বইছে আবার চৈতি হাওয়া পর্ব-৩১+৩২+৩৩+৩৪

0
470

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৩১.

প্রচন্ড জোরে দরজা ধাক্কানোর শব্দে মীরার ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে কিছুই বুঝতে পারল না ও । ঘাড় টনটন করছে, যতক্ষণে সম্বিত ফিরে পেল, তাকিয়ে দেখলো পাশের ঘর থেকে আশিক দৌড়ে এসে দরজা খুলছে।

সকাল সাড়ে ছটা বাজে। আশিক একটু অবাক হলো এই ভেবে যে, বাবা এত তাড়াতাড়ি লোক পাঠিয়ে দিয়েছে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই হুড়মুড় করে কতগুলো লোক ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো। মীরা ততক্ষণে ধাতস্থ হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
লোকগুলো ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তারপর সামনের একজন মীরার দিকে আঙ্গুল তুলে বলল,
– এই যে দেখছেন, কইছিলাম না?
আশিক প্রথমে ভেবেছিল ওর বাড়ি থেকে কেউ এসেছে, দরজা খোলার জন্য। এতগুলো লোক একসঙ্গে দেখে ও একটু হকচকিয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-আপনারা কারা আর এখানে কি চান?
– মাইয়া লইয়া অফিসের নামে ফুর্তি করেন, আবার বড় বড় কথা কন?
– মানে?
সামনের নেতাগোছের লোকটা এবার বাকিদের উদ্দেশে বলল,
– দেখেন, আপনারা দেখেন কি হইতাছে। কিসের অফিস খুলছে বুঝতাছেন?
– এসব কি বলছেন আপনারা? আর আপনারা কারা?
লোকটা আশিকের কথাকে পাত্তা দিল না। পেছন ফিরে অন্যান্য লোকদের উদ্দেশ্যে বলল
-ভাই আপনারাই বলেন এটা ভদ্রলোকের পাড়া, এইখানে এইসব মা/গীবাজী আপনারা সহ্য করবেন?
– মুখ সামলে কথা বলেন। বেরিয়ে যান আমার অফিস থেকে।
-আরে রাখেন মিয়া। অফিসের নাম কইরা মাইয়া লইয়া ফুর্তি করেন, আবার বড় বড় কথা। ওই তোরা জিনিসপত্র ভাঙ্গা শুরু কর।

লোকগুলো মীরার দিকে এগুতে নিলে আশিক ওদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। এতক্ষণে ও নিজেকে সামলে নিয়েছে। এরকম একটা ঝামেলা হতে পারে এমন একটা আভাস আরিফ সাহেব দিয়েছিলেন। এই কারণেই আশিক মানা করা সত্ত্বেও উনি অফিসে সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েছেন। ওনার ধারণা হয়েছিল আপাতত কোন ঝামেলা না হলেও আশিকের উপর ওরা শোধ তোলার চেষ্টা করবে।

মীরা প্রথমটাই কিছুই বুঝতে পারেনি, যখন বুঝতে পারল তখন লজ্জা ঘৃণার চাইতে ওর ভীষণ ভয় করতে লাগলো। নিজের চাইতেও বেশি ভয় করতে লাগলো আশিকের জন্য। ও জানে যতক্ষণ আশিক সামনে আছে, ওর কিছুই হবে না; কিন্তু এতগুলো লোক। ওরা যদি আশিককে কিছু করে ফেলে?

আশিক নিজেকে সামলে নিয়েছে। এই লোকগুলো নিশ্চয়ই প্ল্যান করেই এসেছে। এত সকালে ওদের এসব জানার কথা নয়। এই মুহূর্তে ওদের সঙ্গে লাগতে যাওয়াটা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয। তাছাড়া ও একা আর ওরা প্রায় আর আট দশজন। এখন কোন ঝামেলা হলে ও সামলাতে পারবে না। কাজেই মাথা ঠাণ্ডা রাখাটাই সমিচীন। আশিক ঠান্ডা গলায় বলল,
– দাঁড়ান। নিশ্চয়ই কোথাও কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।
-কিসের ভুল বোঝাবুঝি? ওই তরা শুরু কর।

আশিক পকেট থেকে ফোন বের করে ওর বাবাকে ফোন করল।
-এক মিনিট দাঁড়ান।
আরিফ সাহেব ফোন ধরে বললেন,
আশিক মোজাম্মেল রওনা হয়ে গেছে; কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়ার কথা।
– বাবা এখানে একটা ঝামেলা হয়েছে। কিছু লোক এখানে এসে ঝামেলা করছে।
– তাই নাকি? দাড়াও আমি ল্যান্ড লাইন থেকে ফোন করছি। হাসান সাহেব ফোন কেটে দিলেন।
একটা চ্যাংড়া গোছের ছেলে ততক্ষণে সামনের কম্পিউটারটা তুলে আছাড় মারার জন্য হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে আরিফ সাহেবের ফোন এলো। আশিক ফোন ধরতেই তিনি বললেন,
– ফোনটা লাউড স্পিকারে দাও।
আশিক ফোন লাউড স্পিকারে দিল। আরিফ সাহেব বললেন,
-তোমরা দুজন ঠিক আছো?
– জি বাবা, কিন্তু মনে হচ্ছে এরা ঝামেলা করবে।
– সমস্যা নেই আমি ওদের দেখতে পাচ্ছি। মেক সিওর তোমরা যেন সেফ থাকো।
লোকগুলো একটু থমকালো, তবে তাদের বিশেষ একটা চিন্তিত মনে হল না। নেতাগোছের লোকটা বলল,
– কি হইল তোরা থাইমা গেলি কেন?
এবার আরিফ সাহেবের গুরু গম্ভীর গলা শোনা গেল। উনি বললেন,
– ওরা কি তোমাদের গায়ে হাত দিয়েছে?
– না এখনো দেয়নি।
– কোন প্রপার্টি ড্যামেজ করার চেষ্টা করছে?
– হ্যাঁ চেষ্টা করছে।
– ওদের বাধা দিও না। আমি কমিশনারকে ফোন করেছি। ইকবাল নামের একজন ইন্সপেক্টরকে আসতে বলা হয়েছে ;সঙ্গে ছ জন কনস্টেবল থাকবে। লাল শার্ট পরা যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে, ওর তো ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। ভালোই হয়েছে, সেক্ষেত্রে কেস আরও মজবুত হবে। ওদেরকে তুলে নিয়ে একটু ডলা দিলেই সব বেরিয়ে আসবে।
– বাবা ওরাই অ্যালিগেশন আনছে যে..
– এখানে আলিগেশন আনার কিছু নেই, বরং ওরা অনধিকার প্রবেশ করেছে, কাজেই ওদের বিরুদ্ধে কেস হবে। ওরা কোন ড্যামেজ করতে চাইলে ওদেরকে বাধা দিও না। ভাঙচুর হলে কেস আরো মজবুত হবে। শুধু খেয়াল রাখো যেন তোমরা সেফ থাকো, তোমাদের কোন ক্ষতি না হয়।
চ্যাংড়া ছেলেটা হাত থেকে কম্পিউটার নামিয়ে রেখেছে। বাকি ছেলেগুলো মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। আরিফ সাহেব বললেন,

– পুলিশ কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবে, ততক্ষণ এরা থাকলে ভালো, না থাকলেও সমস্যা নেই। ক্যামেরাতে সব রেকর্ড করা আছে, তবে ওরা যদি এখন ক্ষমা চেয়ে চলে যেতে চায় তাহলে আমরা কোন কেস করবো না। বাকিটা ওদের ইচ্ছা।

নেতাগুছের ছেলেটা পিছু হটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো, তারপর মোবাইলে ফোনে গলা নামিয়ে বলল,
বস এইখানে তো গ্যান্জাম লেগে গেছে। জি? জি, জি আচ্ছা আমরা বাইর হইতাছি।
লোকটা ফিরে এসে বাকিদের উদ্দেশে বলল,
-ওই চল। অগো অফিসে এরা যা মন লয় তা করুক।

লোক গুলো বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় কিছু বলে গেল না। আশিক আস্তে আস্তে বলল,
-বাবা ওরা চলে গেছে।
-আমি দেখতে পাচ্ছি। আশিক আমি উবার পাঠাচ্ছি, তুমি মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়ে এসো।

আশিকের ফোন বাজছে। সম্ভবত নিচ থেকে উবার ড্রাইভার ফোন দিচ্ছে। ও খুব নরম গলায় বলল,
-মীরা চলো।
মীরা আর কিছু বলল না, ব্যাগটা তুলে মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল। পথে আর কোন কথা হলো না। আশিক শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিল,
-তুমি কোথায় যাবে?
-হলে।
পথে আশিক আর কোন কথা বলল না। লজ্জায়, অপমানে ওর মাথা হেট হয়ে আছে। ওর কারনে আজ মীরাকে এতটা অসম্মানিত হতে হয়েছে। হলের গেটে এসে আশিক শুধু আস্তে আস্তে বলল,
-এসে গেছে মীরা। তুমি নামতে পারো।

মীরা ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেল। ঘরে ঢুকে টের পেল ওর গায়ে এখনো আশিকের গেরুয়া চাদরটা জড়ানো। ফেরত দিতে ভুলে গেছে।

চলবে………

বইছে আবার চৈতি হাওয়া

৩২.
কোথাও একটা একটানা, একঘেয়ে শব্দ হচ্ছে। পিন্-পিন্, পিন্-পিন্। আশিক কানের উপর বালিশ চাপা দিয়ে শব্দটা এড়ানোর চেষ্টা করে বার কয়েক। লাভ হয় না। বাধ্য হয়েই ফোনটা তুলে, কানে ঠেকিয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে,
-হ্যালো।
অন্য পাশ থেকে একটি উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শোনা যায়,
-কোথায় তুই?
– বাসায়।
– বাসায় কি করিস?
– ঘুমাই।
– এই অবস্থায় ঘুম হচ্ছে তোর?
– কেন কি হয়েছে?
– তুই ফেসবুক দেখিস নাই?
– না।
– দেখ তাড়াতাড়ি। মীরার কি অবস্থা কে জানে?
আশিক তড়াক করে উঠে বসল বিছানায়। তারপর বলল,
– কি হয়েছে মীরার?
– তুই আগে দেখ, তারপর ফোন দে।
মারুফ ফোন রেখে দিল। এক মুহূর্তে আশিকের সব ঘুম উবে গেছে। আশিক ফেসবুক খুলে হতভম্ব হয়ে গেল। সমস্ত ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জার জুড়ে একই, সেই একই ঘটনা। বারংবার সবাই জানতে চাইছে, প্রশ্ন করছে, কৌতুক করছে। ভাষা ভিন্ন, শব্দচয়ন আলাদা, কিন্তু সারমর্ম একই। অল্প কথায় বললে তার মর্মার্থ হলো, মিরা দ্বিচারিণী। একজনের সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে অন্যজনের সঙ্গে রাত্রি যাপন করছে।

আশিক ভেবে কুল পাচ্ছে না। ওরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে মীরাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় কতখানি হেনস্থা হতে হচ্ছে।

সেই ঘটনার পর দুদিন কেটে গেছে। সেদিন মীরাকে হলে পৌঁছে দিয়ে, ক্লান্ত ও বিদ্ধস্ত আশিক বাড়ি ফিরে এসেছিল। ভেবেছিল সারাদিন নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখবে, কোথাও যাবে না কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। ফেরার পর আরিফ সাহেব জানিয়েছেন, পুলিশ ওর অফিস থেকে ঘুরে এসেছে, সেখান থেকে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে গেছে। এখন ওদের সঙ্গে বসতে হবে। ও যেন ফ্রেশ হয়ে দ্রুত চেম্বারে চলে আসে। আশিক স্নান সেরে দ্রুত চেম্বারে চলে এলো। আরিফ সাহেব ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিল ইন্সপেক্টর ইকবাল, কমিশনার রায়হান চৌধুরী। সমস্ত তথ্য সংগ্রহের পর ভিডিওগুলি বারংবার দেখা হল। কাজ গুছিয়ে ছাড়া পেতে পেতে দুপুর হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলায় তারা আবার এলেন, অনেকগুলো ছবি নিয়ে। আবারো মিটিংয়ে বসতে হলো। ভিডিওর সঙ্গে ছবিগুলো মিলিয়ে দেখা হল। গভীর রাত পর্যন্ত কাজ চলল। আশিক ঘরে ফিরতে পারল অনেক রাতে। মোবাইলে বন্ধুদের অজস্র মেসেজ পেল। দেখার সময় মিলল না। চোখ বন্ধ হয়ে এলো ঘুমে। শুধু রাসেলের মেসেজটাই যা একটু দেখতে পারলো। ও লিখেছে, ওর রিক্সা গর্তে পড়ে গেছিল। হাতে ব্যথা পেয়েছে। বাড়ি ফিরে যেতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। মোবাইল ভেঙে গিয়েছিল সেজন্য কোন যোগাযোগ করতে পারেনি। ক্ষমা চেয়েছে বার বার। মারুফের একটা মিসকল দেখা গেল, কিন্তু রাত হয়ে গেছে ভেবে আর কল ব্যাক করল না আশিক। পরদিন ভোর হতে না হতেই ছুটতে হলো পুলিশ স্টেশনে। কতগুলো ছেলেকে তুলে আনা হয়েছে। তাদের আইডেন্টিফিকেশনের জন্য আশিককে দরকার। মারুফকে ফোন করে আনানো হলো। টিএসসির সেই ছেলেগুলোই ছিল কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। মারুফ কিছু বলতে চেয়েছিল বারবার, কিন্তু সেখানে সেই মুহূর্তে সেটা সম্ভব ছিল না। সেদিনও ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। মারুফ বলে গিয়েছিল যে জরুরি কথা আছে ফোন করতে। সময় করে উঠতে পারেনি। আশিক ফেসবুকে ঢুকে মনে হল মারুফের কথাগুলো শোনা উচিত ছিল। একটার পর একটা ভুল হচ্ছে আর সেই সব ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে মীরাকে।

আশিক মারুফকে ফোন দিল। ধরল না ও। হয়তো ব্যস্ত আছে কিংবা ফোনের ধারে কাছে নেই; অথবা পথে আছে এমনও হতে পারে। মারুফ আর মীরা একই এলাকার। এটা আগে থেকেই জানত আশিক; যদিও ওরা পূর্বপরিচিত নয়, ডিপার্টমেন্টে এসেই পরিচয় হয়েছে। তবে দেখা গেছে মারুফ মীরার পরিবারকে বেশ ভালই চেনে। চেনাটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়; মীরার বড় চাচা এজাজুল ইসলাম মার্কেটে এক নামে পরিচিত। মার্কেটে ওদের তিনটা শাড়ির দোকান। একটা ভাড়ায় চলছে আর বাকি দুটোতে বাবা-ছেলে দুজন বসেন। সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে এজাজ সাহেবের সুনাম আছে বাজারে। এ ছাড়াও উনি ভীষণ ধর্ম-প্রাণ মানুষ। ধর্ম সংক্রান্ত জ্ঞান তার অগাধ। পাড়ায় ধর্ম বিষয়ক কোন পরামর্শের প্রয়োজন পড়লে সকলেই তার শরণাপন্ন হয়। পাড়ায় সবাই তাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করে। এই সমস্ত খবর মারুফের কাছ থেকে জেনেছে আশিক। এখন এইরকম পরিস্থিতিতে সোশ্যাল মিডিয়ার এই খবরগুলো যদি উনার কানে পৌঁছায়, তাহলে তার ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য তা যথেষ্ট। সেটা হতে দেওয়া উচিত হবে না। এমনটা যেন না হয়, সেই চেষ্টা করতে হবে।

আশিকের মাথা কাজ করছে না। মারুফ ফোন ধরছে না। রাসেলের ফোন বন্ধ, সুমন ঢাকার বাইরে গেছে, রিপন অসুস্থ হয়ে কদিন ধরে পড়ে আছে। আর কার কাছ থেকে খবর জানতে পারবে? আশিক মীরাকে একবার ফোন দিল। ওর ফোনও বন্ধ দেখাচ্ছে। কি অবস্থায় আছে এখন কে জানে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে উঠে গেল আশিক। মাথা কাজ করছে না। কড়া করে এক কাপ কফি খেতে হবে, সেটাও করতে ইচ্ছা করছে না। আশিক হাত মুখ ধুয়ে নিচে গিয়ে রোজিনার কাছে কফি চাইল। ব্রেকফাস্ট টেবিলে দেয়া ছিল। খেতে ইচ্ছা করছে না। আশিক একটা স্যান্ডউইচ আর কফি নিয়ে উপরে চলে গেল। ফোন বাজছে, সম্ভবত মারুফ ফোন করেছে। আশিক ফোন ধরতেই চিন্তিত গলায় জানতে চাইল,
– ফেসবুকে দেখেছিস?
– হ্যাঁ দেখেছি। মীরার অবস্থা কি?
– তুই জানিস না কিছু?
– না।
– কাল ক্যাম্পাসে এসেছিল। ওকে বেশ হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে হয়েছে।
– এখন কোথায় ও? ওর ফোন বন্ধ কেন? জানিস কিছু?
– ও চলে গেছে।
– কোথায় চলে গেছে? আশিক আৎকে উঠলো।
– বাড়ি চলে গেছে। ওকে নাকি বাড়ি থেকে জরুরী ভিত্তিতে ডাকা হয়েছে।
– কেন? জানিস কিছু?
মারুফ একটু ইতস্তত করে বলল জানি
-কি ব্যাপার বলতো?
– কালকে ওর বিয়ে।
-হোয়াট! কার সঙ্গে বিয়ে?
-ওর চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে।
-চাচাতো ভাই কোথা থেকে এলো? শুভ কি করছে? আর তাছাড়া তুই এতসব কি করে জানিস?
– ওর চাচাতো ভাই সৌরভকে আমি চিনি। জুনিয়র স্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়েছি। এরপরে বহু বছর যোগাযোগ ছিল না। গেল বছর বাড়ি যাবার পর আবার দেখা হয়েছে। আমার কাজিন রত্নার সঙ্গে ওর একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যতদূর শুনেছিলাম ওদের বিয়ে হবে। এখন হঠাৎ করে এসব কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
– তুই কি শুভর সঙ্গে কথা বলেছিস?
– না আমি বলিনি তবে শুনেছি রাসেল বলেছে।
– কি বলেছে শুভ?
– এসব শোনার পর নাকি মীরার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে চাইছে না।
– কি? হোয়াট ননসেন্স! আমি এখনই শুভর সঙ্গে কথা বলছি।
-কথা বলে মনে হয় লাভ হবে না।
– বলতে হবে মারুফ। সমস্যাগুলো হয়েছে আমার কারনে, কাজেই আমাকেই ফিক্স করতে হবে।

আশিক ভেবেছিল শুভর সঙ্গে কথা বলে অবাক হবে কিংবা হতাশ হবে, কিন্তু রীতিমতো ধাক্কা খেলো ও। ফোন ধরেই শুভ বাঁকা গলায় বলল
– এখন কি আবার তোকে দিয়ে ফোন করালো নাকি, ওকালতি করার জন্য।
– কেউ আমাকে দিয়ে ফোন করায়নি, আমি নিজে থেকেই ফোন করেছি। শুভ তোর সত্যটা জানা উচিত। যেটা হয়েছে, সেটা একটা এক্সিডেন্ট মাত্র। দুর্ঘটনাক্রমে মীরা আটকে গিয়েছিল আমার ওখানে। এর বেশি কিছুই না।
– তাই নাকি? তা দুদিন পর পর তোর ওখানে গেলে তো একনা একদিন আটকা পড়বেই। আমি ওকে মানা করেছিলাম যেতে। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, ও কি টাইপের মেয়ে।
– কি টাইপের মেয়ে মানে?
– এ ধরনের সস্তা টাইপের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে যাওয়াই আমার উচিত হয়নি।আশিকের মাথাটা হুট করে গরম হয়ে গেল। শুভ হাতের কাছে থাকলে ওর টুটি চেপে ধরতো; কিন্তু সমস্যাটা ওর দিক থেকে হয়েছে, তাই মাথা ঠান্ডা রাখা ছাড়া কোন উপায় নেই। আশিক ঠান্ডা গলায় বলল,
– আমার সম্বন্ধে যা ইচ্ছা ভাব, ওকে অন্তত ভুল বুঝিস না। তুই তো ওকে ভালবাসিস।
– হ্যাঁ, আমি স্টুপিড, তাই ওকে ভালবাসতাম এখন আর বাসি না।
– এখন তুই রাগের মাথায় আছিস, তাই হয়তো এমন মনে হচ্ছে। এটা আমেরিকা না, একবার ওর বিয়ে হয়ে গেলে আর কিছু করতে পারবি না।
– ও বিয়ের খবরও তুই জেনে গেছিস দেখছি।
– শুভ, এখনো সময় আছে। তুই চাইলে বিয়েটা আটকাতে পারিস।
– কেন? আমি কেন বিয়ে আটকাতে যাব?
– তুই তো এমনি ওকে বিয়ে করতে চাইছিলি। এখন কি এমন হয়ে গেল? তুই চাইলে আমি তোকে সাহায্য করতে পারি।
– বাহ ফুর্তি করবি তুই, আর বিয়ে করে উদ্ধার করতে হবে আমাকে?
– শুভ, ভদ্রভাবে কথা বল। আমি তোকে আগেও বলেছি, এমন কিছুই হয়নি। তাছাড়া তুই তো ওর প্রতি কমিটেড ছিলি। আগেও ওকে বিয়ের কথা বলেছিলি।
– হ্যাঁ বলেছিলাম। তখন ও না করেছে। তখন তো আমি বুঝিনি যে এই কারণে না করছে।
এখন বুঝুক।
-দেখ আমি তোকে বলছি, যেটা হয়েছে সেটা একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের মধ্যে কোন কিছুই নেই। এখন শুধু মাত্র একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে তুই ওকে বিয়ে করবি না? ওর লাইফটা নষ্ট হতে দিবি?
– তোর এত দরদ থাকলে তুই বিয়ে কর। নাকি তুই শুধু অন্যের প্রেমিকা নিয়ে ফুর্তি করতে পারিস, বিয়ের সময় আসলেই পিছিয়ে যাস।
– কি বলছিস ভেবে বলছিস?
– দেখ আশিক, তোদেরকে নিয়ে ভাবার মত সময় আমার নেই। তোরা যা ইচ্ছা তাই কর । তবে মীরার কোন কিছুতে আমি আর নেই। ওর মতো বাজে, সস্তা মেয়ের সঙ্গে আমি কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না।

শুভ ঘটাং করে ফোনটা কেটে দিলো। আশিক ফোন হাতে কিছুক্ষণ ওই ভাবেই বসে রইল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল।

আরিফ সাহেবের চেম্বারের দরজা বন্ধ, যার অর্থ ভিতরে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে। বাইরে একটা ছোট অফিস ঘরের মতন আছে। রফিক চাচা সেখানে বসেন। রফিক বিবিধ দায়িত্ব পালন করলেও কাগজে-কলমে সে আরিফ সাহেবের ম্যানেজার। আশিক কাছে এসে বলল,
-আমার একটু বাবার সঙ্গে কথা আছে।
– স্যারের মিটিং চলতেছে। ঘন্টা খানেক লাগবে আরো।
– আমার এখনই কথা বলতে হবে। আমি ভিতরে ঢুকছি।
রফিক বাধা দেয়ার সুযোগ পেল না, তার আগেই আশিক ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। দরজার উল্টোদিকেই আরিফ সাহেব বসে আছেন, তার সামনে আরো চারজনকে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। আশিক তাদের মুখ দেখতে পাচ্ছেনা, তবে আরিফ সাহেবকে দেখে বোঝা যাচ্ছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছিল।
– আপনার সঙ্গে একটু জরুরী কথা আছে।
– আমি মিটিং শেষ করে তোমার সঙ্গে কথা বলছি।
– আমাকে এখনই বলতে হবে।
আরিফ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বলো।
– একটু বাইরে আসলে ভালো হয়।
এবার উনি যথেষ্টই বিরক্ত হলেন।
– যা বলার এখানেই বল।
– আমি বিয়ে করতে চাই।
ঘরে মৃদু হাসির গুঞ্জন শোনা গেল। আরিফ সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন।
– এক্সকিউজ মি জেন্টলম্যান, আমি এখনই আসছি।
বাইরে বেরিয়ে এসে উনি রুষ্ট গলায় বললেন,
– তুমি তো এমন ভাব করছো যেন বিয়ের লগ্ন পেরিয়ে যাচ্ছে। এই কথাটা মিটিং শেষ হওয়ার পরেও বলতে পারতে না?
– খানিকটা সেইরকমই। আমাদের এখনই রওনা দিতে হবে, তা নাহলে ওর অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যাবে।
-কার?
– মীরার।
– মীরা মানে ওই মেয়েটা?
– জি।
– কিন্তু তুমি তো বলেছিলে………
– বাকি কথা যেতে যেতে বলি?
আরিফ সাহেব জবাব দিলেন না, বিরক্ত মুখে চেম্বারে ঢুকে গেলেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই বেরিয়ে এসে বললেন,
– রফিক গাড়ির ব্যবস্থা কর। আমরা আধা ঘন্টার মধ্যেই বের হব।
চলবে………..

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৩৩.

এজাজুল ইসলামের বুকে চিন চিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। উনি বুকের বা পাশটা চেপে ধরে বৈঠকখানার জানালাটা খুলে দিলেন। মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে বাতাস কম। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পুরনো দিনের কাঠের পাল্লা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করলো খুলতে। জানালার কপাটের একটা পাশ ভেঙ্গে গেছে, সারানো হয়নি। এই বাড়ি বহুদিনের পুরনো। ওনার বাবা করেছিলেন। বাবার কাঠের ব্যবসা ছিল। মনে পড়ে, তখন ওরা খুব ছোট। দুই ভাই আর মা-বাবা এই বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। একটা মাত্র টিনের ঘর ছিল। দাওয়ার একপাশে এক চিলতে রান্না ঘর, অনেকখানি দূরে যেতে হতো প্রাকৃতিক কার্য সারতে। ছোটবেলায় ভয় করত ভীষণ। দুই ভাই একসঙ্গে যেত। সে সময় টাকা পয়সার খুব টানাটানি ছিল। বাবা দুই ভাইকে মক্তবে ভর্তি করেছিলেন। সেখান থেকেই স্কুল শেষ করেছেন এজাজ সাহেব। তার ধর্মচর্চার শুরু সেই ছেলেবেলা থেকেই। ওনার সঙ্গে যারা পড়তো সকলেই খুব বিরক্তি নিয়ে, পরীক্ষা পাশ করার জন্য পড়তো; কিন্তু কেন যেন ধর্মের প্রতি তার একটা অগাধ টান ছিল ছেলে বেলা থেকেই। কলেজে ওঠার পর তিনি আরো গভীরে গেলেন; পাঠ্য বইয়ের বাইরেও আরো অনেক ধর্মীয় বই পড়তে আরম্ভ করলেন। খুব ইচ্ছা ছিল কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করবেন, কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কলেজ পাশ করার পরপরই বাবা মারা গেলেন। সে সময় আর্থিক অবস্থা আগের থেকে ভালো হলেও ব্যবসার অবস্থা খুব ভালো ছিল না। বাবা মারা যাবার পর তাকে ব্যবসার দায়িত্ব নিতে হয়েছে। আর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি। তবে তিনি পড়তে ভালোবাসেন। বিশেষত ধর্মীয় বই। এই বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান; তবু প্রতিদিন মনে হয় কিছুই শিখে উঠতে পারেননি এবং জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, আর যতটুকু বা শিখেছেন তার ক্ণামাত্র এই জীবনে আমল করতে পারেননি। এই আফসোস তার আমৃত্যু থাকবে। এজাজ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভোরের নরম বাতাসে তার বুকের ব্যথা স্তিমিত হয়ে আসছে। আজ নিজেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ অনুভব করছেন। আশেপাশের লোকজন বিভিন্ন সমস্যায় তার কাছে আসে, পরামর্শ চায় কিন্তু তিনি নিজের সমস্যা নিয়ে কারো কাছে যেতে পারেন না। কেমন সংকোচ লাগে। ছোট ভাইয়ের অভাবটা আজ বড় বেশি করে অনুভব করছেন। মফিজ বেঁচে থাকলে আজ তার সঙ্গে একটু পরামর্শ করা যেত।

এজাজ সাহেব বরাবরই শেষ রাতের দিকে ঘুম থেকে ওঠেন। তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করেন অনেকক্ষণ। তারপর ফজরের আযান দিলে নামাজ পড়তে বের হন। নামাজ শেষ করে প্রাতভ্রমণে যান। দিনের এই সময়টা ওনার সবচাইতে প্রিয়। সে সময়ে ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করে। রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে পরিচিত বিভিন্ন লোকজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। কুশল বিনিময় হয়। ওনারা নানান কথা জিজ্ঞেস করেন। অনেকে পাশাপাশি হাঁটেনও। গল্প করতে করতে সময় কেটে যায়। তারপর বাড়ি ফিরে সবার সঙ্গে প্রাতরাশ সেরে দোকানের উদ্দেশে রওনা দেন। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি; হাঁটতে হাঁটতে পরিচিত একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ভদ্রলোক আফসোসের স্বরে বললেন,
– আপনার ভাতিজিকে ঢাকায় পাঠায় বোধহয় ঠিক করেন নাই এজাজ ভাই।
– কেন কি হয়েছে?
– আমার ছেলেও তো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, বলতেছিল ফেসবুকে নাকি কি সব দেখছে।
– কি দেখেছে?
– সে আমি আপনাকে বলতে চাইনা। আপনি সম্মানিত মানুষ, মনে হইল আপনাকে জানানো দরকার..
– আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখছি।

এজাজ সাহেবে চিন্তিত মুখে বাড়ি ফিরে এলেন। এবং তার পরপরই টেলিফোনটা এলো। যে টেলিফোন করেছে সে তার নিজের নাম বলেনি। কিন্তু ঘটনা যা বলেছে তাতে এজাজ সাহেবের পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। মীরাকে নাকি একটা অফিস রুমে কিছু লোক একটা ছেলের সঙ্গে উদ্ধার করেছে। জানা গেছে সেই অফিসে মীরা প্রায়ই রাত্রি যাপন করে। এখানে কোন আর্থিক ব্যাপার জড়িত আছে কিনা তার জানা নেই, তবে সম্পর্কটা বহুদিন ধরেই চলছে।

এজাজ সাহেবের স্ত্রী চা নিয়ে এসেছেন। স্বামীকে এভাবে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলেন। সাধারণত এই সময় উনি ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে তৈরি হতে থাকেন। চা পান করেন আরো আগেই। আজ নিয়ে আসতে দেরি হয়ে গেছে। উনি সৌরভের ব্যাপারে কিছু কথা বলবেন বলে তৈরি হয়ে এসেছিলেন, কিন্তু স্বামীকে দেখে থমকে গেলেন। এজাজ সাহেবে চা নিলেন না, স্ত্রীকে বললেন উনি বেরিয়ে যাচ্ছেন, সৌরভকে পরে পাঠিয়ে দিতে। ওনার মুখভঙ্গি দেখে নাসিমা আর কোন প্রশ্ন করার সাহস পেলেন না।
এজাজ সাহেব দোকানে ঢুকেই মীরাকে ফোন করলেন। ভাতিজিকে তিনি অত্যধিক স্নেহ করেন। তার নিজের কোন মেয়ে নেই। বিয়ের বহু বছর পর্যন্ত সন্তান হয়নি, শেষ বয়সে এসে সৌরভের জন্ম হয়। তবে আল্লাহ পাক তার সেই অভাব রাখেননি। ভাইয়ের তিন মেয়েকে তিনি নিজ সন্তানের অধিক স্নেহ করেন। তারাও বড় চাচা বলতে অন্তপ্রাণ। তবে সবার মধ্যে ওনার সবচেয়ে প্রিয় মীরা। আজ মীরার ব্যাপারে এমন একটা কথা শুনে উনি অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছেন। তবে উনি নিশ্চিত কোথাও একটা ভুল হয়েছে। মীরা এমন কিছু করতেই পারেনা। মীরাকে উনি যতটা ভালোবাসেন তার থেকেও বেশি বিশ্বাস করেন।

সকাল থেকেই মীরার মন অসম্ভব খারাপ ছিল। সেদিন আশিক ওকে পৌঁছে দেবার পর সারাদিন ঝিম মেরে পড়েছিল। ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়েছিল প্রায় পুরো দিন। মোবাইলে চার্জ দিতেও মনে ছিল না। রাতে মোবাইলে চার্জ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল আবার। পরীক্ষার আর মাত্র কয়েক মাস বাকি, তাই ক্লাস মিস না করে পরদিন চলে গেল ক্যাম্পাসে। ক্লাসে ঢোকার পর থেকেই বুঝতে পারছিল কিছু একটা যেন স্বাভাবিক নেই। পরবর্তীতে সেই অস্বাভাবিকত্ব ভয়ংকর রূপ ধারণ করল। ক্লাসমেট, সিনিয়র এমনকি জুনিয়ররা পর্যন্ত কথা শোনাতে ছাড়ল না। মীরার যখন প্রায় নাজেহাল অবস্থা, তখন টুম্পা ওকে হাত ধরে নিয়ে গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। গাড়ি চলতে শুরু করলে মীরা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। টুম্পা ওকে নিজের বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। অনেকটা সময় লেগেছে ওর স্বাভাবিক হতে। সবটা শুনে টুম্পা বলেছিল নিশ্চয়ই এতে কোন ঝামেলা আছে। বিকেল নাগাদ টুম্পা ওকে হলে পৌঁছে দেয়। মীরার খুব অসহায় লাগছিল। টুম্পাকে অনুরোধ করেছিল ওর গয়নার অর্ডারগুলো যেন পৌঁছে দেয়। ওর হাতে সব গয়নার সেটগুলো বুঝিয়েও দিয়েছে সেদিন। তারপর থেকেই খুব ইচ্ছা করছিল বাড়ি যেতে। পরদিন চাচার ফোনটা পেয়ে তাই খুব খুশি হয়েছিল ও। তবে বড় চাচার কণ্ঠস্বর শুনে কেমন একটু লাগলো মীরার। চাচা বিশেষ কিছু বলেননি শুধু বলেছেন যেন আজই চলে আসে।

মীরা বাস থেকে নামল দুপুর নাগাদ; তারপর রিক্সা নিয়ে যখন বাড়িতে পৌঁছল তখন বেলা তিনটার বেশি বাজে। বাড়ি ঢুকে কাউকে দেখতে পেল না। ওদের এই বাড়িটা দোতালা। একতলায় বৈঠকখানা, খাবার ঘর, রান্নাঘর নামাজের ঘর। উপর তলায় দুই পাশে শোবার ঘর। সাধারণত একপাশে মীরারা থাকত আর অন্য পাশে বড় চাচারা। মীরা রান্নাঘরে উঁকি দিল। মা ওকে দেখে ভীষণ খুশি হয়ে গেলেন। মায়ের খুশি দেখে মীরা একটু নিশ্চিন্ত হল। তার মানে সবকিছু ঠিকঠাকই আছে; কিন্তু যখন স্নান সেরে খেতে বসলো, খাবার আর ওর গলা দিয়ে নামলো না। হালিমা জানাল সৌরভের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এবং আজকে সন্ধ্যের পরেই বিয়ে পড়ানো হবে। মীরা জানতে চেয়েছিল কেন, হঠাৎ করে কি এমন হয়ে গেল। হালিমা জবাব দেননি, শুধু জানিয়েছেন এটা বড় চাচার সিদ্ধান্ত।
মীরা ঠিক করল বড়চাচার সঙ্গে কথা বলবে। কিন্তু আসরের পরেও বড় চাচা ফিরলেন না। বরং মীরাকে বলা হলো বাইরের কিছু লোকজন আসবে, ও যেন উপরের ঘরে চলে যায়। মীরার একবার মনে হল বড় চাচীর সঙ্গে কথা বললে হয়। মীরা গুটিগুটি পায়ে বড়চাচীর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ভেজানো দরজায় হাত রাখার আগেই টের পেল ভেতরে কথোপকথন চলছে। মীরা আশ্চর্য হয়ে গেল। সৌরভ ভাই ভিতরেই আছে। কি অদ্ভুত, এতক্ষন টের পায়নি যে সৌরভ ভাই বাড়িতে। মীরা সাহস করে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। বড় চাচী ওকে দেখে বাঁকা গলায় বললেন,
এই যে, এসে গেছে নবাবজাদি। নিজে নষ্টামি কইরা আসে, আর আমার ছেলের ঘাড়ে চাপে।
সৌরভ হালকা প্রতিবাদ করে বলল,
-আহ মা, থামতো। মীরা আয়।
মীরা একটু থমকালো, তবে এবার ও গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পারল। নিশ্চয়ই ওর সমস্ত খবর এখানেও চলে এসেছে। তাই বাড়ির মান সম্মান বাঁচাতে বড় চাচা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মীরা নির্বিকার গলায় বলল,
-সৌরভ ভাই তুমি পালিয়ে যাও। আমার জন্য নিজের জীবনটা নষ্ট করোনা।
-তুই এটা কি বলছিস মীরা? বাবার কি অবস্থা হবে একবার ভেবে দেখেছিস?
বড় চাচী খেকিয়ে উঠে বলল,
– কেন ভুল কি বলেছে? ওর নষ্টামির জন্য তুই কেন মাসুল দিতে যাবি? তুই তোর নিজেরটা বোঝ।
মীরা একটু ম্লান হাসলো। ও উপকার করার চেষ্টা করছে, অথচ বড় চাচি কথা শোনাতে ছাড়ছে না। মীরা বলল,
– এদিকটা আমি সামলে নেব। তুমি যাও আজকেই রত্নাকে বিয়ে করে ফেলো।

– আর তোর কি হবে?
– কিছুই হবে না। আমি এখানেই থাকবো। আমরা সবাই মিলে চাচাকে ম্যানেজ করে নেব। বড় চাচি আপনি ওর ব্যাগটা একটু গুছিয়ে দিন।
নাসিমা এক মুহূর্ত সময় নিলেন না। ঝটপট সৌরভকে একটা ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন। জামাকাপড়, কিছু টাকা-পয়সা, বিয়ের জন্য কেনা কয়েকটা নতুন শাড়ি সবই দিলেন ব্যাগে। তারপর ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– আমি তো থাকতে পারতেছি না। বিয়ের পর ছবি পাঠাইস।
সৌরভ পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে একবার বলে গেল,
-থ্যাঙ্ক ইউ মীরা।
নাসিমা ছেলেকে বিদায় দিয়ে ফিরে এসে আবার স্বরূপ ধারণ করলেন। খেকিয়ে উঠে বললেন,
-তুই এখানে সং এর মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? নিজের ঘরে যা।

মীরা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। প্রচন্ড মাথা ধরেছে। এক কাপ চা খেতে পারলে ভালো লাগতো। চায়ের সঙ্গে মুড়ি মাখানো। ঠিকমতো ভাত খেতে পারেনি তখন। খিদেটা আবার পেটের মধ্যে জানান দিচ্ছে। নিচে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কেউ বোধহয় এসেছে। দেখতে ইচ্ছা করছে না। মীরা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

চলবে……….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে