সন্ধ্যা আকাশের সুখ তারা পর্ব-০৯

0
109

#সন্ধ্যা_আকাশের_সুখ_তারা
“নওশিন আদ্রিতা”
পর্ব সংখ্যা—৯

২১.
ঢাকায় ফিরার আজ এক মাস পেরিয়ে গেছে। এই একমাসে রুদ্রর সাথে নিরার সাক্ষাত প্রায় না এর মতোই ছিল।কখনো কলেজ যাওয়ার পথেই ট্রাফিকের জন্য চোখাচোখি হয়ে যেতো দুইজনার বা কখনো কফি শপে নিরা যেতো বন্ধুমহলের সাথে আর রুদ্র আসতো ক্লাইন্টের সাথে মিটিং এটেন্ড করতে সেখানেও তাদের চোখাচোখি হলেও কথা বলা হয়ে উঠতোনা। হাজার হোক একই শহরে বাস তাদের। এতোদিন তেমন ভাবে সাক্ষাৎ না থাকার দরুন চোখে পড়লেও তেমন একটা পাত্তা দেওয়া হতোনা কিন্তু হঠাৎ এক ঘটনার জোড়েই ত আজ অপরিচিত দুই সত্ত্বা বহু পরিচিত।

কিন্তু আজ হঠাৎ করেই মুখোমুখি হলো দুইজন। নিরা আর তার বান্ধবি মায়া দুইজনেই আর্কিটেক্ট নিয়েই পড়াশুনা করছে বিধায় দুইজনই “দা সান রাইজ ইন্ডাস্ট্রি”তে ইন্টারভিউ দিতে এসেছে ইন্টার্ন হিসেবে।এর পিছনে দুইটি কারণ রয়েছে এক হলো এই ইন্ডাস্ট্রি বর্তমানে বাংলাদেশের নামকরা ইন্ডাস্ট্রি আর এর অনেক ব্রাঞ্চ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাই আর আরেকটি কারন হলো তাদের কলেজ এর নির্মাতা এই কাম্পানির ওনার৷ ইন্ডাস্ট্রির দুইজন সিনিয়র আর্কিটেক্ট এ পার্সোনাল এসিস্টেন্ট হিসেবেই তাদের কাজ করতে হবে।আর যেহেতু দুইজনই ” দা সান রাইজ ইন্ডাস্ট্রির ” মালিক মিস্টার হেভেন শেখ এর ভার্সিটিতে অধ্যায়নরত সেজন্য তাদের চাকরির অগ্রাধিকার ছিলো বেশি।আর হলোও তাই যেহেতু নিরার বানিয়ে আনা ডিজাইন গুলো চমৎকার আর ইউনিক ছিলো সেজন্য সে খুব সহজেই চান্স পেয়ে যায়। আর মায়ার মৌখিক পরীক্ষাতেও চমৎকার ভাবে উত্তির্ন হওয়াই সেও নিজের জায়গা ধকল করে নেয় শ খানেক ক্যান্ডিডেটদের মাঝখানে।

কিন্তু তখন ও নিরা জানতোনা সে যার এসিস্ট্যান্ট হিসেবে সিলেক্ট হয়েছে সে আর কেও না বরং রুদ্র শিকদার। ম্যানেজমেন্ট কমিউনিটি দুইজনকে পাঠালেন দুই সিনিয়র আর্কিটেক্টদের কেবিনে। দুইজনার রুম পাশাপাশি। দুইজন এর রুমের নাম্বারের নিল চিরকুট তাদের হাতে।

নিরা দাঁড়িয়ে আছে ১০২ নাম্বার কেবিনের সামনে কেবিনের দরজার উপরে স্পষ্ট ইংরেজি এলফাবেট দিয়ে গাঢ় কালো কালি দিয়ে লিখা আছে
“RUDRO SIKDAR”।
নিরা থমকালো সে ভাবেনি সে দাঁড়িয়ে যাবে আবার সে গম্ভির মানুষটির সামনে। এই একমাসে ভিষন জালিয়েছে এই গুমরো মুখোটা তাকে অত্যন্ত বাজে ভাবে। ঘুমতে গেলেও তার গম্ভির চেহারা মনে পড়তেই রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়,খাওয়া গলা দিয়ে নামে না। সামনে না থেকেও যে সারাক্ষন সামনে ঘুরাঘুরি করার ব্যাপারটা তাতে যে বেশ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নিরা এই এক মাসে মাঝেমধ্যে মন চায় লোকটার সামনে যেয়ে কাঠাকাঠ গলায় বলে উঠতে
”শুনেন মিস্টার গম্ভীর লোক আপনি এইভাবে একটা মেয়ের স্বপ্নে সয়নে খাওয়া দাওয়াই হস্তক্ষেপ করতে পারেন না এটা অন্যায় ঘোর অন্যায় এই অন্যায় আপনি করতে পারেন না আপনি একজন ভয়ংকর গম্ভীর অপরাধী আপনার শাস্তি পাওয়া উচিত “।

যার থেকে পালাই পালাই করে ঘুরে বেরাচ্ছিলো শেষ মেষ তার কাছে এসেই তাকে থামতে হবে জানাছিলোনা তার ধুরুধুরু বুক নিয়ে নক করে উঠলো রুদ্র শিকদারের কেবিনের দরজা।দুই থেকে তিনবার নক করার পরেই ওপর থেকে গম্ভীর কন্ঠে ভেসে উঠে পুরুষালি কন্ঠ

—কাম ইন।

রুদ্রর অনুমতি পেয়েই নিরা ভিতরে প্রবেশ করলো কিন্তু রুদ্রর চেহারা দেখার সৌভাগ্য হলোনা তার কারন রুদ্র উলটো দিকে ফিরে কারো সাথে কথা বলতে ব্যস্ত কথার ধাচে নিরা বুঝলো কোন ক্লাইন্টের সঙ্গেই কথা বলছে সে ভাবে কথা বলতে বলতে রুদ্র নিরাকে না দেখেই পিছন ফিরেই বলে উঠলো

— এক কাপ কড়া কফি নিয়ে আসুন তো।

রুদ্র জানে এই মহূর্তে তার একজন নিউ ইন্টার্ন আসবে সেজন্যই সে এই হুকুম টা যারি করলো কিন্তু পিছন ফিরে দেখা হলোনা মানুষটিকে।

নিরা আর কি করবে হাতের ফাইলটি সোফাই রেখেই হাটা ধরলো কফির খোজে।।ইতিমধ্যে রুদ্র ফোন কল শেষ করে কম্পিউটারে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিরা পুনরায় কেবিনে প্রবেশ করে ধোয়া উঠা কফির মগ এনে রাখলো রুদ্রর সামনে। রুদ্র এবার মেয়েলী হাত দেখে মাথা উপরে তুলে তাকায় সামনে নিরাকে দেখে ভ্রম মনে করে আবার পুনরায় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কারন এইটা তার সাথে প্রায় হচ্ছে। কিছুটা ফিল্মি ভাবেই সবার মাঝেই কেন যেনো নিরার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছে সে। এইতো কিছুদিন আগের কথা। ঘুম থেকে উঠতেই সে তার সামনে লাল শাড়ি পরিহিত নিরাকে দেখে কফির মগ হাতে নিয়ে ভিজা চুলে তোয়ালে পেচানো অবস্থায় নিরাকে আস্তো বিবাহিতা বউ বউ লাগছিলো তার কাছে।কিন্তু ফট করেই তার মিসেস শিকদারে গলার আওয়াজে বুঝতে বাকি থাকেনা এটা তার ভ্রম ছিলো এমন ই বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে রুদ্রর সাথে সেজন্য অনেকবার তাকে বেশ লজ্জাতেও পড়তে হয়েছে।কিন্তু রুদ্র আর এই কাজটা করলোনা।

অপরদিনে নিরা রুদ্রর ব্যবহারে অবাক হয়ে গেছে রুদ্র একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াতে বেশ হতাশ হলো নিরা। তবে রুদ্র কি এই একমাসে ভুলে গেলো তাকে। অবশ্য ভুলার ই কথা অপছন্দের মানুষকে মনে রাখার কথাও না। নিরার বুক চিড়ে অজান্তেই বেরিয়ে এলো এক তপ্ত নিশ্বাস হলদে ফর্সা মুখখানা টা হালকা লাল হয়ে উঠলো বিষন্নতাই। নিরা কি করবে ভেবে না পেয়ে সোফায় রাখা ফাইলটি নিয়ে রুদ্রর দিকে এগিয়ে দিয়ে খুব ভদ্রতা সহিত বলে উঠলো।

—স্যার এইটা আমার ফাইল সাথে কিছু বানানো ডিজাইন। আপনি যদি দেখে আমার কাজটা বুঝিয়ে দিতেন।

রুদ্র এবার চমকালো এতোদিন নিরাকে দেখলেও কথা বলতোনা নিরা কিন্তু আজ তো কথাও বলছে।নিরা মিষ্টি আওয়াজে যেনো রুদ্রর তালগোল পাকানোর উপক্রম।
কাপাকাপা হাতে নিরার ফাইল নিয়ে নাম পড়তেই থমকে উঠলো ফাইলের প্রথম পেজ উল্টাতেই ইংরেজি শব্দে ছোট ছোট অক্ষরে লিখা “NIRA TALUKDER”।
রুন্দ্র যেনো এবার আকাশ থেকে পড়লো তার সামনে যে স্বয়ং নিরা নিজে উপস্থিত আর সে তার এসিটেন্ট সেটা বুঝতে বাকি থাকলোনা তার। কিন্তু তার এই অবাক বিস্ময় কিছুই বুঝতে দিলোনা সে নিরাকে বরং শান্ত ও গম্ভির ফেস নিয়েই সম্পূর্ণ ফাইলটা চেক করে নিজের টেবিলের ডয়ারে রেখে দিলো সযত্নে।কিছু ফাইল টেবিল থেকে উঠিয়ে নিরার দিকে বাড়িয়ে দিলো

— মিস নিরা এই ফাইল গুলোতে বেশ কিছু বিল্ডিংস এর ছবি আছে সেখানে কি কি ভুল আছে সেগুলো মার্ক করবেন এবং সে জায়গায় কি ব্যবস্থপনা নিলে ভালো হলে তার উপরে একটা ডিটেইল তৈরি করে আমাকে দেখাবেন ইজ দেট ক্লিয়ার।

নিরা সম্মতি জানিয়ে ফাইল আর লেপটপ নিয়ে সামনে থাকা সোফায় গিয়ে বসে পড়লো বেস মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে লাগলো।আর সেই দৃশ্য মনোযোগ সহকারে দেখতে থাকলো রুদ্র। বেশ কিছুক্ষন সময় পেরিয়ে যেতেই নিরা লেপটপ থেকে মাথা তুলতেই রুদ্র মাথা নিচু করে নিলো। নিরা চোখ যেয়ে আটকালো রুদ্রর নাকে থাকা তিলটাই।

—আজব এই দুনিয়ার নিয়ম পছন্দের জিনিস গুলা হয় দামী নয়তো অন্যকারো। কিন্তু আমার টা তো আমাকে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে। আচ্ছা আমি যদি শান্ত ভদ্র হতাম তাহলে কি এই গম্ভির লোকটা আমাকে পছন্দ করতো আমাকে মনে রাখতো নাকি তখন ও এইভাবেই আমাকে ভুলে যেতো কিজানি বাবা লোকটার মতিগতি বুঝা দায়।

কথাগুলো মনে মনে আওড়ালেও মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা হলোনা।

২২.
অভ্রর সামনে বসে আছে তার মা অর্থাৎ মিসেস তালুকদার। বেশ কিছুক্ষন ধরেই ছেলেকে পাশে বসিয়ে রেখেছে মিসেস তালুকদার কিন্তু কিছু বলা হয়ে উঠছে।এমন না যে তার ছেলে রাগী বা অন্যকিছু তার দুই ছেলে মেয়েই ভীষণ শান্ত শিষ্ট।রাগারাগী করা তাদের ধাচে নেয়। শান্ত হয়েই সব কিছু হেন্ডেল করে ফেলে হাসি মুখে। বিশেষ করে নিরা মেয়েটি কথার জাদুতেই কঠিন থেকে কঠিন সমস্যা সমাধান করে ফেলতে পারে।মিসেস তালুকদার অভ্রর এই ব্যাপারটাও নিরার হাতেই দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু গত একমাস হলো নিরা তার এক্সাম কলেজ ইন্টারভিউ নিয়ে খুব বেশিই ব্যস্ততাই থাকায় তাকে ঘাটানোর সময় পাননি মিসেস তালুকদার এদিকে মিসেস শিকদার আর মিস্টার তালুকদার উভয় খুব বেশিই তাড়াতাড়ি করছেন। তাদের মধ্যে ধৈর্য না দেখেই আজ মিসেস তালুকদার ছেলের মুখোমুখি হয়েছে কলেজ শেষ করে বাসায় ফিরতেই নিজের ছেলে রুমে এসে ঘাপটি মেরে বসে আছেন কিন্তু কি দিয়ে শুরু করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।

দীর্ঘ নিরাবতা ভেংগে অভ্র তার মায়ের হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠে আদুরে শান্ত কন্ঠে
—কি ব্যাপার মা তোমাকে এতো চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন। তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছো। নিজের ছেলের সাথে এতো ভয় পাওয়ার মানে কি মা।

মিসেস তালুকদার ছেলের এমন গলায় সাহস পেলেন

—বাবা আমরা চাচ্ছি এবার তোর বিয়েটা করায় দিতে দেখ তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস বিয়ের বয়স হয়েছে সাথে কলেজের প্রফেসার আবার নিজের বাবার ব্যবসা টাও খুব দারুন ভাবে সামলে নিচ্ছিস কিন্তু তোকেও ত সামলানোর কাউকে চায় তাই না বল।

অভ্র হাসলো সে বুঝেছিলো মা তার এমন কিছুই বলতে চাচ্ছে।

—কে সে মেয়েটা যার জন্য এতো তাড়াহুড়ো তোমার ছেলের বিয়ে নিয়ে।

মিসেস তালুকদার আমতা আমতা করে বলে উঠলো
—রুহানী

অভ্রর ঠোঁটের হাসি প্রসস্থ হলো
—ভেবে বলছো ত মা। তুমি খুব ভালো করেই জানো রুহানীর বাচ্চামো টা সে এখনো ঠিক সে ছোট মেয়েই থেকে গেছে তার ছোট হাত তোমার সংসার সামলাতে পারবেনা। আর না তো তোমার বাকী দশটা মেয়ের মতো আদর্শ বউমা হয়ে উঠতে পারবে। তার রাগ সম্পর্কে ছোট বেলা থেকেই ধারণা আছে।আমি সারাদিন কাজে থাকবো মা সে তোমার সাথেই সারাটা সময় কাটাবে। এবার বলো তুমি পারবে সামলাতে ছোট জেদী শিকদারদের আদরের রুহানীকে।

মিসেস তালুকদার মন দিয়ে শুনলেন এবং বুঝলেন ছেলের কথা গুলো তিনি এইসব সম্পর্কে অবগত আর এতে তার বিন্দু মাত্র আপত্তি নেই কারন সে বউ না আরেক মেয়ে আনতে চাচ্ছে।আর রুহানীর বাচ্চামো স্বভাব টা তার দারুন লাগে।আর একসময় না একসময় ঠিক দেও বিয়ের বন্ধনে বেধে গেলে ঠিক সাংসারিক হয়ে উঠবে বলেই তার ধারণা। আর অভ্রর যে বিয়েতে অসম্মতি নেই তাও বুঝে গেলেন তিনি অভ্রর হাসি দেখে।

—আমার আপত্তি নেই তাকে আমার পুত্রবধু করে আনতে।

অভ্র মায়ের হাত ছেড়ে উঠে রওনা দিলো ওয়াসরুমের উদ্দেশ্য বেশ গরম পড়ায় গোসল না করা অব্দি শান্তি নেই তার। কিন্তু যেতে যেতে মায়ের উদ্দেশ্য বলে গেলো
—তাহলে আমার ও আপত্তি নেই বিয়ের পিরিতে বসতে।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে