বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

0
794

#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে [শেষপর্ব]
প্রভা আফরিন

অন্ধকারে বাস করা মানুষ অনেকদিন বাদে আলোর দেখা পেলে যেমন চোখ ধাঁধিয়ে যায় শুভ্রার মৃত্যুর রহস্যের অন্ধকারে ডুবে যাওয়া আঁখি বেগমের তেমনই হলো। কন্যার মৃত্যুর পর এতগুলো দিন তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন নিজ সংসারের দূর্গতি সইতে না পেরে। আজ দুই বছর পর জানতে পারলেন উনার মেয়ে নির্দোষ ছিল। তাকে ফাঁসানো হয়েছিল। এক নোংরা ষড়যন্ত্রের চোরাবালিতে ডুবে গেছিল আদরের কন্যা শুভ্রা। বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে আঁখি বেগমের। মনে পড়ে যায় সেই জঘন্যতম দিনটার কথা। পায়ের জুতো খুলে পর্যন্ত পি’টি’য়েছিলেন মেয়েটাকে। কত অনুনয়, আকুতি করেছিল সে, উনার মন গলেনি। সন্তানের দেওয়া অপমান, লজ্জার আগুন যেন বুকের ভেতর সঞ্চিত সমস্ত মায়া জ্বালিয়ে দিয়েছিল। নিজের গর্ভকে ভর্ৎসনা অবধি করেছিলেন অমন সন্তান পেটে ধরার জন্য। এমনকি বড়ো মেয়ের দেওয়া যন্ত্রণার ভারে ছোটো মেয়েটাকেও কাছে টানেননি। অনুটা বাড়ি এলে সারাক্ষণ মায়ের গা ঘেঁষে থাকত একটু আদর পাওয়ার জন্য৷ রাতে জড়িয়ে ধরে শুয়ে মাথায় একটু স্নেহের হাত প্রত্যাশা করত। আঁখি বেগম থাকতেন নির্বিকার। মায়ারা যেন ছুঁয়েও ছোঁয় না৷ জগত সংসার উনার কাছে বিতৃষ্ণার অনুরূপ ছিল। আর আজ! আঁখি বেগম অনন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছেন। এই কান্না হারানো সন্তান ফিরে পাওয়ার, হারানো মায়া ফিরে পাওয়ার, হারানো সম্মান ফিরে পাওয়ার। যে মানুষগুলো একদিন ফোন করে মেয়ের চরিত্র নিয়ে বাজে কথা শোনাতো আজ তারাই সমবেদনা দিতে ফোন করছে। সকল ধোঁয়াসার পর্দা উঠেছে। নিউজ চ্যানেলের হেডলাইন এখন জনপ্রিয় উপস্থাপিকা শুভ্রার মৃ’ত্যুর নেপথ্যের গল্প। এক নির্ভীক পুলিশ কর্মকর্তার সফল অভিযানে প্রশংসায় পঞ্চমুখ সারাদেশ।

তুষার সমস্তটা জেনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। যে সন্তানের জন্য বুকের ভেতরটা আজও খাঁ খাঁ করে, সেটা তার ঔরসের ছিলই না! মানুষ এমনও বেইমান হয়! একসঙ্গে ঘর করেও চেনা হয়ে ওঠে না। পিয়াসার প্রতি ঘৃণা এলেও পুষে রাখে না সে। যে মানুষটা মৃত কী লাভ তার ওপর ঘৃণা পুষে! ওপরে একজন আছেন। তিনিই উত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনিই সকলকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেবেন।

রাত বারোটা বাজে। অনন্যা গোসল সেরে আয়নার সামনে এসে বসেছে। আজ অনেক অনেক দিন বাদে সে ফুরফুরে অনুভব করছে। ভঙ্গুর মেরুদণ্ডটা সোজা করে, মাথা উঁচিয়ে বাড়ি ফিরেছে ও। এই যে একটা রাত সে অপহৃত ব্যক্তিদের কাছে আটকা ছিল, এ নিয়েও আড়ালে কানাঘুষা হবে। হয়তো হচ্ছেও। তাতে ওর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। বরং চিন্তার সমস্তটা আরেকজন স্বমহিমায় দখল করে নিয়েছে। থেকে থেকে হৃদয়নীড় তারই চিন্তায় ব্যকুল হয়। অতীতের শেকল ভেঙে বুকের ভেতরটা স্পন্দিত হচ্ছে নব অনুভূতির জাগরণে।

একটি সফল অপারেশন শেষে শ্রাবণ অফিসে ফিরে না গিয়ে সরাসরি প্রেস কনফারেন্স ডেকেছিল। তানভীর খন্দকারের সংযোগ অনেক দূর। জেলে ভরে দিলেও যেকোনো সময় হাওয়া বদলে যেতে পারে। সেই সম্ভাবনা এড়াতেই শ্রাবণ নিজ প্রফেশনকে রিস্কে ফেলে কোনো উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা ছাড়াই অপারেশন থেকে বেরিয়ে সরাসরি মূল অপরাধীসহ মিডিয়ার মুখোমুখি হয়। জামশেদও প্রমাণ নিয়ে প্রস্তুত। এরপর মিডিয়ার সামনে একে একে সমস্ত ঘটনার বিবৃতি পেশ করা হয়। উপস্থাপিকা শুভ্রার আ’ত্ম’হ’ত্যার পেছনের নির্মম গল্প থেকে শুরু করে পিয়াসার খু’ন, তার বাড়ির পরিচারিকার খু’ন তো ছিলই। এরই সঙ্গে চাঞ্চল্যকর তথ্য ছিল একজন সাংবাদিক ও ব্যারিস্টারের খু’নের অমীমাংসিত রহস্যের উন্মোচন। সব মিলিয়ে দেশজুড়ে হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছে এই তরুণ কর্মকর্তা। তবে আফসোসের বিষয় হলো অন্যতম আসামী রাশেদ পলাতক। সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শ্রাবণ জানিয়েছে ঘটনাস্থলে নাকি রাশেদকে পাওয়াই যায়নি। তবে তাকে ধরতে পুলিশ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

দীর্ঘ কনফারেন্স শেষ করে শ্রাবণের হসপিটালে এডমিট হওয়ার কথা ছিল। আগের দিনের আঘাতগুলো ধকলে আবারো তাজা হয়ে উঠেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন ক্ষতচিহ্ন। নির্ঘুম দুই চোখ, ক্লান্ত দেহ বিশ্রামের জন্য হাহাকার করে উঠছিল বারবার। কিন্তু তিনি হসপিটালে গেলেন না। প্রিয়তমাকে নিজ দায়িত্বে তার পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। যেন পরোক্ষভাবে এটাও বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি আমানত রেখে যাচ্ছেন। সময়মতো সেটা বুঝে নেবেন। কী অদম্য জীবনশক্তি লোকটার!
অনন্যা জার্নিটার কথা ভাবলেই লজ্জায় মুখ ঢাকার জায়গা পাচ্ছে না। গাড়ি করে পৌঁছে দেওয়ার ছুঁতোয় অসভ্য পুলিশ তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এসেছে। ওদিকে ড্রাইভিং সিটে জামশেদ তখন মিটিমিটি হাসছেন। কী লজ্জা! চিমটি কেটে, চোখ রাঙিয়েও লোকটাকে তার কাজ থেকে নিবারিত করা গেল না। এক পর্যায়ে যখন ভারী শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়েই গেল, অনন্যার মায়া হলো। এরপর পুরোটা রাস্তা চুলে বিলি কেটে দিয়েছে। ঘুমন্ত ব্যক্তিটির উত্তপ্ত শ্বাসের সান্নিধ্যে উপলব্ধি করেছে কতটা নির্ভরতায়, ভরসায় সে নিজেকে সপে দিয়েছে। বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় আরক্ততা বাড়িয়ে দিতে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে গেছে,
“তুমি শুধু আমার অরক্ষিত হৃদয়ের আশ্রয় হয়ে যাও। আমি আমার আশ্রয়কে সুরক্ষিত রাখতে শেষ র’ক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যাব।”

কাশির শব্দে চমকে উঠল অনন্যা। ধারা কখন ঘরে ঢুকেছে টেরই পায়নি। বিব্রতভাব লুকিয়ে বলল,
“কীরে মেয়ে? এভাবে হাসছিস কেন?”

“তুমি খুব ব্লাশ করছো আপু। চোখে-মুখে কী জেল্লা!”

“ওসব কিছু না। অবেলায় গোসল করেছি তাই এমন দেখাচ্ছে।” অনন্যা বিব্রতভাব লুকাতে ভেজা চুলে ঘন ঘন চিরুনি চালাতে লাগল। সত্যিই আজ ওর মুখটা দ্যুতিময়।

“জানো মানুষ কী বলাবলি করছে?”
“কী?”

“শাহনেওয়াজ শিকদারের প্রেমিকাকে অপহরণ করে ভয় দেখিয়ে তাকে কেইস থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল অপরাধীরা। কিন্তু এসপি উলটে ক্ষীপ্ত হয়ে জীবনবাজি রেখে প্রেমিকাকে উদ্ধার তো করেছেই সঙ্গে সব কয়টাকে জেলেও ভরে দিয়েছে। প্রেমিক হলে এমনই হতে হয়। তোমার কপাল মেয়েদের হিংসার কারণ হয়ে গেছে।” ধারা ঠোঁট টিপে হাসে।

অনন্যা চোখ পাকিয়ে তাকাল। এরই মাঝে আঁখি বেগম ভাত বেড়ে ঘরে নিয়ে এসেছে মেয়ের জন্য। তিনি নিজ হাতে মেয়েকে খাইয়ে দিলেন। মুখে ভাত নিয়ে অনন্যার চোখের জল বাধা মানে না। কতদিন পর সেই পুরোনো মাকে দেখতে পাচ্ছে ও। পরিবারের ছোটো সদস্য হিসেবে সবার আদরের অনু আজ কতদিন বাদে তার আদর ফিরে পেয়েছে৷ এ যেন এক দীর্ঘ অভিশাপের অবসান। পেট ভরে খেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে অনু এক সুখনিদ্রার সন্ধান পেল সেদিন। সমস্ত দেহ, মন জুড়িয়ে দেওয়া এক ঘুম ওকে পেলব পরশে আঁকড়ে ধরল।
____________

“কবে থেকে এসব?”

ফাহমিদা শক্ত মুখে জিজ্ঞেস করলেন ছেলেকে। হাসপাতালের বেডে বসে আপাতত উনার একমাত্র পুত্র, যে কীনা সাহসের পরিচয় দিয়ে সর্বত্র আলোড়ন তুলেছে, সে আপাতত মায়ের শাসনে কাচুমাচু হয়ে আছে। মিনমিন করে বলতে চাইল,
“আসলে আম্মু…” কণ্ঠ থেকে শব্দ বের হতে চায় না।

ফাহমিদার মেজাজ বেজায় গরম। ওদিকে তিনি পাত্রী দেখে হয়রান এদিকে ছেলে এমন প্রেমেই পড়েছে যে তিনি ছাড়া গোটা দেশ জেনে গেছে!পুনরায় খ্যাঁক করে উঠলেন ফাহমিদা,
“কীসের আম্মু? আমি কারো আম্মু নই। আমার কেউ নেই। থাকলে এই দিন দেখতাম না।”

শ্রাবণ মায়ের হাত টেনে ধরল। অপরাধীর স্বরে বলল,
“সরি আম্মু, অজান্তেই হয়ে গেছে। আমি নিজেও বুঝিনি বিশ্বাস করো। বোঝার পর ভেবেছিলাম সম্ভব না। তাই তোমাকেও আর জানাইনি। এরপর কী করে যেন সম্ভব হয়ে গেল। এখন আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। আর তো ফেরানো সম্ভব নয়। আচ্ছা, তুমি না চাইলে বরং কিচ্ছু এগোবে না। আমি চিরকুমার থেকে যাব। এ আর এমন কী?”

ফাহমিদা ছেলেকে হাতের তালুর মতোই চেনেন। কী দারুণভাবে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল ভালোবাসার মানুষকে না পেলে সে চিরকুমার থেকে যাবে। তিনি গালে ব্যথাহীন থা’প্প’ড় মেরে বললেন,
“তুই চিরকুমারই থাক। বিয়ে করতে হবে না।”

শ্রাবণ এবার সত্যি সত্যিই ঘাবড়ে গেল। আরো খানিকটা কোমল হলো কণ্ঠস্বর। অসহায় মুখে বলল,
“অনুকে তোমার অপছন্দ? বিশ্বাস করো ও খুব ভদ্র, ভালো, পরিশ্রমী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটা মেয়ে। খুব সুন্দরীও। অল ইন ওয়ান। এমন পাত্রী হাতছাড়া করা ঠিক?”

“বেয়াদব ছেলে, বিয়ের আগেই বউয়ের গুণের ফিরিস্তি দিচ্ছিস? বিয়ের পর তো আমাকে ভুলেই যাবি।”

“কক্ষনো না। এই আমিটা তোমার তৈরি। তোমাকে ভুলে যাওয়া মানে নিজের অস্বস্তি ভুলে যাওয়া। এমন কথা বলবে না আর।”

ফাহমিদার মন শীতল হয়। চোখে অশ্রু জমে। যে ছেলেকে তিনি নিজ হাতে তৈরি করেছেন তার পছন্দকে কী অপছন্দ হতে পারে!
____________

শ্রাবণের সুস্থ হতে দুটো দিন লাগল। এরমাঝে হাজারবার উশখুশ করেও অনন্যা তার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারেনি। পারবে কেমন করে? মহাশয় দেশ উদ্ধার করে ফিরেছেন, কতশত শুভাকাঙ্ক্ষী, সহকর্মী, আত্মীয়-পরিজন ঘিরে রেখেছে হাসপাতালে! এমনিতেই অঘোষিতভাবে অনন্যা তার ব্যক্তিগত মানুষ হয়ে গেছে। মহাশয় তেমনই ভাব ধরে আছেন সর্বত্র। এরমাঝে সে গিয়ে হাসপাতালে দর্শন দিলে অঘোষিত বাণীর ষোলকলা পূর্ণ হতো। তবে অনন্যা দেখা করতে চেয়েছে সত্যিই। একটা মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার জন্য এতকিছু করল, তার প্রতি এক জনমে ঋণ শোধ করা যাবে না। শুধু কী এর জন্যই! নিজেকে প্রশ্ন করে বিমূঢ় হয় ও। মনের গোপন টান অস্বীকার করার উপায় তো নেই। এরই মাঝে নতুন উপদ্রব শ্রাবণের মামাবাড়ি আর অনুর মামাবাড়ি একইসঙ্গে। ও বাড়ির মানুষ দুইবেলা এসে অনন্যার খোঁজ নিচ্ছে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করছে কবে, কীভাবে, কতদিন ধরে দুজনের সম্পর্ক চলছে। অনন্যা যখনই সত্যবাদী হয়ে বলছে সম্পর্ক ছিল না তখনই ওরা মুখ বেজার করছে, ভাবছে মিথ্যা বলছে। এ কী জ্বালা!

আজ শ্রাবণ হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে। সে জন্য ফাহমিদা অনন্যাদের বাড়ির সবাইকেই দাওয়াত করেছে। দাওয়াতের উদ্দেশ্য সহজেই অনুমেয়। অনন্যা দোনোমোনো করছিল যাবে কিনা। তখন ফাহমিদা নিজেই বলেছেন অনন্যাকেও সঙ্গে আনতে। অগত্যা সেও চলল। মায়ের কথায় ও আজ পিচ কালার শাড়ি পরেছে। লম্বা করে ঝোলানো আঁচল প্রায় মেঝে ছুঁইছুঁই। খোলা চুল পরিপাটি করে পিঠে ছড়িয়ে রাখা। কানে দুল, হাতে দুগাছি চুড়ি। শ্রাবণের বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ইতুও এসে যোগ দিল। শ্রাবণ নিজেই নাকি ওকে ইনভাইট করেছে।

শ্রাবণদের বাড়ি পৌঁছে অনন্যার বুকের ভেতরটা কেমন দুরুদুরু করে উঠল। এই অনুভূতি প্রথম। আদনানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন আড়ষ্টতা অনুর ছিল না। দুজনে ক্লাসমেট হওয়ায় সংকোচ ছাড়া সব কথাই বলতে পারত। কিন্তু শ্রাবণের বেলায় সর্বাঙ্গে এক জড়তার জোয়ার বয়ে যায়। লজ্জায় গালদুটো রাঙা হয়। চোখে-মুখে এক কমনীয় গোধূলির স্নিগ্ধ আভা ফোটে। সান্নিধ্যপ্রার্থী উতলা, অগোছালো মনটাকে বারবার গোছাতে চেষ্টা করে। এসব অনুভূতি ওর জন্য নতুন। যেন সে আগে প্রেমে পড়েনি, আগে ভালোবাসা চেনেনি। আসলেই কি তাই! ইতু বান্ধবীর এই নতুন রূপ আবিষ্কার করে মিষ্টি হেসে বলল,

“ভালোবাসতে তো সবাই পারে। ভালোবাসার মর্যাদা দিতে কজন জানে? যে পারে তাকে হেলা করতে নেই। আর যে পারে না তাকে মনে করে কষ্টও পেতে নেই।”

অনন্যা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা নাড়ে। শাড়ির আঁচল মুঠোয় ধরে ধীর পায়ে এগোয় কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির নিকট। শ্রাবণের বাড়িতে এলাহি কাণ্ড। ওদের দিককার সব আত্মীয় স্বজন অনুকে দেখতে এসেছে। সকলের মাঝে পড়ে ও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। কিন্তু যার জন্য এতসব হলো সেই ব্যক্তির দেখা নেই এসে অবধি। ইতু কানে কানে বলে গেল তিনি ঘরেই আছেন। তবে ভীষণ গম্ভীরতায় মুখ ডুবিয়ে জানিয়েছেন আপাতত কেউ একজনের সামনে আসতে চাইছেন না। সেই কেউ একজন নিরবেই বুঝে ফেলল তার অভিমান। অনন্যা উশখুশ করতে লাগল তার কাছে যাওয়ার জন্য৷ এত মানুষের মাঝে কী করে যাবে বুঝে উঠতে পারে না। ফাহমিদা ঠিকই বুঝলেন। অনুর পদধ্বনি সদর দরজায় পড়া মাত্রই ভেতরের ঘরে একজন উদগ্রীব হয়ে আছে কিনা। তিনি বললেন,
“অনন্যা, তুমি বান্ধবীকে নিয়ে ভেতরের ঘরে গিয়ে আরাম করে বসো। খাওয়ার সময় ডেকে নেব।”

অনন্যা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি ফেলল ভিড় থেকে মুক্তি পেয়ে। ধীরপায়ে প্রস্থান করল। করিডোর ধরে এগোলে মুখোমুখি দুটো বেডরুম। যার একটির দরজা হাট করে খোলা। অপরটি ভিড়িয়ে রাখা। মনের টান পড়ল ভিড়িয়ে রাখা দরজাতেই। আস্তে করে ভেতরে উঁকি দিতেই গম্ভীর কণ্ঠধ্বনি বুকে এসে বিঁধল,
“এই ঘরে প্রবেশ সংরক্ষিত। একমাত্র শ্রাবণকে যারা ভালোবাসে, শ্রাবণের জন্য যাদের অন্তরে সীমাহীন মায়া তারাই প্রবেশ করতে পারবে। কোনো পাষাণী, হৃদয়হীনা রমনী যেন ছলচাতুরী করতে না আসে।”

অনন্যা পুরো দরজাটা খুলে দিল। সদর্পে ঢুকে গেল ভেতরে। যেন এক রাজেন্দ্রাণী একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে নিজ রাজ্যে পদার্পণ করেছে। শ্রাবণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। বোধহয় প্রথমবার শাড়িতে দেখল মেয়েটিকে। অনু সেই নিরলস দৃষ্টিতে লজ্জা পেয়ে গেল। কাছে এসে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“এখন কেমন আছো?”
“দুদিন পর জানতে ইচ্ছে হলো?”
“বেশি দেরি হয়ে গেছে?”
“নাহ, আরো দুদিন পর জিজ্ঞেস করলে বলতাম এতই ভালো আছি যে অফিস যাচ্ছি।”
“তুমি বুঝি অবস্থা রেখেছো? যে দেখে সেই বলে কতদিন হলো? অথচ আমি বেচারী স্বীকার করলামই দুদিন।”
শ্রাবণ চমকে তাকাল, “শিওর?”
অনু স্মিত হেসে জবাব দিল, “ড্যাম শিওর।”

শ্রাবণের সমস্ত মেঘে কেটে যেন রোদ ঝলমল করে উঠল। বিছানা থেকে নেমে অনন্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরে বলল,
“ইউ নো, আমি আমার জীবনের সেরা ঘুমটা ঘুমিয়েছি তোমার কাঁধে মাথা রেখে। যদি জানতে চাও কেন তোমাকে চাই, আমি বলব এই কাঁধটাকে বালিস হিসেবে পাওয়ার জন্য হলেও তোমাকে সারাজীবন নিজের কাছে চাই।”
অনন্যা হতভম্ব হয়ে গেল, “এটা কী প্রপোজ ছিল?”
“ধরে নাও তাই।”
অনন্যা চোখ ছোটো ছোটো করে স্বগোতক্তি করে,
“বাহ! কী রোমান্টিক ডায়লগ! আমার কাঁধকে বালিস হিসেবে পাওয়ার জন্য হলেও আমাকে চান তিনি।”
শ্রাবণ দু্ষ্টু হেসে জবাব দিল,
“হ্যাঁ, আমার ব্যক্তিগত কোলবালিস হবে কিনা।”

অনন্যা লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নিল। ঠিক তখনই ইতুর কাশি ভেসে এলো দরজার কাছ থেকে। সে গুরুতর মুখ করে বলল,
“বড়োরা আগামী মাসে বিয়ের ডেট ফেলবে বলে কথা বলছেন। এদিকে দেখি অবস্থা সিরিয়াস। আগামী সপ্তাহে ডেট দিতে বলব?”
শ্রাবণ মাথা দুলিয়ে হেসে জবাব দিল, “আগামীকাল দিলে আরো ভালো হয়, আমার হতে চলেছেন শালিকা।”
“আজই বরং কাজি ডাকি, আমার হতে চলেছেন দুলাভাই?”
“তাহলে তো এক্ষুনি ফুলের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। বাসর ঘর সাজাতে হবে না?”

ইতু কথায় পরাস্থ হয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে। নবযুগলকে একা ছেড়ে প্রস্থান নেয়। অনন্যা লজ্জায় জুবুথুবু হয়ে শ্রাবণের পিঠে মারতে লাগল। শ্রাবণ খপ করে ওর হাতদুটো নিজের বলিষ্ঠ থাবায় বন্দি করতেই অনু জিজ্ঞেস করল,
“এই অনুভূতির শুরু কবে থেকে, শ্রাবণ?”
“যখন তুমি দুষ্টু কিশোরী আর আমি সদ্য যুবক।”
“এত বছর বুকে চেপে রেখেছ?”
“হয়তো সারাজীবন রাখতাম। কিন্তু দুর্ঘটনা কিংবা খারাপ সময়ের কারণেই হোক, সুযোগটা মিলে গেল। হাতছাড়া করতে চাইনি একেবারেই।”

দুজন একে অপরের সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কাটানোর পর অনন্যার স্মরণ হলো রাশেদের কথা। জানতে চাইল,
“তাকে কী করেছো? গ্রেফতার তো দেখাওনি।”
শ্রাবণ নিঃশব্দে হেসে টেলিভিশন চালু করল। অনন্যা হেডলাইন পড়তে পড়তে হঠাৎ একটা সংবাদে চমকে উঠল।
‘বুড়িগঙ্গার তীরে এক বিভৎস লা’শ উদ্ধার। ধারণা করা হচ্ছে পলাতক আসামী রাশেদেরই লা’শ। তবে মৃ’ত্যুর কারণ জানা যায়নি।’

অনন্যার চমকে তাকাল শ্রাবণের দিকে। চোখ ছলছল করে উঠল। এক দুঃস্বপ্নময় যাত্রার সমাপ্তি ঘটল এবার। শ্রাবণ ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল,
“এই চোখের জন্য দুঃখের কান্না নিষিদ্ধ করা হলো। এই চোখ এখন থেকে শুধু আমার জন্য সুখের অশ্রু ঝরাবে। আমি সেই উষ্ণতম বৃষ্টিতে অবগাহন করে সতেজ হবো। আরো বেশি করে ভালোবাসব।”

অনন্যার কান্না থামল না। আরো বৃদ্ধি পেল। শ্রাবণ ওকে বুকে টানল। প্রশস্ত বুকটাকে আশ্রয় করে অনন্যা অবারিত বর্ষণ ঝরায়। এ অশ্রু সুখের, সমস্ত বেদনার বিসর্জনের।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে