সুখময় বৃষ্টি পর্ব : ৪

0
995

সুখময় বৃষ্টি পর্ব : ৪
#লেখা : রায়না মনি

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ধারা বাইরে হাত রেখে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখলো সেদিনের সেই লোকটা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। ধারা খুশিতে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না! কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে । তারপর ভাবলো, না এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে না। আজ কিছুতেই লোকটাকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।
ধারা ব্যালকনি থেকে রুমে গিয়ে একটা ছাতা নিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেল। গেটের বাইরে এসে রাস্তার দিকে তাকালো, লোকটাকে এখনও দেখা যাচ্ছে। ধারা খুব দ্রুত পায়ে হেঁটে লোকটার দিকে এগোতে লাগলো।
ধারা লোকটার অনেকটা কাছে চলে আসলো। নিজের মাথা থেকে ছাতাটা সরিয়ে পিছন থেকে লোকটার মাথায় ধরতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। ধারা আরও কয়েকবার লোকটার মাথায় ছাতা ধরতে চেষ্টা করলো। কিন্তু যত বারই ছাতা ধরতে চেষ্টা করেছে, তত বারই লোকটা কেমন করে যেন সামনে চলে গিয়েছে। ধারা এবার লোকটার একেবারে কাছাকাছি এসে পিছন থেকে ছাতাটা ধরলো।
হ্যাঁ, এবার ছাতাটা ধরতে পেরেছে। লোকটা হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। ধারার হার্টবিট বেড়ে গেল। লোকটাকে দেখার এত ইচ্ছা ছিল সেটা আজ পূরণ হয়ে যাবে, ভাবতেই ধারার খুব আনন্দ হলো। লোকটা পিছনের দিকে ফিরবে ফিরবে এমন সময় ধারার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
তার মানে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল? ধারা ধরফরিয়ে উঠে বসলো। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। টের পেল হার্টবিট এত বেড়ে গেছে যে, মনে হচ্ছে বুকের ভিতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে। ধারার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এটা স্বপ্ন হওয়ার কী দরকার ছিল! বাস্তবে হলে কী সমস্যা হতো?
আর যদি স্বপ্নই হবে তাহলে লোকটা পিছনে ফিরবে এমন সময়ই কেন স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেল! লোকটাকে একটু ভালো ভাবে দেখাও গেল না! ধারা নিরাশ ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা আনলো, দেখলো রাত আড়াইটা বাজে। এখন আর ঘুমিয়ে কাজ নেই, সেহরী খেয়ে তারপর ঘুমালেই ভালো হবে। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো লোকটার কথা।

সকালে কোচিং ছিল ধারা কোচিং করতে যায়নি।
বিকালে প্রাইভেট পড়তে গেল, সাথে অর্কও গেল। দিয়াকে অনেক বার বলেছিল সাথে আসতে কিন্তু সে আসেনি। তার নাকি মাথা ব্যথা করছে। ওরা দুজন ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে দিয়া মিথ্যা বলেছে। মাথা ব্যথার বাহানা দিয়ে ওদের কাছ থেকে দূরে থাকলো।
সকাল থেকেই ওরা লক্ষ্য করেছে দিয়া মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত ছিল। ওদের কাছে বেশি আসেনি। ওরা দুজন ঠিক করলো সোমা টু নাম দিয়ে যে নাম্বারটা সেইভ করা আছে, ওই নাম্বারটা নিয়ে কল দিয়ে দেখবে।
অর্ক, ধারা বাসায় আসলো সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে। যখন ধারা ওর রুমের কাছে গেল তখন রুম থেকে দিয়ার চাপা কণ্ঠ শুনতে পেল। দিয়া বলছে, “এমন করছো কেন? আমি এখন ভিডিও কলে আসতে পারবো না। রাতে ফেসবুকে কথা হবে। ভালো থাকো, রাখছি।”
ধারা দাঁড়িয়ে পড়লো। দিয়া ফোনে কথা বলছে নিশ্চয়ই ।
ধারা যখন রুমে ঢুকতে যাবে, তখনই দিয়া রুম থেকে বের হয়ে আসলো। ধারাকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ধারা কিছু শুনে ফেলেনি তো? একটু হেসে বললো,
“তোরা আসছিস। কখন আসলি ? আমি সেই কখন থেকে তোদের জন্য অপেক্ষা করছি।”

“এই মাত্রই আসলাম আপু ।”

” ও আচ্ছা আমি নিচে যাই। ইফতারির সময় তো হয়ে গেছে তুই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে আস ।”

ধারা মনে মনে বলছে, ‘আপু তুমি যতই লুকাতে চেষ্টা করো না কেন, আমরা সব কিছু জেনেই ছাড়বো।’

সন্ধ্যার পরে ওরা তিনজন ছাদে গেল। অর্কর ইউটিউবে সমস্যা হয়েছে, এই বাহানা দিয়ে দিয়ার ফোনটা একটু চাইলো। বললো একটা মুভির ট্রেইলার দেখেই দিয়ে দিবে।
অর্ক ফোনটা নিয়ে একটু দূরে গেল, তারপর সেই নাম্বারটা নিলো। তারপর ফোনটা দিয়ে দিলো। অর্ক আর ধারা অনেকক্ষণ ধরে ছাদে বসে রইল, কিন্তু দিয়া শরীর খারাপ লাগছে বলে নিচে চলে গেল। দিয়া যাওয়াতে ওদের সুবিধাই হলো, কারন ওরা এখন তদন্ত করবে।
অর্কর ফোনে দুটো সিম আছে। একটা মেলা থেকে কিনেছিল, ওটা শুধু কিনেই রাখছে কারো কাছে কখনও কল দেয়নি। ওই সিমটা দিয়েই সেই নাম্বার টায় কল দিলো।
কল দেওয়ার পরে কলটা রিসিভ করলো একটা ছেলে। অর্ক রং নাম্বার পরিচয়ে কথা বললো। ছেলেটার নাম বলেছে সাব্বির, বাড়ি কুমিল্লা। ছেলেটা কী করে সেটাও জিজ্ঞেস করেছে। লেখা পড়া করে, অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। অর্ক আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি, সরি বলে ফোন রেখে দিলো। যা বুঝার তা ইতিমধ্যে বুঝে গেছে। ওটা সোমার নাম্বার না । ওদের ধারণাই ঠিক ছিল । অর্ক খুব কষ্ট পেল! ওর বোন এত বাহানা করে মিথ্যা বলে একটা ছেলের জন্য কুমিল্লা চলে গেল! পরিবারের মানুষের সাথে এত বড় প্রতারণা করলো!

বোন যখন সম্পর্কে জড়িয়েই গিয়েছে, এখন দেখতে হবে ছেলেটা ঠিক কত টুকু ভালো। ওরা দুজন মিলে ঠিক করলো, ফেসবুকে ফেইক আইডি খুলে ছেলেটার সাথে কথা বলবে। ছেলেটা কেমন তা তার কথা বার্তায়ই বুঝতে পারবে। ভালো হলে তো ভালো, খারাপ হলে কি বোনকে ফিরাতে পারবে? যে বোন এখন ওদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকছে কথা বলার জন্য, যে অতদূর চলে গেল ছেলেটার জন্য, সে কি আদৌ ফিরবে? অর্ক আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলো, ছেলেটা যেন ভালো হয়। খারাপ কিছুই যেন না পায় ছেলেটার ভিতর।
ওরা দুজন এখন কিছুই ধরা দিবে না দিয়ার কাছে, দেখবে দিয়া নিজ থেকে কিছু বলে কিনা।

অর্করা আরও দুদিন থেকে বাড়িতে চলে গেছে। ধারার খুব মন খারাপ। ছাদে একা একা বসে আছে, কিছু ভালো লাগছে না। ধারা ওদেরকে খুব ভালোবাসে। ওরা থাকলে ধারার সময় গুলো খুব ভালো কাটে। বিশেষ করে অর্কটা থাকলে। অর্ক খুব ভালো, অর্ককে আপন ভাই মনে হয় ধারার।
অর্ক যাওয়ার সময় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ধারাকে ফিসফিস করে বলে গিয়েছে, “আপি তুমিও দিয়া আপুর মতো করো না কখনো! পরিবারের মানুষ গুলোর সাথে কখনো প্রতারণা করো না। কোনো দিন কিছু হলে অবশ্যই আমাকে জানাবে।” কথা গুলো শুনে ধারার মনে হয়েছিল, অর্ক ওর বড় ভাই। ধারার বড় ভাই থাকলে হয়তো এমনটাই বলতো।
ধারা অর্ককে বলে দিয়েছে, ও কখনো প্রতারণা করবে না, আপনজনদের ঠকাবে না। কোনো দিন যদি কোনো সম্পর্কে জড়িয়েও যায়, তাহলে সবার আগে অর্ককেই জানাবে। অর্কর কাছ থেকে কখনো লুকাবে না।
আজকের দিনটা খুব খারাপ ভাবেই কাটলো ধারার । একা একাই থাকলো। সন্ধ্যার পরে একটু ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। রাস্তায় সেদিনের ওই লোকটার মতো একজনকে হেঁটে যেতে দেখলো। ধারা পাত্তা দিলো না, চোখ ফিরিয়ে নিলো। ধারা ভাবলো এটা ওর কল্পনা। লোকটা মনে হয় ওর মাথা থেকে নামবে না! ইশ আর একটা বারের জন্যও যদি লোকটার দেখা পাওয়া যেতো!

রুবিনা আফরোজ একটু মার্কেটে যাবে কিছু কেনা কাটা করতে হবে। ধারাকেও সাথে নিয়ে যেতে চাইলো, কিন্তু ধারা যাবে না। ধারার শরীরটা একটু খারাপ লাগছে । রুবিনা একাই চলে গেল।
ধারা কতক্ষণ অর্কর সাথে কথা বললো, দিয়ার খবর নিলো। দিয়া নাকি এখন আর অর্কর সাথে খুব একটা কথাও বলে না। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়েই বসে থাকে। ধারা ভেবে পায়না, কেউ এমন ভাবে বদলে যেতে পারে কীভাবে?

অর্কর সাথে কথা বলে ধারা ঘুমিয়ে পড়েছিল। মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো। ধারা প্রথমে বুঝতে পারলো না ওর মা কোথায় বসে ডাকছে। ওর মা তো মার্কেটে গিয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি এসেও পড়েছে? মোবাইলটা হাতে নিয়ে বুঝলো একটু সময় না, অনেকটা সময়ই পার হয়ে গেছে।
রুবিনা আবার ডাক দিলো, ধারাকে নিচে যেতে বললো। ধারা ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হলো।
সিঁড়ির অর্ধেকটা পর্যন্ত নেমেই ধারা থমকে দাঁড়ালো। চোখ দুটো ড্রয়িং রুমের সোফার উপর নিবদ্ধ। পলক হীন ভাবে সেদিক তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। সোফার উপরে বসে থাকা মানুষ টাকে বেশ চেনা চেনাই লাগছে। একটু সময় ভাবলো ধারা, তারপরেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। ধারা যা দেখছে তা কি সত্যি দেখছে? নাকি স্বপ্ন?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে