নূপুর বাঁধা যেখানে পর্ব-১৪+১৫

0
862

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-১৪
#মিফতা_তিমু

ঝুমুর হৈমন্তীদের বাসায় ঢুকে হতবাক। সমীরণে বিরিয়ানির ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ এই রাত বিরাতে বিরিয়ানি কেন ? ঝুমুরকে দরজা খুলে দিয়েছিল হৈমন্তী। দেখে দরজায় মাথা ঠুকে নাটকীয় ভঙ্গিতে মেকি কান্না কাদতে কাদতে বললো ‘ এ আমার কি হলো গো। দশ মাস দশ দিন পেটে ধরা মা আজ আমার বান্ধবীর আগমণ উপলক্ষে বিরিয়ানি রাধছে। অথচ আমি বললে কখনও রাধে না। মাত্র এক পলকে পর হয়ে গেলাম। এই বুঝি ছিল আমার কপালে ? ‘

মেয়ের এই নাটকীয় কথাবার্তা সব রান্নাঘর থেকে শুনলেন মারিয়াম। গলা চড়িয়ে বললেন ‘ এত নাটক না করে মেয়েটাকে ঘরে ঢুকতে দে। ওকে নিয়ে ফাহমানের ঘরে বসা। নিজের ঘরের অবস্থা তো কাকের বাসার মতো করে রেখেছিস। ঘরটা গুছিয়ে তারপর ঝুমুরকে ঢুকাবি। খবরদার যদি আগে ঢুকিয়েছিস। এক অকর্মা মেয়েরে জন্ম দিলাম আমি। না পারে কাজ আর না পারে কিছু। ‘

হৈমন্তী মায়ের কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিল। এমনিতেও মায়ের কথার ধার ধারে না সে। সেখানে এ তো ওর প্রিয় সখী। সখীর সামনে মায়ের এত কথা কানে তোলা মানেই মায়ের কথাগুলো যে চিরন্তন সত্য সেটা মেনে নেওয়া। যেটা হৈমন্তী একেবারেই করবে না। তাই ও ঝুমুরের হাত টেনে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল।

‘ দেখলি আমার মা তোর আসার খুশিতে বিরিয়ানি রাধছে এই রাতে। কত করে বললাম ঝুমুর রাতে কার্বোহাইড্রেট খায় না। কিন্তু ওই মহিলা শুনলে তো। এমন ভাব করছে যেন তার মেয়ের বান্ধবী না বরং ছেলের বউ এসেছে। ‘

ঝুমুর হৈমন্তীর কথা শুনলো। অসস্তিতে গাট হয়ে আছে সে। হৈমন্তীর হাতে চাপড় মেরে চোখ রাঙালো। এই মেয়ের কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। মুখে যা আসে তাই বলে বসে। বলার আগে একবারও এটা ভাবলো না কথাটা তার মায়ের কানে গেলে কি ভেবে বসবে। আসলেই ওর কোনো বুদ্ধি নেই।

হৈমন্তীর কথায় আবারও ঝাড়ি মারলেন মারিয়াম। রান্নাঘর থেকেই বললেন ‘ একদিন এসব খেলে কিছু হবে না। অত ডায়েট ফায়েট করতে হবে না। এসব আমার বাসায় চলবে না। ডায়েট করবে তো ? সে ওর বাসায় গিয়ে করুক। আমি আমার বাসায় অত মেপে মেপে খেতে দিবো না। মেয়ে বাপের বাড়ি থাকতে এত মেপে খেলে বিয়ের পর শশুড় বাড়ি গিয়ে কি করবে ? ‘

মায়ের ঝাড়ি খেয়ে এবার আর হৈমন্তী কোনো বেফাঁস কথা বললো না। চুপি চুপি পা ফেলে ঝুমুরকে নিয়ে ভিতরের দিকে গেলো। ঝুমুরকে ফাহমানের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো ‘ তুই ভাইয়ার ঘর ঘুরে ঘুরে দেখ ততক্ষণে আমি আমার ঘরটা গুছিয়ে ফেলছি। বেশিক্ষন লাগবে না। মাত্র পনেরো মিনিট। ‘

হৈমন্তীর কথায় ঝুমুর মাথা নেড়ে সায় দিলো। হৈমন্তী ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। হৈমন্তী প্রস্থান করতেই ঝুমুর আসলেই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো ফাহমানের ঘর। ফাহমানের ঘরে তার ঘরের মতো অত বিলাসবহুল জিনিসপত্র নেই। একেবারেই ছিমছাম ঘর। একটা সিঙ্গেল খাট, একটা পড়ার টেবিল। টেবিলের পাশে থাকা শেলফে সারি সারি মোটা বই রাখা। ঘরের এক কোণায় ড্রেসিং টেবিল আর আলমারি রাখা।

ঝুমুরের নিজের ঘরের তুলনায় ফাহমানের ঘর নিতান্তই সাধারণ। হাতে গোনা কয়েকটা জিনিস। অথচ ঝুমুরের নিজের ঘরে তুলনামূলক অনেক কিছুই আছে। ঝুমুর ভেবেছিল একমাত্র তার ঘরেই হয়তো সব থেকে কম জিনিস। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ফাহমানের ঘরে তো তার থেকেও কম জিনিস।

ফাহমানের ঘরে আসবাব পত্র কম হলেও সব সুন্দর মতো গোছানো। ঘরের বড় দেওয়াল যার সামনে সিঙ্গেল খাট পাতা সেখানে গোটা চারেক ফটো ফ্রেম আছে। একটা ফ্রেমে ফাহমানের মা বাবার ছবি, আরেক ফ্রেমে হৈমন্তী আর ফাহমানের ছোটবেলার ছবি। তৃতীয় ফ্রেমে ফাহমানের মা বাবাসহ তার আর হৈমন্তীর ছবি এবং চতুর্থ ফ্রেমে ফাহমানের বাবা ছাড়া ওদের তিন মা ছেলে মেয়ের ছবি। ছবিটা বোধকরি ফাহমানের বাবা মারা যাওয়ার পরের ছবি।

ফাহমানের ঘরটা মাঝারি ধরনের অথচ এত বড় দেওয়াল জুড়ে মাত্র চারটা ফটো ফ্রেম। ফ্রেমগুলোও এমনভাবে রাখা যে মনে হচ্ছে আরেকটা ফটো ফ্রেম রাখা বাকি। চারটে ফটোফ্রেমের মাঝে বিস্তর জায়গা যেখানে আরেকটা ফ্রেম রাখা যাবে। হয়তো আরেকটা ফ্রেম রাখার জন্যই জায়গাটা খালি রাখা। এই ইউনিক আইডিয়াটা ঝুমুরের পছন্দ হলো। কি সুন্দর চার দিকে চারটা ফ্রেম আর মাঝে আরেক ফ্রেম রাখার জায়গা।

ঝুমুর ঘর দেখতে দেখতে একসময় ফাহমানের পড়ার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। ফাহমানের পড়ার টেবিলটাও সুন্দর করে গোছানো। দেখেই বোঝা যায় অনেক গুছানো মানুষ সে। ঘরের প্রত্যেকটা কোণায় যত্নের ছোঁয়া। ডাক্তারি করেও যে নিজের ঘরদোর গুছিয়ে রাখে এই তো অনেক।

সব ছেলেরা আবার গুছানো হয় না। কিছু কিছু ছেলে যে অগুছালোও হয় সেটা ফারুককে দেখলেই বোঝা যায়। হাসপাতালে যাওয়ার সময় যেই লঙ্কা কান্ড বাঁধিয়ে যায় সেটা দেখলে নির্ঘাত যে কেউ বুকে হাত রেখে শুয়ে পড়বে। এই ব্যাগ গুছাবে তো এই শার্ট শরীরে গলাবে। আবার এই নাস্তা দেওয়ার জন্যও তাড়াও দিবে। ফারুক হয়তো ঝুমুরের সম্পর্কে মামা কিন্তু ঝুমুরের মতো তার মধ্যে কোনো ধীরস্থিরতা নেই। সে সবসময় তাড়াহুড়োয় থাকে যেটা ঝুমুরের মাঝে একদমই নেই। তবে শান্তশিষ্ট ঝুমুর যদি কোনওদিন ভুলক্রমেও একটু হঠকারিতা করে তবেই হয়েছে। সেদিনই তার কাজে রাজ্যের সব ভুল এসে জড়ো হয়।

যাক ফারুকের বন্ধু হয়েও যে ফাহমান অন্তত গোছালো মানুষ এতে শান্তি পাওয়া গেলো। নাহলে ওই ছেলেও যদি ফারুকের মতো হতো তাহলে আর বলতে হতো না। ঝুমুর নিজের ভাবনার মাঝেই মারিয়ামের ডাক পেলো। তিনি ঝুমুরকে ডাকছেন। ঝুমুর পা বাড়ালো দরজার দিকে। তবে যেতে যেতে তার নজর হঠাৎ আটকে গেলো পড়ার টেবিলের উপর থাকা পেন হোল্ডারটায়।

ফাহমানের টেবিলের উপর থাকা পেন হোল্ডারে কি সুন্দর দুলছে ঝুমুরের রুপোলি নূপুরখানা। ঝুমুর সেই নূপুর দেখে ভ্রু কুচকে ফেলেছে। হাত এগিয়ে নূপুরটা হাতে তুলে নিলো সে। মনে হচ্ছে নূপুরটা তার। ঝুমুর উল্টে পাল্টে দেখলো একবার। পাওয়া গেলো নূপুরের এক জায়গায় একটু ভাঙ্গা। হ্যাঁ এটা তো তারই হারানো নূপুর।

কিন্তু ঝুমুর এটা ভেবে অবাক যে তার হারিয়ে যাওয়া নূপুর ফাহমানের কাছে কি করে গেলো। নূপুর তো হারিয়ে গেছিলো। হঠাৎ বিদ্যুৎপৃষ্ট ভাবে ঝুমুরের মনে পড়লো মিস তানিয়া শাহজাহানের ডেন্টাল চেকআপের জন্য সে যেই হসপিটালে গিয়েছিল ফাহমান তো বর্তমানে সেখানেই আছে। হৈমন্তী নিজেই একদিন কথায় কথায় বলেছিল।

তারমানে!! তারমানে সেদিন ঝুমুরের যেই মানুষটার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল সে ফাহমানই ছিল কারণ রুপোর নূপুর দেখলেও লোকে চুরি করে। সুতরাং লোকটা নিশ্চই ফাহমান ছিল যে ঝুমুরের পা থেকে নূপুর খুলে যাওয়া মাত্র সযত্নে তা তুলে নিয়েছিল। কিন্তু নূপুর পেয়ে থাকলে ফিরিয়ে দিল না কেন ? নিজের প্রশ্নের উত্তর পেলো না ঝুমুর। ফাহমান ইতিমধ্যে ঘরে ঢুকেছে। হাসপাতাল থেকে সবে ফিরেছে সে।

ঘরে ঝুমুরকে আবিষ্কার করবে এটা ভাবেনি ফাহমান। সে ঘরে ঢুকে ভুত দেখার মতো চমকে উঠেছে। এই মুহূর্তে ঝুমুর তার ঘরে থাকবে এই আশা সে করেনি। চমকিত সে লক্ষ্য করলো ঝুমুরের হাতে নূপুর কন্যার সেই হারিয়ে যাওয়া নূপুর যেটা সে সযত্নে আগলে রেখেছিল। ঝুমুরের হাতে প্রিয় মানুষটার প্রিয় জিনিস দেখে খুব একটা ভালো লাগলো না ফাহমানের। ছো মেরে নিয়ে নিলো ঝুমুরের হাত থেকে।

ফাহমানের এই অতর্কিত আক্রমণ ঝুমুর আতকে উঠলেন। সে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে ফাহমান পানে। তবে ফাহমান সেসব না দেখে অসন্তোষ ভরা গলায় বললো ‘ কারোর জিনিস না বলে ধরা উচিত নয় এটা কি তোমার জানার বাহিরে ? ‘
ঝুমুর চমকালো, ফাহমান তার নূপুর ধরার ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয়নি। কি অদ্ভুত!! নিজের জিনিস নিজের ধরতেই অনুমতি নিতে হবে। অবশ্য ফাহমানকেও দোষ নেওয়া যায় না। সে নিশ্চই জানে না নূপুরটা ঝুমুরের। জানলে তো ফিরিয়েই দিতো।

ঝুমুর বললো ‘ না মানে আপনার ঘরে নূপুর দেখে অবাক হয়েছিলাম। আপনি ছেলে মানুষ কিন্তু নূপুর তো মেয়েদের। আচ্ছা নূপুরটা কার ডাক্তার সাহেব ? ‘

ঝুমুরের কথায় হঠাৎ ফাহমান অদ্ভুতরকম ভাবে হাসলো। তার দৃষ্টি সামনে দাড়িয়ে থাকা অষ্টাদশী কন্যার দিকে। চোখে পড়ছে তার উত্তর জানার জন্য বাগান কন্যার চোখে মুখে প্রকাশ পাওয়া উদ্বেগ। সে হেসে বললো ‘ এই নূপুর এক নূপুর কন্যার। রূপকথার পরীর মতো ঘন যার কালো কুচকুচে চুল আর হরিণের মতো টানা টানা চোখ তার। ‘
ফাহমানের কথায় ঝুমুর যেন অদ্ভুত প্রশান্তি পেলো। ফাহমান তার চুল আর চোখ নিয়ে প্রশংসা করলো অথচ এমন প্রশংসা সে কতই না শুনেছে। কোথায় তখন তো তার এতটা ভালো লাগেনি ?

কিন্তু ঝুমুরের হঠাৎ মনে হলো ফাহমান তো তার নূপুর কন্যার প্রশংসা করছে, কোনওদিন তো ঝুমুরের প্রশংসা করেনি। যদিও দুজন একই সত্তা কিন্তু ফাহমান তো আর সেটা জানে না। তার কাছে নূপুর কন্যা আর ঝুমুর দুজনে আলাদা মানুষ। ফাহমান যতটা আনন্দ নিয়ে নূপুর কন্যার রূপের বিবৃতি দিচ্ছে,প্রশংসা করছে ততটা আনন্দ নিয়ে কখনও ঝুমুরের সঙ্গে কথাও বলেনি। তবে কি ঝুমুর রুপি নূপুর কন্যাকে সে পছন্দ করে আর আসল ঝুমুরকে সে দেখতেই পারে না ?

ঝুমুরের এবার যেন বুকের বা পাশটায় চিনচিনে ব্যাথা উঠলো। ফাহমান তার এক সত্তাকে পছন্দ করে অথচ আরেক সত্তাকে দেখতে পারে না ভেবেই চিনচিনে ব্যাথাটা হু হ করে আরও বাড়লো। একজনের রুপে মুগ্ধ হয়ে তার হারিয়ে যাওয়া নূপুর সযত্নে তুলে রাখে আর আরেকজনকে পেলেই খোঁচা মেরে কথা বলে। এ কেমন বিরহ যন্ত্রণা। ফাহমান ঝুমুরকে পছন্দ করে না অথচ শুধুমাত্র টানা টানা চোখ দেখতে পাওয়া সেই নূপুর কন্যা যে কিনা আদতে ঝুমুরেরই আরেক সত্তা তাকে পছন্দ করে। যদিও তারা একজনই কিন্তু ফাহমানের মতে তো তারা দুজন।

ফাহমান তার আসল সত্তাকে পছন্দ করে না ভেবেই ঝুমুরের গলায় কাটার মতো বিধলো। ও ম্লান গলায় বলল ‘ সে কি এতটাই সুন্দর ? ‘
ফাহমান মোহাচ্ছন্ন গলায় ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো ‘ হুম, টানা টানা চোখের প্রসাধনীবিহীন মুখের গোলাপি রাঙা শাড়িতে খোলা চুলের নূপুর কন্যা আমার কাছে স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক নাম না জানা অপ্সরী। আমার চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী সে। ‘

এবার ঝুমুরের কিঞ্চিৎ রাগ হলো। ছেলেটা তার সামনে দাড়িয়ে অন্য মেয়ে লোকের প্রশংসা করছে তাও আবার রসিয়ে রসিয়ে মুগ্ধ গলায়। এর কি এক ইঞ্চি পরিমাণ বুদ্ধিও নেই ? এই মানুষটা কি আসলেই জানে না কোনো মেয়ে লোকের সামনে দাড়িয়ে অন্য কারোর প্রশংসা করতে নেই ? এরকম করলে সেই মেয়ের কষ্ট হয়। আসলে এই ছেলের কাছ থেকে বেশি আশা করাও ভুল। থাকুক সে তার নূপুর কন্যাকে নিয়ে, তাতে ঝুমুরের কি ? তার রূপের প্রশংসা সে সারাজীবন শুনে এসেছে কাজেই এই অর্বাচীন ডাক্তার সাহেবের কাছ থেকে তার প্রশংসা শোনার কোনো প্রয়োজন নেই।

‘ মনে হচ্ছে আপনার নূপুর কন্যা কুইন এলিজাবেথ। তাহলে ভাবতে থাকুন তাকে নিয়ে। সুযোগ হলে তাকে খুঁজে বের করে বিয়েও করে নিতে পারেন। আমি গেলাম, মনি ডাকছে। ‘ কথাগুলো গম্ভীর অথচ নিচু গলায় বলে ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেলো ঝুমুর।

ফাহমান ঝুমুরের ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে যাওয়া দেখলো। আনমনে বললো ‘ নূপুর কন্যা যদি কুইন এলিজাবেথ হয় তবে তুমি, অঙ্গনা ঝুমুর আমার জান্নাতের হুর। নূপুর কন্যা যতই বিউটি কুইন এলিজাবেথ হোক না কেন আমার চোখে তুমিই সেরা। তোমার ঐ কাজল পড়ানো মদিরাক্ষী আমি আমার তুচ্ছ চোখ মেলে দেখেছি ঝুমুর। ‘

—-

রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে হৈমন্তী আর মারিয়ামের সঙ্গে ওদের ঘরে শুয়েছে ঝুমুর। হৈমন্তীদের ঘরের বিছানাটা বেশ বড়ই বলা চলে। পাতালে শুলে আরাম করে হাত পা মেলে শোয়া যায়। কিন্তু ঝুমুরের ঘুম আসছে না। একটু আগে রাগ দেখিয়ে ফাহমানের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেও এখন তার মন খারাপ। ফাহমান তার রেগে যাওয়া ব্যাপারটা বুঝে তো নেই উল্টো কথাও বলবার চেষ্টা করেনি। নিজের আনন্দে পেট পুরে বিরিয়ানি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আরামে ঘুমোতে গেছে সে।

প্রথম প্রথম রাগে দিশেহারা হয়ে ফোঁসফোঁস করলেও ক্রমশ রাগ উড়ে গিয়ে মন খারাপের মেঘ এসে জড়ো হচ্ছে ঝুমুরের মনে। ভিতরটা আনচান করছে। মনে হচ্ছে যার উপর রাগ দেখিয়ে মুখ হতে একটা শব্দও বের করলো না সে তো রাগ করার ব্যাপারটা ধরতেই পারেনি। এ কার উপর রাগ দেখালো যে তার রাগের ব্যাপারটাই আঁচ করতে পারলো না ?

তাছাড়া ঝুমুর রাগও বা করলো কোন অধিকারে ? ফাহমানের উপর তার কিসের অধিকার ? ফাহমানের উপর কোনো অধিকার নেই তার। তবে কেন অধিকার ছাড়া এরকম একটা কাজ করলো সে ? ঝুমুর এমন করার মানুষ না। ঝুমুর জানে না, জানে না… জানে না, সে কিছুই জানে না।

ঝুমুর অস্থির চিত্তে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। শুয়ে শান্তি পাচ্ছে না সে। নিঃশব্দে পায়ে স্লিপার গলিয়ে ঘর ছাড়ল সে। ফাহমানদের বসার ঘরে এসে দাড়ালো। বসার ঘরের জানালা থেকে স্পষ্টতর ভাবে ওদের বাগানবাড়ি দেখা যায়। ঝুমুর দেখলো তার পাশের ঘরটার পাশে, ফারুকের ঘরে আলো জ্বলছে। ফারুক বিয়েতে যায়নি। ওসব বিয়ে টিয়ে তার আমলে নেই। বিয়ে বাড়ির হাজার কোলাহল তার পছন্দ নয়।

ফারুক সচরাচর দশটার দিকে ফিরে আসে কারণ তার শিফট শুরু হয় দেরিতে। ঠিক এই কারণেই ঝুমুরকে হৈমন্তীদের বাড়িতে রাখা কারণ সারাদিন সে একা থাকবে। যদিও সে বলেছিল ম্যানেজ করে নিবে কিন্তু মনোয়ারা বেগম শুনেননি। ফিরতে দেরি হবে বিধায় ফারুকের জন্য রাতের খাবার দিয়ে এসেছে হৈমন্তী। কিন্তু কাল সকালে ফারুক এই বাড়িতেই খাবে। কাল সাপ্তাহিক ছুটির দিন কাজেই ফারুক, ফাহমান দুজনেই বাড়িতে থাকবে। মনোয়ারা বেগমরা ফিরতে ফিরতে বিকেল পেরিয়ে যেতে পারে।

মনোয়ারা বেগম আড়ালে আবডালে জিজ্ঞেস করেছিলেন ঝুমুর যাবে কিনা। কিন্তু কোচিং করতে হবে বলে ঝুমুর না করে দিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে গেলে হয়তো এসবের মুখোমুখি হতে হতো না। ঝুমুরের প্রথমে মনে হয়েছিল সে যদি ফাহমানকে বলে দেয় যে সেই নূপুর কন্যা তাহলে ফাহমান ওকে তার মনের কথা বলবে, বলবে নিজের ভালো লাগার কথা। পরে মনে হলো ফাহমান তো তাকে নূপুর কন্যা হিসেবে পছন্দ করে, ঝুমুর হিসেবে নয়। ঝুমুরের অন্তত অমন ভালোবাসার দরকার নেই।

ভালোবাসা!! কি আশ্চর্য!! ঝুমুর ভালোবাসার কথার ভাবছে ? বুঝাই যাচ্ছে এই ফাহমান ওর মাথা পুরো খারাপ করে দিয়েছে। নাহলে ঝুমুর এরকম ছিল না। এসব নিয়ে সে কোনওদিন ভাবেনি। ভাবার সুযোগ কোথায় ? পড়াশোনা নিয়ে সে বরাবরই অনেক ব্যস্ত।

ঝুমুরের শান্তি লাগছে না। সে সুইচ টিপে বসার ঘরের টিমটিমে আবছায়া নীলচে বাতি জ্বালিয়ে দিলো। পরনে তার সোয়েট শার্ট আর ঢোলা ট্রাউজার। ঝুমুর বরাবরই এমন ঢিলেঢালা জামা কাপড় পড়ে। কারণ ফিটিং জামা কাপড়ে তার আনকমফোর্ট ফিল হয়। ঝুমুর এগিয়ে গিয়ে বিশালাকার সোফায় গা এলিয়ে দিল। মাথার নিচে তার কুসুন রাখা। যেহেতু ঘরে ঘুম আসছে না কাজেই এখানে শোয়া যায়। যদি ঘুম এসে যায়। কে বলতে পারে।

~চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#নূপুর_বাঁধা_যেখানে-১৫
#মিফতা_তিমু

ঘুম আসছিলো না ফাহমানের। বুকটা কেমন ধুকপুক করছে। ভিতরটা উচাটন, শুধু মনে হচ্ছে পাশের ঘরে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটা আছে। আছে তার অভিমানী প্রেয়সী। অভিমানী কেন বললো ? ঝুমুর ভেবেছিল সে বুঝতে পারেনি যে নূপুর কন্যার প্রশংসা করাতে ঝুমুর রেগে গেছে। ফাহমান অত বোকাও নয় যে নারী মন বুঝবে না। হতে পারে নারী মন বোঝা সবার কম্য নয় কিন্তু কেউ কেউ পারে, কেউ কেউ পারে শক্তপোক্ত মুখের আড়ালে অভিমানের গভীরতা বুঝে নিতে।

কিন্তু ঝুমুরের রাগ, অভিমান টের পেয়েও ফাহমান কিছু বলেনি। কেন বলেনি সেটা তো সে নিজেও জানে না। শুধু এটা জানে ঝুমুরের রাগে ঈষৎ লাল হয়ে যাওয়া ফোলাফোলা মুখটা দেখতে তার ভালো লাগছিল। তাই ঝুমুরের রাগ ভাঙায়নি। যদি একদিন রাগিয়ে দিয়ে ওই ফুলে যাওয়া মুখ দেখার সুযোগ পায় তবে থাকুক না মানুষটা রাগ করে। পরে নাহয় সুযোগ বুঝে রাগ ভাঙিয়ে নিবে।

আসলে ফাহমান নিজেকে নিজেই বুঝতে পারছে না। ঝুমুর তার জীবনে আসার পর থেকে অদ্ভুত সব আচরণ করছে সে। কখনও ঝুমুরের বংশ মর্যাদা, প্রতিপত্তির কথা ভেবে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে তো পরমুহূর্তেই ঝুমুরের প্রেমে মত্ত উন্মাদ প্রেমিকের মতো তাদের ভবিষ্যৎ লাল, নীল সংসারের স্বপ্ন সাজাতে বসে যাচ্ছে। এ হয়েছে তো হয়েছে কি তার ?

তবে যাই হয়ে থাকুক না কেন ঝুমুরের প্রেমে মত্ত নিজের এই ছন্নছাড়া জীবনটা ফাহমানের দারুন লাগছে। এতকাল সে বড্ড গোছালো জীবন পাড় করেছে। এখন কোনো অতিথি পাখি এসে যদি তার গোছালো জীবনটাকে ক্ষণিকের জন্য অগোছালো করে দেয় তো তাতে ক্ষতি কিসের ? হোক না একটু অগোছালো জীবনটা। জীবনের গতি বদলাবে, বদলাবে একঘেয়েমি ভাবটাও। কি লাভ ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজের বর্তমানটা নষ্ট করার ? ভবিষ্যৎ নাহয় ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিবে। দেখা যাক নিয়তি কি খেলে।

অস্থির মন নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো ফাহমান। ওই ঘরে তার মন টিকছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ। এখনই পানি খেয়ে তেষ্টা নিবারণ করা প্রয়োজন। ফাহমান ধীর কদমে এগিয়ে এলো খাবার ঘরে। দেখলো বসার ঘরে জ্বালানো নীলচে আলো হালকা ছায়া ফেলছে খাবার ঘরে। ফাহমানের মনে হলো বসার ঘরের লাইট নিভানো প্রয়োজন। তার আগে পানি খেয়ে তৃষ্ণা মিটাতে হবে।

তেষ্টা মিটিয়ে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো ফাহমান। ঘরে ঢুকে সে দেখলো সোফায় কেউ একজন গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। বসার ঘরের জানালার পর্দা হালকা ফাঁক করা। সেই ফাঁক দিয়ে ঠিকরে পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঢুকছে। চাঁদের আলোয় আবছা ভাবে ফাহমান দেখলো সোফায় ঝুমুর শুয়ে আছে। তার লম্বা কেশরাশি ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে।

ফাহমান ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। নিঃশব্দে ঝুমুরের পাশে কাঠের টি টেবিলে বসলো।
মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো ঝুমুরের নিষ্পাপ মুখ পানে। ঘুমোলে তো জগতের সবথেকে নিষ্ঠুর মানুষটাকেও নিষ্পাপ লাগে। সেখানে এ তো তার প্রেয়সী। চাঁদের আলো ঝুমুরের চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। অবিন্যস্ত চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে। মেয়েটা বড্ড দায়িত্ব জ্ঞানহীন নিজ সম্পর্কে। এত সুন্দর চুলগুলো বাঁধেওনি। চুলগুলো বেঁধে বেণী করলে কত ভালই না হতো।

ঝুমুর নিশ্চুপ শুয়ে আছে সোফার উপর। চোখ দুটো বুজে রাখা। মুখের উপর পড়ে আছে ছোট চুলগুলো। চুলের জালায় অতিষ্ট ঝুমুর চোখ মুখ কুচকে ফেলছে বারবার। ফাহমান হাসলো। খানিকটা এগিয়ে ঝুমুরের চুলে হাত রাখলো। চুলগুলো গুঁজে দিলো কানের পিছনে।

কারোর উষ্ণ হাতের স্পর্শে ধীর লয়ে নিজের দৃষ্টি মেলে ধরলো ঝুমুর। তার ঘুম ঘুম ভাব এসেছিল ঠিকই কিন্তু পুরোপুরি ঘুমায়নি সে। তাই কেউ মাথায় হাত রাখতেই ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেছে। হতবাক চোখে সে তাকিয়ে আছে সামনে বসা মানুষটার দিকে। মানুষটা এখনও তার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে আছে শুধুই এক রাশ মুগ্ধতা, স্নিগ্ধতা আর পবিত্রতা। নেই কোনো কাম বাসনা।

ঝুমুরের চকিতে মনে পড়লো যেই মানুষটা একটু আগেই ভিতরের দিকের চার দেয়ালে বন্দী ঘরটায় তার সামনে দাড়িয়ে অন্য এক মেয়ে লোকের রূপের প্রশংসা করছিলো সেই এখন তাকে মুগ্ধ চোখে দেখছে। যেই মানুষটা একটু আগেই অন্যের প্রশংসা করছিলো সে এখন আবার তার দিকেই ঝুঁকে পড়েছে। এ আবার কেমন মানুষ!! একসঙ্গে দুই নৌকোয় পা দিয়ে চলছে।

দুই নৌকা কথাটা মাথায় আসতেই মুহূর্তেই ঝুমুরের দাতে দাত চেপে গেলো। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। শরীরের সমস্ত শক্তি খাটিয়ে তার দিকে ঝুঁকে থাকা ফাহমানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ালো সে। ধাক্কা খেয়ে ততক্ষনে ফাহমান বেসামাল প্রায়। কোনোমতে সামলে নিয়েছে নিজেকে। ফাহমান টেবিলে হাত রেখে স্বাভাবিক হয়ে বসলো। হতবাক দৃষ্টিতে তাকালো ঝুমুরের দিকে।

ফাহমানের বিস্মিত দৃষ্টির পরোয়া করলো না ঝুমুর। দাতে দাত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো ‘ জাস্ট স্টে আওয়ে ফ্রম মি। গো টু হেল উইথ ইউর মিস নূপুর। ‘ কথাগুলো বলেই তড়িৎ গতিতে বসার ঘর থেকে প্রস্থান করলো ঝুমুর। রাগে তার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেছে। শরীর অসম্ভব ভাবে কাপছে। এতটা রাগ তার আগে হয়নি কখনো।

ধুপধাপ পায়ে ঘরে ফিরে এসে নিজের জায়গায় ধুপ করে গিয়ে বসলো ঝুমুর। তার এমন ধুপ করে বসায় মারিয়াম আর হৈমন্তী নড়ে উঠলো। তবে তাদের ঘুম ভাঙলো না। মা মেয়ে বেশ গভীর ঘুম দিয়েছেন। ঝুমুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। এতক্ষণ তার রাগ লাগলেও এখন তার কান্না পাচ্ছে। সেই কান্না এক বুক যন্ত্রণা আর ক্রোধ মেশানো। বুক চিড়ে কান্নাগুলো বেরিয়ে আসছে।

ঝুমুর তার বিসর্জিত অশ্রুগুলো মুছে নিলো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে। আশ্চর্য!! সে কেন কাদঁছে ? কার জন্য কাদছে ? যার জন্য কাদছে সে তো তার মনের খবরই রাখেনি। কাজেই কেঁদেকেটে লাভ নেই ঝুমুর। এখন থেকে নিজেকে শক্ত করতে হবে। সব পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে সাহস নিয়ে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বালিশে মাথা এলিয়ে দিল। চোখ বুজে ঘুমনোর চেষ্টায় মত্ত হয়ে পড়লো।

ঝুমুর ধাক্কা দিয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে যেতেই হৃদয় খন্ডিত এক তীব্র যন্ত্রণা টের পেলো ফাহমান। তার মুখটা বেদনায় নীল হয়ে উঠেছে। ভিতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সবকিছু আবছা লাগছে। ঝুমুর ওর সঙ্গে এমন ধারার রুঢ় ব্যবহার করবে ভাবতে পারেনি সে। মেয়েটার হয়েছে কি ? কেন এমন করছে ? কেন বারবার কাছে এসেও দূরে সরে যাচ্ছে ? কেনই বা উসকে দিয়েও ফাহমানকে কাছে আসার সীমা অতিক্রম করতে দিচ্ছে না ? এতগুলো প্রশ্নের উত্তর জানে না ফাহমান। শুধু এটা জানে ওই কাজল পড়ানো চোখের মায়াবিনীকে না পেলে এত বছরের বসন্ত পাড়ি দিয়ে এই প্রথম প্রেমে পড়াটা ব্যর্থ হবে।

—-

খাবার ঘরে সকলে একত্রিত হয়েছে। ফারুক এসেছে সকালের নাস্তা করতে। তাকে এই সময় দেখে সকলে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই চমকে উঠেছে কারণ ফারুক কোনওদিন হয়তো খাওয়া ভুলে যেতে পারে কিন্তু ছুটির দিনে ঘুমোনো সে কখনো ভুলে না। তবে আজ কেন অভ্যাস ভুলে সকাল সকাল বাড়িতে হাজির ?

ফাহমান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। ঠেস মারা গলায় ফারুকের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিল প্রশ্ন ‘ কি ব্যাপার ? আজ কি সূর্য দিক ভুলে পশ্চিমে উঠেছে ? ‘

ফাহমানের কথায় বিশেষ পাত্তা দিল না ফারুক। সে তার মুখোমুখি বসা ঝুমুরের দিকে দৃষ্টি ফেললো। ঝুমুর নিজের মতো খেতে ব্যস্ত। খাওয়ার সময় সে কদাচিৎই অন্যদিকে মাথা ঘামায়। ঝুমুরকে এহেন শান্ত, নীরব দেখেও অভ্যস্ত ফারুক। কিন্তু ভাগ্নিকে না খোচালে তার আবার পেটের ভাত হজম হয় না। তাই বললো ‘ কিরে বুড়ি ? মন খারাপ ? আম্মু আব্বু সবাইকে নিয়ে তোকে ছেড়ে চলে গেলো বলে খারাপ লাগছে ? আফসোস হচ্ছে পোলাও মাংস খেতে পারলি না ? ‘

ঝুমুর প্রতিউত্তর করলো না। ফারুকের কথায় জবাব দিলে ফারুক সুযোগ পেয়ে আরও খোচাবে। তার থেকে মৌন থাকা শ্রেয়। ঝুমুরকে নীরব দেখলো ফাহমান। ইচ্ছে করছে আগ বাড়িয়ে কিছু একটা বলতে কিন্তু এর উত্তর যে ঝুমুরের দিক থেকে কেমন গতিতে আসবে সেটা জানা নেই। কাজেই কিছু বলার সাহস হচ্ছে না।

‘ ওকে জালিও নাতো ফারুক ভাই। বেচারি খাচ্ছে খাক। তুমি তো জানো ও খাওয়ার সময় কথা বলা পছন্দ করে না। তুমি কি খাবে বলো ? কালকে রাতের অল্প বিরিয়ানি আছে। ওটা খাবে নাকি রুটি খাবে ? ‘ হৈমন্তী বললো।

‘ বিরিয়ানিই দে। বিরিয়ানি থাকতে আলুর ভর্তা চোখে দেখি না আমি। ‘

ফারুকের কথা শুনে ফ্রিজ থেকে বিরিয়ানি নামিয়ে গরম করতে রান্নাঘরে গেলো হৈমন্তী। ফারুক আবারও বললো ‘ থাক থাক এত মন খারাপ করবার প্রয়োজন নেই। যা আজ আমিই তোকে ট্রিট দিবো। তুই,আমি, ফাহমান আর হৈমন্তী রেস্টুরেন্টে যাবো কেমন ? কিরে ফাহমান কিছু বল। আইডিয়াটা কেমন ? ‘

ফারুকের কথায় থতমত খেয়ে গেলো ফাহমান। দ্রুত মাথা নেড়ে বললো ‘ ভালো আইডিয়া তো। এই অজুহাতে তোদের বাইরে যাওয়া হবে। কিন্তু আমাকে আর হৈমকে কেন টানছিস ? ‘
ফাহমানের কথায় আড়চোখে ওর দিকে একবার তাকাল ঝুমুর। ফাহমানের চোখে চোখ পড়ে গেলো তার। অপ্রস্তুত সে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো অন্যদিকে। ফারুক আপনমনেই বললো ‘ ইচ্ছা হয়েছে তাই টানছি। আমার মন, আমার ইচ্ছা। তুই,আমি, ঝুম আর হৈমন্তী মিলে বাহির থেকে খেয়েদেয়ে আড্ডা দিয়ে আসবো বলেছি যখন সেটাই ফাইনাল। এতে তোর তো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। আন্টির কথা যদি বলিস তাহলে আমি অনুমতি নিচ্ছি। ‘

কথাগুলো বলতে বলতে ফারুক মারিয়ামকে ডাকলো। মারিয়াম এসে জানালেন তার কোনো আপত্তিই নেই। এরপর আর কি বলার থাকে। ফাহমানের কাছে রাজি হওয়া ছাড়া উপায় নেই। সে বললেও যে ফারুক শুনবে তাতো নয়। ইতিমধ্যে ফারুকের বিরিয়ানিও হাজির। সে হলো আজমাঈন সাহেবের মত বিরিয়ানী লাভার। বিরিয়ানি তার প্রিয় খাবারের মধ্যে একটা। তাই বাড়িতে বিরিয়ানি রান্না হলে সবার আগে তার পাতেই পড়ে সেটা।

ঝুমুর ফারুকের কথার কোনো প্রতিউত্তর করেনি। হ্যাঁ না কিছুই বলেনি। ফাহমান ঠিক তার অভিপ্রায় বুঝে উঠতে পারছে না। ঝুমুরের চোখ মুখ দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। তার মনে যে কি চলে সে তো খোদ খোদাই জানে। সত্যিই নারী জাতি বড় জটিল। তাদের না যায় বোঝা আর না যায় বোঝানো।

কাপড়ের ব্যাগে সন্ধ্যায় পড়ে বের হওয়ার জন্য পছন্দের জামা নিয়ে বের হয়েছে হৈমন্তী। আজ সে হলুদ রংয়ের জামাটা পড়বে। হলুদের মধ্যে ছোট ছোট সাদা ফুলের ছাপা। ঠিক একই রকমের ড্রেস ঝুমুরেরও আছে। দুই বান্ধবী মিলেঝুলেই কিনেছিল। ভাবলো আজ যখন পড়ার সুযোগ হয়েছে তখন পড়াই যায়। তাই ড্রেসটা এখন লন্ড্রিতে দিবে হৈমন্তী।

লন্ড্রিতে দেওয়ার প্রয়োজন পড়তো না যদি ড্রেসটা সাধারণ সুতি কাপড়ের হতো। ড্রেসটা অন্যরকম সেনসিটিভ কাপড়ের। তাই লন্ড্রিতে দেওয়াই ভালো। লন্ড্রি আবার ওদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে, বড় রাস্তার দিকে। হৈমন্তী দ্রুত পা চালিয়ে লন্ড্রি দোকানে এসে দাড়ালো। লোকটাকে বিকেলে এসে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে টাকা দিয়ে ফিরতি পথ ধরলো। দ্রুত বাড়ি ফিরে বই খাতা নিয়ে বসবে সে। সামনে অ্যাডমিশন, ভালো মতো পড়তে হবে।

হৈমন্তী খটমটে পিচ ঢালা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে পড়া গুছিয়ে নিচ্ছিল। হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকে দেখছে। এসব ব্যাপারে সব মেয়েদের মধ্যেই একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে। সন্দিহান ব্যাপারগুলোতে তাদের এই সিক্সথ সেন্স তাদের সবার আগেই সচেতন করে দেয়। হৈমন্তী খানিকটা ঘাবড়ে গেল। ধীর লয়ে আলকাতরা দেওয়া রাস্তা থেকে মাথা তুলে সামনের দিকে নজর দিল।

রাস্তার ধারে বাইকের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে আসিফ। চোখে কালো রোদ চশমা। পরনে কালো জ্যাকেট আর কালো জিন্স। জ্যাকেটের খোলা চেইনের ভিতর থেকে উকি দিচ্ছে শুভ্র সফেদ টিশার্টখানা। হাতে তার সিগারেট ধরা। খানিক পরপরই সেই সিগারেট মুখে চেপে ধরে সমীরণে সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়াচ্ছে।

আসিফের পাশে দাড়িয়ে আছে তার দুই চার সাঙ্গপাঙ্গ। নাম রিভু, রাজিব আর আমির। আসিফ, পুরো নাম আসিফ জোহান। সে এমপি শিহাব সাহেবের একমাত্র ছেলে। তবে হৈমন্তীর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত এক সম্পর্ক আছে। সে সময় আসলেই জানা যাবে। আমির হৈমন্তীকে হেঁটে আসতে দেখেই আসিফকে ডাকলো। বললো ‘ আসিফ, ভাবি চলে আসছে। ‘

হৈমন্তী তখন আসিফ হতে হাত দশেক কয়েক দূরে দাড়িয়ে। ভয়ে তার শরীরের সমস্ত লোমকূপ শিউরে উঠেছে। আমির আসিফকে কি বলেছে সে ও জানেনা কিন্তু আমিরের কথা শোনা মাত্র আসিফ যখন ওর দিকে বক্র চোখে তাকালো তখনই হৈমন্তীর বুকের ভিতরটা দ্রিমদ্রিম শব্দে দামামা বাজাতে শুরু করলো। শরীরটা অনবরত কাপছে। অবিন্যস্ত চুলগুলো খোলা হাওয়ায় উড়ে চোখে মুখে এসে পড়ছে।

আসিফ আমিরকে কি বললো শুনতে পেলো না হৈমন্তী। তবে আসিফের কথা শোনা মাত্র আমির ওর দিকে এগিয়ে আসছে দ্রুত পদক্ষেপ। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই আমির ওর মুখোমুখি দাড়ালো। চোখ নিচে নামিয়ে বললো ‘ আপনাকে ভাইজান কাছে ডাকছেন। ‘
আমিরের কথা শুনে হৈমন্তী আসিফের দিকে নজর দিল। আসিফ তার সিগারেট টানতে ব্যস্ত। অন্যদিকে আমির চোখ নামিয়ে রেখেছে। হৈমন্তীর দিকে চোখ তুলে তার চোখে চোখ রেখে কথা বলার মতো অসম্ভব এই ক্ষমতা অন্তত তার নেই। আর মনেও হয়না যে কখনও হবে।

আমির আর আসিফ ছোটবেলার দুই বন্ধু। ছোট থেকে দুজনের একসঙ্গেই বেড়ে ওঠা। হয়তো তাদের মাঝে আত্মার মিলটা এতই ছিল যে দুজনের পছন্দও অনেকটা এক রকম। তবে ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক মর্যাদা কোনোটাই এক নয়। আসিফ হলো আমিরের বাবার মালিকের ছেলে। আমিরের বাবা মিনহাজ সাহেব হলেন এমপি সাহেবের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট। তাদের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। ঠিক এই কারণেই আমির আর আসিফও ছোট থেকে খুব ঘনিষ্ঠ। তাদের বন্ধুত্ব অন্যরকম, নিখাদ এক বন্ধুত্ব।

তার জন্যই তো একসময় হৈমন্তীকে নিজের সব ইচ্ছা শক্তি এক করে চাইবার পরও শুধুমাত্র আসিফের জন্য হৈমন্তীর দিকে এখন আর চোখ তুলে তাকায় পর্যন্ত না। হৈমন্তী তার বন্ধুর সম্পত্তি। বন্ধু হয়ে সে কি করে পারে বন্ধুর পিঠে ছুরি চালাতে। তাই যেদিন থেকে হৈমন্তীর প্রতি আসিফের অনুভূতি টের পেলো সেদিন থেকেই নিজ দায়িত্বে তাদের পথ থেকে সরে দাঁড়ালো।

~চলবে ইনশাআল্লাহ্…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে