সন্ধ্যা আকাশের সুখ তারা পর্ব-০৩

0
129

#সন্ধ্যা_আকাশের_সুখ_তারা
“নওশিন আদ্রিতা”
পর্ব সংখ্যা—৩

৮.
রুহানী “তালুকদার নিবাসে”পৌঁছাতেই তার আখিজোড়া আটকে গেলো বসার ঘরে মেয়েদের ভীড়ে।তার আর বুঝতে বাকি নেই সব গুলো অভ্রর কাছে বায়োলজি পড়ার বাহানাই তাকে চোখ দিতে গিলে খেতে এসেছে।রাগে শরীর জ্বলে উঠলো রুহানীর । সে বুঝে পায় না মেয়ে গুলো এই হলুদ বানরের চেহারায় কি এমন মধু খুজে পেয়েছে যে মৌমাছির মতো তার আশেপাশে বিন বিন করে বেরায়। ক্লাসেও পড়া বাদ দিয়ে সব গুলা যে অভ্রকে চোখ দ্বারা গিলে খাই তা খুব ভালো করেই জানে সে অভ্রও কথাটা জানেও তবুও রোজ একদম নতুন বরের মতো তৈরি হয়ে আসার কারণ টা বোধগম্য হয়না তার।এখন তো বাড়িতেও এসে জুটেছে।

রুহানীর বকা থামে অভ্রর কন্ঠে।

—মিস রুহানী আপনাকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য নিশ্চয় মামনি(জামিলা শিকদার) এখানে পাঠায়নি।
—আপনাকেও নিশ্চয় মেয়েদের সাথে ঢোলাঢলি করতে বাবাই (রুহুল তালুকদার) আপনাকে পড়াশুনা করায়নি।

রুহানী কথাটা মনে মনে বললেও জোড়ে বলা আর হয়ে উঠলোনা। চুপচাপ সোফার এক কোণে যেয়ে বসে পড়লো বই নিয়ে।

রুহানী অভ্রর থেকে বেশ খানিকটা দূরেই বসে আছে তার কারণ অভ্রকে ঘিরে বসে আছে প্রায় বিশ জনের মতো মেয়ে। এদের ভীড়ে যে অভ্র তাকে দেখতেও পাবেনা তা বেশ জানা আছে তার। অভ্রর দিকে তাকাতেই তার চোখ গেলো তার পাশে বসে থাকা শার্ট আর জিন্স পড়ে থাকা মাইশার উপরে শার্টের অবস্থা দেখে রুহানীরই লজ্জাই মুখ লাল হয়ে গেলো । মাইশা নামের মেয়েটি এমন খোলামেলা পোশাক পড়েই অভ্রর একদম কাছে যেয়ে বসে উঠে। অভ্র তবুও চুপচাপ বসে আছে বলে রুহানী ব্যাগ রেখেই উঠে গেলো।

অভ্র পিছ থেকে ডেকে উঠলো

—মিস রুহানী কই যান।
—জাহান্নামে যায় আপনার এইসব পড়া নামক রঙলিলা শেষ হলে ডাক দিয়েন।

রুহানীর কথায় সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটির যাওয়ার দিকে।অভ্র কিছুনা বলে হেসে পড়ানোই মন দিলো বিরবির করে বলে উঠলো

—ঝাসির রানী।

রুহানী সোজা কিচেনে যেয়ে মিসেস তালুকদার কে জড়ায় ধরলো।আচমকা জড়ায় ধরায় প্রথমে অবাক হলেও পড়ে ঠিকই টের পেলো পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি রুহানী

—খুদা লাগেছে মামনি কিছু খাইতে দেও তো পেটের ভিতরে হাতি গুলা লাফাতে লাফাতে আমার ছুডু(ছোট) পেট টাকে ফাটায় দিবে যানো।ঘুম থেকে উঠেই তোমার ওই অসভ্য বাদর ছেলের জন্য দৌড়ায় দৌড়ায় আসতে হয়েছে খাইতেও পারিনি।

মিসেস তালুকদার হেসে দিলেন রুহানীর কথায় বয়সে বড় হলেও স্বভাবে এখনো সেই বাচ্চাটিই রয়েগেছে যার কারণে দুই পরিবারে অতিরিক্ত আদরের রুহানী।

রুহানীর গালে আলতো হাতের থাপ্পড় দিয়ে হাতে ক্ষিরের বাটি ধরায় দিলো।রুহানী খুশীতে আত্নহারা হয়ে মিসেস তালুকদারকে জড়ায় ধরতেই তিনি হেসে বলে উঠলেন

—তুই আরামে বসে খা লাগলে ওইখানে আছে তুলে নে।তুই আজ না আসলেও অভ্র বা তোর বাবাই এর হাতে তোর জন্য ক্ষির পাঠাতাম এসেছিস ভালো করেছিস।

রুহানী হেসে খেতে শুরু করলো এর মাঝেই অভ্রর ডাক শুনা গেলো

—মা আমি রুমে যাচ্ছি রুহানীর সাথে এক মগ কফি পাঠিয়ে দিও ত।

কথাটা শুনে রুহানী ভেংচি কাটলো। আসতে ধীরে পুরো বাটি শেষ করে উঠে দাড়ালো কফির মগ মিসেস তালুকদারের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় ডাইনিং টেবিলের দিকে নজর দিতেই চোখে খুশির ঝিলিক দেখা গেলো মাথায় ভড় করলো দুষ্টু বুদ্ধি।

৯.
বাস থেকে নামতেই নিরা আর রুদ্রর সামনে এসে পড়লো এক প্রাইভেট কার হঠাৎ আগমনে নিরা কিছুটা পিছনে সরে গেলো।গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এক হ্যাংলাপাতলা টাইপের লোক। উজ্জ্বল শ্যামা লোকটির ঝাকড়া চুলের ভীড়ে কপাল আর চোখ দেখা মুশকিল।নিরা বেশি প্রচেষ্টাও করলোনা।রুদ্র কি করা দেখাই তার এখন একমাত্র কাজ বলতে গেলে রুদ্রের পদক্ষেপই সে অনুসরণ করবে বলেই সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে।

লোকটি রুদ্রের সামনে এসে হাত বারিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো

—আপনি কি মিস্টার রুদ্র শিকদার “দা সান রাইজ ” এর সিনিয়র আর্কিটেক্ট।

রুদ্র সম্মতি জানাতেই ঝকঝকে দাত বের করে হেসে উঠলো লোকটি।

—আমি সাকিল ইসলাম। আপনাকে নিতে এসেছি আমাদের স্যার আপনাকে নিতে আমাকে পাঠিয়েছে আমি “বিজয় গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিতে ” কর্মরত।

রুদ্রও হেসে হাত মিলাতেই সাকিল নামের ছেলেটির নজর পরে নিরার উপরে নিরা বুঝছেনা তার এখানে থাকা উচিত নাকি চলে যাওয়া উচিত।

—স্যার আমাকে জানানো হয়েছে আপনি একাই আসবেন। ম্যাম কে ঠিক চিনলাম না উনি কি আপনার সাথে।

রুদ্র মাথা দুলিয়ে বলে উঠলো

—মিট নিরা শিকদার আমার ওয়াইফ। সেও আমার সাথেই থাকবে।

সাকিল হতদম্ভ হয়ে তাকিয়ে মাথা ঝাকিয়ে বলে উঠলো

—ঠিক আছে।আপনারা একটু অপেক্ষা করুন আমি আসছি।

শাকিল একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফোন দিলো কাউকে।

সাকিল যেতেই নিরা রুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুদ্র বলে উঠে
—দেখুন আমি জানি আপনি কি বলতে চাচ্ছেন।আসলে মিস্টার বিজয় রহমান একটু পুরানো দিনের ভাবনা পোষণ করেন অবিবাহিত ছেলে মেয়েদের একসাথে তিনি ভালো নজরে দেখেন না সেজন্য আমার এসিস্ট্যান্ট ও ছেলে এবং এর আগে তিনি তাকে দেখেছে সেজন্য আপনাকে এসিস্ট্যান্ট হিসেবে পরিচয় করাতে পারলাম না। আমি এইজন্য দুঃখিত।

—ঠিক আছে।আমিই আপনার সাথে আসার কথা বলেছিলাম।

রুদ্র আর নিরা আর কোন কথা বলবে তার আগেই সাকিল ছেলেটি ফিরে আসলো তাদের আর কোন কথা বলা হলোনা তারা দুইজন নিশ্চুপ থেকেই উঠে পড়লো গাড়িতে।সারাদিনের ক্লান্তিতে নিরা গাড়িতেই রুদ্রের কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলো।রুদ্র একবার তাকিয়ে ইচ্ছা করলো সরাতে কিন্তু পরক্ষণেই কি মনে করে সরালোনা।

মাথা ঘুরিয়ে চাঁদের আলোতে নিরার মুখের দিকে তাকাতেই পুনরায় ধক করে উঠলো তার বুকে।কাপা কাপা হাতে কপালে এসে পড়ে থাকা চুল গুলো আলতো হাতে কানের পিঠে গুজে দিতেই কেপে উঠলো নিরা।মাথাটা আরেকটু শান্তি করে এলিয়ে দিলো রুদ্রের প্রসস্থ কাধে।

বিরাট বড় অট্রালিকার সামনে গাড়ি থামতেই নিরার মাথা সামনে এগিয়ে পড়তেই রুদ্র সামলে নিলো কিন্তু নিরার তবুও ঘুম ভেংগে গেলো।নিরা নিজেকে ঠিক করে উঠে বসে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।

নিরা আর রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে ঢুকিতেই এক মাঝবয়েসী লোক তাদের দিকে হাসি মুখ এগিয়ে এলো।

—ওয়েলকাম মিস্টার এন্ড মিসেস তালুকদার আশা করি আপনাদের এখানে আসতে অসুবিধা হয়নি।

বিজয় রহমান এর মুখে এই কথা শুনে বিরল হাসলো রুদ্র। রুদ্রকে আলিঙ্গন করে নিরার উদ্দেশ্য বলে উঠলো

—ইউ আর ভেরি লাকি মিস্টার তালুকদার আপনার ওয়াইফ অনেক সুন্দরী রমনী আই মাস্ট হেভ টু সে ইট।

রুদ্র হাসলো।

—আজ রাতে আপনারা আমাদের বাসায় স্টে করবেন মিস্টার রুদ্র।আপনি প্রথমবার আপনার ওয়াইফকে নিয়ে এসেছেন আমি না শুনবোনা।
—কিন্তু মিস্টার রহমান আমি অলরেডি হোটেল বুক করে ফেলেছি।
—কেন্সেল ইট মিস্টার রুদ্র আমি কোন কথা শুনতে প্রস্তুত নই।

রুদ্র করুন চোখে তাকালো নিরার দিকে।তার একটা মিথ্যাই যে এতো খারাপ ভাবে ফেসে যাবে সে বুঝেনি।

রহমান ভিলাই প্রবেশ করতেই মিসেস রহমান নিরারকে টেনে নিয়ে চলে গেলেন। চারজনে খাবার সম্পূর্ণ করে উঠে পড়লো। কিন্তু বিপত্তি বাধলো রুম নিয়ে যেহেতু রুদ্র বলেছে তারা স্বামি স্ত্রী সেহেতু মিস্টার রহমান যে তাকে এক ঘড়েই থাকতে দিবেন এইটাই স্বাভাবিক ছিলো।এইজন্য রুদ্র আসতে দ্বিধা বোধ করচ্ছিলো।

বেডের দিকে দুইজনে তাকিয়ে আছে।

—আমি বেড ছাড়া ঘুমাতে পারবোনা।

রুদ্রের কথা শুনে হাসলো নিরা।ওইটুকু সোফায় যে রুদ্র ঘুমাতে পারবেনা তা বেস জানা আছে নিরার।

—রুদ্র সাহেব এক রুমে ঘুমাতে আপনার আমার দুইজনের অসস্তি হবে চলুন আজ ময়মনসিংহ এর পরিবেশ এ তাজা হাওয়া খেয়ে নেওয়া যাক। বর্ষা আর শীতের এই মেলবন্ধণে পরিবেশ টাই আলাদায় মাধুর্যতা ছড়িয়েছে চলেন আজ নাহয় এই পরিবেশে নিজেদের বিলিন করা যাক।

নিরার কথা সায় জানালো রুদ্র এই অস্বস্তিকর চার দেওয়ালের ঘরের চাইতে খোলা আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করাটা অনেক ভালো বলেই মনে করলো রুদ্র।

দুইজনে পাশাপাশি হেটে চলেছে।নিস্তব্ধ রজনীতে দুইজন মানুষ এর হাটার শব্দ ব্যতীত কোন শব্দই শুনা যাচ্ছেনা যেহেতু জায়গাটা একটু গ্রাম্য সাইটে সেজন্য খুব অল্প সময়ে সবাই বাসার ভীতরেই রয়েছে।হয়তো এতোক্ষনে ঘুমিয়েই গেছে।

হঠাৎ নিরা রুদ্রর শার্টের হাতার কাছের দিকে খামছে ধরতেই রুদ্র ভ্রু কুচকে তাকাতেই নিরা হাতের ইশারায় সামনের দিকে ইশারা করতেই সেদিকে চোখ যেতেই থমকে গেলো রুদ্র।

তাদের সামনেই ছোট একটা পদ্মফুলের পুকুর। সেখানেই ঝি ঝি পোকার আলোই চারদিকে আলাদা এক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে।বিষ্ময়ে নিরা বাচ্চাদের মতো লাফাতে শুরু করে দিয়েছে।

রুদ্র অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার পাশে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের মতো লাফানো এক যুবতীর দিকে।পরণে শাড়ি পরিহিত মায়াবী এক নারী তার হাতের শার্ট খামচে ধরে বাচ্চাদের মতো লাফাচ্ছে ভাবতেই তার চোখে ছেয়ে গেলো আলাদা এক মুগ্ধতা।

এমন না যে রুদ্র এর আগে সুন্দরী কোন মেয়ে দেখেনি কিন্তু তা না এরচেয়েও সুন্দরী মেয়ের সাথে তার কাজের জন্য উঠাবসা করতে হয়েছে কিন্তু এই মেয়েকে সুন্দরীর তালিকায় ফেলা যায়না অদ্ভুত রকমের এক মায়া কাজ করে নিরার মাঝেই বলেই ধারণা তার। নাহ ফর্সা না শ্যমলা অদ্ভুত এক রঙ্গের অধিকারীনি সে। পানির ছিটায় জল জল করতে থাকা মুখশ্রী দেখে কেমন এক প্রশান্তির বাতাস ঘিরে ধরলো তাকে।আলাদা ঘোরের মাঝেই পা বারালো নিরার দিকে।নিরা ততোক্ষনে ছুট লাগিয়েছে পদ্ম ফুলের লোভে কিন্তু সে টের ও পেলোনা কেউ একজন তার সৌন্দর্যর কবিতাও বানিয়ে রটে ফেলেছে ইতিমধ্যেই।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে