Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 103



সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-২০+২১

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২০
ফারিহা জান্নাত

পৃথিশার মৃদু চিৎকারে চোখে থাকা ঘুমটুকুও ছুটে গেলো যুবকটির। তার চোখের দৃষ্টি উদভ্রান্ত, পড়নে কালো টিশার্ট। চোখ-মুখ কঁচলে পৃথিশাকে দেখে তার ভ্রু সহসাই কুঁচকে গেলো। চমকিত গলায় বলল,

– তুমি?এখানে কিভাবে আসলে?

পৃথিশা নিজেও অবাক হয়েছে চরমভাবে। ফেনটা বের করে ম্যামের নাম্বারে কল করতেই ফোনের টিউন শোনা গেলো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টি পৃথিশার চোখে, পৃথিবী এত ছোট।

– আপনি? আপনি রোজ ম্যামের ছেলে ডা. মারুফ? মানে ম্যাম আপনার মা?

– ম্যামের ছেলে আমি হলে, উনার তো আমার মা হওয়ারই কথা তাই না?

মারুফের কন্ঠস্বর কৌতুকময়। পৃথিশাকে এখানে দেখে অবাক সে। কিছু একটা মনে পড়তেই শুধালো,

– তুমি এখানে কেন? বাসার জন্য তুমিই ফোন দিয়েছিলে?

পৃথিশা মাথা নাড়ালো। মারুফ মুখভঙ্গি পাল্টে গেলো। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,

– কেন? তোমার বাসার কি হয়েছে?

– এতিমদের কোন বাড়ি থাকে না। ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়ার হলে বলুন,নাহলে চলে যাই।

পৃথিশার কড়া উত্তরে মারুফ কিছু বলল না। ফ্ল্যাটের চাবিটা নিয়ে এসে পৃথিশাকে বাসা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ছোটখাটো একটা স্টুডিও ফ্ল্যাট। একটা রুম,সাথে ছোট একটা রান্নাঘর ও বারান্দা। খুব বেশি বড় না। তবুও বারান্দার জন্য পৃথিশার পছন্দ হলো বাসাটা। দেখতে আসবে বলে হয়তোবা পরিষ্কার করিয়ে রাখা হয়েছিল।
মারুফ জিজ্ঞেস করলো পৃথিশাকে,

– কবে উঠবে?

– আজ, এক্ষুণি।

অবাক হলো মারুফ।

– তুমি সব নিয়ে এসেছো?

পৃথিশা দরজার বাহিরে হাত দিয়ে দেখালো। মারুফ উঁকি মেরে দেখলো সিড়ির কোণায় বড় দুটো লাগেজ রাখা। অবাক স্বরে বলল,

– তুমি এগুলো নিজে টেনে এনেছো? কিভাবে আসলে এতদূর?

– উবারে করে এসেছি। উল্টোপাল্টা কথা বাদ দিয়ে আপনি বলুন বাসায় এখন উঠা যাবে কিনা।

– উঠা তো যাবেই।কিন্তু তোমার কেন ফার্নিচার আছে? কিভাবে থাকবা?

– ফার্নিচার দুইদিনের মধ্যেই এসে যাবে।

পৃথিশা আর কোন কথা বলল না। সিড়ি থেকে একটা লাগেজ টেনে আনার চেষ্টা করতেই মারুফ এগিয়ে এসে দুটো লাগেজই নিয়ে রুমে রেখে দিলো। অবাক হয়ে নিজের ছোট হাত আর মারুফের হাতগুলো মিলানোর চেষ্টা করলো সে। এত ভারি ব্যাগগুলো একসাথে নিয়ে নিলো! মারুফের কাছ থেকে ফ্ল্যাটের চাবি নিয়ে দরজা আটকে দিলো। চিন্তিত মারুফ কিছুসময় দাঁড়িয়ে থেকে নিজেও চলে গেলো।

বাসাটা নিজের মতো ঘুরে দেখছিলো পৃথিশা। কলিংবেল লের আওয়াজ পেয়ে ফিরত আসলো দরজায়। মারুফ এসেছে। হাতে আটা লেগে আছে। পৃথিশাকে দেখে মৃদু হাসলো সে।

– তুমি কি সকালল নাস্তা করেছো?

পৃথিশার হাতের ঘড়িতে তাকালো। সকাল এগারোটার বেশি বাজে। এই লোক এখন নাস্তার কথা জিজ্ঞেস করছে।

– সকাল সাড়ে এগারোটা বাজে? এখন কে নাস্তা করে? আমি খেয়ে এসেছি।

মারুফ হেসে মাথা চুলকালো। আটাগুলো মাথায় লেগে গেছে।

– আসলে আজ ডিউটি নেই তো তাই বেলা করে উঠেছি। তাও যথেষ্ট তাড়াতাড়িই উঠেছি।

– আমি না আসলে আরও পরে উঠতেন?

– হে অবশ্যই।

পৃথিশা বড় বড় চোখে তাকালো। এগারোটা পর্যন্ত ঘুমিয়েও কম ঘুমিয়েছে। অবশ্য পৃথিশাও আগে এমন করেই ঘুমাতো। ইদানীং কালেই ঘুমাতে পারে না। উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখে। মারুফ পৃথিশাকে বলে চলে গেলো,তার নাকি রুটি বসানো চুলায়। পৃথিশার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো মারুফ একাই সব করে? তার মতো? জিজ্ঞেস করা অবশ্য হলো না।

দুপুরের খাবারটা পৃথিশা বাহির থেকেই কিনে আনলো। গ্রামের বাড়িতে ফোন দিয়ে ফার্নিচার আনার ব্যবস্হা করেছে সে। নতুন করে শুধু একটা বুকশেলফ কিনতে হবে। পৃথিশার গল্পের বইগুলো রাখার জায়গা হচ্ছে না। বাসায় একা থাকতে ভালো লাগছে না পৃথিশার। একটা খাতা কলম নিয়ে লিস্ট করতে বসলো সে। যত কম জিনিস নিয়ে থাকা যায় তত ভালো। বাসাটা এমনিতেই ছোট। খাট আনার সাহস পাচ্ছে না সে। এই বাসায় তাদের বিশাল খাট আটবে না। লিস্ট করা শেষ হলে বাহিরে বের হওয়ার জন্য তৈরী হতেই কলিংবেল বেজে উঠলো। মারুফ ছাড়া আসার কেউ নেই। দরজা খুলতেই পৃথিশার ধারণা সত্যি হলো, মারুফই এসেছে। একা আসে নি। হাতে ব্যাগ। পৃথিশাকে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মারুফ নিজেই তাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলো। বাসায় পৃথিশা কিছুই করে নি। শুধু একপাশে চাদর বিছানো ও পানির বোতল। ব্যাগগুলো ফ্লোরে রেখে ক্লান্ত শ্বাস ফেললো মারুফ। পৃথিশা এগিয়ে এসে বলল,

– আপনি এইসময়? এগুলো কি?

– মায়ের ছাত্রীর বাসায় আসলাম প্রথমবার। খালি হাতে আসা যায় নাকি?

পৃথিশা বিপাকে পড়ে গেছে। বাসার বসার জায়গাও নেই।পৃথিশা যে তাকে বসতে বলবে সেই সুযোগও মিলছে না। মারুফ বোধহয় পৃথিশার অবস্হা বুঝতে পারলো। নিজ থেকেই বলল,

– একা বাচ্চা একটা মেয়ে কীভাবে আছে সেটাই দেখতে এলাম। ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।

ব্যাগগুলোর দিকে উঁকি দিলো পৃথিশা। ফলমূল সহ কাঁচা বাজারও আছে। লোকটা পৃথিশাকে বারবার ঋণী করে দিচ্ছে। এমন কেন সে? পৃথিশাকে ব্যাগ হাতে দেখে মারুফ জিজ্ঞেস করলো,

– কোথাও যাচ্ছিলে?

– কয়েকটা জিনিস কেনার দরকার ছিলো।তাই বের হচ্ছিলাম।

– তুমি এখানকার রাস্তাঘাট চেনো?

পৃথিশা আমতা আমতা করছে।মারুফ চটে গেলো।খানিকটা গম্ভীর স্বরেই বলল,

– একা একা এই সন্ধ্যা করে বের হচ্ছো? বিপদে পড়লে কি হবে ভেবে দেখেছো?

পৃথিশা মাথা নিচু করে রাখলো। কথা বলল না। মারুফ গম্ভীর স্বরেই আবার বলল,

– কি কি লাগবে? লিস্ট দাও দেখি

– দরকার নেই। আমি নিজেই পারবো।

মিনমিনে স্বর পৃথিশার। মারুফ মনে মনে হাসলো। একটু বকা খেয়েই মুখটা কেমন ছোট করে ফেলেছে। এই মুখ দেখে কি রেগে থাকা যায়? যায় না, মারুফ তো পারে না। হাসিটা চেপে জিজ্ঞেস করলো,

– আচ্ছা রাগ করে না। ভালোর জন্যই বলেছি। চলে আমার সাথে, আমি আজ দেখিয়ে দেই। পরে তুমি নিজে যেও আবার।

পৃথিশার আসলেই দরকার ছিলো। তাই গেলো মারুফের সাথে। আজ মারুফ গাড়ি বের করলো না। দোকান কাছেই, হেঁটেই যাওয়া যাবে। তবে বিকাল হতেই সেখানে মানুষের ভীড় নামে। অনেকটা সময় নিয়ে কেনাকাটা করলো দু’জন মিলে। মারুফের অন্যরকম সত্তা দেখে অবাক হলো পৃথিশা। ভীড়ের মধ্যে পৃথিশাকে কীভাবে আগলে রেখেছিলো, বাবা’র পরে অন্য কোন পুরুষের এমন কাজে চোখ ভিজে উঠেছিলো পৃথিশার। রাতের খাবার কিনে বাসায় ফিরলো দু’জনে। ব্যাগগুলো পৃথিশা বারবার নিতে চাইলেও মারুফের সাথে পেরে উঠে নি। কয়েকবার বলেছিলো, কিন্তু মারুফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই চুপ।

রাতে ঘুমমানোর সময় পৃথিশার মন খারাপ হয়ে গেলো। পুরোটা ঘর এত ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।পৃথিশার কান্না পেলো। জীবনটা এত বদলে গেলো কেন।কেন তার কোন আপন মানুষ রইলো না। দাদা বাড়িতে কেউ কোনদিন একটিবারের জন্যও ফোন দিয়ে খোঁজ নিলো না। মণিদীপা কেন লড়াই করলো না, কেন একটু সহ্য করলো না। পৃথিশা তো ছিল তার সাথে। কেউ একটিবারের জন্য ছোট্ট পৃথিশার কথা চিন্তা করলো না। বাবার জান ছিলো সে। বাড়ির সবাই তাকে পুতুলের মতো রাখতো। পৃথিশার মনে পড়ে না কোনদিন সে নিজে রান্নাঘরে গিয়ে চুলার গ্যাস জ্বালিয়েছে। মা- বাবা ছোট মেয়ে বলে কোনদিনই কিছু করতে দেয় নি। খুব বেশী ধনী হয়তোবা তারা ছিলো না কিন্তু তার কোন শখ অপূর্ণ থাকে নি কোন দিন। মণিদীপার উপর পৃথিশার রাগ হচ্ছে অনেক। কষ্ট মণিদীপা পেয়েছিল ঠিকই তবে ঝড় তো বয়ে গেছে পৃথিশার উপর। ছোট মেয়েটা এক ধাক্কায় বড় হয়ে গেছে। এতদিনের চেপে রাখা ব্যাথাগুলো যেন আজ উপচে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। নিজেকে সামলাতে পারছে না।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২১
ফারিহা জান্নাত

অনবরত কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো পৃথিশার। মূহুর্তেই মেজাজ গরম হয়ে গেলো। কোথায় ছুটির দিন ঘুমাবে তা না সাত সকালে ঘুম হারাম করে দিচ্ছে। গায়ে কোনমতে ওড়না জড়ালো পৃথিশা। এদিকে অনবরত বেল বেজেই যাচ্ছে। বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই মারুফের মুখস্রী ভেসে উঠলো। সারা পিঠময় ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে বারবার, ঘুমে চোখ খুলে রাখা দায়। মারুফের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে রমণীর এমন কান্ডে। অধর জোড়া প্রসারিত করে বলে,

– কি ব্যাপার? কাল আমাকে নিজেই বললে দেড়ি করে ঘুম থেকে উঠি, অথচ আজ নিজে..

কথা থেমে গেলো মারুফের।পৃথিশার চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। পা টলমল কররছে, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। মারুফ এগিয়ে চিন্তিত স্বরে বলল,

– পৃথিশা, কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছো..

বলার আগেই পৃথিশা ঢলে পড়লো মারুফের গায়ে। হতভম্ব হয়ে গেলো মারুফ। পৃথিশার গালে কয়েকবার টোকা দিলেও কাজ হলো না। পৃথিশার বাসায় খাট না থাকায় নিজের বাসায়ই নিয়ে গেলো তাকে। মারুফ তাকে কোলে করে নিয়ে গেছে জানলে নিশ্চিত এতক্ষণে লজ্জায় রাঙা হতো মেয়েটা।
বিছানায় পৃথিশাকে শুয়িয়ে এসি অন করে দিলো সে। অভিজ্ঞতা থাকায় কিছুটা বুঝতে পারছে প্রেশার ফল করেছে। চেক করতেই দেখলো তার ধারণা সঠিক। রাগ হলো তার। মেয়েটা শেষ কখন খেয়েছে? পৃথিশাকে জাগালো না আর। অপেক্ষা করতে থাকলো মেয়েটা কখন জাগবে। মেয়েটাকে আজ অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছিল তার বাসায় নাস্তা করার জন্য।

বেশ খানিকক্ষণ পর ঘুম ভাঙলো পৃথিশার। শরীরে এক ফোঁটা শক্তি নেই যেন। অপরিচিত জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করতেই হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লো সে। মারুফ সোফায় বসে কাজ করছিলো। পৃথিশার জন্য আজও সে ডিউটি শিফ্ট করেছে৷ মেয়েটাকে একা রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছিলো না। পৃথিশাকে উঠতে দেখে এগিয়ে আসলো সে। পাশের টি-টেবিল থেকে শরবত নিয়ে এগিয়ে দিলো। পৃথিশা পানি নিলো না। বরং জিজ্ঞেস করলো,

– আমি এখানে কিভাবে?

মারুফ তার কথার উত্তর না দিয়ে শরবতটা নিতে ইশারা করলো। মারুফের দৃষ্টি দেখে পৃথিশা নিয়ে অল্প খেয়ে আবার রেখে দিলো। মারুফ শান্ত স্বরে বলল,

– পুরোটা শেষ করো।

এমন করে বললে কেউ না শুনে পারে? পৃথিশা তো পারে না। চুপচাপ শরবতটা খেয়ে নিলো। অতিরিক্ত মিষ্টি শরবতটা। খাওয়া শেষ করতেই মারুফ আবার পানি এগিয়ে দিলো। এবার আর কিছু বলল না পৃতিশা। চুপচাপ পানিটাও খেয়ে নিলো। মারুফের দিকে এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই মারুফ বলল,

– কতক্ষণ ধরে না খেয়ে?

পৃথিশা উত্তরদ দিলো না। গতকাল দুপুরের পর আর খাওয়া হয় নি সত্যি বলতে। বিকেলে মারুফের সাথে বাহিরে চা খেয়েছিলো শুধু। মারুফ আবারে জিজ্ঞেস করলো,

– কি হলো? কখন খেয়েছিলে লাস্ট?

– গতকাল দুপুরে।

কন্ঠস্বর নিচু পৃথিশার। মারুফের রাগ উঠে গেলো। হাতে থাকা গ্লাসটা শব্দ করে টেবিলে রেখে বলল,

– এতক্ষণ ধরে না খেয়ে তুমি অথচ হুঁশ নেই। খাওনি কেন হ্যাঁ আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম তখন তো ঠিকই বললে খেয়েছে? তাহলে এখন?

পৃথিশা কিছু বলল না। মারুফকে কখনো এতটা রাগতে দেখেনি সে। মারুফ আবারো বলল,

– কি হলো? এখন কথা বলো না কেন? প্রেশার,সুগার সব তো তলানিতে। অথচ দিন-রাত লাফিয়ে বেড়াও।

নাক টানলো পৃথিশা। চোখে ইতিমধ্যে অশ্রু জমেছে। নিজের কান্ডে নিজেই অবাক হলো সে। কই কখনো তো কোনদিন এত অল্প কথায় কাঁদেনি সে।তবে আজ কি হলো? মারুফ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। পরপরই রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো। পৃথিশা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। তবে মারুফ হাতে প্লেট নিয়ে রুমে প্রবেশ করলে তার স্বস্তি রইলো না। প্লেট ভর্তি খাবার নিয়ে এসেছে সে। মারুফের তার দিকে প্লেট এগিয়ে বলল,

– সবটা শেষ করো তাড়াতাড়ি।

পৃথিশা অবাক হলো অনেকটা।লোকটা তার জন্য কেন এত করছে। প্রশ্নটা মনে মনে করলেও মুখে জিজ্ঞেস করে না সে। পাছে আবার মারুফ রেগে বসে। পৃথিশা প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মারুফ প্রশ্ন করে,

– কোথায় যাচ্ছো?

– নিজের বাসায় গিয়ে খাই। মানুষ দেখলে খারাপ ভাববে।

– এখানে তুমি মানুষ কোথায় দেখছো?

– কেন আপনার বাসায় কেউ নেই?

পৃথিশার কন্ঠস্বর বিস্মিত। মারুফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই বিষয়ে কথা বলতে বলতে ক্লান্ত সে।

– বাবা মারা গিয়েছে অনেক বছর হবে। আমি তখন দশম শ্রেণীতে পড়ি। আর আম্মু মারা গেলো মাস ছয়েক আগে। ভাই-বোন নেই আমার। দাদা বাড়ির দিকে কাছের কোন আত্নীয় নেই কারন বাবার ভাই ছিলো না। একাই থাকি আমি।

পৃথিশা কিছু বলল না। তার মতো অবস্হা মারুফের। তনে তার মতো এতটা নাজুক অবস্থায় নেই সে। পৃথিশাকে খেতে না দেখে মারুফ ধমক দিলো আবারো,

– সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে যাচ্ছে অথচ তোমার খাওয়ার নাম নেই। খাওয়া শুরু করো তাড়াতাড়ি।

পৃথিশা মারুফকে পাত্তা না দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।পেছন পেছন মারুফও এলো। দেখলো পৃথিশা ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে। মারুফকে আসতে দেখে বলল,

– বেডরুমে খাবার ফেলে অপরিষ্কার করতে চাই নি। তাই এখানে এলাম।

মারুফ নিজেও এগিয়ে এসে পৃথিশার সামনাসামনি বসলো।তার দৃষ্টি পৃথিশার দিকে।ইদানীং কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে সে। খেতে খেতেই পৃথিশা প্রশ্ন ছুঁড়লো,

– আপনার ফিয়ন্সের সাথে দেখা করাবেন না আমায়?

মূহুর্তেই মেজাজ থমথমে হয়ে গেলো মারুফের। উত্তর দেওয়ার আগেই কলিংবেল বাজলো উচ্চস্বরে।পৃথিশাকে বসতে বলে দরজা খুলতে গেলো সে। পৃথিশা টেবিলে বসে দেকতে পেলো না কে এসেছে তবে কথা শুনলো,

– দিন দুপুরে যুবতী মাইয়া তোমার ঘরে কি করে? দেশটা রসাতলে গেলো একেবারে তোমাগো মতো নষ্টা পোলা-মাইয়ার জন্য।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-১৯

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১৯
ফারিহা জান্নাত

দুশ্চিন্তায় হাঁত কাঁপছে পৃথিশার। এখন পর্যন্ত একটা বাসার খোঁজ পায় নি সে। ঢাকায় তার তেমন কোন বন্ধু-ও নেই যাদের কাছে সাহায্য চাইতে যাবে। নিস্তব্ধ রাত। হুটহাট এক-দুইটা গাড়ির আওয়াজ ব্যতীত কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ঘড়ির কাঁটাটা জানান দিচ্ছে সময় তখন রাত এগারোটা। উপায় না পেয়ে মোবাইলের কন্ট্যাক্ট লিস্ট ঘাটতে বসলো পৃথিশা যদি কাউকে পাওয়া যায় যে সাহায্য করতে পারবে এই মূহুর্তে। অনেক ঘাটাঘাটি শেষে পৃথিশা তার পুরোনো একজন শিক্ষকের নাম্বার পেলো যিনি এখন ঢাকায় থাকেন। নাম্বার পেয়ে যাওয়ার পরও সংকোচ হতে লাগলো পৃথিশার, হুট করে ফোন করে এভাবে সাহায্য চাওয়াটা বেমানান। উনার সাথে পৃথিশার শেষ কথা হয়েছে এক বছর আগে। অবশেষে উপায় না পেয়ে ফোন করলো সে। প্রথমবারে কেউ ধরলো না, বরং কেটে গেলো ফোনটা। হতাশ হয়ে গেলো পৃথিশা। এবার আর কোন উপায় হাতে থাকলো না তবে। তবে কিছুসময় পরই ফোনের রিংটোনে বিছানাশুদ্ধ কেঁপে উঠলো। সেই ম্যামের নাম্বার, খুশিতে ফোনটা ধরতেই পুরুষালি গলা শুনে হকচকিয়ে গেলো সে। ফোনের ওপাশ থেকে তখন ক্রমাগত আওয়াজ আসছে,

– কে বলছেন, হ্যালো?

নিজেকে সামলে জবাব দিলো পৃথিশা। খবর পেলো ম্যাম মারা গেছেন মাস ছয়েক হবে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। পছন্দের মানুষ বলেই কি তারা এত তাড়াতাড়ি চলে যায়। ফোনের ওপাশে থাকা লোকটা ম্যামের ছেলে। কেন ফোন দিয়েছে জানতে চাইলেই পৃথিশা উশখুশ করা শুরু হলো। একবার ভাবলো এই লোকের কাছে কি সাহায্য চাবে, পরক্ষণেই আবার দুশ্চিন্তা ভর করলো মাথায়। অবশেষে অনেকটা বাধ্য হলেই একটা বাসা ভাড়ার কথা বলতেই লোকটা বলল তাদের একটা স্টুডিও ফ্ল্যাট খালি হয়েছে এক সপ্তাহ আগে,এখনো ভাড়া হয় নি। পৃথিশা চাইলে থাকতে পারে। খবর পেয়ে খুশি হলেও চিন্তা গেলো না পৃথিশার। একজন অপরিচিত লোকের কথায় এভাবে যাওয়াটা ভালো মনে হচ্ছে না। তবুও উপায় না পেয়ে ঠিকানা জেনে রাখলো। কিছু না পেলে সেখানেই যাবে।
ফোন রেখে ব্যাগ গুছাতে বসলো সে। এই বাসায় এসেছে অনেকদিন অথচ তার একটা লাগেজ এখনো বের করাই হয় নি। সেই লাগেজ ভর্তি শুধু শাড়ি। বেশির ভাগই মণিদীপার,কয়েকটা মায়ের। একেকটা শাড়ির একেকটা গল্প কিন্তু খুলার সাহস হয় নি কখনো, ভয় হয় খুললেই যে কেঁদে ভাসাবে। আলমারি থেকে কাপড়চোপড়গুলো বের করে লাগেজে রাখছিলো। হুট করেই রাতের থমথমে নিস্তব্ধতা বিরাজমান পরিবেশে গানের শব্দ শুরু হলো। শব্দটা রায়ানের রুম থেকে আসছে। পৃথিশা ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো রাত বারোটা বাজে। এত রাতে এত জোরে গান বাজানোর মানে কি। তবক কিছু বলল না সে, রায়ানের রুম ও তার রুম পাশাপাশি। তাই গানের শব্দটা কানে একটু বেশিই আসছে। ইংরেজি গান বাজছে ক্রমাগত।

– Darling I am a nightmare dress like e daydream…

– ইউ ওয়ার অ্যাকচুয়েলি অ্যা নাইটমেয়ার।

সকাল আটটা বাজতেই বরাবরেই মতোই দরজায় টোকা পড়লো। গতরাতে এমনিতেই গানের শব্দে ঘুমাতে বেশ দেড়ি হয়েছে এখন আবার সকাল সকাল ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো। এই বাসায় আবার নিয়ম মেনে সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট করে ফেলা হয়। বিরক্ত হয়ে ফ্রেশ হতে গেলো পৃথিশা,রোজ রোজ এই জ্বালা সত্যিই নেওয়া যাচ্ছে না। আয়নায় নিজেকে দেখতেই বিরক্তিটা আরও বেড়ে গেলো যেন।রাতে চুলে বেণী করে ঘুমিয়েছিলো, কিন্তু এখন চুলের দফারফা অবস্হা। বড় চুল দেখতে যেমন সুন্দর লাগে তেমনি সামলাতেও ঝামেলা পোহাতে হয়। খাবার টেবিলে আসতেই দেখতে পেলো রায়ান ও রাহনুমা বেগম বসে। তারই অপেক্ষা করছিলো যেন। খিচুড়ির ঘ্রাণ ঘরময় ছড়িয়ে গেছে। পৃথিশা প্লেট উল্টো করতে করতে বলল,

– কি ব্যাপার? শাহী খানাপিনা কেন, বিদায় উপলক্ষে নাকি?

কথার মাঝে সূক্ষ খোঁচাটা রায়ানের বুঝতে সমস্যা হলো না। চোখ রাঙিয়ে পৃথিশার তাকাতেই পৃথিশা তাকে দেখিয়ে কাবাবের টুকরো’টায় বড়সড় একটা কামড় বসালো। তাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে রাহনুমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,

– সেই বানিয়েছো খালা। তোমার হাতের রান্না মানেই বেস্ট।

রাহনুমা বেগম পৃথিশার মাথায় হাত বুলালেন, মেয়েটাকে নিজের কাছে রাখার জন্য এখানে এনেছিলেন। কিন্তু ভাগ্য, কি এক ঝামেলার জাঁতাকলে পড়লেন।একদিকে নিজের আপন ছেলে, অন্যদিকে পৃথিশা। রায়ানের সাথে কথা বলেছিলেন তিনি কোন অজ্ঞাত কারনে রায়ান কোন কিছু মানতে নারাজ। তার একমাত্র চাওয়া পৃথিশাকে সে দেখতে চায় না এখানে। তিনিও পাল্টা কিছু বলার সুযোগ পায় নি। তার চিন্তার সুতো কাঁটলো রায়ান প্লেটের শব্দে। খাবারগুলো প্লেটে নিয়ে সে নিজের রুমে দিকে যেতে যেতে বলল,

– রুমে খাবো আমি।

রাহনুমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিসের এতো দ্বন্দ্ব তাদের মাঝে। পৃথিশা রায়ানের দিকে চোখ তুলে তাকালো না, তার সম্পূর্ণ মনোযোগ খাওয়ার দিকে কবে আবার খালার হাতের রান্না খেতে পারবে কে জানে।

সকালের খাওয়া শেষ করেই পৃথিশা বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। বেশি দেড়ি করা যাবে না। সে আপাতত প্ল্যান বি হিসেবে একটা হোটেলে উঠার চিন্তা করেছে। মোবাইলে একটা উবার বুক করে শেষ বারের মতো জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিলো সে। নিজ বাড়ি ছেড়ে আসার পর এখন তার অন্য কিছু ছাড়তে কষ্ট হয় না। উবার আসার কল পেতেই ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বের হলো সে। ড্রয়িং রুমে রাহনুমা বেগম বসে টিভি দেখছিলেন,সোফায় রায়ান বসে চা খাচ্ছে। পৃথিশাকে ব্যাগ নিয়ে বের হতে দেখে রাহনুমা দৌড়ে এলেন। পৃথিশা তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মূহুর্তেই কন্ঠ রোধ হয়ে আসলো তার। মা তুল্য খালার স্নেহ, ভালোবাসার ঋণ শোধ সে করতে পারবে না কোনদিন। রাহনুমার কন্ঠস্বর কান্নামিশ্রিত,

– তুই কোথায় যাস পৃথি? তোকে না বললাম তুই আমার সাথে থাকবি?

পরিস্থিতি সামলানো যতটা সহজ হবে ভেবেছিলো পৃথিশা ততটা সহজ মনে হলো না। রাহনুমা বেগম তাকে ছাড়তেই চাইছে না। রায়ানের মুখও হতভম্ব, সে হয়তোবা পৃথিশা সত্যিই চলে যাবে।

– খালা, আমি বললাম তো তোমার সাথে দেখা করবো আমি নিয়ম করে। কিন্তু আমি এখানে থাকতে পারবো না। তুমি আমাকে চেনো। ঢাকায় এসেছি শুধু তোমার জন্য, এখন আমাকে বিদায় দাও হাসিমুখে। খুব শীঘ্রই দেখা হবে। তোমার পিছু এত দ্রুত ছাড়ছি না সুন্দরী।

কোনভাবেই পৃথিশাকে আটকানো গেলো না। রাহনুমাকে ছেড়ে পৃথিশা রায়ানের সামনে গেলো। মুখে কিছু বলার ইচ্ছা ছিলো না তেমন। তবুও কিছু কথা না বললেই নয়।

– মিস্টার রায়ান হোয়াটএভার, আপনার পুরো নামটাও জানি না দেখুন। অথচ আপনি আমরা হিস্ট্রি জানতে চেয়েছিলেন। কিছু বলার নেই, শুধু বলব জেলাসিটা একটু কমান নাহলে নিজেই জ্বলেপুড়ে ছাড়খার হয়ে যাবেন যেমনটা এখন হচ্ছেন।

পৃথিশাকে শেষ পর্যন্ত আটকানো গেলো না। সে চলে গেলো নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

ঠিকানায় পৌঁছাতেই পৃথিশা চার তলায় চলে গেলো। চার তলায়ই ফ্ল্যাটটা ফাঁকা হয়েছে শুনেছিলো সে। ‘এ’ ফ্ল্যাটটা ম্যামের বাসা, অন্য ফ্ল্যাটটা খালি। সেই ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো একজন পুরুষ। মুখটা দৃশ্যমান হতেই পৃথিশার মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে গেলো।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-১৭+১৮

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১৭+১৮
ফারিহা জান্নাত

১৭
– সরি আন্টি,ভুলে চলে এসেছি। আসলে আমরা ভেবেছিলাম এটা প্রিয়তাদের বাসা।

রুম থেকে বেরিয়ে আসার আগেই মারুফের কন্ঠস্বর শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো পৃথিশা। রায়ানও ততক্ষণে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। পৃথিশার দিকে দৃষ্টি তার। মারুফরা অতি দ্রুতই বিদায় নিয়ে চলে গেলো। পৃথিশাও নিজের রুমে এসে পড়া শুরু করলো। দুই ঘন্টা পর তার একটা পরীক্ষা আছে,অথচ এখনো দুইটা চ্যাপ্টার রিভিশন বাকি। কিছুসময় পরই রায়ান এলো তার রুমে। ইদানীং পৃথিশা নিজেকে রায়ানের থেকে সরিয়ে নিয়েছে। অকারণে সামনে যায় না, রুমে তো একেবারেই না। রায়ানকে দেখেওনা দেখার ভান করলো সে।

– মারুফ তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিল তাই না?

পৃথিশা উত্তর দিলো না। বইয়ে মুখ বুজে থাকলো।

– উত্তর দাও পৃথিশা। রাগ বাড়াবে না। মারুফের জন্যই আমাকে রিজেক্ট করেছো?

পৃথিশা নিরুত্তর। কথাগুলো হজমের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রায়ান যে আরও বিষাক্ত কিছু বলবে, তার জন্যও নিজেকে প্রস্তুত রাখলো।

– বাহ্, ঢাকায় এসেছো দুই দিনও হয় নি অথচ এর মধ্যেই বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেললে। পারফেক্ট মা..

– আপনাকে কথা বলার সুযোগ দিয়েছি বলে এর মানে এই না যে যা খুশি তাই বলবেন। ঘরে থাকতে দিয়েছেন বলে যে আপনার সব কথা শুনতে হবে এটাও না। আপনি আপনার অনুভূতি জানিয়েছেন আমি আমার টা। পারলে সম্মান করবেন না করতে পারলে নাই। কিন্তু বারবার এটা নিয়ে ঝামেলা করবেন না। আর রইলো উনার কথা, একজন মানুষ হিসেবে আমাকে সাহায্য করেছেন এবং এতটুকুই আমাদের পরিচয়। এর বাহিরে কিছু না। আমি তাকে এর আগে কখনও দেখিও নি।

পৃথিশা থামলো। রায়ানের চোখ-মুখ থমথমে। যেন এখনই আবার কিছু বলবে। হলোও তাই,

– বেশি কথা শিখে গিয়েছো দেখছি। যার টা খাও,যার টা পড়ো তার উপরেই কথা। আর যাওয়ার জায়গা কোথায় তোমার?

সঠিক জায়গায় তীর ছুঁড়লো রায়ান। তীরটা বুকে ডেবে বসলো তো বসলোই, একেবারে ফাঁলা ফাঁলা করে দিলো। ‘যাওয়ার জায়গা’ কথাটা দুইবার উচ্চারণ করলো পৃথিশা। তৎক্ষনাৎ রায়ানকে কোন জবাব দিতে পারলো না। কিয়ৎক্ষণ পর কাঁপা গলায় বলল,

– আমি এখানে কখনোই আসতে চাই নি। কখনোই না। তার কারন আপনার মতো এখানকার মানুষগুলো। যতক্ষণ আপনাদের কথামতো পুতুল হয়ে থাকবো ততক্ষণ আমি ভালো, আপনিও ভালো। কিন্তু যখনই নিজের মত দেবো তখনই আমি খারাপ,আশ্রিতা তাই না? খালা আমাকে জোর করে এখানে এনেছে, আমার থাকার জায়গার অভাব হতো না। বুবুর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পিন,বাবার অ্যাকাউন্ট সবই আমার জানা। বুবু আমার নামে অ্যাকাউন্ট খুলে টাকাও জমাতো। আমার অভাব হতো মানুষের। তাই আমি এসেছিলাম খালার সাথে।

চোখের কোণে জমা পানিটা মুছলো পৃথিশা। রায়ানের দৃষ্টি তখনও তার দিকে। কিছু বলার পূর্বেই পৃথিশা তার মোবাইল বের করে রায়ানের সামনে ধরলো। রায়ানের দিকে ইশারা করলো স্ক্রিনে তাকাতে।

– দেখতে পাচ্ছেন এগুলো কি? থাক আমিই বলি, আপনার বাগদত্তার ম্যাসেজ। কোথা থেকে আমার নাম্বার জোগাড় করেছে কে জানে। আমি যেন আপনার থেকে দূরে থাকি। আরে আমি আপনার কাছেই গেলাম কখন? আপনার চাল আমি বুঝতে পেরেছি বহু আগেই। এতটাও গাধা নই যে মানুষের দৃষ্টি বুঝবো না। একসাথে কয় জনকে লাগে আপনার?

রায়ান চুপ। কোন কথা বলছে না। পৃথিশা আবারো বলল,

– এটা ফার্স্ট ও লাস্ট ওয়ার্নিং মিস্টার রায়ান, যদি কখনো আমার কাছ ঘেঁষার সুযোগ খুঁজেছেন আপনাকে আমি দেখে নিব।আর কিছুক্ষণ আগে যে খোঁটাটা দিলেন না? যে আমি আপনাদের খাই,আপনাদের পড়ি। খুব দ্রুতই এখান থেকে চলে যাবো,মানুষের বোঝা হয়ে থাকার মতো পরিস্থিতি এখনো আসে নি। এখন রুম থেকে বের হোন।

রায়ান আর কোন কথা বললো না। চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রায়ান চলে যেতেই পৃথিশা বই নিয়ে বসলো আবারও। তবে চোখের পানিতে অক্ষরগুলো দেখতে পাচ্ছে না। টুপটাপ পানি ফোঁটা ক্রমশ বইটা ভিজিয়ে দিতে থাকলো।

কোচিংয়ের উদ্দেশ্য বের হয়েছে পৃথিশা। আজ রায়ানের সাথে আসে নি। একাই এসেছে। ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে সাধারণত রিকশা কিংবা সিএনজি কখনোই থাকে না। তাই বাধ্য হয়েই এই কড়া রোদের মধ্যে হাঁটা শুরু করেছে সে। মন-মেজাজ খুবই বিক্ষিপ্ত। আগে মেজাজ খারাপ থাকলে যেই কথা বলতে আসতো তার উপর রাগটা ঝেড়ে দিতো।এই কাজটা সবথেকে বেশি করতো মণিদীপার উপর। পৃথিশা এই কয়েকদিনে উপলব্ধি করেছে মণিদীপা তার জীবনের কতটা জুড়ে ছিলো। তার প্রত্যেকটা কাজে মণিদীপার হাত ছিলো, এখন পর্যন্ত মণিদীপাকে ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে বলে মনে পড়ে না। চুপচাপ হাঁটার অভ্যাস পৃথিশার নেই। এই মূহুর্তে তার গান শুনে হাঁটতে ইচ্ছা করছে কিন্তু দুইদিন আগেই হেডফোনটা নষ্ট হয়ে গেছে। এক কানে শোনা যায়,আরেক কানে শোনা যায় না। হাঁটার মাঝেই কারো ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গেলো সে। চোখের থাকা চশমাটা ঠিক করে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো একজন মেয়ে সাথে মারুফ। মেয়েটার সাথেই পৃথিশা ধাক্কা খেয়েছে। পৃথিশা সরি বলার আগেই মেয়েটা মারুফের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসি তাহলে।’
মারুফ মাথা নাড়াতেই মেয়েটা চলে গেলো। পরপরই পৃথিশার দিকে তাকালো মারুফ। মৃদু হেসে বলল,

– কেমন আছেন আপনি? পায়ের অবস্হা কেমন?

মারুফের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো না পৃথিশার। তার জন্যই আজ রায়ানের কাছে এতগুলো কথা শুনেছে সে। পৃথিশা ধীরেসুস্থে জবাব দিলো,

– জি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

– ভালো। কোথায় যাচ্ছেন এই সময়ে?

কথা বাড়ানোয় বিরক্ত হলো পৃথিশা। তবুও মুখে তা প্রকাশ করলো না,

– কোচিংয়ে যাচ্ছি, পরীক্ষা আছে একটা। আচ্ছা আমার দেড়ি হয়ে যাচ্ছে,আমি আসি।

পৃথিশা যাওয়ার সুযোগ খুঁজছিলো। কিন্তু মারুফ তা হতে দিলো না।

– এতদূর যাবেন আপনি কীভাবে? পায়ের উপর প্রেশার দেওয়া যাবে না বলেছিলাম।

পৃথিশা উত্তর দিলো না। মারুফ নিজে থেকেই আবার বলল,

– আমার সাথে আসুন।আমি পৌঁছে দিচ্ছি।

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলো পৃথিশা।

– না না কোন দরকার নেই। আমি যেতে পারবো।

মারুফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। পৃথিশা খানিকটা থমকে গেলো। এতগুলো দিন পর কেউ তার দিকে শাসনের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কেউ তার ভালোর জন্য বলছে। পৃথিশাকে না করার সুযোগ দিলো না মারুফ। তাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে কিছুটা দূরে রাখা গাড়িটা নিয়ে আসলো দ্রুত।

আজও পৃথিশা পেছনের সিটেই বসেছে। মারুফ পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। পৃথিশা ব্যাগ থেকে বই খুলে পড়ার চেষ্টা করলো। হুট করে মারুফের প্রশ্নে চমকে উঠলো সে। মারুফ সেটা লক্ষ্য করে আবার বলল,

– শান্ত হোন, আমি নাম জিজ্ঞেস করেছি শুধু।

– পৃথিশা, পৃথিশা চৌধুরী।

– মেডিকেল পরিক্ষার্থী?

পৃথিশার হাতের বইটা দেখে প্রশ্ন করলো মারুফ।

– জি।

জড়শড় ভঙ্গিতে জবাব দিলো পৃথিশা। মারুফ আবারও প্রশ্ন ছুঁড়লো,

– সত্যিই মেডিকেলে পরীক্ষা দিবেন?

এবার খানিকটা অবাকই হলো পৃথিশা। এই প্রশ্নের মানে কি?

– যদি পরীক্ষা না দেই, তাহলে পড়ছি কেন?

– আমি জিজ্ঞেস করেছি নিজ ইচ্ছাতে দিবেন নাকি?

পৃথিশার মনে হলো তার মনের ভিতর কেউ একটা বোমা ফেলেছে। সামনের মানুষটা যেন তার তীক্ষ্ণ চোখ দু’টি দিয়ে পৃথিশার মন অনায়াসে পড়ে নিচ্ছে। ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো সে।

– নিজ ইচ্ছাতেই না দিলে পড়ব কেন? আজব!

– মাঝে মাঝে প্রশ্নের উত্তর দিবেন। এতে লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।

পৃথিশা কথা পাল্টানোর চেষ্টা করলো,

– আপনি কিসের ডাক্তার?

মারুফ শব্দহীন হাসলো।

– কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছেন পৃথিশা? আমি এতটাও বোকা নই।

পৃথিশা জিব কাঁটলো, ধরা পড়ে গিয়েছে। তাও দমে না গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

– আসলেই জানতে চাইছি, বলুন না।

– কার্ডিওলজিষ্ট।

পৃথিশা আর কথা বাড়ালো না। তারা গন্তব্যে এসে পড়েছে। পৃথিশা গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার সময় মারুফ বলে উঠল,

– নিজের মনে বিরুদ্ধে যেতে নেই পৃথিশা, এতে ভালো থাকা যায় না। নিজের খেয়াল রাখবেন,ভালো থাকবেন।

পৃথিশা উত্তর দেওয়ার আগেই মারুফ চলে গেলো। রাস্তায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো পৃথিশা। মনে কোণে প্রশ্ন জমেছে, ‘মানুষটা আমায় এত নিপুণভাবে পড়লো কি করে?’

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১৮
ফারিহা জান্নাত

– তা প্রেমকাহিনী শেষ করে বাসায় আসার সময় হলো?

দরজায় পা রাখতে না রাখতেই এমন প্রশ্নে চমকে উঠলো পৃথিশা। প্রশ্নকর্তা রায়ান, তার হাতে চায়ের কাপ। রাহনুমা বেগম-ও রায়ানের পিছনেই সোফায় বসে ছিলেন। রায়ানের কথা শুনে তিনি ধমক দিয়ে বললেন,

– এসব কি কথা রায়ান? মেয়েটা মাত্র আসলো।

রাহনুমা বেগম পৃথিশার দিকে এগোতে চাইলে রায়ান আটকে দিলো।

– থামো মা, বাহিরে একা কোথায় যায় কি করে বেড়ায় জানো?

পৃথিশা চুপ করে আছে। সে আজ দেখতে চায় রায়ান কতদূর যেতে পারে। রাহনুমা বেগম ছেলের আচরণে অবাক হলেন। রায়ান আবারও বলল,

– পৃথিশাকে জিজ্ঞেস করো মা, সে আজ মারুফের গাড়িতে যায় নি? বলো?

রাহনুমা বেগম মারুফকে চিনেন না। তিনি বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

– মারুফ কে?

পৃথিশা কিছু বলার আগেই রায়ান বলল,

– তোমার সো কল্ড আদরের পৃথিশার প্রেমিক। দুইদিনেই জোগাড় করে ফেলেছে।

রাহনুমা বেগম পৃথিশার দিকে তাকালেন,সে এই মূহুর্তে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। হাত মুঠ করা। তিনি পৃথিশাকে শুধালেন,

– রায়ান কি বলছে এসব পৃথিশা? তুই অন্য কোন ছেলের গাড়িতে গিয়েছিস?

এবারও রায়ান আগ বাড়িয়ে কথা বলল,

– গাড়ি দিয়ে না গেলে কীভাবে গেলো? আমিও তো নিয়ে যাই নি,এখানে রিক্সাও পাবে না। তোমার মনে হয় ওর ব্যাথা পা নিয়ে সে এত দূর হেঁটে যেতে পেরেছে।

রাহনুমা বেগম মনে হয় রায়ানের কথা বিশ্বাস করলো।তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেলো, কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো,

– এসব কি পৃথিশা? চুপ থাকবে না উত্তর দেনআমাকে?

– উত্তর দেওয়ার মুখ ওর আছে নাকি? আমি মিথ্যা বললে আগে থেকেই তো প্রতিবাদ করতো, চুপ থাকতো না।

ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলো পৃথিশার। নিজের সম্পর্কে সাফাই গাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই তার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলার চেষ্টা করলো,

– গত কয়েকদিন আগে আমি যখন রাস্তায় অ্যাকসিডেন্ট করেছিলাম, ডাক্তার মারুফ আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন পায়ের অবস্হা খারাপ ছিলো বলে। হাসপাতাল থেকে আসার সময় সিএনজি, রিকশা কিছুই পাচ্ছিলাম না। পরে তিনি আমাকে বাসায় পৌঁছে দেন। আজকেও সেরকমই হয়েছে। রায়ান ভাইয়া নিয়ে গেলেন না,তাই নিজেই হেঁটে যাচ্ছিলাম।পরে হুট করে উনার সাথে দেখা,তার হাসপাতাল-ও সেদিকে সেই সুবাদে লিফ্ট দেন আমায়। এতটুকুই, এর বাহিরে কিছু নেই। তাও বিশ্বাস না হলে আমার কিছু করার নেই।

পৃথিশা থামলো। বাহির থেকে আসার কারনে মাথাটা ব্যাথা করছে।এতক্ষণ ধরে এরা কাহিনী করছে। রায়ান তেঁতে উঠলো,

– মিথ্যা কথা সব, বানিয়ে বলছে এসব। আমি নিজে ওদের প্রেমলীলা দেখেছি।

পৃথিশা এগিয়ে রায়ানের গালে চড় মারলো। রায়ান অপ্রস্তুত ছিল, পৃথিশার এমন কাজে তার হাত থেকে চায়ের কাপ ছিটকে পড়লো। রাহনুমা বেগমও হতভম্ব। রায়ান ব্যাপারটা হজম করতে বেশ সময় নিলো। তুতলিয়ে বলল,

– তুমি… তুমি কি করলে এটা?

– যেটা আরো আগেই করা উচিত ছিলো। একের পর মিথ্যা বলতে বিবেকে বাঁধলো না আপনার? কি ক্ষতি করেছি আমি আপনার? হ্যাঁ? কি করেছি যে আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলছেন?

রায়ানের শরীর রাগে কাঁপছে। পৃথিশার রিজেক্ট সে মেনে নিতে পারে নি। পৃথিশাকে মারার জন্য হাত তুলতে গেলে রাহনুমা বেগমের চিৎকারে থামলো সে।

– রায়ান, ভুলেও পৃথিশার গায়ে হাত তুলবি না। ভুলেও না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের দিকে যেতে নিলে রায়ান চিৎকারে থামতে হলো।

– এই মেয়ে এই বাড়িতে থাকলে আমি থাকবো না এখানে।

– তুই কি সব আজেবাজে বকছিস রায়ান? মেয়েটা পুরো ঘটনা ক্লিয়ার করলো।

রাহনুমা বেগমের ক্লান্ত কন্ঠস্বর। পৃথিশার বড্ড মায়া হলো তার জন্য।

– আমি যখন বলেছি থাকবো না, মানে থাকবো না।

খাবার টেবিলে থাকা গ্লাসগুলো তুলে আছাড় মেরে ফেলে দিলো সে। বিকট শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। পৃথিশা এক মূহুর্ত কিছু একটা ভাবলো। তারপর রায়ানের সামনাসামনি এসে বলল,

– আচ্ছা, চলে যাব আমি। তবে দুইটা দিন সময় আমাকে দিন। তারপর নাহয়..

তার কথার মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিলো রায়ান,

– নো, ইউ হ্যাভ অনলি টুয়েন্টি ফোর আওয়ার। এর মাঝেই তুমি যাবে।

পৃথিশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রায়ান নিজের রুমে চলে গেলো।পৃথিশা রাহনুমা বেগমের দিকে তাকালো। তিনি হতভম্ব হয়ে আছেন। নিজের ছেলের এই রূপ বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছে। পৃথিশার কিছু বলতে ইচ্ছা করলো না। সে চুপচাপ রুমে চলে এলো।

বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিতেই চাপা কষ্টগুলো বেরিয়ে এলো। শরীর কাঁপিয়ে কান্না এলো তার। বালিশে মুখ গুজে কান্নার শব্দ আটকাতে চাইলো। দরজায় করাঘাত শুনতেই উঠে চোখ মুছলো সে। রাহনুমা বেগম এসেছেন। তিনি বিছানায় এসে বসলেন। কি বলবেন,কিছু বুঝতে পারছেন না। পৃথিশা ফ্লোরে বসে তার কোলে মাথা রাখলো। বেশ অনেকটা সময় চলে যাওয়ার পর রাহনুমা বেগম মুখ খুললেন,

– তুই কোথাও যাবি না।

পৃথিশা মুখ তুলে তাকালে তিনি আবারও বললেন,

– তুই কোথাও যাবি না। তুই আমার মেয়ে। যার যাওয়ার ইচ্ছা সে যাবে।

-তা কি হয় খালা? তোমার নিজের ছেলে, সে কেন নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে যাবে।আমি বাহিরের মেয়ে। আমার জন্য কেন সে সমস্যায় পড়বে খালা।

রাহনুমা বেগমের চোখে জল। পৃথিশাও কান্না আটকে রেখেছে, ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা।

– তুই আমার মেয়ে পৃথি,তুই কোথাও যাবি না। কোথাও না।

পৃথিশাকে নিজের বুকে চেপে ধরলেন তিনি। মায়ের সমতুল্য খালার পেট জড়িয়ে বড় একটা শ্বাস নিলো সে। কেমন মা মা একটা গন্ধ। কিন্তু এখানে সে থাকতে পারবে না। আশ্রিতার মতো অনুভূতি নিয়ে সে থাকতে চায় না। পৃথিশা মুখ তুললো। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে বলল,

– কিন্তু আমি এখানে থাকতে পারবো না খালা। তুমি আমার জন্য অনেক করেছো, এর ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না। বাকিটা পথ আমার একাই চলতে হবে। রায়ান ভাইকে নিয়ে তুমি ভালো থাকো যেভাবে এতদিন ছিলে। আমি এর মাঝে আসতে চাই না। তুমি আমাকে অনুরোধ করো না,কারন আমি শুনবো না। তুমি তো আমাকে চিনো খালা।

রাহনুমা বেগম কিছু বলতে পারলেন।কান্নায় কণ্ঠ রোধ হয়ে আসলো তার। বারবার অস্ফুট স্বরে বললেন,

– হুট করে কি এমন হলো। কি হলো?.

পৃথিশা কিছু বলল না আর। জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো গোসলের উদ্দেশ্যে। গোসল সেরে রুমে রাহনুমা বেগমকে দেখতে পেলো না। টেবিলের উপর ঢাকনা দিয়ে খাবার রাখা। ক্ষুধা নেই তার,খাওয়ার ইচ্ছা মরে গেছে। আলমারি খুলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বের করলো, ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হবে। বিছানায় বসতেই মনে পড়লো বাসা কিভাবে খুঁজবে সে। এই ক্যান্টনমেন্টের আশেপাশে তো ভুলেও বাসা পাবে না। সে তো কিছু চিনেও না, কারো কাছ থেকে যে সাহায্য নিবে সে সুযোগও নেই তার। চিন্তায় মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার জোগাড় হলো যেন। মোবাইল নিয়ে অনলাইনে কয়েকটা গ্রুপে খোঁজ চালালো বাসার জন্য। মোবাইলটা রেখে কাগজ নিয়ে বসতেই দরজায় কেউ আঘাত করলো।ভাবলে রাহনুমা বেগম এসেছে বোধহয় তাই মাথা না তুলেই ভেতরে আসতে বলল সে। তবে রায়ানের গলার স্বর পেয়ে চমকে গেলো, দ্রুত বালিশের পাশ থেকে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিলো।

– এখন কেমন লাগছে পৃথিশা? কোথায় যাবে তুমি? কার কাছে যাবে? বলেছিলাম না আমায় রিজেক্ট করে ভুল করেছো।

ঘৃণায় চোখ-মুখ কুঁচকে গেলো পৃথিশার।

– তোর মতো ফকিররে আমি গুনায়-ও ধরি না বুঝলি। তুই থাক তোর বা/লের রিজেকশন নিয়া। তোর মতো মানুষরে আমি নিজের চারপাশেও দেখতে চাই না। প্রপোজ যেমন স্বাভাবিক, রিজেকশন-ও সরকমই স্বাভাবিক। সেটা তুই মানতে না পারলে আমার কিছু করার নাই। শালা, কু**

পৃথিশার গালি শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো রায়ান। এই মেয়েকে সে শান্ত মনে করেছিলো, এমনিতে তো শান্তই দেখা যায়। রায়ানকে কথা বলতে না দেখে রাগ আরও বাড়লো পৃথিশার।

– এখনও দাঁড়ায় আছেন কেন? আরও শুনবেন?

আর কোন শব্দ করলো না রায়ান,চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রাগে মাটিতে পরপর দু’বার পা দিয়ে আঘাত করলো পৃথিশা। পরক্ষণেই ব্যাথায় চোখ-মুখ কুঁচকে এলো তার। ব্যাথা পাত্তা না দিয়েভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো, শরীর মন খুব ক্লান্ত।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-১৬

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১৬
ফারিহা জান্নাত

মারুফের কেবিনের হুইল চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে আছে পৃথিশা। ইনজেকশন দেওয়া লেগেছিল ব্যাথার জন্য। দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যায়। পরে মারুফ তাকে নিজের কেবিনে নিয়ে আসে। রুমে এসি চলছে। ঠান্ডায় পৃথিশা হালকা কাঁপছে। শীত লাগায় কিছুসময় ওরই তার ঘুম ভেঙে যায়। বসে বসে ঘুমানোর কারনে ঘাড় ব্যাথা করছে। গায়ের ওড়না ঠিক করে রুমের আশেপাশে তাকালো।তবে কাউকে দেখতে পেলো না সে। ঘড়ির দিকে নজর দিতেই চোখ কপালে তার। তিন ঘন্টা হয়ে গেছে। বাসায় নিশ্চয়ই হুলস্থুল পড়ে গেছে। পৃথিশা ধীরে ধীরে পা ফেললো। ব্যাথা আগের থেকে অনেকটাই কমে এসেছে। আস্তেধীরে দাঁড়ালো সে। আশে পাশে নিজের ব্যাগটা খুঁজতে শুরু করলেই মারুফ কেবিনে ঢুকলো। পৃথিশাকে দাঁড়াতে দেখে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,

– আপনি ঠিক আছেন এখন?

– ঠিক আছি, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

পৃথিশা আবারও ব্যাগ খুজতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। মারুফ তার টেবিলের সাথে লাগোয়া ড্রয়ারটা খুলে ব্যাগ বের করে পৃথিশা অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।

– অনেকেই কেবিনে যাওয়া-আসা করে বার বার। তাই ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। আপনার ঔষধগুলোও এতে আছে।

পৃথিশা মৃদু হেসে ব্যাগটা নিলো। মানুষটাকে কিভাবে ধন্যবাদ দিবে সে জানে না। সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে কেবিন থেকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই মারুফ বলল,

– আসলেই আপনার ফ্যামিলির কেউ আসে নি? মা কিংবা বাবা?

পৃথিশা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আসলেই আজ যদি বাবা- মা থাকতো পুরো হাসপাতাল উঠিয় ফেলতো। মনিদীপার তো কথাই নেই। পৃথিশা শান্ত স্বরে বলল,

– তারা এই পৃথিবীতে নেই।

চার শব্দের ছোট্ট একটা কথা। কিন্তু এটা বলতে গিয়ে পৃথিশার বুক কাঁপিয়ে কান্না এলো। নজর লুকাতে দ্রুত কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো সে। বহুকাল আগে কল্পনা করা একটা দৃশ্য চোখে ভেসে উঠলো। সে রুমে একা জ্বরে কাহিল,কেউ নেই তার সাথে। তারপর হুট করে মণিদীপা আসলো,তার পেছন পেছন রাশেদুল চৌধুরী। ওয়ার্ড বয়ের ধাক্কায় বাস্তবে ফিরলো পৃথিশা। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে জায়গাটা চিনতে পারলো না সে। সাইনবোর্ড দেখে বুঝলো এটা মিরপুর ১০। এখান থেকে মঈনুল রোড যেতে অনেক সময় লাগবে। আদেও কোন রিকশা যাবে কিনা কে জানে।
বিকাল হয়ে আসছে, খুব একটা রিকশা নেই। পৃথিশা যাদের জিজ্ঞেস করলো তাদের কেউই যেতে ইচ্ছুক না। কি করবে বুঝতে না পেরে রাস্তায়ই দাঁড়িয়ে রইলো বেশ খানিকটা সময়। কিছুসময় পরই মারুফ বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে। হাতে অফিস ব্যাগ, মনে হয় ডিউটি আওয়ার শেষ। পৃথিশাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে আসলো।

– কোথায় যাবেন আপনি?

পৃথিশাকে বলতে না দিয়ে আবার নিজেই বলল,

– ও হ্যাঁ,আপনি তো বলেছিলেন মঈনুল রোডে যাবেন। রিকশা তো পাবেন না মনে হয়। আমার সাথে আসুন।

এতক্ষণ থেকে পৃথিশা বুঝেছে লোকটা খারাপ নয়। কিন্তু বারনার একজনের কাছেই সাহায্য চাওয়াটা ভালো দেখাচ্ছে না। তাই না করে দিল,

– সমস্যা নেই, সিএনজি করে যেতে পারব আমি। আপনাকে ধন্যবাদ।

মারুফ কিছু বলতে নিলেই তার ফোনে কল আসে। ফোনটা নিয়ে একটু দূরে চলে যায়। পৃথিশা আবারও রিকশার খোঁজ করা শুরু করে কিন্তু কোন রিকশাই সে পাচ্ছে না। এদিকে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার জন্য পায়ে ব্যাথাটাও আবার শুরু হয়েছে। কিছুসময় পরই মারুফ কথা শেষ করে ফিরে এলো।পৃথিশাকে বলল,

– সরি আমার ফিয়ন্সের ফোন ছিলো তাই কথার মাঝখানে চলে গিয়েছিলাম।দেখলেন,আপনি এখনো রিকশা, সিএনজি কিছুই পান নি আমার সাথে চলুন আমার বাসা ওইদিকেই।

পৃথিশা আর প্রতিবাদ করলো না। আসলেই অনেক দেড়ি হয়ে গেছে। আর লোকটা যেহেতু নিজে থেকেই সাহায্য করতে চাচ্ছে,তাই আর না বলল না। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। পিছনের সিটেই বসলো পৃথিশা। মারুফ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল,

– এসি অন করি? আপনার এসিতে সমস্যা হবে না তো?

– না, সমস্যা হবে কেন? আপনি অন করুন এসি।

– আসলে তখন দেখছিলাম এসির ঠান্ডায় ঘুমের মধ্যেই কাঁপছিলেন।

পৃথিশা আর কিছু বলল না। মানুষটার দৃষ্টি ও বিচক্ষণ শক্তি খুব প্রখর। সবকিছুই খেয়াল করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেলো। পৃথিশার বাসার ঠিকানা পুরোপুরি জেনে বাাসর সামনেই নামালো তাকে। পৃথিশা বারবার ধন্যবাদ দিলো তাকে। পৃথিশা গাড়ি থেকে নামতেই রায়ান কোথা থেকে ছুটে এলো। মারুফ তখন পৃথিশাকে নামতে সাহায্য করছিলো। রায়ান এসে পৃথিশার হাত ধরে নিজের দিকে ফিরালো। পৃথিশা হকচকিয়ে গেলো হুট করে এমন করায়। রায়ান জেরা করা শুরু করলো পৃথিশাকে,

– কোথায় ছিলে এতক্ষণ? কখন ছুটি হয়েছে কোচিং?আমি গিয়ে পেলাম না কেন? কথা বলছো না কেন?

মারুফ বিরক্ত হলো রায়ানের ব্যবহারে। মেয়েটার হাতে-পায়ে থাকা কি ব্যান্ডেজ তার চোখে পড়ছে না? পৃথিশাকে চুপ থাকতে দেখে সে নিজেই বলল,

– আপনি একটু থামুন। তিনি অ্যাকসিডেন্ট করেছিলেন,পরে তাকে আমি হাসপাতালে নিয়ে যাই। এজন্যই তার দেড়ি হয়েছে। আপনাার তো তাকে একবারও খোঁজলেন না।

রায়ান মারুফের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির স্বরে বলল,

– আপনি কে?

– ডা. মারুফ আহমেদ।

পৃথিশা তাদের থামালো। মারুফের দিকে তাকিয়ে বিনীত স্বরে বলল,

– আপনাকে আবারো অনেক ধন্যবাদ। বাসায় আসুন প্লিজ।

মারুফ পৃথিশার দিকে তাকলো। হলুদ রঙের কামিজ পড়া, রোদে মুখ লাল হয়ে আছে। মারুফ নাকচ করে দিলো,

– অন্য আরেকদিন আসবো। আপনি নিজের যত্ন নিবেন। আসি।

মারুফ কিছু বলার সুযোগ দিলো না। গাড়ি নিয়ে হুট করে কেটে পড়লো। মারুফ যেতেই পৃথিশা রায়ানের দিকে তাকালো। পৃথিশার ডান হাতটা তার মুঠোয় ধরা। পৃথিশা হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটা ধরলো। রায়ান-ও পিছু পিছু এসে তার হাত ধরে তাকে আটকালো।

– তুমি ওই লোকটাকে চিনো পৃথিশা? মাফুজ না কি নাম যেন বলল?

পৃথিশার দৃষ্টি তাদের হাতের দিকে। রায়ান প্রায়ই হুটহাট স্পর্শ করে বসে। শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,

– হাতটা ছাড়ুন।

রায়ান হাত ছেড়ে দেওয়ার আগেই পৃথিশা হাত ছাড়িয়ে অনেকটা তাড়াতাড়িই হেঁটে চলে গেলো। রায়ন আটকানোর সুযোগ পেলো না। রাগে মাটিতে পা দিয়ে আঘাত করলো সে।

_____

মেডিকেলে পরীক্ষার বেশিদিন বাকি নেই।পৃথিশা সব ভুলে পড়তে বসেছে।কিন্তু পড়া হচ্ছে না ঠিকমতো। একটার পর একটা ঝামেলা লেগে আছে। গত দুইদিন আগেই রায়ান তাকে বলেছে সে পৃথিশাকে পছন্দ করে। পৃথিশা মুখের উপর না করে দিয়েছে।এসব সম্ভব না। রায়ানের ব্যবহারে আগেই সে বুঝেছে। হুট করেই বাহিরে হইচইয়ের আওয়াজ শোনা গেলো।পড়া থামিয়ে উঠতে হলো তাকে। দরজা খুলে বাহিরে তাকাতেই দেখতে পেলো মারুফকে সাথে আরো কয়েকজন অপরিচিত মানুষ।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-১৫

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১৫
ফারিহা জান্নাত

বাহিরে কাঠফাটা রোদ। কোচিং থেকে পরীক্ষা দিয়ে বেরোলে রায়ানকে দেখলো না পৃথিশা। দাঁড়িয়ে বেশ কিছুসময় অপেক্ষা করলেও তার দেখা মেলে না। এদিকে গরমে নাজেহাল অবস্হা। ব্যাগে থাকা পানিটাও গরম হয়ে আছে। আশেপাশে তাকিয়ে পৃথিশা রিকশা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। আজ প্রথম পরীক্ষা ছিলো। রায়ানকে বলা ছিলো যেন তাকে নিতে আসে। পৃথিশা নতুন তাই রাস্তাঘাট খুব একটা চেনে না। বাসার ঠিকানা জানে, তাই অনেকটা সাহস করেই রিকশা নিয়ে নিলো। রাস্তায় বিশাল জ্যাম। রিকশাওয়ালা তাড়াতাড়ি যেতে রং সাইড ব্যবহারের চেষ্টা করলো। তবে কিছু পথ যাওয়ার পরপরই পাথরের সাথে রিকশার চাকা আটকে রিকশা উল্টে গেলো। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলো পৃথিশা। রিকশার চাকা পায়ে উঠে পড়েছে। ওড়নাটা চাকায় পেঁচিয়ে গেছে, পড়ে যাওয়ার হাতে আঘাতের কারনে ছিলে গেলো বেশ খানিকটা চামড়া। আশ-পাশ থেকে মানুষ এগিয়ে পৃথিশার গায়ের উপর থেকে রিকশা সরালো। কোনমতে একজন মহিলার সাহায্য নিয়ে উঠলো পৃথিশা। পা ফেলতে পারছে না, ব্যাথায় দম আটকে আসছে। লোকজন নিজেদের মতো কথা বলে চলে যাচ্ছে। পৃথিশা হাঁটার শক্তি-টাও পাচ্ছে না। রিকশাওয়ালাও বেশ আঘাত পেয়েছে। তিনিও রিকশা চালিয়ে পৃথিশাকে নিয়ে যেতে পারবেন না। মাটিতে পড়ে থাকা ব্যাগটা কোনমতে তুলে রিকশাওয়ালাকে ভাড়াটা দিয়ে দেয় সে। চোখ বুজে ব্যাথাটা হজম করে হাঁটার চেষ্টা করতেই মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে যায় সে। লজ্জায়,ব্যাথায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে কপোল বেয়ে।মূহুর্তেই একজন এসে তার হাত ধরে টেনে তুলে। ব্যাক্তিটি কে তা না দেখেই তার উপর গায়ের ভর ছেড়ে দেয় পৃথিশা। এই পা নিয়ে হাঁটার ক্ষমতা নেই তার।

কিছুসময় পর ধাতস্থ হয়ে মাথা তুলে মানুষটির দিকে তাকানোর চেষ্টা করে। নাকে জেন্টস পারফিউমের কড়া গন্ধ নাকে এসে লাগছে। পৃথিশার বেণী করা চুলগুলো লোকটার কাধে পড়ে আছে। নিজেকে লোকটার কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে নিলো সে। শ্যামবর্ণের মুখটা রোদে লাল হয়ে আছে।

– আপনি একা,আপনার সাথে কেউ নেই?

প্রশ্নকর্তার মুখের তাকালো পৃথিশা। ভ্রু কুঁচকে তিনি পৃথিশার দিকে তাকিয়ে আছেন,বয়স খুব করে ২৪/২৫হবে বোধহয়। পৃথিশা উত্তর দেওয়ার অবস্হায় নেই। ব্যাথায় মুখ নীল হয়ে যাচ্ছে।পৃথিশার অবস্হা দেখে তিনি এগিয়ে পৃথিশার ব্যাগটি নিজের হাতে নিয়ে বলল,

– আপনি কথা বলার অবস্হায় নেই।একটু কষ্ট করে আমার সাথে আসুন। ওদিকেই আমার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

পৃথিশা না বলার করার সুযোগ পেলো না। তার আগেই তাকে ধরে গাড়ির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো মানুষটা। পৃথিশাও কথা বলার সুযোগ পেলো না। চুপচাপ তার গাড়িতে বসে পড়লো। এই মূহুর্তে ভালো -খারাপ চিন্তা করার অবস্হায় নেই সে।

গাড়িতে এসি চলছে। ঘর্মাক্ত শরীরে ঠান্ডা বাতাস লেগে গা শিরশির করছে পৃথিশার। কোল্ড অ্যালার্জী আছে ছোট থেকেই।তবুও মনে হয় শীতকালই ভালো, এই অসহ্য গরমকালের চেয়ে। ওড়নার আঁচলে ঘাম মুছে ড্রাইভারের সিটে তাকালো। যিনি এই মূহুর্তে মনোযোগ সহকারে পৃথিশার পা’য়ের দিকে তাকিয়ে আছে।পৃথিশা অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। চেনা নেই জানা নেই এমন একজনের গাড়িতে হুট করে বসে পড়েছে। একবার ভাবলো নেমে যাবে,কিন্তু পায়ের ব্যাথায় পরমুহূর্তেই চিন্তাটা বাদ দিলো। লোকটা এত ভালো মানুষ, বাসার ঠিকানা বললে নিশ্চয়ই নামিয়ে দিয়ে যাবে। পৃথিশা নিম্ন স্বরে বলল,

– আমার জন্য আপনি ঝামেলায় পড়লেন। আমি দুঃখিত। আমাকে একটু কষ্ট করে মঈনুল রোডে নামিয়ে দিয়ে যাবেন প্লিজ।

লোকটা মাথা তুলে তার দিকে তাকালে পৃথিশা তাকে সম্পূর্ণরূপে দেখতে পেলো। উজ্জ্বল গৌরবর্ণের মুখ,কপালের একপাশে দাগ। পৃথিশার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। আগুন্তক বলে উঠল,

– আমি মারুফ আহমেদ,একজন ডাক্তার। আপনার পা দেখে এতটুকু বুঝতে পারছি ভালোই ব্যাথা পেয়েছেন। হাসপাতালে যেতে হবে তাড়াতাড়ি। পরে নাহলে বাড়িতে গেলেন।

পৃথিশা কথা বলতে চাইলে মারুফ আবার বলে উঠল,

– বাড়িতে কাউকে ফোন করে জানিয়ে দিন। ভয় পাবেন না আমাকে।

পৃথিশা কিছু বলল না আর। সিটে মাথা এলিয়ে দিলো। ঠান্ডায় গা কাঁপছে। ওড়না শরীর জড়িয়ে নিতেই এসিটা অফ হয়ে পাশের জানালাগুলো খুলে গেলো। পৃথিশা অবাক চোখে মারুফের দিকে তাকালো যে এখন সামনে তাকিয়ে একমনে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত।

কিছু সময় পর কারো ডাকে চোখ খুললো পৃথিশা। আরাম পেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তাকে চোখ খুলতে দেখে মারুফ মৃদু হেসে বলল,

– একটু কষ্ট করে হাতটা ধরুন, হুইল চেয়ারে বসতে হবে।

পৃথিশা জড়তা নিয়ে হাতটা বাড়ালো। মারুফের শক্তপোক্ত হাতের মাঝে তার হাতটা দেখতে ছোট লাগছে। পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতেই ব্যাথায় চোখ-মুখ কুঁচকে গেলো তার। মারুফ খেয়াল করলো সেটা। হাতের বন্ধনে আরেকটু জোর দিয়ে বলল,

– একটু সহ্য করুন, দুই পা হাঁটতে হবে শুধু।

ফাঁকা ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে পা বাড়ালো। তবে পায়ে ব্যাল্যান্স রাখতে পারলো না। এতক্ষণ বসে থাকায় পা আরো ফুলে গেছে। হুমড়ি খেয়ে পড়তে নিলেই মারুফ পৃথিশাকে কোলে নিয়ে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিলো। হতভম্ব চোখে মারুফের দিকে তাকালো সে। মারুফ হুইল চেয়ারটা টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

– সরি, আপনাকে টাচ করার কোন ইন্টেনশন আমার ছিলো না। কিন্তু পায়ের যে অবস্হা আেনার আপনি হাঁটতে পারতেন না।

পৃথিশা কোন কথা বলল না। আসলেই সে হাঁটতে পারতো না। পা ব্যাথায় টনটন করছে। হাত-ও জ্বলছে অনেক।এতক্ষণ পা ব্যাথায় হাতের কথা মনে ছিলো না।

ইমারজেন্সি বিভাগে পৃথিশাকে এনে রাখা হলো। অল্প সময়ের মধ্যেই একজন নার্স তার হাতের র’ক্ত পরিষ্কার করে তা ব্যান্ডেজ করে দিলো। এদিকে পৃথিশার মনে হচ্ছে পা ব্যাথায় সে এই মূহুর্তেই মা’রা যাবে। মারুফ-ও আশেপাশে নেই। পৃথিশা কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। কিছুসময় পরই মারুফ এসে সরাসরি তার সামনে বসে পায়ে হাত দিলে পৃথিশা আঁতকে উঠে,

– আরে, পায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?

মারুফ শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। ওই দৃষ্টিতে কি ছিলো পৃথিশা জানে না,তবে এরপর আর কিছু বলল না সে। তার পা’টা খানিকক্ষণ দেখে উঠে গিয়ে একজন নার্সকে ডাকলো সে। তাকে কিছু একটা বুঝিয়ে দিতেই তিনি পৃথিশার পা ধরে তা বেঁকিয়ে দিলেন। ব্যাথায় চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেলো পৃথিশা। চোখে পানি চলে এসেছে, ব্যাথাটা কমে যেতেই চোখ খুললো সে। মারুফ তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পৃথিশাকে এক পলক দেখে প্রেসক্রিপশন রেডি করলো সে। তারপর সেটা পৃথিশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

– ঔষধ নিয়মিত খাবেন। পা যেভাবে মচকে গেছে, এই ব্যাথা চলে যাবার পরও বেশি লোড নিলে আবার শুরু হবে। এই এক সপ্তাহ চলাফেরার সময় পায়ে বেল্ট ব্যবহার করবেন।

পৃথিশা মৃদু স্বরে ‘আচ্ছা’ বলে প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিলো।তারপর কিছু একটা ভেবে মারুফের দিকে তাকিয়ে বলল,

– এই হসপিটালে ফার্মেসী থাকলে কাউকে বলে এই ঔষধগুলো আনিয়ে দিবেন প্লিজ, আমি টাকা এনে দিচ্ছি।

মারুফ অবাক হয়ে গেলো,

– কেন? আপনার ফ্যামিলির কেউ এখনো আসে নি?

পৃথিশা কঠোরতার সহিত বলল,

– আমার ফ্যামিলি নেই,তাই আসে নি। কেউ না পারলে সমস্যা নেই আমিই যাচ্ছি।

পৃথিশা উঠতে নিলেই মারুফ তাকে থামিয়ে দিলো। বলল,

– উঠবেন না, পায়ের ব্যাথা আরো বাড়বে। আমি আনিয়ে দিচ্ছি, আপনি বসুন।

– ধন্যবাদ।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-১৪

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১৪
ফারিহা জান্নাত

পৃথিশা রায়ানের কাছে পড়তে এসেছে। কিন্তু রায়ান বেশ কিছুক্ষণ সময় ধরে ফোনে কি যেন করছে। পৃথিশা দুইবার ডাকলেও জবাব দিয়ে আবার চুপ করে যায়। একটা সময় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো পৃথিশা। বিরক্তিতে বই গুছিয়ে চলে যেতে নিলেই হাতে টান পড়লো তার। রায়ান তার হাত টেনে আবার বিছানায় বসিয়ে দিয়েছে। রায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে ফোন পাশে রেখে দিয়েছে। পৃথিশা বই খুললো। রায়ান তাকে প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস দাগিয়ে দিয়ে পড়তে বললো। পৃথিশা নিজের রুমে গিয়ে পড়তে চাচ্ছিলো।রায়ানের সামনে পড়তে তার অস্বস্তি লাগছে। রায়ানের চোখের দৃষ্টি অন্যরকম। পৃথিশা বই গুছিয়ে নিচ্ছে দেখে রায়ান জিজ্ঞেস করলো,

– কি ব্যাপার? পড়বে না?

– রুমে গিয়ে পড়ি।

রায়ান ভ্রু কুঁচকালো।ময়েটা এখানে পড়বেনা কেন,আজব। বলল,

– কেন,এখানে পড়তে কি সমস্যা? আমি কি তোমাকে বিরক্ত করছি?

– আমি কি একবারও বলেছি আপনি আমাকে বিরক্ত করেন? আমি থাকলে আপনি নিজেই বিরক্ত হবেন আপমার পড়ার শব্দে।তাই চলে যেতে চেয়েছিলাম।

– তুমি থাকলে আমি কখনোই বিরক্ত হবো না পৃথিশা।

পৃথিশা চুপ হয়ে গেলো। বই খাতা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ বসে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রায়ান পৃথিশার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটা এত কঠিন মনের কেন!

পৃথিশা নিজের রুমে এসে পড়ছে। কিন্তু পড়ায় মন বসছে না। বারবার রায়ানের কথা মাথায় আসছে। রায়ানের চাহনি, কথা সে বুঝে। কিন্তু এসব করার সময় এখন না। পৃথিশা এসবে জড়াতে চায় না। কিন্তু রায়ানকে পাল্টা কিছু বলার সুযোগ সে পাচ্ছে না। এসব অযাচিত ভাবনা রেখে পড়রায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো পৃথিশা। মেডিকেলে চান্স হয়ে গেলে সে চলে যাবে এখান থেকে। এভাবে মানুষের বোঝা হয়ে থাকার কোন ইচ্ছা তার নেই।

______

পৃথিশার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছেন রাহনুমা। পৃথিশা আরামে চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে আছে রাহনুমার গাঁয়ে। আগে মণিদীপা এভাবে তার মাথায় তেল দিয়ে দিতো। এতো বড় চুলে তেল লাগানোর মতো ইচ্ছা থাকতো না পৃথিশার,মণিদীপাই সবসময় তেল লাগিয়ে দিতো নিয়ম করে। আজ তার চুলগুলো উশকো-খুশকো দেখে রাহনুমা তেল লাগিয়ে দিচ্ছেন। রাহনুমা পৃথিাশাকে অনেক যত্নেই রেখেছেন।পৃথিশা এই মানুষটার জন্যই এখানে আছে। নাহলে নিজ শহর ছেড়ে এখানে আসার কোন ইচ্ছা তার ছিলো না। তার জন্যই পৃথিশা এই বাসা থেকে যেতে পারছে না,নাহলে কবেই চলে যেত।
পৃথিশার মাথার চুলগুলো দু’ভাগ করে বেণী করে দিলেন রাহনুমা। চুলের আগাগুলো আঁচড়ে দিয়ে বললেন,

– এত বড় চুল সামলাতে কষ্ট হয় না? একটু ছোট করে কোমড় সমান করে নিলেই তো পারিস। হাঁটু পর্যন্ত বড় চুল রেখে কি করবি।

– বুবু আমার চুল শখ করে বড় করেছিলো খালা। তার ইচ্ছা ছিলো আমার চুল বড় থাকবে। আমি সেই চুল কাটি কি করে।

রাহনুমা কিছু বললেন। যে উদ্দ্যেশ্যে পৃথিশাকে ঢাকায় এনেছেন তা পূরণ হয় নি। পৃথিশার মানসিক অবস্হা আগের মতোই আছে। এখনো কারো সাথে স্বাভাবিক হতে পারে নি। পৃথিশা রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলেই রায়ানের মুখোমুখি হলো। পৃথিশার ছোটখাটো গোলগাল মুখটা তেলেতেলে হয়ে আছে। রায়ান একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। সোজা রুমে ঢুকে গেলো সে। পৃথিশা রায়ানের কাজে খানিকটা অবাক হলেও পাত্তা দিলো না। আগামীকাল তার পরীক্ষা কোচিংয়ে সেটার প্রিপারেশন নিতে হবে। সময় নষ্ট করার মতো সময় তার হতে নেই।
পৃথিশা রুমে গিয়ে পড়তে বসতেই দেখলো তার প্রয়োজনীয় একটা বই নেই। রায়ানের রুমে থালতে পারে এটা ভাবতেই সে আবার রুম থেকে বের হয়। রায়ান তখন রাহনুমার রুম থেকে বের হয়ে কোথাও যাচ্ছিলো।পৃথিশার সাথে ধাক্কা লেগে তার হাতে থাকা কাগজগুলো পড়ে ছড়িয়ে গেলো। পৃথিশার দিকে তাকিয়ে রায়ান বিরক্ত গলায় বলল,

– দেখে চলতে পারো না তুমি? সারাক্ষণ ধুপধাপ করে বেড়াও।

পৃথিশা উত্তর দিলো না। তার চোখ কাগজগুলোর দিকে।পৃথিশা কাগজগুলো হাতে দেখলো মণিদীপার মেডিকেল রিপোর্ট। এগুলোর কপি রায়ানের কাছে কীভাবে গেলো তা বুঝতে পারলো না। এগুলো তো তার কাছে ছিলো। পৃথিশা রায়ানের দিকে তাকালে দেখতে পেলো রায়ানের চোখের দৃষ্টি অন্যরকম, কেমন যেন তাচ্ছিল্য মেশানো।পৃথিশা কাগজগুলো তুলে জিজ্ঞেস করলো,

– আপনি এগুলো কোথায় পেয়েছেন?

– তা জেনে তোমার কাজ কি? কাগজগুলো আমাকে দাও।

– আমি জিজ্ঞেস করেছি কোথায় পেয়েছেন এগুলো? উত্তর দিন আমাকে।

পৃথিশার গলার স্বর উচ্চ।রাহনুমা চৌধুরী তার গলার স্বর পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।।পৃথিশা রিপোর্টগুলো দেখিয়ে বলল,

– তোমার কাছে এগুলো কীভাবে গেলো খালা?

রাহনুমা কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। পৃথিশার লাগেজ থেকে রিপোর্টগুলো তার নিই সরিয়ে রেখেছিলেন। এইসব ব্যাপার ধামাচাপা দিতে চাচ্ছিলেন তিনি। পৃথিশা এসব নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করলে তিনি নিজেও ঝামেলায় পড়বে ভেবে তিনি কাগজগুলো সরিয়ে ফেলেছিলেন যাতে কোন প্রমাণ না থাকে। পৃথিশা এসব জানলে এখনই বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে তিনি জানেন।তাও তিনি বুঝানোর স্বরে বললে,

– আমি এগুলো নিজের কাছে রেখেছিলাম। তুই এসব নিয়ে মন খারাপ কর আমি চাই না।

পৃথিশা শান্ত হলো খানিকটা। দমে না গিয়ে বলল,

– ভাইয়ার হাতে এগুলো কেন গেলো?

রাহনুমা ফ্যান চলাকালীন সময়েও ঘামছেন। রায়ানকে দিয়ে বলেছিলেন যাতে এগুলো নিচে গিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসে। পৃথিশার মুখোমুখি এভাবে হবে তিনি ভাবেননি। রায়ান কিছু বলতে চাইলেই রাহনুমা তাকে থামিয়ে দিলেন। পৃথিশার দিকে এগিয়ো মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললেন,

– ও বোধহয় ভুলে তার কাগজ নাম তে গিয়ে এগুলো নিয়ে গেছে। আমি দেখিনি ঠিকভাবে।

পৃথিশা পাল্টা প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেলো। চুপ চাপ নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। রাহনুমা চৌধুরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। রায়ানকে রুমে যেতে বলে তিনি নিজেও চলে গেলেন।

পৃথিশা রুমে এসে নিজের আলমারির চাবিটা দেখলো সঠিক জায়গায় আছে কিনা। চাবিটা ঠিক জায়গায় দেখে সে বুঝতে পারলো রাহনুমা বেগমের কাছেও ডুপ্লিকেট চাবি আছে। তা না হলে তিনি আলামরি থেকে এই কাগজ নিতে পারতেন না। রাহনুমার চিন্তার কারন পৃথিশা বুঝতে পেরেছে। কেউই নিজের ঘাড়ে ঝামেলা নিতে চায় না। পৃথিশা ঠিক করলো গ্রাম থেকে নিজেদের রুমের টেবিলেটা এখানে আনাবে।সেটার চাবির ডুপ্লিকেট নিশ্চয়ই রাহনুমার কাছে থাকবে না। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো তাকে সামলে রাখতে হবে। মণিদীপা শখ করে পৃথিশাকে সেটা বানিয়ে দিয়েছিলো।মণিদীপার কথা মনে আসতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো পৃথিশা। ক্লান্ত স্বরে বলল,

– আমি তোকে ছাড়া একেবারেই থাকতে পারতাম না বুবু, অথচ তোর আর আমার মাঝে এখন কত দুরত্ব। এই বিশাল পৃথিবীতে আমার জন্য কেউ নেই। আমাকে বুঝার কেউ নেই। কাকে বিশ্বাস করব আমি। সবই স্বার্থপর। আমাকে তোদের সাথে নিয়ে গেলি না কেন বুবু। আয়নায় নিজেকে দেখতে আমার ঘৃণা হয়। পরাজিত মুখটা নিয়ে আমি আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারি না। কান্না গলায় দলা পাঁকিয়ে আসে, কাঁদতে পারি না। তোরা সবাই পালা করে আমাকে ছেড়ে গেলি,কেন? কেন?

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-১২+১৩

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১২+১৩
ফারিহা জান্নাত

ব্যস্ততম নগরী ঢাকা। এখানকার মানুষগুলোও আত্মকেন্দ্রিক। নিজেদের মত করে থাকে সবাই। অন্য কাউকে নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। পৃথিশার খালু আর্মি অফিসার ছিলেন, সেই সুবাদে পৃথিশার খালা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে থাকেন। ক্যান্টনমেন্ট এলাকাগুলো বেশ ছিমছাম, গুছানো হয়ে থাকে। পৃথিশার বেশ পছন্দ হলো জায়গাটা। কোন কোলাহল নেই, চেঁচামেচি নেই। প্রত্যেকটা বাসার সাথে একটা করে পার্ক। গাড়ি থেকে নামার জন্য তাগাদা দিলেন রাহনুমা বেগম। চুলগুলো সামলে নিয়ে নামলো পৃথিশা। গাড়ির ঝাঁকুনিতে বেণী প্রায় খুলে গেছে। হাঁটু নিচে পড়া চুলগুলো পৃথিশা সেই কবেই কেটে ফেলতো যদি না মণিদীপা বাধা দিতো। মণিদীপার কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। পৃথিশা একটা জিনিস বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করেছে, মণিদীপার জন্য তার যতটা মন খারাপ হয় ততটা মন খারাপ তার মা কিংবা বাবার জন্য হয় না। তাদের ছাড়া নিজেকে সামলে নিতে পেরেছে সে কিন্তু মণিদীপার চলে যাওয়াটা সে এখনো মানতে পারে নি। হয়তোবা সর্বক্ষণ মণিদীপার সাথে থাকার কারণেই তার অভাবটা বেশি পরিলক্ষিত হয়। ভাবনা বাদ দিয়ে খালার পাশে দাঁড়ালো সে। বিশাল উঁচু বিল্ডিং, গায়ে বড় করে নাম লিখা ‘পড়শী’। পৃথিশা লক্ষ্য করলো সবগুলো বিল্ডিংয়ের আলাদা আলাদা নাম। পৃথিশার খালার এক মেয়ে ও এক ছেলে। বড় ছেলে কিছুদিন আগে পড়াশোনা শেষ করেছে পৃথিশা যতদূর জানে। মেয়েটার খবর জানা নেই তার। রাহনুমার ধাক্কায় সজ্ঞানে ফিরলো পৃথিশা। গাড়ির পেছন থেকে তাদের ব্যাগগুলো ড্রাইভার নামিয়ে ফেলেছে। নিজের বিশাল লাগেজটা নিয়ে হাঁটা ধরলো পৃথিশা। রাহনুমার বাসায় কখনো আসা হয় নি তার। রাহনুমাই যেতেন সবসময়। পৃথিশার মায়ের বড় হওয়ার বোনকে খুব স্নেহ করতেন। পৃথিশার খালু গত হয়েছেন বছর দুয়েক হবে। মিশনে মৃত্যু হওয়ায় এখানে বেশ সুযোগ-সুবিধা পান রাহনুমা। তবে রাহনুমা বেশিরভাগ একাই তাদের বাসায় যেতেন। তাই তার ছেলে-মেয়েকে দেখার খুব একটা সুযোগ হয়নি পৃথিশার।

বিশাল বিল্ডিংয়ের আটাতালায় রাহনুমা বেগনের বাসা। বাসার সামনে জুতার র্যাক ও নানারকম ইনডোর প্ল্যান্ট। পৃথিশার গাছ পছন্দ না।কিন্তু মণিদীপার পছন্দ থাকায় তাদের অনেকগুলো ফুল গাছ ছিলো। পৃথিশা সেগুলো সাথে করে নিয়ে এসেছে। তবে গাড়ি যে ঝাঁকুনি খেয়েছে তাতে মনে হয় সব গাছ একসাথে লেপ্টালেপ্টি করে লেগে আছে। কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুললো রাহনুমা বেগমের বড় ছেলে রায়ান। মা’কে দেখে জড়িয়ে ধরলো সে। পৃথিশার দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকালো। রাহনুমাকে জিজ্ঞেস করলো,

– উনি কে?

– পৃথিশা,তোর ছোট খালার মেয়ে। মনে নেই?

বড় বড় চোখে পৃথিশার দিকে তাকালো রায়ান। অস্বস্তিতে পড়ে গেলো পৃথিশা। এদিক-ওদিক দৃষ্টি ঘুরাতে লাগলো। রায়ান বিস্মিত স্বরে বলল,

– মাই গড! এটা পৃথিশা? এত বড় হয়ে গেছে কীভাবে? ও না কত ছোট ছিলো, এইযে এতটুকু।

বলেই তিনি কোমড় সমান পর্যন্ত হাত দিয়ে ইশারা করলো রায়ান। পৃথিশা আরও অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। রাহনুমা বেগম ছেলেকে সরালেন। পৃথিশা এতক্ষন বাহিরে দাঁড়িয়েই তাদের কথা শুনে যাচ্ছিলো। রাহনুমা তাকে ভেতরে আনলেন। বাসাটা বেশ বড়। তিনি পৃথিশাকে একটা রুম দেখিয়ে দিলেন। বুয়াকে বলে তিনি আগেই রুম পরিষ্কার করিয়ে রেখেছিলেন। পৃথিশাকে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে দিলেন তিনি।

পৃথিশাকে যে রুম দেয়া হয়েছে তা মাঝারি ধরনের, খুব বেশি বড় না আবার ছোটও না। একটা আলমারি, একটা টেবিল ও বিছানা। রুমের সাথে একটা বারান্দা-ও আছে। পৃথিশা লাগেজটা বিছানার উপর রাখতেই রায়ান আসলো তার রুমে। ঢোকার আগে দরজার শব্দ করে দুইবার। পৃথিশা সেদিকে তাকালো। রায়ান শরবতের গ্লাসটা টেবিলে রেখে হেসে বলল,

– জার্নি করে এসেছ, ঠান্ডা শরবত ভালো লাগবে।

মৃদু স্বরে ধন্যবাদ দিলো পৃথিশা। রায়ান তার দিকে কিছুক্ষণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

– আম্মু বলেছিল তুমি মারকুটে ধরনের মেয়ে। কিন্তু তোমাকে তো সেরকম মনে হচ্ছে না।

মাত্রই শরবত মুখে তুলেছিল পৃথিশা। রায়ানের কথা শুনে তা গলায় আটকে গেলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

– আমি কি এখন আপনার সাথে মারামারি করে দেখাব আমি কেমন?

– এইতো এতক্ষণে কথা ফুটেছে মুখে। মারামারি করতে বলি নি, জাস্ট জানতে চেয়েছি। যাই হোক, জার্নি করেছ রেস্ট নাও। মারামারি করার সময় পাবো আরো।

পৃথিশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রায়ান বেরিয়ে গেলো। রায়ান চলে যেতেই পৃথিশা দরজা আটকে দিলো। জামা বের করে গোসল করতে চলে গেল। বের হতে না হতেই দরজায় আবারো টোকা পড়লো। পৃথিশা তখন চুল মুছতে ব্যস্ত। ভেজা তোয়ালে-টা বিছানায় রেখে সে দরজা খুলতে গেলো। রায়ান খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছে। পৃথিশার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। তাকে চুপ থাকতে দেখে পৃথিশা নিজেই জিজ্ঞেস করলো,

– কিছু বলবেন?

রায়ান অস্ফুটস্বরে কিছু একটা বলল। পৃথিশা শুনতে পেলো না ঠিকমতো। তাই আবারো একটু জোরেই জিজ্ঞেস করলো,

– কি বলতে এসেছেন বলুন।

রায়ান দৃষ্টি সরালো। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

– খেতে আসুন।

যেতে গিয়েও আবার ফিরে এসে বলল, “চুল মুছে নিও, জামা ভিজে যাচ্ছে।”

বলেই চলে গেলো। পৃথিশা অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। হুঁশ ফিরতেই ভেজা তোয়ালেটা মাথায় জড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। খাবার টেবিলে রাহনুমা বেগম, রায়ান বসে আছে। রাহনুমা বেগমের মেয়েকে চোখে পড়লো না পৃথিশার। জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করলো না। পৃথিশা রাহনুমা বেগমের পাশে বসলো। তার ঠিক সামনাসামনি বসলো রায়ান। তার চোখের দৃষ্টি অন্যরকম। পৃথিশাকে খানিকটা বিভ্রান্ত দেখালো। সবাইকে চুপচাপ দেখে রায়ানই কথা বলা শুরু করলো। পৃথিশার ব্যাপারে সবই শুনেছে সে।সেখান থেকেই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লো,

– মেডিকেল ভর্তি পরিক্ষা তো দুই মাস পরই হবে। প্রিপারেশন কেমন?

হাত থেমে গেলো পৃথিশার। রায়ানের দিকে চকিত নজরে তাকালো। রাহনুমা বেগম ছেলেকে বললে,

– তোকে কে বলল পৃথিশা মেডিকেলে দিবে? পৃথিশা বলেছে?

পৃথিশা কিছু বলল না দেখে রাহনুমা রায়ানকে আবারো জিজ্ঞেস করলেন,

– কি রে বল।

– মনে হলো তাই বললাম।

পৃথিশা কোন কথা না বলে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে চলে গেলো। এইচএসসি পরীক্ষার পরে পড়াশোনায় যে ঘাটতি এসেছে তা এই এক মাসে কভার করা সম্ভব হবে না। মণিদীপার ইচ্ছা ছিলো পৃথিশাকে মেডিকেলে পড়ানোর। পৃথিশার নিজস্ব কোন পছন্দের সেক্টর নেই, তবে সে চেয়েছিল ইন্জিনিয়ারিংয়ের দিকে যেতে। পরে অবশ্য মণিদীপার ইচ্ছেতে মেডিকেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এই কয়েকমাসে তার তেমন কোন প্রস্তুতি নেওয়া হয় নি। এখন শুরু করলেও শেষ করতে পারবে না।
এসব নিয়ে ভাবনার মাঝেই রাহনুমা বেগম প্রবেশ করলেন, হাতে এক গ্লাস দুধ। পৃথিশার জন্য এনেছেন। মেয়েটা কয়েকদিন কিছুই খায় নি। এছাড়াও তিনি ঠিক করেছেন পৃথিশাকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাবেন। মেয়েটা আজ গাড়িতে ঘুমের মধ্যেও কয়েকবার ভয় পেয়ে উঠে গেছে। চিকিৎসা না করালে জল বহুদূর গড়াবে। পৃথিশাকে খানিকটা জোর করে অর্ধেকের মতো দুধ তিনি খাওয়াতে পারলেন। মেয়েটা এতো জেদি, কারো কথা সহজে শুনতে চায় না। গ্লাসটা টেবিলে রেখে তিনি পৃথিশাকে জিজ্ঞেস করলেন,

– কোথায় এডমিশন নিবি? কিছু ঠিক করেছিস?

– মেডিকেলে নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সময় নেই হাতে।

রাহনুমা বেগম কিছু একটা ভাবলেন। পরপরই বললেন,

– রায়ন পড়াবে তোকে। ও তো মেডিকেলে-ও চান্স পেয়েছিলো,পড়লো না। ও তোকে গাইড করতে পারবে।

পৃথিশা কিছু বলল না। রাহনুমা বেগম নিজের মনেই বলতে থাকলেন,

– কালকে রায়ানের সাথে গিয়ে প্রয়োজনীয় বই কিনে আনিস, এখন তো কোথাও ভর্তি হলেও বুঝতে পারবি না ঠিকঠাক। আগে নিজে পড়া শুরু কর,পরবর্তীতে ঠিক করিস কি করবি।

কথাগুলো বলে তিনি পৃথিশার মাথায় একটা চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেলেন। পৃথিশা শুয়ে পড়লো বিছানায়। শরীর আর চলছে না খাওয়া-দাওয়ার পর।

পরদিন ভোরে বেশ তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙলো পৃথিশার। অপরিচিত জায়গা বলে রাতে বারবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙলেও রুম থেকে বের হলো না সে । বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ। ঘড়ির কাঁটা ছয়ের ঘরে আসতেই নিচে রায়ানকে দেখতে পেলো। জগিং স্যুট পড়ে রাস্তার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় বারবার দৌড়াচ্ছে সে। কিছুক্ষণ পরপর থেমে আবার বিশ্রাম নিচ্ছে। পৃথিশা বারান্দায় আর দাঁড়ালো না। রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেলো রাহনুমা বেগম নাস্তার আয়োজন করছে। পাশে কাজের মেয়েটি তাকে সাহায্য করছে। পৃথিশা হাত লাগাতে চাইলো কিন্তু রাহনুমা বেগম দিলেন না। পৃথিশাকে চা দিয়ে রান্নাঘর থেকে বের করে দিলেন। পৃথিশা চা খেতে বসতেই কলিংবেল বাজলো। রাহনুমা বেগম পৃথিশাকে বললেন দরজাটা খুলতে। পৃথিশা দরজা খুলতেই রায়ানের ঘর্মাক্ত মুখস্রী নজরে এলো। সরে দাঁড়িয়ে রায়ানকে ঢোকার সুযোগ করে দিলো।

বসার ঘরে এসে ফ্যান ছেড়ে গা এলিয়ে বসলো রায়ান। পৃথিশা তার চায়ের কাপটা এখানেই রেখে গিয়েছিলো। কাপটা নিতে এসে দেখলো রায়ান সোফায় বসে আছে,পা দুটো সামনে থাকা টি-টেবিলের উপর উঠানো। পড়নে স্যুটের উপরের দুই বোতাম খোলা, ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে।পৃথিশা চেয়েছিলো নিঃশব্দে চায়ের কাপটা নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু তা হলো না। কাপটা উঠিয়ে যেতে নিলেই রায়ান চোখ বন্ধ অবস্হায়ই বলে উঠল,

– বসো পৃথিশা, কথা বলি।

পৃথিশা আর যাওয়ার সুযোগ পেলো না। অগত্যা বসতেই হলো তাকে। রায়ান মৃদু হেসে পা নামিয়ে বলল, ” গুড মর্নিং। কি অবস্হা? রাতে ঘুম হয়েছে? চোখ-মুখ ফুলে গেছে একদম। ”

পৃথিশার মুখ লজ্জায় রাঙা হলো। মৃদু স্বরে বলল, ” শুভ সকাল।”

রায়ান উচ্চস্বরে রাহনুমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আম্মু এক কাপ চা।”
তারপর পৃথিশাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– আম্মু বলল আজকে তোমাকে নিয়ে বই কিনতে যেতে। কখন বের হবে?

– যখন আপনার সময় হবে।

রায়ান শব্দ করে হাসলো। বলল,

– অ্যা’ম এট ইউর সার্ভিস ম্যাম। যখন বলবেন তখনই যাব।

পৃথিশা চুপ হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবল, ছেলেটার সমস্যা কি এভাবে কথা বলে কেন সবসময়। পৃথিশাকে কিছু বলতে না দেখে রায়ান নিজেই বলল,

– তাহলে দুপুরের খাবার পর বের হই, তখন রোদ একটু কম থাকবে।

পৃথিশা ‘আচ্ছা’ বলে উঠে গেলো। রায়ানের সামনে বসতে তার অস্বস্তি হয়। ছেলেটার দৃষ্টি তার কাছে অদ্ভুদ ঠেকে।

বিকেল বেলা রোদ কমলে রায়ান পৃথিশাকে নিয়ে বের হওয়ার জন্য তৈরী রায়ানের নিজেদের গাড়ি আছে। গাড়ি নয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো তারা । পৃথিশা রেডি হয়ে বের হতেই রায়ান রওনা হলো তাকে নিয়ে। পেছনের সিটে পৃথিশাকে বসতে দেয়নি রায়ান। জোর করে পাশের সিটেই বসেছে। পৃথিশা কিছু বলে নি,বরাবরেই মতোই নিশ্চুপ ছিলো। এসব অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে চায় না সে। কিছুসময় পর রায়ান নিজেই মুখ খুললো,

-তুমি কি সবসময় এমন চুপ করেই থাকো? কথা বলো না? আম্মু তো বলেছিলো তুমি খুব প্রাণোচ্ছল।

পৃথিশা রায়ানের দিকে তাকালো। সে একমনে সম্মুখে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে। চোখ ঘুরিয়ে নিলো পৃথিশা। থমথমে স্বরে বলল,

– কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না,তাই বলিনি।

– কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো না কেন? মানুষটা আমি বলে?

পৃথিশা উত্তর দিতে যাবে তার আগেই গাড়ির ঝাঁকুনিতে তার খোপা করা চুলগুলো ঝড়ঝড়িয়ে খুলে চারপাশে ছড়িয়ে গেলো। বিরক্তিতে মুখ কালো হয়ে গেলো পৃথিশার। বিড়বিড়িয়ে একটা গালি দিয়ে চুলগুলো গুছিয়ে একপাচে আনলো সে। পৃথিশাড বিড়বিড়িয়ে বলা কথাটা রায়ানের কানে গেলো। সে হতভম্ব হয়ে বলল,

– তুমি? তুমি এসব কি বলো? কিসের কি বাচ্চা?

পৃথিশা বিরক্তি ছিলো সবকিছু নিয়ে। রায়ানের দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

– আপনি কি প্লিজ চুপ করবেন?

রায়ান চুপ হয়ে গেলো, বাকিটা পথ কোন কথা বললো না সে। পৃথিশার প্রয়োজনীয় বইগুলো কিনে দিয়ে তাকে গাড়িতে বসিয়ে নিজে আবার বেরিয়ে গেলো। রায়ান বের হতেই হুট করে বৃষ্টি শুরু হলো। হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নয়, একেবারে মুষলধারে বৃষ্টি। পৃথিশা চিন্তিত চোখে বাহিরে তাকালো। ছেলেটা এখনো আসছে না কেন? তার ভাবনার মাঝেই রায়ান ভেজা শরীরে গাড়ির দরজা খুলে বসে পড়লো। তার মাথা থেকে পানি পড়ছে। হাতে খাবারের প্যাকেট।সেগুলো সাবধানে গাড়ির সামনের জায়গায় রেখে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছতে থাকলো। পৃথিশার একটা কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো কিন্তু কিছু বলল না। চোখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলো। রায়ান মাথা মুছে পৃথিশার দিকে তাকালো। পৃথিশার পড়নে সাদা জামা,তাতে গোলাপি সুতার কারুকাজ করা। পৃথিশার শ্যামলা বদনে রঙটা অন্যরকম লাগছে। চুলগুলো হাতখোপা করে রাখা,তবে খোপা থাকছে না হেলে ঘাড়ের পড়ে গেছে। রায়ান চোখ সরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-১১

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১১
ফারিহা জান্নাত

মধ্যরাত, বাহিরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাজ পড়ার প্রচন্ড আওয়াজে ঘুম ভাঙলো পৃথিশার। শুয়ে থাকতে থাকতে কোন সময় যে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল করেনি। নিভু নিভু চোখজোড়া খুলতেই দেখতে পেলো সিলিং ফ্যানে কেউ ঝুলছে।তার পা দুটো ঠিক তার মুখের কয়েক ইঞ্চি উপরে। চিৎকার করে বালিশে মুখ গুজলো সে। বৃষ্টির শব্দের কারনে তার চিৎকার বাহিরে পৌঁছালো না। বালিশ থেকে মুখ তুলতেই সেই রাতের মণিদীপার রক্তাক্ত মুখস্রী ভেসে উঠলো চোখের সামনে। তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো সে। দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে হাঁটুতে মুখ গুজে কেঁদে উঠলো সে। মস্তিষ্ক যেন বলছে, তুই দায়ী সবকিছুর জন্য,কাউকে আগলে রাখতে পারলি না। চিৎকার করে পাশে থাকা ল্যাম্পটা ছুড়ে ফেললো সে। সে শব্দে পাশের রুম থেকে তার খালা দৌড়ে আসলো। দরজা বন্ধ থাকায় রুমে আসতে পারলো না। পদরজা ধাক্কাতেই পৃথিশা চিৎকার করে উঠল,

– চলে যাও সবাই। কেউ আসবে না আমার কাছে কেউ না।

বেশ কিছুক্ষণ দরজা ধাক্কানোর শব্দ শোনা গেলেও পরে আর শোনা গেলো না। পৃথিশা হু হু করে কেঁদে উঠলো। বিড়বিড়য়ে বলল,

– সবাই চলে যায় আমাকে রেখে। সবাই। কেউ থাকলো না আমার সাথে কেউ না।

পরমুহূর্তেই চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো সে। প্রচন্ড আক্রোশে বলল,

– তুই হেরে গেছিস বুবু,তোর লড়াই করার কথা ছিলো কিন্তু তুই হার মেনে নিলি। আমি হার মানবো না বুবু, ওদের মৃত্যু না দেখলে আমি শান্তি পাবো না।

পৃথিশা উন্মাদের মতো দরজা খুললো। বাহিরে যাওয়ার জন্য হাঁটা ধরতেই পেছন থেকে তার খালা এসে ধরলেন তাকে,

– এতরাতে কোথায় যাচ্ছিস তুই পৃথিশা?

পৃথিশা ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে নিলো। চিৎকার করে বলল,

– আমাকে ছাড়ো খালা, ঝামেলা করবে না।

– শান্ত হ মা,বস তুই। একটু শান্ত হ।

পৃথিশা শুনলো না। তার জ্ঞান- বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। পৃথিশার খালা বয়স্ক মানুষ। তার শরীরে এত জোর নেই। পৃথিশা সহজেই তাকে সরিয়ে বের হয়ে গেলো। পৃথিশার খালা তার পেছন পেছন গেলেন। বাহিরে ঝড়ো হাওয়া সাথে তুমুল বৃষ্টি। পৃথিশা বাহিরে বের হলো, তবে বৃষ্টির কারনে আশ-পাশ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চোখের পানি বৃষ্টির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এই গ্লানি কি শেষ হবার…

________

ঘুম ভাঙতেই নিজিকে বিছানায় আবিষ্কার করলো পৃথিশা। মাথা প্রচন্ড ভার হয়ে আছে। কাল রাতের ঘটনার কিছুই তার মনে নেই। পাশের টি-টেবিলে পানি ও রুমাল রাখা। বাহিরে বের হওয়ার পর থেকে আর কোন ঘটনাই তার মনে নেই। বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে নিলো সে। রুম থেকে বের হতেই দেখতে পেলো বাসায় বাড়িওয়ালা এসেছে,তার সাথে তার খালা কথা বলছে। পৃথিশা সেদিকে এগিয়ে গেলো। তাকে দেখে বাড়িওয়ালা চুপ হয়ে গেলো। কিছু না বলে উঠে গেলেন উঠে গেলেন তিনি।পৃথিশা তার খালাকে জিজ্ঞেস করলো,

– কি হয়েছে? তিনি আসলেন কেন?

পৃথিশার খালা কথার উত্তর না দিয়ে পৃথিশার দিকে এগিয়ে মাথায় হাত রাখলেন, স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন,

– অবশেষে জ্বর কমেছে, ভয় পায়িয়ে দিয়েছিলিস তুই। এখন কেমন লাগছে?

– উনি এখানে এসেছিলেন কেন?

– বাসা ছাড়তে হবে না বললেন।

তাচ্ছিল্য হাসলো পৃথিশা। যাকে নিয়ে সমস্যা ছিলো সে তো এখন নেই,তাই সমস্যাও হওয়ার কথা নয়। পৃথিশার খালা তার কাছে এলেন। এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিলেন। নরম গলায় বুঝাতে চেষ্টা করলেন,

– এখানে থাকলে তোর প্রতিনিয়ত ওদের কথা মনে পড়বে। তুই আমার সাথে চল। তুই তো আমারই মেয়ে, আমার সাথে থাকবি তুই এখন থেকে।

পৃথিশা কথা বলল না,নিজের রুমে এসে বসলো সে। মণিদীপার রুমে যাওয়ার সাহস তার নেই। কাল রাতের ঘটনা মস্তিষ্কে ভাসছে। এরই মাঝে মনে হলো কেউ যেন কানের পাশে বলছে, ‘আমি পারি নি, আমি পারি নি।’
কান চেপে ধরলো পৃথিশা। মাথা নাড়ালো বার’কয়েক। মনে হচ্ছে মণিদীপা দেখছে ওকে।পৃথিশার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। মূহুর্তেই মনে পড়লো সে কালকে এই সময়ে যে দু’জন মানুষের সাথে ছিলো তারা আজ নেই,মৃ/ত তারা। পৃথিশা আর ভাবতে পারলো না কিছু। বিছানায় শুয়ে কানে বালিশ চেপে ধরলো সে। নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো।

– মেয়েটার বারবার গা কাঁপিয়ে এমন জ্বর আসছে কেন? কিভাবে কি করব আমি।

রাহনুমা বেগনের কন্ঠস্বর চিন্তিত। তিনি বড় ভাইকে ফোন দিলেন। পৃথিশা তখন নিভুনিভু চোখ খুলছে। তিনি পৃথিশার মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলেন দ্রুত। পৃথিশা বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলছে।তিনি পৃথিশার মুখের কাছে মাথা নিলেন, পৃথিশার তার হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে। পৃথিশা ভাঙা স্বরে বলছে, ‘আমি তোকে ভয় পাচ্ছি বুবু,তুই চলে যা।’
রাহনুমা চৌধুরী বোকা নন।পৃথিশা যতই কঠোর হোক না পরপর এতগুলো শকে সে হতভম্ব হয়ে গেছে। নিজেকে শান্ত করতে সময় লাগছে তার। মণিদীপা তার খুব কাছের। বোনকে এভাবে হারিয়ে সে নিজেকে সামলাতে পারছে না। ধীরে ধীরে সেই কষ্ট মানসিক অবসাদে রূপ নিচ্ছে। তিনি ঠিক করলেন কালকের মধ্যেই পৃথিশাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাবেন। এখানে থাকলে পৃথিশা অসুস্থ হয়ে পড়বে। বাসার ফার্নিচারগুলো তিনি গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্হা করবেন৷ তিনি সাথে সাথে নিজের ছেলেকে ফোন দিয়ে আসতে বললেন। খুব দ্রুতই সব ব্যবস্হা করে ফেললেন পৃথিশার মামার সাহায্যে। সকাল হলেই তহওয়ার নি পৃথিশাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবেন।এখন অপেক্ষা নতুন সকালের।

পৃথিশার ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। চারপাশে তখনও আলো ফোটেনি। পাশে তার খালা নামাজ পড়ছেন।পৃথিশাকে উঠতে দেখে তিনি বললেন,

– ভালো লাগছে এখন মা? হাত-মুখ ধুয়ে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নে। আমরা আলো ফুটলেই বের হবো।

পৃথিশা অবাক হলো। বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,

– কোথায় যাবো এত সকালে?

– ঢাকায় যাবি তুই আমার সাথে।

রাহনুমার কন্ঠস্বর কড়া। পৃথিশা বিস্মিত ভাব কাটিয়ে দ্রুত বলল,

– আমি কোথাও যাবো না। আমি এখানেই থাকবো।

– আমি তোর মতামত জানতে চাইনি পৃথিশা। তুই আমার সাথে যাবি মানে যাবি। আর কোন কথা শুনতে চাই না আমি।

পৃথিশা কিছু বলার সুযোগ পেলো না। রাহনুমা নিজেই পৃথিশার ব্যাগ গুছাতে শুরু করলো। পৃথিশার উদ্দেশ্যে বলল,

– ফার্নিচারগুলো সব গ্রামে পাঠিয়ে দিবো ভেবেছি। তুই কোনটা রাখতে চাস?

পৃথিশা উত্তর দিলো। রুম থেকে বেরিয়ে গেলো চুপচাপ। রাহনুমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।পৃথিশা তার সাথে কথা বলবে না তিনি জানেন। মেয়েটা অনেক জেদি। কিন্তু পৃথিশার ভালোর জন্য তাকে কঠোর হতেই হবে। তিনি পৃথিশাকে এভাবে গুমড়ে গুমড়ে মরতে দেখতে পারেন না।

সকাল হতেই তিনি পৃথিশাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। পৃথিশার কোন কথাই তিনি আর শুনলেন না। বাসার চাবি পৃথিশার মামার কাছে দিয়ে আসলেন। গাড়ি কিছু সময় পরই পৃথিশাদের আগের বাসাটা পেরিয়ে গেলো। চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি পড়লো পৃথিশার। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর যে বিশ্বাসটা ভেঙেচুড়ে গুড়িয়ে গেছিলো বুকের ভিতর সেই বিশ্বাসটা আবারও দানা বাঁধতে শুরু করলো। এই এলাকায় প্রতিশোধ নিতে আসার এক অদম্য ইচ্ছা মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-১০

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-১০
ফারিহা জান্নাত

সকাল বেলা কলিংবেলের আওয়াজে পৃথিশার ঘুম ভাঙলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো আটটা বাজে। এদিকে অনবরত কলিংবেল বেজেই চলছে। গায়ে ওড়না জড়িয়ে পৃথিশা বেরোলো। মায়ের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনি এখনো ঘুমিয়ে আছেন,পৃথিশা খানিকটা অবাক হলো। তার ঘরের দিকে যাওয়ার আগেই আবারও কলিংবেল বেজে উঠলো। পৃথিশা বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো বাড়িওয়ালা দাঁড়িয়ে আছেন।পৃথিশা অবাক হলো খানিকটা। বাড়িওয়ালা সাধারণত কারো বাসায় যায় না পৃথিশা শুনেছে। অবাকের রেশ কাটিয়ে পৃথিশা তাকে ভিতরে আসার জন্য বললো। তিনি গম্ভীর মুখে ভিতরে ঢুকলেন। সোফায় বসে আশপাশটা দেখতে লাগলেন। পৃথিশা তাকে জিজ্ঞেস করলো,

– কোন সমস্যা আন্টি?

– তোমার বোনের নামে পুরো এলাকায় যে খবর রটেছে এটা জানো? বাসা ভাড়া নেওয়ার আগে আমাদের তো জানালে না কিছু।

পৃথিশা হতভম্ব হয়ে গেলো। কোনমতে বললো,

– কি হয়েছে আন্টি? আপনার কথা বুঝলাম না।

কি হয়েছে বুঝতে পারছে না? নাটক করো? তোমার বোন যে কদিন কান্ড করে হাসপাতালে ভর্তি থাকলো, এখন আবার ওটা নিয়ে কেসও করেছো। ঢং দেখে বাঁচিনা তোমাদের। সেই ছেলে এসে আমাদের হুমকি দিয়ে গেছে। বাসা ছেড়ে দাও তোমরা, তোমাদের জন্য আমরা এত ঝামেলা পোহাতে পারব না।

পৃথিশা বিস্মিত হয়ে গেলো। অপরাধ তারা করেছে,আবার সেই বড় গলায় হুমকি দিচ্ছে। মহিলাটিকে কিছু বলার আগেই তিনি বেরিয়ে গেলেন দরজার সামনে গিয়ে বললে,

– বাসা দুইদিনের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। অগ্রিম দেওয়া টাকা ফিরিয়ে দিবো নে।

পৃথিশা থম মেরে সোফায় বসে রইলো। বাসা ছেড়ে দিলে কোথায় যাবে, কীভাবে কি করবে বুঝতে পারলো না। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো। মণিদীপার রুমের দিকে তাকালে দেখলো দরজা এখনো বন্ধ। পৃথিশা হাত-মুখ ধুয়ে মায়ের রুমের দিকে এগোলো। তিনি ঘুমাচ্ছেন।পৃথিশা পর্দা সরিয়ে দিয়ে বলল,

– আম্মু এখনো ঘুমাচ্ছো যে,শরীর খারাপ লাগছে নাকি? সকাল হয়ে গেছে তো।

পৃথিশার মায়ের কোন জবাব নেই। পৃথিশা অবাক হলো খানিকটা। তার দিকে এগিয়ে কপালে হাত দিতেই শরীর কেঁপে উঠলো তার। শরীর ছিটকে সরে গেলো সে। কাঁপা স্বরে ডাকলো, ‘আম্মা!’
বিছানায় বসে মায়ের মাথাটা নিজের কোলে নিলো। মাথায় হাত বুলালো। ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘আম্মা, উঠো।তোমার কি ঠান্ডা লাগছে?’ পৃথিশার মায়ের মলিন মুখটা তার কোলে পড়ে আছে। পৃথিশা এবার অধৈর্য হয়ে বলল,

– তোমরা সবাই কি আমার জীবনটা খেলা পেয়েছো? সব মজা আমার সাথেই করো কেন? মা,আমি কিন্তু এবার বিরক্ত হচ্ছি।

পৃথিশা ক্লান্ত শ্বাস ফেললো। সে মনে হচ্ছে একটা ঘোরে আটকে আছে। পৃথিশা হাতটা মায়ের নাকের কাছে নিতেই শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। মায়ের মুখটা হাতের মধ্যে নিয়ে পাগলের মতো কান্না করতে করতে বলল,

– আম্মা, এই আম্মা চোখ খুলো। আমার সাথে এমন কেন করছো আম্মা? ও আম্মা কথা শুনো না তুমি। কথা বলো না আম্মু, কথা বলো, কথা বলো।

পৃথিশা মণিদীপার রুমে যাওয়ার জন্য বিছানা থেকে নামলো। তার পা টলছে।পৃথিশা মণিদীপার দরজায় হাত রাখতেই তা খুলে গেলো। তার মানে দরজা লাগানো ছিল না। পৃথিশা রুমে ঢুকতেই চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। মণিদীপা ফ্যা’নের সাথে ঝু”লছে। পৃথিশা দৌড়ে গেলো, মণিদীপাকে ধরে নামানোর চেষ্টা করলো। শরীরে যেন কোন জোর নেই। শেষ পর্যন্ত ফ্যানের সাথে থাকা ওড়নাটা কেটে দিতেই মণিদীপার দেহটা নাম নিচে পড়ে গেলো। পরপর ধাক্কায় পৃথিশা যেন অবশ হয়ে গেছে। মণিদীপার কাছে গিয়ে তাকে ভালোভাবে বিছানায় শোয়ালো। গালে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে বলল,

-‘বুবু,এই বুবু। বুবু কথা বল। আমার সাথে তোরা কেন এমন করছিস সবাই মিলে।আমি তো বলেছিলাম সব সামলে নিবো তাহলে…

আর বলতে পারলো না পৃথিশা। কান্নায় লুটিয়ে পড়লো সে। মণিদীপার দেহটা বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো,

– সবাই ছেড়ে গেলি আমাকে।তোরা সবাই চলে গেলি। আমার কথা কেউ ভাবলি না। আমি কীভাবে থাকব তা নিয়ে তোদের কোন মাথা ব্যাথা নেই।আমাকে নিয়ে তোদের কোন চিন্তা নেই। সবাই নিজেদের মুক্ত করে চলে গেলি।

পৃথিশার চোখ গেলো মণিদীপার টেবিলে। সেখানে কালো কাগজ রাখা। পৃথিশা মণিদীপাকে কাঁথা দিয়ে ঢেকে দিলো। পৃথিশা কাগজটা হাতে নিতেই দেখতে পেলো একটা চিঠি। পৃথিশার জানে, মণিদীপার খুব মন খারাপ হলে সে কালো কাগজ ব্যবহার করে। পৃথিশা চিঠিটা পড়তে শুরু করলো-

পৃথিশা,

বোন আমার। এই স্বল্প পরিসরের জীবনে আমার প্রিয় প্রাপ্তি হচ্ছিস তুই। তোকে পুতুলের মতো বড় করেছি আমি, আমার খেলার পুতুলের মতো যত্ন করেছি। মাঝেমাঝে মনে হয় তুই আমার বাচ্চা। আমি সবসময় চাইতাম তোকে সকল কঠোরতা থেকে আগলে বড় করব। আমি তা পারিনি, বাবু। আমি আর পারছি না পৃথিশা। আমি জীবন ভালোবাসা মেয়ে। এই পৃথিবী দেখার শখ ছিলো অনেক।কিন্তু আমি আর পারছি না পৃথি। সৃষ্টকর্তা আমাকে এতোটা ধৈর্যশক্তি দিয়ে পাঠায়নি। নিজেকে আয়নায় দেখলে আমার ঘৃণা হয়। মন আমাকে বারবার বলে, ‘তুই অ/পবিত্র হয়ে গেছিস।’ আমার জন্য তোদের এত সমস্যা। আমার জন্যই বাবা আজ তোদের সাথে নেই। আমি হাল ছাড়তে চাই নি বিশ্বাস কর। আমি সবরকম চেষ্টা করেছি।কিন্তু পারি নি শেষ পর্যন্ত। আমার এই জীবন আর কিছু চাওয়ার নেই। আমাকে মাফ করে দিস।
তুই খুব ভালো থাকিস বাচ্চা। ইউ ডিজার্ভ দ্যা বেষ্ট। বুবু লাভস্ ইউ।

__________

পৃথিশার সামনে দু’টো খাটিয়া। একটাতে তার মা রানী আহমেদ, অন্যটাতে মণিদীপা। পৃথিশাকে তার খালা ধরে রেখেছেন। পৃথিশা পাথর হয়ে আছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে নিজ পরিবারকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ সে। পৃথিশা তার মায়ের খা”টিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শেষ বারের মতো মায়ের মুখটা দেখে নিলো সে। মায়ের সাথে তার খুব যে সখ্যতা ছিলো তা না। তবে মা’কে ছাড়া একটা দিনও কল্পনা করতে পারতো না সে। মায়ের কপালে হালকা করে হাত রাখলো সে। মলিন স্বরে বলল,

– তোমাকে কখনোই কিছু দিতে পারি নি মা। তুমি সবসময় ভালোটা ডিজার্ভ করো, তা দিতে পারি নি । আমাকে মাফ করে দিয়ো মা, একটু দোয়া করো আমার জন্য যাতে তাড়াতাড়ি তোমার কাছে যেতে পারি।

পৃথিশার কন্ঠস্বর রোধ হয়ে এলো। তার খালা রাহনুমা আহমেদ তাকে পেছন থেকে ধরলো। পৃথিশা তার কপাল থেকে হাত সরালো না। তার চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে। কান্নারত স্বরে রাহমুনাকে বলল, ‘ আম্মা তো ঠান্ডা হয়ে খালা’।
পরপরই পৃথিশা জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। সারািনের এত ধকল শরীর নিতে পারলো না। পৃথিশার দাদাবাড়ির সাথে তাদের সম্পর্ক তেমন ভালো না। রানী আহমেদ অনেক আগেই বলে দিয়েছিলেন তাকে যেন মৃত্যুর পর তার শ্বশুরবাড়িতে না নেওয়া হয়। তাই মণিদীপা ও তাকে পৃথিশার নানাবাড়িতেই দা”ফন করা হবে। পৃথিশাকে তার খালা সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। পৃথিশার চাচারা কেউই তাকে রাখতে ইচ্ছুক না তেমন। কিন্তু পৃথিশা তার সাথে যেতে চাইছে না। তার এক জেদ সে তাদের বাসায় যাবে। অবশেষে তার জেদের কাছে হার মেনে পৃথিশার সাথে রাহনুমা আহমেদ তাদের বাসায় আসলেন। আপাতত কিছুদিন এখানে থেকে পরবর্তীতে পৃথিশাকে নিয়ে তাদের বাড়িতে যাবেন।

বাসায় ঢুকতেই পৃথিশা মণিদীপার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। মণিদীপার খাটে তার পড়নের ওড়না ছিলো। পৃথিশা সেটা হাতে জড়িয়ে বসে রইলো। এই মূহুর্তে বিশাল এই পৃথিবীতে তার কেউ নেই। সে একা,একদম একা। একটা ঘটনা মানুষের সম্পূর্ণ জীবন কীভাবে পাল্টে দেয়। পৃথিশা ইহজগতেও চিন্তা করেনি মণিদীপা এমন কোন কাজ করতে পারে। তার মায়ের মৃ’ত্যুর কারনও তার কাছে স্পষ্ট নয়। সবকিছুর মূলে দায়ী ওই ঘটনা। পৃথিশা বুঝতে পারলো না দোষট কার। কিসের জন্য তার জীবনের আজ এই পরিণতি।

চলবে,

সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-০৯

0

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-০৯
ফারিহা জান্নাত

থানায় প্রায় আধ ঘন্টা যাবত অপেক্ষা করছে পৃথিশা ও মণিদীপা। সেদিন মণিদীপা কথাটা বলার পর পৃথিশা ভেবেছিলো মণিদীপা রাগের বশে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই মণিদীপাকে সময় দিয়েছিলো সে। কিন্তু মণিদীপা নিজ সিদ্ধান্তে কঠোর ছিলো। পৃথিশা পাল্টা কিছু বলে নি। সে নিজেও তাই চেয়েছিলো। ওই নরকের কীটগুলোকে এভাবে বাহিরে বুক ফুলিয়ে ঘুরতে দেওয়া যায় না। এজন্যই তারা আজ এখানে এসেছে। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটলো। তাদের ডাক পড়লে তারা ভিতরে যায়। সেই পুরোনো পুলিশ অফিসার বসা। তিনি পৃথিশাকে দেখেই চমকে গেলেন। মণিদীপাকে না দেখায় তিনি চিনতে পারলেন না। তবে পৃথিশাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– আপনি এখানে কি করছেন?

পৃথিশা তার কথার উত্তর না দিয়ে সামনে রাখা চেয়ারগুলোতে বসলো। পুলিশটিকে এখন আরও বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে। পৃথিশা মণিদীপার দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,

– মাফুজুর রহমান ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা করতে।

নামটা শুনে পৃথিশার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকালেন তিনি। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললেন,

– কি নাম বললেন? আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন?

– মাফুজুর রহমান। তার নামে নারী নির্যাতনের মামলা করতে এসেছি। এজ আ অফিসার, আপনি সাধারণ জনগণের কেস নিতে বাধ্য। এখানে অন্য প্রসঙ্গ আসছে কেন?

মণিদীপা এতক্ষণে মুখ খুলল। পুলিশটি তার দিকে তাকিয়ে বলল,

– আপনি’ই কি মণিদীপা চৌধুরী?

– জি আমি মণিদীপা। এবং এই মামলাটা আমার পক্ষ থেকেই হচ্ছে।

– আপনারা বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তো? আপনাদের কিন্তু ভবিষ্যতে এর জন্য অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। এত তাড়াতাড়ি কোন সমাধান আপনারা পাবেন না।

– আমরা কোন কিছুতে ভয় করি না। আপনি লিখা শুরু করুন।

পুলিশ অফিসার তাদের দিকে তাকিয়ে লিখা শুরু করলেন।পরবর্তীতে বললেন,

– আপাতত আমি অভিযোগ লিখে রেখেছি।কাল এই ঠিকানায় যাবেন। স্যার-ই সব দেখবেন।

পৃথিশারা বেরিয়ে গেলো। রাস্তার ধারে আসতেই মণিদীপা বলল,

– পৃথি চল আজ ঘুরি। তোর রেজাল্টের গিফ্ট।

– একদম না বুবু, তোকে ডাক্তার বেশি হাঁটাচলা করতে না বলেছিলো।তুই তো শুনিস না একদম। এখন বাসায় চল।

– ধুর, আয় তো আমার সাথে।

মণিদীপা পৃথিশার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। শপিং মলের তৃতীয় তলায় আসতেই মণিদীপা আদিদকে দেখতে পেলো, সাথে তার মা। মণিদীপা সেদিকে যাবে কি না ভাবতে লাগলো। পরমুহূর্তেই আদিদ তাদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসলো। আদিদের মা মুখ ফিরিয়ে উল্টো দিকে যেতে লাগলো। মণিদীপা উশখুশ করছে। পৃথিশা ভাবলো তাদের একা ছেড়ে দিবে,তাই চলে যেতে নিলেই মণিদীপা আটকে দিলো। ধীর গলায় বলল, “তুই এখানেই থাক।”
আদিদ এসে মণিদীপার সামনাসামনি দাঁড়ালো। কোন কথা বললো না। মণিদীপার মুখের কিছু জায়গায় কালসিটে দাগ, ক্ষত শুকিয়ে গেলেও দাগ যায়নি। গলা,ঘাড় ওড়না দিয়ে আড়াল করা। আদিদ জিজ্ঞাসা করলো,

– কেমন আছো মণি?

মণিদীপা কি বলবে ভেবে পেলো না। আস্তে করে বলল,

– ভালো আছি।

বলেই একমুহূর্ত দাঁড়ালো না। তড়িঘড়ি করে চলে গেলো। তা দেখে পৃথিশা আদিদকে বলল,

– বুবু কি চায় তা আমি বুঝে ওঠতে পারছি না। তবে আপনার যদি কোন সমস্যা থেকে থাকে সেই বিষয়ে, তাহলে দয়া করে আমাদের সামনে আসবেন না।

_________

পৃথিশা ও মণিদীপা এই মূহুর্তে একজন পুলিশ অফিসারের রুমে বসে আছে। গতকালের দেওয়া ঠিকানায় আজ তারা এসেছে। পুলিশ অফিসারটি তাদের নাম জানার পর থেকেই কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন। পৃথিশা অবশেষে না পেরে বলল,

– আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?

ভদ্রলোক নড়েচড়ে বসলেন,

– তোমাদের সাথে আর কেউ আসে নি?

– আর কে আসবে? আমরা কি যথেষ্ট নই?

– আমি কখনো কোন পুরুষ গার্ডিয়ান ছাড়া এভাবে এরকম কেস নিয়ে আসতে দেখিনি। যাই হোক, আপনারা কি বুঝতে পারছেন না আপনারা যেচে নিজের কাঁধে ঝামেলা নিচ্ছেন?

– আপনার এরকম কেন মনে হলো?

– আপনারা কাদের বিরুদ্ধে মামলা করছেন? এমপি ফজলুর করিমের ভাগ্নে মাফুজুর রহমানের উপর। আপনারা কি ভাবছেন মামলা করলেন আর হয়ে গেলো? তারা প্রচন্ড ক্ষমতাশালী। এই কেস নিয়ে আপনাদের অনেক ঘুরতে হবে। জায়গায় জায়গায় টাকা ফেলতে হবে, অযথা ঘুরবেন।দিনশেষে কোর্টে ওদের কথাই বহাল থাকবে।

– তাই বলে কি অন্যায়ের প্রতিবাদ করব না? এভাবে আর কতদিন? আপনার কথায় আমরা সিদ্ধান্ত পাল্টাবো না।

– যা ভালো মনে হয় করতে পারো।আমার তো হাত বাঁধা, তোমাদের কথা শুনতে বাধ্য। তবে তোমাদের সাবধানে থাকতে হবে।

বলে তিনি একটা কাগজ দিয়ে তাদের একটা রুম দেখিয়ে দিলেন। বললেন সেখানে গিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে মামলা কনফার্ম করতে।

– পা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে রে, আর কতবার এখান থেকে ওখানে যাবো রে পৃথি?

মণিদীপার ক্লান্ত স্বর।পৃথিশা সেদিকে খেয়াল করলো না তার মনে এখন রাজ্যের দুশ্চিন্তা। যেদিকেই যাচ্ছে সবাই তাদের সাবধান করছে।বারবার মামলা করতে না করছে। পৃথিশা এমনিতেও জানতো এমন কোন ঝামেলা হবেই কিন্তু ব্যাপারটা তার থেকেও জটিল। অফিসারের বলে দেওয়া রুমে ঢুকে দেখতে পেলো এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বসে আছেন আয়েশ করে। তারা সামনে রাখা চেয়ারে বসলো। মণিদীপা তার দিকে মামলার চার্জ শীটটা এগিয়ে দিলো। তিনি তা পড়ে তাদের উদ্দেশ্যে কড়া স্বরে বললেন,

– ভিক্টিম কে?

পৃথিশার বুকে একটা ধাক্কা লাগলো। মণিদীপার দিকে আড়চোখে তাকালো। সে মুখ শক্ত করে বসে আছে। তাদের চুপ দেখে লোকটা আবারও বলে উঠলো,

– আরে ভিক্টিম কে? কথা বলেন না কেন? আজব পাবলিক যত্তসব।

– আমি ভিক্টিম।

লোকটা মণিদীপার দিকে কোণা চোখে তাকালো। চোখে তাচ্ছিল্যপূর্ণ দৃষ্টি। পৃথিশা নড়েচড়ে বসলো। লোকটা কৌতুকের স্বরে বলল,

– কিছু প্রশ্ন করবো। উত্তর দিবেন,হেয়ালি করবেন না।

মণিদীপা দ্বিধান্বিত হয়ে পৃথিশার দিকে তাকালো। পৃথিশার চোখে ভয়, সে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে। তাদের ভাবনার মাঝেই লোকটা প্রশ্নের তীর ছুঁড়লো,

– কয়জন ছিলো একসাথে? কোথায় নিয়ে করছে?

মণিদীপা প্রশ্নটা বুঝে উঠতে পারে নি প্রথমে। লোকটা আবারও একই প্রশ্ন করলে তার বোধ আসে। থমকানো গলায় বলে উঠে,

– ছ…ছয়জন ছিলো।

– কোথায় করছে? মানে ব্যাপারটা ঘটলো কোথায়?

– আমাদের এলাকার এক পুরাতন গলির মাথায়, সেখানটায় কেউ থাকে না। নির্জন গলি।

পৃথিশা উত্তর দিলো।মণিদীপা পৃথিশার হাত আঁকড়ে ধরে বসে আছে মাথা নিচু করে।তার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

– ভিক্টিমকে কথা বলতে দিন। কি করছে? কার দ্বারা আপনি মলে”স্টেনশনের শিকার হয়েছেন? একজন নাকি যারা ছিলো সবাই?

পৃথিশা চেঁচিয়ে উঠলো,

– ভদ্রভাবে কথা বলুন। এসব কি প্রশ্ন?

– থামেন আপনি। কথা নিতে না পারলে এখানে আসছেন ক্যান? যা প্রশ্ন করি সবই উত্তর দিতে হবে। মামলা সাজাতে হবে তো।

মণিদীপা মাথা তুললো এতক্ষণে। তার চোখের কোণে অশ্রু। দৃঢ় গলায় বলল,

– সবাই করে নি। যার নামে মূল মামলা করেছি সে ছিলো। আমার পুরোটা সময় জ্ঞান ছিলো না। তাই সঠিকভাবে বলতে পারব না।

লোকটা মুখ দিয়ে বিরক্তিকর ‘চ’ শব্দ করলেন। বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলেন, “কাম কইরা গেছে তার লগে অথচ খেয়াল ছিলো না।” পৃথিশা কথাটা শুনলো। কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। এভাবে কয়জনের মুখ বন্ধ করবে সে।

সেদিন বাড়ি ফেরার পর দুইদিন সব স্বাভাবিক ছিলো। মণিদীপা ঠিক করলো সে ভার্সিটি যাওয়া শুরু করবে। সকালে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য পৃথিশাকে নিয়ে বের হলো। পৃথিশা নিজেও যেতে চাইছিলো তাই আর না করে নি সে। তবে বাসার নিচে আসতেই মাফুজুরকে দেখতে পেলো সে। মণিদীপার দিকে ক্রোধ নিয়ে তাকিয়ে আছে সে। এতদিন পর তাকে দেখতে পেয়ে মণিদীপার ভয়ে অন্তর-আত্না শুকিয়ে গেলো। সে এখনো সেই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি নি সে। মাফুজুর তার দিকে এগিয়ে আসতেই পৃথিশা মণিদীপার সামনে এসে দাঁড়ালো। মাফুজুর তার দিকে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,

– সরে যাও সামনে থেকে। আমার বোঝাপড়া তার সাথে।

– কু”ত্তা/ র বাচ্চা, তোর সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। কোন সাহসে এই মুখ নিয়ে আমার সামনে এসেছিস? নাকি সেদিন মার খেয়ে মন ভরে নি?

– সাহস কিভাবে হয় আমার সাথে এভাবে কথা বলার। তোমরা মামলা করার সাহস কিভাবে পেয়েছ? আমি কি করতে পারি তার ধারণা আছে তোদের মতো চুনোপুঁটির?

– ফ/কি/র সারাজীবন এইসব নিয়েই কথা বলে গেলি। তুই তাকিয়ে দেখ কি করি। তোকে চৌদ্দ শিকের ভাত না খাওয়ানো পর্যন্ত আমি পৃথিশা শান্তি পাবো না।

পৃথিশা দাঁড়ালো না আর। মণিদীপাকে নিয়ে বাসার ভেতরে চলে গেলো। ভার্সিটিতে আর যাওয়া হলো না। দিন না গড়াতেই পৃথিশার মায়ের ফোনে আদিদের মায়ের কল আসলো। তিনি রেগে হুশ হারিয়ে উল্টাপাল্টা বললেন পতাকে।তার কথার সারমর্ম এই- যা হয়েছে হয়ে গিয়েছে, এখন আবার মামলা কেন করা হলো। সবাই খবর জেনে গিয়েছে, তাদের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে যেহেতু মণিদীপার সাথে আদিদের এনগেজমেন্টের খবর সবাই জানে। ফোনটা লাউডস্পিকারে ছিলো।মণিদীপা সবটাই শুনলো চুপচাপ। কিন্তু কিছু বলল না। চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। বারবার বলেও দরজা খুলাতে পারলো না পৃথিশা। সেদিনের ঘটনার পর এই প্রথম মণিদীপা একা থাকলো। তবে অস্হিরতায় সারারাত ঘুমাতে পারলো না পৃথিশা। কে জানে আগামীদিন কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।

চলবে,