বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে পর্ব-৮+৯

0
487

#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে
#প্রভা_আফরিন
[৮]

নানাজানের বাড়িটা দোতলা। নিচতলা দোকান, গ্যারেজ ও হোটেলের জন্য বরাদ্দ এবং উপরের তলায় বাসস্থান। আমার দুইজন মামা। বড়ো মামা স্থানীয় ব্যবসায়ী ও ছোটো মামা প্রবাসে আছেন প্রায় দশ বছরের অধিক সময় ধরে। মামীরা মিলেমিশেই সংসারে আছেন। চারজন মামাতো ভাই-বোন আছে। সবাই আমার ছোটো। এই পরিবারটি আমার নানাজানের ছায়ায় এখনো উজ্জীবিত হয়ে আছে। মামীদের মাঝে ঝ’গড়া-বিবাদ হলেও সংসারের হাড়ি আলাদা করার সাহস কারো হয়নি। নানাজানের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত বলে গণ্য করা হয়। মামারা মাথা পেতে মেনেও নেন। সেই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দোতলার সর্ব পশ্চিমের ঘরখানায় আমার ও মায়ের ঠাঁই হয়েছে। ভাইয়া আপাতত ইকরাম ভাইয়ের রুমে থাকবে।

নানাবাড়িতে বেড়াতে এসেছি বহুবার। ছোটাছুটি, হইহই করে মাতিয়ে রেখেছি পুরো বাড়িটা। কত আবদার, আহ্লাদ নিয়ে মামা-মামীদের আশেপাশে ঘুরেছি! এবার কেন জানি সেই উচ্ছ্বাসটা নেই। আছে লজ্জা, সংকোচ। ক্ষণিকের অতিথি নই বলেই হয়তো। এবার আমরা অনির্দিষ্টকালের অতিথি। তাই হয়তো মামীদের মুখেও আপ্যায়নের খুশিটা নেই। গতকাল বিকেলে নানাবাড়ি এসে উঠেছি। এরপর রুম থেকে আর বের হইনি। খাবারটা ঘরে বসেই খেয়েছি। মাও কাল থেকে চুপচাপ আছে। ভাইয়া বাসায় থাকে না। ইকরাম ভাইয়ের সঙ্গে এদিক-ওদিক চলে যায়। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। জানালা খুলে দিতেই একরাশ স্নিগ্ধতা হুড়মুড়িয়ে পুরো রুমে ছড়িয়ে পড়ল। সকালের আবির মাখা লাল সূর্যটা উঁকি দিয়েছে। রাস্তার ওপারের বাড়িটায় কতগুলো কবুতর হাততালির শব্দে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। কিছুক্ষণ নিরলস চোখে সেই উড়াউড়ি দেখলাম। মনে মনে ভাবলাম আমার আকাশটা কবে মুক্ত হবে? মালিকের অধীনে থাকা হৃষ্টপুষ্ট কবুতরের মতো নয়। তাতে সুখ থাকলেও স্বাধীনতা নেই। বনে বনে ঘুরে বেড়ানো, ছন্নছাড়া শালিকের ঝাঁকের মতো মুক্ত একটা আকাশ যে আমার কাম্য। যেখানে সুখই স্বাধীনতা আর স্বাধীনতাই সুখ। এমন একটা আকাশ কামনা করা কি এই কঠিন জগতে খুবই দুষ্প্রাপ্য?

চোখ সরিয়ে নিলাম। সকাল সকাল কাঁদতে ইচ্ছে করছে না। নানাজানের বাড়িটা একদম পাকা সড়ক লাগোয়া। যানবাহন কিংবা লোকেদের গমগমে শব্দ সবই বাড়িতে ঢোকে। নিচতলায় যেহেতু জমজমাট দোকান-পাট তাই দোতলায় আলাদা একটি গেইট লাগানো আছে। প্রত্যেকটা রুমের দরজা-জানালায় ভারী পর্দা ঝোলে।

বিছানা ঝেড়ে, ঘর ঝাড়ু দেওয়া মাত্রই দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো দুবার। অতি নম্রভাবে। বুঝতে অসুবিধা হলো না। মাথায় কাপড় দিয়ে দরজা খুললাম। শুভ্র বেশের লম্বা অবয়ব নজরে এলো। নাকে ধাক্কা দিলো আতরের ঘ্রাণ। হঠাৎই মনটা নির্ভার হয়ে গেল।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম নানাজান।”
“কেমন আছেন আপু?”
মৃদু হেসে দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললাম,
“আলহামদুলিল্লাহ নানাজান। আপনি ভেতরে আসুন।”
নানাজান ধীরপায়ে রুমে ঢুকলেন। বিছানায় বসে আমাকে ইশারা করলেন পাশে বসতে। আমি বসলাম। নানাজান আগের মতোই নির্মল কণ্ঠে বললেন,
“আপনার আলহামদুলিল্লাহ বলায় জোর পেলাম না আপু।”
“মনে শান্তি না থাকলে শব্দে শান্তি ফুটে ওঠে না নানাজান।”
“তাই তো প্রথমেই বললাম আসসালামু আলাইকুম অর্থাৎ আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।”
“আপনার সান্নিধ্যে খানিকটা নির্ভার লাগছে।”
“কিন্তু অন্যের দ্বারা শান্তি চাইলে তো হবে না আপু। শান্তির জন্য আপনাকেই চেষ্টা করতে হবে। ফজরের নামাজ পড়েছিলেন?”
আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। নানাজান বললেন,
“নিয়মিত নামাজ পড়তে হবে আপু। আল্লাহর কাছে মন খুলে চাইতে হবে। তিনি কখনো বান্দাকে নিরাশ করেন না। শুধু ধৈর্য ও বিশ্বাসে অটল থাকতে হবে।”

আমি নত দৃষ্টিতেই মাথা নাড়লাম। নানাজান আমার মাথায় হাত রেখে বলে চললেন,
“উমরাহ থেকে ফিরতে ফিরতে এতগুলো ঘটনা শুনতে হবে কল্পনা করিনি। আপনাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকলে সফরের সময়টুকু দীর্ঘ করতাম না।”
“রাগ করবেন না, নানাজান। আপনার সুস্থভাবে ফিরে আসার জন্যই জানানো হয়নি।”
নানাজান মৃদু হেসে বললেন,
“আপনারা আমার হৃদয়ের কঠোরতা সম্পর্কে এখনো সম্পূর্ণ জ্ঞান রাখেন না। আপনার নানুজান যেদিন আমার হাতের ওপর মা’রা যান আমি সেদিনও ভেঙে পড়িনি। অথচ সেই মুহূর্তটা আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্বল, দুঃসহ সময় ছিল। আপনার নানুজান আমার চেয়েও কঠোর হৃদয়ের মানবী ছিলেন। তাই তো বিন্দুমাত্র দুঃখ যাপনের ফুসরত যেন না পাই তাই আমার হাতে উনার সযত্নে লালিত আমানত অর্থাৎ এই সংসারটি তুলে দিয়ে গেছেন। উনার অবর্তমানে উনার আমানত আমাকেই আগলে রাখতে হবে। আপনার আম্মাও সেই আমানতের অংশ। বাড়িটা আপনার মায়েরও। কাজেই এ বাড়িতে থাকা নিয়ে আপনি হীনমন্যতায় থাকবেন না।”
আমি চুপ রইলাম। নানাজান আমার মনের অবস্থা ধরতে পেরেছে বলে অবাক হলাম না। তিনি আবার বললেন,
“তবে আমি আপনার ওপর খুশি হয়েছি। এত দুর্যোগের মাঝেও আপনি ভেঙে পড়েননি।”

নিজেকে সামলাতে পারলাম না। কান্নারা ঠেলে বেরিয়ে এলো। হেচকি উঠতেই মুখ চেপে ধরলাম। নানাজান সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
“কাঁদুন আপু। এতে যদি ভেতরের উত্তাপ কিছুটা লাঘব হয় তাহলে আটকাবেন না। তবে ধীরে ধীরে আরো শক্ত হতে হবে আপনাকে, আরো সংযমী হতে হবে। আমি জানি আপনি পারবেন।”

নানাজানের সাক্ষাতে অনেকটা আরাম লাগছে। তিনি মানুষটাই এমন। সব পরিস্থিতিতে কঠোর হৃদয় ও কোমল কণ্ঠ উজ্জীবিত রাখেন বলেই সবাই নির্দ্বিধায় উনার ওপর ভরসা করতে পারে। নানাজান একটু বসেই চলে গেলেন। ঘুম থেকে উঠার পর আর মাকে দেখিনি। কণ্ঠস্বরও পাইনি। রুম ছেড়ে বের হতেই ইকরাম ভাইয়ের মুখোমুখি হলাম। চলার পথে থামতে হলো বলে তিনি একটু অপ্রস্তুত হলেন বোধহয়। জিজ্ঞেস করলাম,
“ইকরাম ভাই, তুষার ভাইয়া কোথায়?”
“তুষার তো ঘুমাচ্ছে। গতকাল অনেক রাতে ঘুমিয়েছে। ডেকে দেব?”
“নাহ থাক।”
উনি মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেলেন। নানাজানের থেকে একটা বিশেষ গুণ ইকরাম ভাই পেয়েছেন। মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে কখনো কথা বলে না। মাথা সোজা থাকলেও দৃষ্টি পায়ের নখে নিবদ্ধ সর্বদা।

আমি একপা এগোতেই প্রচন্ড জোরে একটা হেঁচকা টান পেলাম। ধারা প্রায় ছো মেরেই আমায় তার রুমে ঢুকিয়ে নিল। বুকে হাত রেখে লম্বা দম নিলাম। ধাতস্থ হয়ে বললাম,
“ভয় পাইয়ে দিলি।”
ধারা স্বচ্ছ একটা হাসি দিলো। আঁকাবাঁকা দাঁতের এই মিষ্টি মেয়েটি বড়ো মামার বড়ো মেয়ে ধারা। এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। এবাড়িতে ধারাই আমার সঙ্গী বলা যায়। সে কণ্ঠে খানিকটা অনুযোগ মিশিয়ে বলল,
“তোমার ওপর রাগ করেছি আপু। কাল থেকে আমাকে পাত্তাই দিচ্ছো না। রুম ছেড়ে বেরই হওনি।”
দোষ স্বীকার করে বললাম,
“খুব ভুল হয়েছে। আসলে সব গুছিয়ে উঠতে হলো তো। এখন এখানেই থাকছি।”
ধারা বাচ্চাদের মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“আমরা একসাথে থাকব। অনেক মজা হবে।”
জারা খাট থেকে গুটি গুটি পায়ে নেমে এসে আমার জামা টেনে ধরল। বলল,
“আপু আমাকে দেখে না।”

ধারার ছোটো বোন জারা। সাত বছর বয়স। তার ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি বোঝা যাচ্ছে। আমি হেসে তার গালে চুমু খেয়ে বললাম,
“এইতো দেখছি। জারামনি কী ফ্রেশ হয়নি?”
জারা প্রতিবাদ করে বলল,
“আমি সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়েছি। তারপর আবার ঘুমিয়েছি। আপু নামাজ পড়েনি। আপু পচা।”
ধারা তার মুখ চেপে ধরে বলল,
“চুপ, আমি পচা নাকি ভালো সেটা তোকে কে বলতে বলেছে।”
অসম বয়সী দুবোন ঝ’গড়া লাগিয়ে বসল। রান্নাঘর থেকে মামীর উচ্চ স্বরের ধমক ভেসে আসতে থেমেও গেল। দুজন দুজনকে ভেঙচি কে’টে দুদিকে চলে গেল। আমি নিরব দর্শকের মতো সবটা দেখলাম। খানিক বাদেই খুব জোরে চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ পেলাম। ধারা ছুটে জানালার কাছে গেল। উঁকিঝুকি দিয়ে দেখতে দেখতে বলল,
“আপু, খাইস্টা বাড়িতে সকাল সকাল আবার লেগেছে।”

ধারার কৌতুহলী বয়স। অন্যের বাড়ির ঝ’গড়া দেখতেও তার খুবই ভালো লাগে। পাশের বাড়িটা ধারার জানালার মুখোমুখি। ও বাড়ির সদস্যগণ অর্থশালী হয়েও অত্যাধিক কিপ্টে স্বভাবের হওয়ায় অনেকেই আড়ালে তাদের বাড়িটাকে খাইস্টা বাড়ি বলে ডাকে। বলাবাহুল্য, আমি নিজেও এখানে বেড়াতে এলে নামটা নিয়ে এক সময় প্রচুর মজা করতাম। খেয়াল করলাম এবার আর সেই উচ্ছ্বাস পাচ্ছি না। ধারার হাতের টানে জানালার কাছে যেতে বাধ্য হলাম। ও বাড়ির বউদের মধ্যে পান থেকে চুন খসলেই প্রায় চু’লোচুলি বেঁধে যায়। আজও বেঁধেছে। উচ্চশব্দে গা’লা’গাল, একে অন্যের দোষের ফিরিস্তি দিচ্ছে। এটা ও বাড়ির নিত্য সাধারণ একটি ঘটনা।

আমি আগ্রহ পেলাম না। চোখ সরানোর আগে হুট করেই পলেস্তরা খসা দেয়ালের ওপারে একজন পুরুষের দেখা পেলাম। ধারা পড়িমরি করে পর্দার আড়ালে চলে গেল। ফিসফিস করে বলল,
“শ্রাবণ ভাই আসছে সরে যাও।”
আমি সরার ফুরসত পেলাম না। শ্রাবণ আমায় দেখে ফেলেছে। বলাইবাহুল্য সে নিজেও অপ্রস্তুত হয়েছে মা-চাচিদের ঝামেলা নিয়ে। আমি চলে যাওয়ার আগেই সে দৃষ্টি লুকিয়ে পালাল।

চলবে…

#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে
#প্রভা_আফরিন
[৯]

একটি মেঘলা দিনান্তের গায়ে আঁধারের ম্লান বিচ্ছুরণ হচ্ছে। মৃদুমন্দ হাওয়ার তালে জানালার ভারী পর্দা দুলছে। আমি নামাজ শেষ করে জানালা আটকাতে গেলাম। রাস্তার উজ্জ্বল আলোয় দেখতে পেলাম শ্রাবণ এই বিল্ডিংয়ে ঢুকছে। ভ্রু কুচকে এলো। হয়তো কোনো দোকানে যাচ্ছে ভেবে বিশেষ পাত্তা দিলাম না। জানালা আটকে রুম থেকে বের হতেই শ্রাবণের মুখোমুখি হলাম। আমার কপালের ভাজ এবার আরো স্পষ্ট হলো। শ্রাবণ একটু দাঁড়িয়ে স্মিত হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কবে এলে?”
“গত পরশু।”
“আছো তো কিছুদিন?”
“অনেকদিন।”
“ওহহ আচ্ছা।”
ছোটো করে বলে শ্রাবণ আমায় পাশ কাটিয়ে রিডিং রুমে ঢুকে গেল। আমি অবাক হলাম। এ বাড়িতে বাইরের পুরুষ এভাবে হুটহাট যেখানে সেখানে ঢুকে যেতে পারে না। অথচ শ্রাবণের চলাফেরায় মনে হলো তার এ পথে নিত্য যাতায়াত। ধারাকে দেখলাম মাথায় হিজাব জড়িয়ে পিছু পিছু রিডিংরুমে ঢুকতে। ব্যাপারটা স্পষ্ট হলো। নিশ্চয়তা পেলাম বড়ো মামীর কাছে। ধারার বোর্ড এক্সাম আসন্ন বিধায় শ্রাবণের কাছে মাস দুই হলো পড়া শুরু করেছে। একটু চমকালাম। ধারা শ্রাবণকে সহ্যই করতে পারত না। না করার কারণ শ্রাবণের অত্যাধিক মেধাবী হওয়া। ছোটোবেলা থেকে প্রতিবেশী শ্রাবণের সঙ্গে তুলনা দিয়ে ধারাকে অপদস্ত করেছে মামী। মেয়েটা পড়াশোনায় খারাপ নয়। আবার টপেও নেই। অন্যদিকে শ্রাবণ প্রথম বৈ দ্বিতীয় হয় না কখনো। স্কুল থেকে ভার্সিটি সব জায়গাতেই ফলাফল ভালো। মামী রেজাল্ট কার্ড হাতে নিয়ে আফসোস করে বলতেন,
“শ্রাবণ যদি কিপ্টার ঘরে বড়ো হয়ে সব পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারে, তুই বিলাসিতার মাঝে বড়ো হয়ে পারবি না কেন? তোর একটা চোখ কম নাকি শ্রাবণের বেশি? ওর পা ধোয়া পানি খাবি দুইবেলা।”
আমরা হেসে গড়াতাম সে কথা শুনে। অন্যদিকে ধারা শ্রাবণের গুষ্টি উদ্ধার করে গা’লা’গাল করত।

বড়ো মামী শ্রাবণের জন্য নাশতা তৈরি করে বললেন,
“অনন্যা, মশলা বেটে দিতে পারবে? জানোই তো তোমার মামারা বাটা মশলার রান্না খায়।”

আমি মাথা নাড়লাম। মামী কোথায় কী আছে দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। কোমড়ে ওড়না গুজে মশলা বের করে বাটতে বসলাম। এ বাড়িতেই যখন আছি মামীর হাতে হাতে কাজ করে দিতে হবে। আমাদের জন্য উনাদের ওপর বাড়তি চাপ যেন না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এদিকে ছোটো মামী অনেকদিন ধরে বাপের বাড়িতে আছেন। সব মিলিয়ে বড়ো মামীর ওপর ভালোই চাপ যাচ্ছে।

মশলা বেটে সকলের জন্য চা বানিয়ে নিলাম। বসার ঘরে এখন সকলেই উপস্থিত। আমি হাতে হাতে চা দেওয়ার সময় দেখলাম শ্রাবণও বেরিয়ে এসেছে। ইকরাম ভাই তাকে ডাকলেন,
“এসো শ্রাবণ, চা খাও।”
“খেয়েছি একটু আগে। আপনারা গল্প করুন।”
ইকরাম ভাই টেনে বসালেন শ্রাবণকে। বললেন,
“অনন্যার হাতের চা মিস করা বোকামি। খেয়েই যাও। এখন তো আর আগের মতো পড়াশোনার চাপ নেই।”
শ্রাবণ ইতস্তত করে বসল। আমি চা এগিয়ে দিলাম। তুষার ভাইয়া জিজ্ঞেস করল,
“শুনলাম বিসিএস দিচ্ছো?”
ইকরাম ভাই বললেন,
“দিচ্ছে কী? বল হয়েই গেছে প্রায়। রিটেনে টিকে গেছে। বাকিটাও হয়ে যাবে। দিনরাত এক করে খেটেছে ছেলেটা।”
শ্রাবণ সলজ্জে হেসে এক পলক আমার দিকে তাকালো। চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি সরিয়ে চায়ে চুমুক দিলো। আমি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে সকলের কথা গিলে চলেছি। তুষার ভাইয়া জিজ্ঞেস করল,
“কোন ক্যাডারে যাওয়ার ইচ্ছে?”
“পুলিশ ক্যাডার।”
“ভবিষ্যত পুলিশের পাশে বসে আছি তাহলে!”

আমি আড্ডার আসর থেকে সরে এলাম। নানাজানের রুমে চা দিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেলাম। সবকিছু স্বাভাবিক তবুও মনে শান্তি নেই, স্বাচ্ছন্দ নেই। কেমন দমবন্ধ লাগে। ধারা ছুটে এসে বিছানায় সটান শুয়ে পড়ল। নিজেকে সামলে বললাম,
“পড়ে ক্লান্ত হয়ে গেলি নাকি?”
“হ্যাঁ, একঘন্টার জায়গায় দেড় ঘন্টা পড়িয়ে গেল। কে বলেছে ফাও বেশি পড়াতে?”
“এতে তো তোরই ভালো। তা কেমন পড়ায়?”
ধারা নিচু গলায় বলল,
“কিপ্টে হলে কী হবে, পড়ায় ভালো। জটিল বিষয়ও ভেঙে সরল করে ফেলে। খাই’স্টা বাড়ির ছেলেগুলো গুণী এটা মানতে হবে।”
আমি সরু দৃষ্টিতে তাকাতেই ধারা গলা ঝেড়ে বলল,
“গুণের প্রশংসাই করলাম শুধু। নাথিং সিরিয়াস।”

বাইরে থেকে নিবিড়, আবিরের চেঁচামেচি শুনতে পেলাম। ছুটে গিয়ে দেখলাম দুই ভাই বাড়ি জুড়ে ছোটাছুটি আরম্ভ করে দিয়েছে। ওরা ছোটো মামার দুই ছেলে। মামাবাড়ি থেকে আজ ফিরল। শ্রাবণ চলে গেছে ইতিমধ্যে। বাড়ির পরিবেশ মুহূর্তেই গমগমে হয়ে গেল। জারা, নিবিড়, আবিরের খুঁনসুটিতে সেই চিরচেনা মামাবাড়ির দেখা পেলাম। ছোটো মামীর প্রেগন্যান্সির সাত মাস রানিং। আমাদের এখানে আসায় তিনি খুশি হয়েছেন কিনা বোঝা গেল না। কথায় কথায় একসময় হুট করে বলে বসলেন,
“পিয়াসার কী খবর তুষার? ডেলিভারি ডেট কবে?”
ভাইয়ার মুখটা হুট করে ম্লান হয়ে গেল। ছোটো করে বলল,
“আরো কিছুদিন বাকি।”
“সংসারটা কি একেবারেই টিকবে না?”
ভাইয়া সে কথার উত্তর দিতে পারল না। সকলের নজর এড়িয়ে দোতলা থেকে নেমে গেল। জমজমাট আড্ডার মাঝে ছন্দপতন হলো। বড়ো মামী বললেন,
“এসব এখন না জিজ্ঞেস করলেই নয়?”
ছোটো মামী থমথমে মুখে বললেন,
“জানতে চাইলেও দোষ হবে নাকি?”
“বাদ দে এসব প্রসঙ্গ।”

আমি ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলাম। ভাবীর ডেলিভারির সময় এগিয়ে আসছে। বাচ্চাটা তো ভাইয়ারও। অথচ সে অধিকার বঞ্চিত। ইকরাম ভাইয়ের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তিনি আমায় একপলক আশ্বাস দিয়ে দৃষ্টি নত করলেন। বললেন,
“চিন্তা কোরো না। আমি দেখছি।”

ইকরাম ভাই বেরিয়ে গেলেন ভাইয়ার পিছু পিছু। ঠিক তখনই আমার দৃষ্টিগোচর হলো অদ্ভুত এক দৃশ্য। সোফার সামনের টি-টেবিলে এখনো এঁটো চায়ের কাপগুলো পড়ে আছে। ধারা খুব সন্তর্পণে একটা আধ খাওয়া চায়ের কাপ তুলে নিয়ে ঘরে চলে গেল। বি’স্ফো’রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ওটা কার এঁটো কাপ ছিল? এই মেয়েটা আবার অগোচরে কী করছে?
_______________

আজ অদ্ভুতভাবে ফজরের আযানের সময় ঘুমটা ভেঙে গেল। কতদিন পর নিগূঢ় আঁধারে বসে আযান শুনছি আন্দাজ করতে পারলাম না। হয়তো এই প্রথম আযানের ধ্বনিতে এমন মনোনিবেশ করলাম। হৃদয়ে অদ্ভুত প্রশান্তি ঘিরে ধরল। খুব সন্তর্পণে মাকে ডিঙিয়ে ফ্লোরে পা দিলাম। ওজু করে এসে রুমের আলো জ্বে’লে দেখলাম মাও জেগে গেছেন। এ বাড়িতে আসার পর মা আমাদের অবাক করে দিয়ে একদম চুপ আছে। কোনোরূপ উচ্চবাচ্য গত দুদিনে শুনিনি। দরকারের বাইরে কোনো কথাই বলছে না। তবে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে একটু উদাসীন হয়েছে।

মা ওজু করে আসতে আসতে আমি জায়নামাজ বিছিয়ে দিলাম। মা-মেয়ে একসাথে নামাজ পড়লাম। বাইরে তখনো পুরোপুরি আলো ফোটেনি। আমি কৃত্রিম আলো বন্ধ করে জানালা মেলে বসলাম কিছুক্ষণ। পাশের ঘর থেকে ডাকাডাকির শব্দ ভেসে আসছে। ধারা এতবছরেও ভোরে ওঠার অভ্যাস রপ্ত করতে পারেনি। বড়ো মামীকে এখনো অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় এর জন্য। অন্যদিকে জারা নামাজ কিংবা যেকোনো আমলের ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী। নানাজান বাড়িতে থাকলে জারা বেশিরভাগ সময়ই উনার কাছে থাকে।

সকালটা আরেকটু মধুর হলো নানাজানের ঘর থেকে ভেসে আসা তিলাওয়াত-এর সুরে। দরজা পুরোটা খুলে দিলাম। এবার স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এ সময়টাতে কেউ বিশেষ কথা বলে না। সকলেই তন্ময় হয়ে নানাজানের তিলাওয়াত শোনে।

আজ সকালের নাশতা বানানোর সময় নিজে থেকেই বড়ো মামীর হাতে হাতে কাজ করে দিলাম। মামী এতে যেন খুশিই হলেন। ছোটো মামীকে নিয়ে কিছুক্ষণ গজগজ করলেন। ছোটো মামী বড়ো ঘরের মেয়ে। কাজ-কর্মে খুব একটা নিপুণা তো নয়ই, আবার কাজের প্রতি অনীহা ভীষণ। প্রেগ্ন্যান্সির শুরু থেকেই তিনি রান্নাঘর থেকে দূরে আছে। এ নিয়ে বড়ো মামী কিছুটা বিরক্তও বটে।

নাশতা বানানো শেষে গেলাম আবির, নিবিড়কে ডাকতে। দেখলাম খাটে হেলান দিয়ে ছোটো মামী ভিডিও কলে মামার সঙ্গ কথা বলছে। এটা মামীর নিত্য দিনের রুটিন। বেলা এগারোটা অবধি মামা ভিডিও কলে পরিবারের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। আমি আর ভেতরে গেলাম না। অলস ভঙ্গিতে হেঁটে নিজের রুমে চলে এলাম। ফোনটা চেক করে দেখলাম কোনো ম্যাসেজ, কল বা নোটিফিকেশন জমা আছে কিনা। নিজেকে বোঝাই পুরোনো স্মৃতি আঁকড়ে থাকব না, প্রতিজ্ঞা করি সেসব ভাবব না। হয়তো এতেই আমার কল্যান। কিন্তু হুটহাট কী যে হয়! সকল বাধা উপেক্ষা করে আবারো পুরোনোকে খুঁজে ফিরি। দেশ ছাড়ার পর আদনানের পক্ষ থেকে যোগাযোগের কোনো চেষ্টা করা হয়নি। আমিও করিনি। অতীত আমাকে দূরে সরাতে চায় বুঝেও কেন যে ছাড়তে পারি না! ভাবলেই মনটা বিক্ষিপ্ত হয়।

সব ভাবনাদের ছুটি দিয়ে গোসল করে তৈরি হয়ে নিলাম। ভার্সিটি যাব। ইকরাম ভাই বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরিই ছিলেন। আমি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরোতেই শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বললেন,
“চলো নামিয়ে দিয়ে আসি।”
“কোথাও যাচ্ছিলেন মনে হচ্ছে।”
“দরকারি কিছু নয়। পরেও যাওয়া যাবে।”
আমি মাথা নেড়ে বাইকে উঠে বসে মাঝে ব্যাগটা রেখে দিলাম। ইকরাম ভাই বললেন,
“পেছনে ধরে বসো। অসুবিধা হলে বোলো।”

আদনানের পর এই প্রথম অন্যকারো বাইকে ওঠা। পিছুটান ফেলে কিছুটা শূন্যতা, কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে ছুটে চললাম ভার্সিটির পথে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে