Wednesday, July 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1024



ভুলোনা আমায় পর্ব-০৫

0

#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-০৫
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

কাজে এসে কিছুতেই মন বসাতে পারছে না সোহান।বার বার সাবা’র বলা কথাটা মনে পরছে “আমি আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলেছি,সে চায় না আপনার সাথে সংসার করতে”!
কথাটা যতোবার মনে পরছে ততবার অস্থির লাগছে। মনে মনে “আস্তাগফিরুল্ল” পড়ছে,যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। আল্লাহ তা’আলার কাছে শয়তান হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছে।
এমনি করে সকাল গড়িয়ে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। সোহান কিছু একটা ভেবে বাসায় মায়ের কাছে কল করলো…
.
.
রোকেয়া বেগম পাশের বাসার রাফিদা বেগমের সাথে বসে সুখ দুঃখের কথা বলছেন, তখন মেহুল দৌড়ে এসে বললো,
— আম্মা বড় ভাইয়া কল করেছে, তাড়াতাড়ি কথা বলো।

রোকেয়া বেগম কানের কাছে ফোন ধরলেন। তারপর বললেন,
— ওয়ালাইকুমুস সালাম।কিরে বাপ কিছু বলবি?
…….
— এখন ই আসবি?
…….
— আচ্ছা ঠিক আছে আমি ক‌ইতাছি। আচ্ছা আচ্ছা, ফোন কাইট্টা দে।

রোকেয়া বেগম ফোন নামিয়ে বললেন,
— মেহু যা টুসি’রে ডাইকা আন গিয়ে?
— আচ্ছা আম্মা।

একটু পর টুসি আসতেই রোকেয়া বেগম বললেন,
— তোমরা দুইজন তৈয়ার হ‌ইয়া নাও,একটু বাদে সোয়ান তোমাগরে নিতে আইবো।

টুসি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আর মেহুল উৎসুক হয়ে বললো,
— কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের?
— হে গেলেই দেখতে পাবি,যা তাড়াতাড়ি তৈয়ার হ ।আর শোন দুজনেই কিন্তু বোরকা প‌ইরা লবি, সোয়ান বার বার ক‌ইছে।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর সোহান বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে নিল। তারপর খুব সুন্দর করে নিজে পরিপাটি হয়ে রুম থেকে বের হয়ে বললো চলো যাওয়া যাক?
মেহুল আর টুসি বোরকা হিজাব পা মৌজা হাত মৌজা পরে সোফায় বসে অপেক্ষা করছিল সোহানের জন্য। সোহান আসতেই টুসি’র অবাধ্য চোখ দুটো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সোহানের দিকে।বেচারির বা দোষ কি? এতো দিন পাঞ্জাবি পরিহিত সাদাসিধে যে সোহান কে দেখেছে, সেই সোহান থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন এক সোহান কে দেখছে টুসি! একদম ভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়েছে সোহান।টুসি’র ভাস্যমতে এই মূহুর্তে সোহানের লুক,আকাশি কালারের শার্ট এবং কালো জিন্স পরিহিত একজন যুবক তার সামনে দাঁড়ানো। যুবকটির উচ্চতা বেশ ভালো। দেখতে শ্যাম বর্নের, মুখে চাপ দাড়ি, চুলগুলো বেশ কায়দা করে স্টাইল করা। চোখে চশমা, দেখলে একজন নিতান্ত সুদর্শন ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে।

সোহান পকেট থেকে ফোন বের করে সময়টা চেক করে নিল। তারপর হাটতে হাঁটতে বললো,
— ফলো মি।

টুসি ভাবনার সুতো কেটে, রোকেয়া বেগম কে বলে মেহুলের হাত ধরে সোহানের পিছু পিছু এগিয়ে গেল। তারপর বাসার সামনে দাড়াতেই সিএনজি ঠিক করলো সোহান। পিছনের তিন সিটে সুন্দর করেই জায়গা দখল করলো তিনজনে, প্রথমে মেহুল মাঝখানে টুসি পাশে সোহান। অতঃপর কয়েক মিনিটের ব্যাবধানে সাহাবাগ শিশু পার্কে এসে পৌঁছায় তারা।

শিশু পার্কের প্রায় প্রত্যেকটি জিনিসের ভেতরকার নিহিত উদ্দেশ্যই হল শিশুর আনন্দ-বিনোদন নিশ্চিত করা।বলাই বাহুল্য শিশু পার্কে বাচ্চাদের আকর্ষণীয় জিনিস থাকবে। এজন্য ঢাকার এই শিশু পার্কটিতে রয়েছে বাচ্চাদের খেলাধুলা-আনন্দ-বিনোদনের জন্য ১২ টি মজার রাইড। এছাড়া বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে ঢাকা শিশু পার্কে একটি জেট বিমান উপহার দেওয়া হয়।তাই এর থেকে ভালো কোনো স্থান টুসি’র জন্য খুঁজে পেলো না সোহান।
প্রবেশদ্বারের কাছে কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে নেয় সোহান। তারপর ধীরে ধীরে ভিতরে প্রবেশ করে।টুসি গ্রামের মেয়ে হয়ায় এতো কিছু দেখার সৌভাগ্য হয়নি কখনো,তাই এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটছে। হঠাৎ কিছুর সাথে পা লেগে হুচট খায় টুসি।পরে যাওয়া ধরলে, পিছন থেকে সোহানের সার্ট খামচে ধরে।যার ফলে পরে যাওয়া থেকে আটকায়। সোহান পিছনে ফিরে বললো,
— নিচের দিকে দেখে, সাবধানে হাটো।মেহুল তোর পিচ্চি ভাবী কে চোখে চোখে রাখিস,বলা যায় না আবার কোথাও হারিয়ে যেতে পারে।

এ কথা বলে,টুসি’র চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে সোহান।এতে করে লজ্জায় মাথা নিচু করে টুসি। তারপর প্রথমে উড়ন্ত নভোযানে উঠে টুসি আর মেহুল। সোহান পাশে দাঁড়িয়ে থাকে,মেহুল তাদের সাথে উঠতে বলে কিন্তু সোহান উঠে না। হয়তো টুসি বললে ভেবে দেখতো।যাই হোক, এই প্রথম বার রাইডে উঠে ভয়ে বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করছে টুসির। মনে হয় এই যেন পরে যাবে। আল্লাহ তা’আলা কে ডেকে ডেকে অস্থির।

তারপর যখন একে একে কয়েকটি রাইডে উঠলো তখন ভয়টা কমে এলো। তখন আনন্দ অনুভব করতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে ভয় পেলে মেহুল কে শক্ত করে ধরে রাখে।মেহুল তাই করে, দুজনের মধ্যে এ কয়েকদিনে বেশ ভাব হয়েছে,সমবয়সী কিনা।একে একে সব গুলো রাইডে চড়া শেষ হলে,সাড়ে পাঁচটার দিকে পার্ক থেকে বের হয়ে আসে তারা। তারপর ভালো রেস্তোরাঁয় নিয়ে যায় সোহান তাদের। চারিদিকে ঝলমলে লাইটিং এর আলোয় পিচ্চি টুসি’র চোখ ধাঁধিয়ে আসে। পরক্ষনেই আবার নিজেকে মানিয়ে নেয়।চোখ ঘুরিয়ে দেখতে থাকে আসে পাশের বিলাসবহুল পরিবেশ। সোহান এক্সট্রা কেবিন বুকিং করেছে তাদের জন্য।
সেখান থেকে দরজা গলিয়ে বাহিরের কাপলদের দিকে তাকিয়ে থাকে টুসি। অন্যান্য কাপল’রা নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা করছে।একে অপরকে খাইয়ে দিচ্ছে। সেসব দেখে বড় বড় চোখে তাকায় টুসি।যা দেখে ভাই বোন একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে হাসে। তারপর ওয়েটার মেনু কার্ড দিলে টুসি সোহানের দিকে মেনু কার্ড ঠেলে দেয় আর বলে আপনার ইচ্ছে মতো বলুন। সোহান মেনু কার্ড দেখে ওয়েটার কে বললো,
— চিকেন নাগেট,ভেজিটেবল স্যান্ড‌উইচ,ডোনাট আর লাচ্ছি দিন।
মেহুল তুই কি এগুলো খাবি নাকি অন্য কিছু?

মেহুল বললো,
— আমার জন্য লাচ্ছি’র বদলে ফ্রুট কাষ্টার্ড দিতে বলো।

তারপর সোহান ওয়েটার কে বুঝিয়ে বলে দিল,কি কি দিবে।
খাবার আসার ফাঁকে মেহুল সোহানের ফোন নিয়ে সবাই মিলে সেলফি তুললো,পরে সোহান আর টুসি’র কাপল পিক তুললো। তারপর খাবার সার্ভ করা হলে, সোহান হাতে ধরে শিখিয়ে দেয় কিভাবে কাটা চামচ ধরে খেতে হয়। প্রথমে হাত থেকে ফসকে গেলেও পরে মানিয়ে নেয়। ঠিক ভাবেই খেতে পারে।এক পর্যায়ে সোহান মুখের সামনে স্যান্ড‌উইচ ধরে,টুসি তাকিয়ে থাকলে সোহান চোখে ইশারা করে খাওয়ার জন্য। তারপর আবার মেহুল কে খাইয়ে দেয়,মেহুল ও তার ভাইকে খাইয়ে দেয়।তা দেখে টুসিও মেহুল কে খাইয়ে দেয়,মেহুল ও তাই করে। তারপর মেহুল বললো,
— ভাবী তুমি কিন্তু ভাইয়া কে খাইয়ে দিলে না? এটা কিন্তু ঠিক না।

টুসি মাথা নিচু করে বসে থাকে,যা দেখে সোহান মন খারাপ করে বললো,
— থাক লাগবে না কারো খাইয়ে দেওয়ার। আমি নিজেই খেতে পারবো।

এবার টুসি’র কিছুটা খারাপ লাগছে। মানুষটা তার জন্য এতো করে অথচ সে কিনা এইটুকুই নি করতে পারবে না? একটু খাইয়েই তো দিবে,এ এমন কি কঠিন কাজ? মনে মনে হাজার জল্পনা কল্পনা করে অবশেষে কাঁপা কাঁপা হাতে খাবার নিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় টুসি!যা দেখে বড় বড় চোখে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে সোহান।মেহুল তখন বলে, কি হলো ভাইয়া খাবার টা খাও? তবুও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সোহান। এদিকে অস্বস্তিতে মিইয়ে যায় টুসি, শেষে না পেরে সোহানের মতো চোখে ইশারা করে খাওয়ার জন্য।যা দেখে মুচকি হেসে খাবার মুখে নেয় সোহান।

তারপর আবার সবাই খাবার খাওয়াতে মনোযোগ দেয়।টুসি তার লাচ্ছি চুমুক দিয়ে খেয়ে ডোনাট মুখে দেয়।এই সুযোগে সোহান তাদের লাচ্ছি’র গ্লাস পরিবর্তন করে দেয়।
সোহানের কান্ড দেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে টুসি, এদিকে মেহুল সব কিছু দেখেও না দেখার ভান করে নিজ মনে খেয়ে যাচ্ছে।টুসি’র তাকিয়ে থাকা দেখে সোহান বলে,
— প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আমাদের জন্য আদর্শ । স্ত্রীদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন ।দাম্পত্য জীবনে প্রত্যেক স্বামীর কর্তব্য হলো, নবী করীম (সাঃ)-এর সুন্নাত পালন করা ।
স্ত্রী গ্লাসের যে স্থানে ঠোঁট রেখে পানি পান করে সেই স্থানে ঠোঁট রেখে পানি পান করা সুন্নাত[১]
যদিও তুমি গ্লাসে ঠোঁট ছুঁয়ে খাওনি তাতে কি পাইপ দিয়ে তো খেয়েছো?এটা দিয়ে খেলেই আমার একটা সুন্নাত পালন করা হয়ে যাবে “ইনশা আল্লাহ”।

হাদীস সম্পর্কে শুনে টুসি আর দ্বিধা করলো না,বাকি খাবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো।
.
.
এর তেরো দিন পর,টুসি’র বাবা স্বপন তালুকদার কল করে সোহানের পুরো পরিবার কে, তার দুই ছেলের বিয়ে উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করেন। সোহান টুসি’র কাছে ব্যাপারটা চেপে গিয়ে, বাসার বাদবাকি সবার সাথে আলোচনা করে।কে বিয়েতে যাবে আর কে যাবে না। রোকেয়া বেগম বলেছেন তার শরীর টা ভালো লাগছে না তাই তিনি এতো দূর কষ্ট করে যাবেন না, আরমান পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত তাই সে ও যাবে না বলেছে।বাকি থাকে সোহান,টুসি,আর মেহুল।তারা তিন জন যাবে,আর যাওয়া টাই হবে টুসি’র সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ….
___________
রেফারেন্স:-
[১]মুসলিমঃ৫৭৯
____________

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।

ভুলোনা আমায় পর্ব-০৪

0

#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-০৪
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

ক্লাসে নতুন স্টুডেন্ট দেখে সাবা জিজ্ঞাসা করলো,
— তুমি কি নতুন এসেছো?

টুসি দাঁড়িয়ে বললো,
— জ্বি মিস।
— কিন্তু এরকম মাঝ পথে আসার কারণ কি?
— মিস এখানে আমার…

টুসি সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগে মেহুল দাঁড়িয়ে বললো,
— মিস ও আমার ভাইয়ার ব‌উ!

বিদ্যুৎপিষ্ঠের ন্যায় চমকে উঠলো সাবা! আজকে একটা কারণে যতটা না খুশি ছিল তার চেয়ে দ্বিগুণ হারে ব্যাথিত হলো সাবা।তাও ভালো করে যাচাই করতে বললো,
— তোমার বড় ভাইয়া বিয়ে করেছেন?
— জ্বি মিস।

পুনরায় বুকটা হাহাকারের প্রতিধ্বনি তুললো।যাকে ঘিরে তার স্বপ্ন, সেই মানুষটা আজকে অন্য কারো হয়ে গেল? কি দোষ ছিল তার? গরীব বাবার ঘরে জন্মানো এতোই দোষের? নিজেকে কোন রকম সামলে নিয়ে ক্লাসে মনোনিবেশ করে সাবা।

এখানে পড়াশোনা করে নিজ গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে টুসি। সেসব বন্ধবস্ত করেছে সোহান।সে চায় না বিয়ের কারণে পড়াশোনার কোন রকম ক্ষতি হোক। তাছাড়া বয়স কম ধীরে ধীরে ঠিক বুঝতে পারবে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। ততদিন না হয় অপেক্ষা করবে সোহান।
.
.
এটা একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে এখানে পড়াশোনার দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে। প্রতিবছর বোর্ড পরীক্ষায় পনেরো থেকে বিশ জনের মতো গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে স্টুডেন্ট। তাছাড়া অন্যান্য স্টুডেন্টের রেজাল্ট গ্রেড পয়েন্ট থাকে। চুড়ান্ত টেষ্ট পরীক্ষায় যেসকল স্টুডেন্ট সব বিষয়ে উত্তিন্ন হতে পারে না, সেসকল স্টুডেন্ট দের বের করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট’রা এখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। সেখানে সাবা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট হয়ে শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত আছে শুধুমাত্র তার বাবার দৌলতে।
মনিরুল হক এই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন,সাত মাস হলো তিনি পরলোকগমন করেছেন।তার পরিবারের কথা চিন্তা করে সাবা কে এ স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত করা হয়েছে। সেই থেকে বাবার আদর্শ অনুসরণ করে শিক্ষকতা করে যাচ্ছে সাবা। পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। সোহান বা তার মা জানেন না যে সাবা এই স্কুলে কর্মরত আছে।মেহুল তার মায়ের ভয়ে কখনো বলেনি সাবা’র কথা, এমন কি সোহান কে ও না।সাবা মাঝে মাঝে খবর নেয় মেহুলের থেকে সোহানের ব্যাপারে। সেকথা মেহুল কখনো বলেনি সোহান কে।

বেশ কিছুদিন পর,
ক্লাস শেষে সাবা টুসি কে বললো,
— টিফিন পিরিয়ডে অফিস কক্ষে দেখা করো আমার সাথে!
— জ্বি মিস।

যথাসময়ে টুসি অফিসে যাবে বলে, সাথে মেহুল কে যেতে বললে মেহুল বলে,
— মিস তোমাকে একা যেতে বলেছে, আমি সাথে গেলে যদি বকা দেয় তখন? না বাবা তুমি ই যাও।

অতঃপর, ভয়ে ভয়ে অফিস কক্ষের সামনে এসে অনুমতি নিয়ে ভিতরে ঢুকে টুসি।সাবা নিজের টেক্সট বই পড়ছিল,টুসি কে দেখে ব‌ই বন্ধ করে বললো,
— বসো।

টুসি সামনে থাকা চেয়ারে জড়োসড়ো হয়ে বসে মাথা নিচু করে থাকে। তখন সাবা,টুসি’র দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
— এতো কম বয়সে বিয়ে করার কারণ কি?
— মিস আমি বিয়ে করতে চাইনি!দ্যান আব্বু আম্মুর কথায় রাজি হ‌ই।
— কিভাবে পরিচয় তোমার হাসবেন্ড এর সাথে?
— উনি আমার ফুফাতো ভাই।
— আই সি।তো দাম্পত্য জীবনে খুশি তুমি?আই মিন শ্বশুর বাড়িতে ভালো লাগছে? হাসবেন্ড অনেক কেয়ার করে বুঝি?

টুসি মন খারাপ করে বললো,
— আমার এখানে একদম ভালো লাগে না মিস। আব্বু আম্মু দাদি ভাইয়াদের কথা খুব মনে পরে। আমি আমার গ্রামেই আনন্দে ছিলাম, ইচ্ছে করে ছুটে চলে যাই।

সাবা ভ্রু কুঁচকে তাকায় টুসির দিকে।টুসি’র কথা শুনে যা বোঝার বুঝে গেছে সে।তাই টুসির আড়ালে বাঁকা হাসি দেয় সে!তারপর কিছু একটা ভেবে বললো,
— তোমাকে যদি গ্রামে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তুমি যাবে?

অবাক নয়নে তাকায় টুসি, তারপর হাসি মুখে বললো,
— খুব খুশি হবো আমি। কিন্তু এটা কখনোই সম্ভব নয় মিস। আমাকে তারা যেতে দিবে না কখনোই।

সাবা টেবিলের উপর থাকা কলম ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
— আচ্ছা তাসনুভা তোমার বাবা কি করেন?আই মিন তার পেশা কি?
— আব্বুর মাছের প্রজেক্ট আছে অনেক গুলো, সেখানে কর্মচারী দিয়ে সমস্ত কাজ পরিচালনা করা হয়। আব্বু ভাইয়ারা শুধু পরিকল্পনা করে লোকজনদের মাধ্যমে কাজ করান।

এবার সাবার কাছে সবটা ক্লিয়ার হয়, মাছের প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করা মানে অনেক মোটা অংকের টাকা।আর তাই রোকেয়া বেগম তার ছেলের জন্য কম বয়সী মেয়ে বেছে নেন! মহিলার লোভ মাত্রাতিরিক্ত এতেই বোঝা যাচ্ছে। না হয় এতো ছোট একটা মেয়েকে ব‌উ করে আনেন?

সর্বশেষ সাবা টুসি’কে বললো,
— তোমার হাসবেন্ড কে আমার আমার সাথে দেখা করতে বলবে, এখন ক্লাসে যাও।

টুসি জ্বি মিস বলে বলে ক্লাসে চলে যায়। এদিকে সাবা টেবিলের উপর মাথা রাখে,আর কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়।এর কিছুক্ষণ পর সাবা’র সিনিয়র শিক্ষক মাহফুজ আনাম দরজায় নক করে বলে,
— ম্যাডাম আসতে পারি?

সাবা মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে মাহফুজ আনাম এসেছেন।তাই সাথে সাথে দাঁড়িয়ে বললো,
— জ্বি স্যার অবশ্যই।

মাহফুজ আনাম ভিতরে ঢুকলে,সাবা সম্মান করে বসতে বলে। মাহফুজ আনাম মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসে।সাবা প্রশ্ন করে বলে,
— জরুরি কোন প্রয়োজন স্যার?
— প্রয়োজন ছাড়া বুঝি আসতে নেই?
— না তা নয়, আসলে…

সাবা যতটা সম্ভব পর পুরুষে থেকে এরিয়ে চলে। কোন শিক্ষকদের সাথে,কাজ ব্যাতিত অন্য কোন আলোচনা করে না। এদিকে মাহফুজ আনাম পছন্দ করে সাবা’কে! কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না।যদি সাবা নিষেধ করে দেয়..
.
.
রাতের বেলা,
দু’জন স্বামী স্ত্রী দুই পাশ ফিরে শুয়ে আছে, মাঝে কোলবালিশের দেওয়াল বিদ্যমান। হঠাৎ টুসি বললো,
— শুনছেন?

সোহান শুনেও না শোনার ভান ধরে র‌ইলো, কোনরকম সাড়া শব্দ করলো না।টুসি করো কয়েকবার ডাক দিয়ে ব্যর্থ হলো। শেষ মেষ না পেরে নিজের ডান হাতটা সোহানের উন্মুক্ত কাঁধে রেখে ঝাকানি দিয়ে বললো,
— কথা ছিল আপনার সাথে? শুনুন না?

এবার সোহান পাশ পরিবর্তন করে শুলো।লাল রঙা ড্রিম লাইটের আলোয় পিচ্চি টুসি’র মুখ খানি বেশ আবেদন ময় লাগলো সোহানের কাছে, নিজের অবাধ্য বাম হাতটা টুসি’র গালে রেখে তারপর বললো,
— কি বলবে বলো?

আকস্মিক এমন কর্মকান্ডে শুকনো ঢুক গিলে টুসি। তারপর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো,
— মিস আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।

হাতটা সরিয়ে দেওয়ায় ব্যথিত হয় সোহান তাই আবারো পাশ পরিবর্তন করে বলে,
— নাম কি উনার?
— উম্মে মেহরিন সাবা।

সোহান আর কোন উত্তর দিল না, এদিকে টুসি তাকিয়ে আছে সোহান কিছু বলবে এই আশায়। কিন্তু অনেক সময় অতিবাহিত হ‌ওয়ার পরেও যখন সোহান কিছু বললো না তখন নিজেও ঘুমিয়ে পরলো।
.
.
আজকে মেহুল আর টুসি’কে পৌঁছে দিতে সোহান সাথে এসেছে। উদ্দেশ্য ওদের পৌঁছে দিয়ে ম্যাডামের সাথে দেখা করা। তারপর নিজের কাজে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছে সোহান। স্কুলের কেরানি কে ম্যাডামের নাম বলতেই তিনি অফিস রুম দেখিয়ে দিলেন। সোহান সেই মোতাবেক এগিয়ে গেল, তারপর দরজায় নক করে বললো,
— আসতে পারি?

সাবা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
— আসুন মি.সোহান রাজবি!

সোহান সাবা কে দেখে পিলে চমকে উঠলো, গতকাল যখন টুসি তার ম্যামের নাম উম্মে মেহরিন সাবা বললো তখন নামটা অতো আমলে নেয়নি সোহান।কারণ সোহান সাবার পুরো নাম জানতো না। শুধু ডাক নাম সাবা জানতো।
ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সোহান,সাবা বললো,
— বসেন। কি খাবেন বলেন চা নাকি কফি?

সোহান বসে বললো,
— ধন্যবাদ। আমি কিছু খাবো না, আমাকে এখানে ডেকে পাঠানোর কারণ বললে উপকৃত হবো।
— তা তো অবশ্যই বলবো, তার আগে বলুন কেমন আছেন?
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?
— আমার ভালো থাকা হারিয়েছে সেই কবেই তবুও আলহামদুলিল্লাহ।
তো বৈবাহিক জীবনে সুখী আপনি?
— হুম আলহামদুলিল্লাহ খুব সুখী।

সাবা কিছুটা রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
— মিথ্যা বলছেন আপনি! আপনি কখনই সুখী না। তারপর ও কেন ছেড়ে দিচ্ছেন না এই মেয়ে’কে?ডিবোর্স দিয়ে দিন!

সাবা’র এরকম চিৎকার শুনে,আয়া এবং কেরানি দরজার কাছে ভির করলো।তারা আসেপাশে ছিল বলে শুনতে পেয়ে দৌড়ে আসে, কি হয়েছে দেখার জন্য।যা দেখে নিজেকে শান্ত করে সাবা, তার পর দরজার দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমি কি আপনাদের ডেকেছি? তাহলে এখানে আসার কারণ কি? এখন আসতে পারেন আপনারা,আর যার যার কাজে মন দিন গিয়ে।

তারপর সবাই চলে যেতে,সাবা বললো,
— আমি আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলেছি,সে চায় না আপনার সাথে সংসার করতে।তাকে ডিবোর্স দিয়ে চলুন আমরা বিয়ে করি?

সোহান মনোযোগ দিয়ে সাবা’র সবগুলো কথা শুনলো। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
— এই বিষয়ে এক মাস পর কথা বলবো তোমার সাথে, আজকে উঠি।

তারপর সোহান চলে যায় নিজ কাজে।আর সাবা বিজয়ের হাসি হাসে আর ভাবে এই বার বুঝি সে তার প্রিয় মানুষটিকে নিজের করে পেতে চলেছে!…..

#চলবে….. ইনশা আল্লাহ।

ভুলোনা আমায় পর্ব-০৩

0

#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-০৩
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সোহান বাহিরে থেকে এসে দেখে বিছানার এক পাশে গুটিয়ে শুয়ে আছে টুসি।এখানে আসার পর থেকে রোকেয়া বেগম অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে সোহানের সাথে এক ঘরে থাকতে পাঠায় টুসি’কে। সেই থেকে এক ঘরে এক‌ই বিছানায় থাকে তারা। তবে তাদের মনের মিল এখনো হয়নি।কবে যে হবে,সে আল্লাহ তা’আলা ভালো জানেন।
.
.
আজকে দু’দিন হলো টুসি শহরে এসেছে,কিন্তু তার মন প্রাণ যেন গ্রামেই পরে আছে। আব্বু আম্মুর কথা মনে পরতেই চোখ দুটো পানিতে ঝাপসা হয়ে আসে। তবে সারাদিন সোহানের ফোন নিয়ে বসে থাকে সে। সেদিন ট্রেনে যখন সোহান কানিজ ফাতেমার কার্টুন দেখিয়েছিল, তখন সেই কার্টুন বেশ মনে ধরে টুসি’র। সেই থেকে সারাক্ষণ বসে বসে কার্টুন ই দেখে।

এদিকে রোকেয়া বেগম বিরক্ত বোধ করলেও মনের মধ্যেই পুষে রাখেন প্রকাশ করেন না। ভাইজান তার একমাত্র মেয়ে কে দুই হাত ভরে দিতে কৃপণতা করবেন না! সেটা খুব ভালো করেই জানেন রোকেয়া বেগম।তাই তো রাগ ক্ষোভ যা আছে সব গিলে খেতে হবে। তবে সোহান যদি জানতে পারে দেনা পাওনার কথা তাহলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটবে!তাই এ ব্যাপারে সোহান কিচ্ছুটি জানে না। রোকেয়া বেগম ভেবে রেখেছেন যখন টুসির বাবা কিছু দিবেন তখন ছেলেকে বুঝিয়ে বলবেন যে,স্বপন তালুকদার খুশি হয়ে মেয়ে’কে দিচ্ছেন।এতে তো আমাদের আপত্তি করার কিছু নেই।
.
.
সোহান টুসি’র পাশে বসে আলতো হাতে চুলের ফাঁক বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,
— টুসি ম্যাডাম? উঠোন, এই ভর সন্ধ্যে বেলায় কেউ ঘুমিয়ে থাকে?উঠো নাস্তা করবে।

টুসি নড়েচড়ে বললো,
— আর একটু ঘুমাতে দিন না?
— না আর একটুও না। এখন এতো ঘুমালে রাতের বেলা ঘুম আসবে না, তখন বুঝবে ঘুম না আসলে কতটা যন্ত্রনা হয়।

তারপর টুসি’র হাত ধরে টেনে তুলল সোহান। এদিকে সোহানের ছোট বোন মেহুল নাস্তা সাজিয়ে তার ভাই আর ভাবি’কে ডাকতে আসে। এসে দেখে সোহান ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছে।মেহুল কোমরে হাত রেখে বললো,
— ভাইয়া সেই কখন তোমাকে পাঠিয়েছি ভাবী কে নিয়ে আসার জন্য,আর তুমি কিনা কাজ নিয়ে বসেছো?ভাবী কোথায়?
— ও বাথরুমে ফ্রেশ হতে গিয়েছে। তুই যা আমরা আসছি।
— ঠিক আছে তাড়াতাড়ি আসো।

কিছুক্ষণ পর,টুসি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে হাত মুখ মুছে,ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজ প্রসাধনী ব্যবহার করে,খাটে বসে থাকে। সোহানের কাজের মাঝে কড়া পারফিউম এর সুবাস ঘ্রাণেন্দ্রিয় এসে ঠেকলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে টুসি বসে আছে, তখন জিজ্ঞাসা করলো,
— তুমি কি পারফিউম ব্যবহার করেছো?

টুসি মাথা উপর নিচ করে বোঝানো করেছে। তখন সোহান বললো,
— আর কখনো পারফিউম ব্যবহার করো না। কেননা পারফিউম ব্যবহার করে মেয়েদের বাহিরে বের হ‌ওয়া জায়েয নয়। কেননা এখানে তোমার মৃত্যু সমতুল্য দেবর আছে।

যেসব সাজসামগ্রী হালাল বস্তু দ্বারা তৈরি, যা দ্বারা আল্লাহর সৃষ্টি করা গঠনে কোনো বিকৃতি ঘটে না, তা ব্যবহার করা জায়েজ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সাজসজ্জা ইসলামি জীবনরীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলাম নির্দেশ দেয় যে, স্ত্রী যেন ঘরেও স্বামীর জন্য সর্বোত্তম সাজসজ্জা করে থাকে। স্বামীর উদ্দেশে সাজসজ্জা করা একটি ইবাদত। ‘আজীবনের সঙ্গী’ অথবা ‘সব সময় দেখছে’ বলে তার সামনে একেবারে অগোছালো থাকা ইসলামি শিক্ষাবিরোধী।[১]
পারফিউম তথা সুগন্ধি ব্যবহার করা আসলে সুন্নত। ইসলামে নারীদের জন্য পর্দার বিধান আর সুগন্ধি ব্যবহারের বিধান পরস্পরের পরিপূরক অর্থাৎ একই বিধান। অনেক বোন বাইরে বের হওয়ার সময় পর্দা করে বের হন বটে; কিন্তু সঙ্গে পারফিউম বা অন্য সুগন্ধি ব্যবহার করেন। নারীদের বাইরে বের হওয়ার সময় সুগন্ধি ব্যবহার করা নাজায়েজ। এতে পর্দা লঙ্ঘন হয়। শরয়ি পর্দা আদায় হয় না। হাদিস শরিফে ওইসব নারীর ওপর অভিসম্পাত করা হয়েছে, যারা সুগন্ধি মেখে বের হয়। পর্দার সঙ্গে হলেও নারীরা পারফিউম বা সেন্ট জাতীয় কোনো সুগন্ধি ব্যবহার করে বাইরে যেতে পারবে না। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক চক্ষুই ব্যভিচারী। আর কোনো নারী যদি (কোনো ধরনের) সুগন্ধি ব্যবহার করে কোনো (পুরুষের) মজলিসের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, তবে সে ব্যভিচারিণী।[২]
এমনকি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদত করার উদ্দেশ্যে মসজিদে যেতেও সুগন্ধি ব্যবহার করতে পারবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর বান্দীদেরকে মসজিদে আসতে বারণ করো না, তবে তারা যেন খোশবু ব্যবহার না করে সাধাসিধাভাবে আসে।[৩]

টুসি ঠিক বলে রুমের বাহিরে চলে গেল।আর সোহান রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে ডান হাত টা কপালের উপর লম্বা করে রেখে গভীর ভাবনায় মগ্ন হলো….
দেড় বছর আগে,
সাবা নামের মেয়েটি,সোহানের ব্যাবহার করা সুগন্ধির প্রশংসা করলে সোহান মেহুল কে দিয়ে একটা আতরের শিশী পাঠিয়ে দেয় এবং প‌ই প‌ই করে সাবধান করে দেয় সাবা যেন সুগন্ধি ব্যবহার করে বাহিরে বের না হয়। কেননা
কোনো নারী যদি (কোনো ধরনের) সুগন্ধি ব্যবহার করে কোনো (পুরুষের) মজলিসের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, তবে সে ব্যভিচারিণী।
সাবা আতর ব্যবহার করবে কি? সোহান দিয়েছে এতেই সে খুশীতে আত্মহারা। খুব যত্ন সহকারে তুলে রাখে আতরের শিশী খানা।যখন মনে হয় তখন বের করে ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে সুবাস অনুভব করে।
এর পর থেকে শুরু হয় তার পাগলামী, সোহান কে লুকিয়ে দেখা যেন তার নৃত্য দিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।মেহুলের কাছ থেকে জানতে পেরেছে সোহান তার ভাই।তালবাহানা করে দুতলায় যায় এক বিন্দু দেখার জন্য সোহান কে। সাথে নিজেকে সাজসজ্জায় রাঙিয়ে তোলে যেন সোহানের চোখে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে।
আসলে বয়স টাই এরকম উল্টো পাল্টা লজিক ঘুরে বেড়ায় মাথায়।হিতাহিত জ্ঞান থেকে না। ভালো মন্দ বুঝার মত জ্ঞান খুবই কম থাকে।

তো একদিন সাবা নিজেকে পরিপাটি করে দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কখন সোহান আসবে, তাকে দেখে স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকবে।যখন সোহান অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে, তখন সাবা সামনে এসে দাঁড়ায়। এমনি করে হঠাৎ সামনে আসায়, চোখ বড় করে তাকায় সোহান। তাকিয়ে দেখলো তার সামনে এক সুন্দরী নারী দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা কিছু চুল সামনে রেখে দিয়েছে তা ছাড়া আর কতো সাজসজ্জা! সোহান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে নেয়। তারপর পাশ কেটে চলে যেতে নিলে,সাবা আবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়!এতে করে সোহান খুব রেগে যায় এবং ধমকে উঠে বলে,
— এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার?একেই তো বে-পর্দায় এসে দাঁড়িয়েছো তার উপর এমন অসভ্যতা করেছো।ফারদার এরকম বে-পর্দা হয়ে আমার সামনে আসবে না বলে দিচ্ছি। না হয় আমি তোমার বাবার কাছে নালিশ দিতে বাধ্য হবো।

তারপর সাবা সরে দাঁড়ালে সোহান গটগট পায়ে প্রস্থান করে। এরপর থেকে সাবা নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করে, ঘরে বাইরে সব জায়গায় মাথা ঢেকে রাখে। সোহানের সামনে যায় না। তবে সোহান কে বড্ড ভালোবেসে ফেলে।যা ভোলার নয়, রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায় সোহানের কথা ভেবে ভেবে।

একদিন কলেজ থেকে ফিরার পথে, কালো মেঘে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি বর্ষাতে শুরু হয়।সাবা এতো বৃষ্টির মাঝেই ভিজে ভিজে বাড়ী ফিরছে। তখন পিছন থেকে কেউ ডেকে বলে,
— এই মেয়ে এভাবে কাক ভেজা হচ্ছো কেন?জ্বর ঠান্ডা ভালো মন্দ কিছু হয়ে যাবে তো‌।এই নাও..

নিজের ছাতাটা সাবাকে নিতে বলে সোহান, কিন্তু সাবা মাথা নাড়িয়ে বোঝায় ছাতা লাগবে না তার। সোহান জোর করলে,অকষ্মিক সাবা বলে বসে,
— ভালোবাসি! কেন বোঝেন না? নাকি বোঝাতে চাইছেন না?
— বিয়ের আগে এসব সম্পর্ক কে ইসলাম হারাম বলেছে এটা জানো না তুমি?এমন অনেকেই আছে যারা হয়তো পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পড়ে, রমজানে রোজা রাখে, দ্বীনের ব্যাপারেও খুব আগ্রহী। কিন্তু, একটা জায়গায় এসে আটকে গেছে— হারাম সম্পর্ক।
নবী-রাসুলের সময় থেকে এখন পর্যন্ত ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ বহির্ভূত তথাকথিত রিলেশনশিপ বা প্রেমের সম্পর্ক সম্পূর্ণ হারাম । একে অপরের সঙ্গে কামনা-বাসনা সহকারে কথাবার্তা, নির্জনে দেখা-সাক্ষাত, ডেটিং, চ্যাটিং, স্পর্শ, হাসাহাসি, দুষ্টামি সবই ইসলামে নিষিদ্ধ।
এসব রিলেশনশিপ মূলত শয়তানের ফাঁদ। এই ফাঁদে পড়ে নারী-পুরুষ উভয়ে জেনার দিকে ধাবিত হয়-যার পরিনতি খুবই ভয়াবহ।
নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি দৃষ্টি বিনিময়েও রয়েছে সুস্পষ্ট হুকুম। এ প্রসঙ্গে কুরআনে পাকে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করেছেন।
পুরুষদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন- ‘(হে রাসুল! আপনি) মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তাআলা সে ব্যাপারে খবর রাখেন।[৪]

— তাহলে চলুন বিয়ে করবো!
— পাগল নাকি?বলা নেই কওয়া নেই বিয়ে করে নিব? বিয়ে শুধু দুটো মানুষের বন্ধন নয়, দুটো পরিবারের বন্ধন। সেখানে নিজেরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নেয়া কোন বিবেচিত বিষয় নয়।
— পরিবার তো মেনে নিবে না, কিন্তু আমি যে আপনাকেই স্বামী হিসেবে চাই!
— আমি কথা বলবো আমার আম্মার সাথে!

সোহানের এমন সহজ কথায় খুশিতে কেঁদে দেয় সাবা….
_____________
রেফারেন্স:-
[১] আলমুফাসসাল ফি আহকামিল মারআ : ৩/৩৪৮
[২]আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসায়ি, ইবনে হিব্বান, ইবনে খুযাইমাহ, হাকেম, সহীহুল জামে, ৪৫৪০ নং।
[৩] আহমাদ, আবু দাউদ, সহিহ জামে ৭৪৫৭
[৪] সুরা নুর: আয়াত ৩০
_________________

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।

ভুলোনা আমায় পর্ব-০২

0

#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-০২
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

রাগ কে শংবরন করতে না পেরে এগিয়ে গেল সোহান।তার কথা হলো,
— এতো বড় মেয়ে হয়ে এভাবে লাফালাফি করবে কেন?মেয়ে’রা থাকবে পর্দার আড়ালে,যেন কোন পরপুরুষের নজর না পরে।অথচ এই মেয়ে এভাবে ওঠোনের মধ্যে এসে বাচ্চাদের মত করে বাচ্চাদের সাথে লাফালাফি করছে। যেখানে বাড়ির পাশে রাস্তা রয়েছে। মানুষজন যাচ্ছে আর চোখ তুলে তাকাচ্ছে। কতোটা দৃষ্টি কটু ছিঃ!

এদিকে টুসি চোখ বাঁধা অবস্থায় দৌড়ে দৌড়ে সঙ্গীদের ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই সফল হতে পারছে না।এক পর্যায়ে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঝাপটে ধরে বললো,
–ধরেছি ধরেছি,বলতে বলতে হঠাৎ সামনে থাকা ব্যক্তিকে অদ্ভুত ঠেকলো! তুলনা মূলক মোটা, লম্বা অনুভব হলো। তাই ছেড়ে দিয়ে,ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুল উত্তোলন করে স্পর্শ করে বোঝার চেষ্টা চালালো।যখন সন্দেহ জনক মনে হলো এক টানে চোখের বাঁধন খুলে ফেলল। দুই হাতে চোখ কচলে যখন সামনে তাকালো তখন শুকনো ঢুক গিলে খানিকটা পিছিয়ে গেল টুসি।

সোহান চোখ মুখে কাঠিন্য ভাব নিয়ে বললো,
— কি হচ্ছে এসব?বয়স কি দিন দিন বাড়ছে না কমছে? এভাবে বাচ্চাদের মত লাফালাফি কি তোমার সোভা পায়?আজ থেকে মনে রাখবে তুমি আর মিস ন‌ও, মিসেস। মিসেস তাসনুভা ইসলাম টুসি।যাও ঘরে যাও,,

টুসি এক পা ও নড়লো না।যা দেখে সোহান গর্জে উঠে বললো,
— কি বললাম শুনতে পাওনি?

এবার টুসি চোখ মুখ কুঁচকে আ্য আ্য করে কান্না শুরু করে! তারপর ফুফি বলে দৌড়ে যায় ঘরের দিকে..

আকস্মিক ঘটনায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সোহান। তারপর নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
— নাহ ওর সাথে রাগারাগী করলে চলবে না।যথা সম্ভব কোমল ব্যাবহার দিয়ে বোঝাতে হবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
তোমরা নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও, কারণ নারীকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, পাঁজরের মধ্যে উপরের হাড্ডি সবচেয়ে বেশি বাঁকা। যদি তা সোজা করতে চাও ভেঙ্গে ফেলবে, ছেড়ে দিলেও তার বক্রতা যাবে না। কাজেই নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও।[১]

ভাবতে ভাবতে সোহান বাথরুমে যায় ফ্রেশ হতে।
.
.
আজকে সকালে,
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রোজিনা বলেছেন,
— মা’রে বিবাহ (আরবি: نِكَاح‎, প্রতিবর্ণী. নিকাহ‎) হল বিবাহযোগ্য দুইজন নারী ও পুরুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক প্রনয়নের বৈধ আইনি চুক্তি ও তার স্বীকারোক্তি।[২]

এখন তুই তার স্ত্রী, তোর অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে,
— আর এই কর্তব্যের মূল হলো স্বামীর প্রতি তোর দায়িত্ব। তোর উপর তোর স্বামীর অধিকার অনেক বড়, যা আমাদের (পিতা-মাতার) অধিকারের চেয়েও বেশি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার অধিকারের (হকের) পরেই তার অধিকারের শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান। আর এই অধিকারের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে এসেছে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
• “পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।[৩]
উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “নারীদের যে কেউ মারা যাবে এমতাবস্থায় যে তার স্বামী তার উপর সন্তুষ্ট, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
যখন নারী তার পাঁচ ওয়াক্তের সালাত আদায় করবে; তার (রমযান) মাসের সাওম পালন করবে; তার লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে এবং তার স্বামীর আনুগত্য করবে, তখন তাকে বলা হবে: তুমি জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা কর, সে দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবশে কর।[৪]

মেয়েকে যতটা সম্ভব বুঝানোর বুঝিয়েছেন রোজিনা।টুসি’র মুখ দেখে বোঝার জো নেই সে কতটুকু কথা আমলে নিয়েছে। তবে মাকে কথা দিয়েছে সে কখনো বেয়াদবি করবে না তার স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে।
.
.
খাবার টেবিলে রোজিনা মেয়েকে ইশারা করে বোঝালেন সোহান এর প্লেটে আরো পিঠা তুলে দেওয়ার জন্য। তখন টুসি,ডাল পুরি পিঠার ঝুড়িটি নিয়ে কাছে গিয়ে পিঠা দিতে গেলে সোহান পাশের চেয়ারে ইঙ্গিত করে বললো,
— বসো এখানে।

টুসি বসতেই, সোহান নিজ হাতে পিঠা নিয়ে টুসি’র মুখের সামনে ধরল।যা দেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল টুসি।
সোহান তার বাম হাত দিয়ে টুসি’র চোখের কোণায় লেগে থাকা ময়লা মুছে দেয়। তারপর আবার পিঠার দিকে ইশারা করে বললো,
— হা করো?

টুসি আর দ্বিধা না করে, সোহানের হাতে খেয়ে নিল পিঠা।যা দেখে রোজিনা এবং রোকেয়া আনন্দের হাসি হাসেন।
টুসি’র দাদি মশকরা করে বলেন,
— আইজ্জা তিনি নাই বলে খাওয়াইয়া দেওনের কেউ নাই।হের লাইগা অন্যের ভালোবাসা ব‌ইয়া ব‌ইয়া দেহন লাগে।

তখন সোহান হাসি দিয়ে বললো,
— দাদা পরলোকগমন করেছেন তো কি হয়েছে? তুমি চাইলে দ্বিতীয় বিয়ে করতে রাজি আছি আমি। এবার বলো কবুল?

বৃদ্ধা আফসোসের স্বরে বললো,
— এমনে এমনে তো কমু না,টুসি’র শাড়ি গয়না গুলান ফইরা তয় কমু! তোমার ফত্তম ব‌উ রাজি কিনা জিগাউ?

টুসি বৃদ্ধার কথা শুনে রেগে মেগে অস্থির হয়ে বললো,
— বুড়ি তোমার শখ কতো? আমার শাড়ি গয়না জীবনেও কাউকে দিমু না আমি।এ আমি বলে রাখলাম।

তারপর গটগট পায়ে প্রস্থান করে এখান থেকে।যা দেখে সোহান হাত তুলে বৃদ্ধা’কে ইঙ্গিত করে হাত মিলিয়ে হাইফাই করার জন্য। চট করে হাত মিলিয়ে,খলবলিয়ে হাসি দেয় বৃদ্ধা, এতে করে তার বাম পাশের ফাঁকা মারি গুলো সহজেই নজরে পরে।যা দেখে আময়িক হাসে সোহান।
.
.
বিকাল বেলা যখন পরিবেশটা শুনশান নীরবতা পালন করছে। সূর্য মামা তার গতিতে পিছিয়ে চলছে পশ্চিমা সীমান্তে তখন সোহান তার মায়ের আহাল্লাদি বৌমা’মা কে আবদারের সুরে বললো,
— তোমার গ্রাম’টা ঘুরিয়ে দেখাবে আমায়?

টুসি রশি হাতে নিয়ে “ধরির লাফ” খেলতে যাচ্ছিল।তাই সোহানের কথায় খানিকটা বিরক্ত বোধ করলো। পরক্ষনেই মায়ের কথা গুলো মনে পরতেই বললো,
— চলুন..

বাড়ির পশ্চিম দিকে হাঁটা ধরলো। যেখানে নদী বয়ে গেছে। নদীর পাশে সোনালী ধানের জমি,মা শা আল্লাহ এবার খুব ধান হয়েছে জমিতে।যা দেখে “আলহামদুলিল্লাহ” বলে শুকরিয়া আদায় করলো সোহান।
টুসি বড় বড় পা ফেলে আনমনে হেঁটে চলেছে। মাঝে মাঝে ধানের শীষ গুলো নরম মখমলে হাত দিয়ে স্পর্শ করে চলেছে। সোহান মুগ্ধ নয়নে দেখছে তার সহধর্মিণী কে।কালো কামিজের সাথে লাল ওরনা, সেলোয়ার পরেছে টুসি।এতে করে পুতুলের মতো মিষ্টি লাগছে তাকে।
আসার পথে সোহান ওরনা দিয়ে টুসি’র সর্বাঙ্গ ঢেকে দিয়েছে। তাই তার মাথায় ঘোমটা বৃদ্ধমান। ঠিক লাল টুকটুকে বউ লাগছে টুসি’কে। লোকমুখে শোনা যায়, বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর সৌন্দর্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। যেমনটা সোহানের মনে হচ্ছে।তার মা বিয়ের পূর্বে টুসি’র ছবি দেখিয়েছিল, তখন এক পলক দেখলেও সোহানের মনে হচ্ছে এখন বেশী সুন্দরী লাগছে তার ব‌উ’কে। “মা শা আল্লাহ” বলতে ভুললো না সোহান।
.
.
দূরের যাত্রা বলে বিয়ের পর দু’দিন শ্বশুর বাড়ি কাটালো সোহান। এবার বাড়ি ফেরার পালা। নাছোড়বান্দা টুসি সেকি কান্না,সে কিছুতেই বাবার বাড়ি ছেড়ে যাবে না।বাবা’কে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— আমাকে খাওয়ানোর সামর্থ কি নেই তোমার আব্বু? তাহলে কেন এভাবে তারিয়ে দিতে চাইছো? আমি আমার এই মায়াময় গ্রাম ছেড়ে কিভাবে থাকবো আব্বু? কেন এই নিষ্ঠুরতা করছো আমার সাথে? খুব তো মাথায় করে রাখতে, তবে এখন কেন অন্যের হাতে তুলে দিতে চাইছো?

মেয়ের বাঁধ ভাঙা চিৎকারে নিজেকে আর শক্ত করে রাখতে পারলো না স্বপন তালুকদার। অবাধ্য হয়ে ঝরে পরলো চোখের নোনা জল। সোহানের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে বললেন,
— বাবা আমার একমাত্র মেয়েটা এখন তোমার দায়িত্ব, সামলে রেখো বাবা..

সোহান টুসি’র হাত শক্ত করে মুঠো বন্দি করে বললো,
— আমাদের জন্য দো’আ করবেন বাবা। আমি যেন ওর ছায়া সঙ্গিনী হতে পারি।একে অপরের পরিপূরক হতে পারি।
— আমার দো’আ সব সময় থাকবে তোমাদের জন্য।

অদূরে দাঁড়িয়ে রোজিনা মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদছে, এই প্রথম মেয়েকে ছেড়ে থাকতে হবে ভেবেই বুকটা শূন্যতায় হাহাকার করছে তার। বৃদ্ধা দাদিকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো টুসি, বৃদ্ধা ও চোখের পানি রোধ করতে পারছেন না। দুই ভাইয়ের চোখ রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে, ছেলে বলে হাউমাউ করে কাঁদতে পারছে না। কেননা ছেলেদের যে মেয়েলি কান্না সোভা পায় না।
সবশেষে নিষ্ঠুর নিয়মের কাছে নত হয়ে বাড়ি ছাড়তেই হলো টুসি’র। কিছুদূর এগিয়ে ব্রিজের কাছে এসে রেলিং ধরে চিৎকার করে উঠল সে।তখন সোহানের ভাই আরমান মস্করা করে বললো,
— ভাবি এখানে কি আপনার প্রেমিক পুরুষের সাথে দেখা হতো নাকি?

আরমানের এমন কথায় চোখ মুখে কাঠিন্য ভাব করে তাকায় সোহান।যার ফলে ভয়ে চুপসে যায় আরমান। দুই ভাইয়ের নিরবতার মাঝে টুসি বলে উঠল,
— এখানে বিকাল বেলা এসে সবাই মিলে দুষ্টুমি করতাম। আমি কিভাবে থাকবো শহরের চার দেওয়ালের ঘরে?

গ্রামের ছেলে মেয়েরা ও কাঁদছে টুসি’র জন্য। তাদের খেলার সঙ্গী যে চলে যাচ্ছে।
.
.
ট্রেনে ছুটে চলেছে তার গন্তব্যে,টুসি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। সোহান গলা জেরে বললো,
— কার্টুন দেখবে? খুব সুন্দর কিন্তু তোমার মন ভালো হয়ে যাবে নিমিষেই।

টুসি’র আগের মতই র‌ইলো। তখন কর্ণধারে পৌঁছালো,
“শুনো শুনো কানিজ ফাতেমার কথা, ভালো মেয়ে কানিজ ফাতেমার কথা”…..
___________
রেফারেন্স:-
[১]সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৩৩৩১
[২] হাদিস,দ্যা বুক অফ মেরিজ।
[৩] সূরা আন-নিসা: ৩৪
[৪] ইমাম আহমদ হাদিসখানা বর্ণনা করেন
_____________

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।

ভুলোনা আমায় পর্ব-০১

0

#ভুলোনা আমায়
#সূচনা পর্ব
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সোহান তার সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী টুসি’র কাছে যেতেই,হুরমুর করে দাঁড়িয়ে পরে টুসি!
ঘটনার আকস্মিকতায় বরকে যায় সোহান। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
— বসো তোমার সাথে পরিচিত হই, তুমি যখন অনেক ছোট তখন দেখেছিলাম তোমাকে। তাছাড়া দেখা সাক্ষাৎ হয়নি!

টুসি খাটের উপর দাঁড়িয়ে থেকেই চৌওড়া গলায় বললো,
— আপনার সাথে পরিচয় হ‌ওয়ার কোন ইচ্ছা নেই আমার। একটা মেয়ের ঘরে ঢুকতে লজ্জা করলো না আপনার? এক্ষুনি বেরিয়ে যান আমার ঘর থেকে!

নিজের বিয়ে করা স্ত্রীর মুখে এরকম বুলি শুনে খানিকটা হতবাক হয়ে তাকায় সোহান। তারপর হাসি দিয়ে টুসি’র হাত ধরে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে দেয়! কিন্তু নাছড়বান্দা টুসি চিৎকার করে উঠল! সাথে সমান তালে হাত পা ছুড়তে লাগল।এর ফলে সোহান’এর গায়ে আঘাত লাগছে কিছুটা। এদিকে টু’সির থামা থামির নাম নেই।সমান তালে তার কাজ করে যাচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে, চরিত্রহীন,লম্পট লোক!ছারুন আমাকে আমি বাহিরে যাবো।

সোহান ছেড়ে দেয় টুসি কে।
নিজেকে মুক্ত পেয়ে সোহান কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় টুসি!
রাগে গজগজ করতে করতে বিছানার চাদর খামচে ধরে সোহান। আজকে তার এই অপমানের জন্য দায়ী তার আম্মা রোকেয়া বেগম। সে কথা স্মরণ করতেই মাথার চুল টেনে ধরে সোহান।

এদিকে ষোল বছরের কিশোরী মেয়ে টুসি এলোমেলো পায়ে দৌড়ে যায় তার দাদির কাছে।রাত গভীর হয়েছে সারাদিন বিয়ের ঝামেলায় একটুখানি বিশ্রামের জন্য যার যার শয়নকক্ষে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে সবাই।
দু’চালা নতুন ঘর’টাতে সোহান আর টুসি’র বাসর ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে।সেখান থেকেই দৌড়ে বড় ঘরে আসে টুসি। দরজায় সমান তালে কড়াঘাত করে চলেছে টুসি।
টুসির দাদি বৃদ্ধা মহিলা এতো বড় রাত শান্তি মতো ঘুমাতে পারেন না,বয়স হয়েছে কিনা।তাই একটু ঘুমান তো একটু জেগে থাকেন। হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত শুনে কান খাড়া করে ওপাশের ব্যক্তির কন্ঠস্বর শুনতে। তখন শুনতে পান তার আদরের নাতনি বলছে,
— দাদি গো দরজা খুলো দাদি!আমারে তোমার কাছে লুকিয়ে রাখো দাদি।

নাতনির আহাজারি শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে গেল বৃদ্ধা! যতটা সম্ভব দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে দরজা খুলল বৃদ্ধা। দাদিকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে টুসি।
নিঃশব্দ এই রাতের অন্ধকারে এরকম চিৎকারে যে কারো ঘুম উড়ে যেতে যথেষ্ঠ। এরকম টাই হলো। বৃদ্ধা নাতনি কে নিয়ে বসার ঘরে প্রবেশ করলেন, ততক্ষণে বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা হাজির হয়ে গেল। রোকেয়া বেগম হাই তুলতে তুলতে যখন ঠিক করে দেখতে পেলেন টুসি চিৎকার করে কাঁদছে তখন তার দুশ্চিন্তার আর অন্ত র‌ইলো না!বুঝে গেছেন তার ছেলেকে ঘিরেই ঘটনা। কি করেছে তার ছেলে?টুসি’কে মেরেছে! নাকি জোর,জবরদস্তি করেছে? কিন্তু তার ছেলে তো এই ধরনের না। তাহলে কি এমন ঘটনা ঘটেছে যার ফলে টুসি চিৎকার করে কাঁদছে?

টুসি’র আম্মা রোজিনা ইসলাম মেয়ে কে কাছে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বললো,
— কি হয়েছে মা আমার? এভাবে কাদছিস কেন? আম্মাকে বল কি হয়েছে?

টুসি হেঁচকি দিতে দিতে বললো,
— আম্মা ঐ লোকটা.. এইটুকু বলে আবার কাঁদতে শুরু করলো টুসি।

রোজিনা মেয়েকে শান্তনা দিয়ে বললো,
— স্পষ্ট করে না বললে আমরা কিভাবে বুঝবো বল তো? আমাদের সবটা ক্লিয়ার করে বলবি তো?
— আম্মা ঐ লোকটা আমাকে বাজে ভাবে ছুঁয়েছে আ্য আ্য আ্য,,,

এইটুকু বলে আবারও কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে টুসি। তবে বাড়ির সবাই যা বোঝার বুঝে গেছে। কেন তাদের আদরের দুলালি নাকের জল চোখের জল একাকার করে চলেছে।স্বপন তালুকদার বজ্র কন্ঠে বললেন,
— মেয়েকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠালে না কেন?যেমন মা তেমনি হয়েছে মেয়ে!

এই বলে গটগট পায়ে হেঁটে ঘরের দিকে রওনা দিলেন তিনি।টুসি’র দুই ভাই তারা ও বললো,
— মেয়েকে আরো বেশি করে বিয়ে দাও! এখনো ওলগা পাতা পচে নাই আর মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছ!

তারপর তারাও বাপ কে ফলো করে নিজেদের ঘরে চলে গেল। রোজিনা চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। স্বামী আর ছেলেদের কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন তিনি জোর করে একাই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
রোজিনা শুধু সুনাম করে বলেছিলেন, তোমার মেয়ে রোকেয়া আপার কাছে আদরে থাকবে। তুমি এই বিয়েতে অমত করো না। এইটুকু কথাতেই সব দোষ তার হয়ে যাবে কে জানতো?

রোকেয়া বেগম এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সবটা শুনলেন। তারপর মন খারাপ করে ছেলের কাছে যেতে হাঁটা ধরলেন।
সোহান আগের ন্যায় বসে আছে শক্ত মুখ করে। তখন রোকেয়া বেগম এর উপস্থিতি টের পেয়ে বললো,
— আম্মা এবার নিশ্চয়ই খুশি হয়েছো? ছেলেকে বড় সড়ো অপমানের মুখোমুখি করতে পেরে নিশ্চ‌ই খুশি হয়েছো।

রোকেয়া বেগম দ্রুত পায়ে ছেলের কাছে এসে বললো,
— ছোট মেয়ে তো তাই একটু এমন করছে,দেখবি দু’দিন যেতেই ঠিক হ‌ইয়া যাইবো।
— তোমার একেকটা কথা বিষের মতো লাগছে আম্মা, তুমি প্লিজ এখান থেকে যাও।

রোকেয়া বেগম আরো কিছু বলতে যাবে তখন সোহান গটগট পায়ে বেড়িয়ে চলে যায় ঘর থেকে। রোকেয়া বেগম দরজার কাছে আসতেই দেখলেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে সোহান‌।
__________
একটা দীঘির পাড়ে বসে মাটির চাকা ছোড়ে ছোড়ে ফেলছে সোহান।রাগ গুলো যেন এভাবেই বিশর্জন দিচ্ছে সে। শুধু বার বার মনে পরছে আজকে আম্মার জন্য‌ই তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল।অন্যদের মতো তার ও তো সুন্দর একটা জোছনা বিলাসময়ী রাত হতে পারতো? কেন হলো না, কেন হতে দিল না তার আম্মা? শুধু মেয়েটির বাবা গরীব মানুষ বলে? কি লাভ হলো বড়লোক বাপের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে? লাভের লাভ তো কিছুই হলো না উল্টো সম্মানহানি হলো।

আজ থেকে প্রায় দেড় বছর আগের কথা,
সোহান দের নিচ তলায় ভাড়াটিয়া আসে।এক স্কুল শিক্ষক তার পরিবার নিয়ে আসে ভাড়াটে হয়ে।আর দু’তলায় থাকে সোহান এবং তার পরিবার। অল্প কিছুদিনেই বেশ সখ্যতা গড়ে উঠে রোকেয়া বেগম এর সাথে খালেদা বেগম এর। স্কুল শিক্ষক এর স্ত্রী হলো খালেদা বেগম।

খালেদা বেগম এর দুই মেয়ে এক ছেলে।বড় মেয়ে সাবা খুবই মিষ্টি একটা, দুষ্টু স্বভাবের মেয়ে। সোহান দের এখানে একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন স্কুল শিক্ষক মনিরুল হক। জরাজীর্ণ নিচ তলায় খুব কম খরচেই থাকতে পারছেন বলে শুকরিয়ার শেষ নেই মনিরুল হকের। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কতো বা বেতন পান, এতে করে পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।তাই দুই হাজার টাকায় বাড়ি ভাড়া পেয়ে সন্তুষ্ট তিনি।
এমনি করে দিন চলে যাচ্ছে তার পরিবারের। একদিন সাবা বারান্দায় বসে পাঠ্য বই পড়ছে, তো হঠাৎ এক মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে আসে তার
ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে।সাবা ব‌ই খানা চেয়ারে রেখে দৌড়ে যায় মেইন দরজার কাছে, চটপট দরজা খুলে বাহিরে উঁকি মেরে দেখল এক সুদর্শন যুবক সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে! গায়ে তার ক্রিম রঙা পাঞ্জাবি,মুখ ভর্তি চাপা দাড়ি।
দেখতে দেখতে ছেলেটা উপরে উঠে গেল। উঁকি মেরেও আর দেখতে পেল না সাবা। তখন পেছন থেকে বাবার কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে গেল সাবা।
মনিরুল হক বললেন,
— এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? শুক্রবার দিন নামায পড়েছিস?
— জজ্বি আব্বু পড়েছি। তুমি কখন এসেছ?
— মাত্র‌ই এলাম।যা গিয়ে পড়তে বস, আগামীকাল না ক্লাস টেষ্ট পরীক্ষা।
— জ্বি, এক্ষুনি যাচ্ছি।

সাবা কোন রকম দৌড়ে এসে বারান্দায় বসে পরে। তারপর ভয় কাটানোর জন্য বুকে থুতু দেয়!একা একা বকবক করে বলে,
— ভাগ্যিস আব্বু দেখতে পাইনি না হয় আমার যে কি হতো আল্লাহ মালুম। কিন্তু ঐ ছেলেটা কে?এক সপ্তাহ ধরে তো দেখলাম না।বাড়ি ওয়ালা আন্টির বাসায় তো কোন ছেলে দেখিনি এতো দিন।নাহ আমাকে দেখতে হবে কে এই কিউট পোলা?

খালেদা বেগম এসে বললেন,
— এই সাবা পড়া শুনতে পাই না কেন তোর?ব‌ই ল‌ইয়া ব‌ইসা থাইকা দেখাস যে আমি পড়ে সব উদ্ধার করে দিচ্ছি?
— আম্মু তুমি কোন জনমেই আমার পড়াশোনা দেখতে পাও না।
— হুম হ‌ইছে,এহন খাইতে আয়। তারপর আবার পড়তে বসবি।
— উফফ আম্মু দুপুরে খাবার খাওয়ার পর ঘুমাতে হয়, এটা তুমি জানো না? এইটা ব‌ইয়ে লেখা আছে দেখবা?
— হ‌ইছে হ‌ইছে রাইত পোয়াইলে পরীক্ষা, তারপরেও তোর ঘুম শেষ হয় না।
.
.
প্রতিদিনের মত আজকেও মনিরুল হক সাবা কে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে বলেছেন,
— ফজর নামাজ আদায় করে পড়তে বসবে।

সাবা নামায পড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। ভোরের এই স্নিগ্ধ আবহাওয়া বেশ ভালো লাগে সাবা’র।তাই রোজ এই সময় এখানে দাঁড়িয়ে বাহিরের ছোট বড় গাছ গুলো কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সে। সেই সময় হঠাৎ, সেই সুন্দর সুগন্ধি
ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করে সাবা। তৎক্ষণাৎ পিছনে ফিরে দেখল দুপুরের সেই ছেলেটি ঘরে ঢুকছে।সাবা দুপুরের মতোই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালো।

আকস্মিক সামনে কেউ দাঁড়ালে সোহান মিনিট খানেকের জন্য থমকে দাঁড়ায়! তারপর আবার দৃষ্টি নত করে হাঁটা ধরে।
সাবা পিছন থেকে বলে উঠলো,
— মিষ্টার সুগন্ধি? না না মিষ্টার সুবাস? আপনার পারফিউম এর সুবাদে তো সেই মনমাতানো!

সোহান এরকম অবান্তর কথায় দাঁড়ালো ঠিকই কিন্তু পিছন ফিরে তাকালো না…
_________

দূরের মসজিদ থেকে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে চারিদিকে।
সোহান তার ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে। তারপর উঠে দাঁড়ায় মসজিদের উদ্দেশ্যে…
নামায পড়ে এসে দু’চালা ঘরটায় ঘুমিয়ে থাকে সোহান।এক সময় বাচ্চাদের চেঁচামেচি কানে পৌঁছাতে ঘুম ছুটে যায়। আড়মোড়া ভেঙে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে।সামনেই বড় ওঠোনে বাচ্চারা খেলাধুলা করছে, আর এদের লিডার হচ্ছে টুসি ম্যাডাম!….

#চলবে?

উইল ইউ ম্যারি মি? পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0

#উইল ইউ ম্যারি মি?
পর্ব–১০ এবং শেষ পর্ব

বন্ধুদের জোরাজুরি আর তোপের মুখে পড়ে নওশাদের দেওয়া এংগেজমেন্ট রিং আপাত অবস্থায় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল প্রীতি। কিন্তু পরবর্তীতে নওশাদকে সকলের আড়ালে নিয়ে হাত-জোর করে ক্ষমা চেয়ে রিংটা সে ফিরিয়ে দেয়। নওশাদ হকচকিয়ে প্রশ্ন করল,” তোর কি হয়েছে প্রীতি? আমি কি কোনো ভুল করেছি?”
” তোর কোনো ভুল নেই। ভুলটা আমারই। এতোবছরেও তোকে সত্যি কথা কখনও বলা হয়নি।”
” কিসের সত্যি? এখন বল।”
” আমার জীবনে একটা অতীত আছে।”
নওশাদ হেসে ফেলে বলল,” এইটা কোনো ব্যাপারই না। মাত্র একটা অতীত? তোর যদি হাজার অতীতও থাকে তাও আই ডোন্ট কেয়ার। আমি জানতেও চাই না। আমি শুধু জানি, তোকে আমি ভালোবাসি৷ শুধু তোকে বিয়ে করার স্বপ্ন নিয়ে ফ্রান্সে গিয়েছিলাম। যাতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোর সামনে যোগ্য পাত্র হয়ে দাঁড়াতে পারি।”
প্রীতির কথাটা বলতে খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু না বলেও উপায় নেই। প্রীতি দুঃখী গলায় বলল,” আই এম স্যরি নওশাদ। তুই আমাকে ক্ষমা করে দে। কারণ আমি তোকে বিয়ে করতে পারবো না।”
নওশাদের চেহারা অন্ধকার হয়ে গেল। উতলা হয়ে জানতে চাইল,” আমি কি করেছি প্রীতি?”
” বললাম তো তোর কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার। শুধু তোকে না, আমি কাউকেই কোনোদিন বিয়ে করতে পারবো না। আমি সারাজীবন আমার বাবার সাথে থাকবো। আমি ছাড়া বাবার এই পৃথিবীতে কেউ নেই। যদি আমার বিয়ে হয়ে যায় তাহলে বাবা পুরোপুরি নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে।”
নওশাদ এই কথার পর আবারও হাসতে লাগল। প্রীতি করুণ চোখে চেয়ে রইল। তার চোখ ছলছল করছে নওশাদের প্রাণবন্ত হাসি দেখে। নওশাদ বলল,” এটা কোনো ব্যাপারই না প্রীতি। তুই স্টাবলিশড মেয়ে। এসব নিয়ে তুই কেন চিন্তা করছিস? শোন, আমি তোকে আমাদের ফিউচার প্ল্যান বলি। আমরা একটা বিশাল বাড়ি কিনবো। ওই বাড়ির দক্ষিণ সাইডে থাকবে তোর বাবা আর উত্তর সাইডে থাকবে আমার বাবা-মা। মাঝখানে আমি আর তুই। ভালো হবে না?”
প্রীতি অধৈর্য্যের মতো চিৎকার করে বলল,” আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি নওশাদ। তোর সাথে বিয়ে হলে আমি কোনোদিনও তোকে ভালোবাসতে পারবো না।”
নওশাদের হাতে জুসের গ্লাস ছিল। কথাটা শোনার পর জুসের গ্লাস হাত ফসকে পড়ে ভেঙে গেল। দু’জনেই বিব্রত। নওশাদ হাসি দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করল। এই শুনে সে একদমই বিচলিত নয় এমন একটা ভাব করে বলল,” অন্যকাউকে ভালোবাসিস এটা কোনো প্রবলেম না। কিন্তু আমি কি জানতে পারি সে কে?”
প্রীতি আশরাফকে নিয়ে তার জীবনের সমস্ত ঘটনা সাজিয়ে-গুছিয়ে বলে দিল। নওশাদ বলল,” তাহলে তো ওই ছেলের সাথে তোর বিয়ে হওয়ার কোনো স্কোপ নেই। তুই কি সারাজীবন বিয়ে না করেই থাকবি? সবাইকেই সংসারী হতে হয়। একা একা কেউ জীবন কাটাতে পারে না। তোকেও একদিন সবকিছু মেনে নিয়ে নিজের জীবনে কাউকে বেছে নিতেই হবে। এখন আমার কথা হলো তোর যদি অন্যকাউকেই বেছে নিতে হয় তাহলে সেই অন্যকেউটা আমি কেন হতে পারবো না?”
” কারণ তুই খুব ভালো ছেলে নওশাদ। আমি চাই না তোকে কষ্ট দিতে৷ আমি চাই তুই সারাজীবন খুব ভালো থাকবি। আমার চেয়েও হাজার গুণ ভালো মেয়ে বিয়ে করবি। যে তোকে সবসময় ভালো রাখবে। কিন্তু আমাকে বিয়ে করলে তুই সুখী হতে পারবি না। কারণ আমার মনে অন্য একজনের বসবাস। তুই কি চাস তোর স্ত্রী সারাজীবন তোর সঙ্গে থাকুক কিন্তু ভালোবাসুক অন্যকাউকে?”
” প্রীতি তুই যদি আমাকে বিয়ে করিস সেটাই আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। আমার আর কিছু লাগবে না। ভালোবাসা তো মনের ব্যাপার। সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অন্তত আমি তোর জীবনের ভালোবাসা না হই, ভালোলাগা হয়ে থাকলাম। একদিন তুই আমাকেও ভালোবেসে ফেলবি। যদি ভাগ্য সহায় হয়। কিন্তু প্লিজ, আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবিস না। আমি তোকে ছাড়া পারবো না থাকতে।”
” তাহলে পাঁচবছর ফ্রান্সে কি করে থেকেছিস?”
” তোকে বিয়ে করার স্বপ্ন নিয়ে।”
প্রীতি এই কথার পিঠে আর কিছু বলতে পারল না। সেদিন পার্টি থেকে চলে আসার পর বাবার সাথে পুরো বিষয়টা আলোচনা করে প্রীতি। প্রমথ সাহেবও অনুমতি দেন৷ তাঁর একমাত্র মেয়ে এতোদিন পর বিয়ে নিয়ে চিন্তা করছে এই কথা ভেবেই খুশিতে মন ভরে ওঠে। কিন্তু প্রীতির মনে তখনও দ্বিধা। সে নওশাদকে সারাজীবন ঠকিয়ে যেতে চায় না। নওশাদ ক্রমাগত প্রীতিকে বিরক্ত করতে থাকে। প্রীতি যদি তাকে বিয়ে না করে তাহলে নাকি সেও আর কোনোদিন বিয়ে করবে না। কারণ নওশাদ আর কখনোই প্রীতির মতো করে কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। অবশেষে বিয়েতে রাজি হয়েছিল প্রীতি। রাজি হওয়ার মুখ্য কারণ ছিল, ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার দুঃখ সে বোঝে। আশরাফকে সে কোনোদিনও পাবে না। কিন্তু নওশাদের তো প্রীতিকে পাওয়ার সুযোগ আছে। তাই প্রীতি নিজের ভালোবাসা মনে দাবিয়ে নওশাদের ভালোবাসার ফুল সেজেছিল। তাদের বিয়ে ঠিক হলো।

সেদিন ভরা সন্ধ্যা। পার্লার থেকে সেজে-গুজে কমিউনিটি সেন্টারে যাচ্ছে প্রীতি। তার সাথে মাইক্রোতে আরও অনেক মানুষ। প্রমথ সাহেব ক্রমাগত ফোন করছেন। সাথে নওশাদও। প্রীতির কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মাঝ রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকে দিয়েছে। সিগন্যাল পড়েছে বিরাট বড়। ইতোমধ্যে প্রীতির সাথে থাকা বন্ধুরা গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে। আবদ্ধ গাড়িতে বসে বসে সকলে অস্থির। প্রীতি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ছিল৷ হঠাৎ লক্ষ্য করল একটা ছেঁড়া নীল পাঞ্জাবী পরা লোককে ঘিরে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে। মানুষ সেই কথা শুনছে অবাক হয়ে। প্রীতি গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল,” ওইখানে কি হচ্ছে ভাইয়া?”
ড্রাইভার খুব আগ্রহী হয়ে হাসতে হাসতে বললেন,” ভিক্ষুক এসেছে। বিদেশী ভিক্ষুক। বিদেশীদের মতো ইংরেজি বলছে। অবাক কান্ড না?”
প্রীতির ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। ভিক্ষুকের চেহারা দেখার জন্য সামনে এগিয়ে গেল। ড্রাইভার পেছন থেকে ডাক দিলেন,” কই যান আপা? যাইয়েন না। একটু পরেই সিগন্যাল ছাড়বো।”
প্রীতি শুনল না। সে অপ্রকৃতস্থের মতো এগিয়ে গেল। আশরাফকে এতোদিন পর সরাসরি দেখে তার বুকে দামামা বাজতে শুরু করল। রাস্তায় প্রায় জমাট বেঁধে খুব উৎসাহ নিয়ে দেখছে ইংরেজি বলা পাগলকে। প্রীতি টলমল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। কতদিন পর? ঠিক কতদিন পর তাদের এই দেখা? হিসাব মেলাতে কষ্ট হলো না। পাঁচবছর, নয়মাস, আঠারো দিন। আশরাফ তো একদম বদলায়নি এতো বছরেও। শাড়ি-গয়না পরিহিত বিয়ের কন্যাকে দেখে অনেকেই সরে যেতে লাগল। সবাই প্রীতির আগমন দেখে হয়তো ভেবেছে প্রীতি আশরাফের কেউ হয়৷ প্রীতি ধীরে ধীরে আশরাফের একদম সামনে এসে দাঁড়ালো।আশরাফ প্রীতির দিকে একবার ভ্রু কুচকে তাকাল। ভালো মতো উপর-নিচ পর্যবেক্ষণ করল তাকে। তারপর মুখে সারল্যের হাসি ফুটিয়ে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বলে উঠল,” হেই প্রিটি ব্রাইড, উইল ইউ ম্যারি মি?”
প্রীতির চোখ উপচে পানি পড়তে লাগল এবার। ঠোঁটে কামড় দিয়ে কান্না সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে চালাতে আশরাফের দুই কাঁধে হাত রাখল। আশরাফ তখনও আসছে। অস্বাভবিকভাবে ঘাড় নাড়ছে। তার আচরণ সাধারণ মানুষের মতো না। এখন সে বদ্ধ উন্মাদ। প্রীতি আশরাফের ডান বাহু ধরে বলল,” চলো যাই।”
আশরাফ হাসি মুখে প্রীতির সাথে পা বাড়ালো। যেতে যেতে প্রশ্ন করল,” কে তুমি? হু আর ইউ?”
প্রীতি বিষণ্ণ দৃষ্টিতে নিচে তাকিয়ে হাঁটছিল। আশরাফ তাকে চিনতে পারছে না! সে কি সব ভুলে গেছে? ফ্লোরাকেও ভুলে গেছে। ইশ, প্রীতিও যদি সব ভুলে যেতে পারতো। ভুলে থাকা মানেই তো ভালো থাকা। এইতো, যেমন আশরাফ ভালো আছে। কারণ সে ভুলতে পেরেছে। প্রীতি ভালো নেই কারণ সে ভুলতে পারেনি। আশরাফের হাত ধরে হাঁটার সময় হঠাৎ প্রীতির ফোন বেজে উঠল। মনে পড়ে গেল পিছুটানের কথা। আজ তার বিয়ে ছিল! সে সবকিছু ফেলে কোথায় যাওয়ার আয়োজন করছে? প্রীতি মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল নওশাদের কল। প্রীতি কলটা কেটে দিল। নওশাদ এবার ম্যাসেজ করল,” হারি আপ প্রীতি, তোমাদের আর কতক্ষণ লাগবে? প্লিজ পিক আপ দ্যা কল।”
প্রীতি নিজের ফোন সুইচড অফ করে দিল। আজ সে কারো কথা ভাববে না। শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববে। আশরাফের সঙ্গে হাঁটবে। এই হাঁটার উদ্দেশ্য নেই, গন্তব্য নেই, শুধু একরাশ আকাঙ্ক্ষা আছে। প্রীতি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বলে উঠল,” এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো…”
আশরাফ ফিকফিক করে হাসছে। ওই সরলময় হাসি দেখে প্রীতি সারাজীবন হেঁটে যেতে পারবে। তার কোনোদিনও ক্লান্তি আসবে না।

সমাপ্ত।

উইল ইউ ম্যারি মি? পর্ব-০৯

0

#উইল ইউ ম্যারি মি?
পর্ব–৯
®Fareen Ahmed

রাতে প্রমথ সাহেব মেয়েদের জন্য বিরিয়ানী রান্না করেছিলেন। জেরিন আর প্রীতি দু’জনই বিরিয়ানী খুব পছন্দ করে। খাওয়া-দাওয়ার পর অনেক গল্প-গুজব হলো। তারপর প্রীতির সাথে জেরিন একইরুমে ঘুমাতে এলো। প্রীতি মোবাইল রেখে ওয়াশরুমে গেছে। জেরিন বিছানায় একা শুয়ে আছে। এমন সময় প্রীতির মোবাইলে একটা ম্যাসেজ এলো। জেরিন প্রীতিকে ডাকতে নিয়েও থেমে গেল। তার চোখ ফোনের স্ক্রিনে আটকে গেল। ম্যাসেজটা এসেছে একটা ছেলের নাম্বার থেকে। ছেলেটির নাম নওশাদ। ম্যাসেজে লেখা,” ম্যাডাম কি ঘুমিয়ে গেছেন?”
জেরিন ম্যাসেজটা দেখে চুপচাপ শুয়ে রইল। একটু পর প্রীতি ওয়াশরুম থেকে বের হলো। ফোন হাতে নিতেই দেখল নওশাদের ম্যাসেজ। একটু বিরক্ত লাগল। ছেলেটার কাজ হলো রাত হলেই ম্যাসেজ দেওয়া। প্রীতি খেয়েছে কি খায়নি, ঘুমিয়েছে কি ঘুমায়নি এইসব জেনে ওর কি কাজ? নেহায়েত প্রীতির জীবনে খুব বড় একটা সাহায্য করেছিল নওশাদ। তাই প্রীতি কখনও তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারেনি। নয়তো একটা ছেলের থেকে এমন আচরণ প্রীতি কখনোই সহ্য করতো না। জেরিন হঠাৎ বলল,” বয়ফ্রেন্ড নাকি?”
প্রীতি চমকে উঠল,” মানে?”
” কে ম্যাসেজ দিয়েছে তোকে?”
” নওশাদ, আমার ক্লাসমেট।”
” শুধু ক্লাসমেট?”
” না ফ্রেন্ড।”
” শুধু ফ্রেন্ড?”
” উফ, তুই কি শুনতে চাইছিস?”
” আর যাই হোক, বেস্টফ্রেন্ড হলেও রাতের বেলা এইভাবে ম্যাসেজ করার কথা না।”
” এজন্যই তো আমার বিরক্ত লাগে। ছয়মাস ধরে ছেলেটা পেছনে লেগে আছে। গলার কাটার মতো। গিলতেও পারছি না ফেলতেও পারছি না।”
” ফেলতে পারছিস না কেন? ব্লক করে দিলেই তো হয়।”
” আমাদের ভার্সিটির ছেলে। ব্লক মেরে লাভ কি? প্রতিদিন তো দেখা হবেই।”
” দেখা হলেও কি? ইগনোর করবি! তুই কি ভয় পাস নাকি?”
প্রীতি মাথা নিচু করে বলল,” ভয় না। আসলে ওর কাছে আমি একভাবে ঋণী। তাই ও যতকিছুই করুক আমি ওর সাথে রুড হতে পারবো না।”
” তাই? কিভাবে?”
প্রীতি ভার্সিটি এডমিশনের গল্পটা জেরিনকে সম্পূর্ণ বলল। জেরিন শুনে অবাক।
” তোর তো চমৎকার ভাগ্য। তোকে একটা সাজেশন দেই। এই ছেলের সাথে প্রেম কর। ভালো থাকবি।”
” ধ্যাত! সেইম এইজ রিলেশন আমার পছন্দ না।”
” কেন পছন্দ না? তোর তো ফ্যামিলিতে কোনো প্রবলেম নেই। মামাও কত ভালো মানুষ। তোকে কখনও কোনো ব্যাপারে ফোর্স করে না। তুই যার সাথে বলবি তার সাথেই তোকে বিয়ে দিবে। আর তুই গ্র্যাজুয়েশনের পরেই বিয়ে করবি। তোদের লেখাপড়াও একসাথে শেষ হবে। একসাথে চাকরি করবি। তারপর নিজেদের টাকায় বিয়ে! আমাদের দেশে তো এসবই হয়। কত কিউট রিলেশনশীপ! ”
প্রীতি মলিন হেসে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানে গুজল। জেরিন কত সহজভাবে সব চিন্তা করছে। কিন্তু প্রীতির জীবনটা কি আসলেই এতো সহজ?
জেরিন প্রীতির কাঁধে হাত রেখে বলল,” আচ্ছা বলতো, তুই নিউইয়র্ক যেতে চাইছিস না কেন? মায়ের জন্য তাই না? চিন্তা করিস না। এইবার নিউইয়র্কে গেলে তোকে আমাদের বাড়িতে উঠতে হবে না। আমি এখন নতুন একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি।আমার ভার্সিটি থেকে বাসা খুব দূর হয়ে যায় সেজন্যই আলাদা ফ্ল্যাট। ওইখানে অবশ্য আমি একা থাকি না। আমার সাথে আতিফও থাকে। তুই গেলে আতিফ কয়েকদিন থাকবে না। আমরা ফাঁকা বাড়িতে অনেক মজা করবো।”
প্রীতি কাঁধ থেকে জেরিনের হাত সরিয়ে হতাশ কণ্ঠে বলল,” নারে, আমি আর কখনোই নিউইয়র্ক যাবো না।”
” কেন?”
” এমনি।”
” একটা মানুষ অসুস্থ। তোকে দেখার জন্য ছটফট করছে। তাও তুই যাবি না? এটলিস্ট তোর উচিৎ আশরাফ ভাইয়ের কনসোলেশনের জন্য হলেও সেখানে যাওয়া। তিনি ভাবছেন তুই গেলেই তার কাল্পনিক চরিত্র ফ্লোরার সমস্যাটা ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া অসুস্থ মানুষ হিসেবে একবার অন্তত তাকে দেখতে যাওয়া উচিৎ। ”
প্রীতি হঠাৎ ক্ষেপে উঠল,” এতো উচিৎ-অনুচিৎ আমি বুঝি না জেরিন। যাবো না মানে যাবো না। তুই কি আমাকে জোর করে নিয়ে যেতে পারবি?”
” এখানে জোর করার কথা আসছে কেন? তোকে শুধু আমি বোঝাচ্ছি।”
” আমাকে বোঝানোর কোনো প্রয়োজন নেই।”
জেরিন অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” তুই তো এমন নিষ্ঠুর ছিলি না প্রীতি। হঠাৎ তোর কি হয়ে গেল?”
প্রীতি জবাব দিল না। অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে রইল অন্যদিকে। জেরিন আধঘণ্টার মতো বকবক করে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু প্রীতির চোখে ঘুম এলো না। নিউইয়র্ক থেকে আসার পর সে ইনসোমিয়ায় ভুগছে প্রায় ছয়মাস যাবৎ। রাত আসে কিন্তু চোখে ঘুম আসে না। চোখের নিচে দাগ পড়ে চেহারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নওশাদ প্রায়ই বলে,” তোমার কিসের এতো টেনশন প্রীতি? প্লিজ শেয়ার উইদ মি!”
প্রীতির অন্য বন্ধুরাও বলে। কিন্তু প্রীতি নিজের মনের কথা কাউকে জানাতে পারে না। এই অনুভূতি একান্ত তার নিজের। এই কান্না তার ব্যক্তিগত। এই দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা সবকিছুর সাক্ষী তার রুমের দেয়াল, বালিশ আর বিছানা। বারান্দার ওই জানালা, নীল আকাশ, একগুচ্ছ নীরবতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রীতি। যে প্রতিদিন ফজরের আযান শুনে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। কিছু মুহূর্তের জন্য তার হৃদয় শীতল হয়। দিনটা ভালোই কাটে। কিন্তু রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে কষ্টেরা পুনরায় এসে আঁকড়ে ধরে চারদিক থেকে। প্রীতি শুনতে পায় সেই আহাজারি,” প্রিটি, ফ্লোরার দুঃখগুলো মুছে দাও প্লিজ!” প্রীতি শব্দ করে কেঁদে ফেলে। আশরাফের সামনে সে কোনোদিনও যেতে পারবে না আর। যাকে মন-প্রাণ একাকার করে ভালোবাসে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর স্পর্ধাই নেই প্রীতির। কারণ প্রীতি জানে, একবার যদি আশরাফের সামনে গিয়ে সে দাঁড়ায় তাহলে আর কোনোদিনও মানুষটিকে ছেড়ে আসা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। আবার আশরাফকে মেনে নিয়ে সারাজীবন তার সঙ্গে কাটিয়ে দেওয়াও সম্ভব নয়। যার হৃদয় জুড়ে অন্য এক নারীর রাজত্ব, যে প্রতিনিয়ত কষ্টের সমুদ্রে গোসল করে, প্রেমানলে জ্বলে-পুড়ে খাঁক হয়, তার সীমাহীন কষ্ট প্রীতি কিভাবে সহ্য করবে? সারাজীবন ভালোবাসার মানুষের কষ্ট দেখার চেয়ে নিজে বিষাদ-বেদনায় কাতরানো অনেক ভালো। প্রীতি কাতরাবে, কাঁদবে, অস্থির হবে কিন্তু কখনোই আশরাফের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। তার হাত ধরে সারাজীবন পাশে থাকার শপথ করতে পারবে না কখনোই! উফ, নিয়তির এমন নিষ্ঠুর চক্রান্তে আক্রান্ত মানুষগুলোর হৃদয়েই কেন এতো ভালোবাসা জন্মে?

জেরিন এক সপ্তাহ বাংলাদেশে অবস্থান করে। তারপর নিউইয়র্কে ফিরে যায়। প্রীতি লেখাপড়ায় মনোযোগী হয়। সময় কেটে যেতে থাকে। দিন,মাস, বছর পেরিয়ে যায়। নওশাদের সাথে প্রীতির দূরত্ব তৈরী হয়। চোখের আড়াল তো মনের আড়াল বলে একটা ব্যাপার আছে। কথাটাকে একশোভাগ সত্য করতেই বোধহয় নওশাদ ফ্রান্সে গিয়ে আর কোনো খোঁজ-খবর নেয়নি প্রীতির। প্রীতিও নিজে থেকে যোগাযোগ করেনি। একসময় শিক্ষাজীবন শেষ হয়। প্রীতি কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে উঠে। ভালো একটা জায়গায় চাকরি হয়ে যায়। বাবাকে নিয়ে বড় ফ্ল্যাটে থাকার স্বপ্ন এবার পূরণ হবে। বাপ-মেয়ে টাকা জমিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরতেও যাবে। পৃথিবীটা হবে স্বপ্নময়। তবুও মাঝে মাঝে ঘুমের সময় দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দেবে পাঁচবছর আগের সেই অমোঘ বাস্তবতা। অতীতের সেই তুমুল আর্তনাদ,”প্রিটি, ফ্লোরা খুব কাঁদছে। তুমি কি আসবে না প্রিটি?”

একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। কোনো রিকশা, বাস, ট্যাক্সি পাওয়া যাচ্ছে না। ঝড়ের রাতে বিপদ বুঝে সবাই দ্বিগুণ দাম চাইছে। প্রীতিও নাছোড়বান্দা। এতো ভাড়া দিয়ে সে কিছুতেই যাবে না। প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে থাকবে। যারা জীবনে কষ্ট করে পয়সা কামায় তারাই বোঝে জীবনে চলার পথে দুই পয়সারও কত মূল্য। হঠাৎ একটা প্রাইভেট কার এসে প্রীতি সামনে থামে। প্রীতি ভয়ে শিটিয়ে যায়। কার গাড়ি এটা? কালো গ্লাস নামিয়ে মাথা বের করে ভদ্রলোক বলে উঠল,” হাই প্রীতি, কেমন আছো?”
প্রীতি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। তারপর তার মুখ থেকে অস্ফুট আওয়াজ বের হয়,” নওশাদ!”
বহুদিন পর পুরনো বন্ধুকে কাছে পেয়ে রাজ্যের গল্প শুরু হয়। শুরু হয় স্মৃতিচারণ। কত মজার দিন ছিল। সবাই যে এখন কোথায় কোথায় হারিয়ে গেছে! কেউ বিদেশে আছে, কেউ শহরের বাহিরে, কেউ বিয়ে করে সংসারী হয়েছে৷ নওশাদ আনন্দের সাথে প্রীতিকে জানায়, সে দেশে ফিরেছে পাঁচদিন হয়। এখন থেকে এখানেই থাকবে বাবা-মায়ের সাথে। সতেরো তারিখ তার বাড়িতে একটা গেট টুগেদার আয়োজিত হবে। তাদের ব্যাচের অনেক বন্ধুরা আসবে। নওশাদ প্রীতিকেও আমন্ত্রণ করেছে। এমন নয় যে প্রীতির সাথে তার ঘটনাচক্রে দেখা হয়েছে বলেই প্রীতি ইনভাইটেশন পেয়েছে। নওশাদ দেখা না হলেও প্রীতিকে খুঁজে বের করতো। কারণ প্রীতির সাথে তার খুব জরুরী কথা আছে। কি এমন জরুরী কথা তা প্রীতি জানে না। নওশাদ বলেনি। সতেরো তারিখ এলেই নাকি বলবে।

সতেরো তারিখ ছিল শুক্রবার। সবার জন্য ছুটির দিন। নওশাদের অনুষ্ঠান সন্ধ্যায়। সকাল থেকেই প্রীতিকে ফোন করে জ্বালিয়ে মারছিল নওশাদ। কখন আসবে প্রীতি! একবার তো প্রীতির মনে সন্দেহ চাড়া দিল, নওশাদ কি এখনও আগের মতো আছে? প্রীতিকে নিয়ে কি সে এখনও ভাবে? পরক্ষণেই সন্দেহটা জোর করে মন থেকে তাড়িয়ে দেয় প্রীতি। নওশাদের ওইটা ছিল ছোটবেলার আবেগ। এখন তো তারা বড় হয়েছে। এখন নিশ্চয়ই নওশাদ আগের মতো পাগলামী করবে না। সময়ের সাথে অনেক কিছুই বদলায়। কেবল ভালোবাসা বদলায় না। হৃদকুঠুরিতে সারাজীবন অমলিন হয়ে থাকে দৃঢ় যত্নে।

পার্টিতে অনেক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়। প্রীতি সবার সাথে গল্পে মজে যায়। নওশাদের বাবা-মায়ের সাথে পরিচয় হয়। সবাই প্রীতিকে এমনভাবে ট্রিট করছে যেন প্রীতিই এই অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি! শুরুতে এসবের কারণ বুঝতে না পারলেও অনুষ্ঠানে শেষে গিয়ে প্রীতি সব বুঝতে পারল। নওশাদ তার পাগলামীর চূড়ান্ত দেখিয়ে ছাড়ল। প্রীতিকে সকলের সামনে গোল্ড রিং দিয়ে প্রপোজ করল। হাঁটু গেঁড়ে প্রীতির সামনে বসে নওশাদ ভালোবাসাময় কণ্ঠে বলল,” প্রীতি, উইল ইউ ম্যারি মি?”

চলবে

উইল ইউ ম্যারি মি? পর্ব-০৭+০৮

0

#উইল ইউ ম্যারি মি?
পর্ব–৭ ও ৮
® Fareen Ahmed

প্রীতি কথাটা শুনার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইল। ধাক্কাটা সামলে নেওয়ার চেষ্টা। তারপর অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,” আপনি কি সত্যি বলছেন আন্টি? এটা কিভাবে সম্ভব? আশরাফ তো একবারও আমাকে এই ব্যাপারে কিছু বলেনি।”
আরোহী মৃদু হাসলেন। না সূচ মাথা নেড়ে বললেন,” বলবে না তো। কারণ এই কথা সে নিজেও জানে না।”
” মানে?”
” মানে আশরাফ এখনও জানে না যে ফ্লোরা সুইসাইড করেছিল৷ এই ব্যাপারটা ওকে এখনও বিশ্বাস করানো যায়নি। তাই কল্পনায় ফ্লোরার সাথে ও কথা বলে, ফ্লোরাকে নিয়ে ভাবে। ও মনে করে ফ্লোরা এখনও আমাদের সাথেই আছে।”
” তাহলে আপনারা ওকে এটা বোঝাচ্ছেন না কেন? ফ্লোরা যে মারা গেছে এটা ওকে বলে দিলেই হয়।”
” বলা সম্ভব না। স্পেশালিস্টের মতে, আশরাফ যতদিন জানবে ফ্লোরা জীবিত ততদিনই সে ভালো থাকবে। কিন্তু একবার যদি তার মস্তিষ্ক এটা বুঝতে পেরে যায় যে ফ্লোরা মারা গেছে! সে আর কখনও ফিরে আসবে না! তাহলে এটা সহ্য করতে না পেরে আশরাফ ব্রেইন স্ট্রোক করে ফেলবে। তার মস্তিষ্ক থেকে অনিয়ন্ত্রিত রক্তক্ষরণ শুরু হবে। এমনও হতে পারে যে সে সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেল।”
প্রীতি মুখে হাত দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। এ কেমন ভয়ংকর ভালোবাসা? আরোহী প্রীতির কাঁধে হাত রেখে বললেন,” জানি আশরাফের মুখে ফ্লোরার নাম তুমি সহ্য করতে পারছো না। কিন্তু বিশ্বাস করো, আশরাফ ইচ্ছে করে তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এসব করছে না। এটাই তার রোগ।”
” এই রোগের কি কোনো চিকিৎসা নেই আন্টি?”
” আছে তো। চিকিৎসা চলছে। কিন্তু দুইবছরেও কোনো উন্নতি দেখলাম না।”
” আন্টি, ফ্লোরা কেন সুইসাইড করেছিল?”
” আশরাফ তোমাকে ফ্লোরার বাবা-মায়ের সমস্যার কথা বলেনি?”
” হ্যাঁ বলেছে। অনেকবারই বলেছে।”
” ওই প্রবলেমটা নিয়েই ফ্লোরা খুব ডিপ্রেসড ছিল। আর ডিপ্রেশন থেকেই সুইসাইড। তাছাড়া তোমার আঙ্কেলও ফ্লোরাকে খুব বেশি পছন্দ করতেন না। ফ্লোরার সাথে মেলা-মেশা করার জন্য একবার আশরাফকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন।”
প্রীতির নিজেকে স্তব্ধ লাগছে। এজন্যই আশরাফ ওইভাবে প্রীতির কাছে ফ্লোরার বাবা-মায়ের ঝামেলা মেটানোর জন্য অনুরোধ করতো। বার-বার বলতো ফ্লোরার কষ্ট কমিয়ে দিতে। এখন প্রীতির কাছে সবকিছু স্পষ্ট হচ্ছে।
প্রীতি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” কিন্তু এর সাথে আমার আর আশরাফের বিয়ের কি সম্পর্ক আন্টি? ওর মতো পেশেন্টকে আপনারা বিয়ে কেন দিতে চাইছেন? ও তো ফ্লোরার জায়গায় কাউকে সহ্য করতে পারবে না। ওকে কি ওর মতো ছেড়ে দেওয়া উচিৎ না? যেভাবে থাকতে চায় ভালো থাকুক। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠুক। তারপর না হয় আপনারা ওর বিয়ের কথা ভাববেন।”
” বিয়ের সাথে ওর সুস্থ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই মা। ওকে সুস্থ করা আদৌ সম্ভব কি-না এটাই তো আমরা নিশ্চিত নই। আমরা শুধু এমন একজনকে চাই, যে সবসময় আমার ছেলের পাশে থাকবে। ওর খেয়াল রাখবে, বন্ধুর মতো আগলে রাখবে। আশরাফের পেশেন্টদের নিঃসঙ্গ থাকতে দেওয়া যায় না। তাই আমরা একটি বিশ্বাসযোগ্য ভালো মেয়ের খোঁজ করছিলাম। অনেকের সাথে কথা হয়েছে। কিন্তু কেউ দুইদিনের বেশি সহ্য করতে পারেনি। তুমি পেরেছো। এক সপ্তাহ ধরে বন্ধুর মতো ওর পাশে আছো। তোমাকে দেখে আমি ভরসা পেয়েছি। মনে হয়েছে তুমিই যে কাজটা খুব ভালো করে পারবে। আর আশরাফও খুব জলদি তোমার সাথে মিশে গেছে। এতো সহজে ও কারো সাথে মেশে না।”
আরোহীর হাতটা এখনও প্রীতির কাঁধে। শেষ কথাগুলো শুনে প্রীতি ভ্রু কুঞ্চিত করে কাঁধের হাতটা সরিয়ে দিল। রাগান্বিত স্বরে বলল,” এর মানে? আপনারা কি আমাকে বিয়ে দিতে চাইছেন নাকি চাকরি?”
” কাইন্ড অফ চাকরিই বলতে পারো!”
প্রীতির ধৈর্য্যের বাঁধ এবার সত্যিই ভেঙে গেল। আশ্চর্য, সে কি এতোই ফেলনা? গরীব হয়েছে বলে কি তার মতামত নেওয়ার কোনো প্রয়োজনই নেই! আশরাফের পরিবারকে সে আলাদা ভেবেছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, সবাই এক। পৃথিবীর সকল পয়সাওয়ালা মানুষ একই রকম। আরোহী বললেন,” তুমি তো এতোদিন ভালোই ছিলে। হঠাৎ করে এখন কি হলো যে বিয়েটা ভাঙতে চাইছো?”
প্রীতি গরম হয়ে বলল,” আবার জিজ্ঞেস করছেন আমি কেন বিয়ে ভাঙতে চাইছি? এতোবড় সত্যি জানার পর বিয়ে ভাঙবো না তো কি করবো? নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন আন্টি, আপনি হলে কি বিয়েটা করতেন?”
” জানি না। হয়তো করতাম হয়তো না! কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আশরাফের অসুস্থতার কথা তুমি প্রথমবার জেনেছো?”
” প্রথমবারই তো জানলাম। এর আগে কি আপনারা আমাকে বলেছেন? জানানোর প্রয়োজন মনে করেছেন? ধোঁকা দিয়ে বিয়েটা দিতে চাচ্ছিলেন।”
আরোহী এবার ক্ষীপ্ত হলেন।
” কি আবোলতাবোল বলছো? ধোঁকা দিলাম মানে? তোমার সাথে নাফিসা আপা আর জেরিন এই ব্যাপারে আলোচনা করেনি?”
” ওরাও এই ব্যাপারে জানে?”
প্রীতি যেন আকাশ থেকে পড়ল। আরোহী জোর গলায় বললেন,” সবাই সব জানে। তুমি নিজেই তো বলেছো তোমার মাসে মাসে এক লক্ষ ডলার আর একটা উচ্চ পরিচয় লাগবে। তাহলেই তুমি আশরাফের সাথে সারাজীবন থাকতে রাজি।”
প্রীতির মাথায় কিছু আসছে না। এসব সে কবে বলল? টাকার কাছে নিজেকে বিক্রি করার আগে তার মৃত্যু হোক। প্রীতি কাঁদতে শুরু করেছে। আরোহী নরম কণ্ঠে বললেন,” আই এম স্যরি। এভাবে বলতে চাইনি। কিন্তু তুমি ভাবতেও পারবে না তোমার প্রতি আমি কতটা কৃতজ্ঞতাবোধ অনুভব করেছিলাম। নাফিসা আপার কাছে শুনেছিলাম তোমার নাকি মা নেই। ভেবেছি আমি তোমার মা হবো। তোমাকে মেয়ের মতো যত্নে আগলে রাখবো। বিশ্বাস করো, আশরাফ তোমাকে একদম জ্বালাবে না। শুধু মাঝে মাঝে ফ্লোরার গল্প বলবে। তোমার কাজ আশরাফকে হাসি-খুশি রাখা। ওকে একদম কাঁদতে দিবে না। বিনিময়ে তোমাকে আমি আমার সব দিয়ে দিবো।”
প্রীতি চোখ মুছতে মুছতে হালকা হেসে বলল,
” টাকা-পয়সার প্রতি আমার কোনো দূর্বলতা নেই আন্টি। আমার শুধু একটাই দূর্বলতা হলো আমি কারো কষ্ট সহ্য করতে পারি না। কেউ আমার কাছে কেঁদে-কেটে কিছু চাইলে আমি কখনও নিষেধ করি না। যতক্ষণ মানুষটির মুখে হাসি না ফুটবে ততক্ষণ চেষ্টা চালিয়েই যাবো। এটাই আমি।”
আরোহী মিষ্টি করে হাসলেন। প্রীতির গাল দু’টো আলতো করে চেপে ধরে বললেন,” আমি জানি তো মা। তোমাকে দেখেই বুঝেছি। তুমি খুব চমৎকার একটি মেয়ে। সবচেয়ে আলাদা। এজন্যই তোমাকে আমার ঘরে চাই।”
প্রীতি কঠিন মুখে বলল,” কিন্তু আপনার অনুরোধ আমি রাখতে পারবো না আন্টি। এটা অসম্ভব।”
আরোহী বিপর্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
” কেন?”
” আশরাফকে খুশি করার ক্ষমতা মহান আল্লাহ আমাকে দেননি। যদি আমি তার পাশে থাকি তাহলে সারাজীবন আমাকে তার কষ্ট দেখতে হবে। আমি সেই কষ্ট মেনে নিতে পারবো না। আমি আনন্দবিলাসী মেয়ে। চোখের পানি দেখলে যার বুক দুরুদুরু করে সে সারাজীবন কিভাবে কষ্টের সাথে বাস করবে আন্টি? এই কাজ আমার পক্ষে সম্ভব না। ”
আরোহী হাহাকার করে কিছু বলতে নিচ্ছিলেন। প্রীতি সেই সুযোগ দিল না। নিজেই কথা বলতে থাকল,” কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, যদি আশরাফকে ভালো রাখার বিন্দুমাত্র উপায় থাকতো তাহলে আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করতাম। মানুষকে ভালো রাখতে প্রীতি ভালোবাসে। তবে আসল ব্যাপার হচ্ছে, সত্যিকারের ভালোবাসা কখনও হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যায় না। ফ্লোরার প্রতি আশরাফের যে গাঢ় অনুভূতি আমি দেখেছি তা বিলীন করার এতো ক্ষমতা আমার নেই। আমাকে মাফ করবেন প্লিজ।”
প্রীতি এই কথা বলে আর এক মুহূর্তও থামল না। দ্রুত দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আরোহী হতাশ হয়ে বিছানায় বসে রইলেন। তার চোখ দিয়ে বাহিত হচ্ছে দুঃখের স্রোত।

প্রীতি ঘর থেকে বের হতেই আশরাফের সামনে পড়ে গেল। আশরাফকে হঠাৎ দেখে ভয়ে চমকে উঠল প্রীতি। আশরাফ হাসিমুখে বলল,” হেই প্রিটি, কেমন আছো? এতোরাতে আমাদের বাসায় কি করছো? আচ্ছা, ভালোই হয়েছে। ফ্লোরা তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিল। তোমার ব্যাপারে আমি সব বলেছি ওকে। ও খুব খুশি হয়েছে জানো? কালকেই তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। তুমি আন্টি-আঙ্কেলের সাথে কথা বলে তাদের ঝামেলাটা মিটিয়ে দিতে পারবে না? ওরা যেন ডিভোর্স না করে। তাহলে ফ্লোরা খুব কষ্ট পাবে, খুব!”
প্রীতি কি বলবে বুঝল না। তার কি উত্তর দেওয়া উচিৎ? সরাসরি কি বলে দিবে যে সে আজ বাংলাদেশ ফিরে যাচ্ছে? আর কখনও তাদের দেখা হবে না! কিন্তু এটা বললে যদি আশরাফ তাকে যেতে না দেয়? আশরাফ মোবাইল নিয়ে ফ্লোরার নাম্বার ডায়াল করছে। হেসে বলল,” ফ্লোরাকে ফোন করে জানাই তুমি এসেছো। তোমার কথা শুনলেই ও খুশি হয়ে যাচ্ছে। খিলখিল করে হাসছে। ওর হাসিমাখা কণ্ঠ সুন্দর! তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে। দাঁড়াও, এখনি শোনাচ্ছি।”
আশরাফ মোবাইল কানে দিয়ে রেখেছে। ওই পাশ থেকে একটা যান্ত্রিক কণ্ঠ স্পষ্টস্বরে জানান দিচ্ছে কল নট রিচেবল। সেই যান্ত্রিক কণ্ঠকে অবজ্ঞা করেই আশরাফ কথা বলে যাচ্ছে। যেন সত্যিই ফ্লোরার সাথে কথা বলছে। সে বুঝতে পারছে না যে ফোনের ওই পাশে কেউ নেই! আজ বিকালেও প্রীতি প্রত্যাশা করছিল আশরাফ আর ফ্লোরার মতো ভালোবাসা যেন তার জীবনেও আসে। কিন্তু এখন প্রীতি আর সেই প্রত্যাশা করছে না। বরং এমন সর্বনাশা ভালোবাসা কারো জীবনে কখনোই না আসুক। যে ভালোবাসা সবকিছু ধ্বংস করে ছাড়ে সেই ভালোবাসার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রীতি এক দৌড়ে ছুটে চলে এলো আশরাফের সামনে থেকে। লিভিং রুমে এসে বাবার হাত ধরল। চোখমুখ মুছে কান্না সামলে বলল,” বাবা চলো আমরা বাড়ি যাই।”
প্রমথ সরফরাজ সাহেবকে বিদায় জানালেন। তিনি অনুরোধ করলেন, অন্তত আজরাতে এখানে থাকার জন্য। সকালে তিনিই প্রীতিদের ফ্লাইটে তুলে দিবেন। কিন্তু প্রীতি রাজি হলো না। এই কষ্টমহল থেকে সে মুক্তি চায়।
আশরাফ লিভিং রুমে যতক্ষণে এসেছিল ততক্ষণে প্রীতিরা বের হয়ে গেছে। আশরাফ বাবাকে জিজ্ঞেস করল,” বাবা, প্রিটি চলে গেল কেন?”
সরফরাজ হাসার চেষ্টা করে বললেন,” ওর বাংলাদেশে একটা জরুরী কাজ পড়ে গেছে। তাই ওরা দেশে ফিরে যাচ্ছে।”
” দেশে ফিরে যাচ্ছে? ওরা কি আর আসবে না?”
” আসবে তো। নিশ্চয়ই আসবে। একমাস পর আসবে।”
আশরাফ একটু চিন্তা করল, একমাস তো খুব বেশি দেরী হয়ে যাবে। ততদিনে ফ্লোরার কষ্ট আরও বেশি বেড়ে যাবে। প্রীতির আসার আগেই যদি সে সুইসাইড করে? না,না আশরাফ আবার ফ্লোরাকে সুইসাইড করতে দেবে না। কিছুতেই না। প্রীতিকে আটকাতে হবে। আশরাফ দৌড়ে দরজার কাছে গেল। চিৎকার করে ডাকল,” প্রিটি!”
সাউন্ড প্রুফ ঘরের বাহিরে আশরাফের চিৎকার প্রীতির কানে গিয়ে পৌঁছাল না। আশরাফ বাহিরেও বের হতে পারছে না। রাতের বেলা তার বাড়ির বাহিরে বের হওয়া নিষেধ। দরজা লক করা থাকে। চাবি থাকে সরফরাজ সাহেবের কাছে।
প্রীতি বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,” এবার দেশে ফিরে আমি খুব মন দিয়ে লেখাপড়া করবো আব্বু। একটা ভালো ভার্সিটিতে ভর্তি হবো। একদিন আমি খুব ভালো কিছু করবো। বিয়ের কথা কিন্তু আর কোনোদিন আমাকে বলবে না তুমি। মনে থাকবে?”
প্রমথ সাহেব শুধু মাথা নাড়লেন। তিনি গভীর মনোযোগে কিছু ভাবছেন। প্রীতি বলল,” কি হয়েছে আব্বু তোমার?”
” সরফরাজ ভাই বোধহয় আমাকে কিছু বলতে চাইছিলেন।”
” কি বলতে চাইছিলেন?”
” শোনার সুযোগটাই তো পেলাম না। এর আগেই তো তুই এসে হাত ধরে বললি চলো বাড়ি যাই।”
প্রীতি মুচকি হেসে বলল,” একদম ঠিক করেছি।”
” তোর চোখে পানি কেন মা?”
” এটা খুশির অশ্রু আব্বু। তোমাকে ছেড়ে আর যেতে হচ্ছে না। আমার চেয়ে খুশি আজ এই পৃথবীতে কেউ নেই।”
প্রমথ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” আমার মা!”

চলবে

®Fareen ahmed

#উইল_ইউ_ম্যারি_মি?
পর্ব–৮

” হারানো দিনের মতো, হারিয়ে গেছো তুমি। ফেরারী সুখের মতো পালিয়ে গেছো তুমি…”
গানটা কোথাও বাজছিল। প্রীতি দাঁড়িয়ে আছে বাসস্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষায়। এই সময় বাসে প্রচন্ড ভীড় থাকে। আজ কড়া রোদ। প্রীতি মাথায় ছাতা ধরে রেখেছে। পেছন থেকে নওশাদের ডাক শোনা গেল। প্রীতি পেছন ফিরে দেখল নওশাদ দৌড়ে আসছে। তার কপাল, গায়ের শার্ট ঘামে ভিজে একাকার। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে প্রীতির সামনে থামল নওশাদ। প্রীতির চোখ ছলছল করছিল। নওশাদকে দেখে দ্রুতই মুছে নিয়েছে। তবুও নওশাদ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,” তুমি কি কাঁদছো প্রীতি?”
প্রীতি খুব সুক্ষ্মতার সাথে এড়িয়ে বলল,
” কই না তো! ধুলো চোখে এসে লেগেছে। তাই বোধহয় চোখ লাল দেখাচ্ছে। তুমি কোত্থেকে এলে?”
” ভার্সিটি থেকে। তুমি তোমার নোটবুক ফেলে এসেছিলে।”
নওশাদ ব্যাগ থেকে নোটবুক বের করে প্রীতির হাতে দিল। প্রীতি অবাক হয়ে বলল,” এইটুকু একটা জিনিস দেওয়ার জন্য তুমি এতোদূর থেকে এসেছো? কালকে দিলেও হতো।”
এই কথায় নওশাদ অপ্রস্তুতভাবে হেসে উঠল। ওই হাসিতে লজ্জামিশ্রিত ছিল। প্রীতি বুঝল না নওশাদ লজ্জা কেন পাচ্ছে! সে হেসে বলল,
” থ্যাংকস বাই দ্যা ওয়ে।”
” নোটবুকটা ভালো করে দেখে নিও। সব ঠিক আছে কি-না। বায়।”
নওশাদ নোটবুক ঠিক করে দেখার কথা বলল কেন? প্রীতি সাথে সাথেই নোটবুকটা খুলে উল্টে-পাল্টে দেখল। আর যা ভেবেছিল তাই। নওশাদ রঙিন কলম দিয়ে লিখে রেখেছে,” তোমাকে লাইট গ্রিনে সুন্দর লাগে। তবে ডীপ গ্রিনে আরও ভালো মানাতো! আচ্ছা প্রীতি, তুমি সবসময় মনখারাপ করে থাকো কেন? তুমি কি জানো, হাসলে তোমাকে কত সুন্দর লাগে?”
প্রীতি আবার তাকাল নওশাদের দিকে৷ নওশাদ ততক্ষণে হাওয়া। নোটবুকটা ভাজ করে প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে আগেই বুঝতে পেরেছিল যে নোটবুক ফেলে আসেনি। নওশাদই চুরি করেছে। আর এখন নোটবুক দেওয়ার বাহানায় প্রীতির পেছন পেছন বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এসেছে। সে এখান থেকে যাবে না। আশেপাশেই থাকবে৷ যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রীতি বাসে উঠছে। এই ছেলে একটা বদ্ধ উন্মাদ!
গানটা এখনও বাজছে। প্রীতির পুনরায় কান্না আসতে চাইছে। গানের কথাগুলো এতো হৃদয়খচিত কেন? মনে পড়ে যায় নিউইয়র্ক শহরের ব্যস্ত রাস্তাটির কথা। দামী রেস্টরন্ট, কফিশপ আর ধ্বংসাত্মক সেই ভালোবাসার কাহিনী। কেমন আছে মানুষটা? ছয়মাস কেটে গেছে!
প্রীতি বাসে উঠল। নোটবুকটা ব্যাগে ভরে রাখার সময় নজরে পড়ল টিফিনবক্স। এটা নওশাদের টিফিনবক্স। আজ প্রীতি লাঞ্চের সময় মাঠে ঘুরাঘুরি করছিল। ক্যান্টিনে সে যায়নি৷ তার কাছে খাওয়ার টাকা ছিল না আবার বাড়ি থেকে টিফিনও আনতে পারেনি। বাবার শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। তাই প্রীতিই বাবাকে রান্না-বান্না করতে নিষেধ করেছে। প্রীতিই ভার্সিটি শেষে বাড়ি ফিরে রান্না করবে। নওশাদ মনে হয় বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা। তাই নিজের টিফিনবক্স দিয়ে বলল তার মা নাকি প্রীতির জন্য বিরিয়ানী পাঠিয়েছেন। প্রীতি জানে কথাটা মিথ্যে। তবুও সে টিফিনবক্স নিয়েছে। না নিলে নওশাদ কষ্ট পেতো। এই ছেলের মনটা আবার খুব নরম। তুচ্ছ কারণে কষ্ট পায়। মেয়েদের মতো কেঁদে বুক ভাসায়। যে কারণে প্রীতি রাগ করে তাকে কখনও কিছু বলতেও পারে না। তবে নওশাদের সাথে পরিচয় নিয়ে প্রীতির একটা মজার ঘটনা আছে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। প্রীতি এসেছে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা দিতে। সিট পড়েছিল বাংলা কলেজে। নওশাদেরও সেখানেই সিট। দু’জন একই বেঞ্চে বসেছে। প্রীতি জানে তার প্রিপারেশন ভালো নেই। চান্স পাওয়া তার জন্য স্বপ্ন। প্রশ্ন যদি একেবারে পানির মতো সহজ হয় তবুও তার চান্স হবে কি-না সন্দেহ। এদিকে বাবা খুব আশা নিয়ে বসে আছেন। মেয়ে চান্স পাবেই।
হলে ঢোকার পর প্রীতির একটু খারাপ লাগছিল। বাবাকে বিদায় দেওয়ার সময় সে লক্ষ্য করেছে, বাবার চোখে তাকে নিয়ে অনেক আশা! চান্স না পেলে সেই আশা ভেঙে যাবে৷ বাবা দুঃখ পাবেন। প্রীতি বাবাকে দুঃখ দিতে চায় না। পাশেই বসেছিল নওশাদ৷ খুব খুশি মনে নিজের সাফল্যের গল্প শোনাচ্ছিল প্রীতিকে। বুয়েটের প্রিলিতে টিকে গেছে। রিটেন এক্সাম হয়ে গেলে সে চান্স পাবে নিশ্চিত। তার স্বপ্ন ট্রিপল ই নিয়ে পড়ার। এক কথায় টপ স্টুডেন্টের যে সংজ্ঞা তার সব নওশাদের মধ্যে আছে। প্রীতির দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারা দেখে নওশাদ প্রশ্ন করে,” এনি প্রবলেম?”
প্রীতি চাপা স্বভাবের। নিজের প্রবলেম সে শেয়ার করেনি। তবে নওশাদ বুঝে নিয়েছিল। প্রশ্ন পাওয়ার পর নওশাদ খুব হেলা-ফেলা করে উত্তর দাগিয়েছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার তেমন ইচ্ছে তার নেই। এই পরীক্ষা তার জন্য খেলা। কিন্তু প্রীতির জন্য লড়াই। নওশাদ প্রীতিকে এমসিকিউতে খুব হেল্প করল। ধরতে গেলে নওশাদের থেকে সাহায্য নিয়ে সবকয়টা এমসিকিউতে প্রীতি উতরে গেল। সে কখনও ভাবেনি ভর্তি পরীক্ষায় এভাবে তাকে কেউ সাপোর্ট দিবে৷ এরপর এলো রিটেনের সময়। যেহেতু প্রীতি নওশাদের সাহায্যে এমসিকিউ দাগিয়েছে তাই নওশাদ যে বিষয়গুলো নির্বাচন করেছিল প্রীতিও সেগুলোই নির্বাচন করেছে। রিটেনেও তাকে সেসব লিখতে হলো। কিন্তু প্রীতি ম্যাথে দূর্বল ছিল। ধরতে গেলে সে ম্যাথ পারেই না। এইচএসসি’র আগে শেষবার ম্যাথ প্র্যাকটিস করেছিল। তারপর আর ধরা হয়নি। এক্সাম শেষ হতে মাত্র আর দশমিনিট বাকি। প্রীতি সব মোটামুটি এনসার করেছে। কিন্তু ম্যাথ ছুঁয়েও দেখেনি। নওশাদ তা জানতে পেরে বলল,” প্লিজ ম্যাথ এনসার করো প্রীতি। নাহলে তো তুমি চান্স পাবে না।”
মনে হলো প্রীতির চান্স পাওয়া নিয়ে নওশাদের ব্যাকুলতাই বেশি৷ প্রীতি হেসে বলল,” আমি চান্স পাবো না এটা আগেই জানি। আর ম্যাথ তো আমি পারি না। কিভাবে এনসার করবো?”
” তোমাকে অবশ্যই চান্স পেতে হবে।ম্যাথ পারো না মানে? এদিকে দাও আমি দেখছি।”
নওশাদ ঝট করে নিজের সাথে প্রীতির খাতা অদল-বদল করে নিল। প্রীতি ভয়ে অস্থির হয়ে বলল,” ওমা, কি করছো এটা? ধরা পড়লে আমরা দু’জনই এক্সপেল হবো।”
নওশাদ আঙুলের ইশারায় বলল চুপ থাকতে। অতঃপর প্রীতির খাতায় সবগুলো ম্যাথের এনসার ফটাফট লিখতে লাগল। তার লেখার স্পিড দেখে মনে হচ্ছিল অংকগুলো বুঝি তার মুখস্ত। এভাবেই শেষ হলো ভর্তি এক্সাম৷ রেজাল্টের দিন প্রীতি নিশ্চিত ছিল চান্স হবে না। কারণ নিজের যোগ্যতায় সে কিছুই লেখেনি। যা লিখেছে সব নওশাদের সাহায্য নিয়ে। এদিকে প্রমথ সাহেব আগেই রসগোল্লা, লাড্ডু কিনে এনে রেখেছেন। মেয়ে চান্স পেলে পুরো পাড়ায় বিতরণ করবেন। এসব দেখে প্রীতির কান্না এসে যাচ্ছিল। সেদিন সার্ভার খুব ডাউন ছিল। প্রীতি রেজাল্ট জানতে পারল দুপুর দুইটায়। আশ্চর্যজনকভাবে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে তার পজিশন ছিল সাতশো একুশ। প্রীতি খুশিতে কেঁদে ফেলেছিল। প্রমথ পুরো পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ করে সবাইকে গর্বের সাথে সুখবর জানালেন। সারাদিন বাবা-মেয়ে খুশিতে অকারণেই হেসেছে। যেদিন প্রীতি ভর্তি হতে যাবে সেদিন ঠিক করেছিল বুয়েটেও একবার ঘুরে আসবে৷ যদি নওশাদের সাথে দেখা হয়ে যায়! তাকে একটা থ্যাংকস অন্তত দেওয়া দরকার। নওশাদ যেটা প্রীতির জন্য করেছে সেটা কেউ কখনোই করে না। কিন্তু ভর্তির দিন ইউনিভার্সিটিতেই সরাসরি নওশাদের সাথেই দেখা হয়ে যায় প্রীতির। নওশাদ বুয়েটে ভর্তি হয়নি। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ট্রিপল ই নিয়ে ভর্তি হয়েছে৷ তার পজিশন ছিল দুইশো বিশ। অথচ বুয়েটেও সে স্ট্যান্ড করেছিল। ট্রিপল ই সাবজেক্ট অনায়াসে পেয়ে যেতো। তবুও এই ছেলে কেন বুয়েট ছেড়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এলো তা মোটেও প্রীতির বোধগম্য হলো না। প্রীতি ভর্তি হয়েছিল ফার্মাসীতে। একদিন জানতে পারল নওশাদও নাকি নিজের সাবজেক্ট বদলে ফার্মাসীতে চলে এসেছে। প্রীতর ডিপার্টমেন্টে। নিজের ক্লাসে নওশাদকে দেখে প্রীতি হতবাক!
বাস কন্ট্রাক্টর গলা উঁচিয়ে ডাকছে,” এইযে ম্যাডাম, ভাড়াটা দেন৷ কোথায় নামবেন?”
প্রীতি ভাবনায় ছেদ পড়ল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল তার স্টপেজ এসে গেছে। প্রীতি উদগ্রীব হয়ে বলল,” এখানেই আমি নামবো মামা।”
” তাইলে জলদি নামেন। ভাড়া দেন আগে।”
প্রীতি ভাড়া দিয়ে বাস থেকে নামল। দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে। গোসল সেরে রান্নাও করতে হবে৷ বাবাকে বলেছিল দোকান থেকে পাউরুটি আর কলা নিয়ে খেতে। বাবা নিশ্চয়ই খাননি। এখনও না খেয়ে আছেন। প্রীতির বাড়ি গিয়ে প্রথম কাজ হলো বাবাকে ধমক দিয়ে খাওয়ানো।
কলিংবেল চাপল প্রীতি। বাবা হাসিমুখে দরজা খুললেন।
” আয় মা। ভেতরে আয়। তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
” কি সারপ্রাইজ বাবা? তুমি এতো খুশি কেন?”
” সারপ্রাইজটা দেখলে তুইও খুশি হবি।”
প্রীতি বাবার সাথে হাসতে হাসতে বেডরুমে এসে দেখল জেরিন বসে আছে। জেরিনকে দেখেই চেহারা কালো হয়ে গেল প্রীতির। প্রমথ সাহেব আনন্দিত কণ্ঠে বললেন,” চমকটা কেমন ছিল? তোকে সারপ্রাইজ দিতে এই পাগলী আটলান্টিক মহাসাগর পার করে এসেছে। একেই বলে আত্মার টান৷ তোরা গল্প কর। আমি চুলায় রান্না বসিয়েছি।”
প্রমথ হাসতে হাসতে রান্নাঘরে চলে গেলেন। তিনি তো জেরিনের প্রতারণার কথা জানেন না৷ প্রীতি আজও বলতে পারেনি। বাবা জেরিনকে মেয়ের মতো দেখতেন। এসব জানলে কষ্ট পাবেন বলে। জেরিন প্রীতিকে জড়িয়ে ধরতে এলেই প্রীতি দূরে সরে গেল। ভ্রু কুচকে বলল,” আমার বাড়িতে আসার সাহস তোর কিভাবে হলো?”
” তুই আমার ফোন ধরিস না। আমাকে সবজায়গায় ব্লক করে রেখেছিস। তাই উপায় না পেয়ে ডিরেক্ট ফ্লাইটে উঠে চলে এসেছি। প্লিজ রাগ করে থাকিস না বোন। যদিও আমার অপরাধ নেই তাও আমি ক্ষমা চাইছি তোর কাছে। প্রয়োজনে ক্ষমা চাইবো।”
” এতোবড় অপরাধ করেও বলছিস তোর অপরাধ নেই? শুধু পায়ে ধরে কেন? মাথা ঠুকে মাফ চাইলেও আমি তোকে মাফ করতে পারবো না। প্লিজ তুই চলে যা জেরিন।”
” তুই ভুল বুঝছিস আমাকে।”
” ভুল নয়, ঠিকই বুঝেছি। বরং তুই এখন এসেছিস আমাকে ভুল বোঝাতে।”
জেরিন এগিয়ে এসে গলায় হাত চেপে বলল,” আই সুয়্যের আমার কোনো দোষ ছিল না। আশরাফ ভাইয়ের অসুস্থতার কথা আমি জানতাম না বিশ্বাস কর। মা আমাকে কিছুই বলেনি। তাকে আমি বিয়ে করতে চাইনি শুধুই আতিফের জন্য। আর মাও সেটা মেনে নিয়েছিল। কারণ মা সব জানতো। তোর সাথে আমার ভালো ফ্রেন্ডশীপ। আমি যদি সত্যিটা জেনে যাই তাহলে তোকে বলে দিবো। এজন্যই মা আমার কাছে সব গোপন করেছিলেন। তুই ওখান থেকে চলে আসার পর আমি তোর সাথে কানেক্ট হওয়ার কত ট্রাই করেছি জানিস? আমি বুঝতে পেরেছিলাম নিশ্চয়ই তুই আমার উপর রেগে আছিস। কিন্তু রাগের কারণটাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিছুদিন আগে আশরাফ ভাইদের বাসায় গিয়েছিলাম৷ তখন আরোহী আন্টির থেকে সব জানতে পেরেছি।”
কথাগুলো শোনার পর প্রীতি কিছুটা ঠান্ডা হলো। তার মনে হচ্ছে জেরিন সত্যিই বলছে। প্রীতি শান্ত হয়ে বিছানায় বসল। জেরিন হাঁটু গেঁড়ে প্রীতির সামনে বসে বলল,” আমার কথা বিশ্বাস কর প্রীতি। আমি তোর ক্ষতি চাইবো এটা তুই ভাবলি কেমন করে? আমি না তোর বেটার হাফ?”
প্রীতি আচমকা জড়িয়ে ধরল জেরিনকে। অস্থির হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,” আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলান সেদিন। আমার মন ভেঙে গিয়েছিল।”
” আমি জানি। তোর জায়গায় আমি হলে আমিও কষ্ট পেতাম।”
প্রীতি বেশ কিছুক্ষণ ধরে কাঁদল৷ কান্নার মাধ্যমে এতোদিনের জমানো কষ্টগুলো বের করে দিচ্ছিল যেন। জেরিন বিরক্ত হয়ে বলল,” হয়েছে এবার কান্না বন্ধ কর। এতোদূর থেকে তোর কান্না দেখতে আসিনি আমি। নে চোখ মোছ। খচ্চর কোথাকার!কাঁদতে কাঁদতে নাকের পানিও বের করে ফেলেছে।”
প্রীতি হাসতে হাসতে টিস্যুপেপার দিয়ে চোখ মুছল। তারপর জিজ্ঞেস করল,” আশরাফ এখন কেমন আছে?”
আশরাফের কথা শুনে জেরিনের চেহারা অন্ধকার হয়ে গেল। কিছু একটা ভেবে সে দীরশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল,” ভালো নেই।”
প্রীতির ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল,” কেন?”
” সারাক্ষণ তোর নাম নিচ্ছে। আগে ফ্লোরা-ফ্লোরা করতো। আর এখন খালি প্রিটি-প্রিটি করে। তাকে বুঝিয়ে রাখা হচ্ছে তুই কিছুদিন পরেই ইউএসএ আসবি। এই অপেক্ষাতেই সে দিন গুণছে। প্রীতি, তুই কি একবার যাবি আমার সাথে নিউইয়র্কে? প্লিজ চল না। ”
প্রীতি কঠোর গলায় বলল,” কখনোই না।”

চলবে

উইল ইউ ম্যারি মি? পর্ব-০৬

0

#উইল ইউ ম্যারি মি?
পর্ব–৬
® Fareen Ahmed

মেয়ের কথা শুনে প্রমথ সাহেব খুব জোরে হেসে উঠলেন। সময় নিয়ে তিনি হাসতেই থাকলেন। প্রীতি ভ্রু কুচকে বলল,” কি হয়েছে আব্বু? হাসির মতো কি বললাম?”
হাসতে হাসতে প্রমথের চোখে পানি এসে পড়েছিল৷ তিনি চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন,” জীবন এতো সহজ না মা। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। বিয়ে মেয়েদের জীবনের একটি অনিবার্য সত্য। এই সত্য তোকে মানতেই হবে।”
” উফ আব্বু, তুমি বুঝতে পারোনি৷ আমি কোনোদিন বিয়ে করবো না এই কথা কিন্তু বলিনি৷ আমি বলেছি এই ছেলেকে বিয়ে করতে পারবো না। ”
” আশরাফুলকে কেন বিয়ে করতে পারবি না? আমাকে ছেড়ে দূরে থাকতে হবে বলে?”
” এটাও একটা কারণ। কিন্তু এর চেয়েও বড় আরেকটা কারণ আছে।”
” কি?”
প্রীতি কারণটা বলতে নিয়েও থেমে গেল। এতো কথা বাবাকে জানিয়ে কাজ নেই।
” তাকে আমার পছন্দ না।”
” পছন্দ না!”
প্রমথ সাহেব ভীষণ অবাক হলেন। প্রীতি নিশ্চুপ আছে। প্রমথ একটু পর হেসে বললেন,” মিথ্যে কেন বলছিস মা?”
” মিথ্যে কখন বললাম? সত্যি আব্বু, তাকে আমার একদম পছন্দ হয়নি। আমার মনে হয় সে আমার জন্য ঠিক না।”
” কেন তোর এটা মনে হলো? সত্যি করে বল, আশরাফুলকে তোর পছন্দ হয়নি এই কথা আমি বিশ্বাস করবো না৷ কারণ আমি আমার মেয়ের মন বুঝি।”
প্রীতির কিঞ্চিৎ কষ্ট হলো। সে যে আশরাফকে ভালোবেসে ফেলেছিল এটা কি বাবা বুঝে গেছেন? জেরিন তো বুঝেনি। অন্যকেউ বুঝেনি। তাহলে বাবা কি করে বুঝলেন? প্রীতি ক্ষীণ স্বরে বলল,” যদি তুমি আমার ভালো চাও তাহলে প্লিজ বিয়েটা ভেঙে দাও আব্বু।”
” তুই কি সিরিয়াস? আরেকটু ভেবে সিদ্ধান্ত নে।”
” ভাবার কিছু নেই। এই বিয়ে সম্ভব না ব্যাস!”
” আশ্চর্য! এমনি বললে হয় নাকি? একটা উপযুক্ত কারণ তো আমাকে বলতে হবে।”
” ছেলে আমার পছন্দ হয়নি। এটা কি তোমার কাছে উপযুক্ত কারণ মনে হচ্ছে না?”
” মারে, বিয়ে ঠিক হওয়ার পর তোর খুশি আমি দেখেছি। এই বিয়েতে তোর দ্বিধা থাকার কথা না৷ তাহলে এখন হঠাৎ কি এমন হলো যে তুই বিয়ে করতেই চাইছিস না? আশরাফের মধ্যে কি খারাপ কিছু দেখেছিস?”
প্রীতির মনে পড়ল, আশরাফ সেদিন রেস্টরন্টে বলেছিল বিয়ে ভাঙার বাহানা শিখিয়ে দিয়েছিল। বলতে হবে আশরাফ তার সঙ্গে অনেক খারাপ আচরণ করেছে। প্রীতি সঙ্গে সঙ্গে বলল,” লোকটার স্বভাব আমার ভালো লাগেনি বাবা। তিনি আমার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করেছেন।”
” কিরকম বাজে ব্যবহার?”
প্রমথ সাহেবের চোখ-মুখ কুচকে গেল। কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো। প্রীতি খানিক ভয় পেল। বাবা যদি এখন রেগে যান! পরিস্থিতি সামাল দিতে বলল,
” তেমন কিছু না। শুধু আমার মনে হয়েছে এমন একটা ছেলের সঙ্গে আমি সারাজীবন কাটাতে পারবো না। মাইন্ড ম্যাচিং হচ্ছে না। বুঝতে পেরেছো?”
প্রমথ সাহেব হা করে তাকিয়ে রইলেন। তেমন কিছু বুঝতে পারেননি। তবে এইটুকু বুঝলেন যে ঘটনা গুরুতর। নাহলে প্রীতি এমনি এমনি বিয়েতে ‘না’ করবে না। প্রীতি এতো অবুঝ না। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে যা মেয়েটা বলতে চাইছে না। প্রমথ সাহেব কথা বের করার জন্য উচ্চ গলায় প্রশ্ন করলেন,
” আশরাফুল কি করেছে তুই খালি বল।”
বাবার কণ্ঠ শুনে প্রীতি ভয়ে কাবু। সে ভয় পাচ্ছে আশরাফকে নিয়ে। বাবা তো তাকে কিছু বলবে না। কিন্তু আশরাফকে ছাড়বে না। অথচ বেচারার কোনো দোষই নেই। পাশের ঘর থেকে বাপ-মেয়ের তর্ক-বিতর্ক শুনে নাফিসা উঠে এলেন।
” রাত-বিরেতে বাপ-মেয়ের ঝগড়া শুরু হলো নাকি? কি ব্যাপার?”
ফুপুকে দেখে কথা বলতে নিয়েও চুপ হয়ে গেল প্রীতি। কিন্তু প্রমথ সাহেব থামলেন না। নাফিসাকে উদ্দেশ্য করে তেজস্বী কণ্ঠে বললেন,” কি ছেলে দেখেছিস তুই? ছেলে নাকি নম্র-ভদ্র? অথচ প্রীতির সাথে সে এমন ব্যবহার করেছে যে প্রীতি এখন বিয়েই করতে চাইছে না।”
নাফিসার মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। বজ্রের মতো শব্দ করে বললেন,” বিয়ে করতে চাইছে না মানে? মগের মূল্লুক নাকি? এই মেয়ে, তোর কি হয়েছে? বিয়ে কেন ভাঙবি?”
প্রীতি মাথা নিচু করে জেদী কণ্ঠে বলল,” ছেলে পছন্দ হয়নি৷ তাই বিয়ে করবো না। আমাকে কেউ জোর করতে পারবে না। কথা এখানেই শেষ। ”
” আরে অদ্ভুত! পছন্দ না হলে তুই এতোদূর আসলি কেন? তোকে তো ছবি পাঠানো হয়েছিল। তখনি নিষেধ করে দিতি।”
প্রমথ সাহেব মুখ খুললেন,” শুধু ছবি দেখেই কি মানুষ চেনা যায়? ছবি দেখে তো মনে হয়েছিল ছেলে খুব নিষ্পাপ। পৃথিবীর দশজন ভালো মানুষের মধ্যে একজন। কিন্তু এইখানে আসার পর, ছেলের সঙ্গে মেশার পর প্রীতি বুঝতে পেরেছে ছেলের আচরণ ভালো নয়। সেজন্যই তো বিয়ে ভাঙতে চাইছে। আমার মেয়ে এমনি এমনি কোনো কাজ করে না। এখন তোর কাছে আমি জানতে চাই ছেলের আচরণ কেন খারাপ? তুই তো ওদের ফ্যামিলি সম্পর্কে ভালো করে জানিস।”
নাফিসা রেগে বললেন,” আচরণ খারাপ কেন হবে? কি করেছে সে তোর নবাবজাদীর সাথে? এতো ভালো ছেলের আচরণ তোর মেয়ের খারাপ মনে হবে কেন? তাছাড়া পৃথিবীতে নিঁখুত বলে কোনো মানুষ নেই। সবারই ভুল-ত্রুটি থাকে। সেজন্য বিয়ে ভাঙতে হবে নাকি? এডজাস্ট তো করা উচিৎ। ”
প্রমথ সাহেব বললেন,
” তার জন্য জানতে হবে ভুলটা কি? তারপর আমিই সিদ্ধান্ত নিবো এডজাস্ট করা যায় কি যায় না। যদি মনে হয় ক্ষমার অযোগ্য দোষ তাহলে বিয়ে হবে না। আর যদি মেনে নেওয়ার মতো দোষ হয় তাহলে আমার মেয়েকে আমি বোঝাবো।”
” তোরা বাপ-মেয়ে এমন ড্রামা করছিস যেন তুই জন স্পেন্সার আর তোর মেয়ে প্রিন্সেস ডায়না! আরে এমন প্রস্তাব যে তোর মেয়ের জন্য এসেছে সেটা তো তোদের সাত কপালের ভাগ্য! শুকরিয়া আদায় না করে ছেলের দোষ-গুণ খুঁজে বেড়াচ্ছিস? দোষ-গুণ মিলিয়েই তো মানুষ। আর তোর মেয়ে কি খুব নিষ্পাপ? তার কি দোষ নেই? ”
প্রমথ এক বাক্যে বললেন,” আমার মেজাজ খারাপ হওয়ার আগে তুই এখান থেকে চলে যা নাফিসা।”
” তোর মেজাজ খারাপ হবে মানে? মেজাজ তো আমার খারাপ হওয়া উচিৎ। যেই কথা শুনছি!আচ্ছা তোদের কি বলার মতো কোনো পরিচয় আছে? কোথায় আশরাফ আর কোথায় প্রীতি। বামুন হয়ে চাঁদ ছোঁয়ার মতো ঘটনা। সারাজীবন সাধনা করলেও তোর মেয়ে আশরাফের নখের যোগ্য হতে পারতো না৷ সেখান থেকে ওরা নিজে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। এটা তোদের ভালো লাগছে না? অদ্ভুত! কুকুরের পেটে ঘি হজম হয় না বলে একটা বাগধারা শুনেছিলাম। এখন দেখছি সত্যি।”
প্রীতি আর চুপ থাকতে পারল না। হিংস্র বাঘিনীর মতো চিৎকার করল,”তোমার এই বিষয় কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একমাত্র আমার বাবার আছে। আর কারো নেই।”
প্রীতির চিৎকার শুনে এক কানে হেডফোন আর হাতে মোবাইল নিয়ে জেরিন ছুটে এলো। অবাক হয়ে পরিস্থিতি অবলোকন করল। নাফিসা চেঁচিয়ে বললেন,” ভাষণ বন্ধ কর মেয়ে। শুধু চোপা ছাড়া আর কি পারিস তুই? বিয়ে নিয়ে আমি চিন্তা করবো না কেন? এই বিয়ের সাথে আমার সম্মান জড়িত। আরোহী আপাকে আমি কথা দিয়েছি। এখন সেই কথার বরখেলাপ করবো?”
” তুমি আমার ব্যাপারে কথা দেওয়ার কে?”
” আমি তোর ফুপু হই।”
” তোমার মতো ফুপু থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। ”
নাফিসা বড় বড় চোখে প্রমথের দিকে চাইলেন।
” শুনলি তোর মেয়ে কি বলল? কিছু বলবি না ওকে?”
প্রমথ সাহেব টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে নির্বিকার গলায় বললেন,” কেন বলবো? আমিও তাই মনে করি। তোর মতো ফুপু ওর না থাকলেও চলতো।”
” তাহলে পড়ে আছিস কেন আমার বাড়িতে? খাচ্ছিস কেন আমার অন্ন? আজকেই বের হয়ে যা!”
” এখনি বের হয়ে যাচ্ছি।”
জেরিনের মুখ শুকিয়ে গেল পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। প্রীতি কিছু বলার জন্য গজগজ করছে। পেছন থেকে ইশারায় প্রীতিকে চুপ করতে বলল জেরিন। প্রীতি চুপ থাকল না। তার রাগ নিয়ন্ত্রণের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
” তোমার নিজের মেয়ের জন্যেও তো প্রস্তাব এসেছিল। এতোই যখন পছন্দ তাহলে বিয়েটা দিলে না কেন?”
নাফিসা জবাবে বললেন,
” জেরিন অন্যকাউকে চায়। মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি তাকে জোর করে বিয়ে দিবো নাকি?”
” তাহলে আমাকে জোর করছো কোন হিসেবে?”
নাফিসা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,
” তুই আর জেরিন কি এক? আমার মেয়ে চাইলে ওর জন্য আমি রাজপুত্র হাজির করতে পারবো। ওর বিয়ে দেওয়ার জন্য ওর ফ্যামিলি স্ট্যান্ডার্ডই যথেষ্ট। আর তোর কি আছে শুধু সুন্দর চেহারা ছাড়া? তোর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড শুনলে তো পাত্র হাত ধুঁয়ে পালাবে। সেখানে আশরাফের মতো ছেলে তোকে বিয়ে করতে চায়। নিজেকে ধন্য মনে কর।”
প্রীতি বিক্ষিপ্ত মেজাজে বলল,” বিশ্বাস করো, তোমার মতো জঘন্য মানুষ আমি আর দেখিনি। ”
নাফিসা ধাপ করে প্রীতির গালে চড় মারলেন। জেরিন ভয়ে মুখে হাত দিয়ে ফেলল। কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে! প্রমথ সাহেব সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লেন। গম্ভীর গলায় বললেন,” প্রীতি চল। এখানে আর এক মুহূর্ত নয়।”
নাফিসা হৈহৈ করে উঠলেন,” যা, যা। তোদের বাড়িতে জায়গা দেওয়াই আমার ভুল হয়েছে। মান-সম্মান আর কিছু অবশিষ্ট থাকল না।”
প্রমথ কাপড়টাও বদলাননি। হাত ধুঁয়ে লাগেজ ব্যাগ গুছিয়ে নিলেন। তারপর গায়ে ট্রাউজার আর টি-শার্ট নিয়েই মেয়ের হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলেন। প্রীতিও কোনো কথা বলল না। তার গায়ে ছিল একটা সুতির কামিজ। সে শুধু ওরনা দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে নিল। যাওয়ার আগে জেরিন কান্নাকাটি শুরু করেছিল।
” মামা প্লিজ যেও না। তুমি কি তোমার ভাগ্নির কথাও শুনবে না?”
প্রমথ সাহেব শুনলেন না। জেরিনকে তিনি ভাগ্নী না, নিজের মেয়ে মনে করেন। মেয়ের মতো স্নেহ করেন। কিন্তু সেই স্নেহের প্রমাণ দেওয়ার জন্য বাড়িতে থেকে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যে বাড়িতে তার মেয়েকে অপমান করা হয় সেই বাড়িতে তিনি থাকবেন না। কখনোই না!
প্রীতি ব্যস্ত সড়কে বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করল,” আমরা এখন কোথায় যাবো আব্বু?”
” তোর বিয়ে দেওয়ার জন্য যে টাকা এনেছিলাম সেই টাকা দিয়ে এখন বাংলাদেশ যাওয়ার এয়ার টিকিট কাটবো।”
প্রীতির চোখে খুশির অশ্রু চলে এলো। প্রমথ সাহেবের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
” আই লভ ইউ আব্বু।”
” কিন্তু মা, এর আগে আমাদের অন্য একটা জায়গায় যেতে হবে।”
” কোথায়?”
” আশরাফুলের বাড়িতে।”
” সেখানে কেন?”
প্রমথ কোমল হাসি দিয়ে বললেন,” ছেলের বাবা-মা খুব ভালো মানুষ। তাদের না জানিয়ে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমার নিজের বোন আমাকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। কিন্তু তাদের বাড়ি গিয়ে যে সম্মান আমি পেয়েছিলাম তা ভুলে যাই কি করে? আমার মতো সাধারণ মানুষকে যারা এতো সম্মান করতে পারে আমি কিভাবে তাদের অসম্মান করি বল?”
” তুমি ঠিক বলেছো আব্বু। চলো আমরা তাহলে এখনি যাই।”

এতো রাতের বেলা বাবা আর মেয়েকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলেন সরফরাজ সাহেব। তাদের সাথে লাগেজ দেখে আরোহীর ভয়ে বুক কাঁপতে লাগল। যেটা আশঙ্কা করেছিলেন সেটাই কি তবে হয়েছে? আরোহীর আশঙ্কাকে সত্যি করেই প্রমথ সাহেব বিয়ে ভাঙার কথা বললেন। সরফরাজ কারণ জানতে চাইলে প্রমথ সাহেব কিছু বললেন না। শুধু ক্ষমা চাইলেন আর জানালেন সমস্যা আছে। সরফরাজ রীতিমতো অনুরোধ করতে লাগলেন। পারলে তিনি প্রমথের পায়ে ধরে ফেলেন। এতো অনুনয়-বিনয় দেখে প্রমথ সাহেব লজ্জিত হয়ে গেলেন।
আরোহী প্রীতিকে নিয়ে অন্যঘরে এলেন। প্রীতি প্রথমে আসতে চাইল না। আরোহী বললেন,” আবার কবে না কবে দেখা হয়। অন্তত আমার শেষ অনুরোধটুকু রাখো মা। প্লিজ?”
প্রীতি বাবার দিকে তাকাল। প্রমথ সাহেব যাওয়ার অনুমতি দিলেন৷ তারপর প্রীতি আরোহীর সঙ্গে এলো। আরোহী দরজা বন্ধ করতে করতে বললেন,” আমি জানি তুমি কেন বিয়েটা ভাঙতে চাইছো।”
প্রীতি মাথা নিচু করে রাখল। আরোহী আন্টির প্রতি তার রাগ আছে। সব জেনেও তিনি বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে-পরে লেগেছেন। এতে যে প্রীতির জীবন নষ্ট হতে পারে সেই কথা একবারও ভাবলেন না! শুধু নিজের দিকটাই দেখলেন। আরোহী কাছে এসে বললেন,” আশরাফ কি তোমাকে ফ্লোরার কথা বলেছে?”
প্রীতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দিল,” জ্বী বলেছে।”
আরোহী মুচকি হাসলেন। হাসিতে দুঃখ মেশানো। হতাশ কণ্ঠে বললেন,” জানতাম। কি কি বলেছে?”
” অনেক কিছুই। উনি সারাক্ষণ আমার সাথে ফ্লোরার গল্পই করেন।”
” শুধু তোমার সাথে না, ও সবার সাথেই ফ্লোরার গল্প করে। যারা জানে না তারা এই গল্পগুলো সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু যারা আসল সত্যি জানে তারাই কেবল বোঝে ব্যাপারটা কত ভয়ংকর কষ্টের।”
” আন্টি, আমি আপনার কাছে অনুরোধ করবো ওদের সম্পর্কটা মেনে নিন। আশরাফ ফ্লোরাকে খুব ভালোবাসে। ওদের আলাদা করা ঠিক হবে না।”
” আমি ওদের আলাদা করার কে? যখন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই ওদের আলাদা করে দিয়েছেন!”
” মানে? ঠিক বুঝলাম না।”
” আশরাফ তোমাকে ফ্লোরার ব্যাপারে অনেক কিছু বলেছে। কিন্তু একবারও কি এই কথা বলেছে যে ফ্লোরা দুইবছর আগে সুইসাইড করেছিল?”
প্রীতি থমকে গেল। আচমকা ভয়ের একটি শীতল স্রোত তার শরীরে প্রবাহিত হলো।

চলবে

উইল ইউ ম্যারি মি? পর্ব-০৫

0

#উইল ইউ ম্যারি মি?
পর্ব–৫

আশরাফ যেভাবে সারাক্ষণ ফ্লোরার নাম জপ করতে থাকে আর ফ্লোরাকে নিয়ে মুগ্ধতার ঘোরে ডুবে থাকে তাতে প্রীতি ধরেই নিয়েছিল ফ্লোরা হয়তো পৃথিবীর সেরা সুন্দরী হবে। সেরা না হলেও অন্তত কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকার মতো আশ্চর্য সুন্দর কেউ হবে। কিন্তু এখন ফ্লোরার ছবিটা দেখে প্রীতি সত্যিই চমকে গেল। কারণ ফ্লোরা এতো আহামরি সুন্দর তো নয়ই বরং কৃষ্ণবর্ণের, কোঁকড়ানো চুলের একটি অতি সাধারণ মেয়ে। এমন একটি সাধারণ মেয়ের জন্যই আশরাফ খুব অসাধারণভাবে দিওয়ানা। ব্যাপারটা ভয়ংকর সুন্দর। মেয়েটি প্রীতির চেয়ে সুন্দরী না। তবুও তার প্রতি প্রীতির খুব ঈর্ষা। কারণ সুন্দরী না হয়েও সে যা পেয়েছে প্রীতি হয়তো সারাজীবন সাধনা করলেও তা পাবে না! আশরাফের দিকে তাকালো প্রীতি। ছেলেটা বিভোর দৃষ্টিতে তার প্রেয়সীর ছবি দেখছে। ঠোঁটে মিশে আছে আলতো হাসি। আশরাফ ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,” দেখেছো আমার ফ্লোরাকে? খুব মিষ্টি মেয়ে তাই না? সামনে থেকে দেখতে আরও মিষ্টি। শী ইজ ওয়ান্ডারফুল। ”
আশরাফ এমনভাবে কথা বলছে যেন কোনো অমৃত সুধা পান করছে। এইভাবে যদি প্রীতির ছবির দিকে আশরাফ তাকিয়ে থাকতো তাহলে প্রীতি নিজেকে ধন্য মনে করতো। ধূর, কি ভাবছে সে এসব? ভালোবাসায় কখনও জবরদস্তি চলে না। ভালোবাসা খুব পবিত্র ও স্নিগ্ধ অনুভূতি। ইচ্ছে করলেই কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মানো যায় না। আর কেবল সৌন্দর্য্য দেখে যে ভালোবাসা হয় সেটা তো মোহ। সেই ভালোবাসায় ভেজাল আছে। কিন্তু আশরাফের ভালোবাসায় কোনো ভেজাল নেই। তাই তো পৃথিবীতে এতো অনিন্দ্য সুন্দরী থাকতেও আশরাফের চোখে তার ফ্লোরাই ওয়ান্ডারফুল! প্রীতি হেসে বলল,” ঠিক বলেছেন। ফ্লোরা সত্যিই ওয়ান্ডারফুল। আমার কল্পনার থেকেও অনেক বেশি ওয়ান্ডারফুল।”
আশরাফ আগ্রহ নিয়ে তাকালো। প্রসন্ন হেসে বলল,” সত্যি প্রিটি? তাহলে এই ওয়ান্ডারফুল মেয়েটিকে তুমি হেল্প করবে তো? ওর কষ্ট মুছে দাও প্লিজ। একবার তাকিয়ে দেখো ওর আইস। কি ম্যাজিক্যাল তাই না? এই ম্যাজিকেল চোখে আমি টিয়ার্স কখনও দেখতে চাই না। ”
প্রীতি কি বলবে বুঝতে পারল না। সে তো ফ্লোরার বাবা-মাকে চেনেও না। তারা কেন ডিভোর্স করতে চায় সেটাও প্রীতি জানে না। পারিবারিক ছোট-খাটো ঝামেলা না হয় সে বুদ্ধি করে মিটিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু ডিভোর্সের মতো বড় একটা ব্যাপার সে কি করে সামলাবে?
আশরাফ মোবাইল টিপে কাকে যেন ফোন করছে। ওই পাশ থেকে ফোন রিসিভ হওয়া মাত্রই অস্থির কণ্ঠে একনাগাড়ে কথা বলতে লাগল আশরাফ। তাও ইংরেজিতে। যেভাবে বিদেশীরা ইংরেজি বলে ঠিক সেভাবে। প্রীতি তেমন কিছু বুঝল না। তবে এইটুকু বুঝতে পারল যে আশরাফ ফ্লোরাকেই ফোন করেছে। সে এখন ফ্লোরাকে প্রীতির ব্যাপারে বলছে। প্রীতি যে ফ্লোরার খুব প্রশংসা করেছে এটাও আনন্দ নিয়ে বলছে। কথার বলার ধরণটা কি সুন্দর! প্রতিটি বাক্য যেন ভালোবাসায় মোড়ানো চিরকুট।
প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে জেরিনের সাথে এখানে এসেছিল আশরাফকে ভালো-মন্দ দু’টো কথা শোনানোর জন্য। জেরিন তাকে সব শিখিয়েও দিয়েছিল। প্রীতি কঠিন মুখ করে বলতে চেয়েছিল,” বিয়ে ভাঙতে চেয়েছেন, ভেঙে দিবো। আপনার সাথে কন্ট্রাক্ট এখানেই শেষ। খবরদার আমাকে আর ডিস্টার্ব করবেন না। ”
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কথাগুলো আশরাফের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। প্রীতি এতো কঠিন হতে পারবে না। তার ইচ্ছে করছে ফ্লোরার বাবা-মায়ের ডিভোর্সের ঝামেলা সত্যি যদি মিটিয়ে দিতে পারতো! যেকোনো উপায়ে!
মানুষের ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে। আশরাফ আর ফ্লোরার ভালোবাসা সবসময় সুন্দর থাকুক। প্রীতি মনে মনে প্রার্থনা করে, তার জীবনেও এমন একটি ভালোবাসা আসুক।
আশরাফ ফোন রেখেই বিচলিত হয়ে পড়ল।
” আমাকে এখনি যেতে হবে প্রিটি। তুমি কি একা বাড়ি ফিরতে পারবে?”
” কি হয়েছে?”
” ফ্লোরা খুব বিপদে। এখানে আসার পথে ওর একটা সিরিয়াস প্রবলেম হয়েছে। এজন্যই দেরিটা হচ্ছিল। ফোন না করলে জানতেও পারতাম না।”
” তাহলে আপনার উচিৎ এখনি ওর কাছে যাওয়া। আপনি চলে যান। আমি নিজের মতো বাড়ি ফিরে যেতে পারবো।
” শিউর তুমি?”
” হুম।
” ঠিকাছে তাহলে চলে যেও। ফ্লোরার সাথে না হয় তোমাকে অন্য আরেকদিন দেখা করাবো। সেদিন ওর প্রবলেম তুমি মন দিয়ে শুনবে। আর সবকিছু সোলভ করে দিবে। করবে তো?”
” ঠিকাছে করবো।”
” থ্যাঙ্কিউ প্রিটি গার্ল।”
আশরাফ মুচকি হাসি উপহার দিয়ে দ্রুত কফিশপ থেকে বের হয়ে গেল। প্রীতি একটু থমকালো। কারণ আজকে প্রথমবারের মতো আশরাফ তাকে ভুল করে নয় বরং বুঝে-শুনেই প্রিটি ডেকেছে। আচ্ছা, আশরাফের চোখে কি সে আসলেই প্রিটি?

আশরাফ পুরোপুরি কফিশপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রীতি বুঝতে পারল সাংঘাতিক একটা ভুল হয়েছে। প্রীতির কাছে কোনো টাকা নেই। সে কিভাবে বাড়ি ফিরবে? ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বাড়ির এড্রেস ঠিক করে বলতে হবে। সেটাও প্রীতি পারবে না। জেরিন থাকলে ট্যাক্সি ঠিক করে দিতো। কিন্তু এখন জেরিনও নেই। প্রীতি মোবাইল নিয়ে জেরিনকে ফোন করতে গিয়ে দেখল তার ফোনে ব্যালেন্সও শেষ। কি ঝামেলা! অনলাইনে জেরিনকে পাওয়া গেল না। প্রীতির ভয় করতে লাগল। এই দুশ্চিন্তার মধ্যে একটা বিষয় তার হঠাৎ মনে পড়ল। আশরাফ বলছিল ফ্লোরাকে ফোন না করলে বিপদের কথা জানতেই পারতো না। তাহলে ফ্লোরা বিপদে পড়েও কেন নিজে থেকে আশরাফকে ফোন দেয়নি? প্রীতি এসব ভাবতে ভাবতে আবারও নিজের উপর বিরক্ত হলো। সে এইসময় এসব অহেতুক চিন্তা কেন করছে? তার উচিৎ এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার উপায় নিয়ে চিন্তা করা। কিন্তু কিছুই মাথায় আসছে না। প্রায় দুই-তিন ঘণ্টা প্রীতি কফিশপের রুফটপেই বসে রইল। সূর্য ডুবে সন্ধ্যা নামল। সন্ধ্যার দিকে কফিশপের ভীড় প্রচুর বেড়ে গেল। একটা টেবিলও ফাঁকা নেই। প্রীতি একপাশে নিঃসঙ্গের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। যতক্ষণ সে এখানে থাকবে ততক্ষণ নিরাপদে থাকবে। বাহিরে বের হলেই বিপদ। হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এতোক্ষণে প্রীতির একবারও মনে হলো না যে সে রিসিপশনে গিয়ে জেরিনের নাম্বারে ফোন করতে পারে। যখন এই ব্যাপারটা মাথায় এলো তখন আর ফোন করার প্রয়োজন নেই৷ কারণ জেরিন প্রীতিকে খুঁজতে খুঁজতে কফিশপে চলে এসেছে। প্রীতি জেরিনকে দেখেই উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল,” জেরিন, তুই এসেছিস? থ্যাংক গড!”
” আশরাফ ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছিল। তিনি বললেন তুই নাকি একা বাড়ি চলে গেছিস। কিন্তু বাড়িতে ফোন করে জানলাম তুই যাসনি। আমি কত টেনশনে পড়ে গেছিলাম জানিস?”
প্রীতি জীভে কামড় দিয়ে বলল,” স্যরি, আসলে আমার কাছে তো টাকা নেই। কিভাবে যাবো বল?”
” ট্যাক্সি নিয়ে চলে যেতি৷ বাড়ি গিয়ে ভাড়া দিতি।”
” এটা একদম মাথায় আসেনি।”
” গাঁধী কোথাকার!”

জেরিন আর প্রীতি কফিশপে বসে দুই কাপ কফি খেল। তারপর বাড়ি ফেরার জন্য ট্যাক্সি নিল। ট্যাক্সিতে উঠার পর প্রীতির মোবাইল বেজে উঠল। অনলাইনে ফোন করেছে অর্পিতা। প্রীতির বাংলাদেশী কাজিন। তার বড় চাচার মেয়ে। প্রীতি জেরিনের দিকে চেয়ে বলল,” অর্পি ফোন করেছে।”
জেরিন একটু থতমত খেল। সে খুব ভালো করেই জানে অর্পি কেন ফোন করেছে। জেরিনের সাথে আজ অর্পির কথা হয়েছিল। তখন জেরিন আশরাফ আর প্রীতির সবঘটনা অর্পিকে বলে ফেলেছে। এই বিষয়ে নিশ্চয়ই অর্পি এখন প্রীতির সাথে কথা বলবে। এখানেই জেরিনের ভয়টা। প্রীতির অনুমতি না নিয়ে তার ব্যক্তিগত বিষয় সে অর্পির সাথে শেয়ার করেছে। এটা জানলে প্রীতি যদি রাগ করে?
প্রীতি ফোন লাউড স্পিকারে রেখে কথা বলল,” হ্যালো অর্পি, কেমন আছিস? কতদিন পর!”
” শুনলাম তুই নাকি নিউইয়র্কে জেরিনদের বাড়িতে আছিস?”
” হুম। ঠিক শুনেছিস। পারলে তুইও চলে আয়। আমরা খুব মজা করছি।”
” কেন আসবো? বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে সাহায্য করতে নাকি তোর হবু বরের গার্লফ্রেন্ডের বাপ-মায়ের ডিভোর্স ঠেকাতে?”
এই কথা বলেই হাসিতে ঢলে পড়ল অর্পি। খুব সস্তা রসিকতা। প্রীতি বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে জেরিনের দিকে তাকালো। অর্পি এসব কিভাবে জানে? জেরিন আগে মাফ চাওয়ার উদ্দেশ্যে কানে ধরল। তারপর ইশারায় বোঝালো সে নিজেই বলেছে। প্রীতি কটমট করে তাকানো মাত্রই জেরিন নরম স্বরে বলল,” স্যরি!”
প্রীতি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে অর্পিকে উত্তর দিল,” এসব নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না। এগুলো আমার ব্যক্তিগত বিষয়।”
” ব্যক্তিত্বহীনের আবার ব্যক্তিগত বিষয়ও থাকে নাকি?”
অর্পি যেন ফোঁড়ন কাটছে। প্রীতি রেগে বলল,” কে ব্যক্তিত্বহীন?”
” তুই ব্যক্তিত্বহীন। আমার তো মনে হয় তোর চোখের চামড়া নেই। আত্মসম্মানবোধ নেই। যদি থাকতো তাহলে যেই ছেলে তোকে রিজেক্ট করল সেই ছেলের সাথে তুই আবার দেখা করতে যাস কিভাবে?”
” আশরাফ আমাকে রিজেক্ট কেন করবে? ও তো একবারও বলেনি যে ওর আমাকে পছন্দ নয়। আর যদি পছন্দ নাও হয় তাহলে এখানে ইনসাল্ট ফীল করার কি আছে? পৃথিবীর সবার যে আমাকে পছন্দ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি নিজেকে এতোটাও পারফেক্ট মনে করি না। তাছাড়া আশরাফ অন্য একজনকে ভালোবাসে। ওর ফ্যামিলি ওদের সম্পর্ক না মেনে আমার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে। আর ও জাস্ট বিয়েটা ভাঙার জন্য আমার থেকে হেল্প চেয়েছে। এখানে খারাপ কি আছে? আত্মসম্মানে আঘাত লাগার মতো কোনো ব্যাপারই আমি খুঁজে পাচ্ছি না।”
” তাই বুঝি? তোর জায়গায় আমি হলে এই ছেলের মুখও দেখতাম না। এর চেয়েও হাজার গুণ ভালো পাত্র বিয়ে করে দেখিয়ে দিতাম যে আমি কত ভালো ডিজার্ভ করি।”
” এগুলো হচ্ছে হিপোক্রিসি চিন্তা-ভাবনা। তোমার আমাকে ভালো লাগেনি মানে তোমাকে এর জন্য আফসোস করতে হবে__ মানে এটা কেমন মানসিকতা? আত্মসম্মানের দোহাই দিয়ে এসব হিপোক্রিটের মতো ইগো দেখানো বন্ধ কর প্লিজ।”
” আমি হিপোক্রিট হলে তুই কি? সিনেমার নায়িকা? এখন ভালোমানুষ সেজে আত্মত্যাগ করবি? যে তোর সাথে বিয়ে ভাঙল তার গার্লফ্রেন্ডের বাবা-মা’র ডিভোর্স ঠেকাবি?”
” বিয়ে ভেঙে ও কোনো ভুল করেনি। বরং ঠিক করেছে। একটা অসুস্থ সম্পর্ক তৈরী হওয়ার আগেই থামিয়ে দিয়েছে। ও তো আমাকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলতে পারতো। আমি কিছু বুঝতামও না। কিন্তু আশরাফ এটা করেনি কারণ ও অনেস্ট। আর ও শুধু একজনকেই ভালোবাসে এবং সারাজীবন তার সঙ্গেই কাটাতে চায়। আর ডিভোর্স ঠেকানোর কথা বলছিস? একটা মানুষ হেল্প চাইতেই পারে। আমার যদি ইচ্ছে হয় আমি হেল্প করবো। তোর এতো প্রবলেম হচ্ছে কেন?”
প্রীতির চটাং চটাং জবাব শুনে অর্পি ফোন কেটে দিল। প্রীতিও আর কলব্যাক করল না। ঠুনকো বিষয় নিয়ে ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না। কপালে হাত রেখে নিজেকে শান্ত করে নিল। তারপর প্রীতি জেরিনের দিকে চেয়ে হতাশ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” তুই এসব কেন জানালি ওকে?”
” আমি বুঝতে পারিনি যে ও ব্যাপারটা এইভাবে নিবে।”
” ও তো এমনি। জাজমেন্টাল, টক্সিক। এটা তুই জানিস না? যাইহোক, তুই একটা সত্যি কথা বলতো জেরিন। তোরও কি মনে হয় যে আমার আত্মসম্মান নেই?”
” একদম না প্রীতি। তুই খুব পরিষ্কার মনের একটা মেয়ে। ক্লিন হার্টেড গার্ল। আমি তোকে খুব পছন্দ করি।”
প্রীতি হেসে বলল,” থ্যাংকস। আমি কি ঠিক করেছি জানিস?”
” কি?”
” আশরাফ আর ফ্লোরাকে হেল্প করবো।”
” আমি জানতাম। ভেরি গুড ডিসিশন। চেষ্টা করে দ্যাখ কিছু হয় কি না। যদি সত্যি হেল্পটা করতে পারিস তাহলে আশরাফ ভাই খুব খুশি হবে। আমিও আছি তোর সাথে।”
প্রীতির হৃদয় স্বস্তিতে ভরে উঠল। জেরিনের মতো কাজিন থাকলে বেস্টফ্রেন্ডের দরকার নেই। জেরিন সবসময় প্রীতিকে খুব ভালো করে বুঝতে পারে। মাঝে মাঝে প্রীতির মনে হয় জেরিন বুঝি তার বেটার হাফ।

প্রমথ সাহেব বিছানায় শুয়ে আছেন। ডিনারে সবাই একসাথে খেতে বসেছে। প্রমথকে ডাকা হলো। কিন্তু তিনি এলেন না। জানালেন শরীর খারাপ। প্রীতি নিজের আর বাবার খাবার নিয়ে বেডরুমে চলে এলো। খাবার টেবিলে রেখে বাতি জ্বালিয়ে নিল। বাবার কাছে গিয়ে আদুরে স্পর্শে কপালে হাত বুলিয়ে বলল,” আব্বু কি হয়েছে? শরীর কি বেশি খারাপ?”
প্রমথ সাহেব চোখ বন্ধ রেখেই মুচকি হাসলেন।
” নারে মা। বেশি খারাপ না। ”
” তাহলে খেতে এলে না যে?”
” বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। তুই খেয়েছিস?”
” উহুম। জীবনে কখনও তোমাকে রেখে খেয়েছি? চলো একসাথে খাবো। খাবার এখানে নিয়ে এসেছি। ওঠো, উঠে বসো।”
প্রীতি বাবাকে জোর করে উঠিয়ে বসাল। প্লেট এগিয়ে দিল। প্রমথ সাহেব খাওয়া শুরু করার আগে প্রীতিকে বললেন,” তুইও বস।”
” বসছি।”
প্রীতি বাবার মুখোমুখি বিছানায় খেতে বসল। একটু পর বলল,” আচ্ছা আব্বু, ফুপুর সাথে কি তোমার কিছু হয়েছে?”
প্রমথ সাহেবের খাওয়া এক মুহূর্তের জন্য থামল। পরে তিনি আবার স্বাভাবিক হয়ে খেতে লাগলেন। বাবার বিষণ্নতা প্রীতির চোখ এড়ালো না। প্রমথ বললেন,” না। কি হবে?”
” মিথ্যে। ”
প্রমথ সাহেব মাথা নিচু করে থাকলেন। মেয়ের কাছে মিথ্যে বললে সবসময় ধরা পড়েন তিনি। কারণ প্রীতি তার মেয়ে নয়, মা। মায়ের কাছে মিথ্যে বলতে গেলে ধরা তো খেতেই হবে। প্রীতি চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,” আমি কি জানতে পারি কি হয়েছে? যার জন্য তুমি রাতের খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে যাচ্ছিলে? নিশ্চয়ই সিরিয়াস কিছু!”
প্রমথ সাহেব চুপ করে খাবার খাচ্ছেন। সত্যি কথা বলতে গেলে এখন প্রীতি চিল্লাচিল্লি করবে। ফুপুর সাথে ঝগড়াও করতে যেতে পারে। কি দরকার ফুপু-ভাতিজির সম্পর্ক নষ্ট করার? প্রীতি খাবারের প্লেট নামিয়ে বলল,” তুমি কথা বলছো না কেন? আমি খাবো না।”
প্রমথ সাহেব পালটা হুমকি দিলেন।
” ঠিকাছে না খা। আমিও তাহলে রাতের ঔষধ খাবো না।”
প্রীতি বিরক্ত গলায় বলল,” ঠিকাছে। না বললে নেই। আমি জোর করে জানতে চাইবো না। যখন ইচ্ছে হবে তখন অন্তত বোলো।”
” দেখা যাবে। খাওয়া শেষ কর।”
প্রীতির মনে হলো, গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলার উপযুক্ত সময় এখনি। কিভাবে কি বলবে সব ঠিক করা আছে। শুধু বলতেই প্রীতির ভয় লাগছে। বাবা বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ খুশি। এই বিয়ে ভাঙলে তিনি কষ্ট পাবেন নিশ্চিত। কিন্তু বিয়েটা হয়ে গেলে আরও বেশি কষ্ট পেতেন। সেই কষ্টের কাছে এই কষ্ট কিছু না। প্রীতি মাইন্ড সেট করে বলতে নিচ্ছিল তার আগেই প্রমথ সাহেব বললেন,” খাওয়া শেষ হলে আমার ফোন থেকে সরফরাজ ভাইকে একটু অনলাইনে কল লাগিয়ে দিস। জরুরী কথা বলবো।”
” কেন? কি জরুরী কথা বলবে?”
” বিয়ের ডেইট এগিয়ে আনবো। একমাস না, এক সপ্তাহের মধ্যে যেন বিয়েটা হয়ে যায়।”
প্রীতি বিস্ফোরিত কণ্ঠে বলল,” কেন আব্বু?”
” এমনি। তোর বিয়ে দিয়ে আমি দ্রুত দেশে ফিরবো। অনেক কাজ।”
” আমি এতোবড় বোঝা হয়ে গেছি তোমার? তাড়ানোর জন্য একদম উঠে-পরে লেগেছো?”
প্রমথ এবার নরম গলায়,” মারে, তুই এই কথা কেমনে বললি মা? তুই আমার বোঝা! আমার শুন্য জীবনের একমাত্র পূর্ণতা তুই। বোঝা না, তুই হলি আমার সম্পদ!”
” জানি বাবা। তাহলে কেন তুমি তোমার সম্পদ অন্যকাউকে দিয়ে দিতে চাইছো?”
প্রমথ হেসে বললেন,” তো বিয়ে কি দিবো না তোকে?”
প্রীতি কিছু মুহূর্ত চেয়ে রইল। একটু পর এক নিশ্বাসে বলে উঠল,” বাবা আমি এই বিয়ে করবো না। তুমি সরফরাজ আঙ্কেলকে ফোন করে আজকের মধ্যেই বিয়ে ভেঙে দিবে।”

চলবে