সংসার পর্ব-১৯

0
1159

#সংসার
#পর্ব_১৯

#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি।

আমার তাদের দিকে তাকিয়ে নিমিষেই ভয় কেটে যায়। আর মুগ্ধ চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। সৃষ্টি কর্তার এক একজোড়া ভালোবাসার সংসার কতই না মধুর।

৩৭.
আমরা সবাই বান্দরবান এসে, চান্দের গাড়ি নিয়ে নিলাচল নিমাম্বর রিসর্টে চলে যাই। আকাই ভাইয়া আগে থেকেই তিনটা রুম বুক করে রেখেছিল।
এখানে এসে আমরা সবাই একসঙ্গে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পরেরদিন সকাল বেলা সবাই ঘুমিয়ে আছে আমি ওঠে নামাজ পড়ে বারান্দায় যাই। চারদিকে কুয়াশার জন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। গায়ে শীতল বাতাস উপছে পড়ছে। আমি আবার রুমে ঢুকে দেখি রুদ্র চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে।

“আজ এত সকালে ওঠলেন যে? ঘুম ভালো হয়নি?”

রুদ্র কিছু না বলে আমার হাত আচমকা টান দিয়ে বেডের ওপর বসায়। আমার কোলে মাথা রাখে। আমি ওঠতে চাইলে কোমড় জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। ঘুম ঘুম চোখে বলে।
“উহু নড়ো না তো।”

আমি রুদ্রের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি।কপালে কয়েকটা চুল পড়ে আছে। আমি হাত দিয়ে চুল গুলো এলোমেলো করে দেয়।রুদ্র আমার পাগলামি দেখে চোখ বন্ধ করেই মুচকি হাসি। আর আমি ঘোড় লাগা দৃষ্টিতে তার মায়া ভরা হাসির দিকে তাকিয়ে থাকি সারা মুখে মায়ায় ছড়িয়ে আছে। তার চোখ, তার ঠোঁটে সব কিছুতে মায়া উপচে পরছে। আচ্ছা একটা মানুষ আদৌ কি এতটা পারফেক্ট হয়? এই মানুষটা যে আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার জীবন সঙ্গী মনে পরতেই সারা শরীরে খুশির শিহরণ বয়ে যায়।

চারদিকে কুয়াশা কেটে সূর্যের রঙিন আভা ফুটে ওঠেছে। আমি তাড়াতাড়ি রুদ্রকে ওঠিয়ে রুমের বারান্দায় নিয়ে যাই। আমরা যে তিনটি রুম বুক করেছি সেগুলো এক সাথেই আর তিনটি রুমের একটি বড় বারান্দা।
আমি আর রুদ্র বারান্দায় নামতে দেখি রাইমা আপু আর রাকিব ভাই রিসর্টের সামনে দাড়িয়ে কথা বলছে। দুজনের হাতেই কফির মগ। রাকিব ভাইয়া গ্রিলের সামনে দাড়িয়ে হাত দিয়ে নানান জিনিস দেখাচ্ছে আর সেটার বর্ণনা দিচ্ছে। আর রাইমা আপু গ্রিলে পিঠ ঠেকিয়ে এক দৃষ্টিতে রাকিব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি রুদ্রের এক বাহু জড়িয়ে ধরে তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের দেখে রাইমা আপু বলল-

“মেঘ শুভ সকাল, ঘুম কেমন হলো?”

“শু-প্রভাত। অনেক ভালো, তোমাদের?”

“হ্যাঁ ভালো। জায়গা টা খুব সুন্দর তাই না?”

আমি রাইমা আপুর কথায় চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। আসলেই জায়গাটা খুব সুন্দর। চারদিকে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। জায়গাটার নাম যেমন নিলাচল তেমনই মনে হচ্ছে আকাশের নীল আচল চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। চারদিকে সাদা মেঘের দল উড়ে বেড়াচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা খুব নিঁখুত হাতে এই জায়গাটা সাজিয়েছেন।
,

নিলাচলের চারদিকে ঘুরে দেখবো। অথচ এখন পর্যন্ত জেনি আপুর ঘুম ভাঙ্গার নাম নেই। আকাশ ভাইয়ার ঘুম না কাটলেও রুদ্রের ভয়ে ওঠে বসে আছে। ঘুম ঘুম চোখে বেশ কয়েকবার আকাশ ভাইয়া জেনি আপুকে ডাকলে ওঠে না।

তাই রুদ্র জেনি আপুকে ধাক্কা মেরে ওঠতে বলে।

“জেনি ওঠ, নাস্তা খেয়ে আমরা বের হবো। তাড়াতাড়ি ওঠ। এখানে আসছিস কি ঘুমানোর জন্য?”

জেনি আপু রুদ্রকে আকাশ মনে করে ঘুমের ঘোড়ে বকতে শুরু করলো।
“আকাইশ্যার বাচ্চা এখন থাপ্পড় খাবি। যা তো ডিস্টাপ করিস না।”

আকাশ ভাইয়া আপুর কথা শুনে দূর থেকে মিটমিট করে হাসছে যার মানে আজ সে বকা খাইনি সব রুদ্র খাইছে।

রুদ্র রাগে আকাশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-
“ওই না হেসে এই হলুমানেরে ঘুম থেকে তোল। নয়ত তোর একদিন কি আমার একদিন।”

আকাশ ভাই হাসি থামিয়ে মুখটা পেচার মতো করে বেডের দিক এগিয়ে গেল।
“ভাইরে ভাই এই চিপা থেকে বের কর। একদিকে তুই ধমক দিস অন্যদিকে ওইটায় বকা দে। বল আমি কোন দিকে যামু।”

আকাশ ভাইয়ের অবস্থা থেকে বুক ফেটে হাসি আসলেও আমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি আটকিয়ে রাখি। নয়ত এই মুহূর্তে হাসলে আকাশ ভাইয়া কাঁদতে কাঁদতে বলবে মেঘ তুমিও হাসছো?

আকাশ ভাইয়া ভয়ে ভয়ে বেডের পাশের গ্লাস থেকে বেডের দুই হাত দূরে গিয়ে জেনি আপুর মুখে ওপর পানি ঠেলে দেয়। জেনে আপু রাগে চিৎকার দিয়ে ওঠলে সামনে রুদ্রকে দেখে চুপসে যায়। অপরাধী ভাঙ্গিতে বসে থাকে।

৩৮.
আমরা সবাই নাস্তা শেষ করে ড্রেস চেইঞ্জ করতে যাই। আমি আর রাইমা আপু নীল কালারের সাড়ি পরেছি। আমাদের দেখে জেনি আপু বলে-
“ওই তোমরা নীল সাড়ি পরছো, আমাকে আগে বলতে আমিও নিয়ে আসতাম।”

জেনির আপুর কথা শুনে রাইমা আপু বলে-
“জেনি আপু তুমি যে নিলাচল এসে নীল শাড়ি আনবেনা আমরা কি জানি?”

জেনি আপু মন খারাপ করে বসে থাকলে আমি গিয়ে বললাম-
“আপু এই নাও এটা হালকা নীল কালার সাড়ি আমার কাছে এক্সটা ছিল। এটা পরো। কিন্তু এটার সাথে মিলিয়ে নীল ব্লাউজ নেই।

“উহু মেঘ ওসব লাগবে না। আমার নীল ফতুয়া আছে। জিন্সের ওপর এটা পরে নিতে পারব।”

আমি, রাইমা আপু আর জেনি আপু সেজে গুজে রিসর্ট থেকে বের হলাম একটু দূরেই আকাই ভাইয়া প্রকৃতির ছবি তুলছে আর রুদ্র আর রাকিব ভাই দাড়িয়ে কথা বলছে।
রাইমা আপুকে নীল সাড়িতে খুব মানিয়েছে কিন্তু জেনি আপুকে ভালো লাগলেও নিচের দিক থেকে ঠিক একটা ভালো লাগছেনা জিন্সের কারনে। জেনি আপুর অবস্থা দেখে আমার ওই বাংলা প্রবাদের কথা মনে পরল- ‘উপর ঠিক ঠাক নিচে সদরঘাট।’ সাড়ির সাথে জিন্স সত্যিই হাস্যকর। তবুও এই হালকা রঙের নীল শাড়িতে জেনি আপুকে আকাশের দেবী মনে হচ্ছে।

আমরা রুদ্রদের দিকে এগিয়ে গেলে রাকিব ভাই হালকা হেসে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলে-
“নিলাচলের বুকে তিন নীল রমনী যেন নিলাচলের সূন্দার্য আরো ফুটিয়ে তুলেছে।”

আমি রাকিব ভাইয়ের কথায় মুচকি হাসি দেয়। রুদ্র আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে-
“তোমাকে নীল রঙে যে এত সুন্দর লাগে আগে কেন বলোনি। তাহলে আমি পছন্দের জায়গায় আকাশি না রেখে নিল রঙকে বেশি প্রধান্য দিতাম।”

আমাদের এগিয়ে আসতে দেখে আকাশ ভাইয়া সবার অগোচরে জেনি আপুর কয়েকটা ছবি তুলে নেয়।

জেনি আপু আকাশ ভাইয়ার সামনে গিয়ে বলল-
“এই তুই তো বললি না আমাকে কেমন লাগছে?”

আকাশ ভাইয়া একটু হেসে বলল-
“পেত্নির মতো। জিন্সের সাথে শাড়ি ও মাই গড তুই মনে হয় প্রথম মেয়ে এ কিনা জিন্সের সাথে শাড়ি পরেছে। বুইন তুই আসলেই জিনিয়াস। গ্রামের চাচাতো বোন যখন আধুনিক বউ হয়।”

জেনি আপু আকাশ ভাইয়ার কথা শুনে পিঠে কয়েকটা কিল বসিয়ে বলে-
“হারামি আমি তো আর তোর মত হাফ প্যান্ট পরে নেই। দেখিস আজ যদি কয়েকটা ছেলে পটিয়ে না নেয় তবে আমার নামও জেনি না।”

আমি জেনি আপুর কথায় হালকা হেসে সামনের দিক এগিয়ে যাই। আমার পিছন পিছন সবাই আসছে। আকাশ ভাইয়াকে ঘুম ঘুম চোখে হাঁটতে দেখে রুদ্র বলল-
“সালা ঠিক মত হাঁট। নয়তো এখান থেকে পরে গেলে বিয়ের আগে জেনি বিধবা হবে। রাতে ঠিক মত ঘুমাস নি? আমার বিয়ে করেও তো দিব্যি ঘুমিয়েছি তাহলে তোর হলো কি?”

“ভাই তুই আমার জায়গায় থাকলে বুঝতি। সারারাত বসে বসে ঘুমিয়েছি। এই হারামিটা অচেনা জায়গা ভয় পায়। একটা পাখি ডাক দিলেও চিৎকার করে ওঠে।শেষ রাতে একটু শুইছি তাও আবার সোফায়। একবার ভাব ভাই বিয়ের আগেই এই অবস্থা বিয়ের পর কি হবে?”

আকাশ ভাইয়ের কথা শুনে আমরা সবাই হেসে ওঠলাম। পাহাড়ের মাঝখান থেকে রাস্তা। রাস্তার দু পাশে মনে হচ্ছে প্রকৃতি সূন্দার্য এখানে এসে ঘুমিয়ে আছে। আমরা সবাই হেঁটে হেঁটে সব জায়গা দেখছি। চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে আকাশের নিচে মেঘ আর সেই মেঘের ভিতর বাড়ি।
হঠাৎ আমি একটা জায়গা দেখে সেখানে দৌড়ে যাই। জায়গাটার নাম রোয়াদো রং। জায়গা খুব সুন্দর আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি। এখানে দাড়িয়ে কয়েকটা দিন অনায়াসে পাড় করে দেওয়া যায়।
আমার পাশে চোখ পরতেই দেখি রুদ্র আমার দিকে ঘোড় লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি আচমকা খুশিরে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরি।

“মেঘ ছাড়ো, সবাই তাকিয়ে আছে।”

আমার চারদিকের কথা মনে পরতেই তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়। দেখি আশেপাশের সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি লজ্জায় মাথা নত করে ভাবি- এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে আমি কি অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরেছি। এটাতো আমারই জামাই।”
‘আমার জামাই’ কথাটা মনে মনে কয়েকবার আওড়াতেই আবার লজ্জায় লাল হয়ে ওঠি।

আকাশ ভাইয়া আমাদের সবার ছবি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে বসে আছেন। কিন্তু বসে বসে জেনি আপুর ছবি তুলে যাচ্ছেন। জেনি আপু বিভিন্ন পোজে দাড়াচ্ছে আর আকাশ ভাইয়া বিরক্ত মাখা ভঙ্গিতে সেগুলো ক্যামেরায় বন্দি করছে।

আমি হাঁটতে হাঁটতে একটা পাথরের উপর বসতে গিয়ে পিছলে অন্য একটা পাথরের উপর পরি। আর একটা পাথর আমার পায়ে এসে পরে।
তেমন একটা ব্যাথা না পেলেও এখন এতটা দূর হাঁটা সম্ভব না। আমাকে বসে থাকতে দেখে রুদ্র আমাকে ওঠিয়ে তার কোলে নেয়। আমি বার বার বলছি আমি হেঁটে যেতে পারব কিন্তু কে শুনে কার কথা।
চারপাশের সবাই আমাদের দেখে জোড়ে চিৎকার করছে। কেউ ভিডিও করছে। আমি লজ্জায় রুদ্রের গলা জড়িয়ে ধরে বুকের ভিতর মাথা লুকিয়ে রাখলাম।

#চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে