আয়মন।সকালেও অহেতুক কথা শুনিয়েছে সে মায়াকে।প্রতিদিনকার রুটিন হিসেবে মায়া সে সব শুধু শুনেছে কোনো প্রকার কথার প্রেক্ষিতে টু শব্দটিও করেনি।মায়ের সব কথা হজম করে না খেয়েই বাড়ি থেকে বের হয়েছিলো।হয়তো আয়মন এমনটাই চেয়েছিলো ।কিন্তু স্বামীর কথা শুনে আয়মন ভয় পাচ্ছে আবার মনে মনে ভাবছে ম’রে গেলে মানে কি ? তবে সরাসরি জিজ্ঞেস করার সাহোস হয়ে ওঠে নি আয়মনের।আজ আর স্বামীর কথার ওপর জবাব দেয়নি ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো আর ভয়ের পাশাপাশি মনে মনে মায়ার প্রতি রাগ/জিদ টা বেড়ে চলছিলো।হয়তো আজকের কথা গুলো মায়া তার বাবাকে বলে সৎ মায়ের নামে নালিশ করেছে তাই স্বামী তার ওপর বেজায় চটেছে।

বাবা আর মায়ের এমন কথার মাঝে মায়া ওর বাবাকে টেনে দূরে সরিয়ে আনে।আর অন্যদিকে পুষ্প ওর মাকে যেতে বলে।আয়মন রান্না ঘরের দিকে যেতে লাগে আর কাশেম মিয়া পুষ্প কে বলতে থাকে “তোর মায় রে কইয়া দে ভালো হইয়্যা যাইতে না হইলে আমার চাইতে খারাপটা কেউ হইবো না কইলাম।

“বাজান মাথা ঠান্ডা করো মায়ের লগে এমন কথা কইয়ো না।কষ্ট পাবে।এ কথা বলে মায়া বাপের পাশে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।কাশেম মিয়া মেয়ের গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।”মারে অয় তোরে অনেক অত্যা’চার করে কিন্তু আমি কিছুই করবার পারিনি তোর লাইগ্যা।বাপের মতো বাপ হইতে পারিনাই আমারে মাফ কইরা দিস।বাবার এমন কথায় মায়ার বেশ খারাপ লাগে।”কি কও বাজান এ সব?আর কোনোদিন এমন কথা কইবা না।তুমি আমার একটা ভালো বাজান।বলে মায়া তার ওড়নার আচল দিয়ে বাবার চোখ মুছে দেয়।মা যতোই নির্যা’তন করুক না কেনো বোন আর বাবার এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আছে বলেই ও সব শারিরিক ও মানসিক দুঃখ কষ্ট ভুলে থাকে।মায়া সব সময় একটা কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে ওর এই সৎ মা একদিন ওকে আদর করে ঠিক বুকে টেনে নিবে।নিজের মেয়ের মতোই ওকেও ভালোবাসবে।এ সব ভেবে মায়ার চোখ থেকে অজান্তেই জল গড়িয়ে পরে।
বুবু ঘরে চলো বোনের ডাকে চোখ মুছে নিজেকে ঠিক করে জবাব দেয় “তুই যা আমি একটু হাত মুখ ধুইয়া আইতাছি।

বারান্দার মেঝেতে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে দুপুরের খাবার বেড়ে আয়মন স্বামী আর মেয়েকে ডাকতে লাগলো।কাশেম মিয়া এসে পাটিতে বসে পরে মেয়েদের জোড়ে ডাকতে লাগলেন।স্বামীর এমন কাজে আয়মন মোটেও খুশি হয় না।তখন পুষ্প মায়াকে ডাকতে ওর কাছে চলে যায়।
আয়মনের চাওয়া না চাওয়া আর অখুশিতে পুষ্প কখনও ভ্রুক্ষেপ করে না বরং ও সবসময় বোনকে সাথে নিয়েই খেয়ে থাকে।আয়মনের রাগ তখন পুষ্পের ওপর দ্বিগুন হতে থাকে।কাশেম মিয়া বউয়ের জন্য মেয়েকে সবসময় ডাকতে না পারলেও মনে মনে পণ করে রেখেছে আজকের পর থেকে সবসময় মায়াকে সাথে নিয়েই খাবে তাই আজ কয়েক বার মেয়েকে ডাক দিয়েছে ।পুষ্প আর মায়া এক সাথে এসে খেতে বসেছে।
আজ দেশি মোরগ রান্না হয়েছে তাই মায়া বেশ খুশি কিন্তু ওকে ওর পছন্দ মতো ভাত তরকারী দেয়নি ।আয়মন নিজ মেয়ে আর স্বামীকে বেশি করে খাবার তুলে দিচ্ছে।সেটা দেখে কাশেম মিয়া নিজ প্লেট থেকে মাংশ তুলে মায়ার প্লেটে দেয়।এতে আয়মন মনে মনে আরো ক্ষেপে যায়।মায়া খুশি মনে খেতে গিয়ে মায়ের দিকে নজর দিয়ে বুজতে পারে আয়মন বেশ রেগে আছে তাই ওর প্লেট থেকে মাংশ তুলতে গেলে কাশেম মিয়া ওর হাত ধরে থামিয়ে দেয়।শুধু তাই না পুষ্প নিজের হাতে আরো দু টুকরো মাংশ মায়ার পাতে তুলে দেয়।এতে যেনো আয়মনের নিজের কাছে মনে হলো কাটা ঘা’এ নুনের ছিটা দেওয়া হলো তাকে।

আয়মন ভেবে পায় না তার মেয়ে তার মতো না হয়ে বিপরীত স্বভাবের কেনো হলো?তার তো মায়ার ভালো কোনো কিছুই সহ্য হয় না।সে চায় মায়াকে সবাই তার মতোই ঘৃণা করুক।ওর যেনো কোনো কিছুতেই ভালো না হয়।নিজ মেয়ের জন্যই সব সময় চিন্তা করে।আর এই মেয়ে কিনা মায়ের ওপরই খবরদারি করে?ঠিক আছে এর একটা বিহিত করেই ছারবে ।মনে মনে বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আয়মন।মায়াকে খুব শিগ্রই বাড়ি থেকে বিদায় করতে হবে তা হলেই আয়মনের মনে শান্তি মিলবে তার আগে নয়।

বাড়ির সামনে দিয়ে একটা ছোটো খাল বয়ে গেছে।খালে উঠা নামার জন্য একটা অংশে কাঁঠ দিয়ে ঘাট বাঁধানো।যেমনটি পাকা করে সিঁড়ি বাঁধানো থাকে তবে এটা কাঠের হওয়াতে বেশ চওড়া করে বানানো।এখানে ধোয়া মোছা সহ অনেকেই তাদের প্রতিদিনের গোসল সেরে নেয়।
ঘাটের সর্বনিম্ন কাঠের সিড়িতে বসে আছে মায়া।কোমর এর নিচ অব্দি চুলের দৈর্ঘ্য।চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে দু পায়ের টাকনু পর্যন্ত পানিতে চুবিয়ে রেখে এক মনে আকাশ দেখায় ব্যাস্ত রমনী।
পরন্ত বিকেলের গোধূলীর রাঙ্গা আলোয় আসমান ছেয়ে আছে।মুহূর্তটা সত্যিই মনোমুগ্ধকর ,তবে এ সময়টা দেখে কেউ অনেক আনন্দ পায় আবার কেউ একজন মনের দুঃখ কষ্ট গুলো মুছে দেবার জন্য মন খারাপের দিন গুলোতে এখানেই বসে বসে আসমান দেখে।আর সেটা মায়া নিজেই।আজ ও বসে আসমানের পানে চেয়ে মায়ের কথা ভাবছে।এই নিষ্ঠুর দুনিয়াতে ওকে একা রেখে না গেলে এতো কষ্ট পেতে হতো না।বিরবির করে বলছে “মা আমারে সাথে নিয়া যাইতা তা হলে আমিও তোমার মতো আকাশের তারা হয়ে থাকতে পারতাম।”এ সব ভাবতেই মনের অজান্তে টুপ করে চোখের কার্নিশ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরতে লাগলো।মন চাচ্ছে চিৎকার করে কান্না করতে কিন্তু পারছে না।তাই নিরবে কান্না করে যাচ্ছে।

কারোর হাতের স্পর্শে বাম হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নেয়।ও জানে কে এসেছে।এখন ওর খুঁজে একমাএ পুষ্পই আসতে পারে আর সত্যিই পুষ্প এসেছে।
“বুবু তুমি এইহানে?আর আমি খুজতাছি যে।
“কিছু বলবি ?
“হুম তুমি জানো না এহোন সন্ধ্যা হওয়ার পালা এই সময় ভূত পেত্নী চলাফেরা করে আর তুমি চুল খুলেই বসে আছো?
“তো কি হয়েছে?
“কি হয়েছে মানে ধরে নিয়ে যাবে যে।আমার বুবুর যেই সুন্দর চুল এইডা দেখলেই তো কোনো ছেলে ভূত আমার বুবুর প্রেমে পইরা যাইবো।
মায়া মুচকি হেসে বোনকে বলতে লাগলো”তাও তো ভূতে ধরবে কোনো মানুষে তো না।
“বুবু শোনো এমন কথা কইয়ো না তুমি যেই সুন্দর আর তোমার চুল গুলোর কি সুন্দর রং একেবারে বিদেশীদের মতো লাগে তোমারে দেখতে ।যে কেউ তোমারে দেখলে এক দেহোনে পাগল হইয়া যাইবো।কথাটা শুনে মায়া বোনকে বলে
“অনেক দুষ্টু হয়ে গেছোস।
“সত্যি কইছি বুবু কিন্তু দেখো আমারে দেখলে মনে হয়না তোমার বোন আমি।তুমি কতো ফর্সা আর আমি শ্যাম বর্ণের কথাটা বলেই পুষ্পর মন খারাপ করে।

বোনের থুতনি ধরে সামনে ফিরায় মায়া।”এমন কথা আর কইবি না।আমার বোন আমার কাছে সবচাইতে সুন্দর আর আমি তোকে অনেক ভালোবাসি।কথাটা মনে থাকবে?
“হুম থাকবে বুবু।বলে বোনকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে।
“জানো বুবু আমি না সবসময় একটা দুয়া করি
“কি দুয়া?
“কোনো এক রাজপুএ তোমার জীবনে আসবে আর তোমারে এক দেখায় পছন্দ করবে শুধু তাই না একে বারে বিয়া কইরা সাথে করে তার রাজ্যে নিয়া যাইবো।
“ধূর পাগলী আমাগো মতো গরীবের জীবনে এমন টা হয় নাকি?আর না আইবো কোনো রাজপুএ।এ সব স্বপ্নেই মানায় বুঝলি।
“কিন্তু বুবু তুমি দেইখো এমনটিই হইবো সেদিন মিলিয়ে নিও।
“হইছে অনেক স্বপ্ন দেখা এহোন চল বাড়ি যাই।
“চলো বুবু।

——

মিষ্টি সকালের ঝলমলে রোদের ঝলকানিতে মুখরিত চারদিক। রুমের জানালা গুলো বন্ধ তাই মিষ্টি রোদ তার আগমনের বার্তা শুধু বাহিরেই দিচ্ছে রুমের ভেতর আর ডুকতে পারছে না।মোটামুটি অন্ধকার রুমটিতে কেউ একজন গভির ঘুমে মগ্ন।তার ফোনে ভাইব্রেশন হয়েই যাচ্ছে ।কিন্তু ফোনের মালিক মোটেও টের পাচ্ছে না,অনেক রাত করে ঘুমাবার দরুন ঘুম ভাঙ্গছে না।দু থেকে তিন বার রিং হয়ে বন্ধ হবার ঠিক চারবারের সময় কল আসতেই ফোনের মালিক এবার কলটি রিসিভ করে।অপর প্রান্ত থেকে বড়ো গলায় সালামের শব্দ ভেসে আসলে ঘুম জড়ানো কন্ঠে খুব সুন্দর করে সালামের জবাব দেয় কল রিসিভকারী।

ওপর প্রান্ত থেকে বলতে লাগলো”স্যার এখানের সব কিছুর বন্দোব্যাস্ত করে রেখেছি আপনি কি কাল আসবেন?
কথাটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো হা কাল আসছি আর ওখানের সবাইকে বলে রাখবেন মীর মেহরাব হুসাইন কালই ঢাকা থেকে ফুলপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাবে” কথাটা বলেই কল কেটে দিয়ে আবারো বালিশে মাথা রেখে গভির ঘুমে তলিয়ে যায়।হয়তো আরো কয়েক ঘন্টা তার ঘুমের প্রয়োজন।”

চলবে……

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-২৯ এবং শেষ পর্ব

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২৯
ফারিহা জান্নাত

কোর্টে বসে আছে মারুফ-পৃথিশা। অবশেষে দীর্ঘ দুই মাস পর জাহিন ধরা পড়েছে। অপেক্ষার প্রহর যেন কাটতে চায় না কোনভাবেই। অবশেষে জাহিনকে আনা হলেই পৃথিশা নড়েচড়ে বসলো। তার হাত মারুফের হাতের মুঠোয় বন্দি। এই দু’টো মাস মারুফ প্রতিনিয়ত তাকে সাহস দিয়েছে। নিজের সকল চেনা-পরিচিত সোর্স দিয়ে জাহিনকে খুঁজে হাজির করেছে। সাথে আরও একজন সাহায্য করেছে তাকে, আদিদ। কোন কিছুতেই যখন কূলকিনারা পাচ্ছিলো না তখন দেখা মেলে আদিদের। নিজের সর্বাত্নক সহযোগিতা সে করেছে। শুনানি শুরু হলো, আসামী পক্ষের আইনজীবী প্রথমেই বলে উঠলেন,

– মণিদীপা চৌধুরী ছিলেন মানসিক বিকারগ্রস্ত,সেই সাথে মাদক পাচারকারী। নাহলে একজন মেয়ে হয়ে তিনি এরকম অন্ধকার জনমানবহীন গলিতে যাবেন কেন? মাদক পাচারে ধরা পড়ায় জনমানুষের কাছে মার খেয়ে তিনি রাস্তায় পড়ে থাকেন। সেই সময় জাহিন সাহেব সেখান দিয়ে গেলে তাকে দোষারোপ করা হয়। জাহিন সাহেব সম্পূর্ণ নির্দোষ।

কি নিদারুণ মিথ্যা। পৃথিশার রাগে গাঁ কাঁপতে থাকলো। মিথ্যা বলার তো একটা লিমিট থাকে। তবে তা টিকলো না। তৌসিফ দ্রুতই মোড় ঘুরিয়ে ফেললো। সব খেলা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। অবশেষে সময় এলো বিচারকের রায়ের।

– জাহিন রহমানের দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তার ফাঁসির রায় দেওয়া হলো।

মূহুর্তেই গগনবিদারী কান্নায় মুখরিত হলো আদালতের কার্যালয়। মিথ্যার কালো অন্ধকার সরিয়ে ন্যায় ও সত্যের জয় হলো অবশেষে, বহুক্ষণ পর। সব হারিয়ে সর্বশান্ত হওয়ার পর বিচার পেলো তবে দীর্ঘ পথের সেই যুদ্ধে সামিল হবার সুযোগ হলো না মণিদীপার।

________

চোখের সামনে নিজের প্রিয় মানুষের ক/বর। এতটা পথ সাহস নিয়ে পাড়ি দিলেও আজ যেন পৃথিশা ভেঙ্গেচুড়ে গেছে। এতগুলো দিন পেরিয়ে যাবার পরও পৃথিশা কোনদিন মণিদীপার কাছে আসার সাহস পায় নি। আজ এসেছে,এতগুলো দিন পর। আর এসে যেন নিজেকে সামলাতে পারছে না। হাঁটু ভেঙ্গে রাস্তায় বসে পড়লো সে। কান্না জড়িত স্বরে বলল,

– বুবু,আমি আমার কথা রেখেছি। দেখ তোর পৃথি আজ কত বড় হয়ে গেছে। নিজে সব সামলাতে পারছে। আর তাকে সর্বক্ষণ পাশ থেকে সাহায্য করছে একজোড়া হাত। বুবু জানিস, তোর কথা খুব মনে পড়ে। তুই আমায় কত যত্ন করতি, জানিস তোর পছন্দের চুলগুলো কত লম্বা হয়ে গেছে এখন। তোকে খুব মিস করি বুবু। কেন তুই থাকলি না। আমার বুবু তো স্ট্রং ছিলো, সে কেন এমন একটা কাজ করলো। আমি আর কিছু জানতে চাই না বুবু, আর কিছু নেয়ার শক্তিও আমার নেই। পুরো দুনিয়া ঠিকভাবে চলছে, অথচ আমার বুকের ভিতরা দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে, চোখ খুলে সবার প্রথমে তোর কথা মনে পড়ে বুবু। তুই নেই, অথচ যেন সর্বক্ষণ আছিস আমার সাথে, আমার পাশে।পৃথিবীর কঠোরতা সহ্য করতে করতে আমি ক্লান্ত। তোর আর বাবা-মায়ের ছায়া মাথার উপর থেকে চলে যাওয়ার পর আমি একরাতও শান্তিতে ঘুমাতে পারি নি। তোর বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমি শান্তি পেতাম না বুবু। আজ যেন আমার সকল অপেক্ষার অবসান ঘটলো। আজ থেকে আমি মুক্ত,বুকেভারী বোঝা নিয়ে আমি শ্বাস নিতে পারতাম না। বিধাতা বোধ হয় আমায় এবার শ্বাস নেবার সুযোগ দিবে। তুই খুব খুব ভালো থাক বুবু, আমি তোর জন্য দোয়া করি।

পৃথিশা আর বলতে পারল না কিছু। কান্নায় কন্ঠ রোধ হয়ে এলো। মারুফ পাশে বসে বুকে জড়িয়ে নিলো তাকে। কাঁধে থাকা শক্ত পুরুষালি হাতটা বুঝিয়ে দিলো, আমি আছি।

পৃথিশাদের থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে আদিদ। তার চোখ জ্বলছে, মায়ের আদেশে বিয়ে করেছে একমাস হলো। অথচ মণিদীপাকে ভুলতে পারছে না কোনভাবেই। তাইতো ছুটে এসেছিলো পৃথিশার কাছে সাহায্য করতে। সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা সবসময়ই অন্যরকম, তার হাতেই সব। তাও আমরা নিজ পরিকল্পনায় মেতে থাকি সারাক্ষণ।

পৃথিশার চান্স হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। পৃথিশা সেখানে গেছে ঠিকই কিন্তু মারুফ ঢাকায়ই আছে। আজ সে এসে নিজেদের পুরোনো বাসায় উঠেছে। অনেকদিন পর নিজ শহর,চেনা পরিবেশে এসে যেন প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারলো পৃথিশা। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আকাশ পানে বলল,

– প্রিয় শহর, আমি আমার কথা রেখেছি। আমার সকল ওয়াদা সম্পূর্ণ করেই আমি এই মাটিতে পা দিয়েছি। এই শহর আমার সব কেড়ে নিয়েছে, অথচ এই শহরই আমায় পরিপূর্ণতা দিয়েছে। ওহে পৃথিবী, তুমি জানিয়ে দিয়ো সত্য সবসময় সূর্যের সেই আলোর মতোই চিরন্তন ও অনিবার্য সত্য যা ক্ষণিকের জন্য মেঘে ঢাকলেও কখনো চাপা পড়ে যায় না।

রাত বারোটায় বাসার বেল বাজতেই অবাক হলো পৃথিশা। এতরাতে এখানে কে আসবে। বাসায় একা থাকায় ভয়ও হতে লাগলো। দোয়া-দুরুদ পড়ে দরজা খুললেও কাউকে দেখতে পেলো না। ভ্রু কুঁচকে দরজা লাগাতেই কেউ এসে মুখে চেপে ধরে ঘরের ভিতর নিয়ে গেলো। ঘটনা এত দ্রুত ঘটলো যে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। আত্নার সব পানি যেন শুকিয়ে গেছে। শক্তিশালী হাতটা মুখ ছেড়ে দিতেই লম্বা শ্বাস টেনে পিছনে ঘুরলো সে।
মারুফ দাঁড়িয়ে। মেজাজ খারাও হওয়ার সাথে সাথে অবাকও হলো। মারুফ পেছন থেকে সাদা গোলাপ গোলাপের তোড়া বের করতেই রাগে ভাটা পড়লো। ফুলের তোড়া নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই মারুফ কাছে টেনে নিলো তাকে। একটা ফুল কানের পাশে গুঁজে দিয়ে বলল,

– হ্যাপি বার্থডে টু দ্যাট গার্ল হু হ্যাভ বিউটি উইথ ব্রেইন। অলসো হ্যাপি বার্থডে টু মাই লাভ। তোমার জন্মদিনে আল্লাহ আমাকে তৌফিক দান করুক যাতে তোমায় সব বিপদ, কঠোরতা থেকে আগলে রাখতে পারি।

-সমাপ্ত

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-২৮

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২৮
ফারিহা জান্নাত

পৃথিশা নিচে রেডি হয়ে নামতগেই দেখলো মারুফ গাড়ি বরে করেছে। পৃথিশাকে দেখেই তাড়া দিলো,

– তাড়াতাড়ি, লেট হয়ে যাবে।

পৃথিশার এই মূহুর্তে মারুফেরসাথে যাবার কোন ইচ্ছা নেই। কিন্তু নতুন করে কোন ঝামেলা করলো না। সে মারুফের চিন্তাভাবনা বুঝতে চায়,সে কি আসলেই তার কথা বিশ্বাস করেছে কিনা এ নিয়ে সন্দিহান সে।

– কি হলো? দাঁড়িয়ে এত কি ভাবছো?

পৃথিশা চুপচাপ গাড়িতে বসলো। আজ মনে হয় রাস্তাটা দ্রুতই পেরোলো। পৃথিশাকে নামিয়ে চলে যাওয়ার সময় মারুফ বলল,

– আমি নিতে আসতে পারবো না। তুমি চলে যেও।

পৃথিশা অবাকই হলো খানিকটা। এতগুলো দিনে মারুফই তাকে দিয়ে যেতো আবার নিয়ে আসতো। পৃথিশা কিছু না বলে ভিতরে পরীক্ষা দিতে চলে গেলো।
হাজার চেষ্টা করেও পরীক্ষায় মনোযোগ দিতে পারলো না আজ। অগত্যা আগেভাগেই বের হয়ে আসলো। বাহিরে বেরিয়ে আসতেই দেখলো মারুফ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে আশেপাশে তাকাচ্ছে। পৃথিশাকে দেখেই এগিয়ে আসলো,কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,

– আজ তাড়াতাড়ি এসে পড়লে যে? শরীর খারাপ লাগছে?

পৃথিশা রোদে তাকাতে পারছে না, তবুও মুখ তুলে মারুফের দিকে তাকালো। এই লোকটাকে সে বুঝতে পারে না। কেমন ধোঁয়াশা লাগে। মারুফ আবারো প্রশ্ন করলে উত্তর দিলো, না ঠিক আছি আমি।

গাড়িতে বসে মারুফ খানিকটা শান্ত স্বরেই জিজ্ঞেস করলো,

– পৃথিশা,কেসটা রি-ওপেন কবে করতে চাচ্ছো?

চমকে উঠে মারুফের দিকে তাকালো পৃথিশা। অবাক হয়ে বলল,

– আপনি..

কথা শেষ করলো না সে। বিস্ময় কাটছে না। সে ভাবেনি মারুফ তার কথা বিশ্বাস করবে। পৃথিশাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মারুফ বলল,

– হে, আমি। কি হলো বলো?

– আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন?

– আমি তোমাকে কখনো অবিশ্বাস করি নি পৃথিশা।

ছোট্ট একটা কথা, পৃথিশার মনে চলতে থাকা সব দ্বিধাবোধ কাটিয়ে দিলো।

– পরীক্ষাটা শেষ হোক, তারপর নাহয়।

– আমার একজন পরিচিত লইয়ার আছে, তার হেল্প নিতে পারো।

– আচ্ছা, সময় হলে বলব।

গাড়ি অন্য রাস্তায় যেতেই পৃথিশা অবাক হলো। অবশেষে যে বাসার সামনে থামলো তা দেখে মারুফের দিকে তাকালে মারুফ বলল,

– আর কতদিন এভাবল ভুল বোঝাবোঝি চলবে? খালার সাথে সবটা ঠিক করে নাও। নামো তাড়াতাড়ি।

পৃথিশা নামলো। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে নামতেই দেখা হয়ে গেলো রায়ানের সাথে। পৃথিশাকে মারুফের সাথে দেখে ভ্রু কুঁচকে এদিকে আসতে গিয়েও কি মনে করে থেমে গেলো। পৃথিশা রায়ানকে দেখে মারুফের বাহু ঘেঁষে দাঁড়ালো। মিনমিনিয়ে বলল,

– ঢুকতে দেবে না।

– দেবে, আমি কথা বলেছি খালার সাথে। আসো তো।

কলিংবেল বাজাতেই রাহনুমা বেগম এসে দরজা খুলে দিলো। পৃথিশাকে দেখতে পেয়েই জড়িয়ে ধরলো। পৃথিশা হতভম্ব। রাহনুমা বেগমের কন্ঠস্বর কান্নাজড়িত,

– সরি বাচ্চা, আমি বুঝতে পারি নি তুই এতো ঝামেলার মধ্যে পড়ে যাবি।

– আই মিস ইউ খালা।

গতকাল পৃথিশার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আজই সে পুরোনো মামলার কাগজ নিয়ে বসেছে। মারুফ বলল,

– একটু রেস্ট নাও, এ কয়েকদিন তো অনেক দৌড়ঝাঁপ করলে। কিছুদিন পর নাহয় শুরু কর।

– এমনিতেই অনেক দেড়ি হয়ে গেছে, আমি আর দেড়ি করতে চাইছি না।

মারুফ বুঝলো পৃথিশাকে বুঝিয়ে লাভ হবে না।

– আচ্ছা, আপনার না কোন বন্ধু ছিল? তার সাথে আমি দেখা করতে চাই। আজ করা যাবে?

মারুফ পৃথিশার হাত থেকে কাগজগুলো সরিয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। পৃথিশা বুঝলো না হুট করে কি হয়েছে।

– পৃথিশা শোন,হাইপার হবে না। আমার কথা শোনো আগে।

– কি হয়েছে?

– জাহিন দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছে দুইদিন আগে। কোনভাবে খবর পেয়েছিলো তুমি মামলা করবে, সেজন্যই কাউকে না জানিয়ে চলে গিয়েছে। আমি আজ সকালে জানতে পেরেছি।

হতভম্ব হয়ে গেলো পৃথিশা। কি বলবে কথা খুঁজে পেলো না। বলল,

– ওকে খুঁজে আনা যাবে না?

– যাবে তো জান, সময় লাগবে। এছাড়া তুমি একা মামলা চালিয়ে গেলেই তো হবে না। আসামী পলাতক থাকলে রায় হলেও কার্যকর হবে কীভাবে?

পৃথিশা আর কিছু বলল না। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। মারুফ বুঝলো সেটা। পৃথিশার চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

– এভাবে ভেঙে পড়লে কি চলে পৃথি? এতগুলো দিন চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছো, এখন এসে হাল ছেড়ে দিলে হবে। আমরা আমাদের সব রকম চেষ্টা করবো। ডিফেন্সের লোকজনের সাহায্য নিলে ওকে সহজেই খু্ঁজেমপাওয়া যাবে। আমার পৃথি তো স্ট্রং, সে সব পারে।

_______

একটা ক্যাফেতে বসে আছে পৃথিশা,তার পাশে মারুফ। মারুফের পরিচিত লইয়ার তৌসিফের সাথে দেখা করতে এসেছে। কিছুসময় পরই তার দেখা মিললো। মারুফ উঠে গিয়ে হাত মিলালো তার সাথে। ইন্টার লাইফে বন্ধু ছিলো দু’জন, তারপরই আলাদা হয়ে যায়। আজ এত বছর পর দরকারে দেখা হলো দু’জনের। দ্রুতই কাজের কথা উঠলো। সবরকম ডকুমেন্টস দেখে তৌসিফ বলল,

– মামলা সাজানো কঠিন হবে না। তুই একদম চিন্তা করিস না মারুফ, আসামীকে যত ধরনের মামলায় জড়ানো যায় সবটাই আমি দেবো।

মারুফ মাথা নাড়লো। মাঝখান দিয়ে কথা বলে উঠলো পৃথিশা,

– কেন? হি ইজ অ্যা রে//পি//স্ট। এটা কি যথেষ্ট নয় তার শাস্তি হওয়ার জন্য? অন্যান্য মামলা দিতে হবে কেন? আমি পুরো ব্যাপারটা স্বচ্ছ চাই, কোন ছিঁটেফোঁটা মিথ্যা যাতে এখানে না থাকে।

শেষ কথাটা মারুফের উদ্দেশ্য বলল সে। মারুফ নিজেও সহমত, তৌসিফকে বলল,

– ও যা বলে তাই কর।

– কাজ হয়ে যাবে দ্রুতই।

তৌসিফের কথামতো কাজ আসলেই দ্রুত হলো। সেই সাথে খবরও ছড়ালো দ্রুত। মামলা করার তিনদিনের মাথায়ই মারুফের আত্মীয়-স্বজনের ফোন আসা শুরু করলো ঘটনা জানার জন্য। ব্যাপারটা কোনমতে সামলাতে পারলেও সামলানো গেলো না জাহিনের মা’কে। তিনি নিজের ভাইকে নিয়ে হাজির হলেন মারুফের বাসায়।

বাসায় অতিথি আসলে তাকে অবশ্যই আপ্যায়ন করতে হবে। পৃথিশা তাদের বসতে বলে চা আনতে গেলো, মারুফ বাসায় নেই। পৃথিশা জানে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিতে পারে। তাই মারুফকে ফোন করে তাদের আসার কথাও জানিয়ে দিলো। তাদের নাস্তা দিলেও তারা সরাসরি কথায় গেলেন। প্রথমেই মুখ খুললেন জাহিনের মামা, পৃথিশা অনেকদিন পর দেখলো তাকে। ভাগ্নের জন্য সদূর ময়মনসিংহ থেকে তিনি এসে পড়েছেন।

– মামলাটা তুলে নাও।

– কেন তুলবো?

জাহিনের মামা বিরক্ত হলেন। কড়া স্বরে বললেন,

– বোন তো মরে ভূত হয়েছে সেই কবে। এখনো এত তেজ কিসের তোমার? ভালোয় ভালোয় বলছি মামলা তুলে নাও, নাহলে

– নাহলে কি? কি করবেন? আমার অবস্হাও বুবুর মতো করবেন নাকি? অবশ্য একই জাত বলে কথা, কর্মও তো একই হবে।

– মুখ সামলে কথা বলো মেয়ে।

তার থেকেও দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করে উঠলো পৃথিশা,

– আপনারা কি মানুষ? নিজের ছেলে বলে এত বড় একটা অপরাধ কিভাবে ক্ষমা করেন আপনারা? আপনার তো মেয়ে আছে শুনেছি, তাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলে মানতে পারবেন? আপনাদের ছেলে মানুষ হয়, পশুর চেয়েও অধম। সে মানসিকভাবে অসুস্হ, তাই বলেই এরকম জঘন্য কাজ করতে পেরেছে।

পৃথিশার চিৎকারে তারা থেমে গেছে।পরিস্হিতি থমথমে। মারুফ কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। মারুফকে খেয়াল করে তারা কিছু বলতে চাইলে মারুফ শান্ত স্বরে বলল,

– আপনারা এবার আসুন।

মুখের উপর অপমানিত হওয়ার তারা চলে গেলেন চুপচাপ। দরজা লাগিয়ে পৃথিশার কাছে আসলো মারুফ। তাকে বুকে জড়িয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল,

– কাঁদো।

মূহুর্তেই ঝড়ঝড়িয়ে কেঁদে ফেললো পৃথিশা। বুকের কাছের শার্টটা মুচড়ে ধরে বলল,

– তারা এমন করে কেন?

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-২৭

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২৭
ফারিহা জান্নাত

গতকাল রাতের বৃষ্টির আবেশ এখনো যায় নি। পরিবেশে এখনো ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজ করছে। এই ঠান্ডার মাঝেই গরমে ঘুম ভেঙে গেলো পৃথিশার। গলার গরম শ্বাস পড়ছে অনবরত। মারুফের ভাড়ে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে সে। মারুফের কপালে হাত দিতেই বুঝলো জ্বর হালকা আছে এখনো। নিজেকে কোনমতে ছাড়িয়ে উঠতেই দেখলো শাড়ির বেহাল দশা।ভাগ্যিস তার আগে ঘুম ভেঙেছে। শাড়ি সামলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো পৃথিশা। আজ সারাদিনে মারুফের সামনে আসবে না সে।

বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসলো পৃথিশা। হাতে মনে একসপ্তাহের মতো আছে পরীক্ষার। অথচ তার পড়াই হচ্ছে না ঠিকমতো। কিছুসময় পড়ার পরই কলিংবেল বাজতে শুরু করলো, একবারও থামছে না। অনবরত বেজেই যাচ্ছে। হকচকিয়ে উটলো পৃথিশা, দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতে মারুফ হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লো। পড়নে গতরাতের টিশার্ট, মুখ ভেজা,চোখে-মুখে উদভ্রান্ত ভাব। পৃথিশা কিছু বলার আগেই মারুফ বলতে শুরু করলো,

– আমি আমি সরি পৃথিশা। কি যেন হয়ে গেলো, আমি সরি। আমার লিমিটে থাকা উচিত ছিল কিন্তু..

পৃথিশা হতভম্ব। মারুফ ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। মারুফ আবারও কিছু বলার আগেই পৃথিশা এগিয়ে তার মুখে হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো।

– আমি কি আপনাকে কিছু বলেছি?

মারুফ আড় চোখে পৃথিশার দিকে তাকালো। মেয়েটার কন্ঠস্বর লাজুক। কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।পরিস্হিতি স্বাভাবিক করতে পৃথিশা নিজেই বলল,

– আপনার জ্বর কমেছে? ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি নাস্ত বানাচ্ছি।

মারুফ চলে গেলো ফ্রেশ হতে। পৃথিশাও নিজের ফ্ল্যাট লক করে মারুফের ফ্ল্যাটে গেলো।

নাস্তা বানানোর সময় পৃথিশা গতকালকে দেখা ছেলেটার কথা মনে এলো। কাজের চাপে ভুলেই গিয়েছিলো সে। ছেলেটা মারুফের কি হতে পারে এই চিন্তাটা মাথায় হানা দিলো।
নাস্তার টেবিলে বসে পৃথিশা অন্য কোন কথায় না গিয়ে সরাসরি মারুফকে জিজ্ঞেস করলো,

– জাহিন আপনার কে হয়?

মারুফ খাওয়া থামিয়ে অবাক চোখে তাকালো।

– তুমি ওকে কি করে চিনো?

– আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন আগে।

– আমার দুঃসম্পর্ক খালাতো ভাই হয় কেন? কিছু হয়েছে?

পৃথিশা মারুফের চোখের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,

– আপনি কোনদিন আমার পরিবার নিয়ে জানতে চান নি। কেন?

– কারন হসপিটালে তুমি নিজেই বলেছিলে আঙ্কেল-আন্টি মারা গিয়েছে।

– আপনার একবারও মনে হলো না আমি একা থাকি কেন,কেন আমার কোন আত্নীয়ের বাসায় থাকি না?

– আমার এসব নিয়ে কৌতুহল হয় নি কখনো।

– কেন হয় নি?

মারুফ খাওয়া থামিয়ে পৃথিশার দিকে তাকালো। চোখে-মুখে অবাকের রেশ অথচ পৃথিশার মুখ কঠোর।

– তুমি এসব নিয়ে পড়লে কেন এখন?

পৃথিশা হুট করে বলা শুরু করলো,

– আমার একটা বোন ছিলো। আমার থেকে বছর ছয়েকের বড়। তাকে আমি বুবু বলে ডাকতাম। আমার বুবু এত সুন্দর ছিলো,এত নরম মনের মানুষ ছিলো সে। বাবার রিটায়ার্ডের পর নিজেই সংসারের হাল ধরলো। বাচ্চা একটা মেয়ে এখানে-ওখানে দৌড়াদৌড়ি করে টিউশনি করিয়ে বেড়ায়, নিজের পড়াশোনাও সামলায়। একদিন সন্ধ্যায় বুবু বাসায় আসলো না। সময় গড়ায় কিন্তু বুবু আসে না।

পৃথিশার গলা ধরে এসেছে। মারুফ পরবর্তী ঘটনার খানিকটা আঁচ করতে পেরে আঁতকে উঠছে। টেবিলে থাকা পৃথিশার হাতটা আলতো করে ধরলো সে। পৃথিশা থামলো না আবারও বলতে শুরু করলো,

– এলাকার এক ছেলে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বুবুকে বিরক্ত করতো মাঝে মাঝে। কেউ পাত্তা দেই নি আমরা। সন্ধ্যায় গড়িয়ে রাত হলে আমি আর বাবা বুবুকে খুঁজতে বের হই। জানেন, আমার বুবু দেখতে অনেক সুন্দর। এত সুন্দর মানুষ আমি আর কখনো দেখি নি। সেই বুবুকে যখন রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখি বিবস্ত্র অবস্হায় তখন আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গিয়ছিলো। আমি বিশ্বাসই করতে পারি নি এমন কিছু হবে। বুবু আমাকে সেল্ফ ডিফেন্স শিখিয়েছিলো। রাস্তার ঝোঁপে লুকিয়ে থাকা ছেলেটা যখন আমার দিকে এগিয়ে এসেছিলো আমি ছুঁড়ি দিয়ে মেরে দেই তাকে।বুবুর শোকে বাবা হার্ট অ্যাটাক করলো, আর আমি গ্রেফতার হলাম সেই ছেলেকে মারার অপরাধে। সকালে যখন আমি জেল থেকে ছাড়া পাই ততক্ষণে বাবা দুনিয়া ছেড়েছে।

পৃথিশার কান্নায় গলা ভেঙ্গে এসেছে। মারুফ উঠে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। আদুরে গলায় বলল,

– কাঁদে না সোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে।

পৃথিশা চোখ মুছে আবারও বলা শুরু করলো,

– জানেন আমি কখনো ভাবতেই পারি নি বাবা আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। এই জিনিসটা আমার কল্পনারও বাইরে ছিলো। বাবা চলে যাওয়ার পর আমি যেন আমার রূপকথার জগত থেকে বাস্তবে ছিটকে পড়লাম। আমার সবসময় শক্ত থাকা বুবু জ্ঞান ফিরার পর ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেলো। আত্নীয়-স্বজন কাউকে কাছে পাই নি জানেন। মা তো নিজেই ভেঙ্গে পড়েছিলো, আমি সব সামলাতে চেষ্টা করলাম। এলাকা পাল্টালাম, বাসা চেঞ্জ করলাম। আমার এত প্রচেষ্টা,এত আয়োজন সব এক নিমিষে ভেঙ্গে বুবু আ/ত্ন/হ/ত্যা করলো এক রাতে। যে রাতে বুবু এই জঘন্য কাজটা করলো সেদিন রাতেও সে আমাকে ভাত খায়িয়ে দিলো, চুল আঁচড়ে মাথায় তেল দিয়ে দিলো,বাঁচতে শিখালো। বিধাতা বোধহয় আমাকে একসাথে শূন্য করে দিতে চেয়েছিলো তাইতো বোধহয় মা আর বুবু একসাথেই চলে গেলো। আমার কথা কেউ ভাবলো না। এতদিন পুতুলের মতো যত্নে বড় করে, আমাকে ফেলে চলে গেলো তারা। এত ভালোবাসার মানুষ,আমার পরিবার, আমার জীবন সব এক ধাক্কায় পাল্টে গেলো শুধুমাত্র একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

পৃথিশা কাঁদছে, তার কন্ঠস্বর যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে। নিজেকে মারুফের থেকে ছাড়িয়ে পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো সে। তারপর বলল,

– এইসব কিছুর কেন্দ্রে যে সে হলো আপনার দুঃসম্পর্কের আত্মীয় জাহিন। আমার বোনের মৃত্যুর কারণ সে, আমার পরিবার ধ্বংসের কারন৷ জাহিনের মামা এলাকার এমপি,তার ভয়ে কেউ আমাদের মামলা নিতে চায় নি। তার জন্য কোন অপরাধ না করেও আমি জেলে ছিলাম।

মারুফ হতভম্ব। সে পৃথিশাকে বুঝানোর স্বরে বলল ,

– পৃথিশা,তোমার মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার কথাটা..

পৃথিশা থামিয়ে দিলো তাকে,

– এই পৃথিবীতে আমি যে মানুষটাকে সর্বোচ্চ ঘৃণা করি, তাকে চিনতে আমার ভুল হবে না কোনদিন। এই ব্যাপারে আমি কোন এক্সপ্লেইনেশন শুনতে চাই না, আপনার কোন মতামত-ও চাই না। আপনাকে জানানোর দরকার ছিলো তাই বললাম। খুব শীঘ্রই আমি আবার কেসটা রি-ওপেন করবো। শুধু পরীক্ষাটা শেষ হোক।

– যদি তোমার ভুল হতে থাকে তবে?

রাগের পারদটা তরতরিয়ে ভেড়ে গেলো পৃথিশার। টেবিলে বাড়ি দিয়ে চিৎকার করে বলল,

– আমার পরিবারের খুনিকে চিনতে আমার ভুল হবে? ডা. আহমেদ, আপনি হয়তোবা ব্যাপারটার গভীরতা এখনো বুঝে উঠতে পারেন নি নয়তো বুঝেও না বুঝার ভান করছেন কারন যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে আপনার ভাই।

– তুমি চিৎকার করছো কেন পৃথিশা। আমি তোমার কথা বিশ্বাস করেছি, কিন্তু এই বিষয়ে আমি এখন কোন কথা বলতে চাই না। রেডি হতে যাও,তোমার পরীক্ষা আছে।

মারুফ কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে গেলো। মারুফ যেতেই পৃথিশা দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লো, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অনবরত। মারুফের এহেন আচরণ তার আশাযোগ্য ছিলো না। মারুফকে বিচক্ষণ ভেবেছিলো সে, ভেবেছিলো মারুফ ব্যাপারটা খতিয়ে দেখবে কিন্তু তার কথায় ধোঁয়াশা।

– বুবুর বিচারের জন্য যদি আপনাকে ছাড়তে হয় সেটাতেও আমি রাজি আছি ডাক্তার, কত কিছুই তো হারিয়েছি এবার নাহয় আপনাকে ছাড়লাম।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-২৫+২৬

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২৫
ফারিহা জান্নাত

কান্না থেমে গেছে পৃথিশা। এখনও থেমে থেমে নাক টানছে। তার মাথতা মারুফের বুকের কাছে। পৃথিশার কান্নায় শার্ট ভিজে গেছে কিছুটা। নিজের অবস্হান খেয়াল করতেই লজ্জায় পড়ে গেলো পৃথিশা। হালকা নড়াচড়া করতেই মারুফ হাতের বাঁধন হালকা করলো। পৃথিশা সরে এসে ওড়নায় নাক মুছলো। কেউই কিছু বলছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মারুফ বলে উঠলো,

– তোমার কোল্ড অ্যালার্জি আছে পৃথিশা? নাক টানছো কেন এতো? দেখি এদিকে আসো।

রিমোট নিয়ে এসিটা অফ করে দিলো মারুফ। পকেট থেকে রুমাল বের করে পৃথিশার হাতে দিয়ে ইশারা করলো নাক মুছে নিতে। পৃথিশা রুমাল হাতে নিয়ে বসে রইলো। নিজের প্রতি কেমন বিরক্ত লাগছে। কি এমন হয়েছিলো যে পৃথিশাকে কেঁদে ফেলতে হলো, এরথেকে বড় আঘাত কি সে পায় নি নাকি!পেয়ছে তো, তাহলে আজ কেন মারুফের সামনে কেঁদে ফেললো। পৃথিশার ভাবনার সুডতা কাটলো মারুফের কন্ঠস্বরে।

– তুমি কফি খাও? এখানে চা পাওয়া যায় না।

– আমি বাসায় যাবো।

– পরে যাবে,আমার সাথে।এখন বসো এখানে চুপচাপ।

– আমি এখানে থেকে কি করবো? অযথা সময় নষ্ট, আমার পড়া আছে।

মারুফ চেয়ার টেনে পৃথিশার মুখোমুখি হলো। পৃথিশর দিকে মাথা ঝুঁকালে পৃথিশা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়।

– আমাকে দেখো বসে বসে, যেহেতু তোমার কোন কাজ নেই।

চোখ বড় বড় হয়ে গেলো পৃথিশার। নিজের চেয়ারটা টেনে পিছিয়ে গেলো খানিকটা। গলা ঝেড়ে বলল,

– কফি খাবো।

সশব্দে হেসে দিলো মারুফ।

– আমার সাথে কথা ঘুরিয়ে তুমি পার পাবে না পৃথিশা।

পৃথিশা কেবিনের এক কোণায় বসে পড়ছে। এদিকে মারুফ তার নিজের কাজ করছে।পৃথিশা বুঝে পেলো না ওকে বসিয়ে রেখে মারুফের লাভ কি হচ্ছে। মারুফ হুট করেই উঠে পৃথিশাকে বলল,

– পড়া বন্ধ করো। আমার সাথে এসো।

পৃথিশা ভাবলো বাসায় যাবে বোধহয়। কিন্তু না মারুফ পৃথিশাকে নিয়ে গেলো টেস্ট করাতে। পৃথিশা না করলেও শুনলো না। পরপর এতগুলো টেস্ট করে ক্লান্ত হয়ে গেলো পৃথিশা। মেজাজ চটে গেলো তার। টেস্ট করা শেষে মারুফ তাকে এনে গাড়িতে বসিয়ে আবার কোথাও যেন চলে গেছে। কিছুসময় পরই মারুফ গাড়িতে বসলে পৃথিশা দাঁত চিবিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

– আপনার টাকা কি বেশি হয়ে গেছে?

– কেন? কি হলো?

– এতগুলো টেস্ট করালেন কেন?

– বউয়ের পিছনে খরচ করছি, তোমার গায়ে লাগছে কেন?

পৃথিশা হতভম্ব। এই লোক বিরাট চালু। রাগ উঠে গেলো তার।গাড়ির দরজা খুলার চেষ্টা করে বলল,

– আচ্ছা, আপনি তাহলে আপনার বউ নিয়েই থাকেন। আমি যাই।

মারুফ পৃথিশার হাত টেনে আবার গাড়িতে বসিয়ে দরজা লক করে দিলো। পৃথিশার ফুলো ফুলো গাল দু’টো টেনে বলল,

– আহারে, থাক রাগ করে না।

আর রেগে থাকতে পারলো না পৃথিশা। মুখ ঘুরিয়ে ফেললো, চাপা হাসিতে ছেয়ে গেলো তার মুখ।

– এতগুলো টেস্ট করানোর সত্যি কি কোন দরকার ছিলো?

– প্রেশার,সুগার সব তলানিতে রেখে এসে জিজ্ঞেস করছো কেন টেস্ট করিয়েছি? খাওয়া-দাওয়া করতে কি কষ্ট হয়ে যায় খুব বেশি? সারাক্ষণ অনিয়ম শুধু।

মারুফের গলার স্বর হুট করেই গম্ভীর হয়ে গেলো। পৃথিশা বিপরীতে কিছু বলার সুযোগ পেলো না। বাসায় পৌঁছাতেই পৃথিশা নিজের বাসায় ও মারুফ তার বাসায় চলে গেলো। পৃথিশাকে মারুফ থাকতে বললেও পৃথিশা না করে দেয়। নিজেকে তার এখন সামলানো প্রয়োজন।

_____

অনবরত কলিংবেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো পৃথিশার। বুঝে নিলো মারুফই এসেছে। এক সপ্তাহ হতে চললো বিয়ের। পৃথিশা এখনো আলাদাই থাকে। দরজা খুলতেই দেখলো মারুফ হাতে বাজার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুমে এখনো চোখ খুলতে পারছে না পৃথিশা। মারুফ দরজার পাশে বাজারের ব্যাগ রেখে বলল,

– পৃথিশা আমার খালারা আসছে আজ। তারা বিয়ের খবর পেয়েছে কোনভাবে। আমার সাথে বাসায় চলো, ওনারা আলাদা দেখলে খারাপ ভাববে।

কথাগুলো পৃথিশার কানে গেলো না মনে হয়। সে তখনো ঘুমে ঢলছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো মারুফ, কপাল গুণে বউ পেয়েছে যার ঘুম পেলে দিন-দুনিয়ার হুঁশ থাকে না। পৃথিশাকে টেনে নিজের বাসায় নিয়ে পৃথিশার বাসাটা লক করে দিলো সে। এসে দেখলো পৃথিশা সোফায় বসে ঢুলছে। পৃথিশাকে নিয়ে বেডরুমে রেখে নিজে রান্নার কাজে লেগে পড়লো।

ঘন্টাখানেক পর পৃথিশার ঘুম ভাঙলে নিজেকে এই বাসায় দেখে অবাক হলো। ঘুমের ঘোরে থাকায় তখন কিছুই টের পায় নি। গায়ে ওড়না জড়িয়ে বাহিরে গিয়ে দেখলো মারুফ রান্নাঘরে কি যেন করছে। চোখে-মুখে পানি দিয়ে সেদিকে যেতেই দেখলো এলাহি কান্ড। মারুফ নাস্তা বানিয়ে একপাশে রেখেছে। রোস্টে করার জন্য মাংসগুলো ভেজে তুলে রাখছিলো তখন। গায়ে কিচেন এপ্রোণ পড়া। গরমের তাপে চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। পৃথিশা বিস্মিত হয়ে দেখলো তাকে, এই ছেলে সবকিছুতে এক্সপার্ট! “বাহ্ পৃথিশা, কি সুন্দর ভোলাভালা জামাই তোর” নিজেই নিজেকে বাহবা দিলো পৃথিশা। পরক্ষণেই নিজের চিন্তায় অবাক হলো। মারুফ এতক্ষণ পর পৃথিশাকে খেয়াল করলো। চুলার আঁচ কমিয়ে পৃথিশাকে বলল,

– তুমি এখানে গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছো কেন? নাস্তা করো নি তো, এসো নাস্তা করবে।

– আপনি এতসব করছেন কেন? আজ কি কিছু আছে? আমি এখানে এলাম কিভাবে?

মারুফ পৃথিশার অবুঝ চাহনি দেখে বুঝলো তার বউয়ের কিছুই মনে নেই। নাস্তার প্লেটটা হাতে নিয়ে পৃথিশাকে রান্নাঘর থেকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

– ওমাহ্, তোমার কিছুই মনে নেই? আমরা যে একসাথে থাকলাম সারারাত। সব ভুলে গেলা? হ্যাঁ?

মারুফের কন্ঠস্বর কৌতুকময়। পৃথিশা রেগে মারুফের পেটে গুঁতা দিলে, শব্দ করে হেসে দিলো সে।

– আমি নিয়ে এসেছি বউ। এখন কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ নাস্তা করো।

মারুফ কথা বলতে না বললেও পৃথিশা থামলো না। আবারও জিজ্ঞেস করলো,

– আপনি এত আয়োজন করছেন কেন? কে আসবে?

– আমার খালারা আসবে।কাছের আত্মীয় বলতে তারাই আছে। আমি আসলে জানাই না কাউকে বিয়ের খবরটা। কিন্তু বাড়িওয়ালার কাছ থেকে যেন খবর পেয়ে গেছে। এখন আজকে তারা আসছে। তোমাকে আলাদা থাকতে দেখলে কথা বলবে নানা রকম,তাই তোমাকে নিয়ে এলাম।

পৃথিশা আবারও কিছু বলতে চাইলে মারুফ পাউরুটি তার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,

– আর কোন কথা না।

খাওয়া শেষ করে পৃথিশা এসে দেখে মারুফ এখনো রান্না করছে। পৃথিশা প্লেটটা সিঙ্কে রেখে এগিয়ে গেলো তার দিকে। তাকে ঠেলেঠুলে সরানোর চেষ্টা করে বলল,

– আপনি সরুন,অনেক করেছেন।এবার আমি করি। সরুন না, উফ্ এত ভারী কেন আপনি?

হাজার চেষ্টা করেও মারুফকে সরাতে পারলো না পৃথিশা। শেষমেষ মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মারুফ হেসে বলল,

– কি ব্যাপার,শক্তি শেষ?

পৃথিশা কথা বলল না। টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু এনে মারুফের দিকে এগিয়ে দিলে মারুফ ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি করবে। পৃথিশা বলল,

– ঘাম মুছে নিন।

মারুফ মাথা ঝুঁকিয়ে দিলো যার অর্থ তুমি মুছে দাও। পৃথিশা ইতস্তত করে ঘামটুকু মুছে দিয়ে বলল,

– অনেক তো হলো।এবার আমাকে করতে দিন, আপনি ক্লান্ত হয়ে গেছেন। আমি পারব তো।

পৃথিশার জোরাজুরিতে অবশেষে মারুফ সরলো। আসলই অনেক ক্লান্ত লাগছিলো। রান্নাঘর থেকে বেরোনোর আগে পৃথিশাকে বলে গেলো,

– চুলার আঁচ বেশি বাড়াবো না। ওড়না সামলে রাখবে, আর ছুঁড়ি ধরবে না। দূরে দাঁড়িয়ে কাজ করো।

মারুফের দিকে হাতশ হয়ে তাকালো পৃথিশা। লোকটা তাকে কি মনে করে? বাচ্চা নাকি সে? একা একা থাকে, নিজের রান্না তো নিজেকেই করতে হয়। তবুও পৃথিশার বহুদিন পর এই শাসন পেয়ে ভালো লাগলো।ভদ্র বাচ্চার মতো মাথা নাড়িয়ে বলল,

– আচ্ছা, আপনি এখন যান তো।

মারুফ চলে গেলো। তবে বেশিক্ষণ রেস্ট নিলো না, আধ ঘন্টা পরই আবারো ফিরে আসলো। অতঃপর দু’জনে মিলে রান্নাটা শেষ করে নিলো। এখন বাকি শরবত বানানো। পৃথিশা এটার জন্য বটি দিয়ে লেবু কাটতে নিলেই মারুফ হালকা স্বরে চিৎকার করলো। চমকে উঠলো পৃথিশা। মারুফ দ্রুত এগিয়ে এসে পৃথিশাকে সরিয়ে ধমকে বলল,

– তোমাকে না বললাম এগুলো ধরবে না। তাও কেন ধরেছো?

পৃথিশা কিছু বলল না। বিস্মিত হয়ে মারুফের দিকে তাকিয়ে রইলো।মারুফ আবারো জিজ্ঞেস করলো,

– কোথাও কেটেছে? কথা বলছো না কেন?

– আমি ছোট বাচ্চা না, এগুলো করে অভ্যাস আছে আমার। আপনি হাইপার হয়ে যাচ্ছেন কেন?

মারুফ শান্ত হলো খানিকটা। পৃথিশাকে সরিয়ে বললো,

– আচ্ছা, তুমি এখন যাও। বাকিটা আমি করে নিচ্ছি। ওরা এসে পড়বে। গোসল করে নাও।

পৃথিশা আর কথা না বাড়িয়ে চলে যেতেই মারুফ তাকে থামিয়ে বললো,

– আচ্ছা, একটু দাঁড়াও। আমিও আসছি।

হতভম্ব হয়ে গেলো পৃথিশা। আমিও আসছি মানে কি? লোকটার কি গরমে মাথা খারাপ হয়ে গেলো। মারুফ এগিয়ে আসলে পৃথিশা দু’কদম পিছিয়ে গেলো। মারুফ বুঝলো না কিছুই।

– কি হয়েছে?

– কি হবে? কিছুই হয় নি।

পৃথিশার কথা আটকে যাচ্ছে। মারুফের চোখ দেখে বুঝলো পৃথিশা যা ভেবেছে মারুফ সেটা মিন করে বলে নি। পৃথিশা চুপচাপ সোফায় ফ্যানের নিচে গিয়ে বসলো। এত গরম পড়েছে, রান্নাঘরে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। মারুফ একটা প্যাকেট নিয়ে পৃথিশার সামনে আসলে পৃথিশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। মারুফ তার হাতে এটা দিয়ে বলে,

– এটা আমার দাদীর শাড়ি। আম্মু পেয়েছিলো উত্তরাধিকার সূত্রে। বাড়ির বউকে দেখতে আসলে এই শাড়ি পড়তো।

পৃথিশা চুপচাপ হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিয়ে নিজের বাসায় যেতে নিলেই মারুফ বললো,

– তোমার সমস্যা হলে পড়া লাগবে না।

– আমি কি একবারও বলেছি আমার সমস্যা হবে?

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২৬
ফারিহা জান্নাত

বাড়িভর্তি মামুষের মাঝে অতি পরিচিত ঘৃণিত মানুষের মুখশ্রী দেখে মাথাটা যেন ঘুরে উঠলো পৃথিশার। কোনমতে টলমলে পায়ে বাড়ির গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই মারুফ তাকে দেখে বলল,

– এই তো পৃথিশা এসে পড়েছে।

পৃথিশার পড়নে মারুফের দেওয়া শাড়ি, চুলগুলো আলগা করে খোপা করা, চুলের পানিতে ব্লাউজ ভিজে গেছে খানিকটা। মাথায় আঁচল টেনে পৃথিশা মারুফের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শুরু হলো। পৃথিশা বুঝতে পারছে না কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ তার পরিবার সম্পর্কে কোন কিছু জানতে চায় নি। ব্যাপারটা তার কাছে বিস্ময়কর ঠেকছে। পুরো বাসা মানুষে ঠাসা। খাবার টেবিল এমনিতেই ছোট, পুরো সোফার রুম জুড়ে মানুষ বসেছে। কাজ করার মধ্যেও এত মানুষের ভীড়ে পৃথিশার চোখ বারবার কাঙ্খিত মানুষটাকে খুঁজছে। তবে পেলো না কোথাও। অবশেষে আস্তে ধীরে মানুষ যাওয়া শুরু করলে পৃথিশা মারুফকে খুঁজে পেলো। মারুফ তাকে দেখেই দূর থেকে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? পৃথিশা উত্তর দিলো না। মারুফের কাছে গিয়ে তার পাঞ্জাবি মুঠ করে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। খুব অস্হির লাগছে তার।
মারুফ বুঝে উঠতে পারলো না কি হয়েছে হুট করে। তবুও পৃথিশাকে নিজের সাথেই রাখলো পুরোটা সময়।

সবাই চলে যাওয়ার পর পৃথিশা ও মারুফ খেতে বসলো। এতক্ষণ সুযোগ হয় নি। খেতে বসেই মারুফ জিজ্ঞেস করলো,

– পৃথিশা? কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?

– হু?

পৃথিশা অন্যমনস্ক ছিলো। মারুফের কথা খেয়াল করে নি ঠিকমতো। মাথায় অন্যকিছু ঘুরছে। একটু আলাদা থাকতে চায় সে। সেজন্যই বলল,

– আচ্ছা, আমি পরে খাই। পেট ভরা ভরা লাগছে।

– চুপচাপ বসো। এক পা-ও নড়বে না।

মারুফ প্লেটে খাবার বাড়ার জন্য হাত উঠাতেই পৃথিশার নজরে এলো হাতের তালু জুড়ে থাক বড় ব্যান্ডেজ। হকচকিয়ে মারুফের দিকে তাকাতেই মারুফ তার দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের হাতের দিকে তাকালো। পরপরই হাতটা নিচে রেখে মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলল,

– কিছুই হয় নি।

পৃথিশা শুনলো না। হতভম্ব হয়েই হাতটা জোর করে নিজের দুই হাতের মাঝে নিলো। বটি দিয়ে কিছু কাটতে গিয়ে পুরো তালু কেটে গেছে নিশ্চয়ই। মূহুর্তেই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেলো পৃথিশার। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

– আমাকে না বললেন আমি পারব না, এগুলো যাতে না ধরি। আপনি কি করেছেন এটা?

মারুফ উত্তর দিতে পারলো না। মেয়েটার কান্না দেখে সে নিজেই অবাক হয়ে গেছে। বড় বড় চোখ দুটোতে পানি আসলে এত সুন্দর দেখায়। পৃথিশা চোখের পানি মুছে ফেললে মারুফের মনে হলো সে আরেকটা হাত কেটে নিয়ে এসে আবারও তাকে কান্না করাক। তার সেই কল্পনা অবশ্য বাস্তবে পরিণত হলো না পৃথিশার কথায়। সে অনবরত মারুফকে ধমকেই যাচ্ছে।

ঠোঁটের উপর শক্ত পুরুষালি হাতের স্পর্শ টের পেতেই শক্ত হয়ে গেলো পৃথিশা। চোখজোড়া আপনাআপনিই বড় আকার ধারণ করলো, হৃদপিণ্ডের গতি হলো লাগামছাড়া। কিছু বলার শক্তি পেলো না আর।

– কথাটা একটু বন্ধ রাখেন মহারানী, ইচ্ছা করে কাটি নি তো।

মারুফ ঠোঁট থেকে হাত সরালে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো পৃথিশা। নিজেই খাবার বাড়তে শুরু করলো। তবে মারুফের ডান হাত কাটায় কিভাবে খাবে তা নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হলো। শেষমেশ পৃথিশা নিজেই প্লেট থেকে খাবার তুলে মারুফের মুখের সামনে ধরলো। ইশারায় মুখ খুলতে বলতেই বাধ্য ছেলের মতো পৃথিশার হাতে খেয়ে নিলো সে।

______

বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিকালের দিকেই নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এসেছিলো পৃথিশা। এখন রাত প্রায় দশটা বাজতে চললো। হুট করে কারেন্ট চলে গেলে ভয় পেয়ে গেলো পৃথিশা। বাসায় একটা মোমবাতিও নেই যে জ্বালাবে। অগত্যা মারুফের ফ্ল্যাটেই যেতে হলো তাকে।

কয়েকবার বেল বাজানোর পরও দরজা খুললো না কেউ। পৃথিশার চিন্তা হলো, মারুফ তো একবার বেল বাজালেই দরজা খুলে দেয়। পৃথিশার কাছে একটা এক্সট্রা চাবি ছিলো, মারুফ দিয়েছিলো যাতে প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। সেটা দিয়েই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো সে। বাসায় আইপিএস আছে, তাই এখানে বোঝার উপায় নেই যে কারেন্ট গেছে। ঘরের লাইট-ফ্যান সব ছাড়া। পৃথিশা সেগুলো অফ করে মারুফের রুমের দিকে গেলো। দরজা লাগানো, নব মোচড়ে ভেতরে ঢুকতেই গা হিম হয়ে এলো তার। ঘুটঘুটে অন্ধকার,এসি ছেড়ে পুরো রুম ঠান্ডা করে রাখা হয়েছে। পৃথিশা জলদি এসি অফ করে লাইট জ্বালালো। কম্বল গায়ে শুয়ে আছে মারুফ। মাথাটা পর্যন্ত কম্বলের ভিতর ঢুকানো। পৃথিশা এগিয়ে কপালে হাত রাখতেই মনে হলো যেন আগুনের তাপ লেগেছে গায়ে। হুট করে মারুফের এত জ্বরের কারন বুঝতে পারলো না সে। কয়েকবার ডাকলেও মারুফ যখন সাড়া দিলো না তখন বুঝলো জ্বরে জ্ঞান হারিয়েছে।
চটজলদি জ্বরপট্টি দেওয়ার ব্যবস্হা করলো সে। কিন্তু জ্বর না কমায় মাথায় অনবরত পানি ঢেলে গেলো। অবশেষে আধঘন্টা পর শরীরের তাপমাত্রা কমলে স্বস্তির শ্বাস ফেললো সে। মগ, বালতি সরিয়ে মারুফকে ঠিকমতো শুয়িয়ে
দিলো। পড়নে এখনো শাড়ি, আঁচলের দিকটা ভিজে গিয়েছে।

মারুফকে এবার কয়েকবার ডাকতেই চোখ মেলে তাকালো সে। ঠিকমতো চোখ মেলতে পারছে না তবুও আধো আধো স্বরে বলল,

– পৃথি?

– হু, এত জ্বর এলো কীভাবে আপনার?

মারুফ উত্তর দিলো না। হাত বাড়িয়ল পৃথিশাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। পৃথিশা মুখটা একটু এগিয়ে নিলে মারুফ হালকা করে ছুঁয়ে বলল,

– সত্যি তুমি?

– সত্যিই আমি। এবার আপনি উঠুন, ঔষধ খেতে হবে।

মারুফ উঠলো না। গা ছেড়ে পড়ে রইলো। পৃথিশা তাড়াতাড়ি হালকা খাবার এনে মারুফকে খাওয়ানোর জন্য উঠাতে চাইলো। কিন্তু মারুফ শরীর শক্ত করে আছে। সে উঠবেই না। পৃথিশা মাথা ঝুঁখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

– কি সমস্যা আপনার?

পৃথিশা আরও কিছু বলার আগেই ঠোঁটজোড়া আটকে গেলো। মারুফের জ্বর যেন এবার পৃথিশার মধ্যেও ছড়িয়ে পড়লো। শরীরে সমস্ত শক্তি যেন শেষ হয়ে গেছে। ভারসাম্যহীন হয়ে যেতেই আরও আঁকড়ে ধরলো মারুফ। খানিকক্ষণ পর মারুফের গম্ভীর স্বরে বলল,

– পৃথিরানী?

পৃথিশা জবাব দিতে চাইলো, গলায় মারুফে গভীর স্পর্শ পেতেই চুপ হয়ে গেলো পুরোপুরি।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-২৪

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২৪
ফারিহা জান্নাত

সূর্যের আলো মুখের উপর পড়তেই ঘুম ভেঙে গেলো পৃথিশার। অপরিচিত জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করতেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো তার। গায়ের উপর পাতলা কাঁথা দেওয়া। কাঁথা সরিয়ে ওড়না ঠিক করে উঠে বসলো সে। পুরো বিছানায় সে একা। সোফায় চোখ যেতেই দেখলো মারুফ সেখানে বসে ঘুমাচ্ছে দেয়ালে মাথা রেখে। কাল রাতের কথা মনে করার চেষ্টা করলো পৃথিশা। খাওয়ার পর ঔষুধ খেতেই ঘুম পেয়ে যায় তার। ঘুমের তীব্রতা এতই বেশি ছিলো যে সে কিভাবে বেডরুমে এসেছে তা মনে করতে পারলো না। বিছানা থেকে নামতেই পা’টা ভারী ঠেকলো। তাকাতেই দেখতে পেলো সুন্দর ঝকমকে নূপুর। কিন্তু তার পায়ে তো নূপুর ছিলো না, তবে মারুফ দিয়েছে বোধহয়। নূপুরের শব্দ পৃথিশার খুব পছন্দ। পা নাড়িয়ে বারকয়েক শব্দ করতেই মারুফের ঘুম ভেঙে গেলো শব্দে।
এতক্ষণ সোফায় থাকায় ঘাড় ব্যাথা করছে। পৃথিশা মারুফকে দেখে উঠে দা্ড়ালো। আস্তে করে বলল,

– সরি,আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।

– ব্যাপার না, দশটা বাজতে চলল।এমনিতেও উঠতে হতো। ডিউটি আছে আজ।

মারুফ খেয়াল করলো পৃথিশা কিছু বলতে চাচ্ছে। নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করলো,

– কিছু বলবে পৃথিশা?

– আপনি দিয়েছেন?

পায়ের নূপুরজোড়া দেখিয়ে বলল পৃথিশা। মারুফ পৃথিশার দিকে এগোলে পৃথিশা পেছিয়ে যায়। মারুফ হেসে আরেকটু এগিয়ে পৃথিশার চুলগুলো গুছিয়ে দিতে থাকে। পৃথিশা অবাক হলো মারুফের কান্ডে। আবারও জিজ্ঞেস করলো,

– কি হলো বললেন না?

পৃথিশা নিজে থেকেই মারুফের কাছ থেকে সরে গেলো। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে যেন। মারুফ হেসে বলল,

– মায়ের নূপুর এগুলো। তিনি পেয়েছিলেন দাদির কাছ থেকে বড় বউ হিসেবে। মা বেঁচে থাকলে হয়তোবা তিনিই দিতেন। তিনি যেহেতু নেই তাই আমি দিলাম। তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে তো তাই দেখতে পাও নি কখন দিয়েছি।

পৃথিশা কিছু বলল না আর। মারুফ ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গেলে বিছানা গুছিয়ে রাখলো সে। এ বাসার কিছুই তেমন চিনে না সে। রুমের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখতে পেলো একপাশে বেলকনি। জলদি পা চালিয়ে বেলকনিতে গেলো সে। অনেক গাছ সেখানে। মনটা নিমিষেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো পৃথিশার।

– গাছ খুব পছন্দ বুঝি?

চমকে উঠলো পৃথিশা। তার থেকে একহাত দুরত্বে মারুফ দাঁড়িয়ে। পৃথিশা আবারও গাছে ব্যস্ত হয়ে ফুলগুলো দেখতে দেখতে বলল,

– খুব পছন্দ। জানেন,আমার বুবুও গাছ খুব পছন্দ করতো।

পৃথিশা হুট করে চুপ হয়ে গেলো। মারুফ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলে উঠলো,

– আচ্ছা, আমাকে এখন বাসায় যেতে হবে।পরীক্ষা আছে কোচিংয়ে।

মারুফ ইশারায় সম্মতি দিতেই পৃথিশা বেরিয়ে গেলো জলদি। অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো সে। যদিও পড়া হয় নি কিছুই। কিন্তু যা আছে কপালে দেখা যাবে। গ্যারেজে আসতেই দেখলো মারুফ গাড়ি বের করছে।পৃথিশাকে দেখে জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলল,

– জলদি আসো, লেট হয়ে যাচ্ছে।

পৃথিশা কোন বাক্য ব্যয় না করে সামনের সিটেই বসে পড়লো। বইটা খুলে তাতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলো। হুট করে গাড়ি থামলে পৃথিশা ভাবলো বোধহয় তারা এসে পড়েছে। কিন্তু অপরিচিত জায়গা দেখে অবাক হলো। মারুফকের সিটে তাকালে দেখলো সে সিটবেল্ট খুলে বাহিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

– তুমি বসো আমি আসছি, একটু সময় লাগবে।

পৃথিশা আবারও পড়ায় মন দিলো। খুব তাড়াতাড়িই মারুফ ফিরে এলো।হাতে প্যাকেট। পৃথিশার দিকে প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

– পরে পড়বে, আগে খেয়ে নাও।

– আমি খাবো না এখন।

– পৃথিশা,

মারুফের গম্ণীর কন্ঠস্বর। পৃথিশা চুপচাপ প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খেতে শুরু করলো, ভেতরে চিকেন রোল। পৃথিশা নিজে খেতে খেতে কি মনে করে মারুফের দিকে এগিয়ে দিতেই মারুফ ড্রাইভ করার মাঝেই খেয়ে নিলো।
পৃথিশাকে কোচিংয়ে নামিয়ে দিয়ে মারুফ চলে গেলো, সাথে বলে গেলো সে এসে নিয়ে যাবে।

পরীক্ষা শেষ করে পৃথিশা বাহিরে আসতেই দেখলো রাহনুমা বেগম দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই তিনি দৌড়ে আসলেন এদিকে। পৃথিশাও কালবিলম্ব না করে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রাহনুমা বেগমের দিকে তাকাতেই তিনি হেসে বলল,

– আরে পাগলি মেয়ে,কাঁদছিস কেন?

– কাঁদি না তো।

পৃথিশা চোখ মুছলো। পেছন থেকে ‘পৃথিশা’ ডাক ভেসে আসলে দুজনেই সেদিকে ফিরলো। মারুফ দাঁড়িয়ে আছে। আপ্রোণ পড়া, চোখে সানগ্লাস। গাড়ির সাথে দাঁড়িয়ে হাত উচিয়ে পৃথিশাকে ডাকছে। রেহনুমা বেগম মারুফকে চিনতে পারলেন না। অবাক হয়ে পৃথিশাকে জিজ্ঞেস করলেন,

– ছেলেটা তোকে ডাকছে কেন? তাকে চিনিস তুই?

পৃথিশা থমকালো খানিকটা।কি জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। মারুফ এখনো জানে না তার জন্যই পৃথিশা বাড়ি ছেড়ে এসেছে। এখন খালাকে কিছু বলতেও সে চাচ্ছে না। অবশেষে বাধ্য হয়ে বলল,

– খালা, আমি তোমাকে ফোনে বিস্তারিত জানাবো। এখন আমাকে যেতে হবে। তুমি কিভাবে এসেছো? গাড়ি নিয়ে?

রেহনুমা বেগমের দৃষ্টি অন্যরকম। তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না পৃথিশা কি করছে এই ছেলের সাথে। তিনি পৃথিশার কথার উত্তর না দিয়ে আবারও বললেন,

– পৃথিশা,আমাকে সত্যি করে বল এই ছেলে কে?

ততক্ষণে মারুফ এগিয়ে এসেছে। পৃথিশাকে অন্য একজের সাথে দেখে কিছুক্ষণ ইতস্তত করলেও পরে এগিয়ে গেলো। রেহনুমা এবার মারুফের দিকে তাকালেন। তাকেই জিজ্ঞেস করলেন,

– তুমি কে?

মারুফ পৃথিশার দিকে তাকালো। পৃথিশাও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কিছুসময় দৃষ্টি বিনিময়ে কাটার পর পৃথিশা নিজ থেকেই বলল,

– খালা, আমার হাজব্যান্ড, মারুফ আহমেদ।

রেহনুমা ভয়ংকর রকমের চমকে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিশার থেকে দুই পা পিছিয়ে গেল তিনি। পৃথিশা তাকে বুঝানোর স্বরে বলল,

– খালা, আমার কথাটা শুনো..

– তারমানে রায়ান ঠিক ছিলো? তাইনা?

– না খালা, আমি বলছি তোমাকে সবটা।

– থাক, তোর আর কিছু লাগবে না। আমি বুঝেছি সবটা। আসলে মানুষ ঠিকই বলে পরকে এতটা মাথায় তুলতে নেই। তোকে আমি এখানে এনেছিলাম পড়াশোনার জন্য, নিজে যাতে কিছু হতে পারিস এজন্য। কিন্তু তুই কিনা।

– খালা, আমার কথাটা শুনো প্লিজ।

পৃথিশার স্বর কান্নারত। ইতিমধ্যেই চোখ পানিতল টইটুম্বুর

– কিছু শুনবো না আমি। অসভ্য মেয়ে, তুই এরকম এটা বুঝা উচিত ছিলো আমার। নাহলে কি আর তোর বোনের সাথে এরকম কিছু হয়েছে..

– খবরদার খালা, এই ভুলটা করবে না। আমি তোমার পায়ে পরি নি আমায় এখানে আনার জন্য। তুমিই এনেছো। আমি কৃতজ্ঞ এজন্য, সবসময় থাকবো। কিন্তু ভুলেও বুবুকে নিয়ে কোন বাজে কথা উচ্চারণ করবে না তুমি।

পৃথিশার গলার স্বর উঁচু, আশেপাশের অনেকে আড়চোখে দেখছে। মারুফ এগিয়ে বলল,

– পৃথিশা, কি হয়েছে? এতো হাইপার হচ্ছো কেন? চলো আমার সাথে।

মারুফ পৃথিশাকে জোর করেই নিজের সাথে নিয়ে গাড়িতে বসালো। বাসায় না নিয়ে নিজের হাসপাতালেই নিয়ে গেলো। পুরোটা সময় পৃথিশা চুপ থাকলো। মারুফ জলদি তাকে নিজের কেবিনে নিয়ে বসালো। পানি এগিয়ে দিলে পৃথিশা নিলো না। মারুফ গ্লাস রেখে পৃথিশার পাশে বসলো। কোমল স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,

– কি হয়েছে পৃথিশা? আমাকে বলো?

মূহুর্তেই হাউমাউ করে কেঁদে দিলো পৃথিশা। চমকে গেলো মারুফ। মেয়েটার কান্নায় কেমন দমবন্ধ লাগছে। পৃথিশাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলে কান্না যেন আরও বাড়লো পৃথিশার। অস্পষ্ট স্বরে শুধালো,

– আমি কি করেছি? আমাকে এমন বলে কেন?

মারুফ কোন কথা বললো না। চুপচাপ পৃথিশাকে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখলো। তাকে সামলে উঠার সময় দিলো। মাথায় শক্ত হাতটা রেখে বুঝিয়ে দিলো, আমি আছি তোমারই পাশে।

চলবে,