বর্ষাস্নাত রাত পর্ব-০১

0
1974

#বর্ষাস্নাত_রাত
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১
_______________________
রাত ১০ টা। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি। সময়টা বর্ষার আওতায় পড়ায় আজকাল দৈনিকই বৃষ্টির ঝুমুম ঝুমুর শব্দে মুখরিত হয় ধরনীর কোল।
মহিউদ্দিনের বর্ষার এই ঝুম বৃষ্টি দেখতে বড্ড বেশিই ভালো লাগে। তাই তো ছেলে মাহফুজ ও মেয়ে মারিয়াকে নিয়ে বিছানার কোণে বসে জানালার গ্রিল ধরে মাথা উচিঁয়ে রেখেছে মেঘলা আকাশ পানে। এমন সময় হাফসা এসে উদগ্রীব কন্ঠে বলল,
” তোমরা এখনো সজাগ? তোমাদের না সেই কখন আমি ঘুমোতে বলেছিলাম। এখনো ঘুমোওনি যে?”
মহিউদ্দিন বলল,
” কেবলই তো ১০ টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি কখনো ঘুমিয়েছি যে, আজ ঘুমোবো? তাছাড়াও বাহিরে দেখছ কী ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এখনই ঘুমিয়ে পড়লে মন তো মানবে না। তাই মিনিট বিশেক বৃষ্টির এলোপাতাড়ি খেলা উপভোগ করি তারপর না’হয় ঘুমানো যাবে।”
হাফসা মুখ বাকিয়ে বলল,
” তোমার সাথে কথা বলা আর কচু গাছের সাথে কথা বলা একই। যাকগে,যা ইচ্ছে করো তুমি…. এই মাহফুজ , বোনকে নিয়ে নিজেদের ঘরে যা। আর হ্যাঁ ঘরে গিয়ে বাবার মত আবার জানালার গ্রিল ধরে বসে পড়িস না। তোরা দু ভাই বোনই তো পেয়েছিস বাবার মত বৃষ্টি উপভোগ করার রোগ। কিন্তু রাত করে তো সেটা সম্ভব না, তাই সোজা রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বি। বুঝেছিস? ”
৫ বছর বয়সী মারিয়া একলাফে মহিউদ্দিনের কোলে চেপে বসল। বলল,
” না না, আমি যাবো না। আমি তো আব্বুর সাথেই বসে বৃষ্টির খেলা দেখব। তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো যাও।”
মারিয়ার কথা শেষ হতেই ৮ বছর বয়সী মাহফুজ বলে উঠল,
” হ্যাঁ আম্মু, তোমার ঘুম পেলে তুমি ওইরুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমরা তো আব্বুর সাথেই বসে বৃষ্টি দেখব।”
দুই ছেলেমেয়ের কথা শুনে হাফসার চড়া মেজাজ আরও দ্বিগুণ পরিসরে চড়ে গেল। তবে আজ সে মাত্রাতিরিক্ত চড়া মেজাজে কথা বলবে না। আর তো কিছুক্ষণ…. চলুক না সবার ইচ্ছেমতো।
ভেবেই বিছানার একপাশে গা মেলে দিল হাফসা। আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মহিউদ্দিন ও তার দুই ছেলেমেয়ের দিকে।
এদিকে মহিউদ্দিন জানালার বাহিরে এক হাত মেলিয়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি মুঠোবন্দি করে ছেলেমেয়ের মুখে ছিটিয়ে দিতেই মাহফুজ ও মারিয়া উল্লাসে লাফিয়ে উঠল। আর জড়িয়ে ধরল মহিউদ্দিনকে। মহিউদ্দিনও ছেলেমেয়ের উল্লাসের সঙ্গী হয়ে দু’হাত দিয়ে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে খিকখিক করে হাসতে লাগল।
হঠাৎই কলিং বেলের আওয়াজ ভেসে এলো। মহিউদ্দিন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
” এতো রাতে আবার কে এলো?”
বলেই মারিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে মহিউদ্দিন বসা থেকে উঠতে নিলেই হাফসা তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে গায়ের ওড়না ঠিক করে নেয়। আর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
” তুমি বসেছ বসো। উঠতে হবে না তোমাকে। আমি দেখছি কে এসেছে।”
হাফসা চলে যেতেই মহিউদ্দিন মারিয়াকে কোলে তুলে বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল,
” অনেক বৃষ্টি দেখা হয়েছে মা আর দেখতে হবে না। এই মাহফুজ, চল বাবা ঘুমিয়ে পড়বি। নয়তো এবার তোর আম্মু এসে তোদের সাথে সাথে আমাকেও ঝাঁটার বারি খাওয়াবে। চল চল…”
মারিয়া দু’হাত মুখে চেপে ধরে হাসির ছলে বলল,
” আল্লাহ! আব্বু কী বলে! ”
মহিউদ্দিন মারিয়ার গালে চুমু খেয়ে বলল,
” আব্বু তো ঠিকই বলে। ”
বলেই মাহফুজ আর মারিয়ার রুমে ঢুকল মহিউদ্দিন। কোল থেকে মারিয়াকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। পাশেই শুয়ে পড়ল মাহফুজ। পায়ের নিচ থেকে পাতলা কাঁথা টেনে মাহফুজ আর মারিয়ার গায়ে মেলে দিয়ে বলল,
” ঘুমিয়ে পড়ো বাবা।”
মাহফুজ আর মারিয়া একত্রে বলে উঠল,
” গুড নাইট আব্বু। ”
” গুড নাইট।”
রুমের আলো নিভিয়ে দরজা বাহির থেকে টেনে নিজ রুমে চলে গেল মহিউদ্দিন। নিজ রুমে গিয়ে টিভি ছেড়ে বিছানায় শুয়ে রিমোট হাতে নিতেই মনে পড়ল হাফসার কথা। ক্ষানিকটা উঁচু স্বরেক বলে উঠল,
” কই গো! ”
হাফসার কোনো সাড়াশব্দ নেই। মহিউদ্দিন আবারও বলল,
” এই মাহফুজের আম্মু! কোথায় তুমি? আর কে এসেছে? ”
এবারও হাফসার কোনো সাড়াশব্দ নেই। তবে দরজার ওপাশ থেকে কেমন যেন একটা ফুসুরফুসুর শব্দ ভেসে এলো মহিউদ্দিনের কর্ণকুহরে। মহিউদ্দিন বলে উঠল,
” কী ব্যাপার কোনো উত্তর দিচ্ছ না যে? আর কে এসেছে কে? কার সাথে কথা বলছ তুমি?”
হাফসা এবার দ্রুত পায়ে রুমে এসে মহিউদ্দিনের পাশে বসে বলল,
” আরে পাশের ফ্ল্যাটের ভাবি এসেছিল। বলল, চিনি আছে না-কি! এদিকে চিনি তো আজই আমাদের ঘরে শেষ হয়েছে। কোথা থেকে দেই তাই আর কী ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছিলাম।”
” ও আচ্ছা, কিন্তু তাই বলে এতগুলো ডাক দিলাম একটা উত্তরও দিলে না?”
” আরে উনার সাথে কথা বলার মাঝে যদি আবার তোমার সাথে কথা বলি বাজে দেখায় না? তাই কোনো সাড়াশব্দ করিনি।”
” ও……”
” সেসব কথা বাদ দাও। টিভি বন্ধ করে এখন ঘুমাও তো। অনেক রাত হয়েছে। আর ঘুমও ধরেছে। ”
বলেই হাফসা উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। মহিউদ্দিন টিভি বন্ধ করে হাফসাকে নিজের দিক ফিরিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে চুলের ভাজে নাক ডুবাতে ডুবাতে বলল,
” কী হয়েছে আমার বউটার? আজ এরকম অদ্ভুত ব্যবহার করছে কেন হুম?”
হাফসা চোখমুখ কুচকে মহিউদ্দিনের থেকে নিজেকে কিছুটা আলাদা করে নিল। বলল,
” আমার ঘুম ধরেছে। প্লিজ ঘুমাতে দাও।”
বলেই হাফসা আবারও উল্টো দিক মুখ করে শুয়ে পড়ল। তবে মহিউদ্দিন এবার আর হাফসার কাছে গেল না। কয়েক সেকেন্ডের অবাক চাহনি ছুঁড়ে নিজেও উল্টো দিক ফিরে শুয়ে পড়ল।
রাত ১ টা। পুরো ঘর জুড়ে বিরাজ করছে থমথমে পরিবেশ। কোথাও কোন শব্দ নেই। নেই কোনো কোলাহল। কেবল বাহির থেকে ভেসে আসছে ঝুমুর ঝুমুর বৃষ্টির মিষ্টি শব্দ। স্তব্ধতাকে বুকে জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সবাই। এরই মাঝে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চোখ মেলে তাকালো হাফসা। যেন এই সময়টারই অপেক্ষা করছিল সে। চোখ মেলতেই চোখের সম্মুখে দেখতে পেল মাথা থেকে পা অবধি কালো কাপড়ে আবৃত এক বিশাল পুরুষালী দেহ গঠনকে।কিন্তু তারপরও কিঞ্চিৎ ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল না হাফসার মুখ জুড়ে। ধীর পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে সেই কালো কাপড়ে আবৃত পুরুষটির পেছনে গিয়েছে দাঁড়িয়ে পড়ল হাফসা। চোখমুখ জুড়ে শত শঙ্কার ছাপ।
তার সামনে থাকা মুখোশধারী পুরুষটি একহাতে চাকু অন্যহাতে একটি সুতি ওড়না নিয়ে একপা দুপা করে এগিয়ে যাচ্ছে মহিউদ্দিনের কাছে। খুব আলতো করে বিছানার উপর উঠে মহিউদ্দিনের উপর বসে পড়ল।
ঘুমের মাঝে শরীরের উপর মাত্রাতিরিক্ত ভর অনুভব করে মহিউদ্দিন চোখ মেলতেই দেখে তার উপর এক মুখোশধারী পুরুষ নিজের দেহের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে বসে আছে। আর পাশে হাফসা দাঁড়িয়ে। ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকায় হাফসার মুখভঙ্গি আন্দাজ করতে পারছে না মহিউদ্দিন। এরই মাঝে তার উপর ভর দিয়ে থাকা লোকটি অকারণেই মহিউদ্দিনের সাথে জোরজবরদস্তি করতে লাগল। মহিউদ্দিন কিছু বুঝে উঠার আগেই লোকটি মহিউদ্দিনের গলায় কাপড়টি পেঁচাতে লাগল। মহিউদ্দিন হাত দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করার একপর্যায়ে হাত ছিটকে দেয়ালের সুইচ বোর্ডে পড়তেই ঘরের আলো জ্বলে ওঠে। সামনে থাকা মানুষটির চোখ দুটো ভীষণ করে চেনা মহিউদ্দিনের। যেন শত জনম ধরে দেখে এসেছে সে এই চোখ দুটো। তাহলে এতো ক্ষিপ্রতা কেন? কেনই বা তারউপর এতো জিঘাংসা? সে তো কখনো কারো ক্ষতি করেনি।
মৃত্যু খেলায় লড়াই করার মাঝে কথাগুলো ভাবছিল মহিউদ্দিন। গলার ফাঁস টা ক্রমশ গভীর রূপ ধারণ করছে। দম নিতেও যেন মহিউদ্দিনের ভেতর তোলপাড় সৃষ্টি হচ্ছে। চোখের সামনে সবকিছুই ঝাপসা দেখাচ্ছে। তারপরও মহিউদ্দিন তার জীবন বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। হাত পা ছুঁড়ে উপরে থাকা মানুষ নামক পিচাশটিকে সরানোর বল প্রয়োগ করলেই পাশ থেকে হাফসা এসে তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে। চোখে ঝাপসা দেখলেও হাফসার বিষিয়ে থাকা মুখটি মহিউদ্দিনের চোখ এড়াতে পারল না। মরণ যন্ত্রণা ভোগ করা সত্ত্বেও প্রিয় মানুষটির থেকে ধোঁকা খাওয়ার যন্ত্রণা টা যেন একটু বেশিই ছিল মহিউদ্দিনের কাছে। তাই তো হাফসার দিকে তাকিয়ে এক ফোঁটা জল টুপ করে গড়িয়ে পড়ে মহিউদ্দিনের চোখ বেয়ে।
একপর্যায়ে মহিউদ্দিনের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা টাও যেন নেতিয়ে পড়ছে। আর সেই সুযোগে সামনে থাকা মানুষটি ছুরি চালায় মহিউদ্দিনের গলার মধ্যভাগে।
রঙিন বিছানার চাদর রক্তের ছোঁয়ায় ক্রমশ গভীর রঙ ধারণ করছে। আর সেই রঙ আরও গাঢ় করতে হাত পা ছুঁড়ে গলার ছেঁড়া অংশ উঁচিয়ে বিলিয়ে দিচ্ছে মহিউদ্দিন আরও রক্তের বন্যা।
বাহিরে মুশলধারে বৃষ্টি আর ঘরে লাল টকটকে রক্ত বৃষ্টি। সেই রক্ত বৃষ্টির মাঝে গলা ছেড়ে অস্পষ্ট গলায় মহিউদ্দিন বলে উঠল,
” এ বছরের বর্ষাস্নাত রাত টা এভাবে রক্ত খেলায় মাতিয়ে তুললে হাফসা?”
কথাটি শেষ করতেই হাফসার মুখোশধারী সঙ্গী আরও একবার মহিউদ্দিনের গলায় ছুরি বসালো। আর আলাদা করে ফেলল দেহ থেকে মাথা নামক অংশটিকে।
হাফসা বিছানা ছেড়ে উঠে রক্তমাখা হাতটি জামায় মুছে বলল,
” সারাটা দিন খুব ভয়ে ছিলাম যদি ঠিকমত কাজটা না করতে পারি। কিন্তু যতটা ভয় পেয়েছি ততটাও ঝামেলা হয়নি। খুব সহজেই কাজটা শেষ করতে পেরেছি। ”
হাফসার কথায় কোনরকম মতামত প্রকাশ না করে গম্ভীর কণ্ঠে মুখোশের আড়ালে থাকা মানুষটি বলল,
” এখন ফালতু কথা বলে সময় নষ্ট না করে ওই রুমে চলো।”
হাফসা এবার ঢোক গিলল। ভ্রু কুচকে বলল,
” তোমাকে তো আমি বাচ্চাদের কিছু করতে নিষেধ করেছিলাম। আর তুমিও তখন রাজি হয়েছিলে। তাহলে এখন আবার ওই রুমে যেতে চাইছ কেন? তোমার মতলব কী? তুমি কি আমাকে বিট্রে করছ?”
” আহা…. তুমি না বরাবরই দু লাইন বেশি বুঝো। ওরা যদি বেঁচে থাকে তোমার কী মনে হয় তুমি আমাকে পাবে? তোমার ফ্যামিলি আমাদের দু’জনের মিলন মেনে নিবে? কখনোই না। সবাই বলবে এই দুটো বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে জীবন পার করে দিতে। তোমার পক্ষে কী এটা সম্ভব? যে মিলনের জন্য নিজের বরকে মারলে সেই মিলনই যদি না হলো লাভ কী তাহলে এতকিছুর? ”
হাফসা এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর আড়ালে থাকা মানুষটির বুকে নিজেকে সঁপে দিয়ে বলল,
” সবাইকে ছেড়ে দিলেও আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না। এ জীবনে তুমি ছাড়া আমি নিঃস্ব। তাই তোমাকে ছাড়া এ জীবন আমি কল্পনাও করতে পারব না। তোমার যা ভালো মনে হয় করো কিন্তু আলাদা হওয়ার কথা বলো না। ”
আড়ালে থাকা হাফসার প্রিয় মানুষটি কন্ঠস্বরে আহ্লাদী ভাব ফুটিয়ে বলল,
” এই তো আমার ময়না পাখির মতো কথা। এমনি এমনি তোমাকে এত ভালোবাসি না-কি? তোমার এই উজাড় করা ভালোবাসার জন্যেই তো তোমায় এতো ভালোবাসি। ”
হাফসাও মুচকি হেসে আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল তার প্রিয় মানুষটিকে। আর সেই সুযোগে সেই মানুষটি বলে উঠল,
” চলো চলো, বাকি কাজটুকু সেরে ফেলি। ভোর হয়ে গেলে তো আবার সমস্যা হবে। ”
বলেই হাতে রক্তমাখা চাকুটি নিয়ে হাফসাকে বুকে জড়িয়ে এগিয়ে গেল পাশের রুমে।

.
.
চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে