ভালোবেসে ঠাঁই দিও পরাণে পর্ব-০৩

0
299

#ভালোবেসে_ঠাঁই_দিও_পরাণে

#পর্ব_০৩

#নুজাইফা_নূন

-“শেষে কিনা একজন শ্বেতী রোগীর সাথে এমন সোনার টুকরো ছেলের বিয়ে দিলেন ভাবি? এইভাবে ছেলেটার জীবন নিজে হাতে শেষ করে দিতে পারলেন ভাবি?আমার বোনের মেয়ে সোনিয়া দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি স্মার্ট।কোটি কোটি টাকার একমাত্র ওয়ারিশ। ভবিষ্যতে সব টাকার মালিক সোনিয়ার জামাই হবে। আপনাকে কতো বার বললাম সোনিয়াকে আপনার বাড়ির পুত্রবধূ করে নিন। কিন্তু আপনি আমাকে পাত্তাই দিলেন না।অথচ এমন মেয়ের সাথেই রাদিয়াতের বিয়ে দিলেন , যে মেয়েকে কখনো রাদিয়াতের ব‌উ হিসেবে কারো সামনে দাঁড় করাতে পারবেন না।এমনটা কেনো করলেন ভাবি? আজ যদি আপনি রাদিয়াতের রাদিয়াতের গর্ভধারণী মা হতেন তাহলে কি রাদিয়াতের সাথে এমন অন্যায় করতে পারতেন?”

-” সকালে তমা মির্জা কিচেনে ব্রেকফাস্ট তৈরি করছিলেন এমন পাশের ফ্ল্যাটের মিলি ভাবী রাদিয়াতের ব‌উ দেখতে এসে উপরোক্ত কথাগুলো বললেন। কথাগুলো শুনে তমা মির্জার মনে হলো যেন কেউ তার বুকে ছুরি দ্বারা আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। হ্যাঁ সে রাদিয়াত কে নিজের গর্ভে ধারণ করে নি।তাকে দুনিয়ার আনার জন্য প্রসব বেদনা সহ্য করে নি। কিন্তু জন্ম দিলেই যদি মা হ‌ওয়া যেতো তাহলে নর্দমায়, ঝোপ ঝাড়, বনে জঙ্গলে হাজার হাজার নিষ্পাপ শিশুর মৃত দেহ পড়ে থাকতো না।সেসব মা তাদের কে দুনিয়ার আলো দেখার আগেই নিজে হাতে হ’ত্যা করে রাস্তায় রাস্তায় কুকুরের খাদ্য হিসেবে ফেলে রেখে যেতো না।রাদিয়াত যখন ছয় মাসের তখন রাদিয়াতের মা সোহানা মির্জা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মা’রা যান। প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে ভেঙ্গে পড়েন রাদিয়াতের বাবা রফিকুল মির্জা। এতটুকু বাচ্চা ছেলে মা ছাড়া কিভাবে তাকে একা হাতে বড় করবে ভেবে পান না রফিকুল মির্জা।সকলে তাকে দ্বিতীয় বার বিয়ে করার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি মনে করেন সৎ মায়ের কাছে আমার ছেলে কখনো মায়ের আদর ভালোবাসা পাবে না।তাই তিনি রাদিয়াত কে নিয়ে’ই নিজের অফিসে যাওয়া আসা করতেন। কিন্তু এহেন কার্যে তার উপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে যায়।দুই দিক সামলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেন তিনি। ব্যাপার টা নোটিশ করেন‌ তার অফিসের কর্মচারী গফুর মিয়া।গফুর মিয়ার বাসা অফিসের পাশেই ছিলো। তিনি রাদিয়াত কে তাদের বাড়ি নিয়ে যান। গফুর মিয়ার মেয়ে তমা রাদিয়াত কে পেয়ে নিজের বুকে টেনে নেন।আর আশ্চর্যজনক ভাবে রাদিয়াত ও তমার বুকে বিড়াল ছানার মতো লেপ্টে পড়ে থাকে। এভাবেই কেটে যায় কিছুদিন। রফিক মির্জা লক্ষ্য করেন তার ছেলে যতোটুকু সময় তমার সাথে থাকে ততক্ষণ সে হাসিখুশি থাকে।এক পর্যায়ে নিজের ছেলের খুশির জন্য রফিক মির্জার তমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া বাড়তে থাকে।এই নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে গফুর মিয়া তার মেয়ে তমাকে বিয়ে করার জন্য রফিক মির্জার কাছে তার আর্জি জানান। গফুর মিয়া রফিক মির্জার অত্যন্ত বিশ্বস্ত একজন লোক।তার পরিবারের সবাই অনেক ভালো।রফিক মির্জা এর আগেও কয়েকবার গিয়েছেন তাদের বাড়ি। গফুর মিয়ার পরিবারের সদস্যদের আন্তরিকতা দেখে তিনি বরাবরই মুগ্ধ হয়েছেন। মানুষ টা অনেক সহজ সরল। অনেক টাকা পয়সা খরচা করে তার একমাত্র মেয়ে তমাকে বিয়ে দেন। কিন্তু বিয়ের পর তমার স্বামী প্রতিনিয়ত তাকে মেন্টালি , ফিজিক্যালি টর্চার করে। কিছুদিন পর পর তমাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয় টাকা নিয়ে আসার জন্য। গফুর মিয়া তার মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তমাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। সমাজের কাছে সে হয়ে যায় একজন ডিভোর্সি মেয়ে। বখাটে ছেলেদের কুপ্রস্তাব, নানান লোকের নানান কথা শুনতে হয় তাকে।এসব কথা কানে এসেছে রফিক মির্জার। কিন্তু তার যে করার কিছুই ছিলো না। তিনি অপরাগ ছিলেন। গফুর মিয়া যখন তমাকে বিয়ে করার জন্য তার কাছে প্রস্তাব দেন, তিনি ভেবে দেখেন মেয়েটা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। প্রতিনিয়ত পুড়েছে।সে নিশ্চয় অন্যের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারবে।অন্যের ছেলেটাকে নিজের ছেলে হিসাবে গ্ৰহন করতে তার কোনো আপত্তি থাকবে না। তাছাড়া রফিক মির্জা রাদিয়াতের জন্য তমার চোখে ভালোবাসা দেখেছেন ।সব দিক ভেবে রফিক মির্জা আর দ্বিমত করেন না। তিনি তমার সাথে দ্বিতীয় বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।তমা সবসময় রাদিয়াত কে নিজের ছেলে মনে করেন। কক্ষনো রাদিয়াতের কোনো চাওয়া অপূর্ণ রাখেনি। বরং তিনি তুলির থেকে ও রাদিয়াত কে বেশি ভালোবাসে।তার এমন ভালোবাসার জন্য রাদিয়াত কখনো বুঝতে পারে নি তমা তার সৎ মা।রাদিয়াত তমাকে তার নিজের গর্ভধারিনী মা হিসেবে জানে।তাকে সম্মান করে ,ভালোবাসে। কিন্তু রাদিয়াত যখন এই সত্যিটা জানতে পারবে, তখন রাদিয়াত অনেক ভেঙ্গে পড়বে ভাবতেই আতঙ্কে কেঁপে উঠেন তমা মির্জা।তিনি মিলির হাত ধরেন বলেন,

-” জন্ম , মৃত্যু , বিয়ে আল্লাহর হাতে ভাবী। আল্লাহ তায়ালা যার রুজি যেখানে লিখে রাখছে সে কোনো না কোনো মাধ্যমে সেখানে পৌঁছে যায়। আল্লাহ তায়ালা রাদের জন্য রুকু কে হয়তো আগে থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। তাছাড়া রুকু অত্যন্ত ভদ্র , শিক্ষিত একটা মেয়ে। শুধু মাত্র শ্বেতী রোগটা’ই ওর জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু শ্বেতী কোনো ছোঁয়াচে বা প্রাণঘাতী রোগ নয়। সাধারণত শরীরের কোনো বিশেষ স্থানের ত্বকের রং উৎপাদনকারী কোষ বা মেলানোসাইট রোগাক্রান্ত হলে বা সংখ্যায় কমে গেলে অথবা ম’রে গেলে মেলানিন নামক ত্বকের রঞ্জন তৈরি বন্ধ হয়ে যায় এবং ঐ নির্দিষ্ট স্থানে সাদা সাদা দাগ পড়ে।আমাদের ত্বকের মধ্যে মেলানোসাইট কোষে থাকে মেলানিন, যা ত্বকের স্বাভাবিক রঙের ভারসাম্য রক্ষা করে। মেলানিনের ক্রিয়াকলাপে বাধা সৃষ্টি হলে বা ভারসাম্য নষ্ট হলে দেখা দেয় শ্বেতী। শ্বেতী বা ধবল বংশগত কারণে হতে পারে। প্রতি ১০০ জন শ্বেতী রোগীর মধ্যে ৩০ জনের ক্ষেত্রেই শ্বেতী হয় বংশগত ধারায়, মাতৃ বা পিতৃকুলের কারও না কারও থেকে জিনের প্রভাবে। বাকি ৭০ শতাংশের ক্ষেত্রে শ্বেতী সাদা দাগ ছড়াতে থাকে নিজস্ব কারণে, যার মূলে রয়েছে মেলানিনের কারসাজি।বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ১০ কোটি মানুষ শ্বেতীতে আক্রান্ত। প্রয়াত শিল্পী মাইকেল জ্যাকসনও এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাই প্রতিবছর ২৬ জুন তাঁর প্রয়াণ দিবসে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘ওয়ার্ল্ড ভিটিলিগো ডে’ বা বিশ্ব শ্বেতী দিবস হিসেবে।[ সোর্স : গুগল]আমরা আসলে শ্বেতী রোগ নিয়ে নিজেদের মধ্যে অনেক কুসংস্কার পোষন করে রাখি। কিন্তু কুসংস্কার এড়িয়ে যথাযথ চিকিৎসা নিলে এ রোগ ভালো হয়ে যায়। আমি রুকু কে ভালো ডক্টর দেখাবো ।রুকু একদিন ঠিকই আপনার আমার মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে।তবে আপনার কাছে আমার একটাই অনুরোধ আপনি রাদের ব্যাপারে যা জানেন কখনো রাদ কে ওর সত্যিটা বলবেন না প্লিজ ভাবী।আমার ছেলেটা অনেক কষ্ট পাবে।”

-” ঠিক আছে ভাবী ।যদি ও সোনিয়ার জন্য আমার খারাপ লাগছিলো। সোনিয়া রাদ কে অনেক ভালোবাসতো। কিন্তু আমি ও তো একটা মা। আপনার কষ্ট টা আমি বুঝতে পারছি ভাবী।আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন রাদ কে আমি কিছুই বলবো না। হঠাৎ তমার মনে হলো কেউ হয়তো তাদের কথা শুনছিলো।সে একটা ছায়া কে সরে যেতে দেখলো।তমার ধারণা কে সত্যি করে দিয়ে অবয়ব টা একটু দূরে এসে পৌশাচিক হেসে বললো, এটাই তাহলে আসল ঘটনা।এবার জমবে মজা।”
___________________________________

-” রুকু ফজরের নামাজ শেষ করে কিছুক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করে নিজের কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখছে এমন সময় তার ফোনের স্ক্রিনে রিমন নামটা ভেসে উঠে।রিমন নাম টা দেখে কলিজা মোচড় দিয়ে ওঠে রুকুর।রিমন বারো বছর বয়সী হলেও অন্য ছেলেদের তুলনায় সে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠে নি।তার বোধশক্তি ও কম।রুকু ছাড়া কিছু বোঝে না সে।তার গোসল , খাওয়া দাওয়া সবটা করতে হতো রুকুকে।তাকে ছাড়া ছেলেটার পাগলামি নিশ্চয় আরো বেড়ে গিয়েছে ভাবতেই রুকুর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো।রুকু চোখের পানি মুছে রিমনের কল কেটে দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল দিলো।আর তখনি কোথা থেকে রাদ এসে রুকুর হাত থেকে ছো মে’রে ফোন কেড়ে নিলো‌।”

চলবে ইনশাআল্লাহ।।।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে