মন গহীনের শব্দ পর্ব-০৮

0
405

মন গহীনের শব্দ
| ৮ |
কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের কাছে একশ তামিম ভাইও মূল্যহীন।আমি তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললাম, “সুন্দর লাগছে।”
উত্তরে আবারও সেই হৃদয় কাঁপানো শব্দহীন হাসি। তিনি গাড়ি স্টার্ট দিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আজ কি আমরা শুধু গাড়িতেই থাকব?”
“নদীর পাড়ে যাব। ওখানে কিছুক্ষন থেকে সন্ধ্যার আগেই বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসব তোমাকে।”
“এই না প্লিজ, আজ আমি বেশি রাত অব্দি বাইরে থাকব।”
“সুজাতা, বিয়েটা হয়নি এখনও। বেশিক্ষন এভাবে থাকাটা বোধহয় ঠিক হবে না। তাহলে আজ ভুল কিছু হলেও হয়ে যেতে পারে।”
“সবকিছুতেই শুধু বিয়ে, বিয়ে আর বিয়ে। তারমানে বিয়ের আগে আমি কিছুই করতে পারব না। ওকে, চলুন তাহলে আজই বিয়ে করে ফেলি।”

কথা শেষ করেই খেয়াল হলো আমার। হুট করে এসব কী বলে ফেললাম? লজ্জায় মাটি ভাগ করে ভিতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে হলো। চট করেই মাথাটা ঘুড়িয়ে অন্যদিকে তাকালাম। আমার লজ্জা আরো বাড়িয়ে দিতে তিনি উচ্চশব্দে হেসে উঠলেন।
“ম্যাডামের তো দেখছি বিয়ে করার খুবই তাড়া।”
আমি বললাম, “প্লিজ, চুপ করেন।”।
তিনি চুপ করলেন না। বলতেই থাকলেন, “আমারও অবশ্য ইচ্ছে আছে বিয়েটা জলদিই করার। তবে আমি ভেবেছিলাম তুমি ভার্সিটি জয়েন করার পরে ধীরেসুস্থে যা করার করব। কিন্তু এখন তোমার আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে, এতটা দেরি করা মনেহয় ঠিক হবে না। আমাকে দূরে সরিয়ে আজকাল তুমি দেখি থাকতেই পারছ না একদম।”
আমি কাতর স্বরে তাকে বললাম, “প্লিজ, এবার অন্তত থামেন।”

কিন্তু আমার অনুরোধ শোনার সময় কই তার। একের পর এক লজ্জা দিয়ে যেতেই থাকলেন তিনি। সন্ধায় বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা থাকলেও দিলেন না তিনি। মাগরিবের ওয়াক্তে আমাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখেই লক করে পাশের মসজিদে নামাজে গেলেন।

আজকাল অবশ্য আমিও নামাজে নিয়মিত হয়েছি। তবে এখন মাসের বিশেষ দিনগুলো চলছে বলে নামাজের তাড়া নেই।

অনেকটা সময় একসাথে কাটিয়ে আমকে যখন বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলেন তখন প্রায় রাত দশটা বাজে ঘড়িতে। তখনও আমি জানতাম না যে পরের দিন এতবড় একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে আমার জন্য। এক রাতের মধ্যে তিনি কী এমন করলেন জানি না। পরেরদিন বাদ মাগরিব কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই তার সাথে আমার বিয়েটা হয়ে গেল। একটা লাল জামদানি পড়ে কোনোপ্রকার সাজসজ্জাহীন আমি সোফায় গিয়ে তার পাশে বসলাম। শুধু আমাদের বাসার লোক আর আলতাফ ভাইয়ের দুজন বন্ধুর উপস্থিতিতে বিয়ের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একে অপরের জন্য বৈধ হয়ে গেলাম আমরা। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, আপাতত ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা পর্যন্তই স্থগিত থাকবে সব৷ বাবার নির্বাচনের পরে বড় করে আয়োজন করা হবে। আমার বিশ্বাসই হলো না প্রথমে, এই মানুষটা আজ থেকে শুধু আমার।

রাতে খাওয়ার পর আলতাফ ভাইকে আমার রুমেই পাঠানো হলো আজ। বিয়ের পর প্রথম তার সাথে একা আমি। লজ্জা আর অস্বস্তি ঘিরে ধরল আমাকে। খাটের এককোনে চুপচাপ গিয়ে বসলাম আমি। তিনি আমার পাশে বসলেন কোনোরকম দূরত্ব না রেখেই। আমার একটা হাত টেনে নিলেন তার কোলের মধ্যে। আমি নড়েচড়ে বসলাম। আজকে নিশ্চই তিনি তার অধিকার আদায় করে নেবেন। আজকে রাতটা কেমন হতে পারে, সেটা ভাবতেই প্রচন্ড রকমের লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি। লজ্জার সাথে সাথে অস্বস্তিও বাড়ছে। না, তার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে কোনো দ্বিধা নেই আমার। তবে আজ তো আমি প্রস্তুত নই শারীরিকভাবে। এই বিষয়টা কীভাবে বলব তাকে সেটা ভাবতেই কুকড়ে যাচ্ছিলাম আমি। তিনি একের পর এক উষ্ণ স্পর্শ একে দিলেন আমার কপালে, ঠোঁটে, গালে। তারপর একেবারে পেঁচিয়ে ধরে শুয়ে পড়লেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেই বিভিন্ন কথাবার্তা বলতে থাকলেন তিনি। প্রত্যেক মুহুর্তেই আমার মনে হলো, এই বুঝি তিনি আরেকটু গভীরভাবে ছুঁতে চাইবেন আমাকে। কিন্তু অনেকক্ষন কেটে যাওয়ার পরেও যখন তিনি সেরকম কিছু করলেন না, তখন আমি নিজেই প্রশ্ন করলাম,
“এতদিন তো বিয়ে হয়নি, সেই ছুতোয় দূরে সরিয়ে রাখতেন আমাকে। কিন্তু এখন তো আমি আপনার জন্য হালাল। তবুও কেন নিজের অধিকার আদায় করে নিচ্ছেন না?”

তিনি সাথে সাথেই উত্তর দিলেন, “কারন তুমি এখন শারিরীকভাবে প্রিপেয়ার্ড নও। খুব সম্ভবত মাসের একটি বিশেষ সময় চলছে তোমার এখন।”

আমি প্রথমে চমকে উঠলাম। তারপর লজ্জায় চুপসে গেলাম। তার বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কীভাবে বুঝলেন?”

“এই সময়টাতে তোমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসে। ফ্রেশ মুখটাতে কয়েকটা ব্রন দেখা যায়, চোখের নিচে কালি পড়ে, হাঁটার স্টাইলেও চেঞ্জ আসে কিছুটা। অন্যান্য সময় তুমি খুব চঞ্চল, ধুপধাপ বসে পড়, উঠে দাড়াও, চটপট সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাও। কিন্তু এই সময়টাতে বসতে উঠতে গেলে তুমি সময় নাও কিছুটা। গতকাল অনেকটা সময় তুমি আমার সাথে ছিলে। এই সময়টাতে কিছু ব্যাপার আরও বেশি চোখে পড়েছে আমার।”
আমি লজ্জায় আর মাথা তুললাম না। আমার ব্যাপারে এত ছোটো ছোটো বিষয়ও তিনি নোটিশ করেছেন। আর আমি বোকা এতদিন কিনা ভাবতাম, তিনি বোধহয় ভালো করে আমার দিকে তাকানও না। আলতাফ ভাই হেসে বললেন, “ও ময়না, তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো?”
আমি কৃত্রিম রাগ নিয়ে তার দিকে তাকালাম। বললাম, “আলতাফ ভাই প্লিজ, আপনি অন্তত এই নামে ডাকা শুরু করবেন না এখন।”

“হাসব না কি কাঁদব বুঝতে পারছি না। বউ দেখি এখনও আমাকে ভাই বলে ডাকে।”

আমি জিভে কামড় দিয়ে বললাম, “অনেকদিনের অভ্যাস, ঠিক হতে সময় লাগবে।”
“আচ্ছা যাও, আজ রাত পুরোটা দিলাম তোমাকে। শুধু নাম ধরে ডেকে ডেকে অভ্যাস করো। কাল থেকে ভাই টাই বাদ।”

আমি হাসলাম। পুরো রাত কাটল আমাদের গল্প আর খুঁনসুটিতে।

দেখতে দেখতে চলে গেল আরো দুই মাস। এই দুই মাসে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। আলতাফের সাথে সম্পর্ক অনেকটাই এগিয়েছে। বিয়ের আগে যে মানুষটাকে একেবারেই বেরসিক মনে হয়েছিল, এই একমাসে প্রত্যেকদিন তাকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করছি। প্রায় প্রত্যেকদিন রাতেই কোনো না কোনো ছুতোয় বাসায় এসে হাজির হয় সে। এসে আমাকে রুমে পেলেই দরজা আটকে দেবে অথবা বাইরে থাকলে সবার সামনেই ডাক দিয়ে বলবে, “সুজাতা, একটু রুমে এসো তো।”
সবার সামনে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে তখন। দাদি আর রুনি মিটিমিটি হাসে।

আজকে বাসায় ব্যস্ততা প্রচুর। রাত পোহালেই নির্বাচন। আলতাফ, বাবা আর দলের ছেলেপেলেরা ব্যস্ত সকাল থেকেই। সুলেখা আন্টি আর দাদি চিন্তা করছে খুব৷ পরেরদিন ঝামেলাহীন ভাবেই কাটল। মধ্যরাতে বাবার দলের ছেলেপেলেরা উচুঁকন্ঠে স্লোগান দিতে দিতে বিজয়োল্লাসে মেতে উঠল। বাবার জয়লাভে সবাই খুব খুশি। ফলাফল জানার সাথে সাথেই সুলেখা আন্টি নফল নামাজ আদায় করতে গেল। পরেরদিন সকালে আত্মীয়স্বজনে ঘর ভরে গেল। সবাই বাবাকে শুভেচ্ছা জানাতে আসছে। ফুপুও মান অভিমান সব ভুলে আমাদের বাসায় এলো। তিনদিন ধরে চলল মহাভোজ। হাসি আর আনন্দে মেতে থাকলাম সবাই। কিন্তু সেই আনন্দ বেশিদিন রইল না আমাদের।

সপ্তাহখানেক পড়ে পরে হুট করেই একদিন সুলেখা আন্টির শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো। আমিই তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। নরলাম কিছু চেকাপ করে টেস্ট দিলেন। রিপোর্ট পাওয়া যাবে দুই দিন পর। দুদিন পরে রিপোর্ট নিয়ে আবার ডাক্তারের সাথে দেখা করতে গেলাম। রিপোর্টগুলো দেখেই ডাক্তারের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একই টেস্ট আবার করাতে দিলেন। দ্বিতীয়বারেও সেই একই হতাশা তার চেহারায়। তিনি সুলেখা আন্টিকে বললেন, “আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে খুব। আপনি বরং পাশের রুমে গিয়ে রেস্ট করুন। আমি ততক্ষনে আপনার মেয়ের সাথে কথা বলি।”
সুলেখা আন্টি বললেন, “ডক্টর, আমার কি সিরিয়াস কিছু হয়েছে?”
“আরে না, তেমন কিছু না।”
“দেখুন ডক্টর, আমি টিনেজার নই। আপনি যা খুশি তাই বোঝাতে পারবেন না আমাকে। নিজের বড় ধরনের কোনো অসুখের কথা শুনে ভেঙ্গে পড়ার মত দুর্বলও আমি নই। আপনি নির্দ্বিধায় আমার কাছে সত্যিটা বলতে পারেন।”

অগত্যা ডাক্তার বললেন, “আপনার রিপোর্টে লিউকোমিয়া এসেছে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে রক্তের ক্যান্সার। আর অনেকটা দেরি করে ফেলেছেন আপনারা। প্রাইমারি স্টেজে ধরা পড়লে হয়তো ট্রিটমেন্টে কাজ হতো। এখনও আমি ট্রিটমেন্ট দেব। তবে নিশ্চয়তা দিতে পারছি না কিছুতেই।”

সুলেখা আন্টি শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “ডক্টর, আমার হাতে আর কতদিন সময় আছে? বছরখানেক নাকি আরও কম?”

ডাক্তার মাথা নিচু করে ফেললেন। সুলেখা আন্টি হেসে বললেন, “তারমানে সময় আরও কম?”

ডাক্তার কিছু বলার আগেই আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম ওখানে বসেই। সুলেখা আন্টি স্বাভাবিকভাবেই ডাক্তারের সাথে কথা বলে বের হয়ে এলো। পুরোটা সময় আমি তার হাত ধরে রাখলাম শক্ত করে। সুলেখা আন্টি বাইরে বের হয়ে বলল, “সু, নদীর পাড়ের পার্কটায় যাবে? রাতের এই সময়টাতে চমৎকার লাগে জায়গাটা।”
আমি চোখ মুছে বললাম, “যাব।”

নদীর পাড়ে ভালোই মানুষের ভীর৷ সুলেখা আন্টি আর আমি নিরিবিলি এককোনে টাইলস করা বেঞ্চে বসলাম। আমি তখনও নিশব্দে কেঁদে যাচ্ছি৷ সুলেখা আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বোকা মেয়ে, কাঁদছ কেন? শক্ত করো নিজেকে।”

অবাধ্য অশ্রুর সাথে সাথে ভেতরের জমা কষ্টগুলোও বাঁধ ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসতে চাইল এবার৷ আমি কান্না চেপে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললাম, “আমার সাথেই কেন এমন হয় সবসময়? মা কী, সেটা বোঝার আগেই সে আমাকে ছেঁড়ে চলে গেল। একটু একটু করে বুঝতে শিখলাম যখন, তখন আঁকড়ে ধরলাম তোমাকে৷ তারপর থেকে তোমার কাছেই মায়ের আদর, স্নেহ, ভালোবাসা খুঁজেছি। তোমার আঁচলে অদৃশ্যভাবে বেঁধে নিয়েছি নিজেকে। মায়ের জায়গাটা পুরোপুরিই তোমাকে দিয়ে দিয়েছি আমি৷ অথচ আজ তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছ। মায়েরা নাকি মমতায় গড়া হয়৷ তাহলে তোমরা এত নিষ্ঠুর কেন?
সুলেখা আন্টি নিজেকে সামলাতে পারল না আর। রাতের আলো আঁধারে রোডসাইড ল্যামপোস্টের আবছা আলোয় আমি দেখলাম, সে কাঁদছে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে