ভালোবাসি তোকে পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0
4103

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৫
.
আমি ওদের দেখে ভয়ে গুটিয়ে বসলাম। এরা কতটা ভয়ংকর তার প্রমাণ আগেও পেয়েছি আমি। হঠাৎ করেই যে এভাবে আমার সামনে চলে আসবে সেটা ভাবতেও পারিনি। তারমানে সেদিন পার্টিতে আমি ভুল দেখিনি। চারজনের পোশাকই কালো। আবছা অন্ধকার হলেও এটুকু বোঝা যাচ্ছে। আর প্রত্যেককের মুখেই মাস্ক পরা। সামনে থাকা লোকটার মাস্কের সাথে লম্বা হুডিও পরা। আমি উঠে দৌড়ে পালাতে গেলেই হুডি পরা লোকটা আমার হাত শক্ত করে ধরে ফেলল। পাশ থেকে একজন বলল,

— ” পালাতে চাইছ হ্যাঁ? তোমার কী মনে হয়? সবসময় পালানোটা এতো সহজ? সেদিন তোমরা পালাতে পেরেছিলে বলে সবসময় পারবে? হ্যাঁ?”

আমি আশেপাশে একবার তাকালাম। এখন যদি আমি চিৎকার করি তাহলে কী কেউ শুনবে? অডিটোরিয়ামটা তো একটু দূরে। না একটা শেষ চেষ্টা তো করতেই পারি। তাই আমি জোরে চিৎকার করে বললাম,

— ” হেল্প। কেউ আছেন? প্লিজ হেল্প। আদ্রিয়ান..”

আর কিছু বলার আগেই হুডি পরা লোকটা আমার মুখ চেপে ধরে আবারও ধাক্কা দিয়ে দেয়ালের দিকে ছুড়ে মারলো। কপালে আঘাত পেয়ে মাথা চেপে ধরে বসে পরলাম। ভয়ে শব্দ করে কেঁদে দিলাম। হঠাৎ করে আবারও এখন এদের মুখোমুখি হতে হবে সেটা চিন্তাও করিনি। আমি না চাইতেও নিজেকে এদের সাথে জড়িয়ে ফেলেছিলাম। আর এখন চেয়েও এদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারছিনা। পাশ থেকে আরেকজন বলল,

— ” এতো এখনও আগের মতো বাচ্চাই আছে। ভাবলাম দু-বছরে হয়তো বড় হয়েছে। কিন্তু এখনও তো এ সেই বাচ্চামোই করে যাচ্ছে?”

বাকি দুজন হেসে দিল। সামনের লোকটা আমার সামনে হাটু ভেঙ্গে বসল। আমি ভয় পেয়ে একটু গুটিয়ে বসে আমি গুটিয়ে বসে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

— ” আপনারা কেন পরে আছেন আমার পেছনে?”

লোকটা আমার গাল চেপে ধরে বলল,

— ” সত্যিই জানোনা কেন পরে আছি? জানোনা কী করেছো তুমি? বাচ্চা একটা মেয়ে হয়ে আমাদের এত দিনের পরিশ্রমে পানি ঢেলে দিয়েছো। আর এখন জানতে চাইছো যে তুমি কী করেছো?”

আমি কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,

— ” অ্ আমি কিছু করিনি। আমি জানিনা ঐ পাসকোডটা..”

এটুকু বলে নিজেই থেমে গেলাম। জানিনা বলেও তো বলে দিচ্ছিলাম। আমার কথাটা শুনে এবার আমার চুল টেনে ধরল লোকটা। আমি মৃদু চিৎকার করে উঠলাম। লোকটা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

— ” তুমি নিজেই বলে দিলে যে তুমি সব জানো। এবার ঝটপট বলে ফেলো। কী করেছো ওটা নিয়ে?”

আমি চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে অস্ফুট স্বরে বললাম,

— ” আমি জানিনা।”

এবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বলল,

— ” এভাবে হবে না। ঠাটিয়ে দুটো চড় মারলে এমনিই সব বেড়িয়ে।”

বলে আমার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই আমরা সামনে বসে থাকা লোকটা ধমকের সুরে বলল,

— ” স্টপ। সবসময় মাথা গরম করে সব হয়না। যা বলার আমি বলছি তো?”

আমার এই চারজনের মধ্যে দুজনের গলা খুব বেশিই চেনা চেনা লাগছে। যদিও এদের সবার ভয়েজ একরকম মনে হচ্ছে আমার কাছে। কিন্তু কিছুতো সামনের লোকটা, পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বা পাশের লোকটার কন্ঠটা পরিচিত মনে হচ্ছে। আমার দিকে ঘুরে ওপর হাতে আমার গাল চেপে ধরে বলল,

— ” দেখো তোমার সাথে আমাদের কিছুই নেই। চুপচাপ যা জানতে চাইছি বলে দাও। আমরা এমনিতেই ছেড়ে দেবো তোমাকে।”

আমি এবার হালকা চেঁচিয়ে বললাম,

— ” আমি বলছিতো আমি জানিনা।”

লোকটা পেছন থেকে বন্দুক বের করে আমার মাথায় জোরে চেপে ধরে বলল,

— ” তুমি এখনও বেঁচে আছো কারণ তোমাকে আমাদের দরকার। কিন্তু সেই কাজটাই যদি না হয় তো তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার সত্যিই কোনো মানেই হয়না। তাইনা?”

আমি কিছু বলছিনা, আসলে বলতে পারছিনা। ভয়ের সাথে মাথায় লাগা চোটের কারণে সবকিছু এমনিতেই ঝাপসা হয়ে আসছে।লোকটা বন্দুকটা আরও জোরে চেপে ধরে বলল,

— ” তো তুমি কী ডিসাইড করলে? বলবে নাকি না।?”

কিন্তু আমি এবার কিছুই বললাম না। মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে হিঁচকি দিয়ে কেঁদে যাচ্ছি। আদ্রিয়ানের কথাই মনে পরছে বারবার। কোথায় আছে ও? খুজছে আমায়?লোকটা আমার ঘাড়ের ওপর হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল,

— ” ভালোভাবে বলেছিলাম কিন্তু তুমি শুনলেনা। এখন যা হবে তার জন্যে তুমিই দায়ী থাকবে।”

হঠাৎ আমার মনে হলো আমার ঘাড়ের একটু অংশ জ্বলে উঠলো। আমি মৃদু স্বরে ‘আহ’ করে উঠলাম। পাশ থেকে একজন বলল,

— ” আমিতো বলছি এভাবে বলবে না নিয়ে চলো আমাদের সাথে থার্ড ডিগ্রী পরলে সব বলে দেবে।”

আমার সামনে বসে থাকা লোকটা কোনো উত্তর দিলো না। আমার কাছে আস্তে আস্তে সবটাই ঝাপসা হয়ে এলো। শুধু অস্ফুট স্বরে মুখ দিয়ে একবার ‘আদ্রিয়ান’ শব্দটাই বেড়িয়ে এসছিল। আমাকে নেতিয়ে পরতে দেখে সামনের লোকটা একটা ফোনের টর্চ আমার মুখে মারলো। যার ফলে আমার মুখটা ওদের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল। তখনই পেছনের একটা লোক অবাক কন্ঠে বলল,

— ” এটা কীকরে সম্ভব?”

ব্যস এটুকুই এসছিলো আমার কানে। এরপর ওদের কথাগুলো কানে পৌছলেও মস্তিষ্ক অবধি পৌছালো না, সবটাই অন্ধকার হয়ে গেল।

_________________

হালকা কথাবার্তার আওয়াজে আর মাথায় সামান্য ব্যথা অনুভব করে আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম। প্রথম কয়েক সেকেন্ড সবটাই ঝাপসা লাগছিল আমার কাছে। এরপর আস্তে আস্তে সবটা পরিষ্কার হলো। আমি আমার বেডরুমেই শুয়ে আছি। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলাম আপি, ইফাজ ভাইয়া, বাবা, মামনী, বড় আব্বু, বড় আম্মু, জাবিন, বাড়ির সবাই আছে এখানে। আদিব ভাইয়াও আছে। আর ইসু, অরু, ঐশিও আছে আমার সাথে। হঠাৎ আদ্রিয়ানের কথা মনে পড়তেই পাশে তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান আমার পাশে বসে আছে। হঠাৎ মেডিকেলে ঘটা ঘটনাটা মনে পরতেই আমি তাড়াহুড়ো করে উঠে বসতে নিলেই আদ্রিয়ান আমাকে ধরে ঠান্ডা গলায় বলল,

— ” আস্তে! আমি হেল্প করছি।”

বলে আমাকে উঠিয়ে একটা বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বসালো। কপালে হাত দিয়ে বুঝতে পারলাম মাথায় ব্যান্ডেজ করা আছে। মামনি বলল,

— ” সব সময় এমন বাচ্চামি কেনো করিস বলবি? এতো করে বলি ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া কর কিন্তু তুই শুনিসই না। দেখ আজ কত বড় বিপদ হতে পারতো?”

আপিও বলল,

— ” সেটাই। কারো কোনো কথা শুনে চলে এই মেয়ে?”

আমি একটু অবাক হয়ে তাকালাম। আজ যা হয়েছে তার সাথে আমার খাওয়া দাওয়া বা যত্ন নেওয়ার কী সম্পর্ক? আমি একটু অবাক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছি। কিছু বলল তার আগেই অরু বলল,

— ” সত্যিই। তুই গেলি শাড়িটা ক্লিন করতে আর ওয়াসরুমের সামনেই সেন্সলেস হয়ে পরে রইলি?”

ইসু বলল,

— “ভাগ্যিস শুধু কপালটা একটু কেটেছে। যদি বড় কিছু হয়ে যেতো তো?”

আমি এবার বেশ অনেকটা অবাক হলাম। কী সব বলছে ওরা? আমি ওয়াসরুমের সামনে সেন্সলেস হয়েছিলাম? তারমানে ওরা আমাকে ওখানেই ফেলে রেখে গেছে? বাড়ির লোকেরা এ বিষয়ে কিছুই জানেনা। আর ওদের এসব বলে টেনশনে ফেলারও কোনো মানে নেই। তাই আমি আর কিছু বললাম না। আদ্রিয়ান আদিব ভাইয়াকে বলল,

—- ” আচ্ছা তুই অরুমিতা, ইসরাত আর ঐশ্বর্যকে বাড়িতে পৌছে দে।”

আদিব আমার দিকে তাকিয়ে ”টেইক কেয়ার” বলে ওদের নিয়ে চলে গেল। ওরা যাওয়ার পরে আদ্রিয়ান আপিকে বলল,

— ” বউমনি ওর জন্য লিকুইড কোনো খাবার নিয়ে এসো প্লিজ। সলিড কিছু আজ খেতে পারবেনা ও।”

আপি মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি চলে গেলো। ইফাজ ভাইয়া আমাকে আরও একবার চেক করে। আদ্রিয়ানকে ঔষধগুলো সব বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল। বাকিরাও আস্তে আস্তে চলে গেল রুম থেকে। কারণ বেশ অনেকটাই রাত হয়েছে। সবাই চলে যাওয়ার পর আদ্রিয়ান আমার পাশে বসে আমায় একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,

— ” এখন ভাল লাগছে?”

আমি মাথা নেড়ে ওর বুকে মাথা দিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। ওও কিছু বলল না আলতো হাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল। একটু পর আপিও চলে এলো। আপিকে দেখে ও আমাকে ছেড়ে দূরে সরে বসল। আপি সুপের বাটিটা টি-টেবিলে রেখে বলল,

— ” তোমরা রেস্ট করো আমি আসছি।”

বলে আপি দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি নিজের পরনে কুর্তি আর প্লাজো দেখে একটু অবাক হয়ে বললাম,

— ” আমায় চেঞ্জ কে করালো?”

আদ্রিয়ান নিজের গায়ের পাঞ্জাবীটা খুলছিলেন। আমার কথাটা শুনে একটু দুষ্টু হেসে পাঞ্জাবী খুলে আমার পাশে বসে আমার দিকে ঝুকে বলল,

— ” যদি বলি আমি?”

আমি একটা শুকনা ঢোক গিলে বললাম,

— ” ত্ তুমি করিয়েছো মানে কী? বাড়িতে আর কেউ ছিলোনা।”

ও একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল,

— ” আজব! আমার বউকে আমি বাদে অন্যকেউ চেঞ্জ করাবে কেন?”

আমি মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। সত্যিই কী ও করেছে নাকি? যদিও ও করালে আমার তেমন কোনো সমস্যা নেই আমারই তো বর। কিন্তু চোখেমুখে বিস্ময় রাখাটা আবশ্যক। তাই মুখে একটু টেনশন টেনশন ভাব ফুটিয়ে নিলাম। উনি আমার মুখের সামনে তুরি বাজিয়ে বলল,

— ” এইযে ম্যাডাম। যতোটা চিন্তিত হওয়ার অভিনয় করছো ততোটা চিন্তিত তুমি নও। সো ড্রামা বন্ধ করো। আর চেঞ্জ আমি না বউমনি করিয়েছে।”

আমি আড়চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলাম। উনিও হেসে দিয়ে জড়িয়ে ধরল আমাকে। তারপর বলল,

— ” অনেক দুষ্টুমি হয়েছে এবার খেয়ে ঘুমিয়ে পরো বারোটা বাজে।”

আমি একটু ইচ্ছে করেই একটু ড্রামা করে বাচ্চাদের মত করে বললাম,

— ” তুমি খাইয়ে দাও।”

উনি চোখ ছোট ছোট করে কিছুক্ষণ আমার দিকের তাকিয়ে থেকে হেসে আমার চুলগুলো হাত নেড়ে দিয়ে বললেন,

— ” মাই সুইট ড্রামা কুইন। এতো ড্রামা করার দরকার নেই। এমনিতেও আমিই খাইয়ে দিতাম।”

আমি একটু হাসলাম কিন্তু কিছু বললাম না। ও আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে আর আমি তাকিয়ে শুধু দেখছি ওকে। যতক্ষণ খাইয়েছে ততক্ষণ শুধু দেখেই গেছি ওকে। ওর সেদিকে কোনো খেয়াল ছিলনা, ও একমনে খাইয়ে যাচ্ছিল আমায়। আমায় খাওয়ানো শেষ করে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিল। তারপর দুজনেই শুয়ে পরলাম। আজ ওকে বলতে হয়নি আমি নিজেই ওর বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পরলাম। ও বরাবরের মতই আমাকে নিজের সাথে শক্ত করে মিশিয়ে ধরে শুয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর মাথায় বেশ সময় নিয়ে একটা চুমু দিলো। এতক্ষণ হাসি মজার মধ্যে সব ভুলে গেলেও এখন আবার সবটাই মনে পরলো। আর তারসাথে মনে ভয় বাসা বাধল। ওরা যে আবার আসবে সেটাতো জানি আমি। কিন্তু আমার জন্য আদ্রিয়ান বা এই পরিবারের কেউ বিপদে পরবে না তো। ওরা যে কতোটা ভয়ঙ্কর তা আমার চেয়ে ভালো কে জানে? এসব নানা রকমের চিন্তা আর তারওপর ক্লান্ত থাকায় তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পরলাম।

__________________

সকালে বেশ দেরী করেই ঘুম থেকে উঠলাম। কিন্তু উঠে ওনাকে পাশে দেখতে পেলাম না। উঠে সারারুমে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম কিন্তু ওনাকে দেখতে না পেয়ে আস্তে আস্তে নেমে দাঁড়ালাম। মাথাটা খুব বেশি ব্যথা করছে। আসলে চোটটা কালকে বুঝে উঠতে না পারলেও আজ বুঝতে পারছি বেশ জোরেই ব্যথা লেগেছে। হেটে একটু এগোতে নিলেই মাথা চক্কর মারলো। তাড়াতাড়ি খাট ধরে বসে পরলাম। আদ্রিয়ান তাড়াতাড়ি এসে আমার পাশে আমাকে ধরে বলল,

— ” ঠিক আছো? মাথা ব্যথা করছে?”

— ” নাহ জাস্ট একটু ঘুরে উঠেছিল। ঠিক আছি এখন। তুমি কোথায় ছিলে?”

— ” ব্যালকনিতে ছিলাম। ওয়াসরুমে যাবে?”

আমি মাথা নাড়লাম। ও আমায় কোলে করে ওয়াসরুমের দরজা অবধি নিয়ে গেল। তারপর আসার সময় কোলে করেই খাট অবধি নিয়ে এল। একটু পরে আপি খাবারের প্লেট নিয়ে ভেতরে আসতেই আদ্রিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

— ” বউমনি ওকে একটু খাইয়ে দাও আমার একটু বাইরে যেতে হবে।”

আমি একটু ক্লান্ত স্বরে বললাম,

— ” কোথায় যাচ্ছো?”

আদ্রিয়ান একটু হেসে আমার সামনে বস গালের ওপর হাত রেখে বলল,

— ” একটু কাজ আছে ল্যাবে। আজ তাড়াতাড়ি চলে আসবো আমি। তুমি রেস্ট করো।”

আমি মাথা নাড়লাম। ও চলে যাওয়ার পর আপি আমার সামনে বসে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে বলল,

— ” কতবার বলেছি বলতো যে ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া কর। কিন্তু তুই কথাই শুনিস না।”

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্হির কন্ঠে বললাম,

— ” ওরা ফিরে এসছে আপি।”

আপি আমাকে সুপ খাওয়াতে গিয়েও থেমে গেল। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

— ” মানে?”

এরপর আপিকে সবটাই খুলে বললাম আমি। সবটা শুনে আপি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর কাঁপাকাঁপা গলায় বলল,

— ” তোর কোনো ভুল হচ্ছেনা তো? হতে পারে সবটাই তোর মনের ভুল? এসব নিয়ে সবসময় ভাবছিস তাই..”

আমি চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললাম,

— ” না আপি। আমার কপালটা ওদের ধাক্কাতেই কেটে গেছে। আর.. ওয়েট।”

বলে আমার চুলগুলো সরিয়ে ঘাড়ের দাগটা দেখালাম। সব দেখে আপি একটু ভেবে বলল,

— ” তোর কাছে সত্যিই নেই?”

— ” না আপি। আমার কাছে ছিল এটা ঠিক। কিন্তু এখন আমি সত্যিই জানিনা ওটা কোথায় কার কাছে আছে। আই উইশ জেনো ওটা কোনো ভুল হাতে না পরে।”

— ” তোর মনে হয়না যে সবটা আদ্রিয়ানকে জানানো দরকার?”

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে ভেবে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললাম,

— ” বাদ দাও এখন এসব খাইয়ে দাও তো আমাকে।”

আপিও কথা না বাড়িয়ে আমাকে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলো। তারপর আপি বেডে হেলান দিয়ে বসলো আর আমি আপির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরলাম। আপি আমার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে বলল,

— ” জানিস আদ্রিয়ান তোকে কতোটা ভালোবাসে? তোকে যখন সেন্সলেস অবস্থায় বাড়ি নিয়ে এসছিল তখন ওর চোখ মুখ দেখে পাগল পাগল লাগছিল। পাগলের মতো বিহেভ করছিল। তোর কোনোদিন কিছু হয়ে গেলে ও সত্যিই পাগল হয়ে যাবে।”

আমি কিছু না বলে শুধু একটু মুচকি হাসলাম। আমি জানি ও আমাকে কতোটা ভালোবাসে। হয়ত ওর এই ভালোবাসার জন্যে আমিও ওকে ভালোবেসে ফেলছি। কিন্তু কাল থেকে বাড়ির সবাই আমাকে বকলেও আদ্রিয়ান একবারও বকে নি। যেখানে ওর সবচেয়ে বেশি বকার কথা ছিলো। এটাকি আমি অসুস্থ বলে? আর আমার মুখ দেখার পর ওরা অবাক কেন হয়েছিল? আমাকে কে তো আগেও দেখেছে। বরং আমিই ওদের কখনও দেখিনি। যেখানে আমার চেহারা ওরা আগেই দেখেছে তাহলে নতুন করে অবাক হওয়ার কী হল? আর আমাকে ছাড়লো কেনো? ঘাড়েই বা কী ফুটিয়েছিল লোকটা? সবকিছু মিলেও মিলছে না। সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে আমায় দেখে ওদের অবাক হওয়াটা। আর ঐ দুজনের কন্ঠস্বর। সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু।

#চলবে…

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৬
.
শরীরটা অসুস্থ তাই আজ আর মেডিকেলও আজ বন্ধ আছে। সারাদিন বাড়িতেই কেটেছে। আদ্রিয়ানও ল্যাবে গিয়ে বসে আছে। ওনার করা নির্দেশ সারাদিনে ঘরে বেড রেস্টে থাকতে হবে? আমার তো সবকিছুই বিরক্ত লাগছে। এভাবে সারাদিন রুমে বসে থাকা যায়? কিছুই ভালো লাগছে না। ফোনে গেমস খেলতে খেলতেও একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ফোনটা এককোণে ফেলে রেখে দিয়েছি। আপি আর জাবিন এসছিল দুবার বেশ কিছুক্ষণ গল্পও করে গেছে। বিয়ের পর আদ্রিয়ানের শাসনে বিকেলে ঘুমানোর অভ্যেস হয়ে গেছে তাই শুয়ে পরলাম ঘুমানোর জন্যে। ও তো বলল তাড়াতাড়ি চলে আসবে, এখনও এলো না কেনো? হয়তো আটকে আছে, হাতের কাজ না সেড়ে কীকরে আসবে? আমি এরকমি যখন একা বসে থাকি তখন নিজেই প্রশ্ন করি নিজেই উত্তর দেই। নিজের মতই চিন্তা করতে থাকি। এখনও ঠিক তাই করতে করতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পরলাম।

ঘুম ভাঙতেই কারো কারো শরীরের উষ্ণতা অনুভব করলাম। আর সাথেসাথেই চোখ না খুলেও বুঝতে পারলাম আমি আদ্রিয়ানের বুকে আছি। নিজের বুকে খুব সযত্নে আবদ্ধ করে রেখে দিয়েছে ও আমাকে। আমি ওনাকে জরিয়ে ধরে চোখ বন্ধ করেই বললাম,

— ” কখন এলে?”

ও একটু চুপ থেকে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে বলল,

— ” অনি প্লিজ। ঘুম থেকে উঠে আমার সাথে কখনও কথা বলো না।”

আমি একটু অবাক হয়ে চোখ খুলে ভ্রু ওর দিকে তাকালাম। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললাম,

— ” কেনো?”

ও আমায় আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

— ” তোমার ঘুম জড়ানো কন্ঠটা নেশার মতো কাজ করে আমার ওপর। এক অদ্ভুত ঘোরে চলে যাই। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে কষ্ট হয়। খুব করে আদর করে দিতে ইচ্ছে করে।”

ওনার কথাটা শুনেই কেনো জানিনা চুপ হয়ে গেলাম। লজ্জা পেয়ে চোখ এক অদ্ভুত অনুভূতি গ্রাস করছে আমাকে। ইদানিং হয় এরকম। ওর কাছাকাছি থাকলে এখন আর আগের মতো অস্বস্তি বা ভয় লাগেনা। অনেকটাই নরমাল হয়ে গেছি ওর সাথে। এখন সেই ভয় আর অস্বস্তির জায়গায় এসে ভর করেছে নাম না জানা অন্যরকম কিছু অনুভূতি আর হালকা লজ্জা এসে ভর করেছে। এ পরিবর্তনের কারণ কী ওনার প্রতি আমার অনুভূতি পরিবর্তনের লক্ষণ? ও আমার মাথায় আলতো করে চুমু দিয়ে বলল,

— ” কিন্তু আমি চাইনা এমন কিছু হোক যার জন্যে তুমি এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত নও।”

আমি আস্তে করে তাকালাম ওর দিকে। ও আমার চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দিতে দিতে বলল,

— ” ঘুমতো হয়েছে। এবার তো উঠতে হবে না কী? আমি মনিকে বলে দিয়েছি এক্ষুনি কফি নিয়ে চলে আসবে চলো গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।”

আমি আস্তে করে ওর বুক থেকে উঠে ওয়াসরুমে চলে গেলাম। ওয়াসরুম থেকে ফিরে এসে দেখি মনি অলরেডি কফি দিয়ে গেছে। আদ্রিয়ান বলল,

— ” হাতমুখ ভালোভাবে মুছে ব্যালকনিতে চলে এসো।”

আমি মাথা নাড়লাম। ও ব্যালকনিতে চলে গেল। আমিও মুখ মুছে নিয়ে ব্যালকনিতে গেলাম। পাশাপাশি ফ্লোরে বসে দুজনেই মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি আর ধোয়া ওঠা গরম কফির মগে চুমুক দিচ্ছি। অক্টোবর প্রায় শেষ তাই হালকা ঠান্ডাও লাগছে। আদ্রিয়ান এক হাতে আমায় নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল।আমি ওর টিশার্ট ওপর দিয়েই আঁকাবুকি করতে করতে করতে বললাম,

— ” তুমিতো বললে যে তাড়াতাড়ি চলে আসবে। তাহলে এতো দেরী হলো যে?”

আদ্রিয়ান একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

— ” ইশরাকের বাড়িতে নূরের কাছে গেছিলাম। হসপিটালে নিতে হয়েছিল ওকে আজকে।”

আমি হালকা চমকে তাকালাম ওর দিকে। অনেকটা উত্তেজিত কন্ঠে বললাম,

— ” কী হয়েছে নূর আপুর? ঠিক আছে তো? মানে ওনার কোনোরকম কোনো বিপদ হয়নি তো? আপু..”

আদ্রিয়ান আমাকে থামিয়ে বলল,

— ” আচ্ছা কুল কুল। বলছি আমি। কিচ্ছু হয়নি নূরের। ও একদম ঠিক আছে। শান্ত হও তুমি।”

আমি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললাম,

— ” তাহলে?”

— ” আসলে হঠাৎই একটু পেইন হচ্ছিল নাকি। উইক হয়ে পরেছিল। আমি ভাবলাম অনেক সময় তো টাইমের আগেও বেবি হয়ে যায়। তারওপর ওরতো এই বাইশ তেইশ দিন পরেই ডেইট। সো ভাবলাম দেখিয়ে নিয়ে আসি। বুঝতেই পারছো। আঙ্কেলের বয়স হয়েছে। বাড়িতে কোনো ছেলে নেই। তারওপর ওর পরিবার চট্টগ্রাম থাকে। ওর যদি একটা ভাই বা দেবর থাকতো তাহলে তো সেই এসব করতো তাইনা?”

ওর কথা শুনে কষ্ট আর ভালোলাগা দুটোই কাজ করল। কষ্ট হচ্ছে নূর আপুর জন্যে। ইশরাক ভাইয়ার মতো বর তো কপাল করে পাওয়া যায়। যেখানে এই সময়টা ওনার ইশরাক ভাইয়ার অসম্ভব রকমের কেয়ার, ভালোবাসা, শাসন,যত্নে কাটার কথা সেখানে আজ ওনার একটু ডক্টরের কাছে যেতেও অন্যকারও সাহায্যের প্রয়োজন হচ্ছে। কীকরে পারছে মেয়েটা এই যন্ত্রণা সহ্য করতে। ইশরাক ভাইয়ার স্মৃতিগুলো কী ওনাকে তাড়া করে বেড়ায় না? এমনিতেই ইশরাক ভাইয়া নূর আপুকে মাথায় তুলে রাখতো সবসময় আর এইসময় হলে তো কথাই ছিলোনা। আমি যদি কোনোদিন নূর আপুর মতো পরিস্থিতিতে পরি আমিতো মরেই যাবো, একেবারে মরে যাবো। আর ভালোলাগছে এটা ভেবে যে আমার স্বামী এমন একজন মানুষ যে সবার প্রতি নিজের দায়িত্বগুলো নিজের সবটুকু দিয়ে পালন করে। আজ নিজের বেষ্ট ফ্রেন্ড এর অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রীকে ভাইয়ের মতই আগলে রাখছে। আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে ও বলল,

— ” হুম। অনেকদিন যাবত দেখা হয়না নূর আপুর সাথে। নিয়ে যাবে আমায়?”

— ” আচ্ছা নিয়ে যাবো সময় করে। শোনো আজ আর পড়তে বসতে হবেনা। আজকে দিনটা চুপচাপ রেস্ট করো। শরীর ফিট রাখতে হবে। কাল ক্লাস আছে তো? ”

— ” হ্যাঁ আছেতো কেনো?”

— ” কাল থেকে আবার তোমার যাওয়ার সময় ড্রপ আমি করবো আর আসার সময় গার্ড পাঠিয়ে দেবো যদি আমি না আসতে পারি। এন্ড ইয়েস, এটা আমার ওর্ডার। এই বিষয়ে আমি কোনো এক্সকিউস, অজুহাত, জেদ শুনবোনা।”

আমি কিছু বলতে নিয়েও ওর শেষের কথাটা শুনে থেমে গেলাম। কী আর করার বলে যখন দিয়েছে তখন আর কিছু বলেই কিছু হবেনা। তাই আর কথা না বাড়িয়ে মুখ ফুলিয়ে ওর এক হাত জড়িয়ে ধরে কাধে মাথা দিয়ে বসে রইলাম।

___________________

এরমধ্যেই সপ্তাহের মতো কেটে গেছে। মেডিকেল, বাড়ি, পড়াশোনা, আর বাকি সময়টা আদ্রিয়ানের ভালোবাসা আর কেয়ারে কেটে গেছে। এরমধ্যে নূর আপুর সাথে দেখা করে কথা বলে এসছি। একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছে তা নয় কিন্তু তবে এখন আর নিজের অযত্ন করেনা। নিজের ভেতরের ঐ ছোট্ট প্রাণটার কথা ভেবে এখন জোর করে হলেও ভালো থাকতে হচ্ছে তাকে। কী আর করার আছে তার?

আজ অফ ডে তাই সবাই মিলে ঘুরতে বেড়িয়েছি। সবাই মানে ইফাজ ভাইয়া, আপি, জাবিন, সজীব ভাইয়া, অর্ণব ভাইয়া, কাব্য, আদ্রিয়ান আর আমি। প্লানটা আমার কিন্তু এরেঞ্জমেন্ট করেছেন আদ্রিয়ান। একটা বিশাল পার্কে ঢুকেছি। আদিব ভাইয়াও ওনার গার্লফ্রেন্ড রাইমা আপুকে নিয়ে এসছেন। সবাই মিলে হাটছি আর কথা বলছি। কথার মাঝেই সজীব ভাইয়া বলল,

— ” তোমরা থাকো আমি একটু আসছি হ্যাঁ? জাস্ট যাবো আর আসবো।”

বলে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেল। আমরা সবাই কিছুক্ষণের বোকার মতোই তাকিয়ে রইলাম। তারপর আবার যে যার মতো বিজি হয়ে গেলাম। আদিব ভাইয়া, অর্ণব ভাইয়া, কাব্য কথা বলছে। ইফাজ ভাইয়া আর আপি একটু দূরে বসে গল্প করছে। জাবিন একটা গাছে হেলান দিয়ে কথা বলছে ফোনে। আদ্রিয়ান বলল,

— ” চলো আমরা ওদিক দিয়ে একটু হেটে আসি।”

আমিও মাথা নাড়লাম। আমি আর আদ্রিয়ান ইটের সরু রাস্তা দিয়ে হাটছি। দুপাশে বিভিন্ন ফুলের টব। আমি আদ্রিয়ানের এক হাত জড়িয়ে ধরে রেখেছি। আশেপাশের অনেক কাপল নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে।আদ্রিয়ান বলল,

— ” তুমি এতো ছোট কেন বলবে? তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাওনা?”

আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললাম,

— ” মানে?”

— ” মানে তুমি এখনও ছোট বলেই তো আমাকে এতোটা সামলে থাকতে হয়। আর হানিমুনটাও পিছিয়ে দিলাম। আর যাই হোক হানিমুনে গিয়ে তো আর ব্রহ্মচারী হয়ে বসে থাকতে পারবোনা। ওখানে তো..”

আমি চোখ মুখ কুচকে বললাম,

— ” আপনি আসলেই অসভ্য।”

এটুকু বলে সামনে তাকাতেই থমকে গেলাম। আমার সাথে আদ্রিয়ানও দাঁড়িয়ে গেলো। আমরা দুজন দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। সামনে যা দেখলাম সেটা দেখে দুজনেই অবাক। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। এটা কী দেখছি আমি? এতো বড় ধোঁকা?

#চলবে…

( রি-চেইক হয়নি। হ্যাপি রিডিং গাইস। )

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৭
.
আমি ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছি। মানুষ যে এভাবেও ডুবে ডুবে জ্বল খেতে পারে সেটা ভাবতেও পারিনি। সজীব ভাইয়া খুব সুন্দরী একটা মেয়ের সাথে খুব ক্লোজ হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মেয়েটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর ভাইয়া মেয়েটার এক পাশ দিয়ে গাছের ওপর এক হাত রেখে দাঁড়িয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে দুজনের মধ্যে ভালোই প্রেমালাপ চলছে। আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই ও আমার দিকে তাকিয়ে হাত ভাজ করে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

— ” তোমার ভাইতো ভালোই তলেতলে ট্যাম্পু চালাচ্ছে। মেয়েটাকে চেনো?”

আমি একটু ভালো করে দেখলাম। তারপর মনে পড়লো ভাইয়ার ফোনে একবার দেখেছিলাম আপুটার ছবি। কী জেনো নাম? হ্যাঁ সৃষ্টি।আমি ওদের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললাম,

— ” আরে হ্যাঁ! এটাতো সৃষ্টি আপু। ভাইয়ার বান্ধবী বলেই জানতাম এতোদিন। কিন্তু এখনতো অন্যকিছু মনে হচ্ছে। কতবড় ধপবাজ দেখেছেন?”

আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বলল,

— ” তোমার মনে হচ্ছে? আমিতো হান্ড্রেট পার্সেন্ট শিউর।”

আমিও ঠোঁট চেপে চোখ দিয়ে ইশারা করলাম ওদের কাছে যাওয়ার। এরপর দুজনেই আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম ওদের দিকে। কিন্তু ওদের দুজনের সেদিকে কোনরকম কোনো খেয়াল নেই। ওরা ওদের কাজে ব্যস্ত। ওদের কাছ অবধি গিয়ে আমি হালকা করে কাশি দিলাম। দুজনেই চমকে গেলো। সজীব ভাইয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমি দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললাম,

— ” গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসছো?”

আদ্রিয়ান একটু এগিয়ে গিয়ে বলল,

— ” হ্যাঁ হ্যাঁ। ভাইয়া আমাদের ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসছে। তাইনা ভাইয়া?”

সজীব ভাইয়া বেশ কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এতো তাড়াতাড়ি ধরা পরে যাবেন সেটা হয়তো উনি ভাবতেও পারেননি। সৃষ্টি আপুও একবার আমাদের দিকে একবার সজীব ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। সজীব ভাইয়া ইতস্তত গলায় বলল,

— ” ইয়ে আসলে..”

আদ্রিয়ান শব্দ করে হেসে দিল। আদ্রিয়ানের হাসি দেখে আমিও হেসে দিলাম। সজীব ভাইয়া ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে আর সৃষ্টি আপু বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিয়ান হাসি থামিয়ে বলল,

— ” কাম অন ভাই। এমন করছো জেনো বড়দের কাছে ধরা পরে গেছ। বড় ভাই হও তুমি আমাদের। তাই আমাদের বিশেষ কিছু বলার নেই। ”

আমি চোখ ছোট ছোট করে কোমরে হাত রেখে বললাম,

— ” বলার নেই মানে কী হ্যাঁ? অফকোর্স বলার মতো অনেক কিছু আছে। এটা কোন ধরণের চিটিং। তলে তলে এতো কিছু করে বেড়াচ্ছে অথচ আমাদের জানালো অবধি না? কতদিন ধরে চলছে হ্যাঁ?”

সজীব ভাইয়া চোখ রাঙিয়ে বলল,

— ” মারবো টেনে এক থাপ্পড়। বড় ভাই হই আমি তোর। শাসন দেখাচ্ছিস?”

আমি মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সৃষ্টি আপু এগিয়ে আমার কাধে হাত রেখে সজীব ভাইয়ার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

— ” আমার ননদিনী কে বোকছো কেন? আজব! কত মিষ্টি মেয়েটা।”

আদ্রিয়ান একটু ভাব নিয়ে বলল,

— ” আমার বউ বলে কথা মিষ্টি তো হতেই হবে।”

সৃষ্টি আপু আদ্রিয়ানের সাথে পরিচিত হল, আমাকে আগেই নাকি চিনতো, কিন্তু এখন সামনাসামনি আরো ভালোভাবে পরিচিত হয়ে নিল। এরপর ওদের নিয়ে বাকিদের কাছে গেলাম। পুরোটা শুনে সবাই আমাদের মতই শকড। সজীব ভাইয়ার পক্ষেও যে এরকম করা পসিবল সেটা কেউ ভাবতেই পারেনি। সবাই প্রথমে অবাক হলেও পরে বেশ মজা নিলো ব্যপারটায়। সৃষ্টি আপু মেয়েটাও খুবই মিশুক সবার সাথে খুবই সহজে ভালোভাবেই মিশে গেছে। এরপর সবাই মিলে বেশ অনেকটা সময় ঘোরাঘুরি করে রাতের ডিনারটা পুরোটা কম্প্লিট করে তারপর বাড়ি ফিরলাম।

_________________

রাতে ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে এসে দেখি আদ্রিয়ান বেডে হেলান দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছে। চোখে একটা চিকন ফ্রেমের চশমা। আসলে ও অন্ধকারে বা বেশ অনেকটা সময় যদি ফোন বা ল্যাপটপ ইউস করে তখন গ্লাস পরে নেয় চোখের সেইফটির জন্যে। মানুষটা একটু বেশিই গোছালো। বাইরে দিয়ে ভেতর দিয়ে সব দিক দিয়েই পার্ফেক্ট একজন ব্যক্তিত্ব। কিন্তু এতো পার্ফেক্ট মনে মানুষ কীকরে হতে পারে সেটা নিয়েও আমি ভাবি। কিছুক্ষণ নিজের মনে এসব ভেবে। ওনার পাশে গিয়ে বসে বললাম,

— ” ঘুমাবে না?”

উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুখে মুচকি এক হাসি ফুটিয়ে বলল,

— ” হ্যাঁ। এইতো হাতের কাজটা সেড়ে নেই। তুমি শুয়ে পরো।”

বলে আবার নিজের কাছে মন দিলো। কিন্তু বেশ অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরেও আমাকে শুয়ে পরতে না দেখে ও ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” কী ব্যপার? শুয়ে পরো?”

আমি অসহায় গলায় বললাম,

— ” ঘুমাতে ইচ্ছা করছেনা এখন। ঘুম পাচ্ছেনা এখন।”

আমার কথা শুনে আদ্রিয়ান একটু হাসলো। তারপর ল্যাপটপটা বন্ধ করে সাইডে রেখে নিজের চশমা খুলে টি-টেবিলের ওপর রাখলো।তারপর আমার দিকে ঘুরে আমার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে গেলো। তারপর একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,

— ” ঘুমাতে ইচ্ছা করছেনা? রিয়েলি? তোমার মতলব কী বলোতো? অন্যকিছুর প্লানিং এ আছো নাকি?”

আমি কিছু বুঝতে না পেরে বললাম,

— ” অন্যকিছু মানে?”

উনি আমার চুলগুলো কানে পিঠে গুজতে গুজতে বলল,

— ” হয়তো আমার বউয়ের রোমান্স করার শখ হয়েছে। আই থিংক এই মুহূর্তে তোমার আমার আদর পেতে খুব ইচ্ছে করছে?”

আমি বিরক্ত হয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম,

— ” ধ্যাত! সবসময় তোমার এসব ফাল্তু কথা।”

বলে ছাড়িয়ে উঠতে নিলেই ও আমাকে ঘুরিয়ে বেডে শুইয়ে কম্বল টেনে একসাথে দুজনকেই জড়িয়ে নিয়ে আমার ওপর আধশোয়া হলো। আমি একটু বোকার মত তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ওনা এসব হুটহাট আক্রমণে বরাবরই আমার বেচারা বাচ্চা হার্টটা এতোটাই ঘাবড়ে যায় যে প্রচন্ড জোরে লাফালাফি করে বেড়ায়। এখনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাইরে থেকেও আমি সেই বিট শুনতে পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। আদ্রিয়ান আলতো করে আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে আমার গলায় মুখ গুজে দিলো। সাথে সাথেই কেঁপে উঠলাম আমি। পুরো শক্ত হয়ে রইলাম না চাইতেও। নিজের অজান্তেই পুরো শরীর জমে গেল আমার। জোরে জোরে ভারী নিশ্বাসগুলো ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। কিছুক্ষণ পর ও ওভাবে থেকেই অস্ফুট স্বরে বলল,

— ” এভাঁবে শক্ত হয়ে আছো কেনো?”

আমি ব্যপারটা সামলাতে তাড়াতাড়ি কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,

— ” অব্ আমার ঘুম প্ পাচ্ছে।”

ও ওর স্পর্শ আরও গভীর করে দিয়ে এবারে আরো অস্পষ্ট স্বরে বলল

— ” ঘুঁমোও কেঁ বাঁরণ কঁরেছে?”

— ” এভাবে থাকলে ঘুমাবো কীকরে?”

ও আমার থেকে মুখ তুলে বিরক্তি নিয়ে বলল,

— ” ঘুমানোর জন্যে চোখ বন্ধ করে রাখা লাগে আমি তো তোমাকে চোখ খোলা রাখতে বলিনি। তুমি ঘুমাও!”

বলে আবার গলার ওপর সাইডে মুখ গুজে দিল। এই লোকটাকে কিছু বলাই বেকার। আমি খুব ভালো করেই জানি আমি যতই বলি এই পাগল এখন আমাকে ছাড়বেনা। মাঝেমাঝেই এমন করে। আর আমাকে ওর এই পাগলামো গুলো সহ্য করতে করতেই ঘুমিয়ে পরতে হয়। কারণ ঘুমানোর আগ পর্যন্ত ছাড়েই না। বেশ অনেক সময় পর ও আবারও অস্ফুট স্বরে বলল,

— ” লাভ ইউ জানপাখি। আই রিয়েলি লাভ ইউ। সবসময় এভাবেই আমার কাছে থাকবে। খুব কাছে। এতোটাই কাছে যে চাইলেও তুমি দূরে যেতে পারবেনা। আমি পারবোনা তোমাকে যেতে দিতে। নেভার। কবে বলবে যে ভালোবাসো? তোমার ভালোবাসি কথাটা শোনার জন্যে মন কতটা তৃষ্ণার্ত তুমি জানো? সবটাই যে শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে আছে। কিন্তু তুমিতো বুঝতেই পারোনা। এতো ছোট হতে কে বলেছিল হ্যাঁ? আর একটু বড় হতে পারলেনা? একটু বেশিই অবুঝ তুমি। কবে পুরোপুরি বুঝতে পারবে আমায়? তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাও মায়াবিনী। তোমার মায়াজালে এভাবে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলে তুমি মুখ ঘুরিয়ে রাখতে পারোনা। কষ্ট হয় আমার। খুব কষ্ট হয়। বুকের ভেতর ভীষণ ব্যথা হয়। কাউকে বলতে পারিনা, হালকা করতে পারিনা নিজেকে। খুব অদ্ভুত আর ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক কষ্ট এটা জানো? দম আটকে আসতে চায়। মনে হয় আমি মরেই যাবো। আমাকে মরতে দিওনা। আই নিড ইউ ইয়ার। আই নিড ইউ ব্যাডলি। ”

এরপর একদম চুপ হয়ে গেল ও। জানি ও এখন ঘুমিয়ে পরেছে। আর এ কথাগুলোও অর্ধঘুমেই বলেছে। এটা নতুন না প্রায়ই বলে এরকম।আমি আস্তে করে ওর পিঠ আকড়ে ধরলাম। আর ওও ঘুমের ঘোরেই শক্ত করে জড়িয়ে নিলো আমাকে নিজের সাথে। বুকের ভেতরটা অদ্ভুতভাবে ভার হয়ে আসতে। নিশ্বাসও ভারী হচ্ছে। এতক্ষণ টলমল করা চোখ থেকে সেই টলমলে জলটুকু গড়িয়ে পরল চোখের কার্নিশ বেয়ে। আমি সত্যিই বুঝিনা ওনাকে, ওনার কথার মানেগুলোকে, ওনার কাজগুলোকে। এরজন্যে কে দায়ী আমি নাকি আমার বয়স? সেটাও জানিনা। শুধু এটুকুই বুঝতে পারছি যে এই ছেলেটা আমার জন্যেই এতো কষ্ট পায়। আমি ওকে কষ্ট দেই। জেনে না জেনে বারবার আঘাত করে ফেলি। কেনো? কেনো হয় এরকম । আল্লাহ্ কেন আমায় ওকে বোঝার ক্ষমতা দেয়নি। কেন পারিনা আমি ওর সব কষ্ট দূর করে দিয়ে। এতোটা অক্ষম, ডাফার, ইউসলেস কেন আমি? হোয়াই?”

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে