নূপুর বাঁধা যেখানে পর্ব-২২+২৩

0
858

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-২২
#মিফতা_তিমু

ফোনের ওপারে পুরুষালি গলা অথচ জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান প্রায় ঝুমুর বুঝতে পারলো না ওটা ওর মামার গলা। ও ধরা গলায় বললো ‘ অমনি…. অমনি কোথায় তুমি ? অঙ্গনা ইজ মিসিং ইউ। নমু সারাংহেও(আমি তোমাকে ভালোবাসি অমনি) ‘
ফারুক একবার ফোন কান থেকে নামিয়ে ডিসপ্লে স্ক্রিনে চোখ বুলালো। দেখলো কলটা ঝুমুরের নাম্বার থেকেই এসেছে। কিন্তু ও মাকে ডাকছে কেন ? চমকিত ফারুক ফোন আবারও কানে ধরলো।

‘ অমনি… জানো আমি এখানে একদম একা। তুমি চলে যাওয়ার পর বাবা… বাবা আমাকে নিজের কাছে রাখেনি। পাঠিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশে, নানুর বাড়িতে। নানু, আপি, মামা, মামী সবাই এখানে খুব ভালো। ওরা খুব ভালো অমনি। কিন্তু আমি… আমি তোমাকে ছাড়া একদম ভালো নেই। অমনি…. বোগো সিপআয়(আই মিস ইউ)। তোমাকে আমার খুব দরকার। এখানে আমি একদম একা অমনি, একদম একা। ‘

ঝুমুরের সিক্ত কণ্ঠে বলা একেকটা শব্দ ফারুকের ভিতরটা ভাঙচুর করলো। মনে পড়লো বোনটা তার দশ বছর হলো নিরুদ্দেশ। মা ভক্ত আদরের ভাগ্নিটা নিজের মায়ের অনুপস্থিতিতে আজ ভেঙে পড়েছে। তার আপনজনের শেষ নেই, শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকে। কিন্তু আদৌ কি তারা কাছের মানুষ ? হলে কি আজ এই অসুস্থ মেয়েটা মাকে ফোন করে এভাবে কথা বলতো ? ঝুমুর ভাবছে ও ওর অমনির সাথে কথা বলছে কিন্তু আসলে সে তার মামার সঙ্গে কথা বলছে।

ওপাশ থেকে আর কারোর কথা শোনা যাচ্ছে না। ঝুমুর সম্ভবত অজ্ঞান। তবে ওর জ্ঞান ফেরানো দরকার কিন্তু এখান থেকে বসে সেটা সম্ভব নয়। ফারুক জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলো সময় তখন গৌধুলির বিকেল। মনে পড়লো ফাহমানের আজ হাফ ডে ছিল। এতক্ষণে নিশ্চই বাড়ি ফিরেছে ও। ওকে বলা যায় ঝুমুরকে একটু চেকআপ করে দেখুক।

ফোন হাতে নিয়ে প্রথমেই ফারুক ফাহমানকে জানালো ঝুমুরের অসুস্থতার কথা। যদিও সে শিওর না কিন্তু মন বলছে ঝুমুরের প্রচন্ড জ্বর। ঝুমুরের জ্বরের কথা শুনে বাকরুদ্ধ ফাহমান। এই তো আজ সকালেও দেখলো মেয়েটা সম্পূর্ণ সুস্থ। তাহলে এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে কি এমন হয়ে গেলো যে একেবারে অজ্ঞান হবার অবস্থা। দ্রুত সে শরীরে টিশার্ট গলিয়ে বেরিয়ে পড়লো। বান্ধবীর অসুস্থতার কথা শুনে হৈমন্তীও অস্থির তাই ঔ ভাইয়ের পিছন পিছন গেলো। মারিয়াম তখন বেকারিতে।

ফারুকের ফোন মনোয়ারা বেগমও পেয়েছেন। ফারুক জানিয়েছে ঝুমুর জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে গেছে। কথাটা শোনা মাত্র মনোয়ারা বেগম ফোন ফেলে ঝুমুরের ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন। ঝুমুর তার অনেক আদরের। তার সব নাতি নাতনীদের মধ্যে ঝুমুরের প্রতি তার ভালোবাসা একটু বেশীই যেন। তাই ঝুমুরের কিছু হলে উনার কোনো হুশ জ্ঞান থাকে না।

ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল তাই ঝুমুরের ঘরের দরজা সকলে খোলাই পেলো। আঞ্জুম আরা ঝুমুরকে অচৈতন্য অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। ঝুমুর তার মেয়ের মতো। আসলে মেয়ের মত বললে ভুল হবে কারণ উনি তো ঝুমুরকে নিজের মেয়েই মনে করেন। ঝুমুর, শাওমি,অনামিকা ওরা তিনজনই উনার কাছে উনার মেয়ে। নিজের পেয়েও না পাওয়া মেয়ের আরেক রূপ তারা। সৃষ্টিকর্তা তাকে এক মেয়ের বদলে তিন মেয়ে দিয়েছেন।

তবে ঝুমুরের প্রতি উনার ভালবাসার প্রকাশভঙ্গি কিংবা ভালোবাসার ধরন, উভয়ই আলাদা। নিজের প্রথম সন্তানের প্রতি যেমন বাবা মায়ের আলাদা টান থাকে তেমনই ঝুমুরের প্রতিও তার টানটা অন্যরকম। শুধু তারই নয়, তার প্রবাসী স্বামী তানিম সাহেবেরও ঝুমুরের প্রতি আলাদা টান। আঞ্জুম আরার সঙ্গে প্রণয় সম্পর্ক চলাকালীন তানিম সাহেব ঝুমুরকে নিয়ে তিনবার দেখা করতে গিয়েছিলেন তার সাথে।

ঝুমুর মোতালেব সাহেব আর তাসনুবার সঙ্গে কোরিয়া,নিজের দেশেই থাকতো। কিন্তু ঝুমুরের দুই বছর হওয়ার পর নিয়মিত ছুটিতে প্রতি বছর অন্তত একবার করে বাংলাদেশে তাদের আসা হতো। সে সময়টাতে তাসনুবা বাংলাদেশে তার বাবার বাড়িতেই উঠতেন। বংশের পরবর্তী প্রজন্মের প্রথম বংশধর হিসেবে ঝুমুর ওর নানুর বাড়ি এবং দাদুর বাড়ির সকলের কাছেই অনেক আদরের ছিল।

বিশেষ করে তানিম সাহেব আর তানিয়া শাহজাহানের কাছে তার কদর ছিল অন্যরকম। ফারুক তখন একদম ছোট। ঝুমুরের থেকে সে বয়সে গুনে গুনে ছয় বছরের বড় ছিল তাই একমাত্র ভাগ্নি সম্পর্কীয় মেয়েটাকে ঈর্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার। ঝুমুরের যখন জন্ম তখন তানিম সাহেব খুবই কম বয়সী যুবক ছিলেন। তার চোখে তখন প্রেমের রঙিন চশমা। সেই সময় তিনি আঞ্জুম আরাকে দেখতে যেতেন ঝুমুরকে সঙ্গে করে। এর বদলে অবশ্য তিনি ঝুমুরকে আইসক্রীম খাইয়ে বলতেন তিনি যে আইস্ক্রিম খাইয়েছেন এই কথা যেন কাউকে না বলে।

ঝুমুর আবার ভীষন মা ভক্ত ছিল। সে তার অমনিকে সব কথাই বলতো। কাজেই তার মামা তাকে আইস্ক্রিম দিয়েছে আর সে সেটা অমনিকে জানাবে না তাতো হতেই পারে না। সে তার ছোট চুলের দুই ঝুঁটি দুলাতে দুলাতে আধো বাংলা আর আধো কোরিয়ান ভাষায় মামার বিরুদ্ধে নালিশ জানাতো যে মামা তাকে আইস্ক্রিম খাইয়েছে। তখন ওর প্রায় সাড়ে তিন বছর বয়স। তাই বাংলা ভাষা অতটা আয়ত্তে ছিল না।

তাসনুবা মেয়েকে ছোট ভাইয়ের আইস্ক্রিম খাওয়ানোর কথা জানতে পেরে উড়ন্ত জুতো ছুঁড়ে মেরেছিলেন। এমনিতেই ঝুমুরের ঠান্ডার ধাত আছে তার উপর আবার আইস্ক্রিম দিয়েছে ওকে। ওই হতচ্ছাড়াকে কি আর ছাড়া যায় ? জুতো হাতে তিনি ভাইয়ের পিছনে ছুটতেন মারার জন্য।
কিন্তু তারপরও বোনজির প্রতি তানিম সাহেবের ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। এমনকি এখনও নেই। এখনও যখন রোজ শুক্রবারে মনোয়ারা বেগমের কাছে ফোন করে সবার সঙ্গে কথা বলেন তখন ঝুমুরের সঙ্গে তার একারই কথা চলে এক ঘন্টা। সেই এক ঘণ্টায় ঝুমুর কেমন আছে, কি করছে, কেউ তাকে বকাবকি করে কিনা, তার কিছু লাগবে কিনা সব খবরই নেন।

তানিম সাহেব বিদেশে গেছেন প্রায় ছয় বছর। বিদেশে যাওয়ার এক বছরের মাথাতেই সকলে খবর পেয়েছিল তিনি আবারও বিয়ে করেছেন। এ নিয়ে বাড়িতে এক প্রস্থ ঝড় বয়ে গিয়েছিল। মনোয়ারা বেগম রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ছেলেকে যা নয় তাই বলে গালিগালাজ করেছিলেন। সেই সঙ্গে ছেলের দ্বিতীয় স্ত্রী অর্থাৎ তার নব বিবাহিতা বধূকেও অনেক কথা শুনিয়েছিলেন। উনার আবার মুখ খারাপ করার স্বভাব আছে।

কিন্তু মনোয়ারা বেগম এই মুখ পারতপক্ষে ঝুমুরের সামনে খারাপ করতে পারেন না। কারণ একটাই, এসব ঝুমুর নিতে পারে না, কান্নাকাটি করে সে। স্বামীর বিয়ের খবর পেয়ে আবেগী আঞ্জুম আরা কেঁদেকেটে অনেক অভিযোগ করেছিলেন, প্রশ্ন করেছিলেন তাদের এত বছরের প্রণয়, বিয়ে তবে এসবের কি হবে। কিন্তু তানিম সাহেব উত্তর দেননি। সেই তখন থেকে আজও তাদের সম্পর্ক শীতল। দুজনের আর কোনো মানবিক লেনদেন হয়নি।

মাঝে দ্বিতীয় স্ত্রী সামিয়া আর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান নিয়ে দুইবার দেশে এসেছিলেন তানিম সাহেব। কিন্তু নিজ বাড়িতে উঠতে পারেননি। একই এলাকায় নিজের কেনা ফ্ল্যাটে উঠেছিলেন। কারণ, মনোয়ারা বেগমের আঞ্জুম আরাকে মেনে নিতেই বহু বছর লেগেছে সেখানে ছেলের আরেক বিয়ে কি করে মেনে নেন। তাই ছেলেকে ঘরে জায়গা দেননি। তবে তানিম সাহেব প্রায় দিনই ঝুমুর, তাফিম, সামি ওদের দেখতে স্ত্রী সন্তান সমেত চলে আসতেন।

ঝুমুরকে অজ্ঞান দেখে একে একে পুরনো সব স্মৃতি আঞ্জুম আরার মানসপটে ভেসে উঠছিল। ঝুমুর আর তানিম সাহেবকে ঘিরে তার অনেক সুখের স্মৃতি। অথচ এখন সেসবই দুঃস্বপ্ন হয়ে রয়ে গেছে। তানিম সাহেব আছেন, ঝুমুর আছে এমনকি তিনি নিজেও আছেন। শুধু সম্পর্কের সমীকরণ বদলে গেছেন। এত বছরের প্রণয়, বিয়ের সম্পর্ক কেমন মুহূর্তেই বদলে গেছে। যেই ঝুমুরকে ঘিরে তাদের প্রেমের সূচনা হয়েছিল সেই ঝুমুর আজ বড় হয়েছে, মেয়াদ বেড়েছে তার আর তানিম সাহেবের সম্পর্কের, সন্তান হয়েছে তাদের কিন্তু সম্পর্কটা ভিতর দিয়ে মারা গেছে।

আঞ্জুম আরা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিলেন। ঝুমুরের প্রেসার মাপছে ফাহমান। প্রেসার একেবারে নেইই বলতে গেলে। চিন্তিত ফাহমান বললো ‘ ওর প্রেসার একেবারে লো। ব্যাপার কি ? আজ খাওয়া দাওয়া করেনি নাকি ? ‘

মনোয়ারা বেগমের মুখটা মুহূর্তেই অসহায় হয়ে উঠলো। তিনি বললেন ‘ ওর লেট হওয়ার কারণে আজ ব্রেকফাস্ট আমি রেডি করেছিলাম। পরোটা ভেজে দিয়েছিলাম। ঝুমুর এমনিতেই খেতে চায়না তার উপরে তেলে ভাজা পরোটা দেখে বোধ হয় রেগে গিয়েছিল। না খেয়ে বেরিয়ে গেছে। এরপর বিকালে যখন আসলো তখনও খেতে বললাম কিন্তু ভালো লাগছে না বলে না খেয়ে ঘরে চলে এসেছিল। ‘

ফাহমানের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ। উঠে দাড়ালো ও। বললো ‘ আপনারা ওর জন্য স্যুপের ব্যবস্থা করেন। আমি কাছের ফার্মেসি থেকে কিছু ওষুধ নিয়ে আসছি। ‘
কথাগুলো বলে ফাহমান বেরিয়ে গেলো আর আঞ্জুম আরা ছুটলেন ঝুমুরের জন্য খাবার তৈরি করতে। ঝুমুরের দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। মুখটা সারাদিন অনাহারে থাকায় একবারে শুকিয়ে গেছে।

ফাহমান ওষুধ নিয়ে ফিরে এসেছে। আঞ্জুম আরার হাতে সে গ্লুকোজ ধরিয়ে দিয়ে বলল পানিতে গুলিয়ে ঝুমুরের মুখে অল্প অল্প করে চামচ দিয়ে ঢেলে জ্ঞান যেন ফেরানো হয়। আঞ্জুম আরা গ্লুকোজ নিয়ে কিচেনের দিকে গেলেন। দ্রুত গ্লুকোজ গুলিয়ে ছুটলেন ঝুমুরের ঘরের দিকে। প্রায় পনে এক ঘন্টা পর এসে জানালেন ঝুমুরের জ্ঞান ফিরেছে। ফাহমান বললো আগে ওর পেটে কিছু দেওয়া দরকার। তাই ওকে যেন স্যুপটা খাওয়ানো হয়।

এরপর অতিবাহিত হলো আরও কিছুক্ষণ। ঝুমুর এখন কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হতে পেরেছে। দেওয়ালে বালিশ ঠেকিয়ে পিঠ দিয়ে বসেছে। ফাহমান সামনে বসে আছে। আঞ্জুম আরা কিচেনে। মনোয়ারা বেগম আর হৈমন্তী তখন ঝুমুরের ঘরেতেই ছিলেন। ফাহমান খানিকটা গম্ভীর গলায় বললো ‘ আন্টি আমার ঝুমুরের সঙ্গে কিছু কথা ছিল যেহেতু আমি ওর চেকআপ করেছি। ‘

ফাহমানের কথায় মনোয়ারা বেগম আর হৈমন্তী দুজনেই বেরিয়ে গেলেন। ঝুমুর মাথা নিচু করে বসে আছে। ফাহমানের দিকে মুখ তুলে তাকানোর সৎসাহস তার হচ্ছে না। একদিন না খেয়ে যে প্রেসার লো করে এমন অজ্ঞান হয়ে টাল মাতাল অবস্থা হবে জানা ছিল না তার। এখন কে জানে ফাহমান কতটা রেগে আছে। সে তো সেদিন রেস্টুরেন্টেও ঝুমুরকে বলেছিল ঠিকমতো বেশি বেশি খেতে।

‘ অপরাধ করে এখন আমার দিকে চোখ তুলে তাকানো যাচ্ছে না কেন ? ‘

ঝুমুর ফাহমানের কথায় মুখ তুললো। ওর চোখে চোখ রাখতে পারছে না সে। ফাহমানের কঠিন চোয়াল আর গম্ভীর স্বরের কাছে ওর সমস্ত সাহস ভাটা পড়ে যাচ্ছে। ঝুমুর বেশিক্ষন ফাহমানের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলো ফাহমানের কথা।

‘ তুমি কি আমাকে ভালোবাসো ঝুমুর ? ‘

ঝুমুর চকিতে মুখ তুলে তাকালো। ফাহমান ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কি জবাব দিবে ঝুমুর ? ফাহমানকে যে ওর পছন্দ সে তো ও জানিয়েছেই। কিন্তু সরাসরি ভালবাসে এই কথাটা বলার সাহস তো ওর এখনও তৈরি হয়নি। এর জন্য ওর সাহস প্রয়োজন, প্রয়োজন সঠিক ক্ষণ। সেই সাহস কিংবা সঠিক সময় কোনোটাই তো এখনও আসেনি।

ঝুমুরকে নীরব দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফাহমান। বললো ‘ মানলাম তুমি আমায় ভালোবাসো না। আমার কথা তোমার চিন্তা হয়না, আমার কথা শুনতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু তোমার মা, বাবা, নানাভাই,নানু ওদের তো ভালোবাসো। ওদের কথা ভেবে তাহলে কেন নিজেকে সামলে নিচ্ছ না ?

তুমি যে এই অনিয়ম করছো, ইচ্ছে হলে খাচ্ছো না তাতে আলটিমেটলি ক্ষতি তোমারই হচ্ছে। তোমার কিছু হলে কার আসবে যাবে ? কারোর কিছু আসবে না কিংবা যাবেও না। কিন্তু তোমার পরিবারের আসবে যাবে। তোমাকে তারা অকালে হারাবে। ‘

ঝুমুর স্থির দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ফাহমানের দিকে। সে ফাহমানকে ভালোবাসে না, তার কথা চিন্তা করে না এই কথাগুলো বলার সময় ফাহমানের গলাটা কেমন কেপে উঠেছিল। ঝুমুর স্পষ্ট টের পেয়েছে সেটা। অপরাধী সে আবার মাথা নামিয়ে ফেললো। গলা খাদে নামিয়ে বললো ‘ বিশ্বাস করেন ডাক্তার সাহেব, আমি চাই একটু নিজেকে নিয়ে ভাবতে, নিজের জন্য বাঁচতে। কিন্তু যেই মুহূর্তে এসব চিন্তা করি সেই মুহূর্তেই আমার মনে পড়ে আমার অমনি নেই যে আমার সাফল্যে খুশি হবে। আমার বাবা আমাকে ভালোবাসে না যে আমার জন্য তার চোখে মুখে খুশির অশ্রু দেখতে পাবো। আমার কেউ নেই ডাক্তার সাহেব, কেউ না।

এই দশটা বছরে বাবা একবারও আসেনি আমাকে দেখতে। শুধুমাত্র আমি দুবার গিয়েছিলাম। বাবা কখনও আমাকে নিজে থেকে ফোনও দেয় না। ফোন আমিই দেই। আর যখনই ফোন দেই তখনই বাবা বলে আমাকে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করতে হবে কারণ সে আমার থেকে আমার বেস্টটা আশা করে। কিন্তু এসবের বাইরে কি আসলেই তার কিছু বলার নেই ? আমাদের সম্পর্ক কি শুধুমাত্র পড়াশোনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ? আমাদের কি এর বাইরে আর কোনো কথা বলার নেই ? এরপরও কি আর নিজের কথা ভাবা যায় ডাক্তার সাহেব ? আমার শুধুই মনে হয় আমার অমনি হারিয়ে গিয়ে আমার সব কেড়ে নিয়েছে। মানুষটা নিজের সঙ্গে সঙ্গে আমার শৈশব, কৈশোর সব কেড়ে নিয়েছে। ‘

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-২৩
#মিফতা_তিমু

রাতের আকাশ ঝা চকচকে। কোথাও এক রত্তি মন খারাপের ঝড় অব্দি নেই। কিন্তু ঝুমুরের মন খারাপের নৌকা হয়তো বিষাদ নদীর তীরে এসেই ডুবে গেছে। সে অশ্রু ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে ফাহমানের দিকে। ফাহমানের এখন বেশ অসহায় লাগছে নিজেকে। বুঝতে পারছে ঝুমুর তার সামনে যতটা হাসিখুশি, চঞ্চলা কিশোরী, ভিতর থেকে ঠিক ততটাই ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া এক মানবী। আসলে যে যতটা অন্তর্মুখী সে ভেতর ভেতর ততটাই ভঙ্গুর।

ঝুমুর অন্তর্মুখী স্বভাবের। কারোর কাছে সহজে নিজের মনের কথা খুলে প্রকাশ করতে পারে না। তাই হয়তো তার মনে জমাট বাধা কষ্টগুলোর গভীরতাও ঠিক ততটাই অজানা। ঝুমুরের জলে ভাসা গভীর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ফাহমান হাতটা এগিয়ে ঝুমুরের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। বললো ‘ বাবা মায়েরা আমাদের পেটের কথা মুখে আনার আগেই বুঝে ফেলেন কিন্তু তাদের কষ্ট, আনন্দ, খুশি আমরা কখনও দেখতে পাই না। তাদের খুশিটা আমাদের চোখে ধরা পরে না। এই যে তুমি বললে তোমার সাফল্যে আঙ্কেল কখনও খুশি হননা সেটা ভুল কথা। তুমি তার সন্তান। সন্তানের খুশিতে বাবা মা খুশি হবেন না এটা কি সম্ভব ? এতটা নিষ্ঠুরও নন তারা। তারা শুধু পারেননা সন্তানের সামনে নিজের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে।

হয়তো তিনি খুশি হন কিন্তু নিজের অনুভূতি প্রকাশের সীমাবদ্ধতা ডিঙিয়ে মেয়েকে বাহবা দিতে পারেন না। তাতে কি উনার তোমার প্রতি ভালোবাসা কমে যাবে ? এই জীবন অনেক ক্ষুদ্র ঝুমুর। কিন্তু তবুও আমরা এই ক্ষুদ্র এক জীবনেই এমন অনেক মানুষের দেখা পাই যাদের আমরা কখনো ভুলতে পারিনা। তোমার মা মানুষটাও আংকেলের কাছে সেরকমই এক মানুষ। তার অনুপস্থিতি আঙ্কেলকে খুবই কষ্ট দেয়। সেই যন্ত্রণার পরিমাণ এতটাই তীব্র যে তার কাছে তোমাদের প্রতি ভালোবাসটা চাপা পড়ে যায়।

তোমাদের জীবন থেকে আন্টি হারিয়ে গেছেন অনেক বছর। এটা যেমন তোমাকে কষ্ট দেয় তেমনই আঙ্কেলকেও দেয়। উনি যেমন তোমার মা তেমনই আংকেলেরও স্ত্রী। তোমার যেমন তাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হচ্ছে তেমনই তারও হচ্ছে। শুধু পার্থক্য এটাই তুমি সেটা প্রকাশ করো না আর আঙ্কেল সেটা প্রকাশ করেন। প্রকাশ করেন তোমাদের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে। আসলে আমরা মানুষ ভেদে আমাদের প্রকাশ ভঙ্গিও ভিন্ন। ‘

কথাগুলো ঝুমুর চোখের জল ফেলতে ফেলতে এক মনে শুনলো। তার চোখ দিয়ে এখনও টুপটুপ জল গড়াচ্ছে। ফাহমানের প্রতিটা কথাই সত্যি এই কথা এক বিবেকবান ব্যক্তি নিঃসন্দেহে মেনে নিবে। কিন্তু অভিমানী ঝুমুরের বাবার প্রতি অভিমান এই ভীষন বাস্তব কথাগুলো মেনে নিতে চাইছে না। মনটা ক্রমশ আরও খারাপ হচ্ছে। মন খারাপের নৌকা বিষাদ নদীর গভীরে আরও ডুবে যাচ্ছে। সেই ডুবন্ত নৌকার পাল টেনে ফাহমান বললো ‘ এই একাকী জীবনে দিনশেষে আমাদের সবারই একা লাগে। সে যদি আমাদের সবথেকে কাছের মানুষও সঙ্গে থাকে তবুও একাই লাগে। আসলে একাকী এই শরীরে তো আর দ্বিসত্তার বাস নেই যে আমাদের একাকিত্ব ঘুচে যাবে। কিন্তু এই একাকিত্ব আমাদেরই কাটাতে হবে। নিজের মনোবল ধরে রেখে সামনে এগোতে হবে। কাছের মানুষদের অনুভূতি প্রকাশের সীমাবদ্ধতা ভেঙে তাদের কাছে আসার সুযোগ দিতে হবে। ‘

ঝুমুর তাকিয়ে আছে ফাহমানের দিকে। তার মন খারাপের নৌকা আস্তে আস্তে যেন ফাহমানের অদৃশ্য হাতের টানে উঠে আসছে। ভারসাম্য রক্ষা করে বিষাদ নদীতে ভেসে উঠছে। ঝুমুর হাসলো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কাজল কালো চোখ দুটোর স্বচ্ছ অশ্রু মুছে হাসি হাসি মুখে বললো ‘ আপনার মোটিভেশনাল স্পিকার হওয়া উচিত ছিল ডাক্তার সাহেব। তাহলে অন্তত আমার মতো ডিপ্রেশনে ভোগা আরও কিছু রোগীকে উৎসাহ দিতে পারতেন। ‘

ফাহমান ঝুমুরের হাত চেপে ধরলো। বললো ‘ মোটেও নিজেকে এসব উল্টাপাল্টা কিছু বলবে না। ‘
ঝুমুর ঠোঁট বাঁকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে বলল ‘ কেন ? ‘
‘ কারণ আমার পছন্দ না তাই। ‘

‘ আমিই বা আপনার পছন্দ না বলে বলবো না কেন ? আপনি কে আমার ? আপনিই তো বলেছিলেন আপনার সঙ্গে আমার প্রণয় নেই। তাহলে নিজেকে যে আপনার প্রণয়িনী বলে ভাববো সেই অবকাশও নেই। ‘

ফাহমান এবার মুখটা প্যাঁচার মতো বেজায় গোমড়া করে ফেললো। বিরক্তিকর মুখে বললো ‘ একই কথা কতবার বলবে ? ‘
‘ যতদিন আপনি বাঁচবেন ততদিন। এটা হলো আমাদের প্রেম হয়নি বলার শাস্তি। এই কথা সারাজীবন শুনে যেতে হবে আপনার। ‘ ঝুমুর দুষ্টু হেসে বললো।

ফাহমান সরু চোখে তাকিয়ে বললো ‘ তবে যে পরের কথাগুলো বাসে বসে বলেছিলাম তার জন্য পুরুস্কার কি হবে ? ওর জন্য আমারও তো কিছু পাওনা আছে। ‘
ঝুমুরের চোখে মুখে পূর্বের সেই চঞ্চল ভাব ফুটে উঠেছে। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির আঁচ। ঝুমুর ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো ‘ ওগুলো ডিলেটেড। আমার মেমোরি লস হয়েছে। বাসের কোনো কথা মনে নেই আমার। ‘

ফাহমান বুঝলো ঝুমুর ইচ্ছে করে ওর কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার মনে এখন রং লেগেছে। ওকে জালানোর পাঁয়তারা করছে। তাই ও কপট রাগ দেখিয়ে গোমড়া মুখে বললো ‘ প্রেমিকা আছো বলে বেচেঁ গেছো। নিজের বউ হলে দেখিয়ে দিতাম এসব ছাইপাশ বলার শাস্তি কি। ‘
ঝুমুরের মনের রং বোধহয় মেটেনি তাই পূর্বের মতই দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বললো ‘ বউ আবার নিজের পরের হয় নাকি ? আর প্রেমিকা বলে বেচেঁ গেলাম কেন ? বউ হলে কি করতেন ? ‘

‘ বুঝলাম তোমার সঙ্গে কথায় পারবো না। এমনিতে তো দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটা উল্টে খেতেও জানোনা। কিন্তু ভেতর দিয়ে পেটে পেটে অনেক কিছুই আছে তোমার। প্রেমিকা বলেই তোমাকে ছোঁয়ার সাধ্য নেই আমার। বউ হলে ছুঁয়ে দিতে পারতাম। শাস্তি দেওয়ার জন্য তো ছোঁয়া প্রয়োজন। ‘

ফাহমানের শেষের কথাগুলো শুনে ঝুমুরের কিছুক্ষণ পূর্বের সেই মন খারাপ আবার ফিরে এলো। ফাহমান বুঝলো ঝুমুরের মনের ভাব। হেসে ঝুমুরের হাতে হাত রেখে বলল ‘ ওসব নিয়ে ভেবো না। আপাতত নিজের কথা আর অ্যাডমিশন টেস্টের কথা ভাবো। ভেবে দেখো তুমি যদি টেস্ট পাস করে যাও তাহলে কি হবে। রাস্তা দিয়ে আসতে যেতে লোকে বলবে ওই দেখো ডাক্তার সাহেবের ডাক্তার বউ যাচ্ছে। ‘

ফাহমানের কথায় মেকি হাসি দিয়ে নিজের মন খারাপ লুকোনোর চেষ্টা করলো ঝুমুর। ফাহমান আরও কিছু কথা বললো। বললো ঝুমুরকে নিজের একটু যত্ন নিতে। ভালো না লাগলেও খেতে। সব কথা শেষে ফাহমান দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো। পূর্ণ বয়স্ক এক যুবক হয়ে একলা মেয়ের ঘরে বেশিক্ষন থাকাটা লোকে ভালো চোখে দেখবে না। ওদের সম্পর্ক নিয়ে সবার মনে সন্দেহ জাগতে পারে।

সেদিন রাত্রিটা ঝুমুরের মন খারাপের বিষ মনে পুষেই নির্ঘুম কাটলো। আসলে মন খারাপের মেঘ জমেছে যার চিত্তে তার কি আর এত সহজে মেঘলা আকাশে সূর্যের দেখা মেলে। তাই ঝুমুর মন খারাপ নিয়েই নির্ঘুম রাত্রি কাটিয়ে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লো। সময় তখন সকাল ছয়টা। তারিখ ৩১ জানুয়ারি। আর মাত্র একটা দিন। তারপরই জীবন থেকে কেটে যাবে নতুন বছরের পহেলা মাসটা।

ঝুমুরের এলোমেলো কেশরাশি বিছানাময় ছড়িয়ে আছে। জানালার শক্ত পর্দার ফাঁক ঠিকরে সকালের নরম আদুরে রোদ্দুর ঝুমুরের চোখে মুখে হুটোপুটি খাচ্ছে। ঝুমুরের বিকার নেই। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রাত্তিরে তার ঘুম হয়নি তাই নরম রোদ্দুরের ভালোবাসাময় হাতছানি সে উপেক্ষা করেই ঘুমোচ্ছে। ঘুমের ঘোরে প্রিয় মানুষটার আদুরে স্পর্শ স্মৃতিতে উপভোগ করতে ব্যস্ত সে।

বেলা গড়িয়ে যখন দুপুর বারোটা বাজলো ঝুমুর তখনও ঘুমে বিভোর। আজকাল রাত্তিরে তার ঘুম হয়না। সেই ঘুম না হওয়া ক্লান্ত শরীর নিয়েই অন্যদিন কোচিং ছুটতে হয়। কিন্তু আজ শরীরটা একটু বেশিই খারাপ তাই ফাহমান বলেছে একদিন কলেজ না যাওয়াই ভালো হবে। পরে রাস্তার মধ্যে মাথা ঘুরে পড়ে গেলে বিপদ হবে।

ঝুমুরের ঘুম ভাঙলো ফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে। ঝুমুর পিটপিট করে চোখ জোড়া খুললো। আশপাশ হাতড়ে ফোনটা কানে নিলো। ঘুমঘুম গলায় বললো ‘ অঙ্গনা ঝুমুর বলছি। কে বলছেন ? ‘
কলদাতা নির্বাক, শুধুমাত্র তার উঠতি শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঝুমুর ঘুমের মাঝে এমন অদ্ভুত কাণ্ডে বিরক্ত হলো। ধৈর্য্য ধরে বললো ‘ কে বলছেন না বললে কথা তো আগাতে পারছি না। ‘

তবুও ফোনের ওপাশে মানুষটা নির্বাক। ঝুমুর সেকেন্ড কয়েক অপেক্ষা করে তারপর ধীর লয়ে কিছু একটা ভেবে মিহি স্বরে বললো ‘ ডাক্তার সাহেব বলছেন ? ‘
দিনে দুপুরে এমন কথা শুনে চমকে উঠলো ফাহমান। এই মেয়ে বুঝলো কি করে ? এ অন্তর্যামী নাকি ? ফাহমান বিস্মিত কণ্ঠে বললো ‘ তুমি বুঝলে কি করে ? ‘

অসুস্থ শরীরে ভারাক্রান্ত মনটা মুহূর্তেই ফাহমানের কথা শুনে ভালো হয়ে গেলো। তাহলে এই জন্যই ফাহমান তার প্রিয় মানুষ। প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে প্রায় মরে যাওয়া অপ্রিয় মনটা নিমেষেই সতেজ হয়ে উঠেছে। ঝুমুর খিলখিলিয়ে হাসলো। ফোনের ওপারে ফাহমান মুগ্ধ হয়ে শুনছে সেই হাসি। আজ পর্যন্ত ঝুমুরকে এমন উচ্চস্বরে হাসতে দেখেওনি এবং শুনেওনি। ইচ্ছা ছিল ঝুমুরকে কোনো এক বর্ষার ঝুম বিকেলে বলবে সে যেন খিলখিলিয়ে উচ্চস্বরে হেসে ফাহমানের প্রাণ তৃষ্ণা মিটিয়ে দেয়।

তবে ঝুমুর ফাহমানের খুবই প্রিয় মানুষ কিনা তাই মুখে বলতে হলো না। বলার আগেই ঝুমুর বুঝে নিলো ফাহমানের মনের ইচ্ছে। সেই ইচ্ছা পূরণ করেই সে এখন হাসছে। ফাহমান দেখতে পারছেনা সেই হাসি তবে দেখলে নিশ্চিত ঝুমুরের এই হাসিকে সে নির্ঘাত মুক্তো ঝড়া হাসি বলে আখ্যা দিত। নেহাতই সে কবি সাহিত্যিক নয় নাহলে প্রেয়সীর সেই রুমঝুম হাসির সঙ্গে মানানসই চমৎকার সব উপমা আবিষ্কার করতো।

‘ বাহ্ রে, আমি না বুঝলে আর কে বুঝবে বুঝি। আমাকে এমন দিনে দুপুরে বা রাত বিরাতে ফোন দেওয়ার মানুষ তো একমাত্র আপনিই আছেন। মামা নিশ্চই ফোন দিয়ে এখন আমার সঙ্গে আড্ডা পেতে বসবে না। তাছাড়া মামার তো খবর নেওয়ার মাধ্যম আছেই, আপি। ‘

ফাহমান প্রাণ ভরে অনুভব প্রেয়সীর কণ্ঠে মেশানো মাদকতা। এই মাদকতায় ডুবে সে মরতেও রাজি। তার বুকের বা পাশটায় চিনচিনে ব্যাথা উঠেছে প্রিয়তমার রুমঝুম হাসির শব্দে। মনে হচ্ছে মানুষটাকে ভালোবাসতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে যাবে সেই বিরহ বর্ষায়। একটা মানুষকে কি করে এত ভালোবাসা যায় সেটা ঝুমুরের দেখা না পেলে বুঝতেই পারতো না। কালের বিবর্তনে ঝুমুরের প্রতি তার ভালবাসার গভীরতা বেড়েই চলেছে শুধু নেই তাদের কোনো স্বীকারোক্তি।

‘ তাই ? ‘ ফাহমানের প্রশ্ন।

‘ হুম তাই। আপনার নিশ্বাসের শব্দেও আপনি চিনে নিতে পারবো মানুষটা আপনি। বিশ্বাস নাহলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। করবেন পরীক্ষা ? ‘ ঝুমুর হেসে বললো।

ফাহমান জবাবে মৃদু গলায় বললো ‘ না বাবা প্রয়োজন নেই। তুমি মানুষটা এখনও ভর্তি পরীক্ষাই দিতে পারলে না আবার দেবে প্রেমের পরীক্ষা। তার থেকে আগে মনটা সুস্থ করো। ওটা বেশি জরুরি। প্রেমের পরীক্ষা না দিলেও চলবে। ‘
ঝুমুর বললো ‘ কেন বিশ্বাস হয়না আমাকে ? ‘

ফাহমান হেসে বললো ‘ আহা,কি মুশকিল!! বিশ্বাস হবেনা কেন ? আমি তো জানি তুমি যেটা বলছো সত্যিই বলছো। আমি শুধু চাইছি না তুমি কোনো পরীক্ষা দাও। প্রেম কলেজের বাংলা বইয়ের উপন্যাস নয় যে তোমাকে এর জন্য পরীক্ষা দিতে হবে। লাভ ইজ অল এবাউট ফিলিংস। সো ফিল ইউর লাভ এন্ড ইনজয় ইউর লাভ। ‘

ঝুমুর কথা বললো না তবে ওর ঠোটের কোণে প্রচ্ছন্ন হাসি। মানুষটার প্রেমের সাগরে দিনদিন সে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই প্রেমে ডুবে সে নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছে। কিন্তু বলতে ভয় হয়, যদি মানুষটাকে ভালোবাসার কথা জানানোর পর সে হারিয়ে যায়। তার অমনি যেমন বাবাকে ছেড়ে হারিয়ে গেছে তেমন যদি সেও হারিয়ে যায় তাহলে ? তাহলে….. ঝুমুর জানেনা সে কি করবে। তাই ইচ্ছেই করে না মানুষটাকে মনের কথা জানাতে,ভালোবাসার কথা জানাতে। শুধু মনে হয় সব যেমন আছে তেমনই থাকুক।

‘ আচ্ছা সেদিন রাতে আমার গান নিশ্চই আপনার ভালো লাগেনি ? ‘

‘ কেন ? ভালো লাগবে না কেন ? ‘

‘ গান গাওয়ার মতো ঐশ্বরিক প্রতিভা আমার নেই। আমি সংসারী মানুষ। সংসারের কাজকর্ম গান গাওয়া, নাচ করা, ছবি আঁকার থেকে ভালো পারি। আপনার মতো মাল্টি ট্যালেন্টেড মানুষ আমি না। ‘

‘ আমি মাল্টি ট্যালেন্টেড ? কিভাবে ? ‘

‘ হৈমী বলেছে আপনি ভালো স্কেচ করতে পারেন। এই ধরনের এক্টিভিটিস যারা পারে তারা নিঃসন্দেহে মাল্টি ট্যালেন্টেড পারসন। আমি ওসব পারি না। আমি বেগুন যার কোনো গুণ নেই। নাচ, গান, আঁকাআকি আমার দ্বারা কিছুই হয়না। ‘

এতক্ষণ ঝুমুরের নিজ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণাগুলো শুনছিল ফাহমান। কিন্তু ঝুমুর যে বললো ওর কোনো গুণ নেই, ও সংসারের বাহিরে কোনো কাজ পারেনা সেটা ভুল ধারণা। এই ধারণা তো ভাঙ্গা প্রয়োজন। তাই ও বললো ‘ ভুল বললে। তুমি যদি ভেবে থাকো তোমার কোনো গুণ নেই তাহলে তুমি ভুল। গুণ থাকবে না কেন ? অবশ্যই আছে তোমার গুণ। তোমার যদি মনে হয় তুমি গান গাইতে জানো না, তোমার গলায় সুর নেই তাহলে তুমি ভুল।

অবশ্য তোমাকেও দোষ দেওয়া যায় না। নিজের গান কারোরই মনে ধরে না। আমি যখন নুডুলস রান্না করি তখন আমার নিজেরই খেতে ইচ্ছে করে না অথচ মা বলে আমি নুডুলসটা নাকি দারুন করি। তাছাড়া গানের কথা ছেড়ে যদি অন্যকিছুর কথাই ধরি তাহলেও তো তুমি বেগুন নও। তুমি ঘরের কাজকর্ম গুছিয়ে করো, ভালো গিটার বাজাতে পারো, পড়াশোনায় সবসময় ফার্স্ট গ্রেড পাও। এমনকি ডিএমসিতে এডমিশনের জন্যও ট্রাই করছো। ওটা হয়ে গেলে তো মেডিক্যালে চান্স পাওয়ার মতো বড় একটা ক্রেডিট তোমার ঝুলিতে গিয়েই পড়বে। তারপরও তুমি বলছো তুমি বেগুন। এটা অন্যায় হয়ে যাচ্ছে না আমার বাগান কন্যার প্রতি ? ‘

ফাহমানের কথা শুনে হাসছিল ঝুমুর। কিন্তু ওর মুখে ‘ আমার বাগান কন্যা ‘ কথাটা শোনামাত্র ওর সর্বাঙ্গ কেপে উঠলো। ঠোঁটের কোণে হাসিটা আষাঢ় মাসের আকাশে এক ফালি রোদ্দুরের মতো। ফাহমান আবারও বললো ‘ আচ্ছা তোমার গলায় তো ইংলিশ গান শুনলাম। এখন বাংলা গান গেয়ে শোনাও দেখি। আমিও শুনি তুমি বাংলা কেমন গাও। ‘

ঝুমুর নিজেকে সামলে বললো ‘ বাংলা গান!! আমার তো বাংলা কথা বলতে গেলেই ভুলচুক হয়। তাহলে গান কি করে গাইবো ? এ তো একেবারে অসম্ভব কথা। ‘
ফাহমান বললো ‘ মানুষ চাইলে কি না পারে ? তুমি চেষ্টা করেই দেখো না। যাও তোমাকে তেরো দিন সময় দিলাম। আজ মাসের ৩১ তারিখ। সামনের মাসের চৌদ্দ তারিখ মানে পহেলা ফাল্গুনে বসন্ত উপলক্ষে আমি তোমার গলায় বাংলা গান শুনতে চাই। পারবে না এতটুকু করতে ? ‘

ফাহমানের এত আকুতি ভরা আবদারে আর আপত্তি জানানোর সুযোগ পেলো না ঝুমুর। হু বলে সায় জানালো। এমন সময় মনোয়ারা বেগম ঝুমুরের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে ঝুমুরকে দরজা খুলতে বললেন কারণ ঝুমুরের জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন তিনি। ফাহমানকে নিচু গলায় বিদায় জানিয়ে ঝুমুর উঠে গেলো দরজা খুলতে।

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে