Monday, July 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1029



শেষ রাত পর্ব-১৮+১৯+২০

0

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৮
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

গুমোট আকাশের নিচে কোলাহলপূর্ণ ঢাকা শহরটা যেন আজ বেশ থমথমে। এই আলো তো এই অন্ধকার৷ কিছুক্ষন আগেই আকাশ ভেঙে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হলো। ঝড়ো হাওয়ার তান্ডবে এলোমেলো হলো চারপাশ। ঘন্টাখানেকের তীব্র বৃষ্টির শেষে ক্লান্ত হয়েই গতি কমিয়ে পরিবর্তিত হলো মৃদু ঠান্ডা বাতাস আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে। আমি দরজা খুলে বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। পা বাড়ালাম বারান্দার ভেজা মেঝেতে। ধ্রুবর বেলি গাছ গুলোর বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখেই মন খারাপ হলো। ডাল পালা একদম নেতিয়ে গেছে। এতদিনের যত্নে বেলি গাছে যে কয়টা কলি এসেছিল তার প্রায় বেশির ভাগই ঝড়ে পরেছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বেলি গাছগুলোকে ঠিক করে দিতেই কলিং বেল ভেজে উঠলো। মনি মা তুলতুলের গায়ে মালিশ করে দিচ্ছে। তাই আমি বারান্দা থেকে পা টিপে টিপে রুমে আসলাম। ওড়নায় ভেজা হাত মুছে ছুটে চললাম দরজা খুলতে। দরজা খোলা মাত্রই ধ্রুবকে দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়তে দেখলাম। শার্টের কিছু কিছু জায়গা ভেজা। মুখে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোটা। আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে শার্টের হাতায় মুখ মুছলেন তিনি। ভেতরে আসতে আসতে উচ্চস্বরে বললেন-

‘আমার তুলতুল পাখি কোথায়?’

আমি দরজা লাগিয়ে ওনার পেছন পেছন এসে গাঢ় স্বরে বললাম-

‘সব সময় আমার তুলতুল পাখি, আমার মেয়ে এসব বলেন কেন?’

ধ্রুব সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসলেন বেশ আরাম করে। আমার দিকে চেয়ে ভ্রু জোড়া নাচিয়ে পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন-

‘আমার মেয়েকে আমার মেয়ে বলবো না তাহলে কার মেয়ে বলবো?’

আমি কন্ঠে ক্ষীণ বিরক্তি ভাব নিয়ে বললাম-

‘অদ্ভুত তো! তুলতুল কি আপনার একার মেয়ে নাকি যে সব সময় আমার আমার করতে হবে!’

‘অবশ্যই আমার মেয়ে। তাই আমার মেয়ে, আমার তুলতুল এসবই বলবো। তাতে আপনার কি?’

ধ্রুবর ত্যাড়া কথায় আমার মেজাজ খারাপ হলো। অসহ্যকর! মেয়েদের মতো কিভাবে গায়ে পরে ঝগড়া করছেন! আমি ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই মনি মা তুলতুলকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসলেন। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘কি নিয়ে এত তর্ক করছিস!’

মনি মা ধ্রুবর পাশে বসতেই ধ্রুব তুলতুলকে নিজের কোলে নিয়ে নিলেন। তুলতুলের গালে চুমু দিয়ে আড় চোখের আমার দিকে চেয়ে বললেন-

‘বুঝলে তো মা! আমার তুলতুলকে এখন আমার বললেও কিছু মানুষের শরীর ছ্যাত করে জ্বলে ওঠে।’

‘আপনার মেয়ে আপনার মেয়ে কি? তুলতুলকে কি আপনি একা জন্ম দিয়েছেন না-কি! তুলতুল আমারও মেয়ে।’

ধ্রুবর কথায় বিরক্ত হয়েই মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেললাম। তৎক্ষনাৎ নিজের কথাতেই লজ্জায় চুপসে গেলাম। মনি মা বুঝলেন আমার অস্বস্তি বোধ তাই তিনি কথা পালটানোর জন্য বললেন-

‘তোরা থাম তো বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করিস না। তুলতুল নিজেই বলবে ও কার মেয়ে।’

আমি মাথা তুলে তাকালাম তাদের দিকে। ধ্রুব মিটমিট করে হাসছেন। ওনার হাসিতে আমি আবারও লজ্জা পেলাম। সঙ্গে সঙ্গেই চোখ সরিয়ে নিলাম। মনি মা তুলতুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য হাতে তালি দিয়ে আদুরে গলায় বললেন-

‘দিদা বলো তো তুমি কার মেয়ে? মাম্মা’র নাকি পাপ্পা’র!’

তুলতুল কি বুঝলো জানি না। তবে সে খিলখিল করে হেসে ফেলল। কিন্তু কিছু বলল না। খানিকক্ষণ বাদেই তুলতুল ধ্রুবর কোল থেকে নেমে পুরো ড্রয়িং রুম ঘুরে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে মাম্মা মাম্মা বলে ডাকতে লাগল। আমি তুলতুলকে কোলে নিয়েই বিশ্বজয়ী হাসি দিলাম। ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললাম-

‘দেখলেন তো তুলতুল কার মেয়ে? তাই এখন থেকে আমার আমার করবেন না। হয় আমাদের মেয়ে বলবেন নাহলে কিছুই বলতে পারবেন না।’

ধ্রুব তার ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সোফা থেকে উঠে শার্ট ঝাড়া দিয়ে মিনমিনিয়ে বললেন-

‘পুরো বাড়িটাই আমার বিরুদ্ধে চলে গেছে। প্রতিটা মানুষ আমার বিপক্ষে স্বরযন্ত্র করছে। সবগুলো রাজাকার। আর এই যে তুলতুল পাখি আপনি আবার আমার কাছে কিছু চেয়ে আবদার করলে তখন বোঝাবো এই বিরোধী দল কি কি করতে পারে।’

ধ্রুব তুলতুলের গালে টান দিয়েই রুম চলে গেলেন। মনি মা আর আমি সশব্দে হেসে ফেললাম ধ্রুবর কথা শুনে। তুলতুল আমাদের হাসি দেখে বেশ উৎসাহ পেল। আমার কোল থেকে নেমে চোখ বন্ধ করে খিলখিল করে হাসতে হাসতে লাগল। আধো আধো বুলিতে অস্ফুটস্বরে বলল-

‘লাজাকার.. লাজাকার…’

আমি আর মনি মা দুজনেই বিস্মিত হয়ে তুলতুলকে দেখতে লাগলাম৷ তুলতুল হাতে তালিয়ে লাফাচ্ছে আর ভীষণ আগ্রহ নিয়ে লাজাকার লাজাকার বলছে। তাল হারিয়ে সামনের দিকে উবু হয়ে পরে যাচ্ছে আবারও উঠে সেই একই কথা বলে যাচ্ছে। হয়তো শব্দটা তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমি বিরক্তি নিয়ে মনি মা’কে বললাম-

‘দেখেছো মনি মা তোমার ছেলে এসব কি শিখিয়ে গেল?’

মনি মা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে ক্ষীণ স্বরে বললেন-

‘তোরা সবাই আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বি।’

আব্বু আজ সকালেই ব্যবসায়ের কাজে সিলেট গেছে। তাই মনি মা তুলতুলকে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে। তুলতুলকে মনি মা’র রুমে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আসতে আসতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল। রুমে ডুকেই ধ্রুবকে শুয়ে শুয়ে ফোন টিপতে দেখলাম। আমি সেদিকে এক ঝলক তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে আপনমনে চুল আঁচড়াতে লাগলাম। চুল গুলো হাত খোপা করে বিছানার কাছে আসতেই ধ্রুব বললেন-

‘আসুন তুলতুলের আম্মু।’

ধ্রুব বিছানায় শুয়েই এক হাত বাড়িয়ে চোখের ইশারায় আমাকে তার বুকে আসতে বললেন। বাচ্চাদের যেমন করে নিজের কাছে আসার জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয় ঠিক সেভাবেই। আমার কপাল কুচকে এলো। সরু চোখে ওনার দিকে চেয়ে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম-

‘আসুন মানে? কোথায় আসবো?’

‘কোথায় আবার আমার বুকে।’

ধ্রুবর সহজ সরল জবাবে আমার চাহনি আরও তীক্ষ্ণ হলো। বললাম-

‘বুকে কেন?!

ধ্রুব ভ্রুক্ষেপহীন গলায় বললেন-

‘আপনি তো কান্না করার জন্য আর ঘুমানোর জন্য আমার বুক শেয়ারে নিয়েছেন তাইনা! তাহলে আসুন ঘুমানোর সময় হয়েছে তো।’

‘আপনি আবারও আমার সাথে মজা করছেন?’

ধ্রুব অমায়িক ভঙ্গিতে হেসে বললেন-

‘আপনার সাথে কি আমার মজা করার সম্পর্ক নাকি যে মজা করবো? আসুন আসুন বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যান। অনেক রাত হয়ে গেছে।’

আমি লাইট অফ করে বিছানার একপাশে শুয়ে তিক্ত গলায় বললাম-

‘সারাদিন অনেক সময় পাবেন আমাকে নিয়ে মজা করার জন্য। তাই রাত-বিরেতে এসব ফাজলামো না করে ঘুমান।’

‘ভালো কথা বললেই দোষ।’

ধ্রুব উদাসীন গলায় কথাটা বলে অন্য পাশ ফিরে শুলেন। আমি ওনার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে ধ্রুবর বুকে আবিষ্কার করলাম। ওনার বুকে কিভাবে আসলাম! কখন আসলাম! তা আমি কিছুই জানি না। ঘুমের মধ্যে বেশি নাড়াচাড়া করার অভ্যাস কিংবা কারও গায়ে হাত পা তুলে দেওয়ার অভ্যাসও আমার নেই। তাহলে কিভাবে ওনার কাছে এলাম? তাহলে কি ধ্রুব এনেছেন? ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্কে এর কোনো উত্তর পেলাম মা। আর কোনো কিছু না ভেবে খুব সাবধানে ওনার হাত ছড়িয়ে উঠে বসলাম। সরু চোখে তাকিয়ে পরোখ করতে লাগলাম ওনাকে। উনি কি ঘুমের মধ্যে আমাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন? আমি নিম্ন স্বরে ওনাকে ডাকলাম। কিন্তু তিনি উঠলেন না। বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। আমি ওনার ঘুমের ডিস্টার্ব না করে উঠে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় আসতেই বেলি গাছে ফুটন্ত বেলি ফুল দেখে আনন্দে মন ভরে গেল। বৃষ্টি ভেজা স্নিগ্ধ শুভ্র রঙের ফুল। মুগ্ধতায় আমার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো। আবারও ফিরে আসলাম রুমে। ধ্রুবর হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললাম-

‘তুলতুলের আব্বু উঠুন। আপনার বেলি গাছে ফুল ফুটেছে। আসুন না দেখে যান।’

বেশ কিছুক্ষন ডাকার পর ধ্রুব দারুন বিরক্তি নিয়ে উঠে বসেন। চোখ মুখ খিঁচে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন-

‘কি শুরু করলেন সকাল সকাল? এভাবে তো তুলতুলও আমাকে ডেকে ওঠায় না।’

আমি কোনো জবাব না দিয়ে ওনার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে আসলাম। গাছ গুলোর সামনে দাঁড় করিয়ে আনন্দিত গলায় বললাম-

‘দেখুন আমি আমার দায়িত্ব পূরণ করেছি। গাছের ঠিক মতো যত্ন নিয়েছে আর এখন দেখুন ফুলও ফুটে গেছে।’

ধ্রুব চুপচাপ কিছুক্ষন গাছের দিয়ে তাকিয়ে থাকলেন। আড়মোড়া ভেঙে আমার দিকে শীতল চাহনি দিয়ে বললেন-

‘হুম দায়িত্ব নেওয়া শিখেছো এখন শুধু ফুলগুলো সব ভালোবাসা হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা। ফুলের স্নিগ্ধতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলার পালা সানসাইন।’

চলবে….

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৯
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘তুলতুলের আম্মু একটু এদিকে আসুন তো।’

ধ্রুবর গলা ফাটানো ডাকে আমি দ্রুত পায়ে ছুটে আসলাম রুমে। ধ্রুব তার ঘামে ভেজা শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়। দু হাত দু’দিকে ছড়িয়ে রেখে চোখ দুটো বন্ধ করে রাখা। পা দুটো বিছানার বাহিরে ঝুলছে। যেন কোনো বলহীন শরীর পরে আছে। আমি কিছুটা এগিয়ে এসে সহসা উদ্ধিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলাম-

‘কি হলো ডাকছেন কেন? কিছু লাগবে?’

গত দু’দিন ধরে ভীষণ গরম পরেছে। উত্তপ্ত সূর্যের রশ্মি কাঁটার মতো বিঁধে যেতে চায় শরীরে। দিনের শেষ বেলাতেও এসে থেকে যায় প্রখর রোদের রেশ। ধ্রুব অফিস থেকে আসার মিনিটখানেক আগেই কারেন্ট গেছে। আধঘন্টা হতে চলল অথচ এখনও কারেন্ট আসার নাম নেই। তিনদিন ধরে গাড়ি না থাকায় এই তীব্র গরমেই রিকশায় যাতায়াত করছে সে। আব্বু বাসার গাড়ি নিয়ে সিলেট গেছে। আর অফিসের গাড়ি সে নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করতে নারাজ। নারী কর্মচারীদের জন্য রাখা গাড়ি যদি সে নিজেই ব্যবহার করে তাহলে রাতবিরেতে অফিসের মেয়েদের বাসায় পৌঁছে দেওয়ায় ঝামেলা হবে। অফিসের মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়েও ধ্রুব বেশ সচেতন। এই নির্লিপ্ত মানুষটা যেন সব কিছুরই খেয়াল রাখে। নিজের অসুবিধে হলেও অন্যদের যেন কোনো অসুবিধে না হয়।

ধ্রুব উঠে দু’হাত পেছনের দিকে ভর দিয়ে বসলেন। তার শার্টের উপরে তিনটা বোতাম খোলা। বুকে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। ক্লান্তিমাখা তার মুখ। ঠোঁটের কোণে তরল ভঙ্গির হাসি। তার বড় বড় চোখের ক্লান্তিমাখা বিষন্ন চাহনি স্থির করলেন আমার চোখে। ঠোঁট নাড়িয়ে অলস ভঙ্গিতে বললেন-

‘কেন! কোনো কারণ ছাড়া আপনাকে ডাকা বারণ বুঝি?’

আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম-

‘না না তা কেন হবে! আসলে তুলতুলকে খাওয়াচ্ছিলাম তো তাই আরকি।’

ধ্রুব উঠে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ওনাকে কাছে আসতে দেখেই ভীষণ অস্বস্তিতে দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম। তিনি ঝুঁকে তার মুখ নিয়ে এলেন আমার কানের কাছে। ফিসফিসিয়ে বললেন-

‘শুধু কি মেয়ের খেয়াল রাখলেই হবে? মেয়ের আব্বুকেও তো একটু সময় দিতে হবে।’

ধ্রুবর এতটা কাছে আসা আর তার ফিসফিসিয়ে কথা বলায় আমার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এলো। বুকের ধুকপুকানি তীব্রভাবে বেড়ে যেতে লাগল। পাজরের হাড়গোড় ভেঙে এখনই যেন হৃদপিণ্ডটা লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভ্যাপসা গরমেও শরীরে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। আমার শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলায় শুকনো ঢোক গিললাম। মাথা তুলে চোখ দুটো বড় বড় করে চাইলাম। লজ্জা মিশ্রিত দৃষ্টি যেয়ে স্থির হলো ধ্রুবর ঘামার্ত বুকে। চিরচেনা সেই পুরুষালী গন্ধ। যে গন্ধে এখন প্রতিদিন সকালেই আমার দেহের প্রতিটি লোমকূপ শিউরে ওঠে। চারদিন যাবৎ ঘুম থেকে উঠেলেই এই ঘামার্ত বলিষ্ঠ বুকে নিজেকে খুঁজে পাই৷ রাতে দুজন দু’পাশে ঘুমালেও ঘুম ভাঙতেই নিজেকে ধ্রুব বাহুডোরে বন্দী অবস্থায় আবিষ্কার করি। কখন আর কিভাবে এমনটা হয় তা আমার জানা নেই৷ রহস্যময় হয়ে থাকে আমার প্রতিটি সকাল।

‘এই যে তুলতুলের আম্মু! কোথায় হারিয়ে গেলেন?’

আমার ধ্যান ভাঙলো। আগ্রহ নিয়ে চাইলাম ধ্রুবর দিকে। আমার থেকে দুয়েক পা দূরত্বেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ঠোঁটের কোণের মৃদু হাসিটা প্রসারিত হয়ে ছড়িয়ে পরলো চিবুকে সহ সাড়া মুখে। আমাকে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে শুধালেন,

‘এটা আপনার জন্য।’

আমি তার হাতের ব্যাগটার দিকে ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম-

‘কি এটা?’

‘আপনার জিনিস আপনি নিজেই খুলে দেখুন।’

ধ্রুব আমার হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েই পূনরায় বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পরলেন। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে ব্যাগ খুলে দেখলাম। ধ্রুবর দিকে চোখ বড় বড় তাকিয়ে উৎকন্ঠিত হয়ে বললাম-

‘নতুন ফোন! কিন্তু ফোন দিয়ে কি করবো আমি?’

‘সেদিন তো একটা ফোনের হ’ত্যা করলেন। তাই দ্বিতীয় হ’ত্যা কার্য সম্পূর্ণ করার জন্য এটা এনে দিলাম। নিশ্চিন্তে পরিকল্পনা করে তারপরেই হ’ত্যা করবেন। তেমন কোনো তাড়াহুড়ো নেই।’

ধ্রুবর রসিকতায় আমি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম-

‘আমার সাথে এসব রসিকতা না করলে কি ভালো লাগে না?’

ধ্রুব জবাব দিলেন না। সব সময়ের মতোই হাসলেন। আমি হতাশ হয়ে মিহি কন্ঠে বললাম-

‘আমার তো ফোনের দরকার ছিল না। শুধু শুধু কেন টাকা নষ্ট করে ফোন কিনে আনলেন আপনি?’

ধ্রুব উঠে আবারও আমার কাছে আসলেন। গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন আমার প্রশ্নাত্মক চোখের দিকে। ঘামে কপালে লেপ্টে থাকা আমার চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে উদাসীন গলায় বললেন-

‘এখন দরকার না থাকলেও কিছুদিন পর দরকার হবে। তোমার জন্য না হলেও আমার ভীষণ প্রয়োজন পরবে সানসাইন।’

ধ্রুব রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি ওনার কথার মানে না বুঝে বিমূঢ় দৃষ্টি তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলাম। মাঝেমধ্যে খুব অদ্ভুত আচরণ করেন উনি। ভীষণ প্যাচানো ধরনের কথাবার্তা বলে আমার মাথা এলোমেলো করে দেন। আমি কিছুই বুঝি না ওনার এমন প্যাচানো কথা। বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

‘অনু আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

খাবার টেবিলে মনি মা’র গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে মাথা তুলে তাকালাম। সহসা খানিক কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম-

‘কিসের সিদ্ধান্ত মনি মা!’

‘দু’দিন পর থেকে তুই তোর মা’র বাসায় থাকবি। ধ্রুব তোর সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে দু’দিন পর তোকে ওই বাসায় দিয়ে আসবে।’

আমি হতভম্ব হয়ে স্থির বসে রইলাম। অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে কখনো মনি মা, কখনো ধ্রুব আর কখনও আব্বুর দিকে তাকাতে লাগলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম পরিস্থিতি। কিন্তু ব্যর্থ হলাম। সবাইকে স্বাভাবিক লাগছে। এ বিষয়ে আমি অবগত না থাকলেও তাদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক আগেই আলোচনা হয়েছে তা তাদের ভাবগতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি নিজেকে যথাসাধ্য সামলিয়ে নিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘কি বলছো মনি মা? ওই বাসায় কেন থাকবো?’

মনি মা জবাব দিলেন না। আমি উত্তরের আশায় ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকালাম। ধ্রুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই খাচ্ছেন। মনি মা আর আমার কোনো কথাই যেন তার কানে যাচ্ছে না। মনি মা তার আচল দিয়ে তুলতুলের মুখ মুছে গম্ভীরমুখে বললেন-

‘যা বলছি ঠিক বলছি। পাঁচ দিন পর তোর এক্সাম। এখানে থাকলে তোর পড়াশোনা কিছুতেই হবে না। সারাক্ষণ তুলতুলকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবি। পরিক্ষার পড়া কিছুই পড়তে পারবি না৷ বিয়ের জন্য পড়াশোনায় এমনিতেও অনেক পিছিয়ে গেছিস৷ তা ছাড়া এখান থেকে তোর ভার্সিটি অনেকটা দূর হয়ে যায়৷ প্রতিদিন এতটা পথ জার্নি করে পরিক্ষা দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। তাই আমি ঠিক করেছি পরিক্ষা শেষ না হওয়া অব্দি তুই ওই বাসায় থাকবি।’

আমি ভড়কে গেলাম। ভীষণ অস্থির হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। তুলতুল আর বাকি সবাইকে ছাড়া থাকবো ভেবেই বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। গলার স্বর আটকে গেল। কি বলবো না বলবো কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। দলা পাকিয়ে গেল সব কিছু। চোখদুটো ভীষণ আবেগে ঝাপসা হয়ে এলো৷ মনি মা আমার প্রতিত্তোরে অপেক্ষা করলেন না। তুলতুলকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন রুমে। আমি আহত দৃষ্টিতে একবার ধ্রুবর দিকে দিকে আরেকবার আব্বুর দিকে তাকালাম। আব্বু খাওয়া শেষে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-

‘মন খারাপ করিস না মা। তোর মা এসব নিয়ে অনেক বেশি সিরিয়াস। নিজের সিদ্ধান্তে সব সময়ই অটল থাকবে। কারও কোনো কথাই শুনবে না।’

একে একে সবাই চলে গেল। আমি এখনও স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। ধ্রুবও কিছু বললেন না। একবারও মনি মা’কে বাধা দিলেন না। আমাকে আশ্বস্ত করার জন্যেও কিছু বললেন না। কেন এমন নিষ্ঠুরতা করছেন আমার সাথে? আমি কোনো রকম ডাইনিং টেবিলের সব কিছু গুছিয়ে ড্রয়িং রুমে আসলাম। ধ্রুব আর আব্বু সোফায় বসে অফিসের কাজ নিয়ে আলোচনা করছেন। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মনি মা’র রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। দরজার কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালাম। ভয় করছে খুব। বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে তীব্র গতিতে। চেনা মানুষটাকেও ভীষণ অচেনা লাগছে। ভয় লাগছে। আমি ইতস্তত করে বললাম-

‘মনি মা আসবো?’

‘আমার রুমে আসতে অনুমতি নেওয়া শুরু করলি কবে থেকে? থাপ্পড় খেতে না চাইলে চুপচাপ এসে বস এখানে।’

মনি মা দারুণ বিরক্তি নিয়ে কথা গুলো বললেন। তবে একবারের জন্যেও আমার দিকে ফিরে তাকালেন না। আমি থমথমে পায়ে রুমে এসে বিছানার এক পাশে কাচুমাচু হয়ে বসলাম। অনেক কথা বলার আছে। তবে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না। মনি মা তুলতুলের মাথায় তেল দিতে দিতে সহজ গলায় বললেন-

‘আমি জানি তুই কি বলতে চাচ্ছিস। কিন্তু তার আগে আমার কিছু কথা আছে তোকে বলার জন্য। সে গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবি তারপর তোর যা ইচ্ছে হয় করিস।’

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২০
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘আমি তোকে কখনো মোহনার থেকে আলাদা মনে করিনি অনু৷ তোর জন্মের পর দিনের বেশির ভাগটা সময় তুই আমার কাছে আর মোহনার কাছেই ছিলি। যদিও বা ধ্রুবর আব্বুর বিজনেসের জন্য আমরা সপরিবারে সিলেট চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু তোর আম্মুর কাছে প্রায়ই তোর খোঁজ নিতাম। তুই হয়তো জানিস না মোহনা বিয়ে করেছিল ভালোবেসে। তবে বিয়ের পর সেই ভালোবাসা আর বেশিদিন ছিল না। শ্বশুর বাড়ির নানান ঝামেলায় আমার মেয়েটা মানসিক ভাবে ভেঙে পরেছিল। তাই হয়তো তুলতুলকে জন্ম দেওয়ার সময় বেঁচে থাকার জন্য মানসিক শক্তিটুকু পায়নি। হাঁপিয়ে উঠেছিল নিজের জীবন নিয়ে। তাই হয়তো হার মেনে নিয়েছে।’

মনি মা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। খানিক্ষন চুপ থেকে আবারও বলতে লাগলেন-

‘তোকে আমি সেদিন পার্কে দেখা মাত্রই চিনে ফেলেছিলাম। তোর ওভাবে ভেঙে পরা দেখে মনে হচ্ছিল আমি মোহনাকেই দেখছি। ভীষণ কষ্ট হয়েছিল সেদিন। কিন্তু তুলতুলের জন্য তোকেই নিজের ছেলের বউ করে নিয়ে আসতে হবে সেটা ভাবিনি। তুই যখন ছোট ছিলি তখন নিছকই মজার ছলে তোর মাকে বলেছিলাম তোর সাথে ধ্রুবর বিয়ে দিবো। কথাটা সত্যি হয়েছে। মনি আন্টি থেকে মনি মা হয়েছি। তবে তোকে কখনোই আমি ছেলের বউ হিসেবে দেখিনি। সব সময় নিজের মেয়ে মনে করেছি। তাই আমি তোর বিষয়ে কোনো হেয়ালি করতে চাই না। মোহনার খুব ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কিন্তু বিয়ের পর এত ঝামেলা আর মানসিক চাপের জন্য তা আর হয়নি। এই জন্যই আমি চাই না তোর বেলাও সেরকম কিছু হোক। আমি চাই তুই তোর পড়াশোনা ঠিক মতো চালিয়ে যা। তারপর না-হয় সংসারে মন দিস তখন আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। আশাকরি তুই আমাকে ভুল বুঝবি না।’

আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম মনি মা’র দিকে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন তিনি। বরাবরের মতোই লুকানোর চেষ্টা করলেন তার সকল কষ্ট। সকল ব্যথা। সব সময় সবাইকে ধমকের উপরে রাখা এই সাহসী নারীরও কষ্ট আছে। চোখ ভিজে আসার মতো বিষন্নতায় ঘেরা কিছু আবেগ আছে। মেয়ে হারানোর কষ্টে কাতর হয়েও সবার মুখের দিকে চেয়ে নিজেকে শক্ত রাখার দারুণ ক্ষমতা আছে। এক যুগ পর দেখা হলেও ঠিক সেই আগের মতোই মমতায় জড়িয়ে নেওয়ার মতো অসীম ভালোবাসা আছে তার বুকে। এই মানুষটা শুধুই ভালোবাসার৷ যাকে শুধু এবং শুধুই ভালোবাসা যায় কখনও ভুল বুঝা যায় না।

আমি নিঃশব্দে তুলতুলকে মনি মা’র কোল থাকে নামিয়ে আমি নিজেই মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। তুলতুল হামাগুড়ি দিয়ে এসে আমার বুকের সাথে মিশে শুয়ে রইলো। আমি জড়িয়ে ধরলাম তাকে। মনি মাও আমার মাথায় রাখলেন। পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমি নিশ্চুপ থেকেই উপলব্ধি করলাম মনি মা’র নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। আর আমার বুকের সাথে জড়িয়ে রাখা তুলতুলের প্রতি নিজের দূর্বলতা৷ এই মানুষ গুলো ছাড়া আমি অচল। তাদের ভালোবাসা ছাড়া আমার আর কিছু নেই।

‘ ডাইনিং টেবিলে আমাদের সামনে গম্ভীর গম্ভীর কথা বলার পর এখানে এসে এত ভালোবাসা আসলো কিভাবে? তা তোমার সব রাগী রাগী ভাব কি শুধু আমার সামনেই দেখাও না-কি মনি?’

আব্বুর কথায় মনি মা তীক্ষ্ণ চোখে ওনার দিকে তাকালেন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন-

‘আপনারা বাপ ছেলে যেমন আপনাদের সাথে তেমন করেই কথা বলি বুঝলেন!’

আব্বু কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম-

‘থামো তোমরা। আমি এখান থেকে যেয়ে নেই তারপর আবার শুরু করো কেমন!’

আমি মনি মা’র কোল থেকে মাথা তুলে উঠে বসতেই খেয়াল করলাম তুলতুল ঘুমিয়ে পরেছে। আমি খুব সাবধানে তুলতুলকে কোলে নিয়ে বেড রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। পেছন থেকে মনি মা আর আব্বুর ঝগড়া শোনা গেল। আব্বুও পারে বটে। সারাক্ষণ মনি মা’কে না ক্ষেপালে তার হয়তো ভালোই লাগে না। ইচ্ছে করে মনি মা’কে রাগায়। আর মনি মা সবটা জেনেও কৃত্রিম রাগ নিয়ে আব্বুর সাথে ঝগড়া করে। এটাই হয়তো তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এভাবে ঝগড়া করেই হয়তো কাটিয়ে দিবে সারাজীবন।

চোখের পলকের শেষ হয়ে এলো দু’দিন। ধ্রুব নিজেই আমার সকল বই খাতা আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গাড়িতে নিয়ে রাখছেন। তার মধ্যে বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়নি দু’দিনে। আমার চলে যাওয়া নিয়ে আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি। পুরোটা সময় ছিল স্বাভাবিক। আমি চলে যাওয়াতে কি তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই?? উনি কি এমনটাই চেয়েছিলেন! এতেই কি খুশি! না-কি অন্য কিছু!! আমিই বুঝতে ভুল করছি!

‘চলো তুলতুলের আম্মু। গাড়িতে সব কিছু রাখা হয়ে গেছে।’

ধ্রুবর কথায় আমি আহত দৃষ্টিতে একঝলক তার মুখপানে তাকালাম। দৃষ্টি সরিয়ে স্থির করলাম মনি মা’র দিকে। ঠোঁট প্রসারিত করে মলিন হাসলেন মনি মা। আমি তৎক্ষনাৎ ওনাকে জড়িয়ে ধরলাম। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সবাইকে ছেড়ে যেতে। বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। মনি মা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-

‘ধুর বোকা মেয়ে। এভাবে মন খারাপ করছিস কেন? মনে হচ্ছে আমি একেবারের জন্য তোকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। মাত্র তো কয়েকদিনের ব্যাপার। আর তা ছাড়া তোর বন্ধের দিন আমি তো যাবোই তুলতুলকে নিয়ে। আর আমি যেতে না পারলেও ধ্রুব তোকে নিয়ে আসবে। তারপর পরিক্ষা শেষ হলে একেবারেই নিয়ে আসবো। মন খারাপ করিস না।’

আমি মাথা নাড়িয়ে জোরালো কন্ঠে বললাম-

‘নিজের খেয়াল রেখো মনি মা। আর তুলতুলকেও দেখে রেখো।’

আমি মনি মা’কে ছেড়ে তুলতুলকে কোলে নিলাম। তুলতুল হাসছে। মেয়েটা সব সময়ই হাসি খুশি থাকে। আচ্ছা আমাকে না পেলে কি কান্না করবে? এতগুলো দিন আমাকে না দেখে ভুলে যাবে না তো!!
তুলতুল আমার গালে তার ঠোঁট ঘষছে। আস্তে আস্তে করে কামড় দিচ্ছে আমার গালে। আমি হাল্কা হেসে তুলতুলের গালে চুমু দিয়ে বললাম-

‘মাম্মা খুব তাড়াতাড়ি এসে পরবে তুলতুল। একদম কান্না করবে না ঠিক আছে?’

তুলতুলে হাত তালি দিয়ে থেমে থেমে অস্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করলো-

‘মাম্মা ঘুরে.. যাবো।’

ধ্রুব তাড়া দিতেই মনি মা তুলতুলকে আমার কোল থেকে নিতে চাইলো। তবে তুলতুল যাচ্ছে না। শক্ত করে ঝাপটে ধরে আছে আমাকে। মনি মা বেশ কয়েক বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তুলতুল কিছুতেই আমাকে ছাড়তে রাজি না। আর কোনো উপায় না পেয়ে জোর করে আমার কাছ থেকে নিয়ে নিলো তুলতুলকে। সাথে সাথেই তুলতুলের কান্না শুরু হলো। চেচিয়ে চেচিয়ে বলে উঠলো- ‘মাম্মা ঘুরে যাবো। মাম্মা ঘুরে যাবো।’

আমার মন খারাপ হলো ভীষণ৷ মেয়েটা হয়তো ভেবেছিলো আমি তাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। মনি মা তুলতুলের কান্না থামানোর চেষ্টা করতে করতে বললেন-

‘তোরা যা আমি ওকে সামলাচ্ছি। আর অনু তোর তুলতুলকে নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হবে না। ওর কান্না একটু পরেই থেমে যাবে।’

আমি কিছুই বললাম না। পুরোটা সময় চেয়ে থাকলাম তুলতুলের দিকে। হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কান্না করছে তুলতুল৷ আমার কাছে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। জেদ দেখাচ্ছে। চোখের জলে সারা মুখ লেপ্টে গেছে। সাথে সাথেই মুখ লাল হয়ে গেছে তার। আমি এগিয়ে যেতে নিলেই ধ্রুব আমার হাত ধরে হাঁটা শুরু করলেন। আমাকে গাড়িতে বসিয়ে দিতে দিতে বললেন-

‘সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তুলতুলের আম্মু। তাড়াতাড়ি বসুন তো। আমাকে আবার রাতে একবার অফিসে যেতে হবে।’

আমি বসলাম। গাড়ি ছাড়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তাকিয়ে থাকলাম বাড়ির দিকে। দূরত্ব বাড়ছে সেই সাথে চোখের আড়াল হচ্ছে সব কিছু। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। না চাইতেও চোখে জল আসলো। অনিচ্ছাতেই সেই জল গড়িয়ে পারল গাল বেয়ে।

‘আমার জানা মতে মেয়েরা বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় কান্না করে। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে সেটা উল্টো হচ্ছে কেন? বাপের বাড়ি যাচ্ছেন ভেবে তো আপনার খুশিতে নাচানাচি করার কথা। তা না করে ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করছেন। এটা কেমন কথা?’

আমি অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালাম ধ্রুবর দিকে। নির্বিকার ভঙ্গিতে গাড়ি চালাচ্ছেন। কান্নার মাঝেও ক্ষীণ রাগ এসে ঝাপটে ধরলো আমাকে। বিরক্তিতে কপাল কুচকে এলো আমার। কান্না থামিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। ধ্রুব আমার চাহনি বুঝতে পেরে আড় চোখে পর পর কয়েকবার তাকালেন। গলা পরিষ্কার করে মিনমিনিয়ে বললেন-

‘আমি কি করলাম? আমাকে রাগ দেখাচ্ছেন কেন? চোখ দেখে তো মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই আমাকে ঝলসে দিবেন। আপনার দৃষ্টিতে পুড়ে ছারখার করে দিবেন আমাকে।’

‘আপনি কি থামবেন তুলতুলের আব্বু? আমাকে না রাগালে আপনার ভালো লাগে না তা-ই না?’

আমার কঠিন বাক্য ধ্রুবকে তেমন একটা প্রভাবিত করলো না। তিনি তার মতোই স্বাভাবিক। কোনো হেলদোল হলো না তার মাঝে। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ বসে রইলাম। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল৷ ধ্রুব বেশিক্ষণ থাকলেন না। সবার সাথে কুশল বিনিময় কিরেই আবারও বেরিয়ে পরছেন যাওয়ার জন্য। আম্মু’র কথা মতো আমিও ধ্রুবর পেছন পেছন গেইট পর্যন্ত আসলাম তাকে বিদায় জানাতে। হঠাৎ করেই ধ্রুব আমার দিকে ফিরে তাকালেন। দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে শীতল কন্ঠে বললেন-

‘আসুন আমাকে একটা টাইট হাগ দিন।’

আমি বিস্ফোরিত চোখে ওনার দিকে চাইলাম। রাত বাতির নিয়ন আলোয় তার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো ঝলঝল করছে সোডিয়ামের আলোয়। ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি। আমি সহসা অবাক করা কন্ঠে প্রশ্ন করলাম-

‘মানে কি বলছেন?’

ধ্রুব হাসলেন। বরাবরের মতোই শান্ত গলায় বললেন-

‘তাড়াতাড়ি আসুন আমাকে একটা হাগ দিয়ে দিন। আমি চলে যাচ্ছি৷ তুলতুলকে কাঁদিয়ে এসেছেন। আমি গেলেই তো মেয়েটা জিজ্ঞেস করবে তার মাম্মার কথা। তখন আমি না হয় আপনার পক্ষ থেকে একটা টাইট হাগ দিয়ে দিবো। কিন্তু আমার কাছে তো মায়েদের মতো অসাধারণ মমতা আর তার গায়ের গন্ধ নেই। তাই আপনার কাছ থেকে একটু মমতা আর গায়ের গন্ধ নিজের সাথে করে নিয়ে যেতে চাচ্ছি।’

আমি হতবাক হয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম। বাকরুদ্ধ অবস্থা আমার। কি বলবো ওনাকে! জড়িয়ে ধরবো কি-না সেটাও বুঝতে পারলাম না। আমার দুর্বল মস্তিষ্ককে আর কষ্ট করে কিছু ভাবতে হয়নি। তার আগেই ধ্রুব আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। নিঃশব্দে মুখ গুজে দিলেন আমার ঘাড়ে। আমি থমকে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য। চোখ বড় বড় করে দেখতে লাগলাম রাস্তার আশেপাশে কেউ আছে কি-না। ভাগ্য সহায় হলো। রাস্তায় একটি মানুষও দেখা গেল না। পুরো ফাঁকা নির্জন রাস্তা। আমি স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে ধ্রুবর পিঠে আলতো করে হাত রাখলাম। ধ্রুবর নেড়েচেড়ে উঠলেন। আমার ঘাড়ের কাছে থাকা তার ওষ্ঠদ্বয় যুগল নাড়িয়ে অত্যন্ত নরম গলায় বললেন-

‘একটা কথা মনে রেখো সানসাইন, দূরত্ব সব সময় শুধু কষ্টদায়ক হয় না। কিছু কিছু দূরত্ব কষ্টের ফল হিসেবে অনেক কিছু ফিরিয়ে দেয়। ভালোর জন্যেও মাঝে মাঝে দূরত্বের প্রয়োজন হয়।’

ধ্রুব তার কথা শেষেই আলতো করে তার ওষ্ঠদ্বয় আমার ঘাড়ে ছুঁয়ে দিলেন। আমি কেঁপে উঠলাম। পুরোপুরি ঘটনা বুঝে মস্তিষ্ক সচল হয়ে ওঠার আগেই গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ পেলাম। ধ্রুব চলে গেছে। তার গাড়ি দৃষ্টির আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি তাকিয়ে থাকলাম। শূন্য রাস্তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে যন্ত্রের মতো পা ফেলে ফিরে আসলাম বাসায়।

কেটে গেল আরও দু’দিন। পড়াশোনায় নিজেকে সারাক্ষণ ডুবিয়ে রাখলাম। সকল চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে শুধুই বই পড়ালাম। পরিক্ষার প্রস্তুতি নিলাম। এত এত ব্যস্ততার মাঝেও কিছু কিছু জিনিসের অনুপস্থিতি আমার দীর্ঘ শ্বাসের কারণ হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিজেকে খালি বিছানায় দেখে বুক চিড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়েছে। খাবার টেবিলে বসে মনি মা, তুলতুল আর আব্বুকে দেখতে না পেয়ে মন খারাপ হয়েছে। বারান্দায় এসে ধ্রুবর বেলি গাছ না দেখে বুকে তীব্র হাহাকার অনুভব করেছি। সারা বাড়ি জুড়ে তুলতুলের ছুটোছুটি করা আর মাম্মা ডাক শোনা ভীষণ মিস করেছি। মনি মা আর তুলতুলের সঙ্গে দু’দিন কথা হলেও ধ্রুবর সঙ্গে কথা হয়নি। ধ্রুবর দেওয়া ফোন দিয়েই কথা বলেছি মনি মা’র সাথে। তবে ধ্রুবকে কল দেওয়ার সাহস আর কারণ কোনোটাই খুঁজে পাইনি।
কলিং বেলের শব্দ পেলাম তবুই গেলাম না। আম্মু আছে, ভাইয়া আছে তারাই খুলবে। আমি আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলাম ফাঁকা বারান্দায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার আকাশ। কালো মেঘে ঢেকে আছে। কিছুক্ষণ বাদেই বৃষ্টি নামবে বোধহয়।

মিনিট পাঁচেক পর কেউ একজন দরজা ঠেলে রুমে আসলো। শব্দ পেলেও আমি তবুও পেছন ফিরে তাকালাম। ভাবলাম আম্মু হয়তো এসেছে পড়াশোনার খোঁজ নিতে। কিন্তু আমার ধারনা ভুল হলো। পুরুষালি কন্ঠে কেউ একজন ডাকলো আমায়-

‘তুলতুলের আম্মু?’

আমি চমকে গেলাম। দ্রুত রুমে এসে দেখলাম ধ্রুব বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে ক্লান্ত ভঙ্গিতে। আমাকে দেখা মাত্রই বুকে হাত দিয়ে অস্ফুটস্বরে থেমে থেমে বললেন-

‘আমার বুকে ভীষণ ব্যথা করছে তুলতুলের আম্মু। কিছুটা হয়েছে আমার বুকে। আমি টের পাচ্ছি সেই জিনিসটার উপস্থিতি। মাঝেমধ্যে ভীষণ ভারী হয়ে যায় বুক তখন তীব্র যন্ত্রণা করে। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আমার খুব ভয়ংকর কিছু হয়েছে আমি বুঝতে পারছি তুলতুলের আম্মু।’

ধ্রুব কথা গুলো বলেই হাঁপাতে শুরু করলেন। বুকে হাত দিয়ে বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি।

চলবে…

শেষ রাত পর্ব-১৫+১৬+১৭

0

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৫
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

ঘুম ভেঙেই নিজেকে ধ্রুবর বাহুডোরে দেখে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম। রাতে করা নিজের বোকামির কথা ভেবেই লজ্জা পেলাম খুব। খানিকটা অবাক হলাম ধ্রুবর ব্যবহার আর তার কথা গুলো মনে করে। সবার সামনে আমাকে তুমি সম্মোধন করলেও যখন আমরা একা থাকি তখন কখনই তিনি আমাকে তুমি সম্মোধন করেননি। কিন্তু কাল রাতে কি অদ্ভুত ভাবেই না কথা বললেন। কিন্তু কেন? আর আমিই বা কেন ওনার বুকে নিজের ঠাঁই খুঁজে নিতে চাইলাম। কেন ওনার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে চাইলাম আমি? প্রশ্ন গুলো দিশেহারা হয়ে আমার মস্তিষ্কের পুরোটা জায়গা জুড়ে ঘুরতে লাগল। তবে কোনো উত্তর এলো না মস্তিষ্ক থেকে। আমি নেড়েচেড়ে উঠলাম। ধ্রুবর বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম। কিন্তু হলো তার বিপরীতে। ধ্রুব আরও শক্ত করেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন-

‘উফফ তুলতুলের আম্মু! সাপের মতো এভাবে মোচড়ামুচড়ি করছেন কেন? আমার জানামতে আমি তো কোনো নাগিন মেয়ে বিয়ে করি নি।’

ওনার কথায় ক্ষীণ রাগ নিয়ে মাথা তুলে তাকাতে চাইলাম কিন্তু সম্ভব হলো না। আমি হাল ছেড়ে স্বাভাবিক হয়ে শুয়ে রইলাম। দারুণ অস্বস্তি নিয়ে মিনমিনিয়ে বললাম-

‘আমাকে ছাড়ুন। আমি উঠবো।’

ধ্রুব আমাকে ছাড়লেন না বরং আমাকে লজ্জায় ফেলার মতো কিছু ভয়ংকর কথাবার্তা বলা শুরু করলেন,

‘কাল রাতে তো আমার পারসোনাল বুকের ভেতর একদম ডুকে যেতে চাচ্ছিলেন। তখন তো আমি বাধা দেইনি। তাহলে এখন কেন এতো লজ্জা পাচ্ছেন?’

আমি লজ্জা আর অস্বস্তিতে চুপ করে করে থাকলাম। ধ্রুবর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলাম না বা খুঁজতে চাইলাম না। ধ্রুব হয়তো বুঝলেন আমার মনের অনুভূতি। তিনি খুব সাবধানেই তার বাহুডোর থেকে আমাকে মুক্ত করলেন। খাঁচায় বন্দী থাকা পাখির মতোই আমি মুক্তি পেতেই ঝটপট করে উঠে বসলাম। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়েই নিজেকে ঠিক করতে ব্যস্ত হলাম। আমার এলোমেলো চুলগুলো হাত খোপা করতেই ধ্রুব আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলেন। অত্যন্ত সহজ গলায় বললেন-

‘আমার পারসোনাল বুকটা আপনার সাথে শেয়ার করলাম। আমার এতো বছরের যত্ন করে রাখা একান্ত ব্যক্তিগত বুকটাতে আপনার জায়গায় দিলাম। তাই বলে যে আপনি কেঁদেকেটে আমার বুক ভাসাবেন আর সারা রাত বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আমার শরীর ঝিম ধরিয়ে ফেলবেন তা তো হবে না। বুকে যেমন জায়গায় দিয়েছি তেমনি আপনারও উচিত সেই বুকটাকে সযত্নে আগলে রাখা, খেয়াল রাখা আর নিয়মিত এর ভাড়া পরিশোধ করা।’

ধ্রুবর এমন উদ্ভট কথাবার্তায় আমি বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

‘ভাড়া কিভাবে দিবো! আর আপনার অতি পারসোনাল বুকের খেয়াল আমি রাখবো কিভাবে?’

‘এখন এত কিছু জানতে হবে না। সময় হলে আমি নিজেই বলে দিবো। আপাতত আপনার নোনাজলে ভেসে যাওয়া আমার টি-শার্টটা ধুয়ে দিলেই হবে।’

ধ্রুব ভ্রুক্ষেপহীন গলায় কথা গুলো বলেই নিজের টি-শার্ট খুলতে লাগলেন। আমি বিস্ফোরিত চোখে ওনার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। আমতা আমতা করে বললাম-

‘আপনি.. আপনি…!’

আমার কথা জড়িয়ে গেল। ওনাকে বলার জন্য কথা গুছিয়ে নিতে পারলান না। ধ্রুব তার নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন-

‘কি? আপনি আপনি করছেন কেন?’

আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বললাম-

‘আপনি নির্লজ্জ। আপনার লজ্জা করে একটা মেয়ের সামনে এভাবে হুটহাট টি-শার্ট খুলে ফেলতে!’

ধ্রুব অবাক করা কন্ঠে বললেন-

‘আমি তো এখানে আমার বিবাহিত বউ ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে দেখছি না তুলতুলের আম্মু। তাহলে লজ্জার কি হলো এখানে? যাই হোক এই নিন টি-শার্ট সময় করে ধুয়ে রাখবেন।’

ধ্রুব তার টি-শার্ট দিয়ে আমার সাড়া মুখ ডেকে দিয়েই ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আমি হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলাম। লোকটার ভাবগতিক কিছুই বুঝতে পারছি না৷ দিন দিন যেন তার লুকিয়ে রাখা নানান ধরনের রূপ এক এক করে প্রকাশ পাচ্ছে। আমি মুখ থেকে ওনার টি-শার্ট সরিয়ে হাতে নিয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম।

‘কিরে তুই কখন এলি?’

সানি তুলতুলের সঙ্গে খেলতে খেলতে এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে বলল-

‘বেশিক্ষন না মিনিট দশেক হবে।’

আমি সানির পাশে বসে ভ্রু কুচকে সন্দিহান কন্ঠে বললাম-

‘সকাল সকাল এই বাসায় কি ব্যাপার!’

‘কোনো ব্যাপার না। সকাল সকাল তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেছে তাই ভাবলাম তুলতুলের সঙ্গে দেখা করে তোকে নিয়েই এখন থেকে কলেজে যাবো।’

খানিকক্ষণ বাদেই ধ্রুব এসে কুশল বিনিময় করলেন সানির সাথে। কথার এক পর্যায়ে সানি বেশ উৎসুক হয়ে বলল-

‘দুলাভাই আপনি আজ গাড়ি নিয়ে অফিসে চলে যান। অনু আর আমি আজ রিকশা করে যাবো ভার্সিটিতে। অনেক দিন একসাথে যাওয়া হয়না।’

‘এক সাথে যাবে তাহলে আমার গাড়ি দিয়ে যাও। ধুলোবালির মধ্যে রিকশা দিয়ে যাওয়ার কি দরকার!’

ধ্রুবর কথায় সানি হাসতে হাসতে বলল-

‘আমি আর অনু আগে রিকশা দিয়েই যেতাম তাই ওর ডাস্ট অ্যালার্জি নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না।’

ধ্রুব কপাল কুচকে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে রইলেন। ছোট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে উদাসীন গলায় বললেন-

‘আমার বউটাকে দেখে রেখো শালি সাহেবা। আমার কিন্তু একটা মাত্রই বউ।’

ধ্রুবর কথায় সানি শব্দ করে হেসে ফেলল। রান্নাঘর থেকে মনি মা-ও হাসলেন। আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ধ্রুবর দিকে নিক্ষেপ করলাম। তবে এতে তার কোনো হেলদোল হলো না। উনি ওনার মতোই স্বাভাবিক।

বহুদিন পর সানির সাথে রিকশায় কলেজে এলাম। পুরনো স্মৃতি গুলো মনে করে খুব হাসলাম। মেয়েটা আমাকে হাসাতে পারে যে কোনো পরিস্থিতিতে। আমার মতো ইন্ট্রোভার্ট মেয়েকে মুহূর্তেই হাসাতে হাসাতে পেট ব্যথায় করিয়ে ফেলে। ভার্সিটির মাঠে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সানির কথা হঠাৎ করেই থেমে যায়। আমার হাতে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে বলল-

‘দোস্ত সাদাফ ভাই দাঁড়িয়ে আছে।’

আমি সানির দৃষ্টি অনুসরণ করে মাঠের অন্য প্রান্তে তাকাই। সাদাফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও এড়িয়ে গেলাম। সানিকে বললাম-

‘বাদ দে ক্লাসে চল।’

আমরা ক্লাসে চলে আসলাম। পর পর তিনটা ক্লাস শেষ হলো অথচ সাদাফ এখনও আমার ক্লাস রুমের জানালা বরাবর মাঠের সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। এক মুহুর্তের জন্যেও সেখান থেকে যায়নি। আমার পাশ থেকে সানি চিন্তিত গলায় বলল-

‘অনু সাদাফ ভাই তো দেখছি পাগল হয়ে গেছে।’

আমি চুপ করে রইলাম। সানির কথার প্রতিত্তোরে কিছু বললাম না। সানি আমার কাধের উপর হাত রেখে ভারি গলায় বলল-

‘শোন অনু। তুই সাদাফ ভাইয়ের সঙ্গে ভালো করে কথা বল। রাগ না করে ভালো করে বুঝিয়ে বল ওনাকে। তাহলেই হয়তো উনি বুঝবেন। এভাবে আর কত দিন এড়িয়ে যাবি? ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে না উনি এত সহজে তোকে নিয়ে হার মানবে।’

আমি চুপ থেকে মনে মনে ভাবলাম সানির বলা কথা গুলো। সানিকে চোখের ইশারায় সম্মতি জানিয়ে ব্যাগ নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলাম। সাদাফের কাছে এসে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম-

‘তুমি এখনও যাওনি কেন সাদাফ? এখানে তো তোমার কোনো দরকার থাকার কথা না।’

‘এখনও আমার তোমাকে পাওয়া বাকি আনুপাখি।’

সাদাফের সহজ সরল জবাবে আমি হতাশ হলাম। ছোট্ট করে তপ্ত শ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বললাম-

‘আমাদের কোথাও বসে কথা বলা উচিত।’

আমার কথা শুনেই সাদাফের চোখদুটো খুশিতে চিকচিক করে উঠলো। তার বিষন্ন মুখে এক চিলতে হাসি দেখা দিল। আনন্দিত হয়ে বলল-

‘সত্যিই বলছো অনু পাখি? আমার সাথে যাবে তুমি?’

আমি কোনো জবাব না দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। ভার্সিটি থেকে মিনিট পাঁচেক দূরে একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসলাম দুজনে। রেস্টুরেন্টের এক কোণের টেবিল দখল করে চুপচাপ বসে রইলাম। আমার সামনের চেয়ারেই সাদাফ কথা বলার জন্য হাসফাস করতে লাগলো। একটা পর্যায়ে চুপ থাকতে না পেরে উত্তেজিত হয়েই বলল-

‘আমি তো ভাবতেই পারিনি ধ্রুব তোমার হাসবেন্ড। তুমি সবার কথা রাখতে বিয়ে করেছো তাই না অনুপাখি? আমি জানি তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো। আগের মতোই ভালোবাসো। তুমি কখনই আমাকে ছেড়ে নিজের ইচ্ছাতে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারো না। কাল রাতে কত করে কল দিলাম। কিন্তু তুমি ধরলে না কেন? আমাকে ব্লক করলে কেন? ধ্রুব সাথে ছিল না-কি?’

সাদাফ একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে যাচ্ছে তবুও থামছে না। অবশেষে আমি মুখ খুললাম। ভীষণ শান্ত গলায় বললাম-

‘আমাদের উপন্যাসের বইয়ের সূচনা হয়েছিল ভালোবসার রঙিন কালির আঁচড়ে। মাঝের ধূসর পাতায় লেখা ছিল কিছু অভিমান, অপেক্ষা আর হেয়ালিপনার কথা। অপেক্ষা, অভিমান আর কষ্ট আমার ছিল। একান্তই আমার। আর খামখেয়ালিপনা ছিল তোমার। তোমার অবহেলা আর হেয়ালিতে আমাদের উপন্যাসের শেষের পাতা গুলো ফাঁকাই রয়ে গেল। বিষাদে মোড়ানো একটা সমাপ্তি টানতে হলো উপন্যাসের। ভালোবাসার রঙিন কালি দিয়ে আবারও সেই সমাপ্ত উপন্যাসের শেষটা লেখা সম্ভব না। প্রকাশিত উপন্যাস আবারও নতুন করে লেখা হয়না সাদাফ। উপন্যাসের সমাপ্তিটা বিষাদময় হলেও সেটাই আমাদের মেনে নিতে হবে আজীবনের জন্য।’

আমি থামলাম। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইলাম সাদাফের দিকে চেয়ে। সাদাফ মাথা চেপে ধরে মিনিট খানেক সময় নিঃশব্দে বসে থাকলো। দৃষ্টি তুলে তাকায় আমার দিকে। গম্ভীর গলায় বলে,

‘তুমি চাইলেই ধ্রুবকে ডিভোর্স দিয়ে আমার কাছে চলে আসতে পারো। তুমি তো ধ্রুবকে ভালোবাসো না। আমাকে ভালোবাসো। তাহলে ধ্রুবর সাথে কেন সংসার করবে? ভালোবাসাহীন সম্পর্ক কতদিনই বা নিজের অনিচ্ছায় টিকিয়ে রাখবে অনন্যা? ধ্রুবকে বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই রাজি হবে তোমাকে ডিভোর্স দিতে। ধ্রুব আমার কথা বুঝবে আমি জানি।’

চলবে….

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৬
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘সাদাফ! তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি অনেকগুলো ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছো! প্রথমত আমি তোমাকে ভালোবাসতাম এখন বাসি না। তুমি আমার না হওয়া অতীত। আমার প্রাক্তন। তোমার কারণে আমি আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ ছাড়তে পারবো না। কিছতেই না। আর দ্বিতীয়ত আমি কখনও-ই তোমার কাছে ফিরে আসবো না। আর আমি কোনো দিনও তুলতুলের আব্বুকে ডিভোর্সের কথা বলবো না।’

‘কিন্তু তুমি তো ধ্রুবকে ভালোবাসো না অনন্যা তাহলে কেন!’

আমার কথা শেষ হতেই সাদাফ গাঢ় স্বরে কথাটা বলল। তার এই কথাটা আমাকে ভাবালো। আমি আপনমনে ভাবতে লাগলাম। আমি ধ্রুবকে ভালোবাসি না তবুও কেন তার সঙ্গে থাকবো! কি কারণে থাকবো? মুহুর্তেই অনেক গুলো কারণ খুঁজে পেলাম। তার মধ্যে সব চেয়ে বড় কারণ হলো পূর্নতা। আমাদের মেয়ে পূর্নতা। ধ্রুব আর আমার মেয়ে।

‘ভালোবাসার থেকেও বেশি কিছু আছে সাদাফ। আর সেটা হলো গুরুত্ব। যা কি-না তোমার আমার ভালোবাসার মাঝে কখনই ছিল না। আমি ধ্রুবকে শ্রদ্ধা করি, বিশ্বাস করি, সম্মান করি। উনিও আমার থেকে দ্বিগুণ আমাকে শ্রদ্ধা করে। আমার অনুভূতি গুলোকে শ্রদ্ধা করে। আমার কষ্ট গুলোকে বোঝে। যখন আমি ভেঙে পরি তখন আমার দিকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দেয়। আর সব থেকে বড় কথা হলো আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি। আমাদের মেয়েকে ভালোবাসি। আমি কখনই একজন স্বার্থপর মা হতে চাই না। কারও স্বার্থপর স্ত্রী বা পুত্রবধূ হতে চাইবো না। কখনই না।’

আমি থামলাম। সাদাফ আহত চোখে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। বাহিরের কোলাহল আর আশেপাশের টেবিলে বসে থাকা মানুষগুলোর নিম্নস্বরে ফিসফিসে কথার শব্দে কেটে গেল কিছুটা সময়। ডান পাশের টেবিলে বসে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকার ঠোঁটে মিষ্টি লাজুক হাসি। মনে মনে হাসলাম আমি। আবারও তাকালাম সাদাফের দিকে। কেউ কেউ নতুন প্রেমে মত্ত আর কেউ বা বিচ্ছেদের দাহনে পোড়াচ্ছে তার মন। আবারও মুচকি হাসলাম আমি। নিয়তির খেলায় হাসলাম।
সাদাফ মাথা নিচু করেই জড়ানো কন্ঠে বলল-

‘আর কোনো আশা নেই!’

আমি খানিকটা সময় চুপ থেকে শান্ত ভঙ্গিতে বললাম-

‘তোমার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো খুব সুন্দর ছিল। মধুর ছিল। তুমি দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর আমার লাইফে ছিলে এ নিয়ে আমার কোনো রিগ্রেট নেই। তবে আমি চাই না ভবিষ্যতে তোমার প্রতি আমার মনে তিক্ততা কিংবা ঘৃণা চলে আসুক। আমি চাই না তোমার জন্য আমার চরিত্রে দাগ লাগুক। বিয়ের পরও প্রাক্তনের সাথে সম্পর্ক রেখেছি বলে মানুষ আমার দিকে আঙুল তুলুক। তুমি যদি সত্যিই আমার ভালো চাও তাহলে আর কখনও আমার সামনে ভালোবাসার দাবী নিয়ে এসো না। কলেজে এসে এভাবে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থেকো না সাদাফ।’

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। শান্ত চোখে চাইলাম সাদাফের দিকে। সে আগের মতোই মাথা নত করে বসে আছে। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ব্যাগ নিতে নিতে বললাম-

‘জানো তো সাদাফ ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অবহেলার মুহুর্ত গুলো বিষের মতো বিষাক্ত হয়। তাই পরের বার কাউকে ভালোবাসলে তাকে অবহেলা করো না। তার কষ্টের সময় কিছু করতে না পারলেও অন্তত তার মাথায় একটু ভরসার হাত রেখো। আসছি। ভালো থেকো।’

আমি বেরিয়ে এলাম। সাদাফকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগলাম সামনে। পেছনে ফেলে গেলাম বিষাদময় অতীত। ভার্সিটির সামনে এসেই ধ্রুবকে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখলাম। মুখোমুখি হলাম আমার বর্তমান আর ভবিষ্যতের সাথে। আমার কপালের সূক্ষ্ণ ভাঁজটা চলে গেল৷ ঠোঁটের কোণে ফুটলো তৃপ্তিময় হাসির রেখা। আমাকে দেখে ধ্রুব সহজ ভঙ্গিতে হেসে বললেন-

‘গাড়িতে উঠে বসুন।’

ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো না আমি কোথায় গিয়েছিলাম। জানতে চাইলো না কোনো কিছুই। আমি চাচ্ছি উনি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করুক। তাই আর আমি গাড়িতে উঠে বসলাম না। দাঁড়িয়ে থাকলাম আগের মতোই। ধ্রুব ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে আমার দিকে তাকায়। আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘আপনাকে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিল। আমার অতীত নিয়ে। আর আমার প্রাক্তন নিয়ে।’

ধ্রুব কিছু বলার আগেই ধ্রুবর পেছনের রাস্তা দিয়ে রাফিন ভাই দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। কন্ঠে অস্থির ভাব নিয়ে হড়বড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘কেমন আছেন ভাবি? সাদাফকে দেখেছেন? কতক্ষণ ধরে ওকে খুঁজে যাচ্ছি।’

আমি থমকে গেলাম। অপ্রস্তুত হয়ে তাকালাম ধ্রুবর দিকে। সে আগের মতোই স্বাভাবিক। বাঁকা হয়ে রাফিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ইতস্তত করে করে বললাম-

‘সামনের রেস্টুরেন্টে।’

রাফিন ভাই হন্তদন্ত হয়ে চলে যেতে নিলেই ধ্রুব তাকে ডাকলেন-

‘এই যে শুনুন। ভাবির সাথেই কথা বলে চলে যাবেন! ভাইয়ের সাথে পরিচিত হবে না!’

সাদাফ থতমত খেয়ে যায়। একবার আমার দিকে আরেকবার ধ্রুবর দিকে চেয়ে মিনমিনিয়ে বলল-

‘অহহ আপনিই ধ্রুব? সাদাফ বলেছিল আপনার কথা। আচ্ছা অন্যদিন পরিচিত হবো। আজ একটু তাড়া আছে।’

রাফিন ভাই চলে গেলেন ব্যস্ত পায়ে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম হতভম্ব হয়ে। ধ্রুব গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললেন-

‘এখানে না দাঁড়িয়ে থেকে চলুন অন্য কোথাও যেয়ে কথা বলি।’

আমি চুপচাপ ধ্রুবর কথা মতো গাড়িতে উঠে বসলাম। ধ্রুব এবারও কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কেন রাফিন ভাই আমাকে ভাবি ডাকলেন! কেন সাদাফের খবর আমি জানি! কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। বেশ খানিকটা পথ নিস্তব্ধতায় পাড় হলো। ধ্রুব ড্রাইভিং করছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। আমি কিছুক্ষণ হাসফাস করতে করতে বললাম-

‘আপনি সব জানতেন তাই না!’

ধ্রুব কোনো জবাব দিলেন না। আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। যেন তিনি একাই এই গাড়িতে বসে আছেন। আমি নামক কোনো ব্যক্তি তার পাশে নেই। তিনি আপনমনেই গাড়ি ড্রাইভ করছেন। হঠাৎই একটা ব্রিজের পাশে এসে গাড়ি থামালেন। আমার দিকে ঘুরে সহজ গলায় বললেন-

‘হ্যাঁ জানি তো। আগে থেকেই জানি।’

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম-

‘সব জেনেও এতদিন কিছু বললেন নি কেন?’

‘কিছু বলেনি কারণ আমার বিশ্বাস ছিল আপনি নিজেই সব কিছু ঠিক করে নিবেন। মনে হচ্ছে সব ঠিক হয়ে গেছে। কি হয়নি ঠিক!!’

ধ্রুব তার ভ্রু জোড়া নাচিয়ে কিছুটা ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। আমি সরু চোখে ওনাকে দেখলাম। বরাবরের মতোই তার ঠোঁটে সহজ সরল হাসি। এই হাসির পেছনে যে মানুষটা আরও কত কিছু লুকিয়ে রেখেছেন এক মাত্র আল্লাহ তায়ালা আর তিনি নিজেই জানেন। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করলাম-

‘সাদাফের সাথেই আমার সম্পর্ক ছিল এটা কবে থেকে জানেন?’

‘বিয়ের আগে আগে থেকেই জানি। তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছিলাম যেদিন সাদাফ আপনার হাত ধরেছিল ভার্সিটির মাঠে সেদিন। তোমাদের দেখে আমি চলে এসেছিলাম। তোমাদের মাঝে কথা বলতে চাইনি৷ কারও ব্যাক্তিগত আলাপে না যাওয়াটাই বেটার মনে করেছি। আর আপনি নিজেই সামলে নিতেন তাই চলে এসেছিলাম।’

ধ্রুবর কথা প্রচন্ডরকম অবাক হলাম। বিস্মিয়ের চোখের ওনার দিকে চেয়ে গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

‘বিয়ের আগে জেনেছেন মানে? কাছ থেকে জেনেছেন? সাদাফের কথা তো তেমন কেউ জানতো না।’

ধ্রুবর সোজা হয়ে বসলেন। রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন-

‘বলেছে খুব কাছের একজন। আপনার খুব প্রিয় একজন মানুষ।’

আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম কে হতে পারে সেই মানুষ যে কি-না আমাদের সম্পর্কে জানে। সানি? নাহ ও তো ধ্রুবকে চিনতোই না। তাহলে কি ভাইয়া? তবে ভাইয়ার সাথেও তো ধ্রুবর তেমন একটা পরিচয় ছিলো না। তাহলে আর কে হতে পারে? আমি কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে বললাম-

‘বলুন না কে বলেছে আপনাকে এসব?’

চলবে….

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৭
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘আম্মু বলেছে মানে আপনার মনি মা।’

ধ্রুবর জবাবটা যেন মেঘহীন আকাশে শুকনো বজ্রপাতের মতো শোনালো। আকাশ থেকে পড়ার মতো বিস্মিত হলাম আমি। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম ধ্রুবর মুখের দিকে। আমার চমকে যাওয়াতে মৃদু হাসলেন তিনি৷ তবে কিছু বললেন না খুব স্বাভাবিকভাবেই বসে থাকলেন। আমার মস্তিষ্ক তার সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে অচল হলো। মনি মা কিভাবে জানেন! আর এতদিন কি ভেবেছেন আমাকে নিয়ে! এসব নিয়ে কোনো চিন্তাই করতে পারলাম না৷ অনুশোচনা আর লজ্জাবোধে গলার স্বর আটকে গেল কণ্ঠনালীতে। অপরাধ বোধে চোখের দৃষ্টি হলো নত। ধ্রুব আমার গালে আঙুল দিয়ে গুতো দিতেই আমার হুশ ফিরলো৷ আমি ভ্রু কুচকে ওনার দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গেই উনি বাঁকা দাঁত বের করে মন কাড়া একটা হাসি দিলেন। তিনি সব সময় এভাবে বাঁকা দাঁত বের করে হাসেন না। বেশিরভাগই মৃদু হাসেন তাই এই বাঁকা দাঁত বেশি একটা দেখাও যায় না। আমি নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করলাম-

‘মনি মা কিভাবে জানেন? আপনার এত এত রহস্য ভালো লাগছে না আমার৷ দয়া করে সব কিছু খুলে বলুন তো।’

ধ্রুব আমার কথার অন্য মানে বের করলেন। দুষ্টু হাসি দিয়ে রসিকতা করে বললেন-

‘ছিঃ এসব কি বলছেন? আমাকে সব খুলে কথা বলতে বলছেন!! ছিঃ ছিঃ লজ্জা করে না আপনার!’

ধ্রুবর কথার ভাবার্থ বুঝতে আমার সেকেন্ড কয়েক সময় লাগলো। ওনার কথা বুঝতেই মনে মনে একটা কথা বললাম- ‘অসভ্য লোক’। আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম মানুষটার দিকে। তিক্ত গলায় বললাম-

‘রসিকতা করছেন আমার সঙ্গে!’

‘আপনি কি আমার বিয়াইন না-কি যে আপনার রসিকতা করবো?’

ধ্রুবর পালটা জবাবে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। উনি এবার শব্দ করেই হাসলেন। পুরো গাড়ি রঞ্জিত হলো তার হাসিতে। আমি বিরক্তি নিয়ে ওনার হাসি মুখে স্থির চেয়ে থাকলাম। দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। হতাশ হয়ে ক্লান্ত গলায় বললাম-

‘মজা না করে যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দিন প্লিজ।’

ধ্রুব হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসলেন। খানিকক্ষণ চুপ থেকে আমার দিকে শীতল চাহনি দিয়ে বললেন-

‘সেদিন পার্কে আম্মু হয়তো আপনাদের কথা শুনেছিল। বাসায় এসে আমার আর সাদাফের ট্যুরের ছবি দেখিয়ে বলল সাদাফ আপনাকে কষ্ট দিয়েছে। আপনাকে একা রেখে চলে গেছে। আরও নানান কথা বলে সাদাফের প্রতি ভীষণ আক্ষেপ আর রাগ প্রকাশ করেছে। আমি আম্মুর কথা বিশ্বাস করিনি। তবুও একবার সাদাফের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর নাম্বার বন্ধ থাকায় আর কথা হয়নি। পরে এসব নিয়ে আর কোনো মাথা ঘামাইনি। তবে দিন দিন আপনার প্রতি তুলতুলের পাগলামি দেখে আম্মু একদিন হঠাৎ করেই আমাদের বিয়ের কথা বললেন। আমি সেটাও গুরুত্ব দেইনি। ভেবেছিলাম আপনি যেহেতু অন্য কাউকে ভালোবাসেন তাই হয়তো বিয়েতে রাজি হবেন না। কিন্তু আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে আপনি বিয়েতে রাজি হলেন। আর সেদিনই আম্মু আমাকে বলে দিয়েছিল আমি যেন আপনার থেকে দূরে দূরে থাকি। স্বামীর অধিকার না খাটাই। আপনাকে যেন অতীত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সময় দেওয়া হয়। আপনাকে আপনার মতো করে থাকতে দেওয়া হয়। আরও অনেক অনেক হুকুম দিয়েছিল। আর সে জন্যই ওদিন রেস্টুরেন্টে ওসব শর্ত দিয়েছিলাম যেন আপনি নিজেই নিজেকে আমার থেকে দূরে রাখেন।’

ধ্রুব কথা গুলো শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম স্থির হয়ে। মনি মা সব জানেন বলেই কি আমাকে সব কিছুতে এত এত ছাড় দিয়েছেন? আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেই কথার ঝুলি খুলে বসেছে। সব সময় আমাকে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বলেছে। আমাকে মনমরা থাকতে দেখে তুলতুলকে আমার কোলে এনে দিয়েছে। আমার নিজের প্রতি অবহেলায় কড়া গলায় শাসন করেছেন। সংসার নামক কোনো দায়িত্বের যাতা কলে আমাকে পিশে যেতে দেয়নি। নিজেকে গুছিয়ে নিতে সময় দিয়েছে। একটা মানুষের কি আদোও এতটা ভালো হওয়া উচিত! এই স্বার্থপরের দুনিয়ায় কি আদোও এতটা ভালো মনের মানুষ হওয়া মানায়? আমি কোনো উত্তরই খুঁজে পেলাম না। আচমকাই হাতে টান অনুভব করলাম। আমি পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম ধ্রুব বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।

‘বারিয়ে আসুন। একটু হাঁটাহাঁটি করি।’

আমার প্রতিত্তোরে অপেক্ষা না করেই ধ্রুব আমার হাত ধরে আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিলেন। ফাঁকা ফ্লাইওভার ব্রিজ। নিচে ছোট খাটো একটা নদী। মতুন ব্রিজ তাই হয়তো গাড়ি চলাচল খুবই কম। মিনিট খানেক পর পর একটা দুটো করে গাড়ি শাই শাই শব্দে চলে যাচ্ছে। আমরা বেশ খানিকটা সময় ব্রিজের পাড় ধরে হাঁটলাম। পুরোটা সময় ছিলাম নিশ্চুপ। কথা বলার মতো কোনো কিছুই খুঁজে পেলাম না আমি। আমার নিশ্চুপতা দেখে ধ্রুব হাঁটতে হাঁটতে শান্ত গলায় বললেন-

‘যেদিন আপনি তুলতুলের জন্য নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে আমাকে বিয়ে করেছেন। সেদিনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম আপনি কখনও তুলতুলকে ছেড়ে যাবেন না। সাদাফ ফিরে এলেও না। আপনার প্রতি আমার আর আম্মুর যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল। তাই আপনাকে কখনও আপনার অতীত নিয়ে কিছু বলিনি আর আপনার মনের উপর জোর খাটাইনি। তাই এসব নিয়ে বেশি ভাববেন না।’

আমি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ধ্রুবর কথা গুলো মন দিয়ে শুনলাম। গলার স্বর নামিয়ে মিহি কন্ঠে বললাম-

‘আমি কি এসব কিছুর যোগ্য!’

ধ্রুব তার হাঁটা থামিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। খানিকটা ঝুঁকে মুখোমুখি হয়ে আমার মাথায় আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-

‘অবশ্যই যোগ্য। আর যোগ্য বলেই তো বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছো সানসাইন। কোনো ঝামেলা না করে সব কিছু কত সুন্দর করে সামলিয়ে নিয়েছো। তুমি চাইলেই আমাদের অগোচরে সাদাফের সাথে রিলেশন রাখতে পারলে। আমাদের ছেড়ে ওর কাছে চলে যেতে পারতে। কিন্তু তুমি তা করনি। তুমি তা-ই করেছো যা তোমার কাছে সঠিক মনে হয়েছে।’

কেউ আমার উপরে এতটা বিশ্বাস করে ভেবেই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এখনই বোধহয় গড়িয়ে পরবে চোখের জল। কান্না করতে ইচ্ছে হলো খুব। মুখ গুজে কান্না করার জন্য ধ্রুবকেও পেলাম সামনে। কোনো দ্বিধাবোধ না করেই ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুজেই কান্না করে দিলাম। নিঃশব্দে চোখের জল বিসর্জন দিতে লাগলাম। ধ্রুব বোধহয় সব সময়ের মতোই মৃদু হাসলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ধিরে ধিরে। আমার নিঃশ্বাস গাঢ় হতে লাগল। কান্নাজড়িত গলায় থেমে থেমে বললাম-

‘আমাকে এতটা বিশ্বাস করার জন্য ধন্যবাদ। আপনি অনেক ভালো।’

ধ্রুব হাসতে হাসতে বললেন-

‘ভালো না হলেই কি বার বার আমার পারসোনাল বুকটাকে সাগর বানাতে দেই না-কি!’

দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে অথচ কলিং বেল বাজাতে সাহস পাচ্ছি না। চেনা মানুষকেই আজ আবারও নতুন করে চিনলাম তাই কিছুটা ইতস্ততবোধ করছি। আকাশ-পাতাল চিন্তাভাবনা করে অবশেষে কলিং বেল বাজালাম। কয়েক সেকেন্ড পেরুতেই মনি মা দরজা খুললেন। আমাকে দেখেই বিরক্তি নিয়ে বললেন-

‘দেরি করলে কেন আজ? খাবার খেয়েছিস নাকি না খেয়েই বাদরটার সাথে ঘুরেলি? যে বেখেয়ালি একটা ছেলে জন্ম দিয়েছি মনে হয় না তোর আর তার নিজের খাবার-দাবারের প্রতি কোনো খেয়াল আছে। পুরো বাপের ফটোকপি হয়েছে।’

আমি মনি মা’র সকল কথা অগ্রাহ্য করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ওনাকে। মনি মা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন-

‘কিরে অসুস্থ লাগছে! না-কি মন খারাপ কোনটা?’

আমি জবাব দিলাম না। চুপ করে কিছুক্ষন মনি মা’কে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। মিনিটখানেক পর ওনাকে ছেড়ে সোজা হয়ে হাসি দিয়ে বললাম-

‘কিছু না। তুমি খুব ভালো মনি মা।’

মনি মা তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-

‘তুইও দেখি ওই বাপ-ছেলের মতোই হচ্ছিস। পাম দেওয়া শিখে যাচ্ছিস। আমাকে এসব পাম দিয়ে কোনো লাভ নেই। যা হাত মুখ ধুয়ে আয় আমি খাবার দিচ্ছি।’

মনি মা চলে গেলেন রান্নাঘরে। বিরক্তি নিয়ে এটা ওটা বলেই যাচ্ছেন একের পর এক। আমি সেদিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসলাম। এরা মা ছেলে দুজন এতটা স্বাভাবিক থাকে কিভাবে সবসময়! সব কিছু জেনেও এমন একটা ভাব যেন তারা কিছুই জানে না। এসব কি আমাকে অস্বস্তিতে না ফেলার জন্যই করেন? আমি হাসি মুখে চলে গেলাম রুমে। আবারও যেন নতুন করে সব কিছু শুরু হলো। পুরো বাড়িটাই যেন নতুন নতুন মনে হতে লাগলো। মনের ভেতর আলাদা এক প্রশান্তি অনুভব করলাম। এই বাড়ির মানুষ গুলো সাথে থাকলে আমি কখনোই ভেঙে পরবো না। এক এক জন আমার ডাল হয়ে আগলে রেখেছে আমাকে। প্রকাশ্র নয় অগোচরেই আমাকে আগলে রেখেছে প্রতিটা সময়।

চলবে…

শেষ রাত পর্ব-১২+১৩+১৪

0

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১২
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘অনুপাখি শুনছো! ভালোবাসি।’

অসময়ে কাঙ্ক্ষিত এই কথাটা শোনা মাত্রই খাঁ খাঁ করে উঠলো কান দুটো। যেন জ্বলন্তআগুনের শিখা ঢেলে দিয়েছে কান দু’টোতে। মূর্তির ন্যায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। নোনাজলের স্রোতে ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম সামনের মানুষটার দিকে। ঠোঁটের কোণে মনকাড়া হাসির রেখা টেনে দাঁড়িয়ে আছে সাদাফ। চোখদুটোতে তার অসীম মুগ্ধতা। হাসি মুখে এগিয়ে এলো সে। আমাকে নিরুত্তর নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিকটা ঝুঁকে মুখোমুখি হলো। আমার ডান গালে হাল্কা টান দিয়ে অত্যন্ত নরম গলায় বলল-

‘কি হলো অনুপাখি? বিশ্বাস হচ্ছে না আমি এসেছি!’

সাদাফের স্পর্শে পুরো শরীর অস্বাভাবিক ভাবে কেঁপে উঠলো। তার ছোঁয়া কাঁটার মতো বিঁধলো গায়ে। মস্তিষ্কের পুরোটা জায়গায় এলোমেলো হয়ে ছুটতে লাগলো একটাই কথা। আমাকে স্পর্শ করা তার উচিত হয়নি। মোটেও উচিত হয়নি। অনুচিত ভীষণ অনুচিত এই স্পর্শ। আমি ধ্রুব স্ত্রী। ধ্রুব হাসানের স্ত্রী আমি। আমাকে স্পর্শ করার অধিকার সাদাফের নেই। একদমই নেই।

‘এই যে কোথায় হারিয়ে গেলে?’

সাদাফ আবারও গালে টান দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে। সাদাফের কন্ঠে আমার হুশ ফিরলো। সচল হলো আমার মস্তিষ্ক। তৎক্ষনাৎ সাদাফের হাত এক ঝাটকায় সরিয়ে দিয়ে দু এক পা পিছিয়ে গেলাম। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম তার দিকে। আকাশসম অভিমান আর রাগের নিচে চাপা পরে গেল আমার কন্ঠস্বর। এতদিন ধরে জমিয়ে রাখা সকল কথা হঠাৎ করেই যেন স্মৃতির পাতা থেকে মুছে গেল৷ ভুলে গেলাম আমি সব কিছু।
সাদাফ দু’হাত উঁচু করে রসিকতার ভঙ্গিতে বলল-

‘ওকে ধরবো না তোমার গাল৷ রাগে তো দেখছি একদম আইটেম বোম হয়েছে আছো। একটা প্রবাদ শুনেছো নিশ্চয়ই- যাহার মস্তিষ্কে রাগের পাহাড়, তাহার মস্তিষ্কে’ই ভালোবাসার শৃঙ্গ। তবে যাইহোক রাগলে তোমাকে ভীষণ কিউট লাগে। বিশেষ করে তোমার টমেটোর মতো গাল গুলো।’

আমি এবারও চুপ করে রইলাম। সাদাফকে বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। মস্তিষ্কে ঘুরছে হাজারো কথা তবে সব কিছুই এলোমেলো। দলা পাকানো।
সাদাফ হাত নামিয়ে পকেটে গুঁজে দিলো। নিখুঁত চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষন। কন্ঠে কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে বলল-

‘কি ব্যাপার! তোমাকে আজ একটু ভিন্ন লাগছে। একটু ভিন্নরকম সুন্দর লাগছে। আগের থেকেও যেন দ্বিগুণ সুন্দর হয়ে গেছো। তবে শুকিয়ে গেছো অনেকটা। চোখের নিচে কালিও পরেছে। আচ্ছা তুমি কি অসুস্থ! ঠোঁট গুলো কেমন ফ্যাকাসে শুকনো লাগছে। তোমাকে দেখেই কেমন জ্বর জ্বর ভাব লাগছে। জ্বর এসেছিলো না-কি? আমি কি তোমার কপালে হাত রাখতে পারি অনুপাখি!’

সাদাফের কথায় তিক্ততায় থিতিয়ে গেল মন। বিস্মিত হলাম বেশ খানিকটা। সামান্য একটু সময়েই সব কিছু এতটা নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ কীভাবে করলো সাদাফ! আগেও কি এভাবেই সব কিছু খেয়াল করেছিলো? মনে পরছে না। হাতে চেপে রাখা ফোনটা তীক্ষ্ণ সুরে বেজে উঠল। ব্যাঘাত ঘটালো আমার ভাবনায়। ফোনটা চোখের সামনে তুলে আনতেই কিছুক্ষনের জন্য থমকে গেলাম। চোখজোড়া স্থির হলো ফোনের স্কিনে ভেসে ওঠা ‘তুলতুলের আব্বু’ লেখাটার দিকে। নির্জীবের মতোই আমি ফোন রিসিভ করে কানের কাছে ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গেই ধ্রুবর নির্লিপ্ত কন্ঠেস্বর শোনা গেল।

‘তুলতুলের আম্মু! আমি গেইটের কাছে গাড়িতে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি চলে আসুন।’

আমার গলার স্বর ফুটলো। অস্ফুটস্বরে ছোট্ট করে বললাম-

‘হুম আমি আসছি।’

ফোনে রেখে দেওয়া মাত্রই সাদাফ মন খারাপ করে উদাসীন গলায় বলল-

‘চলে যাবে? আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়না আনুপাখি? আমার সাথে তো একটুও কথা বললে না। ভালোবাসি বললাম তা-ও কিছু বললে না। এত অভিমান কেন তোমার? আরও সময় লাগবে অভিমান ভাঙতে!’

আমি নিজেকে যথাসাধ্য গম্ভীর করে নিলাম। ফোনটা ব্যাগে রেখে ভারি কন্ঠে বললাম-

‘আমি তোমাকে জাস্ট একটা কথাই বলবো সাদাফ। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি আর আমার কাছে আর এসো না।’

কথাটা বলে আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম না সাদাফের ভাবভঙ্গি। আশেপাশের সব কিছু উপক্ষা করে নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে চললাম আমার সঠিক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। ভার্সিটি থেকে বের হতেই রাস্তায় ডান পাশে গাড়ি দাঁড় করানো দেখলাম। ধ্রুব আমাকে দেখামাত্রই জানালা দিয়ে হাত বের করে নাড়লেন। আমি এগিয়ে গেলাম। গাড়ির কাছে এসেই নিঃশব্দে সামনের সিটে বসলাম। ধ্রুব আমার দিকে ঝুঁকে এলেন। ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমার কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন-

‘জ্বর আছে এখনো!’

আমি বরাবরের মতোই তার স্পর্শ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে ইতস্তত করে বললাম-

‘আমি ঠিক আছি। এখন জ্বর নেই।’

‘জ্বর নেই তাহলে মুখ এমন ফ্যাকাসে বিবর্ণ হয়ে আছে কেন?’

ধ্রুবর প্রশ্নে আমি নিরুত্তর হতাশ মুখ নিয়ে বসে রইলাম। আমার মনে হলো ধ্রুব বুঝবে আমার পরিস্থিতি। আমার নিশ্চুপ থাকার কারণ। ঠিক তাই হলো। ধ্রুব আর কোনো কথা বাড়ালো না। সে হয়তো বুঝেছে এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা ঠিক হবে না। আমাকে চুপ থাকতে দেওয়াই এখন শ্রেয়। মানুষটা সব কিছুই বুঝতে পারে। সব কিছুরই খেয়াল রাখে সে।

বাসার সামনে এসে গাড়ি থেকে নামতেই ধ্রুব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-

‘জ্বর কমেছে। আবার যেন ঘাড়ে ভূত চেপে না বসে। তাহলে এবার সত্যি সত্যিই চড় দিয়ে সেই ভূত নামাবো।’

ধ্রুব আমার কোনো কথার অপেক্ষা না করেই গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। আমি স্থির চেয়ে রইলাম তার যাওয়ার পথে। ওনার কথার মানে কি হুমকি ছিল না-কি কেয়ার! ঠিক বুঝতে পারলাম না। ছোট্ট করে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে বাসায় চলে আসলাম। রুমে ব্যাগ রেখেই চলে গেলাম মনি মা’র রুমে। মাত্রই ওয়াশরুম থেকে বের হলেন তুলতুলকে কোলে নিয়ে। আমাকে দেখেই মনি মা ক্লান্তিমাখা স্বরে বললেন-

‘অনু তুই কি কাল আমার সাথে একটু মার্কেটে যেতে পারবি? ইদানিং প্রচন্ড গরম পরেছে তুলতুলের জন্য হাল্কা পাতলা কিছু জামা কিনতে হবে। ওরা বাপ ছেলে নাকি কাল অফিসের কাজে খুব বিজি থাকবে। সময় হবে না ওনাদের।’

আমি বিছানায় বসে তুলতুলের ভেজা শরীর মুছতে মুছতে বললাম-

‘এ নিয়ে তুমি চিন্তা করো না মনি মা। কাল কখন যাবে আমাকে বলে দিও আমি রেডি হয়ে থাকবো।’

রাত প্রায় দশটা। বারান্দার আবছায়া আলোয় দাঁড়িয়ে আছি। এলোমেলো একটা মস্তিষ্ক আর বিষন্নতায় ঘেরা মন নিয়ে। ধ্রুব রুমে ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। তুলতুল মেয়েটাও ঘুমিয়ে পরেছে। মেয়েটা ঘুমিয়ে থাকলেই সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মস্তিষ্কে তখন হানা দেয় পুরনো সব কথা। বিষাদে ছেয়ে যায় চারপাশ। সব কিছুতেই তখন থাকে বিষন্নতা।

‘নিন’

আমি ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকাতেই ধ্রুব আমার দিকে কফির মগ বাড়িয়ে দিলেন। আমি মলিন হেসে কফির মগ হাতে নিলাম। আবারও দৃষ্টি দিলাম অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের দিকে। নিরবতায় কেটে গেল মিনিট পাঁচেক সময়। নিস্তব্ধতা ভেঙে ধ্রুব স্বাভাবিক ভাবে বললেন-

‘আপনাকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম কিন্তু সেদিন উত্তর পাইনি।’

আমি জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ধ্রুব বুঝলেন আমার দৃষ্টির মানে আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন-

‘আপনার প্রাক্তন এসে সব কিছু ঠিক করে দিলে কি আপনি তার কাছে ফিরে যাবেন?’

তপ্ত শ্বাস ফেললাম। কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে বাকিটুকু রেখে দিলাম টেবিলের উপরে। আবারও বারান্দার রেলিঙের হাত দিয়ে দাঁড়ালাম। ডান পাশের বেলি গাছটায় দৃষ্টি স্থির করে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলাম-

‘আপনার এই বেলি গাছ গুলোতে একদিনও ফুল ফুটতে দেখলাম না। কিন্তু কেন?’

ধ্রুব আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। হাল্কা হেসে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল-

‘যত্ন করা হয়নি তাই। এবাসায় শিফট করার পর নানান কাজ আর বিয়ে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম সবাই। একারণেই আর গাছের সঠিক যত্ন নেওয়া হয়নি। তবে এখন যেহেতু আপনি আছেন তাই আমার বেলি গাছের দায়িত্ব এখন থেকে আপনার।’

আমি ধ্রুব কথার প্রতিত্তোরে মৃদু হাসলাম। আবারও দু’জনই ডুব দিলাম নিরবতার অতলে গহ্বরে। এভাবেই হয়তো শেষ হবে আমাদের রাত। অনুভূতিহীন, ভালোবাসাহীন রাত।

মার্কেটে মানুষের ভীড় আর হৈচৈয়ে অস্থির হয়ে তুলতুল কেঁদেকেটে অস্থির করে ফেলছে। হেঁচকি তুলে দম আটকানো কান্না। কোনো কিছুতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না। মনি মা এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিলেন। তুলতুলকে আমার কোলে দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন-

‘মা তুই যা তো ওকে নিয়ে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আয়। আমি কেনাকাটা শেষ করে তোকে ফোন দিবো।’

আমি মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে আসলাম। মার্কেটের বাহিরের ফাঁকা জায়গা তুলতুলকে নিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতেই তুলতুল থেমে গেল। ক্লান্ত হয়ে ঘাড় কাঁত করে শুইয়ে রইলো আমার কোলে। একটু পর পর বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। আমি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে পায়চারি করছি। সূর্য ঢলে পরছে পশ্চিম আকাশে। রক্তিম বর্ণে রঙিন হচ্ছে পশ্চিমাকাশ।

‘এখানে কি করছো অনুপাখি?’

সাদাফের কন্ঠ শুন্স চমকে পাশ ফিরে চাইলাম। আশ্চর্য যার মুখোমুখি হতে চাচ্ছি না বার বার তার কাছে এসেই কেন ধরা দিতে হয়! এসব কি কাকতালীয় ব্যাপার? নাকি অন্য কিছু!

‘কি হলো এভাবে ভূত দেখার মতো চোখ বড় বড় তাকিয়ে আছো কেন?’

আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম-

‘তুমি এখানে কি করছো?’

‘একটু কেনাকাটা করতে এসেছিলাম। এই কিউটিপাই-টা কে?’

সাদাফ আমার দিকে এগিয়ে এসেই তুলতুলের গালে টান দিল। তুলতুল মাথা তুলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো সাদাফের দিকে। সাদাফ মুখের নানান রকম ভঙ্গিমা করে তুলতুলকে হাসানোর চেষ্টা করছে। তার চেষ্টা সফল হলো। তুলতুল খিলখিল করে হেসে উঠলো সাদাফের দিকে চেয়ে। সাদাফ আমার দিকে চেয়ে মিষ্টি করে বলল-

‘বিয়ের পর আমাদের বাবুও এমন হবে দেখে নিও। একদম তোমার মতো কিউটিপাই।’

আমি চোখমুখ কঠিন করে শক্ত গলায় বললাম-

‘আমাদের বিয়ে হবে না সাদাফ। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আর তুলতুল আমার মেয়ে।’

সাদাফ ঝংকার তুলে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে তার মুখ আর কান দুটো লাল হয়ে আসলো। কোনো রকম হাসি থামিয়ে এক প্রকার জোর করেই তুলতুলকে আমার কাছ থেকে নিয়ে নেয়। তুলতুলের গালে শব্দ করে কয়েকটা চুমু খেয়ে বলল-

‘এই কিউটিপাইয়ের নাম তাহলে তুলতুল? নামটাও একদম ওর মতোই কিউট। আর হ্যাঁ কি যেন বললে ও তোমার মেয়ে? যদিও তোমার মতোই দেখা যায় তবে এটা আরেকটু বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো যদি আমি কয়েক বছরের জন্য বিদেশ যাত্রা করে ফিরতাম তাহলে।’

‘আমার বিয়ে হয়ে গেছে সাদাফ। কেন বিশ্বাস করছো না?’

আমি দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বললাম। সাদাফ ঠোঁট চেপে হাসি থামানোর চেষ্টা করছে। আমার রাগ দেখে যেন ভীষণ মজা পাচ্ছে সে। সাদাফের হাসি থেকে তরতর করেই আমার মাথায় রাগ উঠে গেল। আমি আবারও রাগান্বিত কন্ঠে বললাম-

‘হাসি বন্ধ করো সাদাফ। আমার কথা তোমার হাসির মনে হচ্ছে? আমি কি কৌতুক করছি তোমার সাথে?’

সাদাফ হাসি থামলো। ঠোঁটে চাপা হাসি নিয়ে বলল-

‘আচ্ছা আচ্ছা মানলাম তোমার বিয়ে হয়েছে। এটা তোমার মেয়ে। আর তোমার স্বামী। চলো এবার বাসায় যাই।’

কথাটা বলেই সাদাফ আবারও হাসা শুরু করলো। আমি জ্বলন্ত চোখে সাদাফের হাসি মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। আচমকাই আমার ফোন ভেজে উঠলো। আমি তুলতুলকে সাদাফের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। পেছন থেকে সাদাফ হাসতে হাসতে বলল-

‘আমি, তুমি আর তুলতুলকে নিয়ে আমাদেরও সুখের সংসার হবে অনুপাখি। খুব শীগ্রই হবে।’

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৩
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘আমি, তুমি আর তুলতুলকে নিয়ে আমাদেরও সুখের সংসার হবে অনুপাখি। খুব শীগ্রই হবে।’

আমি থমকে দাঁড়ালাম৷ পেছন ফিরে দেখলাম সাদাফের প্রাণোচ্ছল হাসি। এই প্রথম ঘৃণা করলাম আমি সাদাফকে। জীবনে প্রথম কাউকে ঘৃণা করলাম। সেটাও আবার আমার ভালোবাসার মানুষকেই। ঘৃণার দৃষ্টিতে সাদাফের দিকে চেয়ে শক্ত গলায় বললাম-

‘তুমি আজও সব কিছুতে হেয়ালি করছো সাদাফ। তোমার অবহেলা পেয়েও আমি সব সময়ের মতো ভালোবাসা নিয়ে তোমার ফিরে আসার অপেক্ষা করতে পারিনি। শেষ দিনের কথাটা খুব হাস্যকর ভাবেই সত্যি হয়ে গেল সাদাফ। তুমি ফিরে এসে আমাকে আর পাওনি। আমি এখন অন্যকারো অর্ধাঙ্গিনী। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। এটা তোমাকে মানতেই হবে আজ না-হয় কাল। সত্যিটা তোমাকে মেনে নিতেই হবে। তেতো হলেও মানতে হবে। কষ্টের হলেও মানতেই হবে সাদাফ।’

সাদাফ তার হাসি থামিয়ে বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইলো আমার দিকে। কয়েক পা এগিয়ে এসে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে-

‘তুমি আমাকে শায়েস্তা করার জন্য এমনটা করছো তাই না অনন্যা!’

আমি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসলাম। তুলতুলের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে সহজ গলায় বললাম-

‘তোমার আমার কখনও সুখের সংসার হবে না। তুলতুলের আব্বু কখনই তা হতে দিবে না। আর তুলতুলের আম্মু কখনই তুলতুলকে ছাড়বে না।’

কথাটা বলেই আমি চলে আসলাম মনি মা’র কাছে। তুলতুলকে মনি মা’র কোলে দিয়ে আড়ালে এসেই কল করলাম সানিয়াকে। দু-তিন বার রিং বাজতেই কল রিসিভ হলো। সানিকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই আমি গম্ভীরমুখে বললাম-

‘শোন সানি! সাদাফ হয়তো তোর কাছে ফোন করবে৷ আমার বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে তুই সরাসরি বলে দিবি আমার বিয়ে হয়ে গেছে। ও যেন এই সত্যিটা মেনে নেয় ব্যস।’

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে সানিয়া বিরক্তি নিয়ে বলল-

‘সাদাফ ভাই কি এখনও বিশ্বাস করছে না তোর বিয়ের কথা?’

‘তোর কি মনে হয় সাদাফ এতসহজেই সব বিশ্বাস করবে?’

আমার পালটা প্রশ্নে সানিয়া হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। নিম্ন স্বরে বলল-

‘আচ্ছা আমি বলে দিবো। আর হ্যাঁ তোর বউ সাজের কিছু ছবি আছে আমার কাছে ওগুলো কি দেখাবো?’

‘তোর যা ভালো মনে হয়।’

আমি ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে কথাটা বলেই ফোন রেখে দিলাম। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পা বাড়ালাম তুলতুলের উদ্দেশ্যে। মেয়েটা আবারও কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে কি-না কে জানে!

অপেক্ষা করার মতো বিরক্তিকর আর যন্ত্রণাদায়ক হয়তো কিছু নেই। আমার প্রথম অপেক্ষা করা শুরু হয়েছে সাদাফের জন্য। আমাদের সম্পর্কের ছ’মাস চলছিলো তখন। হঠাৎ করেই একদিন সাদাফ বলল সে তার বন্ধুদের সঙ্গে তিনদিনের জন্য কক্সবাজার যাবে। আমি রাজি হয়েছিলাম। তবে খুব আকষ্মিকভাবেই খেয়াল করলাম কক্সবাজার যাওয়ার পর সাদাফ আমার সাথে পুরোপুরিভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ভয় পেয়েছিলাম খুব। কোনো দূর্ঘটনা হয়েছে কি-না ভেবেই আঁতকে উঠেছিলাম বার বার। ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছিলাম তিন দিন। নির্দিষ্ট সময়েই সাদাফ ফিরেছিল। সে ছিল স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করাটাও স্বাভাবিক। আমাকে ফোন দিয়ে নিজের খোঁজ খবর না জানানোও বেশ স্বাভাবিক। এর কারণ জানতে চাইলেই সহজ জবাব দেয়- ‘ঘুরতে গিয়েছিলাম তাই শুধু প্রকৃতিকেই অনুভব করতে চেয়েছি। এ কারণেই ফোন বন্ধ করে রেখেছিলাম।’ আমি রাগ করেছিলাম তারপর আবারও সব স্বাভাবিক। এর পর থেকে দু এক মাস পর পর তার ট্যুর দেওয়াই ছিল নিয়ম। যোগাযোগও বরাবরের মতোই ছিল বিছিন্ন। আস্তে আস্তে তার ট্যুর দেওয়ার সময় দীর্ঘ হতে লাগে। তিন দিন থেকে পাঁচ দিন। পাঁচ দিন থেকে সপ্তাহ খানেক। এভাবেই আমার অপেক্ষার প্রহর গুনা শুরু হয়। আজও অপেক্ষা করছি। তবে সাদাফ নয় ভিন্ন মানুষের জন্য। ধ্রুবর জন্য। সকাল সকাল বেরিয়েছে আব্বুর সাথে অফিসে কাজে। আব্বু সন্ধ্যা হতেই ফিরে এসেছে তবে ধ্রুবর এখনও ফিরেনি।

কলিং বেলের শব্দেই আমার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো। সোফা থেকে উঠে দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখলাম। বারোটা বেজে পনের মিনিট। আমি ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজা খুলতেই ধ্রুব খানিকটা উৎকন্ঠিত হয়ে বলল-

‘সরি অনেক দেরি হয়ে গেল। আসলে অফিসে…’

ধ্রুবকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আমি শান্ত গলায় বললাম-

‘সমস্যা নেই। আমি আপনার কাছে কোনো কৈফিয়ত চাইবো না। আমি যথাসম্ভব আপনার শর্তগুলো মেনে চলার চেষ্টা করবো।’

আমার কথা শুনে ধ্রুব অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলো। হয়তো কিছু বলতে চাচ্ছেন তবে পারছে না। ধ্রুব হতাশ হয়ে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে থমথমে পায়ে রুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে খাওয়ার মাঝে হঠাৎ করে বলল-

‘সেদিন আমি ওভাবে কথা গুলো বলতে চাইনি। আমার কথায় আপনি কিছু মনে করে থাকলে আমি সরি।’

আমি গ্লাসে পানি ঢেলে ধ্রুবর দিকে এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললাম-

‘আমি কিছু মনে করিনি। আপনি আপনার মতো থাকবেন এটাই আমাদের মাঝে শর্ত ছিল। তাই আপনাকে কোনো কিছু নিয়ে আমাকে কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন নেই।’

ধ্রুব নিশ্চুপ। খাবার শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল-

‘সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠবো। তাই কাল ড্রাইভার আপনাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিবে।’

আমি মাথা নাড়িয়ে ‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলতেই ধ্রুব ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে রুমে যায়।

ক্লাসের মাঝেই রাফিন ভাই আমাকে ক্লাস থেকে ডেকে আনে। মাঠের এক পাশে সাদাফকে আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে দিয়েই তিনি নিঃশব্দে চলে যান। আমি গম্ভীর পায়ে সাদাফের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম-

‘তুমি আবারও এখনে কেন এসেছো সাদাফ!’

আমার প্রশ্নে সাদাফের কোনো ভাবান্তর হলো না। শূণ্য দৃষ্টিতে স্থির তাকিয়ে রইলো আমার চোখের দিকে। তার চাহনিতে কোনো পরিবর্তন হলো না। শূন্য দৃষ্টিতেই তাকিয়ে থেকে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল-

‘আমি খোঁজ নিয়েছে। সবাই বলছে তোমার বিয়ে হয়ে গেছে৷ তোমার বউ সাজের ছবি দেখিয়েছে। আমি অন্য কারও কথা কিংবা কোনো ছবি কোনো কিছুই বিশ্বাস করি না। আমি শুধু তোমার মুখে সত্যিটা শুনতে চাই অনন্যা।’

‘তুমি যা শুনেছো সবটাই সত্যি। আমি তোমাকে আগেও অনেক বার বলেছি আমার বিয়ে হয়ে গেছে। কেন বিশ্বাস করছো না আমার কথা?’

আমার সহজ প্রতিত্তোরে সাদাফ খানিকটা হাসার চেষ্টা করলো। আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে জোড়ালো কন্ঠে বলল-

‘তুমি মজা করছো তাই না অনুপাখি!’

আমি খুব সাবধানে সাদাফের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। দু পা পিছিয়ে এসে তপ্ত শ্বাস ফেললাম। সাদাফের দিকে তাকাতেই হতভম্ব হলাম আমি। তার চোখদুটো ছলছল করছে। মুখটাও কেমন মলিন হয়ে আছে। হয়তো দোটানায় পরে গেছে। আমার বিয়ের কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে তবে তার মন হয়তো বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না এই কথা।

‘আমি মজা করছি না সাদাফ। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আর আমি এখন অন্য একজনের ওয়াইফ এটা তোমার বিশ্বাস করতেই হবে। তুমি চলে যাওয়ার বিশদিন পরেই আমার বিয়ে হয়। আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও ব্যর্থ হয়েছি।’

আমি তাচ্ছিল্যের সুরে কথা গুলো বলেই হাল্কা হাসলাম। সাদাফের চোয়ালে শক্ত হলো। মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়ে এলো তার মুখের ভঙ্গিমা। গম্ভীর থেকেই গম্ভীরতর হলো তার চাহনি। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলল-

‘বিয়ে হয়ে গেছে তোমার? অন্য কারও ওয়াইফ তুমি! এতটা সহজে বলে দিলে এসব! যাকে তাকেই বিয়ে করে নিবে। বিয়েটা কি তোমার কাছে ছেলেখেলা মনে হচ্ছে অনন্যা?’

‘ছেলেখেলা তো আমাদের সম্পর্কটা ছিল তোমার কাছে। দিনের পর দিন অবহেলা করেছো। ছন্নছাড়া ভাব নিয়ে আমার সাথে থেকেছো কয়েকটা বছর। আমার অনুভূতি, আমার অভিমান, অভিযোগ, রাগ কোনো কিছুরই গুরুত্ব তোমার কাছে ছিল না। ছেড়ে দিয়েছো আমাকে আমার মতো একা। একটা বার খোঁজ নিয়ে দেখো নি আমি কীভাবে তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি। কীভাবে অভিমান গুলোকে নিজের মনে চাপা দিয়ে থেকেছি এতটা দিন।’

সাদাফ কিছুটা সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পকেট থেকে ফোন বের করে আমার বউ সাজের ছবি আমার দিকে তুলে ধরে। ভীষণ শান্ত গলায় বলে,

‘তুমি বউ সেজেছো অন্য কারো জন্য? এই লাল শাড়ি সাজগোজ সব কিছু অন্য কারও জন্য? এতটাই অভিমান ছিল যে একেবারে অন্যকারো সাথে নিজের জীবন জড়িয়ে নিলে? এতটাই রাগ ছিল আমার উপর যে এত বড় একটা শাস্তি দিলে আমাকে!! আমার জন্য কি আর একটু অপেক্ষা করা যেতো না অনন্যা???’

সাদাফ লাস্টের কথাটা হুংকার দিয়ে বলেই ফোনটাকে মাটিতে আছাড় মা’রে। চোখের পলকেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল ফোন। রক্তিম হয়ে এলো সাদাফের চোখ দুটো। আজ প্রথম সাদাফের এমন রূপ দেখছি। তার হাসিখুশি মুখের পেছনে এতটা রাগ লুকিয়ে আছে আগে কখনই তা প্রকাশ পায়নি। আমি অপ্রস্তুত হয়ে খানিকটা দূরে সরে গেলাম। ভয় জড়ানো দৃষ্টিতে তাকালাম সাদাফের রাগান্বিত চেহারার দিকে। আশেপাশের দু একজন স্টুডেন্ট কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। সাদাফ চোখ বন্ধ করে কিড়মিড়িয়ে বলল-

‘আমার সামনে থেকে যাও অনন্যা। আমি চাই না রাগের মাথায় আমি তোমাকে আঘাত করি। আমি চাই না এই মুহুর্তে তুমি আমার সামনে থাকো। অনন্যা ক্লাসে যাও বলছি।’

সাদাফের ধমকে আমি কেঁপে উঠলাম। ভয়ে এলোমেলোভাবে পা ফেলে ফিরে আসলাম ক্লাসে। সাদাফেএ এমন রূপ দেখে আমার পুরো শরীর অসাড় হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। কিভাবে সামলাবো আমি সব কিছু? হতভম্ব হয়েই হাঁটতে লাগলাম। ক্লাসে এসে আবারও সানিয়ার পাশে মূর্তির মতো বসে রইলাম। সানিয়া নানানরকম প্রশ্ন করেছে তবে তার উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। গলার স্বর আটকে গেছে। এভাবেই নিস্তব্ধ হয়ে কাটয়ে দিলাম এক ঘন্টা। ক্লাস শেষ খানিকটা ভয় নিয়ে বের হলাম। সাদাফ এখনও মাঠে আছে কি-না ভেবেই চিন্তায় অস্থির হয়ে পরলো মস্তিষ্ক। সাদাফের এমন ভয়ংকর রাগ দেখার পর যেন আত্মা শুকিয়ে গেছে আমার। ভার্সিটির মাঠে সাদাফকে না দেখে মনে মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম। তবে এই স্বস্তি বোধ বেশিক্ষন টিকলো না। বড়সড় এক ধাক্কা খেলাম ভার্সিটির গেইট থেকে বের হয়েই। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে। চোখদুটোকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। পর পর কয়েকবার চোখের পলক ফেলে আবার দৃষ্টি স্থির করলাম সেদিকে। নাহ এটা কল্পনা না। আমি সত্যি দেখছি। ধ্রুব সাদাফের সাথে কোলাকুলি করছে। ভীষণ হাসি হাসি তাদের দুজনের মুখ। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেলাম আমি। কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। সাদাফের সাথে ধ্রুবর কি সম্পর্ক? ধ্রুব কি সাদাফকে চেনে? আর ধ্রুব হাসিমুখেই বা কেন কোলাকুলি করছে সাদাফের সঙ্গে?

চলবে..

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৪
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

একের পর এক ধাক্কা খেয়ে নিজেকে সামলাতে সময় লাগলো মিনিট খানেক। সাদাফের ভয়ংকর রাগী রূপ হজম করার আগেই এখন আবার আরেক নতুন চমক। আজ বোধহয় সবাই আমাকে চমকে দিতে দিতেই মা’রার প্ল্যান করেছে। মাথার মধ্যে ভনভন করেই ঘুরে যাচ্ছে হাজারো প্রশ্ন। ধ্রুব কেন হাসিমুখে জড়িয়ে ধরলেন সাদাফকে? আর সাদাফই বা স্বাভাবিক আছে কি করে! অতীতকে পিছু ছাড়তে চাচ্ছি তাহলে কেন অতীত এসে আমার বর্তমানে মিলে যাচ্ছে? এসব অতীত আর বর্তমানের মাঝে যেন পিষে যাচ্ছি আমি। অসহায় হয়ে পরেছি পরিস্থিতির কাছে। কে উদ্ধার করবে আমাকে এই দোটানার মধ্য থেকে!

‘তুলতুলের আম্মু এদিকে আসো।’

সাদাফের পাশ থেকেই ধ্রুব আমাকে দেখে হাত নাড়িয়ে ডাকলো। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি সেদিকে। সাদাফের দৃষ্টি আমার মাঝেই নিবদ্ধ সেটাও বুঝতে পারছি স্পষ্ট৷ ধ্রুব আবারও আমাকে ডাকলো। আর কোনো উপায় না পেয়ে আমি থমথমে পায়ে ধ্রুবর দিকে এগিয়ে যেতে গেলাম। ধ্রুবর তর সইলো না। সে নিজেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে আমার দিকে। আমার হাত ধরেই টেনে নিয়ে যায় সাদাফের কাছে। সাদাফের সামনে দাঁড় করিয়ে আমাকে এক হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। আমি যেন আরও স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বরফের ন্যায় জমে গেলাম আমি। তবে ধ্রুব বেশ আনন্দিত গলায় বললেন-

‘এই হলো আমার ওয়াইফ অনন্যা। কিছুদিন আগেই আমাদের বিয়ে হয়েছে।’

সাদাফ তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। তার চেহারাতে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে তার চমকিত ভাব। আমাকে হয়তো এখানে আশা করেনি। হয়তো কল্পনাও করেনি অন্য কোনো পুরুষের বাহুতে দেখবে নিজের অনুপাখিকে। এমনটা না ভাবারই কথা এতটা বছর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল আমাদের মাঝে৷ আর এখন কি-না আমি অন্য কারও স্ত্রী!
ধ্রুব আবারও বেশ উৎসাহ নিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বললেন-

‘ওর নাম সাদাফ। আমি লাস্ট ইয়ার ট্যুরে খাগড়াছড়ি গিয়েছিলাম সেখানেই ওর সাথে পরিচয়। সপ্তাহ খানেক এক সাথেই ঘুরে বেড়িয়েছি আমরা। খুব ভালো বন্ডিং হয় আমাদের মধ্যে।’

আমি অবাক হলাম। তার চেয়েও বেশি হলো রাগ। ইচ্ছে করছে দুজনকে একসাথে সারাজীবনের ট্যুরে পাঠিয়ে দেই। ট্যুর ট্যুর করে এরা দুজন আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলবে হয়তো। ধ্রুব আমাকে অস্বস্তিতে মিইয়ে যেতে দেখে বললেন-

‘তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে তুলতুলের আম্মু?’

আমি রবোটের মতো ডানে বায়ে মাথা নাড়লাম। সাদাফ মুখ খুললো। তার চমকিত ভাব চাপা দিয়ে ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করে-

‘কিছুদিন আগে বিয়ে হলো অথচ এখনই তুলতুলের আম্মু মানে!’

ধ্রুব তার সহজাত সহজ সরল হাসি দিয়ে বললেন-

‘পূর্নতার ডাক নাম তুলতুল। পূর্নতার কথা তো বলেছিলাম তোমাকে।’

সাদাফ নিম্নস্বরে আনমনা হয়ে ‘ওহ আচ্ছা’ বলেই আবারও চুপ করে রইলো। ধ্রুব ফের আমার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নিলেন। আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সাদাফকে বললেন-

‘আচ্ছা আজ যাই। তুলতুলের আম্মু ধুলোবালিতে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। এল্যার্জির প্রব্লেম হয়। তোমার সাথে অন্য কোনো একদিন সময় করে আড্ডা দিবো। আজ আসি।’

সাদাফ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই ধ্রুব আমাকে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। উনি নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। সাদাফ অপলক তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই চোখের আড়াল হয়ে গেল সাদাফের অস্তিত্ব। দূরে, অনেকটাই দূরে চলে আসলাম সাদাফের কাছ থেকে। চুপচাপ জানালার দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে বসে রইলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম ধ্রুব সাদাফের আসল পরিচয় পেলে কেমন রিয়েক্ট করবেন। তাদের বন্ধুত্ব নিশ্চয়ই থাকবে না। ধ্রুবকে কি এখন বলা উচিত সাদাফ আমার প্রাক্তন যাকে তিনি সহ্য করতে পারেন না। আচ্ছা পরে যদি সাদাফের কাছ থেকে সত্যটা জেনে যায় তখন কি তিনি আমাকে ভুল বুঝবেন! এসব কোনো প্রশ্নের উত্তরই আমার জানা নেই।
বেশ খানিকটা সময় পর ধ্রুব নিরবতা ভেঙে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন-

‘কি ব্যাপার! আপনি এতো চুপচাপ কেন আজ?’

ধ্রুবর কথায় শুনেই আমার রাগ হলো। মনে পরে গেক তার ট্যুরে যাওয়ার কথা। আমি ক্ষিপ্ত গলায় প্রশ্ন করলাম তাকে,

‘আপনি ট্যুরে যান?’

‘হ্যাঁ যাই তো।’

ধ্রুব নির্লিপ্ত জবাবে আমার রাগ তরতর করেই মাথায় উঠে যায়। যে আমি কখনও রাগ প্রকাশ করতাম না। আজ সেই আমিটাই ধ্রুবর সামান্য কথাতেই রাগ প্রকাশ করছি। আমার অধিকার নেই জেনেও আমি অনুচিত কথা বলে ফেললাম মুখ ফসকে।

‘আপনি আর কখনও এসব ট্যুর ফুরে যাবেন না বলে দিচ্ছি। আমার এসব মোটেও ভালো লাগে না। অসহ্য লাগে ভীষণ।’

কথা গুলো বলেই আমি থমকে গেলাম। আমি ধ্রুবর শর্তের বিরুদ্ধে গিয়ে তার লাইফে হস্তক্ষেপ করছি এ কথা মনে পরতেই নিজের ভুলের জন্য অনুশোচনা হলো। ধ্রুব হাসলেন অমায়িক ভঙ্গিতে। সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই শান্ত গলায় বললেন-

‘বউ বাচ্চা নিয়ে গেলে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হবে না তাই না!’

আমি চুপ করে রইলাম। তার কথার প্রতিত্তোরে টু শব্দটিও করলাম না। তবে ধ্রুব মুচকি হাসি আমার দৃষ্টির আড়াল হলো না। কেন হাসছেন তিনি তার কারণ বুঝতে পারলাম না।

‘অনু তুলতুলকে আমার কাছে দে আমি ওকে খাওয়াচ্ছি। তুই বরং ধ্রুবর সাথেই খেয়ে নে অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে।’

আমি তুলতুলের মুখে খাবার দিয়ে মনি মা’কে বললাম-

‘এখন আমার খিদে নেই মনি মা। তুমি এখন খেয়ে নাও আমি আজ খাবো না।’

মনি কিছুটা সময় চুপ থেকে শাসনের সুরে বললেন-

‘দুপুরেও তো ঠিক মতো খেলি না। খাওয়া দাওয়া নিয়ে হেয়ালি আমার একদম পছন্দ না অনু। তুলতুলকে খাওয়ানো শেষ হলেই তুই আমার সাথে খাবি।’

আমি মলিন মুখে মনি মা’র দিকে চেয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। আড় চোখে পাশে তাকিয়ে ধ্রুবর চাপা হাসি দেখেই আমার গাঁ জ্বলে গেল। মনি মা আমাকে বকা দিলেই যেন উনি সব চেয়ে বেশি খুশি হোন। ধ্রুব এখনও ঠোঁট চেপে হাসছেন। হয়তো আমার তাকিয়ে থাকা দেখেই আরও বেশি করে রাগাতে চাচ্ছেন। আমি ওনার হাসি পাত্তা না দিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেই। তুলতুলের মুখে আবারও খাবার তুলে দিতেই তুলতুল তার সরু দাঁত দিয়ে আমার আঙুলে কামড় বসিয়ে দেয়। সাথে সাথেই আমি মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে হাত সরিয়ে নিলাম। ধ্রুব, মনি মা আর আব্বু তিনজনই চমকে তাকালেন আমার দিকে। মনি মা আর আব্বু এক সাথেই জিজ্ঞেস করলেন-

‘কিরে! কি হলো?’

আমি আঙুলের দিকে তাকাতেই দেখলাম তুলতুলের দাঁতের ছাপ পরে গেছে। আমি হাল্কা হাসার চেষ্টা করে ক্ষীন স্বরে বললাম-

‘তুলতুল কামড় দিয়েছে।’

হঠাৎই ধ্রুব ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। আমার ডান হাত ধরে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। গম্ভীরমুখে তুলতুলের দিকে চেয়ে বললেন-

‘তুলতুল পাখি তোমাকে বলেছি না মাম্মাকে ব্যথা দিবে না! তুমি দিন দিন পঁচা হয়ে যাচ্ছো। এই যে দেখো তোমার মাম্মাকে কামড় দিয়ে লাল করে ফেলেছো।’

আমি ধ্রুবর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মনি মা আব্বুর দিকে লাজুক চোখে তাকাই। তাদের ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি দেখে আরও লজ্জা পেলাম। ধ্রুব আঙুল উঁচু করে তুলতুলকে নানান কথা বলে শাসন করছেন। তুলতুলের দিকে চেয়ে দেখলাম মেয়েটা ঠোঁট উল্টে ফোপাঁচ্ছে। হয়তো এখনই কান্না দিবে মেয়েটা। বিরক্তিতে ভাঁজ পরলো আমার কপালে। ধ্রুবর দিকে চেয়ে বিরক্তির স্বরে বললাম-

‘আহহ! বকছেন কেন মেয়েকে? ও বুঝেশুনে ব্যথা দিয়েছে না-কি!’

ধ্রুব সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-

‘বকা দিচ্ছি না বোঝাচ্ছি যেন আবারও কাউকে ব্যথা না দেয়।’

ধ্রুব আবার তুলতুলের দিকে তাকিয়ে শাসনের সুরে বললেন-

‘আবারও কামড় দিলে মাম্মার হাতে খাওয়া বন্ধ করে দিবো। আমার কথা মনে থাকে যেন তুলতুল পাখি।’

তুলতুল এবার ফোপাঁতে ফোপাঁতেই চিৎকার দিয়ে কেঁদে দিলো। আমি তুলতুলে ভালো করে কোলে নিয়ে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। জ্বলন্ত চোখে চাইলাম ধ্রুবর দিকে৷ ক্ষিপ্ত গলায় বললাম-

‘আজব মানুষ তো আপনি! শুধু শুধুই মেয়েটাকে কাঁদালেন।’

আমার কথা শেষ হতেই মনি মা তিক্ত গলায় বললেন-

‘একদম বাপের মতো হয়েছে। যেমন বাপ তেমন তার ছেলে।’

‘এই ফাজিল ছেলে একদমই আমার হয়নি। আমি কোনো কালেই ধ্রুবর মতো বেপরোয়া ছিলাম না। ধ্রুব তো তোমার মতো হয়েছে।’

তৎক্ষনাৎ আব্বু প্রতিবাদ করলেন মনি মা’র কথায়। আব্বুর প্রতিবাদে তেঁতে উঠলেন মনি মা। রাগান্বিত হয়ে বললেন-

‘একদম বাজে বলবেন না ধ্রুবর বাবা। ধ্রুব হুবহু আপনার মতো হয়েছে। মনে নেই ধ্রুব ছোট বেলায় খেলনার গাড়ি দিয়ে আমার মাথায় বাড়ি দিয়েছিলো বলে ওর পিঠে থাপ্পড় দিয়ে পাঁচ আঙুলের ছাপ বসিয়ে দিয়ে ছিলেন!’

ধ্রুব এতটা সময় নিশ্চুপ থালকেও এবার বিস্ফোরিত চোখে তাকায় আব্বুর দিকে। খানিকক্ষণ স্থির থেকে তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলেন-

‘আব্বু! মা কি সত্যিই বলছে?? তুমি আমাকে মেরেছিলে?’

আব্বু হকচকিয়ে গেলেন। মনি মা’র কথাই সত্যি সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি বোকার মতো বসে তাদের তর্ক করা দেখছি। তুলতুলও এখন কান্না থামিয়ে তাদের কান্ডকারখানা দেখছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুলতুলকে খাওয়ানো শুরু করলাম। যাকে নিয়ে ঝগড়ার শুরু তার দিকেই এনাদের খেয়াল নেই। কি অদ্ভুত মানুষ। একজন আরেকজনের সাথে যেন সাপেনেউলে সম্পর্ক। ঝগড়া আর ধমকা ধমকি মাঝেই যেন এনারা একজন আরেক জনের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেন।

‘তুমি নিজ ইচ্ছেতে বিয়ে করনি তাই না অনুপাখি? আমি জানি তুমি কখনই অন্য কাউকে বিয়ে করতে রাজি হবে না।’

সাদাফের মেসেজ দেখেই খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম। সাদাফের নাম্বার ব্লক ছিল। এখন আবার অন্য নাম্বার দিয়ে মেসেজ দিয়েছে। আমি পাশ ফিরে তাকালাম খুব সাবধানে। ধ্রুব ঘুমিয়ে আছে। তুলতুলকে আজ মনি মা নিয়ে গেছে। মনি মা’র মনে হচ্ছিলো আমি ঠিক নেই তাই আমাকে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরার হুকুম দিয়েছে। তবে মনি মাকে কীভাবে বলি আমার ঘুম হবে না। ঘুম এসে ধরা দিবে না আমার চোখের পাতায়। আমার ভাবনার মাঝেই আবারও মেসেজ টোন বেজে উঠল। আমি মেসেজ না দেখেই তাড়াহুড়ো করে নাম্বার ব্লক করে দিলাম। ফোনটা বালিশের নিচে রেখে চোখ দুটো বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। মিনিট খানেক পর আবারও ফোন বেজে উঠল। অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছে। আমি খানিকটা বিরক্তি নিয়ে ফোন রিসিভ করতেই সাদাফ হড়বড়িয়ে বলল-

‘আমার নাম্বার ব্লক করে দিচ্ছো কেন অনন্যা?’

ভীষণ রাগ হলো। রাগে চিড়বিড়িয়ে উঠলো আমার সারা শরীর। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে বয়ে তীব্র রাগ। আমি সাদাফের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়েই ফোন কেটে দিলাম। সাথে সাথেই আবারও ফোন আসলো। এবার আর রাগ সামলাতে পারলাম। হাতের ফোনটা ছুড়ে ফেললাম মেঝেতে। ফোন ভাঙার ঝংকার তোলা শব্দে ধ্রুব খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই উঠে আমার দিকে ফিরে বসলেন। ওনার চোখ মুখ আর উঠে বসার ভঙ্গি দেখে মনে হলো না তিনি এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলেন। আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন-

‘কেমন আছো সানসাইন?’

ওনার কন্ঠে আর ওনার প্রশ্নে অদ্ভুত কিছু ছিল। আমার রাগ জেদ নিমিষেই উবে গেল। ক্লান্ত বোধ করলাম খুব। হাঁপিয়ে উঠেছি প্রতিদিনের এত ঝামেলা আর সবার সামনে অভিনয় করতে করতে। ভীষণ অসহায় হয়েই কান্না শুরু করে দিলাম। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। খানিকটা সময় পর ধ্রুব আমার পাশে এসে শুয়ে পরলেন। আমাকে টেনে ওনার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন খুব যত্নসহকারে। আমাকে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত গলায় বললেন-

‘আমার পারসোনাল বুকটা আজ থেকে তোমার সাথে শেয়ার করলাম সাইনসাইন।’

কান্নার মাঝেও শান্তি অনুভব করলাম আমি। এত এত কষ্টের মাঝেও শেষ রাতে এসে কারও বুকে ঠাঁই পেলাম। মাথায় কারও ভরসার হাত পেলাম। চোখেরজলে কারও একজনের বুক ভেজা ওর অধিকার পেলাম খুব। শান্ত হলাম আমি। সকল কষ্ট, বিষন্নতা যেন বিদায় নিলো ধ্রুবর কাছে এসে।

চলবে…

শেষ রাত পর্ব-১০+১১

0

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১০
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘কোথায় যাবেন ম্যাডাম? আপনি যেখানে যেতে চাইবেন সেখানেই আপনাকে নিয়ে যাবো।’

ধ্রুবর কথায় আমি বিস্মিত হলাম। বিস্ময়ের দৃষ্টি স্থির করলাম তার দিকে। ধ্রুব আমার হাত ধরে হাঁটছেন খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। আমার থেকে এক দু পা এগিয়ে আছেন যার কারণে ওনার হাতের বাঁধন খানিকটা শক্ত হয়ে আমার হাতে টান পরছে। আমি হাঁটছি নিঃশব্দে ভাবলেশহীন হয়ে। চোখদুটো যেন জ্বলন্ত আঙ্গার। কান্নার ফলে ক্ষনে ক্ষনে ভারি উত্তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসছে বুক চিড়ে। মাথার মধ্যে কিছু অবাঞ্ছিত, অনুচিত অনুভূতি ঝটলা পাঁকিয়ে আছে নির্দ্বিধায়। আমি যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। দৃষ্টি নামিয়ে ক্ষীণ স্বরে থেমে থেমে বললাম-

‘বাসায় যাবো। তুলতুল অপেক্ষা করছে হয়তো।’

ধ্রুব ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে একঝলক তাকালেন। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়ে বললেন-

‘এখন তো বাসায় যাওয়া যাবে না মিসেস ধ্রুব হাসান। আর তুলতুলকে নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না। আম্মু আছে ওর সাথে আর আমিও কিছুক্ষন আগে কল দিয়েছিলাম। তুলতুল এখন ঘুমাচ্ছে।’

‘কেন! বাসায় যাওয়া হবে না কেন?’

আমি ভীষণ কৌতুহল নিয়েই তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব থামলেন। হাত ছেড়ে পেছন ঘুরে দাঁড়ালেন আমার মুখোমুখি হয়ে। খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে স্থির চেয়ে থেকে নরম স্বরে বললেন-

‘কেঁদেকেটে নিজের যা হাল করেছেন, এই অবস্থা আপনাকে বাসায় নিয়ে গেলে আম্মুর হাজারো প্রশ্নের জবাবদিহি করতে হবে। আর প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিতে না পারলে উনি ভাববেন আমি আপনাকে কাঁদিয়েছি। তার চেয়ে বরং আপনি নিজেকে পুরোপুরি স্বাভাবিক করে ঘন্টাখানেক পর বাসা যান। আর আমারও অফিসে কোনো কাজ নেই। তাই আপনাকে কোম্পানি দেওয়াই আমার জন্য ভালো মনে হচ্ছে।’

আমি চুপ থেকে ভাবলাম। ধ্রুবর কথা গুলো যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হলো। কান্নাকাটি করে নিজের যে হাল করেছি এই অবস্থায় বাসায় গেলে মনি মা তার প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসবেন নিশ্চিত। ওনার প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে ভালো কিছুক্ষন বাহিরে থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়া। আমি মাথা তুলে ধ্রবর দিকে চাইলাম। আমার মতামত শোনার জন্যই হয়তো বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে বললাম-

‘আচ্ছা, আপনার যেখানে ইচ্ছে সেখানেই নিয়ে চলুন।’

ধ্রুব অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলেন। তার হাস্যজ্বল মুখ নিয়ে এগিয়ে এলেন আমার কাছাকাছি। দু’হাত দিয়ে খুব যত্নসহকারে আমার মুখের উপর এসে পরা এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে দিলেন। ওড়ানটাও খুব সচেতনতার সঙ্গে ঠিক করে দিয়ে সহজ গলায় বললেন-

‘একটু অগোছালো লাগছিল তবে এবার একদম পারফেক্ট। চলুন এখন যাওয়া যাক।’

ধ্রুব আমার প্রতিত্তোরে অপেক্ষা না করেই হাত ধরে হাঁটা শুরু করলেন। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে লাগলাম। ধ্রুবর কাজে আমি হতবাক। হঠাৎ করেই আমার এত খেয়াল রাখছেন। নির্দ্বিধায় যখন তখন আমার হাত চেপে ধরে হাঁটছেন। কান্নার কারণ জানতে চেয়েও আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেন নি৷ কিন্তু কেন? এসব কেন করছেন তিনি? কিছুক্ষন আগে মনের ভেতর ছাড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনুভূতি গুলো অস্পষ্ট, ঝাপসা হতে লাগলো। মস্তিষ্কে ঘুরতে লাগলো নানানরকম প্রশ্ন আর কিছু নতুন অনুভূতি। এলোমেলো অশান্ত মনটা অবুঝের মতোই প্রশ্ন করল- ‘ধ্রুব কেন এমন করছেন? সব কিছু জেনেশুনেও কেন এতটা নির্লিপ্ত তিনি? কেন এমন স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন?’ অশান্ত মনটাকে শান্ত করার মতো কোনো জবাব মস্তিষ্ক থেকে খুঁজে পাওয়া গেল না। নিরুত্তর, হতাশ মন নিয়েই ধ্রুবর পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম।

ফেব্রুয়ারির শেষ সময়। ফাল্গুনের এক উজ্জ্বল দুপুর ধীরে ধীরেই আঁধারে নিমজ্জিত হলো। আকাশ হলো মেঘাচ্ছন্ন। শীতল ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগলো চারপাশে৷ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতেই এদিক ওদিকে ছুটোছুটি করে যেতে লাগল সবাই। মিনিট খানেকের মাঝেই খালি হয়ে এলো জনমানবে পরিপূর্ণ রাস্তা। আশেপাশের লোকজনের এত অস্থিরতার মাঝেও ধ্রুব নির্বিকার। তার মাঝে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না। বৃষ্টির পানি স্পর্শ করতে পারেনি তার নির্লিপ্ততাকে। আধভেজা শরীর নিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই আমার হাত ধরে হাঁটছেন। আজ হয়তো আমার হাত ছাড়া পাবে না। আজ সারাক্ষন আমার হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে রাখার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন হয়তো। চলতে চলতেই আমার চোখ আটকে গেল। কিছুটা দূরে রাস্তার ডান পাশে একটা কদম গাছে। অসময়ের ছোট্ট ছোট্ট কদমফুল। বৃষ্টিস্নাত ভেজা কদম। আমার পূর্নাঙ্গ দৃষ্টি এবং মনোযোগ দুটোই স্থির হলো সেই গাছটায়।

‘খুব সুন্দর তাই না!’

ধ্রুবর কথায় আমি সেইদিকে দৃষ্টি দিয়েই ঘোর লাগা কন্ঠে বললাম-

‘হুম হুম। অনেক বেশিই সুন্দর।’

ধ্রুব আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আমার হুশ ফিরলো। ধ্রুব দিকে তাকাতেই স্নিগ্ধ হাসি উপহার দিলেন তিনি। শীতল কন্ঠে বললেন-

‘একদম আপনার মতোই সুন্দর।’

ধ্রুব একটু থেমে কিছু একটা ভাবলেন। ভাবুকতার সঙ্গে বললেন-

‘দাঁড়ান আমি আসছি।’

ধ্রুব চলে গেল সেই গাছটার দিকে। ওনার গায়ে জড়ানো খয়েরী রঙের শার্ট। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ওনার শার্ট পুরোপুরি না ভিজলেও কাধের দিকটা ভিজে একদম চুপচুপে অবস্থা। আমাকে অবাক করে দিয়ে ধ্রুব কদম ফুল ছেঁড়ার চেষ্টা করতে লাগল। বেশি কষ্ট করতে হলো না। হাত উঁচু করে একবার লাফ দিতেই গাছের ডাল ওনার হাতের মুঠোয় চলে আসলো। অনেক গুলো ফুল থাকা স্বত্তেও তিনি মাত্র দুটি ফুল এনে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মুখে সহজাত হাসি টেনে নিয়ে গাঢ় স্বরে বললেন-

‘গাছের ফুল গাছেই সুন্দর মানায়। কিন্তু বৃষ্টিস্নাত রমনীর হাতে ভেজা কদম ফুল থাকবে না এটা বড্ড বেশিই বেমানান। তবে আমি গাছ থেকে পারমিশন নিয়েই তার ফুল ছিঁড়েছি। গাছটা খুব গম্ভীর গলায় আমাকে অনুমতি দিয়েছে। বলেছে- দুজন মানুষের জন্য শুধু দুটো ফুল দেওয়া যাবে। এর বেশি নিতে চাইলে তার গাছের ফুল হ’ত্যার দায়ে আমাকে এই গাছের ডালেই ফাঁ’সিতে ঝুলতে হবে।’

ধ্রুবর কথা শুনে আমি ফিক করেই হেসে ফেললাম। খেয়াল করলাম। ধ্রুবর ঠোঁটের হাসি আরও প্রসারিত হলো। খানিকক্ষণ হাসার পর ফুল হাতে নিয়ে বললাম-

‘আপনি এসব আজগুবি চিন্তাভাবনা করেন কিভাবে? মাথায় আসে কিভাবে এসব!’

‘বিয়ের আগেই কিছু না করে এক বাচ্চার বাপ হয়ে গেলাম। সেখানে এসব চিন্তাভাবনা করা তো খুবই তুচ্ছ ব্যাপার।’

ওনার দাম্ভিকতা পূর্ন কথায় আমার কপাল কুচকে এলো। ভ্রু জোড়া মাঝে সুতীক্ষ্ম রেখা ফুটে উঠলো। ধ্রুবর বাহুতে হাল্কা আঘাত করে তিক্ত গলায় বললাম-

‘ছিঃ রাস্তাঘাটে এসব কি বলছেন আপনি!’

ধ্রুব এবার শব্দ করেই হাসলেন। প্রাণোচ্ছল হাসিতে ফেটে পরলেন তিনি। আমার হাত ধরে ফিরতি পথে হাঁটতে হাঁটতে বললেন-

‘আচ্ছা এবার চলুন। বাকি কথা না হয় আমাদের রুমে একা একা ফিসফিস করে বলবো।’

দমকা শীতল বাতাসে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল আমার অর্ধ ভেজা শরীর। বাতাসের সাথেই তাল মিলিয়ে ধ্রুবর ঝংকার তোলা হাসির শব্দে থরথর করেই কেঁপে উঠলো আমার ভেতরটা। লজ্জারা এসে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আমাকে। অযাচিত লজ্জায় নুয়ে গেল আমার চোখ দুটো। আমি আটকাতে পারলাম না চোখের লজ্জা ভাব। চোখ তুলে চাইতে পারলাম না। ধ্রুবর এই অসহ্যকর হাসিতে লজ্জারা আরও বেশিই উৎসাহ পেতে লাগল। খুব ইচ্ছে করলো কান দুটো তালা দিয়ে রাখি। কিন্তু তা সম্ভব হলো না। আমাকে লজ্জার কাছে মাথা নত করতে হলো। আমাকে অসহায় করে দিয়ে ধ্রুব তার অসহ্যকর হাসিতে আমাকে লজ্জায় ফেলতে লাগলো।

‘পেছনের সিটে তোয়ালে আছে সেটা মাথাটা একটু মুছে নিন।’

ধ্রুবর কথা মতোই গাড়িতে বসে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে লাগলাম। ধ্রুব এসে ড্রাইভিং সিটে বসলেন। তার চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পরছে। আমি তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে বললাম-

‘নিন মাথা মুছে নিন। এখন কি বাসায় যাবেন নাকি অন্য কোথাও?’

ধ্রুব মাথা মুছতে মুছতেই উত্তর দিল,

‘নাহ একেবারে লাঞ্চ করেই ফিরবো।’

আমি আর কিছু বললাম না। ভেজা শরীর নিয়ে বাসায় ফেরাও ঠিক হবে না। তারচেয়ে বরং আর কিছুটা সময় পাড় হলেই যাওয়া ঠিক হবে। এখন ওনার কথা মতো চলাই শ্রেয় মনে হচ্ছে।

‘তুলতুলের আম্মু! আপনার কি অস্বস্তি লাগছে আমার সামনে বসে থাকতে? তখনকার ঘটনার জন্য আমি আপনাকে কিছু বলিনি এই নিয়েই হয়তো মনে মনে অস্বস্তিবোধ করছেন তাই না!’

আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে অনবরত কাটা চামচ দিয়ে খাবার নাড়তে লাগলাম। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে ইতস্তত করে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। ধ্রুব মৃদু হাসলেন। টেবিলের উপরে দু’হাতে তুলে দিয়ে কিছুটা ঝুঁকে এলেন। শান্ত গলায় বললেন-

‘শুনন অনন্য৷ আমি আপনার উপর কোনো প্রকার চাপ সৃষ্টি করতে চাই না। আমি জানি আপনার জন্য এই মুহুর্ত গুলো খুবই কষ্টদায়ক। মনের ভেতরে কষ্ট পুষে রেখে প্রতিটি মুহুর্ত সবার সামনে স্বাভাবিকভাবে থাকা এটা নির্দ্বিধায় খুব কঠিন একটা কাজ। আপনি প্রতিনিয়ত এই কঠিন কাজটাই করে যাচ্ছেন। নিজেকে শক্ত রাখছেন। এর মধ্যে আমি আপনার প্রাক্তনের কথা তুলে আপনার মন ভাঙতে চাই না। ক্ষত জায়গায় নতুন করে আঘাত করতে চাই না। আমি চাইলেই পারতাম বিয়ে হওয়ার পর পরই আপনার উপর স্বামীর অধিকার খাটাতে। অতীত ভুলে যাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত আপনাকে চাপ দিয়ে বাধ্য করতে৷ কিন্তু এসব করে কি লাভ! আমি কোনো কাপুরুষ নই, যে মেয়েদের উপর জোর খাটাবো। সব কিছুতে জোর খাটানো গেলেও কারও মনের উপর জোর খাটানো যায় না। আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষ হারিয়েছেন বুঝলাম। এই সত্যটা মেনে নিয়ে নতুন করে সংসার করতেও যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন এটাও আমি বুঝি। কিন্তু আপনি সেই সময় টুকু পাননি। তাই আমি আপনাকে স্পেস দিচ্ছি। নিজের মতো করে থাকার সুযোগ দিচ্ছি। আপনি যেন নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারেন। অতীত মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। এবার নিশ্চয়ই বুঝেছেন কেন আমি আপনার ব্যাপারে উদাসীন, নির্লিপ্ত।’

আমি প্রতিত্তোরে কিছু বললাম না। ওনার কথা গুলো শুনে হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। ধ্রুব খানিকটা নেড়েচেড়ে আবারও বললেন-

‘আমার সাথে আপনি ফ্রেন্ডলি কথা বলতে পারেন। আমি আপনার হাসবেন্ড হিসেবে না আপনার পূর্বপরিচিত একজন হয়ে কথা বলছি। তোকে তো আমি ছোট থেকেই চিনি। সারাদিন আমার মা আর আপুর পেছনে লেগে থাকতি। আমার পেছনেও ঘুরতি আইসক্রিম খাওয়ার জন্য। তুই ভুলে গেলেও আমি কিন্তু ভুলিনি।’

ধ্রুব কথা গুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। কিন্তু শেষের কথা গুলো শুনেই হেসে ফেললাম। মানুষটা খুব দ্রুত কথা বলার ধরন পালটে ফেলতে পারেন। ওনার নির্লিপ্ততা এতদিন আমার রাগের কারণ হলেও আজ সব কিছু শুনে ওনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হলো। খানিকটা ভালো লাগার জন্ম নিলো মনে। আমি মুচকি হাসলাম৷ কিন্তু কিছু বললাম না৷ রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসবো তখনই ধ্রুব চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতে যেতে বললেন-

‘আমার হলে পুরোপুরি আমারই হতে হবে।’

ধ্রুব অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে চলছেন। আমি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ওনার দিকে চেয়ে রইলাম। হঠাৎ করেই এই কথার কি মানে? কেন বললেন এই কথা?

রাত হতেই হু হু করে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে লাগলো। অসময়ের জ্বর কাবু করে নিলো আমাকে। শরীরের ভেতরটা যেন ভ্যাপসা গরমের সিদ্ধ হতে লাগল। চোখদুটো জ্বালা করছে খুব। চোখ মেলে চেয়ে থাকাটাও মুশকিল মনে হচ্ছে। আমি অলস ভঙ্গিতে চিঠি আর ম্যাপল পাতায় আলতোভাবে হাত বুলিয়ে চাপা দিয়ে রাখলাম ডায়েরির ভাঁজে। বারান্দা দিয়ে আসা হিমশীতল বাতাসে পুরো রুম যেন হিমঘরে পরিনত হয়েছে। খালি রুম। অন্য কেউ নেই রুমে। তুলতুল খেলতে খেলতে মনি মা’র রুমেই ঘুমিয়ে পরেছে৷ বাসায় আসার পর থেকেই আমার সাথে চিপকে লেগে ছিল পুরোটা সময়। যেন আমাকে ছেড়ে দিলেই আমি হারিয়ে যাবো। রাতে ধ্রুব অফিস থেকে আসার পরেই আমাকে ছেড়েছে। ধ্রুবও হয়তো মনি মা’র রুমেই এখন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। টেবিলের ডয়ারে ডায়েরিটা রেখে উঠে দাঁড়ালাম। কি আশ্চর্য। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও যেন পাচ্ছি না। ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ে যন্ত্রণা যে এখন পুরো শরীরে ছড়িয়ে পরলো। সাদাফের বিষাক্ত ভালোবাসায় বিষিয়ে উঠলো আমার সারা দেহ।

চলবে….

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১১
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

বিষাক্ত ভালোবাসায় নিজেকে আক্রান্ত করেছি বিগত সাড়ে তিন বছর যাবত। ধীরে ধীরে সাদাফ নামক ভালোবাসার বিষ এরকম ভয়ংকর রূপ নিবে তার ধারণা ছিল না। গল্পের এক অসহায়, আঘাতে জর্জরিত চরিত্র আমি। আর সাদাফ সেই গল্পের অদ্ভুত, ভীষণ অদ্ভুত এক উদাসীন চরিত্র। আমার প্রতিটি বিষয়ে হিমালয় সমান তার উদাসীনতা। যখন দেখতে চেয়েছি তখন দূরে সরে গেছে। যখন কথা বলতে চেয়েছি তখন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। ভালোবাসতে চেয়েছি সে এক আকাশ অভিমান ফিরিয়ে দিয়েছে। মানুষ ভালোবেসে কাছে আসতে চায়। অথচ সাদাফ দূর থেকে ভালোবাসা অনুভব করতে চায়। দূর থেকেই ভালোবাসার গভীরতা বাড়াতে চায়। ভালোবাসা হয় আনন্দ আর সুখের এক রঙিন অনুভূতি। তবে সাদাফের ভালোবাসা কষ্টের, অপেক্ষার, অভিমানের ধূসর রঙের অনুভূতি। এটা কি আধো ভালোবাসা ছিল? নাকি ভালোবাসা নামক বিষ ছিল। যে বিষ গ্রহণে শুধু এবং শুধুই যন্ত্রণা হয়। মরণ যন্ত্রণা। মনের অসুখ আর ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ের মতোই দূর্বল হয়ে পরেছে আমার বলহীন দেহ। পালা দিয়ে বেড়েই চলছে দেহের তাপমাত্রা। চোখ দুটো জ্বলন্ত লাভার রূপ নিলো। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হাত কপালে রাখলাম। বুঝলাম জ্বর খুব ভালো গতিতে বেড়ে যাচ্ছে।

‘সরি সরি একটু দেরি হয়ে গেল। আব্বুর সাথে অফিসের কাজ নিয়ে কথা বলছিলাম। সময়ের খেয়াল করিনি।’

আমি দাঁড়িয়ে থেকেই পিটপিট করে ধ্রুব দিকে চাইলাম। তিনি একনাগাড়ে কথা গুলো বলেই বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে অনুরোধের ভঙ্গিতে বললেন-

‘আমার ফোনটা দেখেছেন তুলতুলের আম্মু? কোথায় যেন রেখেছি মনে নেই। একটু কষ্ট করে খুঁজে দিবেন প্লিজ! আমার শরীর খুব ক্লান্ত লাগছে তাই আপনাকে বলছি।’

শুকিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে যাওয়া গলা দিয়ে আমি ক্ষীন স্বরে বললাম-

‘হুম দিচ্ছি।’

ধ্রুব খুশি হলেন। ঠোঁটের কোণে তৃপ্তিময় হাসির রেখা আরেকটু প্রসারিত হলো৷ খানিকক্ষণের জন্য শারীরিক যন্ত্রণা ভুলে বলহীন শরীর নিয়েই এগিয়ে গেলাম ড্রেসিং টেবিলের দিকে। অফিস থেকে এসেই এখানে ফোন রেখেছেন। আর এখনই না-কি ভুলে গেছেন। কি অদ্ভুত! চোখের সামনেই তো ফোন। তবুই পাচ্ছে না এটা কেমন কথা! আমি ফোন নিয়ে ধ্রুরব কাছে আসতেই মাথা ঘুরে উঠলো। ঝিম ধরে গেল মাথা। চোখের সামনের পুরো দুনিয়াটাই যেন অন্ধকার হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকার আর কোনো শক্তি পেলাম না। তাল হারিয়ে ঢলে পরলাম ধ্রুব উপর। মিনিট খানেক ধ্রুবর বুকে ঝিম মে’রে পরে রইলাম। খানিকক্ষণ পর ধ্রুবর বুকে হাতের ভর দিয়ে মাথা তুলে তাকাই। ধ্রুবর ঝাপসা মুখের দিকে স্থির চেয়ে রইলাম। চোখদুটো ভয়ংকর রকম জ্বালা করছে। জ্বরে তীব্র উত্তাপ যেন চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

”Is it comfortable lying there?

ধ্রুবর কথায় আমার উত্তপ্ত চোখজোড়া বিস্ময়ে গোলাকৃতি হলো। ড্যাবড্যাব করেই চেয়ে রইলাম ধ্রুবর ভ্রু কুচকানো মুখের দিকে। আমাকে নড়তে না দেখে ধ্রুব তার আঙুল দিয়ে আমার ডান গালে পর পর দু’বার গুতো দিলেন। হাহাকার ধ্বনিতে বললেন-

‘আমার পারসোনাল বুক থেকে উঠুন না প্লিজ!’

আমি ফুস করেই তপ্ত শ্বাস ফেললাম। ওনার বুকে দু’হাতের ভর দিয়ে উঠে যেতে চাইলাম। তার আগেই ধ্রুব তার দু’হাতে আমার গাল চেপে ধরে বাধা দিলেন। ওনার বুকের উপর থেকে আমার ডান হাত নিয়ে নিজের গালে রাখলেন। সাথে সাথেই চমকে উঠলেন তিনি। অবাক কন্ঠে বললেন-

‘আপনার হাত এত গরম কেন? দেখি তো কপাল দেখি।’

ধ্রুব উত্তেজিত হয়েই আমার কপালে হাত রাখলেন। ধ্রুব চমকালেন আমার শরীরের তাপমাত্রা দেখে। আর আমি শিউরে উঠলাম ওনার ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে। ধ্রুব দ্রুত আমাকে তার জায়গায় শুয়িয়ে দিয়ে তিনি আমার নিচ থেকে উঠে বসলেন। অস্থির হয়ে বললেন-

‘আপনার এত জ্বর আর আপনি চুপচাপ বসে আছেন কেন? আমাকে বলেন নি কেন?

আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। তার আগেই ধ্রুব অপরাধীর ন্যায় গলারস্বর নামিয়ে বললেন-

‘আমার ভুলের জন্যই এমন হয়েছে। আমি আপনাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছি বলেই এমনটা হলো।’

আমি নেড়েচেড়ে উঠে বসতে চাইলাম। কিন্তু শরীরে সেই শক্তিটুকু পেলাম না। ক্লান্ত শরীরের পুরোপুরি ভর ছেড়ে দিলাম বিছানায়। অস্ফুটস্বরে বললাম-

‘আপনার কোনো দোষ নেই। বাসায় ফিরে একটু বেশি সময় নিয়ে গোসল করেছিলাম। এই জন্যই হয়তো জ্বর এসেছে।’

আমার কথা শুনে ধ্রুব তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষন চেয়ে রইলেন আমার দিকে। ফুস করে একটা শ্বাস ফেলে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে কড়া গলায় বললেন-

‘ইচ্ছে করছে এক চড় দিয়ে মাথা থেকে সব ভূত বের করি। কিন্তু আফসোস সব ইচ্ছে পূরণ করতে নেই।’

আমি চেতন আর অচেতনের মাঝামাঝি অবস্থান নিয়ে শুয়ে রইলাম। আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই চোখ মেলে দেখার সুযোগ হলো না। মুখ ফুটে কিছু বলার শক্তি বোধ হলো না। তবে ধ্রুবর কথা গুলো শুনতে পেলাম স্পষ্ট। শেষ রাতে কেউ তো একজন বুঝতে পারলো আমার পরিস্থিতি। আমার কষ্ট, বিচ্ছেদের ব্যথা। অবশেষে কেউ তো একজন শাসন করছে আমার পাগলামিতে। কেন এতদিন কেউ খেয়াল করলো না আমাকে? কেন কেউ বুঝতে পারলো আমার ভালোবাসা হারানোর কষ্ট? কেন সবার সামনে আমাকে ভালো থাকার অভিনয় করে যেতে হলো? অবচেতন মনে আরও কত কত প্রশ্ন উঁকি দিল। মনে মনেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে আওড়াতে লাগলাম। কিন্তু কোনো জবাব পেলাম না। মিনিট খানেক পরেই কপালে ঠান্ডা কিছু অনুভব করলাম। ধ্রুব জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছেন। আমার উত্তপ্ত মাথায় চলছে তার শীতল হাতের বিচরণ। মনে মনে কিছুটা অপরাধবোধ কাজ করলো। একটু আগেই ধ্রুব বললেন তার ক্লান্ত লাগছে। এখন আবার আমার জন্য এতটা অস্থির হয়ে পরেছেন।

তীব্র শীতল বাতাসের স্পর্শে ঘুমের মধ্যেই কেঁপে উঠছে আমার শরীর। কপাল কুচকে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাই। চোখ খোলা মাত্রই জানালার দিকে নজর গেল। বাতাসের ঝাপটায় জানালার পর্দা গুলো হেলেদুলে উড়ছে। ঘুম জড়ানো ঝাপসা চোখে দেয়ালের ঘড়িটা স্পষ্ট দেখা হলো না। শরীর থেকে কম্বল সড়ে গেছে বলেই শীত করছে। ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকাতেই ধ্রুবর ঘুমন্ত মুখে দৃষ্টি আটকালো। আমার মাথার নিচেই তার বা হাত বন্দী। আমার ক্লান্ত মস্তিষ্কে কিছুই ডুকলো না। জ্বরের ঘোরে কখন ওনার হাতে মাথা রেখে শুয়েছি তার বিন্দুমাত্র হদিস পেলাম না। আমি খুব সাবধানে ওনার হাত থেকে মাথা সরিয়ে নিতে চাইলাম। তার আগেই ধ্রুব নেড়েচেড়ে উঠলো। চোখ বন্ধ রেখেই ডান হাত দিয়ে কম্বল টেনে আমার গলা পর্যন্ত ঢেকে দিলো। কম্বলের উপরে আমার পেটের উপরে হাত রেখে ঘুম পারানোর মতো করে ওঠানামা করতে লাগলেন। আমি ঘুম জড়ানো চোখে স্থির তাকিয়ে রইলাম। ওনার কর্মকাণ্ড বোঝার চেষ্টা করলাম। উনি কি আমাকে তুলতুল মনে করছেন? তুলতুলকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতেই কি তার এমন অভ্যাস হয়েছে? আরও নানান কথা ভাবতে ভাবতেই আবারও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

‘তুলতুল পাখি মাম্মা অসুস্থ। মাম্মাকে কষ্ট দেয় না ঠিক আছে!’

ধ্রুবর কন্ঠস্বর আর তুলতুলের স্পর্শে আমার ঘুম ভাঙলো। সেই সাথে তুলতুলের মাথাটাও বুঝি আমার গলার দিকে আসলো। মোচড়ামুচড়ি করছে আমার গাঁয়ে গাঁ মিলিয়ে। খুব সম্ভবত মেয়েটা চাইছে আমি তাকে জড়িয়ে ধরি।

‘চুপচাপ শুয়ে থাকো তুলতুল পাখি। তুমি না ভালো মেয়ে একদম তোমার মাম্মার মতো! তাহলে পঁচা কাজ কেন করছো! নাড়াচাড়া করে না তুলতুল। তোমার মাম্মা ব্যাথা পেলে তোমাকে কিন্তু আর তার কাছে আসতে দিবো না।’

আমি এবার চোখ মেললাম। তুলতুলকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে মাথা হাত বুলিয়ে দিলাম। তুলতুল খুশি হয়ে আমার বুকে মুখ গুজিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলো। আমি ধ্রুবর দিকে চোখে ছোট ছোট করে সরু দৃষ্টিতে চাইলাম। ক্লান্ত গলায় বললাম-

‘মেয়েকে বকা দিচ্ছেন কেন?’

আমার কথায় ধ্রুব ভীষণ অবাক হয়ে বললেন-

‘বকা কখন দিলাম? আমি ওকে বুঝিয়ে বলছিলাম।’

‘এইটুকু বয়সে মেয়েটা কি বুঝবে আপনার কথা? আর আপনি আমার কাছে ওকে আসতে দিবেন না বলেই তো হুমকি দিলেন। আবার বলছেন বকা দেননি।’

আমি ওনার দিকে ভ্রু জোড়া ঈষৎ উঁচু তাকাতেই ধ্রুব হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। কন্ঠে উদাসীন ভাব এনে বললেন-

‘মা-মেয়ে মিলে আমার বিরুদ্ধে দল বানিয়েছেন তাই তো! সমস্যা নেই সবাই-ই তো আপনার দলেই আরেকটা বাবু হলে ওকে আমার পক্ষে করে নিব। তখন আমার দলও ভারি…’

ধ্রুব কথার মাঝেই থেমে গেলেন। আমি বিস্মিত হয়ে ওনার কথার ভাবার্থ বোঝার চেষ্টা করলাম। ধ্রুব থতমত খেয়ে অপ্রস্তুত গলায় বললেন-

‘আমি অফিস যাচ্ছি। আম্মুকে বলে রেখেছি আপনার খেয়াল রাখবে। আর হ্যাঁ আগামী দু’দিন আপনার ভার্সিটিতে যাওয়া নিষেধ।’

ধ্রুব হড়বড়িয়ে আলমারি থেকে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলেন। ভীষণ হাতাশায় আমার মুখ চিমসে গেল। সামান্য জ্বরের জন্য দু’দিন ভার্সিটিতে যাওয়া নিষেধ এটা কেমন কথা! আহামরি কিছু তো আর হয় নি। সামান্য একটু জ্বর।

‘ভাবি! আবারও আসলাম ডাকপিয়নের দায়িত্ব পালন করতে। কি খবর আপনার ভাবি? কেমন আছেন?’

রাফিন ভাইয়ের কথা শুনে বিরক্তিতে ভাঁজ পরলো দুই ভ্রুর সংযোগ স্থলে। গম্ভীরমুখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলাম জানালার অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাফিন ভাইয়ের দিকে। মুখ ঘুরিয়ে পাশে বসে থাকা সানির দিকে চেয়ে ভারি কণ্ঠে বললাম-

‘সানি তুই ক্লাস কর। আমি এখন যাই। একটু পরেই তোর দুলাভাই আমাকে নিতে আসবে।’

সানির প্রতিত্তোরে অপেক্ষা না করেই আমি গাম্ভীর্যের সঙ্গে পা ফেলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলাম। দরজার কাছে আসতেই রাফিন ভাই অবাক হয়ে বললেন-

‘দুলাভাই নিতে আসবে মানে কি ভাবি? আপনি কিভাবে জানলেন?’

‘কি জানার কথা বলছেন?’

আমার পালটা প্রশ্নে রাফিন ভাই মিইয়ে গেলেন। আমি বিরক্তি ভাব নিয়েই ঘড়িতে টাইম দেখলাম। একদিন পর ভার্সিটিতে এসেছি। কিছুদিন পরেই এক্সাম তাই ক্লাস মিস দিতে চাইনি। ধ্রুবকে খুব করে রিকুয়েষ্ট করার পর তিনি রাজি হয়েছেন। তবে তার একটাই শর্ত। অসুস্থ শরীর নিয়ে আজ সব ক্লাস করা যাবে না। তিনটা ক্লাস করেই ওনার সাথে বাসায় ফিরতে হবে। বাধ্য হয়েই ওনার শর্ত মেনে নিয়েছিলাম।

‘ভাবি এই যে এটা আপনার জন্য। সাদাফ পাঠিয়েছে।’

আবারও চিঠি তবে এবার নীল রঙের। আমি হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিতেই রাফিন ভাই তাড়াহুড়ো করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে মাঠের অন্য পাশে এশে একটু বসলাম। ধ্রুবর আসতে আরও অনেকটা সময় আছে৷ তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিঠি খুললাম।

অনুপাখি,

তোমার বাউন্ডুলে প্রেমিকের উড়নচণ্ডী স্বভাবকে পরিবর্তন করার সময় এসেছে অনুপাখি। আমার ভালোবাসায় তোমার অভিমানকে ভেঙে গুরিয়ে দেওয়ার সুযোগ এসেছে। সময় এসেছে তোমার চোখের জল শুষে নেওয়ার। ভালোবাসা এবার রঙিন হবে। তোমার অপেক্ষার আবাসন ঘটবে। সকল দূরত্ব ঘুচে যাবে। আমার তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো এবার তোমাকে বউ সাজে দেখে নিজের তৃষ্ণা মেটাবে। মুছে দিবো আমি তোমার মনে থাকা সকল কষ্ট। তৈরি তো তুমি তোমার ইচ্ছে আর চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে?

ইতি,
তোমার বাউন্ডুলে প্রেমিক

চিঠি পড়া শেষ হতেই ফুস করে একটা তপ্ত শ্বাস ফেললাম। অলস ভঙ্গিতে চিঠি ভাঁজ করে ব্যাগে রেখে দিলাম। খুব করে চেষ্টা করলাম এসব নিয়ে না ভাবতে। চিঠির কথা গুলো মস্তিষ্ক থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। মন খারাপ করবো না। কিছুতেই না। কান্নাও করবো না আমি। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে তুলতুলের ছবি দেখতে লাগলাম। মেয়েটার মুখ দেখেই মনে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল। বিচ্ছেদের দাহনে পুড়তে থাকা হৃদয়টা হঠাৎ করে শীতল হয়ে গেল। ভালো লাগায় ছেয়ে গেল চারপাশ।

‘অনুপাখি!!’

চিরচেনা সেই পুরনো কন্ঠস্বর শুনেই বুকটা ধক করে উঠলো। হাতুড়ি পেটার মতো ধুপধাপ করে লাফাতে লাগলো হৃদয়। ফোন থেকে দৃষ্টি তুলে সামনে তাকাতেই থমকে গেলাম আমি।

চলবে…

শেষ রাত পর্ব-৮+৯

0

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৮
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

ধ্রুব তার উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় যুগল চেপে ধরলেন আমার গালে। একটু আগেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেভাবে তুলতুলের মুখের সর্বত্র জুড়ে চুমু এঁকে দিয়েছিলেন। ঠিক সেভাবেই বোধহয় অবাঞ্ছিত স্পর্শে কাতর করতে চাইলেন আমাকে৷ আমি থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। থমকে গেল আমার মন মস্তিষ্ক সব। এক হাত দিয়ে শক্ত করে খামচে ধরে রাখলাম ধ্রুবর শার্টের কিছুটা অংশ। কয়েক সেকেন্ড কাটলো এভাবেই। ধ্রুবর তপ্ত ঠোঁট জোড়া এবার অগ্রসর হতে লাগলো আমার বা গালের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতা বুঝে সচল হলো আমার মস্তিষ্ক। তৎক্ষনাৎ মুখ ফিরিয়ে নিলাম অন্যদিকে। তার বুকের কাছে হাল্কা ধাক্কা প্রতিবাদ করলাম। আমার প্রতিবাদ কিংবা বাধা ধ্রুব খেয়াল করলো কি-না জানি না। সে নিজের মতোই শব্দ করে চুমু খেলেন আমার বা গালে। আবারও স্তব্ধ হলাম আমি। বলহীন শরীর এবার থরথর করেই কেঁপে উঠলো। ধ্রুব আমাকে মুক্ত করলেন তার উষ্ণ ছোঁয়া থেকে। তুলতুলকে কোলে নিয়ে আনন্দের সাগরে মন ভাসাতে ভাসাতেই ছুটে চললেন রুমের বাহিরে। কানের মধ্যে তীরের মতো এসে বিঁধলো তার উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বর।

‘মা!! মা!! দেখো তুলতুল আমাকে পাপা ডেকেছে। এক বার দু’বার না তিন-চার বার বলেছ। বাবা তো আমার মুখের কথা বিশ্বাস করবে না। তুমি জলদি বাবাকে ডাক দাও। তোমাদের সামনে তুলতুল পাখি আবারও আমাকে পাপা ডাকবে দেখে নিও…’

এই রকম আরও নানান কথা ধ্রুব বেশ উত্তেজনা নিয়ে একের পর এক বলে যাচ্ছেনল। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম আগের জায়গায়। তীব্র অবিশ্বাস নিয়ে গালে হাত দিয়ে স্তম্ভিত হলাম আমি। ডান গাল এখনও জ্বালা করছে। ওনার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ঘষাতেই গাল জ্বলে উঠেছে। কি থেকে কি হয়ে গেল কোনো কিছুই মাথায় ডুকছে না। বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত মুহুর্তটা। ধ্রুব কি খেয়াল করেছে সে কি করে গেছে আমার সাথে! হয়তো খেয়াল করেনি তাই তো ড্রয়িং রুমে এত হৈ-হুল্লোড়। মনি মা আর বাবার সাথে খুশিতে গদগদ হয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। এই অযাচিত ঘটনার কথা মনে পরলে কি তিনি লজ্জা পাবেন! অস্বস্তি বোধ আর অনুশোচনায় চুপ করে রইবেন। না-কি বরাবরের মতোই তার মাঝে কোনো ভাবান্তর ঘটবে না!

ঘড়িতে সময় বারোটা বেজে একুশ মিনিট। রুম আধো আলো আর আধো আঁধার। ফেরি লাইটের আলোয় সব কিছুই স্পষ্ট। তুলতুল ঘুমিয়ে পরেছে। রুম আলোকিত করে রাখার কারণ আমি আর তুলতুল দু’জনেই। তবে তুলতুলের চেয়ে বেশি প্রয়োজন আমার। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দম বন্ধ হয়ে আসে। মাথা ঘুরে খুবই অসহনীয় চাপ সৃষ্টি হয় মাথার ভেতর। এই কারণেই সব সময় রুম আলোকিত করে রাখতে হয়। যদিও এতে ধ্রুবর খানিকটা অসুবিধে হয় তবে তিনি কখনই তা মুখ ফুটে প্রকাশ করেননি। কিন্তু উনি না বললেও আমি বুঝতে পারি। তুলতুলের অপর পাশে ধ্রুব পাশ ফিরে শুয়ে আছেন৷ হয়তো ঘুমিয়ে পরেছেন এতক্ষনে। তবে আমার ঘুম আসছে না। ঘন্টা খানেক সময় চুপচাপ শুয়ে থাকার পরেও দুচোখের পাতায় ঘুম এসে ধরা দিলো না। কাল ভার্সিটিতে যেতে হবে ভেবেই ঘুমানোর চেষ্টা করলাম খুব। তবে কোনো লাভ হলো না এত চেষ্টা করেও। মাথাটা বড্ড এলোমেলো লাগছে। বিচ্ছেদের দাহনে পুড়ে যাওয়া মন আর ধ্রুবর স্পর্শে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া আমি। সব কিছু মিলিয়ে কেমন গন্ডগোল পাকিয়ে গেছে মাথায়।

‘তুলতুলের আম্মু!’

আচমকাই ধ্রুবর ডাকে আমি আনমনেই ‘জ্বি!’ বলে সাড়া দিলাম। পরক্ষণেই নিজের মুখ চেপে ধরলাম। ধ্রুব এখনও ঘুমান নি! এক দেড় ঘন্টা শুয়ে থেকেও ঘুমায়নি তিনি! কি আশ্চর্য! আর উনি জানলেই বা কিভাবে আমি জেগে আছি। আমি তো একটুও নাড়াচাড়া করিনি।

‘আমার মনে হচ্ছিলো আপনি এখনও ঘুমান নি ঠিক তা-ই হলো। আমার ধারনাই সত্যি।’

ধ্রুব নিম্নস্বরে কথাটা বললেন। তার কন্ঠস্বর শুনে মনে হলো আমাকে সজাগ পেয়ে তিনি কিঞ্চিৎ খুশি বোধ করছেন। আমি আগের মতোই চুপ করে রইলাম। ধ্রুব এবার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমার দিকে ফিরলেন। আমার মুখোমুখি হয়ে নরম গলায় বললেন-

‘তখনকার ঘটনার জন্য আমি সরি। আমি আপনাকে ওভাবে চুমু… মানে টাচ করতে চাইনি। আসলে তুলতুলের মুখে প্রথম পাপা ডাক শুনে অতিমাত্রায় খুশি হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কি করেছি না করেছি কিছুই খেয়াল করিনি।’

আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘হুম বুঝতে পেরেছি।’

‘আপনার এতো অস্বস্তিবোধ করতে হবে না। আর লজ্জাও পেতে হবে না। আমরা আমরাই তো। জাস্ট একটু চুমুই তো খেয়েছি তা-ও আবার গালে। তুলতুলকেও দিয়েছি ও লজ্জা পায়নি তাহলে আপনি কেন এত লজ্জা পাচ্ছেন!’

আমি চোখ বড় বড় করে চাইলাম। ধ্রুব তার নিজের কথাতেই থতমত খেয়ে গেলেন। লোকটা কখন কি বলেন তা সে নিজেও জানে না। যখন যা মুখে আসে তা-ই বলে ফেলে। পরে আবার নিজেই হকচকিয়ে যায়। কি অদ্ভুত মানুষ উনি। ধ্রুব গলা পরিষ্কার করে কথা পালটানোর চেষ্টা করলেন।

‘আমাকে পাপা ডাকতে হবে এটা তুলতুলকে কিভাবে শিখিয়েছন?’

‘আপনার ছবি দেখিয়ে শিখিয়েছি।’

ধ্রুব ছোট্ট করে ‘ওহহ’ বলে চুপ করে গেলেন। আবারও নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন হলো সাড়া ঘর। আমরা কেউই আর কোনো কথা বললাম না। হয়তো সেই ঘটনার জন্যই অস্বস্তি বোধ করছি দুজনে। দুজনের মনেই হয়তো চলছে লজ্জা আর অস্বস্তির মিশ্রণে অদ্ভুত অনুভূতি।

‘মনি মা! তুলতুলের দুধের ফিটার আমি রেডি করে দিয়েছি। ঘুম থেকে উঠলে ওকে খাইয়ে দিও। আর হ্যাঁ গোসল করানোর সময় পানি হাল্কা গরম করে নিও। পানি যেন বেশি গরম না হয় খেয়াল রেখো।’

মনি মা কপাল কুচকে বিরক্তিভাব নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। ভারি কন্ঠে বললেন-

‘এখনই এমন অস্থির হয়ে পরেছিস তাহলে ক্লাসে মন বসাবি কিভাবে? এত চিন্তা না করে চুপচাপ যা৷ দেরি হচ্ছে তোর। আর হ্যাঁ ক্লাসে বসে বসে আবার তুলতুলকে নিয়ে অস্থির হোস না। ওর জন্য আমি আছি।’

আমি মাথা নিচু করে মলিন মুখে ধ্রুব কাছে গেলাম। ধ্রুবর অদ্ভুত চাহনি আমার দিকেই স্থির। আমি ধ্রুবর সাথে বেরিয়ে যেতে লাগলাম। দরজার কাছে এসে আবারও দাঁড়ালাম। মনি মা’র দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বললাম-

‘তুলতুল বেশি কান্নাকাটি করলে আমাকে কল দিও মনি মা।’

মনি মা ক্ষেপে গিয়ে রাগান্বিত গলায় বললেন-

‘তুই এখন যাবি নাকি দিবো এক চড়! কি শুরু করেছিস কতক্ষন ধরে? আমি বলেছি তো আমি তুলতুলের খেয়াল রাখবো। তুই নিজের পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা কর। তুলতুলের জন্য তোর রেজাল্ট খারাপ হলে একদম তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসবো তোকে মনে থাকে যেন। এখন যা। আরেকটা কথা বললে খবর আছে।’

আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। এই কয়দিন তুলতুলকে ছাড়া এক মুহুর্তের জন্যেও কোথাও যাইনি৷ আজ তুলতুলকে রেখে বাহিরে যাচ্ছি ভেবেই মনটা খুতখুত করছে। তুলতুল কিভাবে থাকবে তা ভেবেই চিন্তায় সব গুলিয়ে ফেলছি। ধ্রুব বিরক্ত হয়ে আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন-

‘উফফ তুলতুলের আম্মু আসো তো। তোমাকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে আমাকে আবার অফিসে যেতে হবে।’

আমি থমথমে পায়ে ধ্রুব সাথে হাঁটতে লাগলাম। ধ্রুব গাড়ির দরজা খুলে আমাকে বসিয়ে দিতে দিতে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-

‘আর কিছুদিন পর হয়তো আপনার এক্সাম। ঠিক মতো পড়াশোনায় মন দিন। না হলে আম্মু ভীষণ রাগ করবে। আর তুলতুলকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আম্মু আগেও ওর খেয়াল রেখেছে আর ভবিষ্যতেও রাখতে পারবে।’

আমি মাথা নিচু করে রাখলাম। মেয়েটাকে ছাড়া একমুহূর্তও মন টিকছে না। এতক্ষন কিভাবে থাকব তা-ই বুঝতে পারছি না। তুলতুল ঘুম থেকে উঠে আমাকে না দেখলেই হয়তো মাম্মা মাম্মা বলে কান্নাকাটি শুরু করবে। তখন কি মনি মা ওকে সামলাতে পারবে! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ভার্সিটিতে এসে পরলাম৷ ধ্রুব গাড়ি থামিয়ে সহজ গলায় বললেন-

‘আচ্ছা সাবধানে থাকবেন আর কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে কল দিয়েন।’

আমি ইতস্তত করে মিনমিনিয়ে বললাম-

‘আপনার নাম্বার আমার কাছে নেই।’

ধ্রুব অবিশ্বাসের চোখে আমাকে তাকালেন। মাথা নাড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করলেন,

‘আমার নাম্বার মানে আপনার হাসবেন্ডের নাম্বার আপনার কাছে নেই?’

আমি তার দিক থেকে দৃষ্টি নামিয়ে ডানে বায়ে মাথা নাড়লাম। ধ্রুব বোধহয় হতাশ হলেন। ছোট করে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে আমার দিকে হাত বাড়ালেন। আমি না বুঝে ওনার হাতের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। ধ্রুব এবার বিরক্ত প্রকাশ করলেন। হাত নাড়িয়ে বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললেন-

‘ফোন দিন। আপনার ফোন।’

আমি কিছুক্ষন স্থির বসে থেকে ফোন বের করে ওনার হাতে দিলাম। তিনি আমার ফোনে কিছু একটা করলেন। খানিকক্ষণ পর আমার ফোন দিয়েই নিজের একটা সেলফি তুললেন। তারপর আবারও ফোনে কিছু একটা করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমি ফোন হাতে নিয়ে ভীষণ আগ্রহের সাথে ফোনের স্ক্রিনে তাকালাম। ধ্রুব তার নাম্বার সেভ কিরে দিয়েছে আমার ফোনে। খুব সুন্দর করে ‘তুলতুলের আব্বু’ লিখে নিজের ছবি দিয়ে সেভ করেছেন নাম্বার। আমি ফোন থেকে চোখ তুলে বিস্ময় নিয়ে তাকাই ধ্রুবর দিকে। নির্লিপ্ত তার চাহনি। তিনি কি আমার উপর অধিকার খাটাচ্ছেন? আদর্শ স্বামী হওয়ার চেষ্টা করছেন নাকি এমনিতেই বিনাকারণে এমন করছেন!

‘কি হলো যান। দেরি হচ্ছে তো আপনার আমার দুজনের। আমাকে পরেও দেখতে পারবেন। অনেক সুযোগ আছে দেখার।’

আমার তীক্ষ্ণ চাহনি ওনার দিকে নিক্ষেপ করে বিনাবাক্য ব্যয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। ধ্রুব খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন-

‘ক্লাস শেষে অপেক্ষা করবেন। আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাবো।’

আমি হাল্কা করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই তিনি চলে গেলেন। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অলস ভঙ্গিতে ভার্সিটির ভেতরে আসলাম। অডিটোরিয়ামের দিকে আসতেই কারও আকর্ষণ কাড়া ডাকে আমি থমে দাঁড়িয়ে গেলাম। ধক করেই কেঁপে উঠলো বুক। ভার্সিটিতে আসতেই পুরনো স্মৃতি চারপাশ থেকে আকড়ে ধরতে লাগল।

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৯
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘এই যে ভাবি! কেমন আছেন ভাবি?’

পেছন ফিরে আমি মানুষটার দিকে দৃষ্টি স্থির করলাম। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলাম বাউন্ডুলেপনার এই সদস্যকে। মুখে অমায়িক হাসি ঝুলিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন রাফিন ভাই। সাদাফের খুব কাছের ফ্রেন্ড উনি। আমাকে দেখলেই ভাবি ভাবি বলে জান বের করে দেওয়ার উপক্রম হয় তার। ভাবি ডাকতে ডাকতে মুখে ফেনা তুলে ফেলবে তবুও যেন তার মন ভরে না। রাফিন ভাই দ্রুত পায়ে হেঁটে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তরল ভঙ্গিতে হেসে বললেন-

‘জানেন ভাবি! দু’দিন ধরে ভার্সিটিতে এসে কতবার খুঁজে গেছি আপনাকে! অবশেষে আজ আপনাকে পেয়েই গেলাম।’

আমি ছোট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কড়া বললাম-

‘শুনুন রাফিন ভাই। বার বার আমাকে ভাবি ডাকবেন না। আমি আপনার ভাবি না। মনে থাকে যেন এই কথা।’

রাফিন ভাই আবারও হাসলেন। সহজ গলায় বললেন-

‘আচ্ছা ভাবি মনে থাকবে।’

আমার জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম তার দিকে। কিন্তু এতে তার কোনো হেলদোল হলো না। তিনি আগের মতোই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। ক্লান্ত গলায় বললাম-

‘আপনি এখানে কি করছেন? আপনার তো এখন দেশের বাহিরে বাকি সবার সাথে থাকার কথা।’

রাফিন ভাই মুখ কালো করে বিষন্ন গলায় বললেন-

‘তিন দিন আগেই এসেছি। ওদের সাথে ট্যুর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি ভাবি। সবগুলা শা’লায় এত হাঁটাহাঁটি করতে পারে জানা ছিল না। আমি ওদের সাথে আর একদিন থাকলেই হয়তো মরা লাশ হয়ে ফিরতাম দেশে।’

‘ওহহ আচ্ছা! তা আমাকে খুঁজছিলেন কেন? কোনো দরকার ছিল নাকি এমনি!’

রাফিন ভাই আমার দিকে একটা ধূসর রঙের খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন-

‘ভাবি, এই যে এটা। সাদাফ এই খাম আপনার কাছে পৌঁছে দিতে বলেছে। লাভ লেটার লিখেছে হয়তো আপনাকে।’

কথাটা বলেই রাফিন ভাই দুষ্টু হাসি দিলেন। আমি অপলক তাকিয়ে থাকলাম ওনার হাতের খামটার দিকে। এটা কি আদোও লাভ লেটার মনে হচ্ছে? এমন ধুসর কালো খামে কি ভালোবাসার কথা থাকে না-কি বিষন্নতার কথা, মন খারাপের কথা থাকা উচিত!

‘অনু তুই এখানে কি করছিস? জলদি চল ক্লাস শুরু হয়ে গেছে তো।’

আচমকাই সানি আমার কাছে এসে খুব তাড়া দিয়ে কথা গুলো বলে। আমি কিছু বলবো তার আগেই আবারও অস্থির হয়ে বলল-

‘তাড়াতাড়ি চল না ভাই। তোকে নিতে এসে এখন দেখছি আমাকেও বকা খেতে হবে টিচারের কাছে।’

আমি চুপ করে রইলাম৷ একবার সানির দিকে আরেকবার রাফিন ভাইয়ের দিকে তাকালাম। রাফিন ভাই আমার হাত ধূসর রঙের খামটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন-

‘ভাবি আপনি এখন ক্লাসে যান। আমিও বাসায় চলে যাচ্ছি। ভালো থাকবেন ভাবি। আল্লাহ হাফেজ।’

রাফিন ভাই চলে যেতেই সানি আমাকে টেনে ক্লাসের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। আমি রোবটের মতো সানির সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছি। হাতে এখনো রাফিন ভাইয়ের দেওয়া সেই খাম। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য মানুষ মনে হচ্ছে নিজেকে। অনুভূতিহীন ভাবেই পুরোটা সময় ক্লাসে বসে রইলাম। সানি একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে তবে আমার মস্তিষ্ক সেসব কিছুই বুঝতে পারছে না। স্পষ্ট শুনতে পারছি না কারও কোনো কথা। ক্লাস শেষ হতেই ভরদুপুরে ভার্সিটির পাশের আম বাগানে এসে বসলাম। সানিও আমার পিছু পিছু লেগে আছে। একটা সময় দারুণ বিরক্তি নিয়ে বলল-

‘এভাবে চুপ করে আসছিস কেন আসার পর থেকে? আর রাফিন ভাই এখানে কেন এসছিল? কিরে তুই কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস? কিছু বল।’

সানি হাল্কা করে আমার গায়ে ধাক্কা দিলো। আমি নেড়েচেড়ে বসলাম। চোখ তুলে শান্ত চাহনিতে তাকালাম সানির দিকে। ওর চোখেমুখে বিরক্তির সুক্ষ্ম রেখা ফুটে উঠেছে। কপালে সুতীক্ষ্ম ভাঁজও পরেছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থেকেই ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘সানি আমি একা থাকতে চাচ্ছি। তুই প্লিজ বাসায় চলে যা।’

‘কিন্তু দোস্ত…’

সানির কথার মাঝেই আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে গাঢ় কন্ঠে বললাম-

‘প্লিজ সানি…’

সানি মুখ অন্ধকার করে ফেলল। আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালো। মলিন মুখে বলল-

‘আচ্ছা সাবধানে থাকিস। ধ্রুব ভাইকে ফোন করে বলিস তুই এখানে। নাহলে উনি তোকে খুঁজতে খুঁজতে অস্থির হয়ে যাবেন।’

আমি চোখের ইশারায় সম্মতি জানাতেই সানি চলে গেল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ব্যাগ থেকে ধূসর রঙের খামটা বের করে দেখলাম উপরে খুব সুন্দর করে লেখা ‘অনুপাখি’। লেখাটা দেখেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। ঝাপসা হয়ে এলো আমার দৃষ্টি। কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা খুললাম। ধূসর রঙের চিঠি আর তার সাথে একটা লালচে-হলুদ রঙের ম্যাপল পাতা। আলতো হাতে ছুঁয়ে দেখলাম পাতাটা। বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। চিঠির ভাঁজ খুলতেই সাদা রঙের জেল পেন দিয়ে লেখা হাজারো শব্দ চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। প্রথম দেখাতেই বুঝলাম এগুলো সাদাফের হ্যান্ড রাইটিং। চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে চিঠি পড়ার সাহস জুগানোর চেষ্টা করলাম।

অনুপাখি,

প্রথম চিঠি লিখলাম তোমাকে আর প্রথমেই ভুল করে ফেললাম, এটাই তো ভাবছো তাই না! তবে জেনে নাও আমি ভুল করি নি। ইচ্ছে করেই তোমার নামের আগে প্রিয় সম্মোধন করিনি। প্রিয় শব্দটা তোমার জন্য না। তুমি তো আমার কাছে প্রিয় থেকেও বেশি কিছু। ছোট্ট একটা শব্দ ‘প্রিয়’। এই শব্দ দিয়ে তোমার গুরুত্বটা ঠিক প্রকাশ করা যাবে না তাই লিখিনি।

কেমন আছো তুমি অনুপাখি? খুব রেগে আছো আমার উপর তাই না! খুব কি অভিমান জমেছে তোমার বাউন্ডুলে প্রেমিকের উপর? ভীষণ ভীষণ ভীষণ অভিমান! না-কি ক্ষুদ্র অভিমান! নিশ্চয়ই সারাক্ষণ মন খারাপ করে বসে থাকো। রাতের বেলা কান্নাকাটি করে মাথা ব্যথা তুলে ঝিম ধরে শুয়ে থাকো। ঠিক বলেছি না আমি! আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হয়৷ তবে আমি খুব স্বার্থপর অনুপাখি। তোমার বাউন্ডুলে প্রেমিকটা খুব বেশিই স্বার্থপর। আমি চাই তুমি আমার উপর রাগ করো। অভিমান করো। আমার জন্য নিজের চোখেরজল বিসর্জন দাও। কেন জানো তো! কারণ মানুষ তো তার উপরেই রাগ,অভিমান করে যাকে সে ভালোবাসে। একটা মানুষ তার জন্যই চোখেরজল ফেলে যাকে সে হারানোর ভয় পায়। যে মানুষটা’কে সে তীব্র ভাবে ভালোবাসে। তোমার রাগ, তোমার অভিমান, তোমার চোখের জল এসব কি প্রমাণ করছে না তুমি আমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসো? এতে কি প্রমাণ পাচ্ছে না ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্ক কতটা ভালোবাসাময় হবে?

যাইহোক, খুব শীগ্রই এসে তোমার সামনে হাজির হবো। তোমার রাগ ভাঙাবো। তোমার মনে জমে থাকা অভিমান একটু একটু করে ভালোবাসায় পরিনত করবো। আর কি করা যায় বলো তো! ওহ হ্যাঁ মনে পরেছে। তোমাকে বিয়ে করে খুব খুব খুব শীগ্রই নিজের করে নিবো। আর অপেক্ষা করাবো না তোমাকে অনুপাখি।

ইতি,
তোমার বাউন্ডুলে প্রেমিক।

পুনশ্চঃ ১.গাছের নিচে বসে চিঠি লিখছিলাম। চিঠির সাথে তোমাকে কি গিফট দেওয়া যায় তা-ই ভাবছিলাম। ঠিক তখনই গাছ থেকে এই পাতাটা ঝরে চিঠির উপর পরলো। তখনই আমি বুঝে ফেললাম পাতাটা তোমার ছোঁয়া পেতে ব্যাকুল হয়ে পরেছে। ঠিক যেমনটা আমার চোখ ব্যাকুল হয়েছে তোমাকে দেখার জন্য। একটু ভালোবাসা দিয়ে ছুঁয়ে দিও পাতাটাকে। আমি না-হয় ভেবে নিবো তুমি আমাকে স্পর্শ করেছো।

পুনশ্চঃ ২.ভালোবাসি কথাটা কি বলতে হবে? তুমি কি অনুভব করতে পারছো না আমি তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি? আমি জানি তুমি বুঝতে পারছো। অনুভব করতে পারছো তাই না অনুপাখি! আর হ্যাঁ ধূসর রঙের চিঠি পেয়ে মন খারাপ করো না। ভালোবাসা সব সময় রঙিন কাগজেই প্রকাশ করতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। আমার ভালোবাসার রঙ না হয় ধূসর রঙের-ই হলো। খুব কি ক্ষতি হবে!

চোখ চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম আমি। ভীষণ জ্বালা করছে চোখদুটো। চোখের কার্নিশ বেয়ে অবিরত নোনাজল গড়িয়ে পরছে। অসহনীয় কিছু যন্ত্রণা চোখের পানি হয়ে ঝরে যেতে চাইছে। বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম। উত্তপ্ত মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করে উঠলো বুকের ভেতরটা। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হলো। এই ছোট্ট একটা কাগজ দুমড়েমুচড়ে দিলো আমাকে। এত সুন্দর রঙিন ম্যাপল পাতাটা খুবই বিষাক্ত মনে হলো। যে বিষের একটু ছোঁয়াতেই মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যু হলো আমার মন আর আমার ভালোবাসারও। ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল আমার হৃদয়। খুব কি দরকার ছিল এই চিঠি দেওয়ার! খুব কি প্রয়োজন ছিল এই সময় এসে আমাকে আরও দূর্বল করার। আমার ভাঙা হৃদয়ে আরও আঘাত করার?

হঠাৎই আমার ডান কাধে কারও হাতের স্পর্শ পেলাম। আমার কান্নাভেজা ঝাপসা চোখ দুটো দিয়ে মানুষটার দিকে তাকালাম। ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে আমার ডান পাশে। তার ঠোঁটজোড়ায় সহজ সরল হাসি। তার নির্লিপ্ত দৃষ্টির মুখোমুখি হতেই চোখ নামিয়ে ফেললাম। ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে মাথা নিচু করে ফেললাম। আবারও ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। ধ্রুব আমার পাশে বসলেন। নিঃশব্দে আমার ওড়না নিয়ে মাথায় বড় করে একটা ঘোমটা দিয়ে দিলেন। কিন্তু কেন? আমার কান্না লুকাতে চাইলেন! নাকি আমাকে কান্নার করার সুযোগ করে দিলেন? আমার জানা নেই এর উত্তর।
বেশ খানিকটা সময় পাড় হলো নিরবতায় আর শব্দহীন কান্নায়। নিরবতা ভেঙে প্রথমে ধ্রুবই কথা বললেন। দারুণ শান্ত শীতল গলায় বললেন-

‘তুলতুল কান্না করলেও ওকে আপনার মতোই কিউট লাগে।’

ধ্রুব হাসলে খুব সুন্দর করে। আমি তাকালাম তার হাসির দিকে। কি সুন্দর স্নিগ্ধ সেই হাসি। এই হাসিতে বিষন্নতার কোনো ছোঁয়া নেই। ধ্রুব উঠে দাঁড়ালেন। ডান হাত আমার দিয়ে বাড়িয়ে সহজ গলায় বললেন-

‘চলুন এবার যাওয়া যাক।’

আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইলাম। ধ্রুব অপেক্ষা করলেন না। উনি নিজে থেকেই আমার হাত ধরে হাঁটা শুরু করলেন।

চলবে…

শেষ রাত পর্ব-৬+৭

0

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৬
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘আচ্ছা আপনার প্রাক্তন আসলে কি আপনি তার কাছে ফিরে যাবেন?’

ধ্রুবর প্রশ্ন শুনে আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওনার দিকে চাইলাম। তুলতুলকে বুকের উপর নিয়ে ঘুম পারানোর চেষ্টা করছেন তিনি৷ তুলতুলের পিঠের উপর রাখা ওনার ডান হাত একটু পর পর ওঠানামা করছে। প্রশ্নটা যে তিনিই করেছেন তা ওনার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। আমি তপ্ত শ্বাস ফেললাম৷ ওনার এমন প্রশ্নে মনের ভেতর ক্ষীণ রাগ জন্ম নিলো। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে বয়ে কিছু সুক্ষ্ম রাগ আর অভিমান। আমি নিশ্চুপ রইলাম। ওনার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তুলতুলকে নিজের কাছে নিয়ে নিলাম। রাগ কিংবা অভিমানের উপেক্ষিতেই তুলতুলকে ছিনিয়ে নেওয়ার অধিকার খাটালাম। ওনার ঠিক উল্টো দিকে মুখ ফিরে চুপচাপ তুলতুলকে নিয়ে শুয়ে পরলাম। মিনিট খানেক পেরুতেই তুলতুলের ঘুম জড়ানো চোখ আস্তে আস্তে বুজে এলো। আচমকাই ধ্রুব মৃদুস্বরে হেসে উঠলো। আমি ঘাড় বাঁকিয়ে আমার কৌতুহলী চোখজোড়া ওনার ঠোঁটের সহজ সরল হাসিতে স্থির করলাম। হঠাৎ এভাবে বিনাকারণে হাসার মানে বুঝলাম না। ধ্রুব খানিক্ষন হেসে শান্ত গলায় বললেন-

‘বউ রাগ করে স্বামীর কাছ থেকে সন্তানকে ছিনিয়ে নিলো। তবে ঝগড়া করল না আর রাগ প্রকাশও করল না। বুদ্ধি খাটিয়ে স্বামীকে শায়েস্তা করার সুক্ষ্ম এবং নিখুঁত পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। যাইহোক তুলতুলকে মাঝে রাখুন। নয়তো ঘুমের মাধ্যে নিচে পরে যাবে।’

আমি কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এটা কি স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার স্বাভাবিক মনকষাকষি! ঠান্ডা মাথার ঝগড়া নাকি অন্য কিছু!! নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক করে তুলতুলকে আলতো করে আগলে নিয়ে আমাদের মাঝে শুয়িয়ে দিলাম। ধ্রুব এবার তুলতুলের দিকে ফিরে কাত হয়ে শুলেন। এতে করে মুখোমুখি হলো আমাদের দুজনের। অস্বস্তিতে ফ্যাকাসে বর্ণের হতে লাগলো আমার মুখ। ধ্রুব হয়তো বুঝলো। হয়তো বা লক্ষ্য করলো আমার অস্বস্তিবোধ। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই অন্যদিকে ফিরে গেলেন। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলাম। মানুষটাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে হলো না বলেই একটু স্বস্তি বোধ করলাম। না বলতেই তিনি বুঝে গেলেন আমার পরিস্থিতি এতে ওনার প্রতি কিছুটা ভালো লাগা এবং শ্রদ্ধা জন্ম নিলো।

ভ্যাপসা গরমে ঘুমের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠলাম আমি। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে পিটপিট করে চোখ মেললাম। চোখ মেলে তাকাতেই সিলিংফ্যানে নজর পরলো। ফ্যান ঘুরছে না তার মানে কি কারেন্ট চলে গেছে! চোখের দৃষ্টি নামিয়ে দেয়াল ঘড়িতে স্থির করলাম৷ ঘড়ির ছোট কাঁটা সাতটার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। ধীরে ধীরে আমার মস্তিষ্ক সচল হতেই পেটের উপর ভারি কিছুর উপস্থিতি টের পেলাম৷ আমার ঘুম ঘুম ভাব এবার পুরোপুরিই কেটে গেল। মাথা হাল্কা উঁচু করে আমার পূর্নাঙ্গ দৃষ্টি দিলাম পেটের উপর। সাথে সাথেই বরফের ন্যায় জমে গেল আমার সম্পূর্ণ শরীর। দম আটকে এলো আমার। গরমের মধ্যেও শীতলতায় শিউরে উঠলাম আমি। নিঃশ্বাস নেওয়ার ফলে পেটের ওঠানামা করা বন্ধ করার প্রাণপণে চেষ্টা করলাম। কিন্তু হলো না। আমার নিঃশ্বাসের সাথে সাথেই আমার পেটের উপরে থাকা ধ্রুবর হাতও ওঠানামা করতে লাগলো। আমি থমথমে অবস্থায় ধ্রুবর দিকে তাকাই। তুলতুল ধ্রুবর গলা জড়িয়ে ধরে একদম চিপকে শুয়ে আছে। ধ্রুবর ডান হাত তুলতুলের উপর দিয়ে এসে পরেছে আমার পেটের উপর। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। চোখ দুটো বন্ধ দেখেই খুশিতে চিকচিক করে উঠে আমার চোখ। ওনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে আমার দেহে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে ভীষণ সচেতনতার সঙ্গে ওনার হাত সরিয়ে আমি উঠে গেলাম। চোখ বন্ধ করে বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিলাম। শুকনো ঢোক গিলে ধ্রুবর দিকে একবার তাকিয়ে এগিয়ে গেলাম জানালার কাছে। জানালা খুলে দিতেই দমকা হাওয়ায় শীতল হয়ে গেল পুরো রুম। পেছন ফিরে ধ্রুবর ঘুমন্ত মুখ দেখতেই লজ্জা আঁকড়ে ধরলো আমাকে। নাকমুখ দিয়ে যেন গরম আভা বের লাগলো। লজ্জা আর অস্বস্তিতে একা একাই লালনীল হতে লাগলাম। ভাগ্যিস তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। না হলে কতটা আপত্তিকর পরিস্থিতিতেই না পড়তে হতো আমাকে। হঠাৎই উপলব্ধি করলাম আজ পর্যন্ত কোনো ছেলে আমাকে এতটা গভীর ভাবে ছুঁতে পারেনি৷ সাদাফের সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন সময়ে শুধু একে অপরের হাত ধরা হয়েছে। এর চেয়ে গভীর ভাবে কখনোই সাদাফ আমাকে ছুঁতে চায়নি। দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম আমি।

সময়টা বিকেলের শেষ। চারপাশ ভ্যাপসা গরমে কেমন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। দারুণ গুমোট একটা পরিবেশ। কাক ডাকছে ক্লান্ত ভঙ্গিতে। কর্কশ ডাকেও অদ্ভুত এক উদাসিনতা ছড়িয়ে দিচ্ছে আশেপাশে। উদাসীনতায় হাহাকার করে উঠলো আমার হৃদয়। চোখের পলকেই কেটে গেল দু’দিন। চিরচেনা এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার অন্তিম সময় হলো। এই বিষন্ন বিকেল জানিয়ে দিচ্ছে এবার আমার বিদায় নেওয়ার পালা। বাবা-মা আর ভাইয়াকে ছেড়ে যাওয়ার বিষাদময় অন্তিম প্রহর এসেছে। বিষন্ন সন্ধ্যার মতোই আঁধার নেমে এলো আমার মনে। কান্না চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। তবুও চোখ ভিজে আসলো। আব্বু, আম্মুকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কয়েক ফোটা চোখের জল বিসর্জন দিলাম। সবশেষে ভাইয়ার সামনে আসতেই ভাইয়া দুঃখি দুঃখি গলায় বলল-

‘তুই ধ্রুব ভাইয়ের বাসায় চলে যাচ্ছিস তাই আমার খুব খারাপ লাগছে। আর চিন্তাও হচ্ছে ভীষণ। তোর মতো পেত্নিকে মনি আন্টি আর ধ্রুব ভাই সামলাতে পারবে কি-না কে জানে!! খুব মায়া হচ্ছে ওনাদের জন্য।’

চোখেজল নিয়েই জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম ভাইয়ার দিকে। মন খারাপের মাঝেও হেসে ফেলল সবাই। সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠবো তখনই বাধ সাধলো তুলতুল। সে কিছুতেই ভাইয়ার গলা ছাড়তে রাজি নয়। ভাইয়ার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একপ্রকার ঝুলে আছে। অল্প কিছুদিনেই মেয়েটা ভাইয়ার সাথে একদম মিশে গেছে। ধ্রুব আর আমি বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তুলতুলকে ছাড়িয়ে নিলাম ভাইয়ার কাছ থেকে। সকলের কাছে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে।

‘জানালার গ্লাস উপরে তুলে দিন। ধুলাবালি আসছে। আপনার সমস্যা হতে পারে।’

আমি শান্ত চোখে ধ্রুব দিকে তাকালাম। তিনি সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে ড্রাইভ করছেন নির্বিকার ভঙ্গিতে। আমি নিম্ন স্বরে বললাম-

‘নাহ, সমস্যা হবে না।’

‘আমার জানামতে আপনার ডাস্ট অ্যালার্জি আছে। তবুও বলছেন ধুলোবালিতে সমস্যা হবে না!!’

আমি চুপ করে রইলাম। ধ্রুব কিভাবে জানলেন আমার ডাস্ট অ্যালার্জির কথা তা নিয়েই ব্যস্ত হলো আমার মস্তিষ্ক। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ধ্রুব নিজেই জানালার গ্লাস তুলে দিলেন। আমি কিছুই বললাম না। ধ্রুবকে খুব অদ্ভুত লাগছে আমার কাছে। এক এক সময় এক এক রকমের আচরণ করেন তিনি। আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন কিনা তা-ও বুঝতে পারছি না।

——————

‘মনি মা আমার কাছে দাও আমি নাস্তা বানাচ্ছি।’

মনি মা তরকারি নাড়তে নাড়তে শাসনের সুরে বললেন-

‘তোর এত ব্যস্ত হতে হবে না নাস্তা বানানো নিয়ে। অন্যদিন রান্না করিস। সামনে আরও অনেক দিন পরে আছে।’

আমি ইতস্তত করে বললাম-

‘তাহলে তোমার কাজে হেল্প করি!’

‘আচ্ছা আমার সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বল। কোনো হেল্প লাগলে আমি বলবো।’

আমাদের কথার মাঝেই ধ্রুবদের এক রিলেটিভ রান্নাঘরে এসে হাজির হলেন। মনি মা ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন-

‘উনি আমার ফুফাতো বোন হয়। ধ্রুব খালা। তুইও ওনাকে খালা বলেই ডাকতে পারিস।’

‘নতুন বউ থাকতে আপনি রান্না করছেন কেন আপা?’

ভদ্রমহিলার কথায় মনি মা অত্যন্ত সহজ গলায় বললেন-

‘মেয়েটা কালকেই তো এলো বাসায়। আজকেই কিভাবে রান্নার কাজে লাগিয়ে দেই!’

ভদ্রমহিলা এবার আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘তা.. রান্নাবান্না ঠিক মতো করতে পারো তো!’

আমি দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে বললাম-

‘তেমন ভালো পারি না। টুকটাক রান্না করতে পারিনি।’

আমার জবাবে ভদ্রমহিলা মুখ বিকৃতি করে বলে উঠলেন-

‘বলে কি এই মেয়ে! বিয়ে হয়ে গেছে এখনও ঠিকঠাক রান্না করতে পারো না এটা কেমন কথা!’

আমি মাথা নিচু করে মেঝেতে তাকিয়ে রইলাম। মনি মা চুলা বন্ধ করে আচঁলে হাত মুছে নিয়ে ভদ্রমহিলার দিকে পুরোপুরি ফিরে তাকায়। হাল্কা হেসে শান্ত গলায় বলে,

‘বিয়ে হয়েছে বলেই যে রান্নাবান্না শিখতে হবে এমন তো কোনো নিয়ম নেই নিপা। বিয়ের জন্য ঘরের সব কাজ জানা থাকতেই হবে এমনটা হলে তো যে কোনো কাজের মেয়ের সাথেই আমার ছেলের বিয়ে দিতাম।’

মনি মা কিছুটা থেমে আবারও বললেন-

‘ছোট থেকে এক মায়ের কাছে পড়াশোনা শিখেছে এখন না হয় ওর মনি মা’র কাছে রান্না করা শিখবে। আমি নিজেই শেখাবো সব কিছু। তবে লেখাপড়া শেষ করুক তারপর ধীরে ধীরে সংসারের কাজ শিখবে এত তাড়াহুড়ো তো নেই।’

ভদ্রমহিলা মুখ কালো করে চলে গেলেন। মনি মা আমার কাধে হাত রেখে বললেন-

‘এমন অনেক আত্মীয়স্বজন আছে যাদের কাজই হলো মানুষের খুত ধরা। মানুষকে ছোট করে কথা বলা। এদেরকে সঠিক সময় সঠিক ভাবে জবাব দিতে হয় না হলে এদের সাহস আরও বেড়ে যাবে। আর হ্যাঁ এসব কথায় একদমই মন খারাপ করিস না। যাই হোক বাদ দে। ধ্রুবর জন্য চা নিয়ে যা এখন।’

আমি মুচকি হাসলাম। মনি মা’কে যত দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি ওনার ব্যবহারে। একটা মানুষ এতটা ভালো হয় কি করে!

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৭
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘এই যে শুনছেন! সকাল হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠুন।’

আমার ডাকে ধ্রুব খানিকটা নেড়েচেড়ে আরও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলেন। আমি চায়ের কাপ টেবিলের উপরে রেখে আবারও ডাকলাম।

‘তুলতুলের আব্বু আপনার চা পাঠিয়েছে মনি মা। ঘুম থেকে উঠুন। অনেক বেলা হয়ে গেছে।’

কি আশ্চর্য! সাড়ে আটটা বেজে যাচ্ছে অথচ তিনি এখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। পর পর কয়েকবার ডাকার পরেও ওনার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারলাম না। আমার ডাক কি ওনার কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে না! নাড়াচাড়াও তো করছে না এখন। ম’রে টরে গেল না-কি!! আমার ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে এলো। সরু চোখে তাকিয়ে ওনাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। নাহ, ধ্রুব একদমই নড়ছে না। বিছানার সাইডে বসে খানিকটা ঝুঁকে ওনার নাকের কাছে হাত রাখলাম। ঠিক মতোই তো শ্বাস নিচ্ছে। ম’রেও তো যায়নি। আমি আরেকটু ঝুঁকে এসে বিস্ময় নিয়ে নরম সুরে আবারও ডাকলাম-

‘তুলতুলের আব্বু!’

এবারও তার কোনো হেলদোল হলো না। ম’রার মতো পরে পরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। বিরক্তবোধ করলাম খুব। বিরক্তিতে তিতিয়ে উঠলো আমার মেজাজ। ক্ষিপ্ত হয়ে ওনার হাত ধরে ঝাকুনিয়ে দিয়ে শক্ত গলায় বললাম-

‘আরে ভাই উঠুন না! এত ঘুমান কীভাবে আপনি!’

ঝট করেই ভূতের মতো তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে তাকালেন ধ্রুব। এহেন কাজে খানিকটা হকচকিয়ে গেলাম আমি। চোখজোড়া আপনাআপনিই বড় হয়ে গেল। ড্যাবড্যাব করে ওনার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। এভাবে কেউ ঝট করে চোখে মেলে তাকায় নাকি অদ্ভুত! ধ্রুব আমার দিকে চেয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন-

‘এভাবে ডাকলে কেউ ঘুম থেকে উঠবে না বরং আরও আরাম করে ঘুমাবে তুলতুলের আম্মু।’

আমার চাহনি তীক্ষ্ণ থেকেও তীক্ষ্ণ হলো। আগের মতোই তাকিয়ে রইলাম ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব কিছুটা নেড়েচেড়ে উঠে তার দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। অত্যন্ত সহজ গলায় বললেন-

‘আমার পারসোনাল হাতটা ছেড়ে দিন। আমি উঠবো এখন।’

আমি পিটপিট করে তার হাতের দিকে দৃষ্টি দেই। এতক্ষণে খেয়াল হলো আমি এখনও ওনার বা হাত চেপে ধরে ঝুঁকে আছি। আমার মস্তিষ্ক ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই তটস্থ হাত সরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশের দিকে নজর দিয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম অন্যত্র। পরক্ষণেই ধ্রুবর কথা পুরোপুরি বুঝতে পেরে খানিকটা রাগ হলো। পারসোনাল বুক, পারসোনাল হাত এসবের মানে?? ওনার বুক, ওনার হাত-পা সব তো ওনারই। আমি কি কখনও বলেছি ওসব আমার! তার শরীরে উপর দখল বসিয়েছি নাকি যে বার বার পারসোনাল পারসোনাল বলে চিল্লাপাল্লা করতে হবে। কথা গুলো ভেবেই রাগে চিড়বিড় করে উঠলো আমার সারা শরীর। নিজের হাতের উপরেই রাগ হচ্ছে ভীষণ। কেন ওনার পারসোনাল বডিকে ধরতে গেলাম। নিজের রাগ সংযত করে গম্ভীর কণ্ঠে বললাম-

‘আপনার চা টেবিলে রাখা আছে। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়েন। আমি আসছি।’

আমি বিছানা থেকে উঠে পা বাড়ালাম দরজার দিকে। তখনই ধ্রুবর আকর্ষণকাড়া ডাকে থমকে দাঁড়ালাম।

‘তুলতুলের আম্মু শুনুন!’

আমি পেছন ফিরলাম। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওনার শান্ত শীতল মুখের দিকে। ঘুম জড়ানো ফোলা ফোলা চেহারা। এলোমেলো হয়ে আছে তার চুল। টিশার্ট ঠিক করতে করতে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কন্ঠে হতাশা নিয়ে বললেন-

‘মেয়েদের মুখের ভাই ডাক ছেলেদের কলিজায় তীরের মতো করে বিঁধে। আর আপনি তো আমার বউ। একমাত্র বউ। বউয়ের মুখে ভাই ডাক শোনা মানে হৃদপিন্ডটা মেঝেতে রেখে পাথর দিয়ে আঘাত করে সেটাকে ক্ষত-বিক্ষত করা। হৃদয় ভেঙে চুরমার করে ফেলার মতো যন্ত্রণাদায়ক এই ভাই ডাক। আশাকরি এতটা নিষ্ঠুর আপনি হবেন না। দয়া করে ভাই না ডেকে আমার হৃদয়টাকে রেহাই দিন।’

ধ্রুব ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আর আমাকে রেখে গেলেন হতভম্ব অবস্থায়। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম সেদিকে তাকিয়ে। লোকটা কি বলে গেলেন এসব! শুধু একবার ভাই ডাকার জন্য এত জ্ঞান! এত লেকচার!! এ কেমন উম্মাদের সাথে বিয়ে হলো আমার? কি সব উদ্ভট আচরণ তার। মাথায় গণ্ডোলা আছে নিশ্চয়ই। স্বাভাবিক মানুষ বলে তো মনেই হয় না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। থমথমে পায়ে বেরিয়ে এলাম রুম থেকে।

———————

‘তুলতুল পাখি আমি অফিস যাচ্ছি। তুমি একদম দুষ্টুমি করবে না ঠিক আছে! আর আমাকে মিস করবে বেশি বেশি।’

ধ্রুবর কথাতে তুলতুলের মাঝে কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। সে আগের মতোই বিছানার ঠিক মাঝে বসে আপনমনে খেলছে। তুলতুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে ধ্রুব কপাল কুচকালেন। বিছানায় ভর দিয়ে তুলতুলের দিকে ঝুঁকে এসে আলতো করে গালে চুমু দিলেন। এতে বোধহয় তুলতুল খানিকটা বিরক্ত হলো। সঙ্গে সঙ্গেই হামাগুড়ি দিয়ে চলে আসলো আমার কাছে। মাম্মা মাম্মা বলে আমার কলে উঠে বসলো। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তুলতুলের দিকে চেয়ে উদাসীন গলায় বললেন-

‘সব সময় শুধু মাম্মা মাম্মা মাম্মা। আমি তো শুধু নামেই তুলতুলের আব্বু। সব ভালোবাসা তো শুধু মাম্মার জন্যই৷ বাড়ির কারো কাছেই এখন আর আমার মূল্য নেই। সবাই শুধু নতুন বউয়ের পেছনে ঘুর ঘুর করে। আমার আর এখানে থেকে কি লাভ? আমি যাই। থাকুন আপনারা দু’জন।’

আমি নিঃশব্দে মনোযোগ সহকারে ধ্রুবর কথা গুলো শুনলাম। তবে কিছু বললাম না। তার অসহায়ত্বের কথা শুনে ঠোঁট চেপে হাসলাম। ধ্রুব আড় চোখে দেখলেন আমাকে। ভারি কন্ঠে বললেন-

‘আমি যাচ্ছি তুলতুলের মাম্মা। আর আপনি যত পারেন সবাইকে নিজের দলে নিয়ে নিন। শুধু বাড়ির সবাইকে না পুরো এলাকাবাসীকে নিজের পক্ষে করে নিন।’

আমার হাসি চেপে রাখার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। খুব চেষ্টা করেও হাসি দমিয়ে রাখতে পারলাম না। শব্দ করেই ফেললাম। আমার দেখাদেখি তুলতুলও হাসলো খিলখিল করে। ধ্রুব কিছুক্ষণ স্থির চেয়ে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন নিঃশব্দে। আমি এখনও হেসেই যাচ্ছি৷ বহুদিন পর প্রানখুলে হাসতে চাইছে আমার বিষন্ন মন। বিষন্নতা কাটিয়ে আগের মতোই একটু হাসলাম।
চোখের পলকেই বিয়ের এক সপ্তাহ কেটে গেল। এই এক সপ্তাহ অফিসের কাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে ছিল ধ্রুব। এই ছুটি অবশ্য ওনার আব্বুই দিয়েছেন ওনাকে। আব্বুর অফিসেই কাজ করেন তিনি। ধ্রুব ছুটি নিতে না চাইলেও আব্বুর কড়া গলায় তিনি বাসায় থাকতে বাধ্য হলেন। ছুটির দিন গুলো সারাদিন তুলতুলকে নিয়েই কাটয়েছেন। আর মাঝেমধ্যে হুটহাট করেই বাহিরে চলে যেতেন। আমি জানতে যাইনি কোথায় যান, কি করেন কিছুই না। তার শর্ত মেনেই চলছি আমি। তার স্বাধীনতায় বাধা দিচ্ছি না। তবে সব কিছুর মাঝে একটা বিষয়ে একটু কৌতূহল ছিল। তুলতুল ধ্রুবকে সব সময়ই মাম্মা ডাকে। বাবা বলে কখনই ডাকেনি। একারণে ধ্রুবর মনে হয়তোবা কিছুটা আক্ষেপ ছিল। যদিও তা কখনও প্রকাশ করেনি৷ তবে আজকের কথায় খানিকটা মন খারাপের আভাস পেয়েছি।

‘মা মেয়ে মিলে এভাবে হাসছিস কেন?’

মনি মা’র কথায় আমি হাসি থামিয়ে ফেললাম। দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম মনি মা কপাল কুচকে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বললাম-

‘তেমন কিছু না মনি মা। আসো, ভেতরে এসে বসো আমাদের সাথে।’

মনি মা ভেতরে এলেন। আমার পাশে বসে বললেন-

‘ভার্সিটিতে যাবি কবে থেকে? এক সপ্তাহ হয়ে গেছে বিয়ের। পড়াশোনা তো মনে হচ্ছে একদমই ছেড়ে দিয়েছিস।’

ভার্সিটির কথা মনে পরতেই সর্বপ্রথম সাদাফের কথা মাথায় আসলো। সাদাফের সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলো একের পর এক এসে মস্তিষ্কে হানা দিতে লাগল। আবারও সেই পুরনো ব্যথা জাগ্রত হলো মনে। মনি মা’র দৃষ্টি আমার দিকে স্থির থাকায় নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক রাখতে চাইলাম। ছোট করে তপ্ত শ্বাস ফেলে ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘যাবো কিছুদিন পর। তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করো না।’

‘আবার কিছুদিন পর কেন? এমনিতেই অনেক গুলো ক্লাস মিস দিয়েছিস৷ আমি তোর মা’কে কথা দিয়েছিলাম বিয়ের জন্য তোর পড়াশোনায় কোনো প্রকার ক্ষতি হতে দিবো না৷ এখন তুই যদি ঠিক মতো পড়াশোনা না করিস তখন আমাকে সবার কাছে ছোট হতে হবে।’

আমি মনি মা’র হাত ধরে আশ্বস্ত করে বললাম-

‘চিন্তা করো না মনি মা। আমি ঠিক মতোই পড়াশোনা করবো।’

মনি মা আমার মাথায় বুলিয়ে দিলেন। আমি ম্লান হেসে মনে মনে ভাবতে লাগলাম কিভাবে ভার্সিটিতে যাবো৷ সাদাফের মুখোমুখি হবো কিভাবে? কি হবে আমাদের কথা? সাদাফ বিশ্বাস করবে আমার বিয়ের কথা? হয়তো করবে না। ভাববে তার অনু পাখি তার উপর অভিমান করে এসব মিথ্যা নাটক করছে। একটু পরেই হয়তো অনু পাখির রাগ অভিমান চলে যাবে। আদোও কি এই অভিমান শেষ হবে??

রাত প্রায় নয়টা। তুলতুলের জামা চেঞ্জ করছিলাম তখনই কলিং বেল বেজে উঠল। তুলতুলকে তাড়াতাড়ি করে জামা পরিয়ে বসিয়ে দিলাম বিছানায়। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে ছবি গুলো নিয়ে টেবিলের ডয়ারে রাখলাম। ওড়না ঠিক করে রুম থেকে বের হতে নিবো তখনই ধ্রুবর কন্ঠস্বর শোনা গেল। তুলতুলকে ডাকতে ডাকতে রুমের দিকে আসছেন উনি। ধ্রুব রুমে আসতেই তুলতুল হাসলো। ধ্রুবকে অবাক করে দিয়ে অস্ফুটস্বরে পর পর দু’বার ‘পাপা’ ‘পাপা’ বলে ডাকলো। তুলতুল দাঁড়িয়ে দু-হাত বাড়িয়ে ধ্রুবর কোলে যাওয়ার আগ্রহ দেখালো। ধ্রুব থমকালো। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো একই জায়গায়। পালটে যেতে শুরু করলো তার মুখের রঙ। ক্লান্ত মুখটা হঠাৎই বিস্ময়ে থমথম হয়ে গেল। নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো মিনিট খানেক সময়। আচমকাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে তুলতুল কোলে তুলে নেয়। আনন্দে তার চোখদুটো ঝলঝল করে উঠলো। তুলতুল আবারও পাপা ডাকতেই ধ্রুব অতিমাত্রায় আনন্দিত হলো। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না৷ হয়তো গলার মাঝেই সকল কথা আর আনন্দ দলা পাকিয়ে গেছে। কি বলবে তা হয়তো বুঝতে পারছে না ধ্রুব। তুলতুলের সারা মুখ জুড়ে অজস্র চুমু এঁকে দিলেন। ঠোঁটের কোণে তার বিশ্বজয়ী হাসি। আনন্দের অশ্রু চিকচিক করছে চোখের কোণে। তুলতুল এবার হাসফাস করতে লাগল। ধ্রুব তুলতুলকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন৷ খুশিতে আত্মহারা হয়েই এবার আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। উত্তেজিত হয়ে ধরা গলায় বললেন-

‘তুমি তুলতুলকে পাপা ডাক শিখেছো তাই না সানসাইন!’

আমি ইতস্তত করে হাল্কা মাথা নাড়ালাম। ধ্রুব আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। ঘটনার আকষ্মিকতায় বরফের ন্যায় জমে গেলাম আমি। অবশ হয়ে আসলো পুরো শরীর৷ ধড়ফড় করছে আমার হৃদপিণ্ড। এখনই বোধহয় লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে আসবে। ধ্রুব খেয়াল করলো না আমার অস্বস্তি। বুঝতে পারলো না আমার অদ্ভুত অনুভূতি। সে পর পর কয়েকবার আমাকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলেন। তবুও তার খুশি প্রকাশ করা হলো না। তিনি তুলতুলের মতোই নিজের ঠোঁট চেপে ধরলেন আমার গালে। কেঁপে ওঠলাম আমি। গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে গেল মুহুর্তেই। তাকে বাধা দেওয়ার কোনো প্রকার শক্তি নিজের মাঝে খুঁজে পেলাম না। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো।

চলবে..

শেষ রাত পর্ব-৪+৫

0

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৪
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘কি হলো! এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছিস কেন?’

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের মানুষটার দিকে। অপরিচিত একটা মেয়েকে কত সুন্দর নির্দ্বিধায় ‘তুই’ সম্মোধন করে কথা বলছে। যেন আমি তার চিরচেনা খুবই কাছের একজন মানুষ। আমি এবার সত্যিই তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম। জানালা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে সূর্যের আলো এসে পরেছে তার গায়ে। হাল্কা ব্রাউন কালারের চোখ দুটো চিকচিক করছে আলোতে। অগোছালো চুল আর হাল্কা ভাজ পরা সাদা শার্টটে কি অদ্ভুতই না দেখাচ্ছে তাকে। গাল ভর্তি দাঁড়ি গুলোও একদম অবাঞ্চিত মনে হচ্ছে। যেন বহু অবহেলায় বেড়ে উঠেছে তারা। বেপরোয়া একজন মানুষ। এই মানুষটাকে আমি আগে কখনই দেখিনি। দেখেছি বলে মনেও পরছে না আমার।

‘তোকে কি এখন নিমন্ত্রণ দিতে হবে বসার জন্য! আম্মু তো আমাকে বলেনি একথা৷ আমার জানা থাকলে অবশ্যই একটা নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে আসতাম। এখন যেহেতু আনিনি তাই চুপচাপ বসে পর অনু।’

লোকটার কথায় বুঝলাম তিনিই ধ্রুব। আমার মনে থাকা ক্ষীণ সন্দেহ দূর হলো। আমি আমার হতচকিত ভাব কাটিয়ে উঠলাম। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে তার সামনের চেয়ারে বসলাম মূর্তির মতো। আমি বসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আবারও কথা বলা শুরু করলেন। কন্ঠে হতাশা প্রকাশ করে বললেন-

‘আমি লাস্ট তোকে দেখেছিলাম তখন তোর বয়স ছয় কিংবা সাত বছর ছিল। তবুও আমি তোকে দেখা মাত্রই চিনে ফেললাম। আর আমি তো তখন কত বড় ছিলাম তারপরও তুই আমাকে চিনতে পারলি না। এটা কেমন কথা!’

আমি সরু চোখে তার দিকে তাকালাম। বেশ স্বাভাবিক ভাবে নরম সুরে বললাম-

‘আপনার মুখভর্তি দাঁডি কিংবা এমন অগোছালো ভাব আগে ছিল না তো তাই চিনতে পারিনি। আর হ্যাঁ আপনি যে বার বার আমাকে ‘তুই’ সম্মোধন করছেন, এটা আমাকে বিভ্রান্ত করার জন্যই করছেন। তা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি।’

‘কিভাবে বুঝলি!’

আমি নিজেকে যথাসাধ্য গম্ভীর করে তুললাম। চাহনি তীক্ষ্ণ করে কড়া গলায় বললাম-

‘আপনার সাথে কোনো কালেই আমার এতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো না। যে এতদিন পর দেখা হওয়ায় এভাবে আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলতে হবে। তাই দয়া করে আমার সাথে এভাবে কথা না বললেই আমি খুশি হবো।’

‘ওকে ওকে রেগে যেতে হবে না। আমি তো জাস্ট আপনার সাথে মজা করছিলাম। তবে আমি কিন্তু আগে আপনাকে তুই করেই বলতাম। তা হয়তো আপনার মনে নেই।’

ধ্রুবর কথায় আমি গম্ভীরমুখে বললাম-

‘ছোট ছিলাম তাই এসব মনে না থাকারই কথা।’

ধ্রুব নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ারে গাঁ এলিয়ে দিলেন। ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে স্থির তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। কি দেখছেন এভাবে? যাকে বিয়ে করবে তার রূপ আছে কি-না! নাকি কোনো খুঁত খুঁজে বের করতে চাচ্ছেন! উনি নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন কোনো রূপবতী মেয়ে হবে ওনার বউ। ওনার জীবনসঙ্গী। তবে আমি সেই রূপবতী নই। এখন হয়তো আমার মতো শ্যামবর্ণা মেয়ে দেখে কিছুটা হতাশ হয়েছেন। আফসোস হচ্ছে নিশ্চয়ই!!

‘এই যে সানসাইন! দয়া করে আপনার ঘড়িটা একটু খুলে রাখুন। রোদের আলো আপনার ঘড়িতে পরছে। আর সেখান থেকে তীর্যক রশ্মি এসে আমার চোখে পরছে। ঠিক মতো চোখে দেখতে পারছি না আমি।’

আমি নিঃশব্দে টেবিলের উপর থেকে হাত নিচে নামিয়ে ফেললাম। কথা বাড়ালাম না। ইচ্ছে করছে না কথা বলতে। মাথাটা বড্ড এলোমেলো লাগছে। সাদাফের কথা ওনাকে বলে দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। ওনাকে আগে থেকে সব বলে রাখাই হয়তো উচিত হবে।

‘শুনুন মিস, আমি সোজাসাপ্টা কথা বলার মানুষ। কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা আমার স্বভাবের মধ্যে নেই। তাই আমি কিছু কথা বলছি মনোযোগ দিয়ে শুনুন।’

‘জ্বি বলুন আমি শুনছি।’

ধ্রুব সোজা হয়ে বসলেন। ওয়েটার এসে দু মগ ধোঁয়া ওঠানো কফি দিয়ে গেলেন। ধ্রুব কফির মগের দিকে তাকিয়ে খুবই সহজ গলায় বলতে লাগলেন-

‘এই মুহুর্তে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। কিন্তু আম্মু নিজে থেকেই সব কিছু ঠিক করেছে ফেলেছেন। আর ওনার অমতে যাওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই বিয়েতে রাজি হয়েছি। আর তুলতুলের ব্যাপারটাও আমার মাথায় আছে।’

ধ্রুবর কথায় আমি কোনো প্রতিক্রিয়া করলাম না। ভ্রুক্ষেপহীন গলায় প্রশ্ন করলাম-

‘তো আমাকে কি করতে বলছেন?’

ধ্রুব একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। কপালে ভাজ পরেছে। চোখদুটো এখন আর চিকচিক করছে না আগের মতো। সূর্যের আলো এখন আর নেই। আমি এবার টেবিলের উপরে হাত তুলে রাখলাম। ধ্রব আবারও নির্লিপ্ততার সঙ্গে বললেন-

‘আমি স্বাধীন ভাবে চলার মানুষ। আমার দ্বারা বিয়ে নামক সম্পর্কের এত দায়বদ্ধতার মধ্যে থাকা অসম্ভব। এত এত দায়িত্ব কিংবা নিজের স্বাধীনতাকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া। কোনো কিছু করার আগে অন্য আরেকজনের পারমিশন নেওয়া৷ এটা করলাম কেন! ওটা করলাম কেন! এসবের কৈফিয়ত দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না৷ তাই আমি আগেই বলে রাখছি বিয়ের পর আমার উপর কোনো প্রকার জোর খাটাতে পারবেন না। আমি এটা পছন্দ করি না। আমি আমার মতো চলতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমি কি করবো না করবো তা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে অন্য কারো অধিকার খাটানো সহ্য করবো না। এটা আপনি বিয়ের শর্ত হিসেবে ভাববেন না-কি অন্য কিছু তা আপনার ব্যাপার।

আমি মনে মনে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসলাম। আমার অবচেতন মন বলছে আমার সামনে সাদাফ বসে আছে। সাদাফের সেই হাসি হাসি মুখটা ভাসছে আমার চোখের সামনে। কিন্তু না আমার সচল মস্তিষ্ক ধ্রুবকে আবিষ্কার করলো আমার সামনে। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকা মানুষটা ঠিক যেন সাদাফের মতোই মুক্ত পাখির মতো থাকতে চায়৷ সাদাফের মতোই অন্যকারো কোনো কথা শুনবে না। নিজের মতো চলবে, ঘুরবে, খাবে সব করবে। তাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারও থাকবে না।
আমি মৃদু হেসে নরম গলায় বললাম-

‘কারও উপর অধিকার খাটানোর ইচ্ছে আমার নেই। আমি বিয়েতে রাজি হয়েছি একমাত্র তুলতুলের জন্য আর মনি আন্টির কথা রাখার জন্য। আপনি কে! আপনি কি করেন বা ভবিষ্যতে কি করবেন এসব দেখার বিষয় আমার না।’

‘যাক তাহলে আর কোনো চিন্তা নেই। এবার নিশ্চিন্তে আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি। তবে এই শর্ত গুলো যেন সব সময় মনে থাকে। বিয়ের পর আবার প্যারাময় স্ত্রী হয়ে আমাকে প্যারা দেওয়ার কথা চিন্তা করবেন না।’

আমি হাল্কা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। ধ্রুব আর কোনো কথা বললেন না। আমি বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শক্ত করলাম। নিম্ন স্বরে বললাম-

‘আমারও কিছু কথা বলার ছিল আপনাকে।’

ধ্রুবর নির্লিপ্ত চাহনি এবার আমার মাঝে নিবদ্ধ হলো। নিঃশব্দে চেয়ে রইলো মিনিট খানেক সময়। কফির মগ হাতে নিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে অত্যন্ত সহজ গলায় বললেন-

‘নিশ্চয়ই আপনার রিলেশন আর প্রেমিকের কথা তাই তো!’

বিস্ময়ে আমি হতবাক। অবাক দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে তাকালাম। বুঝতে চেষ্টা করলাম তার ভাবাবেগ। তিনি আগে থেকে কিভাবে বুঝলেন আমি এসব বলতে চাই! উনি কি মানুষের মন পড়তে জানেন! নাকি আমার বিষয়ে আগে থেকে খোঁজ খবর নিতে এসেছেন! আমার মনে প্রশ্নের খেল চলছে। সেই খেলা থামিয়ে দিতে ধ্রুব শান্ত গলায় বললেন-

‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপনাকে দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে আপনি মানসিক চাপের মধ্যে আছেন। দুঃশ্চিন্তা অথবা নির্ঘুমে আপনার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে। আর চোখের অবস্থা না-ই বা বললাম। সবাই হয়তো ভাবছে বিয়ের চিন্তায় এমন হচ্ছে তাই কেউ কিছু বলছে না। তবে আমার মনে হচ্ছে এ বিয়ে নিয়ে আপনার এতটা মানসিক চাপ থাকার কথা না। বাকি আরেকটা কারণ থাকতে পারে তা হলো প্রেমিকের কথা। এখন আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আমার ধারনাটাই ঠিক।’

আমি ফুস করে শ্বাস ছাড়লাম। দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম তার থেকে। লোকটাকে বেপরোয়া মনে হলেও তিনি আসলে বেপরোয়া নন। হয়তো কিছু কিছু জিনিস খুব নিখুঁতভাবে শনাক্ত করতে পারেন। খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন তার আশেপাশের সবটা। আর আমি না বললেও হয়তো তিনি সব বুঝে যেতেন।

‘হ্যাঁ আপনার ধারণাই ঠিক। আর আমি আমার অতীত লুকিয়ে রেখে আপনাকে অন্ধকারে রাখতে চাই না। আমি চাইনা পরে অন্য কারও কাছ থেকে এসব শুনে আপনার মনে হোক যে আমি আপনাকে ধোঁকা দিয়েছে, মিথ্যা বলেছি। তাই আমি আমার দিক থেকে সব কিছু ক্লিয়ার করতে চাই।’

ধ্রুব হাসলেন। খুবই সহজ সরল হাসি৷ কফির মগে চুমুক দিয়েই কপাল কুচকে ফেললেন। হয়তো কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। কফির তিক্ত স্বাদেই মুখ এমন বিকৃতি হয়েছে তার।পরক্ষণেই তিনি কফির মগ রেখে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বললেন-

‘আপনার সাহস দেখে মুগ্ধ হলাম। তবে যাইহোক আপনার অতীত নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। নিশ্চিন্তে থাকুন। তিনদিন পর বিয়ে তা নিয়ে চিন্তা করুন।’

আমি আর কিছু বললাম না। মিনিট পাঁচেক নিঃশব্দে কাটিয়ে দিলাম দুজনে। খানিকক্ষণ পর আমি ধ্রুবর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই ধ্রুব ডাকলেন-

‘এই যে শুনুন!’

আমি ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম ওনার দিকে। উনি বরাবরের মতোই সহজ গলায় বললেন-

‘আপনি একদম তুলতুলের মতো হয়েছেন। সরি মানে তুলতুল দেখতে আপনার মতো হয়েছে। তুলতুলের ঠোঁটের উপরেও আপনার মতো তিল আছে। যদিও তুলতুলের তিলটা ততটা-ও স্পষ্ট এখনও হয়নি তবে আমি খেয়াল করেছি। আর আমার কাছে ওই তিলটা খুব ভালো লাগে। তবে এখন আপনার থুতনির নিচের বড় তিলটা ভালো লাগছে। আই থিংক তুলতুলের থাকলেও ভালো লাগতো।’

আমি হতবিহ্বল চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে রইলাম। এই লোক এতক্ষণ ধরে আমার মুখের তিল গুলো নিয়ে গবেষণা করেছে!! এইজন্যই কি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন! ওনার কথার প্রতিত্তোরে কি বলা উচিত তা আমার মস্তিষ্ক খুঁজে বের করতে পারলো না। মস্তিষ্ক ব্যর্থ হলো তার কথার জবাব দিতে। আমি মলিন হেসে পা বাড়ালাম রেস্টুরেন্টের সদর দরজার দিকে। পেছন ফিরে তাকালম না। ধ্রুবকে দেখ যতটুকু ধারণা হয়েছে তা অনুযায়ী ধ্রুবর কোনো মাথা ব্যথা নেই আমার নিঃশব্দে চলে আসা নিয়ে। ধ্রুবর গাঁ ছাড়া ভাব সাদাফের মতোই প্রখর। অবশেষে কি তাহলে সাদাফের মতো একজনকে আমার বিয়ে করতে হবে! আমি কি এটা মেনে নিতে পারবো! সারাজীবন কি তাহলে সাদাফের এই বেপরোয়া স্বভাবটা আমাকে ধ্রুবর মাঝে দেখতে হবে! যে স্বভাবের জন্য আমি আজ আমার সুখ হারিয়েছে, আমার ভালোবাসা হারিয়েছে। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি সাদাফের অপেক্ষায়। আমি জানি সাদাফ আসবে না। তবুও ব্যর্থ অপেক্ষা করে নিজেকে স্বান্তনা দিচ্ছি। আমি জানি আমার বিয়ের আগে কিছুতেই আসবে না। আর আমিও পারবো না তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। সাদাফ হয়তো কোনো এক অচেনা দেশে ট্যুর দিয়ে বেড়াচ্ছে বন্ধুদের সাথে। বেপরোয়া ভাবে। মুক্ত পাখির মতো। তার চিন্তা নেই তার ভালোবাসা নিয়ে। তার অনুপাখিকে নিয়ে। সাদাফ এবার নিজের অজান্তে তার অনু পাখিকে হারিয়ে ফেলল। এই তিক্ত সত্যটা কি মানতে পারবে সাদাফ?

বর্তমান,

‘তুলতুলের আম্মু আপনি ঠিক আছেন তো! দরজাটা খুলুন।’

ধ্রুব কথা গুলো বলার সাথে সাথেই বারান্দার দরজায় আস্তে করে আঘাত করলেন। আমার ধ্যান ফিরলো। খানিকটা নেড়েচেড়ে বসলাম আমি। হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল মুছে নিলাম। এখন আর নিজের মধ্যে কোনো প্রকার রাগের উপস্থিতি টের পেলাম না। সকল রাগ এখন মন খারাপে পরিনত হয়েছে।

‘আচ্ছা তুলতুলের আম্মু আমি সরি। আমার ভুল হয়েছে আপনার পারমিশন ছাড়া ডায়েরি ধরা। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। আপনি দয়া করে রুমে আসুন প্লিজ।’

আচমকাই খেয়াল করলাম ধ্রুব বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমাকে ‘তুলতুলের আম্মু’ বলে ডাকছে। অতিরিক্ত রাগের কারণে এতক্ষণ খেয়াল করিনি৷ কিন্তু হঠাৎ করে এভাবে ডাকছেন কেন? আন্টির সামনে তুলতুলকে আমাদের মেয়ে বলে পরিচয় দিয়েছি তাই!!
আমি ডায়েরিটা সামনে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে বারান্দার দরজা খুলে দিলাম। ধ্রুব হয়তো দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাই দরজা খুলে দেওয়ার সাথে সাথেই ধ্রুব হুড়মুড়িয়ে আমার উপর এসে পরলো। আমি এক হাতে তার বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম-

‘কি করছেন কি! সোজা হয়ে দাঁড়ান।’

ধ্রুব সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত গলায় বললেন-

‘সরি আসলে খেয়াল করিনি আপনি দরজা খুলে দিয়েছেন।’

ধ্রুব কিছুটা থেমে আবারও বললেন-

‘সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি তো। এবার আপনি হাত সরান আমার পারসোনাল বুক থেকে।’

ধ্রুবর কথা শুনতেই খেয়াল হলো আমার এক হাত এখনও তার বুকে রাখা। আমি চট করে হাত সরিয়ে ফেললাম। খানিকটা লজ্জাও পেলাম। তারচেয়েও বেশি বিস্মিত হলাম ওনার কথায়। পারসোনাল বুক মানে কি! এসব কি ধরনের উদ্ভব কথাবার্তা! আমাকে চুপ থাকতে দেখে ধ্রুব শান্ত গলায় বললেন-

‘আমি সরি। আমার উচিত হয়নি আপনার পারসোনাল ডায়েরি পড়া। আর আপনার প্রাক্তনকে নিয়ে ওসব কথা বলাও ঠিক হয়নি। আমি সরি তুলতুলের আম্মু।’

আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওনার দিকে চেয়ে থেমে থেমে বললাম-

‘ইটস ওকে তুলতুলের আব্বু।’

আমি ধ্রুবকে পাশ কাটিয়ে রুমে আসলাম। পেছন থেকে ওনার মৃদু হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। আমিও স্মিত হাসলাম।

চলবে..

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৫
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘তোর ফোন বন্ধ কেন অনু! খেয়াল কই থাকে তোর?’

আমি ভাইয়ার প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে তুলতুলকে কোলে তুলে নিলাম। সাথে সাথেই মেয়েটা খিলখিল করে হাসতে লাগল। কত সুন্দর প্রাণবন্ত হাসি। ওর এই হাসি দেখেই যেন পুরো ধরনী প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে। তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো তুলতুল কিছুটা আমার মতো দেখতে হয়েছে। ধ্রুবর কথা মতো তুলতুলের ঠোঁটের উপরের তিলটাও একদম আমার সাথে মিলে যায়। যে কেউ দেখলেই বিশ্বাস করে নিবে তুলতুল আমার মেয়ে। হ্যাঁ, আমারই তো মেয়ে৷

‘সানি তোকে কল দিয়েছিল৷ তোর ফোন বন্ধ পেয়ে আমার কাছে কল দিয়েছে। এই নে ফোন। কল দিয়ে এখন কথা বলে নে সানির সাথে।’

আমি হাত বাড়িয়ে ভাইয়ার কাছ থেকে ফোন নিয়ে বললাম-

‘তুই এখন যা। আমার কথা বলা শেষ হলে তোকে ফোন দিয়ে আসবো।’

‘এত তাড়া নেই। তোর যখন ইচ্ছে ফোন দিয়ে আসিস। এখন আমি যাই ফ্রেশ হয়ে আসি। ধ্রুব ভাইকে পাঠিয়ে দিস নাস্তার জন্য।’

ভাইয়া ঘুম ঘুম চোখে ঢুলতে ঢুলতে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। আমি সেদিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে তুলতুলের উদ্দেশ্যে আদুরে গলায় বললাম-

‘তোমার ঘুম ভালো হয়েছে মামুনি?’

তুলতুল হাসতে হাসতে দুই হাতে একত্র করে তালি দিতে লাগলো। আমার গালে নাকমুখ লাগিয়ে ঘষতে ঘষতে পর পর কয়েকবার মাম্মা মাম্মা বলল। বেশির ভাগ ছোট বাচ্চারাই ঘুম থেকে উঠে সাধারণত কান্নাকাটি করে৷ কিন্তু তার ক্ষেত্রে ভিন্ন। তুলতুলের মেজাজ দেখাচ্ছে ফুরফুরে। আমি পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখলাম ধ্রুব ঘুম থেকে উঠে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। তার শান্ত শীতল চাহনি আমার দিকেই স্থির। আমার চোখাচোখি হতেই তিনি দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। অগোছালো চুল গুলো হাতের সাহায্যে পেছনে ঢেলে দিলেন যত্ন করে। বিছানা থেকে নেমে নিঃশব্দে ওয়াশরুমে চলে গেলেন তিনি। আমি ছোট করে একটা শ্বাস ফেললাম। তুলতুলকে কোলে নিয়েই বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ভাইয়ার ফোন দিয়েই কল দিলাম সানিয়াকে। এক বার রিং বাজতেই ফোন রিসিভ হলো।

‘হ্যালো অনু!’

‘হ্যাঁ শুনছি বল।’

সানিয়া কিছুটা সময় চুপ থেকে নিম্ন স্বরে প্রশ্ন করল-

‘কেমন আছিস অনু?’

সানিয়ার কথায় আমার ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে এলো। কিছুটা বিস্মিত হলাম মনে মনে। এই মেয়ে সাতসকালে ফোন দিয়েছে আমি কেমন আছি তা জানার জন্য? আমাদের দুজনের মধ্যে তো কখনই এমন ফর্মালিটি দেখানোর মতো সম্পর্ক ছিল না। কেমন আছি না আছি এসব অহেতুক প্রশ্ন করে কখনই সৌজন্যতা রক্ষা করিনি। আমাদের কথা শুরু হতো ঝগড়াঝাটি আর গা’লি দিয়ে। আমি সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করলাম-

‘তুই সকাল সকাল ভাইয়ার ফোনে কল করেছিস আমি কেমন আছি তা জিজ্ঞেস করার জন্য?’

আমার প্রশ্নের প্রতিত্তোরে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসলো। চুপ করে রইলো অপরপ্রান্তের মানুষটা। সানিয়ার নিশ্চুপ থাকা দেখে বুঝতে পারলাম ও কিছু একটা নিয়ে ইতস্তত বোধ করছে। আমার সাথে কিভাবে কথা বলবে তা নিয়ে ভাবছে। আমার সাথে কথা বলতে ওর এখন ভেবেচিন্তে বলতে হচ্ছে!! তবে কি আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে জড়তা এসেছে পরেছে! কোনো কারনে কি আমি দূরে সরে যাচ্ছি আমার আশেপাশের মানুষদের থেকে? সবার সাথে আমার সম্পর্ক পালটে যাচ্ছে!

‘তোর ফোন হয়তো অফ করে রেখেছিস। তোকে কল দিয়ে ফোন বন্ধ পাচ্ছিলাম তাই ভাইয়ার ফোনে কল দিয়েছি।’

সানিয়ার কথায় মনে পরল গত পাঁচ দিন যাবত আমার ফোন বন্ধ। সাদাফকে কল দিতে দিতে ক্লান্ত হয়েই ফোন অফ করেছি। খুব যত্ন করে আলমারিতে তালা দিয়ে রেখেছি। ফোনটা চোখের সামনে দেখলেই আমার মন অস্থির হয়ে ওঠে। বেহায়া হয়ে ওঠে আমার মন। নিরাশ হতে হবে জেনেও আমার এই বেহায়া মন বার বার সাদাফকে কল দিতে চায়। নিজের বেহায়া মনের প্রতি অসহ্য হয়েই ফোনকে বন্দী করে রেখেছি চোখের আড়াল করে। আমি ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে তুলতুলের দিকে চাইলাম। তুলতল আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। হয়তো আমার কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললাম-

‘হ্যাঁ ফোন এখনও বন্ধ করে রেখেছি। এসব বাদ দিয়ে বল কল করেছিস কেন?’

‘তুই ঠিক আছিস তো অনু! সব কিছু জেনেও তোকে এই প্রশ্ন করাটা এক প্রকার বোকামি আমি জানি। তবুও জিজ্ঞেস করছি তুই কেমন আছিস?’

তুলতুল আমার কোল থেকে নেমে রুমে চলে গেল। আমি সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রেলিঙের উপর হাত রেখে অলস ভঙ্গিতে দাঁড়ালাম। দূর আকাশে আমার ক্লান্ত চাহনি স্থির করে ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘আমি ভালো আছি কি-না জানি না৷ তবে আমার উপর অনেক দায়িত্ব আছে এখন। দু পরিবারের সবাইকে ভালো রাখতে হবে৷ তুলতুলকে ভালো রাখতে হবে। তাদের জন্য হলেও আমার নিজেকে শক্ত করতে হবে সানি৷ তুলতুলের জন্য হলেও আমার বাঁচতে হবে।’

‘সাদাফ ভাই ফিরে আসলে কি হবে দোস্ত? ওনাকে শান্তশিষ্ট মানুষ দেখা যায় কিন্তু তোকে কি অন্যকারো পাশে দেখে ঠিক থাকতে পারবে?’

আমি কন্ঠে চাপা রাগ নিয়ে বললা-

‘সেটা ওর আগে ভাবার উচিত ছিলো। আমি অনেক চেষ্টা করেছি ওর সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছি। সম্পর্ক কখনও একজনের প্রচেষ্টায় টিকে না। দু পক্ষ থেকেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। সাদাফের উড়নচণ্ডী স্বভাবের জন্যই আজ আমাদের এই পরিনতি। আমি এখন অন্য কারও কিন্তু এখনও এই খবর সাদাফ জানে না। ওর কি উচিত ছিল না আমার প্রতি আর এই সম্পর্কে প্রতি একটু দায়িত্ববান হওয়া!’

—————

‘সানি কে? তোমার প্রাক্তন না-কি অন্য কেউ?’

ধ্রুবর কথায় আমি সরু চোখে তাকালাম তার দিকে। তার কোলেই তুলতুল বসে আছে। আর তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে তুলতুলের চুলে জুটি বেধে দিচ্ছেন। তাদের দু’জনের দৃশ্যটা দেখে ভালো লাগলো। তবে ওনার প্রশ্নটা মাথা থেকে বের হলো না৷ আমি টেবিলের উপর ভাইয়ার ফোনটা রাখতে রাখতে ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘বিয়েতে আমার পাশে যে মেয়েটা ছিল ওর নাম সানিয়া। আমি সানি বলে ডাকি।’

ধ্রুব মাথা তুলে পূর্নাঙ্গ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। বরাবরের মতোই শান্ত শীতল চোখ তার। খানিকক্ষণ স্থির চেয়ে থেকে ছোট করে ‘অহহ’ বলে আবারও ব্যস্ত হয়ে পরলেন তুলতুলের চুল বাধতে। আমি ধীর পায়ে ধ্রুবর দিকে এগিয়ে আসলাম। ওনার পাশে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসে বললাম-

‘তুলতুলকে আমার কাছে দিন। আমি ওর চুল বেধে দিচ্ছি।’

ধ্রুব কপাল কুচকে তাকায়। চোখ ছোট ছোট করে সন্দিহান কন্ঠে বলে,

‘আপনার কি মনে হচ্ছে আমি ওর চুল বাধতে পারবো না!’

‘নাহ তা কেন মনে হবে! তুলতুল তো এতদিন আপনার কাছেই ছিল এসবে আপনি অভ্যস্ত হতেই পারেন। কিন্তু এখন তো আমি আছি তাই আমার কাছে দিন আমি ওর চুল বেধে দিচ্ছি। আপনি বরং এখন যান। সবাই হয়তো আপনার জন্য অপেক্ষা করছে নাস্তার টেবিলে।’

ধ্রুব মাথা নাড়িয়ে তুলতুলকে আমার কলে দিয়ে দিলেন। আমার দিকে চেয়ে হাল্কা হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

‘বউ পানির গ্লাসটা একটু দাও তো।’

ধ্রুবর কথায় আমি বিষম খেলাম। গলার মাধ্যেই খাবার আটকে গেল। আমি আড়চোখে আশেপাশে তাকাল। আম্মু তুলতুলকে খাওয়াচ্ছে আর মিটমিট করে হাসছে। আব্বু আর ভাইয়াও দেখছি ঠোঁট চেপে হাসছে। লজ্জায় আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ধ্রুব আগের মতোই স্বাভাবিক। চোখের ইশারায় আবারও পানির গ্লাস চাইলো। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে ধ্রুবর দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিলাম। তিনি গটগট করে পানি খেয়ে বেসিনে হাত তুলে চলে গেলেন। আর আমাকে ফেলে গেলেন লজ্জা আর অস্বস্তির বিশাল সমুদ্রে। আমি ঝটপট করে নাস্তা শেষ করে নিজের রুমে চলে আসলাম। রুমে এসেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তখনই পেছন থেকে ধ্রুব শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললেন-

‘সরি তখন তুমি করে বলার জন্য। আমি চাই না আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে আশেপাশের মানুষ মন খারাপ করুক। তাই এখন থেকে তুমিও চেষ্টা করো সবার সামনে স্বাভাবিক বউদের মতো আচরণ করতে।’

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। ধ্রুব এবার চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় ডাকল,

‘শোনো বউ!’

ওনার ডাকে বিস্ময়ে আমার চোখজোড়া বড় বড় হলো। ধড়ফড়িয়ে উঠলো আমার বুক। আমার লজ্জা দেখেই হয়তো ধ্রুব ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে অত্যন্ত সহজ গলায় বললেন-

‘একটা কথা না বলে পারছি না। লজ্জা পেলে তোমাকে ভীষণ কিউট লাগে। তুলতুল একদম তোমার মতোই কিউট হয়েছে।’

কথাটা বলে উনি হাসতে হাসতেই রুম থেকে চলে গেলেন। আমি এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম৷ আমার হতচকিত ভাব এখনও কাটিয়ে উঠতে পারলাম না। এই লোকটা ইচ্ছে করেই আমাকে লজ্জায় ফেলতে চাচ্ছেন। তার ভেতরের চঞ্চলতার রূপ এখন আস্তে আস্তে বের হতে লাগল।

ফাল্গুনের গোধূলি বিকেল। দুপুরের উত্তপ্ত সূর্যটা শান্ত হয়ে ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে ঢলে পরতে শুরু করেছে। প্রাণচঞ্চল শহরটাতে নেমেছে মানুষের হুল্লোড়। বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে পার্কের সর্বত্র জুড়ে৷ চারপাশ মেতে উঠেছে তাদের প্রাণোচ্ছল হাসির শব্দে। পার্কের রাস্তা ধরে পাশাপাশি হাঁটছে কিছু লাজুক প্রেমিক-প্রেমিকা। বেঞ্চি গুলো দখল করে মধ্যবয়স্ক কিছু মানুষ কথার ঝুড়ি খুলেছে। এত হাসিঠাট্টার আর আনন্দমুখর পরিবেশে আমি হাঁটছি ভাবলেশহীন ভাবে। আমার পাশেই সানিয়া তুলতুলকে কোলে নিয়ে হাঁটছে। কিছুটা সামনে ভাইয়া আর ধ্রুব এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে বলতে এগুচ্ছে। হাল্কা বাতাস এসে উড়িয়ে দিচ্ছে আমার উন্মুক্ত চুল। তা দেখেই তুলতুল একটু পর পর খিলখিল করে হেসে উঠছে। আমার চুলের প্রতি মেয়েটার ভীষণ ঝোঁক এসেছে। সব সময়ই আমার চুলের প্রতি তার আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই আমি থামকে দাঁড়ালাম। স্তম্ভিত হয়ে স্থির চেয়ে রইলো সামনের বেঞ্চিটার দিকে। এই বেঞ্চিতে বসেই সাদাফের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল৷ এখানেই সমাপ্তি হয়েছিলো সব কিছুর। এই জায়গাটা জুড়ে আছে আমাদের বিচ্ছেদের স্মৃতি। আমি আর হাঁটার মতো শক্তি পেলাম না। পুরো শরীরে নেমে আসলো অসাড়তা। আচমকাই তুলতুল চেচিয়ে উঠলো। পার্কের পাশের দাঁড়িয়ে থাকা ফেরিওয়ালার কাছে বেলুন দেখে অস্থির হয়ে একনাগাড়ে বলতে লাগল-

‘মাম্মা আমি চায়, আমি চায়…’

বেলুন চেয়ে বায়না করতে করতেই সানির কোল থেকে নেমে গেল। ছোট ছোট পদক্ষেপ ফেলে ছুটে যেতে লাগলো সেই দিকে। সানিও তুলতুলের পেছন পেছন যাচ্ছে। আমি আগের মতোই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। নির্বিকারভাবে দেখছি তুলতুলের বায়না করা। তুলতুল কিছুটা দূরে যেতেই দেখলাম ধ্রুবও সেদিকে যাচ্ছে। আমি স্থির তাকিয়ে রইলাম। আচমকাই আমার কাধে কারও হাতের স্পর্শ পেলাম৷ আমি ঘাড় বাকিয়ে পাশে তাকালাম। ভাইয়া উদাসীন ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। তার চোখদুটো যেন কিছু বলতে চাইছে। আমি মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। ভাইয়া আমার হাত ধরে সামনের সেই বেঞ্চিটাতে গিয়ে বসলেন। মিনিট খানেক সময় পাড় হলো নিরবতায়। অবশেষে ভাইয়া নিরবতা ভেঙে মলিন কন্ঠে বললো-

‘হাতে গুনে পুরোপুরি তিন বছর একদিনের বড় আমি তোর থেকে৷ তবুও সব সময় চেয়েছি তোর সাথে ফ্রেন্ডলি চলতে৷ হ্যাঁ আমি মানছি ছোট থেকেই আমরা অনেক ফ্রেন্ডলি ছিলাম। বড় ছোট ব্যাপারটা কখনোই আমাদের মাঝে ছিল না। কিন্তু তুই তোর জীবনের সব থেকে বড় কথাটাই আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখলি। কি ভেবেছিলি তুই তোর ভাই বেপরোয়া! সারাক্ষণ তোর সাথে দুষ্টুমি করি, ঝগড়া করি, তোকে রাগাই। তাই বলে কি আমি আমার বোনের দিকে নজর রাখবো না! আমার বোন কি করছে না করছে তার খোঁজ খবর নিবো না!’

ভাইয়া থামলো। আমি আগের মতোই মাথা নিচু করে বসে আছি। ভাইয়া কি বলতে চাচ্ছে তা হয়তো আমার মস্তিষ্ক কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে। ভাইয়া একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বলল-

‘আমি অনেক আগেই সাদাফের সঙ্গে তোকে এখানে বসে থাকতে দেখেছি। সেদিনই আমি ওই ছেলে সম্পর্কে সব খোঁজ খোঁজ খবর নিয়েছি৷ যতটুকু জেনেছি সাদাফ খুব ভালো ছেলে। তেমন কোনো বাজে স্বভাব কিংবা বাজে কোনো রেকর্ড নেই। তাই আমি তোর সাথে এই বিষয়ে কোনো প্রকার কথা বলিনি। আমি অপেক্ষা করছিলাম তুই নিজেই আমাকে সব কিছু বলবি সেদিনের। কিন্তু তার আগেই তোর বিয়ের কথা শুরু হলো। আর আমাকে অবাক করে দিয়ে তুই নিজেও বিয়েতে রাজি হয়ে গেলি। আমি সানির কাছে থেকে সব জেনেছি। ও বলতে চাচ্ছিলো না। তবুও আমার জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না সাদাফের মতো শিক্ষিত মানুষ এতটা বেপরোয়া কিভাবে হয়। এত কিছু হয়ে গেল অথচ এখনও তার কোনো খোঁজ খবর নেই। যাইহোক সেই কথা। আমি জানি তুই এই বিয়েটা শুধু মাত্র তুলতুলের জন্য করেছিস। তবুও আমি চাই তুই সব কিছু ভুলে নতুন করে শুরু কর। ধ্রুব ভাই খুব ভালো একজন মানুষ। উনি তোকে ভালো রাখবেন নিশ্চিত। অতীত ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর অনু।’

আমি মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। ভাইয়া তো জানেই না ধ্রুব আর সাদাফ একই ধাঁচের মানুষ। যে কিনা বিয়ের আগেই আমাকে নানান রকম শর্তে বেধে দিয়েছেন সে কিভাবে আমাকে ভালো রাখবেন?

‘বাহ! দুলাভাইয়ের প্রশংসা হচ্ছে এখানে?’

সানিয়ার কন্ঠে আমি পেছন ফিরে চাইলাম। সানিয়া হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে ওর পাশেই ধ্রুব তুলতুলকে কোলে নিয়ে দাঁড়ানো।

চলবে…

শেষ রাত পর্ব-২+৩

0

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘এই বার তুমি চলে গেলে আমাকে আর কখনও ফিরে পাবে না সাদাফ।’

আমার কথায় সাদাফ মিষ্টি করে হাসলো। আমার পাশে বসে নরম স্বরে বলল-

‘পারবে না-কি আমাকে ছেড়ে থাকতে?’

আমি শান্ত চোখে চেয়ে রইলাম সাদাফের হাসি মুখের দিকে। ওর এই স্বভাবটা সব সময় আমার মন খারাপের কারণ হয়। অভিমান আর রাগের কারণ হয়। এই মানুষটার সঙ্গে যতই সিরিয়াস কথা বলি না কেন তার মধ্যে কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া কিংবা ভাবাবেগ দেখা যায় না। সব সময়ই একটা গাঁ ছাড়া ভাব তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। যেন কিছুই হয়নি। কোনো কিছু নিয়েই তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। সব কিছুই যেন স্বাভাবিক। অতি স্বাভাবিক। আমি নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললাম-

‘তুমি কি কখনও আমাকে নিয়ে সিরিয়াস ছিলে সাদাফ?’

‘এভাবে কেন কথা বলছো অনন্যা? আমি তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি তা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়। তবুও কেন এসব কথা বলছো?’

সাদাফের কথায় আমি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসলাম। হাসলো বিষন্ন মনটাও। সাদাফের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম অদুরে। চাপা কষ্ট বুকে রেখে কঠিন গলায় বললাম-

‘তোমার মাস্টার্স কমপ্লিট হয়েছে দেড় বছর হলো। অথচ তুমি এখনও ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো প্রকার চিন্তাভাবনা করছো না। কয়েক দিন পর পর ট্যুরে যাচ্ছো আর আমার সাথে সপ্তাহ খানেকের জন্য যোগাযোগ একেবারেই বিছিন্ন করে দিচ্ছ। যা এক প্রকার বিচ্ছেদের মতোই। তোমার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়ে আমি বরাবরই ব্যর্থ হই। হতাশ হই। অভিমান নিয়ে বসে রই। কিন্তু এতে তো তোমার কিছুই যায় আসে না। তুমি তোমার মতোই বন্ধুদের সঙ্গে বেশ আনন্দে থাকো। তোমাকে আমি আগেও বলেছি আব্বু আম্মু আমার বিয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু করে দিয়েছে। অথচ এসব নিয়েও তোমার কোনো প্রকার মাথা ব্যথা নেই। এত কিছুর পরেও আমি কিভাবে ভেবে নিবো তুমি আমাকে নিয়ে সিরিয়াস! তুমি কি সত্যিই আমার বিষয়ে সিরিয়াস?’

‘শোনো অনন্যা এত চিন্তা করে লাভ নেই। আমি তো বলেছি তোমার বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই আমি তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হবো।’

সাদাফের কথায় আমি হতাশ হলাম। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো এক হতাশ ভরা নিঃশ্বাস। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলালাম। ক্লান্ত গলায় বললাম-

‘কোনো বেকার ছেলের সাথে আমার বাবা কি মনে করে আমাকে বিয়ে দিবে শুনি!’

সাদাফ আমার দিকে ফিরে বাঁকা হয়ে বসলো। বরাবরের মতোই শান্ত ও ভ্রুক্ষেপহীন মুখে আমার দিকে চাইলো। অতি সহজ ভঙ্গিতে বলল-

‘আব্বুর এত বড় ব্যবসা সবটাই তো আমার। যাইহোক এখন এসব কথা রাখো। আর এক ঘন্টা পরই আমার ফ্লাইট। আমার ফ্রেন্ডরা সবাই হয়তো এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমাকে এখন যেতে হবে। আর হ্যাঁ, এসব নিয়ে তুমি এতো প্রেশার নিও না তো অনুপাখি। আমি কয়েকটা দেশ ঘুরেই এক দেড় মাসের মধ্যে ফিরে আসবো৷ এসেই প্রথমে তোমার সাথে দেখা করবো প্রমিজ। তবুও এত চিন্তা করো না প্লিজ।’

ধপধপ করেই রাগে উঠে গেল আমার মাথায়। সব সময় শান্ত, চুপচাপ মেয়ে হয়েও আমিটা-ও রেগে গেলাম৷ চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে রাগান্বিত কন্ঠে বললাম-

‘আমি তো বলেছি এবার চলে গেলে তুমি আমাকে আর কখনও ফিরে পাবে না। প্রতিবারের মতো আমি আবারও তোমার কথায় গলে গিয়ে নতুন করে রিলেশন শুরু করবো না। আর অপেক্ষাও করবো না তোমার জন্য৷ প্রতিবারের মতো তোমার সাথে যোগাযোগ করার জন্য ব্যস্তও হবো না।’

আমার রাগ প্রকাশ করা ব্যর্থ হলো। মনে মনে আফসোস হলো ভীষণ। কেন রাগ প্রকাশ করলাম এই নির্বিকার মানুষটার সামনে!! সাদাফ তার স্বভাবগত হাসি দিয়ে বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়ালো৷ আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড হাসি মুখে তাকিয়ে রইলো নিঃশব্দে। হয়তো এবারও আমার কথা, আমার অভিমান উপেক্ষা করে তার বিদায় নেওয়ার সময় এসেছে। সাদাফ পেছন ফিরে চলে যেতে যেতে বলল-

‘তা না হয় আমি আসলেই দেখে নিবো অনুপাখি।’

আমি স্থির চেয়ে রইলাম সাদাফের যাওয়ার পথে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই চোখের আড়াল হয়ে মানুষটা। সেই সাথে আড়াল হলো আমার ভালোবাসা৷ আমার অনুভূতি, আমার সবটা। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো আমার। বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম। মনের ব্যথা। বিচ্ছেদের ব্যথা। সকল কষ্ট যেন অশ্রুবিন্দু হয়ে উপচে পরতে চাচ্ছে আমার চোখদুটো দিয়ে। এই মানুষটার অপেক্ষায় থাকা আমার জন্য দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। প্রতিবার হতো সপ্তাহ খানেকের বিচ্ছেদ। আকাশস্পর্শী পর্বতের সমান অভিমান নিয়ে অপেক্ষা করেছি তার ফিরে আসার। সব কিছু ভুলে আবারও তার ভালোবাসায় ডুবে গিয়ে নতুন করে শুরু করেছি সবটা। কিন্তু আজকের বিচ্ছেদ দীর্ঘদিনের৷ আজকের দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার কিংবা শহরের নয়। যোজন খানিক দূরত্ব নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে ভিন্ন দেশে। আমার সকল অনুভূতি, অভিমান আর সকল অপেক্ষাকে তুচ্ছ করে দিয়ে চলে গেছে মানুষটা। অসহ্য যন্ত্রণায় বিষিয়ে উঠলো আমার মন। মাথা নিচু করে দুহাতে মুখ চেপে বসে রইলাম পার্কের বেঞ্চিতে। ঠিক তখনই কেউ একজন আমার এলোচুল আলতো করে টেনে ধরলো। অস্পষ্ট স্বরে আধো আধো গলায় ডাকলো-

‘মাম্মা! মাম্মা!’

আমি ঝট করেই চোখে মেলে তাকালাম। সিলিং-এর ঘুর্নায়মান পাখার দিকে চেয়ে ঘনঘন শ্বাস নিতে লাগলাম। হু হু করে উঠলো৷ আমার বুকের ভেতর। সেই বিষাক্ত দিনের মতোই তুলতুলের প্রথম মাম্মা মাম্মা ডাক কানে এসে বারি খেল। বিষাক্ততা কেটে গেল তুলতুলের মিষ্টি, আদুরে ডাকে। সকাল শুরু হলো খুবই বিচিত্রতার সঙ্গে। অন্য সব সকাল থেকে বড্ড বেশিই ভিন্ন হলো আজকের সকাল। অন্যান্য সকালের মতো পাখির কিচিরমিচির ডাক কিংবা আম্মুর চিল্লাচিল্লিতে ঘুম ভাঙলো না। আজ ঘুম ভেঙেছে তুলতুলের মায়া কাড়া ডাকে। তার জুতার পে পু শব্দ আর দরজায় পরা মৃদু আঘাতের শব্দে। ঘাড় কাত করে পাশে তাকাতেই চোখের সামনে একজন ঘুমন্ত মানুষের মুখ ভেসে উঠলো। ধ্রুবর মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড স্থির চেয়ে রইলাম৷ পরপর কয়েকবার চোখের পলক ফেলেই ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। কয়েক মিনিট সময় লাগল এই নিষ্ঠুরতম সত্যটা মেনে নিতে। অবশেষে বুঝলাম আজ থেকে এটাই হবে আমার নতুন জীবন। আমার নতুন সকাল। প্রতিটি সকালে এই মানুষটার ঘুমন্ত মুখ দেখেই আমাকে অভ্যস্ত হতে হবে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চুলগুলো হাত খোঁপা করে গায়ে ভালো করে ওড়না জড়িয়ে নিলাম। দরজায় আবারও আঘাত পরছে। অনবরত পে পু শব্দ বেজেই যাচ্ছে। আমি মুচকি হাসলাম। বিছানা থেকে উঠে এসে দরজা খুলে তাকালাম সেদিকে। ছোট্ট একটা লাল পরি পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। একা একাই হেলছে দুলছে। জুতোজোড়ায় নিজের ইচ্ছায় চাপ দিয়ে পে পু শব্দ তুলছে। দরজা খুলে গেছে তা হয়তো পরিটা টের পায়নি। আমি দরজায় একটু শব্দ করে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। সঙ্গে সঙ্গেই তুলতুল তার পে পু জুতো পড়া পায়ে ছোট ছোট কদম ফেলে ভেতরে আসলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে জড়িয়ে ধরলো আমার পা। দু হাত উঁচু করে কোলে আসার জন্য ‘মাম্মা’ ‘মাম্মা’ বলে অনুনয় করল। আমি কোলে তুলে নিলাম তাকে। কি সুন্দর সকাল! মিষ্টি একটা সকাল। অন্যসব সকাল থেকে বড্ড বেশিই সুন্দর আর পবিত্র। আমি তুলতুলকে কোলে নিয়ে বিছানায় এসে বসলাম। একটু পরেই তুলতুল হামাগুড়ি দিয়ে আমার কোল থেকে নেমে গেল। পরমুহূর্তেই লাফিয়ে পরলো ধ্রুবর বুকে। ছোট ছোট হাতে ওনার গালে থাপ্পড় দিয়ে অনবরত ডেকে যাচ্ছে-

‘মাম্মা.. মাম্মা ঘুম ওঠ।’

আমি মৃদু হাসলাম। বুঝলাম তুলতুল ধ্রুবকেও মাম্মা বলেই ডাকে। তুলতুলের ডাকে ধ্রুব চোখমুখ কুচকে ফেললেন। চোখ ছোট ছোট করে দৃষ্টি দেয় তার বুকে উপর বসে থাকা তুলতুলের দিকে। খানিকটা বিস্মিত হয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-

‘আম্মু তুমি রুমে আসলে কীভাবে? আর দরজাই বা খুললে কীভাবে?’

‘আমি দরজা খুলেছি।’

আমার কথা শুনেই ধ্রুব চমকে গিয়ে আমার দিকে তাকালেন। চোখজোড়া বড় বড় করে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে এক প্রকার লাফিয়ে উঠে বসলেন তিনি। তুলতুলকে কোলে আগলে নিয়ে নিজের শার্ট ঠিক করতে করতে অপ্রস্তুত হয়ে বললেন-

‘অহ আপনি! আপনি আমার বউ! কাল আমাদের বিয়ে হয়েছে তাই না!!’

মনে মনে আমি ভীষণ অবাক হলাম। কিন্তু প্রকাশ করলাম না। ওনার কর্মকাণ্ড আর এসব অদ্ভুত কথা শুনে আমি কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে খুবই সহজ ভঙ্গিতে বললাম-

‘আমি সঠিক জানি না। আমি জানলে আপনাকেও জানিয়ে দিবো।’

আমি আর কোনো কিছুই না বলাম। আর ওনার প্রতিত্তোরে অপেক্ষাও করলাম না। উঠে চলে এলাম ওয়াশরুমে। আমি নিশ্চিত উনিও এখন সাদাফের মতোই স্বাভাবিক হয়ে গেছেন। ভাবলেশহীন ভাবেই হয়তো তুলতুলের সঙ্গে খেলা শুরু করেছে। সাদাফের মতোই ধ্রুবর মধ্যে গাঁ ছাড়া ভাব পরিপূর্ণ। সাদাফের এই একটা স্বভাবই আমার ভীষণ অপছন্দ ছিল। ওর এই স্বভাবের কারণেই আমি দিনের পর দিন কষ্ট পেয়েছি। আর এখনও পাচ্ছি। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ধ্রুবর মাঝেও সাদাফের এই গুণটা ভরপুর। এইদিক দিয়েই এই মানুষ দুটোর মাঝে দারুণ মিল। এইটাই হয়তো আমার নিয়তি।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো। দুপুর থেকে দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা যাবত স্টেজের সোফায় বসে আছি মূর্তির ন্যায়। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন অকেজো হয়ে গেছে। পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে শরীর। এটা বৌভাতের অনুষ্ঠান তো নয় যেন কোনো অত্যাচার চলছে। মনে হচ্ছে কোনো ভুলের জন্য খুব কঠোর শাস্তি দেওয়া হচ্ছে আমাকে৷ মানুষ আসছে কথা বলছে, গিফট দিচ্ছে আর তার বিনিময়ে আমি খুব কষ্টে নিজের সাথে যুদ্ধ করে একটু মুচকি হাসার চেষ্টা করছি। নতুন বউদের এতটা শাস্তি দিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করা একমুহূর্তে আমার কাছে নেহাৎই বোকামি মনে হচ্ছে। খুবই বড় ধরনের বোকামি। আর আমার পাশের জন মানে ধ্রুব মশাই তিনি বিন্দাস তার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছেন। হাসিঠাট্টায় মেতে উঠেছেন তিনি। মাঝেমধ্যে ওনার বন্ধুরা আমাকে ইঙ্গিত করে ধ্রুবকে ক্ষেপাচ্ছেন। এতে ধ্রুব হাসছেন কিন্তু কিছু বলছেন না। আমিও সব শুনে না শোনার ভান ধরে রইলাম।

‘কিরে, তুই এখনও এখানে আড্ডা দিচ্ছিস কেন? বউমাকে নিয়ে ওদের বাসায় যা। শাকিল তো সেই কখনই তুলতুলকে নিয়ে ওদের বাসায় রওনা হয়ে গেছে। আর তুই এখনও মেয়েটাকে বসিয়ে রেখেছিস। মানে তুই কি আমার ছেলে!! আমি তো এমন বেখেয়ালি ছিলাম না তোর বয়সে। তুই কার মতো হলি! নিশ্চয়ই তোর মায়ের মতো।’

আব্বু মানে ধ্রুবর বাবা ভীষণ আক্ষেপ নিয়ে কথা গুলো বললেন। ধ্রুব তার আড্ডা থামিয়ে দিলেন। আর তার বন্ধুরা মিটমিট করে হাসছেন। ধ্রুবকে বসে থাকতে দেখে তিনি আবারও কড়া গলায় বললেন-

‘এখনও হ্যাবলার মতো বসে আছিস কেন! যা তাড়াতাড়ি বউমাকে নিয়ে। ওদের বাসায় হয়তো সবাই অপেক্ষা করছে তোদের জন্য।’

অবশেষে রওনা হলাম নিজের বাসার উদ্দেশ্যে। কাল অব্দি আমি যে বাসার মেয়ে ছিলাম আজ সেই বাসার অতিথি হয়ে যাচ্ছি। এটাই হয়তো মেয়েদের জীবন। গাড়িতে বসতেই শরীর ব্যথা খুব খারাপ ভাবে আঁকড়ে ধরেছে আমাকে। অনুষ্ঠানের ধকলে ক্লান্ত হয়ে পরেছে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ। ভীষণ ক্লান্তিতেই ঘুমে চোখদুটোর পাতা জড়িয়ে যাচ্ছে৷ ঝিমঝিম করছে মাথাটা কিন্তু ঘুমানোর ভরসা পাচ্ছি না৷ ব্যথায় ছটফট করছি ঠিক তখনই একটা হাত এসে খুব যত্নে আমার মাথাটা নিয়ে তার কাধে রাখলেন। আমি কিছু বলার আগেই ধ্রুব বেশ শীতল কন্ঠে বললেন-

‘অসুবিধে নেই। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন।’

অজানা কারণেই আমি কিছুটা ভরসা পেলাম। ধীরেধীরে চোখদুটো বন্ধ করে নিলাম। ঠিক কতক্ষণ ঘুমালাম জানি না। তবে ঘুম ভাঙলো ধ্রুবর ডাকে।

‘এই যে মিসেস! ঘুম থেকে উঠুন। আপনাদের বাসায় চলে এসেছি।’

আমি তাড়াতাড়ি করেই ওনার কাধ থেকে মাথা সরিয়ে নিলাম। ওনার দিকে কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম নিঃশব্দে।

ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে এসে ধ্রুব, তুলতুল আর ভাইয়া কাউকেই দেখতে পেলাম না। রান্নাঘরে এসে মা’কে জিজ্ঞেস করলাম-

‘মা তুলতুল কোথায়!’

মা রান্নার কাজ করতে করতে বললেন-

‘শাকিল আর ধ্রুবর সাথে হাঁটতে বেরিয়েছে।’

‘রাতের বেলা তুলতুলকে বেহিরে নিয়ে যেতে নিষেধ করলে না কেন?’

আমার কথায় মা কিছুটা অবাক হলেন। আমি নিজেও খানিকটা অবাক হলাম। আমার মধ্যে মাতৃত্ব বোধ চলে এসেছে। মা আমাকে নিয়ে যেভাবে চিন্তা করে আমিও ঠিক সেভাবেই চিন্তিত হলাম তুলতুলের জন্য। মা-ও হয়তো অবাক হলেন তার মেয়ের এই মাতৃত্ব বোধ দেখেই।

‘তুলতুল জেদ ধরেছিল। শাকিলের কোল থেকে নামছিলোই না তাই বাধ্য ওকে নিয়ে গেছে।’

আমাদের কথার মাঝেই এক আন্টি এসে রান্নাঘরে উপস্থিত হলেন। বিয়ে উপলক্ষেই বাসায় মেহমান গিজগিজ করছিল। অনেকে চলে গেছেন। তবে অল্প কয়েকজন রয়ে গেছে। হয়তো বাকিরা কাল সকালেই চলে যাবেন। আন্টি আমাদের সামনে এসে খানিকটা মুখ বিকৃত করে মা’র উদ্দেশ্যে বললেন-

‘বাচ্চাওয়ালা সংসারে তোমার মাইয়ার বিয়া না দিলেই পারতা নাহার। মাইয়া তো আর পইচা যায় নাই যে এক বাচ্চার বাপের লগে বিয়া দিতে হইলো। আমারে বললেই আমি ভালো পাত্র খুঁজে দিতাম।’

চলবে….

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৩
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘তুলতুল ওনার প্রথম সংসারের মেয়ে না। বরং আমিই ওনার প্রথম এবং একমাত্র স্ত্রী। আর তুলতুল ওনার বড় বোনের মেয়ে। যে কি-না তুলতুলকে জন্ম দিতে গিয়েই মারা গেছেন। তবে হ্যাঁ তুলতুল এখন থেকে আমাদের মেয়ে। আমার মনে হচ্ছে আপনার মাথায় কিছু ভুল ধারণা বাসা বেধেছিল আন্টি। আশাকরি সেই ভুল ধারণা এখন চলে গেছে। আর আন্টি আপনি তো বড় মানুষ। তাই বলবো অবুঝের মতো সঠিক বিষয় না জেনেই কাউকে কিছু বলবেন না।’

আন্টি মুখ অন্ধকার করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। মুখ দিয়ে আর দ্বিতীয় কোনো বাক্য বের করার সাহস বোধহয় পেলেন না। আমি পেছন ঘুরে ড্রয়িং রুমের জন্য পা বাড়াতেই মুখোমুখি হলাম ধ্রুবর। দারুণ শান্ত শীতল তার চাহনি। চোখ দুটো যেন কিছু বলতে চাইছে আমাকে। কিন্তু কি? আমি বুঝতে পারলেন না। আমার চোখাচোখি হতেই ওনার দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন। পাশেই ভাইয়া তুলতুলকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি মলিন হাসলাম৷ হাত বাড়িয়ে তুলতুলকে নিজের কাছের নিতে চাইলাম৷ তুলতুল অনায়াসেই আমার কোলে আসলো৷ আশ্চর্যজনক ভাবেই মেয়েটা আমার কোল থেকে হাত বাড়িয়ে আন্টির কোলে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। আমি কপাল কুচকালাম। একটু আগেই তো আন্টি তুলতুলকে তুচ্ছ করে কথা বললেন। আর এই মেয়ে কি-না তার কোলেই যেতে চাইছে!! আমাকে অবাক করে দিয়ে আন্টি হাসি মুখেই তুলতুলকে কোলে নিলেন। খুব আদুরে গলায় কথা বলতে লাগলেন তুলতুলের সঙ্গে। আমি নিঃশব্দে দেখলাম কিন্তু তেমন কিছু বললাম না। ধ্রুবর দিকে ফিরে তাকাতেই খেয়াল করলাম তিনি এখানে নেই। চলে গেছেন হয়তো কিছুক্ষণ আগেই। আমি আর সেদিকে পাত্তা দিলাম না। উনি ওনার মতো থাকবেন। আমি তার বিষয়ে কোনো প্রকার নাক গলাবো না এটাই তো ছিলো আমাদের শর্তে। আমি ছোট একটা শ্বাস ফেলে ভাইয়ার সঙ্গে চলে গেলাম।

রাতের খাবার শেষ হয়েছে প্রায় ঘন্টা খানেক আগে। তবুও আমি ড্রয়িং রুমে ঠায় বসে আছি। এর কারণ হলো আমার রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না। ধ্রুব আমার রুমে থাকায় অস্বস্তিবোধ করছি খুব৷ ভেবেছিলাম তুলতুল আমাদের সাথেই থাকবে আমার রুমে। কিন্তু তা আর হলো না। তুলতুল ভাইয়ার গলা জড়িয়ে ধরে অনেক আগেই ভাইয়ার রুমে ঘুমিয়ে গেছে। খুব চেষ্টা করেও তাকে আনা গেল না। আর কোনো উপায় না পেয়ে হতাশ হয়ে আমার রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। রুমের পাশে বেশ খানিকটা সময় পায়চারি করে অবশেষে রুমে গেলাম। রুমের ভেতরে আসতেই আমার মেজাজ খারাপ হলো। তরতর করে মাথায় রক্ত উঠে গেল। শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরায় বয়ে গেল অবাঞ্ছিত রাগ, জেদ আর ক্ষোভ। জীবনে প্রথম আমার এতটা রাগ উপলব্ধি করলাম৷ রাগের চোটে সাথেই সাথেই আমার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো। কোনো কিছু না ভেবেচিন্তেই ছোঁ মেরে ধ্রুবর হাত থেকে আমার ডায়েরিটা ছিনিয়ে নিলাম। ধ্রুব মাথা তুলে নির্বিকার ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালেন। থরথর করে কাঁপতে লাগলো আমার হাত। হাতের ডায়েরিটার দিকে এক নজর তাকিয়ে রাগে গর্জে উঠে বললাম-

‘আমার ডায়েরি ধরার অনুমতি আমি কাউকে দেইনি। আপনার মধ্যে কি এই কমনসেন্স টুকু নেই যে কারও পারমিশন ছাড়া তার পারসোনাল জিনিস ধরতে হয় না৷’

‘তুলতুলের আম্মু, আমি শুধুমাত্র বোরিংনেস কাটানোর জন্যই ডায়েরিটা সামনে দেখে পড়তে বসছিলাম।’

ধ্রুব সহজ সরল স্বীকারোক্তি আমার রাগ বৃদ্ধির কারণ হলো। পুরনো বিষাক্ত স্মৃতি গুলোর কথা মনে পড়তেই রাগ বাড়তে লাগলো। আমি এমনটা ছিলাম না। কখনই না। রাগ প্রকাশ করা আমার স্বভাবের মধ্যে কখনোই ছিল না। কিন্তু আজ পারলাম না নিজের রাগ সামলিয়ে রাখতে। কিছুতেই পারলাম না আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে।

‘কারও পারসোনাল ডায়েরি পড়া কোনো গল্পের বই পড়ার মতো না। নিজের বোরিংনেস কাটানোর জন্য হয়তো গল্পের বই পড়া যায়। তবে কারও একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি গুলোর ব্যবহার করা মোটেও সামান্য বিষয় না।’

আমি রাগে ফুসতে লাগলাম। তবে ধ্রুব মাঝে কোনো প্রকার ভাবান্তর ঘটলো। ঠিক যেন সাদাফের মতোই নির্বিকার, নির্লিপ্ত। সব কিছুই স্বাভাবিক যেন কিছুই হয়নি। কিছু ঘটেই নি এখানে।

‘আপনি শুধু শুধুই রেগে যাচ্ছেন তুলতুলের আম্মু। ডায়রি পড়ায় কোনো সমস্যা হওয়ার কারণ তো আমি দেখছি না। আপনার প্রাক্তনের কথা তো আমি আগে থেকেই জানি। তবে আপনার প্রাক্তন যে এতটা বেপরোয়া তা এখন জানলাম।’

আমার রাগের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেল। কিছু বলার শক্তি পেলাম না। গলার মাঝেই আটকে গেল সকল কথা। অসহায় বোধ করলাম রাগ প্রকাশ করতে না পেরে। দুচোখ দিয়ে উপচে পরতে লাগলো নোনাজল। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ছুটে চলে আসলাম বারান্দায়। দরজা লাগিয়ে নিজেকে বন্দী করে নিলাম অন্ধকার বারান্দার মাঝে। এই অন্ধকারটাই এখন আমার শান্তির জায়গায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা।

একুশ দিন আগের স্মৃতি গুলো চড়ে বসলো মাথায়। বিচ্ছেদের দাহনে পুড়তে লাগলো আমার মন। কে বুঝবে এই অসহ্য যন্ত্রণা! মানুষটা কি আদোও জানতে পেরেছে আমার বিয়ের কথা! সত্যি সত্যি আমাদের বিচ্ছেদে কথা? আমার ব্যর্থতা আর তার বেখেয়ালির কথা! বারান্দার এক কোণে চুপটি মেরে বসলাম। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। বিষাক্ত স্মৃতি গুলো মস্তিষ্কে দিশেহারা হয়ে ছুটে চলছে। সব কিছুই যেন এলোমেলো লাগলো।

একুশ দিন আগে,

আচমকাই চুলে টান পড়ায় আমি মাথা তুলে তাকালাম। সাথে সাথেই ছোট্ট বাচ্চা একটা মেয়ে তার আধো আধো গলায় ‘মাম্মা’ বলে ডাকলো আমায়। আমি থমকে গেলাম। অদ্ভুত এক অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হলাম। জীবনে প্রথম মাম্মা ডাক শোনার এক অদ্ভুত অনুভূতি। হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়ার চেষ্টা করলাম খুব। বাচ্চা মেয়েটা আবারও আমায় ‘মাম্মা’ বলে ডাকলো। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

‘তুমি এখানে একা কেন বাবু?’

আমার কথা শুনে মেয়েটা কি বুঝলো জানি না। তবে দেখে মনে হলো বেশ খুশি হয়েছে। আমার জামা টেনে ধরে কোলে উঠতে চাইলো। ছোট্ট বাচ্চা আমার বরাবরই খুব ভালো লাগে। আর এই মেয়েটা একটু বেশিই মায়াবী আর কিউট। তাই হয়তো আমার মন খারাপ নিমিষেই উবে গেল। আমি তাকে কোলে নিতেই এক মধ্যবয়সী মহিলার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম-

‘নতুন নতুন হাঁটা শিখেছে। তাই বাহিরে আসতেই বেশি তরতর করা শুরু করেছে পাকনিটা।’

আমি নিখুঁত চোখে দেখতে লাগলাম ভদ্রমহিলাকে। কেন যেন খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। তিনিও আমার দিকে কিভাবে যেন তাকিয়ে আছেন। খানিকটা সময় পর ভদ্রমহিলা উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘তোমার নাম কি অনন্যা! তোমার মায়ের নাম নাহার না!’

আমি চমকাল। থমথমে গলায় ছোট করে ‘হুম হুম’ বললাম। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমার পাশে বসে পরলেন। খুশিতে আত্মহারা হয়ে আমাকে হাল্কা জড়িয়ে ধরে বললেন-

‘আমি তোর মনি আন্টি। ভুলে গেছিস! ছোট বেলা তো মনি আন্টি মনি আন্টি বলে জান দিয়ে দিতি।’

আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। মেয়েটা এখনো আমার কোলে বসে আছে। আমার চুল গুলো নিয়ে খেলছে। আমি কিছুটা সময় চুপ থেকে ভাবলাম। তারপর হাসি মুখে বললাম-

‘চেনা চেনা লাগছিল কিন্তু অনেক দিন পর দেখলাম তোমায় তাই প্রথমে চিনিতে পারিনি। কিন্তু এই বাবুটা কে?’

‘আমার নাতনি পূর্নতা। ডাকনাম তুলতুল।’

আমি হাসলাম। তুলতুলের নরম গালে হাত রেখে বললাম-

‘তুলতুল নাম কে রাখলো! অনেক কিউট নাম।’

‘কে আবার ধ্রুব।’

আমি মৃদু হাসলাম। তুলতুলকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

‘তুলতুল কি মোহনা আপুর মেয়ে?’

আমার কথা শোনার সাথে সাথে খেয়াল করলাম মনি আন্টির চোখে জল এসে পরলো। আমি কৌতূহলী চোখে চেয়ে রইলাম ওনার দিকে। তিনি কিছুটা সময় নিয়ে মলিন মুখে বললেন-

‘হুম মোহনার মেয়ে। কিন্তু মোহনা বেঁচে নেই অনু। তুলতুলের জন্মের কয়েকঘন্টার মাথায় আমার মেয়েটা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে৷’

আমি থমকে গেলাম। হঠাৎ করেই যেন গুলিয়ে গেল সব কিছু। ছোট বেলা মোহনা আপুর কাছে এটা ওটা নিয়ে বায়না করেছি অনেক। দেখা হলেই তার পিছু পিছু লেগে থাকতাম। যেদিন শুনেছিলাম ওনারা সবাই ঢাকা থেকে চলে যাবেন সেদিন খুব কান্না করেছিলাম। শুধু মাত্র মোহনা আপুর জন্য। আজ শুনছি সেই হাস্যজ্বল কিশোরীটা নেই। বুকটা ধক করে কেঁপে উঠলো আমার। পনেরো বছরে একটা বারও দেখার সুযোগ পেলাম না মোহনা আপুর। তবুও সেই পুরনো মায়াটা আবারও জাগ্রত হলো। চুলে টান পড়ায় আমার হুশ ফিরলো। তুলতুলের দিকে তাকাতেই মন খারাপেরা ঝেঁকে বসলো আমার মাথায়। তুলতুলের কথা ভেবেই বিষাদে ছেয়ে গেল আমার মন। মা ছাড়া কিভাবে ছিল এই টুকু বাচ্চা মেয়েটা! আর বাকিটা জীবনই বা কিভাবে থাকবে! নিজেকে কোনো রকম সামলিয়ে ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করলাম-

‘তুলতুলের বাবা কোথায়?’

মনি আন্টি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হেসে বলল-

‘বিয়ে করেছে দু-মাসে হলো। তুলতুল এতদিন আমার কাছেই ছিল। কিন্তু ওর বাবার বিয়ের পর ওনাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তুলতুল নিয়ে একেবারের জন্য ঢাকা চলে এসেছি। আমি চাই না তুলতুল ওর বাবার পরিচয় জানুক। যে কিনা নিজের সন্তানের কথা ভাবার সময় পায় না তার পরিচয় নিয়ে বড় না হওয়াই ভালো।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। আর কোনো কথা বাড়ালাম না এই বিষয় নিয়ে। মনি আন্টি আর তুলতুলকে নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। এতগুলো বছর পর মনি আন্টিকে দেখেই আমার মা কেঁদেকেটে বুক ভাসালেন। তারপর সবাই মিলে আবারও পুরোনো দিনের মতো আড্ডার আসর জমালেন। তবে এবার নতুন সদস্য হিসেবে তুলতুলও আছে সবার মাঝে। এতে যেন সবার আনন্দের পরিমাণ আরও দ্বিগুণ হলো।

কি অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়েছে মেয়েটা আমার সাথে। প্রতিদিন আমার সাথে দেখা না করলেই তার চেচামেচি শুরু হয়। খেলাধুলা, খাওয়া দাওয়া সব কিছু বন্ধ করে সারাক্ষণ মাম্মা মাম্মা বলেই কান্নাকাটি করে মেয়েটা। জেদ নিয়ে বসে থাকে সারাদিন। মনি আন্টি বাধ্য হয়েই তুলতুলকে নিয়ে প্রতিদিন আমাদের বাসায় আসেন। ঘন্টা খানেক সময় থেকে চলে যেতে চাইলেই আবারও তুলতুলের পাগলামো শুরু হয়। এভাবেই যাচ্ছিলো কিছুদিন। তারপর একদিন হুট করেই মনি আন্টি আম্মুর কাছে তার ছেলের জন্য আমার হাত চাইলেন। আমাকে তার ছেলের বউ করে তুলতুলের মা হওয়ার সুযোগও দিতে চাইলেন। আমার হাত ধরে অনুরোধ করলেন তিনি। তবে আমি কিছু বললাম না। হতভম্ব হয়ে শুধু শুনে গেলাম মনি আন্টির কথা। রাত হতেই অস্থির হয়ে গেলাম সাদাফকে খুঁজেতে। বার বার ফোন করে তার সাথে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু অসহায় হলো আমার ভাগ্য। বরাবরের মতোই ব্যর্থ হলাম সাদাফের সাথে যোগাযোগ করতে৷ এই প্রথম ভীষণ ভীষণ ভীষণ কষ্ট হলো সাদাফের বেখেয়ালিতে। তার বেপরোয়া স্বভাবের জন্য নিজেকেই খুব দূর্ভাগা মনে হলো। ঘর বন্দী করে নিলাম নিজেকে। দিনের পর দিন হন্য হয়ে সাদাফের সাথে একটু কথা বলার সুযোগ খুঁজে বেড়াতাম। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটাতে লাগলাম। কান্না করে দুচোখ ফুলিয়ে আবারও চোখে পানির ঝাপটা দিতে বসে থাকতাম। তবুও ফিরে পেলাম না আমার ভালোবাসা। আর না যোগাযোগ করতে পারলাম সাদাফের সঙ্গে। অভিমান নিয়ে বলা আমার কথাটাই যেন এবার সত্যি হতে লাগলো। সত্যিই মনে হতে লাগলো সাদাফ ট্যুর থেকে ফিয়ে এসে আমাকে আর পাবে না। অভিমানে বলা কথা এভাবেই সত্যি হয়ে যাবে জানলে কখনোই মুখ দিতে এই কথা বের করতাম না। আর অন্যদিকে তুলতুলের প্রতিও আমার মায়া জন্মে গেল। মেয়েটা আমার কাছেই মায়ের ভালোবাসা খুঁজে বেড়াতো৷ আর মনি আন্টি!! তার ভালোবাসার কাছে আমি বরাবরই অসহায়। কোনো কিছুই আর আটকানোর সম্ভব হলো না। একদিন হুট করে মনি আন্টি ফোন করে বললেন-

‘অনু মা একটু কষ্ট করে তোদের বাসার কাছে যে রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে যাবি! আর তিনদিন পরেই তো বিয়ে। আমি চাই ধ্রুবর সাথে বিয়ের আগে তুই একবার দেখা করে নে। আমার এই অনুরোধটা তুই রাখ।’

অনুরোধ! ওনার মুখে কি অনুরোধ শব্দটা মানায়!! মোটেও না। যে মানুষটা আমাকে নিজের মেয়ের জায়গায় বসিয়েছে আধোও কি তার কথার বিপক্ষে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব??
আমি ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করলাম-

‘কখন যেতে হবে মনি আন্টি!’

মনি আন্টি খুশি হয়ে বললেন-

‘আধ ঘন্টার মধ্যে গেলেই হবে। আমি ধ্রুবকে বলবো তোর জন্য অপেক্ষা করতে। তাই তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।’

আমি ফোন রেখে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালায়। আয়নায় নিজেকে দেখতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। মাত্র ষোলো দিনেই শরীরের স্বাস্থ্য হ্রাস পেয়েছে অস্বাভাবিক মাত্রায়। চোখের নিচে পরেছে নিখুঁত কালো কালির রেখা। ঠোঁট মুখ শুকিয়ে একদমই বিধস্ত অবস্থা। এভাবে কি ধ্রুবর সামনে যাওয়া ঠিক হবে?? আকাশপাতাল চিন্তাভাবনা করে অবশেষে রওনা হলাম। প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় নিয়েছি রেস্টুরেন্টে আসার জন্য। রেস্টুরেন্টে আসার সাথে সাথেই মনে পরলো আমি ধ্রুবকে চিনি না। ছোট বেলা দেখেছিলাম কিন্তু বড় হওয়ার পর দেখা হয়নি। রেস্টুরেন্টের ভেতরে এসেই থমকে দাঁড়ালাম। আশেপাশে নজর দিয়েও কাউকে ধ্রুব হিসেবে চিনতে পারলাম না। হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম কর্নারের একটা টেবিল থেকে এক লোক হাতের ইশারায় আমাকে ডাকছে। আমি কিছুক্ষন চেয়ে থেকে সেদিকে পা বাড়ালাম। টেবিলের সামনে এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই মানুষটাই ধ্রুব কি-না তা নিয়ে এখনও ক্ষীণ সন্দেহ আছে।

‘কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বসে পর।’

চলবে…

শেষ রাত পর্ব-০১

0

#শেষ_রাত
#সূচনা_পর্ব
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

বাসর ঘরে প্রবেশ মাত্রই অস্পষ্ট গলায় ‘মাম্মা’ ‘মাম্মা’ বলে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পারল তুলতুল। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা তাল হারিয়ে ফেললাম। ক্লান্ত শরীরে আচমকা এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ায় নিজেকে সামলিয়ে নিতে মিনিট খানেক সময় লাগল। আমি চোখ তুলে চাইলাম সামনের মানুষটার দিকে। যার কোল থেকে তুলতুল অনায়াসে লাফিয়ে আমার কোলে এসেছে। তাকে দেখাচ্ছে নির্বিকার, নির্লিপ্ত এবং অতি স্বাভাবিক। মেরুন রঙের পাঞ্জাবি গাঁয়ে জড়ানো। ঠোঁটে স্বভাবগত মৃদু হাসি। দু’হাত আড়াআড়িভাবে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছেন ধ্রুব। আমার স্বামী ধ্রুব। এ-তো কয়েক ঘন্টা আগেই তিনবার কবুল বলে ধ্রুবর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। সবার কাছে বিয়েটা স্বাভাবিক হলেও আমাদের দুজনের মধ্যে ছিল শখানেক শর্ত। এসব শর্ত মেনেই বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়েছে। অবশ্য বিয়ে হওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল কারণ হলো তুলতুল। পরি মতো দেখতে দেড় বছর বয়সী একটা মেয়ে। নাম তার পূর্নতা।

‘তুলতুল পাখি আমার কোলে আসো। ওনার গায়ে ময়লা জীবাণু আছে। আমার কাছে নাহলে জীবণু তোমাকে খেয়ে ফেলবে।’

ধ্রুবর আদুরে কন্ঠস্বর শুনে আমার মস্তিষ্ক সচল হলো। পরক্ষণে ওনার কথা গুলো বুঝে উঠতেই ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠলো আমার পুরো শরীর। ক্ষীণ রাগ নিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চাইলাম ধ্রুবর দিকে। তার ঠোঁট জুড়ে সরল হাসি। দু হাত বাড়িয়ে তুলতুলকে নিজের কাছে নিতে চাইছেন। তবে ওনার কথায় কোনো লাভ হলো না। হয়েছে তার বিপরীত। তুলতুল আবারও ‘মাম্মা’ ‘মাম্মা’ বলে আমার গলা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। ওনার থেকে আড়াল হতে আমার ঘাড়ে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। মনে মনে কিছুটা আনন্দিত হলাম। ধ্রুব আবারও কিছু বলবেন তার আগেই মনি আন্টি মানে ওনার মা এসে রুমে উপস্থিত হলেন। আমার দিকে শান্ত চোখে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে রাগী চেহারায় তাকালেন ওনার ছেলের দিকে। গম্ভীরমুখ করে তেজি কন্ঠে বললেন-

‘বাবুকে ওর কোলে দিয়েছিস কেন! সারাদিন বিয়ের এত ঝামেলায় মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে গেছে দেখছিস না!!’

‘আমি দিয়েছি না-কি! তোমার নাতনি নিজেই এই মেয়ের কোলে লাফিয়ে পরেছে।’

ধ্রুবর সহজ সরল স্বীকারোক্তি হয়তো মনি আন্টির পছন্দ হলো না। তাইতো ভীষণ রকম ক্ষেপে উঠলেন তিনি। চোখ গরম করে ধ্রুবকে এক রামধমক দিয়ে বললেন-

‘এক থাপ্পড় দিবো বেয়াদব। মেয়ে মেয়ে বলছিস কাকে! ও তোর বউ হয় ঠিকভাবে সম্মান দিয়ে কথা বল।’

আমি চুপচাপ এনাদের দুজনের তর্কবিতর্ক দেখছি। তুলতুলও মাথা তুলে তার ডাগর ডাগর চোখ দুটো দিয়ে তাদেরকে দেখছে। ধ্রুবর চেহারায় ভয়াবহ বিরক্তিতে আঁধার নেমে এসেছে। ভ্রু জোড়ার মাঝে পরেছে বিরক্তির সরল রেখা। হয়তো আমার সামনে এভাবে বকাবকি করায় অপমানিত বোধ করছেন। বাসর ঘরে নতুন বউয়ের সামনে মা’য়ের মুখে রামধমক খাওয়া এটা নিশ্চয়ই কোনো ছেলের জন্য গর্বে বুক ফুলানোর বিষয় না। প্রথম রাতেই ইজ্জতের ফালুদা হওয়ায় চোখেমুখে কাঠিন্যতা এনে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। আর কোনো কথা বাড়ালেন না। মনি আন্টি এবার আমার সামনে এসে তুলতুলকে নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। মনি আন্টির রাগ দেখেই হয়তো তুলতুল কিছু বলল না। তবে সাথে সাথেই তার মুখ গোমড়া হয়ে এলো। অন্ধকার হয়ে গেল তার মিষ্টি মুখখানা। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ অভিমান হয়েছে তার। আমি মনি আন্টির উদ্দেশ্যে নরম সুরে বললাম-

‘মনি আন্টি আজ না-হয় পূর্ণ আমার কাছেই থাকুক। আমার কোনো সমস্যা হবে না।’

কি অদ্ভুত! আমার কথাতেও তিনি ক্ষেপে গেলেন। আজ হয়তো কথায় কথায় ওনার রেগে যাওয়ার দিবস। মনি আন্টি বেশ রাগান্বিত হয়ে বললেন-

‘দিবো এক চড়। মনি আন্টি কাকে বলছি! আগে মনি আন্টি ডেকেছিস মানলাম কিন্তু এখন থেকে মনি মা বলবি। পরের বার যেন বলে দিতে না হয়। আর তুলতুল আমার কাছেই থাকবে। সারাদিনের বিয়ের এত ধকলে তোরা দু’জনেই ক্লান্ত তাই তোরা বিশ্রাম নে। আমি যাই। মহারানীর রাগ ভাঙিয়ে আবার ঘুম পাড়াতে হবে।’

মনি মা চলে গেলেন। এই মহিলাটা খুবই অদ্ভুত এক জাদুকরী মহিলা। অল্পতেই মানুষকে আপন করে ফেলার খুব ভালো জাদু জানেন তিনি। আমি নিজেও সেই জাদুর কবলে পরেছি। নিজের ভালোবাসা, অপেক্ষা আর মায়া সব কিছু বিসর্জন দিয়েছি এই বিয়ে নামক সম্পর্কের জন্য। শুধুমাত্র তুলতুল আর মনি মা’র মায়ায় জড়িয়ে বাধ্য হয়েছি বিয়েতে রাজি হতে। নিজের অতীতকে ছেড়ে দিয়েছি শুধুমাত্র তাদেরই জন্য।

‘এক্সকিউজ মি মিসেস! যান ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি এখন যাই আমার ফ্রেন্ডদের সাথে একটু দেখা করে আসি।’

আমি নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম৷ ধ্রুব আমার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। এই লোকটার সাথে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে খুবই কম। যদিওবা ওনারা আমাদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। তবে বিগত পনেরো বছরে আমাদের ফ্যামিলির মধ্যে কোনো প্রকার যোগাযোগ কিংবা পরিচয় ছিল না বললেই চলে। দু-এক মাস হলো ওনারা ঢাকায় শিফট করেছেন। বিশ দিন আগেই এক অপ্রত্যাশিত মুহুর্তে তুলতুল আর মনি মা’র সাথে আমার কাকতালীয়ভাবে দেখা। এই সামান্য দেখাই খুব অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে। আর এই সবটাই হয়েছে তুলতুলের ‘মাম্মা’ ডাকের কারণে।

বেশখানিকটা সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে রুমে আসলাম। পুরো রুম ফাঁকা। ধ্রুব সাহেব এখনও আসেননি। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। শরীর থেকে ভারি শাড়ি খুলতেই যেন বেশ হাল্কা হাল্কা লাগছে নিজেকে। অলস ভঙ্গিতে বিছানায় এসে এলিয়ে দিলাম ক্লান্ত শরীরটা। পুরো শরীর অসাড় হয়ে আসছে। পা ব্যথাটাও এখন আর অনুভব করতে পারছি না। আর মনের তীব্র ব্যথাটাও কেমন যেন মিলিয়ে গেল। অনেক গুলো নির্ঘুম রাতের পর আজ আমার চোখে ঘুম ধরা দিয়েছে। প্রচুর ঘুমে চোখ দুটো বুঁজে আসছে আমার। হঠাৎই দরজা লাগানোর শব্দে ঝট করে চোখ মেলে তাকালাম৷ ধ্রুব এসেছেন। ওনার হাতে খাবারের ট্রে৷ তৎক্ষনাৎ বিদ্যুৎ ঝাটকা খাওয়ার মতোই দ্রুতগতিতে মনে পরলো আমার ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। ক্ষুধার্ত হওয়ার তীব্র জ্বালা অনুভব করলাম। সকাল থেকে কিছুই ঠিক মতো খাওয়া হয়নি। বিয়ের এত ঝামেলা আর দৌঁড়ঝাপে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি ধীরে ধীরে উঠে বসলাম৷ চোখ ছোট ছোট করে ধ্রুবর দিকে চেয়ে তাকে পরখ করতে লাগলাম। তবে আফসোস মানুষটা বরাবরের মতোই নির্বিকার। ধ্রুব এগিয়ে আসলেন। বিছানার পাশের টেবিলে খাবার প্লেট রেখে কন্ঠে নির্লিপ্ততা নিয়ে বললেন-

‘আমাকে বাহিরে দেখে আম্মু রাগারাগি করছিল তাই বলেছি আপনার জন্য খাবার আনতে বেরিয়েছি। আমি জানতাম আপনার নাম শুনলে রাগারাগি করবে না। ঠিক তা-ই হলো। চুপচাপ খাবার গরম করে আমার হাতে তুলে দিয়েছে। আপনার ক্ষুধা থাকলে খেয়ে নিন আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

ধ্রুব আমার কোনো কথার অপেক্ষা না করেই ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আমি স্থির চোখে সে দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন। ইতিমধ্যে পেটে জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে গেছে। খাবার দেখেই যেন ক্ষুধার পরিমাণ সেকেন্ডে সেকেন্ডে দ্বিগুণ হচ্ছে। আমি খাবারের ট্রে নিয়ে বিছানায় বসলাম। আস্তে-ধীরে খাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার! ক্ষুধা থাকা শর্তেও বেশি কিছু খেতে পারছি না। অল্পতেই ক্ষুধা মিটে গেছে। খাবার রেখে দিতেই ধ্রুব রুমে আসলেন। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে খাবারের দিকে চেয়ে বিস্ময় নিয়ে বললেন-

‘খাবার কি আপনি খেয়েছেন না-কি কোনো ইঁদুর টিদুর এসে খেয়ে গেছে! দেখে তো মনে হচ্ছে ইঁদুর-ই খেয়েছে।’

আমি চোখ ছোট ছোট করে ওনার দিকে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। ওনার খোঁচা মারা কথা শুনে আমার ভীষণ রাগ হলো। তীব্র রাগ হওয়া শর্তেও আমার স্বভাবগত অভ্যাসের কারণে তা অপ্রকাশিতই রয়ে গেল। আমি সন্দিহান কন্ঠে বললাম-

‘আমিই খেয়েছি। আর আমি কোনো ইঁদুর না।’

‘সকালে আম্মু এসব দেখলে চিল্লাপাল্লা করে কান ঝালাপালা করে দিবে।’

ধ্রুব কথা শেষ করেই আমাকে চমকে দেওয়ার মতো একটা কাজ করলেন। বিছানায় বসে চামচ নিয়ে আমার এঁটো খাবার খেতে লাগলেন। ওনার এমন কাজ দেখে আমি চমকালাম। বিস্ময়ে রসগোল্লার মতো হলো আমার চোখ দুটো। উনি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই খাবার খেয়ে যাচ্ছেন। যেন এটা খুবই স্বাভাবিক। উনি কি কোনো ভাবে বিয়েটা স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার চেষ্টা করছেন? কিন্তু এমনটা তো আমাদের শর্তে ছিল না তাহলে!! আমার মাথা এলোমেলো হলো। প্রশ্ন গুলো দিশেহারা অবস্থায় মাথার মধ্যে চরকির মতো ঘুরতে লাগল। আমি ক্ষীণস্বরে বললাম-

‘কি করছেন আপনি! আমার এঁটো খাবার খাচ্ছেন কেন?’

উনি খাবার খেতে খেতে আমার দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন-

‘আমারও একটু একটু ক্ষুধা লেগেছে তাই খাচ্ছি। আর তার চেয়েও বড় কারণ হলো খাবার অপচয় করা ভালো না।’

‘তাই বলে সবার এঁটো খাবার খাবেন?’

ধ্রুব আমার দিকে কপাল কুচকে তাকালেন। সন্দিহান কন্ঠে বললেন-

‘সবারটা কখন খেলাম? আমি কি প্রতিদিন বিয়ে করে না-কি যে প্রতিদিন নতুন নতুন বউ এসে খাবার খেয়ে আমার জন্যেও রেখে দিবে!’

আমি দমে গেলাম। হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম বিছানার এক কোণে। আর কোনো কথা বাড়ালাম না৷ উনি খাবার খেয়েই বিছানায় আমার পাশে শুয়ে পরলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আমি এক লাফে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। কয়েক পা পেছনে গিয়ে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

‘আপনি এখানে ঘুমাবেন!’

ধ্রুব মাথা হাল্কা উঁচু করে আমার দিকে চাইলেন। আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো রুমে চোখ বুলালেন। বেশ শান্ত গলায় বললেন-

‘আমার জানানামতে এটা কোনো হিন্দি সিরিয়াল না। তাদের মতো আমার রুমে আলাদা করে কোনো সোফাও রাখা হয়নি। যে আমি সোফায় ঘুমাবো আর আপনি বিছানায়। তবে আপনি চাইলে মেঝেতে ঘুমাতে পারেন। আই ডোন্ট মাইন্ড।’

আমি চোখ রাঙিয়ে চাইলাম। ধ্রুব তার ঠোঁটে সরল হাসির রেখে টেনে নিয়ে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পরলেন। আমি এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। কি করবো না করবো কিছুই বুঝে আসছে না। মিনিট খানেক সময় পেরুতেই ধ্রুবর ঘুম জড়ানো কন্ঠ শোনা গেল।

‘ক্লান্ত শরীর নিয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে পা ব্যথা শুরু হবে। তারচেয়ে বরং চুপচাপ শুয়ে পরুন। আর হ্যাঁ আমি এতটাও চিপ মাইন্ডের না যে নিজের স্ত্রীকে তার অগোচরে কিংবা তার অমতে বাজে ভাবে টাচ করবো। সো চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকুন। রিলেক্স।’

ওনার কন্ঠস্বর ধীরে ধীরে জড়িয়ে যাচ্ছে। হয়তো ঘুমিয়ে পরেছেন। আমি ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। ওনার কথা শুনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে পেলাম। আমি আর কোনো কিছু না ভেবে নিঃশব্দে শুয়ে পরলাম বিছানার অন্য পাশে। অচেনা এক লোকের সাথে একই রুমে একই বিছানায় ঘুমাতে অস্বস্তির আর সীমা রইলো না। এপাশ-ওপাশ করতে করতে মিনিট পাঁচেক পর ঘুমিয়ে গেলাম। অনেক গুলো নির্ঘুম রাতের পর ঘুম হলো আমার। ক্লান্তিতেই যেন বিচ্ছেদের তীব্র ব্যথাও ভুলে গেলাম। মনের ব্যথা ভুলে শান্তিতে ঘুমালাম আমি।

চলবে….

ত্রিকোণ পর্ব-০৫(অন্তিম পর্ব)

0

#ত্রিকোণ
#সুচন্দ্রা_চক্রবর্তী
#পঞ্চম_পর্ব(অন্তিম_পর্ব)

— ‘সংসার?’ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ঐশিক, ‘যে সংসার গড়েই ওঠেনি কোনোদিন, সেটা আবার ভাঙবে কি করে? আর যেটুকুও বা অবশিষ্ট ছিল তাতেও শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছে তোমার গীতালি ম্যাডাম, এই দেখো’, বলেই একটা কাগজ তুলে দিল ঐশিক অভিনন্দার হাতে।
— ‘ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছেন গীতালি ম্যাডাম?’
— ‘হ্যাঁ, গত দুদিন হল ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, আর কালকেই পাঠিয়েছে এটা, ও সাইন করেই পাঠিয়েছে, নীচে আমার সাইনটাও দেখতে পাচ্ছ নিশ্চয়ই?’
— ‘আপনাদের এভাবে বিচ্ছেদ হোক আমি সত্যিই চাইনি…..’
— ‘আমি চেয়েছিলাম। আর ও যদি ডিভোর্স পেপার না পাঠাতো তাহলে আমিই পাঠাতাম।’ একটু থেমে ঐশিক বলে, ‘কারণ হীরে ছেড়ে অতি সাধারণ কাচ আগলে আমিও আর বসে থাকতে চাই না।’
অভিনন্দা নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল, ওর হাতটা ধরে ঐশিক বলে উঠল, ‘চলো অভিনন্দা, ফিরে চলো!’
— ‘সবটা শুনেও আপনি আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন?’
— ‘হ্যাঁ, নতুন করে সংসার সাজাব বলেই তো নিয়ে যাচ্ছি, আর শুধু আমি একা তো নই, ওদিকে তোমার সোনাবাবুও তো তার অভি আন্টিকে একবার দেখবে বলে কি কান্ডটাই না করছে!’
— ‘স্যার, আপনি সৎ, ন্যায়পরায়ণ মানুষ, সবটা শুনে আপনার বিবেকে বেধেছে, আর তাই একটা মেয়েকে সমাজের অপমানের তীর থেকে বাঁচাবেন বলেই নিয়ে যাচ্ছেন, আমায় করুণা করছেন আপনার অপরাধবোধ থেকে, কিন্তু স্যার, আমি যে কারোর করুণার পাত্রী হয়ে বাঁচতে পারব না, আর ভালোবাসাহীন দয়ার সম্পর্কে জড়ালে আপনিও সুখী হবেন না, দুদিন পরেই ওই সম্পর্কের শিকল আপনাকে দম বন্ধ করে শেষ করে দেবে, তাই বলছি স্যার, হঠকারিতায় কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না প্লিজ!’
— ‘অভিনন্দা, তুমি আমায় ভালোবেসেছ ঠিকই, কিন্তু বোধহয় চিনতে পারোনি আমায় ঠিক, যদি চিনতে তাহলে এই কথাটা বলতে না যে আমি করুণা করছি তোমায়। কাউকে করুণা করার মতো স্পর্ধা আমার নেই, আর তোমাকে তো নেই ই। আসলে অভিনন্দা, আমিও মনে মনে তোমায় ভালোবেসেছি, শুধু ইমনের মতো শিশু নই তো তাই মুখ ফুটে বলতে পারিনি কখনো। আমি যদি তোমায় দয়া করতাম, তাহলে হয়তো তোমার ফ্ল্যাটে ছুটে যেতাম না তোমার অসুস্থতার কথা শুনে, তুমি না বলে গ্রামে চলে আসার পর ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে জোর করে তোমার রিপোর্টটা আদায় করতাম না, এমনকি এই গ্রামেও আসতাম না। আসলে কি জানো অভিনন্দা, আমার বিবাহিত স্ত্রীর কাছে আমি কোনোদিন সামান্যতম ভালো ব্যবহারটুকুও পাইনি, কিন্তু আমার পি.এ. যে মেয়েটি, তার কাছে পেয়েছি দুঃখের দিনে সান্ত্বনা, সুখের দিনে একরাশ হাসি। শুধু কি তাই, ইমনকেও তুমি দিয়েছ মাতৃস্নেহ। আর অভিনন্দা’, কিছুটা থেমে ঐশিক বলতে থাকে, ‘সেদিন যদি তোমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে থাকত, আমি যতই ড্রিংক করি না কেন এই আচরণ তার সাথে করতাম না কখনো। কারণ মানুষের মনে যে কথা থাকে, ড্রিংকড অবস্থায় সেটা বেরিয়ে আসে মাত্র, ড্রিংক মানুষের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটায় না। আর আমি চরিত্রহীন নই অভিনন্দা, বিশ্বাস করো!’ অভিনন্দার হাতদুটো ধরে শিশুর মতোই কাঁদতে থাকে ঐশিক।
— ‘স্যার বিশ্বাস করুন, আমি একবারও কিন্তু সেটা….’
— ‘না অভিনন্দা, তুমি সেটাই বলেছ! নইলে অ্যাটলিস্ট এটা বলতে না যে তোমায় আমি দয়া দেখাচ্ছি মাত্র!’

অভিনন্দাও আর সামলাতে পারে না নিজেকে। চোখের জল আর বাঁধ মানে না তার। কাঁপা কাঁপা হাতে ঐশিকের চোখের জল মুছিয়ে দেয় সে।
ঐশিক বুকে টেনে নেয় অভিনন্দাকে। বলতে থাকে, ‘তোমায় কখনো বলা হয়নি ভালোবাসি, কিন্তু আজ বলছি। অভিনন্দা, আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ সো মাচ।’
— ‘আই লাভ ইউ টু,’ অভিনন্দা বলে ওঠে, ‘আমিও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি স্যার।’
— ‘এখনও তুমি আমায় স্যার বলেই ডাকবে অভিনন্দা?’
— ‘আসলে ওটা অনেকদিনের অভ্যেস তো, ছাড়তে তো একটু সময় লাগবেই।’
— ‘আচ্ছা, তাহলে আমার সাথে ফিরছ তো আজ?’
অভিনন্দা স্মিত হেসে বলে উঠল, ‘হুম।’

(সমাপ্ত)