সুখময় বৃষ্টি পর্ব : ৩

0
1040

সুখময় বৃষ্টি পর্ব : ৩
#লেখা : রায়না মনি

দিয়া ছাদের এক কোণায় রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে সাব্বিরের সাথে ফোনে কথা বলছে। তখন ফোনটা সাব্বিরই দিয়েছে। সাব্বির দিয়ার বয়ফ্রেন্ড। দিয়া সাব্বির কে পাগলের মতো ভালোবাসে। সাব্বিরের জন্যই নিজের শহর ছেড়ে অন্য শহরে গিয়ে থাকছে । সাব্বিরের জন্যই নিজের চেনা পরিচিত কলেজের প্রিয় আঙিনা ছেড়ে, অন্য কলেজের অচেনা আঙিনায় পা রেখেছিল। সাব্বিরকে ছাড়া দিয়া বাঁচতেই পারবে না।

খুব সাবধানে পা টিপে টিপে ধারা আর অর্ক সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠছে, দিয়া যেন কোনো শব্দ না পায় সে জন্য ।
উঠে দেখলো ছাদের দরজাটা হালকা ভেজানো। ধারা একটু উঁকি মেরে দেখলো দিয়া হেসে হেসে ফোনে কথা বলছে। কিন্তু কি কথা বলে তা বুঝা যাচ্ছে না । ধারা ফিসফিস করে অর্ককে বললো,
“অর্ক তোর ধারণা ঠিকই মনে হয়।”

“হুম এখন দেখলে তো।”
অর্ক আর ধারা আরও কিছুক্ষণ কান পেতে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কোনো কথা বুঝতেই পারেনি।
দুজনে আবার পা টিপে টিপে নিচে নেমে গেল।

দিয়া অনেক ক্ষণ পরে নিচে আসলো। ধারার রুমে কাউকে পেল না।
অর্ক আর ধারা ডাইনিং রুমে বসে ইফতারী রেডি করছে, আর নিজেদের ভিতর কথা বার্তা বলছে। দিয়া ডাইনিং রুমে ঢোকার সাথে সাথেই দুজন কথা বলা বন্ধ করে দিলো। ধারা দিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললো,
“ওহ তোমার কথা বলা শেষ হলো?”
“হুম।”
অর্ক বললো,
“বাব্বাহ তুমি এত কথা কার সাথে বলো?”
“কার সাথে আবার, আমার একটা ফ্রেন্ড এর সাথে বলছি।”
ওরা দুজন আর কথা বাড়ালো না। নিজেদের কাজে মন দিলো।

সন্ধ্যার পরে ধারা নিজের রুমের লাইট অফ করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো আকাশে কোনো মেঘ নেই আজ। আকাশে তারার মেলা বসেছে, তার মাঝে খুব সুন্দর একটা চাঁদ। চাঁদের আলো গ্রীল ভেদ করে ব্যালকনির ভিতর প্রবেশ করেছে।
ব্যালকনিতে চাঁদের আলোর ছড়াছড়ি, আর তার সাথে মন মাতানো মৃদু কোমল বাতাস। ধারার খুব ভালো লাগছে। ধারা নিজের অজান্তেই বলে উঠলো,

** আজ আমি প্রকৃতির রূপে নিজেকে সাজাতে চাই,
উড়তে চাই মৃদু বাতাসের তালে ।
সন্ধ্যা তারা গুলো গুনতে চাই,
তোমার পাশটাতে বসে । **

বলার পরেই ধারা অবাক হয়ে গেল! ‘তোমার পাশটাতে বসে’ তো বললো, কিন্তু কার পাশে? আর এমন কিছু হঠাৎ করে ধারার মনে আসলোই বা কীভাবে? ধারা ভাবনায় পড়ে গেল। ভাবনার মাঝেই সেই বৃষ্টির মাঝে অপেক্ষা করা মানুষটার কথা মনে পড়ে গেল। ধারা রাস্তার ওই পাশের গ্যারেজটার দিকে তাকালো। গ্যারেজটা খোলা, কয়েক জন মানুষ কাজ করছে। ধারা মনে মনে চাচ্ছে সেই মানুষটাকে যদি এখন আবার ওই গ্যারেজের সামনে দেখতে পেতো, তাহলে খুব ভালো হতো। কতক্ষণ রাস্তার দিকে, গ্যারেজের দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু তাকে দেখা গেল না! ধারার মনটা খারাপ হয়ে গেল! ধারা রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।

দিয়া রুমে এসে দেখলো রুম অন্ধকার, বাইরে থেকে একটু আধটু চাঁদের আলো এসে উঁকি মারছে। দিয়া ধারাকে ডাক দিলো, কিন্তু কোনো সাড়া পেল না। দিয়া রুমের লাইটটা অন করলো, তারপর ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে ব্যালকনিতে ধারার পাশে দাঁড়ালো। দেখলো ধারা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। দিয়া যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেটাও হয়তো টের পায়নি।
“কিরে একা একা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কী করিস?”
পাশে কারো কণ্ঠ শুনে ধারা চকিতে ফিরে তাকালো, দেখলো দিয়া দাঁড়িয়ে আছে।
“তারা দেখছিলাম আপু। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো আকাশটা কতো সুন্দর লাগছে।”
“হুম।”
দিয়া রুমের লাইটটা অফ করে, একটা চেয়ার নিয়ে গিয়ে ব্যালকনিতে বসলো। তারপর ফেসবুকে লগ ইন করলো। দেখলো সাব্বির অনলাইনে আছে।
দিয়া সাব্বিরের সাথে চ্যাটিং এ ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর ধারা আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। দিয়া পাশে বসে কী করছে সেদিকে খেয়াল নেই।

অর্ক মোবাইলে গেমস খেলতে খেলতে ধারার রুমে আসলো। কারোর কোনো সাড়া শব্দ নেই, রুম অন্ধকার। ঘটনা কী? ব্যালকনিতে উঁকি মেরে দেখলো, রুম অন্ধকার থাকলেও ব্যালকনিটা চাঁদের আলোয় আলোকিত, তাই ধারা আর দিয়াকে স্পষ্ট ভাবেই দেখতে পেল অর্ক। অর্ক ব্যালকনিতে গেল।
” কী ব্যাপার তোমরা রুমের লাইট অফ করে এখানে বসে আছো কেন?”
অর্ককে দেখেই দিয়া ফেসবুক থেকে লগ আউট করে বেড়িয়ে গেল। তারপর বললো, “এমনিই বসে আছি।”
অর্ক আর দিয়া গল্প জুড়ে দিলো। ধারা কিছুতেই সেদিকে মন দিতে পারছে না। ধারার মনে এখন শুধু একজনই ঘুরপাক খাচ্ছে। কোথায় একটু কাজিনদের সাথে আড্ডা দিবে, তা না করে অজানা একজন কে নিয়ে পড়ে আছে। যার কোনো মানে নেই। ধারা বিরক্তিতে দিশেহারা হয়ে পড়লো। কোনো কথা না বলে হনহনিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। ধারার অবস্থা দেখে অর্ক আর দিয়া বিস্মিত হয়ে একজন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে আছে। কী হলো আবার এই মেয়ের?

ধারা এসে সোফার উপর বসেই একটা কুশন হাতে নিয়ে সামনা সামনি সোফায় ছুড়ে ফেলে দিল। নিজেকে নিজেই বললো,
“কাম অন ধারা! কী তখন থেকে একটা অজানা অপরিচিত লোককে নিয়ে ভেবে যাচ্ছিস? কে ওই লোকটা যে তাকে নিয়ে এত ভাবছিস?
লোকটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে।”
ধারা একটু খানি বসে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। তারপর আবারও হনহন করে নিজের রুমে গেল । গিয়ে দেখলো দিয়া আর অর্ক আগের জায়গাতেই বসে আছে।
ধারাকে আবার হনহন করে আসতে দেখে অর্ক বললো,
“আপি তুমি ঠিক আছো তো? নাকি প্রেশার বেড়ে গেছে?”

“নারে অর্ক প্রেশার বাড়েনি, আমার প্রেশার তো ঠিকই আছে। তবে যে কোনো মুহূর্তে হয়তো লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যেতে পারে। আমি তা বেশ বুঝতে পারছি।”

“এনি প্রবলেম ?”

“হয়রে ভাই সমস্যা, সবটাই সমস্যা । কিন্তু কী সমস্যা তা নিজেও জানি না।”

অর্ক ধারার কথা শুনে হাসবে না কী করবে বুঝতে পারছে না। এসব কী বলে?
“হু বুঝছি তোমার প্রেশার অলরেডি বেড়ে গেছে। যাও একটু তেঁতুল গুলিয়ে খাও।” বলেই হেসে উঠলো অর্ক।

দিয়া হাসতে হাসতে বললো,
“অর্ক তুই তো দেখি অলরেডি ডাক্তার হয়ে গেছিস। তেঁতুল গুলিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিস।”

“আরে আপু আমার ফ্রেন্ড রিহান আছে না? ওর দাদা তো মাঝে মাঝেই বলে প্রেশার বেড়ে গেছে, তাড়াতাড়ি কেউ তেঁতুলের শরবত বানিয়ে আনো। তারপর তার সামনে তেঁতুলের শরবত আনলেই তার প্রেশার নাকি অর্ধেক নেমে যায়, খাওয়ার পর নাকি প্রেশার থাকেই না। ধারা আপুরও তেঁতুলের শরবত কাজে লাগতে পারে ।” বলে আবার ও হেসে উঠলো অর্ক।

ধারাও ওদের কথা শুনে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বললো,
“অনেক হয়েছে এবার চলো।”

দিয়া বললো,
“কোথায় নিয়ে যাবি আমাদের?”

“এই রাতে নিশ্চয়ই আমি তোমাদের পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাবো না। এখন আমরা মুভি দেখবো।”

ধারা আর দিয়া এক জায়গায় বসা, আর অর্ক অন্য পাশে সোফায় বসা। ধারা আর দিয়া টিভিতে কী দেখবে তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে, আর ওদিকে অর্ক মোবাইলে গেমস নিয়েই পড়ে আছে। ওরা দুজন ভেবে ঠিক করলো ভূতের মুভি দেখবে। ভূতের মুভি চলছে টিভিতে। ধারা এক সময় লক্ষ্য করলো অর্ক ওদের এই টিভি দেখার আসরে নেই, সে এখন মোবাইলের আসরে । ধারা সোফা থেকে উঠে অর্কর থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো,
“এসব কী? তোকে মুভি দেখাতে এনেছি এখানে, মোবাইল নিয়ে বসিয়ে রাখতে আনিনি । মুভি দেখ আমাদের সাথে।”

“মুভি দেখবো! কোনো ভালো মুভি হলে না হয় দেখা যায়, আর তোমরা এসব কী ভূত প্রেত দেখছো ।”

দিয়া এবার ব্যঙ্গ করে বললো,
“এত কথা না পেঁচিয়ে সোজা সাপ্টা ভাবে বলে দিলেই পারিস যে ভূতের মুভি দেখার মতো সাহস নেই তোর।”

“ভুলে যেওনা আমি ছেলে মানুষ। আমার এত ভয় নেই। ওকে দেখবো আমি ভূতের মুভি, আমার কিছুই হবে না। কিছু হলে তোমাদেরই হবে।”

ধারা বললো,
“আমরাও ভয় পাইনা।”
তিনজনে বকবক করছে, আর মুভি দেখছে।
এর মধ্যেই ধারার আব্বু আসলো খবর দেখতে। অর্ক বেশ খুশিই হলো তাতে। দিয়া বললো,
“চাচ্চু আর একটু পড়ে দেখেন, আমরা মুভিটা দেখা শেষ করি।”
“তোমাদের যা দেখার কাল দিনে দেইখো। এখন ডিনার করতে যাও।”

ধারা বললো,
“আব্বু তুমি খবরে কী দেখবা? তার থেকে তুমিও আমাদের সাথে মুভিটা দেখো।”
কিছুতেই কিছু হলো না, জামাল হোসেন খবরই মনোযোগ দিয়ে দেখা শুরু করলো।
ওরা তিনজন ডিনার করে রুমে চলে গেল। রাত বারোটা পর্যন্ত গল্প করলো। তারপর অর্ক চলে গেল গেস্ট রুমে, আর ধারা আর দিয়া ধারার রুমেই থাকলো।
ধারার ঘুম আসছে না। কতক্ষণ এপাশ ওপাশ করলো। তারপর শুধু শুধু মোবাইল টিপলো কতক্ষণ, তাও ঘুম আসলো না। হঠাৎ করে ওর এক পুরোনো বান্ধবীর কথা মনে পড়ে গেল। বান্ধবীটা যে সেই চলে গেল এখান থেকে আর বান্ধবী টাকে খুঁজে পায়নি কখনও! বান্ধবীটার সাথে কাটানো সময় গুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ধারা ঘুমিয়ে পড়লো এক সময়।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে