— ‘যদি অন্যায় না ই হয়ে থাকে, তাও আমি জানতে চাই নামটা, বলো।’
— ‘আই অ্যাম সরি স্যার, আমি বলতে পারব না।’
— ‘বেশ, বলবে না তো? আমি তাহলে নিজেই খুঁজে বের করব তাকে।’
— ‘আমি যদি তার নাম না বলি, আপনি কোনোদিন তাকে খুঁজে বের করতে পারবেন না, দেশের সব পুলিশকে লাগালেও না।’
— ‘ওকে ফাইন, এতই যখন জানো তাহলে নিজেই বলো নামটা।’
অভিনন্দার নীরবতা আরও রাগিয়ে দেয় ঐশিককে, ও রাগের মাথায় চেঁচিয়ে ওঠে, ‘অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছ তুমি আমার, এবার তোমায় বলতেই হবে! আমি তোমার বস, আমি অর্ডার…..’
— ‘সরি স্যার, আপনি আর আমার বস নন, আমি রিজাইন দিচ্ছি’, বলেই ঘরের দেওয়ালে থাকা একটা তাক থেকে রেজিকনেশন লেটারটা ঐশিকের হাতে ধরিয়ে দেয় ও।
ঐশিক লেটারটা পড়েও দেখল না, ছিঁড়ে কুচি কুচি করে দিয়ে বলল, ‘তোমার রিজাইন আমি অ্যাক্সেপ্ট করছি না, গট ইট? এইবার বলো!’
— ‘আচ্ছা স্যার, আমার জায়গায় যদি অন্য কোনো এমপ্লয়ির সাথে এই ঘটনা ঘটত, আপনি কি একই কাজ করতেন? নিজের সব কাজকর্ম ফেলে তার বাড়িতে ছুটে যেতেন?’
— ‘আমি জানিনা, সত্যিই জানিনা। হয়ত যেতাম, বা হয়ত যেতাম না, আই ডোন্ট নো!’
— ‘যেতেন না স্যার। আপনার মনে হচ্ছে না একজন অতি সাধারণ এমপ্লয়িকে আপনি বড্ড বেশি ইম্পর্ট্যান্স দিচ্ছেন?’
— ‘হ্যাঁ যদি সেটাই করে থাকি তাহলে বেশ করেছি! তুমি একদম কথা ঘোরানোর চেষ্টা করবে না!’ অভিনন্দাকে চেপে ধরে ঐশিক, ‘তোমার মুখ থেকে উত্তর না নিয়ে তো আমি ফিরছি না!’
এইবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না ও, অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে অভিনন্দা, ‘আপনি শুনতে চান তো আমার হবু সন্তানের বাবার নাম? তাহলে শুনুন, সে আর কেউ নয়, তার নাম ঐশিক রায়চৌধুরী, আপনি!’
অভিনন্দার মুখ থেকে এই উত্তর একেবারেই আশা করেনি ঐশিক। হঠাৎ যেন শক লাগার অনুভূতি হয় ওর, অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘কি বললে?’
নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ধরা গলায় ও প্রশ্ন করে অভিনন্দাকে, ‘কিন্তু কিভাবে হল এসব? আমার তো কিছু….’
— ‘এইজন্যই বারবার বললাম স্যার, এই প্রশ্নের উত্তরটা আপনার না জানাই মঙ্গল, কিন্তু আপনি তো না শুনে ছাড়বেনই না! শুনুন স্যার, সেদিনের ঘটনাটা আপনার মনে থাকার কথাও নয়!’
— ‘কেন?’
— ‘বলব স্যার, সবটাই বলব। আপনার নামটা যখন আমাকে বলিয়েই ছেড়েছেন তখন বাকিটা তো বলতেই হবে আপনাকে, তবে আপনি বিশ্বাস যদি না করেন তাহলে অবশ্য আমার কিছুই করার নেই।’
ঐশিক অভিনন্দার কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘আমি ব্যবসায়ী অভিনন্দা, মানুষের চোখ দেখে বলে ফেলতে পারি সে সত্যি বলছে না মিথ্যে। তুমি যে একটা কথাও মিথ্যে বলছ না সে আমি বুঝতে পারছি।’ ঐশিক বলে যায়, ‘আর কিছু আড়াল কোরো না আমার কাছে, প্লিজ সবটা খুলে বলো!’
— ‘জানেন স্যার, আপনি যদি আপনার নামটা শুনে আমায় অবিশ্বাস করে এখান থেকে চলে যেতেন, তাহলে অনেক বেশি খুশি হতাম আমি, কিন্তু আমি নিরুপায়, আমাকে এখন সবটা বলতেই হবে। স্যার আপনার মনে আছে, সেই মাসতিনেক আগের কথা, যেদিন আপনি জানতে পেরেছিলেন গীতালি ম্যাডামের একটা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক আছে তন্ময় বলে একজনের সাথে?’
— ‘হ্যাঁ, মনে থাকবে না আবার? গীতালি যে একজন স্বার্থপর, অহংকারী কেয়ারলেস মানুষ সেটা আমি জানতাম, জানতাম যে এইসব ভালোবাসা, সম্পর্ক এসবের কোনও মূল্য নেই ওর কাছে, টাকাটাই সব ওর কাছে, কিন্তু তাই বলে ও যে এইভাবে অন্য একজন পুরুষের সাথে নোংরা সম্পর্কে জড়াবে এটা আমার কাছে আনএক্সপেক্টেড ছিল সত্যিই, আর সেই দিনই আমার জীবনের সেই অভিশপ্ত দিন, যেদিন আমি ফার্স্ট টাইমের জন্য ড্রিংক করি। সেদিন তুমিই তো ড্রাইভ করে আমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলে, না? পরেরদিন সকালে মা আমায় বলেছিল, যদিও আমার কিছুই মনে ছিল না।’
— ‘হুম স্যার, শুধু ড্রিংক করেন ই নি, সেদিন আপনি ড্রিংক করে গাড়িও চালিয়েছিলেন যেটা অত্যন্ত অন্যায় করেছিলেন আপনি।তখন রাত্রি নয়টা কি সাড়ে নয়টা হবে, অফিস থেকে সবাই বেরিয়ে গেছে, শুধু সিকিওরিটি গার্ডরা ছাড়া। আমি সেদিন অফিসের দিকে একটা শপিং মলে এসেছিলাম কিছু কেনাকাটা করতে, হঠাৎ দেখি আপনার গাড়িটা ভীষণ স্পিডে অফিসের দিকে ঢুকছে। ভীষণ অবাক হয়ে যাই আমি, এই সময় তো আপনার অফিসে থাকার কথা নয়! তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে দেখি, আপনি গাড়ি থেকে নেশার ঘোরে টলতে টলতে নামছেন, আমায় দেখেই আপনি একগাল হেসে বললেন, ‘আরে অভিনন্দা ম্যাডাম, তুমি এখানে? তোমায় অনেক কথা বলার আছে আমার, এসো কেবিনে এসো’, বলেই আমার হাত ধরে আমায় নিয়ে আপনার কেবিনে গেলেন। গোটা অফিস খাঁ খাঁ করছে, একটাও জনমানব নেই, সেই বীভৎস শূন্যতায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আপনার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সদ্য মন ভাঙার শ্লেষের হাসি। চোখে জল, অথচ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিলেন আপনি। ওই অবস্থাতেই মোবাইল খুলে তন্ময়ের আপনাকে পাঠানো তন্ময় আর গীতালি ম্যাডামের ঘনিষ্ঠ ছবিগুলো দেখালেন আমায়, সেই সাথে তন্ময় আর গীতালি ম্যাডামের মেসেজের স্ক্রিনশটগুলো। এইসব পাঠিয়ে তন্ময় আপনাকে লিখেছেন, ‘ঐশিকবাবু, গীতালিকে এইবার ডিভোর্সটা দিয়েই দিন, বুঝলেন? আর কেন আমার জিনিসটাকে নিজের কাছে রাখছেন জোর করে?’ স্যার জানেন, আপনাকে ওইভাবে কাঁদতে দেখে আমিও আটকাতে পারিনি নিজেকে, আমার চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পড়েছিল অজান্তেই। তারপরেই আপনি আমায় কাছে টেনে নেন।’
এই পর্যন্ত বলে অভিনন্দা থামল। চোখটা বন্ধ করে ফেলল, গালদুটোও ভিজে গেল অজান্তে।
ঐশিকের গালদুটোও ভিজেছিল। অনেকক্ষণ ঘরে এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল, ঐশিকই নিস্তব্ধতা ভাঙল।
— ‘তোমার সাথে যা হয়েছে অভিনন্দা, সেটা অন্যায়ই, আর আমি কালপ্রিট। কিন্তু অভিনন্দা, তুমি আমায় বাধা দিলে না কেন সেদিন? বাধা দিলে কি আমি তোমার চাকরিটা কেড়ে নিতাম? এতটাও খারাপ মানুষ বোধহয় আমি নই।’
— ‘স্যার, এই উত্তরটাও আমাকে দিয়েই বলাবেন? বেশ শুনুন’, কিছুক্ষণ থেমে অভিনন্দা বলতে থাকে, ‘আসলে স্যার, আপনাকে আমি বরাবরই ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম। আসলে আপনার মতো মানুষ তো কমই দেখেছি জীবনে, এত বড়োলোক, উচ্চশিক্ষিত, তবু অহংকারের লেশমাত্র দেখিনি কখনো আপনার মধ্যে। সবসময় সততা আর নিষ্ঠা দিয়েই কাজ করে গেছেন, কখনো বাঁকা পথে ওপরে উঠতে চাননি আপনি। সব মিলিয়ে এক অপার মুগ্ধতা ছিল আপনার প্রতি, সেই মুগ্ধতা আর শ্রদ্ধাই যে কবে ভালোবাসায় বদলে গেছে আমি নিজেই বুঝিনি কখনো। যাকে ভালোবাসি, তাকে বাধা কিভাবে দিই বলুন তো?’ একটু থেমে অভিনন্দা বলল, ‘সবসময় চেয়েছি আপনি সুখী থাকুন, গীতালি ম্যাডাম যেন আপনাকে বোঝেন। আমি জানতাম, আপনি যদি আমার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে সব সত্যিটা জানতে পারেন, তাহলে কিছুতেই চুপচাপ বসে থাকবেন না, আর তাই তো আপনাকে অ্যাভয়েড করে গেছি এই ক’দিন। আমি কোনোদিনই চাইনি আমার জন্য আপনার সংসারটা ভেঙে যাক।’
— ‘মানে কি স্যার? আমার কি এমন রোগ হয়েছে যে অফিস যেতে পারব না আমি?’
— ‘অভিনন্দা আমি তোমার বস, আমার মুখের ওপর কথা বলার সাহস দেখিও না। আমি বলছি, আগামী সাতদিন যেন তোমার মুখটা অফিসে না দেখি! এটা আমার অর্ডার।’ রাগী স্বরে বলে ওঠে ঐশিক।
— ‘অভিনন্দা মা, এই ফ্ল্যাটে তো তুই একাই থাকিস, শরীরের এই অবস্থায় এখানে থাকবি? তার চেয়ে বরং তুই আমার সাথে আমাদের বাড়িতে চল, ওখানে থাকলে আমরাও নিশ্চিন্ত থাকি।’
— ‘এই কথাটা যে আমি ভাবিনি মা তা নয়, কিন্তু ওই বাড়িতে থাকলে ওকে প্রতিনিয়ত অপমানিত হতে হবে, আর কার জন্য হতে হবে সেটাও নিশ্চয় তোমার অজানা নয়!’
— ‘হ্যাঁ, এটা অবশ্য তুই ভুল বলিসনি বাবা।’
— ‘আর এই যে অভিনন্দা, তোমায় বলছি, ফোন করলে বা মেসেজ করলে দয়া করে সেগুলোর রেসপন্স কোরো।’ বলেই গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেল ঐশিক।
— ‘আসলে তোকে নিয়ে খুব টেন্সড ছিল তো ও, তাই এইভাবে রেগে গেছে। এখন তুই ওর রাগটা সামলে নিস মা।’ বলেই তৃষা বেরিয়ে গেলেন।
কেটে গেল আরও বেশ কয়েকদিন। একদিন ঐশিক তৃষাকে বলল, ‘মা, আমি অভিনন্দার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। ও না তো আমার ফোন ধরছে, না মেসেজের রিপ্লাই করছে। অফিসেও আসছে না, আর ফ্ল্যাটে তালা ঝুলছে। ওর গ্রামের বাড়ির ঠিকানাটা অফিস থেকেই পেয়ে গেছি আমি, আজ ওখানেই যাচ্ছি আমি।’
শহর থেকে প্রায় তিনঘন্টা ড্রাইভ করে ঐশিক পৌঁছল অভিনন্দাদের গ্রামে, তারপর ঠিকানাটা গ্রামের মানুষদের জিজ্ঞেস করে অভিনন্দার বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল ও।
— ‘স্যার আপনি? আসুন আসুন, ভেতরে আসুন।’ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অভিনন্দার মা বাবা।
— ‘অভিনন্দা বাড়িতে আছে?’
— ‘হ্যাঁ স্যার, ওই তো ওর ঘরেই আছে। আর বলবেন না স্যার, দুদিন হল বাড়িতে ফিরেছে, কিন্তু ফিরে থেকেই ওর মুখে হাসি নেই, আমাদের সাথে ঠিক করে কথা পর্যন্ত বলেনি, ঠিক করে খাচ্ছে দাচ্ছে না, শুধু সারাদিন দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে বসে থাকে চুপচাপ, আর কি যে আকাশকুসুম ভাবে কিছুই বুঝি না!’ অভিনন্দার মা বলেন।
— ‘শুধু কি তাই? এসে থেকেই নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখেছে, বাড়ির বাইরে পর্যন্ত বেরোয়নি।’ অভিনন্দার বাবা বললেন।
— ‘হুম, ওর ঘরটা কোন্ দিকে?’
ঐশিক অভিনন্দার ঘরের সামনে গেল। ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, ঐশিক নক করল।
— ‘মা, প্লিজ যাও!’ ভেতর থেকে শোনা গেল অভিনন্দার গলা, ‘আমার খিদে নেই, কিচ্ছু খাবো না আমি!’
— ‘অভিনন্দা আমি ঐশিক রায়চৌধুরী, দরজাটা খোলো।’
— ‘স্যার আপনি? আপনি কেন এসেছেন স্যার?’
— ‘তার আগে বলো তুমি কি দরজার বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে আমায়?’
অভিনন্দা এসে দরজাটা খুলল।
ঐশিক ঘরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপরেই বলল, ‘তুমি কেন এরকম আচরণ করছ সেটা আমার জানা’, বলেই অভিনন্দার মেডিকেল রিপোর্টটা ও ধরল ওর সামনে।
অভিনন্দা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। ঐশিক বলে যেতে লাগল, ‘তুমি অনেক আগেই পেয়ে গেছ রিপোর্টটা, আবার ডাক্তারবাবুকে অনুরোধও করেছ যেন আমায় এই ব্যাপারে কিছুই না জানানো হয়, কিন্তু তুমি বোধহয় জানোনা যে ডাক্তারবাবু আমার বাবার বিশেষ বন্ধু, তোমার অনেক আগে থেকে উনি আমায় চেনেন, তাই একটু চেপে ধরতেই উনি দিয়ে দিলেন তোমার রিপোর্টটা।’ ঐশিক বলে যেতে লাগল, ‘কোনো অবিবাহিতা মেয়ে প্রেগন্যান্ট শুনলে বেশিরভাগ মানুষই মেয়েটার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলে, কিন্তু তুমি ভালোভাবেই জানো যে আমি বাঁধা গতে চলি না কখনো, ভবিষ্যতেও চলব না, তাই আমি ছুটে এলাম এতদূর। তুমি তো ভীতু, লাজুক মেয়ে কোনোদিন ছিলে না অভিনন্দা, তাহলে আজ কি হল যে তোমার মতো একজন স্মার্ট, আধুনিকা, বুদ্ধিমতী মেয়ে এভাবে নিজেকে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি করে ফেলল?’
অভিনন্দা মাটির দিকে তাকিয়ে রইল নীরবে। ঐশিক বলে যেতে লাগল, ‘অভিনন্দা, তোমার কি কোনো প্রেমিক আছে?’
অভিনন্দা ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দিল, ‘না।’
— ‘তাহলে? তাহলে কি তোমার ফিজিক্যাল হ্যারাসমেন্ট হয়েছিল? চুপ করে আছো কেন? কিছু বলো!’ অভিনন্দার কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করল ঐশিক।
— ‘না।’ ভাবলেশহীন কন্ঠে জবাব দিল অভিনন্দা।
— ‘তাহলে? তুমি যদি না বলো তাহলে কিভাবে জানব যে কে তোমার এই অবস্থার জন্য দায়ী?’
— ‘সব প্রশ্নের উত্তরই যে আপনাকে জানতে হবে তার তো কোনো মানে নেই স্যার তাই না? এই প্রশ্নের উত্তরটা না ই বা জানলেন!’
— ‘জানতে হবে বৈকি! সত্যিটা জানব বলেই তো এলাম এতদূর’, ঐশিক বলে চলে, ‘আর একবার যখন তোমার সামনে এসেছি, তখন উত্তর না নিয়ে কিন্তু আমি ফিরব না!’
— ‘সে আপনি চাইলে থাকতেই পারেন এখানে, কিন্তু আমি কিছুতেই আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব না।’
— ‘আচ্ছা অভিনন্দা, কেউ কি ভয় দেখিয়েছে তোমায়? হুমকি টুমকি দিয়েছে? শোনো তুমি ভয় পেও না, কালপ্রিটের নামটা শুধু বলো, সে যত বড়োই প্রভাবশালী হোক, ঐশিক রায়চৌধুরীর সামনে সে কিছুই না, তুমি নিশ্চিন্তে বলোই না।’
— ‘স্যার আপনি যাকে কালপ্রিট বলছেন, আমি তো তাকে কালপ্রিট বলে মনে নাও করতে পারি।’
— ‘আরে কিসব আবোলতাবোল বকছ? একটা সহজ প্রশ্ন করছি, তার সোজা উত্তর দাও! আর এমনি সময় তো তোমার মুখে কথার ফোয়ারা ছোটে, এখন হঠাৎ মৌনব্রত পালন করছ কেন?’ গর্জে ওঠে ঐশিক, ‘আর তুমি যদি মুখ বন্ধও রাখো, আমি ঠিকই তাকে খুঁজে বের করব যে তোমার সাথে এত বড়ো অন্যায়টা করেছে।’
— ‘স্যার আমি তো বারবার বলছি আমার সাথে কোনো অন্যায় হয়নি, তাও কেন….’
— ‘হ্যাঁ সবই জানি, তো এতে অবাক হওয়ার কি আছে? আমাদের কোম্পানিতে চাকরি করে ও, মাস গেলে অতগুলো টাকা পায়, সেই হিসেবে তো ও আমাদের চাকর, যাদের নুন খায় তাদের জন্য এটুকু করবে না ও?’
— ‘প্লিজ গীতা, প্লিজ! চুপ করো তুমি, তোমার কথাগুলো শুনলে ঘেন্নায় গা রি রি করে, প্লিজ চুপ করো!’
— ‘হুঁ, তা তো করবেই! বাই দ্য ওয়ে, সরে যাও আমার সামনে থেকে, এখন আমি রেডি হব!’
— ‘কোথায় যাবে? তন্ময়ের সাথে দেখা করতে?’
— ‘ও ব্বাবা! আমার পেছনে আবার স্পাইও লাগিয়েছ নাকি তুমি? শোনো, আমি যেখানে খুশি যাব, তার জন্য তোমায় কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমি, সরো!’
আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে গীতালি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ইমন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল ঐশিককে, ‘বাবা!’
ঐশিকও ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
একটু পরেই তৃষা ঘরে এলেন। হতাশ কন্ঠে বললেন, ‘ভালো ঘরের মেয়ে আনলাম ঘরে, ভাবলাম, তুই সুখী হবি, কিন্তু এ কাকে নিয়ে এলাম আমরা? তোর জীবনটা একেবারে শেষ করে দিলাম রে আমরা!’
— ‘মা প্লিজ এভাবে বোলো না, মানুষকে কি আর আগে থেকে বোঝা যায়?’
হঠাৎ দরজায় কলিং বেলের শব্দ। দরজাটা খুলতেই দেখা গেল, অভিনন্দা এসেছে। হাতে চকোলেট আর খেলনা।
— ‘ওমা তুই? আয় আয়।’ তৃষা অভিনন্দাকে নিয়ে গেলেন ঐশিকদের ঘরে।
— ‘অভিনন্দা, তুমি?’
— ‘হ্যাঁ স্যার, আসলে যখন থেকে শুনেছি যে সোনাবাবু কাল রাতে কান্নাকাটি করেছে, ওকে দেখার জন্য খুব উশখুশ করছে মনটা। তাই চলে এলাম।’
অভিনন্দাকে দেখেই ইমন এক রকম ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর কোলে, ‘অভি আন্টি!’
— ‘সোনাবাবু, দেখো তো কি এনেছি আমি তোমার জন্য!’ বলেই চকোলেট আর খেলনা গুলো ইমনের হাতে দিল ও।
ইমন তো সেসব পেয়ে মহা খুশি।
ঐশিক হেসে বলল, ‘ইমনের অভ্যেসটা খারাপ করে দিচ্ছ অভিনন্দা, এবার তো ও তোমায় ছাড়া আর একটা মিনিটও থাকবে না!’
— ‘তাতে কি? আমার সোনাবাবু যখনই ডাকবে আমায়, আমি ছুট্টে চলে আসব।’
অভিনন্দা চলে যাওয়ার পর তৃষা নিজের মনেই বিড়বিড় করছিলেন, ‘কেন যে তোকে আরেকটু আগে দেখিনি মা, তাহলে তোকেই ঐশিকের বৌ করে আনতাম রে!’
কেটে গেল কয়েক মাস। অভিনন্দা একদিন একটু দেরি করে অফিস গেল। ও যেতেই ঐশিক হেসে বলল, ‘সূর্যদেব কি আজ পশ্চিমে উঠেছেন? আজ অভিনন্দা সবার পরে এল?’
কিন্তু অভিনন্দার মুখে অন্যদিনের মতো আর হাসির ঝিলিক খেলে গেল না। থমথমে মুখে ও বলল, ‘আসলে স্যার শরীরটা ভালো নেই তো, তাই একটু দেরি হয়ে গেল।’
— ‘জ্বর টর বাধিয়েছ নাকি? এখন শুনছি অনেকেরই ডেঙ্গু টেঙ্গু হচ্ছে….’
— ‘না না স্যার, ওসব কিছু না।’
— ‘তাহলে?’
অভিনন্দা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই ও সেন্সলেস হয়ে গেল। ঐশিক তাড়াতাড়ি ওকে ধরল, নইলে হয়ত ও পড়ে যেত।
অভিনন্দার যখন জ্ঞান এল, ও দেখল ঐশিক চিন্তিত মুখে বসে আছে, আর ডাক্তারবাবু ওকে দেখছেন।
— ‘আজকালকার দিনের ছেলেমেয়েদের এই এক সমস্যা বুঝলে ঐশিক’, ঐশিকের দিকে ফিরে বললেন, ‘খালি কাজ আর কাজ, শরীর স্বাস্থ্যের দিকেও যে নজর টজর দিতে হয় সেটা এদের কে বোঝাবে?’
— ‘হুম ডাক্তারবাবু, সে আর বলতে?’ ঐশিক সায় দিল, ‘একটা ফাইল এদিক ওদিক হবে না, অফিসে আসতেও লেট হবে না, বাড়িতে ডেকে পাঠানো হলেই তাড়াতাড়ি চলে আসেন ম্যাডাম, কিন্তু নিজেকে দেখার বেলায়? গোল্লা!’
— ‘আচ্ছা, আমি আপাতত কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, আর কিছু টেস্টও লিখে দিচ্ছি, করিয়ে নিও।’
ভাবলেশহীন মুখে মাথা নাড়ল অভিনন্দা।
ডাক্তারবাবু চলে যাওয়ার পরেই ঐশিক বলল, ‘আজ তুমি রেস্ট নাও অভিনন্দা, আজ তোমার ছুটি।’
অভিনন্দা হেসে বলল, ‘আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে স্যার, এই সামান্য অসুখে আমার কিছু হবে না।’
— ‘তুমি বড্ড বেশি কথা বলো! তুমি আজ ছুটি নেবে, এটা আমার অর্ডার!’
সেদিন সন্ধ্যেবেলায় ঐশিক ফোন করল অভিনন্দাকে। কিন্তু অদ্ভুতভাবেই ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল।
— ‘আমাদের জন্য মেয়েটা অনেক করেছে রে, ওর অসুস্থতার সময়ে আমাদেরও তো ওর পাশে দাঁড়ানো উচিত, তাই না?’
— ‘হুম মা, একদমই তাই।’
একটু পরেই অভিনন্দার ফ্ল্যাটে কলিং বেল বাজল। দরজাটা খুলতেই অভিনন্দা দেখল, ঐশিক আর তৃষা দাঁড়িয়ে আছেন।
— ‘এ কি স্যার আপনারা?’
— ‘তা না এসে আর উপায় কি বলো অভিনন্দা, ফোনটা ধরলে না, আজ অফিসে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে তুমি,চিন্তা হয় না বলো তো?’ গম্ভীর মুখে জবাব দিল ঐশিক।
— ‘স্যার আপনারা শুধু শুধুই টেনসন….’
ওকে থামিয়ে দিয়ে ঐশিক বলল, ‘দরজার বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে? নাকি ভেতরে আসার অনুমতিটাও দেবে?’
— ‘এমা ছি ছি স্যার, আসুন না, ভেতরে আসুন আপনারা প্লিজ।’
ঐশিক আর তৃষা এসে বসলেন ভেতরে।
একটু পরেই মিষ্টি আর জল নিয়ে এল অভিনন্দা, ‘এই ফ্ল্যাটে তো এ.সি. নেই, খুব কষ্ট হবে আপনাদের।’
— ‘থাক, আমাদের কষ্ট নিয়ে অনেক ভেবেছিস, এবার একটু তোর কথা বল।’ তৃষা বললেন।
— ‘হুম সেটাই। আর ফোন কেন ধরোনি সেটাও বলো।’ ঐশিক বলল।
— ‘আমি একদম ঠিক আছি স্যার, আসলে তখন ওয়াশরুমে ছিলাম…’ বলতে না বলতেই সেন্সলেস হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল।
একটু পরে যখন জ্ঞান এল ওর, ঐশিক চিন্তিত মুখে বলল, ‘তোমার ফোন না ধরার কারণটা এইবার আমার কাছে ক্লিয়ার হল। দেখেছ মা, ভাগ্যিস এখানে এসেছিলাম, নইলে তো উনি কিছুই জানাতেন না, কাল আবার ড্যাংড্যাং করে অফিস চলে আসতেন!’
অফিসে ঢুকেই ঐশিক তাড়াতাড়ি ছুটল কেবিনে। আজ ক্লায়েন্ট মিটিং আছে, একটু পরেই তারা এসে পড়বে। এত ব্যস্ততার দিনেই রাস্তায় অবরোধ হতে হল!
এই অবরোধের জন্যই ঐশিকের অফিস আসতে এতটা দেরি হল। হন্তদন্ত হয়ে যখন ও ছুটে যাচ্ছিল কেবিনের দিকে, মনে মনে একটাই চিন্তা ছিল তার, অভিনন্দা এসে পৌঁছেছে তো? বেশ কিছু ইম্পর্ট্যান্ট ফাইল অভিনন্দার কাছেই আছে, ও যদি আজ সময়ে না পৌঁছায়, তাহলে সর্বনাশের আর বাকি থাকবে না কিছু!
বর্তমানে দেশের অন্যতম সোনা ব্যবসায়ী হলেন ওই রায়চৌধুরীরা। রায়চৌধুরী এন্ড সন্স জুয়েলার্সের নাম কে না জানে!ঐশিক রায়চৌধুরীর ঠাকুর্দা আদিত্য রায়চৌধুরী ব্যবসাটা দাঁড় করিয়েছিলেন, নিয়ে গিয়েছিলেন এত বড়ো জায়গায়। তাঁর সুযোগ্য পুত্র রঞ্জিত রায়চৌধুরীর হাত ধরে আরও ফুলে ফেঁপে উঠেছিল রায়চৌধুরী এন্ড সন্স। ঐশিকও এই বংশের যোগ্য উত্তরাধিকারীর মর্যাদা রেখেছে, এই ব্যবসা তার কাছে নিজের জীবনের চেয়ে কম কিছু নয়। ঐশিক বিদেশ থেকে পড়াশুনা শেষ করে ফেরার পরেই পৈতৃক ব্যবসার হাল ধরেছে, আর তারপরেই ছেলের জন্য যোগ্য পাত্রীও নিয়ে এসেছেন ঐশিকের বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী আর মা তৃষা রায়চৌধুরী। ঐশিকের স্ত্রী গীতালিও ধনী বস্ত্র ব্যবসায়ী পরিবারের একমাত্র মেয়ে। ঐশিক আর গীতালির বছর পাঁচেকের পুত্রসন্তানও আছে, যার নাম ইমন।
আর অভিনন্দা হল ঐশিকের পি.এ.। গ্রামে পড়াশুনা শেষ করে শহরে চাকরি করতে আসা। অভিনন্দার মতো স্মার্ট আর কর্মদক্ষ মেয়ে ওই অফিসে আর একটি খুঁজে পাওয়া ভার। ওর কাছেই বেশিরভাগ ইম্পর্ট্যান্ট ফাইল, কাগজপত্র রেখে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে ঐশিক, কারণ ওর মতো দায়িত্বশীল আর কর্মঠ মেয়ে কমই আছে ওই অফিসে।
ঐশিক চিন্তান্বিত হলেও এটুকু জানত, যাই হয়ে যাক, অভিনন্দা সঠিক সময়ে অফিসে আসবেই, ওর সময়ানুবর্তিতা সত্যিই প্রশংসনীয়।
যা ভেবেছিল ঐশিক, ঠিক তেমনটাই হল। কেবিনে ঢুকেই ও দেখে, অভিনন্দা আগে থেকেই উপস্থিত।
কোনোরকমে নিজের চেয়ারে বসেই ঐশিক কপালের ঘাম রুমালে মুছে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘কিভাবে পারো বলো তো তুমি অভিনন্দা? আজ রাস্তাতে জ্যাম ছিল, তাও কিভাবে সময়ে পৌঁছলে তুমি?’
— ‘আসলে স্যার আমি কালকেই নিউজে দেখেছিলাম যে আজ অবরোধ আছে, তাই আমি আজ হাতে সময় নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম।’ স্মিত হেসে বলল অভিনন্দা।
— ‘উফ সত্যি, তোমার মতো কাজের প্রতি ডেডিকেশন আমি কমই দেখেছি।’
— ‘স্যার, আমি অফিসের সামান্য কর্মচারী মাত্র, শুধুমাত্র আমার দেরি হওয়ার কারণে কোম্পানির বড়ো লস হয়ে যাবে, এটা কিভাবে মেনে নিই বলুন?’
— ‘আচ্ছা বেশ বেশ। ফাইলগুলো টেবিলে রাখো।’
অভিনন্দা টেবিলে রেখে বলল, ‘আমি সবগুলোই চেক করে নিয়েছি স্যার, তাও আপনি একবার দেখে নিন নিজে।’
— ‘ওকে, দাও ফাইলগুলো।’
সবগুলো ফাইল চেক করে হাসি মুখে ঐশিক বলল, ‘অভিনন্দা মৈত্রকে যখন দায়িত্ব দিয়েছি, তখন আর ভুল হতে পারে কিছু?’
— ‘স্যার, আমার এত প্রশংসা করবেন না প্লিজ, এটা আমার ডিউটি।’ লাজুক হেসে বলল অভিনন্দা।
— ‘ও হ্যাঁ তোমায় আসল কথাটাই তো বলা হয়নি! কাল তুমি ইমনকে ঘুম পাড়িয়ে যখন চলে গেলে, তখন তো কোনো প্রবলেমই হয়নি, ইমন দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু হঠাৎ করেই এক দেড় ঘন্টা পরেই ওর ঘুম ভেঙে গেল, ঘুম ভেঙেই যেই দেখেছে তুমি নেই, ওর সে কি কান্নাকাটি! বাড়ির সকলে মিলে হিমসিম খাচ্ছিলাম ওর কান্না থামাতে। সত্যি, বাচ্চা সামলানো তো আর চাট্টিখানি কথা না, আর গীতালি তো ওইসব পারেই না একেবারে!’
— ‘স্যার, থাক না এখন ওসব কথা! হাজার হোক গীতালি ম্যাডামই কিন্তু সোনাবাবুর মা, আমি তো বাইরের লোক মাত্র! সোনাবাবু আজ শিশু, তাই আমার কাছে থাকার জন্য এত জেদাজেদি করে, একটু বড়ো হতে দিন, দেখবেন ও আর এরকম করবে না।’
— ‘হুম, শিশু বলেই তো ও সবটা বোঝে, যে কে ওকে প্রকৃত ভালোবাসে আর কে নয়! বড়ো হলে হয়ত মানুষ এই বোধটা হারিয়ে ফেলে, বা চাইলেও প্রকাশ করতে পারে না, তাই বড়ো হলে মানুষ বেশি অসহায় হয়ে পড়ে।’
অজান্তেই চোখের কোণটা ভিজে যায় ঐশিকের, কিন্তু তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেয় ও।
এই ঘটনাটা অভিনন্দার চোখ এড়ায়নি, কিন্তু সে যেন ব্যাপারটা দেখেই নি এমন ভাব করে বলল, ‘স্যার প্রেজেন্টেশন গুলো একবার দেখে নেবেন না শেষ মুহূর্তে?’ বলেই ওর ল্যাপটপে প্রেজেন্টেশন গুলো খুলে ঐশিকের সামনে রেখে দিল ও।
একটু পরেই ক্লায়েন্টরা এলেন, মিটিং সাকসেসফুলি শেষ হল, অভিনন্দা আর ঐশিক হাসি মুখে বেরোলো অফিস থেকে, তারপরেই ঐশিক চলল বাড়ির পথে, আর অভিনন্দা চলল যে ফ্ল্যাটে ও ভাড়া থাকে সেই ফ্ল্যাটের পথে।
কিন্তু বাড়িতে গিয়েই ঐশিক দেখে, কেমন যেন থমথমে পরিবেশ। রঞ্জিত আর তৃষা গম্ভীর মুখে সান্ধ্য চা খাচ্ছেন, আর গীতালি আর ঐশিকের ঘর থেকে ভেসে আসছে রাগী চিৎকার। তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়েই ঐশিক দেখে, ইমন ঘরের এক কোণে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে কাঁদছে, আর গীতালি চিৎকার করে চলেছে, ওই রাস্তার মেয়েটার প্রতি কিসের এত পিরিত তোর? আমি তোর মা, কিন্তু তুই খালি ওই দু’টাকার মেয়েটার নাম আওড়াস সব সময়! কি যাদু করেছে ও তোর ওপর শুনি?’
ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ইমন বলল, ‘আমি অভি আন্টির কাছে যাব!’
— ‘তবে রে!’ বলে গর্জন করে উঠেই ইমনের গালে চড় কষিয়ে দিল গীতালি।
— ‘গীতা!’ ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠল ঐশিক, ‘অতটুকু বাচ্চাকে তুমি মারছ?’
— ‘না, মারব না, ফুলচন্দন দিয়ে পুজো করব!’ মুখ বেঁকিয়ে গীতালি বলল, ‘সবসময় ওই ভিখিরি মেয়েটার নাম কেন করবে ও?’
— ‘গীতা ভদ্রভাবে কথা বলো! কার সম্পর্কে কি বলছ তুমি? ও গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, দিনরাত পরিশ্রম করে খেটে রোজগার করছে, ওর লড়াইটা তোমার মতো মানুষ বুঝবে না! আর ইমন ওকে ভালোবাসবে না ই বা কেন? মনে আছে ওর যখন জ্বর হয়েছিল রাতে, ও কিছুতেই ওষুধ খেতে চাইছিল না, তুমি তো সেদিন নাইট ক্লাবে মদের গ্লাসে ডুবে ছিলে, জানতেই না ছেলের এদিকে কি অবস্থা, সেদিন ওই বাইরের মেয়েটাকেই ফোন করে ডাকতে হয়েছিল, অভিনন্দা এসে তোমার ছেলেকে আদর করে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে গিয়েছিল সেদিন। শুধু কি ওইদিন? সেই সন্ধ্যেটার কথা মনে আছে তোমার যেদিন ইমনের চার বছরের জন্মদিন ছিল? তুমি সেদিন ঘরে নিজের সাজগোজ, মেকাপ নিয়েই ব্যস্ত ছিলে, ওদিকে ছেলেটা যে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল আরেকটু হলেই, সেই খেয়ালটা পর্যন্ত করোনি তুমি! সেদিনও ওই দু’টাকার মেয়েটা ছিল বলেই ইমন বড়ো অ্যক্সিডেন্টের হাত থেকে বেঁচেছিল, সবটা ভুলে গেছ তুমি?’
শিলার জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে সে একটা অচেনা জায়গায় আবিষ্কার করলো। আশেপাশের পরিবেশ অপরিচিত। আমি ওর পাশে বসে ছিলাম। ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
শিলাঃ নীল আমরা কোথায় আছি? আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছো তুমি?
আমিঃ আহ এতো উত্তেজিত হচ্ছো কেনো? রিল্যাক্স।
শিলাঃ আরে বলোনা আমরা কোথায় আছি?
আমিঃ বলছি আগে ছাদে চলো।
শিলাঃ না আগে বলো নাহলে যাবোনা আমি৷
আমিঃ আমি বলছি চলো। আর বেশি কথা বলবেনা। ( রাগি গলায়)
আমি ওকে দমিয়ে রাখতে কথাটা বললাম। ওর সাথে রাগি গলায় কখনও কথা বলিনা৷ জানি ও আমার জন্য যা যা করেছে তা নিজের জীবন দিয়েও শোধ করতে পারবনা। তাই ওর ইচ্ছা গুলো সব সময় পূরণ করার চেষ্টা করি। আমার ছেলে মেয়েদের আমার শাশুড়ী আর আপু সামলাচ্ছে৷ শিলার সাথে এখন একা সময় কাটাতে চাই৷ যাই হোক ওর চোখ ধরে ছাদে নিয়ে গেলাম৷ ছাদে আগে থেকে একটা ছোট কেক আর হালকা ডেকোরেশন করে রেখেছি। ওকে ছাদে নিয়ে গেলাম৷ তারপর ওকে বললাম,
আমিঃ আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবেনা। খুললে রাগ করবো।
এর মাঝে আমি মোমবাতি জালিয়ে দিলাম। তারপর ওকে চোখ খুলতে বললাম। ও চোখ খুলার পর ওকে জন্মদিনের উইশ করলাম,
আমিঃ শুভ জন্মদিন আমার প্রয়সি। অনেক অনেক শুভেচ্ছা আজকের দিনটার জন্য তোমাকে।
শিলা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ একটু পরেই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। অনেক্ষন আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকলো। ও এখনও খেয়াল করেনি চারপাশে পরিবেশ৷ যখন খেয়াল করবে তখন আরও শক পাবে। কিছুক্ষন পর আমাকে ছেড়ে বলল,
শিলাঃ আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আজ আমার জন্মদিন৷ কিন্তু তুমি ঠিকই মনে রেখেছো। অনেক অনেক খুশি হয়েছি আমি। তবে বাড়ির সবাই থাকলে ভালো হতো।
আমিঃ এই মূহুর্তটা একান্তই তোমার আমার। বিশেষ দিনগুলো আমি একান্তই তোমার সাথে কাটাতে চাই। এই সময়গুলোর ভাগিদার আমি কাওকে হতে দিতে পারিনা।
শিলাঃ হুম৷ এই সময়টা একান্তাই তোমার আমার৷ এই সময়গুলো আমিও শুধু তোমার সাথে একা কাটাতে চাই। তোমাকে মতো কাউকে পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি। আমার সব কিছুর খেয়াল রাখো তুমি। সারাদিন ব্যস্ত থাকার পরেও আমাকে, ছেলে মেয়েকে সময় দাও। সব কিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ।
আমিঃ আচ্ছা এসব কথা পরেও করা যাবে৷ তোমার গিফ্ট নিবেনা?
শিলাঃ তুমিই তো আমার গিফ্ট আর কি লাগবে আমার?
আমিঃ আরে ইমোশনাল কথা রাখো। আগে বলো গিফ্ট দেখতে চাওনা?
শিলাঃ আচ্ছা দেখি?
আমি ওকে ছাদের কিনারায় নিয়ে গেলাম। চারেপাশের দৃশ্য দেখে তো শিলা হা হয়ে আছে। কারণ চারপাশে দৃশ্যটা পুরো স্বপ্নের সাথে মিলে যাচ্ছে। ও কিছুক্ষন আরও ভালো করে পরিবেশটা বুঝার চেষ্টা করলো। ও ভালোভাবেই বুঝতে পারলো এটা গ্রাম্য পরিবেশ। এবার ও আমাকে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো
শিলাঃ নীল এটা কোথায় নিয়ে এসেছো আমাকে? আর এটা কার বাড়ি?
আমিঃ এটা তোমার বাড়ি আর তোমার ইচ্ছা অনুযায়ী বাড়িটা তেরি করেছি তোমাকে না জানিয়েই। পচ্ছন্দ হয়নি তোমার?
শিলা আবারও আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এবার ও কেঁদে দিলো। আমি ওর কান্না দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
আমিঃ এই পাগলি কাঁদছো কেনো?
শিলাঃ আমার একবার বলাতেই তুমি আমার ইচ্ছা পূরণ করে দিলে?
আমিঃ কি করব বলো? একটা মাত্র বউ আমার। তার কথা আমি কিভাবে ফেলতে পারি?
শিলাঃ সত্যি গো এখন নিজেকে আরও বেশি ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। আচ্ছা নিচে গিয়ে বাড়িটা দেখে আসবো?
আমিঃ তোমার বাড়ি তুমি যা ইচ্ছা করতে পারো।
তারপর শিলা আমাকে নিয়ে বাইরে গেলো। চারিদিক থেকে বাড়িটা ঘুরে দেখলো। অনেক অনেক বেশি খুশি হয়েছে শিলা। আমি ওকে বললাম যে ছুটির সময়গুলো আর ঈদ সব এখানেই করবো। এক কথায় রাজি শিলা। দুজনে সেই রাতটা অনেক ভালো ভাবে পার করলাম।
পরেরদিন সকালে কিছু কাজ করে বিকালের দিকে গ্রামটা ঘুরতে বের হলাম৷ প্রথমে কিছু জায়গা ঘুরে নদীর পাড়ে গেলাম। সত্যি সেই দৃশ্যটা অসাধারণ। দেখেই মন জুড়িয়ে গেলো৷ সন্ধ্যার পর ফিরে এলাম৷ ফিরে এসে নীলাকে নিয়ে কিছুক্ষন দুষ্টুমি করলাম৷ মেয়েটা একেবারে তার ভাইয়ের বিপরীত হয়েছে। রিফাত একদম শান্ত ছিলো আর নীলা অনেক দুষ্টু। কোলে থাকতেই চাইনা৷ সব সময় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায়। এখন অবশ্য কোনো জিনিস ধরে দাড়াতে পারে। মাঝে মাঝে এক দুই পা হেটে পড়ে যায়৷ জিসানও হয়েছে ওর বোনের মতো বর্না আপুকে জ্বালীয়ে মারে৷ তবে বর্না আপু সেগুলোই অনেক পচ্ছন্দ করে। রিফাত ভাই বোনকে হাটানোর চেষ্টা করে। একধাপ দিতে পারলেই রিফাতের খুশি দেখে কে? দৌড়ে চলে যাবে শিলার কাছে খবর শুনাতে। জিসান একটু পা এগোলে আপুকে ডাকতে দোড়াবে। আপুকে রিফাত মামনি বলে৷।
পরেরদিন সকালে উঠে দেখি কয়েকজন প্রতিবেশী আন্টি মায়ের সাথে বসে কথা বলছে আমি গিয়ে ওনাদের সালাম দিয়ে কথা বললাম। ২-৩ দিন থেকেই যা বুঝলাম এই গ্রামের মানুষগুলো খুবই আন্তরিক। এমন ভাবে কথা বলছে যেনো আমাদের কত আগে থেকে চিনে। আমি কিছুক্ষন কথা বলে রফিক ভাইয়ের সাথে একটু বের হলাম৷ উদ্দেশ্য বাজার গিয়ে কিছু জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসা। আর পরেরদিন শুক্রবার তাই ভাবলাম নতুন বাড়ি উপলক্ষে সকল মুসল্লিদের মিষ্টি মুখ করাবো। বাজারে গিয়ে মাংস, দই, মিষ্টি, ফলমূল কিনলাম৷ বাড়িতে উঠার আগেই যাবতীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে বাস করার মতো বাড়ি গুছিয়ে নিয়েছি। মসজিদের মুসল্লীদরে জন্য আর এলাকার মানুষের মুখ মিষ্টি করার জন্য মিষ্টির অর্ডার দিয়ে আসলাম৷
সব কিছু কিনে দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরলাম৷ গোসল করে ফ্রেশ হয়ে না খেয়েই শুয়ে পড়লাম। শিলা এসে ডেকেছে তবে আমি খাবোনা বলে দিয়েছি। বিকালের দিকে বুঝতে পারলাম কেউ আমার চুল টানছে। উঠে দেখি এটা আর কেউ না আমার দুষ্টু মেয়ে। ঘুমিয়েছিলো তবে ঘুম ভেঙে গেছে হয়তো তাই আমার চুল টানছে আর হাসছে। আমি ওকে রুম থেকে বের হলাম। বাইরে এসে দেখি সবাই মিলে বসে কথা বলছে৷ রিফাত জিসানের সাথে খেলছে। আমি নীলাকে নীচে নামিয়ে আমি শিলাকে খাবার আনতে বললাম৷ দুপুরে না খেয়ে ঘুমিয়েছি তাই অনেক ক্ষুধা লেগেছে। শিলা খাবার নিয়ে আসার পর আমি খেয়ে রফিক ভাইকে নিয়ে চা খেতে গেলাম৷ গ্রামের চোকানগুলোতে চা খাওয়ার মজা আলাদা।
পরেরদিন সময় মতো আমি, রফিক ভাই আর রিফাত নামায পড়তে গেলাম৷ নামায শেষে সবাইকে মিষ্টিমুখ করিয়ে হুজুর আর মুয়াজ্জিন কে দুপুরের খাবার খেতে বাসায় নিয়ে আসলাম৷ আমাদের ব্যবহার দেখে উনারা অনেক খুশি হয়েছে। ওনাদের অনেক যত্ন করে আপ্যায়ন করলাম৷ কালকেই শহরে ফিরে যাবো।
পরেরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়লাম। গ্রামে কাটানো সময়গুলো অনেক অনেক বেশি ভালো ছিলো। শহরে গিয়ে আবারও সেই ব্যস্ত জীবন শুরু।
সময়গুলো আস্তে আস্তে পার হচ্ছিলো। এদিকে ছেলে মেয়েও বড় হচ্ছে। নীলা, জিসান হাটতে আর কথা বলতে শিখেছে। রিফাত ১২ বছরে পাঁ দিলো। এবার পিএসসি পরীক্ষা দিবে। পরীক্ষার জন্য নীলা আর জিসানকে ঠিক মতো সময় দিতে পারেনা। ওরা দুইজন রিফাতকে পড়তে দিবেনা দেখে জোর করে আমাদের কাছে রাখি।
আজকে ছুটির দিন তাই দুপুরে শুয়ে আছি। কোথা হঠাৎ নীলা দৌড়ে আমার কাছে চলে এলো
নীলাঃ বাবা বাবা আমাকে বাঁচাও। মা আমাকে মারনে।
আমিঃ কি হয়েছে মামনি? তোমার মাকে বিরক্ত করেছো তাইনা?
নীলাঃ না বাবা কিছু বলিনি।
তখনি আবার শিলা রুমে এলো। দেখি হাতে থালি নিয়ে আছে। বুঝলাম মেয়েকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য এতো দৌড়ানি দিচ্ছে।
শিলাঃ নীল ওকে ছেড়ে দাও ১ ঘন্টা ধরে ওর পিছন পিছন দৌড়াচ্ছি কিছুতেই খাওয়াতে পারছিনা। এবাট সুযোগ পেয়েছি।
নীলাঃ বাবা বাবা আমাকে বাঁচাও। আমি খাবোনা৷
শিলাঃ তুমি ওকে ধরে রাখো। আজ না খেলে মাইর দিবো।
আমিঃ আহ শিলা করছো কি? না খেলে জোর করার দরকার নেই।
শিলাঃ একদম কথা বলবেনা৷ তুমিই মেয়ের অভ্যাস খারাপ করার জন্য দায়ী।
আমিঃ এখানে আমার কি দোষ?
শিলাঃ আরও খাওয়াও মেয়েকে চকলেট। সারাদিন চলকেট খাবে আর খাবার দেখলেই পালাবে৷ দেখছোনা কি রকম রোগা হয়ে গেছে?
আমিঃ বাচ্চা মানুষ একটু দুষ্টুমি করবেই।
শিলাঃ এসব বলে লাভ নেই। নীলা আসো আমার কাছে। একটু খেয়ে নাও তাহলে ঘুরতে নিয়ে যাবো।
নীলাঃ সত্যি মা? আমাকে নিয়ে যাবে?
শিলাঃ হুম নিয়ে যাবো আসো খেয়ে নাও।
শিলা কৌশল করে নীলাকে খাইয়ে দিলো। ৪ বছর কেটে গেছে। এর ভিতর অনেক কিছু বদলে গেছে। আন্টি মারা গেছেন ১ বছর আগে। আমার শাশুড়ীর একমাত্র সঙ্গী ছিলেন তিনি। এখন নাতি, নাতনিদের নিয়ে থাকেন। জিসান আর নীলা একসাথে খেলে। এরা তিন ভাই বোনের মধ্যে খুব মিল। আন্টি মারা যাবার পর বেশ কয়েকদিন মানসিক ভাবে ভেঙে পড়পছিলো বর্ণা আপু৷ জিসানের দিকে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করেছে৷
এই কয়েক বছরে আমাদের কোম্পানি দেশের টপ ২০ মধ্যে এখন ১৫ তে আছে। সবকিছু ভালো চলছে। সময় পেলেই আমরা গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। এবার রোজার ঈদও ওখানেই করেছি। কয়েকদিন পর আবার কোরবানির ঈদ আসছে। এবার গরীব দুঃখীদের জন্য একটা গরু আর নিজেদের একটা গুরু কোরবানি দিবো বলে নিয়ত করেছি।
দেখতে দেখতে ঈদের দিন চলে এলো। সকাল সকাল উঠে আমরা চারজন মানে এবার জিসানও যুক্ত হয়েছে, সবাই মিলে ঈদগাহে গেলাম। নীলা আসার জন্য কান্না জুড়ে দিলেও শিলা ওকে সব ভু্লিয়ে আটকে রাখলো।
সুন্দর ভাবে নামায শেষ হলো। নামায শেষে খুতবা শোনার জন্য বসে থাকলাম৷ সব শেষে হুজুর বললো ঈদগাহের এরিয়া বাড়ানোর জমি কিনতে হবে আর ঈদগাহ সুন্দর ভাবে সাজানোর জন্যও টাকার প্রয়োজন প্রায় ২০ লাখ মতো৷ সবাইকে দান করার জন্য বললে আমি নিজেই সবটা দিবো বলে ঈদগাহের সভাপতিকে কানে কানে বললাম৷ কাউকে বুঝতে না দেওয়ার জন্য হুজুর কালেকশন চালিয়ে গেলো৷ সবাই চলে যাবার পর আমি ৩০ লাখ টাকার একটা চেক বুঝিয়ে দিলাম৷ মসিজদের জন্য আর ঈদগাহ সুন্দর ভাবে সাজানোর জন্য দিলাম। সবাই অনেক খুশি হলো।
নামায থেকে ফিরে এসে কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট স্থানে গেলাম৷ যারা কোরবানি দিতে পারেনি তাদের সাথে নিয়ে কোরবানি দিলাম। তারপর সবাইকে যারা কোরবানি দিতে পারেনি তাদের মাঝে বন্টন করে দিলাম৷
বাড়ি ফিরে কিছু খেয়ে নিলাম৷ বিকালের দিকে সবাইকে নিয়ে ঘুরতে বের হলাম৷ ঘুরা শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলাম৷ ৭ দিন পর শহরে ফিরলাম।
এভাবেই আরও ৫ বছর কাটলো। রিফাতের এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পিএসসি আর জেএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছে৷ বর্না আর জিসান এবার ৩য় শ্রেনীতে পড়ে। রিফাত সব সময় ওর ভাই বোনকে আগলে রাখে৷ রিফাতকে জিসানের ব্যাপরটা বুঝিয়ে বলেছি। ও খুব স্বাভাবিক ভাবেই সবটা বুঝেছে। রফিক ভাই আর বর্না আপু জিসানকে খুব আদর দিয়ে বড় করে৷ জিসান আমাকে পাপা আর শিলাকে মামনি বলে। বর্না আপু বা রফিক ভাই আজ পর্যন্ত জিসানের সাথে উচু গলায় কথা বলেনি৷ মা বাবার দায়িত্ব উনারা খুব ভালো ভাবেই পালন করছেন। রিফাত নিজে ওর ভাই বোনকে পড়াই৷ নিজেই ওদের স্কুলে রেখে আসে৷ আর দুই ভাইয়ের চোখের মনি হলো নীলা। কেউ নীলাকে কিছু বললেই দুই ভাই রেগে আগুন৷ শিলা সবচাইতে বেশি ভালোবাসে ওর বড় ছেলেকে মানে রিফাতকে৷ আসলে ওকে ছেড়ে থেকেছে অনেকদিন তাই ওর উপর ভালোবাসা বেশি। নীলা সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে। তিন ভাই বোন সব সময় মিলে মিশে থাকে। আমার শাশুড়ী এখন বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকেন। শিলা, বর্ণা আপুন ওনার সেবা যত্ন করেন।
জীবন থেকে চলে গেছে আরও ১ বছর। কিছুদিন আগে আমার শাশুড়ী গত হয়েছেন। মারা যাবার সময় তিনি শিলাকে বলে গেছেন যেনো ও তার বাবাকে ক্ষমা করে দেয়। সব ধাক্কা সামলে নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। আমাদেরও বয়স হচ্ছে।
অফিস ৭ দিন ছুটি দিয়ে আজকে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। আজকে আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। প্রয়সীর সাথে সময় কাটাতে যাচ্ছি গ্রামের বাড়ি। আজকের রাতটায় চাঁদ পূর্ণাঙ্গভাবে আলো ছড়াচ্ছে। তারা মিটমিট করছে। সেই আগেই মতোই শিলা আমার কাঁধে মাথা রেখে আছে৷ শিলার সাথে কাটানো সময়গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমরা কেউ কোনো কথা বলছিনা। তবে আমাদের মন যেনো একে অপরকে বলছে ” ভালোবাসি প্রিয় তোকে, খুব ভালোবাসি।” 😊😊
আজকে সবাই মিলে এক সাথে বসে আছি। রিফাত বোনকে নিয়ে আছে আর আমার কাছে আমার ছেলে আছে৷ বর্না আপু বারবার মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আমি এবার ভাবলাম ওদের সারপ্রাইজ দেওয়ার সময় চলে এসেছে। আমি রফিক ভাইকে আমার কাছে ডাকলাম। ওনি আমার কাছে আসা মাত্রই আমি আমার ছেলেকে ওনার কোলে তুলে দিলাম৷ রফিক ভাই আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। বর্না আপু বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। আসলে বাচ্চাকে কাউকে কোলে দেওয়ার একটা ধরন আছে। তবে আমি যেভাবে দিয়েছি তাতে মনে হতেই পরে যে আমি ওদের দিয়ে দিলাম।
আমিঃ ভাইয়া আমি চাই আমার এই ছেলের দায়িত্ব আজ থেকে তুমি নাও।
রফিক ভাইঃ মানে? কি বলছিস তুই?
আমিঃ আমি বলতে চাইছি আমার ছেলেটাকে তুমি আর আপু নিজের মতো করে বড় করো। তুমি তাকে নিজের পরিচয়ে বড় করো।
রফিক ভাইঃ এটা তুই কি বলছিস ভাই? এটা হয়না।
আমিঃ দেখো আমার দুইটা সন্তান আছে। আমি তাদের দায়িত্ব নিলাম আর তুমি আমার ছেলের দায়িত্ব নাও।
বর্না আপুঃ নীল দেখো এটা হয়না। বাবা মায়ের আদরের বিকল্প হয়না৷
আমিঃ দেখো আপু তোমরা তো চাইছিলে এতিম খানা থেকে বাচ্চা এনে নিজের পরিচয়ে বড় করতে। তার বদলে তুমি আমার ছেলেটাকেই নিজের পরিচয় দাও? আর বাবা মায়ের আদরের কথা বলছো? আমি জানি এটা তোমাদের থেকে ভালো কেউ ওকে দিতে পারবেনা।
বর্না আপুঃ এটা হয়না নীল। আমরা তোমাদের সন্তানকেই নিজের মনে করে বড় করবো। তবে আমাদের পরিচয়ে বড় করতে পারবোনা।
আমিঃ আচ্ছা আমি কি তোমাদের কোনোদিন পর মনে করেছি? আমার ছেলেটাকেও তোমরা অনেক আদর দিয়েছো। তাহলে আমার এই ছেলেটাকেও দিয়ো।
বর্না আপু এবার শিলার দিকে তাকালো। শিলার চোখ দুটি ভেজা। হাজার হলেও নিজের সন্তান। নিজের সন্তান অন্য কারও পরিচয়ে বড় হবে এটা মেনে নেওয়া কঠিন। নিজের চোখের সামনে অন্য কাউকে বাবা মা ডাকবে এটা অনেক কষ্টের। তারপরও তাদের সুখের কথা ভেবে আমরা এটা করতে চাইছি। আল্লাহ আমাদের ঘরে তিনটা সন্তান দিয়েছেন। তাদের ঘরে তো একটাও নেই। তাদের মুখের হাসির জন্য কষ্ট মেনে নিব। তাছাড়া এমন অনেক আছে যারা নিজেদের বোন বা ভাই নিঃসন্তান থাকলে তাদের জন্য তাদের অন্য ভাই বা বোন আলাদা ভাবে একটা বাচ্চা নিয়ে তাদের লালন পালন করতে দেন।
( এটা বাস্তাবে আমার পরিবারে সাথেই হয়েছে। আমার বড় মামার সন্তান না হওয়ায় ছোট মামা তাদের জন্য একটা সন্তান নিয়ে লালন পালন করতে দিয়েছেন। )
বর্না আপু শিলার দিকে আর শিলা বর্না আপুর দিকে ছল ছল চোখে তাকিয়ে আছে। শিলা নিজেকে সামলে নিয়ে বললো
শিলাঃ দেখো আপু আমার নিজের কোনো বোন বা ভাই নেই। আর তুমি তো আমার বড় বোনের মতোই। একজন মায়ের মতো সেবাযত্ন করেছো আমার। তাহলে আমি এতটুকু বিশ্বাস করতেই পারি যে আমার সন্তান তোমার কাছে কোনোদিনও অসুখী হবেনা। ছোট বোন হিসেবে আমার ছেলেটাকে তোমাদের জন্য উপহার দিলাম৷ ছোট বোনের উপহার নিবেনা?
বর্না আপু এবার কান্না করে দিলেন। আন্টি আর আমার শাশুড়ীও কান্না করছেন। রফিক ভাই আর বর্না আপুর চোখের পানি আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার। শিলা আর আমার চোখে সন্তান দেওয়ার, আমার শাশুড়ী আর আন্টির চোখে আমাদের উদারতার জন্য। রিফাত শুধু দেখছে তবে কিছু বুঝতে পারছেনা। নীরবতা ভেঙে আমি রফিক ভাইকে বললাম
আমিঃ তবে আমাকে একটা কথা দিতে হবে।
রফিক ভাইঃ কি কথা?
আমিঃ সারাজীবন আমাদের সাথে থাকতে হবে৷ আল্লাহ যতদিন হায়াৎ রেখেছেন ততদিন আমাদের নিজের ভাই বোন মানতে হবে৷ ১ সেকেন্ডের জন্যও আমাদে পর ভাবা যাবেনা। আর ছেলেটাকে জীবনেও যেকোনো পরিস্থিতিতে কষ্ট দিতে পারবেনা৷
আমার কথা শুনে রফিক ভাই ছেলেকে আন্টির কোলে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলেন। বর্না আপুও শিলাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।
রফিক ভাইঃ জানিনা মায়ের পেটের ভাইও এতোকিছু করে কিনা। তুই আমাকে নিজের পরিবারের অংশ বানিয়েছিস, একবার ভাই বলাতে বড় ভাইয়ের আসনে বসিয়েছিস আর আজকে নিজের সন্তানকেউ আমার কাছে দিচ্ছিস। আমি জানিনা কিভাবে তোর ঋণ শোধ করব। তবে আমি কথা দিচ্ছি তোর ছেলের গায়ে কোনোদিন ফুলের টোকাও পড়তে দিবোনা৷
বর্না আপুঃ জানিনা বোন জীবনে কোনো ভালো কাজ করেছি কিনা। তবে আমার কপাল অনেক ভালো যে তোমাদের সাথে পরিচয় হয়েছে। নিজের বোনও হয়তো এই কাজ করতনা৷ এই জীবন দিয়েও যদি কোনোদিন তোমাদের কাজে আসতে পারি তবে ২য় বার ভেবে দেখবোনা৷
বর্না আপু আন্টির কাছ থেকে ছেলেকে নিয়ে তার কপালে গভীর ভাবে একটা চুমু দিলো। চোখে পানি তার। মাতৃত্বের খুশি তার চেহারায়। এদিকে আমাদের এই কাজে শাশুড়ী আর আন্টিও অনেক খুশি। আমার মেয়ের নাম দিলাম আমার আর শিলার নামের সাথে মিল রেখে রাখলা নুসাইবা নাসরিন নীলা। ছেলের নাম রফিক ভাইয়া রাখলো জিসান মাহমুদ।
আমার মেয়েটাকে নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকে রিফাত। শিলা এখন আমার দুই সন্তানকে সামলায়। বর্না আপুও অনেক খুশি। অনেক যত্ন করে। ভাই বোন দুইজনকেই রিফাত অনেক ভালোবাসে। তবে বোনের প্রতি কেয়ার বেশি।
অফিসের দুটো শাখা তৈরির কাজ একেবারে শেষের পথে। একটা করলাম ঢাকায় আর একটা কক্সবাজারে। কোম্পানির অগ্রগতি আগের তুলনায় অনেক বেশি। হাবিবুর স্যার আমাদের সাথে দুটো ডিল সাইন করেছেন। আমাদের সাথে তাদের পার্টনারশিপটা অনেক সুন্দর ভাবে জমে গেছে।
বরাবরের মতোই আজকেও অফিসে ছিলাম। বিকাল ৩ টায় শিলা ফোন দিলো। খেয়াল করার সাথে সাথে ফোন ধরলাম৷ ধরেই শুনতে পেলাম ওর কান্না মাখা শব্দ। এতে অনেকটা ঘাবরে গেলাম।
আমিঃ শিলা কি হয়েছে কাঁদছো কেনো?
শিলাঃ নীল আন্টি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তুমি আর ভাইয়া জলদি চলে আসো।
আমিঃ কি? কোথায় তোমরা?
শিলাঃ উনাকে নিয়ে হাসপাতে যাচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।
আমিঃ আচ্ছা টেনসন করোনা। আমি আসছি।
আমি রিফাত ভাইকে বলতে যাবো তার আগেই উনি আমার কেবিনে হাজির।
রফিক ভাইঃ নীল তাড়াতাড়ি চল মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছে।
আমিঃ আপু ফোন দিয়েছিলো তোমাকে?
রফিক ভাইঃ হুম। তাড়াতাড়ি চল।
আমরা আর দেরি না করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম৷ হাসপাতালে গিয়ে দেখি সবাই মিলে কান্না করছে। এমনকি রিফাতও কান্না করছে। নানি নানি বলে আন্টিকে জ্বালিয়ে মারে। এদিকে আমাদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও কান্না করছে কারণ তাদের মায়েরা তাদের দিকে খেয়াল করছেনা। আমি শিলাকে শান্তনা দিয়ে বললাম
আমিঃ শিলা কিছু হবেনা৷ তুমি শান্ত হও প্লিজ।
শিলাঃ জানো আমার চোখের সামনেই ছিলেন আন্টি। আমি ওনার জন্য চা আনতে গিয়েছিলাম৷ এসে দেখি উনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। ( কান্না করে)
আমিঃ কান্না থামাও কিছু হবেনা। এদিকে যে নীলা কান্না করছে এদিকে খেয়াল আছে তোমার?
শিলাঃ সরি আমি খেয়াল করিনি। আচ্ছা তুমি একটু ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখোনা।
রফিক ভাইঃ আল্লাহর উপর ভরসা রাখো আর কান্না থামাও। জিসান কান্না করছে কিন্তু।
বর্না আপু এবার একটু শান্ত হয়ে জিসানের দিকে খেয়াল করলো। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করতে দিয়েছিলো। সেগুলোর রিপোর্ট আসতে একটু দেরি হয়। রিপোর্ট আসার পর আমরা ডাক্তারের সাথে দেখা করতে গেলাম।
রফিক ভাইঃ ডাক্তার সাহেব আমার মায়ের কি অবস্থা?
ডাক্তারঃ দেখুন ওনার হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে। দ্রুত অপারেশন করতে হবে। দেরি করলে সমস্যা হতে পারে।
রফিক ভাইঃ তাহলে অপারেশন করুন।
ডাক্তারঃ দেখুন হার্টের ব্লক নিরাময়ে সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো রিং পরানো। আমরাও সেটাই করতে চাই। আপনারা কি বলেন?
আমিঃ আপনাদের যেটা ভালো আর নিরাপদ মনেহয় সেটাই করুন৷
এরপর আরও কিছু কথা বলে চলে আসি। ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করে। সবাই বাইরে বসে আছি। নীলা আর জিসান ঘুমিয়ে গেছে। রিফাত আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। রফিক ভাই হাঁটাহাঁটি করছে।
৩ ঘন্টা পর ডাক্তার বের হয়ে আসলেন। তাকে দেখা মাত্রই ভাইয়া তার কাছে ছুটে গেলো।
ভাইয়াঃ ডাক্তার কেমন আছেন উনি?
ডাক্তারঃ চিন্তার কোনো কারণ নেই উনি এখন ভালো আছেন। তবে এখন থেকে নিয়মিত কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। একটু পর আমার কেবিনে আসুন। আমি কিছু ওষুধ লিখে দিবো সেগুলো নিয়ম করে খাওয়াবেন।
আমরা সবাই মিলে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলাম। আন্টির সাথে ২ ঘন্টা পর দেখা করতে পেলাম। যদিও এখনও জ্ঞান আসেনি। আরও ২ ঘন্টা পর জ্ঞান আসলো। যাক আল্লাহর রহমতে এখন সব স্বাভাবিক আছে।
২ দিন পর উনাকে নিয়ে বাসায় আসলাম তবে এখন থেকে ১ মাস মতো বেড রেস্টে থাকতে হবে। চর্বি জাতীয় খাবার মোটেও এলাউ না। ২ দিন ভালো মতো অফিস করা হয়নি। তাই আজকে থেকে আবার শুরু করলাম।
সময় আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চোখের পলকেই যেনো সময়গুলো কেটে গেলো। আরও ৬ মাস চলে গেলো জীবন থেকে। এখন আমার মেয়েটা খিল খিল করে হাসে। আর সেটা দেখে রিফাতও হাসে। বোন তো না যেনো তার কলিজার টুকরা সে। শিলা, রিফাত দুজন মিলে সব সময় আদর করে আগলে রাখে। বর্না আপুও জিসানের অনেক খেয়াল রাখেন।
আজকে অফিসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ ছিলো। ফিরতে রাত হলো। রফিক ভাই আজকে একটু আগেই চলে গেছে। আমার যেতে দেরি হলো। বাড়ি গিয়ে দেখি কোনো আলো জ্বলেনা। মনেহয় সবাই কোথাও গিয়েছে। কিন্তু গেলে তো আমাকে একবার বলতে পারতো। যাই হোক কিছু না ভেবে বাড়ির লাইট অন করতেই চমকে গেলাম৷ লাইট অন করার সাথে সাথে সবাই মিলে বলে উঠলো Happy Birthday to you. তারমানে আজকে আমার জন্মদিন? যদিও আমি নিজেই জানিনা আমার জন্ম তারিখ তবে সার্টিফিকেটে দেওয়ার জন্য তো একটা ডেট লাগবে তাই দিয়েছিলাম। সেই হিসেবেই হবে হয়তো। বাড়ির ভিতরটাও সুন্দর ভাবে সাজানো। অনেক খশি হলাম আমি। একটু পর কেক কাটলাম কেটে সবাইকে খাইয়ে দিলাম।
রাত ১১ টা। আমি ছাদের দোলনাতে বসে আছি। আমার কাঁধে মাথা দিয়ে আছে শিলা৷ সময়টা অনেক ভালো লাগছে৷ নিরবতা ভেঙে শিলা বললো
শিলাঃ আচ্ছা নীল আজ তোমার জন্মদিন তুমি আমার কাছে কি চাও?
আমিঃ আমার আবার কি লাগবে?
শিলাঃ কিছু লাগবেনা?
আমিঃ আমার জীবনের সবচাইতে বড় গিফ্ট তো তুমি। আমার মতো একজন এতিমকে এতো ভালোবেসেছো, আমার জন্য এতো ত্যাগ স্বীকার করেছো আর আমাকে পিতা হবার আনন্দ দিয়েছো তুমি। রাস্তা থেকে উঠিয়ে রাজার আসনে বসিয়েছ। এর বাইরে আমি আর তোমার কাছে কি চাইতে পারি। তবে এখন তুমি একটা কাজ করতে পারো।
শিলাঃ কি কাজ?
আমিঃ আমার সাথে এই সময়টা উপভোগ করতে পারো। দেখো আজকের চাঁদ, তারা সবকিছু যেনো মনোমুগ্ধকর একটা পরিবেশ তৈরি করেছে। এই সময়টা বার বার আসেনা। আজকের রাতটা এভাবেই কাটিয়ে দাও এটাই চাই।
শিলাঃ তোমার সাথে এরকম হাজার হাজার রাত কাটিয়ে দিতে রাজি আছি। জানো সেদিন তোমার একটা কথাতে আমি অনেক বড় আঘাত পেয়েছিলাম।
আমিঃ কোনদিনের কথা বলছো?
শিলাঃ মনে আছে সেদিন কক্সবাজার থেকে ফিরার সময় কি বলেছিলে?
আমিঃ কি বলেছিলাম?
শিলাঃ বলেছিলে আমি নাকি তোমার থেকেও ভালো কাউলে পেয়েছি বলে তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি। তুমি কিভাবে বলেছিলে কথাটা?
আমিঃ আমি জানতাম তুমি ওই কথা শুনার পরই কোনো না কোনো কান্ড করবে। আর আমার ধারণাই ঠিক হয়েছিলো। সেদিনই তুমি আমাকে মেসেজ পাঠাও। আর আমিও তোমার সমানে ছটফট করার নাটক করছিলাম।
শিলাঃ তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো?
আমিঃ অনেক বেশি যা পরিমাপ করা যাবেনা।
শিলাঃ আমিও তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি।
আমিঃ আমি জানি জানু।
শিলাঃ জানো আমার একটা ইচ্ছা আছে জানিনা সেটা পূরণ করা সম্ভব কিনা।
আমিঃ তোমার ইচ্ছা অপূর্ণ থাকবে আর আমি এটা হতে দিবো? আমার জীবন যদি নিতে চাও বলো এখনি দিয়ে দিবো।
শিলাঃ তোমার এসব ছাড়া মুখে কোনো কথা থাকেনা? তোমার আর আমার জীবন একটাই৷ মরতে চাইলে মরে যাও আমিও ছেলে মেয়েদের পরোয়া না করেই মরে যাবো। ( মুখ গোমড়া করে)
আমিঃ এমনি মজা করে বলছিলাম জানু এই কান ধরলাম আর কোনোদিনও এসব কথা মুখে আনবোনা।
শিলাঃ মনে থাকে যেনো।
আমিঃ আচ্ছা। তোমার ইচ্ছার কথাটা বললে না তো।
শিলাঃ আমার অনেক ইচ্ছা গ্রামে একটা বাড়ি করার। ছুটির সময় সেখানে গিয়ে কাটিয়ে আসব। আশে পাশে গাছপালা থাকবে, বাড়ির পাশে একটা পুকুর থাকবে, পুকুরের ধারে বসে তোমার কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকবো চুপ হয়ে।
আমিঃ আচ্ছা এসব বাদ দিয়ে চলো নিচে যায়। অনেক ঘুম আসছে।
দেখলাম শিলার হাসিমুখটা নিমিষেই কালো হয়ে গেলো। ও হয়তো ভেবেছে আমি ওর কথায় গুরুত্ব দেইনি। দুইদিনের মধ্যেই শহর থেকে খানিকটা দূরে একটা গ্রামে জমি নিয়ে সেটা শিলার কথা মতো তৈরি করবো। কালকেই রফিক ভাইয়ের সাথে কথা বলব এই ব্যাপারে। হাজার হলেও বউয়ের আবদার না রেখে পারি?
পরেরদিন অফিসে বসে কাজ করছি। তবে আজকে কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে। তখন রফিক ভাইকে কথাটা বলার জন্য ডাকলাম। রফিক ভাই আমার কেবিনে এসে বলল
রফিক ভাইঃ নীল ডেকেছিস?
আমিঃ ভাইয়া বসো। কিছু কথা বলার জন্য ডেকেছি।
রফিক ভাইঃ কি কথা?
আমিঃ আসলে ভাইয়া শিলা একটা জিনিস চেয়েছে সেটার ব্যাপারে কথা বলতে চাই।
রফিক ভাইঃ কি চেয়েছে?
আমিঃ আসলে ওর নাকি ইচ্ছা গ্রামের দিকে একটা বাড়ি করার। তাই আমি চাইছিলাম যে আশেপাশের কোনো গ্রামে একটা বাড়ি করবো।
রফিক ভাইঃ আচ্ছা তাহলে কালকে এই রকম একটা গ্রামের খোজ করে অফিস ২ দিন ছুটি দিয়ে বাড়ি করার জন্য ভালো লোকেশনের খোজ করব।
আমিঃ অনেক ভালো বুদ্ধি। আচ্ছা আজকে কি আর কাজ বাকি আছে?
রফিক ভাইঃ না প্রায় সবার কাজ শেষ।
আমিঃ তাহলে সবাইকে ছুটি দিয়ে দাও আজকে। আর পরের দুইদিন ছুটি থাকবে এটাও সবাইকে বলে দাও। তবে ১ দিনের কাজ দিয়ে দাও। বাসায় বসে ২ দিনে কাজ করবে। আজকে বাসায় গিয়ে একটু আরাম করে কালকে সুন্দর একটা গ্রামের খোজ করে বের হবো আমাদের কাজ করতে।
রফিক ভাইঃ আচ্ছা।
অফিস ছুটি দিয়ে দিলাম। আমি আর রফিক ভাই বাসায় চলে গেলাম৷ তবে বাড়ি পৌছে দেখি পার্কিং এর জায়গাতে একটা অচেনা গাড়ি। বাড়িতে কি কেউ এসেছে তাহলে?
ভিতরে ঢুকে তো আমি অবাক। কারণ ঢুকে দেখি আগের অফিসের বস বসে আছেন। আমি উনাকে দেখেই তাকে সালাম দিলাম৷
আমিঃ আসসালামু আলাইকুম স্যার৷
বসঃ ওয়ালাইকুম আসসালাম। আর স্যার বলছো কেনো? আমাকে আংকেল বলো
আমিঃ জ্বী আংকেল। কেমন আছেন আপনি?
আংকেলঃ আলহামদুলিল্লাহ৷ ভালোই আছি। তুমি কেমন আছো?
আমিঃ আলহামদুলিল্লাহ স্যার আমিও ভালো আছি৷ হঠাৎ চলে আসলেন আগে জানলে আজকে অফিস যেতাম না।
আংকেলঃ আসলে ঢাকায় এসেছি ২ দিন হলো। আমার মেয়েটাও ছিলোনা আর থাকতেও ভালো লাগছিলো না তাই ভাবলাম তোমাদের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে আসি।
আমিঃ যাক ভালোই করেছেন আপনাকে দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। তা আপুকেও নিয়ে আসতেন।
আংকেলঃ আসলে ওর শরীরটা ভালোনা তাই তাই ওকে নিয়ে আসিনি।
আমিঃ আচ্ছা আংকেল আমি ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর সবাই মিলে গল্প করব।
আংকেলঃ আচ্ছা যাও
আমি রুমে গিয়ে জামা কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসলাম৷ শিলা রান্নার কাজ করছে জিসান নীলকে নিয়ে খেলছে, জিসান ঘুমিয়ে আছে। আমি আংকেলের সাথে কথা বলার জন্য বসলাম।
আংকেলঃ তা তোমার অফিসে কাজ কেমন চলছে?
আমিঃ আলহামদুলিল্লাহ আংকেল। ভালোই চলছে আর এখন প্রফিট ভালো আসছে৷ সাথে বড় একটা কোম্পানির সাথে ২ টা ডিল সাইন করে এখন কাজ অনেক ভালো চলছে।
আংকেলঃ মাশাল্লাহ। আসলে তোমার কাজই এমন সবাই পচ্ছন্দ করে।
আমিঃ সব আল্লাহর ইচ্ছা।
আংকেলঃ ঢাকায় এসে চলে যেতাম তবে তোমার ছেলে মেয়েকে দেখার জন্য আরও দ্রুত চলে আসলাম৷
আমিঃ আপনি যখন খুশি আসবেন৷ শিলার জন্য আপনি যা করেছেন তার জন্য সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
আংকেলঃ এসব বলে ছোট করিওনা বাবা। আসলে ওকে নিজের মেয়ের মতোই দেখেছি।
আংকেলঃ আমার তো নাতি হয়েছে। শিলাকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম।
আমিঃ হয়তো ও আমাকে জানাতে ভুলে গেছে৷ ওনাদের নিয়ে আসলে অনেক বেশি খুশি হতাম। সবাই মিলে একটু আনন্দ করতাম।
আংকেলঃ আবার নিয়ে আসবো। আসা যাওয়া লেগেই থাকবে।
আমিঃ জ্বী আংকেল।
তারপর আরও কিছুক্ষন কথা বললাম। আংকেল আমার মেয়েকে নিয়ে কিছুক্ষন আদর করলো। রিফাতের জন্য অনেক গুলো চকলেট আর খেলনা নিয়ে এসেছেন। জিসানের জন্যও অনেক কিছু নিয়ে এসেছন। রাতে সবাই মিলে মজা করে খেলাম৷ আংকেলকে একটা রুমে থাকতে দিলাম৷
পরেরদিন আমরা অফিসের নাম করে আশেপাশে সুন্দর একটা গ্রামের খোজ করতে থাকলাম। রাজশাহী শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা গ্রামের খোজ পেলাম। ৮০ কিলোমিটার দূরে যেতে ২ ঘন্টা মতো লাগে। গ্রামটা অনেক সুন্দর। গ্রামে গিয়ে একটা সুন্দর লোকেশন খুজতে লাগলাম৷ তবে বেশিক্ষন খুজতে হয়নি। শিলার স্বপ্নের মতোই একটা জায়গা পেলাম। আশে পাশে গাছপালা, বাড়িঘরও আছে। পাশে একটা পুকুর। ছোট একটা দালান বাড়ি করা। জমি বিক্রয় করা হবে দেখে সাথে সাথে জমির মালিকের সাথে যোগাযোগ করলাম৷ কিছু কথা বলে সেদিনের মতো চলে আসলাম৷ ওনার সাথে কথা হয়েছে যে কালকে এসে সব কাগজপাতি চেক করে কালকেই জায়গাটা কিনে নিবো।
আংকেল এখনও বাড়িতল আছেন। কালকে চলে যাবেন। আমি বাড়ি পৌছে সোজাসুজি রুমে গেলাম৷ গিয়ে দেখি রিফাত নীলাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা দেখে অনেক বেশি ভালো লাগলো। ভাই বোনের ভালোবাসা দেখে বুকটা জুড়িয়ে গেলো। ফ্রেশ হয়ে রিফাতের পাশে বসালম
আমিঃ কি করছো তুমি বাবা?
রিফাতঃ ভাইকে ঘুম পাড়িয়ে এসে আপুকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম৷ আচ্ছা বাবা আপু কখন কথা বলবে. আমাদের স্কুলের যাদের বোন আছে তারা তো কথা বলতে পারে, হাটতেও পারে। আমাকে কখন ভাইয়া বলে ডাকবে?
আমিঃ ডাকবে বাবা। এখন তো ও অনেক ছোট আরেকটু বড় হোক তখন তোমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে।
রিফাতঃ আচ্ছা। আমি আপুকে আর ভাইকে একসাথে চকলেট খাইয়ে দিবো।
কতটা নিঃস্বার্থ রিফাতের ভালোবাসা। একবার ভাইয়া ডাক শুনার জন্য কত আগ্রহ। রিফাত ওর ভাই বোনের জন্য পাগল। প্রতিদিন ভাইকে ঘুম পাড়িয়ে দিবে তারপর বোনকে ঘুম পাড়িয়ে দিবে৷
রাতে সবাই মিলে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম৷ পরেরদিন আংকেলকে বিদায় জানিয়ে আবার সেই গ্রামে গেলাম। গিয়ে তার সাথে জমির দাম নির্ধারণ করে কাগজ পত্র ভালো ভাবে দেখে নিলাম৷ কয়েকদিন সময় লাগবে নিজের নামে করে নিতে। উনাকে অর্ধেক টাকা দিয়ে এসেছি। এর মাঝে একজনকে জমির লোকেশন অনুযায়ী বাড়ির ডিজাইন করার দায়িত্ব দিলাম। বাড়ির যাবতীয় কাজ অতী শীঘ্রই শুরু করে দিবো যাতে ৬ মাসের মধ্যেই কমপ্লিট হয়ে যায়।
পরদিন থেকে অফিস শুরু হলো। আগের মতো কাজ করতে লাগলাম। এভাবে কাটলো ১ মাস। এর মাঝে সুন্দর একটা বাড়ির ডিজাইন সিলেক্ট করে তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করার কথা বললাম। শিলার জন্মদিন ৮ মাস পর আর সেইদিনই ওকে সারপ্রাইজ দিবো বাড়িটা।
ছেলে মেয়ে আর বউয়ের দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসা দিয়ে দিনগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন পরেই আবার রোজা শুরু হবে। রোজার কারণে অফিসের কাজের টাইম ২ ঘন্টা কমিয়ে দিলাম। রোজার মাত্র ২ দিন বাকি। রোজার প্রথম দুইদিন অফিস বন্ধ রাখার ঘোঘনা দিলাম।
আজ থেকে রোজা শুরু হবে৷ সেহেরির সময় শিলা আমাকে জাগিয়ে দিলো৷ সেহেরি করে আমি আর রিফাত ভাই দুইজন মিলে ফজরের নামায পড়তে গেলাম৷ নামায শেষে এসে দেখি শিলা কোরআন তেলাওয়াত করছে। ওর গলা তো এমনিতেই সুন্দর তারওপর কোরআন তিলাওয়াত শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমি গিয়ে ওর পাশে বসে তেলাওয়াত শুনছিলাম৷ তেলাওয়াত শেষে একটু ঘুমালাম।
এভাবে ২০ রমজান পার হলো। প্রতি ১০ রমজান পর মসজিদে ইফতারের ব্যবস্থা করেছি শেষের ২ দিনও মসজিদে ইফতারের ব্যবস্থা করবো।
২৪ রমজানে অফিস ছুটি দিলাম সাথে সবাইকে ঈদের শুভকামনা জানিয়ে বেতন সহ ভালো একটা বোনাস দিলাম।
কালকে ঈদ৷ রাতে শিলা আমাকে মেহেদি দিয়ে দিলো। সাথে ছেলে মেয়েকেও মেহেদি দিয়ে দিলো। রিফাত ওর ভাই বোনকে মেহেদি দিয়ে দিবে বলে জেদ করলেও শিলা দিতে দেয়নি।
সকালে আমি রফিক ভাই, রিফাত তিনজন মিলে নামায পড়তে ঈদগাহে গেলাম৷ বের হবার সময় সবাইকে সালাম দিয়ে বের হয়েছি।
এভাবেই দেখতে দেখতে ৬ মাস পার হলো এর মাঝে কোরবানির ঈদও অনেক ভালোভাবে পার করেছি। বাড়ির কাজও শেষ এখন রংয়ের কাজ চলছে। শিলার জন্য খুব দ্রুত বাড়িটা করলাম। এখন নীলা আর জিসান হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায় আর রিফাত আর খিল খিল করে হাসে।
কালকে শিলার জন্মদিন৷ রাতে বাড়ি এসে একটা প্ল্যান করালম৷ প্ল্যান অনুযায়ী পরেরদিন ওকে কৌশলে নতুন বাড়ি নিয়ে যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।
পরেরদিন বিকালে বাড়ি আসার পর ফ্রেশ হয়ে ওকে দুটো কফি আনতে বললাম৷ কিছুক্ষন পর নিয়ে আসলো। ও কফি রাখলো আমি ওকে ভিতরে পাঠার জন্য বললাম চিনি কম হয়েছে৷ ও চিনি আনতে গেলে ওর কাপে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিলাম৷ কফি শেষ করার পর ও বলল ওর মাথা নাকি কেমন করছে৷ একটু পর ও ঘুমিয়ে গেলো। ওকে ধরে নিয়ে গাড়িতে বসালাম৷
৩ ঘন্টা পর ও চোখ খুললো। চোখ খুলার পর ও অচেনা জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করলো। আমি ওকে ছাদে নিয়ে গেলাম। তারপর ও বাড়ির চারপাশে হা করে তাকিয়ে আছে……………..
আমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় শিলা এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আমি ওকে ছাড়িয়ে নিলাম। তারপর ও কিছু বলার আগেই ঠাসস করে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। ও চড় খেয়ে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আমি বলতে শুরু করলাম
আমিঃ কি মনেকরো তুমি নিজেকে? সব ত্যাগ শুধু তুমিই করবে? এতসব করে কেনো তুমি আমাকে বার বার ঋণি করে দাও?
শিলাঃ মানে?
আমিঃ তুমি নিজেকে আড়ালে রেখেছিলে কেনো?
শিলাঃ আমি তো তোমাকে সব বলেছি। ( আমতা আমতা করে)
আমিঃ না শিলা না। তুমি আমাকে সবটা বলনি।
শিলাঃ চুপ
আমিঃ কি হলো? চুপ হয়ে গেলে কেনো?
শিলাঃ তাহলে তুমি সবটা জেনে গেছো?
আমিঃ হুম। কেনো তুমি আমার জন্য সব সময় নিজেকে কষ্ট দাও? আমি তো তোমার জন্য কোনোদিন কিছুই করতে পারিনি অথচ তুমি আমার জন্য সব করলে। আমাকে না জানিয়ে নিজে নিজেই এত বড় অসুখের মোকাবিলা করলে। কেনো আমাকে একবার জানানো যেতোনা? কষ্ট পেলে পেতাম তবে তোমার হাতটা ধরে রাখতে পারতাম। আমার খারাপ সময়ে সব সময় তুমি আমার পাশে ছিলে তবে তোমার খারাপ সময়ে তোমার পাশে থাকার সুযোগ আমাকে দাওনি। সারাজীবন কেনো তুমিই একা কষ্ট সহ্য করবে? কষ্ট গুলোর ভাগ দিতে শিখো। যতই বিপদ আসুক দুজনে হাতে হাত রেখে মোকাবিলা করব। জানো তুমি যখন আমাকে তোমার যোগাযোগ করার কারণ গুলো বলো তখন আমি সন্দেহ করেছিলাম। আমি জানি এই সমান্যটুকু কারণের জন্য তুমি আমাকে কখনও দূরে সরাতে পারোনা। সেদিন যদি আমি তোমার ফাইলগুলো না সরাতে যেতাম তাহলে আমি জানতেই পারতাম না। কেনো শিলা কেনো? আমাকে সব খুলে বলতে।
শিলাঃ তোমাকে জানানোর সাহস আমার হয়নি৷ তোমার চোখের সামনে আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি ঠিক থাকতে পারতেনা৷ আমি জানি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো। তোমার কষ্ট হলে যে আমি মরেও শান্তি পেতাম না। এত বড় রোগ হয়েছিল এটা জানলে তুমি আরও ভেঙে পড়তে। আমি এটা হতে দিতে পারতাম না। প্লিজ তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি এখন থেকে নিজের সব কথাই তোমার সাথে শেয়ার করব। কোনোদিন কোনোকিছু লুকাবনা। প্লিজ ক্ষমা করে দাও। ( কান্না করে)
আমি ওর চোখের পানি সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই ওকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে আমিও কাঁদতে লাগলাম৷ ওকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই বললাম
আমিঃ ক্ষমা চাইছো কেনো? তোমার মতো কাউকে আমি আমার জীবনে পেয়ে ধন্য মনে করি নিজেকে। জানিনা আমি জীবনে কোনো ভালো কাজ করেছি কিনা কিন্তু আল্লাহ আমাকে সেরা জিনিসটা উপহার দিয়েছে।
শিলা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিলো। আমিও ওর চোখের পানি মুছে দিলাম। তারপর ওর কপালে চুমু দিয়ে বললাম
আমিঃ সরি দরকার হলে তুমি আমাকে মেরে শোধ করে নাও তবে রাগ করে থেকোনা।
শিলাঃ পাগল একটা৷ তোমার উপর আমি রাগ করে থাকতে পারি? উল্টো আমার সব রাগ তোমাকে একবার দেখলেই হারিয়ে যায়।
আমিঃ আচ্ছা কাল কি যেনো বলছিলে না?
শিলাঃ কি বলছিলাম?
আমিঃ ওই যে রিফাতের জন্য একটা বোন আনার কথা।
শিলাঃ যাহ ফাজিল ( লজ্জা পেয়ে)
আমিঃ আমার তো একটা মেয়ে লাগবেই।
শিলাঃ তো আমি কি করব?
আমিঃ তুমি আবার কি করবে? কষ্ট তো আমাকে করতে হবে।
শিলাঃ তাই বুঝি? তো এভাবে অলসের মতো বসে না থেকে একটু কষ্ট করলেই পারো।
কি আর করার ওকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় ফেলে দিলাম। তারপর আর কি? Everything is history.
২ দিন পর রফিক ভাই আসলো। ওনাকে দেখে অনেক খুশি হলাম। আমি শাশুড়ীকে জানাইনি। ওনাদের দেখে আমার শাশুড়ী জিজ্ঞেস করলেন
শাশুড়ীঃ ওনারা কে বাবা?
আমিঃ আসলে মা আপনাকে না জানিয়েই আমি আর শিলা একটা কাজ করেছি।
শাশুড়ীঃ কি কাজ বাবা?
আমিঃ আসলে মা হয়েছে কি….. ( ওদের ব্যাপারে বললাম)
শিলাঃ মা তুমি কি কিছু মনে করেছ?
শাশুড়ীঃ পাগলি মেয়ে আর পাগল জামাই আমার। তোরা জানিস আমি কতটা খুশি হয়েছি? এত বড় বাড়িতে মাত্র এই কয়জন থাকতে ভালো লাগে? এখন থেকে আমরা সবাই একটা পরিবার৷
শিলাঃ সত্যি বলছো মা?
শাশুড়ীঃ হ্যাঁরে পাগলি। যাক বুড়ো বয়সে একটা বোন পেলাম আমি। সাথে ছেলে বৌমা সব পেলাম৷
আন্টিঃ আমারও আজকে নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। দুইজন বুড়ি আজ থেকে অনেক গল্প করব।
রফিক ভাই আর বর্না আপু তো অনেক খুশি। রাতে সবাই মিলে একসাথে খেতে বসলাম। খাওয়া শেষে ছাদে গেলাম। শাশুড়ী আর আন্টি গল্প করছে আর শিলা বর্না আপুকে সব সাজাতে সাহায্য করছে। ছাদে দাঁড়িয়ে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি তখনি পিছন থেকে আমার কাঁধে একজন হাত রাখলো। দেখি এটা রফিক ভাই
আমিঃ ভাইয়া তুমি এখানে? রাত হয়েছে শুয়ে যাও। এমনিতেও অনেক জার্নি করে এসেছো।
রফিক ভাইঃ আজ আমি ধন্য তোর মতো একটা ভাই পেয়ে। জানিস বর্তমানে নিজের ভাই তার অন্য ভাইকে মেরে ফেলতেও দুইবার ভাবেনা আর তোকে এবার ভাই বলেছি তাতেই তুই আমাকে এতো কিছু দিলি?
আমিঃ আমি আবার কি দিলাম? আর তাছাড়া ছোট ভাই যখন মেনেছো তখন আমার বড় ভাইয়ের প্রতি তো আমার একটা দায়িত্ব আছে তাইনা। তুমি যেমন তোমার পরিবারের ভাগ আমাকে দিয়েছিলে তেমনি আমি দুই পরিবারকেই এক করে দিলাম।
রফিক ভাইঃ আচ্ছা আর ইমোশনাল করিসনা৷ আচ্ছা অফিস নিয়ে কি ভাবছিস?
আমিঃ আমার তো আর ভাবার কিছু নাই। আগের যে ম্যানেজার ছিলো ওনার বয়স হয়েছে। ওনি খুব সৎ একজন মানুষ তাই বয়স হবার পরও ৬ বছর কোম্পানিটা দেখে রেখেছেন। আমি চাই ওনাকে ভালোভাবে বিদায় দিতে। তারপর আমি আর তুমি আমাদের কাজ সামলাবো আর শিলা, বর্না আপু এরা সংসার সামলাবে৷
রফিক ভাইঃ কথাটা ভুল বলিসনি। তাছাড়া বর্না আর আমি কাজ করে যথেষ্ট জমিয়েছি। তাতেই জীবন চলে যাবে। তাই আমিও ভাবছিলাম বর্নাকে আর কাজ করতে দিবনা।
আমিঃ আচ্ছা দুইদিন রেষ্ট নাও তারপর কাজ সামলাবো।
রফিক ভাইঃ আচ্ছা। আমি বর্নাকে সব বলে দেখি
আমিঃ আচ্ছা।
তারপর রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। বাড়িতে সুখ এসেছে। আমার শাশুড়ী আর আন্টির গলায় গলায় ভাব। রফিক ভাই বর্না আপুকে সব বলার পর বর্না আপুও খুশি হয় কারণ তারও ইচ্ছা হয় সংসার করার।
৭ দিন পর আজকে আগের ম্যানেজারকে বিদায় দিলাম। লোকটা সত্যি খুব বেশি ভালো মানুষ৷ শশুর হয়তো এই একটা ভালো কাজ করে গেছেন যে এরকম একটা মানুষকে ম্যানেজার বনিয়েছেন। বয়স হবার পরও ৬ বছর সামলিয়েছেন। আমরা না আসলে যে কি হতো আল্লাহই জানে। ম্যানেজার সাহেব আমাদের সব কাজ বুঝিয়ে দিলেন। যাবার সময় অফিসটার দিকে তাকিয়ে কেঁদেছেন অনেক। ১৫ বছর থেকে কাজ করছে। কোম্পানির শুরু থেকে সাথে ছিলেন তাই আবেগ থাকাটা স্বাভাবিক। ওনার ছেলে মেয়েরা এসেছিলো। আমি ওনার ছেলে এখন ছোট তবে ওনাকে কথা দিয়েছি পড়াশোনা শেষ হলেই ওকে চাকরি দিব।
পরেরদিন শাশুড়ী আর শিলা এসে সবার সামনে আমাকে কোম্পানির বস ঘোষনা করে গেলো। শিলা আর আমার শাশুড়ী চাইছিলো আমার নামে কোম্পানিটা করে দিতে তবে আমি নেইনি। এটা শিলার অধিকার আর শিলারই থাকবে।
আমরা অফিসের দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক মন দিয়ে কাজ শুরু করলাম। সকল স্টাফদের বেতন বাড়িয়ে দিয়ে একটু কাজ বেশি দিলাম৷ অফিসে কাজের চাপ কমানোর জন্য আরও দুইটা শাখা চালু করার উদ্যোগ নিলাম। তবে এটার জন্য বিল্ডিং কিনে রাখলেও সব শুরু করতে ১ বছরের মতো লেগে যাবে। আগের অফিসের সেই রকম নাম ডাক না থাকলেও তাদের কাজ গুছানো ছিলো অথচ এই অফিসের নাম ডাক মোটামুটি ভালো থাকলেও একটাই অফিস বিধায় কাজ করতে সময় লাগে। তাই এই উদ্যোগ নেওয়া।
বিভিন্ন ব্যস্ততার মাঝে থাকার কারণে শিলা রিফাতকে সেরকম সময় দিতে পারেনি৷ তবে এখন মা ছেলে মিলে অনেক দুষ্টুমি করে। ওর যখহ ইচ্ছা হয় আমাদের সাথে আবার ইচ্ছা হলে ওর নানির কাছে থাকে। আজকে অফিস থেকে ফিরে দেখি রিফাতর আর শিলা দুজন মিলে দুষ্টুমি করছে। আমিও ওদের সাথে যোগ দিলাম। আজকে রিফাত আমাদের সাথে আছে। শিলা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। মায়ের আদর আসলেই মা ছাড়া কেউ দিতে পারেনা। এই কয়দিনেই মায়ের আদর পেয়ে রিফাতের মধ্যে চঞ্চলতা এসেছে। এর মধ্যে ওকে একটা স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। শিলা নিয়ে যায় আর আসার ড্রাইভার নিয়ে আসে। শিলা রিফাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। হয়তো আমার মা থাকলে আমাকেউ হয়তো এভাবে আদর করতেন। এর মাঝে রিফাত বলে উঠলো
রিফাতঃ বাবা জানো আমাদের স্কুলে অনেকের ছোট বোন আছে। আমার বোন কোথায়?
আমিঃ আমার বাবার বোন লাগবে?
রিফাতঃ হ্যাঁ বাবা আমার একটা বোন লাগবে৷
আমিঃ আচ্ছা বাবা এনে দিবো।
রিফাতঃ কবে?
আমিঃ খুব তাড়াতাড়ি
তারপর ওকে নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। রিফাত আর শিলা সারাদিন দুষ্টুমিতে মেতে থাকে। ৬ বছরের আদরের ঘাটতি পুষিয়ে দিতে না পারলেও আগের সব দুঃখ ভুলিয়ে দিবে। এখন প্রতিদিন ওদের জন্য চকলেট, আইসক্রিম নিয়ে আসতে হয়। যাই হোক মা ছেলের দুষ্টুমি দেখে আমার অনেক ভালো লাগে।
৩ মাস চলে গেলো। ইদানিং দেখছি শিলার মধ্যে কেমন জানি বিষন্নতা এসেছে। খাওয়া দাওয়া কম করে। আর আজকে তো মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছে। এই ঘটনায় আমি অনেক বেশি ভয় পেয়ে যায়। আমি জানি ওর সমস্যার কথা তাই অনেক ভয় পেয়েছিলাম। তাড়াহুড়ো করে আমি আবার সেই ডাক্তারের কাছেই শিলাকে ভর্তি করি। শিলাকে দেখে উনি অনেক খুশি হয়েছিলেন তবে ওর অবস্থার কথা শুনে একটু ঘাবরে গেলেন। কিছু টেস্ট করতে দেওয়া হলো। ৩ ঘন্টা পর রিপোর্ট আসলো। আমি ডাক্তারের সাথে দেখা করতে গেলাম
আমিঃ ডাক্তার শিলার কি হয়েছে?
ডাক্তারঃ চুপ
আমিঃ এভাবে চুপ করে থাকবেন না প্লিজ বলুন ওর কি হয়েছে?
ডাক্তারঃ আবার বেড়ে উঠছে।
আমি কথাটা শুনে নিজের চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারলাম না৷ অচেনা ভয় আমাকে ঘিরে ধরলো। ডাক্তার আমার অবস্থা দেখে হাসতে লাগলেন৷
আমিঃ আপনি এই অবস্থাতে হাসছেন?
ডাক্তারঃ আপনার পাগলামি দেখে হাসি আটকে রাখতে পারলাম না।
আমিঃ তাই বলে হাসবেন? জানেন আমার এখন কি অবস্থা হয়েছে?
কথাটা শুনে সব ভয় ভীতি দূরে হয়ে মনে আনন্দের ফোয়ারা বইতে লাগলো। ডাক্তার মহিলা না হয়ে পুরুষ হলে জড়িয়ে ধরতাম খুশিতে। আমি চোখের পানি মুছে হাসি মুখে বললাম
আমিঃ আপনার কি আজকে আর কোনো অপারেশন আছে?
ডাক্তারঃ না আমি ইমার্জেন্সি ছাড়া এখন দিনে ২ টার বেশি অপারেশন করিনা। আমার পরিবারকে তো সময় দিতে হয়।
আমিঃ আচ্ছা আপনি বসুন আমি আসছি।
আমি কাউকে কিছু না বলে দৌড়ে বাইরে চলে গেলাম। রফিক ভাই অফিসে ছিলেন। আমাকে দৌড়ে যেতে দেখে বর্না আপুও আমার পিছনে আসতে লাগলো। তবে তার আগেই আমি চোখের আড়াল হয়ে গিয়েছি। আমাকে না পেয়ে ডাক্তারের কাছে গেলো। তারপর ডাক্তার সবকিছু বললেন৷ সবাই কথাটা জানতে পেরে বাড়িতে খুশির জোয়ার চলে এলো। খুশির মাঝেও বর্ণা আপুর চোখ থেকে পানি পড়ে গেলো একটা সন্তানের জন্য।
আমি মিষ্টি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে আমি ডাক্তারকে ৫ কেজি মতো মিষ্টি দিলাম। ডাক্তার ম্যাম বললেন
ডাক্তারঃ এতো মিষ্টি কিসের জন্য?
আমিঃ আপনার মনে আছে যখন আপনি প্রেগন্যান্ট ছিলেন তখন শিলাকে মিষ্টি দিয়েছিলেন? আজ আমার আর শিলার তরফ থেকে মিষ্টিগুলো আপনার জন্য। দুলাভাইকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবেন।
ডাক্তারঃ আচ্ছা ঠিক আছে। ( হাসি দিয়ে)
শিলাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সবটা জানার পর ও তো অনেক খুশি। ওর চোখে সেই খুশি দেখতে পেলাম যেই খুশি ৬ বছর আগে রিফাত হবার সময় দেখেছিলাম। বাড়ি আসতেই দেখি রিফাতও স্কুল থেকে ফিরেছে। আমাদের হাসিখুশি দেখে রিফাত প্রশ্ন করলো
রিফাতঃ তোমরা সবাই এতো খুশি কেনো?
আমিঃ কারণ আমার বাবার আপু আসবে তোমার সাথে খেলতে।
রিফাতঃ সত্যি বলছো বাবা? আমার আপু আসবে?
আমিঃ হ্যাঁ বাবা।
রিফাতঃ কবে আসবে? আমি কখন খেলব আপু সাথে?
আমিঃ একটু অপেক্ষা করো।
রিফাতঃ বেশিদিন অপেক্ষা করতে পারবোনা।
সবাই রিফাতের কথা শুনে হাসলো। বাসায় আবার আনন্দ বিরাজ করছে। তবে আমার নিজের খারাপ লাগছে রফিক ভাইয়ের জন্য। একটা বাচ্চা নিয়ে বাবা মায়ের কতো স্বপ্ন থাকে আর আল্লাহ তাদের সেই সুখটা না দিয়ে পরীক্ষা করছেন।
দেখতে দেখতে ৬ মাস চলে গেলো। অফিসের কাজ অনেক ভালো চলছে। অগ্রগতিও হয়েছে ভালো। সকল স্টাফ আমাদের ব্যবহারে খুব খুশি। আমি সবাইকে বলে দিয়েছি যে সবাই যেনো আমাকে ভাই বলে ডাকে। সব স্টাফ অনেক ভালেভাবে কাজ করে।
আজ শিলার আল্ট্রাসোনো করার জন্য হাসপাতে এসেছি। আল্ট্রাসোনো শেষে পেলাম আরেকটা বিরাট খুশি খবর। আমার ঘরে এবার একটা না দুইটা সন্তান আসতে চলেছে। মানে ডাবল খুশি তবে আমি একটা কথা ভাবলাম মনে মনে। রাতে শিলাকে বলব। শিলাও অনেক খুশি।
রাতে শিলার পাশে শুয়ে আছি তখন শিলা বললো
শিলাঃ নীল আমার একটা কথা বলার ছিলো যদি তুমি কিছু মনে না করো তাহলে বলব।
আমিঃ আমারও একটা কথা বলার ছিলো। কিভাবে যে বলি।
শিলাঃ কি কথা বলো।
আমিঃ না আগে তুমি বলো।
শিলাঃ আমিই আগে বলবো? আচ্ছা বলছি তবে ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিও।
আমিঃ আচ্ছা।
শিলাঃ আচ্ছা আমি ভাবছিলাম কি আমাদের তো টুইন বেবি হবে।
আমিঃ হুম তো?
শিলাঃ রফিক ভাইয়েরাও তো এই বাড়িতেই থাকবেন৷
আমিঃ হুম।
শিলাঃ আমি বলছিলাম কি আমাদের একটা বেবি যদি আমি ওনাদের দিয়ে দেই? জানি বাবা হিসেবে এটা তোমার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। তবে একবার ভেবে দেখো আল্লাহ আমাদের তিনটা সন্তান দিয়েছেন আর ওনাদের তো একটাও দেননি। আমরা যদি আমাদের একটা বেবি ওনাদের দিয়ে দেই তবে কেমন হয়? তাছাড়া আমাদের সাথেই তো থাকবে, সব সময় আমাদের চোখের সামনেই থাকবে৷ হয়তো আমাদের চোখের সামনে আমাদের সন্তান অন্য কাউকে বাবা মা বললে এটা হয়তো সহ্য করার মতো হবেনা তবে তাদের সুখের জন্য কি আমরা এটা করতে পারিনা? তাদের যেহেতু কোনো সন্তান নেই তাই তারা কোনোদিনও সন্তানের ভালোবাসায় কমতি রাখবেনা।
আমিঃ সত্যি শিলা তোমার চিন্তা ভাবনা অনেক উচ্চ মাপের। কোনো বাবা মা কখনই চাইবেনা তাদের সন্তান অন্য কাউকে দিতে৷ তবে তুমি জানো কি আমিও তোমাকে এই কথাগুলোই বলতাম। তার আগেই তুমি আমার মনের কথাগুলো বলে দিলে। এখন ওদের কিছু বলবনা৷ তবে বেবি হবার পরে ওদের উপহার দিবো।
শিলাঃ আচ্ছা তোমার ভাবনার সাথে আমার ভাবনা মিলে গেলো কেনো?
আমিঃ কারণ আমাদের ভালোবাসা অনেক গভীর তাই। ( বলার পর ওর কপালে চুমু দিলাম)
ওকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। রিফাত ওর নানির কাছে থাকে। বর্না আপু এখন শিলার অনেক খেয়াল রাখে। আমার শাশুড়ীকে সেরকম কিছুই করতে দেইনা।
অফিসে গিয়ে কেবিনে বসে আছি তখন একজন মধ্য বয়স্ক লোক আসলো আমার কেবিনে৷ আমি তাকে বসতে বললাম। তার জন্য চা আনতে দিয়ে চা খেতে খেতে তার সাথে কথা বলতে শুরু করলাম
আমিঃ জ্বী তা আপনাকে তো চিনলাম না?
লোকটাঃ আমাকে চিনবেনা তুমি তবে তোমার কাজ দেখে আজকে আমি তোমার কোম্পানির সাথে একটা ডিল করে এসেছি।
আমিঃ কিসের ডিল আংকেল?
লোকটাঃ আমি HK Group of industries এর মালিক হাবিবুর খান । এত বছর বিদেশে ছিলাম তাই দেশের মানুষ আমাকে চিনেনা। এবার হয়তো আমাকে চিনতে পেরেছো।
তার পরিচয় শুনে আমি অবাক৷ কারণ HK group of industries বাংলাদেশের মধ্যে ৫ম স্থানে আছে। আমি বেশ অবাক হলাম যে তিনি নিজে আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন৷
আমিঃ আংকেল আপনি আমাদের সাথে আবার কি ডিল করবেন?
হাবিবুর খানঃ তোমাদের কাজ আমার পচ্ছন্দ হয়েছে। আর তোমাদের অগ্রগতিও অনেক দ্রুত হচ্ছে আর সব চাইতে বড় কথা তোমাদের ব্যাপারে খোজ নিয়ে জানতে পেরেছি তোমরা সৎভাবে কাজ করো। তাই আমি তোমাদের সাথে একটা ডিল করতে এসেছি।
আমিঃ এটা আমাদের কোম্পানির জন্য বিশাল সৌভাগ্য হবে স্যার।
হাবিবুর রহমানঃ আংকেল ঠিক ছিলো। স্যার বললে বুড়ো বুড়ো লাগে৷
আমিঃ তাহলে আংকেল বলবো।
হাবিবুর রহমানঃ আচ্ছা। আজকে আমি শুধুমাত্র তোমাকে দেখার জন্য আসলাম আর সাথে প্রস্তাব দিতে৷ কালকে আবার আসব আমার অফিসের ম্যানেজারকে নিয়ে তারপর সব ডিল সাইন করে কনফার্ম করে নিব।
আমিঃ আচ্ছা আংকেল।
সবকিছু যেনো স্বপ্নের মতো লাগছে। কালকে ডিলটা ফাইনাল হলে সকলের জন্য একটা বোনাস থাকবে। পার্টি করে হুদাই টাকা নষ্ট না করে সকলকে বোনাস দিলে তারা বেশি খুশি হবেন।
পরেরদিন বিকালে আংকেল তার ম্যানেজারকে নিয়ে অফিসে আসলেন৷ ডিলটাও কনফার্ম হয়ে গেলো। এই বার আমাদের কোম্পানি অনেক এগিয়ে যাবে যদি আমরা ঠিক মতো কাজ করতে পারি৷ তবে এতো ভালো কোম্পানি যখন আমাদের উপর ভরসা করেছে তখন আমরাও সবটা দিয়ে কাজ করব।
বাড়ি এসে সবাইকে বলতে সবাই অনেক খুশি হয়েছে। এখন ভালোভাবে কাজ করার পালা। শিলার ৭ মাস চলছে। এখন ব্যস্ততা একটু বেশি থাকায় ওর দেখাশোনার জন্য একটা কাজের মেয়ে ঠিক করেছি।
হাবিবুর আংকেলের কোম্পানিতে এবার লাভ হওয়াতে তাদের বাসাস একটা পার্টি রেখেছেন। আমাকে আর রফিক ভাইকে আসতে বলেছেন। ফ্যামিলি সহ আসতে বলাতে রফিক ভাই বর্না আপুকে সাথে নিয়েছেন। সন্ধ্যার দিকে কাজের মেয়েকে শিলার পাশে রেখে আমরা পার্টিতে গেলাম। বিশাল আয়োজন। আংকেল আমাদের দেখে অনেক্ষন কথা বললেন আমাদের সাথে। কথার মাঝে শিলা একবার ফোন দিয়েছিলো। কল কেটে আমি একটু সাইডে গেলাম কথা বলতে।
আমিঃ কিছু বলবে?
শিলাঃ আমার না আইসক্রিম খাবার মন হচ্ছে।
আমিঃ এই সময়ে আইসক্রিম?
শিলাঃ হুম। নিয়ে আসবে?
আমিঃ রিফাত জেগে আছে?
শিলাঃ না। মায়ের কাছে গিয়ে ঘুমিয়ে গেছে।
আমিঃ কিন্তু ঠান্ডা লাগলে তো সমস্যা হবে।
শিলাঃ কিছু হবেনা।
আমিঃ রিফাতরে জন্যও নিয়ে আসছি সকালে দিয়ে দিও।
শিলাঃ ঠিক আছে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।
আমিঃ আচ্ছা জানু।
তারপর ফোন কেটে পিছনে ফিরলাম৷ দেখি একটা শাড়ি পরা মেয়ে আমার দিকেই আসছে। আমি পাশ কাটিয়ে আসতে যাবো তখন মেয়েটা বললো
মেয়েটাঃ আরে আরে আপনার সাথে কথা বলতে আসলাম আর আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
আমিঃ আমি পার্টিতে যাচ্ছি।
মেয়েটাঃ একটু কথা বলা যাবে?
আমিঃ জ্বী বলুন
মেয়েটাঃ আপনি তো নীল তাইনা?
আমিঃ জ্বী। কিন্তু আমাকে চিনলেন কিভাবে?
মেয়েটাঃ আমি হাবিবুর খানের মেয়ে রিনা খান।
আমিঃ আচ্ছা আপনি তাহলে আংকেলের মেয়ে?
রিনাঃ জ্বী। আপনার ব্যাপারে বাবা অনেক কথা বলে। আজ আপনি আসবেন শুনে আপনার সাথে দেখা করার মন হলো। আপনাকে বাবার সাথে কথা বলতে দেখে আপনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বাবা বলে আপনি নাকি নীল।
আমিঃ ও আচ্ছা।
রিনাঃ তা পার্টিতে এসে এদিকে একা একা কার সাথে কথা বলছিলেন? গার্লফ্রেন্ড নাকি?
আমিঃ আরে না না গার্লফ্রেন্ড হতে যাবে কেনো? আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নাই৷
রিনাঃ বাহ বেশ ভালো তো।
আমিঃ আপনি মনেহয় বাইরে থেকে পড়াশোনা করে দেশে এসেছেন তাই না?
রিনাঃ আপনি বুঝলেন কিভাবে?
আমিঃ আপনার কথা বার্তার ধরন, আপনার ড্রেসিং সেন্স, চুলের স্টাইল দেখে বুঝা যাচ্ছে।
রিনাঃ বাহ খুব ভালো ধরেছেন দেখছি। তা চলুন পার্টিতে গিয়ে কথা বলি।
পার্টিতে রিনার সাথে অনেক্ষন কথা হয়েছে। তবে বাইরের কালচারে বড় হয়েছে তাই গায়ে পড়ার অভ্যাস আছে যেটা আমার পচ্ছন্দ হলোনা। পার্টি শেষ হলো রাত ১০ টায়। বাসায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন আমার হাবিবুর আংকেল দাড়াতে বললেন। তার কথা মতো একটু দাঁড়ালাম তারপর আমাদের সাথে কথা বলতে এলেন
হাবিবুর খানঃ আসলে নীল তোমাকে একটা কথা বলার জন্য ডাকলাম।
আমিঃ জ্বী আংকেল বলুন।
হাবিবুর খানঃ মা এদিকে আই তো। ( রিনাকে ডাকলো) এটা আমার মেয়ে রিনা। ২ মাস হলো কানাডা থেকে এসেছে।
আমিঃ জ্বী আংকেল ওনার সাথে কথা হয়েছে।
হাবিবুর খানঃ তাহলে তো ভালোই হলো। আসলে আমি একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
আমিঃ জ্বী বিনা দ্বিধায় বলে ফেলুন।
আংকেলঃ আসলে আমি রিনার সাথে তোমার বিয়ে দিতে চাই।
কথাটা শুনে আমি একবার রফিক ভাই আর আপুর দিকে তাকালাম। তারা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আমিও একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলাম। তারপর আবারও আংকেল বলতে শুরু করলেন
হাবিবুব স্যারঃ বাইরে বড় হয়েছে তাই হয়তো সংকোচ হচ্ছে। তবে বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর রিনারও নাকি তোমাকে খুব পচ্ছন্দ হয়েছে তাই আমি বলছিলান ব্যাপারটা ভেবে দেখো।
আমিঃ আসলে আংকেল এটা তো সম্ভব না।
হাবিবুর স্যারঃ কেনো?
আমিঃ আংকেল আমি বিবাহিত। ৭-৮ বছর হলো বিয়ে হয়েছে। ৬.৫ বছরের একটা ছেলে আছে আর আমার স্ত্রী মা হতে চলেছে।
আংকেলঃ কি তুমি বিবাহিত? আগে তো কখনও বলনি।
আমিঃ আসলে আংকেল আমি মনে করেছি আপনি আমার সম্পর্কে জানেন তাই বলিনি।
আংকেলঃ আসলে আমারি ভুল হয়েছে। আজ তোমার সাথে কেউ আসেনি দেখে আমি ভেবেছি তোমার হয়তো বিয়ে হয়নি।
রিনাঃ আপনি যে বললেন আপনার গার্লফ্রেন্ড নাই?
আমিঃ বউ থাকতে আবার কিসের গার্লফ্রেন্ড?
আংকেলঃ আচ্ছা বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি বুঝতে পারিনি।
আমিঃ আরে না আংকেল। আমি সরি আমারও বলে দেওয়া উচিৎ ছিলো। রিনা সরি আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।
রিনাঃ সরি বলছেন কেনো? সরি বলার মতো কিছুই হয়নি।
হাবিবুর খানঃ আচ্ছা সব বাদ। তোমরা বাসায় যাও। আর মিষ্টিও খাইয়ে দিয়ো।
আমিঃ মিষ্টি না একদিন সপরিবারে আমাদের বাসায় আসবেন। অনেক ভালো লাগবে।
হাবিবুর স্যারঃ আচ্ছা আসবো।
বেচারি রিনা আগেই ছ্যাকা খেয়ে নিলো। আমরা আর দেরি না করে বাসায় ফিরলাম। আসার পথে শিলার জন্য আইসক্রিম নিয়েছি। বাসায় পৌছে রুমে গিয়ে দেখি গিয়ে দেখি শিলা পেটে হাত দিয়ে বসে আছে৷ আমাকে দেখে একটু লজ্জা পেলো।
আমিঃ কি ব্যাপার মিস? ওদরে সাথে কথা বলছিলেন বুঝি?
শিলাঃ হুম। তোমার নামে বিচার দিচ্ছিলাম৷
আমিঃ তা কি বিচার দিলেন শুনি?
শিলাঃ বললাম ওদের বাবা অনেক পঁচা। এতো রাজ পর্যন্ত জাগিয়ে রেখেছে আমাকে।
আমিঃ তা কি বললো?
শিলাঃ বললো তোমার সাথে কথা বলবেনা।
আমিঃ তাহলে আইসক্রিম গুলো আমিই খাই।
শিলাঃ এই না না৷ আমি কিছু বলিনি। বাবুদের বাবা অনেক ভালো। এত্তোগুলো ভালোবাসে আমাকে।
আমিঃ সত্যি তো?
শিলাঃ হুম।
ওকে আইসক্রিম দিলাম আর আমিও একটা নিলাম। দুজনে ব্যালকনিতে বসে একসাথে আইসক্রিম খাচ্ছি। কেউ কোনো কথা বলছিনা। আইসক্রিম শেষ করে ওকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরেরদিন অফিসে একটু কাজ বেশি থাকায় ফিরতে রাত হলো। আর আজকে চকলেট আনতেও ভুলে গিয়েছি। শরীরটাও খারাপ লাগছে। বাড়ি পৌছে রিফাত দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ওকে একটু আদর করার পর চকলেট চাইলো। আমি তো আনতে ভুলে গেছি। তাই রুমে গিয়ে ব্যাগ রেখে আমার বের হবো তখন শিলা আটকালো।
শিলাঃ দেরি করে এসে আবার কোথাই যাও?
আমিঃ রিফাতের জন্য চকলেট আনতে ভু্লে গেছি। ও রাগ করে আছে। তাই চকলেট নিয়ে আসি।
শিলাঃ একে তো ক্লান্ত হয়ে ফিরলে আর এখন আবার যাবে?
আমিঃ ও রাগ করে থাকলে কি আমার ভালো লাগবে?
শিলাঃ ফ্রীজে আইসক্রিম আছে ওটাই দিয়ে আজকে ভুলিয়ে দাও। এখন যেতে হবেনা।
আমিঃ আচ্ছা ঠিক আছে।
তারপর ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করে রিফাতকে দিলাম৷ যাক রাগ ছাড়ানো গেলো। রাতে শুয়ে আছি তখন আবার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসলো। রিফাত আর শিলা জেগে গেলো। শিলা তো এমনিতেই দুর্বল তারপরও রিফাতকে জাগতে দেখে ওকে একটা বাটিতে করে পানি আনতে বললো। রিফাত পানি নিয়ে আসলে শিলা আমার মাথায় জলপট্টি দিলো। মা ছেলে মিলে আমার সেবা করছে। এটা দেখে আনন্দের বুকটা ভরে গেলো। রিফতা তার ছোট হাতে মাঝে মাঝে আমার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। একটু পর শিলাকে বললো
রিফাতঃ মা তোমার পেটে আমার আপু আছে?
শিলাঃ হ্যাঁ বাবা। তোমার আপু এখানে বড় হচ্ছে।
রিফাতঃ কবে বাইরে আসবে আপু? আর এত ছোট জায়গাতে কেনো রেখেছো আপুকে?
শিলাঃ বাবুরা এখানেই থাকে। তুমিও ছিলে একসময়।
রিফাতঃ আমিও ছিলাম? আমি তো বড় হয়ে গেছি।
শিলাঃ তোমার আপুও বড় হয়ে যাবে আস্তে আস্তে।
শিলা আমাকে ঔষধ খায়িয়ে দিলো। একটু পর জ্বর কমলো। শিলা রিফাতকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলো। সকালে উঠে জ্বর না থাকলেও শরীরটা দুর্বল ছিলো। অফিস যেতে পারিনি। বিকালে আবার জ্বর আসলো। শিলা কষ্ট করে যতটুকু ওর দ্বারা সম্ভব আমার সেবা করেছে। পরেরদিন থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলাম।
শিলার এখন ৯ মাস ২৪ দিন চলছে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছি যাতে কোনো বিপদ না হয়। তারওপর জমজ বাচ্চা তাই সমস্যা হতে পারে। ওর জন্য রক্তের ব্যবস্থাও করে রেখেছি। আমি নিজেও এখন অফিস যাইনা। রফিক ভাই আর এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার কাজ সামলাচ্ছে। এই সময়ে আমি শিলার হাত ছাড়তে পারবনা। গোসল করতে শুধু বাড়ি যাই৷ বর্না আপু রান্না করে নিয়ে আসে৷ আমার শাশুড়ী আর আন্টি দিনে একবার করে আসে।
২ দিন পর শিলার ডেলিভারি পেইন উঠলো। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন সিজার করানোর। কারণ জমজ বাচ্চা নরমালে হওয়াটা রিস্কের ব্যাপার তাই আমিও আর দ্বিমত করলাম না৷ ১০ মিনিট পর অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হলো। এর মাঝে রফিক ভাই চলে এসেছে।
একটু পর বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনে মনটা উৎফুল্ল হয়েগেলো৷ জোড়া কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে তার মানে দুজনেই সুস্থ আছে৷ একটু পর নার্স বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে আসলেন
নার্সঃ ওনি ভালো আছেন৷ রক্ত দিয়েছি এখন সেন্সলেস হয়ে আছে একটু পর কেবিনে শিফট করা হবে।
আমি আমার মেয়েকে নিলাম আর আমার ছেলেকে বর্না আপু কোলে নিলো। ওনার চোখ মায়ের মমতা খুজে পেলাম৷ একে একে সবাই ওদের কোলে নিলো।
৩০ মিনিট পর শিলাকে অন্য কেবিনে পাঠানো হলো। আমরা ওর পাশে বসে আছি আর ওরা দুইজন কান্না করছে। কিছুক্ষন পর শিলার জ্ঞান ফিরলে ওর দুই পাশে দুইজনকে রাখলাম৷ পরম যত্নে ওদের কপালে চুমু দিলো। রিফাত তো খুশিতে লাফাচ্ছে। ভাই বোন পেয়ে ও মহাখুশি।
৪ দিন পর শিলাকে বাসায় নিয়ে আসলাম। ১ মাস পর মোটামুটি সুস্থই আছে।
আজকে সবাই মিলে এক সাথে বসে আছি। রিফাত বোনকে নিয়ে আছে আর আমার কাছে আমার ছেলে আছে৷ বর্না আপু বারবার মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আমি এবার ভাবলাম ওদের সারপ্রাইজ দেওয়ার সময় চলে এসেছে। আমি রফিক ভাইকে আমার কাছে ডাকলাম। ওনি আমার কাছে আসা মাত্রই আমি আমার ছেলেকে ওনার কোলে তুলে দিলাম৷ রফিক ভাই আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে…………..
রিফাতকে ঘুম পাড়িয়ে শিলা আমাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলো। আজ সে তাদের সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা জানতে চাই। আমরা গিয়ে বসলাম। শিলা বলল
শিলাঃ মা আজকে তোমাদের সাথে ঘটে যাওয়া সব কিছু খুলে বলো।
কথাটা শুনার পর শাশুড়ীর চোখে পানি দেখতে পেলাম। উনি পানি মুছে বলতে শুরু করলেন
★শিলার মায়ের কথা★
তোর বাবার কথাগুলো শুনে সেদিন রাতে তোর বাবাকে অনেক বুঝায়। তবে সে কিছুতেই রাজি হবে না। এরপর থেকে উনার সাথে আমারও তেমন কথা হতো না। তোর মুখের দিকেও তাকানো যাচ্ছেনা৷ সবটাই ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। যেদিন তুই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাস সেদিন সকালে তোর রুমে গিয়ে দেখি দরজা খোলা। ভিতরে তোকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু লক্ষ্য করলাম টেবিলের উপর একটা কাগজ ভাজ করে রাখা। ওটা তোর রেখে জাওয়া চিঠি ছিলো। প্রথমে আমি পড়ে খুশি হয়েছিলাম যে তুই এই নরক থেকে পালিয়েছিস৷ কিন্তু আবার নীল আর তোর ছেলের জন্য চিন্তা হয়।
তবে আমি ভেবেছিলাম তোর বাবা চিঠির কথাগুলো পড়লে হয়তো সে নিজের ভুল বুঝতে পারবে। তাই আমি তাকে ডেকে তার কাছে চিঠিটা দেই। তোর বাবা চিঠি পড়া শুরু করে
প্রিয় বাবা মা,
বাবা চোখে আর সেই প্রিয় বাবার মর্যাদা নাই তোমার। বাবাই বা বলছি কেনো? তুমি আমার বাবা হবারই যোগ্যতা হারিয়েছ। আমার তাজ্য করে দিয়েছো। জানো বাবা তারপরও আমি প্রতিদিন তোমার কথা ভাবতাম। একটা ভুল হয়তো করে ফেলেছি তবে আমি খুব সুখে ছিলাম বাবা। আর বাবা মায়ের কাছে তো নাকি সন্তানের সুখটাই আগে। তারপরও যেহেতু ভুল করেছি তাই রাগ করাটা স্বাভাবিক। এতো কিছুর পরেও হাল ছাড়িনি৷ আমার বিশ্বাস ছিলো আমার সন্তান হলে সবাই মেনে নিবে। কিন্তু মেনে নেওয়া দূরের কথা একটাবার দেখতেও আসলেনা৷ তবুও মা এসেছিলো এতেই একটু প্রশান্তি পেয়েছিলাম৷ আমি আমার স্বামী সন্তান নিয়ে অনেক বেশি ভালো ছিলাম৷ তবে জানিনা সে সুখটা কেনো তুমি সহ্য করতে পারলেনা।
যেদিন তুমি আমাকে ফোন করো সেদিন আমি অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এবার হয়তো আমাকে মেনে নিবে এবং তুমি বলেছিলে সেটা। আমিও তোমার কথায় বিশ্বাস করে তোমার একবার ডাকাতেই নিজের স্বামীকে মিথ্যা বলে তোমার কাছে গেলাম। জানো বাবা তুমি যখন আমার মাথায় হাত রাখলে তখন মনে আলাদা একটা প্রশান্তি কাজ করছিলো। তবে পরবর্তীতে তুমি যে কাজটা করলে তাতে আমার ভিতর থেকে তোমার জন্য ভালোবাসা চলে গেছে। তুমি আমার সংসার ভেঙে লোভে পড়ে আমাকে বিক্রি করে দিতে চাইছো। এমপির ছেলে একটা ধর্ষক, চাঁদাবাজ এটা সবাই জানে। তুমি সেটা জেনেও আমাকে তার কাছে বিক্রি করে দিতে চাইলে। তোমার তো সব ছিলো বাবা তাহলে কেনো তুমি লোভে পড়ে আমাকে বিক্রি করে দিতে চাইলে? তোমার এই সিদ্ধান্তে আমার নিজেকে পতিতা মনে হয়েছিলো তখন৷
বাবা মা নাকি তাদের সন্তানের জন্য সব কিছু করতে পারে তাহলে আমার বেলায় ভিন্ন হলো কেনো? কি দোষ করেছিলাম? আমার ভালোবাসাটা দোষ ছিলো নাকি সুখে থাকাটা? আচ্ছা একটা মানুষ এতিম বলে কি তাকে ভালোবাসা যায়না? জানো বাবা ছেলেটা এতিম হলেও মনটা পরিষ্কার। তোমার টাকা ওয়ালা বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দিলে হয়তো বিলাসবহুল জীবন পেতাম তবে এতটা ভালোবাসা পেতাম না। আমি তো বরাবরই সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করেছি আমার তো এতো কিছুর দরকার ছিলোনা। শুধু একটু সুখ চেয়েছিলাম এবং সেটা পেয়েছিলাম আমি৷ ছোট ঘরে থাকা, স্বামীর জন্য নিজ হাতে রান্না করা, নিজের সংসারটাকে নিজের হাত দিয়ে সাজানোর মতো সুখ হয়তো অন্য কোথাও পাবোনা আমি৷ এতো সুখের পরও আমার কোলজুরে একটা ছেলে আসলো আর সুখটা দ্বীগুন করে দিলো। আসলে মানুষ ঠিকই বলে যে বেশি সুখ কপালে সইনা। তবে আমার সুখ যে আমার বাবাই সইতে পারলোনা এটার জন্য আমার অনেক আফসোস হয়। তোমার জন্য আজ আমার দুধেট ছেলেটাকে ছেড়ে চলে যেতে হলো। জানিনা নীল কীভাবে তাকে একা সামলাবে। তবে ওদের কারও কিছু হলে আমি দুনিয়া ত্যাগ করব।
চলে গেলাম আমি। তবে আমার কসম দিয়ে গেলাম। তুমি যদি নীলের বা আমার সন্তানের কোনো ক্ষতি করো তাহলে আমি ফিরে আসব তোমার কাছে। তবে লাশ হয়ে৷ আমার নজরে তুমি এমনিতেই মরে গেছো আর নিজেকে ছোট করো না। আর মা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। পারলাম না বন্দী হয়ে থাকতে৷ নিজেকে পতিতাদের মতো করে বিলিয়ে দেওয়ার চাইতে ভিক্ষা করব তাও খুশি আমি। নিজের খেয়াল রাখবে৷ বাবা ভবিষ্যতে কোনোদিন দেখা হলে নিজের মেয়ে বলে দাবি করবেনা৷ হয়তো আর দেখা নাও হতে পারে। মা তুমি ভালো থেকো। আমার জন্য একটুও মন খারাও করবেনা।
ইতি
তোমাদের অবাধ্য মেয়ে
আমি ভেবেছিলাম চিঠিটা পড়ে হয়তো তোর বাবা একটু নরম হবে। কিন্তু সেটা ছিলো আমার ভুল ধরনা। সে আরও ক্ষেপে গেলো। সাথে সাথে তার সব লোক দিয়ে তোর খোজ শুরু করলো। নীলের ক্ষতি করবে ভেবে আমি অনেক ভয় পাচ্ছিলাম। তবে জানিনা কিসের জন্য তিনি নীলের কোনো ক্ষতি করেন নি।
এদিকে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছিলো আর তোর বাবাও তোর খোজে দিনরাত এক করে দিচ্ছিলো। তবে ভাগ্য হয়তো তোর সাথে ছিলো। কারণ বিয়ের ১ দিন আগে সেই ছেলেকে ধর্ষণ মামলায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। একটা দুইটা না পুরো ৫ জন মানুষ তার বিরুদ্ধে ধর্ষন মামলা করে। সাথে এমপি কেউ তার পদ থেকে বহিস্কৃত করা হয়। এই ঘটনার পর থেকে তোর বাবার মনে অনুশোচনা হতে থাকে তবে তারপরও নিজের ইগোর কাছে হার মানে। আমি তোর বাবার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলতাম না।
তুই সেদিন সত্যি বলেছিলি যে কারও সুখ ছিনিয়ে নিয়ে কোনোদিন সুখি হওয়া যায় না। তোর অভিশাপ হয়তো সত্যি কাজে লেগে গিয়েছিলো। এসবের পর তিনি সব সময় মনমরা থাকতেন৷ তবে আমি তার পাশে দাঁড়াইনি।
৬ মাস পর একদিন হঠাৎ খবর পাই তোর বাবা এক্সিডেন্ট করেছে। তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে গিয়ে শুনি তার মেরুদন্ডের স্পাইনাল কর্ডে আঘাত লাগার ফলে তিনি আর কখনও হাঁটা চলা করতে পারবেন না। ১০ দিন পর তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এরপর তার একমাত্র স্থান হয় হুইল চেয়ার৷ তার জন্য অনেক কষ্ট হতো। আমি সব সময় তার সেবা করতাম। এর মাঝে আবার ব্যবসাতে ধস নামতে থাকে। তবে ম্যানেজার সাহেব কোনো রকমে সবটা সামলিয়ে নেন৷
তোর বাবা সব সময় কান্না করতো। তবে কারণ জানলেও কোনোদিন জিজ্ঞেস করিনি। তোর উপর বা জামাইয়ের উপর তার কোনো অধিকার ছিলোনা। এভাবেই ৪ বছর ৮ মাস কাটে। তোর বাবা চাইতো যাতে তুই একবার ফিরে এসে ক্ষমা চাওয়ার একটা সুযোগ তাকে দিস৷ এই সময়ে শুধু বসে বসে কেঁদেছে। আমাকে যে একবার বলবে তারও সাহস হয়নি। আর বললেও আমার কিছু করার ছিলোনা। সেই এমপিও অসম্মান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলো আর তার ছেলের আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়।
তোর বাবার মারা যাবার ২ মাস আগে আমাকে বলে
তোর বাবাঃ আমার একটা কথা শুনবে?
আমিঃ বলো
তোর বাবাঃ শিলাকে একবার ফোন করে দেখবে?
আমিঃ কোন মুখে করব বলো?
তোর বাবাঃ প্লিজ একটাবার ফোন করে দেখো। এতো বছরে আমি বুকের ভিতর শুধু একটাউ কষ্ট জমিয়ে রেখেছি। ওর সাথে যদি একবার কথা বলতে পারি তবে মরে শান্তি পাবো আমি। আমার মনে হচ্ছে বেশি দিন বাঁচবনা আমি। আমার সব সম্পত্তি আমি শিলার নামে করে দিয়েছি। যদি কোনোদিন দেখা পাও তবে আমার তরফ থেকে ওর পাঁয়ে পড়ে ক্ষমা চেয়ে নিও। আমার পাপের শাস্তি তো অনেক পেলাম।
তারপর আগের সিমটা অন করে তোকে ফোন দেই। তবে নম্বর বন্ধ পাই। অনেকবার চেষ্টা করেও ফোনে পাইনি। ব্যর্থ হয়ে তোর বাবার কাছে গেলে প্রশ্ন করপ
তোর বাবাঃ ফোন ধরছে?
আমিঃ না। ওর নম্বর বন্ধ।
তোর বাবাঃ ওর বলা প্রত্যেকটা কথা আজ সত্যি হলো। ও বলেছিলো যে আমার মরা মুখটাও দেখবেনা আর সেটা মনেহয় সত্যি হবে। হে আল্লাহ একটা বার যদি ওর কাছে ক্ষমা চাইতে পারতাম। ( কান্না করে)।
আমিঃ এখন আর এসব ভেবেই কি লাভ? সময় থাকতে বুঝতে পারনি। তখন তোমার হাত পাঁ ধরেছি। আর আমিও আর কিছু করতে পারবনা। পুরোটা সময় তোমার সেবা করেই কাটিয়ে দিব।
তোর বাবাঃ আচ্ছা জামাইয়ের সাথে একবার কথা বলা যায়না?
আমিঃ কেনো এতিমের বাচ্চার কথার কথা তুলছ? কোনো এতিমের সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারবোনা।
তোর বাবাঃ আমার এই অবস্থাতেও একটু দয়া হয়না? একটা বার তার সাথে কথা বলে আমাকে তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ করে দাও। আমার নাতির মুখটা একবার দেখতে চাই। ওদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার একটা সুযোগ দাও।
আমি তোর বাবার এই অবস্থায় আর না করতে পারিনি। নীলকে আমি ফোন দেই তবে ওর ফোন ও বন্ধ দেখায়। আগের ঠিকানায় লোক পাঠায় তবুও নীলের কোনো খোজ পাওয়া যায়নি। শেষ ২ মাসে ওর কান্না আগের থেকে ১০ গুন বেড়ে যায়। চাইলেও শান্তনা দিতে পারিনি। হয়তো সে বুঝে গিয়েছিলো যে তার সময় আর নেই। ২ মাস পর তিনি মারা যান। চারে পাশের অশান্তিতে আমার মনটা পাথর হয়ে গিয়েছিলো। তার মৃত্যুতে আমার চোখ থেকে এক ফোটাও পানি বের হয়নি। আড়ালে যত কেঁদেছি তাতে সব শুকিয়ে গিয়েছিলো। তার জন্য অনেক দোয়া করেছি যাতে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন।
★বর্তমান★
কথাগুলো শুনে অনেক খারাপ লেগেছিলো। শিলাও অনেক কেঁদেছে তবে বলার মতো কিছু ছিলোনা৷ মা মেয়ে মিলে কান্না করছে। করুক মনটা হালকা হবে৷ একটু পর কান্না থামিয়ে শাশুড়ী বললো
শাশুড়িঃ মারে তোর বাবাকে মাফ করে দিস। বেচারা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। হয়তো তোকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছে তবে সব সময় কেঁদেছে লোকটা তোর কাছে ক্ষমা চাইবার জন্য। তোকে কষ্ট দিয়ে সে নিজেই তার থেকে কয়েকগুন বেশি কষ্ট পেয়েছে।
শিলাঃ অনেক রাগ, অভিমান আর ঘৃনা ছিলো লোকটার জন্য। তবে তিনি নিজেও তো ভালো ছিলেন না। হয়তো সেদিন আমার অভিশাপ দেওয়ায় ঠিক হয়নি। রাগের মাথায় কত কিছু বলে ফেলেছি। তবে আজ আমার আর কোনো রাগ নাই তার প্রতি। মন থেকে ক্ষমা করে দিলাম তাকে। নামাযে বসে বাবার জন্য দোয়া করব।
শাশুড়ীঃ একটু বস তুই। আমি আসছি।
শাশুড়ী আলমারি থেকে একটা ফাইল বের করলো। তারপর এসে বসলো। ফাইলটা শিলার হাতে দিয়ে বললো
শাশুড়ীঃ মা এইটা তুই রাখ।
শিলাঃ এটা কি মা?
শাশুড়ীঃ তোর বাবার সমস্ত সম্পত্তি। অফিসটা কোনো রকমে চলছে। আমি চাই সেটার দায়িত্ব তোরা দুইজন নিয়ে নে। আর এখানেই থেকে যা তোরা৷
শিলাঃ মা এটা আমি কিভাবে নিবো?
শাশুড়ীঃ মা না করিসনা। তোর বাবার শেষ সময়ে এসে এটা তোর আর জামাইয়ের জন্য দিয়ে গেছে। এটা তোর বাবার শেষ ইচ্ছা ভেবে তোর কাছে রেখে দে।
শিলাঃ আচ্ছা মা। তবে এসবের দায়িত্ব আমি তোমার জামাইকে দিবো। আমি ঘর সংসার করব।
আমিঃ না শিলা এটা হয়না। আমি এসব করতে পারবনা। তাছাড়া রফিক ভাই, বর্ণা আপু এদের কি হবে? ওদের ছাড়া আমি থাকতে পারবনা।
শিলাঃ দেখো নীল বাবাকে ক্ষমা করে দাও। আর দায়িত্বটা তুমি নিয়ে নাও। তুমি যদি সব কিছুর দায়ুত্ব নিয়ে নাও তাহলে মনে করব তুমি আমাদের ক্ষমা করে দিয়েছো।
আমিঃ( মেয়েরা শুধু ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে পারে) আচ্ছা তা নাহয় নিয়ে নিলাম তবে রফিক ভাইয়দের কি হবে?
শিলাঃ কেনো ওনারা আমাদের বাড়িতে থাকবেন। আন্টও আর মা দুজন সারাদিন গল্প করবে, রিফাত সবাইকে জ্বালিয়ে মারবে আর আমি সব কিছু সামলে নিবো।
আমিঃ আচ্ছা তাহলে কি ওদের এখানেই চাকরির জন্য ডেকে নেই।
শিলাঃ আমি তো সেটাই বললাম৷ তুমি কালকে ফোন দিয়ে ডেকে নিও ওদের। আমি আংকেলের সাথে কথা বলে নিব।
আমিঃ আচ্ছা। মায়ের কাছে থেকে যাও আমি রিফাতের কাছে গেলাম।
শিলাঃ আচ্ছা।
আমি চলে গেলাম৷ সকালে উঠে দেখি শিলা নাস্তা তৈরি করেছে। কাজের মেয়েদের অন্য কাজ করাচ্ছে। আমি নাস্তা করে ছাদে গেলাম রফিক ভাইকে জানানোর জন্য। গিয়ে ভাইয়াকে ফোন দিলাম
রফিক ভাইঃ নীল কেমন আছিস তুই ভাই? আজ ৩ দিন পর ফোন দিলি তুই। একবারও আমার কথা মনে পড়েনি?
আমিঃ অনেক মনে পড়েছে। তাইতো এখন থেকে আমরা একসাথে থাকব।
রফিক ভাইঃ হুম তা কবে আসছিস?
আমিঃ আমরা না তোমরা আসছো।
রফিক ভাইঃ মানে?
আমিঃ মানে হলো………… ( সব খুলে বললাম)
রফিক ভাইঃ শুনে কষ্ট পেলাম তোর শশুরের জন্য বেচারি অনেক বেশি শাস্তি পেয়েছেন।
আমিঃ হ্যাঁ। আচ্ছা ভাইয়া তুমি আসছো কবে?
রফিক ভাইঃ সপ্তাহ দুয়েক দেরি করলে হয়না?
আমিঃ তুমি তাহলে ১০ দিনের মধ্যে আসো। আর কিছু আনার দরকার নেই। এই বাড়িতে সব কিছু আছে। তুমি শুধু দরকারি জিনিসগুলো মানে জামা কাপড় এসব নিয়ে আসো তাহলেই আবে। বাকি সব আসবাবপত্র এখানেই আছে।
রফিক ভাইঃ আচ্ছা। তাহলে আমি রিজাইন দিয়ে বর্না আর মাকে নিয়ে চলে আসবো ৭ দিনের মধ্যে৷
আমিঃ আচ্ছা। আপু কেমন আছে?
রফিক ভাইঃ কথা বলবি?
আমিঃ কথা বললে তো আপুকেই ফোন দিতে পারব। ৭ দিন পর সামনা সামনি দেখা হবে৷ আর ৭ দিনপর বেশি সময় নিলে তোমার সাথে কথা বলবনা।
রফিক ভাইঃ আচ্ছা ভাই আচ্ছা আমি ৬ দিনের মধ্যে আসব। তোর কিছু আনতে হবে?
আমিঃ কিছু জামা কাপড় নিয়ে আসতে পারো।
রফিক ভাইঃ আচ্ছা। আমি নিয়ে আসব।
আমি ফোন রেখে দিলাম৷ যাক আবার হয়তো একটা সুখের সময় আসতে চলেছে। আর ৩ দিন পর শুক্রবার। দেইদিনই ডাক্তারের সাথে দেখা করতে হবে।
দুপুরে খাবার পর শাশুড়ী রিফাতকে নিয়ে ঘুমালো। আমি আর শিলা শুয়ে আছি। তখন আমি বললাম
আমিঃ না মানে বলছিলাম কি বলছিলাম কি বর্না আপু আর তুমি বাসায় থাকবে আর আমি আর রফিক ভাই অফিস সামলাবো এটাই বলতে চাইছিলাম৷
শিলাঃ আচ্ছা অনেক ভালো হবে। সংসার করার সুখটা পাব।
আমিঃ তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?
শিলাঃ এখন থেকে তো তুমিই বস। তুমি যা ভালো মনে করবে তাই করবে।
আমিঃ আচ্ছা।
শিলাঃ আচ্ছা নীল তোমার কি মনে হয়না আমাদের একটা বাচ্চা নেওয়া উচিৎ?
আমিঃ ধুর এই সময়ে কেউ এসব কথা বলে?
শিলাঃ আরে বলোনা৷
আমিঃ এসব পরে ভাবা যাবে। তাছাড়া রিফাতকে আগে মায়ের আদরটা দাও।
শিলাঃ এমন ভাবে বলছ যেনো আরেকটা বাচ্চা নিলে আমি রিফাতকে ভুলে যাবো।
আমিঃ আরে আমি এটা বলছিনা। মানে একটু সময় নাও।
শিলাঃ আচ্ছা।
বিকালে উঠে বাইরে হাটতে গেলাম৷ আগে যেখানে থাকতাম সেই জায়গাতে গেলাম৷ হেঁটে রাতের দিকে বাড়ি এলাম। খাওয়া শেষ করে শুয়ে আছি এমন সময় শিলা রুমের দরজা লাগিয়ে দৌড়ে এক লাফে বিছানায় উঠে পড়লো
আমিঃ এইটা কি ধরনের বাচ্চামি?
শিলাঃ বাচ্চামি না তবে বাচ্চা আনার জন্য যেসব করা লাগে সেগুলোই এখন করব।
আমিঃ তোমার মাথায় ভুত ঢুকেছে।
শিলাঃ তাহলে আদর করে তাড়িয়ে দাও।
আর কিছু বলতে যাবো তার আগেই শিলা নিজেই তার কাজ শুরু করে দিলো। কি আর বলব ভাই সবাই চোখ বন্ধ করেন নাহলে বিয়ে করেন😁
আজ শুক্রবার। তাই সকাল সকাল উঠলাম৷ শিলা জিজ্ঞেস করেছিলো এতো তাড়াতাড়ি উঠেছি কেনো? আমি বলেছি ঘুম আসছেনা। সকালে নাস্তা করে ৯টা ৩০ মিনিটে আমি ডাক্তাদের দেওয়া ঠিকানায় চলে গেলাম। অবশ্য আগের দিন কথা হয়েছে যে কোন জায়গায় উনি দেখা করবেন। আমাকে লোকেশন দিয়ে দিয়েছেন। আমিও সময় মতো পৌছে গিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছি। ১০ মিনিট পর ডাক্তার আসলেন। আমাকে চিনতে না পারলেও আমি তাকে ঠিকই চিনেছি। তাই তাকে ইশারা করে আমি যেখানে বসেছি সেখানে ডাকলাম। তিনি এসে আমাকে বললেন
ডাক্তারঃ সরি আসলে একটু দরকারী কারণে দেরি হয়ে গেলো।
আমিঃ আরে না না। কোনো ব্যাপার না। আপনি বসুন।
ডাক্তারঃ ধন্যবাদ। আচ্ছা আমাকে ডাকার কোনো বিষেশ কারণ?
আমিঃ আসলে আপনার থেকে কিছু জানার আছে।
ডাক্তারঃ কি জানতে চান?
আমি ফোন থেকে তুলা ছবি ডাক্তারকে দেখালাম। দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
আমিঃ এটা কি আপনার কাছে করা রিপোর্ট?
ডাক্তারঃ হুম আমার কাছে করা। ব্রেইন টিউমারের পেসেন্ট দেখছি। কিন্তু এই রিপোর্ট তো অনেক আগের।
আমিঃ জ্বী। এটার জন্যই ডাকলাম। আসলে এই পেসেন্টকে আপনি চিনেন?
ডাক্তারঃ হয়তো মনে আছে। দেখলে হয়তো চিনতে পারব। তবে এরকম পেসেন্ট তো অনেক এসেছে আমার কাছে। তবুও যদি ছবি দেখাতে পারেন তবে কিছু হতে পারে।
আমি আবারও ফোন থেকে শিলার একটা পিক বের করে তাকে দেখালাম। ডাক্তার ছবিটা দেখেই বলে উঠলো
ডাক্তারঃ ওওও এই মেয়েটা? অনেক ভালোভাবে মনপ আছে তাকে। আমি আজীবন তাকে ভুলতে পারবনা। তার জন্যই আজ আমি সুখে সংসার করছি৷ তার কথা গুলো জীবনে কাজে লাগিয়ে অনেক সুখি হয়েছি। যদিও সে আমার ছোট তবে অনেক বড় শিক্ষা দিয়েছেন তিনি আমাকে। আচ্ছা উনাকে আপনি কিভাবে চিনেন?
আমিঃ সব বলব তবে তার ব্যাপরে যা যা জানেন সব কিছু বলতে হবে।
ডাক্তারঃ আপনি তো তার ক্ষতি করার জন্যও এসব জানতে চাইতে পারেন।
আমিঃ আমি উনার স্বামী।
ডাক্তারঃ আচ্ছা আপনিই তাহলে উনার স্বামী? তাহলে আমার বলতে আর সমস্যা নাই।।
আমিঃ জ্বী বলুন।
★ডাক্তারে কথা★
এটা হয়তো আনুমানিক ৫ বছর আগের কথা হবে। আমি একটা অপারেশন করছিলাম। অপারেশন শেষে আমার চেম্বারে আপনার স্ত্রী শিলা আসে। আমার আরেকটা অপারেশন ছিলো তাই আমি তাকে তাড়াতাড়ি নিজের সমস্যাগুলো বলতে বলি। তখন তিনি বলেন
শিলাঃ আসলে আমি গত কয়েকদিন যাবৎ কিছু সমস্যায় পড়েছি। বেশি আলো সহ্য করতে পারিনা মাথা ব্যাথা হয়ে যায়। হালকা মাথা ব্যাথা সারাক্ষণ লেগেই থাকে৷ চোখে ঝপসা দেখি। আর দিন দিন কেমন জানি ঘুমও ভালো হয়না।
আমিঃ আচ্ছা আপনি সিটি স্ক্যান, এম আর আই, এক্সরে তিনটাই করে নিন। ৩ ঘন্টা সময় লাগবে রিপোর্ট পেতে। আর আমার একটা অপারেশন আছে এখন। আপনি গিয়ে পরীক্ষা গুলো করিয়ে নিন আর পারলে রিপোর্টটা দেখিয়ে যাবেন। কালকে আসলেও সমস্যা নাই।
শিলাঃ সমস্যা নাই ম্যাম আমি অপেক্ষা করবো।
এরপর আমি নিজের মতো অপারেশন করতে চলে যায়। ২ ঘন্টা পর শেষ হয়। বাকি সময়টা এমনি সাধারণ রোগি দেখছিলাম। সব শেষে আপনার স্ত্রী আসে রিপোর্ট নিয়ে। আমি রিপোর্ট গুলো দেখে একটু নার্ভাস হই। কারণ সচারচার এসব রোগের কথা শুনে অনেকে ভেঙে পড়ে। তবুও আমি তো মিথ্যা বলতে পারিনা। তাই বললাম
আমিঃ দেখুন আমি জানিনা আপনি কথাটা কিভাবে নিবেন তবে আপনাকে এটা বলতেই হবে।
শিলাঃ কেনো কি হয়েছে?
আমিঃ আপনার ব্রেইন টিউমার হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। বেড়ে উঠার আগেই অপারেশন করলে ভালো হবার সম্ভাবনা আছে। দেরি করলে ক্যন্সারে রুপ নিতে পারে। তখন বাঁচার আশা কমে যাবে। তবে এখানেও একটা সমস্যা আছে।
শিলাঃ কি সমস্যা?
আমিঃ আসলে বাংলাদেশে এটার ভালোভাবে অপারেশন সম্ভব না। আপনি যদি সিংগাপুরে অপারেশন করান তাহলে সুস্থ হবার অনেক বেশি সম্ভাবনা আছে কারণ এখন প্রাথমিক ধাপে আছে৷ কিন্তু এই রোগের আরেকটা খারাপ দিক আছে।
শিলাঃ কি খারাপ দিক বলুন প্লিজ।
আমিঃ ব্রেইন টিউমার সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব হবেনা৷ আপনি সুস্থ হবেন কিন্তু পরবর্তীতে যেকোনো সময় আবার এটা প্রকাশ পেতে পারে। আর দ্বিতীয় বার প্রকাশ পেলে টিউমারে আক্রান্ত কোষ কেটে ফেলতে হয়। রিস্ক থাকে বেশি। সব চেয়ে বড় রিস্ক থাকে স্মৃতি শক্তি কম হয়ে যাবার। কারণ বুঝতেই পারছেন ব্রেইন অনেক সেন্সিটিভ অঙ্গ। এখন সিদ্ধান্ত আপনার।
সেদিন ওনার চোখে আমি কিছু হারিয়ে ফেলার ভয় দেখতে পেয়েছিলাম। যাই হোক ওনার ব্যাপরে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কারণ এতো রোগি আসে কাকে রেখে কাকে মনে রাখব? তবে ৩ মাস পর তিনি আবার আসেন। প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে চিনেছি। তিনি আসার পর বলেন যে তিনি সিঙ্গাপুরের অপারেশন করিয়ে এসেছেন ১ মাস আগে। তারপরও তিনি চেকআপ করার জন্য আসেন। আবার তাকে পরীক্ষা দেওয়া হয়। এবার আর কোনো সমস্যা ছিলো না। আমি রিপোর্ট দেখে ওনাকে বলি
আমিঃ আপনার এখন কোনো সমস্যা নেই। তবে আপনাকে ৩-৪ বছর অনেক সাবধানে থাকতে হবে। মানসিক চাপ নিতে পারবেন না। আর প্রতি ৩-৪ মাস পর একবার করে চেকআপ করাবেন।
শিলাঃ ধন্যবাদ ম্যাম। আমি আসি তাহলে।
তিনি চলে গেলেন৷ এরপর ৩ বছর আর কোনো সমস্যা হয়নি ওনার। হঠাৎ ৩ বছর পর আবারও তিনি আসেন। এবারও আসেন সেই প্রথমবারের মতো সমস্যা নিয়ে। আমি এবারও তাকে পরীক্ষা করতে বলি আর এবারও তার টিউমার ধরা পড়ে। তবে এবার টিউমার দ্রুত বাড়ছিলো। আমি তাকে ইমিডিয়েটলি আবারও সিঙ্গাপুর যাবার নির্দেশ দেই৷ এখন আমাদের এখানে প্রাথমিক ব্রেন টিউমারের চিকিৎসা থাকলেও সেকেন্ডারি টিউমারের কোনো চিকিৎসা ছিলোনা। এবার তিনি বেশ ঘাবরে যান। সেদিন আমি তাকে কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করি
আমার কথা শুনে তিনি ফুপিয়ে কান্না করে দেন। তাকে একটু শান্ত করে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে তিনি তার সাথে ঘটে যাওয়া সব কিছু খুলে বলেন। উনার কথা শুনে আমি নিজেও কেঁদে ফেলি। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করি
আমিঃ আচ্ছা যতই হোক অন্য নম্বর থেকে তো যোগাযোগ করতে পারতেন।
শিলাঃ কিভাবে করব? আমারও অনেক ইচ্ছা হয় ওর সাথে কথা বলার, সব কিছু বলে বুকে মাথা দিতে ইচ্ছা করে। এখন আমি দূরে আছি জানিনা সে কিভাবে আছে তবে ছেলেটার জন্য নিজেকে ভালো রাখবে। কিন্তু ওকে ফোন দিলে ও আমার কাছে আসতে চাইবে কিন্তু আমার যে রোগ আমি যদি ওর চোখের সামনে মারা যায় তখন? আমি না থাকাতেও সুখে নেই তবে ওর চোখে সামনে আমি মরলে ও নিজেও মরে যাবে। জানেন খুব ভালোবাসে ও আমায়। তবে আমি ওকে ওর চাইতেও দ্বিগুন ভালোবাসি। তাইতো আমি চাইনা এই অবস্থায় ও ফিরে আসুক। এই যাত্রায় বেঁচে গেল আর ওকে দূরে রাখবনা। আচ্ছা এইবার অপারেশন করলে বাঁচা মরার ঝুঁকি কতখানি?
আমিঃ ৫০% বাঁচার সম্ভাবনা থাকে, ৩০% মারা যাবার আর ২০% বেঁচে থেকেও মরে যাওয়ার। মানে মেমোরি লস হবার সম্ভাবনা। থাকে।
শিলাঃ যাক শুনে ভালো লাগলে যে বাঁচার চান্স বেশি। আমি কালকেই সিঙ্গাপুর যাবো।
আমিঃ আপনাকে বেষ্ট অফ লাক। আল্লাহ যদি কোনো অঘটন না ঘটিয়ে ফেলেন তাহলে আপনি অবশ্যই আমার সাথে দেখা করে যাবেন।
শিলাঃ ইনশাআল্লাহ।
এরপর তিনি চলে যান। আমি শুধু বসে ভাবতে থাকি যে তার স্বামীর কথা ভেবে তিনি কত কি করছেন। তার ভালোর জন্যই দূরে থাকছেন অথচ আমি সেই সময় কাজের জন্য নিজের স্বামীর সাথে দূরে থাকতাম। ওকে একেবারে সময় দিতাম না৷ এর কারণে আমাদের সম্পর্কে দূরত্ব বাড়ে। ভেবেছিলাম সম্পর্ক শেষ হলে হবে আমি তো নিজের পাঁয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তবে সেদিন বুঝেছিলাম একটা মেয়ের জীবনে কাজের চাইতেও বেশি জরুরি তার স্বামী। সেদিনের পর থেকে আমি আমার কাজ কমিয়ে আমার স্বামীকে সময় দিতে থাকি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেঔ আমাদের সংসারে সুখ নেমে আসে। তার কিছুদিনের মধ্যে আমার গর্ভে সন্তান আসে৷ এই সবকিছু আপনার স্ত্রীর মুখ থেকে আপনার প্রতি ভালোবাসার কথা শুনে হয়েছিলো।
এরপর ৬ মাস পরে আবার উনি আমার কাছে আসেন। আমি নিজের অজান্তেই সেদিন তাকে ঝড়িয়ে ধরেছিলাম। আমার গর্ভে সন্তান থাকার ফলে আমি কিছুদিন পর বিরতিতে যেতাম। তার আগেই উনার সাথে দেখা হওয়াতে আমি অনেক বেশি খুশি হই। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি
আমিঃ কেমন আছেন আপনি?
শিলাঃ আলহামদুলিল্লাহ। আজ আমি পুরোপুরি সুস্থ। ২ মাস আগেই সুস্থ হয়েছিলাম। তবে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে সময় দিচ্ছিলাম।
আমিঃ আপনি তাহলে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ?
শিলাঃ জ্বী। দ্বিতীয় বার অপারেশনের সময় আমার টিউমার কোষ কেটে ফেলেছিলো। এতে আমার কিছু সমস্যা হয়। তবে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেছে।
আমিঃ অনেক ভালো একটা খবর শুনালেন। এখন তাহলে আপনি আপনার স্বামীর কাছে ফিরে যান।
শিলাঃ আমি আপাতত কিছু সময় একা কাটাতে চাই৷ নিজেকে একটু গুছিয়ে নি, একটু মানসিক শক্তি সঞ্চয় করে আমি ফিরে যাব তার কাছে।
আমিঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শিলাঃ আমাকে কেনো?
আমিঃ আপনার কারণেই আমার সংসারে সুখ এসেছে। সেদিন যদি আমি আপনার জীবনের কাহিনী না শুনতে চাইতাম তাহলে বুঝতেই পারতাম না যে একটা নারীর জন্য সংসারটাই আসল। স্বামীর ভালোবাসায় সবচেয়ে বড় সম্পদ। আপনার কথাগুলোর জন্য আজ আমি সংসারে যথেষ্ট সময় দেই আর আমার ঘর আলো করে আমার সন্তান আসতে চলেছে।
শিলাঃ অভিনন্দন। তা কি বেবি হবে?
আমিঃ জানিনা আর জানার প্রয়োজন মনে করিনা৷ আল্লাহ যা দিবেন তাতেই খুশি। আচ্ছা একটু বসুন।
তারপর আমি উনার জন্য ২ কেজি মিষ্টি আনতে দেই। উনি না করেন নি কারণ তিনি জানতেন আমি অনেক খুশি ছিলাম৷ তারপর আমার স্বামীর বদলির জন্য আমি রাজশাহী চলে আসি। আমার ফোনটা চুরি হয়ে যাওয়াতে আর ওনাকে ফোন করতেও পারিনি। তবে জানেন কি, আপানি অনেক লাকি যে এমন একটা বউ পেয়েছেন৷ আমি দোয়া করি যাতে সারাজীবন আপনারা সুখে থাকেন।
★বর্তমান★
ডাক্তারের কথাগুলো শুনার পর আমার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেলো। আজ পর্যন্ত মেয়েটা শুধু আমার জন্য ত্যাগ করেই এসেছে। প্রথমে বাড়ি ত্যাগ করল, তারপর আমার ভালোর জন্যই আমাকে ছেড়ে গেলো, আমার যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য নিজে সব কষ্ট সহ্য করলো। নিজেকে আড়াল করল আমার জন্য। সত্যিই তো আমার চোখের সামনে ওর কিছু হলে আমি মরেই যেতাম। আজ সত্যি আমার নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। আমি ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম।
বাড়ি আসার পথে আমি ভাবছি যে তাহলে আমার ধারনাই ঠিক ছিলো। ওর বাবার কারণে নয় আসলে ও আমাকে কষ্ট দিবেনা তাই আমার থেকে দূরে ছিলো। একটু আগেও হয়তো ওর জন্য আমার বুকে কিছুটা রাগ ছিলো। তবে এখন সব ভুলে গিয়ে ভালোবাসার পাহাড় জয়ে গেছে। বাড়ি ফিরার পথে ওর জন্য একটা শাড়ি কিনলাম। বাড়ি ফিরে কাউকে কিছু না বলে রুমে গেলাম। শিলার সাথে বাড়ি ফিরার পর আর কথা বলিনি। ও অনেক বেশি অবাক হয়েছে। সারাদিন ওকে এড়িয়ে গেছি।
রাতে আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ করে শিলা আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। আহা কি ফিলিংস। কিছুক্ষন মজা নিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। এরপর আমি যা করলাম তার জন্য শিলা মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। সে আমার থেকে এটা আশা করেনি। খুশি খুশি চেহারাটাতে কালো মেঘের ছায়া নেমে আসলো। কারণ আমি যা করলাম……………
আংকেল সিলেটে সিফট করবেন জেনে একটু খারাপ লাগলো কারণ নিজের মেয়ের মতোই দেখতেন উনি আমাকে। তারপরও কি করার উনাকে তো আমি আর আটকাতে পারিনা। তবে যাবার আগে আগে আমাকে যা বললেন তা আমার ধারণার বাইরে ছিলো। কারণ তিনি বললেন
আংকেলঃ শিলা মা দেখ তোকে একটা দায়িত্ব দিয়ে যেতে চাই।
আমিঃ কি দায়িত্ব?
আংকেলঃ আমি চাই এই অফিসের দায়িত্ব তুই নিজের কাঁধে তুলে নে।
আমিঃ কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? সিফাত সাহেব তো আছেন। অনেক ভালো মানুষ উনি। উনাকেই ূায়িত্ব দিতে পারেন।
আংকেলঃ আমি চাই তোকে বসের দায়িত্ব দিতে। এখন তুই এই দায়িত্ব নিতে না চাইলে আমার সাথে সিলেট চল।
আমিঃ না। তার চেয়ে ভালো আমি বসের দায়িত্বই নিব।
আংকেলঃ আচ্ছা ঠিক আছে। কালকে গিয়ে সবাইকে বলে তোর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আসবো।
আমিঃ আচ্ছা।
আংকেলঃ আচ্ছা তুই তাহলে এই বাড়িতে থেকে যা।
আমিঃ এটা হয়না আংকেল। আমি এখানে থাকতে পারবোনা৷ তার চেয়ে ভালো একটা বাসা ভাড়া করে নিব।
আংকেলঃ আমি জানতাম তুই থাকবিনা তাই আগেই তোর জন্য একটা বাড়ি দেখে এসেছি। সাথে তোর জন্য ওটা কিনে রেখেছি। প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র দিয়ে বাড়ি সাজানোও হয়ে গেছে। আমরা চলে যাবার পর তুই গিয়ে সেখানে উঠিস।
আমিঃ কিন্তু এত কিছু করার কি দরকার? এমনিতেই আমি আপনার কাছে ঋণি হয়ে আছি। তারওপর আপনি যা করছেন তার জন্য আজীবন ঋণি হয়ে থাকবো।
আংকেলঃ দেখ শিলা আমি তোকে মেয়ের থেকে কোনো অংশে কম ভাবিনি৷ তুই এসব বলে আমাকে ছোট করছিস।
আমিঃ সরি সরি৷ আর বলব না।
আংকেলঃ আচ্ছা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
আমি গিয়ে ঘুমাতে গেলাম। তবে ঘুমানোর আগে তোমার ছবিতে একটা চুমু দিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ঘুমাতাম। এই ১ বছরে কোনো দিনও বাবার খোজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। প্রথমত উনি আমাকে তাজ্য করেছেন তার জন্য উনি সব অধিকার হারিয়েছেন আমার উপর আর তার চেয়ে বড় কথা আমার সুখের সংসার ভেঙে দিয়ে তিনি লোভে পড়ে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। নতুন নম্বর থেকে মায়ের নম্বরে কল দিতাম। তবে বন্ধ বলতো। জানতাম এটা বাবার কাজ। বাবার প্রতি আমার সব সম্মান ঘৃনায় পরিণত হয়েছিলো।
পরের দিন আমাকে অফিসের বস ঘোষনা করা হয়। সবাই আমাকে মেনেও নেয় আমার ব্যবহারের জন্য। সিফাত ভাই মানে আমাদের ম্যানেজার তিনি অত্যন্ত অমায়িক মানুষ ছিলেন। তিনি অসৎ হলে আমি কিছুই সামলাতে পারতাম না৷ অনেক বেশি সাহায্য করেছেন তিনি৷ বলতে গেলে নাম মাত্র আমি বস ছিলাম৷ তাই তাকে মূল বেতনের ২০% বাড়তি বেতন দিতাম। যদিও তিনি নিতে চাননি।
অফিসের বস হবার পর আমি নতুন বাড়িতে শিফট করি৷ আংকেল আমার যাতায়াতের জন্য গাড়িও দিয়ে যান। তারপর থেকে আমার একলা পথ চলা শুরু। আমি অফিসে সে মানুষকেই চাকরি দিতাম যাদের ব্যবহার ভালো। তাইতো অফিসের পরিবেশ অনেক বেশি ভালো হয়। খুব বড় মাপের বিজনেসম্যান আংকেল না হলেও খুব বড় মনের মানুষ ছিলেন।
বাসায় আমাকে একা থাকতে হতো। তাই একজন কাজের মেয়ে ঠিক করি। দিনে সে কাজ করে নিজের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতো আর রাতে আমার সাথে থাকতো। তাকে এমন এমন জিনিস দিতাম যে মানুষ বুঝতেই পারবেনা যে সে কাজের মেয়ে।
এভাবেই দিন, মাস কাটে, বছর কাটে৷ সারাদিন কাজের চাপে তোমার কথা কিছুটা ভুলে থাকলেও রাতের বেলা আমি নিজেকে আটকে রাখতে পারতাম না৷ রিফাতের জন্য, তোমার জন্য মনটা ছটফট করতো। আজ নিজের বাবার জন্য আমি সর্ব হারা। তাজ্যপুত্রী করেও তিনি আমার জীবনটা শেষ করে দিচ্ছিলেন।
এর মাঝে একবার সেই ছেলেটা যে আমাকে বিয়ের জন্য বলেছিলো সে আবারও বলতে থাকে৷ সে আমাদের এখানে জব ছেড়ে পাশেই একটা কোম্পানিতে চাকরি করতো। একদিন সে তার মাকে নিয়ে সরাসরি আমার বাসায় চলে আসে। এই ঘটনায় আমার প্রচুর রাগ হয়। মন চাচ্ছিলো গার্ডদের বলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেই। তবে মায়ের বয়সি মানুষ বলে সম্মান দেখিয়েছিলাম৷ তারপর তিনি আমাকে বললেন
ছেলেটার মাঃ দেখো মা তুমি তো বলেছিলে তুমি বিবাহিত আর তোমার ছেলেও আছে৷ কিন্তু আমার ছেলে আজ ১ বছর তোমাকে ফলো করেও সেরকম কিছুই দেখেনি৷ তাই আজ আমি তোমার কাছে এসেছি আমার ছেলের জন্য ভিক্ষা চাইতে৷ আমাকে ফিরিয়ে দিয়োনা৷
খুব বিরক্ত লাগছিলো৷ ছেলেটাও মাথা নিচু করে বসে ছিলো। হয়তো মায়ের বয়সি মানুষ করে সহ্য করছিলাম তবে এসব কথা তো আর সহ্য করার মতো না। তারপরও নিজেকে শান্ত রেখে বললাম
আমিঃ আমি কাউকে কোনো মিথ্যা বলিনি৷ আর আপনি আজব এক ধরনের মা। নিজের ছেলে নির্লজ্জের মতো একটা মেয়েকে ফলো করে তাকে কোথায় শাসন করবেন কিনা চলে আসছেন প্রস্তাব নিয়ে৷ আমি সত্যি বলছি আমার স্বামী সন্তান আছে
ছেলেটার মাঃ দেখো মা আমার ছেলেটা তোমাকে খুব সুখে রাখবে। একবার ভেবে দেখো।
আমিঃ আপনারা হয়তো বুঝতে পারছেন না আমি কি বলছি। আমি তো বললাম আমার স্বামী সন্তান আছে। হয়তো কারও বদ নজরের জন্য আর আমি একা থাকি তবে আমার ভালোবাসা একজনের জন্যই সীমাবদ্ধ। আর কেউ যদি আমার সামনে নিজের জীবনও দিয়ে দেয় তারপরও আমার মন গলাতে পারবেনা।
ছেলেটির মাঃ কি হয়েছে খুলে বলবে? কথা দিচ্ছি আর কোনো রকম ডিস্টার্ব করবেনা আমার ছেলে।
আমার কোনো ইচ্ছাই ছিলোনা এসব মানুষদের সামনে নিজের কাহিনী বলার। তবুও এদের থেকে ছাড়া পাবার জন্য বলতে রাজি হলাম।
আমিঃ তাহলে শুনুন………….. ( সব খুলে বললাম)
ছেলেটিব মাঃ এতো কিছু হয়েছে তোমার সাথে?
আমিঃ জ্বী। আর তাই আমি আমার স্বামী বাদে অন্য কোনো পুরুষের কথা ভাবতেও পারিনা৷ এখন দয়া করে চলে যান আর কখনও আসবেন না। আর এবার থেকে আমাকে বিরক্ত করলে আমি কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবো৷
ছেলেটা আর ওর মা মাথা নিচু করে চলে গেলো। এরপর থেকে আর কোনোদিন বিরক্ত করেনি। আবার এভাবে দিন কাটতে লাগলো।
এভাবে চলতে চলতে মোট ৫ বছর কাটলো। আমি পারতাম তোমার সাথে যোগাযোগ করতে। অন্য নম্বর থেকেও কল করতে পারতাম। তবে বাবা তোমার কল ট্র্যাক করতে পারে ভেবে তোমার সুরক্ষার জন্য আমি কোনো রিস্ক নেইনি। সাথে আমার কোনো বান্ধবীর সাথেও আমি যোগাযোগ করিনি।
এভাবে চলতে চলতে একদিন টিভিতে দেখে পায় আমার বাবা নাকি মারা গেছেন। খবরটা শুনে ওনার প্রতি একটু দয়া আসে। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম আমি তোমার কাছে ফিরে আসবো। তাই পুরাতন নম্বর চালু করতেই দেখি তোমার ৫০০০+ মিস কল আর লাস্ট ফোন করেছিলা ২ দিন আগে৷ তারপর আমি ফোন দিলে তোমার নম্বর বন্ধ পাই৷ তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম রাজশাহী থেকে ঘুরে আসবো। তবে আমাকে অবাক করে তারপরদিনই আমি তোমাকে আমার অফিসে আমার ছেলের সাথে দেখতে পাই। আমার চোখ আটকে যায়। অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম। তবে আর একটু সময় নিয়ে সব ঠিক করতে চাইছিলাম কারণ হঠাৎ করে সামনে আসলে সমস্যা হতে পারে ভেবে৷ আর তোমার অবস্থা দেখে বুঝেছিলাম তুমি ভালো ছিলেনা। তাই কিছু না জেনেই চাকরি, ১০ হাজার এডভান্স সাথে ফ্ল্যাট দেই৷ তোমাকে ভালো রাখার জন্য আমি সব করেছিলাম। তারপর কয়দিন আগে তোমাকে প্রমোশন দিলাম। আমি কিছুদিনের মধ্যেই নিজেকে তোমার সামনে আনতে চাইছিলাম। তাই তোমাকে মেসেজ করি৷ ভাবছিলাম আস্তে আস্তে সব ঘটনা তোমার সামনে নিয়ে এসে সব ঠিক করবো৷ তবে আমি জানতাম না যে তুমি আমাকে প্রথম দিনই চিনে ফেলেছিলে। তারপর আজ তোমার এক্সিডেন্টের কথা শুনে আমার সব উলটপলট হয়ে যায়। আমি সব ঠিক করেই নিয়েছিলাম তোমার কিছু হলে আমি নিজেকে শেষ করে দিবো। তবে আমি না তুমিই যে সব কিছু করছো এটা আজকে বুঝতে পারলাম।
★বর্তমান★
শিলার বলা শেষ হলো। শিলা কাঁদছে তবে আমার এখানেই সব শেষ মনে হচ্ছেনা। শিলা চাইলেই আমাকে না ফোন করলেও তৃপ্তি অথবা আদিবাকে ফোম করতেই পারতো। নতুন নম্বর থেকে ফোন দিলে তো সমস্যা হতো না। হতে পারে ওর বাবা আমার বা ওর ফোন নম্বর ট্র্যাক করছে তবে আদিবা বা তৃপ্তির ফোন নম্বর ট্র্যাক করছেনা। ওদের সাথে যোগাযোগ করে তো সবটা বলা যেতো। তাহলে কি এর মাঝে আরও কিছু গোপন আছে? কারণ ও যদি সত্যি এই কারণে বাড়ি ছেড়ে থাকে তবে ও আমার আর মায়ের খোজ না নিয়ে এভাবে এতোটা সময় পার করতো পারতোনা। আমার মনেহয় আরও কিছু লুকাচ্ছে। যাউ হোক এখন আপনাতত একটু ঘুমের দরকার। তাই সবাইকে বললাম
আমিঃ আচ্ছা অনেক রাত হলো। শিলা তোমাকে এখন বাসাতে রেখে আসাও সম্ভব না। আপু শিলা তোমরা বরং এক রুমে শুয়ে পড়ো। আর ভাইয়া আর আমি এক রুমে শুয়ে পরছি।
বর্ণা আপুঃ কেনো তোরা একসাথে থাকলে সমস্যা কি? তাছাড়া ও তো সব খুলে বললো।
আমিঃ আপু সব কিছু এতো তাড়াতাড়ি মেনে নেওয়া যায় না। একটু সময় তো অবশ্যই লাগবে৷
বর্না আপুঃ আচ্ছা। ম্যাম চলুন আপনি
শিলাঃ আপু আমি আপনার ছোট। প্লিজ আমাকে এখন থেকে নাম ধরে আর তুমি করে ডাকবেন।
বর্না আপুঃ আচ্ছা চলো। আর জেগে থাকতে হবেনা।
বর্না আপু আর শিলা চলে গেলো এক রুমে আর আমি, ভাইয়া আরেক রুমে। শোবার পর ভাইয়া আমাকে বললো
রফিক ভাইঃ নীল এবার মনেহয় সব ঠিক করে নেওয়া দরকার। তাছাড়া ও তো নিজেও কম কষ্ট পাইনি। তোদরে ছেড়ে ও নিজেও ভালো ছিলোনা। তোর প্রতি ভালোবাসা ওর মনে অনেক বেশি। আর কষ্ট দিসনা ভাই।
আমিঃ দেখো ভাইয়া আমি মেনে নিবো। তবে আমাকে সময় দিতে হবে। আর ধীরে ধীরে আমি এসব কিছু মানিয়ে নি তারপর সব কিছু মেনে নিবো।
রফিক ভাইঃ আচ্ছা। ঘুমিয়ে পড়।
আমরা ঘুমিয়ে গেলাম। তবে ঘুমানোর আগে শুধু আমার মাথায় একটা কথায় ঘুরছিলো যে শিলা সবটা সত্যি বলছেনা। কিছু তো লুকাচ্ছে ও। এটাও আমাকে খুঁটিয়ে দেখতেই হবে। তার জন্য ওর সাথে একটু দ্রুত মানিয়ে নিতে হবে তাহলেই সব কিছু জানতে পারবো।
সকাল বেলা শিলা চলে গেলো। আর রিফাতকেও নিয়ে আসলাম। আমাকে দেখে যেনো আকাশের চাঁদ পেয়েছে এরকম অবস্থা। অনেক বেশি খুশি হয়ে গেলো। ওকে কিছুক্ষন কোলে নিয়ে একটু আদর করে আমি অফিসে গেলাম৷
অফিসে বসে কাজ করছিলাম তখন পিয়ন বললো শিলা নাকি ডাকছে। আমি গেলাম গিয়ে ও আমাকে বসতে বললো। তারপর ও নিজের চেয়ার থেকে উঠে আমার পাঁয়ে পড়ে গেলো
শিলাঃ নীল আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর কোনোদিন তোমার কথার খেলাফ করে কোথাও যাবোনা। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবনা। ৬ বছর কেটে গেলো তোমাকে ছাড়া এবার তো আমাকে আপন করে নাও। আমি মানছি আমি এই ১ বছর আমি অনেক বেশি অন্যায় করে ফেলেছি। আর কোনোদিন এরকম করবোনা৷ তুমি বললে আমি চাকরি ছেড়ে দিবো। তবে আমার থেকে দূরে থেকোনা প্লিজ। ( কান্না করে)
আমিঃ দেখুন ম্যাম আমাকে একটু সময় দিতে হবে৷ এসব কিছু আমি সহজে মেনে নিতে পারছিনা৷ অনেক বেশি মানসিক চাপ পড়ছে আমার উপর। প্লিজ একটু সময় দেন আমাকে।
শিলাঃ আচ্ছা তুমি নিজেকে সময় দাও। আর আমাকে আপনি করে বলছ কেনো?
আমিঃ দেখুন এটা অফিস আর আপনি আমার বস। সুতরাং তুমি করে বললে খারাপ দেখায়।
শিলাঃ কেনো এতোদিন তো তুমি করেই বলতে।
আমিঃ এখন আপনি করে বলব। আর এই নিয়ে কোনো কথা বলবেন না।
তারপর শিলার রুম থেকে আসলাম। আমার মনটাও ছটফট করছে ওর জন্য। তবে এতো তাড়াতাড়ি সব কিছু মেনে নেওয়া যাবেনা৷ ২ মাস পর ওর জন্মদিন আসছে। সেই দিনই ওকে আবার মেনে নিব। তবে ও কি লুকাচ্ছে এটাও আমাকে দেখতে হবে। আমি তৃপ্তি আদিবা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি। তবে এখন ওর সাথে যোগাযোগ করতে বারণ করেছি। কিছুদিন পর ওর জন্মদিনে ওকে সারপ্রাইজ দিয়ে দিব।
দেখতে দেখতে ২ মাস চলে গেলো। শিলা ২ দিন পর পর খালি একটাই কথা বলে যে কখন আমি ওকে কাছে টেনে নিবো৷ তবে আমি সময় চাইতাম।
আজকে ওর জন্মদিন। আমি আজকে শরীর খারাপের বাহানায় ছুটি নিয়েছি। সাথে আদিবা, নাহিদ ভাই, তৃপ্তি, আকাশ সবাইকে সাথে নিয়ে ওর বাড়িতেই সব কিছুর আয়েজন করেছি। ওর বাড়ির দারোয়ানের কাছে একটা চাবি থাকে। দারোয়ান কে উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে চাবিটা ম্যানেজ করি। তারপর সব কিছুর আয়োজন করি। এদিকে আমি রফিক ভাই আর আপুকে সময়ের আগে ছুটি নিয়ে চলে আসতে বলেছি। সাথে যেনো রিফাতকেও নেয়।
সন্ধ্যা ৬ঃ৩০ মিনিট। আমরা লুকিয়ে শিলার জন্য অপেক্ষা করছি৷ গাড়ির শব্দ শুনতে পেলাম। বুঝলাম শিলা এসেছে। আমরা সবাই আরও সাবধান হয়ে গেলাম। একটু পর ও বাড়িতে প্রবেশ করলো। সাথে সাথে বাড়ির লাইট জ্বালিয়ে সবাই মিলে একসাথে উইশ করলাম। শিলা ঘটনার আকস্মিকতায় অনেক জোরে এটা চিৎকার দিলো। তারপর আমাদের সবাইকে ওর সামনে দেখে ও বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। একটু পর ও দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। উপস্থিত সবাই এটা দেখে লজ্জা পেলো। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। আমিও আর ওকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিলাম।
আমিঃ এই পাগলি কান্না করছ কোনো?
শিলাঃ তুমি সবটা মেনে নিয়েছো তো?
আমিঃ হুম।
শিলাঃ আজ থেকে আমাকে আর দূরে সরিয়ে রাখবেনা প্লিজ।
এর মাঝে আবার রিফাত এসে বললো
রিফাতঃ এই আন্টি তুমি আমার বাবাকে জড়িয়ে ধরেছো কেনো? ছাড় বলছি।।
শিলা এবার আমাকে ছেড়ে রিফাতকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।
রিফাতঃ আন্টি তুমি কান্না করছো কেনো?
আমিঃ বাবা একটা তোমার আন্টি না। এটা তোমার মা।
রিফাতঃ সত্যি বলছ বাবা? ইনি আমার মা?
আমিঃ হ্যাঁ বাবা।
রিফাতঃ আম্মু তুমি অনেক পঁচা। তোমার সাথে কথা বলব না।
শিলাঃ কি হয়েছে আমার বাবার? রাগ করেছো?
রিফাতঃ তুমি এতোদিন আমার সাথে ছিলেনা কেনো? এতোদিন তো আমার সাথে দেখা করতে তাহলে বলনি কেনো তুমি আমার মা?
শিলাঃ বাবা এটা অনেক বড় একটা গল্প তোমাকে পরে বলবো। এবার আমাকে একটা পাপ্পি দাও?
রিফাত শিলার গালে একটা চুমু দিলো। শিলাও ওর গালে কাপালে চুমু দিলো। তারপর শিলা তৃপ্তি আর আদিবার সামনে গেলো।
শিলাঃ কেমন আছিস তোরা?
তৃপ্তিঃ আমরা কেমন আছি এটা জেনে কি করবি?
আদিবাঃ হুম। আমরা তোর কে হই যে আমাদের এসব জিজ্ঞেস করছিস?
শিলা এবার ওদের পাঁ ধরতে গেলো। তখন তৃপ্তি আদিবা ওকে ধরে ফেললো
আদিবাঃ এই পাগলি কি করতে যাচ্ছিলি এসব? একটু মজা করলাম তাতেও তোর সহ্য হলোনা। এই ৬ বছর তোকে কত মিস করেছি জানিস?
শিলাঃ মাফ করে দে তোরা। আমার কাছে কোনো রাস্তা ছিলোনা দোস্ত।
তৃপ্তিঃ আমরা সবটা জানি। কিন্তু তবুও একবার আমাদের সাথে কথা বললে কি হতো?
শিলাঃ মাফ করে দে। আর কোনোদিন এরকম হবেনা৷
এরপর ওরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো। যাক ৬ বছর পর আজ খুশির একটা সময় আসলো। তারপর শিলা কেক কাটলো। রাতে আমি আর শিলা পাশাপাশি বসে আছি। শিলা আমার কাঁধে মাথা রেখে আছে। একটু পর ও জিজ্ঞেস করলো
শিলাঃ নীল তুমি সত্যি আমাকে ক্ষমা করে সবটা মেনে নিয়েছো?
আমিঃ হ্যারে পাগলি। আমি আগেই মেনে নিতাম। তবে আজকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এতোদিন অপেক্ষা করলাম।
শিলাঃ আজকে তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে দিবে?
আমিঃ আজকে না। তুমি কালকেই অফিসের ফ্ল্যাটে শিফট করবে।
শিলাঃ কেনো এখানেই থেকে যায় আমরা?
আমি; না শিলা। আমরা শুরু করেছিলাম একটা ছোট বাড়ি দিয়ে আর বাকিটা সময়ও ছোট করেই সংসার করে যাবো। এতো বড় বাড়িতে আমি থাকতে পারবোনা।
শিলাঃ আচ্ছা তুমি যা বলছো তাই হবে। আমি কালকেই ফ্ল্যাটে শিফট করব। আবার সেই আগের দিনগুলোর মতোই নিজের মতো করে সাজিয়ে নিবো।
আমিঃ হুম। আচ্ছা অনেক রাত হলো আমি ফ্ল্যাটে যাবো। তুমি রিফাতকে নিয়ে থাকো আজকে।
শিলাঃ না তুমিও থাকো না প্লিজ। আজকের পর তো এখানে আর থাকা হবেনা। অনেকদিন থেকে এখানে আছি তো তাই একটা মায়া আছে এই বাড়ির প্রতি।
আমিঃ আচ্ছা ঠিক আছে।
রাতটা সেখানেই পার করে দিলাম। সকাল হবার পর নাস্তা করে দরকারি সব আসবাবপত্র ফ্ল্যাটে শিফট করা হলো।
শিলা রান্নার কাজ করছে। এর মাঝে ও আমাকে বললো ওর রুমে ড্রেসিং এর ড্রয়ারে অফিসের কিছু ফাইল আছে যেনো সেগুলো ব্যাগে ভরে রাখি। আমিও সব ফাইল গুছিয়ে ভরতে লাগলাম। দুটো ড্রয়ারে ফাইল ছিল। তবে ২য় ড্রয়ারের ফাইল গুলো ব্যাগে ভরার পর একটা মেডিকেল রিপোর্টের ফাইল পেলাম। আমি ভাবলাম যখন ও এক্সিডেন্ট করেছিলো তখনকার রিপোর্ট হয়তো। কিন্তু তখন তো ও বসের বাড়িতে থাকতো। এখানে এসেছে তার ১ বছর পর। তাহলে কি এটা অন্য কিছুর রিপোর্ট হতে পারে?
কৌতুহল বশত রিপোর্টটা দেখতে গিয়ে আরেকটা বড় ধরনের শক পেলাম। তাহলে আমি যেটা ধারণা করছিলাম সেটাই সত্যি? কারণ রিপোর্টটা দেখতে গিয়ে একটা জায়গাতে চোখ আটকে। রিপোর্টের এক জায়গায় “Brain tumour” লিখা ছিলো।
রিপোর্ট তো দেখি শিলারই। নাম ওর আর সব ডিটেইলস ও ওর। আর রিপোর্ট টাও ৪.৫ চার বছর আগের।
এখন ব্যাপারটা আরও ক্লিয়ার হলো যে এটাই তাহলে আসল কারণ। ব্রেইন টিউমার ঠিক হয় তবে কোনো গ্যারেন্টি থাকেনা যে একেবারেই ঠিক হয়ে যাবে৷ এটা যেকোনো সময় আবার জাগ্রত হতে পারে।
তাহলে কি এটাই আসল কারণ যে শিলা কারও সাথে যোগাযোগ করেনি? যদিও প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগ ধরা পড়লে অনেকটাি নিরাময় করা সম্ভব তবে দেরি করে এটা ক্যান্সারে রুপ নিলে বাঁচার সম্ভাবনা কমে আসে। শিলা এই জিনিসটাও আমার থেকে লুকিয়েছে। এবার বুঝলাম ও আমাদের ছেড়ে নিজেও কতটা কষ্টে ছিলো। আমাকে না জানানোর জন্য যেখানে আমার রাগ হবার কথা সেখানে ওর জন্য অনেক খারাপ লাগছে৷
ও হয়তো তার অনিশ্চিত জীবনের কথা ভেবে আমাদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলো। নাহলে আমাদের সাথে নিশ্চয় যোগাযোগের চেষ্টা করতো। যে ডাক্তার তার চিকিৎসা করেছিলো আমি তার নম্বরের একটা ছবি তুলে নিলাম। শিলার ছবি তো আমার কাছে আছেই৷ এখন আমাকে এই ব্যাপারেও জানতে হবে। তার অবস্থা সম্পর্কে আমার জানতে হবে।
যাই হোক আমি আপাতত ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইনা। এখন মনেহয় শিলা সুস্থ আছে। তবে মনে অনেক ভয় হলো। কারণ টেনসন থেকে এই হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই ওকে যতটা সম্ভব টেনশন মুক্ত রাখতে হবে৷ বিকাল হতে হতেই সব কিছু শিফট করা হয়ে গেছে।
রাতে শিলা নিজের হাতে রান্না করে সবাইকে খাওয়াল। ওর হাতের স্বাদ এখনও ঠিক আগের মতোই আছে। আমার জন্য রান্না শিখেছিলো সে।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে আমি রিফাতকে রফিক ভাইয়ের কাছে রেখে এলাম। কারণ অবশ্যই বুঝতে পারছেন😅
রাতে শিলা আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে৷ আমার আত্মাটা যেনো ঠান্ডা হয়ে গেলো। অনেক ভালো লাগছে। তবে কিছু বলছিনা। সময়টা উপভোগ করতে চাইছি। নিরবতা ভেঙে শিলা বলে উঠলো
শিলাঃ নীল।
আমিঃ বল।
শিলাঃ আচ্ছা এতোদিন পর কাছে পেয়ে কি আমাকে একটুও আদর করতে মন চাইছেনা?
বলেই শিলার একটা চরম মূহুর্তে চলে গেলাম। অনেকদিন পর দুজন দুজনকে কাছে পেয়ে ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি। অনেক বছর পর ভালোবাসার মানুষটার সাথে একটা ভালোবাসাময় রাত পার করলাম। পরেরদিন থেকে গাড়ি রেখে আমরা হেঁটেই অফিস যাওয়া শুরু করলাম৷ হেঁটে যাওয়া আসা আমাদের প্রথম ভালোবাসার সময়গুলো মনে করিয়ে দেয়।
আমি কিন্তু সেই ডাক্তারের কথা ভুলিনি। আজ ১৪ দিন পর সেই ডাক্তারকে ফোন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই কয়দিন ভালোবাসার মধ্য দিয়ে পার করেছি। আজ ছুটির দিন তাই সময় করে সেই ডাক্তারকে ফোন দিলাম। ৩ বার দেওয়ার পর ধরলোনা। তারপর ১০ মিনিট পর আবার কল দিলাম। এবার ধরলো।
ডাক্তারঃ আসসালামু আলাইকুম।
আমিঃ ওয়ালাইকুম আসসালাম। আপনি কি ডাক্তার আয়েশা সিদ্দিকা বলছেন?
ডাক্তারঃ জ্বী বলছি। আপনি কে?
আমিঃ আমাকে চিনবেন না। আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।
ডাক্তারঃ জ্বী বলুন।
আমিঃ না মানে সরাসরি আপনার চেম্বারে বসে কথা বলতে চাই।
ডাক্তারঃ তাহলে সময় করে চলে আসুন।
আমিঃ আপনি থাকেন কোথায়?
ডাক্তারঃ আমি কিছুদিন আগে আমার স্বামীর চাকরির জন্য রাজশাহী সিফট করেছি। আমাকে পপুলার, ইসলামিক হাসপাতে পাবেন।
আমিঃ ও আচ্ছা। আপনার কি ফ্রী টাইম থাকে? মানে আমার কথাগুলো বলা অনেক জরুরি।
আমিঃ আচ্ছা আমি তো ঢাকাতে থাকি। আমি কয়েক দিনের মধ্যে আসবো রাজশাহী এসে আপনার সাথে কথা বলব।
ডাক্তারঃ আচ্ছা।
তাহলে এবার রাজশাহী যেতে হবে৷ তখনই শাশুড়ীর কথা মনে পড়লো। শিলার বাবাতো মারা গেছে। জানিনা শাশুড়ী একা একা কি করছে৷ তার খোজ নিতে হবে৷ আর তাকে একা রাখবোনা৷ এবার নিজেদের সাথে নিয়ে আসব। তাছাড়া শিলার বাবা কিভাবে মারা গেলো আর শিলা চলে আসার পর পরবর্তীতে কি হলো এটাও তো জানতে হবে। আজ রাতেই শিলার সাথে কথা বলব।
রাতে শুয়ে আছি। তখন শিলাকে এই ব্যাপারে জানানোর কথা ভাবলাম। যেই ভাবা সেই কাজ। শিলাকে আমি বললাম
আমিঃ আচ্ছা শিলা তোমার বাবাতো মারা গেছেন তুমি কি তোমার মায়ের খোজ নিয়েছিলে?
শিলাঃ তাইতো মায়ের খোজ তো নেওয়া হয়নি। জানিনা মা কি অবস্থায় আছে। তোমাকে ফিরে পাওয়ার খুশিতে মায়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়?
আমিঃ কি কাজ?
শিলাঃ চলোনা একবার রাজশাহী থেকে ঘুরে আসি? মায়ের জন্য এখন মনটা কেমন করছে। জানিনা মা কি অবস্থায় আছে। বাবার মারা যাওয়া ১ বছর কাছিয়ে এলো। মাকে দেখার খুব ইচ্ছা করছে।
আমিঃ আমিও এটাই ভাবছিলাম। আচ্ছা চলো অফিস থেকে ৭ দিনের ছুটি নিয়ে সেই শহরটা থেকে ঘুরে আসি। আর তোমার মাকে নিয়ে চলে আসবো। আমার সংসারটা আবার আগের মতো করেই সাজিয়ে নিবো।
শিলাঃ হুম। আচ্ছা আদিবার কাছ থেকে মায়ের খবর পাওয়া যাবেনা?
আমিঃ আদিবারা তো ২ বছর আগে পাবনা শিফট করেছে। তারা হয়তো বলতে পারবেনা। আর জানার দরকার নেই। আমরা পরশু দিনই ঘুরে আসি কেমন?
শিলাঃ হুম। আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ো। কালকে আমি সিফাত ভাইকে সব দায়িত্ব দিয়ে ৭ দিনের ব্রেক নিব।
আমিঃ আচ্ছা
আমার রাস্তাটা আরও সহজ হলো। এবার আমি সবটা জানতে পারব। জানা খুব বেশি দরকারি না হলেও শিলা তার জীবনে কি কি সহ্য করেছে এটা আমাকে জানতেই হবে৷
পরেরদিন অফিসের দায়িত্ব সিফাত ভাইকে বুঝিয়ে দিলো শিলা। তারপর আমি সেই রাতেরই বাসের টিকিট কেটে নিয়ে এলাম। অফিস থেকে ফিরে রফিক ভাইকে সবটা বলে রিফাতকে নিয়ে রওনা দিলাম। রাতেই যাচ্ছি কারণ সকাল হতে হতে রাজশাহী পৌছে যাবো।
সকালে চোখ খুলতে দেখি আমরা এখন ইশ্বরদিতে আছি। তার মানে রাজশাহী পৌছাতে আর ৩০-৪৫ মিনিট লাগবে।
অবশেষে ৬ বছর পর রাজশাহীতে পাঁ দিলো শিলা। আমার ১ বছর মতো হবে। আমাদের ভদ্রা বাস কাউন্টারে নামিয়ে দিলো। ওখান থেকে রিকশা নিয়ে শিলাদের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। পৌছাতে আরও ২০ মিনিট লাগলো।
সেখানে পৌছে মেইন গেটের সামনে দাঁড়ালাম। দারোয়ান আটকালেও যখন শিলা তার পরিচয় দিলো তখন যেতে দিলো।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। বেল বাজাতে গিয়ে শিলার হাঁত কাঁপছে। তবুও কাঁপা কাঁপা হাতে শিলা বেল বাজালো। একটু পর তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিলো। শিলাকে দেখেই কাজের মেয়েটার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো
মেয়েটাঃ আপা মনি আপনে? এতোদিন পর আমাগো কথা মনে পড়লো?
শিলাঃ কি করবো বলো? আমার তো আর কোনো রাস্তা ছিলোনা। আচ্ছা মা কোথায়?
মেয়েটাঃ আপনে বসেন আমি খালাজানরে ডাইকা আনতাছি।
কাজের মেয়েটা দৌড়ে উপরে চলে গেলো। শিলা রিফাতকে কোলে নিয়ে আছে আর হাতে হাত ঘসছে৷ একটু পর কাজের মেয়েটা আসলো। তবে একা না আমার শাশুড়ীকে নিয়ে আসলো তাও আবার চোখ ধরে।
একটু পর মেয়েটা তার চোখ ছেড়ে দিলো। তবে তাকে দেখার পর আঁতকে উঠলাম। শিলাতো দেখেই কান্না করে দিয়েছে। আর আমার শাশুড়ী উনি পাথরের মতো হয়ে গেছে। শিলা দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। দুজনেই চিৎকার করে কান্না করছে। আমার শাশুড়ীর অবস্থা দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো।
প্রানবন্ত হাসিখুশি একটা মানুষ। তবে এখন দেখি চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। চোখ দুটোও যেনো ভিতরে ঢুকে গেছে। শরীর স্বাস্থ্য একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। দুজনে কান্না থামালো। তারপর শাশুড়ী রিফাতকে বুকে জড়িয়ে নিলো। একটু পর শিলা জিজ্ঞেস করলো
শিলাঃ মা এই কি অবস্থা করেছো নিজের? একটুও যত্ন নাওনি।
শাশুড়ীঃ মারে কার জন্য যত্ন নিবো বল? তুই চলে যাবার পর সব কিছু উলট পালট হয়ে গিয়েছিলো৷ প্রত্যেকটা দিন হাজার কষ্টে পার করেছি। আর যেই মানুষটা তার স্বার্থের জন্য তোর সুখ কেড়ে নিয়েছিলো সে নিজেও সুখি হতে পারেনি রে মা।
শিলাঃ মা এখন বাদ দাও। পরে সব খুলে বলবে। এখন চলো তোমার কোলে মাথা রেখে তোমার সাথে অনেক কথা বলব।
এরপর থেকে বাড়িতে যেনো একটু সুখ আসলো। এভাবে ২ দিন পার হলো। আজকে রাতে খাওয়ার পর রিফাতকে ঘুম পাড়িয়ে শিলা আমাকে নিয়ে শাশুড়ীর কাছে গেলো। তারপর সব ঘটনা জানতে চাইলো। শাশুড়ীও এক এক করে সব বলতে লাগলো।
তবে তাদের করুন পরিণতির কথা শুনে ভিতরটা কেঁপে উঠলো। সত্যি যে কারও সুখ কেড়ে নিলে এতোটা কষ্ট পেতে হয় তা না বললে জানতে পারতাম না। আমার শাশুড়ী যা বললেন……………….
[ বি.দ্রঃ ৯ম পর্বে তৃপ্তির হাসবেন্ডের নাম ভুল করে রাকিব দিয়ে ফেলেছি। ওটা আকাশ শিকদার হবে। সকালের কাছে ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী ]
শিলা আমার হাত ধরে কান্না করছে। শুধু একবারের জন্য ফিরে পেতে চাইছে। আমার হাত ওর কপালের সাথে নিয়ে নিচ দিকে মাথা করে বসে আছে। এমন সময় ও নিজের মাথায় কারও স্পর্শ অনুভব করলো। ও মাথা তুলে দেখে আমার জ্ঞান ফিরেছে। সাথে সাথে ও আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। কান্না করতে করতে আমার বুক ভিজিয়ে ফেলেছে। আজ অনেকদিন পর মনে এক ধরনের শান্তি অনুভব করছি৷ তবে ৬ বছরের অভিমানের পাহাড়ে দেবে আছে আগের ভালোবাসা। মনে আছে কিছু প্রশ্ন। এতো সহজে সবকিছুর সমাধান হওয়া সম্ভব না। আমি উঠে বসলাম আর ওকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলাম।
আমিঃ ম্যাম ক্ষমা পাওয়া এতোটাই সহজ না৷ বললেই ক্ষমা পেয়ে যাবেন। ৫ বছর বিনা কারণে আমাকে আর আমার নিষ্পাপ ছেলেটাকে একা শাস্তি দিয়েছেন। এমনকি প্রথম দিন যখন আপনি আমাকে দেখলেন তখনও আমাকে বুকে জড়িয়ে না নিয়ে ১ বছর নাটক করে গেলেন৷ আমাকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। হয়তো আপনার ভরসা অর্জন করতে পারিনি।
আমাকে এই অবস্থায় উঠে বসতে দেখে শিলা চমকে গেলো৷ কারণ এতো বড় এক্সিডেন্টের পর স্বাভাবিক ভাবে উঠে বসা মোটেও সম্ভব না৷
শিলাঃ তুমি এভাবে উঠে বসলে কিভাবে?
আমিঃ হা হা হা হা। ম্যাডাম আপনি হয়তো নিজেকে অনেক বেশি চালাক ভাবেন। তবে শুধু আপনি না গেম খেলতে আমিও পারি। আর হয়তো আপনার থেকে কয়েকগুন ভালোই পারি।
শিলাঃ মানে? কি বলছো তুমি?
আমিঃ এসব কিছু আমার সাজানো নাটক ছিলো। আমার কোনো এক্সিডেন্ট হয়নি৷ আমি পুরোপুরি সুস্থ আছি। আমি জানতাম তুমি আমার আশে পাশেই রয়েছো। তোমাকে সামনে আনার জন্য এই নাটকটা করলাম। তবে তুমি হয়তো জানোনা আমার নাটক করার কোনো দরকার ছিলোনা৷ আমি এমনিতেই তোমাকে ধরে ফেলতে পারতাম।
শিলাঃ আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া তুমি ভালো আছো। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর যদি আমাকে এমনিই সামনে নিয়ে আসতে পারতে তবে এসব নাটকের মানে কি? ( আমার হাত ধরে বললো)
আমি এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলাম৷ তারপর বললাম
আমিঃ প্লিজ কাছে আসার চেষ্টা করবেনা। আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। তুমি জানো তোমাকে সেই প্রথমদিনই চিনে ফেলেছিলাম। এতোদিন শুধু আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি যে কখন তুমি আসবে আর আমার অভিমান ভাঙাবে। তবে সেটা তুমি করোনি। তুমি কি করলে ১ টা বছর আমার পরীক্ষা নিলে যে আমি তোমাকে ভালোবাসি কিনা। নিজের ছেলেটার সাথেও নাটক করলে। এতোদিন পর কাছে পেয়ে একটা বার মা ডাক শোনার ইচ্ছা হয়নি। জানিনা তুমি এমন কিভাবে হলে। তবে এতোদিনে আমি বুঝেছি আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা সময়ের সাথে কমেছে।
শিলাঃ তুমি যদি আমাকে আগেই চিনে থাকো তাহলে এতোদিন বলনি কেনো? কেনো তুমিও আমাকে কাছে টেনে নিলে না?
আমিঃ বড়ই আজব মানুষ আপনি। দীর্ঘ ৫ বছর আড়ালে থেকেও আজ দোষটা আমাকে দিচ্ছেন। আপনি কষ্ট দিবেন, আপনি ছেড়ে যাবেন আর আপনাকে কাছে টানার দায়িত্ব নিতে হবে আমাকে?
শিলাঃ ক্ষমা করে দাও নীল আমাকে। আমি বাধ্য ছিলাম।
আমিঃ মানুষ বাধ্য হলেও এতোটা বাধ্য হয়না যে নিজের দুধের ছেলে কথা ভাববেনা। ৫ টা বছরে একটা কল করতেও মন চাইনি? একবার খোজ নেওয়ার ইচ্ছা হয়নি?
শিলাঃ তুমি বুঝবেনা নীল। আমি বাধ্য ছিলাম৷ আমার অন্য কোনো রাস্তা ছিলোনা৷
আমিঃ রাস্তা কখনও একটা হয়না। বিকল্প পথও হয়। আপনি কখনও সেই বিকল্প পথটা খুঁজার চেষ্টাও করেননি।
শিলাঃ তোমাকে সব বুঝিয়ে বলবো। আগে তুমি বাড়ি চলো।
আমিঃ এখনও তো কিছু বলাই হলোনা। সবটা বলে ফেলি। আচ্ছা আপনি জানেন আপনাকে কিভাবে আমি প্রথমদিনই চিনেছি?
শিলাঃ কীভাবে।
আমিঃ সেদিন যখন আমি ইন্টারভিউ দিতে যায় তখন আপনাকে সালাম দিলাম কিন্তু আপনি উত্তর না দিয়ে রিফাতের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর যখন আমি সেই চিরচেনা কন্ঠটা শুনি তখনই আমি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। তারপর যখন আপনার চোখের দিকে দেখি তখন আমি পুরোই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ এই মায়া, এই চোখের ভাষা আমাকে আপনার পরিচয় দিয়ে দিয়েছিলো। তারপর আপনি আমাকে কিছু না জিজ্ঞেস করেই চাকরি দেন৷ এরপর আমাকে এডভান্স ১০ হাজার টাকা দেন যেটা কোনো কোম্পানি কোনোদিন করেনা। জয়েনের আগে অগ্রীম কোনো টাকা দেওয়া হয়না। তার সাথে রিফতাকেও আপনি অফিস টাইমে নিজের কাছে রাখতেন। আপনার এসব কর্মকাণ্ড আমাকে আপনার পরিচয় বলে দিয়েছিলো। আমি অপেক্ষা করতাম তোমার জন্য যে কখন তুমি আমার কাছে এসে সবটা বলবে। একটা কথা জানো কি? আমি জানতাম সেদিন কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে ওই মেসেজটা তুমিই দিয়েছিলে। মোবাইল টিপতে টিপতে যখন তুমি তোমার ব্যাগ থেকে অন্য একটা মোবাইল বের করো তখন আমি সেটা খেয়াল করেছিলাম। তুমি মেসেজ দেওয়ার পর যে ফোন এরোপ্লেন মোডে রেখেছিলে ওটাও আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আর তোমার কাজ দেখার জন্যই আমি সেদিন বলেছিলাম যে তুমি অন্য কারও জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেছো। তারপর তুমি আমাকে অন্য কিছু বুঝাতে চাইলে। আর যখন তুমি ফোনটা বের করার পর পরই আমাকে মেসেজ দাও তখন আমি জানতাম সবকিছু। সেজন্য সাথে সাথে কল করিনি। ২ মিনিট শক হবার এক্টিং করি। আমি সারা রাস্তা ছটফট করছিলাম তবে আপনিও ঘুমান নি।
চাঁদের আলো যখন জানালা ভেদ করে আপনার মুখে পড়ছিলো তখন আমি আপনার চোখের নড়াচড়া বুঝতে পারছিলাম। সেই দিন থেকেই আমি আপনাকে সামনে আনার জন্য প্ল্যান করতে থাকি। জানেন তৃপ্তি ঢাকাতেই আছে। আপনি যেদিন আমাকে মেসেজ দেন আমি সব তৃপ্তিকে খুলে বলি। তবে এটা বলিনি যে আমি আপনাকে চিনি বলেছি আপনাকে সামনে আনার জন্য কিছু একটা করতে হবে৷ তারপর তৃপ্তি আমাকে এই নাটকটা করতে বলে। কারণ আপনি যদি আমাকে এক বিন্দুও ভালোবেসে থাকেন তাহলে আমার এক্সিডেন্টের কথা শুনে কখনই নিজেকে আটকে রাখতে পারবেন না৷ আর আপনার পরিচয় ৪ দিন আগে বর্না আপুকে বলেছি। আমরা সবাই মিলে এই প্ল্যানটা করেছি শুধু আপনাকে আড়াল থেকে প্রকাশ্যে আনার জন্য। আমার কিছুই হয়নি৷ ডাক্তারদের সাথে কথা বললে ওনারাও আমাদের সাহায্য করেছেন। সব কিছু সাজানো।
শিলাঃ তুমি একটা বার আমাকে বলে দেখতে যে আমাকে চিনেছো তাহলে তোমাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিতাম। আমি শুধু একটু পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। আমি মানছি এটা করা আমার উচিৎ হয়নি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। একটা বার আমাকে তোমার বুকে জড়িয়ে নাও। কথা দিচ্ছি সারাটা জীবন তোমার পাঁয়ের নিচে পড়ে থাকবো। তোমার কথার বাইরে আমি একটা কাজও করবো না। সব কিছু স্বাভাবিক করার জন্য আর একজন অপরাধীকে সাজা দিয়ে আমি তোমার কাছে ফিরে আসতাম। তবে ভাগ্য তোমাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে। আমি জানি তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছো তারপরও আমাকে ক্ষমা করে দাও ( হাত ধরে কান্না করছে)
আমিঃ আমার সব কথা শুনলে কিন্তু আমি শুধু একটা জিনিসই জানতে চাই কেনো? কেনো তুমি নিজেকে আড়ালে করে নিলে? এর পিছনের কাহিনী আমি জানতে চাই৷ তবে এখানে না। আমার ফ্ল্যাটে সরি তোমার দান করা ফ্ল্যাটে চলো৷ আমি সব জানতে চাই। রফিক ভাই, আপু তোমরা ওনাকে নিয়ে যাও। আমি বাইক নিয়ে আসছি।
শিলা কান্না করতে করতে গেছে। আমি যেতে পারতাম তবে এই মূহুর্তে ওর থেকে দূরে থাকাটাই আমার জন্য ভালো হবে। জানিনা ও কষ্ট পেয়েছে না পাইনি তবে এতো সহজেই সব মেনে নেওয়া যাবেনা। ৬ বছর খুব কম একটা সময় না। এই ৬ বছরে মরে যেতে পারতাম। সব থেকে বেশি খারাপ লাগছে এটা ভেবে যে পাশে থাকার পরও ও আমাকে ১ বছর দূরে রাখলো। আমিও পারতাম ওকে বলে দিতে যে আমি ওকে চিনতে পেরেছি। তবে এতিম হলেও আমারও একটা সম্মান আছে নিজের কাছে।
এসব ভাবতে ভাবতে বাসায় এসে পৌছালাম। আমি বর্না আপুকে বললাম যেনো আজকে রিফাতকে কিছু না বলে যে আমি এসেছি৷ আমি শিলার কথা জানতে চাই যে কেনো ও নিজেকে আড়াল করে নিলো৷
আমি শিলাকে আমার ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে নিজে ছাদে গেলাম। কারণ আমি ওর সাথে একাকী সময় কাটাতে চাইনা এখন। প্রায় ১ ঘন্টা থাকার পর বর্না আপু ফোন দিয়ে নিচে ডাকলো। আমি নিচে গেলাম।
চারজন মিলে বসে আছি। সবাই চুপ চাপ। শিলা কান্না করছে। তবে আমি কিছু বলছিনা আর বর্না আপুকেও বারণ করেছি যাতে ওকে একটু কাঁদতে দেয়। নিরবতা ভেঙে আমি বললাম
আমিঃ শিলা চুপচাপ না থেকে কারণটা বলো।
শিলা এবার কান্নার বেগ একটু বাড়িয়ে দিলো। ওর চোখের পানি দেখে খারাপ লাগার কথা হলেও এখন বিরক্ত লাগছে৷
আমিঃ শিলা কান্না থামিয়ে কারণটা বলো। আর নাহলে তুমি চলে যেতে পারো। তবে এবার গেলে আমি কসম করে বলছি আমাদের হারিয়ে ফেলবে। তারপর তুমি যা করো তাতে আমার কোনো মাথা ব্যাথা থাকবেনা। ( একটু ধমক দিয়ে। জীবনের প্রথম কাউকে ধমক দিলাম)
শিলাঃ না না বলছি বলছি। সব বলছি। তাহলে শুনো
★শিলার অতীত★
সংসার জীবনটা আমি অনেক বেশি উপভোগ করছিলাম৷ তোমার জন্য রান্না করা, রাতে বসে গল্প করা, তোমার দেওয়া ভালোবাসা এইসব পেয়ে আমি অনেক খুশি ছিলাম। মা তো সবটা মেনে নিয়েছিলো কিন্তু বাবার জন্য খারাপ লাগতো। তবে তোমার সঙ্গ পেয়ে আমি অনেক বেশি খুশি ছিলাম।
সেই খুশিকে দ্বিগুন করতে আমার গর্ভে আসলো তোমার সন্তান। আমি বুঝতে পারছিলাম তুমি খুশি হলেও আমার জন্য অনেক চিন্তিত। কারণ আমার মতো স্টুডেন্টের জীবন তুমি এভাবে নষ্ট করতে চাচ্ছিলেনা। তবে আমার অনাগত সন্তানের জন্য আমি অনেক বেশি খুশি ছিলাম। ওর নাম কি রাখবো? ওর জন্য কি কি করবো সব ভেবে মনে মনে হাসতাম। আর সাথে তোমার ভালোবাসা তো ছিলোই। সময় বাড়ার সাথে সাথে আমার উৎসাহ ততই বাড়ে। আসলে মা হবার অনুভূতি মুখে বলে বুঝান যাবেনা। আমার প্রেগ্ন্যাসির সময় তোমাকে পাশে পেয়ে অনেক ভালো লাগতো। সাথে মা কিছু দিন পর পর আসতো। জানো মা আমাদের জন্য অনেক দোয়া করতেন। মা চেয়েছিলেন ওনার সব সম্পত্তি আমাকে দিয়ে দিতে। তবে আমি নেইনি৷ কারণ বাবাকে না বলে কিছু করলে পরে মায়ের জন্য ভালো হবেনা।
দেখতে দেখতে আমার সন্তান দুনিয়াতে আসে। এতোদিন যে কষ্ট গুলো পেয়েছিলাম ওকে দেখে তা নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো। ওকে যখন প্রথমবার কোলে নেই তখন হয়তো আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ ছিলোনা। দিনগুলো ভালোই কাটছিলো। তবে ভালো দিনগুলোর দিকে যে কারও নজর ছিলো সেটা বুঝতে পারিনি। রিফাতের বয়স যখন ৩ মাস তখন হঠাৎ বাবা একদিন আমাকে ফোন দেই।
আমিঃ হ্যালো বাবা? কেমন আছো তুমি?
বাবাঃ ভালো আর রাখলি কই। সেই যে গেলি একটা বারের জন্য ফোন দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করলিনা৷
আমিঃ বাবা তুমি তো আমাকে তাজ্যপুত্রি করে দিয়েছিলে। কোন মুখে তোমার সাথে কথা বলতাম?
বাবাঃ আচ্ছা সব বাদ দিয়ে এখন সব আগের মতো করে নে।
আমিঃ বাবা তুমি সত্যি বলছো? আমাদের মেনে নিবে?
বাবাঃ হ্যাঁ। আর কতদিন এভাবে চলবে বল?
আমিঃ এখন তাহলে আমি কি করবো?
বাবাঃ তুই কালকে আয় বাড়িতে। তোর সাথে আগে মন ভরে কথা বলবো। কালকে তুই একাই আই।
আমিঃ আচ্ছা বাবা আমি আসবো।
বাবাঃ আর তোর জামাইকে বলিসনা এই ব্যাপরে। বলবি ভার্সিটিতে কাজ আছে।
আমিঃ আমি তো ওকে কখনও মিথ্যা বলিনা। তবুও তোমার জন্য এটুকু করতেই পারি।
সেদিন অনেক খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে আমাদের সুখের দিন হয়তো ফিরে আসবে। বাবার কথা মতো আমি বাসায় গেলাম৷ বাসায় বেল দিতেই মা দরজা খুলে আমাকে দেখে চমকে গেলো।
মাঃ শিলা তুই? তোর বাবা বাড়িতেই আছে মা৷
আমিঃ মা আমাকে বাবাই কালকে ফোন করে আসতে বলেছে।
মাঃ তার মানে তোর বাবা সব মেনে নিয়েছে?
আমিঃ হ্যাঁ মা।
মাঃ কই আমাকে তো কিছু বলেনি?
আমিঃ বাবা হয়তো তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে।
মাঃ ভিতরে চল।
আমি ভিতরে গেলাম৷ একটু পর বাবা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আমরা বসে অনেক্ষন গল্প করলাম। কথার মাঝপ বাবা বললো
বাবাঃ তাহলে জামাইকে আর তোর ছেলেকে রেখে এসেছিস?
আমিঃ হ্যাঁ বাবা। আমাকে যেতে হবে তাড়াতাড়ি। ও হয়তো আমার জন্য চিন্তা করবে।
বাবাঃ শোন এখন তোকে আমি কিছু কথা বলবো। তুই মন দিয়ে শুনবি।
আমিঃ বলো বাবা।
বাবাঃ আগামী সপ্তাহে তোর বিয়ে।
আমি আর মা কথাটা শুনে অনেক খুশি হলাম। এবার তাহলে বিয়ে দিয়েই আমাকে ঘরে তুলবে৷ যদিও মানুষে কি বলবে ভেবে খারাপ লাগছিলো। তবুও খুশি হলাম।
আমিঃ বাবা তুমি সত্যি বলছো? আমাদের আবার বিয়ে দিবে?
বাবাঃ হ্যাঁ।
আমিঃ তাহলে আমি নীলকে সবটা খুলে বলি। ও অনেক খুশি হবে।
বাবাঃ তুই হয়তো আমার কথাটা বুঝতে পারিসনি।
আমিঃ এটা আবার না বুঝার মতো কি?
বাবাঃ আমি বলেছি তোর বিয়ে সামনে সপ্তাহে আমি এটা বলিনি যে তোর বিয়ে নীলের সাথে। আমি তোট বিয়ে এমপির ছেলে রকির সাথে ঠিক করেছি।
কথাটা শুনে যেনো আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মা ও হতবাগ হয়ে গেছে বাবার কথায়।
মাঃ এই তুমি এসব কি বলছো? ওর নিজের ঘর সংসার আছে একটা ছেলে আছে। আর তুমি কিসব আজেবাজে কথা বলছো?
বাবাঃ আমি কোনো মজা করছিনা। ভার্সিটি যাবার সময় রকি ওকে দেখে পচ্ছন্দ করেছে। এমপি সাহেব নিজে আমাকে বলেছেন। আর আমি চাইনা ওই এতিমের বাচ্চার সাথে আমার মেয়ে সংসার করুক।
আমিঃ বাবা তুমি পাগল হয়ে গেছো? আমার ঘর ভাঙতে চাইছো তুমি?
বাবাঃ আমার এই কথা তোকে মানতেই হবে।।
আমিঃ বাবা আমি কিছুতেি আমার স্বামী সন্তান ছেড়ে আসবোনা। আর কতটা নিচু মানসিকতার মানুষ হলে তুমি এসব কথা বলো?
বাবাঃ আমি যা বলেছি তাই হবে। আগের বার আটকে রাখতে পারিনি তবে এবার যেতে পারবিনা।
আমিঃ আমি তোমার কথা শুনতে বাধ্য নই। তুমি আমাকে তাজ্যপুত্রি করেছো তাই এখন আর তোমার অধিকার নাই।
বাবাঃ বেশি কথা বলিসনা। এখন এই বাড়ি থেকে তুই এক পাঁও এগোতে পারবিনা।
মাঃ এসব কাজ করনা। তোমার মেয়ে অনেক সুখে আছে ওর ঘর এভাবে নষ্ট করোনা।
বাবাঃ আমি কিছু জানিনা। আমি চাই রকির সাথে ওর বিয়ে দিয়ে ওর শশুরের লোকবলের মাধ্যমে এলাকার মেয়র হতে।
আমিঃ ছিঃ বাবা ছিঃ। তার জন্য নিজের মেয়েকে বিক্রি করে দিবে? আমাকে মেরে ফেললেও আমি এই কাজ করতে পারবোনা৷ চাইলে আমাকে মেরে ফেলো।
বাবাঃ তোকে মেরে ফেলতে পারবোনা৷ তবে তোর ছোটলোক এতিম জামাই আর ওর ছেলেকে মারতে আমার সময় লাগবেনা।
আমিঃ বাবা তুমি এতোট নিচে নেমে গিয়েছ? আমার স্বামী সন্তানের ক্ষতি করতে চাইছে? ( কান্না করে)
বাবাঃ আমি চাইনা তবে তুই রাজি না হলে আমি বাধ্য হবো।
আমিঃ তার চাইতে বরং তুমি আমাকে মেরে ফেলো। আমি তোমার পাঁয়ে ধরি বাবা আমার নিজ হাতে সাজানো সংসার তুমি এভাবে ভেঙে দিয়োনা? ( পাঁয়ে পড়ে কান্না করছি)
বাবাঃ আমি কিছু শুনতে চাইনা। আর শোন তোর আর ওর ফোন কিন্তু ট্র্যাক করা হবে। ভুলেও যদি ওর কাছে কল যায় তাহলে সাথে সাথে ওদের মেরে ফেলা হবে।
মাঃ এতো বড় পাপ তুমি করোনা৷ এর প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবেনা। আমার কথাটা শুনো।
বাবাঃ আমি কিছু শুনতে চাইনা। আর শিলা তোকে আগেই সাবধান করছি ভুলেও কারও সাথে কথা বলার চেষ্টা করবিনা। নাহলে যার সাথে কথা বলবি সবাই মরবে।
আমিঃ আমার স্বামী সন্তানের ভয় দেখিয়ে হয়তো তুমি আমাকে আটকে রাখলে। তবে একটা কথা জেনে রেখো তোমার মরা মুখটাও আমি দেখবোনা। এমন সময় আসবে আমাকে একটাবার দেখার জন্য আকুতি মিনতি করবে। তবে সেইদিন আমাকে দেখতে পাবেনা। আমি বিয়ে করবো। তবে আমি আজ তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি কোনোদিন তুমি সুখী হবেনা৷ আমার বিয়ের পরই আমি আত্মহত্যা করব।
বাবাঃ এসবের চেষ্টা করলেও ওদের মরতে হবে।
আমিঃ মেরে দিও। এমনিতেও আমাকে ছাড়া নীল পদে পদে কষ্ট পাবে। আমাকে অন্য ছেলের সাথে দেখে তিলে তিলে মরার চেয়ে বেশি ভালো ওকে মেরে দিয়ো। সাথে আমার ছেলেকেউ। কারণ একজন এতিমের কষ্ট আমি বুঝি। নিজের স্বামীকে দেখে আমি বুঝেছি।
সেদিন বাবার প্রতি আমার ঘৃনা পৃথিবীর সব জিনিসের চাইতে বেশি ছিলো। আমি পারলে সেখানেই তাকে মেরে ফেলাতাম। তবে আমি পারিনি। তবে আমি অন্য কারও হতেও পারতাম না৷ তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি পালিয়ে যাবো। তোমাকে ফোন করতে পারতাম না৷ কারণ আমার ভয় ছিলো বাবা যদি তোমাকে কিছু করে বসে? তাই ফোন বন্ধ করে দিয়েছিলাম। বাবা মায়ের ফোনও বন্ধ করে রেখে দিয়েছিলো। আমি বাড়ি থেকে পালার সুযোগ পাচ্ছিলাম না৷ একটা ব্যাগে কিছু জামা কাপড় আর কিছু টাকা নিয়ে আমি রেডি ছিলাম৷ ৪ দিন আমি কোনো সুযোগ পাইনি। ৫ ম দিন রাতে আমি সুযোগ বুঝে আমি পালিয়ে যায়। তবে যাবা আগে একটা চিঠি লিখে গেলাম।
তারপর সেই রাতে আমি একা একটা মেয়ে রাতের অন্ধকারে পালাচ্ছিলাম। কাউন্টারে গিয়ে ঢাকার একটা টিকিট কেটে অজানার দিকে পাড়ি দেই৷ কারও সাথে যোগাযোগ করার আমার সাহস হয়নি।
তারপর আমি ঢাকায় আসি। আমি যে টাকা নিয়ে এসেছিলাম তা দিয়ে আমি হোটেলে উঠি। আর তবে আমার কাজের প্রয়োজন ছিলো। তবে বাইরে যাবার আগে আমি নিজেকে পর্দার আড়ালে ঢেকে নিলাম৷ দুইদিন চাকরি খোজার পর কোনো জায়াগাতে কোনো চাকরি পেলাম না।
একদিন চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে ফিরতে একটু সন্ধ্যা হলো। আমি বেখেয়ালি ছিলাম। প্রতিটা সেকেন্ডে আমার ছেলে আর তোমার কথা মনে পড়তো। জানিনা তুমি আমাকে খুঁজে না পেয়ে কি করছিলে তবে আমি নিরুপায় ছিলাম। আমি এটাও জানতাম না যে বাবা তোমার সাথে কিছু করেছে কিনা। তবে এরকম কোনো কিছু জানতে পারলে আমি নিজেকে শেষ করে দিতাম।
যাইহোক সেদিন বেখেয়ালি ভাবে রাস্তা পর হচ্ছিলাম৷ এর মাঝে আচমকা একটা প্রাইভেট কার আমাকে ধাক্কা দিলো। যদি গাড়ির গতি বেশি ছিলোনা। আমার তারপর কিছু মনে নেই। যখন চোখ খুলি তখন ৪০-৪৫ বছর বয়সি একজন মানুষকে আমার পাশে দেখতে পাই। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করি
আমিঃ আমি কোথায় আছি? আর আপনি কে?
লোকটাঃ শান্ত হও মা। তুমি রাস্তা পার হবার সময় আমার গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে একটু আহত হয়েছিলে। আমি তোমাকে নিয়ে আসি।
আমিঃ আমাকে যেতে হবে। চাকরি খুজতে হবে আমাকে। আংকেল আপনাকে ধন্যবাদ আমার সাহায্য করার জন্য। তবে আমাকে এখন যেতে হবে।
লোকটাঃ আরে মা তুমি এতো উত্তেজিত হবেনা। এখন তো তুমি কোথাও যেতে পারবেনা৷
আমিঃ কিন্তু আমার তো চাকরি খুঁজতে হবে৷
লোকটাঃ চাকরি কিসের জন্য?
আমিঃ আমি তো এখন অসহায়। চাকরি না করলে চলবো কিভাবে?
লোকটাঃ আচ্ছা তোমার সাথে কি হয়েছে আমাকে খুলে বলবে?
আমিঃ সেরকম কিছু হয়নি আংকেল।
লোকটাঃ দেখো আমি তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি যে তোমার সাথে কিছু একটা হয়েছে। আমাকে খুলে বললে হয়তো আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।
আমিঃ আসলে আংকেল হয়েছে কি ( সব খুলে বললাম। বলা শেষে নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। কান্নায় ভেঙে পড়লাম)
লোকটাঃ আচ্ছা তোমার সার্টিফিকেট আছে?
আমিঃ এইচএসসির সার্টিফিকেট আছে আংকেল। ভার্সিটি তো শেষ করতে পারিনি।
লোকটাঃ তোমার আইডি কার্ড আছে?
আমিঃ জ্বী আংকেল আছে।
লোকটাঃ তাহলে তুমি কোনো চিন্তা করবেনা। আমি ******* কোম্পানির মালিক। তুমি সুস্থ হলে আমার অফিসে জয়েন করবে।
আমিঃ এতো কিছু আমার জন্য কেনো করছেন?
লোকটাঃ বেশি প্রশ্ন করবেনা। আর আজকে আমি তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাবো।বাড়িতে আমি আর আমার মেয়ে থাকি। আমার স্ত্রী মেয়েটাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। এখন ওকে নিয়ে আমি একা থাকি। তবে আজ থেকে তুমি আমার সাথে থাকবে। আমি কোনো কথা শুনতে চাইনা এই নিয়ে।
এরপর আংকেল আমাকে ওনার সাথে ওনার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ওনার মেয়েটাও ছিলো একদম তার মতোই। বড় মনের মানুষ ওরা। আস্তে আস্তে আমি সুস্থ হয়ে উঠি।
কিছুদিন পর থেকে আংকেলের অফিসে জয়েন করি৷ ২ মাস লাগে আমার কাজ শিখতে তবে বেতন অনেক বেশি দিতো। তার সাথে ওনার বাড়িতে থাকতে পেতাম। দিনগুলো চলছিলো। তবে রাত এলেই তোমার কথা মনে পরতো, নিজের ছেলেটার জন্য মনটা ছটফট করতো। মন চাইতো ছুটে চলে যায় তোমার কাছে। একটা বার কল দিয়ে খোজ নেওয়ার ইচ্ছা হতো। তবে ফোন দিতে গেলে প্রথমত আমার লোকেশন আমার বাবা ট্র্যাক করতে পারত আর দ্বিতীয়ত তোমার সুরক্ষার জন্য।
আমার কাজ ভালোই চলছিলো। অনেক অল্প সময়ের মধ্যেই উনি আমাকে সিনিয়র পদ দিয়ে দেন। আমি এতো তাড়াতাড়ি এতো বড় দায়িত্ব নিতে চাইনি। তবে ওনার জোরাজুরির জন্য হার মানতে হয়।
সব কাজ ভালোই চলছিলো। আমি নিজেকে সম্পূর্ণ পর্দার আড়ালে করে নিয়েছিলাম। আমি চাইতাম না যে কোনো পর পুরুষ আমাকে দেখুক। তবে এতোকিছুর পরও অফিসের আরেক সিনিয়র অফিসার আমাকে বিয়ে প্রস্তাব দিয়ে বসেন। প্রায় প্রতিদিন উনি আমার সাথে এই নিয়ে কথা বলতে আসতেন। একদিন তো উনি তার মাকে দিয়েও ফোন করায়। আমি তখনও উনাকে বলিনি যে আমি বিবাহিত আর আমার বাচ্চা আছে। একদিন লাঞ্চ টাইমে উনি এসে আমার সাথে কথা বলতে চাইলেন। তবে আমি তার কোনো কথা শুনছিলাম না৷ তারপরও তিনি প্রশ্ন করলেন
ছেলেটাঃ আচ্ছা তোমার সমস্যা কি বলোতো? আমি তো কোনো হারাম সম্পর্কে জড়াতে চাচ্ছিনা। আমি তোমাকো বিয়ে করতে চাচ্ছি।
আমিঃ আমিও কারও সাথে পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ আমার একটা ছেলে আছে। প্লিজ আমার সাথে এই নিয়ে কোনো কথা বলবেন না।
ছেলেটাঃ আমি বিশ্বাস করিনা। যদি তোমার স্বামী সন্তান থাকে তাহলে তুমি বসের বাড়িতে উনার সাথে থাকো কেনো? আমাকে ইগনোর করার জন্য তুমি এসব বলছো।
আমিঃ আপনাক মিথ্যা বলে আমার লাভ কি? তাছাড়া আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি।
ছেলেটাঃ আচ্ছা এতোদিন থেকে তোমাকে বলছি তাও তোমার মনে কোনো মায়া সৃষ্টি হলোনা?
আমিঃ আজব ব্যাপার। আপনার প্রতি আমার মায়া সৃষ্টি হবে কেনো? আমার সব মায়া আমার স্বামীর জন্য।
ছেলেটাঃ দেখো আমাকে মিথ্যা বলে লাভ নাই৷ যদি তুমি রাজি না হও আমি নিজের ক্ষতি করবো।
আমিঃ তাতে আপনার ক্ষতি আমার কিছু যায় আসেনা।
ছেলেটাঃ সত্যি তোমার কোনো জায় আসেনা?
আমিঃ হুম। আমার কোনো যায় আসেনা।
ছেলেটাঃ আর কিছু বলার নাই আমার। খু্ব ভালেবাসতাম তোমাকে।
আমিঃ আমাকে কখনও দেখেছেন?
ছেলেটাঃ তোমাকে না দেখেই আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আমিঃ আমি ভালোবাসি আমার স্বামীকে।আর কখনও আমাকে এসব কথা বলতে আসবেন না।
সেদিন রাতে ওনার মা আমাকে ফোন দিয়ে বলেন যেনো আমি রাজি হয়ে যায় কারণ তার ছেলে নাকি আমার জন্য কিছু খাচ্ছেনা আর কান্না করছে। তারপরও আমি রাজি হয়নি। হবো কেমন করে? নিজের স্বামী থেকে দূরে থাকলেও আমি তাকে এক সমুদ্র পরিমান ভালোবাসি। তার কিছুদিন পর থেকে ছেলেটাকে আর দেখিনি। আর খোজ নেওয়ার বিন্দু মাত্র প্রয়োজন মনে করিনি।
দেখতে দেখতে ১ বছর কাটে। একদিন রাতের খাবারের পর আংকেল আমাকে বলেন
আংকেলঃ শিলা মা আমি সিলেট চলে যাবো।
আমিঃ কয়দিনের জন্য?
আংকেলঃ ওখানেই শিফট করতে হবে। তুই ও চল আমার সাথে।
আমিঃ না আংকেল আমি এখানেই থাকবো।
আংকেলঃ তাহলে আমি তোকে কিছু বলতে চাই৷ তবে আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবিনা৷
আমিঃ জ্বী আংকেল বলুন
তারপর আংকেল যা বললেন তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। সবকিছু যেনো স্বপ্নের মতো লাগছিলো। আংকেল যে আমাকে এই কথা বলবেন তা আমি কখনও ভাবতেও পারিনি। কারণ আংকেল যা বললেন……………..