পিয়ানোর সুর পর্ব-১৪

0
340

পিয়ানোর সুর
#১৪পর্ব

ভোর পৌনে পাঁচটা। মেইন ডোর নক করার আওয়াজে লিভিং রুমের এক কর্ণারে পেতে রাখা ইজি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে এগুচ্ছি। জানি দরজার ওপাশে কে। কলিংবেল বাজাবে না। সে জানে সারা পৃথিবী ঘুমিয়ে যেতে পারে কিন্তু তার বাবা সে ফিরে না আসা পর্যন্ত বেডে যাবে না। দরজা খুলে সৌরভকে দেখছি। সারা চোখেমুখে কী এক অলৌকিক খুশীর দ্যুতি ছড়িয়ে হাসছে আমার ছেলেটা। মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। এভাবে চাইনি সৌরভ মিথির সাথে মিলুক। দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম। সৌরভ দু’পা এগিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো চোখে চোখ রেখে। ওর জ্বলজ্বলে পার্পল আইবল দুটো চিকচিক করছে সব পেয়ে যাওয়ার আনন্দে। সেখানে কোনো অপরাধবোধের চিহ্ন নেই।

— ড্যাড মুখ ছাই করে রেখো না। তোমাকে ভিলেইন লাগছে।

— তুই ছাই কাকে বলে জানিস?

— হ্যাঁ জানি। মিথি বলেছে।

— কী বলেছে?

— বলল, গ্রামে ওরা কাঠের টুকরো দিয়ে মাটির চুলোতে রান্না করে। কাঠ সবটুকু পুড়ে ছাই হয়, কয়লা হয়। ছাইয়ের রঙ গ্রে কালার হয়। বাংলায় ফ্যাকাসে বলে। এইমুহূর্তে তোমার সুদর্শন চেহারা ফ্যাকাসে লাগছে। ডোন্ট অরি ড্যাড রিল্যাক্স। সারারাত ছাদে ছুটোছুটি করেছি আমরা। গল্প করেছি। অল্প একটু চুমু খেয়েছি। এরবেশি হয়নি। তোমাকে গ্র‍্যান্ড’পা বানাতে কিছু করিনি। ইজিলি ওল্ড ম্যান হচ্ছ না তুমি।

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়েনি। মনে হল, দ্রুত বেগে ছুটে আসা টর্নেডো আমার পায়ের সামনে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। একটান দিয়ে সৌরভকে বুকে টেনে নিলাম। গর্বে, আনন্দে বুক ফেটে যাচ্ছে। মিথি ঠিক আছে, আমার সৌরভ তার ভাবিবধূকে ধুলোমলিন করে দেয়নি। এ যে কত বড় পাওয়া বোঝাতে পারব না।

— ব্রেভ মাই সান! আই’ম প্রাউড অভ ইউ! ওহ বয় তুই নিজেও জানিস না কী শান্তি দিয়েছিস আমায়।

— ড্যাড মিথি লাগবে। ঘুম হবে না মিথি ছাড়া।

কথাটা বলে আমাকে ছেড়ে একমুহূর্ত দেরি না করে সৌরভ চোখ মুছতে মুছতে ওর রুমের দিকে চলে গেল নাকি পালালো বুঝে ওঠার আগেই সে গায়েব পেছনে আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়ে। তিনদিন পর লিয়ানা আসবে। আমাদের বিয়ে সেইদিন। সৌরভকে কাঁদিয়ে ওর বাবা হিসেবে আমার পক্ষে কিছুতে সম্ভব হবে না লিয়ানাকে বিয়ে করা। ভাবতে গিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল আমার। অনেক কঠোর হতে হবে আমাকে। সামলাতে হবে লিয়ানাকে, নিজেকে।

— মিথি এত ভোরে তুই ছাদে কী করছিস!

সৌরভ ছাদ টপকে ওদের বাসায় চলে যাবার পর আমার আর রুমে ফিরতে ইচ্ছে হয়নি। সারাটা রাত ছাদে কাটিয়েছি দু’জন। ফ্যানের বাতাসে কাপড় শুকোলে একবার শুধু ছোট মামার চিলেকোঠায় ঢুকেছিলাম চেঞ্জ করতে। বাকি রাতটুকু ছাদে কেটেছে আমাদের। ঘনিষ্ঠ আদরের একপর্যায়ে থেমেছিল সৌরভ। বলেছিল, “বাঙালী ট্রাডিশনাল লাল বেনারশীতে তোমাকে জড়িয়ে পুরোটা ভালোবাসবো মিথি। আজ এইটুকু থাক! তুমি রাগ করবে?”

লজ্জায় মিশে গিয়েছি সৌরভের এমন আদুরে আবদারে। সৌরভের অজানা অচেনা আদুরে স্পর্শে কখন যে শিথিল হয়ে এসেছিল শরীর বুঝিনি। যখন ও থেমে থেমে খুব ধীর অথচ জড়ানো কন্ঠে আমার গ্রীবায় ঠোঁট ছুঁয়ে কথাগুলো বলছিল, আমি পারি তো তখুনি ছাদ দিয়ে লাফ দিই লজ্জায়। নীরবে কাঁদতে শুরু করেছি আফসোসে। আরেকটু হলে চরম সর্বনাশ হয়ে যেত। নিজেকে মনেমনে অভিসম্পাত করছি, একাজ আমার দ্বারা কীভাবে সম্ভব হলো ছিঃ মিথি! ওহ আমি বেঁচে আছি কেন?

সৌরভের ঘনিষ্ঠ বাহুডোর থেকে আচমকাই দূরত্ব নিয়ে বসতেই সৌরভ অবাক হয়ে চেয়ে ছিল। লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে ছাদের ফ্লোরে নজর নামিয়ে অস্ফুটস্বরে কোনোমতে বললাম,

— সরি সৌর!

কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে সৌরভ বলল,
— তুমি কষ্ট পেয়েছ? আই’ম সরি বেইবি…

এরপরের ব্যাপারগুলো স্বপ্নময় করে দিয়েছিল সৌরভ। বাঙালী আবহে বড় হলে সে বুঝে ফেলত আমার মানসিক হাল। সৌরভ সবকিছু সোজা বোঝে। এঁকেবেঁকে কথা একদম বোঝে না। শেষে লজ্জার মাথামুণ্ডু খেয়ে নিজেই ওকে বুঝিয়ে বলেছিলাম কষ্ট নয়, লজ্জা পেয়েছি বেহায়ার মত নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে।

আমার স্বপ্ন পুরুষ হাসতে হাসতে খুব নির্লজ্জভাবে কনফেস করলো সে নিজেও কতটা বেহায়া হয়েছিল আমায় কাছে পেয়ে। কষ্ট হচ্ছে তার নিজেকে দমন করতে। শুনে আরেক দফা লজ্জায় মরে শেষ আমি। তবে দু’জনেই এই মিঠা মিঠা আদুরে যন্ত্রণার কষ্টটুকু ভাগাভাগি করেছি নানান রঙের উষ্ণ দুষ্টুমিতে।
সৌরভ চলে যাওয়ার পরও সেই উষ্ণতায় বিভোর হয়ে ছিলাম কতক্ষণ জানি না।
হঠাতই পেছন থেকে অল্প চেনা গুরুগম্ভীর জলদ কন্ঠস্বর শুনে ভূত দেখার মত চমকে তকিয়ে দেখি শোয়েব হায়দার। আমার মেজো মামার ছেলে।

তাকে তার প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলতে যাবো, শুনি পাশের বাড়ীর তিনতলা থেকে ভেসে আসছে পিয়ানোর সুর। সৌরভ এই ভোরে পিয়ানো নিয়ে বসেছে! বুক মুচড়ে উঠলো। ছেলেটা নিশ্চয়ই ভীষণ মিস করছে। পিয়ানোর সুর দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে তার অনুভূতিগুলো।

এটি সেই গানের সুর যা আমি ওকে গল্পচ্ছলে গেয়ে শুনিয়েছিলাম দোলনায় পাশাপাশি বসে। সৌরভ খুব মনমরা হয়ে আনমনে বিড়বিড় করছিল। আমি তা শুনে ফেললেও ধরা দিইনি। আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে সে বলছিল,

— তুমিহীন ঘুম সে বড় অশান্তির মিথি! তুমি বুঝবে না, জানবে না কোনোদিন।

শুনে আমার চোখদুটো পানিতে টইটম্বুর। একে অন্যকে এখন থেকেই মিস করা শুরু করেছি গোপনে। ধরা দিলেই কষ্ট বাড়বে। সৌরভের গালে হাত দিয়ে দুষ্টুমি করে বললাম,

— মনেমনে কী কথা হয় শুনি?

— তুমি শুনবে?

— হুউউম শুনব তো! পিয়ানোতে গেয়ে শোনালে শুনব।

— চিলেকোঠার ছাদে শুধু তুমি আমি। পিয়ানো কোথায় পাবো মিথি!

— সৌরের ভয়েস টোন পিয়ানো হয়ে বাজে মিথির কর্ণকুহরে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমায় একহাতে কাছে টেনে নিয়ে গাল টিপে সৌরভ বলল,

— আজ তুমি গাও মিথি আমি শুনি। আড়ালে কেন গাও? আমার একাকী শুনতে ভীষণ কষ্ট হয়।

অবাক চোখে চেয়ে আছি সৌরভের মুখের দিকে। কী শান্ত মুখশ্রী। তারচেয়ে শান্ত ওর অভিব্যক্তি, কথা বলার ধরণ। অকপটে বলে দিল কষ্টটুকু। এখুনি কিছুটা প্রশান্তি না দিই যদি ভেঙে পড়বে সে। আলতো হাতে ওকে জড়িয়ে ওর শক্ত চোয়ালে আমার চিবুক ঠেকিয়ে বিষন্ন কন্ঠে গাইছি,

“তুমি আকাশ হয়ে যাও

আমি থাকি পাহারা

তুমি ঘুম হয়ে দু’চোখে দেখা

স্বপ্ন রাতের তারা…”

গান গাওয়ার মাঝেই সৌরভ আমার কোলে মাথা রেখে চোখবুঁজে নিয়েছিল আমার হাতের পাতা দুটি ওর বুকের মাঝখানে শক্তভাবে চেপে ধরে।

— কী ব্যাপার জমে গিয়েছিস কেন আশ্চর্য! কিছু জিজ্ঞেস করেছি কানে যায়নি? মিথি!!

শোয়েব ভাইয়ার ধমক খেয়ে সৌরভকে নিয়ে ভাবতে থাকা আমার ভাবনার জগত ভেঙে চৌচির। এমনিতেই আমার এই কলেজ শিক্ষক কাজিন ব্রাদারকে দেখলে আমি লুকিয়ে যাই। বেশ দাম্ভিক আর গুরুগম্ভীর জলদ কন্ঠস্বর মেইন কারণ। শুনলেই মনেহয় এইবুঝি মারতে তেড়ে আসলো। আদৌতে ও তা নয়। দীর্ঘ একটা সময় বাইরে পড়াশোনা করা মানুষ সে। যথেষ্ট অমায়িক এবং ঋজু আচরণ সবার সাথে। সমস্যা সম্ভবত আমার বেলায়। অন্যদের যেমন হয়। গ্রাম থেকে উঠে আসা কাজিন আমি ওদের। মানিয়ে চলার সুযোগ, যোগ্যতা কোনোটাই আমার নেই। সবার ব্যবহারে দূর দূর একটা ভাব থাকে। শোয়েব ভাইয়ারও তাই। আমাকে দেখলেই গম্ভীর হয়ে ওঠেন। অবশ্য আমি নিজেও ওনাকে এড়িয়ে চলি, পালাই পালাই করি। কী করব, এদের কাউকে আমি তেমন করে চিনি না যেমন করে চিনলে কাজিনদের মাঝে ভাব হয়। নানুবাড়ী সবসময় কালেভদ্রে আসা হত। শোয়েব ভাইয়াকে এবারই প্রথম ভালোমতো দেখেছি। উনি অবশ্য আমাকে কয়েকবার দেখেছেন আমার শৈশবে। কিন্তু আমার জন্য তা মনে রাখার মত কোনো স্মৃতি ছিল না। খেলাচ্ছলে দেখে থাকব। মনে নেই বিন্দুমাত্র।

বোবাবনে আছি দেখে ভাইয়া এবার রাগান্বিত হলেন। ওর চেহারার রঙ পাল্টে গিয়ে মেজাজি রূপ ধারণ করার আগেই ছোট মামার চিলেকোঠা লক্ষ্য করে আমি পড়িমরি করে ছুট লাগালাম।
ভোর সাড়ে পাঁচটা বাজে। কে আসবে এই নির্জন চিলেকোঠার ছাদে আমাকে বাঁচাতে। সৌরভ এখনো পিয়ানোতে নিমগ্ন।

শোয়েব ভাইয়া দুই কদমেই এসে খপ করে ছুটন্ত আমার হাত ধরে টেনে ওনার সামনে দাঁড় করলেন। আমার স্পর্ধা দেখে ভয়ংকর শক্তিশালী মানুষটা হতভম্ব হয়ে পলকহীন চেয়ে আছেন। এদিকে তির তির বিরতিহীন কাঁপছে আমার হাত পা। শ্বাস ফেলার জায়গা পাচ্ছি না। ভয়ে দম আটকে আসছে।
কন্ঠ চিড়ে মুখ ফসকে উচ্চারিত হলো একটি নাম,

— সৌর!

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে