পিয়ানোর সুর পর্ব-০৩

0
367

পিয়ানোর সুর
#৩য়পর্ব

আশ্চর্য এক অনুভূতি থেকে থেকে নাড়া দিচ্ছে আমার ভেতরে। আমার ভেতরে টিনাকে হারানোর শোক উপচে পড়ার কথা। সেটা হচ্ছে না। একেবারেই যে না তা নয়। হচ্ছে তবে তা খুব ক্ষীণ। টিনা ওর নিউ লাইফ পার্টনারের সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের একগাদা পিকচার হোয়াটসঅ্যাপ করেছে। কয়েকটি দেখার পর বাকিগুলো দেখার রুচি হয়নি। দুই মাসের এ্যাফেয়ারে তেরো বছরের রিলেশনশীপ কীভাবে ভুলে যাওয়া যায়! বাবা সব জানেন। আমাকে বেশ ট্যাক্টফুলি হ্যান্ডেল করছেন তিনি। বোঝাচ্ছেন, আমার মাকে ছাড়া কীভাবে ত্রিশটা বছর পার করেছেন তবু নতুন করে সম্পর্কে জড়াননি। মা কিন্তু থেমে নেই। তিনি বহুদূর এগিয়েছেন। দীর্ঘ ত্রিশ বছরে মাত্র তিন বৎসর বাবার স্মৃতি নিয়ে পরে থেকেছেন। তারপর আবার নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছেন, বিয়ে করেছেন। সে সংসার টিকেছিল লং টাইম প্রায় সতেরো বছর। তারপর ভেঙে গিয়েছে। মায়ের দু দুটো সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছে তার হাজব্যান্ডদের বন্ধুদের কারণে। মা খুব সুন্দরী ছিলেন। স্বামীর বন্ধুদের মাত্রাতিরিক্ত এটেনশন তাঁর দুই স্বামীর কেউ মেনে নিতে পারেনি। আমার বাবার সাথে মায়ের সংসার টিকেছিল মাত্র চারবছর। তুখোড় প্রেমের বিয়ে। প্রেমের বয়স ছিল মাত্র পনেরো দিনের। বাবাই বিয়েতে দেরি করতে চাননি। মা লিভ ইন রিলেশনশীপ চেয়েছিল। বাবা বাংলাদেশী ঘরানার হওয়ায় মন মানসিকতার দিক দিয়ে বেশ রক্ষণশীলতার গোঁড়ামিপূর্ণ মানুষ ছিলেন। এটাও একটি বিগ ইস্যু ওনাদের ম্যারেজ লাইফ বেশিদিন টেকেনি। বাবা মাকে ঘরোয়া বানাতে চেয়েছিলেন। মা ছিলেন বহির্মুখী, চূড়ান্ত স্বাধীনচেতা ও মুক্তমনা। খ্রিস্টান ধর্মই ঠিক করে পালন করতেন না সেখানে মুসলিম ধর্ম তারজন্য গলায় ফাঁস দেয়ার শামিল। ফলাফল বিচ্ছেদ অনিবার্য। মা ফিরে যান তাঁর আগের ধর্মে। যদিও সেটা ঠিক করে পালন করেননি কোনোকালেই। দ্বিতীয় বিয়েটা একজন জার্মান নাগরিককে করেন। মায়ের কপাল খারাপ। সে বেচারাও ঘরোয়া রমণী বানাতে চেয়েছিলেন মাকে। চেষ্টা করেছেন সতেরোটা বৎসর। শেষে টক্সিট ম্যারেটিয়াল লাইফ থেকে বাঁচতে এক্সট্রা ম্যারেটিয়াল এ্যাফেয়ারে জড়িয়ে পড়েন মায়ের দ্বিতীয় স্বামী। মা অবশ্য তার আগেই জড়িয়েছিলেন। দ্বিতীয় বাবার বন্ধুর সাথে। উভয় পক্ষের জানাজানিতে ভয়ংকর ইস্যু হয়। কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। ভাঙনের রোলার আগেই চলছিল। ভেঙে গুড়িয়ে তবেই থেমেছে। সতেরো বছরে আরও পাঁচ সন্তানের মা হয়েছিলেন আমার মা। জার্মান নাগরিক বাবা তার সেই পাঁচ বাচ্চাকে নিয়েই ইংল্যান্ড থেকে পাড়ি জমান জার্মানিতে। মায়ের সাথে চিরতরে সম্পর্ক ছিন্ন করিয়েছেন ওনার পাঁচ সন্তানদের। মা অবশ্য চাইলে পারতেন সন্তানদের অধিকার নিয়ে লড়তে। উনি সেটা করেননি কী কারণে আজও তা বিরাট রহস্য। কেননা, আমাকে পেতে মা আমার বাবার সাথে কোর্টে ফাইট করেছিলেন। আইনের চূড়ান্ত রায় মায়ের পক্ষে যায়। যারফলে, আমাকে আজন্মের মত বাবাহীন করেছিলেন আমারই মা। এতকিছু জানতে খুব একটা বড় হতে হয়নি আমাকে। ব্রিটিশ সোসাইটিতে বাবা মায়ের ডিভোর্স হলে বাচ্চারা সবার আগে জানে তাদের বাবা মায়ের অতীত ইতিহাস। স্বজনদের মুখেমুখে ফেরে এসব গল্প। ফলে খুব ছোটবেলা থেকেই কোনঠাসা এক জীবন নিয়ে বড় হয়েছি আমি। ছেলে বলেই হয়তো সামলে উঠতে পেরেছি। ততটা পারিনি যতটা হওয়ার কথা ছিল। স্কুল লাইফ এককথায় নরক ছিল আমার জন্য। ইউনি লাইফ সেই নরক থেকে কিছুটা রিলিফ দেয়। স্কুল জীবনে আমার দ্বিতীয় বাবা মানসিক সাপোর্ট দিতেন আমায়। এসব ব্যাপারে মা ছিলেন চরম উদাসীন। মানুষ হিসেবে আমার স্টেপ ফাদার অমায়িক মানুষ ছিলেন। তিনি খুব কাছথেকে বুঝতেন আমার কষ্টগুলো। সেজন্যই কিনা জানি না নিজের ঔরসজাত সন্তানদের বেলায় আমার মত জীবন হোক চাননি। উনি ওনার সন্তানদের পাশাপাশি আমার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। ইচ্ছে হলে যেতে পারতাম। মায়ের জন্য অত টান কখনো ফিল করিনি। কিন্তু কেন জানি ওনাদের ডিভোর্সের রায়ের দিন মায়ের প্রতি মায়া হলো খুব। এত অসহায় আর নির্জীব লাগছিল সেদিন মাকে যেদিন তার দ্বিতীয় বারের মত ডিভোর্স হলো। মায়ের হাত ধরে কোর্ট প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্টেপ ফাদারকে আমার ভাইবোনদের নিয়ে চলে যেতে দেখেছি। মা সেদিন ঘরে ফিরে জানতে চেয়েছিলেন,

“তুমিও কী তোমার বাবার কাছে ফিরে যেতে চাও সালমান? গেলে যেতে পারো। বাঁধা দেবো না।”

ও হ্যাঁ, আমার পুরো নাম সালমান আশরাফি সৌরভ। বাবার দেয়া নাম। বাবা নিক নেইম সৌরভ নাকি শুধুমাত্র মায়ের জন্য রেখেছিলেন। মায়ের শরীরের ঘ্রাণ নাকি বাবার খুব প্রিয় ছিল। সেজন্য এ নাম। মা আমাকে সালমান বলেই ডাকে। যাহোক, সেদিন কোনো উত্তর দিইনি, ছেড়েও যাইনি সংসার জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া অসহায় এক নারীকে। আজীবন অস্বাভাবিক রূপ ছিল যাঁর প্রধান এবং একমাত্র শত্রু। যিনি সম্পর্কে আমার গর্ভধারিণী মা হন। আমি তাঁকে তাঁর রূপহীন, জৌলুশহীন জীবনে একলা ছেড়ে দিতে পারিনি। মাত্র বাইশ বছর বয়সে শক্তহাতে মায়ের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। যদিও তার দরকার ছিল না। দুই বাবার তরফ থেকেই উনি অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। আমার নানা নানিরাও মাকে নিজেদের সম্পত্তির ভাগ দিয়েছিলেন। আর্থিকভাবে কোনো অভাব ছিল না মায়ের।
যে অভাবে আমি ভুগতাম সেই একই অভাবে মা ভুগতে শুরু করলো দ্বিতীয় বার ডিভোর্সের পর। আমাদের কমন অভাবের নাম ছিল – ভালোবাসা। যা আমি জন্ম থেকে না পেয়ে আসছি। আর মা বার্ধক্য শুরু হবার বেশ আগেই এসে সেই অভাবে পড়লেন। মা বুঝতে পেরেছিলেন আমার অভিমান।

হুট করে একদিন মায়ের জীবনটা বদলে গেল। মা হয়ে উঠলেন আমার সত্যিকারের গর্ভধারিণী মা। মায়ের এই পরিবর্তন আমাকেও আমূল পরিবর্তন করে দিতে লাগলো। একজন ব্রিটিশ নাগরিক থেকে ধীরে ধীরে একজন বাঙালী যুবকে পরিণত হতে শুরু করলাম। মা শুরু করলেন আমার জন্মদাতা পিতার সাথে ওনার প্রেমময় চারটি বছরের গল্প। বাংলাদেশের গল্প।
জানলাম, আমার একটি হিড্যান (Hidden) ফ্যামিলি আছে পৃথিবীর মানচিত্রের কোনো এক ছোট্ট বিন্দুতে। যে দেশ ও ফ্যামিলি আমার পূর্বপুরুষদের পরিচয় বহন করে। নামহীন, জাতপাতহীন আমি যেন আচমকাই এক বিশাল সম্রাজ্যের মুকুটহীন রাজপুত্র হয়ে উঠতে শুরু করলাম খুব গোপনে, অগোচরে।

মা তৈরি করছিলেন আমাকে। যোগ্য করছিলেন একজন চিরদুঃখী পিতার সন্তান হিসেবে। ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রকে প্লে গ্রুপের বাচ্চাদের মত হাতে ধরে এনে ভর্তি করিয়ে দিলেন ইংল্যান্ডের এক বাঙালী পাড়ায় বাংলা ভাষা শেখার ও রপ্ত করার স্কুলে। পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার জন্মগত প্রকৃত ধর্মের সাথে। অনলাইনে একজন স্বনামধন্য ইসলামিক স্কলারকে রিকোয়েস্ট করলেন আমাকে আমার ধর্মের সাথে পরিচয় করিয়ে ক্বুরআনিক আরবী শিক্ষা দিতে। একইসাথে মা আমার ওপর ছেড়ে দিলেন ধর্ম চয়েসের সম্পূর্ণ দায়ভার।

বাবার প্রতি আমার গোপনে নিবিড় ভালোবাসা আমাকে ক্রমেই আগ্রহী করে তুললো বাঙালী জীবন সম্পর্কে এবং আমার জন্মগত নিজেস্ব ধর্ম সম্পর্কে। প্রাথমিকভাবে আমি কিছুই বলিনি।

শুধু শিখছিলাম আর একটু একটু করে নিজের ভেতরে ধারণ করছিলাম কল্পপুরীর কোনো এক অচিন দেশ – অদেখা, অজানা কৃষ্টি কালচার পূর্ণ বাঙালিয়ানা বাংলাদেশী সত্তাকে, কিংবা অস্তিত্ব।

চলবে…….
লিখাঃ মাহমুদা সুলতানা মবিন একা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে