প্রিয়দর্শিনী পর্ব-২৬+২৭

0
995

#প্রিয়দর্শিনী🍂
#সুমাইয়া_যোহা

পর্ব-২৬

মাহিম পান্থর কেবিনে ঢুকতেই পান্থর চোখ কপালে উঠে গেছে। মাহিম ওর ভাইয়ের পাশে বসে চিন্তা মিশ্রিত কন্ঠে উদগ্রীব হয়ে বলে-

: এখন কেমন আছিস তুই? একটা বারেরর জন্যও কি আমাকে প্রয়োজন মনে করিস নি জানানোর সবকিছু?

: আরে ভাইয়া টেনশন কিউ লে রেহে হো। চিল মাই ব্রাদার। আই এম এবসোলুটলি ফাইন।

পান্থ অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো মাহিমকে বলল।

: এখন কেমন আছেন আপনি?

মেয়েলি কন্ঠে শুনে চমকে উঠে। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকাতেই মাহিমের পাশে তিথিকে লক্ষ্য করে। তিথি ঠোঁটে একটা ছোট স্নিগ্ধ হাসি মাখা মুখ করে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে। পান্থ মাহিমের দিকে ইশারা জানতে চিলে মাহিম ইশারায় পান্থকে তিথির ব্যাপারে আশ্বস্ত করে। পান্থ চোখে মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল। কারন তার ভাইয়ের যে অবশেষে ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছে। সে তো মহাখুশি।

: তারমানে ইউ আর মাই সুইট লাভলি ভাবি। ভাইয়াকে কেমন জব্দটাই না করলে। সেইজন্য আই লাভ ইউ ভাবি!

পান্থ নির্দ্ধিধায় কথাটা বললে মাহিম পান্থর দিকে চোখ বড় বড় তাকায়। তিথি মাহিমের চাহনি দেখে পান্থ আর তিথি দুজনই হেসে দেয়। মাহিম রেগে গাল ফুলাতেই পান্থ হাসি মাখা মুখ নিয়ে বলে-

: ডোন্ট ওরি ভাইয়া তোমার সম্পত্তি শুধুই তোমার। সেখানে ভাগ বসাবো না। তবে ভাবি যদি আমাকে ভাগ দিতে চায় তাহলে আমি মানা করবো না। কি বলো ভাবি! হা হা..

: ভাগ বসিয়ে তো দেখ। পাবনা পাঠিয়ে দিব।

: আচ্ছা বাবা। বসাবো না। মামনি আর বাবা জানে তোমরা এসেছো।

: হুম জানে। সেখান থেকেই এসেছি। যদিও তিথির সাথে এখনো দেখা করায় নি। এতো বছর ও ওর পরিবারের সাথে দেখা করেনি তাই ও ওর পরিবারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।

: আচ্ছা তরু আপু কোথায়?

: আপু অফিসের কাজে সিলেট গিয়েছে।

কেবিনে দরজা ঠেলে অন্তু প্রবেশ করতে করতে তিথি প্রশ্নের জবাব দিল। অন্তুর জবাব শুনে মাহিম রীতিমতো চমকে উঠে বলে-

: অফিসের কাজে? বাট আমি তো ডাকেনি। আর অফিসের কাজ হলে তো আমি জানতাম।

মাহিমের কথাগুলো পান্থর কান অবদি পৌঁছনোর পরই পান্থ দ্রুত ওর ফোনটা খুঁজতে বলে। মাহিম পান্থকে ফোন এগিয়ে দিতেই পান্থ প্রথমেই মেহুর নম্বর ফোন দেয়। মেহু প্রথমবারেই কলটা রিসিভ করতে পান্থ কিছু বলার আগেই মেহু বিপরীত পাশ থেকে চাপা কন্ঠে বলে উঠে-

: তরু সব জেনে গেছে পান্থ। ও আজকে সকালেই…

মেহু পান্থকে ফোনেই সমস্ত ঘটনা জানায়। পান্থ মেহুর সব কথা শুনে ফোনটা কেটে সাইড রেখে দেয়। পান্থ এইবার আর বেডে শুয়ে না থেকে বসে উঠতেই মাহিম হন্তদন্ত হয়ে কিছু বলার আগে পান্থ অকপটে বলে উঠে-

: ভাইয়া তুমি ফ্লাইটের টিকিট এর‍েঞ্জ করো। আগামী এক ঘন্টার মধ্যেই আমি ফ্লাইটের টিকিট বুক চাই। আর অন্তু তুমি ডক্টরের সাথে কথা বলে আজই আমার হসপিটাল থেকে রিলিজের ব্যাপারে কথা বলো।

: কিন্তু পান্থ তুই তো…

মাহিম ওর কথাটা শেষ করার আগেই পান্থ শান্ত মেজাজে বলে-

: আমি ঠিক আছি ভাইয়া। কাইন্ডলি আমি যা বলছি তুমি সেইটা করো। আর অন্তু এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে যেই কাজটা দিয়েছি সেইটা ফাস্ট করো!

শেষের কথাটুকু খুব জোরালো কন্ঠে পান্থ বললে আর কারোই সেখানে কোনোকিছু বলার সাহস রইলো না।

——————————————————

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে কিছুটা সময় বাকি। রাস্তার এক ধার ঘেষে হাটছি আর মেহু ভাবির বলা কথাগুলো ভাবছি। বাসার কারো সাথে দেখা না করে নীরবে বেরিয়ে আসাটা কতোটা উচিত হয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে এখন আমার মাথায় যে অন্যকিছু কাজ করছে। ফোনের শব্দ কান অবদি ভেসে আসতেই ব্যাগের ভেতর থেকে ফোনটা বের করলাম। ফোনটা সুইচ অফ করে পুনরায় ব্যাগের ভিতর পরে ফেললাম। আপাতত কারো সাথে কথা বলার ইচ্ছা শক্তিটুকুও যেন নিজের ভেতর সঞ্চয় করতে কষ্ট হচ্ছে। আজকে সিলেটের প্রকৃতিটা বেশ অদ্ভুত। কোথাও কোথাও ধূসর মেঘ দেখা যাচ্ছে। আবার পাহাড়গুলোর চারিপাশেও মেঘ আর সূয্যি মামার লুকোচুরি খেলা চলছে। কিছু কিছু স্থানে মানুষের এতোটাই আনাগোনা থাকে সেখানে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করা দুস্কর হয়ে পড়ে। আবার কিছু কিছু স্থানে এর বিপরীত তারতম্য ঘটে থাকতে দেখা যায়। সামনে চোখ পড়তেই খেয়াল করলাম অনেকগুলো স্কুল আর কলেজ ড্রেস পরিহিত ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে কুলফি মামার ছোট্ট দোকানটার সামনে ভিড় করছে। সবার হাতেই কুলফি। এর মাঝেই আবার লক্ষ্য করলাম মাঝ বয়সী কিছু মানুষও সেখান থেকে কুলফি কিনে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছেন আর কুলফির স্বাদ উপভোগ করছেন। পুরোনো কিছু স্মৃতি চোখের সামনে ভাসতেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। সামনে দিকে অগ্রসর হয়ে কুলফি মামার সেই ছোট্ট দোকানটার দিকে এগিয়ে গেলাম। উনি আমাকে দেখে বলেন-

: কি নেবেন মামা?

: একটা মালাই কুলফি দিবেন মামা?

: আরে কি যে কন না মামা! ক্যান দিমু না! এই লন কুলফি।

মামা আমার হাতে দুইটা কুলফি ধরিয়ে দিতেই আমি মামাকে একটা কুলফি ফেরত দিতে নিলে উনি অকপটে বলে উঠেন-

: আরে আরে মামা করতাছেন কি!!

: আমি তো একটা কুলফি চেয়েছি আপনি আমাকে দুটো কুলফি দিয়েছেন।

: হ মামা আমি জানি। মনে আছে একদিন আপ্নে কইছিলেন যে আপ্নে কুলফি খান না। সেদিন আপ্নার লগে একটা সাহেব আছিল উনি আমারে কইছিল যে আপ্নি যেদিন নিজ থেকে আমার থেইকা কুলফি লইবেন হেদিন যাতে আমি আপ্নেরে একটা কুলফি বেশি দেই। তাই একটা বেশি দিছি।

কুলফি মামার বলা কথাগুলো শুনে পান্থ আর আমার এই রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়ার দিনটির দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠে।

সূর্য যখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে এমন এক সময় পান্থ আর তরুনিমা একসাথে হেটে যাচ্ছিল। পান্থ তরুনিমাকে নানারকম কথার জ্বালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। পান্থ হুট করেই ওর কথা বন্ধ করে তরুনিমাকে ক্রস করে সামনে এগিয়ে কুলফিওয়ালার দোকানের দিকে ছুটে যাওয়াতে তরুনিমা বেশ অবাক হয়েছিল। পান্থ সেখান থেকে দুটো কুলফি নিয়ে তরুনিমার হাতে একটা দিতে নিলেই তরুনিমা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল-

: আমি কুলফি খাই না। এগুলো কোনো খাওয়ার জিনিস নয়। আপনার ইচ্ছে হয়েছে আপনি খান।

: আরে মামা খাইয়া দেখেন। অনেক ভালো কুলফি। একবার খাইলে বারবার খাইতে মন চাইবো।

: না মামা আপনি উনাকেই দিন। আমি খাব না। উনার খাওয়ার শখ হয়েছে উনিই খাক!

তরুনিমা কথাগুলো রূঢ় কন্ঠে বললে পান্থ তরুনিমাকে সেদিন কিছুই বলেনি। বিপরীতে শুধু একটা মৃদু হেসে কুলফিওয়ালাকে একটা কুলফি ফেরত দিয়ে তরুনিমার উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলেছিল-

: মামা এই বাড়তি টাকাটা আপনি রেখে দিন।

: ক্যান মামা? আপ্নে তো একটা কুলফি নিতাছেন।

: যেদিন উনি নিজে আপনার কাছ থেকে কুলফি কিনতে আসবেন সেদিন আপনি উনাকে আমার পক্ষ থেকে একটা কুলফি বেশি দিবেন। আর সেই কুলফির টাকাটাই আমি আপনাকে দিলাম।

পান্থ কুলফিওয়ালাকে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে সাবলীল ভাষায় তরুনিমার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে গিয়েছিল।

……….
তরুনিমা পান্থর সেদিনের কথাগুলো মনে পড়তেই কুলফির দিকে তাকিয়ে আনমনে হেসে উঠে। তবে হুট করে তার মনের এক কোণে একটা প্রশ্ন জেগে উঠে-

: সত্যিই কি নতুন করে আরেকটি বার আমার বিশ্বাস করা উচিত? নিজেকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয়া উচিত আমার? সবকিছু মেনে নিলাম। কিন্তু পান্থ কি আদৌ পুরোপুরি জানেন আমার অতীত সম্পর্কে?

#চলবে____

#প্রিয়দর্শিনী🍂
#সুমাইয়া_যোহা

পর্ব-২৭

শো শো গাড়ি চারদিকে ছুটে চলছে। সাদা প্রাইভেট কারটা এক সাইডে রেখে কিছুটা দূরত্বে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে তরুনিমা আর পান্থ। মাথার উপর সোডিয়াম লাইটটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে ওদের আলো দিচ্ছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। তরুনিমা কুলফিওয়ালা থেকে কুলফি নিয়ে সামনে দিকে অগ্রসর হতেই পান্থ ঝড়ের গতিতে এসে তরুনিমার সামনে গাড়ি থামালে তরুনিমা ভড়কে গিয়েছিল তখন। পরক্ষণেই পান্থকে দেখে তরুনিমার ভয়টা কমে গেলেও বেশ চমকে উঠল সে। কারন পান্থকে হুট করে এভাবে আবিষ্কার করবে সেটা তার ভাবনায় ছিল না।পান্থ সামনের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল-

: গাড়িতে উঠে বসো তরু। যেই প্রশ্নের উত্তর গুলো তুমি খুঁজে বেরাচ্ছো তার সব উত্তর আমার কাছে আছে। উঠে বসো।

তরুনিমা পান্থর দিকে তাকিয়ে থাকল। সে একটা কথাও বলতে পারল না। কুলফি হাতে নিয়েই গাড়িতে উঠে বসে। পান্থ গাড়ি ড্রাইভ করছে তরুনিমা কুলফি গুলোকে মুখেও দেয় নি। যেমন ভাবে ছিল তেমনই আছে। পান্থ তরুনিমার দিকে একবার তাকিয়ে কুলফিগুলোর দিকে একবার তাকালো। তরুনিমা চেহারাটা আজকে অত্যন্ত মলিন হয়ে থাকতে দেখে গাড়িটা এক সাইডে ব্রেক করে তরুনিমাকে শান্ত গলায় বলল-

: কুলফিগুলো গলে যাচ্ছে, খেয়ে নাও। বিপরীতে কোনো কথা নয় আজ। যা বলছি তাই করো।

তরুনিমা পান্থর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুনরায় কুলফি গুলোর দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসি ফুটিয়ে পান্থর দিকে একটা কুলফি এগিয়ে দিয়ে বলল-

: নিন। দুটো কুলফি একসাথে খাওয়া সম্ভব না। একটা খেতে খেতে আরেকটা গলে যাবে।

পান্থ গাড়ির সামনের গ্লাসগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে তরুনিমা হাত থেকে কুলফিটা নিয়ে কুলফিসহ গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে সামনে হেটে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইল।

……….
পান্থ দুই হাত ভাজ করে তরুনিমার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। তরুনিমা মাথা নামিয়ে চুপ করে আছে। চারিদিকে ঠান্ডা বাতাস বইছে। শীতের পূর্বাভাস যেন এই দমকা হাওয়াই জানান দিয়ে চলছে। পান্থ চোখ বন্ধ করে কন্ঠে গাম্ভীর্যতা এনে বলে-

: হুট করে সিলেট চলে আসার কারন কি?

: একই প্রশ্নটা যদি আমি আপনাকে করি। আপনার তো হসপিটাল থেকে আরো দুইদিন পর রিলিজ হবার কথা। আর আপনি এতোটাও সুস্থ হন নি যে সিলেট আসতে পারবেন!

তরুনিমা জোরালো কন্ঠে কথাগুলো পান্থকে বলার পরও যেন পান্থর কোনো হেলদোল নেই। সে আগে যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল এখনও সেভাবেই আছে। পান্থ এবার দৃঢ় কন্ঠে বলল-

: কোন সত্য জানার জন্য গতকাল হসপিটাল থেকে দ্রুতগতিতে বের হয়ে বিকালের ট্রেনে সিলেট চলে এসেছিলে? কি জানতে চাও তুমি আমি তোমাকে ভালোবাসি নাকি? তোমার জন্য এতোকিছু কেন করলাম? তোমাকে কিভাবে চিনি আমি? এগুলোই তো?

তরুনিমা অপলক দৃষ্টিতে পান্থর দিকে তাকিয়ে আছে। পান্থ যে ওকে এমনভাবে গড়গড় করে এগুলো বলবে সেটা ওর কল্পনার বাইরে ছিল। আজকে এই প্রথম পান্থকে এতোটা কাছ থেকে সে লক্ষ্য করছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের অধিকারী এই ব্যক্তিটিকে সোডিয়াম আলোয়ও এক অপূর্ব সুন্দর লাগছে। চোখের চশমাটা হাত রাখাতেই চোখগুলো ভীষণ মায়াবী আর চোখের কোটরগুলো চিকচিক করছে। হাত দিয়ে ধরলেই টুপ করে গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়বে এমন মনে হবে। চুলগুলোও খানিকটা এলোমেলো হয়ে আছে বাতাসে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলোও যেন এমন নিখুঁতভাবে বসানো হয়েছে যেটা তার সমস্ত সৌন্দর্য্যকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তরুনিমার সামনে থাকে দুই একটা চুল উড়ছে বাকি চুলগুলো সে খুবই সন্তপর্ণে বেনুণী করে রেখেছে। পান্থ তরুনিমার থেকে উল্টো দিকে ঘুরে শান্ত এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল-

: যেদিন বসন্তকে সবাই বরনের উৎসবে মেতে ছিল একটা মেয়েকে আমি দেখেছিলাম যে কিনা পাথরের ন্যায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে হয়েছিল। যার জন্য সে যত্ন সহকারে সেজে এসেছিল সেই মানুষটা তাকে ডাস্টবিনের আবর্জনার মতো একা ফেলে রেখে নিজের মতো হেটে চলে গিয়েছিল। মেয়েটার চোখগুলো এতোটাই অশ্রু সিক্ত ছিল যে যেন তার ভেতর থেকে কোনো কিছু বের করে নিয়ে গেছে কেউ। ভাবিনি যে সেদিন সেই মানুষটা মেয়েটাকে ভেঙেচুরে নিঃশেষ করে দিয়েছিল। দ্বিতীয়বার দেখেছিলাম তোমাকে আমার গাড়ির নিচে। সেদিন যতোটা সম্ভব তোমাকে বাচানোর চেষ্টা করেছিলাম।

তরুনিমা হতভম্ব হয়ে পান্থর কথাগুলো শুনছে। ওর সেদিনের বেচে যাওয়ার দৃশ্যটা কল্পনা করতেই অনেক কিছুই ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। পান্থ ওর দিকে তাকিয়ে দেখল ওর চোখে মুখে এখনো অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। পান্থ খানিকটা মৃদু হেসে পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে চোখে চশমা গুজে দিয়ে বলে-

: সেদিন তোমার ব্যাপারে জানার আগ্রহটা বড্ড বেড়ে গিয়েছিল। আর এতোদিনের পরিচয়ে এইটুকু তোমার বুঝে যাওয়া উচিত যে পান্থ শাহরিয়ার পক্ষে কোনো কিছু জানা এতোটাও কঠিন নয়। ওইদিন তুমি সেন্সলেস ছিলে এবং এতোটাই আহত ছিল যে তোমার সাথে কথা বলার সুযোগটা আমার ছিল না। যখন হসপিটালে গেলাম জানতে পারলাম তুমি নেই চলে গিয়েছো। সেদিন আমার ফ্লাইটও ছিল। সুতরাং তোমার সাথে দেখা করার সুযোগটা আমি মিস। আর বাকি ঘটনা তোমার মেহুরর থেকে জানা।

তরুনিমা কোনো কিছুরই জবার দিল না। শুধু মাথা নাড়ালো। পান্থ একটা ছোট শ্বাস ফেলে সোডিয়াম লাইটটার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার বলল-

: একটা বছর পর তোমাকে আমি মেহু আর মিনহাজের এনিভার্সারিতে দেখে বুঝেছিলাম যে তোমার বাইরের সব ক্ষতগুলো সেরে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু ভেতরে যেই ক্ষতগুলো ছিল সেগুলো সারিয়ে তোলার মতো কেউ ছিল না। তোমার সাথে সেদিন আমার প্রথম কথা। তোমাকে নিখুঁত ভাবে আরো জানার চেষ্টা করেছি। তুমি বাহ্যিক ভাবে নিজের সামনে এতোটাই শক্ত দেয়াল তৈরি করে রেখেছিলে সে শক্ত দেয়ালটা আমি ভাঙতে চেয়েছিলাম। কিছুটা হলেও আমি পেরেছি। কিন্তু…

: কিন্তু?

পান্থর তরুনিমার দিকে দুই কদম এগিয়ে এসে কানের কাছে নিজের মুখশ্রী এগিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে বলে-

: নিজের অস্তিত্ব তোমাকেই টিকিয়ে রাখতে হবে। আর তোমাকে আবার সেই আগের তরুনিমা হতে হবে। কারন সেটাই তুমি।

পান্থর শেষে কথাগুলো শুনে তরুনিমা নিজের চোখ দুটো বন্ধ করতেই গাল বেয়ে চোখের জলগুলো গড়িয়ে পড়তেই পান্থ সেই চোখের জলগুলোকে নিজের হাতের তালুতে আবদ্ধ করে নিল। অতঃপর সেগুলোকে তরুনিমার সামনে হাত উচিয়ে চোখের জলগুলোর দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে বলে-

: এটাই হবে তোমার শেষ অশ্রু তরু।

তরুনিমা ওর নিজের চোখ মেলতেই দেখে পান্থ ওর সামনে হাটু ভেঙে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে এবার ওর সেই স্নিগ্ধ মায়াবী হাসি ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে বলে-

: তুমি জানতে চেয়েছিলে ভালোবাসি নাকি? হ্যাঁ ভালোবাসি আমি তোমায়। আমার প্রিয়দর্শিনীকে আমি অনেক ভালোবাসি। সেই অধিকারটুকু থেকেই বলছি তুমি কি হবে আমার প্রেয়সী, আমার প্রিয়দর্শিনী?

: আমার সময় লাগবে পান্থ। দেখুন নতুন করে হারানোর কিছুই নেই আমার। তাই হারানোর ভয় আমার নেই। তবে আপনি যা ভেবে আছেন এবং যা বলছেন তার জন্য আমি প্রস্তুত নই। আপনি আমার অতীত সবকিছুই জানেন। আপনি আমাকে নিজের প্রিয়দর্শিনী বলে বারবার অভিহিত করছেন ঠিকই কিন্তু এমনও তো হতে পারে আমি আপনার না হয়ে অন্যকারোও হলাম। তখন…

পান্থ তরুনিমার কথাগুলো হজম হলো না। পান্থর রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। সে তরুনিমার এবার পুরোপুরিভাবে সন্নিকটে এসে তরুনিমার হাতে মুঠোয় নিজের হাত রেখে ঝুকে দাঁতে দাঁত চেপে বলল-

: তুমি সেই রমনী যাকে প্রথম দর্শনেই নিজের #প্রিয়দর্শিনী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি। আর সেই রমনীকে অন্যকারো কাছে সপে দেয়ার মতো এতো দয়ালু আমি নই। নিঃস্বার্থ ভাবে সবকিছু বিলিয়ে দিব এতোটা ভালো আমি নই। আমার যা তা আমারই!

পান্থর প্রতিটা নিঃশ্বাস তরুনিমার মুখে গিয়ে বারি খাচ্ছে। সে পান্থর কথাগুলো শুনে ওর দিকে ছলছল করে তাকিয়ে আছে।

: এখন গাড়িতে গিয়ে বসো! আমাকে যতোটা শান্তশিষ্ট ভাবছো আমি কিন্তু প্রয়োজন হলে তার চেয়ে বেশি হিংস্র হতে পারবো। বিয়ে তো তুমি আমাকেই করবে মিস টুকটুকি। কারন আমার প্রিয়দর্শনীর উপর শুধু আমারই অধিকার থাকবে। অন্যকারো প্রিয়দর্শিনী হতে আমি কখনোই দিব না। কখনোই না!

তরুনিমা আর কিছুই বলতে পারল না। সে যেন আর কোনো কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। হতভম্ব হয়ে পান্থর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর কথাগুলোর মাঝে তরুনিমা অন্যরকম এক আবদ্ধতা অনুভব করে। যে আবদ্ধতা তাকে শেষ করবে না। তাকে প্রাণ খুলে বাঁচার স্বপ্ন দেখাবে।

#চলবে____

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে