নূপুর বাঁধা যেখানে পর্ব-৩২+৩৩

0
1006

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-৩২
#মিফতা_তিমু

‘ আসিফের মা, আসিফের বউ দেখি কিছুই পারে না। একটা পেঁয়াজ কাটতে যাইয়া এমন রক্তারক্তি অবস্থা হইলে সংসার করবো কেমনে। তুমি দেহি আলালের ঘরের দুলালরে বউ কইরা আনছো। ‘

কাকী শাশুড়ির বিরুপ মন্তব্যে জবাব দিলেন না মিসেস কুমুদিনী। তিনি হৈমন্তীর কেটে যাওয়া আঙ্গুলে অ্যান্টিসেপ্টিক লাগাতে ব্যস্ত। মেয়েটা বড্ড শখ করে আগ্রহ নিয়ে পেঁয়াজ কাটতে গিয়েছিল অথচ পুরো আনন্দটাই মাঠে মারা গেলো। কাকী দাদী শাশুড়ির কথায় হৈমন্তীর চোখ দুটো ভরে উঠলো। না চাইতেও ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।

‘ অত কাজ পেরে তো লাভ নেই যদি শাশুড়িকেই সম্মান না করে। আপনার ছেলের বউ তো একেবারে সর্বগুণে গুণান্বিত গ্রামের মেয়ে ছিল কাকিমা। কিন্তু এতে কোনো লাভ হয়েছে কি ? সেই তো আপনাকে তার কথাতেই উঠ বস করতে হতো। ‘

মিসেস কুমুদিনীর এরূপ কথায় ভদ্রমহিলার মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠলো। বুঝতে পারেননি ওই কথার বিপরীতে এমন তিক্ত কথা শুনতে হবে। চোখের সামনে যেন পুরনো স্মৃতিগুলো ভেসে উঠছে। পুত্র বধূর করা অত্যাচারগুলো বিষের মতো ছিল। ভদ্রমহিলা এরপর আর কথা বলার সাহস পাননি।

হৈমন্তী উপলব্ধি করলো এই যে প্রথমে তার বাবাকে নিয়ে কথা শুনলো এরপর আবার তার নরম মন নিয়ে কথা শুনলো এগুলো এখন থেকে রোজই শুনতে হবে। বিয়ের আগে যেই মেয়েরা বাবা ভাইয়ের আদুরে হয় বিয়ের পর তারাই হাজার কটু কথা শোনা সত্ত্বেও সব নীরবে হজম করে নেয় শুধু একটু শান্তি পাওয়ার জন্য। হয়তো হৈমন্তীকেও তাই করতে হবে, সব সয়ে একলা নিরালায় কাদতে হবে।

হৈমন্তী জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। বাহিরে আসিফের বিরাট গাড়িটা এসে থেমেছে। অবশেষে এখন তার সময় হলো বাড়ি ফেরার। সারাদিনে একবারও ফোন দিয়ে খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। অভিমানে হৈমন্তীর বুকটা ভার হয়ে এলো। একাকিত্ব তাকে জাপটে ধরলো। হৈমন্তী শুধু নিষ্প্রাণ চোখে চেয়ে রইলো। আসিফ গাড়ি থেকে নেমে সোজা দৃঢ় পায়ে বাড়ির সদর দরজার দিকে এগিয়েছে।

নিচ থেকে হইচইয়ের শব্দ আসছে। আসিফ ফিরেছে বলেই হয়তো ছোটরা তাকে দেখে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। এই একদিনে হৈমন্তী যা বুঝেছে তাতে আসিফকে বাচ্চারা সকলে জমের মতো ভয় পায়। তার গম্ভীর মুখভঙ্গি তাদের খুশি হতে দেয় না বরং স্মরণ করিয়ে দেয় স্কুলের জাঁদরেল মাস্টারের কথা।

আসিফ ফিরেই মিসেস কুমুদিনীর হাতে সাদা পলি ধরিয়ে দিয়ে বলল ‘ মা এটা হৈমন্তীর ঘরে দিও। এখানে…. ‘
আসিফ পুরো কথা বলার সুযোগ পেলো না। তার পূর্বেই মিসেস কুমুদিনীর ফুপি শাশুড়ি বলে উঠলেন ‘ দেখলে বউ, তোমার ছেলে বিয়ের একদিন যেতে না যেতেই বউয়ের আঁচল কিভাবে ধরে ফেলেছে ? বউয়ের জন্য আলাদা করে জিনিস আনা হচ্ছে। এখনই মা ছেড়ে বউকে ধরেছে না জানি বছর পার হলে তো মাকে আর দেখবেই না। আরে বাবা আনার হলে লুকিয়েই তো বউকে দিতে পারতো। এভাবে মাকে দেখিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মানে কি ? ‘

আসিফ ভদ্রমহিলার কথায় ভ্রু কুচকে তাকালো। এই ধরনের মানুষ তার একেবারেই পছন্দ নয়। আ কে আপেল বানাতে তাদের ন্যানো সেকেন্ড সময়ও লাগে না অথচ এটা তাদের মাথাতে নেই যে আ দিয়ে আমও হতে পারে। আসিফ বিরক্তির চোখে তাকিয়ে ভদ্রমহিলাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললো ‘ এখানে তোমার আর হৈমন্তীর জন্য একসঙ্গেই এনেছি। ‘

কথাগুলো বলে আসিফ সেই স্থান সঙ্গে সঙ্গে ত্যাগ করলো। আপাতত সে তার স্টাডি রুমে যাবে। হৈমন্তী আর মা এখন রাতের খাবার খাবে তার ঘরে বসে। কাজেই তাদের দুজনকে একটু আলাদা সময় দেওয়া উচিত একসঙ্গে কাটানোর জন্য। হৈমন্তী তো তার মায়ের সম্পর্কে কিছুই জানেনা। এই বাহানায় জানা হয়ে যাবে।

আসিফ বেরিয়ে যেতেই মিসেস কুমুদিনী এবার ফুপি শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘ ফুপু, মনসুর ভাই হয়তো আপনার ভয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে রমনা ভাবির জন্য খাবার আনতে পারেন কিন্তু আমার ছেলে সেরকম নয়। তার কাছে মা বউ দুজনেই সমান ভালোবাসার মানুষ। আমার ছেলে মেজাজি হতে পারে কিন্তু ভালোবাসার ক্ষেত্রে সে উজাড় করে ভালোবাসতে জানে। বউ ফেলে মা কিংবা মা ফেলে বউকে একলা ভালবাসা তার পক্ষে সম্ভব না। ‘

মিসেস কুমুদিনীর কথায় ভদ্রমহিলা চুপ করে গেলেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন কুমুদিনীর সামনে ছেলের বউকে নিয়ে আর একটা কথাও বলবেন না। সেই সঙ্গে মনে মনে নিজেকেও কটা কষে চড় লাগালেন। এতবার, এত কথা শুনলেন তবুও মুখে লাগাম নেই। সেই ঠিকই সুযোগ বুঝে আবারও নিজেকে অপমানিত করার পথ তৈরি করে দেন।

হৈমন্তীর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন মিসেস কুমুদিনী। আসিফ তার আর হৈমন্তীর জন্য বাহিরে থেকে গার্লিক নান আর বাটার চিকেন এনেছে। হৈমন্তী খেতে খেতে বললো ‘ আচ্ছা মা, আপনি কি করে জানলেন আমার এখন এগুলো খেতে ইচ্ছে করছিল ? ‘

মিসেস কুমুদিনী নিজের মুখে লোকমা তুলে খেতে খেতে বললেন ‘ জানতাম নাতো, আন্দাজ করেছিলাম। আসিফ জানিয়েছিল তোর শরীর খারাপ। তাই ভাবলাম তোর কিছু খেতে ইচ্ছে করতে পারে। আমারও এই সময় এমনই খেতে ইচ্ছে করতো। হতে পারে তোরও ইচ্ছে করছে ‘

হৈমন্তী শুভ্র আলোয় চোখ তুলে তাকালো তার শাশুড়ি মায়ের দিকে। হৈমন্তী যেন এই প্রথমবারের মতো মুগ্ধ হলো শাশুড়িকে দেখে। পরনে সুন্দর কুচি দেওয়া সাদা কালো শাড়ি, মাখনের মতো মসৃণ দুই হাতে সোনার বালা, কানে ছোট কানের দুল আর গলায় সরু চেইন। এলোকেশী ঘন কুচকুচে কালো সাদা চুলগুলো এলোমেলো খোঁপা করা। ঠোঁটের কোণে বরাবরের সেই স্নিগ্ধ হাসি।

হৈমন্তী আবিষ্কার করলো আসিফ যেন ঠিক তার মায়েরই প্রতিচ্ছবি। সেই একই নাক, মুখ আর রাগটাও মায়ের মতই। যদিও হৈমন্তী নিজ চোখে কখনও শাশুড়ি মায়ের ক্ষোভের তীব্রতা দেখেনি তবে কাল সকালে খাবারের টেবিলে সেই ঘটনার পর আগত মেহমানদের মুখে মুখে এই বাড়ির কর্তির রাগ সম্পর্কে বেশ ভালো কথাই শুনেছে। সেই থেকেই তার ধারণা আসিফ মায়ের রাগই পেয়েছে কারণ আসিফের বাবা আবার খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। অবশ্য কর্মক্ষেত্রে সেও গুরুগম্ভীর ও কঠোর।

তবে আসিফ যে পুরোপুরি মায়ের রাগ পেয়েছে তাও না। হৈমন্তীর বিশ্বাস তার শাশুড়ি মায়ের রাগ আসিফের রাগের মতো এমন সর্বনাশা নয় বরং প্রয়োজনে তিনি নিজেকে সামলে নিতে পারেন। তাই আসিফ মায়ের রাগ পেলেও সেটা নিজ দায়িত্বেই সে নিজের অহং হিসেবে ধরে রেখেছে।
হৈমন্তী ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে তার শাশুড়ি মায়ের গতিবিধি লক্ষ্য করলো।

‘ মা, আপনি খুব ভালো ‘

হৈমন্তীর কথা শুনে হাসলেন মিসেস কুমুদিনী। চাপা কণ্ঠে বললেন ‘ তাই বুঝি ? তোর মায়ের মতো ভালো ? ‘
হৈমন্তী বললো ‘ হ্যাঁ, আমার মায়ের মতোই ভালো। ‘
মিসেস কুমুদিনী হেসে হৈমন্তীর মুখে রুটি দিয়ে বললেন ‘ আচ্ছা তুই খুব ভাগ্যবতীরে হৈমন্তী। আসিফ তোকে খুব ভালোবাসে এবং এতটাই ভালোবাসে যে তোর সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। এমন সৌভাগ্য সবার হয়না। তোর বাবাও আমাকে ভালোবাসেন কিন্তু কোনওদিন আমার হয়ে কিছু বলেননি কারণ সম্পর্কের দিক থেকে উনার ফুপি, কাকী উনার বড়। ঠিক এই কারণেই আমার প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ আমাকেই করতে হয়েছে। অবশ্য আমি প্রতিবাদ করাতে উনি যে বাধা দিয়েছেন তাওনা। শুধু কোনওদিন আমার হয়েই কিছু বলেন নি।

তুই কপাল গুনে এমন মানুষ পেয়েছিস। হতে পারে আমার আসিফ রাগী, বদমেজাজি। কিন্তু ও তোকে ভালোও বাসে খুব। তাই ওকে কখনও ভুল বুঝিস না। ও যা করে তোর ভালোর জন্যই করে। ‘

হৈমন্তী মাথা নাড়লো। মিসেস কুমুদিনী শেষ রুটিটা হৈমন্তীর মুখে তুলে দিয়ে হৈমন্তীকে বিশ্রাম করতে বলে বেরিয়ে গেলেন সবকিছু উঠিয়ে। হৈমন্তী মুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে জামা কাপড় বদলে ভাবলো আসিফের খোঁজ করা উচিত। কে জানে কি করছে।

ডেস্কে বসে চোখে চশমা এটে নিয়নের আলোতে পার্টির কিছু কাগজ দেখছিল আসিফ। আমির কাগজগুলো ফিরতে সময় হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ আসিফের মনযোগে ভাটা পড়লো। চোখ থেকে চশমা নামিয়ে বললো ‘ কে ? ‘
বাহিরে থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ‘ হৈমন্তী ‘
‘ ভিতরে আয় ‘

আসিফের অনুমতি পেয়ে ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো হৈমন্তী। দেখলো পুরো ঘরময় এখানে ওখানে কাগজপত্র ছড়ানো। এই ঘরে স্টাফদের ঢোকার অনুমতি নেই তাই কিছুদিন হলো ঘরটা পরিষ্কার করা হয়না। বিয়ের আয়োজনে মিসেস কুমুদিনী সুযোগ পাননি ছেলের ঘর পরিষ্কার করার। হৈমন্তী চারদিকে নজর বুলিয়ে নিলো।

‘ কি চাই ? ‘

আসিফের কথায় হৈমন্তী উত্তর দিলো ‘ রাত হয়ে গেছে, ঘুমোবেন না ? ‘
‘ তুই গিয়ে ঘুমো, আমার ফিরতে দেরি হবে। ‘
হৈমন্তী আসিফের কথা তেমন গায়ে লাগালো বলে মনে হলো না। ও ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখছে।।আসিফ আবারও চোখে চশমা এটে কাগজ দেখতে দেখতে বললো ‘ কি ব্যাপার যাচ্ছিস না যে ? ‘

‘ একটু থাকি ? আমি কিছু ধরবো না, শুধু এই পড়ে থাকা কাগজগুলো গোছাবো। ‘

হৈমন্তীর কথায় আসিফ সরু চোখে তাকিয়ে বললো ‘ ধরবি না আবার কাগজও গুছাবি। না ধরে কি করে গুছাবি ? ‘
হৈমন্তী অপরাধী মুখে বললো ‘ স্পোকেন মিসটেক। কাগজগুলো দেখবো না, শুধু গুছিয়ে রাখবো। আপনাকে জ্বালাবো না, শব্দও করবো না। ‘

হৈমন্তীর কথা শুনে আসিফ কিছু একটা ভেবে বললো ‘ থাকবি ভালো কথা কিন্তু কাজ শেষে নিজের বই খাতা নিয়ে এসে ওই টি টেবিলে রেখে সোফায় বসে পড়বি। তিন দিন ধরে কোচিং যাচ্ছিস না, পড়া সব জমে যাচ্ছে তোর। বিয়ে করে যুদ্ধ জয় করিসনি যে পড়ালেখা করা যাবে না ‘

হৈমন্তী মাথা নাড়ল। বই খাতা আনতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু আবার ফিরে এলো। আসিফের পাশে গিয়ে সন্তপর্নে দাড়ালো। আসিফ ওকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললো ‘ কিছু বলবি ? ‘
হৈমন্তী মাথা নেড়ে বললো ‘ আমাকে সবার সামনে তুই করে না ডাকলে হয় না ? সবাই হাসাহাসি করে। ‘

‘ কে হাসে ? ‘ আসিফ আড়চোখে তাকিয়ে বললো।

‘ মনসুর কাকার মা আর… ‘

হৈমন্তী পুরো কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই আসিফ ওর হাত টেনে ধরলো। ফলশ্রুতিতে ভারসাম্য হারিয়ে হৈমন্তী পড়ে গেলো আসিফের উপর। আসিফ হৈমন্তীর কোমরে হাত রেখে বলল ‘ কে হাসে না হাসে সেটা কি আমার দেখার কথা ? তোকে আমি এতগুলো বছর তুই ডেকেছি এবং ভবিষ্যতেও সেটাই ডাকবো। লোকে যদি আমার বউকে তুই তুকারি করাতে হাসাহাসি করে তো করুক। আমি তো লোক দেখাতে তোকে বিয়ে করে সংসার করছি না। আমি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছার মালিক। তোকে বিয়ে করাও আমার ইচ্ছা আবার তোকে তুই করে ডাকাও আমার ইচ্ছা। বুঝেছিস ? ‘

হৈমন্তী ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে দ্রুত মাথা নেড়ে বললো ‘ হুম ‘
আসিফ হৈমন্তীর দিকে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। হৈমন্তীর বিউটি বোন দৃশ্যমান। গলায় সরু চেইন, হাতে পাতলা চুড়ি আর কানে ছোট কানের দুল। এগুলো নিশ্চই তার মা দিয়েছে। তার ধারণা বিবাহিত মেয়েদের খালি শরীরে থাকতে নেই। সবসময় গয়না পড়ে থাকতে হয়।

আসিফ হৈমন্তীর সৌন্দর্যে নাকি তার মায়া মায়া চাহনিতে পাগল হলো কে জানে। কিন্তু উদভ্রান্তের মতো হৈমন্তীর কাধে মাথা ঠেকিয়ে উষ্ণ নিশ্বাস ফেললো। হৈমন্তীর ওই নিষ্কলুষ চাহনি ওকে দিনদিন পাগলপারা করছে। হৈমন্তীর ড্যাবড্যাব চাহনি ওকে ভিতর থেকে আগ্রাসী করে তুলছে। আসিফ কম্পিত কণ্ঠে হৈমন্তীর পিঠ জড়িয়ে বললো ‘ সামনে আসিস না হৈম। আর আমার সামনে আসিস না। তোকে দেখতে চাইনা আমি। ‘

কথাগুলো বলে আসিফ হৈমন্তীকে উঠিয়ে দিয়ে টেবিলে হাত রেখে মাথা চেপে ধরলো নিজের। হৈমন্তী প্রথমে বিস্ময়ে থমকে গেলেও পরবর্তীতে অস্থির হয়ে উঠলো। পাগলের মতো জিজ্ঞেস করলো ‘ কি হয়েছে আপনার ? কেন এমন করছেন আপনি ? আমাকে দেখতে চাননা কেন ? আমি কি করেছি ? ‘

শেষের কথাগুলো হৈমন্তী কম্পিত কণ্ঠে বলল। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে তার। আসিফ ওকে দেখতে চায়না কথাটা শুনতেই মনে হলো ওর বুকে কেউ পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। কেমন ভার ভার লাগছে নিজেকে। পায়ের নিচের মাটি টলমলে লাগছে।

আসিফ হৈমন্তীর কথা শুনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। ধীর লয়ে উঠে দাড়ালো। হৈমন্তীকে আগলে নিয়ে হৈমন্তীর ঘাড়ে মাথা ঠেকালো। উষ্ণ নিশ্বাস ফেলে বললো ‘ আমাকে ছেড়ে যাসনা কখনো। তোর শরীরের ওম রোজ গায়ে না মাখতে পারলে আমার শান্তি মিলবে না। এই দুই দিনেই তুই আমার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিস। তোকে ক্ষণিকের নয় চিরদিনের অভ্যাস করতে চাই। ‘

হৈমন্তী এবার বিভ্রান্তিতে পড়লো। আসিফ দুইবার দুই ধরনের কথা বললো। ও কোনটা রেখে কোনটাকে ধরবে। সামনে আসবে না নাকি ছেড়ে যাবেনা কোনটা সত্যি ? হৈমন্তী ধরতে না পেরে চুপ রইলো। আসিফ হৈমন্তীকে আগলে ধরে রুমের সোফায় গিয়ে বসলো। হৈমন্তী আসিফের গালে হাত রেখে অস্থির কণ্ঠে বললো ‘ কি হয়েছে আপনার ? এমন অস্থির হচ্ছেন কেন ? ‘

‘ ভালো লাগছে না কিছু। অস্থির লাগছে আমার। মনে হচ্ছে তোকে পেয়েও পাইনি আমি। তোকে আগলে রাখতে পারছিনা আমি। তোর কাছে আমার অনেক আবদার তবুও যেন বলতে পারছিনা। শুধু মনে হচ্ছে তুই আমার হয়েও আমার না। ‘

হৈমন্তী আসিফের মনের অস্থিরতা টের পেলো। আদুরে হাতে আসিফের চুলে হাত বুলিয়ে দিল। শান্ত গলায় বললো ‘ অস্থিরতা কেটে যাবে আস্তে আস্তে। সবে বিয়ে হয়েছে আমাদের। আমাকে স্ত্রী হিসেবে দেখার অভ্যাস আপনার এখনও হয়নি তাই মনে হচ্ছে পেয়েও পাননি। সমস্যা নেই, অভ্যাস হয়ে যাবে। আমি করবো, যা আপনি চাইবেন। আপনার সব আবদার আমি মিটাবো যা আপনি কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেননি। শুধু একটু সবুর করুন। ‘

আসিফ অশান্ত মন নিয়ে হৈমন্তীকে আকড়ে ধরলো। বুকের ভেতরটা ভার ভার লাগছে। শান্তি কিছুতেই মিলছে না। শুধু মনে হচ্ছে হৈমন্তীকে পেয়েও পায়নি সে। মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই হারিয়ে ফেলবে এই মানুষটাকে। কিন্তু কেন এমন মনে হচ্ছে ? কেন সে এত অস্থির ? কেন সস্তি মিলেও মিলছে না। আসিফ অস্থিরতা নিয়েই চোখ বুজলো।

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-৩৩
#মিফতা_তিমু

ব্যস্ততম শহরে আরও এক নতুন দিনের সূচনা। সকলে ফিরেছে তাদের সেই পুরোনো সত্ত্বায়। আসিফ সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বেরিয়ে গেছে পার্টির কাজে। আত্মীয় স্বজন সকলে একে একে বিদায় নিচ্ছেন। হৈমন্তী আজও কোচিং যায়নি কারণ আত্মীয়দের বিদায় মুহূর্তে তার পড়তে বের হওয়াটা বড্ড বেমানান। তবে সে কাল থেকে যাবে কোচিং। আর তখন শুরু হবে পুরনো সেই উদ্যমে আবারও পড়াশোনা।

ফাহমান আজ আগেভাগে হাসপাতাল এসেছে। তার ডিউটি টাইম শুরু সাড়ে সাতটা থেকে। সাধারণত এমনটা হয়না তবে আজ হাসপাতালে কাজের চাপ আছে। দুই তিনজন ভিআইপি পারসনের হাসপাতালে এডমিট হওয়ার কথা। মনোবিজ্ঞান বিভাগেও বিশিষ্ট এক অধ্যাপক স্ট্রোক করে নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ভর্তি হয়েছেন। তাকে আবার এক্সট্রা ফ্যাসিলিটিজও দিতে হবে। অথচ স্টাফ স্বল্পতার কারণে সবটা সামাল দেওয়া কঠিন। তাই ইন্টার্নদের ওভার টাইম পড়েছে।

‘ ভাই তোর রাউন্ড দেওয়া শেষ ? ‘

জাকির শেষ রাউন্ডটা দিয়ে এসে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল। ফাহমান পেশেন্টের ব্লাড স্যাম্পল নেওয়া শেষ করে কান থেকে স্টেথোস্কোপ নামিয়ে বড় করে নিশ্বাস ফেলে বললো ‘ আই অ্যাম ডান ‘। জাকির শুনে সস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল ‘ তাহলে চল দোস্ত। খুদা আর সহ্য হয়না ভাই। পেটটা গুড়গুড় করছে খালি। ‘

‘ আমার পেটও ডাকাডাকি শুরু করেছে। এখন পেটে খাবার দেওয়াই লাগবে। ডিউটিতে এসে থেকে পেটে কিছু পড়েনি। এরপর আরও দেরি হলে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না। চল, চল তাড়াতাড়ি চল। ‘

স্টেথোস্কোপ আর এপ্রন জায়গামতো রেখে জাকির আর ফাহমান ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলো। হসপিটালের ক্যান্টিন যেতে হলে রিসেপশন পেরিয়ে যাচ্ছে ওরা। ফাহমান এক সিরিয়াস কেস নিয়ে জাকিরের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই এগোচ্ছিল হঠাৎ কানে এলো মেয়েলি এক কণ্ঠ। কন্ঠের মালিক রিসেপশনে দাড়িয়ে থাকা স্টাফকে সুধাচ্ছেন ‘ ডক্টর ফাহমান সওদাগরকে কোথায় পাওয়া যাবে ? ‘

ফাহমানের পদচরণ সঙ্গে সঙ্গে থমকে গেলো। সে পাশ ফিরে দেখলো গোলাপি শাড়ি পরিহিতা এক রমণী রিসেপশনের সামনে দাড়িয়ে আছে। চুলগুলো খোলা তবে রমণীর মুখ দেখা যাচ্ছে না। সে সামনের দিকে ফিরে আছে বলেই একরাশ রহস্য জাল বিছানো অমানিশ কেশরাশি তার কাধ বেয়ে কোমরের নিচ অব্দি নেমে এসেছে। ফাহমান তাকিয়ে আছে সেই রমণীর দিকে। তার চোখে ভাসছে সেদিনের সেই নূপুর কন্যা যার পরনেও ছিল ঠিক একই রকম শাড়ি। কিন্তু আদৌ কি এই রমণী সেই নূপুর কন্যা ?

‘ জাকির ক্যান্টিনে তোর একাই যেতে হবে। একটা কাজ মনে পড়ে গেছে। ‘

ফাহমানের কথায় জাকির কিছুটা গাইগুই করলেও কথা ফেলতে পারলো না সে। অগত্যা নিজেই ক্যান্টিনের দিকে হাঁটা দিলো। ফাহমানের কেমন এলোমেলো লাগছে সবটা। যদি এই রমণী নূপুর কন্যা হয়ে থাকে তবে তাকে কেন খুঁজছে ? তার নাম কি করে জানলো সে ? কি সম্পর্ক নূপুর কন্যার তার সঙ্গে ? তাছাড়া সেই বা কোন সাহসে নূপুর কন্যার মুখোমুখি হবে ? সে তো হারিয়ে ফেলেছে নূপুর কন্যার ফেলে যাওয়া নূপুর।

রিসেপশন থেকে ফাহমানের সিনিয়র ডক্টর আরিসের কেবিন নাম্বার জেনে নিয়েছে ঝুমুর। ফাহমান সাধারণত ডক্টর আরিসের আশেপাশেই থাকে। কাজেই আগে তার কেবিনে খোজ নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। রিসেপশনিস্টকে সাহায্য করার জন্য ‘ ধন্যবাদ ‘ জানিয়ে ঝুমুর পিছন ফিরল। কিন্তু বহু কাঙ্ক্ষিত সেই মানুষটা যে তার পিছনে এসে দাড়িয়ে থাকবে এই আশা করেনি সে। তার সমস্ত শরীর দিয়ে শীতল তরঙ্গ বয়ে গেলো। মানুষটা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার বিস্ময়মাখা হতবাক দৃষ্টিও যেন অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে।

ফাহমান এক ধ্যানে চেয়ে আছে সামনে দাড়িয়ে থাকা রমণীর দিকে। সবকিছুই একই রকম। সেই সেদিনের শাড়ি, সেদিনের গয়না, সেদিনের মাস্ক দিয়ে ঢেকে রাখা মুখ, সেদিনের মতোই কেশগুলো খোলা হাওয়ায় উড়ছে আর একই রকম কাজলহীন টানা টানা চোখ। অথচ আজ এই চোখটাই কেমন চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে এই চোখ তার বহুদিনের চেনা। এই চোখ সে রোজ দেখে, এই চোখের মায়ায় সে রোজ ডুবে। কিন্তু যেই মানুষটাকে সে চিনে না, তার চোখ কেন এত চেনা চেনা মনে হবে ?

‘ ডাক্তার সাহেব ‘

ফাহমানকে দেখামাত্র ঝুমুরের মুখ দিয়ে অস্ফুট বেরিয়ে এলো সেই ডাক। ফাহমান চমকে গেছে। বড় বড় চোখ করে সে চেয়ে আছে ঝুমুরের পানে। ঝুমুর প্রাণোচ্ছল হেসে এবার মুখের মাস্কটা খুলে ফাহমানের সামনে উন্মুক্ত করলো বহু দিনের আকাঙ্ক্ষিত সেই মুখটি। এই মুখের মুখোমুখি হতেই ভয় পাচ্ছিল মানুষটা সামান্য এক নূপুর হারিয়ে ফেলার ভয়ে। অথচ গোটা মানুষটাকেই সে কতদিন চিনে তার হিসাব নেই।

বহু প্রার্থিত অচেনা মানুষটার চেনা রূপে ফাহমানের মনে হলো তার পায়ের নিচের মাটিটা টলমলে। তার মনোরাজ্যে ভূমিধ্বস নেমেছে। সে হতবাক চোখে তাকিয়ে আছে সামনে দাড়ানো রমণীর দিকে। আমানত রক্ষা করতে না পারার ভয়ে কাল অব্দি যার মুখোমুখি হতে ভয় পেয়েছে সে আজ এসে দাড়িয়েছে তার মুখোমুখি তাও আবার প্রেয়সীর বেশে। ফাহমানের কেন যেন সবটা স্বপ্নের মত লাগছে। যেই স্বপ্ন হয়তো এখনই ভেঙে যাবে আর সে ঘুম থেকে উঠে বুঝবে সবটা স্বপ্ন ছিল।

ঝুমুর এক দৃষ্টে দাড়িয়ে দেখছে ফাহমানকে। ফাহমান এখনও ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে তার দ্বিধা স্পষ্ট। ঝুমুর এক পা এক পা করে এগিয়ে ফাহমানের আরও নিকটে এসে দাঁড়ালো। ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বললো ‘ বলেছিলাম আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা পুরুষ অন্য কারোতে মত্ত হলে মন ভাঙবে আমার ডাক্তার সাহেব। বাস্তবিকই ভেঙে দিলেন মনটা। এর কি শাস্তি হতে পারে ? ‘

ফাহমান এখনো হতবাক। এ কি হচ্ছে তার সঙ্গে। সবকিছু এমন অবিশ্বাস্য ঠেকছে কেন ? একসময়কার মোহ আর ভালবাসার মানুষ দুজনে একই ব্যক্তি শুধু তার কল্পনাতেই ছিল তারা দুই সত্তা। দুজনের সাজসজ্জা একই রকম, চোখ দুটো টানা টানা অথচ গভীর কালো, চুলগুলো অমাবশ্যার রাতে অন্ধকার ঘেরা মেঘের মতো। তবে এতটা কাছে থেকেও সে কোনওদিন ধরতে পারেনি নূপুর কন্যা আর বাগান কন্যা দুজনে এক,টানা টানা চোখের নূপুর কন্যা আর কাজল পড়ানো বাগান কন্যা এক।

ঘড়ির ঢং ঢং শব্দে ফাহমানের সম্বিত ফিরল। রিসেপশনের কাছে দেওয়াল জুড়ে বড় একখানা দেওয়াল ঘড়ি আছে। সেই ঘড়িতেই এখন দুপুর আড়াইটা বাজে। আড়াইটা মানে লাঞ্চ টাইম শেষ। ফাহমানকে এখন ফিরতে হবে কাজে। ঝুমুর ফাহমানের দিকে তাকিয়ে হাসলো। ফাহমানের চোখ মুখ করুন। এই রমনীকে যে তার অনেক প্রশ্ন করা বাকি অথচ সময় যে ফুরিয়ে এসেছে।

ঝুমুর এগিয়ে ফাহমানের কাছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো ‘ ফিরে যান ডাক্তার সাহেব। রাতে কথা হবে। আমি থাকবো আপনার অপেক্ষায়। ইন দ্যা মিডল অফ নাইট, ইন দ্যা মিডল অফ নাইট জাস্ট কল মাই নেম, আই অ্যাম ইউরস টু টেম। ‘

কথাগুলো বলে ঝুমুর পিছিয়ে গেলো। সেই মন ভোলানো হাসিটা উপহার দিল ফাহমানকে। ফাহমান সেই হাসিতে আবারও মুগ্ধ হলো। তার তৃষিত হৃদয় জুড়ালো প্রেয়সীর হাসি মাখা মুখ দর্শনে। ঝুমুর বেরিয়ে গেলো। কোচিংয়ের পর ব্যাংকে কিছু কাজ আছে জানিয়ে বেরিয়েছিল সে। উদ্দেশ্য ছিল ফাহমানকে চমকে দেবে। মনে হচ্ছে কাজের নাম করে তার এতদূর আসাটা বৃথা হয়নি। ডাক্তার সাহেব ভালই চমকেছেন।

সময়টা তখন গৌধুলির। ফাহমান কাজের ফাঁকে ফাঁকে বারবার ফোনে সময় দেখছে। কাজপাগল ডক্টর আরিস সেটা লক্ষ্য করলেন। তিনি তখন তার আন্ডারে থাকা অন্য আরও ইন্টার্ন ও ফাহমানকে নিয়ে ক্রিটিকাল এক কেসের ডিসকাশন করছিলেন। ফাহমানকে অমনোযোগী দেখে বললেন ‘ আপনার কি খুব বেশি তাড়া আছে ডক্টর ফাহমান ? ‘

ফাহমান দ্রুত ফোন পকেটে রাখলো। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললো ‘ নো স্যার। ‘ ডক্টর আরিস সরু চোখে ফাহমানকে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর মনে মনে ভাবলেন ‘ এই বয়সটা আমিও পার করে এসেছি। প্রেমের রং মনে লাগলে সময় এমন স্থিরই মনে হয়। মনে হচ্ছে যেন সেদিনই লামিয়ার সঙ্গে প্রেমের শুরু আর আজ বিয়ের পাঁচ বছর কেটে গেলো। অথচ সময়টা যেন এখনও পাঁচ বছর পুরোনো সুতোতেই আটকে আছে। সত্যিই সময়টা কত দ্রুত কেটে যায় তাইনা ? ‘

‘ ডক্টর ‘

ইন্টার্ন মিরাজের ডাকে বাস্তবে ফিরলেন ডক্টর আরিস। হাতে থাকা কেস ফাইল বন্ধ করে বললেন ‘ ওকে গাইজ তাহলে বাকি ডিসকাশন কাল হবে। ‘ তারপর ঘড়ির ডায়ালে চোখ বুলিয়ে বিড়বিড় করে বললেন ‘ ইটস অলরেডি ফাইভ থার্টি। সাতটার আগে বাড়ি পৌঁছতে না পারলে মা মেয়ের ভাষণ শুনতে হবে। ‘

বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে ফাহমান। মস্তিষ্কে চলছে হরেক রকমের চিন্তা। নূপুর কন্যা আর তার প্রেয়সী বাগান কন্যা দুজনেই এক। তবুও সে পারেনি নূপুর কন্যাকে চিনতে। এতটা কাছ থেকে দেখেও চিনতে পারলো না। সেদিন যে হসপিটালে প্রথম দেখলো এরপর আর নূপুর কন্যাকে সে দেখেনি। মাত্র একবার দেখেছে বলেই কি চিনতে পারেনি ? কিন্তু এতটা কাছ থেকে দেখেও কিভাবে সম্ভব চিনতে না পারা ?

ফাহমানের মনে হলো এজন্যই কি তবে ঝুমুরকে নিয়ে ভাবলে সেই ভাবনা আপনিতেই নূপুর কন্যাতে গিয়ে ঠেকত ? তার জন্যই কি তার ভাবনায় বারবার একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাচ্ছিল নূপুর কন্যা আর ঝুমুর ? তবে কি এই কারণেই সে একই সঙ্গে দুজনের প্রতিই দুর্বল হওয়ার মতো অবিশ্যম্ভাবী কাজটা করে বসেছিল ? যদিও নূপুর কন্যার প্রতি সেই দুর্বলতা ঝুমুরের প্রতি ভালোবাসার কাছে আর টিকেনি তবুও তো নূপুর কন্যার টানা টানা সেই চোখে সে যে মুগ্ধ হয়েছিল তাতো আর মিথ্যে নয়। নূপুর কন্যার আষাঢ়ে মেঘের মতো ঘন চুলেও তো হারিয়ে গিয়েছিল সে।

তবে ফাহমান এটা বুঝতে পারছে না ঝুমুর কেন জানায়নি সে নূপুর কন্যা ? সে কি জানতো না তার হারিয়ে যাওয়া নূপুর ফাহমানের কাছে আছে ? না জানলে বুঝলো কি করে ফাহমানের কল্পনার সেই নূপুর কন্যা সে নিজেই ? তাছাড়া নিজেই বা কেন ফাহমানের নূপুর কন্যাকে নিয়ে করা সেদিন রাতের প্রশংসায় ওভাবে রেগে গেলো ? নিজের প্রতি নিজেরই হিংসা কেন ?

এত এত কেনর উত্তর নেই ফাহমানের কাছে। এতগুলো প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার একমাত্র উপায় ঝুমুর। একমাত্র ঝুমুরই পারে তার মনের কৌতূহল মেটাতে। ফাহমান পুলকিত, কখন যে বাড়ি পৌঁছে মেয়েটার মায়া মায়া মুখটা দেখবে সেই তর সইছে না তার। আজ যেন ফাহমানকে অদ্ভুত ভূতে পেয়েছে। হুট করে মনে হচ্ছে যদি ঘরে ফিরেই ঝুমুরের মুখটা দেখতে পেত। যদি দেখতে পেত ঝুমুর শরবত হাতে তার জন্য অপেক্ষা করছে। যদি খেতে গিয়ে দেখতে পেত মায়া মায়া মুখের সেই মেয়েটি তার জন্য প্লেটে খাবার সাজিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তবে কতই না ভালো হতো।

—-

বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে আছে ফাহমান। বারান্দায় একবার উকি মেরেছিল কিন্তু ঝুমুরের ঘরের বাতি তখনও নিভানো। সারাদিনের ক্লান্তিতে কি মেয়েটা ঘুমিয়ে গেলো নাকি এখনো ঘরেই এসে সারতে পারলো না ? কে জানে। ফাহমানের ভাবনার মাঝেই যান্ত্রিক শব্দে ফোন বেজে উঠলো। কলার আইডি দেখে ফাহমানের অধর কোণে হাসি ফুটে উঠেছে। ফাহমান নিঃশব্দে হেসে কলটা রিসিভ করলো। ভেসে এলো ওপারের মানুষটার রিনরিনে কণ্ঠ ‘ আমাদের প্রেমটা হয়েছে কি ডাক্তার সাহেব ? ‘

ফাহমান নিঃশব্দে হাসলো। বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। ফোন কানে অপর পাশে ঝুমুরও দাড়িয়ে আছে। ফাহমান বলল ‘ হয়েছে প্রিয়তমা। এখন শুধু বর্ষায় আপনার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভেজা বাকি। শীতের রাতে কম্বল নিয়ে ঝগড়া করা বাকি। আলসেমি করে মশারী টাঙানো নিয়ে দুজনের কাড়াকাড়ি বাকি। প্রচন্ড গরমে ছাদে খোলা হাওয়ায় বসে জোছনা বিলাস বাকি। আরও অনেক কিছু বাকি নূপুর কন্যা। ‘

‘ নন্দন কাননে দুজনে মিলে গাছ লাগাবো। আপনি আমার ছবি করবেন আর আমি আপনার জন্য গিটার নিয়ে গান বাঁধবো। আপনার ঘরে চার ছবির ফ্রেমের মাঝে যেই জায়গা আছে, সেখানে আমাদের যুগল ছবি থাকবে। আপনার খাটের পিছনটায় বিশাল দেওয়াল জুড়ে আমাদের বিয়ের অয়েল পেইন্টিং থাকবে। এখনও অনেক ইচ্ছে পূরণ বাকি ডাক্তার সাহেব। আমার ইচ্ছেগুলো পূরণ করবেন তো ? ‘

‘ করবো, দুজনে মিলে ঘর সাজাবো। মাকে নিয়ে আমাদের সংসার হবে। সেই সংসারে হৈমন্তী আসিফও থাকবে। হয়তো হৈমন্তী সবসময় আমাদের কাছে থাকতে পারবে না তবে আমাদের পাঁচজনের সংসারটা ছোট হলেও সুখের হবে। ‘

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে