দুপাতার পদ্ম পর্ব-২৬+২৭

0
557

#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২৬
#Writer_Fatema_Khan

আয়াত মেহেরের হাত ধরে তার দিকে ফেরালে মেহের ভয় পেয়ে যায়। হঠাৎ করে টান দেওয়ায় মেহের আয়াতের হাতের দুই পাশে থাকা টি-শার্ট টা আকড়ে ধরে।
“কি হচ্ছে কি আয়াত?”
“কার এতবড় সাহস মেহের আর তুমিই বা আমাকে কিছু বলনি কেনো?”
“কার সাহস আর আপনাকে কি বলব! হাত ছাড়ুন আমার লাগছে।”
“তুমি কেনো লুকাচ্ছো বলো আমাকে, তুমি একদম ভয় পেয়ো না আমি আছি তো।”
“জ্বরের ঘোরে উলটা পালটা বকছেন আপনি। একটু ঘুমান শরীর ঠিক লাগবে।”
এবার আয়াত রেগে মেহেরকে নিজের কাছে টেনে দুই বাহুতে ধরে বলে,
“তোমাকে কে ছুয়েছে মেহের? এতটা গভীর ভাবে তোমাকে ছোয়ার অধিকার আমি কাউকে দেই নি। আর না তোমার অনুমতি আছে কাউকে দেওয়ার। আমার চুপ করে থাকা বা তোমার থেমে দূরে থাকার সুবিধা অন্তত কেউ নিতে পারে না।”
“ছাড়ুন আমাকে আর এসব আবোল তাবোল বলা বন্ধ করুন।”
আয়াত মেহেরকে ছেড়ে দুই হাতে নিজের চুলে মুঠ করে ধরে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় আছে।
“ঠিক আছে আমিই আবোল তাবোল বলছি, কিন্তু তোমার গলায় কামড়ের দাগ কেনো সেটা জানতে পারি? আর কেই ই বা তোমার এত কাছে ছিলো যে এত গভীর ভাবে ছুয়েছে?”
আয়াতের কথা শুনেই মেহের নিজের গলায় হাত রাখে। তাড়াতাড়ি ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে ওড়না আরেকটু সরিয়ে দেখে সত্যি সত্যি গলায় একটা কামড়ের দাগ৷ মেহের আয়াতের দিকে করুন চোখে তাকায়। মেহের নিজের মনেই ভাবতে থাকে,
“মানে কাল রাতে আয়াতের বলা কথা আয়াতের কিছুই মনে নেই আর না মনে আছে হঠাৎ কিছু মুহূর্তের জন্য কাছে আসার সময়টা।”
আয়াত আয়নায় মেহেরকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,
“কি হলো বলো কে করেছে এটা?”
“যদি বলি কাল রাতে আপনি করেছেন, তাহলে মানবেন?”
“আমি! আমার চিন্তা ভাবনাতেও কখনো এটা আসেনি যে কোনো অধিকার ছাড়া তোমায় ছুতে আর এখানে তো খুব গভীর ভাবে ছোয়া হয়েছে।”
“কাল রাতে আপনি বিকেলের পর আর নিচে নামেন নি সাথে খাবারও খান নি। তাই আমি নিজেই আপনার জন্য রাতের খাবার নিয়ে এসেছিলাম। এসে দেখি আপনার গায়ে অনেক জ্বর। তাই আপনাকে জোর করে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দেই। তারপর হঠাৎ আপনি আমাকে জড়িয়ে করে গলায় মুখ ডুবান৷ এর ফলেই এই অবস্থা আমার গলার। আর কিছু শুনতে চান?”
দাঁড়ানো থেমে খাটের উপর বসে পরে আয়াত৷ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বলে,
“কি করে এমন অন্যায় আমি করে ফেললাম, তাও তোমার সাথে! যেখানে তুমি আগে থেকেই আমাকে ভুল বুঝে বসে আছো আর আমি কিনা আরও ভুল করে বসে আছি।”
“আমি আপনাকে ভুল বুঝি নি, আমি জানি আপনার সাথে আরশির কোনো সম্পর্ক নেই। তবে খারাপ লাগে নি এটা বলব না।”
আয়াতের চোখ যেনো চকচক করে উঠলো। মেহেরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কেনো খারাপ লেগেছে? আমাকে তো তুমি দূরেই ঠেলে দিতে চাও। আমি বেহায়ার মতো পেছনে পরে থাকি। তাহলে তোমার খারাপ লাগছে কেনো?”
“জানি না। তবে আমার এভাবে রিয়েক্ট করা উচিত হয় নি। আর রাতে আপনাকে এই অবস্থায় দেখেও আমার ভালো লাগে নি। হয়তো আমার জন্যই আপনার কাল রাতে এতটা জ্বর এসেছিল। আর আপনি জ্বরের ঘোরেও আমাকে বুঝানোর চেষ্টায় ছিলেন আপনি কিছুই করেন নি।”
“আমি জানি কেনো খারাপ লেগেছে তোমার আর এটাও জানি তুমি নিজেও জানো ঠিক কি কারণে তোমার খারাপ লেগেছে।”
“সবাই ঘুম থেকে উঠে পরবে আমার যাওয়া দরকার।”
মেহের টেবিল থেকে স্যুপের বাটিটা নিয়ে বের হতে গেলে আয়াত তার হাত ধরে ফেলে। তারপর হাত থেকে স্যুপের বাটিটা নিয়ে আবার টেবিলে রেখে দেয়৷
“আয়াত আমার নিচে যাওয়া উচিত এবার। এতক্ষণ সবাই নিজেদের ঘরে থাকলেও এখন সবাই উঠে গেছে হবে।”
আয়াত মেহেরের কানের কাছে এসে বলে,
“আমি তোমাকে এত ভোরে এখানে আসতে বলেছি, বলেছি আমার জ্বর আমাকে স্যুপ বানিয়ে খাওয়াও আমি সুস্থ হয়ে যাব। আমার মনে হয় না আমি এসবের একটাও বলেছি। তবে আসলে কেনো, আর এসেই যখন গেছো আমার সব কাজ শেষ হলেই যাবে।”
‘কি কাজ?”
আয়াত হেসে মেহেরের হাত ছেড়ে সামনে থাকা ওষুধের বাক্স থেমে একটা মলম বের করে মেহেরের সামনে বসে। মেহেরের গলার কাছের ওড়না কিছুটা নিচে নামিয়ে মলম লাগিয়ে দিলো লাল হয়ে যাওয়া কামড়ের যায়গায়৷ মেহের আয়াতের ছোয়ায় কেপে কেপে উঠছে যা আয়াত খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। এমন অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে বের হওয়ার জন্য আয়াত তাড়াতাড়ি মলম লাগিয়ে দেয়। সরে যেতে নিলে আয়াত মেহেরের কম্পমান ঠোঁটের দিকে তাকায়৷ চোখ আটকে যায় সেখানে৷ আয়াত যেনো তলিয়ে যাবে এই কম্পমান ঠোঁটের সাথে। আয়াত নিজেকে সংযত করে উঠে দাঁড়ায়।
“হয়ে গেছে।”
আয়াতের গলার শব্দ শুনে মেহের তাকায় আয়াতের দিকে। তবে কোনো শব্দ ব্যয় করে না৷ মেহেরের কোনো শব্দের সন্ধান না পেয়ে আয়াত পেছনে তাকায়৷ মেহের তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো,
“এতক্ষণ তো যাওয়ার জন্য। মরিয়া হয়ে উঠছিলে এখন যাচ্ছ না কেনো? আমার ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাব। আর তুমিও তো অফিস যাবে তাই না। তাহলে নিচে যাও।”
মেহের এমন কিছুর আশা করে নি। সে উঠে স্যুপের বাটি নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরুতে নিলে আবার আয়াত বলে উঠলো,
“গলার দিকটা ওড়না দিয়ে ভালো করে ঢেকে রাখো, বাড়ির বড়রা দেখলে খারাপ লাগবে তাদের আর কাসফির চোখেও যেনো না পরে। ও পিচ্চি মানুষ কি বলতে কি বলে ফেলবে বাবা আর চাচার সামনে।”
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক বুঝিয়ে সে নিচে চলে গেলো। রান্নাঘরের দিকে যেতে নিলে ওইখানে তার মা আর চাচীকে দেখে বাটি সমেত নিজের ঘরে চলে গেলো মেহের। সে চায় না বাসার কেউ জানুক মেহের এত ভোরে আয়াতের ঘরে ছিলো৷ তারা সবটা বুঝলেও জিনিসটা দেখতে দৃষ্টিকটু লাগে। তাই মেহের নিজের ঘরে এসে গোসলে চলে গেলো। প্রায় আধা ঘণ্টা পর গোসল সেড়ে বের হয়ে মেহের অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নিলো। তারপর মাহিকে ঘুম থেকে তুলে ফ্রেশ করিয়ে নিলো। রান্নাঘর থেমে মাহির খাবার এনে খাইয়ে দিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলো। আরেকবার আয়াতের খোঁজ নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তা আর হয়ে উঠলো না মস্তিষ্কের জোরে।
আজ অফিসে অনেক কাজ থাকায় মেহেরের আসতে রাত হয়ে গেলো। রাত তখন ৮টা ছুই ছুই৷ মেহেরের বাবা আর চাচা এসে গেছেন নির্দিষ্ট সময়েই। মেহেরের বাবা অসুস্থ বলেই মেহের জোর করে তার বাবাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয় সাথে চাচাকেও বলে সে নিজে এদিকটা সামলে নিবে তার চাচা যেনো তার বাবার সাথেই থাকে৷ তাই তারা দুইজনেই বাধ্য হয়ে চলে এলো৷ মেহের কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। আজ তার বড্ড ক্লান্ত লাগছে৷ রাতেও ঘুম হয় নি আর সেই ভোরে উঠেছিলো। ভেবেছে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসবে তা আর হলো কই। চোখে যেনো রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে। এতটাই ক্লান্ত ছিলো মেহের যে ওই সময় টাতেই ঘুমিয়ে পরে।
রাত তখন ১১টা বাজে। মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ আর মেহেরকে জাগায়ে ব্যস্ত। মেহেরের উদ্দেশ্যে বললো,
“মেহের, মেহের। রাত ১১টা বাজে মা সেই কখন অফিস থেকে আসলি কিছুই তো মুখে দিলি না। উঠে কিছু খেয়ে নে তারপর না হয় আবার ঘুমিয়ে যাবি।”
কারো এমন ডাকে মেহের পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়। সামনে নিজের বাবাকে দেখে ঘুমঘুম চোখেই হালকা হাসে মেহের। আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসে।
“বাবা তুমি এখনো ঘুমাও নি কেনো? তোমার যে শরীর খারাপ তা কি করে ভুলে যাও বলো।”
“এইতো এখন ঘুমাতেই যাব। তার আগে ভাবলাম আমার রাজকন্যাকে কিছু খাইয়ে আসি।”
সেন্টার টেবিলের উপর খাবারের প্লেট এনে মেহেরের সামনে রাখেন মেহেরের বাবা। তারপর বলেন,
“যা হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয়।”
মেহেরও আর কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো। মিনিট দশেক পর মেহের বাবার সামনে এসে বসে। প্লেট হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করে। খাওয়া শেষ করে নেয় ঝটপট। তারপর হাত ধুয়ে বাবাকে বলে,
‘প্রচন্ড খিদে পেয়েছিলো বাবা, কিন্তু সাথে এতটা টায়ার্ড ছিলাম কি বলব। তাই আর নিচে গিয়ে খাওয়ার ইচ্ছেই ছিলো না। তাই তো ঘুনিয়ে পরেছিলাম। কিন্তু এখন অনেকক্ষণ ঘুমানোর ফলে ফ্রেশ লাগছে আর এখন খেয়ে তো পুরাই তরতাজা লাগছে মন আর শরীর৷”
“অনেকদিন পর তোকে এভাবে বাচ্চাদের মতো কথা বলতে দেখলাম। না হলে তো আমার বাচ্চা মেহের কোথায় যেনো হারিয়েই গেছিলো৷ যে কিনা সবার কাছে গম্ভীর হলেও তার বাবার কাছে সব খুলে বলতো৷ আজ আবার এভাবে দেখে ভালো লাগলো।”
মেহের বিছানার নিচে ফ্লোরে বসে বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। মেহেরের বাবাও যত্ন করে মেয়ের চুলে বিলি কেটে দেয়৷
“বাবা মাহি কোথায়? বাসায় এসে একবারের জন্যও মেয়েটাকে দেখলাম না।”
“তুই যখন বাসায় আসলি তখন আয়াতের কাছে ছিলো ছাদে। এখন তো তোর মায়ের কাছে ঘুমাচ্ছে। থাক না আজ তোর মায়ের কাছে।”
“ওহ।”
“আজ মা ছেলে মিলে গল্প করি।”
“হুম।”
“কি ভাবছিস মা?”
“বাবা আমি কিছুই বুঝতে পারি না।”
“কি নিয়ে?”
“আয়াত।”

চলবে,,,,,

#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_২৭
#Writer_Fatema_Khan

কাঠফাটা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে আয়াত৷ ঘেমে ভিজে গেছে তার পরনের ধুসর রঙের শার্ট টা। অপেক্ষা করছে নির্ধারিত বাসের জন্য। আজ পাঁচ বছর পর সে তার বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যাচ্ছে৷ গায়ে এখন আর জ্বর নেই তবে দূর্বলতা আছে কিছুটা৷ রাস্তার মোড়ে বাস এসে থামলে আয়াত তাতে উঠে পরে। বাস চললো বান্দরবানের উদ্দেশ্যে।
“কিরে দোস্ত অনেক দিন পর ঘুরার প্ল্যান, আমরা তো তুই দেশে আসার পর পরই কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করতে বললাম। কিন্তু তুই মানা করে দিলি। তা হঠাৎ এমন ফোন করে সবাইকে নিয়ে দুইদিনের ভেতর প্ল্যান করলি? বাসায় সব ঠিক আছে, মানে মেহের আপু কি তোকে এক্সেপ্ট করে নি?”
আয়াতের ছোট বেলার ফ্রেন্ড আহনাফ প্রশ্নটি করে বসলো আয়াতকে৷ আয়াত কোনোরূপ ভনিতা না করেই বললো,
“তার নিজেরই জানা নেই সে কি চায়। আমি বুঝতে পারি তার দোটানা কিসের। সে এখনো আবির নামক লোকটা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে নি। সে যে এখন আবির আর আয়াত নামক দুইটা মানুষে আবদ্ধ। সে এখন এমন একটা রূপ যে দুইটা পদ্ম পাতায় যেনো একটি পদ্ম ফোটে তেমন। যা তাকে #দুপাতার_পদ্ম নামে আখ্যায়িত করে। আমি যে তাকে শুধু আমাতে রাঙাতে চাই। সেখানে অন্যকারো অস্তিত্ব থাকবে না। সে শুধুমাত্র আমার নামের পদ্ম হয়েই থাকবে। না থাকবে কোনো রূপ সংকোচ, না থাকবে দোটানা। তার অস্তিত্বে কেবল এই আয়াত থাকবে।”
“এতটা ভালোবাসিস!”
“তাকে না ভালোবেসে থাকা যায় বুঝি? কই আমিতো পারি নি। শত বাধা আছে আমাদের মাঝে। আর সবচেয়ে বড় বাধা মেহের নিজেই। তবুও আমি যখন ভালো না বেসে থাকতে পারি নি, আর পারবও না তার থেকে দূরে থাকতে। দূরে থাকার চেষ্টা করি নি এমনটা কিন্তু নয়, অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কি বলতো আহনাফ, এই বেহায়া মন তাকে দূরে থেকেও বিন্দুমাত্র ভুলতে পারে নি আর সেই মানুষটি যখন তার সামনে থাকে কি করে দূরে থাকা যায়?”
“তাহলে এখন এভাবে হঠাৎ দূরে যাওয়ার মানে কি? নাকি পালাচ্ছিস তার থেকে!”
“তার থেকে নয়, বরং নিজেকে কিছুটা স্পেস দিচ্ছি। একটু রিফ্রেশমেন্টের দরকার। আর মেহের নিজেও নিজেকে কিছুটা টাইম দিক। আমি সামনে থাকলে খালি পালাই পালাই করে। তার থেকে বরং আমার অবর্তমানে একটু নিজেকে জানুক, কি চায় তার মন সে বুঝুক। তবুও যদি সে ভাবে তার সাথে আমাকে সে মেনে নিবে না তবে তাই হোক। কখনো তার সাথে জোর করব না। কারণ জোর করে কারো ভালোবাসা পাওয়া যায় না। আর আমি শুধু মেহেরকে নয় সাথে মেহেরের ভালোবাসা চেয়েছি। যদি মেহেরের ভালোবাসাই না থাকে শুধু মানুষটা দিয়েই বা আমি কি সুখী হব? মানুষ বড্ড অদ্ভুত প্রাণী জানিস আহনাফ।”
“যেমন!”
“আমরা ভালোবাসি ভালো থাকার জন্য, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ভালোবাসার মানুষের সাথে ভালো থাকি না। ভালো না থাকলে তখন আর সেখানে ভালোবাসা থাকে না। যা থাকে তা দায়বদ্ধতা। তখন সবাই সেই দায়বদ্ধতা থেকে বের হওয়ার চেষ্টায় থাকে। যেমনটা করেছে আবির মেহেরের সাথে। কিন্তু আমি চাই না এমনটা আবার মেহেরের সাথে হোক। আমিও যে ঠিক এমনটাই করব না মেহেরের সাথে তার কজ নিশ্চয়তা, আমিও কিন্তু একটা মানুষ। ভালো থাকার জন্যই কিন্তু মেহেরকে নিজের করে চাই, আর যদি ২, ৪, ৫ বছর পরও মেহের আমাকে ভালোবাসতে না পারে তখন হয়তো স্বার্থপর হয়ে যাব। আবার আমার মেহেরকে আমি সেই একই কষ্ট দিয়ে ফেলতে পারি। যা আমার মেহের সইতে পারবে না। তাই জোর করে নয় সে যেনো আমার হয় কিন্তু ভালোবেসে।”
“এত গভীর চিন্তা করিস না ভাই, তোর কথায় বুঝা যাচ্ছে তুই মেহেরের সাথে এমন কিছুই করবি না। তাই নিশ্চিন্ত থাক।”
“তুই আবারও ভুলে যাচ্ছিস, আমিও মানুষ। কারো ভালোবাসা পাওয়ার কাঙাল বলতে পারিস। যদি কখনো তা না পাই তার প্রতি হিংস্র হব না তার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারছি না। মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল। তাই মেহের আমার না হোক কিন্তু দশ বছর পর তাকে দেখে আমার মুখে যেনো হাসি ফুটে। মেহের যেনো হাসি মুখে আমার সাথে কথা বলতে পারে। কোনো সংকোচ না থাকে দুইজনের ভেতর। যা আবিরের জন্য এখন মেহেরের কাজ করে। প্রথম আমি মেহেরের ভালো বন্ধু পরে অন্য কিছু৷ মেহেরের সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান করি। সে যা চায় তাই হবে। তার অপেক্ষায় আছি। কাছে এলে জড়িয়ে ধরব নিমিষেই আর না আসলেও আফসোস নেই। আমিতো জানি আমার ভালোবাসায় কোনো ঘাটতি ছিল না। আর না কখনো থাকবে।”
“সত্যি তুই কেমন যেনো আয়াত! মানুষ যেখানে নিজের ভালোবাসা ছিনিয়ে নেয় সেখানে তুই ছেড়ে দিয়েছিস। এই আশায় সে ফিরে আসবে তোর কাছে, আর না ফিরলেও আফসোস নেই।”
“বাদ দে। এই মুহূর্ত গুলো এনজয় করি। এটাই এখন আমাদের মূখ্য কাজ বুঝলি।”
“হুম।”
“আমরা খুশি না জেনেও নিজেকে খুশি রাখার প্রচেষ্টা। আমি জানি তুই ভালো থাকবি না যদি না মেহের আপু তোর না হয়। সামনে যদি সারাদিন ভালোবাসার মানুষটার বিচরণ থাকে তাহলে ব্যর্থ মানুষটা কি করে ভালো থাকে? তবুও ভালো থাকিস ভালোবাসা এটাই মন থেকে দোয়া। ভালো থাকবেন মেহের আপু তবে আমার বন্ধুর সাথে। আপনি ছাড়া যে সে ভেঙে পরবে তা আয়াত মুখে স্বীকার না করুক তার চোখ বলে দেয়। শত লুকানোর চেষ্টায়ও ব্যর্থ সে। বন্ধুত্ত্ব হয়তো এটাকেই বলে, শত না বলা কথাও বন্ধু বুঝে নেয়।”
আয়াতের বন্ধ চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে ভাবনায় ডুব দেয় আহনাফ। আয়াতের দিক থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকায়। বাসের জানালার দিকে তাকিয়ে ভাবে,
“এই পিছু ফেলে আসা গাছগুলোর ন্যায় আমরাও যদি নিজেদের দুঃখ গুলোকে পিছনে ফেলে আসতে পারতাম কত না সুখময় হতো প্রতিটি মানুষের জীবন। কিন্তু তা তো হবার নয়। আমাদের মন কোনো অচেনা পথ নয় যে, আমাদের সামনে আসা সবকিছুকেই আমরা উপেক্ষা করতে পারি। এটা মানুষের অক্ষমতাও বলা যায়, আমরা মানব জাতি নিজেদের কষ্ট ভুলতে পারি না। তেমনি আমিও ভুলতে পারি নি তাকে। সে যে মেহের বলতে পাগল আমার এই বন্ধুকে মন দিয়ে বসেছিলো। আমিও তো ভুলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভুলা আর হলো কই? আমরা এমন কেনো নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি চাওয়া আমাদের? আচ্ছা সে কি জানে আয়াত মেহের আপুকে ভালোবাসে, নাকি এখনো সেই ভ্রমেই আছে আয়াতকে কোনো একদিন সে পাবে? বড্ড পীড়া দেও তুমি পিচ্চি। কয়েক দিনের পরিচয়ে আজও পুড়ছি আমি৷ সেই খবর কি রাখ তুমি, আমিও বোকা বোকা কথা ভাবি। তুমিতো আমার মনের খবরই জানো না আমার পুড়ে যাওয়ার খবর কি করে রাখবে? তবে কষ্ট পেয়েছিলাম এটা জেনে যে তুমি আয়াতকে মন দিয়ে বসে আছো। যেখানে তার মন অনেক আগেই আরেকজনের হয়ে আছে। আমি কষ্ট পাচ্ছি সেই কষ্ট যে তুমিও পাবে তা যে আমার সত্যি সহ্য হবে না। তবুও কিছুই করার নেই। না জেনে বিষ পান যখন করেছো তার যন্ত্রণা তো সহ্য করতেই হবে।”
এসব ভাবনার মাঝেই চোখ বুজে নিলো আহনাফ।

আজ খুব বেলা করেই ঘুম ভাঙলো মেহেরের। ঘুম ঘুম চোখে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘড়ির সময় দেখে নিলো মেহের। সকাল ১০ঃ৩০ টা বাজে। কিছুটা অবাক হয়েই তাকালো মেহের মোবাইলের ঘড়ির দিকে। না ঠিকই দেখছে সে। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে এলো। খাবার টেবিলে কেউ নেই, এর মানে সকলেই খাবার খেয়ে যার যার দৈনন্দিন জীবনে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। মেহের রান্নাঘর থেকে নিজের খাবার এনে খাওয়া শুরু করলো। মেহেরের মা রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপ এনে মেহেরের সামনে রেখে বললো,
“কিরে আজ শরীর খারাপ নাকি, এত বেলা করে উঠলি যে!”
“আমি তো টেরই পাই নি মা। কখন এত বেলা হয়ে গেলো!”
“শরীর ভালো না লাগলে আজ অফিস যাওয়ার দরকার নেই। আজ মা মেয়ে মিলে সারাদিন সময় কাটাবো।”
“ওহ, ভালো তো মা মেয়ে মিলে সারাদিন সময় কাটাবে আর আমাকে দূরে ঠেলে দিবে বুঝি?”
“দূর পাগলি। তুই তো আমার ছোট বোন, তোকে কি করে দূরে ঠেলে দেই!”
চাচী এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মা আর চাচীর এমন ভালোবাসা সত্যি মেহেরকে আবেগী করে তুললো৷ এর মাঝেই তার ভাবনায় নাড়া দিলো আয়াত নামক মানুষটা। আয়াত কি আজ ভার্সিটি গেছে, তার জ্বর কি কমেছে, জ্বর না কমলে তার যাওয়ার দরকার কি, এতটা অবুঝ কেনো সে, আচ্ছা আজও কি আরশি আয়াতকে জড়িয়ে ধরবে? এসব ভাবনার মাঝেই মেহেরের চাচীর ফোনে কল আসলো। তিনি কল রিসিভ করে কিছুক্ষণ কথা বললেন। তার কথা শুনে মেহের বুঝলো আনিকা কল দিয়েছে। ওপাশ থেকে আনিকা হয়তো জিজ্ঞেস করছে আয়াতের জ্বরের কথা। মেহের ভাবলো তারমানে চাচীর কাছ থেকেই শুনেছে আয়াতের জ্বর। হঠাৎ করেই চাচী বলে উঠলো,
“এই ছেলে কারো কথা শুনে নাক? তুই বল আনিকা মা এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কেউ কি বাসার বাইরে বেড়িয়ে যায়। তাও আবার ব্যাগ পত্র নিয়ে। বললো ট্যুরে যাচ্ছি। কই যাচ্ছে, কয়দিন থাকবে কিছুই বললো না।”
মেহের যেনো অবাকের শীর্ষ পর্যায়ে।
“আয়াত বাসায় নেই, ট্যুরে গেছে তাও আমাকে কিছুই বললো না। কিন্তু এমন কিছু হবে তা আমার ভাবনার বাইরে ছিলো।”

চলবে,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে