সুখ একটি প্রজাপতি পর্ব-৮+৯

0
1962

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৮)

ট্যুর থেকে ফেরা হয়েছে এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে অভিনব কল করল না। ঝিল নিজেও বসে নেই কলের অপেক্ষায়। সেই ছেলেটির সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। এমন সবই নিজেকে বুঝিয়েছে মেয়েটি। তবে সব কিছু ঠেলে ঠিকই চেয়ে রইল ফোনের পানে। বেলা বাজে দুইটা। এ সময় ওদের বাসায় লাঞ্চ হয়। সকলে একসাথে। ঝিল উঠে এলো। গত কয়েকদিন হেলায় দিন পার করেছে। এভাবে চললে পাপা আর ভাইদের মনে সন্দেহ হবে। ঠিকই খুঁজে বের করবে এর পেছনের কারণ। আর তারপর,তারপর কি হবে ঝিল জানে না। ভাবতেও চায় না। ওর মন বলে সব ঠিক থাকুক। ডাইনিং এ আগে থেকেই বসা ছিলেন ইকবাল মির্জা। মেয়েকে দেখে কাছে ডাকেলন। “এসো মামুনি, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

“ভাইয়ারা কোথায় বড় পাপা?”

“আসবে,তুমি বসো আগে। কথা আছে।”

ঝিল বসতেই নিজ হাতে খাবার বেড়ে দিলেন ইকবাল মির্জা।
“ট্যুর কেমন হলো?”

“ভালো বড় পাপা।”

ঝিল খাবার মুখে তুলল। আজকাল ওর সব খানেই অস্বস্তি। একটা ঘটনা কতটা বদল ঘটিয়েছে। ইকবাল মির্জা উঠে এলেন। মেয়েকে বোঝার চেষ্টা করছিলেন তিনি। সত্যি বলতে ঝিলের সাথে বেশি কথা হয় না। খুবই অল্প সময়ের আলাপ। এত ব্যস্ততা জীবনে না থাকলেও পারত। তাহলে হয়ত মেয়েটিকে আরেকটু ভালো রাখতে পারতেন।

অভিনব গত রাত্রিতে খুব ব্যস্ত আর ক্লান্ত থাকায় আলাপ করতে পারে নি মাহেরা। সকাল হতে না হতেই উঁকি ঝুকি শুরু। অভিনবর অভ্যাস সকালে গোসল করা। ছেলেটা সবে গোসল করে এসেছে। বলিষ্ঠ বুকে জমে আছে পানি কনা। পেশিবহুল ফর্সা হাত দেখলেই লোভ জাগে। ভদ্রতা জানে মাহেরা। তাই শুরুতেই নক করল।
“আসব?”

মেয়েটিকে একবার কি দুবার দেখেছে অভিনব। আরফান ভাইয়ের শালিকা। তবে পরিচয় নেই। অনুমতি পেয়ে প্রবেশ করে মাহেরা। ততক্ষণে টি শার্ট পড়ে নিয়েছে অভিনব। ছেলেটির সৌন্দর্য্য নিয়ে বরাবরই ভীষণ আগ্রহ। তবে সেটার বহিঃপ্রকাশ করল না। অতি সাধারণ ভাবে পরিচয় দিল।
“হায় আমি মাহেরা, মুনতাহা আপুর ছোট বোন।”

“হ্যালো। গত দিন আপনাকে দেখেছিলাম। ভীষণ পরিশ্রান্ত থাকায় কথা হয় নি।”

“উম ব্যাপার না। এক বাড়িতে আছি যখন তখন কথা হবেই।”

“তা অবশ্য ঠিক। আপনি বসেন প্লিজ।”

“থ্যাংকস। আচ্ছা অভিনব, মোস্ট প্রবাবলি আপনি আমেরিকায় স্ট্যাবল। এম আই রাইট?”

“হ্যাঁ।”

চমৎকার হাসল অভিনব। মাহেরা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে। এ চোখের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় না ছেলেটার। তবু ভদ্রতার খাতিরে কথা আগায়। মাহেরার ব্যবহার চমৎকার। দেখতেও দারুণ সুন্দরী। কিন্তু অভিনব, সে কি চাইবে এই মেয়েটির হাত?

আজও মৌনতা লেট! ওকে ফেলেই শপিং এ চলে গেছে সবাই। মেয়েটি বোকা নয় তবে কাজে ধীর। বিশেষ করে ঘুমের জন্য। এই ঘুম ই ওকে এক ধাপ পিছিয়ে নিয়েছে। চলতে চলতে আচানাক জুতো ছিঁড়ে গেল। ইচ্ছে করছে এখানে বসেই কান্না জুড়ে দিতে। কিন্তু সময় নেই। একি বিপদ। কান্নার জন্যও সময়ের প্রয়োজন! জুতো হাতে নিয়ে এদিক সেদিক তাকায়। উঁহু নেই কোনো কাকপক্ষীও। এমন হলে চলে নাকি!
অসময়ে বন্ধু হয়ে এলো তরুণ। ছেলেটা এ পথেই যাচ্ছিল। ওকে দেখেই গাড়ি থামিয়েছে। হাতে জুতো দেখে বেশ হাসি পাচ্ছে। এসবে মৌনতার ভ্রু বেঁকে বসে। একটা বিরক্তি নামে। ঝিল ঠিক ই বলে অভিনব আর তরুণ দুই বন্ধু এক ধাঁচের ই প্রানী। অদ্ভুত আর আস্ত
শ য় তা ন!
“লজ্জা করে না বিপদে পড়া এক মেয়েকে দেখে এভাবে হাসতে?”

মেয়েটিকে পাত্তাই দিল না। বরং আরও এক ধাপ এগিয়ে শব্দ করে হেসে উঠল। এসবে ভীষণ রাগ হয় মেয়েটির। কোনো কিছু না ভেবেই হাতে থাকা হ্যান্ড পার্স দিয়ে আঘাত করে বসে। তরুণ প্রায় হতভম্ব! ঝিল যদি হয় লঙ্কা তবে ম‍ৌনতা সেই লঙ্কার ঝাল।
“কোথায় যাবে?”

“যাব না কোথাও।”

“ওমা, তাহলে বের হয়েছ কেন?”

“জানি না।”

“আচ্ছা, স্যরি। তোমরা দুই বান্ধবী এক একজন অষ্টম আশ্চর্য।”

মৌনতা প্রায় হুংকার তুলে বলল “কি?”

“রিলাক্স, এত হাইপার কেন হও? কোথায় যাবে বল নামিয়ে দিব।”

মেয়েটি ইষৎ অস্বস্তি বোধ করছে। তরুণ চাঁপা হাসল। ভরসা দিয়ে বলল “আমি খারাপ নই।”

সামান্য লজ্জায় পড়ে মৌন। এদিকে লেট হয়ে গেছে। রিক্সার দেখা নেই। মিলবে ও না বোধহয়। নিশ্চয়ই ওরা শপিং শেষ করে ফেলবে। আর কথা বাড়ায় না মেয়েটি। নীরব কৃতজ্ঞতায় উঠে বসে গাড়িতে। মাথা হেলায় সিটে। তরুণ হাসে। দুই বান্ধবীই ভীষণ অদ্ভুত!

রোহনের চোখ লাল হয়ে আছে। ঝিল প্রায় ছুটে এসে বলল “কি হয়েছে, মৌন কোথায়? আনো নি?”

কথা নেই রোহনের মাঝে। ঝিল বুঝতে পারছে না কিছুই। হতাশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরেই গাড়ি এসে থামল। তরুণকে ধন্যবাদ জানিয়ে এপথেই আসছে মৌন। ঝিল বুঝতে পারল কারণটা। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে একরাশ ব্যথা অনুভব হয়। মৌনতা আর রোহনের সম্পর্কটা সম ধর্মী চার্জের মতো। এরা সর্বদা পরস্পরকে বিকর্ষণ করে।
.

ঝিলের দ্বারা একটি ভুল হয়েছে। অভিনব এতদিনে কল করেনি একটিবার। মনের ভেতর উসখুস লাগছিল। নাম্বারটা বার বার রিপিট করছিল। আর তখনি হাত লেগে চলে যায় কল। মেয়েটি আঁতকে উঠে। মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। আর তারপর, ফোন অফ করে বসে থাকে। এই ভয়ের জন্য প্রায় তিন ঘন্টা ফোন অফ করেছিল। একটু আগেই আহনাফ কল করে ফোন বন্ধ পায়। খবর পাঠায় ফোন অন করার জন্য। কিন্তু ভয়ের চোটে ফোন অন করতে পারছে না। মাথায় একটা যন্ত্রণা চেপে বসেছে। একটি ছেলে ওর জীবনটাই বদলে দিল। ভয়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফোন অন করে ঝিল। আহনাফকে কল করলে আহনাফ জানায় ফিরতে লেট হবে। খেয়ে ঘুমিয়ে যেতে। অন্যদিন এমন হলে ওর মন খারাপ হতো। ভাইয়ের সাথে অভিমান করত। আজ তেমন কিছুই হলো না। বরং চাঁপা আনন্দের উদয় হলো। কল রেখে চাতক পাখির মতো বসে রইল। বার বার দেখছে ফোন। ইস যদি শোনা যায় মানুষটির কণ্ঠ!
সে রাত্রিতে কল এলো না। অভিনবর বেহিসেবি বিচরণ ঝিলকে পীড়া দেয়। বড্ড অভিমান জাগে। এর কোনো মানে নেই তবু মনে হয় কেন এলো না কল? রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছে। ভোর রাতে শীত শীত অনুভব হচ্ছিল। কুকরে যাচ্ছিল শরীর। প্রতিটা লোমকূপ ভীষণ সজাগ।মেয়েটির ঠোঁট উল্টানি দেখে অভিনব হেসে ফেলল। ঝিলের এই বিশেষ ধরণের স্বভাব ওর ভালো লাগে। ইচ্ছে করে আদর করে দিতে। ইচ্ছাকে মূল্য দিল মেয়েটি। মেয়েটির তেলচিটচিটে গালে নাক ঘষতে লাগল। এ স্পর্শ ঝিলের চেনা নয়। তবে ভীষণ ভালো লাগছে। ঘুমের ঘোরে হাত বাড়িয়ে আরেকটু কাছে টানল। অভিনবর টনক নড়ে। চটপট সরে আসতে চাইল। অথচ মেয়েটি নাছোড়বান্দা। ফের চেষ্টা করল না ছেলেটি। ওভাবে বসে রইল। আঙুলের অগ্রভাগ ঠোঁটে ঠেকিয়ে চেয়ে রইল নিরন্তর।

ভোরের আলো এসে স্পর্শ করতেই মেয়েটির ঘুম ভাঙল। হাতে একটু টান অনুভব হয়। মাথাটা উঁচু করতেই দেখতে পায় বলিষ্ঠ দেহের মানুষটিকে। বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করে না। ছেলেটার অবিন্যস্ত চুলে আনমনেই হাত গলিয়ে দেয়। অভিনবর ঘুম পাতলা। হাল্কা স্পর্শেই জেগে যায়। তবে বুঝতে দেয় না। দেখতে থাকে ঝিলের কান্ড। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না সে অনুভূতি। ঝিল গর্জে উঠে, “ফের এসেছেন! আপনি কি আমায় শান্তিতে থাকতে দিবেন না।”

মেয়েটির হঠাৎ গর্জনে অভিনব উঠতে বাধ্য হয়। আড়মোরা ভেঙে বলে “আপনিই তো ডেকেছেন প্রজাপতি।”

“আমি ডেকেছি মানে!”

“সেটা তো আপনার অজানা নয়। তবে কিসের এত হেয়ালি।”

“হেয়ালি তো আপনি করছেন। একটা মানুষের জীবনকে এলোমেলো করে দিয়ে ঠিকই সুখে আছেন।”

চমৎকার হাসে অভিনব। ঝিলের নাকের দু পাশে জমে থাকা সারারাতের তেল আঙুলে মুছে নিয়ে বলে “সুখ তো অনেক দামী জিনিস ঝিল। আমি আর সুখের সমীকরণটা হচ্ছে গরীব বামন আর অহংকারী চাঁদের মতোন।”

শব্দগুলো ঝিলের চিত্ত কাঁপায়। আর কিছু বলতে পারে না মেয়েটি। অভিনব নিস্তব্ধ সুরের ইতি টানে। ভরাট গলায় বলে উঠে,
“পালিয়ে যাবেন আমার সাথে?”

অসময়ে এমন অদ্ভুত কথা শুনে ঝিল ভয় পেয়ে যায়। গলা শুকিয়ে হয় কাঠ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতে পারল না। এবার ছেলেটা শব্দ করেই হেসে উঠে। দূরত্ব কমিয়ে কাছে আসে।
“আপনার ভয়ার্ত মুখ, কি যে সুন্দর তা যদি আপনি জানতেন তবে সারাক্ষণ ই ভয় পেতেন।”

কেন যেন মেয়েটি রাগ দেখাতে পারে না। বরং হেসে উঠে শব্দ করে। অভিনবর ভালো লাগে। মেয়েটার মাথায় নরম স্পর্শ করে। এক চিলতে হাসি রাখে ঠোঁটে,
“প্রজাপতি এভাবেই সর্বদা হাসতে থাকুন আপনি। দুঃখ যেন আপনাকে স্পর্শ না করে। আপনার সব দুঃখ আমার হোক আমি আমার সমস্ত সুখ আপনার চরণে দিব।”

চলবে….

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৯)

তিনদিন ধরে বাড়ি নেই আরফান। কান্না আর অতিরিক্ত টেনশনের ফলে মুনতাহার যা তা অবস্থা। বাড়ির সকলে মেয়েটিকে ভীষণ ভালোবাসে। অথচ স্বীয় স্বামীর থেকে অবহেলা সহ্য করতে হয় প্রতিনিয়ত। ভালোবাসার ছিঁটে অবধি নেই! মুনতাহা ধৈর্য্য ধরে চার খানা বছর সংসার করল। আশা তো একটাই আরফানের ভালোবাসা। ওর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ছেলেটা প্রচন্ড ভালোবাসা দিবে। কিন্তু এর লেশমাত্র নেই! মেয়েটির ডাগর দুটি চোখে নেমেছে বিষণ্নতা। একটু আগেই কল করেছিল। ধরেছে একটি মেয়ে। এর আগেও এমনটা হয়েছে। আজ মুনতাহার সহ্য হচ্ছে না। দিনের পর দিন শার্টে পাওয়া লিপস্টিকের দাগ আর মেয়েলি পার্ফিউমের সুবাস। এসব অনেক কিছুই বলে দেয়। তবু নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে এসেছে। আজ কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। যন্ত্রণায় মাথা খারাপ। গুমোট অনুভূতিতে মেয়েটির হৃদয় হচ্ছে চুরমার। এভাবে আর নয়। চারটে বছর কম সময় নয়। এমন করে আর যাই হোক সংসার হয় না। দীর্ঘ চার বছরের ব্যর্থতা নিয়ে মুনতাহা উপস্থিত হয় সমঝোতার প্রয়াসে। এত গুলো কথা জানাতে ওর ভীষণ লজ্জা লাগছিল। স্বীয় স্বামী যে কি না দিনের পর দিন অবহেলা করেছে ভালোবাসার সীমা শুধমাত্র মাঝ রাত্রিতে। এসব আর কত দিন? মেয়েটি হৃদয় আর মস্তিষ্কের কোন্দলে দম বন্ধ হয়ে আসে। সব কিছু বলে পাথর বনে যায়। ওকে অবিশ্বাস করার মতো কোনো কারণ নেই। ইববান শিকদার বিচক্ষণ মানুষ। ছেলের খামখেয়ালিপানা নজরে এসেছে বৈকি। তবে বাহিরের মশ্রিণতা দেখে ঘাটাতে চান নি। তিনি ভেবেছিলেন সংসারে তো সুখ আছে। মুনতাহার তো কোনো অভিযোগ নেই। বর‍ং সর্বদা চোখে ছিল প্রাপ্তি। ওনার সমস্ত ধারণা আজ বদলে গেল। আরফানের মা আবিদা বেগম নির্বাক। ছেলের এই কর্মকান্ড ওনার হৃদয়ে বেদনা দিচ্ছে। মা হিসেবে অযোগ্য মনে হয়।
“এসব আগে জানানো উচিত ছিল মুনতাহা। তুমি এ বাড়ির বউ হওয়ার পূর্বে আমার মেয়ে। আমি চাইব না আমার এক সন্তানের জন্য আরেক সন্তান যন্ত্রণায় ভাসুক। আরফান ফিরলে এর একটা বিহিত করা হবে।”

“বাবা আমি আর পারছিলাম না। আমার সহ্য হচ্ছে না এতসব। দিনের পর দিন এত অবহেলা আমি সত্যিই নিতে পারছি না। কখনো অভিযোগ করেছি? আমায় ভুল বুঝবেন না। আমি সত্যিই ভেঙে গেছি।”

“শান্ত হও মা, তোমায় সর্বদা স্বাধীনতা দিয়েছি। বরং আমি এটা ভেবে কষ্ট পাচ্ছি দীর্ঘ চার বছর ধরে এত সব সহ্য করছো তুমি। ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো। আবিদা ওকে রুমে নিয়ে যাও।”

মেয়েটি এলেবেলে ভাবে ঘরে চলে গেল। ইববান শিকদারের কপালে চিন্তার রেখা। ওনার ছেলেটা এত পঁচে গেল কবে?

সে রাত্রিতে বড়সড় ঝামেলা হলো। শুরুতেই আরফান অভিযোগ করল,
“এখন কেন দোষারোপ করছো? আমি বলেছিলাম ওকে আমার পছন্দ নয়। তবু তোমরা শুনলে না।”

“ভদ্রতা বজায় রাখবে আরফান। কথা বার্তায় এতটা আবর্জনা মিশে গেছে!”

“মাফ করবেন বাবা। আপনি আমার মন কে গুরুত্ব না দিয়ে এমন এক মেয়ের সাথে আমায় জড়ালেন যাকে কোথাও নিতেও আমার রুচিতে বাঁধে।”

“কি হচ্ছে কি আরফান! এত দিন পর কেন তোমার এসব মনে হলো?”

“অনেক আগেই মনে হয়েছে মা। তোমাদের বলেছিলাম এই মেয়ের সাথে আমার যায় না। তবু তোমরা…।”

এত গুলো কথা চুপ করে শুনছিল মেয়েটি। দু চোখে পানি নেই। অথচ ওর হৃদয়ে ভীষণ কান্না। ভেতরে ভেতরে চলছে কান্নার রোল। ধৈর্য্য ওকে এই অবধি এনেছে। অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করত।
“বাবা, মা আমি কিছু বলতে চাই।”

একবার তাকালো ও না আরফান। টান হয়ে দাঁড়িয়ে। ইববান শিকদার মেয়েটির মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন। তবে জোর দিয়ে আদৌ কি সংসার হয়?
“আপনার ছেলে সম্ভবত আমার থেকে মুক্তি চায়। আমি চাই তাকে মুক্তি দিতে।”

কথাটা হজম করে নিলেন ইববান শিকদার। অন্য সময় হলে তিনি কি করতেন জানা নেই। তবে এই মুহূর্তে সত্যিই ওনি কথা বলতে পারলেন না। আবিদা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আলগোছে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মুনতাহা। অভিনব বাইরেই ছিল। অনেক গুলো কথা ওর কানে এসেছে। মুহতানা ইষৎ হাসার চেষ্টা করল।
“কখন এলেন ভাইয়া?”

“এই তো মাত্র।”

“চা খাবেন তো? আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।”

অভিনবর হৃদয় ভেঙে দীর্ঘশ্বাস নামে। মেয়েটিকে দেখে মনে হয় না এ এক বিষাদসিন্ধু। উপরটা কতটা পরিচ্ছন্ন রেখেছে। এমন এক মানুষের মর্ম বুঝতে পারছে না আরফান ভাই!
.

ছোট্র বক্সটার ভেতরে রাখা ছিল লকেটটা। সেটা খুঁজে পাচ্ছে না ঝিল। বাক্স সহ অদৃশ্য হয়ে গেছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা না! অনেক যত্নে ছিল সেসব। মেয়েটির ব্যকুলতা দেখে চলেছে খাঁচায় বন্দী পাখি দুটো। মাঝে মাঝে ডেকে চলেছে। আরও কিছুক্ষণ খুঁজে কান্নায় ডুবে গেল। পাখি দুটো সেই কান্নার সাথে তাল মিলিয়ে ডেকে যায়। মেয়েটি উঠে আসে খাঁচার কাছে। নিশ্চুপ হয়ে যায় দুটি প্রাণী। ওর ভীষণ মন খারাপ। চোখের নিচে থাকা জল বিন্দু মুছে নিয়ে খাঁচা নামিয়ে চলে আসে ব্যলকনিতে। ওর ঘরের সাথে লাগানো বারান্দাটা বিশাল বড়। এক পাশে সারি সারি গাছ। দেখলেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে যায়। মেয়েটির কোমল ত্বকে ছুঁয়ে যায় হাল্কা বাতাস। হৃদপিন্ডের শব্দ বেশি। পাখি দুটো ফের ডেকে উঠে। মুক্ত করে দেয় ঝিল। গোল গোল ঘুরে উড়ে যায় ওরা। মেয়েটি ঘরে চলে আসে। এই মাঝ রাত্রিতে একটা নিঃসঙ্গতা লেপ্টে আছে। এই সময়টায় সব থেকে বেশি মনে পড়ছে মা নামক মানুষটিকে। প্রিয় মানুষেরা এত দ্রুত কেন হারিয়ে যায়?

জাফর মির্জা একটু রগচটা। বদমেজাজি আর কিছুটা একরোখা। তবে ভেতরটা কোমল। খুব কাছের মানুষ ব্যতীত এ সত্য কেউ জানে না। বাবার রুমের কাছের এসে ঝিল দেখতে পায় ভদ্রলোক চেয়ারে শুয়ে। ভীষণ মায়া হয়। কোনো কথা বলার পূর্বেই ভেতর থেকে শব্দটা কানে আসে, “ভেতরে এসো।”

চমকায় না মেয়েটি। ও জানে বাবা কতটা বিচক্ষণ। জাফর মির্জা চোখ খুলেন। হাতের ইশারায় মেয়েকে কাছে ডাকেন। দুজনের চোখেই ঘুম নেই। এই দিনটায় গত কয়েক বছর কি ঘুমাতে পেরেছেন ভদ্রলোক?
“জেগে আছ পাপা?”

“হু,ঘুম আসছে না।”

“ডাক্তার বলেছিলেন তোমার ঘুমের প্রয়োজন। অনিয়ম যেন না হয়।”

“দু একটা অনিয়মে কিছু হবে না মামুনি। থাক না জীবনে কিছু অনিয়ম। খুব ক্ষতি নেই এতে।”

কথাটা ভীষণ ভালো লাগে মেয়েটির। জাফর মির্জা মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। তিনি তো জানেন প্রতি বছরের মতো মেয়েটি ওনার নিকট ছুটে আসবে। একি ভাবে বলবে জেগে আছ পাপা। চোখ আবছা হয়ে আছে। জল গড়াতে চাইলেও গড়াতে দেন না। ওনার মেয়েটা যে ভীষণ আবেগে ঠাসা।

সকাল থেকেই আয়োজন চলছে। প্রতি বছরের মতো এ বছর ও সকল ধরণের ব্যবসায়িক কাজ বন্ধ। ঝিল গোসল করে এসে বসল সবার সাথে। ভীষণ ব্যস্ত সবাই। হাজার খানেক মানুষের আয়োজন। খাবারের সাথে রয়েছে পোশাকের ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে কারো হাতে সময় নেই।
“এ জামা কেন পড়েছ? তোমার জন্য তো নতুন জামা রেখেছি মামুনি।”

“পাপা,আমি একটা আবদার করব। দিবে প্লিজ?”

মলিন হাসলেন জাফর মির্জা। মেয়ের মাথায় হাত রেখে শুধালেন, “হ্যাঁ নিশ্চয়ই।”

“আম্মুর বিয়ের শাড়িটা দিবে আমায়?”

বুকের ভেতর ধক করে উঠে জাফর মির্জার। ভদ্রলোকের চোখের কোণ ভিজে। অস্পষ্ট দৃষ্টির সাথে ঠোঁট প্রসারিত করেন। আলমারিতে থাকা ভীষণ যত্নে রাখা শাড়িটা নিয়ে আসেন। সাথে কিছু গহনাও। ঝিল সেসব নিয়ে যায়। মনিরুল মির্জা ছোট ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখেন। মলিন চোখে তাকায় জাফর মির্জা। এ সময়ে ভীষণ কান্নার প্রয়োজন হলেও তিনি কান্না করতে পারছেন না।

মায়ের শাড়ির প্রতি মেয়েদের দূর্বলতা থাকে। প্রতিটা মেয়েরই ইচ্ছে হয় বউ সাজার। এর প্রথম ধাপ বোধহয় মায়ের শাড়িতেই পূর্ণ হয়। শাড়িটা বুকে ধরে গন্ধ নেয় ঝিল। মায়ের শরীরের ঘ্রাণ যেন এখনো স্পষ্ট! বাবা কতটা যত্নে রেখেছিলেন। শাড়িটা জড়িয়ে নেয় ঝিল। লাল রঙটা ওকে একটু বেশিই সুন্দর করে তুলে। কোনো রকম প্রসাধনী ছোঁয়ায় না। মা তো এভাবেই সাজতেন। অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন তিনি। মেকাপের প্রয়োজন হতো না। ভদ্রমহিলা যখন বের হতেন তখনি পেছনে ছেলেদের লাইন লেগে যেত। তবে কারো কপালেই জুটেন নি তিনি। নিজের ভালোবাসা দিয়ে জয় করে নেন জাফর মির্জা। কত সুখের সংসার ছিল। বিয়ের দিন থেকে শুরু করে আজ অবধি মায়া ভালোবাসা সবটাই কেবল বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি সে বয়স আর সুযোগ থাকত তবে নিশ্চয়ই পাগলামি করে বসতেন জাফর মির্জা। মা বাবার ভালোবাসা গুলো মনে করে হেসে ফেলে ঝিল। বেরিয়ে আসে। মেয়েটি যখন সিঁড়ি দিয়ে নামে জাফর মির্জা থমকে যান।
“আম্মুর মত সুন্দর লাগছে আমায়?”

“তাঁর থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে মা।”

বাবার বুকে মাথা রাখে ঝিল। জাফর মির্জার দুটি চোখ এবার সত্যিই ভিজে উঠে। গড়িয়ে যায় দুটি ফোঁটা।
“আমরা এভাবেই মনে রাখব আম্মুকে। তুমি কষ্ট পেও না পাপা।”

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে