[১১]
নিগূঢ় নিস্তব্ধ রজনী। বাতাসের বেগের সাথে পাল্লা দিয়ে অন্তঃকরণে বয়ে চলেছে হু হু দমকা হাওয়া। দু’হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে প্রেমা। অশ্রুকণা চিবুক গড়িয়ে ভিজিয়ে দিলো বক্ষঃস্থল। নীরব কান্নার মতো ক্ষতগুলো ও নিরব। যার আর্তনাদ কারো না দৃষ্টিগোচর হয় আর না কর্ণগোচর। অনেকদিন পর আজ নীহার সাথে কথা হলো। একবুক বিষাদময় যন্ত্রণার পাশাপাশি স্বস্তি মিলছে। তার বোন অন্তত ভালো আছে। নাফিজের মতো মানুষটি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে নীহার সাথে। সে ভালো না থেকে খা’রা’প থাকতে পারে? দু’বোনের কথোপকথনের মাঝেই সুশ্রী বুলিতে অন্তর আ’ঘা’ত প্রাপ্ত হলো। নাফিজ দুর্বল কন্ঠে একগ্লাস পানি চাইলো। এক অদ্ভুত মাদকতা মিশ্রিত ছিলো সামান্য এই বুলি টুকুতে। মানুষ যাকে ভালোবাসে তার সবকিছুই অসাধারণ লাগে।
মানুষটা কেনো তার হলো না? রা’গে, দুঃখে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে প্রেমা। আজ আর খাওয়া হলোনা তার।
আজকাল সংসারের কাজ নিয়েই সময় কে’টে যায় নীহার। যেটুকু সময় হাতে থাকে সে সময়টুকু হয়তো ঘুমিয়ে নয়তো সুফিয়ার সাথে গল্পগুজবে কাঁটিয়ে দেয়। রাতের সময়টুকু ও দূরত্ব মেনে চলে দুটি দেহের, দুটি হৃদয়ের। নীহা পারছেনা সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। কোনো এক অভিমানের দেয়াল তাকে বাঁধা দিচ্ছে।
নাফিজ চোখের উপর হাত দিয়ে সটান হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমিয়েছে কিনা জানা নেই নীহার। সে দূরে জানালার দ্বার ঘেঁষে প্রকৃতির খেলা দেখতে ব্যস্ত।
চোখ থেকে হাত সরিয়ে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো নাফিজ। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী একই ঘরে থাকলে কিছু ঘটা অনুচিত নয়। সেখানে তারা দুজনেই স্বামী-স্ত্রী। সম্পর্কটি হালাল, বৈধ। যেখানে রয়েছে পাহাড় সম অনুভূতি। নাফিজের দিক থেকে সে একেবারেই এগিয়ে আছে। কিন্তু নীহার থেকে আশানুরূপ কিছু না পেয়ে বারবার হতাশ হচ্ছে নাফিজ। বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে নীহার দিকেই তাকিয়ে আছে নাফিজ। খোঁপা করা চুলের নিম্ন অংশ বিনা আঁচলে উন্মুক্ত থাকায় না চাইতেও বারবার বেহায়া চোখদুটো সেদিকেই চলে যাচ্ছে।
সম্বিত ফেরে নীহার। এতক্ষণ যাবত তার উন্মুক কটিদেশে একজোড়া দুষ্ট চোখের বিচরণ ঘটেছে তার অগোচরেই। নাফিজকে খেতে ডাকার আগেই নীহা দেখতে পেলো নাফিজ আগেই উঠে বসে গেছে। খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে রান্নাঘরে বাকি কাজ গোছাতেই রয়ে গেলো নীহা।
আজকাল গরম যেনো ট্রাকে ভর্তি করে হানা দেয়। শাড়ির আঁচলে ঘাড়, গলা মুছে ঘরে রওনা দিলো। নাফিজ মনে হয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে গিয়েছে। হাতমুখে পানি দিয়ে নাফিজের উল্টো পাশে শুয়ে পড়লো। মিনিট দশেক গড়াতেই হাতের উপর একটা শক্তপোক্ত, বলিষ্ঠ হাতের চাপ অনুভব করে।
মুহূর্তেই আবদ্ধ চোখজোড়া সজাগ হয়ে ওঠে নীহার। ঝট করে নেত্রপল্লব খুলে তাকায়।
পাশ ফিরে তাকাতেই নাফিজের আবিষ্ট চোখজোড়া দৃষ্টিগোচর হয়। তার দৃষ্টিতে রয়েছে হাজার ও আকুতি, কিছু পাওয়ার ব্যাকুলতা, তৃষ্ণা।
এরকম একটা দৃষ্টি বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে নীহার। পরিপক্ব বয়সেই বিবাহ জীবনে পা রেখেছে। নাফিজের দৃষ্টির অর্থ ধরতে পেরে চট করেই অপর পাশে ফিরে গেলো। নাফিজ আরেকটু শক্ত হাতে চেপে ধরলো নীহার হাত। চোখ খিঁচে দম নিলো নীহা। শক্ত জবাবের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে।
নাফিজ নিচুস্বরে নম্রগলায় বলল,
-“এবার মনে হয় আমাদের সম্পর্কে এগোনো উচিত। বিস্তর একটা ফারাক সৃষ্টি হচ্ছে দিনদিন।”
নীহা নাফিজের দিকে ফিরলো। চোখে চোখ রেখে কঠিন কন্ঠে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিলো।
-“শরীরের টান অনুভব করছেন বুঝি? ভাবছেন নিজের বিয়ে করা বউ, আমিতো যা ইচ্ছে তাই করতে পারি। তাকে এমন ধোয়া তুলসীপাতার মতো কেনো সাজিয়ে রাখবো?”
বক্ষঃস্থলে হাত রেখে একটানে আঁচল সরিয়ে নিলো নীহা। আবারও বলতে লাগলো,
-“নিন ভো’গ করুন। এটাই তো চাইছেন। আমি তো বাঁধা দিচ্ছি না। আপনি চাইলে আরও আগেই যা করার করতে পারতেন। আমিতো এখন বৈধ পন্য।”
নাফিজ স্তব্ধ, হতবাক। বিষ্মিত চাহনি খেলে যাচ্ছে তার নেত্রে। একটা সম্পর্কে পা বাড়ানো কি অন্যায়? মুহুর্তেই তার অভিব্যক্তি বদলে গেলে। চোখেমুখে দেখা দিলো ভীষণ ক্রো’ধ। মানুষের ভাবনা কতটা নিকৃষ্ট হলে স্বামীর চরিত্র সম্পর্কে জেনেও তার দিকে বা’জে আঙ্গুল তাক করে। অনেক তো হয়েছে। এতটা অহং’কার, তেজ থাকলে সংসার জীবন সুখের হয়না। দু’দিক থেকেই সমান প্রচেষ্টা থাকতে হয়। সবাইকেই স্যাক্রিফাইস করতে হয়। একজনের দ্বারা সংসারে উন্নতি সম্ভব নয়। চোয়ালে হিং’স্র ভাব। নাফিজ মানুষটা ঠান্ডা মেজাজের। কিন্তু একবার যদি রে’গে যায় তবে সেই রাগ খুবই ভয়’ঙ্কর হয়। সে সর্বদাই রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে।
শক্ত হাতে নীহার দুবাহু চেপে ধরে তার দিকে ঝুঁকে য়ায় নাফিজ। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“আর একটা বা’জে কথা মুখ দিয়ে বের করলে হাত পা বেঁ’ধে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসবো। বড় বড় ভাষণ দিচ্ছেন। আমি তো আপনাকে বলিনি এই বিয়েতে মত দিন। আপনি না করলে নিশ্চয়ই বিয়ে হতোনা। ভাবার জন্য বিয়ের আগে আপনাকে যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়েছে। বিয়ের পরও আমি আমাদের সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে আপনাকে প্রচুর সময় দিয়েছি। আর দশটা সম্পর্কের মতো আমাদের সম্পর্ক হলে দুজনের মধ্যকার দূরত্ব বহু আগেই ঘুচে যেতো। সেটা হোক মানসিক আর হোক শারিরীক। বিয়ে করে এখন সম্পর্কে আগাতে চান না। কেনো? তা’লাক নিবেন? তাহলে শুনুন, এটা কোনো ছেলেখেলা নয়। কোনো সিনেমা নয়। এটা বাস্তবতা। শুধুমাত্র আপনার জন্য দুটো পরিবারে ভাঙ্গন ধরবে, আমার মা ধুঁকে ধুঁকে ম’রবে এটা আমি হতে দেবোনা। এতই যখন আমার প্রতি অনীহা আগেই না করে দিতে পারলেননা। আজ আমার চ’রিত্র নিয়ে কথা বলেছেন। দ্বিতীয়বার যেনো এমন কিছু না শুনি।”
প্রথম ধা’ক্কায় নীহা বেশ ভ’য় পেলেও এবার যেনো ফুঁসে উঠলো।
-“আচ্ছা চরিত্র নিয়ে কথা বললে খুব গায়ে লাগে, না? যখন নিজের সামনে পরপুরুষ এসে নিজের স্ত্রীকে অ’সম্মান করে। ক’টু বাক্য করে, কই তখন তো আপনার সুপুরুষ গিরি দেখিনি। এখন কাপুরুষের মতো শরীরে হাত দিতে এসে নিজেকে সুপুরুষ দাবী করছেন। নারীর শরীরের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে পারলেই তাকে সুপুরুষ বলেনা। পারলে মনে ও রাজত্ব করে দেখান। লুজার কোথাকার।”
মাথায় র’ক্ত চড়ে গেলো নাফিজের। ভিত্তিহীন ভাবে তাকে ক্রমশই ছোট করে যাচ্ছে মেয়েটা। একটা ঠুনকো ব্যাপারে রাগ ধরে রেখেই তার এমন দু’র্ব্যবহার। নীহার বাহুতে হাতের ছাপ বসিয়ে ফেলবে যেনো নাফিজ। কপালের রগগুলো দপদপ করে ফুলে উঠেছে। নাকের পাটা ক্রমাগত ফুলে ফুলে উঠছে। রা’গের বসে নীহার গলায় কা’মড়ে ধরে।
নীহা ব্যথা পেয়ে অস্পষ্ট স্বরে ‘উহ্! অস’ভ্য’ বলে উঠতেই নাফিজ ছেড়ে দেয়। ওভাবে নীহাকে দুহাতে চেপে ধরে রেখেই বলল,
-” অ’সভ্য, কাপুরুষদের মনের দরকার হয়না। কি দরকার শুধু শুধু শরীর ছেড়ে মন নিয়ে কা’ড়া’কা’ড়ি করা। আমিতো কাপুরুষ। আপনার আমার কাছে সেরকম আচরণই কাম্য। কোনো বিষয় অজানা হলে, কোনো ক্ষো’ভ থাকলে বোঝাপড়া করে নেওয়া উচিত। যে জানতে চায়না তাকে কোনো কিছু এক্সপ্লেইন করার ও প্রয়োজন মনে করিনা।”
সরে গেলো নাফিজ।
বিষ্মিত হয়ে চেয়ে রইলো নীহা। সভ্য পুরুষের আড়ালে সত্যিই সে এক অস’ভ্য পুরুষকে আবিষ্কার করলো। তাছাড়া লোকটা করেছে টা কি? যে তার কাছে এক্সপ্লেইন করবে?
-“আজকাল আমার রূপ বরফের মতো গলে গলে পড়ছে নাকি? ঘুমের ঘোরেও মানুষ তাকিয়ে থাকে।”
কটমট করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো নীহা। উনি নাকি ঘুমিয়ে আছে। তাহলে অস’ভ্যতামি করলো কে? উনার আত্মা?
মনে মনে বেশ আনন্দ পেলো নাফিজ। নীহাকে জব্দ করতে পেরে তার অধর কোনো সূক্ষ্ম বক্র হাসি উঁকি দিলো। ব্যাপারটা হালকা ভাবে নিলে হবেনা। তাকেই কিছু একটা করতে হবে। বিয়ে কোনো পুতুল খেলা নয়।
[১২]
দিনটি শুক্রবার। সরকারি ছুটির দিন। নাফিজ আজ বাড়িতেই রইলো। সুফিয়া নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। নীহা শাশুড়ীর সাথে টুকটাক কাজে সময় ব্যয় করে। মাঝেমধ্যে শাশুড়ী রান্না করে আবার মাঝেমধ্যে নীহা রান্না করে। এ নিয়ে ভেদাভেদ নেই। যে আগে রান্নাঘরে ঢুকে, রান্নাটা সেই করে নেয় নিজ দায়িত্বে। আজ শাশুড়ী সাহায্য করছে, বউ রান্না করছে। ভাতের মাড় ফেলতে গিয়ে সিটকে অনেকখানি ভাত পড়ে যায়, সাথে নিহার হাতে ও মাড় পড়ে। নাফিজের মা কিছুক্ষণ ব’কা’ঝকা করেন এত অসাবধানে কাজ করার জন্য। পরক্ষণে নিজেই ট্যাপের নিচে নীহার হাত ভিজিয়ে টুথপেষ্ট লাগিয়ে দেন। হাত প্রচন্ড জ্বালাপোড়া করছে। শাশুড়ী মা নীহাকে রান্নাঘর থেকে বের করে দিলেন।
-“যাও কিছুক্ষণ ফ্যানের নিচে গিয়ে বসো।”
ঘরে গিয়ে ফ্যানের নিচে বসলো নীহা। চোখ বন্ধ করে খাটের সাথে হেলান দিয়ে রইলো। হাত জ্বালাপোড়া করায় ডান হাত আলগা করে রাখলো। নাফিজ ভ্রু কুঁচকে হাতের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-“হাতে কি হয়েছে? দেখি!”
নীহা মুখ ঘুরিয়ে সরে বসলো।
নাফিজ মনে মনে বিরক্ত হয়ে বলল,
-“মেয়ে মানুষের ঢং দেখলে বাঁচিনা। ঢং বিষয়ক কোনো পরীক্ষা থাকলে সব মেয়ে নিশ্চিত একশতে একশ পেয়ে যেতো।”
নীহার হাতের কব্জি চেপে ধরে চেক করে হাতের দিকে দৃষ্টি রেখেই নাফিজ জিজ্ঞেস করলো,
-“কিভাবে হাত পুড়লেন?”
নীহা চরম রা’গ দেখিয়ে হাত ঝাড়ি মেরে সরতে গিয়ে উল্টো খাটের সাথেই হাতে লেগে আরও ব্যথা পেলো। ব্যথায় দাঁতে দাঁত লেগে গেলো। চোখ খিঁচিয়ে বসে রইলো।
শান্তভাবে নীহার হাত টে’নে নিয়ে ফুঁ দিয়ে দিলো নাফিজ। স্বগোতক্তি করে বলল,
-“কি লাভ হলো দূরে গিয়ে? জানেনতো, আমরা কিছু মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাই ব্যথা পাবো বলে। কিন্তু মানুষটি থেকে দূরে সরে গেলে অজান্তেই ব্যথা পেয়ে বসি। ব্যথাটা সেরে ওঠা হয়না। আরেকটু তীব্র হয়।”
ছেলেটা ফোন হাতে নিয়েই ছাদে এসেছিলো। আকাশের করুণ অবস্থা দেখে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বাড়ির মালিকের পুত্রবধূকে চোখে পড়লো। তাই সৌজন্যতার খাতিরেই কথাটা জিজ্ঞেস করলো। আবার ও মিষ্টি হেসে ছেলেটি বলল,
-“আপনি তো ভারী মিষ্টি মেয়ে।”
ছেলেটি ভেবেছিলো প্রশংসা শুনে নীহা খানিকটা হাসবে। কিন্তু নাহ তাকে ভু’ল প্রমাণিত করে হাতের কাপড় নিয়েই তাড়া দেখিয়ে নিচে ছুটলো সে।
নীহার ভ’য় হয়। এমন তাগড়া যুবক আর তাকে একসাথে ছাদে দেখে যদি কেনো কে’চ্ছা রটে যায়? আজকাল এসব ঘটনা ঘটার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বিকাল চারটায় অফিস শেষ করেই বাড়ি ফিরলো নাফিজ। স্বভাব সুলভ বাড়ি ফেরার পথে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিলো নাফিজ। ছাদে চোখ পড়তেই দেখতে পেলো তাদের ভাড়াটিয়া ছেলে তার বউকে হেসে হেসে কিছু বলছে। নীহা নেমে যাওয়ার পর নাফিজ ঘরে গেলোনা। সোজা ছাদে পা বাড়ালো। এই তিনতলা বাড়িটি তার বাবার হাতে গড়া। তারা দুইভাই চাকরী ছাড়া আর কিছুই জোড়াতে পারেনি। তিনতলায় তারা থাকে। আর নিচের দুইতলায় চারটা ফ্ল্যাট করে ভাড়া দেওয়া।
নীহা যাওয়ার পর ছেলেটি নামার জন্য সিঁড়ি ঘরে পা রাখলো। নাফিজ এসে তার সামনে দাঁড়ালো। ছেলেটি স্বভাব সুলভ হেসে বলল,
-“তুমি এখন থেকে আর ছাদে উঠবেনা। তুমি কেনো? যেকোনো ছেলেরই এখন থেকে ছাদে ওঠা নিষেধ।”
ছেলেটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। খানিক সময় পর মুখ খুললো,
-“কিন্তু কেনো ভাইয়া? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
নাফিজ নিষ্পলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কাঠকাঠ গলায় বলল,
-“ছাদে মেয়ে মানুষের আনাগোনা থাকে। তাই মেয়েদের ভীড়ে ছেলেমানুষের না আসাই ভালো।”
ছেলেটি যেনো বুঝেও বুঝলোনা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল,
-“ভাইয়া, মেয়ে মানুষতো আগেও আসতো।”
বিরক্ত হলো নাফিজ। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
-“আগে তোমার বোন, আমার বোন আরও কয়েকটা মেয়ে আসতো। এখন সেই লিস্টে বাড়ির বউ ও যোগ হয়েছে। আশা করি বুঝতে পেরেছো।”
নাফিজ আর দাঁড়ালোনা। সারাদিন অফিস করে সে ভীষণ ক্লান্ত। টানা বসে বসে কম্পিউটারের সামনে কাজ করা লাগে। মাথাটা ও ভার ভার লাগছে। বুকটা ক্রমাগত ব্যথায় লাফিয়ে উঠছে।
নাফিজের কথার মর্মার্থ বুঝে ছেলেটি মিটিমিটি হাসলো।
-“ভাইয়া দেখছি ভীষণ ভাবে প্রেমে পড়েছে।”
শুকনো কাপড়গুলো গুছিয়ে সবার জামাকাপড় সবার ঘরে দিয়ে আসলো নীহা। সুফিয়া কারো সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত। অধরকোনে লজ্জা মিশ্রিত হাসি। নিশ্চয়ই হবু বরের সাথে কথা বলছে। কিছুদিন আগেই বিয়ে ঠিক হয়েছে তার। সুফিয়ার জামাকাপড় রেখে নিজের ঘরে যাওয়ার পথে নাফিজের দেখা পেলো। ক্লান্ত ভঙ্গিতে পা চালিয়ে ঘরে যাচ্ছে নাফিজ। নীহা আর ঘরে গেলোনা। রান্নাঘর থেকে ঠান্ডা পানি দিয়ে একগ্লাস লেবুর শরবত গুলে নিয়ে গেলো। নাফিজ অফিসের পোশাক পাল্টে নরমাল জামা পড়ে নিয়েছে। নীহা শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে নিজের কাজে ধ্যান দিলো।
নাফিজ শরবতে চুমুক দিয়ে চোখে হাসলো। ঠোঁট প্রসারিত হলোনা। কিন্তু চোখের দিকে তাকালেই যেকেউ টের পেতো নাফিজের প্রশান্তির হাসি। ভালোলাগা, ভালোবাসাগুলোকে দমিয়ে রাখলোনা সে। বাড়তে দিলো বেসামাল ভাবে। একটু ছুঁয়ে দেওয়ার অপেক্ষা। সুপ্ত অভিপ্রায়।
নীহা নিচু হয়ে ঝুঁকে কাপড় হাতে নিলো আলমারিতে রাখার উদ্দেশ্য। শাড়ি সরে গিয়ে উন্মুক্ত হলো পিঠ, কোমরের অংশ। দৃষ্টি সরালোনা নাফিজ। আত্ম তৃষ্ণায় স্বার্থপর হলো। নেত্রপল্লবে শুষে নিলো রঙিন কিছু মুহূর্ত।
নীহা প্রয়োজন ব্যতীত নাফিজের সাথে খুব একটা কথা বলেনা। প্রথম দিকে জড়তা থাকলেও এখন কেবলই অভিমান দেয়াল টানিয়েছে। কিন্তু তার অভিমানের স্তর কতটা গাঢ় তা নাফিজকে আঁচ করতে দিচ্ছে না।
বুকে ব্যথা উপশমে বুকের নিচে বালিশ চেপে উপুড় হয়ে শুলো নাফিজ। আবেশে চোখজোড়া বুঁজে নিলো।
পাশে দাঁড়ানো নীহার দেহের এক অকৃত্রিম সুবাস টের পেয় মনে মনে শুধালো,
-“আহা এ বুঝি এক কঠিন প্রেম। হাড় কাঁপানো জ্বরের আভাস পাচ্ছি। আমার হৃদয়ে তোমার উষ্ণতা পাওয়ার বড় স্বাদ জাগছে।”
[১০]
ঘন আষাঢ়িয়া নৃত্য শেষে স্থির হয়েছে প্রকৃতি। শান্ত, স্তব্ধ,নিরব প্রকৃতিতে সতেজতার ছোঁয়া। কচি কিশলয়ে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি কণা জমে চিকচিক করে উঠছে। সোঁদা মাটির ঘ্রাণ প্রাণ ভরে শুষে নেওয়াতে এক আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। জানালার দ্বার ঘেঁষে প্রকৃতির এই মনোরম সৌন্দর্য উপভোগে ব্যাঘাত ঘটলো মুঠোফোনের কম্পিত শব্দে। পাশ ফিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো মুঠোফোনে। “অন্তিক ভাই” নামটি ফোনের স্ক্রিনে বারবার ভেসে উঠছে।
রিসিভ করে সালাম বিনিময় করলো দুজনে।
অন্তিক বলল,
-“তোর এপ্লাই কমপ্লিট। আমি এখান থেকেই আবেদন করেছি তোর জন্য। এখন শুধু অপেক্ষার পালা ফিরতি এসএমএস এর।”
প্রেমার মধ্যে প্রফুল্লতা আর চরম উৎকন্ঠা কাজ করলো। খুশির ঝিলিক দৃষ্টিগোচর হলো তার চোখেমুখে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে প্রেমা বলল,
-“তুমি এতো ভালো কেনো ভাইয়া? এই জন্যই তোমাকে আমার এত ভালোলাগে।”
স্মিত হাসলো অন্তিক। গলা ঝেড়ে কঠিন স্বরে বলল,
-“এত খুশি হলে চলবেনা। প্রাথমিক কাজ গুলো নিজে নিজেই বাড়িতে প্র্যাকটিস কর। তাহলে এখানে আসলে ট্রেনিং এ সহজ মনে হবে। আর হ্যাঁ আমি সেনাবাহিনী হবো বলে লাফালে চলবেনা। নিজের মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে। দেশের জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করলাম। আমি একজন গর্বিত সৈনিক। প্রাণ থাকা অবদি দেশের জন্য লড়ে যাবো।
মনোবল শক্ত রাখতে হবে। নয়তো সেনাবাহিনীতে আসার আশা ছেড়ে দে। এখনো সময় আছে।”
অন্তিক অনুভব করলো প্রেমা কঠিন হচ্ছে। তার নরম আবরণ ঢাকা পড়ে শক্ত খোলস বেরিয়ে আসছে। প্রেমা চোয়াল শক্ত করে শুধালো,
-“আমিই পারবো। একবার যে প্রতিজ্ঞা আমি করেছি তা সাফল্য হিসেবে বয়ে আনবোই।”
অন্তিক মনে মনে অনেকটাই খুশি হলো। প্রেমার মধ্যে দৃঢ়তা আছে। তবে তার বড্ড ভ’য় হয় এখানে এসে নাজানি মেয়েটার মত বদলে যায়। তাইতো সময় থাকতে তাকে শক্ত করছে। সিলেক্ট হওয়ার পর যদি এখানে আসার সুযোগ পায় প্রেমা তবে তার নরম, হাস্যরসাত্মক ভাই অন্তিকের বদলে অন্য এক অন্তিককে দেখবে। যার মধ্যে কোনো কোমল হৃদয় নেই। কেবল, কেবল এক কঠোর চরিত্রের অধ্যায় দেখবে প্রেমা।
দুজনের কথা শেষ হতেই প্রেমা মাকে গিয়ে খবরটা দিলো। আয়শা মুখ কালো করে বসে রইলেন। উনার মাঝে কোনো আগ্রহ দেখা গেলোনা।
সেদিন অন্তিক খালাকে নানাভাবে বুঝিয়ে প্রেমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে ঘুরিয়েছে। তবুও আয়শার মনে একটা কালো আঁধারের স্তর থেকেই গেলো। তার এমন তুলতুলে, নরম মেয়ে কিভাবে সইবে এমন কষ্ট?
জয়নুল আবেদীন খোশ মেজাজে বাড়ি ফিরলো। উনার নামের মি’থ্যে লোন নেয়ার অভিযোগ টা উঠে গেছে। উনাদের ছয় জনের নাম করে আবুল কোম্পানিরই এক লোক টাকা লোন নিয়েছেন।
বাড়ি ফিরে মেয়ের মুখে আরেকটা খুশির খবর শুনে আয়শাকে বললেন,
-“আজ বাড়িতে খিচুড়ি হবে নাকি? একে একে সব খুশির খবর। তারউপর বৃষ্টির পরবর্তী শীতল পরিবেশ। আহা! জিহ্বে জল এসে পড়লো।”
আয়শা উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। প্রেমা পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল,
-“মা সাথে একটু লেবুর আচার হলে ভালো হয়।”
[১১]
মইফুল ভাসুরের ঘরে গিয়েছে। চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে আর থাকতে পারলোনা।
বাদশা আর তার বউ শিমু দুজন দুজনের উপর চরমভাবে ক্ষেপেছে। শিমু কেনো ঘর ছেড়ে ফকিরকে চাল দিলো? তার সুন্দরী বউকে এখন ফকির দেখে ফেলেছেনা? এ নিয়ে হা’উ’কা’উ করে বাড়ি মাথায় তোলে বাদশা। শিমু দিশা না পেয়ে তার হিল জুতা দিয়ে বাদশার মাথায় আ’ঘা’ত করে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
-“আমার ডিস্কুর বাড়ি খা।”
বাদশা মাথায় হাত দিয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে মই দিয়ে ঘরের চালে উঠে গেলো। আদরের বউকে ফিরতি আ’ঘা’ত করলোনা। তাদের ঝ’গ’ড়া থামানোর সাধ্য কারো নেই।
বাদশা চালের উপর গাঁট হয়ে বসে রইলো। অন্তিকের বাবা, তার বাবা সহ সবাই নেমে আসতে বলছে। সে কিছুতেই নামবেনা। জেদ ধরে বলল,
-“শিমু আমাকে ডিস্কু দিয়ে মা’র’লো কেনো? আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আরও একটা বিয়ে করবো। আব্বা আপনি আমাকে অনুমতি দেন বিয়ে করার। নয়তো আমি চাল থেকে নামবোনা বলে দিলাম।”
বাদশার বাবা ক্ষে’পে গেলেন।
-“হা’রা’ম’জা’দা আগে নেমে আয়।”
বাদশা বসেই রইলো। এদিকে বাদশা বিয়ে করবে শুনে শিমু জ্ঞান হারালো।
আর অপেক্ষা করলোনা বাদশা চাল থেকে নেমে গেলো। তার বউকে কাউকে ধরতে দিলোনা। নিজে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে গেলো। নিজ থেকেই সেবা করে শিমুর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে।
পানির ছিটা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে শিমুকে জড়িয়ে ধরলো বাদশা।
-“কসম করে কইলাম বউ। আমি বিয়ে করবোনা।”
শিমুর যে কয়টা দাঁত আছে সবগুলো বের করে হেসে দিলো। স্বামী স্ত্রীর মিল দেখে যে যার কাজে চলে গেলো। মইফুল বিড়বিড় করতে করতে হাঁটলেন,
-“পা’গ’লের গোষ্ঠীতে এসে পড়েছি আমি। আমি নিজে যে পা’গ’ল হয়ে যায়নি এতেই শুকরিয়া আদায় করি।”
অন্তিকের বাবা খরগোশের মতো কান খাড়া রাখলেন। খ্যাঁক করে উঠতে গিয়েও শান্ত রইলেন। পরিস্থিতি হয়তো বিগড়ে যেতে পারে।
-“আমার লজ্জা করছে বাবা। তুমি একটা বাচ্চার কপাল খা’মছে নিলে?”
অভীকের অভিযোগের সুর শুনে তার বাবা খেঁকিয়ে উঠলো।
-“সর কু’ত্তার পয়দা। তুই আমাকে জ্ঞান দিবি?”
অভীক অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
-“কিন্তু আমরা দু’ভাই তো তোমার পয়দা। তাহলে কু’ত্তার পয়দা বললে কেনো? তারমানে?”
অভীকের বাবা রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে তিরিক্ষি গলায় শুধালেন,
-“জু’তার বাড়ি খাইতে না চাইলে যা এখান থেকে।”
অভীক রাগ করে ঘরে চলে গেলো। রাতে মায়ের এত ডাকাডাকির পরও খেতে গেলোনা। অন্তিক আসলো ডাকতে। অভীক রাগ করেছে তাই কিছুতেই খেতে যাবেনা। বসে বসে ম্যাথ সলভ করছে। তখনই ওর বাবা আসলো ঘরে। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
-“চল আব্বা! খাইতে চলো।”
অভীক ম্যাথে মনযোগ দিয়েছে। এমন একটা ভাব করছে যেনো সে ব্যতীত এখানে আর কেউ নেই।
বাবা এবার খাতার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“অঙ্কে পাস,
ইজ নট ম্যাটার অফ ঠা’স ঠা’স।
বুঝলা আব্বা, আমি অংকে খুবই ভালা ছাত্র ছিলাম।”
অভীক আর চুপ করে থাকতে পারলোনা। বাবা আসার পরই তার রাগ পড়ে গিয়েছে। অভীক সকৌতুকে বলল,
-“কিন্তু দাদীর কাছে শুনলাম তোমার মুখে বো’ম মা’রলে বো’ম ফিরে আসতো, কিন্তু শতকিয়া মুখ দিয়ে আসতোনা।”
বাবা মুখ কাচুমাচু করে বেরিয়ে যাওয়ার আগে খেতে তাড়া দিয়ে গেলেন।
অভীক, অন্তিক দুইভাই শব্দ করে হাসলো। অন্তিক বলল,
-“বাবা খুবই সহজ সরল মানুষ।”
অভীক লাফিয়ে ওঠে বলল,
-“বাবা হলো মীর-দৌলা। মানুষ তাকে মীর’জাফর মনে করে কিন্তু আমাদের বাবার মধ্যে সিরাজুদ্দৌলার বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। তাই দুইটার সংমিশ্রণে বাবাকে মীর-দৌলা উপাধিতে ভূষিত করলাম।”
-“তুই যেমন, বাবা ও তেমন।”
অভীকের পিঠ চা’পড়ে বলল অন্তিক। দুজনেই খাবার টেবিলে গিয়ে বসলো। একসাথে খাওয়া হলো সবার।
[৮]
ঘরে বিদ্যুৎ নেই। চারপাশে গুমোট অন্ধকার। একটা চার্জার লাইট হাতে ধুরুধুরু বুক নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো নীহা। মনে হচ্ছে পেছন থেকে, চারপাশ থেকে কেউ ওকে খপ করে ধরে নিয়ে যাবে। ভ’য়ে ভ’য়ে চুলায় খাবার বসালো গরম করার উদ্দেশ্যে। সুফিয়ার পরীক্ষা শুরু হয়েছে সে পড়া নিয়ে ব্যস্ত। নীহার শাশুড়ী এশার সালাত আদায় করে তসবিহ নিয়ে বসেছেন আর উঠেননি। নাফিজ অফিস থেকে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছে। কাল সন্ধ্যা সাতটার পর পাশের বাসার একটা মেয়ে আত্ম’হ’ত্যা করেছে। সকাল নাগাদ আরেকটা বাসার ছোট্ট একটি মেয়ে পানিতে পড়ে মা’রা গিয়েছে। সেই থেকে ভয়ে আছে নীহা।সে কোথাও শুনেছে আজরাইল যদি পরপর দুটো প্রাণ নেয় তাহলে ধরে নিতে হবে সে আরও একটি প্রাণ নিবে। এক ভ’য়’ঙ্কর খচখচানি শব্দে থরথর করে কেঁপে ওঠে নীহা। চিৎকার করে শাশুড়ীকে ডাকে।
-“আম্মা! আমার মনে হয় সময় ঘনিয়ে এসেছে। আজরাইল তিন নাম্বার জান ক’ব’জ করতে চলে এসেছে। আপনারা সবাই আমাকে মাফ করে দিয়েন। আপনার ছেলেকেও বলবেন আমাকে যেনো মাফ করে দেয়।”
কথাগুলো বলেই রান্নাঘরে জ্ঞান হারালো নীহা। নীহার চিৎকারে নাফিজ সহ সবাই দৌঁড়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। নীহাকে রান্নাঘরের ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখলো। খচখচানি শব্দ কানে আসতেই নাফিজ সেদিকে লাইট ঘুরিয়ে দেখলো একটা ইঁদুর প্লাস্টিক নিয়ে কাম’ড়াকা’মড়ি করছে বলে শব্দ হচ্ছে। নাফিজের মা বললেন,
-“মেয়েটা কাল থেকেই ভ’য় পেয়ে আছে। ওকে ঘরে নিয়ে আয়।”
নাফিজ কোলে তুলে নিলো নীহাকে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পানির ছিটা দিলো। বিদ্যুৎ এসে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নীহার জ্ঞান ফিরলো। আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখে সে বেঁচে আছে।
নাফিজের মা পাশে বসে নীহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“কি হয়েছে, মা? জ্ঞান হারালে কেনো?”
নীহা ভ’য়ে ভ’য়ে বলল,
-“রান্নাঘর থেকে কিরকম ভ’য়’ঙ্কর শব্দ আসছিলো। আমি ভাবলাম আমার সময় শেষ।”
নাফিজ শান্ত চোখে চেয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল,
-“ওটা ভ’য়’ঙ্কর শব্দ নয়। ইঁদুর প্লাস্টিক নাড়াচাড়া করছিলো।”
নাফিজের মা আর সুফিয়া খিলখিল করে হেসে উঠলো। নিজের বোকামিতে লজ্জা পেয়ে মাথানিচু করে নিলো নীহা। ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো নাফিজ। দুর্বোধ্য সে হাসি। যা সবার চোখ এড়িয়ে গেলো। কিছুটা সময় হাসাহাসির মধ্যেই কাটলো। নীহার পুরোপুরি ভ’য় কাটলোনা।
নীহার শাশুড়ী গিয়ে খাবার টেবিলে নিয়ে আসলো। একসাথে খাবার সেরে যে যার ঘরে ফিরলো। নাফিজ লাইট জ্বালিয়ে ব্যাংকের একটা হিসেব মেলাচ্ছে। নীহা চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। চোখে ঘুম নেই। মনে হচ্ছে মেয়ে দুটো তাকে দুপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। আপাদমস্তক কাঁথা দিয়ে ঢেকে ও স্বস্তি পাচ্ছে না।
নাফিজ কাজ সেরে লাইট বন্ধ করে দিতেই নীহা চিৎকার দিয়ে উঠলো।
-“লাইট নিভাবেন না। তাহলে আজ রাতে আমার ঘুম হবেনা।”
নাফিজ বলল,
-“ভ’য় নেই। ডিম লাইট জ্বালিয়ে দেবো।”
নীহা কিছুক্ষণ গাঁইগুঁই করে থেমে গেলো। ডিম লাইট জ্বালিয়ে নাফিজ পাশে শুয়ে পড়লো। নীহা কিছুক্ষণ পরপর মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে দেখছে মেয়ে দুটো আছে কিনা?
নাফিজ চোখ জোড়া বন্ধ রেখেই বলল,
-“বারবার চেইক করলে দেখবেন সত্যি সত্যি মেয়ে দুটো আপনাকে ঝাপটে ধরবে।”
নীহা এবার লাফ দিয়ে উঠে বসলো। কিছুতেই তার ভ’য় কমছেনা। ভেতরে ভেতরে বিধ্বস্ত অবস্থা। তাই ঠিক করলো সারারাত বসেই কাটিয়ে দেবে। আজ আর ঘুমাবেনা। মেয়ে দুটো আসলে একদৌঁড়ে শাশুড়ীর কাছে চলে যাবে।
নাফিজ আবারও বলল,
-“আসবেনা ওরা। ঘুমিয়ে পড়ুন। মৃ’ত মানুষ কখনো ফিরে আসেনা।”
সেখানে বসে থাকতে থাকতেই ঘুমে তলিয়ে গেলো নীহা। পা জোড়া খাটের বাইরে। দু’হাতে কাঁথা শক্ত করে ধরে রেখেছে। মাঝরাতে নড়তে গিয়ে নাফিজের মনে হলো সে কেমন বেতালে শুয়েছে। চোখ খুলে লাইট ধরিয়ে দেখলো তার বউ ম’রা’র ভ’য়ে এলোমেলো হয়েই ঘুমিয়ে আছে। সন্তর্পণে নীহাকে সোজা করে শুইয়ে দিলো। নড়চড় না দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নাফিজ। ঘুম ভাঙলেই হয়তো মেয়ে দুটো এসেছে বলে চেঁচামেচি করতো।
প্রেমার বাবা জয়নুল আবেদীন এর মুঠোফোন কেঁপে উঠতেই রিসিভ করলেন তিনি। চিটাগং ডাচ্ বাংলা ব্যাংক থেকে কল এসেছে।
-“আসসালামু আলাইকুম। আমরা ডাচ্-বাংলা ব্যাংক থেকে লোন এর ব্যাপারে কল করেছি। আমরা এখন কুমিল্লায় আছি। দশমিনিট এর ভেতর আপনার বাড়িতে আসছি।”
বলে লাইন কে’টে দিলো।
জয়নুল আবেদীন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। একমাস পূর্বে এরকম কল এসে জানিয়েছে উনি দশ লক্ষ টাকা লোন নিয়েছেন। উনি পাত্তা দেননি। আর কল ও আসেনি। আজ আবার হুট করেই কল আসলো।
তিনি অন্তিকের নাম্বারে কল দিয়ে ব্যাপারটা জানালেন। তার নামে মি’থ্যে অভিযোগ টা’নলে অন্তিক নিশ্চয়ই কিছু একটা করতে পারবে।অন্তিক প্রেমাকে নিয়ে আসছে বলে দিলো। এদিকে নাফিজকে ও খবর দিলেন।
দশমিনিট এর ভেতরেই দুজন লোক এসে হাজির। নাফিজ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে শশুর বাড়িতে আসলো। সমস্ত ডকুমেন্টস জয়নুল আবেদীন এর বিরুদ্ধে কাজ করছে। যেখানে প্রমাণ হচ্ছে জয়নুল আবেদীন ব্যাংক থেকে দশ লক্ষ টাকা লোন নিয়েছেন। তিনি একা নন। মোট ছয়জন শেয়ারে ষাট লক্ষ টাকা নিয়েছে।
জয়নুল আবেদীন আশ্চর্য হলেন। উনিতো এরকম কিছুই জানেননা। বিয়ের পর প্রথম দিকে তিনি আবুল কোম্পানিতে ম্যানেজার পদে চাকরী করেছেন। এরপর সেখান থেকে এসে সিঙ্গাপুর চলে গিয়েছেন। একবছর হবে তিনি বাড়ি ফিরে তিনটে বাস নামিয়েছেন। আর বিদেশে যাবেননা ঠিক করেছেন।
নাফিজ প্রশ্ন করলো,
-“আমার শশুরকে যে আপনারা লোন দিয়েছেন, সেটা কিসের ভিত্তিতে? কোন জমির দলিল এর ভিত্তিতে?”
লোক দুটো জানালো,
-“দলিল লাগেনি। উনি যেহেতু ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন তাই তার আর দলিলের প্রয়োজন হয়নি।”
জয়নুল আবেদীন হতবিহ্বল কন্ঠে বললেন,
-“আমি কখন ইসলামী ব্যাংকে চাকরী করলাম? আমি প্রথমে আবুল কোম্পানিতে ছিলাম। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর। আর এখন দেশে।”
জয়নুল আবেদীন এর কথা শুনে লোক দুটো বলল,
-“কিন্তু স্যার এটাই সত্যি আপনি লোন নিয়েছেন। পাঁচমাস যাবত লোনের টাকা পরিশোধ করছেননা বলে কে’স ফাইল হয়েছে। এসব নিয়ে কেস চলছে।”
নাফিজ ঠান্ডা মাথায় প্রশ্ন করলো,
-“লোন কবে,কখন নেওয়া হয়েছে? আমিও কিন্তু একজন ব্যাংক কর্মকর্তা।”
উনারা জানালেন,
-“২০২০ সালে লোন নেওয়া হয়েছে।”
জয়নুল আবেদীন সাথে সাথেই উত্তর দিলেন,
-“আমি ২০২১ এ দেশে ফিরেছি। তাহলে আমি কিভাবে লোন নিলাম?”
লোক দুটোর মধ্যে একজন বলল,
-“স্যার এখানে আপনার ছবি, আইডি কার্ড সব দেওয়া আছে। এখন আমরা কি করবো বলুন? আমরা ও তো চাকরী করে খাই। আচ্ছা আপনার কি কাউকে স’ন্দেহ হয়?”
জয়নুল আবেদীন সন্দেহ জনক কাউকেই পেলেন না।
নাফিজ কিছু একটা ভেবে বলল,
-“সমস্ত ডকুমেন্টস দেখান তো।”
নাফিজ একে একে জয়নুল আবেদীনের সব কিছুর মিল পেলো। স্ত্রী এর জায়গায় গিয়ে নাফিজ তার শাশুড়ীর পুরো নাম পেলোনা। সাথে শাশুড়ীর মা বাবার নাম টা ও ভুল। এরপর শশুরের ছবি দেখলো। যা আবুল কোম্পানিতে থাকাকালীন একটা ছবি।
সবকিছুতে মিল না পেয়ে লোক দুটো ছবি আর জয়নুল আবেদীনকে দেখলো। ছবির লোকটি একজন যুবক। আর জয়নুল আবেদীন এর চুল দাঁড়ি পাক ধরেছে। তারা বিস্মিত হয়ে বলল,
-“আপনি তো বুড়ো হয়ে গেছেন। অথচ আপনার ইয়াং বয়সের ছবি দিয়ে লোন নেওয়া হয়েছিলো। দুঃখিত স্যার! আপনাকে এভাবে হে’ন’স্তা করার জন্য। আপনি আমাদের আসল কাল’প্রিটকে ধরার সুযোগ করে দিন। কাকে সন্দেহ হয়, কে আপনাকে ফাঁ’সাতে পারে তার নাম বললে উপকৃত হবো।”
জয়নুল আবেদীন এর স’ন্দেহ লিস্টে কেউ নেই। তখন আবুল কোম্পানিতে থাকাকালীন একজন ড্রাইভার ছিলো। যার সাথে উনার বনা’বনি ছিলোনা। এতটুকুই। লোকদুটো চলে গেলো। কে’স এ কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পরবর্তীতে জানানো হবে বলে গেলো। নাফিজ শশুর বাড়ী থেকে বিদায় নিলো। শাশুড়ীর জো’রা’জো’রিতে এক কাপ চা খেলো শুধু। আবার গিয়ে অফিস ধরতে হবে।
রাতের দিকে প্রেমাকে নিয়ে অন্তিক কুমিল্লায় আসলো। খালুর মুখ থেকে সমস্ত ঘটনা শুনে সা’ব’ধান করে দিলো। যাতে পাসপোর্ট, আইডি কার্ড, জন্ম নিবন্ধন কার্ড কাউকে না দেয়। এগুলো দিয়ে মানুষকে বিভিন্ন দূ’র্নী’তিতে ফাঁ’সি’য়ে দেওয়া হয়। যা মানুষ মোটেও টের পায়না।
রোজ সকালে নিয়ম করে অন্তিকের বাবা হাঁটতে বের হন। আজও বের হয়েছেন। আজ আবার একটা বাচ্চাকে দেখে কাছে ডাকলেন।
বাচ্চাটি চরম শে’য়া’না। সে দুহাত গোল করলো।
[৬]
রান্নাঘরের ভ্যাপসা গরমে ঘাম চুইয়ে পড়ছে নীহার শরীর বেয়ে। সুতি শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল, গলার ঘাম মুছে নিলো। বাড়ীতে আজ মেহমান আসছে। নাফিজ একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরী করে। সেখান থেকেই তার সহকর্মীরা আসছে নাফিজের বউ দেখতে। বিয়েতে তো কাউকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি, তাই এখন খাওয়া ও হবে বউ দেখাও হবে। নীহার শাশুড়ীর শরীরটা আজ বিশেষ ভালো নেই। বড়সড় রান্নাগুলো নিজ হাতে চড়িয়ে দিয়ে সব দায়িত্ব নীহার কাঁধে দিয়ে দিলেন। সাথে সাহায্য করার জন্য সুফিয়া আছে। তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। মায়ের শরীর খারাপ ব্যাপারটা নাফিজের কানেও পৌঁছে গেছে। তাই রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে একবার জিজ্ঞেস করে গেলো কোনো সাহায্য লাগবে কিনা?
নীহা মৃদুস্বরে উত্তর দিলো,
-“পারবো আমি।”
সাথে সুফিয়াকে দেখে আর দ্বিতীয়বার কিছু জিজ্ঞেস করলোনা নাফিজ। মেহমান চলে এসেছে। নাফিজ তাদের আপ্যায়ন করে যাচ্ছে। নীহা ফল কে’টে নাস্তা রেডি করে দিলো। নাফিজ সব টেবিলে নিয়ে রাখছে। সবাই যখন ভাবী দেখতে চাইলো নাফিজ রান্নাঘরে এসে একপলক তাকালো নীহার দিকে। চোয়াল ঘেমে নেয়ে একাকার, এলোমেলো চুলের খোঁপা ঢিলে হয়ে ঘাড়ে এসে থেমেছে। আগুনের কাছে থাকায় হলুদ ফর্সা গালে আরক্তিম আভার দেখা মিললো।
নীহা মাথায় কাপড় দিয়ে সামনে যাওয়া ধরতেই নাফিজ থামিয়ে দিলো।
-“আপনি বরং একেবারে ফ্রেশ হয়ে আসুন। রান্নাঘর থেকে বের হয়েছেন, ফ্রেশ হলে আপনার ও ভালো লাগবে।”
নীহা খানিকটা কষ্ট পেলো। ভাবলো রান্নাঘরে থেকে নিশ্চয়ই তাকে কুৎ’সিত দেখাচ্ছে। তাই নাফিজ তাকে সবার সামনে যেতে দিচ্ছে না। চুপটি করে ঘরে চলে গেলো।
অথচ নাফিজ এমন ভাবনা থেকে কিছুই বলেনি।
নীহা একেবারে গোসল সেরে পরিপাটি হয়ে আসলো। বেশির ভাগই পুরুষ এখানে। নীহা হাসিমুখে সবার সাথে আলাপচারিতা শেষ করে দুপুরের খাবার দেয়ার জন্য সব রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসছে। নাফিজ কলিগদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। একজন বলে উঠলো,
-“ভাই ভাবীতো সেই একখান পাইছেন। এই জন্যইতো বলি আমাদের একনাম্বার নাফিজ ভাই দুইনাম্বার ভাবি নিয়ে টা’না’টা’নি করে কেনো?”
-“ভাবীর উপরি রূপ দেখেই কি পা’গল হয়েছেন,নাকি চারমাসে আরও অনেক কিছুই দেখেছেন?”
নীহার পা জোড়া থেমে গেলো। ছিহ! নিজের সম্পর্কে আর কি কি শুনতে হবে? সম্পর্কটা তাকে কতটা নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। নাফিজ উচ্চবাক্য করতেই নীহাকে চোখে পড়লো। মেয়েটা নিজের সমন্ধে এসব আ’জে’বা’জে কথা শুনলে কষ্ট পাবে। তাই আপাতত অফ গেলো নাফিজ। নাফিজের সাথে চোখাচোখি হতেই খাবারের বাটি রেখে রান্নাঘরে ঢুকলো নীহা। সুফিয়াকে বলল,
-“তোমার ভাইয়াকে সাহায্য করো, আমার শরীর খারাপ লাগছে।”
ঘরে চলে গেলো নীহা। এখন তার ঘরটা পরিবর্তন হয়েছে। আগে থাকতো নাহিদের ঘরে আর এখন নাফিজের ঘরে। খাটে বসে চোখ বন্ধ করে নিলো। ভেতরে এক সুপ্ত কষ্ট অনুভব হচ্ছে। ভালোবাসা শুরু হওয়ার পূর্বেই তৈরি হলো এক সূক্ষ্ম অভিমান। লোকটির সামনে তাকে নিয়ে বা’জে কথা বলল। অথচ লোকটি নির্বিকার। চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়লো একফোঁটা জল। ও তো তু’চ্ছ একটা মানুষ। দয়া করে দায়বদ্ধতা থেকেই তাকে বাড়িতে স্থান দিয়েছে। এত এত আশা করা বোকামো ছাড়া কিছুই নয়। লম্বা চুলের খোঁপা খুলে বালিশে চুল ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো নীহা। যদি ঘুমিয়ে যেতে পারতো, শান্তির ঘুম। আহা! কতইনা ভালো হতো। সবার উপর থেকে বোঝা নেমে যেতো। অভিমানগুলো আরেকটু পাকাপোক্ত হলো।
নীহাকে না দেখে নাফিজ সুফিয়াকে ওর কথা জিজ্ঞেস করলো। সুফিয়া জানালো,
-“ভাবীর নাকি শরীর খারাপ। তাই ঘরে চলে গিয়েছে।”
নাফিজ আর ঘাটালোনা। মেহমান বিদায় দেওয়ার মুহূর্তে ঘর থেকে বের হয়ে নাফিজ সেই লোকটিকে উদ্দেশ্য করে শক্ত কন্ঠে হেসে বলল,
-“বাহার ভাই, সবসময় নিজ মর্জি মতো অন্যের চরিত্র বিচার করবেননা।”
-“ভাবটা এমন যে আর কারো বউ নেই। পেয়েছেন তো দুইনাম্বার জিনিস। আবার এতটা তেজ দেখাচ্ছেন।”
নাফিজ এতক্ষণ যথেষ্ট শান্ত থাকার চেষ্টা করেছে। আর পারলোনা। ঝাপিয়ে পড়লো বাহার লোকটির উপর। নাকেমুখে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিলো। অন্যান্য কলিগরা অবস্থা বেগতিক দেখে দুজনকেই ছাড়িয়ে দু’দিকে দাঁড় করালো। দুজনকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে সবাই মিলে চলল নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে। এই বুঝ টুকু আরেকটু আগে দিলে হয়তো এতটা ঝা’মে’লা হতো না।
নাফিজ প্রথমেই নিজের ঘরে গেলোনা। বসার ঘরে বসে থেকে আগে নিজেকে শান্ত করলো। নিজেকে ধাতস্থ করে ঘরে ফিরলো। পায়ের শব্দ পেয়ে ক্রন্দনরত নীহা চোখ বুঝে ফেললো। নাফিজ নীহার দিকে তাকিয়ে থেকে উপলব্ধি করলো নীহা ঘুমিয়ে নেই। তার চোখের কোনে পানি জমে আছে। খানিক বাদে বাদে শরীর মৃদু কেঁপে উঠছে। তাহলে কি নীহা নিজের ব্যাপারে বলা কথাগুলো শুনে ফেলেছে?
নাফিজের ভেতরটা তীব্র অপ’রাধবোধে বি’ষিয়ে গেলো। তার ও তো কোনো দোষ নেই।
[৭]
দুপুরের পর অন্তিক একবার মোড়ের দোকানে গিয়ে বসলো। সাথে তার জেঠাতো ভাই বাদশা উপস্থিত। রং চায়ে চুমুক দিতে দিতেই একে অপরের সাথে কথা বলছে। বাদশা অতি দুঃখের সাথে জানালো,
-“অন্তিক, ভাইতো এতিম হয়ে গেছি।”
অন্তিক অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
-“কি বলো ভাই? জেঠা-জেঠি তো বেঁচে আছে।”
বাদশা কন্ঠে আরেকটু দুঃখ ঢেলে দিয়ে বলল,
-“তোর মর্জিনা ভাবি তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার যাওয়ার দুঃখে আমাদের যে ক্ষেত আছে না? সেখানে বড় বড় তিনটা গরু খাইয়েছি।”
অন্তিক ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
-“দাওয়াত দিলেন না ভাই? আপন চাচাতো ভাই হই আপনার।”
বাদশা বলল,
-“না না ভাই। মিলাদে কেউ আসেনি। মর্জিনা একা একাই তিনটা গরু খেয়েছে।”
বাদশার কথা শুনে চা দোকানিও খিটখিটিয়ে হেসে উঠলেন। অন্তিককে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“এবারের বউটাও নাকি ওরই মতো আধ পা’গল।”
অন্তিক দুজনের চায়ের বিল মিটিয়ে হাঁটা ধরলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রেমা, অভীক, ওর আরও দুজন চাচাতো বোন সহ ওরা কোথায়ও যাচ্ছে মনে হচ্ছে। অন্তিক সাথে যোগ হলো।
-“কোথায় যাচ্ছিস দলবেঁধে?”
অভীক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
-“ক্ষেতগুলোতে পানি জমেছে। মাছ ধরবো নৌকা নিয়ে। তুমি যাবে নাকি?”
-“যাওয়ায় যায়, চল।”
পাঁচজন মিলে ছোট্ট একটা নৌকায় উঠলো। নৌকা কিছুদূর যেতেই অভীক জাল ফেললো। খুব একটা মাছ উঠলোনা। এরপর অন্তিক জাল ফেললো। সবার শেষে প্রেমা জাল ফেলতে গিয়ে জাল সহ পানিতেই প’ড়ে গেলো। অন্তীক নৌকা কিছুদূর নিয়ে গেলো।
প্রেমা চেঁচিয়ে বলল,
-“আমাকে তোলো।”
অভীক খিলখিলিয়ে হাসলো।
-“খাইশটা মহিলাদের এই অবস্থায়ই হয়।”
সাথে অন্তিক যোগ দিলো।
-“তুই যেই চাকরীতে যোগ দিতে চাচ্ছিস সেখানে সাঁতার জানা খুবই জরুরি। নয়তো প্রথমেই বাদ পড়বি। তুই বরং সাঁতার কা’টা শিখে নে।”
প্রেমা আত’ঙ্কিত চোখে চারপাশে তাকিয়ে বলল,
-“আমি সাঁতার জানি। প্লিজ এই পানিতে জোঁক আছে। আমাকে তোলো।”
অন্তিক দেরি করলোনা। নৌকা ঘুরিয়ে নিলো। অভীক হাত টে’নে উঠিয়ে নিলো প্রেমাকে। নৌকার শেষমাথায় পাটাতনে পা গুটিয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো প্রেমা। যদি সত্যি সত্যি জোঁকে ধরতো? অভীক নৌকা চালাচ্ছে। অন্তিক প্রেমার পাশে এসে বসলো। মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলল,
-“রাগ করেছিস?”
প্রেমা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। অন্তিক অভীককে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“অভীক, কেউ রা’গ করলে কি করা উচিত?”
অভীক বাঁকা হেসে উত্তর দিলো,
-“তাকে আবার ও পানিতে চু’বানো উচিত।”
মাছের বালতি প্রেমার সামনেই ছিলো। একটা মাছ নিয়ে অভীকের মাথায় ছুঁ’ড়ে মা’রলো। অন্তিক হু হা করে হেসে উঠলো। এবার পুরো বালতির মাছই পানিতে ফে’লে দিলো প্রেমা। সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
নীহার মন ভালো করতে বিকেলেই নাফিজ বলল,
-“তৈরি হয়ে নিন। আমরা বের হবো।”
নীহা শক্ত কন্ঠে বলল,
-“ভালোলাগছেনা, আমি যাবেনা।”
নাফিজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠান্ডা গলায় বলল,
-“সুফিয়া ও সাথে যাচ্ছে। ওর নাকি ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে। আর আপনি না গেলে ও যাবেনা।”
নীহা আর কথা বাড়ালোনা। তৈরি হতে চলে গেলো।
মি’থ্যে কাজে লেগেছে ভেবেই প্রশান্তির শ্বাস ফেললো নাফিজ। এরপর ছুটলো সুফিয়ার ঘরে। সুফিয়াকে যাওয়ার কথা বলতেই সে যাবেনা বলে দিলো। ভাই ভাবীকে স্পেস দেওয়া দরকার।
নাফিজ বলল,
-“তুই না গেলে তোর ভাবী যাবেনা।”
সুফিয়া ও রাজি হলো। এক মি’থ্যে দিয়ে দুজনকেই পটিয়ে নিলো। বাড়ি থেকে অনেক দূরে নতুন একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। যেখানে ঘোরাঘুরি, খাওয়ার ব্যবস্থা সবই আছে। মূলত পার্ক বলা চলে। সেখানেই নিয়ে গেলো সুফিয়া আর নীহাকে। সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখে সুফিয়া বায়না ধরলো বোট এ উঠবে। যেগুলো উপরে ইঞ্জিন দিয়ে চালানো হয়। নৌকার এক অংশ উপরে তো অপর অংশ মাটি ছুঁই ছুঁই। তিনটে টিকিট কে’টে নাফিজ উঠে পড়লো। সে মাঝখানেই বসেছে। সুফিয়া, নীহা দুপাশে। নৌকা চালনা শুরু হওয়ার পরই যারা ভ’য় পায় তারা চোখ বন্ধ করে চিৎ’কার শুরু করলো। সুফিয়া ও চোখ বন্ধ করে শক্ত করে সামনের রড ধরে রেখেছে। নীহা দুপুরের জ’ঘ’ন্য কথাগুলো ভাবছে। চোখবুঁজে নিলো ঠিকই,কিন্তু রড ছেড়ে দিলো। তারা যে মাথায় বসেছে সে মাথা উপরে উঠে যেতেই পড়ে যাওয়া ধরলো নীহা। নাফিজ একহাতে রড ধরে অপর হাতে নীহাকে চেপে ধরলো নিজের সাথে। তড়াক করে উঠলো নীহা। এক্ষুনি কি হয়ে যেতো? সামনে ব্যালেন্স রাখার জন্য রড ধরে নিলো। নাফিজ ওকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। ওর ভেতরে দ্রিম দ্রিম হাতুড়ি পে’টার শব্দ হচ্ছে। এক্ষুনি মেয়েটা প’ড়ে যেতো।
আর বেশি ঘোরাঘুরি করলোনা। সন্ধ্যার পরই খেয়ে বাসায় ফিরলো তিনজন। নীহার অবস্থার তেমন একটা পরিবর্তন হলোনা।
সারারাত্রি নিদ্রায় কাটিয়ে দর্শন দিলো সূর্য। মিটিমিটি চোখে তাকিয়ে তাপ ছড়াচ্ছে সর্বত্র। মইফুলের শরীরটা ভারী হয়ে আসছে। তাই সকালে ব্যায়াম করার উদ্দেশ্য বের হলেন। রাস্তায় আরও অনেকেই আছে। যাদের ডায়াবেটিস সহ বিভিন্ন রোগ আছে, ব্যায়াম করতে বের হয়। সাতটা বেজে গেলো অথচ অন্তিকের বাবা তার স্ত্রী মইফুলকে খুঁজে পাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে কিছু মহিলাকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ভাবী, আমার স্বর্ণের কুমড়া’কে দেখেছেন?”
মহিলাগুলো মুখ টিপে হাসছেন। পেছনে মইফুল ছিলেন। অন্তিকের বাবা খেয়াল করেনি। একজন মহিলার ইশারায় পেছন ঘুরতেই দেখতে পেলো তার স্বর্ণের কুমড়ার চোখজোড়া টলটলে, অভিমানে নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। টুপ করেই অশ্রু বর্ষণ হবে।
মইফুল হাঁটা ধরলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। পেছন পেছন তার স্বামীও আসছে। মইফুল মনে করেন তার স্বামী সর্বদা তাকে নিয়ে ঠা’ট্টা করার পরিকল্পনা এঁটে থাকেন। মোটা বলে তাকে স্বর্ণের কুমড়া উপাধি দিলেন।
মইফুল বাড়ি ফিরে আসলেন। অন্তিকের বাবা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা মেয়েকে দেখে বলল,
-“এদিকে আয়।”
মেয়েটা আসছেনা দেখে অন্তিকের বাবা হেসে উঠে নরম কন্ঠে আদুরে ভঙ্গিতে বললেন,
-“দাদা কিছু করবোনা। এদিকে আয়।”
যেই মেয়েটা কাছে আসলো অন্তিকের বাবা খা’মছি দিয়ে মেয়েটির কপাল থেকে মাংস সমেত টিপ তুলে নিলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“মক্তবে কেউ টিপ লাগিয়ে যায়? এক চ’ড় মারবো।”
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছে না’লিশ করলো,
কলপাড় থেকে মুখ ধুয়ে খালার পাশে এসে বসলো প্রেমা। দুদিন যাবত গ্যাস লাইন বন্ধ। তাই টিনশেড বিল্ডিং এর পাশে উন্মুক্ত অংশে মাটির চুলা তুলে সেখানে রান্না করা হচ্ছে। পাশাপাশি খালার জা ও চুলা বানিয়েছেন। সকালের নাস্তা এখানেই তৈরি করছেন। খালার ভাসুরের বড়ছেলের বউ শিমু পাশের চুলায় রুটি সেঁকছে। সে উদাস হয়ে বিরস মুখে পেটে হাত দিলো। প্রেমার দিকে তাকিয়ে মনমরা হয়ে বলল,
-“তোমার ও দেখি পেট ছোট। জানো, আমার সাথে যাদের বিয়ে হয়েছে সবার পেট ফুলে ইয়া বড় হয়ে গেছে। কিন্তু আমার পেট এখনো দেখি শুকিয়ে আছে।”
প্রথম বউ থাকাকালীন প্রেমা চট্টগ্রাম এসেছিলো। সে চলে যাওয়ার পর নাকি খালার ভাসুরের বড় ছেলে আবার বিয়ে করে। ছেলেটার ও মাথায় হালকা সমস্যা। জম্পেশ মিলে যাচ্ছে। এদের সবার মাথার তার ছিঁ’ড়া।
-“যাতো, অভীক কে ঘুম থেকে ডেকে তোল। পশ্চিম দিকটায় একটা টিন দিয়ে বেড়া দিলে আর বাতাসে আগুণ নিভে যাবেনা।”
প্রেমা সোজা অভীকের ঘরে ঢুকলো। দরজা খোলাই ছিলো। অভীকের সাথে তার একটা ফুফাতো ভাই ঘুমিয়েছে। দুজনের অবস্থা দেখে প্রেমার চোখ কপালে উঠে গেলো। দমফাটা হাসি আসছে। ঠোঁট চেপে একদৌড়ে নিজের ঘরে গেলো। ফোন হাতে নিয়ে এসে ফটাফট তিন-চারটা ছবি তুলে নিলো। এরপর অভীক কে ডেকে তুললো।
ঘুম ভাঙতেই আৎকে উঠে অভীক। হায় খোদা, শ্যাষ, ইজ্জত একেবারে শ্যাষ হয়ে গেলো। ফুফাতো ভাই ওর লুঙ্গির ভিতর দুইপা ঢুকিয়ে আরামসে ঘুমাচ্ছে। ভাগ্যিস হাঁটু পর্যন্ত হাফ প্যান্ট ছিলো।
পাশে শুয়ে থাকা ফুফাতো ভাইকে ধা’ক্কা দিয়ে তুলে দিলো। লজ্জায়, ক্ষোভে জবুথবু হয়ে ধমকে উঠলো,
-“এ ব্যাডা! তুই ও হোদ্দলা আমিও হোদ্দলা। তাইলে তুই ক্যান আমার লুঙ্গির ভিতর পা ঢুকাবি?”
ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। ঘুম থেকে ওঠায় মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলোনা। প্রেমা ঘর কাঁপিয়ে হাসলো। পরক্ষণেই অনুভব করলো কতদিন পর সে এমন মন খোলা হাসি হাসলো। যে কারণে অভীক কে ডাকতে এসেছিলো সেই কারণ বলেই ঘর থেকে বের হলো। ঘরের সামনে সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে বসার ব্যবস্থা করা আছে। সেখানেই বসলো প্রেমা।
অভীক আগে মায়ের নির্দেশিত কাজ সেরে মুখ ধুয়ে আসলো। সবাই মিলে সকালে নাস্তা করলো। কলেজ আছে অভীকের। সদাই-পাতি কিছু লাগবে কি-না মাকে জিজ্ঞেস করেই তৈরি হতে গেলো। এসব বাজার করা, রান্না করার একটু আধটু অভ্যেস আছে অভীকের। মা যখন অসুস্থ থাকে তখন সে রান্না করে ফেলে। তাদের তো আর বোন নেই। তাই বোনের কাজ তারাই করে।
সকালের নাস্তা শেষে প্রেমা আশেপাশে হেঁটে হেঁটে দেখছে। খালা দুপুরের রান্নার জোগাড় করছে। আজ তার বড় ছেলে বাড়ি ফিরবে। দিনরাত গাধার খাটুনি খাটতে হয়। বছরে দুবার ও ঠিক করে মায়ের রান্নার স্বাদ নিতে পারেনা। এই ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মইফুল। অন্তিক ভাইয়া আসবে শুনেই কুমিল্লা থেকে ছুটে আসলো প্রেমা।
অভীক তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বের হলো। সামনে দিয়ে একজন আইসক্রিমওয়ালা যাচ্ছে। অভীক পাঁচ টাকা দিয়ে একটা আইসক্রিম কিনলো। বাড়ির সামনের রাস্তায় প্রেমাকে দেখে আরও একটা কিনে তার হাতে দিলো। কোত্থেকে অভীকের জেঠাতো ভাইয়ের বউ শিমু দৌঁড়ে আসলো।
-“দেবর ভাই, আমাকে একটা আইসক্রিম কিনে দাও।”
অভীক আইসক্রিম মুখ থেকে বের করে বলল,
-“টাকা আছে? আমি মাগনা তোমাকে আইসক্রিম কিনে দিতে পারবোনা।”
শিমুর ফর্সা মুখে আঁধার নামলো। গাল ফুলিয়ে বলল,
-“আমার জামাইকে বললে আমাকে একটা না পাঁচটা কিনে দিতো।”
আইসক্রিম বিক্রেতা লোকটি চলে যাচ্ছে। শিমু ভাবী সত্যি সত্যি আইসক্রিমওয়ালার পেছনে ছুটলো। এদিকে তার লম্বা আঁচল মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। গলার স্বর বড় করে বলছে,
-“আইসক্রিমওয়ালা দাঁড়ান, আপনাকে জামাই বলছি আমাকে একটা আইসক্রিম দিয়ে যান।”
প্রেমা চরম আশ্চর্য হলো। ভেবেছি উনার মাথায় সমস্যা আছে, কিন্তু এতো দেখছে পুরাই পা’গ’ল। অভীক কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো। সামনে গিয়ে আরেকটা আইসক্রিম শিমু ভাবীর হাতে দিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। খালার বাড়ি যদি চট্রগ্রাম না হয়ে পাবনা হতো? কেউ জিজ্ঞেস করলে অকপটে বলে দিতে পারতো ‘এরা পাবনার পা’গ’ল। অতিসত্বর চিকিৎসা করা হবে।’
প্রেমা, শিমু দুজনেই বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো।
[৫]
অনেকক্ষণ বসে থেকে রান্না করায় কোমর ব্যথায় টনটন করছে। খালা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আচমকা ভ’য় পেয়ে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলেন।
পেছন থেকে জড়িয়ে কেউ উনাকে উপরে তুলে রেখেছে। তার গায়ের ঘ্রাণ আর কিটকিটিয়ে হাসির শব্দে বুঝে গেলেন তার সোনার টুকরো বাড়ি ফিরেছে।
বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেই উঠোনে মাকে আবিষ্কার করলো অন্তিক। হাতের ব্যাগ মাটিতে রেখেই ইউনিফর্ম গায়ে নিয়েই মাকে পেছন থেকে কোলে তুলে নিলো। মাকে কোল থেকে নামাতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মইফুল। অন্তিকের পুরো মুখ জুড়ে অসংখ্য চুমু খেলেন। ছেলে এমন চাকরি করে যেখানে জানের মায়া করতে নেই। সবসময় বুকে পাথর বেঁধে চলতে হয়। যেকোনো সময় প্রস্তুত থাকতে হয় মৃ’ত্যুর খবর শোনার জন্য। অন্তিক হেসে উঠে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
প্রেমা দূরে দাঁড়িয়েই পর্যবেক্ষণ করলো সেনাবাহিনীর পোশাক গায়ে চাপিয়ে উঁচা লম্বা একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। অধর কোনে সুগভীর হাসির খেল। ঠোঁটের সাথে সাথে চোখজোড়া ও হেসে উঠছে। এগিয়ে গেলো প্রেমা। ওকে দেখে অন্তিক মিষ্টি করে হাসলো।
অন্তিকের ঠোঁট থেকে যেনো হাসি সরছেইনা। মুক্তোঝরানো হাসিমুখ নিয়েই বলল,
-“এতগুলো মাস পর পরিবারকে কাছে পেলে ভালো না থেকে উপায় আছে?
তুই দেখছি দিনদিন লম্বা আর শুটকি হয়ে যাচ্ছিস।”
ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেলো প্রেমার। এরা দুই ভাই সবসময় ওকে পঁচাতে প্রস্তত থাকে। মুখ ঘুরিয়ে থমথমে গলায় বলল,
-“ধুরো! তোমাদের খালি একই ঘ্যানঘ্যান।”
শব্দ করে হাসলো অন্তিক। মায়ের তাড়া খেয়ে ঘরে ফিরে পোশাক বদলে নিলো। লম্বা একটা ঘুম দিলো। দুপুর নাগাদ বাবা আর অভীক’কে বাড়িতে দেখা গেলো। বাবা অন্তিক কে দেখে গদগদ হয়ে জড়িয়ে ধরলেন। চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। তিনি খুবই নরম মনের মানুষ।
ভাইয়ের সাথে ও কুশল বিনিময় করে খেতে বসলো অন্তিক।
খাওয়া পাতে রেখেই অভীক প্রেমাকে পঁচানো শুরু করলো,
-“ভূ’তী, তোকে কত করে বললাম চালের গুদামের নাম বল। আমিও একটু মোটা হই। বললিনা। দেখ আমার অভি’শাপে তুই এখন দিনদিন পাটকাঠি হয়ে যাচ্ছিস।”
প্রেমা বিরক্ত হয়ে বলল,
-“ভাইয়া, ভূ’তী বলো কেনো?”
অভীক টিট’কিরি মেরে বলল,
-“ছোটবেলায় যা আটার বস্তা ছিলি। তোর গালদুটো মাংসের ভারে ভোঁতা ভোঁতা দেখাতো। ইচ্ছে করতো চ’টাশ চ’টাশ করে থাপ্পড় মারি। তখন তোকে দেখে ভূ’তী ছাড়া মাথায় আর কিছুই আসতোনা। আচ্ছা এখন এত চিকন হলি ক্যামনে? গুদামের চাল কি শেষ?”
অভীক ভাবলো প্রেমা রাগ হবে। কিন্তু প্রেমা রাগ হলোনা, মোটেও রাগ হলোনা। রাগের পরিবর্তে প্রেমার চেহারায় দেখা গেলো এক পৈশা’চিক হাসি। মুঠোফোন বাড়িয়ে ধরলো অভীকের সামনে।
নিজের সকাল বেলার কাণ্ডকীর্তি ফোনে ক্যাপচার দেখে দমে গেলো অভীক। পাশে তাকিয়ে দেখলো বাবা খেয়ে উঠে গেছে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
প্রেমা চট করে অন্তিকের দিকে ফোন ঘুরিয়ে ধরলো।
অভীকের লুঙ্গির ভেতর তার ফুফাতো ভাইকে দেখে ঘর কাঁপিয়ে হাসলো অন্তিক। টিটকারি করে ছোট ভাইকে বলল,
-“শেষে কিনা ছেলে হয়ে ছেলের সাথেই এরকম একটা কাজ করলি? ছিহ্!”
অভীক কাচুমাচু মুখ করে দাঁতে দাঁত চেপে প্রেমাকে বলল,
-“তুই আসলেই একটা খাইশটা মহিলা।”
প্রেমা বুদ্ধিমানের মতো নিপুনভাবে হাসলো।
আরক্তিম আভা ছড়ানো আকাশ। দিনের শেষ ভাগে এসে রাত্রিকে আপন করে নেওয়ার আয়োজন। ভোরে ওঠা পূর্বের সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়লো। রোদের মৃদু আঁচ গাছের কচিপাতায় পড়তেই ঝলমলিয়ে উঠে চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে ধরা দিলো। ফ্যানের হাতায় ধা’ক্কা লেগে ছোট এক চড়ুইপাখি পায়ের উপর আঁচড়ে পড়লো। অন্তিক ছানাটি বিশাল হাতের তালুতে নিয়ে দেখলো পাখিটি পায়ে ব্যথা পেয়েছে। আফসোসের সুরে চড়ুই পাখির পায়ে আঙ্গুল ছুঁয়ে দিচ্ছে অন্তিক। দরজার কাছে অনেকক্ষণ ধরে পায়চারি করছে প্রেমা। যে কথাটি বলতে এসেছে কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছেনা। অন্তিক ভাইয়া কি তার কথা শুনবে? দাঁত দিয়ে নখ কে’টে অবশেষে ঢুকে পড়লো অন্তিকের ঘরে।
কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পিছু তাকালো অন্তিক। প্রেমাকে দেখে একগাল হেসে বলল,
-“কিরে, কিছু বলবি?”
প্রেমা আমতা আমতা করে বলল,
-“হ্যাঁ! কিছু বলার আছে।”
-“এত বাহানা না করে যা বলতে এসেছিস বলে ফেল।”
প্রেমা ঠা’স করে বলে দিলো,
-“আমি আর্মিতে জয়েন্ট করতে চাই।”
অন্তিকের হাতে থাকা চড়ুইটি এক্ষুনি পড়ে যেতো। কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বিস্ফোরিত নেত্রে তাকালো অন্তিক। পরোক্ষণে ব্যঙ্গ হেসে বলল,
-“কি বললি? আবার বল তো।”
প্রেমা করুণ চোখে তাকিয়ে বলল,
-“আমি মজা করছিনা ভাইয়া। আমি সিরিয়াস।”
অন্তিক নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
-“ভালো কথা। কিন্তু এ কথা আমাকে বলছিস কেনো?”
প্রেমা বিষন্ন কন্ঠে বলল,
-“তুমি মাকে বোঝাবে। আর্মিতে জয়েন হওয়ার কথা শুনলেই মা হার্টফেল করবে। মা মনে করে আর্মি ট্রেনিং এ দু’একটা লাঠির বাড়ি খেয়ে আমি ম’রে যাবো।”
অন্তিক এবার সিরিয়াস হলো।
-“তুই পারবি? দেখ, আর্মিতে যোগ দিলে জীবনের মায়া ত্যাগ করতে হবে। দেশের জন্য নিঃস্বার্থ হতে হবে। খালার ধারণা ঠিকই, একটা লাঠির আ’ঘা’তেই তুই ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠবি।”
প্রেমা বিরক্ত হয়ে বলল,
-“দেখো আমি এত কিছু বুঝিনা। আমি আর্মিতে জয়েন করবো আর তুমি মাকে বোঝাবে যে তুমি ওখানে আছো। সুতরাং আমাকে নিয়ে যাতে কোনো চিন্তা না করে।”
অন্তিক নাক সিটকে বলল,
-“দেখিস, তোর নাকের পানি যেনো কফিতে না পড়ে।”
রাগ হলো প্রেমা। কিন্তু কফি বানানো হলোনা। রাগ করে অন্তিকের ঘর ছাড়তেই অভীকের মুখোমুখী হলো।
-“ভূ’তী চল তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবো।”
প্রেমা ভালো করেই জানে অভীক ও তাকে পঁচানোর প্ল্যান নিয়ে এসেছে। তাই দুপদাপ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। ছোটবেলায় সবারই নাক দিয়ে পানি গড়ায়। তাই বলে সেই খোঁটা সারাজীবন শুনতে হবে নাকি?
#চলবে…….
নাফিজের উত্তর শুনে জয়নুল আবেদীন বেজায় সন্তুষ্ট, কিন্তু মুখে প্রকাশ করলেননা। প্রসন্নচিত্তে বাড়ি পথে রওনা হলেন দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। যাওয়ার পূর্বে নীহা’র শাশুড়ীকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানালেননা। বলে দিলেন,
-“ভেবে আপনাদের জানাবো। তাছাড়া ওর মা, আমার বড় ভাই তাদের ও মতামতের প্রয়োজন আছে।”
নীহা’র শাশুড়ী আর কথা বাড়ালেন না। অপেক্ষায় রইলেন পরবর্তী উত্তর আসার।
নাফিজ এলাকার একটি সিএনজি ঠিক করে দিলো। মুহুর্তেই টান লাগালো জয়নুল আবেদীনের বাড়ি। প্রেমা চোখ তুলে একবার ও নাফিজের দিকে তাকালোনা। এতে নাফিজ এর ও বিশেষ খেয়াল নেই। নীহা মুখ লুকানোর চেষ্টায় অন্যদিকে ফিরে আছে। আড়ষ্টতা, লজ্জায় মিইয়ে আছে মেয়েটা। এ কয়েকমাসে একটিবারের জন্যেও নাফিজের সামনে পড়েনি নীহা। বিয়ের ব্যাপারটা তো মাথার আশেপাশেও আনতে পারেনি, থাকতো মনে আনবে। একজনের শোকেই দিনাতিপাত করেছে।
এতটা সহজে নাফিজ মায়ের কথায় সম্মতি জানালো? কেনো? হয়তো করুণা হচ্ছে তার জন্য।
সিএনজি আর রাস্তার পাশে বেড়া ওঠা গাছগুলোর মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা হচ্ছে। কে কাকে পেছনে ফেলতে পারবে। এদিকে কারো মনে তুমুল ঝড়ের তান্ডব বইছে। ব্যথাগুলো বুকে নয়,মনে হচ্ছে গলায় এসে আটকে আছে। না পারছে ভেতর থেকে হজম করতে আর না পারছে মুখ দিয়ে উগলে দিতে। মনের কোটরে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা অনুভূতি গুলো চাপা পড়ে নিঃশেষ হওয়ার পথে। চোখজোড়া ভীষণ জ্বালা করছে। এক্ষুনি ভিজে ওঠা উচিত। কিন্তু এই উচিত অনুচিতের দ্ব’ন্দ্বে অনুচিত জয়ী হলো। বাবা, আপু যখন কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করবে তখন কি জবাব দেবে? বেহা’য়া উত্তরে নিজের আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিতে পারবেনা। দাঁত চেপে কান্না সংবরণ করলো। আর তো কিছু সময় তখন নাহয় নোনাজলের বন্যা বইয়ে দিবে।
[৩]
বাড়িতে পা রাখতেই একদফা কান্নার সুর উঠলো। আয়েশা যুবতী মেয়ের বিধবা রূপে বিধ্বস্ত হলেন। মা মেয়ের কান্নায় শামিল হলো চাচি, জেঠিরা। বাড়ির মেয়ে ফিরে আসার খবর শুনে এ ঘর ও ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসলেন। আয়েশাকে বুঝালেন মেয়েটার মন এমনিতেই ছোট হয়ে আছে। নিজে মেয়ের সামনে কেঁদে কে’টে মেয়েটাকে আরও দুর্বল করে দিলে কিভাবে চলবে? নীহার জেঠি এসে নীহাকে বসিয়ে ফ্যান ছেড়ে দিলেন। মা বোনের কান্না দেখে প্রেমা যেনো সুযোগ পেলো, স্বস্তি পেলো। ভেতরকার কষ্ট গুলো চোখের পানিতে ধুয়েমুছে ফেলার সুযোগ। শব্দ করেই কাঁদলো প্রেমা। ছোট চাচি এসে তাকেও বসিয়ে দিলেন ফ্যানের নিচে। সবার কান্নাকাটি ঘন্টাখানেকের মধ্যে থেমে গেলেও থামলোনা প্রেমার কান্না। সবার মাঝখান থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো। নিরব অশ্রু তীরের মতো আ’ঘা’ত করছে।
আচ্ছা পুরুষ মানুষ যে বাঁধ ভাঙা কান্না কাঁদতে পারেনা তাহলে তাদের কষ্ট গুলো কিভাবে পিষ্ট করে? নাকি যন্ত্রণা গুলো নিংড়ে ফেলতে না পারার কষ্টে আরেকটু ধুঁকে ধুঁকে মরে?
জয়নুল আবেদীন বড়ভাই ছোটভাইকে এঘরে রাতের খাবার খেতে বলে দিলেন। কিছু আলাপ আলোচনার ব্যাপার আছে। সেই অনুযায়ী খাওয়ার পর্ব এগিয়ে আসতেই খাবার টেবিলে চেয়ার পেতে তিন ভাইকে বসে থাকতে দেখা গেলো। আয়েশা সবার পাতে খাবার তুলে দিচ্ছে। নীহা, প্রেমা চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। খরগোশের মতো কান কিন্তু খাড়া রেখেছে আলোচনায় কি চলে?
জয়নুল আবেদীন বড়ভাইকে নীহা’র শাশুড়ীর সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। নীহা’র জেঠা বেশ ভেবেচিন্তে উত্তর দিলেন,
-“ভালোই তো প্রস্তাব। একবার সবকিছু বিবেচনা করে দেখ। আমাদের মেয়েটাকে তাদের বাড়িতে দিলাম। এখন তাদের ছেলে কি কারণে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে দুনিয়া ছাড়লো সে ব্যাপারে আমরা কেউই অজ্ঞাত নই। হয়তো নিজেদের কোনো ভুলের অনুশোচনা থেকেই তারা বিয়ের প্রস্তাব রেখেছেন। তাছাড়া নীহাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে গেলেও তারা নাক সিটকাবে। ধরলাম বিনা বাঁধায় বিয়েটা ও দিয়ে দিলাম। কিন্তু সেখানে যে সুখী হবে, তারা যে মেয়েটাকে কথা শোনাবেনা এটার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আমার মনে হয় ভেবে দেখা উচিত।”
নীহার ছোট চাচা নীহাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন,
-“যে কয়টা দিন শশুর বাড়িতে ছিলি, তোর প্রতি তাদের ব্যবহার কেমন ছিলো? চারমাস কিন্তু কম সময় নয়। তোর সাথে কোনো ধরনের খা’রা’প ব্যবহার করেছে?
নীহা দুপাশে মাথা নেড়ে জানালো,
-“আমার সাথে কোনো ধরনের খা’রা’প ব্যবহার করেনি। আর না তাদের ব্যবহারে খা’রা’প মানুষ মনে হয়েছে।”
নীহার উত্তর শুনে তিন ভাই একে অপরের চোখে তাকালো। জয়নুল আবেদীন আয়েশাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“তোমার কি মতামত?”
আয়েশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“মেয়েটার একটু সুখ দেখলেই আমি খুশি।”
সবার কথাবার্তায় প্রেমার মনে হলো বিয়েটা এগিয়ে যাবে। দু’পরিবার থেকেই গ্রিন সিগন্যাল। আধখাওয়া ভাতের প্লেটে পানি ঢেলে উঠে পড়লো প্রেমা। জয়নুল আবেদীন জিজ্ঞেস করলেন,
-“কি হয়েছে আম্মু? পুরো খাবারটা খেলেনা যে?”
-“খাওয়া শেষ। আর ইচ্ছে করছেনা।” বলে প্রেমা স্থান ত্যাগ করলো।
গলা দিয়ে খাবার কিভাবে নামবে? এমুহূর্তে এক বি’চ্ছিরি অনুভূতি হচ্ছে। যার স্বাদ শুধুই তিক্ততায় ঘেরা। এখন থেকেই বুঝি যন্ত্রণার দিনগুলো শুরু? তীব্র হাহাকার জর্জরিত করছে। চারদিক গুমোট অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে মনে ক্ষীণ আলোর প্রয়োজন। নইলে যে বাঁচা মুশকিল হয়ে যাবে? মুখে ওড়না গুঁজে চিৎকার করে বেরিয়ে আসা কান্নাগুলো থামানোর বৃথা চেষ্টায় মাঠে নেমেছে মেয়েটা। রগচটা স্বভাবটা যেনো প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসছে। এই মুহূর্তে নীহার প্রতি ভীষণ রাগ হলো। যতটা রাগ হলে কাউকে খু’ন করার ইচ্ছে মনে জাগে। চাপা ক্ষো’ভ ধাবিত হলো বোনের উপর।
ঘর বন্ধি থেকে সম্বিত ফিরলো প্রেমার। নিজের প্রতি ধি’ক্কার ছাড়া কিছুই আসছেনা। স্বার্থপরের মতো নিজের কথাটাই ভেবে চলেছে। নীহার তো কোনো দোষ নেই। প্রিয়জন তো সে ও হারিয়েছে। তার উচিত ছিলো একটিবার জিজ্ঞেস করার,’ আপু তুই ভালো আছিস?’
খাবার টেবিলে যখন বিয়ের বিষয়ে এগোনো নিয়ে কথা হচ্ছিলো, নীহার মতামত জানতে চাইলেন জয়নুল আবেদীন।
বিষন্ন মনটা চেপে রেখে মিইয়ে যাওয়া স্বরে অনুরোধ করলো নীহা,
-“বাবা, আমি আপাতত কিছুদিন সময় চাই। নিজের দিকে তাকানোর সময়টা আমাকে দাও। আমি তোমাদের নিরাশ করবোনা।”
কথা সব সেখানেই থেমে গেলো।
নীহা নিজের মতো করে সময় কাটাচ্ছে। এদিকে প্রেমার বেপরোয়া ভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্বভাবে উগ্রতা, ভালো কথায়ও তেঁতে ওঠা। সবকিছুই সুক্ষ্ম চোখে খেয়াল করলেন জয়নুল আবেদীন।
দাদী খেঁ’কিয়ে উঠে বললেন,
-“বলেছিলাম নাম প্রেমা রাখিসনা। নিশ্চয়ই নামের সাথে মিল রেখে প্রেম করে এখন দেবদাসী হয়ে ঘুরছে।”
কছু বললেননা জয়নুল আবেদীন। আদরের তিন মেয়ে উনার। বড় মেয়ে খুব একটা আসেনা। স্বামী সংসার নিয়েই ব্যস্ত। জয়নুল আবেদীন ও বেশি চাপ প্রয়োগ করেননা। সন্তানরা সুখী থাকলেই বাবা মা সুখী।
[৪]
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। পেটের অনাগত বাচ্চাটা ফেলে নাড়ি পরিষ্কার করে নিলো শাহনাজ। দিনের পর দিন বাবামায়ের মা’রের আর কথার আ’ঘা’ত সহ্য করেছে মেয়েটা। নাহিদের সাথে তার কঠিন প্রেম ছিলো। এমনই প্রেম যেখানে দুজনের মধ্যে কিছুই বাকি রইলোনা। দু’জনের এক তুমুল ঝ’গড়ায় নাহিদ ক্ষোভের বসে নীহাকে বিয়ে করে নেয়। সেদিনই জানতে পারে শাহনাজের গর্ভে তারই অংশ। সাগরের মাঝখানে এসে আর পথ খুঁজে পেলোনা নাহিদ। নিজের জীবন বলি দিলো। এতো এতো মা’র’ধরে ও শাহনাজ নাহিদের নাম ভাঙলোনা। এই চরম সত্যি কেউ জানেনা। ভাগ্য বশত ভাইয়ের চিরকুট পেয়ে নাফিজ আর মা জানতে পারলো। বাচ্চাটাকে নিঃশেষ করে নাহিদের মতো শাহনাজ ও পাড়ি জমালো পরপারে। একটিমাত্র পা’পের ফলে তিনটে প্রাণ নিঃশেষ হলো।
বয়সটা উনিশ ছুঁই ছুঁই। উচ্চমাধ্যমিক এর ফলাফল এর সময়টা ও ঘনিয়ে এসেছে। নীহার বিয়ের পরই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসে প্রেমা। সব কিছুতে হেলাফেলা চললেও পড়াশোনায় গাফিলতি করা প্রেমার স্বভাবে পড়ে না। ফলাফল প্রকাশ পাবে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রেমার মাঝে প্রতিবারের মতো এবারে কোনো আগ্রহ, উৎকন্ঠা দেখা গেলোনা। উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশ পেলো, প্রেমার ফলাফল ভালো হলো। প্রত্যাশা অনুযায়ী সে ফলাফল পেয়েছে। সবাই খুশি থাকলেও প্রেমার কোনো ভাবান্তর হলোনা। কয়েকদিন যাবত মেয়ের ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন আয়েশা। গতকাল ও চ্যালাকাঠ নিয়ে মা’র’তে গেলেন। শেষে জয়নুল আবেদীন এর ধমক খেয়ে থামলেন। বউ, বাচ্চার গায়ে হাত তোলা উনার একদমই পছন্দ নয়। মেয়ের আগের চেয়ে গুটিয়ে যাওয়ার স্বভাব লক্ষ্য করেই জয়নুল আবেদীন কর্মস্থলে সময় কমিয়ে মেয়েকে সময় দিচ্ছেন ইদানীং। প্রতিটা মেয়ের ক্ষেত্রেই জয়নুল আবেদীন যখন দেখতেন তার মেয়েরা একাকিত্বে, নিঃসঙ্গতায় ভুগছে তখনই কাজ ছেড়ে মেয়েদের সময় দেন। কুমিল্লা রোডে জয়নুল আবেদীন এর তিনটা বাস আছে।
আজ প্রেমাকে এক প্রকার জোর করেই বাইরে নিয়ে গেলেন। পাশের এলাকায় নাকি মেলা বসেছে? সেখানেই নিয়ে গেলেন। প্রেমার মন ভালো হলো কিনা তিনি জানেননা, তবে প্রেমার চেহারায় বিষন্ন ভাবটা তখন ছিলোনা। সন্ধ্যার আগেই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।
নীহাকে যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়েছে। ভালো সমন্ধ হাতছাড়া করা ও উচিত নয়। জয়নুল আবেদীন হুট করেই নীহার শাশুড়ীকে খবর দিয়ে বসলেন বিয়ের ব্যবস্থা করতে। তিনিও ছেলেমেয়ে আর দেবরকে নিয়ে এসে সেদিনই বিয়ে পড়িয়ে দিলেন নাফিজ, নীহার। বিয়েতে সম্মতি দেওয়ার সময় নীরব অশ্রুতে কপোল ভিজিয়েছে নীহা। আরেকটু সময় নিলেও বাবাকে তার আশানুরূপ উত্তর দিতেই হতো। সেই রাত নাফিজ এবাড়িতেই থেকে গেলো। প্রেমা ঘর ছেড়ে বের হলোনা। মুখ লুকিয়ে কাঁদলো। নির্ঘুম রাত্রি কাটিয়ে সকালেই মায়ের হাতে হাতে কাজ করার উদ্দেশ্যে বের হলো। নাস্তার টেবিলে প্রেমা নাফিজের মুখোমুখি হয়ে গেলেও চোখ নামিয়ে রাখলো। ভাগ্যিস সে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটায়নি, নইলে নাফিজের সামনে মুখ দেখানোর সাহস পেতোনা। মানুষটা তাকে বে’হায়া ভাবতো। নীহা নাফিজের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখছে। হুট করে এরকম একটা সম্পর্ক মেনে নেওয়া যায়না। প্রেমা সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলো নাফিজ নীহাকে পানির গ্লাস, এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। দায়িত্ব জ্ঞানে ছেলেটা বেশ পটু। এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো প্রেমা। বোনটা অন্তত সুখে থাক। কাউকে না পেয়েও সুখী হওয়া যায়। এই যে তার বোনের কত খেয়াল রাখছে নাফিজ এতেই নিজেকে সুখী সুখী লাগছে।
চট্টগ্রাম থেকে বড়খালার ফোন এসেছে। মা দিব্যি হেসেখেলে কথা বলছেন। বাবা ও উপস্থিত আছেন। খালা কথা তুললেন,
-“প্রেমাটা তো কিছুদিন আমার কাছে এসেই থাকতে পারে। একা একা সারাদিন কাটাই।”
প্রেমা নাকোচ করে দিলো। খালার আরেকটি কথা শুনে কিছু পাওয়ার লো’ভ সামলাতে না পেরে বলে দিলো ‘আচ্ছা আমি যাবো।’
পরেরদিনই জয়নুল আবেদীন মেয়েকে ট্রেন এ উঠিয়ে দিলেন। কুমিল্লা থেকে ট্রেন ধরে চট্টগ্রাম এসে পৌঁছালো প্রেমা। তাকে অপেক্ষা করতে হলোনা। ট্রেন থেকে নামতেই অভীক ভাইয়া মাথার গাট্টা মেরে বলল,
-“তোর এই জামাকাপড়ের গাট্টি আমার বাইকে নিলেও বাইকের মানসম্মান যাবে। কোথায় রাখি এটা? পেছনেই রাখি। কিরে, তুই দেখি আগের চেয়ে পাটকাঠি হয়ে গিয়েছিস। তোদের গুদামের চাল কি শেষ হয়ে আসছে? এই জন্যই বুঝি খেয়েদেয়ে শরীর বানাতে আমাদের বাড়িতে আসলি?”
প্রেমা বেজায় বিরক্ত হলো অভীকের ঘ্যানর ঘ্যানর শুনে। “তাড়াতাড়ি বাইক স্টার্ট দাও তো? আমার ঘুম পাচ্ছে।”
অভীক আর রসিকতা করলোনা। বাইক থেকে পড়লে বি’পদ আছে। বাড়ি পৌঁছে গেলো। রাত হয়ে যাওয়ায় খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো প্রেমা।
সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো খালুর চিৎকার চেঁচামেচিতে।
-“কোন কু’ত্তার পয়দা এখানে পায়খানা করেছিস? একবার আমার সামনে পড়তি, তোর পায়ুপথ সেলাই করে দিতাম। ও কু’ত্তার পয়দা।”
এটা নতুন কিছুনা। চট্টগ্রামে খালার বাড়ি আসলেই কিছু বিনোদন পাওয়া যায়। খালু খুবই পরিষ্কার মানুষ। গায়েগতরে যেমন পরিষ্কার, মনের দিক থেকেও তেমনই পরিষ্কার,নরম। পায়খানা করা লোকটি যদি এসে বলে, ‘আমার বাড়িতে পায়খানার ব্যবস্থা নেই তাই আপনার বাড়ির সামনে পায়খানা করলাম।’
তখন দেখা যাবে উদারমনা খালু ছলছল চোখে চেয়ে বলে উঠবেন,’ আপনি পায়খানা করুন, একবার নয় হাজারবার পায়খানা করুন। আমি পানির ব্যবস্থাটা ও করে দেবো।’
[১]
ফুলে সজ্জিত রঙিন ঘরে ফ্যানের সাথে লা’শ হয়ে ঝুলে আছে নীহা’র স্বামী। টকটকে লাল বেনারসি গায়ে জড়িয়ে যখন বাসরঘরের উদ্দেশ্যে ঘরে পা রাখলো, ফ্যানের সাথে ঝুলে থাকা মানুষটিকে দেখে থমকে গেলো চোখজোড়া। জীবনের সমস্ত রং শুষে নিলো কোনো এক রংচোষা যন্ত্র।
নীহার ননদ ভাইকে দেখে চিৎকার চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করেছে। একটু আগেও ঘরটি ফাঁকা ছিলো। ভাবীকে নতুন সাজে বাসরঘরে দিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই পা রেখেছিলো সুফিয়া। ভাইকে অনেকক্ষণ যাবত না দেখে ভেবেছিলো কল করে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে বলবে। কিন্তু ভাই যে সারাজীবনের জন্য আসল ঘরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে?
সুফিয়ার চিৎকারে লোক জড়ো হলো। চারদিকে বিষাদময় করুণ সুর আঁ’চড়ে পড়লো। নীহা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। ক্ষণিকেই চেহারার ঔজ্জ্বল্য বর্ণ খৈ হারিয়ে মুখশ্রীতে দেখা দিয়েছে মলিনতা, বিষাদের ছাপ। ভেতরে দাপুটে ঝড়ের হাতছানি। প্রথমদিকে বিয়েতে সে নারাজ ছিলো। যতই বিয়ের প্রস্তাব আসুক না কেনো, ছেলে তার পছন্দ হয়নি। শেষ যাত্রায় কিভাবে যেনো নাহিদ’কে পছন্দ হয়ে গেলো। বিয়ের কথাবার্তা আগালো। নিপুনভাবে বোনা স্বপ্নগুলো নিয়ে পা বাড়ালো নতুন যাত্রায়। কিন্তু স্বপ্নগুলো সব তাল হারালো, এলোমেলো হয়ে পড়লো। শরীরে কালিমা লেপন হলো ‘ সে এক বিধবা নারী, অল’ক্ষী নারী।’
নাহিদের ঝুলন্ত লা’শ মাটিতে নামানো হলো।
সবাই হায়হায় করছে। নীহার শরীরের লাল শাড়ি ছাড়িয়ে সাদা শাড়ি জড়িয়ে দেওয়া হলো। টেনে’হিঁচড়ে গয়নাগাটি খুলে রাখা হচ্ছে। অথচ দুপুরেই কত রংঢং করে গয়না পড়ানো হলো তাকে, মুখ ভারী করলো নানাবিধ প্রসাধনী ব্যবহারে। কেমন গুমোট ভাব ঝেঁকে ধরেছে নীহাকে। শুষ্ক চোখজোড়ায় খরা দেখা দিয়েছে। এক ফোঁটা পানি তার কপোল স্পর্শ করছেনা। চারপাশের মানুষজন এতে আরও যেনো লাই পেলো। ছিঃ ছিঃ করছে নীহাকে নিয়ে।
-“কেমন মেয়ে গো এটা? বিয়ে করে শশুর বাড়ী আসতে না আসতেই স্বামীকে খেয়ে বসলো। এখন দেখো তার দু-চোখে একফোঁটা পানির ঠাঁই নেই।”
নীহা’র কোনো পরিবর্তন হলোনা। কোলাহল, কান্নার শব্দে মাথা ভারী হয়ে উঠলো। ঝিম ধরে যাচ্ছে প্রতিটি নিউরন। খবর পেয়ে নীহা’র বাড়ি থেকে ছুটে আসলো তার পরিবারের লোকজন। বাবা, মা, বোনকে কাছে পেয়ে দলাপাকানো কান্নারা যেনো বাঁধ ভাঙলো। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো নীহা।
ভাইয়ের কথা শুনে হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে আসলো নাফিজ। সে ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা ব্যাপারটা। ভী’ত ঢোক গিলে ছুঁয়ে দিলো নাহিদের ঘুমন্ত চোয়াল। চোখে ফেটে গড়িয়ে পড়লো একফোঁটা উষ্ণ জল। মা জ্ঞান হারিয়েছে, ছোটবোন বেতাল হয়ে পড়ে পড়ে কাঁদছে। নতুন যে মেয়েটা আজ এ বাড়িতে বউ হয়ে আসলো সে ও নিশ্চয়ই কাঁদছে? আচ্ছা কেমন কাঁদছে? খুব বেশিই নাকি কম কাঁদছে?
চারদিক তাকেই সামাল দিতে হবে।
বেশি দেরি করা ঠিক হবেনা। সকল দায়িত্ব এখন নাফিজের ঘাড়ে। লা’শ দ্রুত ঘর থেকে বের করা হলো। লা’শ ঢাকার জন্য আলমারি থেকে নতুন বিছানার চাদর বের করতে গিয়ে এক টুকরো কাগজ এসে পড়লো পায়ের কাছে। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হলো নাফিজের। একটি খোলা কাগজ। ভাঁজ করা হলে হয়তো এতটাও কৌতুহল জেগে উঠতোনা। নাহিদের মৃ’ত্যুটা কিভাবে হয়েছে ভাবতেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেনা। ঝটপট পড়ে ফেললো কাগজটি। ভাইয়ের কিছু তিক্ত অনুভূতি পড়তেই ভেতরটা মুচড়ে উঠলো নাফিজের। পড়া শেষে ভাঁজ করে খুব সন্তর্পণে নিজের পকেটে গুঁজে নিলো কাগজটি। বিছানার চাদর হাতে নিয়েই ঘর ছাড়লো।
বাইরের ঘরে মালেক চাচার মেয়ে শাহনাজকে চোখের পানি আড়াল করতে দেখা গেলো। নাফিজ সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে পকেটে গুঁজে রাখা সাদা কাগজে চোখ রাখলো। “পাপ কখনো বাপকে ও ছাড়েনা”। কিন্তু আত্ম’হ’ত্যা কোনো সমাধান নয়, এই কথাটি মানুষ জানলেও বুঝে উঠতে পারেনা।
লা’শের সকল কার্যাদি সম্পন্ন হলো। হায় আফসোস নিজ দোষেই আজ ছেলেটা কবরস্থানে ঠাঁই পেলোনা। তার স্থান হলো পুকুর পাড়ের নিচু অংশে। যত মানুষ তাকে দেখতে এসেছিলো তার কানাকড়ি মানুষকেও জানাজায় পাওয়া যায় নি। গুটিকয়েক আত্মীয়স্বজন
কে দেখা গেলো জানাযায়।
বিয়েটা যেহেতু হয়েছে তখন নীহাও ইসলামী নিয়মের উর্ধ্বে নয়। অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে হলেও অন্তত চারমাস দশদিন অপেক্ষা করতে হবে। স্বামীর বাড়িতেই স্থান নিতে হবে তাকে। এমন হৃদয় ভাঙা পরিবেশে কারোরই গলা দিয়ে খাবার নামছেনা। প্রেমা হাজার চেষ্টা করেও বোনের মুখে একদানা খাবার তুলতে পারলোনা। নাফিজ একবার পর্দার আড়াল থেকে মহিলাদের খাবারের তদারকি করে গেলো।
প্রত্যাশিত কন্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই আড়াল থেকে বের হলো প্রেমা। বিরস মুখে জবাব দিলো,
চতুর্দিকের চিন্তায় মাথাটা টনটন করে উঠলো নাফিজের। ডান হাতে কপাল চেপে ব্যথা নিবারনের চেষ্টা করলো।
প্রেমা যেনো মুহুর্তেই বুঝে গেলো মানুষটার ভেতরকার কথা। ঝট করে বলে উঠলো,
-“আপনার কি মাথাব্যথা হচ্ছে?”
-“নাহ। তোমরা সবাই খেয়ে নাও। আর উনাকে ও খাওয়ানোর চেষ্টা করো।” বলেই সরে দাঁড়ালো।
প্রেমা চেয়ে থাকলো নাফিজের যাওয়ার পথে। আপুর যখন বিয়ে ঠিক হয় তখন বরের পাশে বসে থাকা বরের ছোট ভাইকে তার মনে ধরে, ভীষণ মনে ধরে। প্রেমা নাফিজের বয়সের তুলনায় অনেকটা ছোট বলে নাফিজ ওকে তুমি করেই বলে। অবশ্য নীহা, প্রেমা দু’বোনই বয়সের তুলনায় নাফিজের ছোট। অষ্টাদশী প্রেমার একটাই আক্ষেপ,
-“ইশ! এই সুন্দর মানুষটা যেনো আমার হয়।”
অনেক বিড়ম্বনার পর মাত্র দু’লোকমা খাবার নীহাকে খাওয়ানো গেলো। রাত্রি কাটলো নিদ্রাহীন। নাফিজের মায়ের জ্ঞান ফেরার পর থেকেই থেকে থেকে ডুকরে কেঁদে উঠছেন। তার বড় ছেলে। সোনার টুকরো ছেলে এভাবে কেনো সবকিছুর মায়া ত্যাগ করলো? মায়ের মন ভুলবে কি করে? নাড়িছেঁড়া ধন কে কিভাবে ভোলা যায়? সবাই ভুলে গেলেও কোনো এক সুখের মুহূর্তে এসেও মা মুখ চেপে কাঁদবেন সন্তানের কথা ভেবে। যদি সন্তানটা থাকতো তবে আরেকটু, আরেকটু খানি সুখ ধরা দিতো।
আমাদের জীবন একটা বইয়ের মতো। বইয়ে যেমন নানা অধ্যায় থাকে। তেমনি জীবনে আর কিছু থাক বা না থাক সুখ, দুঃখ এ দুটি অধ্যায় অবশ্যই থাকে।
সুখের অধ্যায়টা যতটা সহজ দুঃখের অধ্যায় ঠিক ততটাই কঠিন। এর সময়সীমা ও যেনো অত্যধিক। অথচ সুখের মুহুর্ত গুলো স্রোতের গতিতে গড়িয়ে যায়।
[২]
জীবন থেকে হারিয়ে গেলো কিছু বিষাদময় দিন। এই দিনগুলো নাফিজের দায়িত্ব,কর্তব্যের ভেতর দিয়েই কে’টে গেলো। মা,বোন, বড় ভাইয়ের স্ত্রী সবার দায়িত্ব, সংসারের দায়িত্ব একহাতেই সামলে নিলো নাফিজ। মাঝে একদিন মায়ের হাতে নাহিদের লিখা সাদা কাগজখানা তুলে দিলো। আজ আবার ও মায়ের চোখে পানি টলমল করছে, সাথে চোখদুটো চরম আশ্চর্য হলো।
প্রেমা বাবার সাথে আজ আবার নাফিজের বাড়িতে আসলো। চারমাস সময় অতিক্রম করেছে। এখন তো আর এখানে থাকার প্রয়োজন নেই। আপুকে এখান থেকে নিয়ে যাবে তারা। হয়তো বাবা আবার ও আপুর বিয়ের তোড়জোড় শুরু করবেন। যখন শুনলো নাফিজ আজ কর্মস্থলে যায়নি তখন থেকেই প্রেমার ব্যস্ত চোখজোড়া নাফিজকে খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠলো। তার দেখা না পেয়ে নীহা’র কাছে গিয়েই বসলো। এ কয়েকমাসে নীহা’র রূপ-লাবণ্য কমে গিয়েছে। উজ্জ্বল চামড়া ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। নাওয়াখাওয়ায় শুকিয়ে কেমন কাঠ হয়ে আছে। প্রিয় বোনের এমন দুর্দশা দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো প্রেমা। নীহা মৃদু হেসে বলল,
-“এভাবে কাঁদছিস কেনো পা’গ’লি?”
প্রেমা কান্না চেপে বলল,
-” তোমার এই অবস্থা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা আপু। কি অবস্থা হয়েছে তোমার? তোমাকে চিনতে আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে।”
উত্তরে ম্লান হাসলো নীহা।
দুপুরে একসাথে খাওয়া শেষ করলো সকলে। তখনই নাফিজের দেখা পেলো প্রেমা। নাফিজ প্রেমাকে দেখে মুচকি হেসে খোঁজখবর জেনে নিলো। সবাই পাশে থাকায় আর লজ্জায় প্রেমা বেশি কথা বলতে পারলোনা। মাঝের সময়গুলোতেও কয়েকবার এসে বোনের সাথে সময় কাটিয়ে গিয়েছে প্রেমা। খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে একটু বিশ্রাম করতে ধীরস্থির হলেন প্রেমার বাবা। মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার কথা তুলতেই বেয়ানের কথা শুনে চকিতে তাকালেন জয়নুল আবেদীন।
-“আপনার কাছে আমার ছোট্ট একটা অনুরোধ। নীহা এই বাড়ির বড় বউ হয়ে আসলেও সে এই কয়দিনে আমার মেয়ের জায়গা নিয়ে নিয়েছে। তাকে ছাড়া দিন কাটাতে আমার খুব কষ্ট হবে। আমি ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি চাই আপনারা বউমাকে আমার কাছেই আমানত রাখুন। নাহিদ নেই তো কি হয়েছে? নাফিজ বিয়ে করবে নীহাকে।”
নীহাকে নিয়ে তৈরি হয়ে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বসার ঘরে আসলো প্রেমা। নীহার শাশুড়ীর কথা শুনে পা যেনো চলছেইনা। ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে। ভেতরটা জীবন্ত অনুভূতি গুলো মাটি চা’পা দেওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নাফিজ লোকটা তার বোনকে বিয়ে করবে?
নীহা ও বেশ চমকালো। মনে হচ্ছে চোখের তারা ছুটে যাচ্ছে। আম্মা এসব কি ধরনের কথাবার্তা বলছে?
জয়নুল আবেদীন নিজেকে ধাতস্থ করে বেশ গম্ভীর সুরেই শুধালেন,
-“কিন্তু নাফিজ কি বিয়ে করবে নীহাকে?”
নীহার শাশুড়ী জয়নুল আবেদীনকে আশ্বস্ত করে বললেন,
-“নাফিজ এর মতামত নিয়েই বিয়ে হবে। আপনি চিন্তা করবেননা।”
খাবার খেয়ে ঘরেই বিশ্রাম নিচ্ছিলো নাফিজ। ছোটবোন সুফিয়া এসে জানালো মা নিচে ডেকে পাঠিয়েছে। নিচে নেমে মায়ের প্রস্তাবে আশ্চর্য হলো নাফিজ। মায়ের চোখে ছেলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস দেখলো নাফিজ।
প্রেমা নাফিজের দিকে তাকিয়ে আছে তার উত্তরের আশায়। নাফিজের ভাবভঙ্গি দেখে বোঝার উপায় নেই তার উত্তর কি হতে পারে। কি বলবে লোকটা? সে কি আপুকে বিয়ে করতে রাজি হবে?
কিছুটা সময় নিয়ে নাফিজ উত্তর দিলো। তার উত্তর শুনে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো প্রেমা।
“করিডোরে আবির পাইচারি করছে আর রাত্রির জন্য আকুল হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষন পর একজন নার্স বেড়িয়ে আসলো ওটি থেকে। তার কুলে তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো এক শিশু। নার্স টি বলল পেশেন্ট এর বাসার লোক কোথায়? আবির এগিয়ে আসলো। নার্সটি বাচ্চাটিকে আবিরের কুলে দিয়ে বলল, কংগ্রাচুলেশন আপনার মেয়ে বেবি হয়েছে। আবির বলল, আমার ওয়াইফ কেমন আছে? নার্সটি বলল, তিনি সুস্থ আছেন একটু পরেই দেখা করতে পারবেন। বলে নার্স টি চলে গেলো।”
“আবির মেয়েকে একটু পর পর দেখছে আর রাত্রির কথা ভাবছে। কিছুক্ষন পর আবির রাত্রির কাছে গেলো। গিয়ে দেখলো রাত্রি শুয়ে আছে। আবির পাশে বসলো আর বলল, এখন কেমন আছো পাগলি।”
“রাত্রি মুচকি হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। ”
“আমাদের মেয়েকে দেখেছো? বলেছিলাম না একদম তোমার মতো আমার একটা প্রিন্সেস হবে! তাই হয়েছে একদম তোমার মতো।”
“তাই! তারপর রাত্রি উঠে হেলান দিয়ে বসলো। আবির রাত্রির কুলে বেবিকে দিয়ে বলল, আজ থেকে ওর নাম হলো রশ্নি খান। তারপর রাত্রির কপালে চুমু দিলো।”
—–
*এক বছর পর*
“ওইদিকে ইভার এস এস সি পরিক্ষা শেষ হলো। পাত্র পক্ষ ইভাকে আজ দেখতে এসেছিলো। তারা বলে গেছেন সামনের সপ্তাহে বিয়ে পড়াবে। ইভার পড়ালেখা শেষে উঠাই নিবে। রাতে ইভা ফয়সাল কে কল দিলো কান্না করতে করতে বলল, ফ ফয়সাল ভাইয়া আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনের শুক্রবারেই আমার বিয়ে। আমি মানা করেছি কেও আমার আমার কথা শুনিছেনা। আমি যে বিয়ে করতে চাইনা কাওকে। আমি যে আপনাকে কথা দিয়েছি আমি আপনাকে ছাড়া কাওকে বিয়ে করবোনা। আমি থাকতে পারবোনা আপনাকে ছাড়া। প্লীজ কিছু একটা করুন। আমি আপনার কথা বাসায় বলেছি আম্মু আমাকে মে’রেছে অনেক। আমাকে কোথাও বের হতে দিচ্ছেনা। ম’রে যাবো আমি। কান্না করতে থাকলো ”
“ইভা শান্ত হও রিল্যাক্স! কান্না করবেনা একদম। তুমি না আমার মিষ্টি পাখি। কেও আমাদের আলাদা করতে পারবেনা। তুমি শুধু আমার।কেও তোমাকে বিয়ে করতে পারবেনা আমি ছাড়া বুঝলে। একদম নিশ্চিন্তে থাকো পাখি। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো একদম স্বাভাবিক চলাফেরা করো। আমি আছিতো সব সমাধান করে দিবো কথা দিচ্ছি আমি।”
“সত্যি তো!”
“হুম সত্যি।”
“চলে এলো শুক্রবার আজ ইভার বিয়ে। ইভা অনবরত কান্না করে যাচ্ছে। একটু পরেই বিয়ে পড়ানো শুরু হবে। ৫ দিন ধরে ফয়সালের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেনা ইভা। ইভার ফোন নিয়ে নিয়েছে তার মা। ইভা মনে মনে বলছে, ফয়সাল আপনি কোথায়? আপনি তো বলেছিলেন আমি শুধু আপনার। আমি যে আর পারছিনা প্লীজ আমার কাছে আসুন একবার প্লীজ। ভাবছে আর কান্না করছে।”
“একটু পরে ইভা শুনতে পেলো লিভিং রুমের চিল্লা’চিল্লির শব্দ। ইভা বেরোতে চাইলে ইভার মামাতো বোনেরা তাকে আটকে রাখলো। ”
“ব্লেক জিন্স, হুয়াইট শার্ট, ব্লেক ব্লেজার পরিহিত এক লম্বা যুবক দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে বাদল আহমেদ আবির রাত আর পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এর লোকজন। হ্যাঁ যুবক টি আর কেও নই ফয়সাল। ফয়সাল জোরে ডাক দিলো ইভা বলে। ইভা কোথায় তুমি বেরিয়ে এসো। দেখো আমি এসেছি তোমার ফয়সাল ফিরে এসেছে ইভা তুমি বেরিয়ে এসো।”
“ফ ফয়সাল এসেছে আ আমার ফয়সাল এসেছে ছাড়ো তোমরা আমায়। বলেই ইভা ঝারি মেরে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। দৌড়ে লিভিং রুমে আসলো। ফয়সাল কে দেখতে পেয়ে দৌড়ে গিয়ে ফয়সাল কে জড়িয়ে ধরলো আর কান্না করতে থাকলো।”
“ফয়সাল ইভাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিতে থাকলো। এই মিষ্টি পাখি একদম কান্না করবেনা। আমি এসেছি তো দেখো। আমি কথা দিয়েছি না তোমায় যে আমি সব ঠিক করে দিবো। শান্ত হও এখুনি আমাদের বিয়ে হবে কিছুক্ষন অপেক্ষা করো। সবাই তাকিয়ে আছে তুমি উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াও পাখি। ইভা তৎক্ষনাৎ সোজা হয়ে ফয়সালের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো। বাদল আহমেদ বললেন কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করুন। ”
“একি বলছেন এসব কি হচ্ছে। আমি এ বিয়ে পড়াতে পারবোনা।”
“আপনি কি বিয়ে পড়াবেন নাকি ছেলে পক্ষের সাথে আপনাকেও শায়েস্তা করতে হবে। ফয়সাল বলল।”
“ইভা তুই যদি এই বিয়ে করিস খুব খারাপ হবে কিন্তু। তীর জন্য এ বাড়ির দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ থাকবে। ইভার বাবা বলল। আর ইভার মা কান্না করতে ব্যাস্ত।”
“আপনারা যা খুশি করে দেখান। দরজা বন্ধ করে দিলে কি ও ম’রে যাবে নাকি। ও আজ থেকে আমার অস্তিত্বের অধিকারী হয়ে থাকবে সো আপনাদের
এতো ইন্টারফেয়ার করতে হবেনা। ফয়সাল বলল।”
“খালামণি আপনারা যেহেতু সোজা কথা মানেন নি আমাদের এই ব্যবস্থা করতে হয়েছে। যদি ইভার কথা টুকু মেনে নিতেন তাহলে আজকে এতো হিস্ট্রি হতোনা। আবির বলল। ”
“আবির ঠিক বলেছে খালামণি তুমিই ভুল করেছো। রাত বলল।
“বিয়ে পরিপূর্ণ হলো। ফয়সাল রা চলে গেলো ইভাকে নিয়ে। অবশেষে তারা ফয়সালদের বাসায় পৌছায়। সেখানে গিয়ে দেখে ইভা, রাত্রি তার মেয়ে, আভা তার ছেলে, মানে আত্মীয়স্বজন সবাই উপস্থিত সেখানে। ইভা খুশি হলো তারপর আবার মন খারাপ করে ফেলল। রাত্রি এসে জিজ্ঞাসা করলো কি মন খারাপ করে আছিস কেনো? ত’লে ত’লে প্রেম করে বিয়ে করে ফেলেছিস তো আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করিস নি। এখন মুখটা এমন শুকনো করে রেখেছিস কেনো?”
“ফয়সাল রুমে ঢুকে ইভার পাশে বসলো। ইভার হাতে একটা চেক দিয়ে বলল, এটাতে দেন মোহরের টাকা পুরোটা দেওয়া আছে এটা তোমার তুমি রাখো। ”
“আমি টাকা দিয়ে কি করবো।”
“যা খুশি করে নিও এটা তোমার অধিকার বুঝলে। এটা তোমার প্রাপ্য টাকা তুমি তোমার ইচ্ছে মতো যা ইচ্ছা কিরে নিও এই টাকা দিয়ে৷”
“মুচকি হেসে ইভা চেক টা নিয়ে পাশে রেখে দিলো। আর চুপ করে মাথা নিচু করে রইলো।”
“ফয়সাল ইভাকে টেনে কুলে বসিয়ে বলল, এই মিষ্টি পাখি মন খারাপ কেনো এখনো? খুশি হওনি আমি বিয়ে করেছি বলে?”
“তা কেনো হবে। ”
“তাহলে! বাসার জন্য মন খারাপ করছে?”
“হুম।”
“ধৈর্য ধরো সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“তাই যেনো হয়।”
“ভয় পাচ্ছো তুমি? ”
“ন না।”
“তাহলে এমন কুকড়ে যাচ্ছো কেনো নাকি লজ্জা পাচ্ছো?”
“নিশ্চুপ ইভা।”
“শুনো মিষ্টি পাখি ভয় লজ্জা একদম করবেনা কেমন। আমি জানি তুমি এডাল্ট নও আমি কিছু করবোনা তোমাকে। আমি তোমার হাজবেন্ড সো এতো লজ্জা ভয় পেতে হবেনা। আর তুমি পড়াশুনা কন্টিনিউ করবে কেমন আমি আবার চলে যাবো আব্বুর সাথে ১ মাস পরে। ইইমার্জেন্সি ছুটিতে আব্বু কে নিয়ে দেশে এসেছি শুধু মাত্র তোমার জন্য পাখি। ইভার দুই গালে হাত রেখে বলল।”
“তাহলে আবার চলে যাবেন কেনো?”
“পড়াশুনা শেষ করে ভালো চাকরি করতে হবেনা! তারপর একবারে তোমাকে নিয়ে যাবো আমার কাছে। তুমিও ততোদিনে খুব ভালো করে পড়ো কেমন। আর হ্যাঁ একদম সংকোচ বোধ করবেনা আজ থেকে এটা তোমার পরিবার বুঝলে।”
“হুম ঠিক আছে। কিন্তু এখন আমার একটা জিনিস লাগবে সেটা আপনাকে দিতেই হবে না করতে পারবেন না প্রমিস করুন।”
“আচ্ছা প্রমিস করলাম বলো।”
“লিপ কিস লাগবে আমার।”
“ওরে বাবা এতো দুষ্টুমি জানো কিভাবে হুম।”
“এমনেই জানি আমি মুভিতে দেখেছি তো জি এফ বি এফ কিস করে। কিন্তু আমরা তো স্বামী স্ত্রী হয়ে গেছি এখন আমরা তো করতেই পারি তাই না।”
“যেহেতু প্রমিস করেছি দিবো। কিন্তু তুমিও কথা দাও আমাকে এখন থেকে তুমি বলে ডাকবে আর আপনি চলবেনা।”
“ওকে।”
“তারপর ফয়সাল ইভাকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ সময় ঠোঁট এ ঠোঁট চেপে রাখলো।”
“হইতো তাদের ভালোবাসা পুরোপুরি পূর্ণতা পাইনি যখন সময় হবে সেদিন না হয় তাদের ভালোবাসা ও পুরোপুরি পূর্ণতা পাবে।”
“অন্যদিকে আবির আর রাত্রি ও বেশ সুখে দিন কাটাচ্ছে। তাদের মেয়ে বড় হতে লাগলো।”
“আবির দ্রুত বেলকনি থেকে বেরিয়ে এসে বলল, কি হয়েছে আমার মা এর দেখি এদিকে এসো পাপা ফ্রেশ করিয়ে দেই।”
“রাতে রশ্নি ঘুমিয়ে পড়েছে আবির রাত্রির পাশে শুয়ে রাত্রির কানে ফিস ফিস করে বলছে, আমাদের প্রিন্সেস তো অনেক বড় হয়ে গেলো এখন তো তার জন্য আরেকজন খেলার সাথি নিয়ে আসা উচিত তাই না। ডাক্তার গিরি না হয় এখন থেকে তিনজনের উপর ফলাবে কি বলো।”
“রাত্রি মুচকি হেসে বলল, হুম আই ডু। সাথে সাথে আবির রাত্রি কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুম্বন করলো। হারিয়ে গেলো দুজনে অজানা নগরীতে। ”
“ফয়সাল আজ দেশে ফিরেছে। ইভা গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। ”
“ফয়সাল ইভার জন্য রুমে অপেক্ষা করছে। রাত ১২ টা বাজতে চলল মেয়েটা এখনো কোথায় কি করছে। এরই মধ্যে ইভা রুমে আসলো। ভীষন লজ্জা পাচ্ছে ইভা। এডাল্ট হয়েছে বুঝতে শিখেছে সব কিছু লজ্জা পাওয়ারই তো কথা।”
“ফয়সাল রাত্রিকে কুলে তুলে বলল, আজকে লজ্জা পেলে কাজ হবেনা। অনেক সাধনা করে আসছি। এই দিনটার অপেক্ষা করেছি ৪ টা বছর ধরে। তুমি লজ্জা পেলেও আজ তোমাকে ছাড়া ছাড়ি নেই। খুব তাড়াতাড়ি আমার একটা বেবি চাই দিবে আমায় সেই অধিকার। পাখি!”
“পুরো আমি টাই তো আপনার অস্তিত্বের তাহলে অধিকার তো আগেই পেয়ে গেছেন নতুন করে চাওয়ার কি আছে জনাব।”
“দেখেছো আম্মু আমার বোন টা কতো বড় হয়ে গেছে! মা হতে চলেছে! আর আমি হবো মামা তাই না আম্মু! আবির বলল।”
“হুম ঠিক বলেছিস বাবা। আবিরের মা বলল। ”
“ইয়েস আমি চাচ্চু হবো। কি মজা। ধুর! কি বলছি আমিতো ওই পুচকির ডেডি হবো হুহ! রাত ভাইয়া পর ডেডি হবে আর আমি আপন ডেডি। রায়াফ এর এই কথা শুনে লিভিং রুমে বসা সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা।”
“রাত সবার সামনে কিছু বলতে পারছেনা তাই রাত্রি বলল, ভাবি তুমি রুমে যাও ভাইয়া খুব আকুল হয়ে আছে যাও। কানে কানে বলল আভাকে।”
“রুমে আসতেই রাত আভাকে জড়িয়ে ধরলো আর বলল, ধন্যবাদ আভা। আজ আমি খুব খুশি জানো! আগে কেনো বলোনি আমাকে। তোমাকে কি বলে যে বুঝাবো আমার ভাষা নেই আমি বাবা হবো আভা ভাবতেই অবাক লাগছে। আই লাভ ইউ আমার বাবুর আম্মু। ”
“আই লাভ ইউ টু বাবুর আব্বু। আমিও অনেক খুশি আপনাকে বাবা হবার সুযোগ দিতে পেরে।”
“রাত্রি রুমে চলে গেলো। রায়াফ ও আবিরকে নিতে রাত্রির রুমে গেলো। দুষ্টু রায়াফ বাইরে থেকে দরজা আটকে দিলো নিজে বেরিয়ে। রাত্রি আবির দুজনেই ভড়কে গেলো। রাত্রি শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল তারপর আবিরকে বলল, বেলকনিতে যাই আসুন।”
“হুম চলো।”
“আবির রাত্রিকে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। রাত্রি কেপে উঠলো আর বলল, শুনছেন।”
“হুম বলো।”
“আমি কবে মা হবো!”
“আচমকা এমন কথা শুনায় আবির শকড হলো আর বলল, তোমার তো এখনো বিয়েই হয়নি। অপেক্ষা করো।”
“পারবোনা অপেক্ষা করতে। মন খারাপ করে বলল।”
“এতো ধৈর্য হারা হলে হবেনা এইচ এস সি শেষ করো তারপর বিয়ে তারপর মেডিকেল এ বা ভার্সিটি যে টাই চান্স পাও সেখানে পড়ো ১-২ বছর তারপর বেবি। ”
“এতো সময়! চোখ বড় বড় করে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল।”
“হুম মাই কুইন এতো সময় নয় খুবই অল্প সময়। দেখতে দেখতে চলে যাবে।”
“হয়েছে আর বুঝ দিতে হবেনা।”
“আবির রাত্রির নাকে নাক ঘষে বলল, এতো অভিমান করলে হয় নাকি হুম। কথায় কথায় এতো অভিমান কোথা থেকে আসে।”
“জানিনা! ছাড়ুন আমাকে। সব সময় খালি পড়া আর পড়া। খেলবোনা আপনার সাথে।”
“ঠিক আছে খেলতে হবেনা। আমিও সময় পাইনা খেলার অফিসের চাপ থাকে। মুচকি হেসে বলল আবির।”
“মজা নিচ্ছেন তাই না! ”
“আবির রাত্রিকে আর একটু কাছে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, বিয়ে করে যখন এতোগুলা ভালোবাসা দিবো তখন যায়গা করে নিতে পারবে তো!”
“না পারার কি আছে।”
“দেখা যাবে।”
“তারপর রাতে ডিনার করে আবির রা তাদের বাসায় চলে গেলো৷
” ফয়সাল ইভা কে রাতে কল করেছে দুজনে ভিডিও কলে কথা বলছে। বেশ খুশি এখন দুজনে। কল কে’টে ফয়সাল বেলকনিতে দাঁড়িয়ে অস্ফুট সুরে বলতে লাগলো খুব ভালোবেসে ফেলেছি তোমায় ইভা। কখনো ভাবিনি তোমার মায়ায় জড়িয়ে যাবো অন্য জনের মায়া কাটিয়ে। তবে ভালো হয়েছে অনেক। আমি অতীতের টান আর রাখতে চাইনা। আমি তোমাকে নিয়েই বাকিটা জীবন পার করতে চাই। অপেক্ষায় থেকো পাগলি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যাবো তোমার কাছে। ”
“চলে গেলো আরও ৫ মাস রাত্রির এক্সাম শেষ হয়ে গেছে আরও আগেই আজ তার মেডিকেলের রেজাল্ট দিবে তাই বাসার সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। আভা ৬ মাসের পেট নিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তার ও টেনশন হচ্ছে। ”
“আরে ভাবি তুমি বসে থাকো তো আমার বেবিটার কষ্ট হচ্ছে এভাবে হাঁটছো যে! রায়াফ বলল। ”
“১ ঘন্টা পর রেজাল্ট বের হলো রাত্রি ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। সবাই খুশিতে মেতে উঠলো। রাত আবির তাদের বাবা রা অফিসে খবর শুনে তারাও খুশি হলো। ”
“সন্ধ্যা বেলায় আবির আভা কে কল দিলো আর বলল, কংগ্রাচুলেশন মাই কুইন। আমি খুব খুশি হয়েছি। আ’ম প্রাউড অফ মাই কুইন। আই লাভ ইউ।”
“আই লাভ ইউ টু মাই কিং।”
“কি করছো এখন।”
“কথা বলছি আপনার সাথে।”
“হুম ভালো। তো কিছু ভাবলে কি!”
“কি ভাববো!”
“এবার কি বিয়েটা করে ফেলবো নাকি একবারে পুরো ডাক্তার হওয়ার পর করবো।”
“একবারে পুরো ডাক্তার হওয়ার পর করলেই ভালো হবে।”
“রাত্রির এমন কথায় আবির বিষম খেলো আর মনে মনে বলল, কি ব্যাপার যে মেয়ে বেবির চিন্তা করে ফেলেছিলো আর সে কিনা এখন বলছে আরও পরে বিয়ে। মাথা কি ঠিক আছে? শব্দ করে বলল, দেরিতে কেনো এখন। তুমি তো আরও আগেই করে নিতে চেয়ে ছিলে। এখন ডিসিশন চেঞ্জ কেনো?
” ইচ্ছে হয়েছে তাই। আমি আরও পড়তে চাই বিয়ে করবো না।”
“রাত্রি কি বলছো ভেবে বলছো তো!”
“একদম ভেবে বলছি। আপনার মতো লাউ কে বিয়ে করার চেয়ে কুমারি থাকা ভালো।”
“হুয়াট! লাউ! আমি লাউ কেনো হতে যাবো?
ব্রু কুচকে বলল আবির।”
“তা নইতো কি! লাউ একটা নিরামিষ আপনিও তাই। যখন আমি বলতাম বিয়ে করবো তখন আপনি শুধু পড়া পড়া করতেন। এখন আমি বলছি আমি পড়বো আমি বিয়ে করবোনা।”
“আচ্ছা তাই! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা ওয়েট করো ৫*৬ দিন। আমাকে নিরামিষ বলা লাউ এর সাথে তুলোনা করা তাইনা। আবির খান কে অপমান করছো তো একটা শোধ তুলবো দেখে নিয়ো।”
“৫ দিন পর আবিরদের বাসায় গিয়ে রাত্রি আর আবিরের বিয়ে ঠিক করা হলো। আগামী শুক্রবারই বিয়ে। আবিরের ইচ্ছে এতো ঝাক ঝমক অনুষ্ঠান হবেনা। শুধু আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দেওয়া হবে বাসায় আর কাজি বাসায় এনে বিয়ে পড়ানো হবে।”
“রাতে আবিরকে কল দিয়ে বলল রাত্রি, এই যে মি. বিয়ে ঠিক করলেন কেনো হুম। বলেছি না বিয়ে করবোনা।”
“একদম রগ বাকা কথা বলবানা কুইন। রগ সোজা করে দিবো। ”
“হুহ পারবেনই তো তাই করতে।”
“হুম জাস্ট ওয়েট আন্ড ওয়াচ। কি করি দেখে নিও। বাকা হেসে বলল আবির।”
“আগামী শুক্রবার প্লান মতোই দুজনের বিয়ে সম্পন্ন হলো রাত্রিদের বাসায়। কম বেশ সব মেহমানরা উপস্থিত ছিলো। ”
“রাত আভা আজকে আবিরদের বাসাই চলে আসছে আবিরের জোড়াজুড়ি তে।”
“বিয়ে কম রিচুয়াল মেনে হলেও আবির তাদের বাসর ঘর অনেক সুন্দর করে ডেকুরেট করিয়েছে বাইরের লোকজন দিয়ে৷ ”
“আভা রাত্রি কে আবিরের সাজানো রুমে বসিয়ে দিয়ে বলল, আমার ভাইয়া টাকে খুব ভালোবেসো পরি৷ সেই ছোট বেলা থেকে ভাইয়া আমার এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ আমার ভাইয়া স্বার্থক হলো। কখনো দুজনে ভুল বুঝা বুঝি করোনা প্লীজ। খুব ভালোবেসো দুজন দুজনকে। আর খুব তাড়াতাড়ি আমাকে ফুপি হওয়ার স্বাদ দিয়ো। বলেই আভা শব্দ করে হেসে চলে গেলো।”
“বা বা এই নিরামিষ টা দেখি খুব সুন্দর করে রুম টা সাজিয়েছে। বাহ ভালোই৷ ”
“রাত্রির ভাবনার মাঝেই আবির রুমে এসে ডোর লক করে দিলো। বিছানায় বসে পড়লো। রাত্রি সালাম দিলো। আবির উত্তর দিলো। তারপর দুজনে নামাজ পড়ে নিলো। তারপর আবার দুজনে বেডে বসে রইলো। ”
“আবির বলল, কুইন চোখ বন্ধ করো তো।”
“কেনো?”
“আবার কেনো! বন্ধ করতে বলেছি করো।”
“রাত্রি চোখ বন্ধ করলে আবির রাত্রির হাতে একটা গোল্ড রিং পড়িয়ে দিলো। আর বলল, এটা তোমার জন্য আমার সামান্য গিফট।”
“বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আবির বলল, খুব সুন্দর লাগছে তোমায়। জানো রাত্রি আজ আমি সব চেয়ে বেশি আনন্দিত। আমি এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম এতোগুলো বছর। বলেই রাত্রিকে জড়িয়ে ধরলো। রাত্রিও জড়িয়ে ধরলো। ভালোবাসি বউ।”
“আমিও ভালোবাসি।”
“রাত ৩ টা বাজে এতক্ষন দুই মানব মানবী বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তাদের ভালোবাসা উপভোগ করছিলো। আবির বলল, অনেক রাত হয়েছে ঘুমাবেনা?”
“না ঘুমাবোনা। ”
“কেনো? ”
“এইযে আপনার বুকে আছি এখানেই আমার ভালো লাগছে।”
“আচ্ছা রুমে চলো আমি তোমাকে বুকে নিয়েই ঘুমাবো।”
“শুনুন না! ”
“কি বলো।”
“ভাবি বলে গেছে তাকে যেনো ফুপির স্বাদ দেই খুব তাড়াতাড়ি। আমিও চাই ভাবির মতো মা হতে। প্লীজ না করবেন না।”
“আবির বলল, বললাম না একবারে ডাক্তার হয়ে যাও তারপর। ”
“রাত্রি আর কথা বাড়ালোনা মন খারাপ করে শুয়ে পড়লো অপরপাশ ফিরে।”
“আবির বেডে শুয়ে রাত্রিকে জড়িয়ে ধরে বলল, রাগ করে থেকোনা কুইন । খুব তাড়াতাড়ি তুমি মা হবে কিন্তু তার জন্য তোমাকে আমি আরও কিছুদিন সময় দিতে চাই। এর জন্য তুমি আপসেট থেকোনা প্লীজ।”
“আচ্ছা। বলেই আবির রাত্রি দুজনে ঘুমিয়ে পড়লো।”
“কে’টে গেলো আরও ২ মাস। আজ রাত্রিকে ঢাকা চলে যেতে হবে। আবির দের ঢাকার অফিসে আবির স্যাটেল হয়েছে। রাত্রি যেহেতু ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে সেহেতু ওকেও ঢাকা চলে যেতে হবে। ”
“আবির রাত্রি তাদের পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। আবিরের বাবা ঢাকা তে আবিরকে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে। আবির নিজের গাড়ি করেই চলল গন্তব্যে। যেতে যেতে প্রায় ৩ টা বেজে গেলো।”
“রুমের তালা খুলে দিলো দাড়োয়ান চাচা। ভিতরে ঢুকে রাত্রি অবাক হলো যে যায়গায় ধুলাবালি থাকার কথা সে যায়গায় এতো পরিপাটি করে সাজানো সব কিছু! এইযে বলছিলাম কি এতো সুন্দর করে কে সাজিয়েছে?”
“পছন্দ হয়েছে কিনা তোমার সেটা বলো।”
“হুম খুব ভালো লেগেছে।”
“ফ্ল্যাট টাই ৩ টা রুম একটা বেডরুম একটা গেস্ট রুম আর একটা লিভিং ডাইনিং একসাথে। পাশা পাশি কিচেন রুম রয়েছে। বেডরুম এ একটা ওয়াশ রুম আর একটা এটাচ ওয়াশরুম।”
“আবির বলল, যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও আমি খাবার অর্ডার করছি। বলেও আবির সোফায় বসে পড়লো। সব ফার্নিচার আগে থেকেই আনা ছিলো বিদাই আবির কে আর হয়রানি হতে হয়নি।”
“রাত্রি ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পড়ে বের হলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুলো ঝেরে শাড়িটা ঠিক ঠাক করে রুমের বাইরে গেলো। প্রতি দিনকার মতো আজও আবির এক ধ্যানে রাত্রি কে দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।”
“রাত্রি সোফায় আবিরের পাশে বসে বলল, আপনার বউ ই তো কেও নিয়ে যাবেনা সব সময় এভাবে দেখতে হবে না। রাত্রির কথায় আবিরের হুশ ফিরলো আর রাত্রিকে টেনে নিজের কুলে বসিয়ে কোমর চেপে ধরে বলল, আমার কুইন কে প্রতিদিন নতুন রূপে দেখতে আমার ভালো লাগে তাই এভাবে আমি আমার কুইন এর দিকে তাকিয়ে থাকি তাতে তোমার কি।”
“আপনার সাথে কথায় পেরে উঠবোনা আমি। উঠুন শাওয়ার নিয়ে আসুন।”
“তাহলে একটু আদর করে দাও!”
“ঢং তো খুব ভালোই শিখেছেন দেখছি। তারপর মৃদু সুরে হেসে আবিরের কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিলো। হয়েছে এবার যান।”
“আবির রাত্রিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষন বসে উঠে চলে গেলো শাওয়ার নিতে।”
“রাত্রি এই সময় টায় বেডরুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। আবির ফ্রেশ হয়ে বের হলো পড়নে একটা হালকা লেমন কালার টাওয়েল। ওখানে কি করছো কুইন।”
“রাত্রি পেছন ফিরে বলল, এইতো দেখছিলাম এখানকার পরিবেশ টা। ”
“তো কেমন লাগছে দেখতে?”
“হুম ভালো।”
“তারপর আবির একটা টাওজার আর টি-শার্ট পড়ে লিভিং রুমে গেলো কলিং বেল এর শব্দ শুনে। ডোর খুলে বিল পরিশোধ করে সিগন্যাচার করে খাবার প্যাকেট গুলো হাতে নিয়ে ডেলিভারি মেনকে ধন্যবাদ দিয়ে আবার ডোর লক করে চলে এলো ডাইনিং এ। কুইন এদিকে এসো। জোরে ডাক দিলো রাত্রিকে।”
“হুম আসছি! ”
“বসে পড়ো খেয়ে নাও। ”
“আপনি বসুন আমি সার্ভ করছি।”
“পারবে!”
“ইনশাআল্লাহ। শিখে এসেছি তো একটু একটু কাজ করে নিবো। ”
“সন্ধ্যার পর আবির রাত্রিকে বলল, কুইন রেডি হয়ে নাও তো আমরা একটু বাইরে বের হবো।”
“কোথায় যাবো!”
“চলো যাওয়া যাক কোথাও ঘুরে আসি। হানিমুনে যাওয়া হয়নি তো কি হয়েছে এই শহর টাই না হয় ঘুরবো তোমায় নিয়ে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
“গেইট এর কাছে দুজন দাঁড়িয়ে আছে। রাত্রি বলছে আমি রিক্সা কিরে ঘুরবো। ”
“গাড়ি থাকতে রিক্সা কেনো?”
“না না আপনি ড্রাইভ করলে আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারিনা। তাই আমরা রিক্সা করে ঘুরবো। ”
“আচ্ছা চলো।”
“তারপর আবির রাত্রি রিক্সায় চড়ে বসলো। রাত্রি আবিরকে পাশে বসে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে রাত্রি আঙ্গুল নাড়িয়ে এটা ওটা দেখাচ্ছে। ”
“ফুচকা ক্যাফে নেমে রাত্রিকে ফুচকা খাওয়ালো। ”
“এভাবে অনেক্ষন ঘুরাঘুরির পর বাসায় ফিরে দুজনেই টায়ার্ড।”
“পরদিন রাত্রিকে মেডিকেলে এডমিশন দেওয়া হলো। আর আবির অফিসে চলে গেলো। এইভাবেই চলতে থাকলো তাদের মিষ্টি ভালোবাসার সম্পর্ক। ”
“এক রাতে আবির সোফায় বসে অফিসের কাজ করছিলো ল্যাপটপ এ। রাত তখন ১ টা বাজে আবিরের সেই খেয়াল হারিয়েই গেলো। এতো রাত হয়ে গেছে! কুইন মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। শুয়ে পড়ি বাকি কাজ না হয় সকালে করে নিবো। কাল তো ফ্রাইডে এতো চাপ নেওয়ার ই বা কি দরকার ছিলো। বলেই আবির রুমে ঢুকলো। বিছানার দিকে তাকাতেই আবির থমকে থেকো। বেশামাল অবস্থায় রাত্রি শুয়ে আছে চিত হয়ে। উন্মুক্ত পেট, হাত পা ছড়ানো। শাড়িটা হাটুর উপরে উঠে গেছে। এতোদিন হলো বিয়ের আজ অব্দি আবির এমন ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেনি। এর আগেও তো অনেকবার এমন দেখেছে কই তার তো এমন অসস্থি হয়নি। তবে আজ কেনো সব কিছু এতো এলো মেলো লাগছে। কেনো অবাধ্য হচ্ছে চোখ দুটো। অবাধ্যই বা বলছি কেনো শি ইজ মাই ওয়াইফ ওর প্রতি সব রকমের চাওয়া পাওয়া আছে। দায় দায়িত্ব আছে তাহলে আমার ভাবনা গুলো ও এমন কেনো হচ্ছে। এসব ভাবছে আর রিতীমত ঘামছে আবির। কাপা কাপা পায়ে এগিয়ে গেলো বিছানার দিকে। হাটু গেড়ে ফ্লোর এ বসে শাড়িটা নিচে নামিয়ে দিলো হাটুর উপর থেকে। উন্মুক্ত পেট টা ঢেকে দিলো। শরীরে কাথা জড়িয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেলো বেলকনিতে । বেলকনিতে গিয়ে হাত দুটো দিয়ে চুল চেপে ধরে নিজেই নিজেকে বলতে লাগলো কন্ট্রোল ইউর সেল্ফ আবির৷ অনেক সময় পড়ে আছে এতো বেসামাল হলে হবেনা। পেছন থেকে কারও হাতের স্পর্শ পেতেই আবির চমকে পেছন ফিরে তাকালো। আর বলল, কুইন তুমি! ”
“হুম আমি। কি করছেন এখানে এতো রাতে। আর কি সব বলছেন!”
“ক কই কিছুনা তো। তুমি উঠলে যে! ঘুমাও নি! ”
“না আমি ঘুমায়নি। আপনি জেগে থেকে কাজ করছিলেন আমি কি ঘুমাতে পারি নাকি। আপনার বক্ষ-স্থল ছাড়া তো আমার ঘুম হয়না এখন জানেন না! ”
“হুম তাও ঠিক। তুমি তো আমার বক্ষ_পিঞ্জর এর পাখি।”
“এক মিনিট এক মিনিট বক্ষ_পিঞ্জর এই নাম টা আমি আগেও কোথাও শুনেছি।”
“এই রে কি বললাম এখন তো বুঝে যাবে যে ওকে মেসেজ গুলো আমি করতাম। যে গা’লি দিয়েছিলো বাবা আজীবন মনে থাকবে। মনে মনে বলল আবির।”
“হ্যাঁ! মনে পড়েছে। মেসেজ! তার মানে আপনি আমাকে মেসেজ করতেন!”
“ইয়ে মানে হ্যাঁ। ”
“ইশ! আগে বললেন না কেনো। কি ব’কা দিয়ে ফেলেছিলাম ইশ! সরি ক্ষমা করে দিবেন।”
“ইট’স ওকে। পাগলি সরি বলতে হবেনা। ঘুমাওনি যে এতোক্ষন কি তাহলে জেগেই ছিলে।”
“হুম। বলেই রাত্রি আবিরকে জড়িয়ে ধরলো।”
“রাত হয়েছে যাও ঘুমিয়ে পড়ো আমি আসছি।”
“এতো কেপে কথা বলছেন কেনো? নার্ভাস ফিল করছেন কোনো কিছু নিয়ে।”
“না যাও না কুইন ঘুমিয়ে পড়ো।”
“কিছু কি হয়েছে আপনার?”
“না কিছু হয়নি। বললাম না যাও রুমে। একটু জোরেই বলল আবির।”
“রাত্রি আবিরকে ছেড়ে মাথা টা ভয়ে নিচু করে ফেলল। পেছন ফিরে চলে যেতে লাগলো। ওমনি আবির হেচকা টান দিয়ে রাত্রিকে নিজের বুকে চেপে ধরলো। রাত্রির থুতনিতে তর্জনী আঙ্গুল টা রেখে উপরে তুলল মুখটা। আর বলল, সরি কুইন ক্ষমা করে দাও পারছিনা আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে। চেয়েও পারছিনা নিজেকে তোমার থেকে দূরে রাখতে। নাও আই নিড ইউ কুইন! বলেই রাত্রির পেটের পাশে বাম হাত চেপে ধরলো, ডান হাত ঘাড়ে গুজে দিলো আর নিজের প্রান্ত যুগল রাত্রির প্রান্তরে চেপে ধরলো। রাত্রি চোখ বন্ধ করে দুই হাতে আবিরের টি-শার্ট জোরে আকড়ে ধরলো।”
“বেশ কিছুক্ষন পর আবির কে ছেড়ে ওকে তুলে নিলো। তারপর বেডে শুইয়ে দিলো। নিজেও রাত্রির উপর শুয়ে পড়লো। রাত্রির গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো। আবিরের উষ্ণ নিঃশ্বাস এ রাত্রি চোখ বন্ধ করে আবিরের ভালোবাসা টুকু অনুভব করতে লাগলো। হারিয়ে গেলো দুজনে এক অজানা দুর্গে। এবার আর কিছু লিখতে পারবোনা আপনারা মন মতো সাজিয়ে নিয়েন। ”
“নতুন দিনের সূত্র পাত হলো। ভোরের পাখিরা জানান দিচ্ছে প্রভাত শুরু হলো বলে। শহরের অলিগলিতে মানুষের হাক ডাক আনাগোনা চলছে। রাত্রি আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকালো। নিজের দিকে তাকিয়ে রাতের কথা গুলো মনে পড়তেই আনমনে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো রাত্রির। পাশে তাকিয়ে দেখতে পেলো আবির রাত্রিকে জড়িয়ে ধরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। রাত্রি আবিরের পাশ ফিরলো। আবিরকে জড়িয়ে ধরে আবিরের চুলে হাত বুলাতে থাকলো। আবির চোখ মেলে তাকিয়ে রাত্রির মিষ্টি হাসি মাখা মুখটা দেখতে পেলো। আবির বলল, সু-প্রভাত মাই কুইন। ”
“সু-প্রভাব। ঘুম ভাঙলো তবে!”
“হুম। তুমি কখন উঠেছো? ”
“এইতো মাত্রই উঠেছি।”
“ওহ আচ্ছা।”
“হুম। আচ্ছা উঠুন অনেক বেলা হয়ে গেছে।”
“আজ ফ্রাইডে ওকে নো প্যারা সো চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকো। বলেই আবির রাত্রিকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।”
“হচ্ছে টা কি হুম। উঠুন! ”
“না উঠবোনা। প্লীজ শুয়ে থাকোনা?”
“রাত্রি আর কিছু না বলে শুয়ে রইলো কিছুক্ষন এরই মাঝে আবির আবারও ঘুমিয়ে গেলো। রাত্রি আবিরের কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে উঠে চলে গেলো বেশ কিছুক্ষন পর শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে কিচেনে চলে গেলো। নাস্তা তৈরি করে দুই মগ কফি নিয়ে আবিরের কাছে এলো। এখনো ঘুমন্ত পুড়িতে আছে সে। এই যে শুনছেন!”
“তুমি সব সময় সব কিছুতে এতো কেনো কেনো করো কেনো হুম? যা বলছি তাই করো। ”
“হুম জানি তো প্রতি দিনকার মতো আমার টা নিজে খাবেন। আর আপনার টা আমাকে দিবেন। আমি দিবোনা আজ।”
“আচ্ছা দিবেনা! তাই! ”
“হুম তাই ”
“আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে দিতে হবেনা আমিই নিয়ে নিবো সময় বুঝে। বলেই আবির নিজের কফির মগটা টি-টেবিলে রেখে ঠুস করে রাত্রির অধর জোড়া গুলো নিজের অধরে একত্রিত করলো। রাত্রি অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে গেলো। হুট করে এমন কিছু করবে রাত্রির ধারনা ছিলোনা। এই ফাকে আবির রাত্রির হাত থেকে কফির মগটা নিমিষেই হাওয়া করে দিলো। মানে নিজের হাতে নিয়ে নিলো। তারপর রাত্রিকে ছেড়ে দিয়ে ভদ্র ছেলের মতো কফিতে একের পর এক চুমুক দিতে থাকলো। ”
“হুহ রোমান্স নাকি চিটারি হুম! এমন করে তো ঠিকি আমার কফির মগটা নিয়ে নিলেন। চালাকি খুব শিখে গেছেন।”
“কি করবো বলো তো কুইন! তুমি তো সোজা পন্থায় দিতে রাজি হচ্ছিলে না তাই একটু বিপরীত পন্থা অবলম্বন করলাম আর কি। মুখ টিপে হেসে বলল।”
“হুম হুম হয়েছে ড্রামা কিং এবার শাওয়ার নিয়ে জলদি আসুন আমি নাস্তা তৈরি করে রেখে এসেছি।”
“বা’ব্বাহ! আমার কুইন তো দেখছি খুব বড় হয়ে গেছে, অনেক সংসারী হয়ে গেছো তাই না! ”
“হুম তা তো হতেই হবে।”
“আচ্ছা শুনো।”
“কি?”
“ড্রেসিং টেবিলের সেকেন্ড ড্রয়ারে পেইন কিলার ট্যাবলেট আছে এটা খেয়ে নাও।”
“কেনো? আর এটা কখনই বা আনলেন?”
“বলেছি তাই খাবে কোনো বাড়তি কথা নয় মনে থাকে যেনো। এটা রক্তিম ভাইয়ার বউ আসার সময় ঠাট্টা করে দিয়ে দিয়েছিলো। মানে মামাতো ভাই এর বউ। ”
“কিন্তু! বলেই রাত্রি থেমে গেল। রাত্রিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবির ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ”
“রাত্রি ঔষধ টা বের করে বেলকনিতে গিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলো একটা ট্যাবলেট। পেইন কিলার খাবো আমি তাই না! খাবোনা আমি মেডিসিন ফেলে দিয়েছি এবার বুঝবেন কি করে আমি খেয়েছি নাকি খায়নি। হুহ কতো আশা নিয়ে বাসা বুনতেছি আর ওনি আসছে আমাকে পেইন কিলার খাওয়াবে যত্তসব! বলেই রাত্রি ডাইনিং টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে আবিরের জন্য। দুই গালে দুই হাত রেখে দুই হাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে দুই গালে টপা টপ করছে।”
“আবির ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে ড্রেসিং টেবিল এর সামনে যেতেই দেখতে পেলো পেইন কিলার এর পাতা টা উপরে রাখা তার থেকে একটা মেডিসিন খালি। আবির মনে বলল, এতো সহজে ও এটা খেয়ে নিলো! তারপর আবির ডাইনিং এ গিয়ে বসলো। রাত্রি আড়চোখে আবিরকে দেখে মুখ টিপে হাসলো আবির সেটা খেয়াল করেনি। দুজনে নাস্তা করে সোফায় বসে রইলো। আবির ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লো অফিসের কাজ করতে। রাত্রি আবিরের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙছি কে’টে মনে মনে বলল, সারা দিন খালি কাজ আর কাজ। ভেবে পাইনা এতো কাজ আসে কোথা থেকে ওনার কাজ মার্কা হাব্বি পাইছি একটা মা’ইরি। ”
“সন্ধ্যা বেলা রাত্রিদের বাসা থেকে কল এলো আভার ডেলিভারি হয়েছে ছেলে বাবু হয়েছে। এটা শুনে রাত্রি অনেক খুশি হলো। পরক্ষনে মন টা খারাপ করে ফেলল। আবির বলল, কি হয়েছে খুশিই তো হয়েছিলে তাহলে আবার মুড অফ কেনো হয়ে গেলো?”
“জানিনা! কপট রাগ দেখিয়ে বলল রাত্রি।”
“এটা কি হলো! রেগে গিয়েছো কেনো?”
“বলতে বাধ্য নই আপনাকে। বলে লাভ আছে কোনো? লাভ নেই। সো আপনাকে সব কিছু বলার প্রশ্নই আসেনা। সরুন সামনে থেকে আর হ্যাঁ কাল সকালে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া রওনা দিবো মনে থাকে যেনো। বলেই রাত্রি ফোন টা সোফায় ঢিল মেরে ফেলে রুমে চলে গেলো।”
“যাক বাবা হটাৎ কি হলো? এতো গরম কেনো হয়ে গেলো বুঝলাম না। মেয়েরা পারেও বটে এই খুশি তো এই বেজার। রাত্রি টাও না যে কি বুঝিনা একেক সময়। কই আগে তো এমন করতে দেখিনি তবে আজ কি হলো? এগুলো ভাবতে ভাবতে আবির ফোন স্ক্রল করতে লাগলো। আবার বলল, নাহ যাই দেখে আসি কি করে রাগের তো আবার সীমা নেই। আমি লং টাইম এইসব রাগা রাগি সহ্য করতে পারবোনা। বলেই আবির রুমে গিয়ে দেখলো রাত্রি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, কি হয়েছে রাগ করেছো কেনো?”
“নিশ্চুপ রাত্রি।”
“কথা বলছোনা কেনো কুইন? তুমি রাগ করে থাকলে যে আমার ভালো লাগেনা। বড্ড অসহায় মনে হয় নিজেকে। প্লীজ কথা বলো।”
“বলবোনা কথা ছাড়ুন আমাকে।”
“কি হয়েছে সেটা তো বলো আগে।”
“এবার আর রাত্রি থাকতে পারলোনা ফুপিয়ে কেঁদে দিলো। আবিরকে সামনে ফিরে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাবির তো বেবি হয়ে গেলো আমারও একটা বেবি চাই প্লীজ। আপনি কেনো নিষেধ করেন আমি বুঝিনা। আমাইও যে চাই খুব তাড়াতাড়ি আমাদের একটা ছোট্ট মণি আসুক যে আমাদের সুখের সংসার গড়তে অনেকটা সাহায্য করবে। ”
“আবিরকে চুপ করে রাত্রি কে জড়িয়ে ধরে মৃদু সুরে বলল, ওকে ফাইন! হবে বেবি ঠিক আছে! এখন কান্না বন্ধ করো প্লীজ। আমার কুইন এর কথায় এখন শিরধার্য রইলো এখন খুশি!”
“রাত্রি চ’ট করে মাথা উঠিয়ে বলল, সত্যি!”
“হুম সত্যি।”
“রাত্রি পা উঁচু করে ঠুস করে আবিরের ঠোঁট এ চুমু দিয়ে দিলো। ”
“ওরে বাবা! এতো আদর চলে আসছে এখন! যেই না বলেছি বেবি হবে ওমনি ভালোবাসা বেড়ে গেছে তাইনা!”
“হুম। হালকা শব্দ করে হেসে বলল।”
“তাহলে তো আমি ডাবল আদর দিবো এখন। ”
“তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“তাই না!”
“হুম”
“তারপর আবির ও রাত্রিকে শক্ত করে পেচিয়ে ধরে অধর যুগল একত্রিত করে রাখলো দীর্ঘক্ষন। রাত্রিও রেসপন্স করলো। কিছু সময় পর আবির বলল, পারবে তো বেবিকে সামলাতে?”
“হুম পারবোনা কেনো! রান্না করা শিখেছি এতো কষ্ট করে। আর বেবি লালন পালন করা তেমন কি। না পারলে তো বেবির পাপা আছেই তাইনা!”
“হুম বেবির পাপা তো আছেই ওনিই করবে সব তাইনা!”
“হুম একদম ঠিক বলেছেন।”
“পাগলি মেয়ে। ”
“আচ্ছা আপনার ছেলে বেবি লাগবে নাকি মেয়ে বেবি?”
“আল্লাহ যে টাই দান করবেন সেটা তেই আমি খুশি। তবে সব চেয়ে বেশি খুশি হবো আমার কুইন এর মতো একটা প্রিন্সেস হলে। রাত্রির নাক টেনে বলল।”
“মুচকি হাসলো রাত্রি।”
“পরদিন সকালে তারা রওনা হলো। ”
“এই পিচ্চি আমাকে ডেডি বলে ডাকবে তুমি ঠিক আছে। যদি না ডাকো তাহলে তোমাকে আবার তোমার মায়ের পেটে পাঠিয়ে দিবো। আদর করবোনা একদম, চিপস, চকলেট কিনে দিবোনা। রায়াফ আভার ছেলেকে হাতের আঙুল ধরে এসব বলছে। রাত এর আম্মু আব্বু রুমা আভা রাত সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে রায়াফ এর কথায়।”
“হুহ তুমি তো পারোনি এতো বড় হয়েও ডেডি হতে। আমি পেরেছি। দেখেছো কত্ত সুন্দর আমার ছেলে। তোমার থেকে বেশি সুন্দর। এই ভাই আমার ছেলে যদি কালো হয়ে যায় আমাকে বলো কেমন ক্রিম মাখিয়ে আবার সুন্দর করে দিবো। বেশি বেশি দুধ ডিম খাওয়াবা যেনো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায় আর আমার সাথে স্কুলে যেতে পারে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে মহাশয়। আভা বলল।”
“এরই মাঝে কলিং বেল এর চাপ পড়লো আভার আম্মু আব্বু আসছে। তার ১ ঘন্টা পর রাত্রি আবির পৌঁছালো বাসায়। রাত্রি এসে ফ্রেশ হয়ে বেবিকে কুলে নিয়ে খাটে বসে পড়লো। এই পুচকি কথা বলো। তাকিয়ে দেখো কে এসেছে তোমার ফুপি চলে এসেছে তোমায় দেখতে। রাত্রি বেবিটাকে বিভিন্ন ধরনের কথা বলছে আর আবির তাকিয়ে ভাবছে মেয়েটা এতো দিওয়ানা একটা বেবির জন্য আর আমি কিনা ওকে দূরে দূরে রেখেছি। যাই হোক এখন আর তা হবেনা খুব শিঘ্রই আমাদেরও বেবি হবে কুইন। ঠিক তোমারই মতো হবে আমাদের প্রিন্সেস।”
“৭ দিন পর রাত এর ছেলের আকিকা করে নাম রাখা হলো রিয়ান। অনুষ্ঠানের কিছুদিন পর আবির রাত্রি আবার ঢাকায় ফিরে গেলো। বেশ চলছে সবার সুখ ময় জীবন। একদিন সকালে আবির অফিসে চলে যাওয়ার পর রাত্রির খুব শরীর খারাপ করতে লাগলো ওয়াশরুম এ যেতেই বমি করে দিলো। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে ভাবলো আবির কে কল করবে। না না ওনি তো মনে হয় কাজ করছেন এখন ওনাকে বিরক্ত করা ঠিক হবেনা। এগুলো ভেবে রাত্রি আর আবিরকে কল করেনি ”
“অবশেষে আবির রা রাত্রির বাসায় পৌঁছালো। আবির এর আম্মু আব্বু আভা আগে রাত্রির রুমে ঢুকলো। আবির সবার শেষে রুমে ঢুকলো রাত কে নিয়ে।”
“এই পরি এখন কেমন আছো? কেমন লাগছে শরীর এখন? আভা বলল। সব সময় রাত্রিকে আভা পরি বলেই ডাকে।”
“আলহামদুলিল্লাহ ভাবি। ”
“এতো টেনশন কিসের তোমার। আবিরের মা বলল। খাবে ঘুড়বে ফিরবে। এতো পড়াশুনা করতে হবেনা। রাত বাবা বুঝি তোমাকে এতো পড়ায় তাইনা! আবির ও বকা দেয় পড়ার জন্য! আর পড়া লেখায় করতে হবেনা তোমাকে। এই টুকু মেয়েটাকে এতো প্রেশার দেই কেও মেয়েটা একদম শুকিয়ে গেছে।”
“মামনী একদম পড়তে হবেনা তোমাকে আমরা জোর করে তোমাকে পড়াবোনা যত টুকু নিতে পারবে তত টুকুই পড়ো। কেও তোমাকে বকা দিলে আমি আছি তো আমাকে বলবে একদম ওদের বকে দিবো। আবিরের বাবা বলল।”
“রাত্রি শুধু মুচকি হাসলো। একবার ও আবিরের দিকে তাকালো না। বড্ড অভিমান হয়েছে আবিরের উপর আজ আবিরকে নিয়ে ভাবতে গিয়েই রাত্রির জ্বর এ বেহাল অবস্থা। আর এইদিকে আবির করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাত্রির দিকে আর ভাবছে। জানি অভিমান করে আছো কিন্তু কেনো? দেখা হয়নি বলে এতোদিন! কিন্তু কথা গুলো মনে মনে বলায় আবির কোনো উত্তর পেলোনা।”
“কাল রাত থেকে রায়াফ একটু ও সরেনি বোনের কাছ থেকে। এখন অব্দি এখানেই বসা। আজ রায়াফ ও আবিরের সাথে কথা বলছেনা। রায়াফ বুঝতে পেরেছে তার আপুর কেনো টেনশনে জ্বর আসলো।”
“আচ্ছা আপনারা আসুন আগে নাস্তা করে নিবেন। রাত্রির আম্মু বলল।”
“না না বেয়ান আমরা নাস্তা করেই এসেছি। আবিরের বাবা বলল।”
“বললেই হলো নাকি চলুন তো আসুন। বলেই রাত্রির আম্মু আভা আর তার মা বাবা কে নিয়ে গেলো। আবিরকে বাবা চলো এসো।”
“না আন্টি আমি কিছু খাবোনা খিদে নেই আমার। মুখ টা মলিন করে রাত্রির দিকে তাকিয়ে বলল। আবির।”
“আভা রাত্রির আম্মুকে ইশারা করে নিয়ে চলে গেলো আর বলল, ভাইয়া অভিমান হয়েছে নিশ্চয় দেখে নিও। রায়াফ আসো তুমিও নাস্তা করবে।”
“না ভাবি আমি খেয়েছি তোমরা খেয়ে নাও।”
“আচ্ছা আসো আমার পাশে বসে থেকো খেতে হবেনা বোন কে তো সারা রাত পাহাড়া দিয়েছো এবার আমাকে দিবে চলো।”
“আচ্ছা তুমি যাও আমি এক্ষুনি আসছি।”
“আচ্ছা এসো। ”
“চ্যাম্পিয়ন তোমার কি হয়েছে কথা বলছোনা কেনো আমার সাথে। আবির রায়াফ এর হাত ধরে বলল।”
“তুমি পঁচা আবির ভাইয়া। রাগ করেছি তোমার সাথে। তোমার জন্যই চিন্তা করেছে আপু রাতে তাই তো জ্বর এসেছে। আপু অসুস্থ হলো তোমার জন্য তাই আমি আর কথা বলবোনা তোমার সাথে। ”
“আচ্ছা এই কথা তাই না! আচ্ছা এই যে কান ধরে সরি বলছি। আর তোমার আপুর অসুস্থ হওয়ার কারন হবোনা৷ হ্যাপি।”
“হুম। হ্যাপি। বলেই রায়াফ চলে গেলো আভার কাছে৷ রায়াফ আভা রাত্রি দুজনকেই ভালোবাসে অনেক। রাত্রিকে একটু বেশি ভালোবাসে বোন বলে কথা। আবির এসেছে তাই ও ভদ্র ছেলের মতো আভার কাছে চলে গেলো। ”
“আবির রাত্রির পাশে বসলো। রাত্রি মুখ ঘুড়িয়ে নিলো।”
“কি হয়েছে অভিমান করেছো কেনো? আর রায়াফ যা বলে গেলো তা কি সত্যি৷ ”
“নিশ্চুপ রাত্রি।”
“কুইন চুপ করে আছো কেনো কিছু বলো। অ্যান্সার মি। ”
“জানিনা আমি। ”
“আবির রাত্রির দিকে তাকিয়ে বলল, অভিমান করেছো আমার উপর।”
“না। ”
“তাহলে কথা কথা বলছোনা কেনো?”
“এমনি। এসেছেন কেনো এখন চলে যান। কথা বলবেন না আমার সাথে। ”
“চলে যাবো! সত্যি! আচ্ছা চলে যাচ্ছি ভালো থেকো। বলেই উঠতে গেলো বসা থেকে। ওমনি রাত্রি আবিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসলো আর ফুপিয়ে কেঁদে দিলো।”
“খুব স্বার্থপর আপনি খুব! এতোদিন কেনো দেখা করেন নি কেনো কথা বলেন নি আমার সাথে। আমার খুব কষ্ট হয়েছে জানেন আপনি! ”
“আচ্ছা তাই না! এই জন্য চিন্তা করে করে জ্বর বাধিয়েছো! পাগলি! প্রমিস করছি আর এমন করবোনা। সব সময় তোমার সাথে কথা বলবো ঠিক আছে কিন্ত মাঝে মধ্যে দেখা হবে কেমন।”
“হুম সত্যি তো! ”
“হুম সত্যি। এবার কান্না বন্ধ করো আমার বাচ্চা বউ।”
“হুহ! আমিতো বাচ্চাই। ”
“পাগলি কুইন আমার। দেখেছো শরীরের অবস্থা কি করেছে। গা এখনো গরম রয়েছে। সকালে নাস্তা করেছো? ঔষধ খেয়েছো?”
“হুম। আপনি খেয়েছেন?”
“আমার বউ টা অসুস্থ আমি কি খেতে পারি ওকে না দেখে।”
“হুহ! আসছে ড্রামা করতে। ”
“আবির মুচকি হেসে বলল, ড্রামা করছিনা কুইন। যখন তোমার কথা আভা বলল তখন আমি ফ্রেশ হয়েই রেডি হয়ে চলে আসছি। খাবার যে মানুষের খেতে হয় এমন টা আমি ভুলেই গেছিলাম। তখন শুধু মনে হয়েছে যে আমি তোমাকে দেখলেই শান্তি পাবো।”
“তার মানে এখনো খান নি। আম্মু ডেকে গেলো গেলেন না কেনো।”
“আমার কুইন এর সাথে কথা বলবো তাই যায়নি। আর আমার খিদেও নেই।”
“আভা রুমে আসলো। এসে দেখলো দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে। আভা উহুম উহুম করলো।তারপর রাত্রি সরে যেতে চাইলো কিন্তু আবির সরতে দিলোনা। আভা বলল, থাক থাক সমস্যা নেই পরি থাকো না আমার ভাইয়ার বুকে আমার কোনো সমস্যা নেই এতো লজ্জা পেতে হবেনা। বলো কি জন্য ডেকেছো।”
“রাত্রি আরও লজ্জা পেয়ে গেলো। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, তোমার ভাইয়ার জন্য নাস্তা দিয়ে যাও।”
“আমি খাবোনা বললাম তো! ”
“আপনি খাবেন আপনার বউ ও খাবে আপনার বাচ্চা রা ও খাবে।”
“আচ্ছা ভাইয়া বসো এখানেই তুমি আমি নিয়ে আসছি। নইলে পরি আবার রাগ করবে। বলেই আভা চলে গেলো দরজা আটকে।”
“এই এই আপনি আমাকে ছাড়লেন না কেনো?”
“এমনি।”
“ভাবি কি ভাববে বলুন তো।”
“কিছুনা। শুনলেনা কি বলে গেলো। আমার বোন বলে কথা। ”
“ইশ এখন আর আপনার বোন মানিনা। এখন ও আমাদের ভাবি। ”
“আচ্ছা ঠিক আছে তোমাদেরই সব। তাও উত্তেজিত হয়োনা নইলে আবার অসুস্থ হয়ে যাবে।”
“আভা কিছুক্ষন পর খাবার নিয়ে হাজির হলো। চলে গেলো খাবার ট্রে টি-টেবিল এর উপর রেখে। রাত্রি আবিরকে নিজে খাইয়ে দিলো। আবির রাত্রিকে খেতে বলল কিন্তু রাত্রি আগে খেয়েছে বিদায় আর কিছু খায়নি।”
“খাওয়া শেষে আবির চুপ করে বসে রইলো তারপর বলল, ফোন কোথায় তোমার দাও।”
“বালিশের নিচ থেকে ফোন টা বের করে দিলো রাত্রি।”
“একদম মাথার কাছে ফোন রাখবেনা লাস্ট এন্ড ফার্স্ট টাইম বলে দিলাম। তারপর আবির তার একটা ফেবু একাউন্ট লগ ইন করে দিলো রাত্রির ফোন এ।আর বলল, এই নাও মেসেঞ্জার এ কথা বলবো সব সময় ঠিক আছে। ”
“রাত্রি খুশিতে ঠোঁট এ হাসি ফুটালো আর বলল হুম ঠিক আছে।”
“আরও কিছুক্ষন থেকে আবির আর তার মা বাবা চলে গেলো আভা আর গেলোনা।”
“অন্যদিকে আজও ফয়সাল ইভা একসাথে পুকুরপাড় বসে আছে। ইভা বলল, ভাইয়া আপনার নাম্বার টা দিবেন যদি খুব বেশি ক্ষতি না হয়।”
“ফয়সাল কিছুক্ষন চুপ থেকে তারপর নাম্বার টা দিয়ে দিলো। যে যার বাসায় চলে গেলো তারপর।”
“এভাবে শেষ পরিক্ষা চলে এলো ফয়সালের শেষ পরিক্ষার দিন ইভা বায়না করলো ভাইয়া চলুন না আমরা কোথাও ঘুরে আসি প্লীজ প্লীজ।”
“আচ্ছা চলো। তারপর ইভা ফয়সালের এক্সাম ফাইল টা তার হাতে নিয়ে নিলো। দুজনে রিক্সা করে কাছেই একটা পার্কে গেলো। এই ১ মাসে দুজনের মধ্যে অনেক ভাব জমে গেছে। পার্কে গিয়ে ইভা ফয়সালের হাত ধরেই হাঁটা হাঁটি করেছে। ফয়সাল যদিও প্রথম প্রথম একটু সংকোচ বোধ করতো কিন্তু এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে ইভার সাথে মিশতে। ফয়সাল ভাইয়া আমাকে ওই বেলুন গুলো এনে দিবেন। ”
“হুম দিচ্ছি বসো তুমি এখানে আমি নিয়ে আসছি।”
“আচ্ছা।”
“ফয়সাল অনেক গুলো লাভ বেলুন এনে দিলো ইভাকে। ইভা খুশি হয়ে গেলো ভীষণ আর নাচতে নাচতে ফয়সাল কে জড়িয়ে ধরলো। ফয়সাল বেচারা ভয় পেয়ে গেলো আর দেখতে পেলো চারদিকে লোকজন তাকিয়ে আছে। ফয়সাল বলল, ইভা ছাড়ো লোকজন দেখছে।”
“দেখুক তাতে আমার কি। ”
“উফ! বুঝার চেষ্টা করো ইভা সিনক্রিয়েট হয়ে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে ছাড়ো।”
“ইভা ঝারি মেরে সরে দাড়ালো আর বলল, লোকজনের এতো সমস্যা কিসের বুঝিনা বাবা। বলেই ফয়সালের হাত ধরে আবার হাঁটা শুরু করলো। তারপর দুজনে লাঞ্চ করতে গেলো রেস্টুরেন্টে। যেহেতু আজ ফয়সালের প্রাক্টিকেল এক্সাম ছিলো তাড়াতাড়ি এক্সাম শেষ হওয়ায় এই সময় টা ঘুরে আসলো। দুপুর টাইম বিদায় রেস্টুরেন্টে আসলো।খাবার সময় ইভা ফয়সাল কে খাইয়ে দিয়েছে নিজ হাতে৷ কিন্তু ফয়সাল যেনো অস্বস্তি তে পড়ে যাচ্ছে বার বার৷ রেস্টুরেন্টের ওয়েটার গুলো ও তাকিয়ে মুচকি হাসছে৷ ফয়সাল লজ্জা পেলো।আর বলল, ইভা নিজের খাওয়ায় মন দাও আমাকে খাইয়ে দিতে হবেনা। বেচারা ফয়সাল ইভা কে জোরে ধমক ও দিতে পারেনা বাচ্চাদের মতো কান্না করে দেয় ইভা। বড় হচ্ছে ঠিকি কিন্তু ইভা এখনো সমাজ টাকে ভালো করে বুঝতে শিখেনি। এসব ভাবছে আর খাচ্ছে ফয়সাল।”
“ভাইয়া বিল টা আমি পরিশোধ করবো ঠিক আছে। বলতে দেরি হলো আর ফয়সাল ইভার দিকে রক্ত চোখে তাকাতে দেরি হলোনা। ইভা চুপ করে গেলো।”
“বিল মিটিয়ে বকশিস দিয়ে ফয়সাল বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে ইভাকে নিয়ে। ৩ টা বেজে গেছে তাই ইভা আর দেরি করলোনা ফয়সাল কে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। ফয়সাল মনে মনে ভাবছে, মেয়েটা একদম চঞ্চল আর ভালো অনেক৷ সমস্যা একটাই বুঝ কম৷ মাইন্ড নেস বলতে কিছু নেই। পাগলি একটা। তারপর ফয়সাল ও চলে গেলো বাসায়। ”
“আবির আর রাত্রির সময় ও এখন ভালো যাচ্ছে। যখন সময় পাই আবির রাতে তখন ই রাত্রির সাথে কথা বলে। ”
“কে’টে গেলো আরও ১ মাস। ফয়সালের রেজাল্ট বের হয়েছে 4.95 পেয়েছে ফয়সাল। বাসার সবাই খুব খুশি। তবে ফয়সালের একটু মন খারাপ এ+ না আসায়। ফয়সালের আম্মু আবিরদের বাসায় এসে মিষ্টি দিয়ে গেছেন। আভা ও শুনলো খুশির খবর রাত্রিকে ও বলল, রাত্রি খুশি হলো। এভাবেই আজকের দিন টা কে’টে গেলো ফয়সালের বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা ও দিলো। দিন শেষে ভুলেই গেলো ইভার কথা। আজ একবার ও কথা বলেনি ইভার সাথে। ইভা অপেক্ষায় ছিলো যে আজ ফয়সালের রেজাল্ট দিবে ফয়সাল ফোন করে ইভাকে খবর টা জানাবে। কিন্তু না! ফয়সাল ফোন করেনি। সেই জন্য ইভা আজ না খেয়েই রাতে শুয়ে পড়েছে।”
“ফয়সাল হাঁটছে এক পথ ধরে রাস্তার পাশেই একটা চিরকুট দেখতে পেলো সেখানে লিখা, ফয়সাল ভাইয়া আপনি একটু পাহাড়ের দিকে আসুন না কথা আছে। ফয়সাল পাহাড়ের দিকে গেলো গিয়ে দেখলো ইভা পাহাড়ের একদম কিনারে দাঁড়িয়ে আছে আর বলছে, ফয়সাল ভাইয়া আপনি আসছেন ! আমিতো মনে করেছিলাম আপনি আসবেননা। ভাইয়া আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই প্লীজ শুনবেন মন দিয়ে। ভাইয়া আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনি কি আমায় ভালোবাসবেন ভাইয়া। উত্তর দিন। ফয়সাল উত্তর দিলো, দেখো ইভা তুমি ছোট মানুষ কিই বা বুঝো এমন পাগলামি করোনা। এভাবে ভালোবাসা হয়না। ইভা বলল, তার মানে আপনার উত্তর হলো ‘না’ ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি আপনার থেকে অনেক দূরে আর আসবোনা ভালোবাসা চাইতে৷ ভালো থাকবেন ভাইয়া। বলেই ইভা পাহাড় থেকে লাফ দিলো। ফয়সাল চিৎকার করে উঠলো ইভা! বলে। ফয়সাল ঘুম থেকে উঠে বসলো। রিতীমত ঘামছে। পাশে থাকা ওয়াটার বটল টা নিয়ে ঢক ঢক পানি খেয়ে নিলো সবটা। ফয়সাল ভাবতে লাগল, এটা কি তাহলে স্বপ্ন ছিলো! ইভা ঠিক আছে তো! মেয়েটার সাথে আজ আমি কথা বলিনি। রাগ করেনি তো আবার। ভেবেই ফোন টা হাতে নিয়ে দেখলো ২ টা বাজে রাত। না এখন ফোন করা যাবেনা এখন হইতো ঘুমাচ্ছে৷ সকালেই না হয় ফোন করবো। ভেবেই আবার শুয়ে পড়লো কিন্তু ঘুম আসলোনা ফয়সালের। ”
“সকালে উঠেই ফয়সাল ইভার নাম্বারে কল দিলো ফোন বন্ধ। ফয়সাল নাস্তা করে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। উদ্দেশ্যে ইভার স্কুল। টিফিন সময় পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলো। কিন্তু ইভার আসার নাম নেই মাঠে। অবশেষে দেখতে পেলো ইভা একটা ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ফয়সালের মেজাজ টা বিগড়ে গেলো মুহূর্তের মধ্যেই। জোরে জোরে কদম ফেলে এগিয়ে গেলো ইভার দিকে। ইভার হাত টা শক্ত করে ধরে বলল, কোথায় ছিলে এতক্ষন আর এখানে কি করছো? ও কে হয় তোমার? ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলল। ”
“আমার ক্লাস মেট ভাইয়া। ইভার সোজা উত্তর।”
“আচ্ছা চলো এখান থেকে। তারপর জোরপূর্বক নিয়ে গেলো ইভাকে। পুকুরপাড় টায় বসে পড়লো। ফয়সাল বলল, ফোন অফ কেনো তোমার? আর কাল আমাকে ফোন করোনি কেনো?”
“ইভা চুপ করে রইলো।”
“কি হলো চুপ করে আছো কেনো? উত্তর দাও। ”
“আপনার কালকে রেজাল্ট বেরিয়েছে অনেক অপেক্ষা করেছিলাম যে আপনি নিজ ইচ্ছেতে আমাকে ফোন করে জানাবেন রেজাল্ট এর কথা। কিন্তু আপনি ফোন করেননি। আমি ভেবেছি হইতো ফ্রেন্ডস দের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন তাই কল করিনি। কিন্তু যখন রাতেও কল দিলেন না আমি আপনার উপর রাগ করে ফোন টা ওয়াশ রুমের বালতি তে চুবিয়ে রেখেছি। যাতে আম্মু বকা দিতে না পারে৷ ভাংলে তো আম্মু বকা দিবে। তাই আম্মুকে সকালে বলেছি যে ফোন টা হাত ফসকে বালতিতে পড়ে গেছে। আম্মু বলছে যে, ফোন নিয়ে বাত রুমে কি করিস। আমি বলেছি, লাইট টা ডিস্টার্ব করছিলো ওয়াশ রুমের তাই তো মোবাইল টা নিয়ে গেছিলাম। হুম আরেকটা কাজ করেছি সাথে ওয়াশরুমের লাইট টা নষ্ট করে ফেলেছি। ”
” ফয়সাল এর যেনো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। ”
“আপনি হাসছেন কেনো? ব্রু কুচকে বলল ইভা।”
“এতো কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছো আমি ফোন না দেওয়ায়! এতো রাগ কেনো হুম। আর আমি তোমার কে হয় যে আমার সাথে কথা বলতেই হবে।”
“ইভার মুখটা চুপসে গেলো। ইভা বলল, আমার জামাই হন! তাইতো এতো রাগ করে এইসব কান্ড ঘটিয়েছি।”
“কীহ! আমি তোমার হাজবেন্ড! কবে বিয়ে করলাম তোমায়।”
“তা তো জানিনা!”
“তাহলে বললে কেনো? ”
“ইচ্ছে হয়েছে তাই বলেছি।”
“আচ্ছা ভালো করেছো। এখন শুনো আমি লন্ডন চলে যাবো আব্বুর কাছে। ওখানে আমি পড়াশুনা করবো। তোমার সাথে হইতো আর দেখা হবেনা। তবে মাঝে মাঝে কথা হবে ইনশাআল্লাহ। ”
“ইভা চমকে উঠে ফয়সালের দিকে টলমল চোখে তাকালো।”
“এ’কি ইভা তোমার চোখে পানি কেনো?”
“ইভা কিছু না বলে ফয়সাল কে জড়িয়ে ধরে বলল, কোথাও যাবেন না আপনি। আমার সাথে সব সময় দেখা করবেন প্লীজ। আমি ভালো থাকবোনা আপনার সাথে দেখা করা ছাড়া।”
“ফয়সাল জানতো ইভা এমন কিছু করবে তাই ফয়সাল রিয়েক্ট করেনি এভাবে জড়িয়ে ধরাতে। ফয়সাল ইভাকে সোজা করে বলল, কেনো ভালো থাকবেনা শুনি। ”
“জানিনা আমি।”
“না জানলে হবেনা বলতেই হবে বলো।”
“হইতো বুঝতাম না আকর্ষন কি। কিন্তু আপনার সাথে মিশার পর আমি সেটা বুঝেছি। এটাও বুঝেছি যে সব কিছু আবেগ নয় অনেক কিছু সত্যি ও হয়। আর তাই আমার কথা হলো আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি ভাইয়া। আমি আপনাকে ছেড়ে দূরে থাকতে পারবোনা। প্লীজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না।”
“ফয়সাল ভড়কে গেলো। চোখ গুলো গুল গুল হয়ে গেলো। ফয়সালের স্বপ্ন যে এভাবে সত্যি হয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি। স্বপ্নের ধরন অনুযায়ী ফয়সাল ভয় পেয়ে বলল, আচ্ছা আমাকে ভালোবাসো ভালো কথা। তুমি কি করতে পারবে আমার জন্য।”
“যা বলবেন তাই করতে পারবো। ”
“আচ্ছা আমার জন্য কতোদিন অপেক্ষা করতে পারবে? দেখো এখন তো আর তোমাকে বিয়ে করতে পারবোনা। আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। ইনকাম করতে হবে। তাহলেই না তোমাকে বিয়ে করতে পারবো। তার জন্য তো অনেক সময় প্রয়োজন। তুমি কি সেই সময় টা পর্যন্ত আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে?”
“হুম পারবো। কেনো পারবোনা। অনেক দিন অপেক্ষা করতে পারবো।”
“পারবে আরও ৫ বছর অপেক্ষা করতে?”
“এতোগুলো বছর! ”
“হুম।”
“পারবো ইনশাআল্লাহ। ”
“যদি মোহে পড়া ভালোবাসা হয় তাহলে তো ভুলে যাবে।”
“নাহ ভুলবোনা। দাঁড়ান ১ মিনিট। বলেই ইভা দৌড়ে পুকুরপাড় এর কড়ুই গাছ টার কাছে গেলো সেখানে ইটের কণা দিয়ে আজকের তারিখ টা লিখলো সাথে এফ লিখলো। (10-10-2022-F)। ফয়সাল এর দিকে তাকিয়ে বলল, এই লেখা টা এখানে থাকবে আমি মনে করি। যদি গাছ টা কা’টা পড়ে যায় তাহলে ও মনে থাকবে আশা করি ভুলবোনা আপনাকে। ৫ বছর পর এই যায়গা টায় আমি আবার দেখা করবো আপনার সাথে আসবেন তো!”
“হুম ইনশাআল্লাহ আসবো। ”
“আবারও ইভা ফয়সাল কে জড়িয়ে বলল, আই লাভ ইউ ভাইয়া।”
“ফয়সাল ও এখন জড়িয়ে ধরলো আর বলল, নো ভাইয়া। লাভ ইউ টু পাগলি। অপেক্ষায় থেকো আমার আমি ফিরে আসবো তোমার কাছে প্রমিস করছি।
আজকের সারাদিন ইভা আর ফয়সাল একসাথে কাটিয়েছে। ”
“পরদিন সকালের ফ্লাইটে ফয়সাল লন্ডন পাড়ি জমায়।”
“৫ মাস পেড়িয়ে গেলো একদিন আভা দুপুরে খাবার খাচ্ছিলো হটাৎ তার বমি পেলো। ওয়াশ রুমে গিয়ে বমি করে দিলো। রাত এর আম্মু টেনশনে পড়ে গেলেন। এই সময় কেও বাসায় নেই। রুমা আভা আর রাত এর আম্মু বাসায়। রাত এর আম্মু সি এনজি তে করে আভা কে নিয়ে হসপিটালে চলে গেলো। রিপোর্ট আসলে জানতে পারলো আভা প্রেগন্যান্ট। রাত এর আম্মু ভীষণ খুশি হলো। অবশেষে বাসায় ফিরলো। কিন্তু কাউকে কিছু বলেনি। বাসায় সবাই একসাথে হলেই বলবে। ”
“সন্ধ্যা বেলা রাত দের বাসায় আভার আম্মু আব্বু আর আবিরকে ইনভাইট করেছেন রাত এর আম্মু। তারা সবাই বাসায় এলো। লিভিং রুমে রুমা সবাইকে নাস্তা দিয়ে গেলো। নাস্তা খেতে খেতে রাত এর আম্মু সবাইকে বলল যে, আভা প্রেগন্যান্ট। সবাই যেনো আকাশ থেকে পড়লো এমন একটা সংবাদ শুনে। ”