বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে পর্ব-০৭

0
470

#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে
#প্রভা_আফরিন
[৭]

আজ ভার্সিটি থেকে ফিরতেই দেখলাম বাড়ির মূল দরজা হাট করে খোলা। ভ্রু কুচকে এলো। ভর দুপুরে দরজা এভাবে খোলা থাকে না কখনো। মা মা করে ডেকে ঘরে ঢুকলাম। কোনো সাড়া পেলাম না। বুকটা ধক করা উঠল। ছুটে গেলাম মায়ের ঘরে। মা নেই, বাড়ির কোথাও নেই। নার্ভাসনেসে আমি ঘামতে লাগলাম। মা তো একা একা কোথাও যায় না সচরাচর! প্রতিবেশীদেরকেও একপ্রকার এড়িয়ে চলে এখন। তাহলে? মায়ের ফোনটাও ঘরেই পড়ে আছে। নিশ্চিত হতে আশেপাশে খুঁজে দেখলাম। কোথাও নেই। ভাইয়াকে ফোন দিতে দিতে আবারো ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিলাম। সম্ভাব্য সবখানে খুঁজতে হবে। বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছে আন্দাজ করতে পারছি না। আল্লাহর নাম নিতে নিতে দরজায় তালা আটকাতে যাব এমন সময় মায়ের দেখা পেলাম। জানে পানি এলো যেন। ছুটতে গিয়েও থেমে গেলাম। মা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। মায়ের বাহু ধরে নিয়ে আসছে আরেকটি পরিচিত মুখ।

ইকরাম ভাই মাকে ধরে আমার সামনে এসে অসন্তোষের সঙ্গে বললেন,
“এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ করো কেন, অনন্যা? অসুস্থ মানুষটা একা একা বেরিয়ে গেছে খেয়াল করোনি?”
“ইকরাম ভাই! আপনি এখানে?”
বিস্ময়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম। ইকরাম ভাই আমার নানাজানের সার্বক্ষণিক সহযোগী। গ্রাম থেকে এসে নানাজানের ছায়ায় থেকে পড়াশোনা করেছে। পাশাপাশি বৃদ্ধ নানাজানের দেখাশোনার কাজটাও করেছে। বলা যায় তিনি এখন নানাবাড়ির পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠেছে। বর্তমানে নানাজানের হোটেলে বসেন।

ইকরাম ভাই আমার প্রশ্নে একই মুখভঙ্গিতে বললেন,
“হ্যাঁ, শুকরিয়া করো যে আমিই পেয়েছি খালাকে।”
“কোথায় পেলেন?”
“বাস স্ট্যান্ডে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। আমায় চিনতে অবধি পারছিল না।”
আমি করুণ চোখে মায়ের দিকে তাকালাম। ভারী মুখটা লাল হয়ে গেছে। মা আমার হাত ধরে বলল,
“কোথায় ছিলি তুই? পুরো দুনিয়া খুঁজে ফেলেছি।”
“আমি ভার্সিটি গিয়েছি, ভুলে গেছো?”
মা এলোমেলো তাকাল। যেন কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আমি মাকে ধরে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে পেছন ফিরে বললাম,
“আপনি ভেতরে আসুন।”

ইকরাম ভাই কিছু বললেন না। আমার পিছু পিছু ঘরে ঢুকলেন। মাকে সোফায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“পায়ে ব্যথা কী করে পেলে?”
“কী যেন বাঁধল পায়ে, হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছি।”
পা দেখলাম, বুড়ো আঙুলটা কে’টে-ছিলে গেছে। ইকরাম ভাই বললেন,
“স্যাভলন দিয়ে মুছে, পরিষ্কার কাপড় দিয়ে বেঁধে দাও। তাহলে আর সমস্যা হবে না।”
মাথা নেড়ে বললাম,
“দাঁড়িয়ে কেন? বসুন। আমি খাবার দিচ্ছি।”
“আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না। আমি এক্ষুনি বেরোবো। একগ্লাস ঠান্ডা পানি দাও শুধু।”
আমি পানি এনে দিলাম। তিনি ঢকঢক করে পুরোটা শেষ করে আরো একটু চেয়ে নিলেন। বললেন,
“খালার এ অবস্থা কী করে?”
আমি ইতস্তত করে বললাম,
“আসলে বাবার মৃ-ত্যুর পর মায়ের আচরণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।”
“কিছুটা না, অনেকটা। এভাবে একা রেখে ভার্সিটি চলে গেলে খালা যদি আবার বেরিয়ে যায়? গাড়ি-ঘোড়ার রাস্তা। বিপদের তো মা-বাপ নেই।”

আমি মাথা নিচু করে নিলাম। কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আজকে সাহস করে বেরিয়ে গেছে, কালও যাবে না তার নিশ্চয়তা কই? এদিকে ভার্সিটি মিস দিয়ে সারাক্ষণ বাড়িতে বসে থাকাও তো সম্ভব না। ভাবনার মাঝে আমার ভাইয়া চলে এলো। ভাইয়াই মায়ের পা স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করে বেঁধে দিলো। আমি তাদের রেখে রান্নাঘরে ছুটলাম। সকালে যা রেঁধে গিয়েছি তাই আছে। এতে মা, ভাইয়া আর ইকরাম ভাইয়ের হয়ে যাবে। আমার জন্য আবার রান্না বসাতে হবে। টেবিলে খাবার দিতে গেলে ভাইয়া বলল,
“একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অনু।”
“কী?”
“মাকে নানাজানের কাছে পাঠিয়ে দেই বরং। আমাদের অগোচরে এমন হুটহাট যদি বাসা থেকে বেরিয়ে যায় রিস্কি হয়ে যাবে। তুইও চলে যা। ভার্সিটি একটু দূরে হবে শুধু।”
ইকরাম ভাই খেতে খেতে বললেন,
“ভার্সিটি ব্যাপার না। বাড়িতে বাইক আছে। একটানে নামিয়ে দিতে পারব। ওখানে খালা সবার চোখের সামনেই থাকবে। বেরিয়ে পড়ার চিন্তা নেই।”

পরিস্থিতি বিবেচনায় উত্তম সিদ্ধান্ত। কিন্তু ভেতরটা খচখচ করছে। সেখানে মামা-মামী, কাজিনরা মিলে এমনিতেই বড়ো সংসার। কতদিনই বা সহ্য করবে আমাদের? মুখ ফুটে কিছু বললাম না। ইকরাম ভাই যাওয়ার আগে বলে গেলেন কাল-পরশুই যেন মাকে নিয়ে চলে যাই। ভাইয়া সম্মতিও দিয়ে দিলো। ভাইয়ার আগ্রহটা আমার কেন জানি ভালো লাগল না। মনে হচ্ছে আমাদের পাঠাতে তাড়াহুড়ো করছে। কিন্তু কেন?

খেয়াল করলাম ভাইয়ার অফিসে ফেরার তাড়া নেই। এঁটো বাসনগুলো মেজে-ধুয়ে নিজের জন্য ভাত বসালাম চুলোয়। ভাইয়াকে বসার ঘরে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে বললাম,
“অফিস যাবে না?”
ভাইয়া যেন সম্বিত ফিরে পেল এতক্ষণে। কিছুটা হকচকিয়ে তাকালো আমার দিকে। বলল,
“শরীরটা ভালো লাগছে না। যাব না আর।”

ভাইয়া পরেরদিন ও অফিস গেল না। আমাকে ধীর গলায় একবার জিজ্ঞেস করল মাকে নিয়ে নানাজানের কাছে যাব কিনা। বললাম ইচ্ছে করছে না। আর কিছু বলেনি। দুদিন গড়াতেও ভাইয়ার মাঝে কোনো হেলদোল দেখলাম না। যেন চোখের সামনে থেকেও ভাইয়া এ জগতে নেই। না পেরে নিজেই ভাবীকে ফোন দিলাম।
“আসসালামু আলাইকুম ভাবী। কেমন আছো?”
“ভালো আছি। হঠাৎ কী মনে করে?”
“আসলে ভাবী, ভাইয়া কয়েকদিন যাবত ভেঙে পড়েছে। খাওয়া-দাওয়া করছে না, অফিসও যাচ্ছে না। তোমাদের মাঝে কোনো সমস্যা হলে মিটিয়ে নাও, প্লিজ! জানোই তো ভাইয়া কেমন দুর্বল মনের মানুষ।”
“এক মিনিট, এক মিনিট। সমস্যা মিটিয়ে নেব মানে? তুমি কী জানো না আমরা ফাইনাল ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি?”
অবাক হলাম। বললাম,
“ফাইনাল ডিসিশন মানে?”
“তুষার তোমাদের কিছুই জানায়নি? আমরা আপাতত সেপারেট আছি। বেবি হলে ডিভোর্স কার্যকর হবে।”

মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এসব কী শুনলাম? শেষ পর্যন্ত ভাইয়া-ভাবীর সংসারটাও…। অনুনয়ের সুরে বললাম,
“ভাবী, বাচ্চাটার কথা একবার ভাবো। তার তো বাবা-মা দুজনকেই দরকার। তোমার এখানে থাকা নিয়ে প্রবলেম তো? থেকো না। ভাইয়াকে নিয়ে আলাদা থাকো। বাচ্চাটার কথা ভেবে নাহয়…”
“শোনো অনন্যা, এসব নিয়ে কথা বলতে আর কখনো ফোন করবে না। আমার সিদ্ধান্ত বিন্দুমাত্র বদলাবে না। কিসে অন্ধ হয়ে যে তোমার ভাইকে বিয়ে করেছিলাম? চাকরিটাও তো আমার বাবাই জুটিয়ে দিয়েছিল। এবার তাকে নিজের যোগ্যতায় কিছু করতে বলো। যোগ্যতা হাড়ে হাড়ে টের পাবে।”

সেদিনই জানতে পারলাম ভাইয়ার চাকরিটা আর নেই। এ জন্যই ভাইয়া ঘর ছেড়ে বের হচ্ছিলো না! চোখে চোখ রেখে কথা বলছিল না। আমার চোখ ছাপিয়ে কান্না এলো। কেউ ভালোবাসা চেয়েও পায় না আবার কেউ পেয়েও পায়ে ঠেলে।

ভাইয়া ধীরে ধীরে কেমন গুটিয়ে যেতে লাগল। দিন কয়েক বাদে কতগুলো সিভি বানিয়ে এনে কয়েক জায়গায় জমা দিয়ে এলো। ইন্টারভিউয়ের ডাক পায়, ভাইবা হয়, চাকরি আর মেলে না। একমাস এভাবেই চলে গেল। মায়ের চিকিৎসার খরচ চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠল। সংসারের সকল বাড়তি খরচ বাদ দিয়েও পেট চালানো দায় হয়ে গেল। দুয়েকটা টিউশনি পেতে এদিক ওদিক আমিও কম ছুটছি না। কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে। দুর্দশা, হতাশা আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে যেন। মায়ের পাশাপাশি ভাইয়াও এবার বিষণ্ণতার কবলে পড়ছে। আমি সব দেখেও না দেখার ভান করে দিন কাটাই। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মনে মনে প্রার্থনা করি ঘুম থেকে উঠে দেখব সকল হতাশা বিদায় নিয়েছে। নেয় না, বরং একটু একটু করে অভাব আমাদের নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠছে।

সেদিন বাড়িওয়ালা এসেছিল। দু-মাসের ভাড়া বাকি। ভাইয়া লজ্জায় মুখ তুলতে পারেনি। বাড়িওয়ালা আঙ্কেল অবশ্য সরাসরি ভাড়া চাননি। কথায় কথায় বললেন বাড়িটা ভেঙে একটা বহুতল ভবন বানানোর ভাবনা আছে। উনার বাবার একমাত্র স্মৃতি বলে এখনো ভাঙেননি। যা বোঝার বুঝে নিয়েছি। এই একতলা বাড়িটায় আছি পনেরো বছর হলো। একদম নিজের বাড়ির মতোই বাড়িটার প্রতিটি দেয়াল, ইট যত্নে রেখেছি। হয়তো কালেভদ্রে মাসখানেকের ভাড়া আটকে গেছিল তবে এমন দিন কখনো আসেনি। কোনোদিকেই যখন কিছু হলোনা ভাইয়া হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“সব গোছগাছ করতে শুরু কর। নানাজান আমাদের উনার আশ্রয়ে যেতে বলেছেন।”

বুঝলাম এ বাড়িটায় আমাদের মেয়াদ ফুরিয়েছে। মা মেঝেতে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদল। আমি বরাবরের মতোই সকল দুর্ভাগ্যের নীরব সাক্ষী হয়ে রইলাম।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে