Monday, July 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1028



দুজনা পর্ব-০৪

0

#দুজনা
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-০৪

ইদানীং দেখছি আমার শাশুড়ী মা আমাকে আদিলের বেতনের কথা জিজ্ঞেস করছেন আমাকে।এই যেমন সকালে নাস্তা বানানোর সময় শাশুড়ী মা কিচেনে ঢুকলেন।আমি রুটি বানালাম;এর সথে আলু-মটরশুঁটি ভাজি করবো নাকি ডিমের অমলেট করবো বুঝতে না পেরে শাশুড়ী মাকে বললাম,

“মা,ডিমের অমলেট নাকি আলু-মটরশুঁটি ভাজি?”

শাশুড়ী মা আমার প্রশ্নের উত্তর না করে সোঁজা বলে উঠলেন,
“আদিল তোমাকে তার অফিস থেকে বেতন পাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলেছ?”

যদিও অবাক হলাম কিছুট।তবে তা মুখে আর প্রকাশ করলাম না।স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বললাম,

“নাহ, মা।বলে নি।”
“যদি কিছু বলে আমাকে জানাইয়ো ত।”
“জ্বী,আচ্ছা। ”

পরে দুপুরের সময়,রাতে খাবারের সময়ও জিজ্ঞেস করছেন।আমি বুঝতে পারলাম না ঠিক শাশুড়ী মা কেনো এতবার জিজ্ঞেস করতেছেন।বিষয়টি পরে আমি আচ করতে পারলাম।যখন আমি সন্ধে জামাকাপড় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেছিলাম তখন শাশুড়ী মায়ের কারো সাথে রাগারাগি করার আওয়াজ কানে আসে।সিঁড়র সাথের নিচের রুমটাতেই শাশুড়ী মা থাকেন।আমি সেখানে সেকন্ডস দুয়েকের মতন দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম শাশুড়ীমা আদিলের সাথে ফোনে কথা বলতেছেন,

“আজকে দুই তারিখ চলতেছে!আর তুই এখনো বেতন পাস নি মানে!মিথ্যে বলতেছিস নাকি আমাকে!”

আদিলের কথা শুনা গেলো না।লাউড লো ছিল।
“তোর বস বেতন দিবে না আমারতো এমন মনে হচ্ছে না!তুই ই ত বলেছিস তোর বস খুব ভালো!”

“—————-।”
“ঠিক আছে।বুঝতে পেরেছি!যদি বেতন নিয়ে দ্বিতীয়বারও এরকম টানাহেঁচড়া করে তাহলে ওখানে আর কাজ করার দরকার নেই।সোঁজা চলে আসবি বাসায়।আর এসে তোর দুলাভাই অথবা ভাইয়ের সাথে কাজে লেগে যাস।কথাটা যেনো মনে থাকে।আমি আর এসব সহ্য করতে পারতেছি না।কিসের উপরে তোদের সংসার টা চলে, হ্যাঁ?তোর এখানে এ সমস্যা ওখানে এ সমস্যা!এত সমস্যার কথা শুনলে তোদের খরচটা কতদিন চালাবে অন্যজন, বলতো আমাকে!”

“——————”
“নাহ আমি ওত কথা শুনতে চাচ্ছি না।যেগুলো বলেছি ওগুলো মাথায় রাখিস।রাখলাম!”

বলেই শাশুড়ী মা ফোনটা কেঁটে দেন আদিলের।তারপর বিরবির করে বলেন,
“টাকা দেবে না ওদের সংসার চালাবে আরেকজন!”পাশে ননদ এবং জাও ছিলেন।উনারা শাশুড়ী মায়ের সাথে ফিসফিস করে যেনো কি বলতেছেন!

আমি আর দাঁড়ালাম না।আমার রুমে চলে এলাম।জামাকাপড়গুলো পাশে বিছানার উপর রেখে চুপ করে বসে রইলাম কিছুক্ষণ!আর মনের ভেতরে সন্দেহ জমতে শুরু করলো,

“আচ্ছা,আদিল যে আমার বাবার থেরাপীর জন্যে চাব্বিশ হাজার টাকা দিয়েছিলো তা কি তার বেতনের থেকে দিয়েছিল?নাহলে ত আদিলের আর কোনো উৎস দেখছি না টাকা পাওয়ার!”

সন্দেহটা সত্যি ভাবতেই মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি।সারাটা সন্ধা মন খারাপে কেঁটেছে আমার!রাত এগোরটার দিকে আদিল কল করে।ফোন পাশেই ছিল।রিসিভ করি সাথে সাথেই।আর অপেক্ষা না করে বলি,

“আপনি বাবাকে টাকাটা কি আপনার বেতনের থেকে দিয়েছিলেন?”
“মানে কি বলতেছো তুমি এসব?”
“তাহলে কোথায় থেকে দিয়েছেন!”
“আগের কথা এখন আবার টানার মানে কী,প্রিয়া!?নাকি একই কথা বারবার তোমার বলতে ভাল্লাগে!”

আদিলের কথাতে তেঁজ ছিল কিছুটা।হয়তো রাগ হয়ে গেছে।বিয়ের সাতমাসের মাথায় আজ এই প্রথম মানুষটির তেঁজ অবলোকন করলাম!তারপরও চুপ করে থাকলাম না।উল্টো রাগ চলে এলো!কে বলেছে ওক এত দয়ালু হতে!কে বলেছে!রাগে-অভিমানে বলতে থাকলাম,

“তবে শুনু রাখুন এটা করা আপনার একদমই ঠিক হয়নি!”

সাথে সাথে আদিল কলটা কেঁটে দিলো।বুঝলাম ও আরো রেগে গেছে!

পরদিন সকালে আদিল আবার কল করে!স্ক্রিনে উনার নামটা ভেসে উঠতেই মন ভরে শ্বাস নিই।বিশ্বাস করুন?গতকাল রাত উনি রাগে কলটা কেঁটে দেওয়াতে শ্বাস আমার রুদ্ধ হয়ে গেলো।এখন যেনো আবার প্রাণটা ফিরে এলো।কলটা রিসিভ করতেই,

“সরি প্রিয়া!কালরাতে ওভাবে কল কেঁটে দেওয়াতে।আমার উপর তোমার খুব রাগ হয়েছিল না?মনখারাপও হয়তো!আই’ম সরি প্রিয়া।আসলে আমি তোমাকে মনখারাপ হতে দিই নি।তবে,একই প্রসঙ্গ আমার এতবার শুনতে ভালো লাগে না।প্লিজ তুমিও প্রিয়ু একই প্রসঙ্গ বারবার আমাকে বলো না।”

আমার পেঁটের কোণে এখন দেখি হাসিটা চেপে রাখাও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।ছেলেটা নিজের রাগ-অভিমান সব রাখতে পেরেছে চেপে?মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে নিজেই আবার বেহায়া বিলাইয়ের মতন মেওমেও করতেছে। বহু কষ্টে হাসিটাকে সামলিয়ে,গলাটা ভালো কর ঝেঁড়েঝুড়ে নিই,যাতে একটি কণাও আমার হাসির শব্দ আদিলের কানে না পৌঁছায়।বললাম,
“ইট’স ওকে।ইট’স ওকে!”

আহা শান্তি!এই মানুষটা রাগ করে থাকলে আমারো ভাল্লাগে না!তারপর অনেকক্ষণ ধরে আমরা কথা বললাম।কত কথাতে কত ধরণ ছিল আমাদের হাসি-তামাশা আবার জোকস আবার মাঝে মাঝে দুঃখেরও কথা!উনার মা-বাবার ব্যাপারে বলেছেন।উনার মায়ের থেকেও নাকি উনার বাবার আদর বেশি পেয়েছেন।বাবা সারাক্ষণ নিজের কাছে কাছে রাখতো।সুযোগ পেলে গল্প শুনাতো।আবার আদর করে “আমার জান” বলে ডাকতো।তবে অতি সুখ বেশিদিন সইলো না।এগারো বছরকালেই বাবা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য শহরে যাওয়ার পথে ট্রাক এক্সিডেন্টে মারা যান।কত কেঁদেছিলেন বাবার জন্যে সেইদিন।আর আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন সংসারটা খুব ভালো থাকতো। রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোর সাথে মুখ কালো হতো না কারো !

————————————————-
পরের মাসেও শাশুড়ী মা আদিলের থেকে বেতনের টাকা পায়নি।আর চাকরিটাও ছাড়ে নি।এই নিয়ে শাশুড়ী মা প্রচন্ড রেগে যায়।সেই রাগটা শাশুড়ী মায়ের তার তিনদিন পরে আরো তিনগুণ বেড়ে যায়।কারণ হলো আদিলের টাকায় আমার বাবার যে থেরাপী চিকিৎসা করা হয় তা কিভাবে যেনো শাশুড়ী মা, ননদ এবং জা জেনে যায়!শাশুড়ী মা আমাকে এসে খুব বকেন।আর এও বলেন,

“একটা ভাতের দানাও যদি তুই আমার মেয়ের এবং বড় ছেলের টাকার খাস তাহলে সেইদিন তোকে আমি দেখে নিব!ফকিন্নি,এমনিতে তো বাপের বাড়ি থেকে কিছু আনতেই পারিস নি আবার আমার সংসারের টাকা তোর সংসারে দিস!সাহস কত!এইজন্যেই ত ভাবী ছেলেকে আমার মন্ত্র কেন পড়ায়!”

চলবে……..

দুজনা পর্ব-০৩

0

#দুজনা
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-০৩

মা কারো কাছে চড়া সুদেও টাকা পেলেন না।আর বাকি আছে মাত্র দুইদিন।দুইদিন পর বাবার থেরাপী দিতে হবে।অথচ এখনো টাকা জোগাড় হয়নি।জোগাড় হবেও কি না,তাও অনিশ্চিত। সবরকমের চেষ্টা করা শেষ মায়ের!মা সকাল থেকে পাগলের মতন করতেছেন!বিশ-ত্রিশ বার কল করা শেষ আমাকে।কল করে শুধু এটুকুই বলতেছেন,

“কি হবে,প্রিয়া?কি হবে?কি হবে!”
আমার উত্তর শুধু কান্না!আসলে উত্তর করার মতন আমার কোনো শব্দ জানা নেই।তবে ভাবছি বাসায় যাবো।যেয়ে আমিও চেষ্টা করবো।দেখি টাকার ব্যবস্থা করা যায় কি না।আল্লাহ উপায় একটা অবশ্যই দেবেন।শাশুড়ী মাকে বলতে হবে বাড়ি যাওয়ার কথা।

——————————————————-
বিকেলের নাস্তা বানানো সেগুলো টেবিলে রাখি।শাশুড়ী মা ডাইনিং ই বসা ছিলেন।জা এবং ননদ এখনো আসেননি।আসবেন।শাশুড়ী মা চেয়ারে বসে বসে তসবি গুনছেন আর আমার দিকে তাকাচ্ছেন।আমি সবকিছু চটজলদি হাতে শেষ করার চেষ্টা করি।চাচ্ছি বাসায় যাওয়ার কথাটা আমার ননদ এবং জা এখানে আসার আগেই মাকে বলে নিব।পরে উনাদের সামনে বললে শাশুড়ী মা রাজি হন কি হন না কে জানে!কিচেনে শেষ কিছু এঁটো থালাবাসন ছিল।সেগুলো তাড়াতাড়ি ধুঁয়ে ওড়নায় কোনমতে হাত মুছে ডাইনিং আসি,ূ

“মা?একটু কথা ছিল।”

উনার তসবির কড়ি গোনা শেষ হয়নি বোধহয়।ঠোঁট নড়তেছে।তাই সাথে সাথে উত্তর পাই নি।উত্তর পেতে আরো এক মিনিটের মতন দাঁড়িয়ে থাকি।সবগুলো কড়ি পড়া শেষ হলে কি যেনো একটা সূরা পড়েন।তারপর বুকে,দুইকাঁধে ফু মারেন।এবার আমার দিকে তাঁকিয়ে,

“দেখতেই পাচ্ছ তসবি পড়তেছি।তসবি পড়ার মাঝে কথা বলা কোনধরণের বদভ্যাস?”

মাথা নুইয়ে ফেলি।আসলেই আমি বাসায় যাওয়ার চিন্তায় ওলটপালট প্রায়।তাই ঠিক খেয়াল করিনি।তবে শাশুড়ী মাকে আর কিছু বললাম না।উনি এবার গলা খাঁকারি টেনে বলেন,
“কি বলতে এসেছো বলো?”
“মা আমার বাবারলকে আর দুইদিন পর থেরাপী দেওয়া হবে।আমি বাসায় যেতে চাচ্ছি একটু।তাই আপনাকে বলতে এসেছি।”
“গত মাসে যে বাবাকে থেরাপী দিলে তখন কোনা বাসায় ছিলে?”
“জ্বী,এই বাসায়।”
“তো এবারো যাওয়ার কি দরকারা!থেরাপী দিবে তোমার মা আছে,মামা আছে।আর তুমিতো ডাক্তার না যে যেতেই হবে,নাকি?”
“মা আমার এবার যেতে খুব মন চাচ্ছে।না করবেন না মা।বাবাকে অনেকগুলো দিন হলো দেখি নি।”

বলতেই চোখজোড়া থেকে টপটপ করে পানি বেয়ে পড়লো! এরমাঝে জা এবং ননদ চলে আসেন।আমার চোখে পানি দেখে,
“কাঁদছে যে?”

শাশুড়ী মা মুখটা ভার করে খাওয়াতে হাত লাগালেন ।জা এবং ননদের কথার জবাব দিলেন না।উনারাও জবাবের আশা না করে চেয়ার টেনে খেতে বসলেন।।আমি যে দাঁড়িয়ে,আর চোখে পানি। কারো খেয়াল নেই।আর খেয়াল করার প্রয়োজনও মনে হচ্ছে না এদের কারো।নিজেকে স্বাভাবিক আনতে সময় লাগলো।তবে আর বেশিক্ষণ দেরী করলাম না।আত্মসম্মানে তীব্র আঘাতে রুমে ফিরে এলাম এদের সামনে থেকে।রুমে এসেও শব্দ করে কান্না করতে পারলাম না।অবশের মতন হয়ে গেলাম।ফোনটা হাতে নিলাম।খুব ইচ্ছে হলো আদিলকে কল করতে।আদিল হয়তো অফিসে।তাও আমার কিছু যায়-আসলো না।কল করে বসলাম।তিন-চারবার রিং হতে রিসিভ করলো আদিল।আর আমি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলাম।অন্য সময় হলে আদিল কলটা কাটার জন্যে অস্থির হয়ে যেত,”প্রিয়া,কল কাঁটো বস দেখে ফেলবে!চাকরি যাবে।”আদিল আজ তা করলো না।আজ সে আমার কান্নায় অস্থির হয়ে গেল,

“কি হয়েছে প্রিয়া?কি হয়েছে তোমার?”
” আমি আমাদের বাসায় যাবো।আগামী বুধবারে বাবাকে থেরাপী দিতে হবে।মায়ের হাতে কোনো টাকা নেই।মা কারো থেকে ধারও পাচ্ছে না।আমি বাসায় গিয়ে চেষ্টা করবো টাকার ব্যবস্থা করার।সময় নাই।যেতে না করবেন না আমাকে।”

ওপাশ থেকে আদিলের মিনিট একের মত নিস্তব্ধতা শুনতে পেলাম। পরে বললেন,
“তারমানে বুধবারেই টাকাটা লাগবে,তাইতো?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা তুমি বাসায় যাও।আমি কল করে বলে দিচ্ছি।আর পারলে আজকেই চলে যাও।”
“মা দিবেন না।আমি মাকে বলেছি।”
“আচ্ছা আমি কথা বলতেছি।রাখো।”

————————————————–
সন্ধে নেমে আসে।চারদিকে ঝিঁ ঝি পোকা ডাকছে।আঁধার নেমেছে কিছুটা।আমি রুমের জানলাগুলো বন্ধ করে পর্দা নামিয়ে দিলাম।এমন সময় আমার ননদ আমার রুমে আসেন।বলেন,
“তোমাকে মা ডাকছেন।”
বলেই চলে যান।আমি শাশুড়ী মায়ের রুমে যাই।মাগরিবের নামাজে দাঁড়াবেন।জায়নামাজ বিছিয়েছেন ফ্লোরে।আমাকে দেখামাত্রই বলেন,

“আমাকে রাজি করাতে পারো নি, গলায় ঝুঁলে স্বামীকে নিজে রাজি করিয়ে নিলে অবশেষে?বাসায় যেতে খুব ইচ্ছে হলো না?এখনই যাও!”

বলেই নিয়ত বেঁধে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম।আমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ়!কি বললেন উনি এটা!সন্ধের পরই বের হই আমি।রিজার্ভ সি.এন.জি নিয়ে।আদিল ঢাকায় যাওয়ার সময় আমার হাতে হাজার দুয়েক টাকা দিয়ে যায়।তার থেকে ভাড়া দিই।বাসায় আসাতে মা খুশি হয়ে যান।বাবাও।বাবাকে দেখে আমার খুব কান্না পেয়ে যায়।যে’বার শেষ দেখলাম, মনে হয় পাঁচ মাস হবে।বাবাকে মোটামুটিভাবে স্বাস্থ্য আর মোটা দেখলাম।কিন্তু এবার তো বাবার শরীরের ওজন ৩৫ কেজির বেশি হবে না।শরীরের হাড্ডিগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।বাবার কাছে যাই।আলতো কপালে হাত বুলিয়ে দিই।বাবা হাসেন।আর হ্যাঁ,আরেকটা কথা। বাবা ভালো করে কথা বলতে পারেন না।ক্যান্সার হওয়ার ৫ মাসের মাথাায় বাবার কথা বলার শক্তি কমে যায়।আমিও হাসি।কান্না হাসি আর কি।বাবা বুঝে ফেলেন উনাকে দেখে আমি কেঁদে ফেলেছি।তাই মাথায় হাত বুলান।হাত বুলানোর ইঙ্গিতে বুঝান,কাঁদতাম না।ঠিক আছেন তিনি।আমার কেনজানি আরো কান্না পেয়ে যায়।চেপে রাখি।ওড়না মুখের উপর কিছুক্ষণ ধরে রেখে নিজেকে স্বাভাবিক করি।পরক্ষণে জোরপূর্বক হেসে বাবার সাথে কথা বলতে থাকি।

ভাবলাম আমি বাাড়িতে এসে একটা উপায় বের করতে পারবো।কিন্তু উপায় বের করতে যেয়ে বুঝলাম মায়ের চেষ্টা কম ছিল না।সব জায়গায় আমিও তন্নতন্ন করে খুঁজেছি কোথাও পাইনি।গতকাল এক কাকু চড়া সুদে দেওয়ার জন্যে রাজি হয়েছিল।কিন্তু আজ গিয়েছি আর বারণ করে দিয়েছি।উনার ছেলের নাকি টিউশন ফি দিতে হবে।এখন কি করবো মাথায় কিছুই আসছে না।

“প্রিয়া?তোর কল এসেছে!আদিল মনে হয় করেছে।”

আমি মোড়া থেকে উঠে ঘরে যাই।ফোনটা হাতে নিতে আসলেই আদিল কল করেছে!রিসিভ করি,

“হ্যালো?”
“প্রিয়া?তোমার বিকাশটা একটু চেইক করো ত?টাকা এসেছে কি না?”
“কিসের টাকা?”
“আগে চেইক করো।”

আদিলের ফোন ধরে রেখেই মেসেজ অপশন চেক করি।বিকাশ থেকে মেসেজ এসেছে।তাতে লেখা “Cash in 26,0000 taka” অবাক হয় গেলাম।আওয়াজস্ত কন্ঠে বললাম,

“আপনি এটা কি করলেন?কেন টাকা দিলেন?আর আপনিতো এখনো বেতন পাননি। কোথা থেকে দিয়েছেন!”
“প্রিয়া?এত কথা বলো না। আগে রোগীকে সুস্থ করো।রাখলাম।নিজের যত্ন নিও।আর বাবার অবস্থান জানাইয়ো।”

বলেই কেঁটে দিলো আদিল।আমার কেনজানি কান্না চলে এলো।খুশির নাকি দুঃখের কান্না তাও জানি।মানুষ এতটা ভাল হয় কীভাবে!?

চলবে……

দুজনা পর্ব-০২

0

#দুজনা
#রোকসানা_আক্তার
#পর্ব-০২

আদিল ঢাকায় ফিরেছে গোনে গোনে আজ তিনদিন হলো।এই দিনগুলোর মধ্যে আদিল একটিবারও আমাকে কল করে নি।ও গতবার যাওয়ার সময় আমাকে একটা সিমের নাম্বার দিয়ে গিয়েছিল।ওটায় ডায়াল করেছি।বন্ধ পাচ্ছি।এছাড়া উনার আর কোনো নাম্বার নেই আমার কাছে।ভেতরটা এবার সত্যিই শুষ্ক মরুভূমির মতন হাহাকার করে উঠে আমার।শাশুড়ী মাকে জিজ্ঞেস করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে আদিলের ব্যাপারে।কিন্তু উনাকে জিজ্ঞেস করতেও ভয় করছে।দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে ফোনটা খাটের উপর রেখে খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই।দৃষ্টিটা দূরে দিয়ে দেয়ালের সাথে গা এলিয়ে দাঁড়াই!হঠাৎ নাঁকে-মুখে গন্ধের একটা ঝাঁঝ আসে।গন্ধের ঝাঁঝ কোথা থেকে আসতেছে এখানে?ভাবতে ভাবতে পরক্ষণেই আমার হুঁশ ফিরে!আমিতো রান্না ঘরে করলা ভাঁজি ছড়িয়ে রুমে চলে এসেছি আদিলকে আবার একটু ট্রাই করতে।কিন্তু ফোনটা হাতে নেওয়ার পর করলা ভাঁজির কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছি।সেটা পুঁড়ে যেয়ে আবার গন্ধ বের হয় নি ত?হন্তদন্ত পায়ে ছুটে যাাই রান্নাঘরের দিকে।আসলে যা ভাবনা তা-ই সত্য হলো।করলার অংশবিশেষ পুঁড়ে গিয়েছে।পাশের রুম থেকে শাশুড়ী মা প্রচন্ডভাবে কাশতেছেন।আর কাঁশতে কাঁশতে বোধহয় রান্নাঘরের দিকেই আসতেছেন।আমার ভেতরের চেপে থাকা সেই ভয়টা আরো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবার!আমি উপায়ন্তর না পেয়ে ভাঁজির ভেতর পানি ঢেলে দিই।শাশুড়ী মা এসেই,

“রান্না টুকু করতে জানো না?বাপ-মা রান্না শেখায় নি তোমাকে?কাঁশতে কাঁশতে তো আমার দম বেরিয়ে যাচ্ছে!”

বলে উনি চুলার দিকে আরেকটু এগিয়ে আসেন।মাথাটা হালকা উঁচিয়ে করলার পাতিলে চোখ রাখেন।কোটর থেকে যেনো চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম শাশুড়ী মায়ের এবার।সাথে রাগটা আকাশ ছুই ছুই।প্রচন্ড বিকট আওয়াজে বলে উঠেন,

“সে কি!তোমাকে না বলেছি?ভাঁজি করতে?তুমি এ রান্না করতেছো কেনো?বড় বউ মা?সাথী?সাথী?”

সাথে সাথে আমার জা এবং ননদ রান্নাঘরে এসে হাজির হয়।ননদ বলে,
“কি হয়েছে,মা?”

“দ্যাখো,ও কি রান্না করেছে?”

ননদ শাশুড়ী মাকে পাঁশ কাঁটতে কাঁটতে বলে,
“দেখি কি রান্না করেছে?”
বলে পাতিলের দিকে তাকায়।খুন্তি ছিল পাশে। তা দিয়ে করলাগুলো নাড়া দেয়।নাড়ার মাঝেই চোখমুখ কুঁচকে আসে উনার।করলা এক পিচ মুখে দেয় টেস্ট করতে।সাথে সাথে “ওয়াক ওয়াক” করে মুখ থেকে আবার সেই করলার পিচটা ফেলে দেয়।তেঁজি কন্ঠে বলে উঠে,

“এ’তো সব পুঁড়িয়ে ফেলেছে,মা!”
“কি!আবার পুঁড়িয়েও ফেলেছে!” (জা)

বলে জাও পর্যবেক্ষণ করে করলাটা।ননদের উক্তির সাথে সেও একই উক্তি প্রকাশ করে।আমি অপরাধী দৃষ্টিতে শাশুড়ী মায়ের দিকে তাকাই। শাশুড়ী মায়ের মুখ দেখে বেগ পেতে হলো না বেশিক্ষণ উনি যে খুব রেগে গেছেন আমার উপর!আমি সত্যটা এবার বলে দিই,

“মা আমি ভাঁজিই করেছিলাম।রুমে গিয়েছিলাম আর একটু ফিরে এসে দেখি পুঁড়ে গেছে।বিশ্বাস করুন মা আমি তা ইচ্ছে করে করিনি।”
“বিয়ে করিয়েছি ছেলেকে।আজ পর্যন্ত এক পয়সা বাপের বাড়ি থেকেতো আনতেই পারলে না।তারউপর রান্নাবান্নাটাও ভালো করে জানো না।কোনো কাজই ভালো করে জানো না তুমি।শুধু রক্ত-মাংসের একটা মানুষ হয়ে এই বাসায় এসেছো।এটুকুই তোমার গুণ!”

“বাপের বাড়ি থেকে একটা পয়সাও আনতে পারো নি”-বিয়ের পর আজ এই প্রথম শাশুড়ীর মুখ থেকে এ’কথাটা শুনলাম।এর আগে কখনো বলেন নি। কেনজানি খুব কষ্ট লাগলো।খুব!শান্ত স্বরেই বলে উঠলাম,
“মা?আপনিতো আমাকে দেখেশুনেই আপনার ছেলের জন্যে বিয়ে করিয়ে এনেছেন।আর আমার পরিবারের সেই অবস্থা এখনতো আর নেই। বাবা ক্যান্সারের একজন রোগী!”
“হয়েছে রাখো তোমার অজুহাত।বিয়ে করিয়ে আনার পর থেকেই সেই একই অজুহাত” ক্যান্সার ক্যান্সার!যে ভিক্ষা করে খায় না?সেও তার মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ভ্যানগাড়ি ভর্তি জিনিস পত্র পাঠায়।যাও সামনে থেকে আমার!বড় বউমা,ফ্রিজে করলা আছে?”
“জ্বী,মা।”
“কয়কটা করলা বের করে কেটেকুটে তোমার হাতে ভেঁজে নাও।আমি আজ করলা ভাঁজি দিয়ে ভাত খাবো।”

বলে শাশুড়ী মা চলে যান।পেছন পেছন ননদও।আমি দাঁড়িয়ে রইলাম আগের জায়গায় নির্জীব এবং নিষ্পলক!জা আমার দিকে ধমকের সহিত তাকিয়ে বলে উঠলেন,

“যাবে?নাকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরো ন্যাঁকা অভিনয় দেখাবে?”
চলে এলাম।দরজাটা বন্ধ করলাম।চোখ থেকে অজস্র পানির ধারা টপটপ করে বেয়ে পড়তে লাগলো!অনেকক্ষণ ধরে কাঁদলাম।চারদিকে আসরের আযান পড়তে বুঝতে পারলাম বিকেল হয়েছে।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে নিয়ে বসা থেকে উঠপ বাথরুমে ঢুকলাম।নামাজের ওযু করলাম।জায়নামাজ হাতে নিয়ে নামাজে দাঁড়াবো কল বেঁজে উঠে।এগিয়ে যেয়ে স্ক্রিনে তাকালাম।মায়ের কল।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কলটা রিসিভ করলাম।ওপাশ থেকে মায়ের কান্নামিশ্রিত কন্ঠস্বর!

“প্রিয়ারে?কত জায়গায় টাকা চাইলাম।কোথাও টাকা পেলাম না।তোর বাবার থেরাপী দেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।এখন কি করবো?কোথা থেকে এতগুলা টাকা জোগাড় করবো মাথায় কিছুই আসতেছে না!”

“মামার কাছে চেয়েছো?”
“চেয়েছি।তোর মামার হাত পুরা খালি।আর কত দেবে আমাদের!আমাদের দিতে দিতে সে নিজেই এখন শেষ!”
“মা কান্না করো না।সমস্যা আল্লাহ দিয়েছে।একটা সমাধান নিশ্চয়ই হবে!”
“কীভাবে সমাধান হবে!জমি যেটুকু শেষ সম্বল ছিল তাও বন্ধক।একটা কড়িও যে কোনোভাবে নিব আর সেই পথ নাই।”

বলে মার কান্নার স্বর আরো বিকট হতে থাকলো।আমার মুখে ভাষা নেই কী জবাব দেব এই মুহূর্তে। বিধাতাকে শুধু এটুকুই বলতে ইচ্ছে হলো,জীবনটা কেন এত কষ্টের!”মা আবার বললেন,
“আচ্ছা রাখি।পরে কথা বলবো তোর সাথে।দেখি সুদের মাধ্যমে কেউ দেয় কি না!”

বলে মা কল কেঁটে দেন!

———————————————————
রাতে ঘুমাতে গেলে কতরকমের চিন্তা মাথায় আসে।আদিল কল করছে না।কেনো করছে না?রাতে আবার ফেরত দেওয়ায় অভিমানে রাগ করে নয়তো?নাকি অন্য কোনো কারণে?কিভাবে জানবো?কোন উপায়ে!ওদিক দিয়ে বাবার থেরাপি দেওয়ার সময় চলে এসেছে।হাতে এক কড়িও নেই।কি হবে?কীভাবে?মাথায় কিচ্ছু আসছে না।কিচ্ছু না!চোখ বন্ধ করে চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ!নিস্তব্ধতার ঘোর কাঁটে ফোনের আওয়াজে।নাম্বার না দেখে হাতরিয়ে ফোনটা তুল কানের কাছে নিই,

“হ্যালো,প্রিয়া?”

চির পরিচিত কন্ঠস্বরটা কানে ঢুকতেই ভেতরটা ধক করে উঠে।আর মুহূরে আমি কেঁদে ফেলি।অভিমানী কান্না।বলতে থাকি,
“এতদিন কেনো কল করেন নি?কি হয়েছে আপনার?”
“কান্না থামাও তুমি প্রিয়া।বলতেছি!”
“নাহ কান্না থামাবো না।আপনি আমাকে খুব যন্ত্রণা দিয়েছেন এই ক’দিনে!”
“আসলে সমস্যা হয়ে গিয়েছিল প্রিয়া!”
“যত সমস্যা থাকুক।ফোন তো দিয়ে ত অন্তত একটু খবর জানাতে পারতেন আপনার!তাও করেননি।আপনি খুবই পাষাণ!”
“প্রিয়া?বউ?লক্ষ্রী বউ?দয়া করে একটু শোন!”

এবার নিজেকে যথেষ্ট দমানোর চেষ্টা করি।উনি বলেন,
“বাসা থেকে আসার সময় ট্রেনে আমার ফোনটা চুরি হয়ে যায়।যখন বাসায় এসে পৌঁছায় তখন ব্যাগ খুলে দেখি ফোনটা নাই।তন্নতন্ন করে খুঁজি ব্যাগে,আমার পকেটে। তবে আমার মনে ছিল ফোনটা আমি ব্যাগের পকেটে রেখেছিলাম।তা আর কি করার!উপায় ছিল না কারো সাথে যোগাযোগ করার।পরে বন্ধু ছিল ওর একটা ফোন ছিল পুরনো ওটা আজ আমাকে দিয়ে যায়।তাই ওই ফোন দিয়ে এখন তোমাকে কল করলাম।”

চুপ করে রইলাম।আসলে আমি মানুষটাকে কতভাবে ভাবলাম!এত বড় বিপদের মুখ দিয়ে গেলো।আমার নিশ্চুপতায় আদিল,
“প্রিয়া শুনতেছো আমার কথা?”
“জ্বী,বলুন…!”

এভাবেই রাত বারোটা বেঁজে যায় আদিলের সাথে কথা বলতে বলতে।কথার মাঝে ভেতরটা বারবার হাহাকার করে উঠে আদিলকে কিছু বলতে!কিন্তু বাবার অসুখের টাকার চিন্তা সবকিছুতে মনটা বিষিয়ে যায়।চেপে গেলো মনের যত অতল কষ্ট!হয়তো আদিল কখনোই আমার মনোকষ্টের জানবে না!কখনোই না!কল কেঁটে আবারো দুই ফোঁটা অশ্রু বেরিয়ে এলো।

চলবে…..

দুজনা পর্ব-০১

0

#দুজনা
#রোকসানা আক্তার
সূচনা পর্ব

চাকরির এক সপ্তাহ না গড়াতেই হঠাৎ আমার স্বামী আদিল ব্যাগপ্যাক নিয়ে বাসায় এসে হাজির।এসেই ভরা রুমে সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“প্রিয়া,তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না।তাই চলে এসেছি।”

আমার ননদী,ঝাঁ এবং চাচি শাশুড়ী সবাই সামনে ছিল।লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসে আমার।আদিল আমাকে সবার সামনে জড়িয়ে ধরার তার এই বাচ্চাসুলভ কান্ডটা প্রথমে ধরতে পারেনি সে।যখন চাচীমা বলে উঠেন,

“মানুষ এতটা বউয়ের পাগল হয়!আমাদের আদিলকে না দেখলে তো বুঝতামই না!”
তখন আদিল সাথে সাথে আমাকে ছাড়িয়ে নেয়।আর অপ্রস্ত কন্ঠে বলে,

“নাহ,মানে…..!”

চাচিমা থামিয়ে দিয়ে বলে উঠেন,
“হয়েছে,হয়েছে আর কিছু বলতে হবে না।প্রিয়া?তোমার আঁচলের নিচে গুঁজেূ রাখা স্বামীকে তুমি নিজের রুমেই নিয়ে যাও।দূর থেকে এসেছে একটু রেস্ট করতে দাও।”

আমি নৈঃশব্দে সম্মতি জানিয়ে উনার হাত থেকে ব্যাগ নিতে গেলে উনি বাঁধ সাধেন,
“এত বড় ব্যাগ তোমার নিতে হবে না।আমিই নিয়ে যাচ্ছি।আর আমার সাথে আসো।”

বলে আদিল ব্যাগ নিয়ে রুমে যায়।আমি তার পেছন পেছন পা বাড়াতে পেছন থেকে আমার ননদী ডেকে উঠেন,

“ভাবী?রুমে একটু পরে যাও?মার তােমার সাথে কি নাকি কথা আছে!মার সাথে কথা সেড়ে তারপর যাও।”

আমি ভেতরটা আঁতকে উঠে।শাশুড়ীকে আমি খুব ভয় পাই।আদিল চাকরি রেখে চলে এসেছে।এখন মা এটা নিয়ে আমার উপরই রাগবেন।আদিলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে আজ ছয়মাস।এই ছয়মাসের মধ্যে আদিলের সাথে আমার একসাথে থাকা হয়েছে একমাস কি দেড়মাস।বাকি মাসগুলোতে শাশুড়ী, ননদী এবং ঝাঁ আদিলকে বিভিন্ন কাজের তদারকিতে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতো।যেমন আমার ননদীর জামাইয়ের যশোরে পাটের কারখানাা আছে।ননদীর জামাই একা সামলাতে পারবে না ভেবে আদিলকে শাশুড়ী মা ওখানে পাঠিয়ে দিতেন।আবার ভাসুরের খুলনায় চামড়ার কারখানা আছে।ওখানেও পাঠিয়ে দিতেন।আদিলও যেত।কথা হলো, সে যখন আমাকে বিয়ে করেছে তখন সে বেকার ছিল।তাই নতুন বিয়ে করা,নতুন একটা সংসার হওয়া মানেই তো সাতদিকে খরচ বাড়া।তাই আদিল ওতশত না ভেবে উনাদের কথায় রাজি হয়ে যায়।কিন্তু আমাকে নতুন বিয়ে করে রেখে দূরে বেশিদিন থাকতে পারেনি আদিল।সব ছেড়ে চলে আসে।আদিল ফিরে আসাতে কেউই খুশি হয়নি।পরিবারের সবার মুখ ভারী এবং কালো হয়ে যায়।আদিলের ফিরে আসায় সবাই আমাকেই দোষারোপ করতে থাকে।সেই রাতেই মা,ননদী এবং ঝাঁ রুমে এসে বলেন,

“নতুন একটা সংসার হয়েছে তোর!
এই যে তোমার সংসারটা চালাবে কে?কার উপর নির্ভর কারে তুই এখানে ফিরে এসেছিস?কারো কোটি টাকা নেই আরেকজনের সংসার চালাবে!”

আদিল মার মুখের উপর বলে উঠে,
“আমি নতুন চাকরি দেখবো।তবে খুলনায় যেতে পারবো না।এখান থেকে খুলনা অনেক দূরে।আমি আশপাশে কোথাও একটা চাকরি দেখে নিব।”

পরে আদিল এদিকে আর মনমতো চাকরি পায়নি।যা পায় খুব কম বেতনের।যা দিয়ে আমাদের সংসার চলতে কষ্টকর হয়ে যাবে।তাই পরে আর উপায় না পেয়ে এক বন্ধুর সহায়তায় ঢাকায় চাকরি দেখে।সেখানেই নামধারী একটা কোম্পানিতে মোটামুটি একটা ভালো এমাউন্টের চাকরি জোগাড় করে ফেলে।ওখানেই এক সপ্তাহ আগে জয়েনিং হয়ে আজ বাসায় আবার চলে আসে আদিল।

আমি মৌনমুখে ননদীর কথায় সায় দিয়ে মার রুমে ঢুকি।শান্ত স্বরে বলি,

“মা?ডেকেছেন?”

শাশুড়ী মা আমার কথার জবাব তুললেন না।চোখজোড়া তীক্ষ্ণ করে তাকিয়ে থাকলেন!মিনিট দুয়েক যেতে ননদী পাশ থেকে বলে উঠেন,

“কি নাকি বলবে তা বলে বিদেয় দাও তাড়াতাড়ি !”

শাশুড়ী মা গলাটা হালকা ঝেড়ে নিলেন। তারপর সামনে এক বাটিটা থেকে একটা পানের খিল মুখে ফুঁড়ে বলতে থাকলেন,

“সংসার করবে তোমরা।মাইনে যা পাবে তা সংসারে৷ খরচা করবে তোমরা!ছেলের মাথা টা খেয়ে ফেলো কেন?তাকে কেনো ঢাকা থেকে বাসায় নিয়ে এলে?তোমাদের সংসারটা কার উপর চলব শুনি?তোমার বাপের বাড়ি থেকে কি মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে দেবে নাকি?”

“মা আপনার ছেলেকে আমি আসার ব্যাপারে কিছুই বলিনি।উনি যে আজ আসবে তা আমিও জানি না।”
“আবার নাটক শুরু করেছো গতবারের মতন!ছেলে ত আমার আগে ঠিকই ছিল।ছুটি ছাড়াা বাসায় আসতাে না।কাজ চলাকালীন কাজ বরখাস্ত করে আসতো না।তোমাকে বিয়ে করার পরই বা কেনো এরকম করতেছে ছেলে!এই মেয়ে?আমার ছেলেকে কি মন্ত্র পড়িয়েছো,শুনি?”

ননদী বলে,
“এমন মন্ত্র পড়িয়েছে বউয়ের আঁচলের তলা ছাড়া তোমার ছেলের কোথাও ভালাে লাগে না!”
“সব দোষ এই মেয়েটার!ভালো ভেবে এঁকে বিয়ে করি এনিয়েছি।এ তো দেখি দিনেক দিন আমাদের জন্যে কালসাপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে!”
“মা,আপু?আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে।দয়া করে এরকম মিথ্যে অপবাদ আমাকে দিবেন না।”
“সব ঠিক হয়ে যাবে।যদি আজকে রাতের মধ্যে ছেলেকে আবার ঢাকায় পাঠিয়ে দাও!বুঝাতে পেরেছি?এবার আসতে পারো।”

শাশুড়ী মার রুম থেকে বেরুতে আমার চোখজোড়া টলমল হয়ে যায়।দুইফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে দুইগাল বেয়ে।তরহর করে সেই পানি আবার মুছে নিই।তারপর আমাদের রুমের সামনে আসি।খানিকক্ষণ রুমের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করি।কিছুতেই আদিলকে এই বিষয়টা বুঝতে দেওয়া যাবে না।আগেরবারও দিই নি!আমার মার নিষেধ ছিল।এই বাড়িতে আসার আগে মা একটা কথাই বলেছিলে,প্রিয়া?এই দেয়ালের কথা যেনো ওই দেয়াল না শুনতে পারে।তোর বাবা ক্যান্সারের একজন রোগী।কতটা দারিদ্র্যের সহিত আমাদের সংসারটা চলতেছে তা তুই ভালো করেই দেখতেছিস।পরের বাড়িতে এমন কিছু করিস না মা, যাতে স্বামীর জন্যে শাশুড়ী,ননদীর,ঝাঁয়ের চোখে খারাপ হোস।বা শাশুড়ী,ননদী এবং ঝাঁয়ের জন্যে স্বামীর কাছে খারাপ হোস।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে আদিলের চোখজোড়া ঝলমল করে উঠে।মুখে ফুঁটে উঠে বহুদিনের প্রতীক্ষার হাসি।আমিও জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলাম।তারপর সোঁজা টেবিলের কাছে এগিয়ে যেয়ে হাত থেকে চুঁড়িগুলো খোলার অভিনয় করতে করতে বললাম,

“কেনো এলেন?

আদিল আমার দিকে এগিয়ে এলো।পেছন থেকে কোমরে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বললো,
“তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারছি না।কাজে মন বসে না।ভেতরটা হাহাকার হাহাকার লাগে প্রচন্ড।সারাক্ষণ তোমার চেহারা চোখের সামনে ভাসে।তাই নিজেকে আগলে রাখতে না পেরে ছুটে এসেছি!”
“আসাটা কি খুব বেশিই প্রয়োজন ছিল?”

উনি এবার আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উনার দিকে ফেরাালেন।বললেন,

“জানি না।তবে তোমাকে ছাড়া থাকা অসম্ভব”

আমি উনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলাম।কথাটার পিঠে বলে উঠলাম,
“আপনি বুঝতেছেন?আপনি যে বাচ্চাদের মতন আচরণ করতেছেন?”
“এতে কি তুমি রাগ আমার উপর,প্রিয়া? ”

পরক্ষণে আমি হেসে উঠলাম।আসলে এমনিই হাসিটা আসেনি।ইচ্ছে করে হাসলাম।যাতে উনি আমার ভেতরের চাপা রাগটা না ধরতে পারেন।হাসিমুখেই বললাম,

“নাহ রাগ কেনো হবো!আসলে আপনি যেভাবে হুটহাট চাকরি রেখে চলে আসেন এরকম করলে তো আমাদেরই সমস্যা।আজ আপনার বেশি টাকার প্রয়োজন পড়ছে না।কিন্তু যখন আমাদের একটা বাচ্চা আসবে।তখন তো না চাইলেও করতো হবে চাাকরি।কারণ,বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ-এর কথা সর্বপ্রথম ভাবতে হবে। আর পিতামাতা হিসেবে এটা দায়িত্ব আমাদের।তাছাড়া,আপনি কাজ করতে চাচ্ছেন না কতকাল আপনার ভাই অথবা বোনের জামাইয়ের উপর নির্ভর করে থাকবেন,বলেন?আমাদেরও একটা লজ্জা থাকার বিষয় আছে!”

আদিল মিনিট তিনেকের মতন চুপ করে ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারপর আলতো কন্ঠে বললো,

“তাহলে আমি আবার ঢাকায় ব্যাক করবো প্রিয়া?”
“হ্যাঁ।আর আজকে রাতের মধ্যেই।”
“কিন্তু একটা রাত তোমার….!”
“আরো কত রাত কাঁটাতে পারবেন!আপনি চাকরির মাঝখান থেকে চলে আসছেন।কাল না গেলে আপনার বস রেগে যাবে।এমনকি চাকরির থেকে বাদও দিয়ে দিতে পারে।আপনি এখনই আবার চলে যান।”
“আমার বস ওরকম করবে না তুমি যেমনটি ভাবছো,প্রিয়া!”
“তারপরও..!মানুষদের মনের কথা বুঝা যায় না।আপনি যান।”

আদিল এবারো স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।আমার এরকম অস্বাভাবিক কথাবার্তা হয়তো উনার মোটেও ভালো লাগে নি।তারপরও আমি যেহেতু বলেছি উনি ফিরে যাবেন এটা আমি জানি।উনার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার পর উনাকে আমি যতটুকু বুঝেছি উনি আমার কোনো কথাই ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন না কখনো।

———————————————–
অত্যন্ত ব্যথিতমুখে আদিল আমাদের সবাইকে রাত এগোরটার দিকে আমাদের সবাইকে আবার বিদেয় দেয়।আদিল যাওয়ার সময় আমি মুখে হাসি হাসি ভাব রাখার চেষ্টা করি।তারপরও আদিলের মাঝে একরাশ হাসতে দেখি নি।সে যাওয়ার সময় আমাকে শুধু এটুকুই বলে যায়,

“আসি।ভালো থেকো।আর নিজের খেয়াল নিও।”

আদিল চলে যাওয়ার পর আমার শাশুড়ী, ননদী এবং ঝাঁ খুবই খুশি হোন!

চলবে……

শেষ রাত পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

0

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৩৪(অন্তিম পর্ব)
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

ধ্রুবর গায়ে জড়ানো শার্টের হাতের দিকেটা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে লিনা। লিনাকে ধ্রুবর এতটা কাছে দেখে ক্ষনিকের জন্য থমকে গেলাম আমি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু বিশ্রী চিন্তাভাবনা এসে মাথায় চড়ে বসলো। ক্ষনিকের জন্যই চোখের সামনের দৃশ্যটাকে ভীষণ আপত্তিকর মনে হলো। ভয় হলো। বুকে চিনচিনে ব্যথাও হলো। খুব বাজে একটা অনুভূতির উপস্তিতি অনুভব করলাম। মস্তিষ্ক সচল হওয়ার আগেই পরিস্থিতিটা একদমই ভিন্ন একটা মোড় নিলো। আচমকাই একটা লোক এসে ধ্রুবর সামনে দাঁড়ালো। লোকটার উপস্থিতিতে লিনা ভয় কিংবা অস্বস্তিতে ধ্রুবর আড়ালে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করলো। লোকটা কড়া গলায় ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে বললেন-

‘আমি আমার স্ত্রীর সাথে একা কথা বলতে চাই। আপনি এখন আসুন।’

ধ্রুবর এক বিন্দুও নড়লেন না। আগের মতোই ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-

‘লিনা আপনার স্ত্রী ছিল, এখন নেই। তাই যা বলার আমার সামনেই বলুন।’

লোকটা কিছুটা সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে লিনার উদ্দেশ্যে বললেন-

‘লিনা তুমি মামলা উঠিয়ে নাও। আমাদের ডিভোর্স হয়েছে তাই সব কিছু এখানেই শেষ করো। তোমার মামলার জন্য আমাকে কতটা ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে জানো? খুব কষ্টে তোমার খোঁজ নিয়ে এখানে এসেছি।’

লিনা কিছুই বলল না। ধ্রুবর একবার লিনার দিকে চেয়ে আগের মতোই গম্ভীরমুখে বললেন-

‘কাপুরুষের মতো নিজের স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন। আর আপনাকে এভাবেই ছেড়ে দিবো তা তো হয় না।’

‘লিনা তুমি চলো আমার সাথে। এক্ষুনি তুমি মামলা উঠিয়ে নিবে। চলো।’

লোকটা ধ্রুবকে অন্য পাশে ধাক্কা দিয়ে লিনার হাত ধরে জোড়াজুড়ি করতে লাগল। লিনা বাঁধা দিচ্ছে। নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে তবে পুরুষালী শক্তির কাছে পেরে উঠছে না। কিছুতেই না। জবরদস্তি করার এক পর্যায়ে লোকটা রেগেমেগে লিনার গালে সজোড়ে চড় বসিয়ে দেয়। লিনা শান্ত হয়ে গেল। মূর্তি ন্যায় স্তব্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ধ্রুব কিছুক্ষণ হতবাক হয়েই তাদের দিকে চেয়ে রইলেন। পরক্ষণেই চোখেমুখে ভয়ংকর রাগ ফুটে উঠলো তার। তেড়ে এসে লোকটা কলার ধরে মারতে যাবে ঠিক তখনই লিনা ধ্রুবকে বাধা দেয়। সেই সুযোগেই লোকটা ছাড়া পেয়ে রেলিঙ টপকে পাশের ছাদে চলে যায়। আমি এখনও ঠিক আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সিড়ি ঘরের দরজার কিছুটা আড়ালে। রাগ হচ্ছে ভীষণ। রাগে সাড়া শরীর রি রি করছে। কিন্তু রাগটা কার উপর? লোকটার উপর নাকি লিনার উপর! লোকটা তাকে ধ্রুবর সামনেই গায়ে হাত তুললো অথচ লিনা তবুও লোকটাকে রক্ষা করলো। এটা কি তাহলে বাঙালি নারীর পরিচয়! সব কিছু মুখ বুঝে সহ্য করার অসীম ক্ষমতা বাঙালি নারীদের মধ্যে ঠুসে ঠুসে দেওয়া হয়েছে। স্ত্রীরা মুখ বুঝে স্বামীর সংসারে সবকিছু সহ্য করবে। মায়েরা সন্তানের জন্য সব কিছু ত্যাগ করবে। এভাবেই হয়তো কিছু নারীরা সারাজীবন কাটিয়ে দেয়। তাদের মনের খবর কেউ জানে না। সকলের চোখে এটাই স্বাভাবিক। এটাই নিয়ম। মেয়ে মানেই মায়ের জাত। মেয়ে মানেই অসীম মায়া। মেয়ে মানেই মানিয়ে চলা। এটাই মেয়েদের জীবন।
অশ্রুজলে টইটম্বুর হয়ে ওঠা চোখদুটো ভীষণ ক্লান্ত হয়েই বাধ ভেঙে দিল। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে লিনা। ধ্রুব লিনার কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। লিনাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। আমি সিড়িঘরের আড়াল থেকে বেরিয়ে ছাদে পা রাখলাম। সামনে এগিয়ে যেতে চেয়েও থমকে গেলাম। এই মুহুর্তে লিনার কাছে যাওয়া হয়তো বেমানান দেখাবে। আমার উপস্থিতি লিনার জন্য লজ্জার এবং বিব্রতকর পরিস্থিতির কারণ হবে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার ঝামেলা অন্য কারও সামনে প্রকাশ পাওয়া প্রতিটা মেয়ের জন্যই লজ্জার ব্যাপার। খুব বিশ্রী আর তিক্ত অভিজ্ঞতা এটা।
হঠাৎই ধ্রুবর সাথে আমার চোখাচোখি হলো। সাথে সাথেই উনি লিনার কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে নিলেন। আমি কোনো কথা না বলে লিনার দৃষ্টির অগোচরে ছাদ থেকে নেমে এলাম। রুমে এসে স্তম্ভিত হয়ে বিছানায় বসে রইলাম। অন্যের খারাপ পরিস্থিতি না দেখা অব্দি নিজের অবস্থান বোঝা মুশকিল। নিজেকে লিনার অবস্থানে কল্পনা করতেই ভয়ে আঁতকে উঠলাম আমি৷ নিজেকে এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী মেয়ে মনে হচ্ছে। ভীষণ সুখী মানুষ হিসেবেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম। আমার ভাগ্যও তো লিনার মতো হতে পারতো তবে তা হয়নি। ধ্রুবর, মনি মা, আব্বু আর তুলতুলভেই সবগুলো মানুষকে পেয়েই আমি খুশি। কেউ আমাকে কখনো আঘাত দেয়নি। আমাকে কষ্ট দেয়নি। খুব সহজেই আমাকে আপন করে নিয়েছে। না চাইতেই আমাকে অসীম ভালোবাসায় ডুবিয়ে রেখেছে।
মিনিট খানেক সময় পেরুতেই ধ্রুব হন্তদন্ত হয়ে রুমে এলেন। আমি উঠে ওনার সামনে গেলাম। তিনি আমাকে দেখা মাত্রই উত্তেজিত হয়ে বললেন-

‘তুলতুলের আম্মু আপনি যেমনটা দেখেছেন বিষয়টা তেমন না৷ প্লিজ আপনি লিনা আর আমাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু ভাববেন না৷ আমি আপনাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি।’

আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ধ্রুব হয়তো ভেবেছেন আমি তাদেরকে একসাথে দেখে অন্যকিছু ভেবেছি। আসলেই তো প্রথমে তাদের দেখে বাজে চিন্তাই করেছিলাম। পুরো ব্যাপারটা না দেখলে হয়তো ভুল বুঝেই বসে থাকতাম। ধ্রুব আমার বাহু ধরে হাল্কা ঝাঁকি দিতেই আমি স্তম্ভিত ফিরে পেলাম। ঘোর লাগা কন্ঠে বললাম-

‘আপনাকে কিছু বলতে হবে না।’

ধ্রুব অবাক হলেন। ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন-

‘কিছু জিজ্ঞেস করার নেই আপনার?’

‘নাহ।’

‘লিনা আর আমাকে এত রাতে ছাদে একসাথে দেখেও কিছু জিজ্ঞেস করার নেই? আমার কাছ থেকে কিছু জানার নেই?’

আমি কপাল কুচকে ফেললাম। সহজ গলায় বললাম-

‘নাহ কিছু জানার নেই।’

ধ্রুব আমাকে ছেড়ে দিলেন। ডান হাতের আঙুল দিয়ে কপাল ঘষে আচমকাই শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিলেন। চোয়ালে শক্ত করে রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন। ভয় এবং অস্থিরতায় ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মুখখানা হঠাৎই পরিবর্তন হতে লাগল। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচমকা এসে আমার ডান হাত চেপে ধরলেন তিনি। চাপা রাগ নিয়ে শক্ত গলায় বললেন-

‘কোনো কিছুই বলার নেই আমাকে?’

আমি কোনো প্রত্যুত্তর করলাম না৷ ধ্রুবর এমন ব্যবহার দেখে কিছু বলার সাহস কিংবা ভাষা কিছুই খুজে পেলাম না৷ কোনো কিছু না বুঝে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার নিশ্চুপতা-ই যেন ধ্রুবর রাগের কারণ হলো। আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো কাজ হলো আমার নিরবতা। ধ্রুব রাগে চিড়বিড় করে উঠলেন। আমার হাত দেয়ালের সাথে চেপে ধরে হুংকার দিয়ে বললেন-

‘কথা বলছো না কেন? উত্তর দাও। আর কত চুপ করে থাকবে? এমন গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে আর কতদিন অনন্যা? এত এত ভালোবাসার পরেও কেন আমি তোমার মনে একটু জায়গায় করতে পারলাম না? কেন আমাকে নিয়ে একটু ভাবতে পারছো না? কেন আমার বিষয়ে তোমার কোনো আগ্রহ নেই? এতগুলো মাস তোমাকে সময় দেওয়ার পরেও কেন আমাকে একটুও ভালোবাসতে পারলে না অনন্যা? আমি কখনো তোমার কাছে কিছু চাইনি। শুধুমাত্র একটু ভালোবাসা পাওয়ার আশায় প্রতি দিন প্রতিমুহূর্ত অপেক্ষা করে যাচ্ছি। তবুও কেন আমি ব্যর্থ হলাম? উত্তর দাও।’

ধ্রুব রাগ দেখে আমি ভয়ে সিটিয়ে গেলাম। ভয়াতুর চোখে ওনার দিকে চেয়ে রইলাম। ধ্রুব আবারও গর্জে ওঠা কন্ঠে বললেন-

‘সেদিন লিনা আর আমাকে রাস্তায় দেখে আমাকে কিছুই বলো নি। মার্কেট থেকে লিনার সাথে বেরিয়ে যেতে দেখেও কিছু জানতে চাওনি। আর আজকেও না। সব সময়ের মতো আজকেও তুমি নির্লিপ্ত। স্ত্রী হিসেবে তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার উপর। আমি বিষয়ে সব কিছু জানার অধিকার আছে। অথচ তুমি আজ পর্যন্ত সে অধিকার বিন্দুমাত্রও খাটাও নি। কখনও আমার কাছে কিছু জানতে চাওনি৷ আমি কি করলাম কেন করলাম তা নিয়ে মাথা ঘামাও নি। এতদিনে কি আমাকে একটুও ভালোবাসতে পারোনি? আমি কি তোমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না অনন্যা?’

ধ্রুব থামলেন। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হেসে বললেন-

‘থাক তোমাকে আর কিছুই বলতে হবে না।’

ধ্রুব আমাকে ছেড়ে দিলেন। এক মুহুর্তে দেরি না করে দরজা খুলে ঝড়ের বেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড পর যে-ই গতিতে বেরিয়ে গেছেন তার চেয়েও দ্রুত পায়ে হন্তদন্ত হয়ে রুমে ফিরে আসলেন। আমি মাথা তুলে ওনার দিকে তাকালাম। নাহ এখন আর রাগের ছিটেফোঁটাও নেই। শান্ত শীতল চোখ দুটোতে ভয়ের খেলা। অস্থিরতা আর ভয়াবহ উত্তেজনা। থমথমে পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। ওনার হাত উঁচু করে কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন-

‘এটা রক্ত! তোমার রক্ত!’

আমি এবারও চুপ রইলাম। চোখ নামিয়ে স্থির করলাম আমার হাতের দিকে। তৎক্ষনাৎ ধ্রুব ছুটে এসে আমার হাত ধরলেন। উদ্ধিগ্ন হয়ে আমার হাত তুলে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। লাল রঙের কাঁচের চুড়ি গুলো রক্তে ভিজে আছে। ভাঙা চুড়ির দু টুকরো এখনও হাতে বিঁধে আছে। হাতের কবজি থেকে তালুতে বেয়ে পরছে রক্ত। আমি হাতের ব্যথা অনুভব করতে পারলাম না। একটুও টের পেলাম না। পুরো শরীর যেন বোধশক্তি হীন হয়ে গেছে। মাথার মধ্যে শুধু ধ্রুবর কথা গুলোই ঘুরছে। ধ্রুব একাই এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। আমি ধ্রুবর সাথে স্ত্রীর মতো আচরণ করিনি৷ কথাটা সত্য। অপ্রিয় তিক্ততায় ঘেরা একটি সত্য। তবে আরেকটা সত্য হলো আমি তাকে ভালোবেসে ফেলছি৷ অনেক বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি। ধ্রুব অনেক আগেই আমার মনের সবটুকু জায়গায় দখল করে নিয়েছেন। সব কিছুই ধ্রুব পেরেছে। শুধু আমিই তা প্রকাশ করতে পারিনি। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি।

ধ্রুব আমাকে নিয়ে বিছানায় বসালেন। তড়িঘড়ি করে আমার সারা রুম খুঁজে ফাস্টএইড বক্স বের করলেন। আমার পাশে বসে হাতের রক্ত মুছতে মুছতে অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে বললেন-

‘আমি সরি। তোমাকে আঘাত করার কোনো উদ্দেশ্য আমার ছিল না। আমি ইচ্ছে করে এমনটা করি না। সত্যি বলছি আমি তোমাকে ব্যথা দিতে চাইনি। রাগের মাথায় এমনটা হয়েছে। প্রমিজ করছি আর কখনও এমন হবে না। আর কখনও রাগ দেখাবো না।’

আমি শান্ত চোখে ধ্রুবকে দেখছি। ধ্রুবর অস্থিরতা, আমাকে নিয়ে তার ভয় সবটাই প্রকাশ পাচ্ছ তার ব্যবহারে। আমার হাত থেকে চুড়ির টুকরো বের করতেই মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠলাম। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে নিম্ন স্বরে বললাম-

‘আমি জানি আপনি কখনো ইচ্ছে করে আমাকে আঘাত করবেন না। এটা একটা এক্সিডেন্ট তাই নিজেকে এর জন্য অপরাধী ভাবার কিছু নেই। আসলে আমি আপনাকে আর লিনা আপুকে নিয়ে অন্য কিছু মনে করেনি। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। আর তাছাড়া আমি ছাদের পুরো ঘটনাটা-ই দেখেছি। লিনা আপু অস্বস্তিবোধ করবে আমাকে দেখলে তাই আমি তখন আপনাদের সামনে না গিয়ে রুমে চলে এসেছি।’

ধ্রুব আমার দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মিহি কন্ঠে বললেন-

‘সরি আমার ভুল ছিল। আমি ভেবেছিলাম আপনি অন্য কিছু ভেবে ওখান থেকে চলে এসেছেন।’

তিনি খুব সাবধানে আমার হাতে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিচ্ছেন। আমি হাতের দিকে একনজর তাকিয়ে আবারও ধ্রুবর ফ্যাকাসে বর্ণের হয়ে যাওয়া মুখের দিকে দৃষ্টি দিলাম। শান্ত গলায় বললাম-

‘আমি আপনার মতো এত সহজে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি না। আমি চাপা স্বভাবের মেয়ে তাই হয়তো আমার অনুভূতি আপনাকে বোঝাতে পারি না।’

ধ্রুব সব কিছু গুছিয়ে আবারও আমার পাশে এসে বসলেন। আলতো করে আমার ধরে আবেগি হয়ে বললেন-

‘তোমাকে কিছু প্রকাশ করতে হবে না। শুধু দিন শেষ তোমাকে আমার পাশে পেলেই হবে। তুমি আমার পবিত্র ভালোবাসা। শুদ্ধ ভালোবাসা। তোমার ভালোবাসার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারবো। তবে তোমাকে আমার পাশে সব সময়-ই চাই। ভালোবাসা নয় শুধুমাত্র তোমার একটু উপস্থিতই আমার জীবনটাকে উজ্জ্বল করে তুলতে পারে। আমার সানসাইন তুমি। আমার প্রতিটি শেষ রাতে আমি তোমাকে চাই।’

‘আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি ধ্রুব।’

আমার কথা শুনে ধ্রুব বিস্ফোরিত চোখে আমাকে দিকে চেয়ে রইলেন। ক্ষীণ স্বরে বললেন-

‘ সত্যি?’

আমি মাথা নাড়লাম। ধ্রুব আবারও থেমে থেমে জিজ্ঞেস করলেন-

‘কবে থেকে! আমাকে বলনি কেন?’

‘মনে করে দেখুন বুঝে যাবেন।’

আমার সহজ সরল জবাবে ধ্রুব খানিকটা আনমনা হয়ে গেলেন। নিশ্চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে বললেন-

‘যেদিন আমার গালে চুমু দিয়েছিলে তার আগে থেকে তাই না?’

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাতেই ধ্রুব আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ভীষণ রকম উত্তেজিত হয়ে বললেন-

‘কতদিন ধরে অপেক্ষা করেছি মুখে এই কথাটা শোনার জন্য জানো? এই শেষ রাতে তোমার মুখে এমন কথা শুনবো ভাবতেই পারিনি। কতটা বোকা আমি এতদিন বুঝতে পারিনি।’

ধ্রুব আমাকে ছেড়ে দিয়ে দু গাল আগলে ধরলেন। আমার চোখের দিকে চেয়ে শীতল কন্ঠে বললেন-

‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি সানসাইন। প্রথম দিন থেকেই ভালোবাসি৷ অনেক বেশিই ভালোবাসি।’

আমি হাসলাম। ধ্রুব আবারও নরম গলায় বললেন-

‘চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। দিবো?’

ধ্রুব অনুমতি চাইলেন ঠিকই তবে অনুমতির অপেক্ষা করলেন না।৷ তার আগেই আমার মুখে চুমু দিতে লাগলেন। আমি বাধা দিলাম না। অস্বস্তিও অনুভব করলাম না।

খুব সকালেই আজ ঘুম ভাঙলো। পুরো বাড়িতে তখন পিনপতন নীরবতা। গতকালের ক্লান্তিতে হয়তো এখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সবাই। কারও ঘুম না ভেঙে পা টিপে টিপে নিঃশব্দে ছাদে চলে এলাম। ছাদে পা রাখতেই আমি চমকালাম। ছাদের এক কোণে রাখা কাঠের বেঞ্চিতে লিনা মাথা নিচু করে বসে আছে। আমি তাকে বিরক্ত করলাম না। চুপচাপ নিঃশব্দে অন্য পাশে গিয়ে রেলিঙ ধরে দাঁড়ালাম। খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর লিনা খুব মিষ্টি করে আমার নাম ধরে ডাকলো।

‘অনন্যা! এখানে আসো।’

আমি ঘাড় বাঁকিয়ে লিনার দিকে চাইলাম। সব সময়ের মতোই সারা মুখ জুড়ে হাসি ছড়িয়ে আছে। উন্মুক্ত চুলগুলো সারা পিঠে ছড়িয়ে আছে। খুব কায়দা করেই ডান গালের অর্ধেকটা চুল দিয়ে ডেকে রেখেছে। আমি অবাক হলাম মেয়েটার মুখের হাসি দেখে। রাতে ঘটে যাওয়া এমন বিশ্রী ঘটনার পরেও হাসছে! কীভাবে পারছে হাসতে! নিজেকে সকলের সামনে এতটা স্বাভাবিক রাখার অভিনয় করতে কষ্ট হচ্ছে না! নিজের মনেই প্রশ্ন গুলো আওড়াতে লাগলাম৷ এসব ভাবতে ভাবতেই থমথমে পায়ে লিনার পাশে এসে দাঁড়ালাম। লিনা হাত দিয়ে তার পাশে বসার ইশারা করে বললেন-

‘বসো আমার পাশে। তোমার সাথে কথা বলি।’

আমি বসলাম লিনার পাশে। কিছুটা বিস্ময় আর অস্বস্তি নিয়েই চুপ করে বসে রইলাম৷ লিনা একটু বাঁকা হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন-

‘তোমাকে সরি বলার ছিল।’

‘সরি! কিন্তু কেন?’

লিনা থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি উৎকন্ঠিত হয়ে প্রশ্নটা করলাম। আমার প্রশ্ন শুনে লিনা মুচকি হাসলো। ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে নম্র গলায় বলল-

‘তুমি আমার ছোট তাই তোমাকে তুমি করেই বলছি৷ কিছু মনে করো না।’

আমি হাল্কা করে মাথা নাড়লাম। লিনা দৃষ্টি নামিয়ে আবারও বলতে লাগলেন,

‘ডিভোর্সের ব্যাপারটা এখন অনেক কমন একটা বিষয়। এতে লজ্জা পাওয়া কিংবা বিব্রতবোধ করার কিছু নেই। তবে আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা পুরোপুরি ভিন্ন৷ আমি হৃদয়কে বিয়ে করেছিলাম অনেকটা পাগলামি করে। পরিবারের সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে বাসা থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। খালার সাথেও অনেক বাজে ব্যবহার করেছি হৃদয়কে খারাপ বলায়। সবাইকে বাদ দিয়ে আমি শুধু হৃদয়কে বেছে নিয়েছিলাম। ভালোবাসি বলেই এমন পাগলামি করেছি৷ কিন্তু বিয়ের পর আমার প্রতি হৃদয়ের ব্যবহার দেখে দিন দিন একটু একটু করে সেই ভালোবাসা মরে যেতে লাগল। একটা সময় সকল অনুভূতিরাই মরে গেল। শুধু নিজের ভুলের জন্য লজ্জিত বোধ করছিলাম। সবার সাথে করা অন্যায়ের জন্য খুব বেশিই লজ্জিত ছিলাম। তাদের সামনে দাঁড়ানোর মতো মুখ আমার ছিল না। এই কারণে দুটো বছর ধরে চেষ্টা করে গেছি নিজেকে হৃদয়ের সাথে মানিয়ে নিতে। তবে তা আর সম্ভব হলো না। অবশেষে হৃদয় আমাকে ডিভোর্স দিয়েই ছেড়েছে। ডিভোর্সের পর নিজেকে সকলের থেকে আলাদা করে রাখতে চেয়েছি। তবে ধ্রুব আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আম্মুর কাছে নিয়ে যায়। ডিভোর্সের পর থেকেই মানুষের মুখোমুখি হতে আমার ভীষণ অস্বস্তি লাগে। যার কারণে আমি শুধু পালিয়ে বেড়াই৷ নিজেকে আড়ালে লুকিয়ে রাখি। এই জন্যই তোমার সাথে কথা বলা হয়ে ওঠে নি। তোমার সাথে ভালো করে পরিচয়ও হতে পারিনি। তাই আমি দুঃখিত।’

আমি ঠোঁট প্রসারিত করে মৃদু হাসলাম। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম-

‘সমস্যা নেই। আমি কিছু মনে করিনি। আস্তে আস্তে সবার সাথে মেশার চেষ্টা করলেই একটা সময় সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এ-নিয়ে চিন্তা করবেন না।’

‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখানে থাকবো না। আপাতত এই শহরে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই যাওয়ার আগে তোমার সাথে একটু ভালো করে পরিচিত হয়ে নিচ্ছি। ধ্রুবর মুখে তোমার কথা এত শুনেছি যে তোমার দেখার ভীষণ আগ্রহ ছিল। প্রতিনিয়ত ধ্রুব তোমার এত বর্ননা দিয়েছে যে মনে মনে আমি তোমার একটা কল্পনা চিত্র এঁকে ফেলেছি। শুধু তোমাকে দেখার পালা ছিল। তবে এই রকম পরিস্থিতিতে তা আর সম্ভব হয়নি এতদিন। তবে এখন তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমার কল্পনার চেয়েও বেশি সুন্দর, স্নিগ্ধ, পবিত্র। ধ্রুবর কথা গুলোও এখন কম মনে হচ্ছে।’

লিনার কথায় আমি নিঃশব্দে হাসলাম। তবে মুখে কিছুই বললাম না। লিনা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সহজ গলায় বললেন-

‘জানো তো আমার কোনো ভাই নেই। বাবাও মারা গেছেন অনেক আগে। তখন থেকেই ধ্রুবদের সাথে আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। ওনারা সব সময় আমাদের খেয়াল রেখেছেন। মোহনা আপু মারা যাওয়ার পর ধ্রুব এনি আপু আর আমার মাঝেই যেন মোহনা আপুকে খোঁজার চেষ্টা করতো৷ বড় ভাইয়ের মতোই খেয়াল রাখতো। তবে আমার ব্যবহারের জন্য খালা অনেকটা কষ্ট পেয়েই আমাদের বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দেয়। কাল রাতে ধ্রুব যখন খালাকে সব কিছু বলে ছাদে আমার কাছে পাঠায় তখন খালা ঠিক আগের মতোই আমাকে বুকে আগলে নেন। তার মধ্যে কোনো প্রকার খোঁপ ছিল না। এই পরিবারের প্রতি আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে ধ্রুবর প্রতি। ধ্রুব বেশ কিছুদিন ধরেই আমার ঝামেলা গুলোকে সালাচ্ছে নিজ হাতে। অফিসের কাজ করে এসে আমাকে নিয়ে ছুটোছুটি। তারপর আবারও অফিসে গিয়ে রাত পর্যন্ত কাজ করে তুলতুলকে দেখতে যাওয়া। এত এত চাপের মধ্যেও ধ্রুব কোনো প্রকার অভিযোগ করেনি। আমি ভয় পাচ্ছিলাম আমার কারনে ধ্রুব তোমাকে আর তুলতুলকে সময় দিতে পারছে এটা ভেবে। সব শেষে একটা কথাই বলবো সরি।’

আমি মুখের হাসি ধরে রেখে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম-

‘শুধু মাত্র স্ত্রী সন্তান নিয়ে একটা পুরুষের পৃথিবী হয় না। তার আশেপাশে আরও অনেক মানুষ থাকে। স্ত্রী আর সন্তান ছাড়াও পরিবারের বাকি সদস্য কিংবা আত্মীয় স্বজনদের প্রতি দায়িত্ব থাকে। বিপদেআপদে তাদের পাশে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। এই কারণে বার বার সরি বলার কিছু নেই।’

———————

‘কি ব্যাপার অনু তোকে আজ খুব খুশি খুশি মনে হচ্ছে। চেহারা তো একদম ঝলমলিয়ে উঠেছে। ব্যাপার কি হ্যাঁ?’

ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই হঠাৎ সানিয়ার মুখে এমন কথা শুনে খানিকটা লজ্জা পেলাম। আমার লজ্জা বাড়িয়ে দিতে সানিয়া খুব ভয়ংকর একটা কথা বলল।

‘অদ্ভুত তো। বাসর হলো তোর ভাইয়ের আর লজ্জা পাচ্ছিস তুই? দেখে তো তোকেই নতুন বউ লাগছে। কই ধ্রুব ভাই কই? উনি কি জানেন ওনার বউ লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে!’

আমি অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশে তাকালাম। পাশের সোফায় মনি মা মুখ চেপে হাসছেন। ওনার হাসি দেখে যেন আমার লজ্জার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেল। আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মনি মা’র কোল থেকে তুলতুলকে নিয়ে দ্রুত পায়ে রুমের দিকে যেতে লাগলাম। পেছন থেকে মনি মা’র কন্ঠ স্বর শোনা গেল,

‘আরে আস্তে-ধীরে যা। পরে যাবি তো।’

রুমে এসেই আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তুলতুলকে বিছানায় বসিয়ে দিতেই ধ্রুবর উপর হামলে পরলো। সব সময়ের মতোই ধ্রুবর গাল ধরে টানতে টানতে বলল-

‘পাপ্পা ঘুম ওঠ। পাপ্পা…’

বেশ কিছুটা সময় ডাকাডাকি করার পর ধ্রুব চোখে মেলে তাকালেন। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন-

‘তুলতুল পাখি আরেকটু ঘুমাতে দাও।’

কে শোনে কার কথা! তুলতুল আগের মতোই ধ্রুবকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে ধ্রুব হাল ছেড়ে দিলেন। আড়মোড়া ভেঙে আধশোয়া হয়ে বসলেন পেছনে হেলান দিয়ে। তুলতুল সঙ্গে সঙ্গেই ধ্রুবর উপর উঠে দু’হাতে ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে বসলো। ধ্রুব আড় চোখে আমার দিকে চেয়ে মিনমিনিয়ে বললেন-

‘মেয়েটাকে একদম আপনার মতোই বানিয়েছেন। আস্তো এক নাছোড়বান্দা।’

আমি তীক্ষ্ণ চোখে চাইলাম ধ্রুবর দিকে। ভারী কন্ঠে বললাম-

‘আমার মেয়ে তো আমার মতোই হবে।’

ধ্রুব খানিকক্ষণ স্থির চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আচমকাই আমার হাত ধরে টান মেরে তার কাছে নিয়ে গেলেন। এক হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন-

‘পূর্ণতার জন্যই আজ আমার জীবনটা পূর্ণ হয়েছে। ও না থাকলে হয়তো আপনার সাথে বিয়েই হতো না।’

আমি হাল্কা হেসে বললাম- ‘আমাদের জীবনের পূর্ণতা হয়েই ও এসেছে। আমাদের গুড লাক তুলতুল পাখি।’

ধ্রুব কিছুটা সময় চুপ থেকে গাঢ় স্বরে ডাকলেন,

‘তুলতুলের আম্মু!’

‘জ্বি বলুন’

‘ভালোবাসি তোমাকে সানসাইন।’

হঠাৎই ধ্রুবর এমন কথায় খানিকটা লজ্জা পেলাম। দৃষ্টি নামিয়ে নিম্ন স্বরে বললাম-

‘আমিও’

ধ্রুব ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘কি আমিও?’

ধ্রুব আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি চুপ করে আছি। ঠিক তখনই তুলতুল স্পষ্ট গলায় বলল-

‘ভালোবাসি।’

তুলতুলের কথায় আমরা দুজন এক সাথেই হেসে ফেললাম। ধ্রুব শক্ত করে আমাদের দু’জন জড়িয়ে ধরে বললেন-

‘হ্যাঁ ভালোবাসি। আপনাদের দুজনকেই ভালোবাসি মহারানী।’

~সমাপ্ত..🌻🌻

শেষ রাত পর্ব-৩৩

0

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৩৩
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

মিথ্যে বলার সাথে এসবের কি সম্পর্ক?’

আমার করা প্রশ্নে ধ্রুব হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। সকলের মন কেড়ে নেওয়ার মতো সুন্দর মুখখানায় সব সময়ের মতো তার সেই বিখ্যাত সরল হাসিটা আজ নেই। মুখশ্রীতে আঁধার নামানো দুঃখি দুঃখি চেহারা। উদাসীন ভঙ্গিতে খানিকক্ষণ চুপ থেকে মলিন কন্ঠে শুধালেন,

‘লিনার ডিভোর্স হয়েছে কিছুদিন হলো। সে-রাতে ঢাকা থেকে অফিসে ফেরার পথেই লিনার সাথে দেখা। বাসার বাহিরে বসে কান্না করছিল। গাড়ি থেকে নেমে ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করার পর আমাকে সবটা খুলে বলে৷ বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই লিনার গায়ে হাত তোলা শুরু হয়। সেদিন রাতেও লিনার গায়ে হাত তুলেছিল। এমনকি ডিভোর্সের কথা বলে বাসা থেকে বের করে দেয় ওর হাসবেন্ড। আমি তখন কোনো উপায় না পেয়ে ওর হাসবেন্ডকে বুঝিয়ে লিনাকে সেই বাসায় রেখে আসি৷ আর ডিভোর্স দেওয়ার কথাও ফাইনাল হয় সেই রাতেই। বিয়ের পর অভাবের সংসারে ক্ষনিকের প্রেম ভালোবাসার মৃ’ত্যু হয়েছিল নিখুঁতভাবে,ধিরে ধিরে। তুলতুলকে যেদিন হসপিটাল থেকে বাসায় আনা হয়েছে সেদিনই লিনার ডিভোর্স হয়। আর ওর হাসবেন্ডের নামে নারী নির্যাতনের মামলাও করা হয়েছে। লিনা এসব ঝামেলায় জড়াতে না চাইলেও শেষমেশ আমার কথায় রাজি হয়। আর সেদিনই প্রথম আমি আপনাকে মিথ্যা বলেছিলাম যে আমি অফিসে আছি আর কাজের চাপ বেশি থাকায় তুলতুলের কাছে যেতে পারিনি। তুলতুল আপনার কাছে ভালো থাকবে কিন্তু লিনার পাশে ছিল না তাই নিশ্চিন্তে তুলতুলকে আপনার একার দায়িত্বে রেখে গেছি।’

আমি নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম- ‘সেদিন-ই আমি আপনাদের দেখেছিলাম।’

‘দেখেছিলে!! তাহলে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো নি কেন? কোনো কিছু জানতে চাওনি কেন?’

ধ্রুব বেশ উৎকন্ঠিত হয়েই প্রশ্ন গুলো আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। আমি জবাব দিলাম না। ধ্রুবর প্রশ্ন গুলোকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পালটা প্রশ্ন করলাম,

‘এত কিছু হওয়ার পরেও উনি বাসায় ফিরে যায়নি কেন? আর আপনিই বা সবার কাছে এসব লুকিয়েছেন কি কারণে?’

ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ক্লান্ত ভঙ্গিতে রেলিঙের হেলান দিয়ে দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে দাঁড়ালেন। আমার দিকে চেয়ে বিষন্ন গলায় বললেন-

‘ওর পরিবারের কেউ বিয়েতে রাজি ছিল না। লিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ওর সাথে সবার যোগাযোগই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ তাই এত কিছুর পরেও বাসায় ফিরে যাওয়ার সাহস পায়নি। নিজের ভুল সিদ্ধানের জন্য লজ্জিত ছিল। আর আমি এসব লুকিয়েছে কারণ আমি লিনাকে কথা দিয়েছি এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলবো না৷ বিশেষ করে আম্মুকে।’

আমি ভীষণ আগ্রহ নিয়ে তাকালাম ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব আমার প্রশ্নাত্মক চাহনির মানে বুঝতে পেরে বললেন-

‘আম্মু লিনাকে অনেক বার বুঝিয়েছিল ছেলেটা ভালো না। কিন্তু লিনা মানতে নারাজ। এমনকি আম্মুর সাথে রাগারাগি করেছিল ওই ছেলের জন্য। তাই অপরাধ বোধের জন্য লিনা এখন আর আম্মুর সামনে আসতে চায় না। এই কারণেই তখন মার্কেট থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছিল।’

‘হুম বুঝলাম। কিন্তু এখন উনি কোথায় থাকেন?’

‘এতদিন হোস্টেলে ছিল। তবে আজ ওকে নিপা আন্টির কাছে দিয়ে এসেছি। আন্টি এসব শুনে অনেকটা উত্তেজিত হয়ে পরেছিল। কিন্তু পরে নিজেকে সামলে নেয় আর লিনাকেও মেনে নিয়েছে। আর এসব ঝামেলা মেটাতে গিয়েই আমার এই নাজেহাল অবস্থা।’

ধ্রুব উদাসীন গলায় কথা গুলো বলেই ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দে হাসলাম। ঠিক তখনই আমার অবচেতন মন বেশ ফুরফুরে মেজাজে আমাকে বলল- ‘আজ আমার মন ভালো। ভীষণ ভীষণ ভীষণ রকমের ভালো।’ হঠাৎ করেই মনে হতে লাগলো পৃথিবীটা খুব সুন্দর। আমি খুব সুখী মানুষ। আমার কোনো দুঃখ নেই। মন খারাপের কোনো কারণ নেই। ভেতরটা অদ্ভুত কারণেই সুখের সাগরের ভাসতে লাগল। আমি মুগ্ধ নয়নে তাকালাম আকাশের দিকে৷ মাথার উপরের এই বিশাল আকাশটা ধ্রুবর মতোই স্নিগ্ধ, শুদ্ধ, পবিত্র। এই বিশাল আকাশের মতোই ধ্রুবর আমার মনে খুব সাবধানে নিজের জন্য বিশাল এক জায়গায় তৈরি করে নিয়েছেন। আমার অজান্তেই আমি তাকে খুব খুব খুব বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি। অসময়ে ঠিক সঠিক মানুষটাকেই আমি ভালোবেসেছি, বিশ্বাস করেছি। আর সেই বিশ্বাস ধ্রুব খুব ভালো করেই রক্ষা করেছে। তিনি আমাকে ঠকায়নি, অযথা মিথ্যাও বলেনি। মিথ্যে বলার কিংবা সারাদিন ব্যস্ত থাকার অযুহাত দেখানোর যথেষ্ট কারণ ছিল ওনার। অন্যকে সাহায্য করতেই তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। আমাকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে না।

‘আচ্ছা ওইটা কি ছিল?’

ধ্রুবর প্রশ্নে আমি ভাবনার দেয়ালে পেরিয়ে বাস্তবে এলাম। অনিচ্ছা স্বত্তেও কপালে মৃদু ভাঁজ পরলো। প্রশ্নের জবাবে পালটা প্রশ্ন করলাম আমি,

‘কোনটা কি ছিল?”

ধ্রুব নিজের গালে হাত দিয়ে শুকনো ঢোক গিললেন। আশ্চর্য! ওনার সারা মুখে লজ্জার আভা ছড়িয়ে পরেছে। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গোলাকার চাঁদটা এবার আস্তে আস্তে করে উঁকি দিতে লাগলো। জ্যোৎস্নার তীব্র আলোয় ঝলমলিয়ে উঠলো ধ্রুবর মুখ। আমি বুঝলাম ধ্রুব দুপুরের ঘটনাটা নিয়ে কথা বলতে চাইছেন। আর এই কারণেই তিনি লজ্জা পাচ্ছেন। কিছুটা সময় ইতস্তত করে বললেন-

‘ওই যে দুপুরে দিয়েছিলেন এখানে।’

ধ্রুবর কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে আমার ভীষণ হাসি পেল। তবুই হাসিটা নিজের ভেতরেই চেপে রাখলাম। চোখেমুখে গাম্ভীর্যতা এনে ভারী গলায় বললাম-

‘কেন আপনি জানেন না কি ছিল?’

‘না মানে… হ্যাঁ জানি তবে ওটা কি সত্যি ছিল? কীভাবে কি হলো কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।’

আমি ধ্রুবর একদম কাছে এগিয়ে গেলাম। খানিকটা উঁচু হয়ে ওনার বিস্ময় ভরা মুখখানার দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে শীতল কন্ঠে বললাম-

‘তাহলে কি বোঝার জন্য আবারও দিতে হবে ওটা!’

আমার কথা ধ্রুব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। কিছুটা পেছনে সরে গিয়ে হকচকিত অবস্থায় বললেন-

‘আপনার কি আজ কিছু হয়েছে? এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন কেন? আগে তো এমন ছিলেন না।’

আমি মৃদু হাসলাম। মুখের হাসি ধরে রেখে বললাম-

‘কেন আপনি তো প্রতিদিন এমনই ব্যবহারই করেন। তাহলে আমি করলে কি অসুবিধে?’

‘আমি আর আপনি এক না। আপনি আমার বউ। আমি আমার বউয়ের সাথে এমন করতেই পারি না।’

ধ্রুব কথায় আমি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললাম-

‘আপনিও আমার স্বামী। আমিও আমার স্বামীর এমন করতেই পারি। তবে আপনি যে এতটা লজ্জাশীল স্বামী তা আগে জানতাম না। ভালোই হলো জেনে নিলাম।’

আমি রুমের দিকে পা বাড়ালাম। পেছন থেকে ধ্রুব হড়বড়িয়ে বললেন-

‘আমি মোটেও আপনার মতো লজ্জাবতী না। হঠাৎ করে আপনার এমন পরিবর্তনে কিছুটা না অনেকটা-ই বিস্মিত হয়েছি।’

আমি কিছু বললাম না। পেছন ফিরে ওনার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

দেখতে দেখতেই ভাইয়ার বিয়ের দিন চলে এলো। বাড়ির প্রতিটি আনাচেকানাচে শুধুই উল্লাস। সবার হাসি মুখের উজ্জ্বলতায় ঝলমলিয়ে উঠে সারা বাড়ি। বেশ আনন্দ নিয়ে পরিবারের প্রতিটা মানুষ বিয়ের কাজ করছে। এতগুলো মেহমান আর বিয়ে বাড়ির ব্যস্ততায় ধ্রুবর দেখা পাওয়া মুশকিল হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বরযাত্রী বেরিয়ে পরবে কমিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে। ধ্রুব রেডি হয়েছে কি-না তা-ও আমার জানা নেই। সকাল থেকেই নানান কাজ নিয়ে এখানে ওখানে ছুটোছুটি করছেন তিনি। বাড়ির এক মাত্র জামাই বলে কথা। সব দায়িত্বই তিনি নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছেন। সবার প্রতি যত্নশীল হলেও নিজের বেলায় মানুষটা বড্ড বেখেয়ালি।

‘তুলতুলের আম্মু! যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। রেডি হয়েছেন আপনি?’

তুলতুলকে কোলে নিয়ে ধ্রুব রুমে ঢুকেলেন। তুলতুলের জামা ঠিক করতে করতে কথা বলেছেন তিনি। তুলতুলের জামা ঠিক করা হলে মাথা তুলে আমার দিকে চেয়েই অবাক হলেন। অবাক হয়েছি আমি নিজেও। তাদের দু’জনকে দেখেই আমি হতবাক হয়ে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। কাকতালীয় ভাবে আমাদের তিনজনের ড্রেসের কালারই এক রকম। ধ্রুবর গায়ে কালো শার্ট, কালো প্যান্ট এমনকি ব্লেজারটাও কালো রঙের৷ তারচেয়েও অবাক করার বিষয় হলো তুলতুলের ড্রেসও কালো রঙের। ধ্রুব কখন তার মার্কেট করেছে তা আমি জানি না। তবে তুলতুলের মার্কেট ভাইয়া আগেই করে রেখেছিল তবে আমাকে দেখায় নি। তাই তাদের মার্কেট সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না।
ধ্রুব আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে অবাক কন্ঠে বললেন-

‘আপনিও আজ কালো শাড়ি পরেছেন?’

আমি নিজের হতভম্ব ভাব কাটিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললাম- ‘আব্বু পছন্দ করে কিনে দিয়েছে এই শাড়ি। কিন্তু আপনাদের টা কীভাবে?’

ধ্রুব অদ্ভুত ভাবে হাসলেন। ছাড়া ছাড়া গলায় বললেন-

‘কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। তবে যাইহোক আপনাকে দেখতে মাশাআল্লাহ পুরো ধ্রুবর বউ লাগছে। আর তুলতুলকেও আপনার মতোই সুন্দর লাগছে।’

ধ্রুব প্রসংশায় শুনে আমি কপাল কুচকে ফেললাম। সরু সরু চোখে তাকিয়ে রইলাম ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব আমার দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে বললেন-

‘আমি জানি আমাকেও সুন্দর লাগছে। তবে আমাকে দেখার আরও সময় আছে কিন্তু শাকিলের বিয়ের বেশি সময় নেই। তাই তাড়াতাড়ি আসুন। আমাদের যেতে হবে। সবাই অপেক্ষা করছে গাড়িতে।’

আমি তীক্ষ্ণ চোখে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। কিছু বলার আগেই ধ্রুর আমার হাত ধরে হাঁটা শুরু করলেন। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই কমিটি সেন্টারে পৌঁছে গেলাম৷ তার কিছুক্ষণ পরেই সানিয়া এসে উপস্থিত হলো আমাদের সামনে।

‘বাহ দোস্ত আজ তো তোদের পুরো ফাটাফাটি লাগছে। তিনজনেই তো একদম ম্যাচিং করে ড্রেস পরেছিস। বাই দ্যা রাস্তা তুই কবে থেকে ড্রেস ম্যাচিং করে পরা শিখলি! তোর ড্রেসিং সেন্স এমন তুখোড় হলো কি করে অনু?’

সানিয়া ভ্রু নাচিয়ে কথা গুলো বলেই তুলতুলকে কোলে তুলে নিলো। আমি ধ্রুবর দিকে আড় চোখে চাইলাম। ঠোঁটের কোণে তার সহজাত হাসি ঝুলিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘জানি না কীভাবে ম্যাচিং হয়েছে। আলাদা আলাদা-ই তো মার্কেট করা হয়েছিল।’

আমার কথায় সানিয়া দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল-

‘এটাকে-ই বলে ভালোবাসা। সত্যিকারের ভালোবাসা।’

‘এত বুদ্ধিমান শালি থাকতে আমার বউটা এখনও বোকা রয়ে গেল কিভাবে?’

ধ্রুবর প্রশ্নে সানিয়া সশব্দে হেসে ফেলল৷ রসিকতা করে বলল-

‘হয়তো আপনার অপেক্ষায় দুলাভাই।’

আমি জ্বলন্ত চোখে সানিয়ার দিকে তাকালাম। এটা আদোও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড না-কি শত্রু! আমাকে খ্যাপানোর জন্য সব সময় হয়তো সুযোগের অপেক্ষায় হা করে বসেই থাকে। আমি রাগান্বিত হয়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই ধ্রুব সানিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগল। বেশ কিছুটা সময় তাদের এই অহেতুক হাসি সহ্য করার পর হাল ছেড়ে দিলাম। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বললাম-

‘হাসি থামাবেন নাকি মনি মা’কে বলতে হবে!’

ধ্রুব সঙ্গে সঙ্গেই তার হাসি গিলে ফেললেন। মুখ অন্ধকার করে মিনমিন করে বললেন-

‘আমার মেয়েটাও কিছু হলে এমন মা মা করে না যতটা তুমি করো।’

ঠিক তখনই তুলতুল স্পষ্ট গলায় পর পর কয়েকবার ‘ভালোবাসা’ শব্দটা উচ্চারণ করলো। তুলতুলের কথায় ধ্রুব আর সানিয়ার হাসির পরিমাণ কমার বদলে আরও দিগুণ বেড়ে গেল। ঝংকার তুলে হাসছেন তারা দু’জন। তাদের হাসি দেখে তুলতুলও উৎসাহ পেয়ে হাতে তালিয়ে অনবরত ভালোবাসা ভালোবাসা বলেই যাচ্ছে। আমি তীরের মতো তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলাম ধ্রুব দিকে। ধ্রুব বুকে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে বললেন-

‘আহহ! আবারও বুকে যন্ত্রণা শুরু হলো।’

ধ্রুবর কথায় আমি কিছু বলবো তার আগেই পেছন থেকে কেউ একজন সুরেলা কণ্ঠে ধ্রুবকে ডাকলো। এই কন্ঠ আমি এর আগেও শুনেছি। খুব পরিচিত না হলেও কন্ঠটা একদম মাথায় গেঁথে গেছে।

‘ধ্রুব! তুমি এখানে!’

আমরা সবাই কৌতুহল ঘেরা চোখে সামনের দিকে চাইলাম। লাল রঙের শাড়ি গায়ে জড়ানো লিনা দাঁড়িয়ে আছে ঠিক আমাদের দৃষ্টির সামনেই। ঠোঁটে সেই আগের মতোই মনকাড়া হাসি ঝুলানো। আমার মস্তিষ্ককে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো- লিনা এখানে কি করছে?

ধ্রুব অবাক কন্ঠে পালটা প্রশ্ন করলেন লিনাকে,

‘তুমি এখানে কীভাবে?’

‘তোমাকে বলেছিলাম তো আমার ফ্রেন্ডের বিয়ে। এখানেই তো ওর বিয়ে কিন্তু তোমরা!!’

লিনার জবাবে ধ্রুব দারুণ আগ্রহ নিয়ে শুধালেন- ‘এখানে তো শাকিলের বিয়ে তার মানে কি শাকিলের বউ মানে লাবিবা তোমার ফ্রেন্ড?’

লিনা দ্রুতগতিতে মাথা ঝাঁকালো। খানিক্ষন ধ্রুবর সাথে কুশল বিনিময় করে কারও একজনের ডাকে সেখান থেকে লিনা চলে যায়। আর ধ্রুব চলে যায় স্টেজে ভাইয়ার কাছে। আমি দূর থেকেই ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছি। ভাইয়ার সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন তিনি৷

‘অনু মেয়েটা কে ছিল রে?’

সানিয়ার প্রশ্নে আমি নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম- ‘ধ্রুবর কাজিন।’

সানিয়া কিছুটা সময় চুপ থেকে সন্দেহের গলায় বলল-

‘মেয়েটাকে আমার ঠিক সুবিধার মনে হলো না। তুই ধ্রুব ভাইয়ের সাথেই ছিলি অথচ তোকে কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। আর একটু বেশিই হাসি হাসি মুখে কথা বলছিল ধ্রুব ভাইয়ের সঙ্গে। কেমন যেন আমার কাছে ভাল্লাগে নাই।’

আমি থমকে গেলাম। আমার নিজেরও ভালো লাগে না ধ্রুবর পাশে মেয়েটাকে দেখতে৷ অস্থির অস্থির লাগে। ঈর্ষান্বিত বোধ করি। বিনাকারণেই মেয়েটাকে অসহ্যকর মনে হয়। ধ্রুব থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সানির দিকে চাইলাম৷ নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে হাল্কা হেসে বললাম-

‘তুই একটু বেশিই ভাবছিস সানি। চল এখন তুলতুলকে কিছু খাওয়াতে হবে।’

সানিয়া আবারও কিছু বলতে চাইলো তবে আমি বলার সুযোগ দিলাম না৷ খুব সাবধানে এড়িয়ে গেলাম বিষয়টা।

চারপাশে ঘন অন্ধকার নেমে আসতেই বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলো। বিদায় বেলা সকলের কান্নাকাটির পাঠ চুকিয়ে নতুন বউ নিয়ে উপস্তিত হলাম আমাদের বাসায়৷ নতুন বউয়ের সাথে সঙ্গী হয়ে এলো তার ছোট দুই ভাই-বোন আর লিনা। আনন্দমুখর পরিবেশেও কেন যেন কিছুটা সংকোচিত বোধ করছি। মনটা বিনা কারণেই অস্থির হয়ে উঠছে। বাসায় পৌঁছে হাসিঠাট্টা আর হৈ-হুল্লোড়ের কেটে গেল অনেকটা সময়। তুলতুল ঘুমিয়ে পরেছে সানিয়ার কাছেই। রাত প্রায় বারোটা। অনেকেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। আবার অনেকে এখনও আড্ডা দিচ্ছে। সানিয়ার রুম থেকে বেরিয়ে ধ্রুবকে কোথাও দেখতে পেলাম না। আমি রান্নাঘরে এলাম। আম্মু আর মনি মা সব কিছু গুছিয়ে রাখছে। আমি তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

‘মনি মা উনি কোথায় দেখেছো?’

মনি মা ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে বললেন- ‘কার উনি!’

আমি কপাল কুচকে ফেললাম। এই সময় মনি মা আমার সাথে রসিকতা করছে! মা ছেলে সব একই রকম হয়েছে। আড় চোখে আম্মুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম আম্মু ঠোঁট চেপে হাসছে। আমি হতাশ গলায় বললাম-

‘আমার উনি। তুলতুলের আব্বু।’

মনি হাসতে হাসতে বললেন- ‘সবাই মিলে ছাদে আড্ডা দিবে শুনেছিলাম। গিয়ে দেখ ওখানে কি না।’

আমি বিনাবাক্য ব্যয়ে স্থান ত্যাগ করলাম। আম্মু আর মনি মা বান্ধবীর মতোই সব সময় এক সাথে জোড়া লেগে থাকে। না জানি কখন কি আমাকে লজ্জায় ফেলে দেয় বিশ্বাস নেই। তার চেয়ে বরং এখানে চলে যাওয়াই ভালো। ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই ভাইয়ের বন্ধুদের সাথে দেখা হলো। আমি ওনাদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম-

‘রাহাত ভাই আপনি কি তুলতুলের আব্বুকে দেখেছেন?’

রাহাত ভাই অলস ভঙ্গিতে সিড়ির শেষ ধাপে এসে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন-

‘আমাদের সাথেই তো ছাদে আড্ডা দিচ্ছিলো। নিচে এসেছে কিনা খেয়াল নেই। তুমি দাঁড়াও আমি দেখে আসি।’

‘নাহ নাহ.. আপনারা যান ঘুমিয়ে পরুন আমি দেখছি।’

রাহাত ভাই মাথা দুলিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন-

‘আচ্ছা ঠিক আছে। ভয় পেও না। পুরো ছাদ লাইটিং করা আছে।’

আমি হাল্কা হেসে চলে এলাম। ছাদের দরজার কাছে এসেই আমি থমকে গেলাম। বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম। অসহনীয় তীব্র ব্যথা। মুহুর্তেই এলোমেলো হয়ে গেল আমার সারা পৃথিবী। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে বয়ে গেল ভয়ংকর রাগ। রাগ হলো ভীষণ রাগ৷ অতিরিক্ত রাগে মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই৷ চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো ধীরে ধীরে। কিছুক্ষণের জন্য মস্তিষ্কটা কাজ করা বন্ধ করে দিলো।

চলবে…

শেষ রাত পর্ব-৩০+৩১+৩২

0

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৩০
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘ধ্রুব ভাইয়ের কি হয়েছে রে অনু? ইদানিং খুব ব্যস্ত থাকে মনে হচ্ছে। এখানেও তো তুলতুলের কাছে বেশি আসে না।’

ভাইয়ার কথায় খানিকক্ষণের জন্য আমি হাত আপনাআপনি থেমে গেল। নিজের অজান্তেই বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। নিজেকে যথাসাধ্য সংযত করে আবারও তুলতুলের জামা কাপড় ভাঁজ করে ব্যাগে গুছিয়ে রাখতে লাগলাম। ভাইয়ার প্রশ্নাত্মক চোখ জোড়া এখনও প্রতিত্তোরের আশায় স্থির চেয়ে আছে আমার দিকে। তবে আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। তুলতুলের সকল জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে বেডের পাশে রাখলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুলতুলকে নিয়ে আবারও বাড়ি ফিরবো। বিষাদ আর একাকিত্বে ঘেরা বাড়িটা আবারও তুলতুলের প্রাণোচ্ছল হাসিতে মুখরিত হয়ে উঠবে। স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে তুলতুলের ঘুমন্ত মুখের দিকে একনজর চাইলাম। তিনদিন ধরে মেয়েটা হসপিটালের কেবিনে পরে আছে। অথচ ধ্রুবর দেখা পাওয়া যেন দুষ্কর হয়ে উঠেছে এই সময়টায়। উনি এতটা বেখেয়ালি বা ব্যস্ত আগে ছিলেন না। তুলতুলের অসুস্থতার সাথে সাথেই যেন ওনার ব্যস্ত পালা দিয়ে বেড়েছে। সারাদিনে তাকে একবার দেখতে পাওয়া-ই ভীষণ ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে গেছে সবার জন্য। ভাইয়া সোফায় বসে ফোন টিপছে। আমি নিঃশব্দে এসে ভাইয়ার পাশে বসলাম। ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসির রেখা টেনে নিয়ে সহজ গলায় বললাম-

‘উনি কিছুদিন ধরে অফিসের কাজে একটূ ব্যস্ত তাই তুলতুলের সাথে বেশি সময় কাটাতে পারে না।’

ভাইয়ার ফোনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই বলল- ‘সত্যি-ই ব্যস্ত না-কি তুই আবার ওনার সাথে কোনো ঝামেলা টামেলা পাকিয়েছিস!’

ভাইয়া কথাটা বলেই মাথা তুলে আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আমি কিছুটা সময় চুপ থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম-

‘তোর কি মনে আমি সব সময় শুধু ঝামেলা-ই পাকাই!’

‘ধ্রুব ভাইয়ের মতো ভালো আর শান্তশিষ্ট স্বভাবের মানুষ কখনও ঝগড়াঝাটি করবে বলে মনে হয় না। আর তুই হলি পেত্নি। পেত্নিরা সবার সাথে ঝামেলা করে বেড়াবে এটাই তার আসল কাজ।’

আমি জ্বলন্ত চোখে ভাইয়ার দিকে চাইতেই ভাইয়া জোরপূর্বক দাঁত বের করে হাসলো। সোফা থেকে উঠে ফোন পকেটে রাখতে রাখতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল-

‘বিকেল হয়ে গেছে চল এখন তোকে তোর শ্বশুর বাসায় দিয়ে আসি। বাকি সত্য কথা অন্য আরেকদিন বলবো।’

আমি ভ্রু কুচকে তিক্ত গলায় বললাম- ‘এসব তোর সত্য কথা!’

ভাইয়া কিছুই বললো না। আমার দিকে চেয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। আমাকে রাগানোর মিশন কমপ্লিট হয়েছে তার।
ভাইয়া ঘুমন্ত তুলতুলকে খুব সাবধানে কোলে নিয়ে অন্য হাতে ব্যাগ তুলে নিলো। আমি দ্রুত পায়ে ভাইয়ার কাছে এসে বললাম-

‘ব্যাগটা আমার কাছে দে। তুই তুলতুল আর ব্যাগ একসাথে নিতে পারবি না।’

‘তোর এত পাকনামি করতে হবে না। আমার যথেষ্ট শক্তি আছে। আমি তোর মতো বাতাসের সাথে উড়ে বেড়াই না। যা সর।’

ভাইয়া আর এক মুহুর্ত দেরি না করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। আমি একমনে তাকিয়ে রইলাম ভাইয়ার যাওয়ার পানে। চোখের সামনে ভাসছে ভাইয়ার কাঁধে চড়ে ঘুরেবেড়ানোর স্মৃতিগুলো। বেশিদিন তো না এইতো সেদিনের-ই তো কথা। এই রুম থেকে ওই রুমে যেতেই ভাইয়ার কাঁধে চড়ে যেতে হয়েছে। আমার চেয়েও বেশি ভাইয়া আনন্দ পেতো আমাকে তার কাঁধে চড়িয়ে। আর এখন আমার সেই জায়গাটা আমার মেয়ে পেয়েছে। চোখের সামনেই যেন আবারও আমার ছোটবেলা দেখতে পাচ্ছি। ভাইয়া কর্কশ গলায় আমাকে ডাকলো। আমি ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলাম। মুচকি হেসে ভাইয়ার পিছু পিছু হাঁটা শুরু করলাম।

বৃষ্টিস্নাত বিকেল। ঘন্টা খানেক হলো বৃষ্টি থেমে প্রকৃতি শান্ত হয়েছে। মেঘহীন ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ। ঝিরিঝিরি হিম শীতল বাতাস বইছে চারপাশে। কোলাহলপূর্ণ শহরটাতে ঝুপ করেই নিরবতা নেমে গেল। বৃষ্টি ভেজা পিচঢালা রাস্তার পাড় দিয়ে নিঃশব্দে হাঁটছে লাজুক প্রেমিকা আর তার পাশেই মুগ্ধ নয়নের প্রেমিক পুরুষ। বৃষ্টির স্নিগ্ধতায় মেতে উঠেছে প্রেমিক প্রেমিকার মন। আমি মুগ্ধ হয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখছি। রাস্তায় জমে থাকা পানিতে গাঁ ভিজিয়ে পথশিশুরা খেলছে। কি সুন্দর প্রাণখোলা তাদের হাসি৷ এই হাসিতে নেই কোনো চিন্তা কিংবা বিষাদের ছোঁয়া। সব কিছুর মাঝে আচমকাই আমার দৃষ্টি আটকে গেল দুটো মানুষের দিকে। রাস্তার পাশে ফুটপাত দিয়ে পাশাপাশি হাঁটছে দু’জন। লাল জামা পড়া খোলা চুলের মেয়েটা এক নজরে তাকিয়ে আছে তার পাশে হাঁটতে থাকা মানুষটার দিকে। খুব মনোযোগ দিয়েই শুনছে মানুষটার কথা। ক্ষনিকের জন্য নিজের চোখদুটোকে অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো এই মুহুর্তে। ঝট করেই আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আবারও পূর্নাঙ্গ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে দেখতে চাইলাম মানুষটাকে। তবে তা আর সম্ভব হলো না। ঘুমন্ত তুলতুলের তোয়াক্কা না করেই গাড়ির স্পিড আগের চেয়েও বাড়তে লাগল। আচমকাই ভাইয়া হড়বড়িয়ে বলে উঠলো-

‘অনু শোন না তোকে তো একটা কথা বলতে ভুলেই গেছি। মনে আছে একটা মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম! তারা তো বিয়ের কথা ফাইনাল করতে চাচ্ছে৷ তোর কি মনে হয় আমার এখন বিয়ে করা উচিত? কয়েকমাস হলো আব্বুর ব্যবসায় মন দিয়েছ। এখনই সবাই বিয়ের জন্য উঠে পরে লেগেছে। খুব জলদি হয়ে যাচ্ছে না! কিরে কথা বলছিস না কেন? তোকে কিছু বলছি আমি। আমাকে একটু সাহায্য কর।’

হঠাৎ করেই ভাইয়ার এমন ব্যবহারে আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। মাথাটা এলোমেলো লাগছে। আমি কি সত্যিই দেখলাম না-কি আমার মনের ভুল ছিল! মানুষটা কি সত্যিই এখানে ছিল! আমি আর বেশিক্ষণ এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারলাম না। ভাইয়ার উদ্ভট আচরণ আর একনাগাড়ে কথা বলায় অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। তুলতুলও এবার নেড়েচেড়ে উঠলো। আমি বিরক্ত হয়ে চাপা কন্ঠে বললাম-

‘ভাইয়া! তোর বকবক বন্ধ কর তো। আর গাড়ির স্পিড কমা। তুলতুল ঘুমাচ্ছে দেখছিস না! আর বিয়ে নিয়ে তোর এত মাথা ঘামাতে হবে না। আব্বু আম্মু যা সিদ্ধান্ত নিবে তোর সেটাই মানতে ব্যস।’

ভাইয়া গাড়ির স্পিড কমিয়ে আমতা আমতা করে বলল- ‘আমি তো তোর মতামত চাচ্ছিলাম।’

‘এখন মন দিয়ে গাড়ি চালা এসব নিয়ে বাসায় যেয়ে কথা বলবো।’

ভাইয়া আর কথা বাড়ালো না। চুপ থেকেই পাড় করলো সারা পথ। কেমন যেন চিন্তিত লাগছে ভাইয়াকে। বাসায় এসে তুলতুলে কোলে নিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে আমার রুমে চলে আসলো। মনি মা সাথেও কেমন নির্লিপ্ত ভাবেই কথা বলল।

‘অনু একটু এদিকে আয়। আমার পাশে বস।’

আমি তুলতুলের গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে ভাইয়ার দিকে চাইলাম। বিছানার এক কোনে পা ঝুলিয়ে বসেছে। দারুণ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ভাইয়ার পাশে এসে বসলাম। বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কিছু বলবি?’

ভাইয়া কিছু বলল না। মাথা নিচু করে চুপচাপ দু’হাত এক করে বসে রইলো। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে আমার হাত আলতো করে ধরলো। নিজের দু’হাতের মুঠোয় আমার বা হাত আগলে নেয়। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে একমনে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার ভ্রু জোড়া কুচকে এলো। ভীষণ কৌতূহল নিয়ে দেখছি ভাইয়াকে। এর আগে কখনও ভাইয়া এমন ব্যবহার করে নি। আমার সাথে কথা বলতে তার এতো জড়তা কাজ করেনি। তাহলে আজ কেন এমন করছে?

‘অনু আমি জানি তোর বিয়েটা অন্য সব বিয়ের মতো স্বাভাবিক না। তুই একমাত্র তুলতুলের জন্যই এই বিয়েতে রাজি হয়েছিস। অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েছিস এই সম্পর্কের জন্য। এই ক’দিন তোর পাগলামো দেখেই আমি বুঝেছি তোর জন্য এই পরিবার কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আসলে এই পরিবারের প্রতিটা মানুষই ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য। ওনারা সবাই খুব ভালো সেটা আমরা ছোট থেকেই জানি। তোকেও খুব ভালোবাসে সবাই৷ বিশেষ করে মনি আন্টি। ওনার মতো ভালো মানুষ পাওয়া মুশকিল। আর..’

ভাইয়াকে মাথ পথে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম-

‘আর তোর ধ্রুব ভাইও খুব ভালো। কিছুক্ষণ আগেই হসপিটালে ওনার প্রসংশা করলি। আমার সব মনে আছে৷ তাই এখন আবার শুরু করিছ না। আমি জানি সবাই ভালো। এখন আসল কথায় আয়। বল কি বলবি!’

ভাইয়া আমার হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরলো। চোখমুখে গাম্ভীর্যতা এনে ভারী কন্ঠে বলল-

‘আমার কাছে সবার উপরে তুই। তোকে কেউ কষ্ট দিলে আমি তাকে কখনোই ছাড়বো না। সেটা আমার ভালো ধ্রুব ভাই হোক বা অন্য কেউ। এখন থেকে একটা কথা মাথায় ডুকিয়ে রাখ। তোর কোনো দরকার বা কোনো ঝামেলা হলে তুই আমাকে অবশ্যই জানাবি। আমি জানি তোর ধৈর্য্য শক্তি অনেক। তুই চাপা স্বভাবের মেয়ে। তবে আমার কাছে কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা করিস না। মনে রাখিস তোর পাশে কেউ না থাকলেও আমি সব সময় থাকবো।’

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ভাইয়ার কথা শুনে। আমার আর বুঝতে কষ্ট হলো না ভাইয়া রাস্তায় ধ্রুবর সাথে মেয়েটাকে দেখে ফেলেছে৷ আমি নিজের হতভম্ব ভাব কাটিয়ে যথাসম্ভব স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। মৃদু হেসে বললাম-

‘তুই হয়তো কোনো কিছু নিয়ে ভুল বুঝছিস ভাইয়া। কেউ আমাকে কষ্ট দিবে না৷ শুধু শুধু চিন্তা করিস না তো।’

‘হ্যাঁ আমিই যেন ভুল হই। সব কিছু ভুল হয়ে যাক শুধু তুই হ্যাপি থাকলেই হবে।’

রাত নয়টায় বাসায় ফিরলেন ধ্রুব। তুলতুলকে দেখেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন তিনি। মেয়েকে কোলে নিয়ে বেশ কিছুক্ষন সময় আদর করার পর শান্ত হয়ে বসলেন। তবে তুলতুল তার পাপার গলা জড়িয়ে ধরে থাকলো আগের মতোই। আমি দূর থেকে তাদের দু’জনকে দেখলাম। তাদের দেখে মনে হলো কত বছর তুলতুল বাসায় এসেছে। বাচ্চা মেয়েটাও অসুস্থতা থেকে বেরিয়ে একটু বেশিই চঞ্চলতা দেখাচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম তাদের কাছে। ধ্রুবর দিকে চেয়ে ক্ষীন স্বরে বললাম-

‘কিছুদিন ধরে আব্বুর সাথে আসেন না যে কোনো কিছু হয়েছে!’

ধ্রুব তুলতুলকে বিছানায় বসিয়ে গালে চুমু দিয়ে ভ্রুক্ষেপহীন গলায় বললেন-

‘আমার কাজ থাকে তাই আমি অফিসেই থেকে যাই৷ তুলতুলকে কখন নিয়ে এসেছেন হসপিটাল থেকে? আমি তো কিছুই জানি না।

‘আপনার হয়তো খেয়াল নেই তবে আপনাকে জানানো হয়েছিল। আর বিকেলেই ভাইয়া নিয়ে এসেছে। আপনার কথাও জিজ্ঞেস করেছিল। তুলতুলের সাথে দেখা করতে যাননি তাই।’

আমার কথায় ধ্রুবর মুখশ্রীতে পরিবর্তন হলো। ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা হাসি মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। অনুভূতিহীন হয়ে কিছুটা সময় চুপ থেকে বললেন-

‘অফিসে কাজের চাপ বেশি তাই যেতে পারিনি।’

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। ধ্রুব জঘন্যতম একটা কাজ করলেন। মিথ্যা বললেন তিনি। যে জিনিসটা আমি সব চেয়ে বেশি ঘৃণা করি ধ্রুব সেইটাই করলেন। আমাকে মিথ্যা অযুহাত দেখাচ্ছেন! আমি তো দেখেছি তিনি অফিসে ছিলেন না। আর আব্বুও তো বলেছেন অফিসে কাজের তেমন চাপ নেই। তাহলে কেন তিনি মিথ্যা কথা বলছেন আমাকে? আর ওই মেয়েটা!

‘তুলতুলের আম্মু? কোথায় হারিয়ে গেলেন! আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।’

আমি ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ক্ষীণ স্বরে বললাম- ‘জ্বি বলুন।’

ধ্রুব হাসলেন। আমার দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন-

‘আমি আপনাকে ভালোবাসি। আর আপনিও আমাকে ভালোবাসেন।’

আমি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আজ আর কিছু বললাম না৷ কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। বার বার মনে হচ্ছে তার মিথ্যা কথা আর রাস্তায় মেয়ের পাশে হাঁটার সেই দৃশ্যটা। কে ওই মেয়েটা যার কারণে উনি আমাদের সবাইকে মিথ্যা কথা বলছেন? আমার কি ওনাকে জিজ্ঞেস করা উচিত? কিন্তু কোথাও যেন একটা বাঁধা কাজ করছে।
আচমকাই তুলতুল অস্পষ্ট উচ্চারণে বলল- ‘ভালোবাসি’

পর পর কয়েকবার তুলতুল এই শব্দটা-ই উচ্চারণ করলো। ধ্রুব হেসে ফেলল শব্দ করে। আমি ব্যস্ত ভঙ্গিতে তুলতুলকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এখনও ধ্রুবর আকর্ষণ কাড়া হাসির তীক্ষ্ণ শব্দ তীরের মতো কানে এসে বাজছে।

চলবে….

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৩১
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘অনন্যা তুই কি ধ্রুবকে অবিশ্বাস করছিস?’

বিশ্বাস! বিশ্বাস খুব ছোট একটা শব্দ। তবে এর মর্যাদা রক্ষা করা খুব খুব খুব কঠিন। ঠিক তেমনি কারও মনে নিজের প্রতি বিশ্বাস জাগানোটাও ভীষণ কষ্টকর। ভালোবাসা ছাড়া বিশ্বাস হয়। তবে বিশ্বাস ছাড়া ভালোবাসা কিংবা সম্পর্ক কোনোটা-ই হয় না। ধ্রুব আর আমার সম্পর্কটা বিশ্বাস দিয়েই শুরু হয়েছে। ধ্রুব একদিনে আমার মনে তার জন্য বিশ্বাস জাগায়নি। দিনের পর দিন তার ব্যবহারে মাধ্যমেই আমার মনে তার প্রতি বিশ্বাস জাগিয়েছে। এতদিনে একটু একটু করে জন্মানো বিশ্বাস এক পলকের একটা দৃশ্য দেখে কিংবা তার একটা মিথ্যা শুনেই ভেঙে যাওয়া কি ঠিক! অন্য সবাই হয়তো কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করেই পুরনো সকল কথা ভুলে শুধু এবং শুধু মাত্র একটি মিথ্যাকে গুরুত্ব দিয়েই মানুষকে ভুল বুঝে বসে থাকে। আমরা মানুষ জাতি বরই অদ্ভুত। কেউ আমাদের সারাজীবন আগলে রাখলে সেটা আমরা মনে রাখি না। যেই না একদিন মানুষটার কোনো ভুল সামনে আসলো অমনি তার হাজারটা ভালো কাজ ভুলে শুধু খারাপটাই মনে রাখতে শুরু করি। তবে আমি পারলাম না সবার মতো হতে। আমার পক্ষে সম্ভব হলো না ধ্রুবকে অবিশ্বাস করা। বিয়ের পর থেকে আমার প্রতি ধ্রুবর ভালোবাসা, কেয়ার, বিশ্বাস সব কিছু ভুলে শুধু মাত্র একটি মিথ্যাকে গুরুত্ব দিতে পারলান না। আমাকে আমার প্রাক্তনের সাথে দেখেও যে মানুষটা আমাকে অবিশ্বাস করেনি, আমি কীভাবে সামান্য একটা বিষয়ে তাকে অবিশ্বাস করবো! প্রতিদিন একটু একটু করে আমার মনে তিনি নিজের জন্য জায়গায় করে নিয়েছেন। বিশ্বাস তৈরি করেছেন। বিচ্ছেদের দাহনে পুড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া আমিটাকে খুব সুন্দর করে সামলে নিয়েছেন। সেই মানুষটা এত সহজে আমাকে ঠকাবেন এটা মেনে নেওয়া যায় না। কল্পনাও করা যায় না। তিনি মিথ্যা বলেছেন এটা আমি জানি। হয়তো তার পেছনে যথাযথ কোনো কারণ আছে। তুলতুলকে দেখতে না এসে তিনি একটা মেয়ের সাথে বাহিরে হেঁটেছেন এর পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। খুব বড়সড় কারণ আছে। তা নাহলে তিনি কখনই তুলতুলের অসুস্থতায় নিজেকে আড়াল করতে পারতেন না। যে মানুষ তুলতুলের হাল্কা সর্দিকাশিতে অস্থির হয়ে পরে সে মানুষ কখনোই তুচ্ছ কারণে তুলতুলকে উপেক্ষা করবেন না। হয়তো সঠিক সময় আসলেই তিনি সবটা খুলে বলবেন। মিথ্যার আশ্রয় কেন নিয়েছেন তা-ও বলবেন। এখন শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা। নিজের মস্তিষ্কে জেগে ওঠা প্রশ্নে আমার মন খুব সুন্দর করে উত্তর দিলো-

“নাহ, আমি ধ্রুবকে অবিশ্বাস করছি না। করতে পারি না। ধ্রুবকে অবিশ্বাস করা যায় না। কিছুতেই না। পুরো পৃথিবী আমাকে ঠকালেও ধ্রুব কিছুতেই আমাকে ঠকাবেন না। আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। তাকে অবিশ্বাস করা যায় না। তাকে শুধু বিশ্বাস করা যায়৷ ভরসা করা যায়।”

মন থেকে আসা প্রত্যুত্তরের বিপরীতে আমার মস্তিষ্ক তখন পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো আমার দিকে- “শুধুই কি বিশ্বাস আর ভরসা করা যায়! ভালোবাসা যায় না?”

এই প্রশ্নের জবাবে আমি শুধুই হাসলাম। যে হাসির মানে হতে পারে অনেক কিছু। যে হাসির মানে আমি বের করতে চাই না। যে হাসিকে শুধুই প্রশ্রয় দেওয়া যায়।

————————

‘কিরে কখন আসবি তোরা? আমরা বেরিয়ে গেছি তো।’

ফোন রিসিভ করতেই অপরপ্রান্ত থেকে ভাইয়ার দুর্বল কন্ঠস্বর ভেসে আসলো। আমি কল লাউডস্পিকারে দিয়ে ফোন ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখলাম। আয়নার দিকে চেয়ে চুল ঠিক করতে করতে বললাম-

‘এই তো রেডি হচ্ছি একটু পরেই বেরিয়ে যাবো।’

‘আচ্ছা জলদি কর। নাহলে আজ সারারাত শপিংমলেই থাকতে হবে। ভাল্লাগে না এসব মার্কেট ফার্কেট করতে। তোরা-ই তো বিয়ে ঠিক করলি তাহলে তোরা একা একা কেন মার্কেট করতে পারবি না! একদম দল বেধে সবাইকে কেন নিয়ে যেতে হবে? আর আমাকেই বা কেন যেতে হবে?’

ভাইয়া আক্রোশ ভরা কন্ঠে একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে। ভাইয়ার রাগ দেখে আমি নিঃশব্দে হাসলাম। বিয়ে নিয়ে ভাইয়া বিব্রতবোধ করছে। সব কিছুতেই অস্বস্তি প্রকাশ পাচ্ছে। আমি সেটা বুঝতে পারছি। হয়তো বিয়ের সময় এমন হওয়াটা-ই স্বাভাবিক। জীবনের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নার্ভাস তো লাগবেই। এটাই স্বাভাবিক। আমি ভাইয়ার অস্বস্তি কিংবা চাপা রাগ কোনটাই পাত্তা না দিয়ে সহজ গলায় বললাম-

‘কারণ বিয়েটা তোর একার হলেও মার্কেট সবার-ই করা লাগবে। আর তুই কি পুরনো জামাকাপড় পরেই বিয়ের দিন ভাবির বাসায় যাবি না-কি!’

‘এই চুপ থাকতো পেত্নি। প্যাচাল না পাইরা জলদি আয়।’

ভাইয়া ক্ষিপ্ত গলায় কথাটা বলেই খট করে ফোন রেখে দিলো। আমি মৃদু হাসলাম। রেডি হয়ে রুম থেকে বের হবো ঠিক তখনই ধ্রুব আমাকে ডাকতে ডাকতে হন্তদন্ত হয়ে রুমে ডুকলেন। আমাকে দেখে আচমকাই থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। আমি কৌতূহলী চোখে ওনার দিকে চাইলাম। দরজার সামনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। চোখের মনিজোড়া স্থির নিষ্পলক। ওনাকে এভাবে দেখে আমি ভ্রু জোড়া নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

‘কিছু বলবেন?’

আমার প্রশ্নের জবাবে ধ্রুব কিছু বললেন না। আগের মতোই ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে আছেন। আমি কয়েক পা এগিয়ে এসে আবারও মিহি কন্ঠে প্রশ্ন করলাম-

‘কি হলো কিছু বলছেন না কেন?’

ধ্রুব সঙ্গে সঙ্গেই তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। হঠাৎই দরজা বন্ধ করে দিয়ে একদম আমার সামনা-সামনি এসে দাঁড়ালেন। খানিকটা ঝুঁকে এসে মুখোমুখি হয়ে কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বললেন-

‘কালো ড্রেস আর হাল্কা সাজে তোমাকে এত সুন্দর লাগে আগে জানতাম না। অবশ্য না সাজলেও তোমাকে সুন্দর-ই লাগে। তবে আজ একটু ভিন্ন লাগছে। এখন থেকে তুমি সব সময় আমার সামনে কালো জামা পড়ে থাকবে। ঠিক আছে?’

আমি ওনার বুকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে সোজা করে দিলাম। উনি কপাল কুচকে ফেললেন৷ দু-হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে আমার দিকে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমি ওনার চাহনি উপেক্ষা করে সন্দিহান কন্ঠে বললাম-

‘একই জিনিস প্রতিদিন দেখতে বা খেতে কখনোই কারো ভালো লাগে না। একটা সময় পর সেই জিনিসটার প্রতি একঘেয়েমি চলে আসবে এটাই স্বাভাবিক৷’

কথাটা বলে আমি চলে যেতে নিলেই ধ্রুব আমার হাত ধরে ফেললেন। আমি পেছন ফিরে তাকাতেই আমার হাত টান দিয়ে আবারও তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন। খানিকক্ষণ স্থির চোখে চেয়ে থাকলেন। ওনার এমন নিষ্পলক চাহনিতে ক্ষীণ অস্বস্তি বোধ করলাম আমি। মাথা নিচু করে আমার দৃষ্টি নামিয়ে নিতেই ধ্রুব তার দু’হাতে আমার গাল ধরে তার মুখোমুখি করে করে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বললেন-

‘তুমি কোনো জিনিস না যে তোমার প্রতি আমার একঘেয়েমি চলে আসবে। তুমি প্রতিদিন কালো জামা পরলেও আমার একঘেয়েমি আসবে না। আর জামা না পড়লেও একঘেয়েমি আসবে না।’

ধ্রুবর কথায় আমার চোখ রসগোল্লার মতো বড় হড় হয়ে গেল। বিস্ফোরিত চোখে ওনার দিকে তাকালাম৷ ওনার বুকে থাপ্পড় দিয়ে নাকমুখ ছিটকে বললাম-

‘ছিঃ আপনি এত নির্লজ্জ টাইপ কথাবার্তা বলেন কিভাবে! অসভ্য লোক।’

ধ্রুব নিজের কথা বুঝতে পেরে থতমত খেয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন-

‘আরে এটা তো এমনি কথার কথা বললাম।’

আমি আর কিছু বললাম না৷ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ধ্রুব মিনিট খানেক সময় ইতস্তত করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য গাঢ় স্বরে বললেন-

‘যাইহোক কোথায় যেন ছিলাম! অহহ হ্যাঁ মনে পরেছে। তুমি কোনো জিনিস না যে প্রতি আমার একঘেয়েমি চলে আসবে। বুঝতে পেরেছো! আমি তোমাকে ভালোবাসি মানে তোমার সব কিছুকেই ভালোবাসি। তুমি যেমনই হও না কেন তোমাকেই ভালোবাসি। আর আমার ভালোবাসার কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই। আমি প্রতিদিন তোমাকে নতুন নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করি। এসব ড্রেস কিংবা সাজগোছ তো জাস্ট ক্ষনিকের ভালো লাগার জন্য। চোখের মুগ্ধতার জন্য।’

ধ্রুব থামলেন। কিছুক্ষন চুপ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-

‘অনেক কথা বলে ফেললাম এবার একটা চুমু দিন তো তুলতুলের আম্মু।’

ধ্রুব নিচু হয়ে তার গাল আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি কয়েক মুহুর্ত শান্ত চোখে ওনার গালের দিকে স্থির চেয়ে থাকলাম। এখন আর আগের মতো অবহেলায় বেড়ে ওঠা সেই অবাঞ্ছিত দাঁড়ি গুলো নেই। খুব সুন্দর করে ছাটাই করা খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ঢেকে আছে তার ফর্সা গাল। বারান্দার দরজা আর জানালা দিয়ে আচমকাই দমকা হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিলো আমাকে। বাতাসের সাথে আসা বেলি ফুলের তীব্র সুগন্ধে সম্মোহিত হয়ে গেলাম আমি। দমকা হাওয়ার মতোই এলোমেলো হলো আমার মনের সকল অনুভূতি। ঝড় বইতে শুরু করলো। অনুভূতিরা মিছিলে নামলো। ধ্রুব নামক মিছিল। এই মিছিল যেন থেমে যাওয়ার নয়। খুব ভয়ংকর একটা কাজের দিকে নির্ভয়েই পা বাড়ালাম আমি। ধ্রুবকে এবং নিজেকে প্রচন্ডরকম অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যিই একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেললাম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যিই আমি এই প্রথম ওনার গালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম। আমার নরম সরম ঠোঁট জোড়া আকষ্মিকভাবেই ওনার নিষ্ঠুর ধারালো গাল ছুঁয়ে দিল। এই প্রথম বুঝি আমি ওনার দিকে পা বাড়ালাম। ধ্রুবর সাথেই তাল মিলিয়ে সম্পর্কের সিড়িতে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলাম। ধ্রুবর কেঁপে উঠেছিল তখন। তারপর হুট করেই আবারও থমকে গেলেন। কিছুক্ষণ সেভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে ঝট করেই কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন তিনি। ভূত দেখার মতো অবিশ্বাস্য চোখে আমার দিকে চাইলেন। এমন ভয়ংকর একটা কাজ করে আমি অদ্ভুত ভাবেই নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রূপেই আবিষ্কার করলাম। আমার উচিত ছিল লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নুয়ে ফেলা। অথচ আমি স্বাভাবিকভাবেই ওনার বিস্ফোরিত চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মুহুর্তের মধ্যেই যেন কান দুটো লাল হয়ে লজ্জায় মিইয়ে গেলেন তিনি। কি অদ্ভুত! ধ্রুব লজ্জা পাচ্ছে। ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। তার চাহনিতে স্পষ্ট লজ্জার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তার লাল লাল কান দুটো বলে দিচ্ছে তিনি লজ্জা পাচ্ছেন। ইশ! ভীষণ অনুচিত কাজ কিরে ফেললাম বোধহয়। আমার লজ্জা পাওয়ার কথা ছিল অথচ সেখানে ধ্রুব লজ্জা পাচ্ছে। কি অদ্ভুত! মনে মনে অজানা আনন্দের উপস্তিতি টের পেলাম। আমি হাসলাম ধ্রুবর লজ্জা দেখে। নিজের কাজের জন্য অনুশোচনা কিংবা লজ্জিতবোধ না করে ভেতর ভেতর আমি উল্লাসিত অনুভব করলাম। ধ্রুব হয়তো ভাবেনি আমি সত্যি তার কথা মেনে নিবো।

‘কিরে কই তোরা! আজ কি মার্কেটে যাবি না-কি বাসাতেই বসে থাকবি!’

বাহির থেকে মনি মা’র তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই ধ্রুব অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে হন্তদন্ত হয়েই রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন উনি। আমি তাকিয়ে রইলাম ওনার যাওয়ার দিকে। মুচকি হেসে আমিও ওনার পেছন পেছন গেলাম। ধ্রুবকে দেখে মনি মা তিক্ত গলায় বললেন-

‘অনুকে ডাকতে গিয়ে তুই কোথায় উধাও হয়ে গেছিলি? একটা কাজও কি ঠিক মতো করতে পারিস না!’

ধ্রুব কিছু বললেন না। চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলেন। আব্বু তুলতুলকে কোলে নিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন-

‘তোমার এই গাঁধা ছেলেকে দিয়ে কখনও কোনো কাজ ঠিক মতো হয়েছে সেটা দেখেছো!’

মনি মা আব্বুর কথা পাত্তা দিলেন না। ধ্রুবর দিকে খানিক্ষন তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থেকে এগিয়ে এসে চিন্তিত গলায় বললেন-

‘ধ্রুব তোর কান লাল হয়ে আছে কেন? আর মুখটাও তো কেমন যেন লাগছে। তোর কি শরীর খারাপ করেছে? এল্যার্জির সমস্যা হয়েছে না-কি!’

মনি মা’র কথা শুনেই ধ্রুব বিষম খেলেন। কাঁশতে কাঁশতে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললেন-

‘কিছু না মা কিছু না৷ দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। জলদি আসো। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।’

ধ্রুব কথা গুলো বলেই আমার দিকে চেয়ে শুকনো ঢোক গিলে হনহনিয়ে চলে গেলেন। ধ্রুবর এমন হাল দেখে আমার প্রচন্ড হাসতে ইচ্ছে হলো৷ হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে মন চাইলো৷ কিন্তু আফসোস এখন আর তা করা সম্ভব না। আমি নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। মনি মা আবারও চিন্তিত গলায় বললেন-

‘এই ছেলের কখন কি হয় কিছুই বুঝি না৷’

‘কি আর হবে! তোমার ছেলে তোমার মতোই আধপাগল হয়েছে।’

আব্বুর কথায় মনি মা তেঁতে উঠলেন। আবারও শুরু হলো তাদের কথা কাটাকাটি। আমি সেদিকে মন দিলাম না। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ধ্রুবর পিছু পিছু বেরিয়ে গেলাম। আমার পেছনেই মনি মা রাগে গজগজ করে এটা ওটা বলতে বলতে আসছেন। আব্বুও মনি মা’র রাগে ঘি ঢালার জন্য প্রস্তুত হয়েই পেছন পেছন আসছেন। সারা রাস্তা ধ্রুব আর একটা কথাও বলেন নি। আমি পুরোটা সময়েই তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। খেয়াল করছিলাম তার আড়চোখে তাকানো। কিছুক্ষণ পর পরেই আড়চোখে আমার দিকে চাইতেন। আমার চোখাচোখি হতেই লজ্জায় আবারও দৃষ্টি সরিয়ে নিতেন। আমি ধ্রুবকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। আমার চুমু দেওয়াতে তিনি এতটা লজ্জা পাবেন তা ভাবিনি।

‘কেমন আছো ধ্রুব?’

মেয়েলী সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনে আমি শাড়ি দেখা বাদ দিয়ে চমকে পেছন ফিরে চাইলাম। হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে সেদিন রাস্তায় ধ্রুবর পাশে দেখা মেয়েটা। ধ্রুব পেছন ফিরে মেয়েটার দিকে চাইলেন। সাথে সাথেই মেয়েটার মুখের হাসি আরও প্রসারিত হলো। ধ্রুব কিছুটা অবাক হয়ে মেয়েটাকে প্রশ্ন করলেন-

‘তুমি এখানে কি করছো লিনা?’

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৩২
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘তুমি এখানে কি করছো লিনা?’

ধ্রুব সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে লিনা নামের মেয়েটার দিকে প্রত্যুত্তরের আশায় চেয়ে থাকলেন। মেয়েটার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি দেখা দিলো। পরক্ষণেই সেই হাসি ছড়িয়ে পরলো সারা মুখ জুড়ে৷ মেয়েটার হাসিতে তার চোখদুটোও হেসে ফেলল। ইশ, কি সুন্দর হাসি! তবুও মনে হচ্ছে এই হাসিতে প্রাণ নেই। কেমন যেন প্রাণহীন হাসি মনে হচ্ছে। মুখ হাসলো। ঠোঁট হাসলো। তার চোখদুটোও হাসলো তবে তার মন থেকে যেন হাসি আসলো না। ধ্রুবর প্রশ্নে মেয়েটা বেশ নম্রতা সহকারে জবাব দিলো,

‘ফ্রেন্ডের বিয়ে তাই মার্কেট করতে এসেছিলাম।’

মেয়েটা থামলো। সচেতন চোখে আমার দিকে চাইলো একবার। চোখের মনিজোড়া তীক্ষ্ণ হলো। চোখদুটোতে ঝলঝল করে জ্বলে উঠলো কৌতূহলের তারা। ঘাড় বাঁকিয়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে কৌতুহলী হয়ে আবারও প্রশ্ন করল-

‘এটা-ই কি তুলতুলের আম্মু?’

ধ্রুব মৃদু হাসলেন। আমার দিকে চেয়ে চোখেমুখে লাজুক ভাব এনে মাথা দুলালেন। আমি তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে। ধ্রুবর জবাবে মেয়েটার ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করলাম। তবে আমি ব্যর্থ হলাম মেয়েটার মনের ভাব বুঝতে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই মেয়েটা ফের প্রশ্ন করলো,

‘তোমরা ঘুরতে বেরিয়েছিলে বুঝি?’

‘নাহ, শাকিল মানে অনন্যর ভাইয়ের বিয়ে তাই সবার সাথে মার্কেট করতে এসেছি।’

ধ্রুবর প্রতিত্তোরে মেয়েটা মলিন মুখে বলল-

‘অহহ, আন্টিও এসেছে!’

‘হ্যাঁ এসেছে। এখন বোধহয় অন্য কোথাও শাকিলের বউয়ের জন্য বিয়ের কেনাকাটা করছে।’

ধ্রুবর কথা শেষ হতেই আব্বু আমাদের কাছে আসলেন। লিনার দিকে খানিক্ষন ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘তুমি নিপার বড় মেয়ে এনি না?’

‘নাহ নাহ আংকেল আমি লিনা। এনি বড় আপুর নাম।’

লিনা বেশ অস্বস্তি নিয়ে কথাটুকু বলেই চুপ করে গেল। মাথা নিচু করে মেঝেতে তার দৃষ্টি স্থির করলো। অস্বস্তিতে মিইয়ে যাওয়া তার চোখ দুটো প্রাণপণে গোপন করার চেষ্টা করছে। বিনাকারণেই মেয়েটার এমন অস্বস্তি বোধ করা ঠিক স্বাভাবিক মনে হলো না আমার কাছে। কিছু একটা বিষয় তো আছেই যা মেয়েটার অস্বস্তির আর তার দৃষ্টি লুকানোর কারণ।
নিজের ভুল বুঝতে পেরে আব্বু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলেন। ভুল শুধরে নেওয়ার জন্য ইতস্তত করে বললেন-

‘অহহ, বড় হয়ে গেছো তাই চিনতে পারিনি। তাছাড়া তোমাদের চেহারা একই রকম দেখা যায়। যাইহোক কখন আসলে? মনির সাথে দেখা হয়েছে?’

‘আন্টির সাথে অন্যদিন দেখা করবো। এখন আমাকে যেতে হবে। ধ্রুব আমার সাথে একটু আসো তো জরুরি কাজ আছে।’

লিনা হড়বড়িয়ে কথা গুলো বলেই পেছন ফিরে হাঁটা শুরু করলো। ধ্রুব স্তম্ভিত হয়ে কয়েক সেকেন্ড লিনার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পরক্ষনেই নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলে হাল্কা হেসে বললেন-

‘তোমরা মার্কেট করো আমি আসছি।’

আমার কিংবা আব্বুর প্রতিত্তোরের অপেক্ষা না করেই ধ্রুব লিনার পেছন পেছন চলে গেলেন। আমি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ঠিক আগের মতোই চেয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে টু শব্দটিও বের করলাম না। লিনা আর ধ্রুবর এমন ব্যবহারে আব্বু নিজেও যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন।

‘তুই লিনাকে চিনিস?’

আব্বুর প্রশ্নে আমি ডানে বায়ে মাথা নাড়লাম। যার অর্থ আমি চিনি না। আব্বু চোখেমুখে চরম বিরক্তি ভাব নিয়ে এসে বাজখাঁই গলায় বললেন-

‘কেমন গাঁধা ছেলে জন্ম দিয়েছে তোর মনি মা আমি বুঝি না। কই মেয়েটাকে তোর সাথে একটু পরিচয় করিয়ে দিবে এইটুকু বুদ্ধিও এই ছেলের মাথায় নেই। গাঁধা কোথাকার।’

আব্বুর কথায় আমি ম্লান হাসলাম। যদিও হাসিটা শুধু মাত্র আব্বুকে দেখানোর জন্যই। আব্বু হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন-

‘লিনা হলো নিপার মেয়ে। বিয়েতে যে এসেছিল ধ্রুব খালা নিপা। মনে আছে? ওই যে কুটনী টাইপের মহিলাটা যে ছিল ওঁরই ছোট মেয়ে। যাইহোক এদের কথা বাদ দিয়ে এখন কি কেনার বাকি আছে কিনে নে। বাকিদেরও খুঁজতে হবে আবার।’

কুটনী টাইপের মহিলা!! আব্বুর কথা শুনেই আমি হেসে ফেললাম। তবে হাসিটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলাম না। অজানা কারনে মুহুর্তেই সেই হাসি ঠোঁটে মিলিয়ে গেল। আব্বুর দিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে আবারও শাড়ি দেখতে লাগলাম। একটার পর একটা শাড়ি উলটে পালটে দেখছি তবে কোনটাই ভালো লাগছে। মন বসছে না কিছুতেই। আচমকাই যেন ফুরফুরে মেজাজটা ভীষণ বাজে ভাবেই বিগড়ে গেল। ধ্রুবর এভাবে চলে যাওয়াতে বিষন্নতায় আঁধার হয়ে এলো মন। সব কিছুতেই বিষাদের ছায়া। পুরো পৃথিবীটা-ই যেন এলোমেলো লাগছে।

‘কিরে মা, কিছু পছন্দ হচ্ছে না?’

আব্বুর কন্ঠ শুনে আমি আব্বুর দিকে চেয়ে উদাসীন ভঙ্গিতে দু’দিকে মাথা নাড়লাম। আব্বু মুখ গম্ভীর করে আমার পাশের টেবিলে বসে শাড়ি দেখতে লাগলেন। মিনিট খানেক পেরুতেই কালোর মাঝে লাল সুতোর কাজ করা একটা শাড়ি নিয়ে বললেন-

‘এই নে এটায় তোকে দারুণ মানাবে।’

আমি সরু চোখে শাড়িটার দিকে একমনে তাকিয়ে রইলাম। বাপ ছেলে দেখতে যেমন একই রকম তেমনি তাদের পছন্দও এক রকম। তবুও একথা তারা মানতে রাজি না। আব্বু গলা পরিষ্কার করে ভারী কন্ঠে বললেন-

‘কি! আমার পছন্দের উপর বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে শুনে রাখ আমি-ই কিন্তু তোর মনি মা আর মোহনার জন্য সব সময় মার্কেট করি। মোহনা শাড়ি কিনলে সব সময় আমাকে সাথে নিয়ে যেতো। আমার মতো না-কি অন্য কেউ শাড়ি পছন্দ করে দিতে পারে না। মোহনা তো নেই তাই এখন আর কেউ বায়না করে না মার্কেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’

শেষ কথাটুকু বলতে গিয়ে আব্বুর গলারস্বর ধরে এলো। মেয়ে হারানোর কষ্ট মনে পরতেই চোখদুটো চিকচিক করে উঠলো। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো অন্যদিকে। পুরুষদের কাঁদতে হয় না। নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে হয় না। এটাই হয়তো নিয়ম। আর এই নিয়ম মানতেই আব্বু নিজেকে সামলে নেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। সন্তান হারানোর কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চাইছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পরক্ষণেই ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে নিয়ে মুগ্ধ গলায় বললাম-

‘কে বলল পছন্দ হয়নি! আমি তো ভাবছিলাম তুমি এত তাড়াতাড়ি এমন সুন্দর একটা শাড়ি কিভাবে পছন্দ করলে। আর মনে মনে তোমাকে নিয়েই প্রতিবার মার্কেটে আসার চিন্তাভাবনা করছিলাম। তুমি থাকলে শাড়ি খুঁজতে খুঁজতে আমার মাথা আর এলোমেলো করতে হবে না।’

আব্বু হাসলেন। সহজ সরল হাসি। এই মানুষটার প্রতি আমি ছোট থেকেই ভীষণ রকম দূর্বল ছিলাম। ছোট বেলা ওনাকে দেখলেই রহিম আংকেল, রহিম আংকেল বলে গলা জড়িয়ে ধরে থাকতাম। অন্য কারও সাধ্য ছিল না ওনার থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিতে। একটা সময় এসে দেখা গেল এই প্রিয় মানুষ গুলোর সাথেও দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সেই দূরত্ব মুছে এত গুলো বছর পর অপ্রত্যাশিত ভাবে আবারও খুব গাঢ় সম্পর্ক হলো। আগের থেকেও মজবুত হয়েছে এবারের সম্পর্ক।

———————

বিকেল গড়িয়ে রাত হলো। সূর্য ডুবে চাঁদের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠলো চারদিক। দেয়াল ঘড়িটা শব্দ তুলে এগিয়ে চলছে তার নির্দিষ্ট গতিতে। সময় গড়িয়েছে অনেকটা অথচ ধ্রুব এখনও বাসায় ফেরেনি। চাঁদের আলো আজ পৃথিবীকে মুগ্ধ করতে পারেনি। আর না পারছে সব সময়ের মতো আমার মনকে মুগ্ধ করতে। ধ্রুবকে ছাড়া চাঁদের আলোও আজ ফ্যাকাসে মনে হচ্ছে। মনের কোণে জমতে থাকা বিষাদের ছায়ায় পুরো পৃথিবীটা-ই নিস্তব্ধতার চাদরে মুড়ে গেল। ভয়াবহ নিরবতার নিচে চাপা পরল এই শহর। যেদিকে দৃষ্টি যায় সেদিকেই শুধু বিষন্নতা, উদাসীনতা আর দীর্ঘশ্বাস। এই দীর্ঘশ্বাসের কি মানে! ধ্রুবহীন কিছুটা সময় কেন এত উদাসীন লাগছে? ধ্রুবহীন আকাশের তারা গুলোও কেন আজ আলোহীন? মন খারাপের অসুখ হয়েছে আমার! তবে কি ভালোবেসে নিজেকে দূর্বলতাকে প্রশ্রয় দিলাম? আত্মসমর্পণ করলাম ধ্রুবর কাছে! নিজের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না সব কিছুই তুলে দিলাম ধ্রুবর হাতে। কোনো কিছুতেই এখন আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। সব কিছুতেই এখন ধ্রুবর নিয়ন্ত্রণ। ধ্রুব চাইলেই আমাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারে একমুহূর্তেই। আমাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার অস্ত্র আমি তার হাতে তুলে দিয়েছি। ধ্রুব কাছে থাকলে আমার সব কিছুই তখন রঙিন হয়। ধ্রুব হাসলে আমি হাসি। ধ্রুব দূরে গেলেই ভীষণ রকম মন খারাপে হাহাকার করে ওঠে ভেতরটা। ভালো লাগারা তখন গাপটি মে’রে বসে থাকে মনের এক কোণে। ধ্রুবকে নিজের থেকে দূরে কিংবা অন্য-কোনো মেয়ের সঙ্গে কল্পনা করাই নিজের জন্য ভয়াবহ ধ্বংসের মনে হয়।

কলিংবেল বেজে উঠল। বারান্দায় থেকে বেরিয়ে এলাম ড্রয়িংরুমে। দরজা খুলতেই ধ্রুবর ক্লান্ত মুখখানা আমার দৃষ্টি কেড়ে নিল। ধ্রুব তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে কিছুক্ষন। আমি সরে দাঁড়াতেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে ভেতরে চলে এলেন। রুমে এসে ধ্রুব অলস ভঙ্গিতে বিছানায় বসলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে পুরো রুমে নজর বুলিয়ে নিলেন একবার। তুলতুলকে রুমে না দেখে ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন করলেন-

‘তুলতুল ঘুমিয়ে পরেছে?’

আমি টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ওনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললাম-

‘হ্যাঁ মনি মা’র কাছেই ঘুমিয়ে পরেছে। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।’

ধ্রুব আমার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে গটগট করে গ্লাসের সব পানি শেষ করতে লাগলেন। স্থির দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ ধ্রুবর দিকে চেয়ে থেকে আমি রুম বেরিয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।

‘বারান্দায় চলে এলেন যে! ঘুমাবেন না?’

ধ্রুবর উপস্থিতে ঘাড় বাঁকিয়ে একঝলক তার দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি দিলাম অদূর আকাশে। গোলাকার ঝলমলে চাঁদটা কৃষ্ণবর্ণের মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেছে। ঠোঁট হাল্কা প্রসারিত করে মিহি কন্ঠে বললাম-

‘আপনি ঘুমিয়ে পরুন। আমি কিছুক্ষণ পর ঘুমাবো।’

ধ্রুব কিছু বললেন না। আগের মতোই আমার পাশে রেলিঙের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। তার দৃষ্টি এখনও আমার দিকেই তা বুঝতে আমার মোটেও অসুবিধে হচ্ছে না। আর অন্য সময়ের মতো তার চাহনিতে অস্বস্তিও লাগছে না।
তিনি খানিক্ষন নিশ্চুপ থেকে গাঢ় স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন আমার দিকে।

‘আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন তুলতুলের আম্মু? মানে আপনার কি কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?’

ধ্রুবর প্রশ্নের জবাবে আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম-

‘নাহ তো। কিছু বলার থাকলে তো বলতাম-ই।’

আমার কথায় ধ্রুব সন্তুষ্ট হলেন না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। হতাশ গলায় বললেন-

‘আপনার কিছু বলার না থাকলেও আমার অনেক কিছুই বলার আছে।’

‘হুম বলুন আমি শুনছি।’

ধ্রুব আমার দিকে ফিরে ঘুড়ে দাঁড়ালেন। অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে নিম্ন স্বরে বললেন-

‘আসলে আমি আপনাকে কিছু মিথ্যা কথা বলেছি। আর সেটা লিনার জন্য বলতে হয়েছে।’

‘মিথ্যা কথা বলেছেন! তার জন্য যথেষ্ট কারণ হয়তো আপনার কাছে আছে। আর সেই কারণটা-ই হয়তো আমার কাছে ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছেন!’

ধ্রুব মাথা তুলে আমার দিকে অবাক চোখে তাকালেন। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বললেন-

‘লিনার সম্পর্কে জেনেছেন নিশ্চয়ই! আম্মুর ফুপাতো বোনের মেয়ে। একটা ছেলের সাথে ওর সম্পর্ক ছিল। দু’বছর আগে সকলের অমতে পালিয়ে গিয়ে বিয়েও করে তারা দুজন।’

ধ্রুবকে থামিয়ে দিয়ে আমি নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম-

‘মিথ্যে বলার সাথে এসবের কি সম্পর্ক!’

চলবে…

শেষ রাত পর্ব-২৭+২৮+২৯

0

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৭
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

বিষন্নতার ধূসর বর্নের চাদরে মুড়ি দিয়েছে আজ আকাশ। রৌদ্র নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে সেই ধূসর বর্ন মেঘের আড়ালে। ভ্যাপসা গরমে ফুলে-ফেঁপে ওঠেছে সারা শহর। স্তব্ধ হয়ে আছে চারপাশ। দুপুরে শেষ সময়। রাস্তাঘাট তখন মানুষের কোলাহলে গমগমে অবস্থা। বিদঘুটে নিমপাতার মতো তিক্ত একটা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমি। নিজের অসহায়, ব্যর্থ জীবনটা কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি রাস্তায় রাস্তায়। এই মুহুর্তে আমার বেঁচে থাকাটাও মরে যাওয়ার চেয়ে কষ্টকর মনে হচ্ছে। মস্তিষ্কে যেন ভয়াবহ জ্যাম লেগেছে। কি করা উচিত আর কি করা উচিত না কিছুই মাথায় খেলছে না। মাথায় তখন একটাই চিন্তা ঘুরছে ধ্রুবকে সবটা জানাতে হবে। উনি একমাত্র ব্যক্তি যে সব কিছু চোখের পলকেই ঠিক করতে পারে। আলাদীনের জিনির মতোই তার জাদু দিয়ে সব ঠিক করে ফেলতে পারে। খুব সুন্দর ভাবে ঠান্ডা মাথায় সব কিছু সামলে নিতে পারে। কিন্তু এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড় তিক্ত ও বিষাক্ত সত্য হলো আমি তাকে কাছে পাচ্ছি না। বার বার ফোন করেও তাকে পাচ্ছি না। আমি একা পরে গেছি। ভীষণ একা। কোলে থাকা মেয়েটাকে ছটফট করতে দেখেই যেন বার বার ভয়ে আঁতকে উঠছি। রাস্তায় বের হতেই বুঝলাম আমি কখনও হসপিটালের ধারের কাছেও যাইনি। হসপিটালে যাওয়ার দরকার পরেনি কখনও। এরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে আগে কখনোই আবিস্কার করিনি। আমি এদিক ওদিক ঘুরছি সাহায্য পাওয়ার আশায়। একটা ভরসার হাত পাওয়ার আশায় কিন্তু কাউকে পাচ্ছি না। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে অবশেষে নিজেকে নিজের ভেতরে শামুকের মতো গুটিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। তবে আফসোস শামুকের খোলস হিসেবে ধ্রুবকে খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি বলেছিলেন নিজেকে লুকিয়ে নিতে চাইলে তার মাঝেই লুকিয়ে নিতে হবে। আমি শামুক হলে তিনি হবেন আমার খোলস। তবে তিনি কথা রাখেননি। কথা রাখতে পারেন না। কথা রাখতে জানেন না। সব চেয়ে বড় তিক্ত সত্য তাকে আমি কাছে পাচ্ছি না।
ধ্রুবকে ফোনে পেলাম না। তিনি ফোন ধরছেন না। বার বার রিং বেজে কেটে যাচ্ছে। আমি হতাশ হলাম। আর কোনো উপায় না পেয়ে ফোন রেখে দিলাম ব্যাগে। আশেপাশে তাকিয়ে তুলতুলকে নিয়ে উঠে পরলাম থেমে থাকা একটা বাসে। সিটে বসার কিছুক্ষণ পরেই তুলতুল আরেক দফায় বমি করলো। আবারও সেই ছটফটিয়ে ওঠা। আমার ধারণা নেই মেয়েটার কি হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে! মেয়েটার এমন অবস্থা দেখে চোখের জল ফেলা ছাড়া আমি আর কিছুই করতে পারছি না। আমি হয়তো ব্যর্থ একজন মা। যে কি-না নিজের সন্তানের কোনো সাহায্য করতে পারছে না।

‘কি হইছে মা কানতাছো কেন? মাইয়ার শইল ভালা না?’

পাশ থেকে এক মধ্যবয়স্কা মহিলার কন্ঠস্বর শুনে আমি ক্ষীণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালাম। পাশের জানালার সাথের সিটে বসা পাঁক ধরানো চুলের ফর্সা বর্ণের মহিলা। প্রশ্নোত্তর চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি মুখে কোনো প্রকার শব্দ না করে ডানে বায়ে আস্তে করে মাথা নাড়লাম। তিনি একবার তুলতুলের দিকে চেয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমার পাশের সিটে এসে বসলেন। তুলতুলের শরীর থেকে জামা কাপড় সরিয়ে দিতে দিতে অধৈর্য্যে সঙ্গে বললেন-

‘মাইয়ার তো দেখি খিঁচুনি উঠছে। শইল ডাইক্কা রাখা যাইবো না। জ্বর তো অনেক বাড়ছে। জলদি জ্বর নামাইতে না পারলে অসুবিধা হইবো।’

আমি এক হাতে চোখের পানি মুছে ওনার দিকে পূর্নাঙ্গ দৃষ্টিতে তাকালাম। তিনি আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন-

‘প্রথম বাচ্চা! তোমার বয়সও বেশি মনে হইতাছে না। বাড়ির কাউরে সাথে আনো নাই ক্যান? একলা একলা এই বাচ্চা নিয়া সব সামলাইতে পারবা? বাচ্চার বাপেরে জানাইছো?’

আমি মাথা দুলিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললাম- ‘ফোন দিয়েছি তবে…’

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। গলার স্বর জড়িয়ে গেল। তিনি হয়তো বুঝলেন আমার অসম্পূর্ণ কথার মানে। তুলতুলকে আমার কোল থেকে নিজের কাছে নিয়ে চিন্তিত গলায় বললেন-

‘অন্য কাউরে কল দিয়া জানাও। আর চিন্তা কইরো না আমার বাড়ি হাসপাতালের সামনেই।’

আমি ওনার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। কি সুন্দর করে তুলতুলকে আগলে রেখেছেন। একদম মনি মা’র মতোই। তিনিও হয়তো আমার মনি মা’র মতোই একজন মমতাময়ী। যে কি-না নির্দ্বিধায় অন্যের সাহায্য করতে ব্যস্ত হয়ে পরেন। আমি জোড়ালো শ্বাস ফেললাম৷ ফোন বের করে ভাইয়াকে কল দিলাম। পর পর দু’বার রিং বাজতেই ফোন রিসিভ হলো। পরমুহূর্তেই ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,

‘আমাকে কল দিয়েছিস কেন তুই? আমার কাছে তোর কি প্রয়োজন?’

ভাইয়ার অভিমানী গলা শুনে আমার ভেতরটা যেন দুমড়েমুচড়ে যেতে শুরু করলো। অন্য সময় হলে ভাইয়ার কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু ঝাঁঝালো কথা শুনিয়ে দিতাম। কিন্তু আজ আমার কান্না পাচ্ছে। নিজেকে একা পেয়ে ভীষণ কান্না পাচ্ছে। অবশ্য ভাইয়ার অভিমান করাটা-ই স্বাভাবিক। বেশি কিছু তো চায়নি। পাত্রী দেখতে যাওয়ার সময় তার সাথেই আমাকে থাকতে হবে এইটুকুই তো আবদার করেছিল। কিন্তু আমি নানানরকম অযুহাত দেখিয়ে ভাইয়ার সাথে যাওয়ার বিষয়টা এড়িয়ে গেছি। বড় ভাইয়ের আবদারটুকু রাখতে না পারা ব্যর্থ বোন আমি। ভাইয়ার ধমকে আমি যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে জড়ানো কন্ঠে বললাম-

‘ভাইয়া! তুই একটু আসবি!’

‘কি হয়েছে অনু? তোর কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? কান্না করছিস!’

ভাইয়া অস্থির হয়ে প্রশ্ন গুলো করলো আমাকে। ভাইয়ার প্রশ্নে যেন আমি এবার আরও ভেঙে পরলাম। কান্না করতে করতে ধরা গলায় বললাম-

‘তুলতুল খুব অসুস্থ ভাইয়া। কেউ নেই আমার সাথে। তুই কি মনি মা’কে নিয়ে একটু আসবি! আমার খুব ভয় করছে।’

‘কি হয়েছে তুলতুলের? ধ্রুব ভাইকে কল করিস নি? আর এখন তুই কোথায়?’

ধ্রুবর ভাই শুনেই অভিমানে ভার হয়ে এলো আমার হৃদয়। ওনার বিষয়টা এড়িয়ে গিয়ে গাঢ় স্বরে বললাম-

‘আমি পপুলার হসপিটালে যাচ্ছি। এখন বাসে আছি।’

ভাইয়া ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন- ‘আচ্ছা তুই সাবধানে যা। আমরা আসছি। চিন্তা করিস না।’

এত গুলো মানুষের মাঝেও নিজেকে বড্ড একা একা লাগছে। ভাইয়া, আম্মু, মনি মা সবাই হন্তদন্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। তুলতুলকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। খুব সম্ভবত তিন দিনের জন্য রাখা হয়েছে। জ্বরের সাথেই খিঁচুনি উঠছে। বমির সময় কিছুটা শ্বাসনালীতে ডুকে গেছে। যে কারণে তুলতুলের অবস্থা আরও খারাপ দিকে চলে গেছে। তবে ঠিক সময়ে জ্বর কমে যাওয়ায় কিছুটা আশংকা মুক্ত হয়েছে এখন। আমি মূর্তির মতো বসে আছি কেবিনের বাহিরে। খানিকটা সময় পর মনি মা এসে আমার পাশে বসলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললেন-

‘ভয় পেয়েছিলি তাই না অনু? চিন্তা করিস না পূর্নতার কিছু হয়নি। তুই সময় মতোই ওকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিস।’

‘আজ যদি ওর কিছু হয়ে যেত মনি মা তখন আমি কি করতাম! আমি ঠিক মতো তুলতুলের খেয়াল রাখতে পারিনি। আমার জন্যই ওর এমন হয়েছে। মা হিসেবে আমি ব্যর্থ মনি মা।’

কথাগুলো বলতে বলতে আমার গলার স্বর ধরে এলো। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পরলো নোনাজল। মনি মা আমাকে নিজের বুকে আগলে নিলেন। পরম মমতায় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-

‘ধুর পাগলি মেয়ে। এসব কেন ভাবছিস? বাচ্চাদের এই বয়সে প্রায়শই খিঁচুনি হয় এটা তেমন কিছু না। আর তুই ঠিক মতো পূর্নতার খেয়াল রাখতে পেরেছিস বলেই তো ঠিক সময় হাসপাতালে নিয়ে এসেছিস। তাই এসব আজেবাজে চিন্তা করিস না।’

মনি মা তার শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার মুখ মুছে দিয়ে বললেন-

‘চল তো এখন। তোর সাথের ওই আপা-টা ওনার বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে এসেছে সবার জন্য।’

আমি অবাক চোখে চাইলাম। অচেনা একজন মানুষ দুপুর থেকেই আমার সাহায্যে উঠে পরে লেগেছেন। এই পর্যন্ত বেশ কয়েকবার এসে তুলতুলের খবর জেনে গেছেন। আর এখন কি-না রান্নাও করে নিয়ে এসেছেন। আশেপাশে এখনও কিছু নিঃস্বার্থ মনের মানুষ আছে মনি মা’র মতো।

রাত প্রায় বারোটা। হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে ছুটে আসলেন আব্বু। কেবিনে ঢুকেই তুলতুলকে কিছুক্ষন দেখলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আমার দিকে চেয়ে নিম্ন স্বরে বললেন-

‘আমি তো কিছুই জানতাম না। বাসায় যাওয়ার পর তোর মনি মা আমাকে এসব কিছু বলল। তোরা কেউ আমাকে একটু জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?’

আব্বু মুখ অন্ধকার করে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। আম্মু মনি মা’কে নিয়ে চলে গেছে ঘন্টা খানেক আগেই। এত চিন্তার মধ্যে আব্বুকে জানানোর কথা মনেই ছিল না। আমি আব্বুর দিকে চেয়ে বললাম-

‘তুলতুলের এমন অবস্থা দেখে চিন্তায় আর কিছুই মনে ছিল না আব্বু। তা ছাড়া আমি তোমার ছেলেকে হাজার বার কল দিয়েছিলাম কিন্তু উনি কল রিসিভ করেননি।’

নিস্তব্ধ থমথমে একটা পরিবেশ। পুরো কেবিন জুড়ে শুধুই নিরবতা। তুলতুল ঘুমাচ্ছে। বসে থেকে শরীর অসার হয়ে যাওয়ায় ভাইয়া কেবিনের বাহিরে হাঁটাহাঁটি করতে গেছে। আব্বু চলে গেছেন ঘন্টাখানেক হবে। ভাইয়া জোর করেই ওনাকে বাসায় পাঠিয়েছে। এত কিছুর মাঝেও ধ্রুবর দেখা মেলেনি। একটি বারের জন্যেও তার কল আসেনি। আব্বু বলেছেন ধ্রুব অফিসে কাজে কোথাও গেছে কিন্তু এখনও ফেরেনি। ফোনও না-কি অফিসেই রেখে গেছেন। তার ভাষ্যমতে ওনার ছেলে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গাধা, বেপরোয়া। এরকম গাধা ছেলে জন্ম দিয়ে তিনি লজ্জিত। আফসোস ছাড়া এখন আর তার কিছুই করার নেই। এই বেপরোয়া ছেলে তার নিজের সন্তান এটা নাকি ভাবতেই তার আফসোস হয়।
শেষ রাত। আচমকা মৃদু শব্দ করেই কেবিনের দরজা খুলে গেল। আমি সোফায় বসে থেকেই নির্লিপ্ত চোখে দরজার দিকে তাকালাম। ভীষণ ক্লান্ত মুখ। এলোমেলো চুল। শরীরে লেপ্টে থাকা ঘামে ভেজা শার্ট। দুর্ধর্ষ শরীর নিয়ে একটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হলো আমাদের। চাপা রাগ আর অভিমানের ভীড়ে হারিয়ে গেল আমার লজ্জা মিশ্রিত সকল অনুভূতি। বোঝার চেষ্টা করলাম না তার চাহনির গভীরতা। পড়তে চাইলাম না তার চোখের ভাষা। তাকে বোঝার, তাকে জানার সকল আগ্রহ আমি হারিয়ে ফেললাম। অনুভূতিহীন আমি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই নিজের চোখ সরিয়ে নিলাম। ঠিক আগের মতোই বসে রইলাম। মানুষটা থমথমে পায়ে এগিয়ে গেল তুলতুলের বেডের কাছে। খানিকক্ষণ সেখানেই চুপচাপ বসে থাকলেন। মিনিট পাঁচেক পর নিঃশব্দে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ আমার দৃষ্টি আগের মতোই ধবধবে সাদা মেঝেতে স্থির রইলো। ওনার দিকে মুখ তুলে তাকানোর ইচ্ছে জাগলো না।

‘তুলতুলের আম্মু আপনি কি রেগে….’

আমি মুখ তুলে তাকাতেই ধ্রুবর কথা থেমে গেল। আহত চোখে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। ফোন নিয়ে কল লিস্ট বের করে ওনার সামনে ধরলাম। অত্যন্ত শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম-

‘কয়বার কল করেছি?’

ধ্রুব আমার ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে ক্লান্ত চোখে চাইলেন। শুকনো ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে মৃদুস্বরে বললেন-

‘আসলে আমি ফোন অফিসে ফেলে রেখেই চলে গিয়েছিলাম। খেয়াল ছিল না।’

আমি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসলাম। হঠাৎ করেই কিছু তিক্ত অনুভূতি এসে বিষিয়ে দিলো আমার সারা শরীর। শরীরে প্রতিটি শিরায় শিরায় বয়ে গেল তিক্ততা। ভয়াবহ জেদ চেপে বসলো আমার সর্বাঙ্গে। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে বয়ে গেল ভয়ংকর রাগ। হাতের ফোনটা সজোরে আছাড় মারলাম মেঝেতে। থরথর করেই কেঁপে উঠলো রাগে জ্বলে ওঠা আমার শরীর। কঠিন চোখে ওনার দিকে চেয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বললাম-

‘খেয়াল ছিল না আপনার? এক বার দু’বার নয় বহুবার কল দিয়েছি আমি৷ তুলতুলের এমন অবস্থা দেখে দিশেহারা হয়ে বার বার আপনাকে খুঁজে পেতে চেয়েছি। কিন্তু আপনার তো খেয়ালই ছিল না।’

ধ্রুব নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি এক পা এগিয়ে গেলাম ওনার দিকে। তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম-

‘খুব তো বড় বড় কথা বলতেন। আপনি সব সময় আমার পাশে থাকবেন। আমার চোখেরজল ফেলার জন্য আপনার বুক সব সময় আমার সামনে থাকবে। এটা করবেন ওটা করবেন। তাহলে আজ কোথায় ছিলেন? যখন আপনাকে আমার খুব প্রয়োজন ছিল তখন কেন আমি আপনাকে পাইনি? পাগলের মতো কল করে গেছি আপনাকে। কি করবো, না করবো কিছুই মাথায় ছিল না। শুধু জানতাম আপনাকে আমার পাশে লাগবে। আপনি সব সামলে নিবেন। কিন্তু আপনি ছিলেন না। একা পরে গিয়েছিলাম আমি। ভীষণ একা। দিশেহারা হয়ে শুধু এদিক ওদিক ছুটেছি। মেয়ের এমন অবস্থা দেখে আমার কি হাল হয়েছিল আপনি ভাবতে পারছেন ধ্রুব? যদি মেয়েটাকে ঠিক মতো হাসপাতালে না আনতে পারতাম তখন কি হতো! কোনো ধারণা আছে আপনার? জানি কোনো ধারণা নেই আপনার। আমি কেমন ছিলাম! আমার কখন আপনাকে প্রয়োজন! কে কখন আপনাকে পাশে চায়! এসব নিয়ে আপনার কোনো ধারণা নেই। আপনিও বেপরোয়া। বেখেয়ালি। নির্বিকার একজন মানুষ। আপনিও আপনার ফ্রেন্ডের মতোই। নিজের বাহিরে অন্য কাউকে নিয়েই আপনাদের চিন্তা থাকে না। আপনারা শুধু নিজের মতোই চলতে পছন্দ করেন। শুধু মুখেই ভালোবাসি বলতে পারেন তবে ভালোবাসার যন্ত নিতে কিংবা আগলে রাখতে জানেন না আপনারা। আপনিও সাদাফের মতোই ধ্রুব। আপনারা সব এক।’

ক্লান্ত হয়েই আমার গলারস্বর মিলিয়ে গেল। চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ছে। বলহীন সারা শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কঠিন মনে হলো।

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৮
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন ধ্রুব? বলুন কি বলবেন!’

ধ্রুব আমার দিকে চেয়ে স্মিত হাসলেন। আমার সকল প্রশ্ন, রাগ, অভিমান কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করেই আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অত্যন্ত নরম গলায় বললেন-

‘শান্ত হও তুলতুলের আম্মু।’

আমি থমকে গেলাম ক্ষনিকের জন্য। মনে জমে থাকা সকল রাগ আপনাআপনি-ই ধীরে ধীরে মাটি হয়ে যেতে লাগল। নিজের অজান্তেই আমি শান্ত হয়ে গেলাম। একদম শান্ত। রাগ, অভিমান, জেদ সব কিছু হঠাৎই কিভাবে মিলিয়ে গেল, কিছুতেই বোধগম্য হলো না। ভীষণ ক্লান্ত হয়েই ধ্রুবর বুকে মাথা এলিয়ে দিলাম। সারাদিনের ক্লান্তি গ্লানিগুলো চোখেরজল হয়ে নিঃশব্দে বিসর্জন হতে লাগলো ওনার ঘামার্ত বুকে। ধ্রুব আগলে নিলেন আমাকে। ওনার স্পর্শে কোনো মিথ্যা স্বান্তনা কিংবা মিথ্যে আশ্বাস নেই৷ আছে শুধু ভরসা, বিশ্বাস আর……। আর কি? ভালোবাসা!! হয়তো তা-ই হবে।

‘আমি জানি তুমি অনেকটা রেগে আছো। তোমার রাগ করাটা-ই স্বাভাবিক। তবে আমি চাই না তুমি রাগের মাথায় এমন কিছু বলে ফেলো যার কারণে রাগ কমলে তুমি নিজেই তার জন্য অনুতপ্ত হও। হ্যাঁ, আমি সাদাফের মতো বেখেয়ালি, বেপরোয়া সেটা আমি মানছি। তবে আমি কখনও তোমাকে নিয়ে বেপরোয়া ছিলাম না। কখনোই আমার কাছের মানুষদের প্রতি বেখেয়ালি হইনি। আমি নিজেকে বদলে নিয়েছি। বদলাতে বাধ্য হয়েছি। তোমাকে ভালোবাসার পর নিজের বেপরোয়া স্বভাবটা নিজের মধ্যে পুষে রাখার দুঃসাহস আমি দেখাতে পারিনি। কারণ আমি ভয় পাই। তোমাকে হারানোর ভয় পাই। সেই ভয় থেকেই নিজেকে আমি গুছিয়ে নিয়েছি। বাউন্ডুলেপনা বাদ দিয়ে একজন দায়িত্বশীল জীবনসঙ্গী আর একজন ভালো বাবা হওয়ার চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত।’

ধ্রুব থামলেন। ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবারও বললেন-

‘তবে আজ কোনো এক কারণেই হয়তো আমি বেপরোয়া হয়ে গেছি। তুলতুলের এই অবস্থায় পাশে থাকতে পারিনি। এটা আমার ভুল। অনেক বড় ভুল। আর এই ভুলের জন্য তোমার রাগ করাই উচিত। মা হয়ে সন্তানের এমন অবস্থা দেখে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। শুধু তুমি একা নও সব মায়ের জন্যই সন্তানের অসুস্থতা তার উপর ভয়ংকরভাবে প্রভাব ফেলে। দিশেহারা হয়ে যায়। তুমিও স্বাভাবিকভাবেই ভয়ে, চিন্তায় সেই সময় আমাকে খুঁজেছো কিন্তু পাশে পাওনি। তবে আমি জানি তুলতুল তোমার কাছে ভালো থাকবে। তোমার কাছে থাকা অবস্থায় কখনোই তুলতুলের কিছু হবে না। যেকোনো মা-ই তার সর্বস্ব দিয়ে সন্তানকে রক্ষা করে আগলে রাখে। তাই আমি না থাকালে তুলতুলের কি হবে সেই ধারনা আমি নিজের মাঝে আনতে চাচ্ছে না। আমি জানি তুমি আমাকে বুঝবে।’

আমি বুঝলাম। ধ্রুবর বলা প্রতিটি কথাতেই নিজেকে নিরব আর হিমালয়ের মতোই শান্ত শীতল হিসেবেই আবিষ্কার করলাম। কান্না থেমে গেল। প্রায় প্রচন্ড ক্লান্ত হয়েই থেমে গেলাম আমি। সকল ভয়, চিন্তা নিমিষেই কেটে গেল ধ্রুবর কথায়। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ধ্রুব আমাকে ছেড়ে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। দু হাতে আমার মুখ মুছে চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে শান্ত গলায় বললেন-

‘এখন চলো একটু ঘুমাবে। না ঘুমিয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পরবে।’

আমি মুখ দিয়ে টু শব্দও বের করলাম না। ধ্রুব নিজেই আমাকে ধরে নিয়ে সোফায় বসালেন। আমার মাথা ওনার কাধে রেখে খুব যত্নের সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমি চুপ থাকলাম পুরোটা সময়। কিছু বলার মতো শক্তি কিংবা কথা কিছুই নিজের মাঝে খুঁজে পেলাম না। মিনিট খানেকের মাঝেই রাজ্যের ঘুম এসে আমার চোখে ধরা দিলো। শেষ রাতে এসে একজন ভরসার মানুষ আর ভরসায় জায়গা হিসেবে তার বুকে নিজের আশ্রয় পেয়ে নির্ভয়েই ঘুমে তলিয়ে গেলাম। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলাম আমি।

‘নাহ.. আমি ডক্টরের সাথে কথা বলেছি। তুলতুলকে আপাতত চার দিন জন্য তাদের অবসেরভেশনে-ই রাখবে।’

আমি পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালাম। চোখ মেলেই সামনে তুলতুলের পাশে ভাইয়াকে বসে থাকতে দেখলাম। বুঝলাম ভাইয়াই এতক্ষণ ফিসফিস করে কথা বলেছে। আমাকে সজাগ হতে দেখেই ভাইয়া বলল-

‘কিরে, এতক্ষণে তোর ঘুম ভেঙেছে!’

কপাল কুচকে আমার চাহনি তীক্ষ্ণ হলো। ঘুম থেকে ওঠার পর মানুষের মস্তিষ্ক সচল হতে কিছুক্ষণ সময় লাগে। আমারও সময় লাগলো। চোখ থেকে পুরোপুরি ঘুমের ঘোর কেটে যেতেই নিজের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলাম। পুরুষালী গাঁয়ের তীব্র গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। ঘাড় বাঁকিয়ে আমার বাহুতে পুরুষালী শক্তপোক্ত হাত দেখতে পেলাম। এটা ধ্রুবর হাত। আমার বলহীন শরীর পুরোটাই লেপ্টে আছে তার সাথে। আচমকাই কানের কাছে তীব্র এক ভূমিকম্প অনুভূত হলো। খুব নিষ্ঠুর ভাবে কিছু একটা লাফাচ্ছে। তৎক্ষনাৎ আমার হুশ ফিরলো। ভীষণ লজ্জা আর অস্বস্তি নিয়েই ছিটকে দূরে সরে আসলাম সেই নিষ্ঠুর বুক থেকে। অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। লজ্জায় ভাইয়ার দিকে তাকানোর মতো সাহস নিজের মাঝে খুঁজে পেলাম না। ধ্রুব গলা খেকরিয়ে হাত পা ঝেড়ে সোজা হয়ে বসলেন। আমি আড় চোখে চাইলাম ওনার দিকে। বরাবরের মতোই শান্ত তার মুখ। ঠোঁটের কোণে স্বভাবগত সরল হাসি। দারুণ আগ্রহ নিয়ে তিনিও আমার দিকে তাকালেন। চোখাচোখি হলো। আবারও আগের মতোই অনুভূতিরা এসে ঝাপটে ধরলো আমাকে। লজ্জায় দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই ভাইয়ার মুখোমুখি হলাম। সরু চোখে আমার দিকে চেয়ে সহজ গলায় বলল-

‘এত লজ্জা পাচ্ছিস ক্যান তুই? নিজের জামাইয়ের বুকেই ঘুমিয়েছিস অন্য কেউ তো আর না।’

ভাইয়ার কথা শুনে আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম। ছোট থেকেই ভাইয়া আমার সাথে খুব ফ্রী। সারাক্ষণ মা’রামা’রি ঝগড়াঝাটি এসব আমাদের মধ্যে লেগেই থাকে। কিন্তু তাই বলে ধ্রুবর সামনে এমন কথা বলবে? ছিঃ লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। আমি না-হয় ঘুমিয়ে ছিলাম কিন্তু ধ্রুব! উনিই বা কেমন মানুষ! ভাইয়ার সামনেও কি আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা লাগে! ছেলে মানুষ বলতেই নির্লজ্জ। লজ্জার ছিটেফোঁটা তাদের মাঝে নেই। না আছে আমার ভাইয়ের মাঝে। আর না আছে ধ্রুবর মাঝে।

‘থাক থাক ভাই তোর আর লজ্জা পাইতে হইবো না। তুই এখন ধ্রুব ভাইয়ের সাথে বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আয়। কাল থেকে খাওয়াদাওয়া না করে এখানে পরে আছিস।’

ভাইয়ার কথা শুনে আমি অস্থির হয়ে বললাম- ‘নাহ নাহ আমি তুলতুলকে এখানে একা রেখে যাবো না।’

‘এত বেশি কথা বলিস ক্যান তুই? তুলতুল একা কোথায় আমি তো আছিই এখানে আর মা-ও আসতাছে। আমাকে ফোন করছে বলছে এখন রাস্তায় আছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে।’

ভাইয়ার ভারী গলার স্বর শুনে আমি খানিকক্ষণ চুপ থেকে নিম্ন স্বরে বললাম- ‘কিন্তু ভাইয়া…’

আমার কথায় মাঝেই ধ্রুব উঠে দাঁড়ালেন। শার্টের কলার ঠিক করতে করতে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন- ‘শাকিল ঠিকই বলেছে। এখানে সারাক্ষণ এভাবে না খেয়েদেয়ে বসে থাকলে তুমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পরবে। তখন তুলতুলের খেয়াল কে রাখবে? তাই কথা না বাড়িয়ে এখন আমার সাথে বাসায় চল।’

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। ধ্রুবর দিকে মলিন মুখে চেয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। আর কোনো বাক্যব্যয় না করে থমথমে পায়ে তুলতুলের কাছে আসলাম। ভাইয়া তুলতুলের পাশ থেকে উঠে অন্য পাশে যেয়ে দাঁড়ালো। আমি শান্ত চোখে তুলতুলের দিকে চাইলাম। মেয়েটার দিকে তাকাতেই বুকে মোচড় দিয়ে চিনচিনে ব্যথা শুরু হলো। একদিনেই কি হাল হয়েছে মেয়েটার। ঠোঁট মুখ শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে মুখ। ঠোঁটের কোণের হাসিটা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। সব সময় খিলখিল করে হাসিতে মেতে থাকা মেয়েটা হঠাৎ করেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। এই নিস্তব্ধতা, নিশ্চুপ থাকা মেনে নেওয়ার মতো না। কিছুতেই না। এই নিরবতা যন্ত্রণার। তীব্র যন্ত্রণা আর হাহাকারের৷ আমি আলতো করেই তুলতুলের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম। ধ্রুব এসেও তুলতুলকে চুমু দিয়ে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পরলেন। সারা রাস্তা আমি আর কোনো কথা বলিনি। ধ্রুবও কিছু বললেন নি। নিরবতায় কেটেছে সারা পথ।

‘আপনি রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি অন্য রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

ধ্রুব এই কথা টুকু বলেই অন্য রুমে চলে গেলেন। আমি স্থির চেয়ে রইলাম তার যাওয়ার পথে। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম মনি মা অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে মনি মা’র এই চাহনির মানে খুঁজতে লাগলাম। পরক্ষণেই বুঝলাম ধ্রুবর আপনি সম্মোধন করা নিয়েই তিনি অবাক হয়েছেন। ধ্রুব হয়তো কোনো কিছু খেয়াল না করেই আমাকে আপনি সম্মোধন করেছেন। আমি ইতস্তত করে বললাম-

‘আমি রুমে যাচ্ছি মনি মা।’

মনি মা যন্ত্রের মতোই মাথা নাড়লেন। আমি আর কোনো কথা না বলেই দ্রুত রুমে চলে আসলাম। ওনার কৌতূহল মেটানোর কোনো উপায় আমার জানা নেই। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেকে মনি মা’র কৌতুহলী চোখের আড়াল করতে চাইলাম।

ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হতেই ধ্রুবর মুখোমুখি হলাম। দরজার কাছেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। বিস্ময়ের চাহনি স্থির করলাম ধ্রুবর নির্লিপ্ত মুখে। আধ ভেজা চুল গুলো লেপ্টে আছে তার কুঞ্চিত কপালে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ধূসর রঙের শার্টের কিছু কিছু জায়গা ভিজে আছে। আমি দৃষ্টি নামিয়ে নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক করে নিলাম। তপ্ত শ্বাস ওনাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আমার হাতে টান পরলো। আমি চমকে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধ্রুব আমার হাত টান দিয়ে ঝড়ের বেগে রুমে এনে দরজা লাগিয়ে দিলেন। আমাকে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন-

‘এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন আমাকে?’

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ধ্রুবর এহেন কাজে। ধ্রুবর চোখে মুখে বিরক্তি রেশ। আমি শুকনো ঢোক গিলে মাথা নিচু করে চলে যেতে নিলেই ধ্রুব আমার হাত চেপে ধরলেন। অন্য হাতে আমার মাথা তুলে খানিকটা ঝুঁকে এলেন আমার মুখের দিকে। খানিকক্ষণ স্থির চেয়ে থেকে চাপা কন্ঠে বললেন-

‘এখনও রেগে আছেন আমার উপর? আমি তো সব কিছুই খুলে বলেছি।’

আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। অস্বস্তিতে দম আটকে আসার উপক্রম হলো আমার। ধ্রুব নড়ছেন না। আগের মতোই এক দৃষ্টিতে ভ্রু কুচকে আমার দিকে চেয়ে থাকলেন। আবারও বললেন-

‘আচ্ছা রাগ থাকলে সেটা প্রকাশ করুন। বকা দিন, ধমক দিন। দরকার পরলে আমার গালে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিন। তবুও এভাবে চুপচাপ থেকে আমাকে এড়িয়ে যাবেন না। দিন দিন এই গালেই একটা চড় দিয়ে নিজের রাগ মিটিয়ে নিন।’

ধ্রুব সত্যি সত্যিই তার ডান গাল আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমার বিস্ফোরিত চোখজোড়া বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। লোকটা কি পাগল না-কি! এসব কি ধরনের অদ্ভুত কথাবার্তা! নির্ঘাত মাথায় সমস্যা টমস্যা আছে। তা নাহলে কেউ কি নিজের বউকে এই কথা বলে? বউয়ের হাতে চড় খাওয়ার এতটাই শখ ওনার? আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে ডান হাতে ওনার গাল সরিয়ে দিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘আমি এখনও আপনার উপর রেগে নেই। আসলে কালকের কথা গুলোর জন্য আমি সরি। তুলতুলের ওমন অবস্থা দেখে মাথা ঠিক ছিল না। তাই রাগের বশে আপনাকে যা-তা বলে ফেলেছি। আর এই কারণেই কিছুটা লজ্জিত বোধ করছি বলে কথা বলতে পারছিলাম না। সরি আমার কালকে ওভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি।’

আমার কথা শেষ হতেই ধ্রুব অবাক চোখে আমার দিকে চাইলেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই ঠোঁট প্রসারিত করে মনকাড়া একটা স্নিগ্ধ হাসি দিলেন। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনেই মধুর কন্ঠে বললেন-

‘তাহলে একটা চুমু দাও।’

আমি চোখ বড় বড় করেই চাইলাম। ওনাকে ধাক্কা দিয়ে সরে যেতে চাইলেও পারলাম না। তিনি ঠিক আগের মতোই আমাকে ধরে রাখলেন। বাঁকা হেসে বললেন-

‘থাক তোমার কষ্ট করতে হবে না। আমি নিজেই নিয়ে নিচ্ছি।’

ধ্রুব ঝুঁকে তার মুখ এগিয়ে নিয়ে আসতে লাগলেন আমাত দিকে। আমি মূর্তির মতো জমে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুক ধড়ফড় করছে আমার। এখনই বুঝি বুক চিড়ে বেরিয়ে আসবে হৃদপিণ্ড। আচমকাই ধ্রুবর ফোন বেজে উঠল। ভীষণ বিরক্ত হয়েই তিনি সরে গেলেন। পকেট থেকে ফোন বের করে হতাশ চোখে তাকিয়ে থেকে রিসিভ করলেন। কি কথা হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। তিনি শুধু বললেন ‘আচ্ছা আমি আসছি।’ ধ্রুব ফোন কানে রেখেই আমার দিকে চাইলেন। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন-

‘আমার একটু জরুরি কাজে যেতে হবে। তুমি আম্মু আব্বুর সাথে তুলতুলের কাছে চলে যেও।’

আমার কথার কোনো অপেক্ষা না করেই ধ্রুব দরজা খুলে হনহনিয়ে চলে গেলেন। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। ড্রয়িং রুমে আসতেই আব্বুর প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম।

‘কিরে মা ধ্রুব কই?’

আমি গাঢ় কন্ঠে বললাম- ‘অফিস থেকে হয়তো কোনো জরুরি কল এসেছে তাই কিছুক্ষণ আগেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন।’

আব্বু অবাক হয়ে বললেন- ‘আজ আবার কিসের অফিস? শুক্রবার আমাদের অফিস বন্ধ থাকে ভুলে গেলি! এই গাধা ছেলে জীবনেও মানুষ হবে না। আমি কোনো কাজ দেইনি তাহলে আবার কিসের জরুরি কাজ? আবারও হয়তো শুরু করেছে নিজের গাধামির পরিচয় দেওয়া।’

আব্বু রাগে চিড়বিড় করে একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছেন। আমি নিঃশব্দে শুনছি আব্বুর কথা। ধ্রুব কোথায় গেলেন? অফিস ছাড়া তো তার আর কোনো কাজ নেই তাহলে কিসের এত তাড়াহুড়ো? কি এমন কাজ যে তুলতুলের কাছে না যেয়ে ওখানে চলে গেলেন!

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৯
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘তুলতুল কেমন আছে ভাইয়া?’

কেবিনে ডুকেই গমগমে গলায় ভাইয়াকে প্রশ্ন করলাম। আচমকা আমার প্রশ্ন শুনে ভাইয়া কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে-ই পেছন ঘুরে তাকায়। আমার পেছন পেছনই মনি মা আর আব্বু কেবিনের দরজা ঢেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। আমি তাদের দিকে এক নজর তাকিয়ে আবারও ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। ভাইয়া তুলতুলকে আড়াল করে বসে থাকায় তুলতুলকে দেখা যাচ্ছে না। গম্ভীর মুখে আমার দিকে খানিকক্ষন চেয়ে থেকে গাঢ় স্বরে বলল-

‘তুই নিজেই দেখে নে।’

ভাইয়া তুলতুলের সামনে থেকে সরে এসে দাঁড়ালো। আমি সংকোচিত মনে তুলতুলের দিকে চাইলাম। সঙ্গে সঙ্গেই জল তরঙ্গের মতো হাসির দেখা মেললো। তুলতুল হাসছে। প্রাণোচ্ছল তরল হাসি। মনে হচ্ছে লুকোচুরি খেলায় ধরা পরে ভীষণ খুশি হয়েছে। ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল-

‘আমাদের তুলতুল পাখি একদম ঠিক আছে। ঘুম থেকে উঠেই আমার সাথে খেলছে, হাসছে, দুষ্টুমি করছে। ডক্টর এসে ওকে দেখে অনেক খুশি হয়েছে। এই বয়সেও অসুস্থতায় এতটা হাসি খুশি দেখে উনি মুগ্ধ হয়েছেন। বলেছে মানসিক ভাবে সুস্থ থাকলে শারীরিক অসুস্থ খুব জলদি বিদায় নিবে। বেশিদিন হসপিটালে রাখতে হবে না।’

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ম্লানমুখে তুলতুলের দিকে এগিয়ে গেলাম। তুলতুল আমার দিকে ডাগরডাগর চোখে তাকিয়ে আছে। অসুস্থতার জন্য মুখ শুকিয়ে যাওয়ায় যেন চোখদুটো আরও বড় বড় মনে হচ্ছে। আমাকে হাসতে না দেখেই যেন তার চোখে কৌতূহল চিকচিক করছে। আমি তুলতুলের পাশে এসে বসতেই তুলতুল আধো আধো গলায় বলল-

‘মামু আস..’

ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে কয়েকবার একই কথা বলল তুলতুল। ভাইয়া এগিয়ে আসলো। আমি উঠে যেতেই ভাইয়া আবারও আগের জায়গায় বসলো। তুলতুল কিছুক্ষন ভাইয়ার আড়ালে চুপ করে লুকিয়ে থাকলো। আমি, মনি মা আর আব্বু ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি সে দিকে। খানিকক্ষণ পর তুলতুল ভাইয়ার হাতের ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে ভয় দেখানোর ভঙ্গিতে ‘ভাও’ বলে চিৎকার দিলো। আমি অবাক চোখে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তুলতুল তার মামুর সাথেই তাল মিলিয়ে হেসে যাচ্ছে। মনি মা আর আব্বুও হেসে ফেলল। ভাইয়া আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল-

‘আমাকে দোষ দিবি না। আমি তো শুধু একবার এমন করেছিলাম। কিন্তু তারপর থেকেই তোর মেয়ে নার্স, ডাক্তার যে আসছে তাকেই এমন করে ভয় দেখাচ্ছে। তোর মতোই স্বভাব পেয়েছে। তুইও ছোট বেলা একটা কিছু শুনলে সেটা একনাগাড়ে বলা শুরু করতি।’

আমি হেসে ফেললাম। তুলতুলের হাসিতেই চারপাশে আপনা আপনি খুশিতে মেতে ওঠে। এই মেয়েটা চুপ থেকলেই যেন সব কিছুতে বিষাদ আর অবসন্নতার ছোঁয়া লেগে থেকে।

———————

‘অনু তোকে কিছু জিজ্ঞেস করবো। আশাকরি তুই আমাকে সত্যিটা-ই বলবি।’

আমি শুকনো ঢোক গিলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। মনি মা আমার দিকে ঘুরে বসলেন। ভারী কন্ঠে একের পর এক প্রশ্নের তীর ছুড়তে লাগলেন আমার দিকে,

‘তোর আর ধ্রুবর মাঝে কি এখনও কিছুই ঠিক হয়নি? বিয়ের এতগুলো মাস পেরিয়ে গেছে অথচ ধ্রুব এখনও তোকে আপনি সম্মোধন করে এটা কেমন কথা! তোদের মাঝে কি এতটাই দূরত্ব যে একে অপরকে অপরিচিত মানুষদের মতো আপনি আপনি করে কথা বলতে হবে?’

যা নিয়ে ভয় পাচ্ছিলাম ঠিক তা-ই হলো। মনি মা এত সহজে এই কথা মাথা থেকে ঝেরে ফেলার মানুষ না। ওনার প্রশ্নের মুখোমুখি আমাকে হতে হবে সেটা আমি জানতাম। কিন্তু এই প্রশ্ন গুলোর প্রতিত্তোরে আমি কি জবাব দিবো? ধ্রুব আর আমার মাঝে যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কিন্তু উনি আমাকে প্রায়শই ‘আপনি’ সম্মোধন করে কথা বলেন। ওনার এসব কথা শুনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই আমিও এ বিষয় নিয়ে তেমন মাথা ঘামাইনি। কিন্তু মনি মা’কে কি করে বুঝাবো?

‘বিয়ে করলেই বউকে তুমি তুমি করে ডাকতে হবে এমন তো কোনো নিয়ম নেই মা। তুলতুলের আম্মুকে আপনি করে সম্মোধন করতেই আমার ভালো লাগে। তাই আমি প্রায়শই তুলতুলের আম্মুকে আপনি আপনি করে কথা বলি।’

ধ্রুবর কন্ঠস্বর শুনে আমি চমকে গিয়ে দরজার দিকে চাইলাম। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। মুখে কোনো সংকোচবোধ কিংবা অস্বস্তির চিহ্ন কিছুই নেই। সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন জরুরি কাজের কথা বলে। সারাদিন পেরিয়ে রাত নয়টা বাজে এসে তার দেখা মিলল। কি এমন জরুরি কাজ যে সারাদিনে একবারও তুলতুলের খোঁজ নেননি। অফিস নেই তাহলে আর কিসের এত কাজ! কিসের এত ব্যস্ততা? এসব প্রশ্ন করতে চাইলেও আমি করতে পারবো না। কোথাও যেন একটা অদৃশ্য বাধা কাজ করে। হয়তো রেস্টুরেন্টে বলা ধ্রুবর সেই কথা গুলোই আমার মনে গেঁথে গেছে।

মনি মা তিক্ত গলায় বললেন- ‘নিজের বউকে কেউ আপনি বলে সম্মোধন করে কখনও দেখেছিস?’

ধ্রুব ক্লান্ত ভঙ্গিতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন৷ আমি সোফা থেকে দাঁড়াতেই তিনি মনি মা’র পাশে বসে পরলেন৷ শার্টের উপরের একটা বোতাম খুলে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বললেন-

‘কে কি করলো না করলো তা দেখার বিষয় আমার না। আমার যেভাবে ভালো লাগে আমি সেভাবেই নিজের বউয়ের সাথে কথা বলবো৷ তা ছাড়া আমি তো বেশিরভাগ সময়ই তুমি সম্মোধন করে কথা বলি৷ তুমি দেখো না!’

মনি মা প্রচন্ডরকম বিরক্ত হলেন। ধ্রুবর পাশ থেকে উঠে খানিকটা দূরে গিয়ে রাগান্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন। চোখমুখ শক্ত করে রাগী গলায় বললেন-

‘তোদের যা ভালো মনে হয় তোরা তা-ই কর। আমি আর কিছুই বলবো না। তবে হ্যাঁ সময় থেকতে যেভাবে সময়ের মূল্য দিতে শেখা লাগে। সেভাবেই মানুষ থাকা অবস্থায় তার মূল্য দিতে হয়। পরে হারিয়ে ফেললে আফসোস ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। আর ধ্রুব তুই! জরুরি কাজের কথা বলে বাহিরে ঘুরাঘুরি না করে সম্পর্কের যত্ন নে। যত্ন ছাড়া কোনো কিছুই বেশিদিন টিকে না। মাথায় রাখিস।’

মনি মা’র কথা শুনে বুক ধক করে উঠলো। হারিয়ে ফেললে মানে কি? ধ্রুবকে হারিয়ে ফেলার কথা তো আমি কখনোই ভাবিনি। ওনাকে হারিয়ে ফেললে কি শুধুই আফসোস হবে না-কি এর চেয়েও ভয়ংকর কিছু! আমার সব কিছুতেই ওনার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। আর উনি হারিয়ে গেলে হয়তো আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলবো।

‘আমি নিজেও হারিয়ে যাব না। আর অন্যকাউকেও হারিয়ে যেতে দিবো না। তোমার ছেলে এতটাও কাপুরষ না৷ আর বাকি রইলো সারাদিন এখানে না আসার কথা। তার কারণ হলো আমি কিছু পারসোনাল কাজে বিজি ছিলাম তাই সারাদিন আসতে পারিনি সরি।’

মনি মা আর কোনো কথা বাড়ালেন না। ধ্রুব আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে তুলতুলের কাছে চলে যায়। বেশ খানিকক্ষণ তুলতুলের সাথে সময় কাটানোর পর মনি মা কাঠকাঠ গলায় বললেন-

‘অনেক রাত হয়ে গেছে তোরা এখন বাসায় যা। আজ রাতে আমি আর আপা থাকবো এখানে।’

মনি মা’র কথায় আমি কিছু বলবো তার আগেই আম্মু রুমে এসে বললেন-

‘হ্যাঁ তোরা এখন বাসায় যা। তুলতুলকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, আমরা আছি।’

আমি দমে গেলাম। তুলতুল আর ধ্রুবর হাসাহাসি করছে। ঘাড় বাঁকিয়ে তুলতুলের দিকে একনজর চেয়ে মনি মা’র গম্ভীরমুখের দিকে দৃষ্টি স্থির করলাম। ধ্রুবর উপর রেগে আছেন তিনি তা ওনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। হয়তো আমার উপরেও রেগে আছে। তাই আমাদের দুজনকেই বাসায় পাঠিয়ে দিতে চাচ্ছেন। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম।

কৃষ্ণবর্ণের মেঘে ঢেকে আছে রাতের আকাশ। ক্ষনে ক্ষনে দূর আকাশে নিষ্ঠুর গর্জন দিয়ে আলোকিত করছে চারপাশ। পরক্ষণেই আবার ঘন অন্ধকারে ঘিরে নিচ্ছে শহরকে। ঝিরিঝিরি শীতল হাওয়ার বেগ বেড়েছে প্রবলভাবে। প্রকৃতি জানান দিচ্ছে খানিকক্ষণ বাদেই ঝমঝমিয়ে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পরবে বৃষ্টির কণা। গাছপালা এলোমেলো করে শুরু হবে বৃষ্টি কন্যার মনমাতানো নৃত্য। মিনিট খানেক পেরুতেই ধ্রুব নিঃশব্দে এসে আমার পাশে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ালেন। আমি আড় চোখে পরক্ষ করলাম তাকে। সব সময়ের মতোই অতি স্বাভাবিক, শান্তস্বভাব তার। অদূর আকাশে তাকিয়ে আছেন মুগ্ধ নয়নে। চোখদুটোতে তার অসীম মুগ্ধতা। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতেই চিকচিক করে জ্বলে ওঠছে ওনার চোখ দুটো। ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ তরল হাসি। আমার দৃষ্টি থমকে গেল। থমকে গেলাম আমি নিজেও। অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতি এসে হানা দিলো আমার মনের কোণে। অনুভূতিরা মিছিল করছে। তীব্র চিৎকার করে বলছে এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য আমার চোখের সামনে। সব চেয়ে সুন্দর এবং শুদ্ধতম পুরুষ আমার দৃষ্টিতে নিবদ্ধ। ধ্রুব তাকালেন। ফ্যালফ্যাল করে আমাকে দেখছেন। আমি এখনও তাকিয়ে আছি। ধ্রুবর ভ্রু নাচানোতেই আমার হুশ ফিরলো। দারুণ অস্বস্তি নিয়ে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলাম। পর পর কয়েকবার ঢোক দিয়ে গলা পরিষ্কার করে মিহি কন্ঠে বললাম-

‘আপনি এখনও আমাকে আপনি সম্মোধন করে কথা বলেন কেন?’

ধ্রুব মৃদু হাসলেন। সহজ গলায় বললেন- ‘আজ থেকে আরও পনেরো বছর আগে আপনাকে তুই করেই বলতাম। কিন্তু সেদিন রেস্টুরেন্টে আপনাকে তুই বলায় আপনার প্রতিবাদ দেখে মনে হলো নাহ, আর যা-ই হোক এই গম্ভীর চরিত্রের মেয়েকে তুই বলা ঠিক হবে না। এই মেয়ে এখন আর ছোট্ট নেই। গম্ভীর, চাপা স্বভাবের রসকষহীন একটা মেয়ে। সম্মান দিয়ে কথা না বললেই হয়তো আমার গলা চেপে ধরবে। তাই আরকি আপনাকে একটু সম্মান দিয়ে কথা বলি।’

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম ধ্রুবর দিকে। ভ্রু জোড়া কুচকে কপালে সুক্ষ্ম বলিরেখা পরেছে আমার। ধ্রুবর চোখে মুখে দুষ্টু হাসি। আমার চাহনি আরও তীক্ষ্ণ হলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম-

‘আমি রসকষহীন মেয়ে! সম্মান দিয়ে দিয়ে কথা না বললে আমি গলা চেপে ধরবো? আপনি তাহলে আমাকে নিয়ে এসব ভাবেন? আর এই হলো আপনার সম্মান দেওয়ার নমুনা!’

আমার কথা শেষ হতেই ধ্রুব শব্দ করে হেসে ফেললেন। ডান পাশের বাঁকা দাঁতটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমি ভ্রু কুচকে একদৃষ্টিতে ওনার হাসির দিকে তাকিয়ে আছি। আচমকাই উনি হাসি থামিয়ে ফেললেন। ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। হঠাৎ করেই ওনার হাসি থেমে যাওয়ায় আমি হকচকিয়ে গেলাম। অথচ তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই গাঢ় স্বরে বললেন-

‘আপনাকে তিনটা সত্য কথা বলার আছে।’

‘কিসের সত্যি কথা?’

‘এক, আমি সত্যিই আপনাকে মন থেকে সম্মান করি। দুই, আমার ভালো লাগে তাই আমি আপনি সম্মোধন করে কথা বলি৷ তা ছাড়া অন্যসব কাপলদের মতো আমাদের মাঝেও যদি একই জিনিস হয় তাহলে সেটা বোরিং বোরিং লাগবে। তাই আমরা না-হয় অন্য সবার থেকে একটু আলাদা হলাম। তিন, আমি আপনাকে ভালোবাসি। আর আপনিও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। খুব অসাবধানতার সাথেই নিজেকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন।’

আমি অপ্রস্তুত হয়ে দু এক পা পিছিয়ে গেলাম। আমতা-আমতা করে বললাম-

‘এসব আপনি কি বলছেন?’

‘সত্যি কথাই বলছি। কেন আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার?’

ধ্রুব ভ্রু নাচিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন। আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। ইতস্তত করতে লাগলাম। আমি ধ্রুবকে ভালোবেসে ফেলেছি? সত্যি-ই কি তাই! ভালোবাসা কি বার বার হয়? এত তাড়াতাড়ি একজনের জায়গায় অন্যজনকে বসানো যায়? এটা কি সম্ভব! এসবের উত্তর আমার জানা নেই। ধ্রুব আমার হাতে হেঁচকা টান দিয়ে তার কাছে নিয়ে গেলেন। আমি কেঁপে উঠলাম ওনার স্পর্শে। চোখ বড় বড় ওনার দিকে চাইলাম। শহর তলিয়ে ঝমঝমে বৃষ্টি শুরু হলো। হিম শীতল বৃষ্টি কণার স্পর্শে আলাদা এক শিহরণ বয়ে গেল সর্বাঙ্গে। ঠিক এই শীতল আবহাওয়ার মতোই ধ্রুবর চাহনি। নিজেকে হারিয়ে ফেলার মতো এক অচেনা বৃষ্টিস্নাত শহর আছে ওই চোখে।

‘তোমার চোখদুটো-ই বলে দেয় তুমি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছো। আমার দিকে তাকানোর ধরন আর তোমার চাহনি সবটাই বলে দেয় তুমি আমাতে আবদ্ধ হয়েছো। আমার স্পর্শে আগের মতো অস্বস্তি বোধ না করে লজ্জায় কেঁপে ওঠার সেই অনুভূতি বলে দেয় তুমি আমাকে অনুভব করো। এত কিছুর পরিবর্তন হলো অথচ তুমি তা লক্ষ্য করলে না। তবে আমি সবটাই লক্ষ্য করেছি। আর আমি এটাও জানি তুমি এই অনুভূতির মুখোমুখি হতে চাচ্ছো না। হয়তো ভয়ে নিজেকে আড়াল করে নিচ্ছো। আমি তোমাকে জোর করতে পারবো না। শুধু বলবো আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে যাবো না। আর তোমাকেও যেতে দিবো না। যতদিন না তুমি নিজের মুখে তোমার ভালোবাসার কথা বলবে ততদিন আমি শুধু অনুভব করবো তোমার না বলা অনুভূতি আর অপ্রকাশিত ভালোবাসা। অনেক কথা বলে ফেললাম টায়ার্ড হয়ে গেছি। এবার একটা চুমু দাও তো সানসাইন।’

ধ্রুবর শেষের কথাটা শুনেই আমি বিষম খেলাম। ধ্রুব ঝংকার তুলে হাসতে লাগলেন। বৃষ্টির শব্দের মতোই তার হাসির শব্দ ছড়িয়ে পরলো সর্বত্র। আমি একমনে তাকিয়ে রইলাম ধ্রুবর দিকে। আমি সত্যিই ভয় পাচ্ছি। আবারও ভালোবাসে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার ভয়। ধ্রুবকে হারিয়ে ফেলার ভয়। ভালোবাসার সম্পর্ক এক পর্যায়ে তিক্ততার সম্পর্কে পরিনত হয়ে যাওয়ার ভয়। হ্যাঁ আমি ভয় পাচ্ছি আমার অনুভূতির মুখোমুখি হতে। ধ্রুব সবটাই বুঝতে পারেন। আমি না বললেও তিনি বুঝতে পারেন।
ফোনের তবে তীক্ষ্ণ শব্দে আমি ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলাম। ধ্রুব ফোন হাতে নিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। আমি কৌতূহলী চোখে চেয়ে রইলাম ধ্রুবর দিকে৷ ধ্রুব ম্লান হেসে বললেন-

‘বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। আপনি রুমে যান নাহলে পুরোপুরি ভিজে যাবেন।’

আমি বুঝলাম ধ্রুব স্পেস চাচ্ছে ফোনে কথা বলার জন্য। আমি নিঃশব্দে রুমে চলে আসলাম। কিছুটা দূর আসতেই ধ্রুবর চাপা কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম।

‘এত রাতে কল করেছো কেন?’

আমি থমকে গেলাম ধ্রুবর কথা বলার ধরন আর আন্তরিকতা শুনে। চিন্তিত শোনাচ্ছে তার গলার স্বর। কে ফোন করেছে? সকালেও এক ফোন কলেই সব কিছু ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। আর এখন এত রাতে!

চলবে…

[রিচেক করা হয়নি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

শেষ রাত পর্ব-২৪+২৫+২৬

0

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৪
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘আমার কথা ভেবে লজ্জা পাচ্ছিলেন বুঝি তুলতুলের আম্মু!’

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে ধ্রুবর গাঢ় কন্ঠস্বর শুনেই আমি চমকে গেলাম। অপ্রস্তুত হয়ে বললাম- ‘আপনি?’

‘নাম্বার না দেখেই কি কল রিসিভ করেন সবসময়?’

ধ্রুবর কাঠকাঠ গলায় পালটা প্রশ্নে আমি খানিকক্ষণ নিশ্চুপ রইলাম। ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘আসলে খেয়াল করিনি। হঠাৎ করে কল দিলেন কোনো দরকার ছিল?

ধ্রুব ভারী হয়ে আসা কন্ঠে বললেন-

‘অদ্ভুত তো! আপনি সব কিছুতেই দরকার খুঁজে বেড়ান কেন? কারণ ছাড়া কি আপনাকে কল দেওয়া যাবে না! যাইহোক আপাতত আপনার সাথে প্রেম করাই আমার অতি দরকারী বিষয়। আপনার সাথে প্রেম করার চেয়ে দরকারী কিছু আমার কাছে আর নেই। বুঝেছেন আমার কথা!’

ধ্রুব শেষে কথাটা হাল্কা ধমকের স্বরেই জিজ্ঞেস করলেন। আমি ঘোরলাগা কন্ঠে ছোট করে ‘হুমম’ বললাম। ধ্রুব আবারও গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-

‘বলেছিলাম তো আপনাকে ফোনটা দিয়েছি আমার প্রয়োজনে। রাতবিরেতে আমার যখন ইচ্ছে হবে আমি তখনই কল দিবো। আর ফোন বন্ধ পেলে বা রিসিভ না হলে ডিরেক্টর আপনাদের বাসায় চলে আসবো মনে থাকে যেন। আর হ্যাঁ আমার কথা শুনে আমাকে বখাটে মনে হলে হবে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। নিজের বউয়ের কাছে শুধু বখাটে কেন নির্লজ্জ, অসভ্য, বেহায়া সব কিছুই হওয়া যায়। যাইহোক এখন রাখছি। গাড়ি ড্রাইভ করছি। বাসায় পৌঁছে কল দিবো।’

ধ্রুব আমাকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়েই কল কেটে দিলেন। আর আমি হতভম্ব হয়ে ফোন কানের কাছে ধরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। মুহুর্তেই হতচকিত ভাব কাটয়ে লজ্জায় লাল রাঙা হলাম। মানুষটার কন্ঠ শুনলেই এখন কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। তার কথা ভাবতেই ভীষণ লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে। কি ভয়ংকর পরিস্থিতি। ভয়াবহ অনুভূতি।

‘অনু তোর কি হয়েছে বল তো!’

সানির আক্রোশ ভরা কন্ঠস্বরে আমার ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে এলো। চোখ ছোট ছোট করে সানির মুখের দিকে তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলাম-

‘আমার আবার কি হবে?’

আমার প্রশ্নে সানির মুখে বিরক্তির রেশ দেখা গেল। ভ্রু জোড়ার সংযোগস্থলে সুতীক্ষ্ণ ভাঁজ পরলো। বড় বড় চোখদুটোতে সন্দেহ ফুটে তুলে অত্যন্ত অধৈর্য্য হয়ে বলল-

‘কিছুদিন ধরে তুই সব সময় কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকিস। কিছু জিজ্ঞেস করলেই মুচকি হেসে উত্তর দিচ্ছিস। বিনাকারণেই লজ্জা পাচ্ছিস। খুবই অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যবহার করছিস। আগে তো কখনো এমন ব্যবহার করিস নি। তোর মাঝে আমি কেমন যেন প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি। তুই কি প্রেমে ট্রেমে পরলি না-কি অনু? দুলাভাইয়ের প্রেমে পরেছিস? কিন্তু কবে! কখন? কীভাবে?’

সানির প্রশ্নগুলো তীরের মতো এসে হানা দিলো আমার মনে। প্রতিটি কথা গেঁথে গেল মনের কোণে। প্রেমের কথা শুনেই ক্ষীণ লজ্জার উপস্থিতি টের পেলাম। তবুও নিজেকে যথাসাধ্য সামলে নিলাম। কৃত্রিম রাগ নিয়ে চটপটিয়ে বললাম-

‘চুপ থাকতো সানি। ফালতু কথা বলিস না৷ চুপচাপ আমার সাথে বসে থাকতে চাইলে বস না হলে চলে না।’

আমার রাগ প্রকাশে সানির তেমন কোনো হেলদোল হলো না৷ সে এখনও কৌতুহলী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো৷ আগ্রহ নিয়ে আবারও কিছু বলতে চাইলেই আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম। সানি হতাশ হয়ে গাল ফুলিয়ে ফেলে৷ আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকলো। আমি ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেললাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম সানির বলা কথা গুলো। আমি কথায় কথায় লজ্জা পাচ্ছি! মুচকি হেসে উত্তর দিচ্ছি? প্রেমে পরেছি? আসলেই কি তাই! কেউ কি তার স্বামীর প্রেমে পরে? আমি কি ধ্রুবর প্রেমে পরেছি? জানা নেই। তবে আমি জানি আমি যখন তখন বেখেয়ালি হয়ে যাচ্ছি। ধ্রুবর স্পর্শে এখন থমকে না গিয়ে কেঁপে উঠছি। তার কথা ভেবেই একা একা লজ্জাবোধে নিজেকে আড়াল করে নিতে চাচ্ছি। তাকে দেখলেই আমার দৃষ্টি থমকে যাচ্ছে। রাত-বিরেতে ধ্রুবর ফোন কল পাওয়া। যখন তখন বাসার নিচে এসে দেখা করা। কিছু অযুক্তিক কারণ দেখিয়ে আমাকে ছুঁয়ে দেওয়া। এসব কিছুতেই নিজেকে এক কিশোরী মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। নতুন নতুন প্রেমে পড়া এক কিশোরী মেয়ে। যে কি-না বিনাকারণেই হাসবে। একা একাই লজ্জায় লাল হবে। প্রেমিক পুরুষের স্পর্শে ভয়ংকরভেবে কেঁপে উঠবে তার শরীর আর মন দুটোই। আবেগি হবে কিছু ভালোবাসাময় কথা শুনেই। যার মস্তিষ্কটা জুরে থাকবে শুধু একজন প্রেমিক পুরুষেরই বিচরণ। আর সেই প্রেমিক পুরুষ হলেন ধ্রুব৷ নাছোড়বান্দা বীর প্রেমিক পুরুষ।

‘কেমন আছো অনন্যা?’

হঠাৎই পাশ থেকে চিরচেনা কন্ঠস্বর শুনে আমি স্তম্ভিত ফিরে পেলাম। মাথা উঁচু করে পাশে তাকাতেই ভীষণ পরিচিত এক মুখ চোখের সামনে আটকে গেল। উদাসীন তার চাহনি। চোখ দুটো ডেবে গেছে ভীষণ অযত্নে। সব সময় হাস্যজ্বল থাকা মুখখানার বিভৎস অবস্থা। গাল ভর্তি অবহেলায়, অযত্নে বেড়ে ওঠা দাঁড়ি। ঠোঁটে কালচে পোড়ার দাগ। কতশত সিগারেটের উত্তপ্ত ছোয়া পেয়েছে এই ঠোঁট তার হয়তো নির্দিষ্ট হিসেব নেই। শরীরের কি বাজে বিধ্বস্ত অবস্থা। এসবটা কি আমার জন্যই হয়েছে! আমার চোখাচোখি হতেই তার কালচে পোড়া ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে মলিন হাসি দিলো। আমি যন্ত্রের মতো উঠে দাঁড়ালাম। আমার পাশাপাশি সানিও দারুণ চমকিত ভাব নিয়ে তাকায় সাদাফের দিকে। আমি প্রত্যুত্তর করলাম না৷ নিরুত্তর চোখে তাকিয়ে রইলাম সাদাফের দিকে। সাদাফ মৃদু হেসে ম্লানমুখে বলল-

‘আমি কি তোমার সাথে একটু একা কথা বলতে পারি অনন্যা?’

আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। নিজেকে সহজ করে সানির দিকে চেয়ে ভারী কন্ঠে বললাম-

‘সানি তুই চলে যা। তোর দুলাভাই হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে আমি ওনার সাথেই বাসায় চলে যাবো।’

সানি অবাক চোখেই সাদাফের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার কথা শোনা মাত্রই মাথা নাড়িয়ে নিঃশব্দে চলে গেল। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রাস্তার দিকে চাইলাম। ধ্রুবর এতক্ষণে এসে পরার কথা ছিল। কিন্তু এখনও আসছে না কেন? যদি এখানে এসে আমাকে সাদাফের সাথে দেখে তাহলে কি আমাকে ভুল বুঝবে! হুহ্ কখনোই না। উনি আমাকে আগেও বিশ্বাস করেছেন আর সারাজীবন বিশ্বাস করবেন। এটা আমি জানি। উনি কখনই আমাকে ভুল বুঝবেন না।

‘আমি এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি৷ তাই শেষ বারের মতো তোমায় দেখতে আসলাম। আশাকরি বিরক্ত হলেও আজ অন্তত মুখ ফিরিয়ে নিবে না। সব সময়ের মতোই আমাকে সহ্য করবে।’

আমি নিশ্চুপ তবে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম সাদাফের দিকে। ক্ষীণ স্বরে থেমে থেমে প্রশ্ন করলাম-

‘দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছো মানে কি? কোথায় যাচ্ছো?’

সাদাফ হাসার চেষ্টা করে বলল- ‘কানাডা আব্বুর কাছে চলে যাচ্ছি। সাথে আম্মুকেও নিয়ে যাবো। সেখানেই আব্বুর বিজনেসে একটু মন দিবো। সব কিছুই রেডি হয়ে গেছে। হাতে বেশি একটা সময় নেই। কাল রাতেই ফ্লাইট৷ জানি না আবার কখনও কোনো পিছুটানে এই দেশে ছুটে আসবো কি-না।’

‘কিন্তু হঠাৎ করেই এই সিদ্ধান্ত কেন? তুমি তো কখনই এই দেশে ছেড়ে তোমার আব্বুর কাছে যেতে চাওনি।’

আমি সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন গুলো করেই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম তার জবাবের আশায়। সাদাফ আম বাগানের অদূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। ঠোঁট প্রসারিত করে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বলল-

‘আগে এই দেশটা খুব সুন্দর স্নিগ্ধ লাগতো। সবুজ গাছপালা, নীল আকাশ, রাস্তার চারপাশের কোলাহল সব কিছুতেই মুগ্ধতা খুঁজে পেতাম। কারণ তখন আমার মনে তোমার বসবাস ছিল। আমার পাশে তোমার অস্তিত্ব ছিল তাই। আমি প্রকৃতি প্রেমি বাউন্ডুলে ছেলে। সারাদেশ ঘুরেও তোমার কাছে ফেরে এসেছি। এত ভালোবেসেছি এই প্রকৃতিকে। আর সেই প্রকৃতিই কি-না তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলো। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এখন আমার কাছে বিষাক্ত মনে হচ্ছে। মস্ত বড় ভুল মনে হচ্ছে। জানো তো, তুমিহীনা এই শহর বড্ড নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু বিষাদ আর বিষাদ। শহরের প্রতিটি অলিগলিতে শুধুই তোমার স্মৃতি ভেসে ওঠে। নীল আকাশ এখন শুধুই আমার দীর্ঘ শ্বাসের সাথী। এখন আর ভালো লাগে না এই আকাশ৷ তুমি ছাড়া একলা আমি এখানে কি করে থাকি বলো তো অনুপাখি! আমার দম আটকে আসে। ভীষণ কষ্ট হয়। বদ্ধ ঘরেও যেন তোমার স্মৃতিরা এসে আমাকে আঁকড়ে ধরে। তোমার প্রতি অবহেলা করার অপরাধে আমি নিজের কাছেই অপরাধী। এত এত বোঝা নিয়ে আমি থাকবো কীভাবে?’

আমি আহত দৃষ্টিতে দেখলাম সাদাফের টলমলে চোখ দুটো। সব সময় যে চোখদুটোতে মুগ্ধতা ছেয়ে থাকতো আজ সেই চোখে শুধুই বিষাদ। ঠোঁটের হাসিও যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। আমি তপ্ত শ্বাস ফেলে মিহি কন্ঠে বললাম-

‘নিজেকে দোষী ভেবো না সাদাফ। এটাই আমাদের ভাগ্যে ছিল তাই অতীত ভুলে যাও। নতুন করে সব কিছু শুরু করো। মুভ অন করো।’

সাদাফ আক্রোশ ভরা কন্ঠে বলল- ‘সব কিছু কি এতটাই সহজ যতটা সহজ ভাবে তুমি বলছো? একটি বারের জন্য কি আমাকে রেখে দাওয়া যায়নি অনন্যা? ভালো না-ই বা বাসতে ঘৃণা নিয়েই না হয় সারাজীবন আমার সাথে থাকতে। কিভাবে আমি নিজেকে সামলাবো? তুমি ছাড়া সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার একটা কারণ কি তুমি আমায় দেখাতে পারো?’

আমি খানিকক্ষণ নিশ্চুপ রইলাম। দৃষ্টি তুলে আবারও সাদাফের দিকে চেয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম-

‘কারও জন্য জীবন থেমে থাকে না সাদাফ৷ তুমিও বাঁচবে আর আমিও বাঁচবো৷ ভিন্ন কোনো উপন্যাসের পাতায়৷ ভিন্ন কোনো গল্পের চরিত্র হয়ে। আমি চাইনা তুমি অতীত আঁকড়ে ধরে পিছিয়ে থাকো৷ এতে আমি নিজেকে অপরাধী মনে করবো। তুমি যদি নিজের জীবন এভাবেই নষ্ট করে আমাকে অপরাধী বানাতে চাও তাহলে তুমি তা-ই করো। আর যদি আমার কথা ভেবে হলেও নিজেকে গুছিয়ে নাও তাহলে আমি কৃতজ্ঞ।’

সাদাফ আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিতে রইলো। অতি সন্তপর্ণে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল সে।

‘মাম্মা.. মাম্মা!’

আচমকাই তুলতুলের ডাকে আমি চমকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালাম৷ ধ্রুব তুলতুলকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার হাতে অনেকগুলো রঙিন বেলুন। তুলতুল ছটফট করছে ওনার কোল থেকে নেমে আমার কাছে আসার জন্য। আমি অপলক দৃষ্টিতে ধ্রুবর গাম্ভীর্যপূর্ণ চোখের দিকে চেয়ে রইলাম। ভীষণ গম্ভীর লাগছে তাকে। সাদাফকে দেখে কি রেগে যাচ্ছেন তিনি!

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৫
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

ধ্রুব খুব আশ্চর্যজনক ভাবে নিজের গাম্ভীর্যতা লুকিয়ে ফেললেন। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে সরল হাসি ঝুলিয়ে এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। আমার সামনে আসা মাত্র তুলতুল আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা করলো না। ধ্রুবর কাছ থেকে লাফিয়ে এসে পরলো আমার কোলে। আমি তৃপ্তির হাসি দিলাম। মেয়েটা কত সুন্দর ভাবেই না আমার সারা মুখে আদরের ছোঁয়া দিয়ে দিচ্ছে। কেন যেন মনে হচ্ছে মেয়েটা বেশ বড় হয়ে গেছে। যদিও এই বিশ দিনে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে তুলতুলের সঙ্গে। তবে আজ ভিন্ন লাগছে। চুল গুলো বড় হয়েছে বোধহয়। খুব নিখুঁত ভাবে তার বড় বড় চুল গুলোতে সিঁথি কেটে দু’টো ঝুটি করা হয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম এই নিখুঁত কাজ আর কারও নয় ধ্রুবর। ঘন্টা খানেক সময় লাগিয়ে হলেও সে খুব নিখুঁতভাবেই তুলতুলের চুল বাধার কাজ সম্পূর্ণ করেন। খুব উৎসাহ নিয়েই এই কাজ করেন। বিয়ের পর থেকে এমনটাই দেখেছি। একবার না পারলে বার বার চেষ্টা করেন। আর তুলতুলও লক্ষী মেয়ের মতো চুপচাপ বসে থাকে। একটু বিরক্তি প্রকাশও করে না।

‘কেমন আছো সাদাফ?’

ধ্রুবর কন্ঠস্বর শুনে আমার দৃষ্টি সেদিকে দিলাম। দেখলাম ধ্রুব সাদাফকে জড়িয়ে ধরে আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলছেন। সাদাফের মুখেও হাসি তবে সেটা অপ্রস্তুত কৃত্রিম হাসি। ওনারা একে অপরের হালচাল জিজ্ঞেস করে পাশের বেঞ্চিতে বসলেন। আমিও তুলতুলকে কোলে নিয়ে সামনের বেঞ্চিতে বসলাম। দূর থেকেই সংকোচিত মনে ধ্রুবকে লক্ষ্য করতে লাগলাম৷ তার কথা বলার ধরনে সুখী সুখী ভাব। মুখটাও বেশ হাসি হাসি। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি তার স্ত্রী’র প্রাক্তনের সঙ্গে কথা বলছেন। খুব কাছের বন্ধুর সাথে অনেক দিন পর দেখা হলে যতটা আন্তরিকতা প্রকাশ করা প্রয়োজন ঠিক ততটাই তাদের মাঝে দেখা যাচ্ছে। সাদাফ নিজেও এখন সহজ হয়ে এসেছে। কোনো জড়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কথা বলার মাঝেমধ্যেই তুলতুলের তীব্র চিৎকারে বিস্ময় নিয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আবারও চোখে ফিরিয়ে নিচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই।

‘তা কি করছো এখন? কোথাও কি ট্যুরে গিয়েছিলে এই কিছুদিনের মধ্যে?’

ধ্রুবর এই সহজ প্রশ্নেও সাদাফের মাঝে বিষন্ন ভাব এসে পরলো। মাটির দিকে চেয়ে ম্লানমুখে বলল-

‘নাহ ট্যুরে এখন আর যাওয়া হয় না। ঠিক করেছি কানাডা একেবারে সেটেল্ড হয়ে যাবো। কাল রাতেই ফ্লাইট। দেখি সেখানে আব্বুর কোনো কাজে আসতে পারি কি-না।’

সাদাফের জবাবে ধ্রুব কিছুটা সময় চুপ করে রইলো। ভ্রু কুচকে ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘আমার জানা মতে ধরাবাঁধা নির্দিষ্ট নিয়মে চলা এমন জীবন তোমার পছন্দ না। তাহলে হঠাৎ করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?’

সাদাফ আড়চোখে আমার দিকে একঝলক তাকালো। তার এই তাকানোর মাঝে ছিল আমার প্রতি অভিযোগ কিংবা তীব্র অভিমান। সাদাফ অদূরে দৃষ্টি দিয়ে আক্রোশ ভরা কন্ঠে বলল-

‘সব সময় পছন্দ অপছন্দ এক থাকে না। পরিস্থিতির সাথে সাথে পছন্দের জিনিসও একটা সময় অসহনীয় হয়ে ওঠে। পছন্দের না হলেও কিছু সিদ্ধান্ত পরিস্থিতির কারণে নিতে হয়।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। খেয়াল করলাম ধ্রুব আমার দিকেই নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছেন। শান্ত শীতল তার চাহনি। মুখের হাসিটা এখন আর নেই৷ হয়তো সাদাফের চলে যাওয়ার কথায় কিছুটা অবাক হয়েছেন। হয়তোবা আমার ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছেন। ধ্রুব আমার দিকে চেয়েই গাঢ় স্বরে বললেন-

‘আমি সোজাসাপ্টা কথা বলার মানুষ। ঘুরিয়ে পেচিয়ে আমি কথা বলতে পারি না। তাই যা বলার কোনো প্রকার বিনীতা ছাড়াই বলবো। হয়তো আমার কথায় বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হবে। তবে কিছু কথা বলা প্রয়োজন বলেই আমি বলতে চাচ্ছি।’

সাদাফ হাল্কা করে মাথা নাড়লো। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি ধ্রুবর দিকে৷ উনি ঠিক কি বলতে চাচ্ছেন তা-ই বোঝার চেষ্টা করছি। ধ্রুব আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সাদাফের দিকে স্থির করলেন। অত্যন্ত সহজ গলায় বললেন-

‘আমি তোমার অতীত সম্পর্কে সবটাই জানি। হয়তো আমি তোমাকে তোমার অতীত আর অনন্য কোনোটা-ই ফিরিয়ে দিতে পারবো না। তবে আমি চাইনা তোমাদের মনে একে অপরের প্রতি তিক্ততা থাকুক। কোনো না কোনো কারণে বিচ্ছেদ যেহেতু হয়েছে সেটা মেনে নিয়েই তোমরা নতুন ভাবে জীবন শুরু করো সেটাই আমি চাই। তুমি আমার ফ্রেন্ড। অল্প দিনের হলেও আমার খুব কাছের ফ্রেন্ড। আমার চোখের সামনে তুমি ভেঙে পরবে সেটা আমি দেখতে পারবো না। আশাকরি তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো।’

‘এসব বলা খুব সহজ তাই না! তবে মেনে নেওয়া কি এতটা-ই সহজ? কাউকে এতটা ভালোবাসার পর তাকে ভুলে যাওয়া কি সত্যিই সম্ভব? তুমি কি বুঝবে আমার যন্ত্রণা ধ্রুব! হয়তো বুঝবে না। কারণ আমার জায়গায় তো তুমি নও। বিচ্ছেদের তীব্র কষ্ট। অবাঞ্ছিত কিছু যন্ত্রণা দিন দিন ঘুনে পোকার আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছি আমি। এসব কি বুঝবে তুমি?’

ধ্রুব নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলো সাদাফের দিকে। নিরুত্তর তার দৃষ্টি। আমি চুপচাপ বসে তাদের কথা শুনছি। তাদের কথার মাঝে কথা বলার কোনো প্রয়োজন বোধ মনে হলো না বলেই আমি নিশ্চুপ। তুলতুল বেলুন নিয়ে খেলছে। এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। সব সময়ের মতো আজ সেই পে পু শব্দ করা জুতো পায়ে নেই। ভালোই হয়েছে আজ সেই জুতো না পরায়। জুতোর তীক্ষ্ণ পে পু শব্দে হয়তো তাদের কথার মাঝে ব্যাঘাত ঘটাতো। অবশ্য এই পর্যন্ত দু বার বেলুন ফুটিয়ে তুলতুল আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তবে এতে তুলতুলের মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। সে নিজের মতোই খিলখিল করে হাসছে। প্রাণোচ্ছল হাসি।

‘আমি বুঝতে পারি অনন্যর তীব্র যন্ত্রণা কেমন ছিল। তার চোখে দেখেই আমি সবটা বুঝে ফেলি। কিছুদিন পর পর তোমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করায় প্রতিবারই বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় ছটফট করেছে সে। তার চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক ছিল তাকে অপেক্ষায় রেখে বন্ধুদের সাথে তোমার আনন্দে থাকার মুহূর্ত গুলো ভাবা। প্রতিবার তার অনুভূতি, অপেক্ষা, অভিমান সব কিছুকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে তোমার চলে যাওয়া। তীব্র যন্ত্রণাদায়ক ছিল। নির্ঘুম রাত ছিল তার সাক্ষী। তুমি কি খেয়াল করে দেখো নি তোমার ভালোবাসার মানুষের চোখ দুটো! বিষন্নতায় আঁধার হয়ে যাওয়া তার মুখখানা দেখে তোমার বুকে ব্যাথা হয়নি?’

সাদাফ প্রত্যুত্তর করলো না। মূর্তি ন্যায় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। এতগুলো বছর এই প্রশ্নগুলো করতে চেয়েও আমি সাদাফকে করতে পারিনি। হয়তো তার কাছে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নেই। এইজন্যই হয়তো দৃষ্টি নামিয়ে চুপ করে বসে আছে। ধ্রুব আমার নির্লিপ্ত চোখের দিকে চেয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন। তার দৃষ্টি স্থির রেখেই অতি নরম গলায় বললেন-

‘আমি খেয়াল করেছি সবটাই। তার বিষাদগ্রস্ত মুখ, তার উদাসীন দৃষ্টি, গাঢ়তর কালি পড়া ক্লান্ত চোখ সবটাই খেয়াল করেছি। হঠাৎ হেসে সেই হাসি আবার মিলিয়ে যাওয়ায় আমার বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথাও অনুভব করেছি। আমি জানি না তুমি কিভাবে অনন্যকে উপেক্ষা করেছো বা করতে পেরেছো। তবে আমি পারিনি। অনন্যকে দেখার পর আমার আর অন্য কোনো কিছুর প্রতিই মায়া কাজ করেনি। এই মেয়েটাকে ভালোবাসার পর আর কোনো কিছুকেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনি। প্রকৃতিকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনি। ট্যুরে যেতে ইচ্ছে করেনি। এই মেয়েটার মাঝেই আমি আমার সারা পৃথিবীর মুগ্ধতা খুঁজে পেয়েছি। ওকে ভালোবাসার পর পাহাড় পর্বত, সমুদ্র, আকাশ, মেঘ, বৃষ্টি সব কিছুই অনন্যর সামনে তুচ্ছ মনে হয়। ওর চোখের দিকে তাকালেই বিশাল এক সাগর দেখতে পাই। নীল আকাশ দেখতে পাই। ওর চোখদুটো দেখে আমি পারিনি বেশিক্ষণ নিজের বেপরোয়া স্বভাবটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে। প্রকৃতিকে ভালোবেসে সব সময়ের মতো উড়নচণ্ডী হয়ে থাকতে পারিনি। তুমি পেরেছো তবে আমি পারিনি। হয়তো এই দিক দিয়ে তুমি আমাকে ব্যর্থ ভাবতে পারো। আমি একদিনও ওকে ছাড়া থাকতে পারছি না। এতেই আমার ঘুম উড়ে যাচ্ছে। অল্প কিছুদিনের দূরত্বেই ভালোবাসার তীব্রতা অনুভব করতে পারছি। এই মেয়েকে ছাড়া একমুহূর্তে ভালো থাকা আমার জন্য অসম্ভব। তুমি কি বুঝতে পারছো ভালোবাসার পার্থক্যটা! তোমার উচিত নিজের ভুল গুলো শুধরে নেওয়া। পরের বার কাউকে ভালোবাসলে তার মাঝেই নিজের পৃথিবী খোঁজার চেষ্টা করা। যদি নিজের আনন্দ, উল্লাস, মুগ্ধতা সব কিছু কারও মাঝে খুঁজে পাও তখন বুঝবে তোমার ভালোবাসার প্রখরতা।’

আমি মুগ্ধ হলাম। ধ্রুবর প্রতিটি কথায় আমি আবারও নতুন করে ভালোবাসার মানে খুঁজে পেলাম। ধ্রুবর চাহনিতে এক রাশ মুগ্ধতা দেখলাম। আমি আবারও ভালোবাসা শিখলাম নতুন করে। ধ্রুব নামক ভালোবাসা। কিছু নতুন নতুন অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত করালো আমাকে। আমাকেও কেউ এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ভেবেই অভিভূত হলাম। আমার মাঝেও কেউ তার পৃথিবী খুঁজে পায় শুনেই নিজেকে কারও সুখের কারণ হিসেবে মনে করলাম। এই বুঝি আমি আবারও প্রেমে পরলাম। খুব ভয়ংকর ভাবেই পরলাম। আমি বুঝি নিজেকে আত্মসমর্পণ করলাম ধ্রুবর ভালোবাসার কাছে!
সাদাফ মাথা নত করে আছে। হয়তো সে বুঝতে পেরেছে তার ভুল। কেউ কোনো কথা বলছে না। এবার সত্যিই বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হইলো। তবে বেশিক্ষণ আর এমনটা থাকলো না। তুলতুল সাদাফের কাছে যেয়ে তার কোলে ওঠার জন্য শার্ট ধরে টানছে। সাফাদ দৃষ্টি তুলে তুলতুলের দিকে চাইলো। খুব যত্নসহকারেই তাকে কোলে তুলে নেয় হাসি মুখে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। তবে ধ্রুবর শান্ত শীতল চাহনি এখনও আমার মাঝেই নিবদ্ধ হয়ে থাকলো।

‘আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?’

আমার প্রশ্নে ধ্রুব কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলেন-

‘না, আপনার উপর রেগে থাকার কোনো কারণ নেই।’

আমি ভ্রু কুচকে সন্দিহান কন্ঠে বললাম- ‘রেগে না থাকলে মুখ এমন অন্ধকার করে রেখেছেন কেন?’

ধ্রুব কোনো প্রকার প্রত্যুত্তর করলেন না। চুপচাপ সামনের দিকে চেয়ে ড্রাইভ করছেন। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে তুলতুলের দিখে চাইলাম। ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে মেয়েটা। সাদাফকে ছেড়ে কিছুতেই আসতে চাচ্ছিলো না। গলা জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। আমি শুধু অবাক হয়ে দেখছিলাম ওর কান্ডকারখানা। মেয়েটা অল্পতেই সবার সাথে মিশে যায়। মেয়ে, মেয়ের বাবা, দাদা-দাদি সবার মাঝেই এত ভালোবাসা আসে কোত্থেকে! সবার প্রতি তাদের ভালোবাসার আর সীমা থাকে না। সে অচেনা হলেও তারা আপন করে নিতে একটুও সময় নেয় না। আমি ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে তুলতুলের কপালের চুল গুলো সরিয়ে দিলাম। ভালো করে আগলে নিলাম তাকে৷ ধ্রুবর দিকে চেয়ে মলিন কন্ঠে বললাম-

‘আমি বুঝিতে পারছি আপনি আমার উপর রেগে আছেন। তবে আমি সত্যি করে বলছি আমি ইচ্ছে করে সাদাফের সাথে দেখা করিনি। আমি জানতাম না ও এখানে আসবে।’

ধ্রুব কড়া গলায় বললেন- ‘বললাম তো আমি রেগে নেই।’

‘এই তো রাগ দেখিয়ে কথা বলছেন আমার সাথে। তাহলে মিথ্যা কেন বলছেন যে রেগে নেই!’

ধ্রুব বিরক্তি নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। আমার কথায় তিনি ভীষণ বিরক্ত হচ্ছেন সেটা ওনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৬
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘আমি আপনার উপর রাগ করিনি। তবে সাদাফের সঙ্গে আপনাকে দেখে মেজাজ বিগড়ে গেছে।’

ধ্রুব কাঠ কাঠ গলায় কথা গুলো বলেই ড্রাইভিং-এ মনোযোগ দিলেন। আমি কিছুটা সময় চুপ থেকে নিম্ন স্বরে বললাম-

‘কিন্তু আমি তো ইচ্ছে করে সাদাফের সাথে দেখা করিনি।’

ধ্রুব কপট রাগ দেখিয়ে বললেন- ‘আমি সেটা জানি তবুও আমার রাগ লাগছে।’

আমি সরু চোখে ওনার দিকে চেয়ে থাকলাম। আজ প্রথম উনি আমার সাথে রাগ দেখিয়ে কথা বলছেন। সাদাফকে নিয়ে তার প্রব্লেম হচ্ছে কিংবা রাগ লাগছে এটাও আজকেই প্রথম প্রকাশ করলেন। মানুষটাকে এতদিন নির্বিকার, অনুভূতিহীন মনে হতো। কোনো কিছুতেই রিয়েক্ট করেন না। রাগ দেখান না৷ স্ত্রীর প্রাক্তন নিয়েও মাথা ঘামান না। সব বিষয়েই যেন তিনি নির্বিকার থাকেন। তবে আজ ভিন্ন মনে হচ্ছে। নির্বিকার মানুষটার মধ্যেও রাগ আছে। স্ত্রীর প্রাক্তন নিয়েও তিনি জেলাস। এটাই কি স্বাভাবিক নয়! আমি ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে দৃষ্টি নামিয়ে নিম্ন স্বরে বললাম-

‘সরি আমার ভুল হয়ে গেছে। নেক্সট টাইম আর এমন কিছু হবে না।’

ধ্রুব গাড়ির স্পিড কমিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে চাইলেন। ভ্রু জোড়ার মাঝে সুতীক্ষ্ণ ভাঁজ পরেছে। আমার কথায় যেন তার বিরক্তি ভাব আরও দ্বিগুণ হয়েছে। চোখমুখ কুচকে তিক্ত গলায় বললেন-

‘আমি কি বলেছি আপনাকে সরি বলতে!’

‘আপনি রেগে আছেন বলেই তো সরি বললাম। এখন তো দেখছি সরিও বলা যাবে না। তাহলে আপনিই বলুন কি করলে আপনার রাগ কমবে?’

ধ্রুব প্রতিত্তোরে কিছু বললেন না। আগের মতোই ড্রাইভিং করতে লাগলেন। আমি মলিন মুখে তাকিয়ে থাকলাম ওনার দিকে। গাড়ি থামলো বাসার সামনে এসে৷ আমি তুলতুলকে কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই ধ্রুব আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। নিঃশব্দে তুলতুলকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গাঢ় স্বরে বললেন-

‘আমার রাগ ভাঙানোর জন্য আপনাকে কিছুই করতে হবে না। সময় হলে আমি নিজেই চেয়ে নিবো।’

ধ্রুব গাম্ভীর্যের সাথে পা বাড়ালেন বাসার ভেতরে। আমি কয়েক মুহুর্ত সেদিকে স্থির তাকিয়ে থেকে হাঁটা শুরু করলাম। এই মানুষটাকে শুধু একটা কথাই বলা যায় আর তা হলো “অদ্ভুত” ভীষণ ভীষণ ভীষণ অদ্ভুত।

‘তোদের মধ্যে কি কিছু হয়েছে অনু? দুপুরে আসার পর থেকে ধ্রুব কেমন যেন গোমড়া হয়ে আছে।’

মনি মা’র কথায় আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। ডাইনিং টেবিলের প্লেট গুলো গোছাতে গোছাতে বললাম-

‘তেমন কিছু হয়নি মনি মা। উনি এমনিতেই একটু রেগে আছেন।’

আমি প্লেট গুলো নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাবো তখনই মনি মা আমাকে আটকে দিলেন। আমার হাত থেকে প্লেট গুলো নিয়ে আবারও টেবিলে রাখলেন। আমি বিস্মিত চোখে মনি মা’র দিকে তাকালাম। আমাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে মনি মা নিজেও বসলেন। কিছুক্ষন আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন-

‘আমি জানি তোদের সম্পর্ক আর দশ-টা সম্পর্কের মতো না। তবে তোরা মন থেকে চাইলেই তোদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হবে। সময় নে, চেষ্টা কর দেখবি ধীরে ধীরে তোরা দু’জনেই এই সম্পর্কে স্বাভাবিক হয়ে আসবি। আমি ধ্রুবকে বুঝিয়েছি। আজ তোকে বলছি। বিয়ের সম্পর্কটা অনেক পবিত্র আর মূল্যবান একটা সম্পর্ক। কবুল বলার সাথে সাথেই স্বামী স্ত্রীর মনে একে অপরের প্রতি আলাদা একটা টান বা অনুভূতির জন্ম নেয়। না চাইতেও তখন এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন হয়ে যায়। কারণ সব সম্পর্কের উর্ধ্বে হলো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। তাই এই সম্পর্কের যত্ন নিতে শিখ। আশাকরি তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস।’

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। মনি মা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন-

‘এসব আমি গুছিয়ে রাখছি। তুই এখন রুমে যা। অনেক রাত হয়ে গেছে।’

আমি মনি মা’র কথা অগ্রাহ্য করে প্লেট গুলো নিয়ে রান্না ঘরে যেতে যেতে বললাম-

‘ভাইয়ার জন্য পাত্রী দেখতে যাবে তাই আম্মু তোমাকে পরশু ওই বাসায় যেতে বলেছে।’

মনি মা আমার কাছে এসে ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে বললেন-

‘কেন তুই যাবি না!’

‘নাহ মনি মা। এক্সামের প্যারায় অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। তাই কিছুদিন বাসায় থেকে রেস্ট নিবো। আর তুলতুলকে একটু সময় দিবো।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে এখন রুমে যা। বেশি দেরি হলে ধ্রুব হয়তো আরও রাগে যাবে। বাপের মতোই কিন্তু রগচটা হয়েছে। তবে বেশি প্রকাশ করে না।’

আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে অলস ভঙ্গিতে রুমের দিকে যেতে লাগলাম। দুপুর থেকে ধ্রুব আমার সাথে ঠিক মতো কথা বলেননি। সারাক্ষণ মুখ ভার করেই বসে ছিলেন। উনি সাদাফকে নিয়ে এতটা জেলাস ফিল করেন তা আমার ধারনা ছিল না। মনের ভেতর এত কিছু লুকিয়ে সব সময় সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলেন কিভাবে! কি অদ্ভুত চরিত্র ওনার। ওনাকে বোঝার চেষ্টা করতে করতেই হয়তো আমি বুড়ি হয়ে যাবো। তবুও হয়তো ওনাকে বুঝতে পারা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
বিছানার মাঝ বরাবর তুলতুল ঘুমিয়ে আছে। পুরো রুমে আমি চোখে বুলিয়ে নিলাম। ধ্রুব রুমে নেই। বারান্দার দরজা খোলা। ঘুটঘুটে অন্ধকার বারান্দা। আমি নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। আবছায়া আলোতে ধ্রুবর পেছন সাইড স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রেলিঙের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি৷ আমি বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে ওনার পাশে এসে দাঁড়ালাম। ধ্রুব আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলেন। এক পলকের জন্যেও আমার দিকে ফিরে তাকালেন না। ভাবটা এমন যে, আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি এটা যেন তিনি লক্ষ্যই করেন নি। আমি উদাসীন চোখে আকাশের দিকে চাইলাম। কৃষ্ণবর্ণের মেঘ গুলো এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। ঝিরিঝিরি হাওয়ার বেগ বেড়েছে প্রবলভাবে। বেলি গাছের পাতা গুলো এক একটা ঢালের সাথে বাড়ি খেয়ে শব্দ তুলছে। আমি এবার হাল ছেড়ে ধ্রুবর দিকে ফিরে দাঁড়ালাম। ক্লান্ত গলায় বললাম-

‘আপনি এখনও রেগে আছেন?’

ধ্রুব প্রত্যুত্তর করলেন। আমার প্রশ্ন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তাকিয়ে রইলেন অদূর মেঘলা আকাশে। কয়েক মুহুর্ত নিরব থেকে পালটা প্রশ্নে করলেন আমাকে,

‘সাদাফ চলে যাচ্ছে, আপনার কষ্ট হচ্ছে না?’

আমি থমকে গেলাম কয়েক মুহুর্তের জন্য। মস্তিষ্কে এলোমেলো ভাবনার সৃষ্টি হলো। সাদাফ চলে যাচ্ছে এ কথাটা আমার মাথায় একদমই ছিল না। দুপুর থেকে ধ্রুবকে নিয়ে ভাবতেই ব্যস্ত ছিলাম। কীভাবে ওনার রাগ ভাঙানো যায়৷ ওনার গাম্ভীর্যতা দূর করা যায় এসব চিন্তা-ই মাথার মধ্যে সর্বক্ষণ ঘুরছিল।
আমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ধ্রুব আমার দিকে ফিরে তাকালেন। অত্যন্ত নরম গলায় বললেন-

‘আমি জানি আপনার মনে এখন সাদাফের জন্য কোনো জায়গা নেই। আপনি কখনও সাদাফের কাছে ফিরে যাবেন না এটাও আমি জানি। আমি আপনাকে ভালোবাসি তার চেয়েও বেশি বিশ্বাস করি। আপনি আমাকে ভালোবাসেন কিংবা না বাসেন তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে আমি কখনও আপনাকে ছাড়তে পারবো না। আপনি চাইলেও না। আপনার ব্যাপারে আমি ভীষণ স্বার্থপর। আপনার ছায়াও অন্য কারও পাশে আমার সহ্য হয় না। সেটা সাদাফ হোক কিংবা অন্য কোনো পুরুষ। আর আমার সহ্য হয় না বলেই তখন রাগ হয়েছিল।’

আমি মাথা তুলে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। এই শান্তশিষ্ট মানুষটা আমাকে নিয়ে এতটা-ই জেলাস! আমি থমথমে গলায় বললাম-

‘আপনার রাগ ভাঙানোর জন্য কি করতে হবে আমাকে?’

ধ্রুব আমার দিকে ঝুঁকে মুখোমুখি হয়ে বললেন-

‘আপাতত আমার বুকের যে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে সেটা কমিয়ে দিন। তাহলেই হবে।’

‘কীভাবে?’

আমি বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করতেই ধ্রুব সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ঠোঁট প্রসারিত করে মৃদু হাসলেন। দু হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে শীতল কন্ঠে বললেন-

‘আসুন। এখানে মাথা রাখুন। বুকে মাথা রাখলেই সেই যন্ত্রণাদায়ক ভারি জিনিসটা শান্ত হয়ে যাবে।’

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধ্রুব আমার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ওনার বুকে আগলে নিলেন। আমি কেঁপে উঠলাম। আচমকাই আগমন ঘটলো তুমুল বর্ষণের। হিম শীতল বৃষ্টির ফোটা ছুঁয়ে দিলো আমাদের শরীর। অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেল সর্বাঙ্গে। অনুভূতিরা যেন দিশেহারা হয়েই মন মস্তিষ্কের সর্বত্র জুড়ে ছুটোছুটি করতে লাগল।

‘তুলতুলের আম্মু আমি যাচ্ছি।’

ধ্রুব কথায় আমি মাথা তুলে ওনার দিকে তাকালাম৷ শার্টের হাতা ঠিক করছেন তিনি। অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তুলতুলের গায়ে চাদর টেনে দিয়ে নিম্ন স্বরে বললাম-

‘আচ্ছা। সাবধানে যাবেন।’

‘আজ অফিসে প্রচুর কাজ। আসতে অনেক দেরি হবে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

ধ্রুব এবার কিছুটা উচ্চস্বরে বললেন- ‘ওকে তাহলে যাচ্ছি।’

ধ্রুবর কন্ঠে তুলতুল নেড়েচেড়ে উঠলো। আমি এবার খানিকটা বিরক্ত হলাম। তুলতুলের বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চাপা কন্ঠে বললাম-

‘কি শুরু করেছেন আপনি? তুলতুল উঠে যাচ্ছে তো৷ আব্বু ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছে। আপনি যান এখন।’

ধ্রুব আহত দৃষ্টিতে আমাকে একবার তুলতুলকে একবার দেখে রুম থেক বেরিয়ে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড পর তিনি আবারও ফিরে এলেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গাঢ় স্বরে ডাকলেন আমাকে,

‘তুলতুলের আম্মু একটু এদিকে আসুন তো।’

আমি সরু চোখে ওনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। কেমন যেন কাচুমাচু করছেন তিনি। কি অদ্ভুত এর আগে তো কখনও তিনি অফিসে যাওয়ার সময় এমন করেননি। আজ আবার কি হলো ওনার! আমি তুলতুলের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে এলাম ওনার কাছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওনার দিকে চেয়ে ক্ষীণ রাগ নিয়ে বললাম-

‘আপনার কি হয়েছে বলুন তো!’

ধ্রুব আচমকাই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন৷ আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ধ্রুবর এহেন কাজে। ঘটনার আকষ্মিকতা বুঝে আমার মস্তিষ্ক সচল হওয়ার আগেই ধ্রুব আমার গালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরলেন। আমি বরফের ন্যায় জমে গেলাম। বিস্ময়ে চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেল আমার। এভাবেই কেটে গেল কিছু মুহুর্ত। ড্রয়িং রুম থেকে আব্বুর আকর্ষণ কাড়া ডাকে আমার হুশ ফিরলো। প্রচন্ডরকম অপ্রস্তুত হয়েই ধ্রুবর বুকে ধাক্কা দিয়ে প্রতিবাদ জানালাম। ধ্রুবর মাঝে পরিবর্তন হলো না৷ তিনি আমার গাল থেকে তার উষ্ণ ঠোঁট জোড়া সরিয়ে নিলেন। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। আমার কানের কাছের মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন-

‘তুলতুলের জন্য দিয়ে গেলাম। ঘুম থেকে উঠলে আমার পক্ষ থেকে তুলতুল পাখিকে আদর করে দিয়েন।’

ধ্রুব কথাটা বলে আমাকে ছেড়ে দিয়েই হনহনিয়ে চলে গেলেন। আমি অবাক চোখে ওনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলাম। খানিকক্ষণ পর আনমনেই হেসে ফেললাম। মনে মনে একটু আফসোস হলো ওনার জন্য। বেচারা আমাকে জড়িয়ে ধরার জন্য, একটুখানি ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য তুলতুলের অযুহাত দিচ্ছেন বার বার। তুলতুলের নাম করেই প্রতিবার আমাকে জড়িয়ে ধরছেন। আর আজ তো চুমুও দিয়ে গেলেন তুলতুলের নাম করেই। কি অদ্ভুত সব ছেলেমানুষী তার! ওনার এসব ছেলেমানুষীতেই যেন আমি বার বার দূর্বল হয়ে পরছি। অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি ওনার অদ্ভুত অদ্ভুত কর্মকান্ডে।

সব সময় হাসতে খেলতে থাকা মেয়েটা হঠাৎ করেই চোখের সামনে নিস্তেজ হয়ে পরছে। প্রচন্ড জ্বরে শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠছে মেয়েটার। আমি প্রচন্ডরকম ব্যস্ত হয়েই এক হাতে তুলতুলের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছি আর অন্য হাতে ধ্রুবকে কল দিচ্ছি। ধ্রুব কল রিসিভ করছে না। আমি বার বার কল দিতে লাগলাম কিন্তু কোনো লাভই হলো না। বাসায় আর কেউ নেই৷ ধ্রুব আর আব্বু অফিসে গেছেন। আর মনি মা সকালেই বেরিয়ে পরেছেন আমাদের বাসার উদ্দেশ্যে। মাথা কাজ করছে না। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে আমার। বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে। তুলতুল গোঙাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি করে তুলতুলে কোলে নিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলাম। জ্বরের তাপে যেন পুরে যাচ্ছে মেয়েটার শরীর। সকালের হাল্কা জ্বর দুপুর হতেই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। মেয়েটার খাওয়া যাওয়া একদমই বন্ধ হয়ে গেছে। মুখে কিছু দিতেই বার বার বমি করছে। ক্লান্ত হয়েই শরীর একদম নেতিয়ে গেছে। ঠোঁট মুখ শুকিয়ে ফ্যাকাসে বর্ণের হয়ে গেছে। আমি আবারও ধ্রুবকে কল দিলাম। ধ্রুব এবার রিসিভ করলো না। বরাবরের মতোই কয়েকবার রিং বেজে কেটে যাচ্ছে। এবার আমার চোখের বাধ ভেঙে গেল। গাল বেয়ে পরতে লাগলো নোনাজল। আর কোনো উপায় না পেয়ে আমি একাই তুলতুলকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম রাস্তায়। মেয়েটা এখনও আগের মতোই ছটফট করছে।

চলবে…

শেষ রাত পর্ব-২১+২২+২৩

0

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২১
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘আমার বুকে খুব ভয়ংকর কিছু একটার উপস্তিতি টের পাচ্ছি তুলতুলের আম্মু। স্বাভাবিক কোনো রোগ বলে মনে হচ্ছে না। হঠাৎ হঠাৎই বুকে সেই ভারী জিনিসটা অনুভব করি। তখন আচমকাই তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়। আপনি কি বুঝতে পারছেন আমার কষ্টটা?’

ধ্রুব ভীষণ উত্তেজিত হয়ে কথা গুলো বললেন। আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ। ধ্রুব এখনও বুকে হাতে দিয়ে হাঁপাচ্ছেন৷ হয়তো এতগুলো কথা এক সাথে বলার কারণে এমনটা হয়েছে। আচ্ছা ওনার কি সত্যিই কিছু হয়েছে? আমি উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে গেলাম ধ্রুবর দিকে। ওনার বাহুতে হাত রেখে চিন্তিত গলায় বললাম-

‘কি বলছেন আমি তো কিছুই বলতে পারছি না। কি হয়েছে আপনার! আর হঠাৎ করে অসুস্থই বা হলেন কিভাবে! ডক্টর দেখিয়েছেন?’

‘ভয়ংকর কিছু একটা হয়েছে। খুবই ভয়ংকর। ডক্টর কিছুই করতে পারবে না। আমি এখনও টের পাচ্ছি আমার বুকে সেই ভয়ংকর জিনিসটা নাড়াচাড়া করছে। আমাকে তীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছে। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে ওই জিনিসটা।’

ধ্রুব এবারও হাইপার হয়ে কথাগুলো বললেন। তার এমন বিধস্ত অবস্থা দেখে আমি খানিকটা ভয় পেলাম। ওনার পাশে বসে ভয় জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম-

‘খুব খারাপ লাগছে আপনার? ডক্টর আনতে বলবো? কি হয়েছে বুকে? আগে তো কখনো এসব বলেননি। আর কি সব নাড়াচাড়া করার কথা বলছেন? কিসের ভারী ভয়ংকর জিনিস? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। একটু বুঝিয়ে বলুন না তুলতুলের আব্বু৷ আমার ভয় করছে।’

ধ্রুব সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ওনার ভাবভঙ্গি আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। কখনই বুঝতে পারি না। ধ্রুব তার মাথা হাল্কা উঁচু করে ক্ষীণ স্বরে বললেন-

‘বুঝিয়ে বলবো?’

আমি দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম। ধ্রুব এবার আধশোয়া হয়ে বসলেন। হাত নাড়িয়ে আমাকে কাছে ডেকে বললেন-

‘এদিকে আসুন। বুকে মাথা রেখে শুনুন।’

ধ্রুব অপেক্ষা করলেন না। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার মাথা ওনার বুকে চেপে ধরলেন। আমি অবাক হলাম। খানিকক্ষণ স্তব্ধ থেকে দারুণ আগ্রহ নিয়ে শুনলাম ওনার বুকের ধুকপুকানি। ওনার হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে। হয়তো কিছুটা দ্রুত গতিতে। তবে এটাই কি ওনার সমস্যা! আমি সরে আসতে চাইলেই ধ্রুব বাধা দিলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন শক্ত করে। নরম গলায় বললেন-

‘আমার বুকে বিশাল এক ভালোবাসার দলা পাকিয়ে গেছে। পাহাড় সমান ভালোবাসা অনুভব করছি। হঠাৎ করেই বুকের ভেতর এসে চেপে বসলো এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা। ভালোবাসা গুলো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। বুকের ভেতর চাপা থাকতে চাইছে না কিছুতেই না। ভালোবাসা ছাড়িয়ে দিতে চাচ্ছে সারা পৃথিবীতে। শহরের প্রতিটি অলিতে গলিতে। আর আমাদের সেই বেলি ফুল গাছটাতে। ফুল হয়ে ফুটতে চাচ্ছে ভালোবাসা। বৃষ্টির ফোটা হয়ে ঝড়তে চাচ্ছে। ধুয়েমুছে দিতে চাচ্ছে সকল বিষাদ আর অবসন্নতা।’

ধ্রুব থামলেন। নিরব হলেন কিছুক্ষনের জন্য। আমি স্তম্ভিত হলাম। বাকরুদ্ধ কর অবস্থা হলো আমার। বাহিরে দমকা হাওয়া বইছে। এলোমেলো বাতাস। আমার মন, মস্তিষ্ক সবটাই এলোমেলো হলো সেই বাতাসের মতো। ধ্রুব ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস ফেললেন। বিষন্ন গলায় বললেন-

‘ভালোবাসারা বুকের ভেতর থেকতে না চেয়ে আমায় তীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছে। অসহনীয় যন্ত্রণা। আমি অসহায় হয়ে পরেছি ভালোবাসার অত্যাচারে। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পরেছি। আপনার কি মনে হচ্ছে না এটা খুব ভয়ংকর একটা রোগ! আমার মনে হচ্ছে আমি এই রোগে-ই মারা যাবো। আমার বুকটা ফেটে যাবে। একটু যত্ন দরকার। আপনার উচিত ছিল একটু যত্ন নেওয়া। ভালোবাসা গুলো একটু আপনার আগলে রাখা প্রয়োজন ছিল।
একটু সামলে নেওয়া প্রয়োজন। পারবেন তো আমাকে বাঁচতে? আমার পারসোনাল বুকটাকে একটু আগলে রাখতে পারবেন আপনি!’

আমি কোনো জবাব দিলাম না। এই মূহুর্তে কিছু বলার মতো অবস্থা আমার নেই। গলার স্বর আটকে গেছে কণ্ঠনালীতে। আমার মস্তিষ্কের পুরোটা জায়গায় দখল করে নিয়েছে ধ্রুবর কথা গুলো। আমি ভাবতে লাগলাম তার বলা কথা। ওনার ভালোবাসা আগলে রাখার ক্ষমতা কি আমার আছে? আমি কি আদোও কারও ভালোবাসা যত্নে রাখার যোগ্য? জানি না এসব প্রশ্নের উত্তর। এই অনুভূতি গুলোকে অসহনীয় লাগতে লাগলো। ভীষণ অস্বস্তি বোধ করলাম আমি। শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরায় জেদ বয়ে গেল। রাগ হতে লাগলো নিজের উপর। আমি কারও ভালোবাসা আগলে রাখার ক্ষমতা রাখি না। যে আমার কাছে ভালোবাসা নিয়ে আসবে সে শুধুই কষ্ট পাবে। আমার দ্বারা মানুষ শুধুই কষ্ট পায়।

ধ্রুব হাল্কা হেসে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন-

‘আমার মনে হয় আপনি একটা শামুকের মতো। শামুক যেমন একটু নাড়াচাড়াতে নিজেকে খোলসের ভেতর লুকিয়ে নেয়। আপনিও ঠিক সেভাবেই নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাচ্ছেন। তবে সমস্যা নেই। আপনি শামুক হলে আমি আপনার খোলস হতে রাজি। নিজেকে লুকিয়ে নিতে চাইলে আমার মাঝেই লুকিয়ে নিতে হবে। অন্য কোথাও না। অন্য কারও সেই অধিকার নেই।’

ধ্রুব আমাকে ছেড়ে দিতেই আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। নিজেকেই এখন রুগী মনে হচ্ছে। ধ্রুবর বুকের ব্যথাটা যেন এখন নিজের মধ্যেই এসে পরেছে। বুক ধড়ফড় করছে তীব্রভাবে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। আমি ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। ধ্রুব বিছানা থেকে উঠে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-

‘আপনি পড়তে বসুন আমি শাকিল আর আব্বু-আম্মুর সাথে কথা বলে আসি। আমি এসেই আপনার সব পড়া চেক করবো। কাল সকালে আপনার এক্সাম তাই আজ এখানেই থাকবো।’

ধ্রুব হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে বসে থেকে বই নিয়ে পড়তে বসলাম।

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। ভেজা মাটির গন্ধ ছড়িয়ে পরলো চারপাশ। কানে শুধু ভাসতে লাগলো বৃষ্টির পাগল করা ছন্দ। অনুভূতিহীন আমি হঠাৎ করেই বৃষ্টির ছন্দে মাতাল হলাম। চেনা অচেনা সব অনুভূতিরা এসে ঝাপটে ধরলো আমায়। বৃষ্টিস্নাত এক গভীর রাত। ধ্রুব আমার হাত নিজের মুঠোয় আগলে নিয়ে এগিয়ে গেলেন বারান্দার দিকে। আমাকে পাশে নিয়ে দাঁড়ালেন রেলিঙের সামনে। বৃষ্টির ছাঁট আসছে গাঁয়ে। শীতল হাওয়ায় কাঁটা দিয়ে উঠছে সারা শরীর। দু’জনের মাঝে এক আকাশ সমান নিরবতা। মিনিট খানেক পর নিরবতা ভাঙে ধ্রুব অতি নিম্ন স্বরে বললেন-

‘এই মেঘাচ্ছন্ন আকাশ আর মুশলধারার বৃষ্টি দুটোই তোমার মতো স্নিগ্ধ। আমাদের মাঝের এই নিরবতা ঠিক তোমার চোখের মতোই গভীর। আর বাতাস!! সেটা তো তোমার মুগ্ধকরা চাহনির মতোই শীতল।’

আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম ধ্রুবর মুখের দিকে। কয়েকঘন্টা আগের সেই কথাগুলো আবারও মনে পরলো। হঠাৎ করেই ধ্রুবর এমন পরিবর্তন আমাকে বার বার অস্বস্তিতে ফেলছে। ধ্রুব তার মুগ্ধ দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করলেন। অত্যন্ত শীতল কন্ঠে থেমে থেমে বললেন-

‘সানসাইন! শুনো না একটা কথা বলছি। তোমাকে ভালোবাসি। হুম তোমাকে ভালোবাসি আমি। তোমাকে ভালোবাসার কারণটা জানি না। আর খুঁজতেও চাই না। ভালোবাসার নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পেলে ভালোবাসার তীব্রতা কমে যায়। মানুষটার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। আর হ্যাঁ আমি কিন্তু তোমাকে জোর করছি না আমাকে এত জলদি ভালোবাসতে। তুমি ধীরে ধীরে বুঝবে নিজের অনুভূতি তখনই আমায় ভালোবাসবে। হয়তো তোমার আগেই আমি বুঝে যাবো তোমার ভালোবাসা।’

আমি মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। ধ্রুব আমার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে গাঢ় স্বরে বললেন-

‘তুলতুলের সাথে কথা হয়েছে??’

আমি মিহি কন্ঠে বললাম-

‘হ্যাঁ ডিনার করার পরেই কথা হয়েছে।’

‘আচ্ছা এখন যান রুমে যেয়ে ঘুমিয়ে পরুন। সকাল সকাল উঠতে হবে।’

আমি মাথা নাড়িয়ে রুমের দিকে পা বাড়াতেই ধ্রুব পেছন থেকে ডাকলেন,

‘তুলতুলের আম্মু!’

আমি পেছন ঘুরে কৌতুহলী চোখে তাকালাম ওনার নির্লিপ্ত চোখের দিকে। ঠোঁটের কোণে তরল ভঙ্গির হাসি। মুখে বৃষ্টির পানি লেগে আছে। কি অদ্ভুতই না দেখাচ্ছে তাকে। আমার দিকে চেয়ে থেকে শান্ত গলায় বললেন-

‘আমার হতে হলে পুরোপুরি আমারই হতে হবে। সেখানে অতীতের বিন্দুমাত্র রেশ থাকবে না। আমি অপেক্ষা করতে রাজি তবে হার মানতে নয়।’

‘ধ্রুব ভাই আপনি জানেন অনুর যে পরিক্ষার হলে ফিট হয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে?’

ভাইয়ার কথা শুনে আমি জ্বলন্ত চোখে ওর দিকে তাকালাম। ভাইয়া পাত্তা দিলো না আমার চাহনি। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে ধ্রুবর দিকে। মুখে সয়’তানি হাসি। ভাইয়াকে আরও উৎসাহ দিয়ে ধ্রুব বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

‘ক্লাস ফাইভের সমাপনী পরিক্ষা দেওয়ার সময় ফিট হয়েছিল সেটা জানি। এখনও কি সেই অভ্যাস আছে??’

‘অবশ্যই আছে। কেন থাকবে না! এই যে এখনও যদি দুষ্টুমি করে একটা থাপ্পড় দেই দেখবেন কান্না করতে করতে বেহুশ হয়ে গেছে।’

ভাইয়া পুরো ড্রয়িং রুম কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। ধ্রুবও তাল মিলালো ভাইয়ের সাথে। তাদের এমন ঝংকার তোলা হাসি দেখে আমি রাগান্বিত গলায় বললাম-

‘ভাইয়া তুই কি থামবি নাকি আম্মুর কাছে বিচার দিবো?’

ভাইয়া মুখ বিকৃতি করে করে বলল-

‘দেখলেন ধ্রুব ভাই কিছু না বলতে কেমন শুরু করেছে।’

আমি রেগেমেগে কিছু বলবো তার আগেই ধ্রুব নিজের হাসি চেপে রেখে বললেন-

‘থাক শাকিল বাদ দাও। একটু পর এক্সাম এখন আবার কান্নাকাটি করলে সমস্যা।’

ধ্রুবর কথায় আমি তীক্ষ্ণ চোখে চাইলাম। ধ্রুব ঠোঁট চেপে হাসলেন। আমার রাগ পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে আমার হাত ধরে বেরিয়ে পরলেন ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। পুরো রাস্তা আমি আর কোনো কথা বলিনি। ভার্সিটিতে এসে আমি গাড়ি থেকে নামতেই ধ্রুব আমার পেছন পেছন আসলেন। আমার সাথেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন সানিয়ার জন্য। আমি কিছু বললাম না। বেশ খানিকটা সময় পর সানিয়া আসলো। ধ্রুবর সাথে কুশল বিনিময় শেষে ভার্সিটির ভেতরে চলে যাবো তখনই ধ্রুব আমার হাত ধরে নরম গলায় বললেন-

‘ঠিক মতো এক্সাম দিও। আর হ্যাঁ অন্য কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করো না। মনোযোগ দিয়ে লিখবে। নিজের উপর বেশি চাপ দিও না যতটুকু পারবে ততটুকুই লিখবে। আর হ্যাঁ সব কিছু নিয়েছো কিনা একবার দেখে নাও।’

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে ধ্রুবর কথা শুনলাম। আমার পাশ থেকে সানিয়া দুষ্টুমি করে বলল-

‘দুলাভাই আপনার বউ কিন্তু এর আগেও অনেক বার এক্সাম দিয়েছে। আর আপনি যেমন করছেন মনে হচ্ছে কোনো বাচ্চা এই প্রথম এক্সাম দিতে এসেছে।’

ধ্রুব খানিকটা বিব্রতবোধ করলেন। থতমত খেয়ে বললেন- ‘আচ্ছা যাও তোমরা দেরি হচ্ছে।’

সানিয়া এবারও ঠোঁট চেপে হেসে বলল-

‘দুলাভাই অনুর হাতটা না ছাড়লে যাবো কিভাবে? অবশ্য আপনি অনুর সাথে যেতে চাইলে আমি টিচারের সাথে কথা বলে দেখতে পারি রাজি হয় কি-না।’

ধ্রুব এবার ভীষণ লজ্জা পেলেন। ঝট করে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশে চোখ বুলালেন। দু হাত পকেটে গুজে জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়েই চলে গেলেন তিনি। আমি অপলক সেদিকেই চেয়ে থাকলাম। ধ্রুব কারো কথায় লজ্জা পায়, বিব্রতবোধ করেন এটাও আজ নতুন দেখছি৷ মানুষটাকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি।

‘দুলাভাই তোর অনেক কেয়ার করে তাই না অনু? তোর কি মনে হচ্ছে না তোর নেওয়া সিদ্ধান্তটাই ঠিক ছিল?’

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২২
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘তোর কি মনে হচ্ছে না দুলাভাইকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা তুই ঠিক নিয়েছিস! আমার কেন যেন মনে হচ্ছে দুলাভাই তোর জন্য পারফেক্ট। দুলাভাই-ই একমাত্র ব্যক্তি যে তোকে ভালো রাখতে পারবে।’

সানির কথার প্রতিত্তোরে আমি কিছুই বললাম না। নির্লিপ্ত চোখজোড়ার দৃষ্টি নামিয়ে একদম পায়ের কাছে এনে স্থির করলাম। আশেপাশের হৈচৈ আর সানির বলা একের পর এক কথা কোনটাই কানে এসে পৌঁছালো না। আমার মস্তিষ্কে চলতে থাকা চিন্তাধারা গুলো একটা জায়গায় এসে থমকে গেল। পৃথিবীর কেউ কারও জন্য পারফেক্ট নয়। কেউ কাউকে পুরোপুরি ভালো রাখতে পারে না। কেউ বিনাকারণে কাউকে ভালোবাসে না। প্রয়োজন ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই হয় না। কারণ ছাড়া একটা পাতাও নড়ে না। সব কিছুতেই কারণ আছে, স্বার্থ আছে। আচ্ছা ধ্রুবর ভালোবাসা কি সত্যি! আর সত্যি হলেও এই ভালোবাসার কারণ কি? আমার ভগ্নহৃদয়ের প্রতি সহানুভূতি? না-কি জোরজবরদস্তি হয়ে যাওয়া স্ত্রীকে মেনে নেওয়ার প্রচেষ্টা? হঠাৎ করেই কেন ভালোবাসা হলো? এত এত প্রশ্নের জবাব কে দিবে আমায়? ধ্রুব কি দিতে পারবে আমার সকল প্রশ্নের জবাব!
ক্লাসে রুমে এসে পা রাখতেই আমার মস্তিষ্ক স্থির হয়ে গেল। পরিবর্তন হলো আমার মন। বিশৃঙ্খল সকল চিন্তাভাবনা তালাবদ্ধ করে রাখলাম মনের মাঝে। মস্তিষ্কে পুরোটা জুড়ে শুধুই পরিক্ষা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। মনি মা’র কথা মনে পরতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। তার মেয়ে আমি। তার সব ইচ্ছে পূরণ করতে হবে আমাকে। মোহনা আপু না পারলেও আমাকে পারতে হবে। খুব মনোযোগ দিয়ে পরিক্ষা দিলাম। যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়েও ভালো লিখেছি পরিক্ষার খাতায়। ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেইটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার অবচেতন মন বলছে ধ্রুব আমাকে নিতে আসবে। আমি অপেক্ষা করলাম। একমিনিট, পাঁচ মিনিট, দশমিনিট অনেকটা সময় ধরেই অপেক্ষা করলাম। ধ্রুব আসলেন না। এমন কি ফোন করে কিছু জানালেনও না। আমি তবুও পথ চেয়ে রইলাম ধ্রুবর জন্য। সানি হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল। ক্লান্ত গলায় বলল-

‘দোস্ত চল না আমরা একাই চলে যাই। দুলাভাই বোধহয় আসবে না। শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় বল!’

সানি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে কিছু একটা ভাবলো। পরক্ষণেই উত্তেজিত হয়ে বলল-

‘কি অদ্ভুত! দুলাভাই আসবে কি-না তা ওনাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেই তো হতো৷ কি বোকা আমরা। এতক্ষণ কেন আসলো না এই বুদ্ধি! যাইহোক সময় নষ্ট না করে দুলাভাইকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস কর আসবে কি-না।’

আমি শান্ত চোখে সানির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘আমি কখনো ওনাকে নিজে থেকে ফোন দেইনি।’

সানি প্রচন্ডরকম অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। চোখের ছানা বড় বড় করে অবিশ্বাসের গলায় বলল-

‘তুই দুলাভাইকে নিজে থেকে ফোন দিস নি মানে কি? বিয়ের এতদিন হয়ে গেলো অথচ তুই দুলাভাইকে একবারও নিজে থেকে কল করিসনি?’

আমি প্রতিত্তোরে ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখলাম ভাইয়া আসছে। আমার সামনে এসেই হাঁটুতে দু’হাত ভর দিয়ে ঝুঁকে হাঁপাতে লাগলো। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল-

‘ওই রোডে প্রচুর জ্যামরে অনু। জানিস তোর জন্য কতটা পথ আমার হেঁটে আসতে হয়েছে!’

আমার সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম ভাইয়ার ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মুখের দিকে। দু-হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে সন্দিহান কন্ঠে বললাম-

‘আমি বলেছি তোকে আসতে?’

‘তুমি বলো নাই কিন্তু তোমার স্বামী মানে আমার ধ্রুব ভাইয়ের হুমুক তার মহারানীকে যেন আমি যত্নসহকারে কোলে করে বাসায় নিয়ে যাই।’

ভাইয়ার বিকৃতভাষ্য শুনে আমি জ্বলন্ত চোখে চাইলাম। পরক্ষনেই নিজের রাগ সামলিয়ে নিয়ে শান্ত গলায় প্রশ্ন করলাম-

‘উনি তোকে আসতে বলেছে কেন?’

‘আরে ধ্রুব ভাইয়ের-ই তো আসার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই নাকি জরুরী কাজ পরে গেছে তাই তো আমাকে ফোন করে বললো তোকে নিয়ে যেতে। এখন চল তাড়াতাড়ি। অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে হবে। সানি তুইও চল।’

ভাইয়া তৎক্ষনাৎ একটা অটোরিকশা থামিয়ে আমাদের নিয়ে উঠে পরলেন। বেশ খানিকটা পথ যেতেই তীক্ষ্ণ শব্দে আমার ফোন বেজে উঠল। আমি ফোন হাতে নিতেই স্কিনে ধ্রুবর ছবি আর তার নিচে স্পষ্ট একটা নাম ভেসে উঠলো ‘তুলতুলের আব্বু।’ নিজের অজান্তেই খানিকটা স্বস্তি বোধ করলাম।

‘কিরে ফোন রিসিভ করছিস না কেন!’

সানি আমার গায়ে হাল্কা ধাক্কা দিতেই আমি অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত ফোন রিসিভ করলাম। সাথে সাথেই ধ্রুব নিম্ন স্বরে বললেন-

‘সরি আমি আসতে পারিনি৷ আসলে হঠাৎ করেই একটা জরুরি কাজ পরে গিয়েছিল। তাই শাকিলকে বলেছি যেন আপনাকে নিয়ে আসে।’

‘ঠিক আছে সমস্যা নেই। আমি বুঝতে পারছি।’

ধ্রুব কিছুটা সময় নিশ্চুপ থেকে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলেন-

‘পরিক্ষা ভালো হয়েছে?’

আমি ছোট করে ক্ষীণ স্বরে বললাম ‘হ্যাঁ’।

‘এখন কি রাস্তায়?’

‘ হুম।’

‘শাকিল আছে সাথে?’

‘ হুম আছে।’

আমাদের কথার মাঝে আচমকাই ভাইয়া সামনে থেকে ধমকে উঠলো৷ রাগে চিড়বিড় করে বলল-

‘এসব কি ধরনের কথাবার্তা অনু! হ্যাঁ, হুম এসব কেমন কথা? আমার তো শুনেই বিরক্ত লাগছে ধ্রুব ভাইও নিশ্চয়ই বিরক্ত হচ্ছে। তুই কি লজ্জা পাচ্ছিস আমার সামনে কথা বলতে! অদ্ভুত ব্যাপার তো। আমি তো তোকে কখনও আমার সামনে লজ্জা পেতে দেখিনি।’

ভাইয়ার কথার সুর টেনেই সানি কৌতুক করে বলল-

‘নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে একটু আধটু লজ্জা পাওয়াটাই স্বাভাবিক শাকিল ভাই।’

এতক্ষন লজ্জা না পেলেও সানি আর ভাইয়ার কথায় এবার আমি সত্যি সত্যিই লজ্জা পেলাম। লজ্জাভাব আরও প্রখর হলো যখন ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে ধ্রুবর তরল ভঙ্গির হাসি শুনতে পেলাম। লজ্জায় লাল হতে লাগলাম আমি। ইচ্ছে করলো নিজেকে আড়াল করে নেই সব কিছু থেকে। কিন্তু এটা সম্ভব না কিছুতেই না। ধ্রুব নামক এই নির্লিপ্ত মানুষটার কারনেই প্রতিদিন নতুন নতুন অনুভূতির সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করতে হবে।

বিষন্নতার চাদরে মোড়ানো রাতের আকাশ। ধূসর কালো মেঘগুলো ভাসছে বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। প্রবলবেগে বইছে বৈশাখের ঝোড়ো হাওয়া। আকাশের দিকে উদাসীন চোখে চেয়ে আনমনেই ভাবতে লাগলাম ধ্রুব এখন কি করছে? তিনিও কি আমার মতোই এই বিষন্ন আকাশ দেখছে? ওনাকেও কি ছুঁয়ে দিচ্ছে এই বিশৃঙ্খল বাতাস? ভীষণ এলোমেলো হয়ে আছে আমার মন। কাল দুপুর থেকে ধ্রুবর সঙ্গে একবারও কথা হয়নি। ধ্রুব ফোন দেয়নি আর আমিও ফোন করে ওনার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করিনি। মনি মা’র কাছেও লজ্জায় কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। সব কিছুতেই যেন একটা দ্বিধাবোধ কাজ করে। ইচ্ছে করলেও সব ইচ্ছে পূরণ করতে মন সায় দেয় না। দ্বিধাবোধ আর অস্বস্তিতে বাধা পরে যায় সকল ইচ্ছে। ফোনের রিংটোনের শব্দে আমার ভাবনায় ছেদ পরলো। ক্ষীণ বিরক্তি নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। ধ্রুব ফোন করেছে। খানিকক্ষণ স্থির চেয়ে থাকলাম স্কিনের দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করে কানের কাছে ধরলাম। ফোনের অপরপ্রান্তের মানুষটা নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন-

‘আমি অপেক্ষা করছি। দু মিনিটের মধ্যে বাহিরে আসুন।’

আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ধ্রুব লাইন কেটে দিলেন। আমি হতভম্ব হয়ে ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পুরো বিষয়টা যেন মাথার উপর দিয়ে গেল। এই রাতের সময় বাহিরে কিভাবে? আর উনি অপেক্ষা করছেন মানে কোথায় অপেক্ষা করছেন? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ধ্রুবর সতর্কবার্তা এসে পৌঁছালো আমার ফোনে। ‘এক মিনিট বাকি জলদি আসুন।’ ধ্রুব মেসেজ দেখেই আমি হড়বড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। ড্রয়িং রুমে কাউকে না দেখে পা টিপে চুপিচুপি বেরিয়ে এলাম বাসা থেকে। গেইটের কাছে আসতেই গাড়ি নিয়ে ধ্রুবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। দু হাত পকেটে গুঁজে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার শান্ত শীতল মুখশ্রী। আমি ওনার দিকে এগিয়ে এসে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলাম-

‘ভেতরে না এসে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আর আমাকেই বা বাহিরে আসতে বললেন কেন?’

ধ্রুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে হাত বের করে তার এলোমেলো চুলে নিখুঁত কাজ চালিয়ে দিলেন। সুন্দর করে চুল গুলো গুছিয়ে নিয়ে আমার প্রশ্ন পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে বললেন-

‘ Let’s go’

‘কোথায় যাবো?’

আমার প্রশ্নে ধ্রুব খুব সহজ গলায় বললেন-

‘আমি যেখানে যাবো সেখানেই।’

আমি ভ্রু কুচকে ফেললাম। ওনার কথায় নাকোচ করে বললাম-

‘আমি কোথাও যাবো না। আমার ইচ্ছে করছে না। বাসায় কেউকে বলে বের হইনি।’

ধ্রুব বাঁকা হাসলেন। অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন-

‘আপনার ইচ্ছে না করলেও যেতে হবে। if i call you, you have to be there.’

আমি আগের মতোই ভ্রু কুচকে বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ধ্রুব বোধহয় কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেন। কড়া গলায় বললেন-

‘যা বলেছি তা করুন। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসুন তুলতুলের আম্মু।’

আমি যন্ত্রের মতো চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলাম। ধ্রুবও বসলেন। আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বললেন-

‘সিট বেল্ট লাগিয়ে নিন।’

ধ্রুবর কথা মতোই আমি সিট বেল্ট লাগিয়ে নিলাম। গাড়ি চলছে। এলাকার গলি পেড়িয়ে চলে এলো অন্য রাস্তায়। আমি কিছুটা ইতস্তত করে বললাম-

‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? আর বাসায় এসে ভেতরে যান নি কেন? আম্মু আমাকে না পেয়ে চিন্তা করবে তো।’

‘বউয়ের সাথে প্রেম করতে এসেছি। এতে আমার বোকাসোকা শ্বাশুড়ি ভিলেন হবেন বলে তো মনে হয়না।’

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৩
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘বউয়ের সাথে প্রেম করতে এসেছি৷ এখানে আমার বোকাসোকা শ্বাশুড়ি ভিলেনের রূপ নিবে বলে তো মনে হচ্ছে না। উনি আমাকে আপনার চেয়েও বেশি ভালোবাসে যেমনটা আমার মা আপনাকে ভালোবাসে। তাই ভালোবাসায় ভালোবাসায় কাটাকাটি।’

ধ্রুবর মুখে অমায়িক হাসি। কত সহজ সরল ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছেন। রাত নয়টা বাজে কাউকে কিছু না বলেই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। আমাকে বাসায় না পেয়ে সবাই অস্থির হবেন কি-না এতে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি তপ্ত শ্বাস ফেলে ম্লান কন্ঠে বললাম-

‘বাসার ভেতরে যাননি কেন?’

ধ্রুব ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে চেয়ে অদ্ভুত ভাবে হাসলেন। গলার স্বর নামিয়ে মিনমিনিয়ে বললেন-

‘আসলে আমার লজ্জা লাগছিল। বউয়ের সাথে দেখা করতে প্রতিদিন শ্বশুর বাসায় যাওয়া ব্যাপারটা খুবই লজ্জাজনক মনে হচ্ছে। তা ছাড়া এসব দেখলে সবাই তো আমাকে বউ পাগল বলবে যা মোটেও আমার ক্যারেক্টারের সাথে যায় না।’

ওনার কথা শুনে আমার ভীষণ হাসি পেল। আমি মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলাম। কোনো রকম নিজের হাসি লুকিয়ে চাপা কন্ঠে বললাম-

‘অহহ আচ্ছা! শ্বশুর বাসায় বউয়ের সাথে দেখা করতে যাওয়া লজ্জাজনক ব্যাপার!! আর এখন যে কাউকে না জানিয়ে বউকেই তুলে নিয়ে যাচ্ছেন তার বেলায় কি? এটা তো আরও ভয়াবহ ব্যাপার। এটা কি বুঝতে পারছেন?’

ধ্রুব অবাক চোখে আমার দিকে তাকালেন। পরক্ষনেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললেন-

‘বিয়ের আগে প্রেম করার শখ বিয়ের পর মেটাচ্ছি এর জন্য একটু আধটু ভয়াবহ কাজ তো করতেই হবে। আমার আবার বীরপুরুষ টাইপ প্রেমিক হওয়ার ইচ্ছে ছিল। এখন না হয় প্রেমিকের জায়গায় বীর স্বামী হলাম তাতে ক্ষতি কি!’

আমি অবাক হলাম। বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলাম ধ্রুবর দিকে। কি বলছেন এসব? মানুষটা কি পাগল হয়ে গেছে না-কি! একবার লজ্জায় লাল হচ্ছে আবার কি সব সাংঘাতিক প্রেম প্রেম কথা বলছেন। নির্ঘাত মাথার তার ফার সব ছিঁড়ে গেছে। নাহলে এমন হলেন কি করে?

‘এই রেস্টুরেন্টের কথা মনে আছে আপনার?’

ধ্রুবর কথায় আমি ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলাম। ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালাম৷ আনমনা হয়ে বললাম-

‘হ্যাঁ বিয়ের আগে আপনার সাথে দেখা করেছিলাম এখানে।’

আমার কথার বিনিময়ে তিনি মৃদুস্বরে হাসলেন। গাড়ি রাস্তার একপাশে থামিয়ে আমার দিকে ঘুরে বসলেন হাসি হাসি মুখে। খানিকক্ষণ রেস্টুরেন্টের দিকে চেয়ে থেকে শান্ত গলায় বললেন-

‘সেদিন আম্মু আমাকে একপ্রকার জোর করেই আপনার সাথে দেখা করতে পাঠিয়েছিল। আমি রেস্টুরেন্টের এই জানালার পাশেই বসে ছিলাম। রাস্তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিলাম অনাকাঙ্ক্ষিত এক মানুষের। ভেবেছিলাম এত এত বছর আগে দেখা সেই ছোট্ট পিচ্চি মেয়েটা হয়তো বিচ্ছেদের দাহনে পুড়ে বিষন্ন, উদাসীন এক রমনীতে পরিনত হয়েছে। তখন হঠাৎ করেই রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মায়াকাড়া চেহারার এক শ্যামলতার দিকে নজর পরে৷ যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। খুবই বিধস্ত লাগছিল তাকে। আচমকাই একটা বাচ্চা দৌড়ে যাওয়ার সময় তার সাথে ধাক্কা লেগে নিচে পরে যায়। সেই বিষন্ন রমনী খুব মমতার সঙ্গে বাচ্চাকে তুলে দেয়৷ কি যেন কথা বলছিল বাচ্চাটার সঙ্গে। কথার মাঝে হঠাৎ করেই হাসি ফুটলো তার সেই উদাসীন মুখে। রাতের আকাশে থাকা ধ্রুব তারার মতোই ঝলমলে ছিল ওই হাসি৷ একদম তীরে মতো এসে বিধেছিল আমার বুকে। চিনচিনে ব্যথা অনুভব করেছিলাম বুকের বা পাশটায়। খানিকটা সময়ের জন্য থমকেও গিয়েছিলাম। পরমুহূর্তে সেই হাসিটাও থমকে গিয়েছিল। ভীষণ আফসোস হয়েছিল হাসিটা মিলিয়ে যেতে দেখে। আবারও সেই মনমরা মুখ। ঘন আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে গেল সেই হাস্যজ্বল চেহারা। যখন আমার কাছে এসছিল মেয়েটা তখন একদমই ভিন্ন লাগছিল তাকে। চোখে মুখে বিষাদের ছায়া। ঝলমলে চোখ দুটোর নিচে জমানো কালি গুলো নির্ঘুম রাত কাটানোর জানান দিচ্ছিলো। মন খারাপ হয়েছিল ভীষণ।’

ধ্রুব থামলেন। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইলেন সেই রেস্টুরেন্টের দিকে চেয়ে। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বিস্ময়ে বড় হয়ে যাওয়া চোখ দুটো দিকে ধ্রুবর শান্ত শীতল মুখখানা দেখলাম। উনি আমার প্রতিটি বিষয় এতটা নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তা আমার ভাবনার মধ্যেই ছিল না। তাহলে কি উনি সত্যিই আমায় ভালোবাসেন!
আমি নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক করে জিজ্ঞেস করলাম-

‘আপনি আমায় ভালোবাসেন কেন? হঠাৎ এই ভালোবাসার কারণ কি?’

ধ্রুব বরাবরের মতোই তার সহজাত তরল ভঙ্গির হাসি দিলেন। তার শান্ত শীতল চাহনি স্থির করলেন আমার কৌতূহলী চোখের দিকে। কোনো কথা না বলেই গাড়ি নিয়ে ফিরে এলেন বাসার পথে। গেইটের কাছে গাড়ি থামতেই আমাকে বললেন-

‘নামুন। বাসায় এসে পরেছি।’

আমি গাড়ি থেকে নামলাম। আমার সাথে সাথে ধ্রুবও তার সিট থেকে নেমে এলেন গাড়ির বাহিরে। আমার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত নরম সুরে বললেন-

‘আমি ঠিক করেছিলাম আমি তোমার মুখের হাসি দেখতে চাই। তোমার জন্য নয় আমার নিজের জন্য। সেদিনের মতোই আমি বার বার তোমার হাসি দেখে থমকে যেতে চাই। বুকের সেই চিনচিনে ব্যথাটা অনুভব করতে চাই৷ নিজেকে মুগ্ধ করার জন্য হলেও তোমার হাসিটা আমার খুব প্রয়োজন। আর আমি তোমাকে চাই আমার নিজের স্বার্থের জন্য। আমি তোমাকে ভালোবাসি নিজের জীবনটাকে পরিপূর্ণ করার জন্য। তোমার ঠোঁটের হাসি সারাজীবন দেখার জন্য। সবটাই চাই আমার নিজের জন্য এটাই হলো তোমাকে ভালোবাসার কারণ। বুঝলে সানসাইন?’

আমি মূর্তি ন্যায় থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। কি অদ্ভুত এক অনুভূতি। নিজের স্বামীর মুখে এমন সব কথা শুনেও যেন অস্বস্তি হচ্ছে। লজ্জা লাগছে। তার চেয়েও বেশি হচ্ছি অবাক। মানুষটা এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে! কাউকে ভালোবাসার কারণ কি আদোও এসব হতে পারে? আমাকে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব দু হাত বাড়িয়ে সহজ গলায় বললেন-

‘তুলতুলের আম্মু! আসুন তো আমাকে একটা টাইট হাগ দিন। তুলতুল পাখি হয়তো অপেক্ষা করছে কখন আমি গিয়ে আপনার পক্ষ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরবো সে জন্য। আসুন আসুন জলদি আমাকে জড়িয়ে ধরুন। নাহলে শ্বশুর বাড়ির কেউ দেখে ফেললে আমার লজ্জায় পরতে হবে।’

ধ্রুব জোর করেই আমাকে টেনে নিলেন তার বুকে। আমি হাল্কা কেঁপে উঠলাম। অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল সারা শরীরে। অনুভূতিরা সব পাল্লা দিয়ে বিশৃঙ্খল ভাবে ছুটে চলল আমার মস্তিষ্কে। অসাড় হয়ে এলো শরীর। ধ্রুর বুকের ধুকপুকানি শুনে যেন আরও বেশিই চমকে গেলাম। বরফের ন্যায় জমে যেতে লাগলাম আমি। ধ্রুব আমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বললেন-

‘তোমাকে ভালোবাসার তৃষ্ণা আমার কখনোই মিটবে না সানসাইন। আমার হৃদ স্পন্দ আমার বেঁচে থাকার জন্য যতটা জরুরি ঠিক ততটাই জরুরি তোমাকে ভালোবাসা। আমার পারসোনাল বুকের ভাড়া হিসেবে আমার তোমাকেই প্রয়োজন। আমার পারসোনাল বুকটা শুধু তোমার জন্যই বরাদ্দ। এখানে শুধু মাত্র তুমি আর তোমার ভালোবাসারা থাকবে। তোমার অতীত, তোমার বিষন্নতা, তোমার কষ্ট সব কিছু আমি মুছে দিতে চাই আমার ভালোবাসা দিয়ে। তুমি এখন আমাকে ভালো না বাসলেও আমার বিশ্বাস একটা সময় তুমি ঠিক আমায় ভালোবাসবে। আমার চেয়েও বেশি আমায় ভালোবাসবে।’

‘কিরে অনু! তুই এতো রাতে বাইরে থেকে আসলি কীভাবে?’

আম্মুর কথা শুনেই আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম৷ ভয়াতুর চোখে আম্মুর দিকে পিটপিট করে তাকালাম। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছেন আমার দিকে। আমার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। আম্মুকে কি জবাব দিবো তার উত্তর হাজার ভেবেও খুঁজে পেলাম না। ধ্রুবর সঙ্গে বাহিরে গিয়েছিলাম বলাও ঠিক যুক্তিযুক্ত মনে হলো না। খুবই লজ্জার ব্যাপার বলেই মনে হলো। আর কোনো মিথ্যা কথা কিংবা বাহানাও খুঁজে পাচ্ছি না। প্রচন্ড রাগ লাগছে ধ্রুবর উপর। নিজে তো চলেই গেল অথচ আমাকে এই পরিস্থিতিতে ফেলে গেল।

‘অনু আমার সাথে ছাদে গিয়েছিল মা।’

ভাইয়ার কন্ঠ শুনে আমি পেছন ফিরে দরজার দিকে চাইলাম। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আম্মুর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভাইয়া। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই আম্মু ধমকে উঠলেন। তিক্ত গলায় বললেন-

‘ এত রাতে ছাদে কি প্রয়োজন? খেয়েদেয়ে কি তোদের কোনো কাজ নাই? রাত-বিরেতে ভূত-পেত্নীর মতো ছাদে ঘুরাঘুরি করছস। এসব কি ধরনের বাজে অভ্যাস?’

‘আহহ মা আমরা তো আর প্রতিদিন ছাদে যাই না। আজকেই তো গেলাম। এখানে এত রাগার কি আছে? এখন যাও খাবার দাও আমরা আসছি।’

ভাইয়ার কথা গুলো বলতে বলতেই সোফায় গাঁ এলিয়ে দিলো। আম্মু তীক্ষ্ণ চোখে আমাদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে রাগে গজগজ করে রান্নাঘরে চলে গেলেন। ভাইয়া তৎক্ষনাৎ উঠে আমার কাছে আসলো। আমার মাথায় চড় দিয়ে চাপা কন্ঠে বলল-

‘নিজের আপন জামাইয়ের সাথেও লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করতে যাওয়া লাগে আপনার? আমি যদি ছাদ থেকে আপনাদের রোমান্টিক সিন না দেখতাম তাহলে আপনাকে কে বাঁচতো আম্মুর এসব বিরতিহীন প্রশ্ন থেকে?’

অন্য সময় হলে হয়তো আমার মাথায় চড় দেওয়ার বিনিময়ে ভাইয়াকে আরও দশটা চড় খেতে হতো। কিন্তু আজ লজ্জায় আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। ছিঃ কি বিব্রতকর পরিস্থিতি। আর ভাইয়াও কিভাবে লাগামহীন ভাবে কথাগুলো বলে ফেলল। নিজের ছোট বোনকে এসব বলতে কি তার একটুও লজ্জা লাগলো না? হা’রামি একটা। নির্লজ্জ। সবটাই হিয়েছে ধ্রুবর সঙ্গ পেয়ে৷

‘যা সর। আমার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমনে লজ্জায় লাল নীল হওয়া লাগবে না তোর। রুমে গিয়ে ফ্রশ হয়ে আয় ডিনার করবি।’

আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে এলোমেলো ভাবে পা ফেলে রুমে চলে আসলাম। ধ্রুবর বলা প্রতিটি কথা মাথার মধ্যে ঘুরছে। ওনার কথা ভেবে ফাঁকা রুমেই লজ্জা পেলাম আমি। ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও চলে যাই নিজের লজ্জা নিয়ে। আচমকাই তীক্ষ্ণ শব্দে আমার ফোন বেজে উঠলো। ভাবনার মাঝেই কেঁপে উঠলাম আমি। হুশ ফিরতেই শুকনো ঢোক গিলে অপ্রস্তুত হয়ে ফোন রিসিভ করলাম।

চলবে…