দুপাতার পদ্ম পর্ব-০৮

0
487

#দুপাতার_পদ্ম
#পর্ব_০৮
#Writer_Fatema_Khan

মেহেরের বুকের মাঝে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে মাহি। চারদিকে ফজরের আজান দিচ্ছে৷ আজানের শব্দে মেহেরের ঘুম ভেঙে গেলো। মাহিকে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে মেহের উঠে গেলো। নামাজের জন্য অজু করে জায়নামাজে দাড়ালো। নামাজ শেষ করে নিচে নেমে নিজের জন্য এক কাপ চা করে আবার ঘরে ফিরে এলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে৷ এখনো সূর্য উঠেনি পূর্ব দিগন্তে। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই গরমেও ঠান্ডা ফুরফুরে হাওয়া বইছে। মেহেরের মনটা এমনিতেই ভালো হয়ে গেলো সকালের এমন পরিবেশে৷ কাল সারাদিন মেহেরের মন ভালো ছিলো না আয়াতের জন্য। আর আজ এই সকাল মূহুর্তেই মেহেরের মন ভালো করে দিলো। আজ বোধহয় বৃষ্টি নামবে। পরিবেশ তারই জানান দিচ্ছে। আজ শুক্রবার তাই মেহেরও অফিস যাবে না। চায়ের কাপটা রেখে বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই বৃষ্টি নামা শুরু হলো। মেহের নিজের হাত দুটি গ্রিলের বাইরে দিয়ে বৃষ্টির প্রথম ফোটা অনুভব করছে। মেহের ঘরের দরজা লক করে নি এমনি চাপিয়ে রেখেছিলো। হঠাৎ করেই কেউ দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো। আচমকা দরজা খোলার জন্য মেহের ভয় পেয়ে যায় আর পেছনে তাকায়।
“কাল এত গরম পরছিলো আর আজ সকালে এত ঠান্ডা লাগছে কেনো?”
কাথাটা টেনে গায়ে জড়াতে জড়াতে আয়াত বললো। আয়াতের এখনো ঘুম ভাঙে নি। আর আয়াত এত সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেও না। দেশে আসার পর ৯টার আগে এখনো আয়াত উঠে নি। কাথাটা মুরো দিয়ে আবার ঘুমের ঘোরে চলে গেলো আয়াত। প্রায় মিনিট পনেরো পর আয়াত কোনো মেয়ের হাসির শব্দে চোখ মেললো৷ তাড়াতাড়ি মোবাইল হাতে নিয়ে আয়াত দেখলো মাত্র ৬টা বাজে।
“এত ভোর বেলা ছাদে কোনো মেয়ে আসবে কোত্থেকে! আর কাসফি বা মেহেরও তো এত ভোরে ছাদে আসবে না, আর আসলেও এভাবে হাসবে কেনো?”
মনে মনে এসব ভেবেই আয়াত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। যদিও তার বিছানা ছাড়ার কোনো ইচ্ছা ছিলো না কিন্তু বাইরে কি হচ্ছে জানার জন্য তাকে উঠতেই হলো। বিছানার পাশে থাকা জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে জানালার গ্লাসে পানি। আয়াত বুঝতে পারলো বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।
“ওহহো, বাইরে তাহলে বৃষ্টি হচ্ছে তাই আমার এত ঠান্ডা লাগছিলো। কিন্তু এই বৃষ্টির মাঝে হাসছিলো কে?”
ছাদে ভালো করে তাকিয়ে দেখে কাসফি বৃষ্টিতে ভিজছে আর হাসছে। আর কি যেনো বলছে। আয়াত ভালো করে চারদিক তাকিয়ে দেখলো আর কেউ নেই তাহলে কাসফি কথা কার সাথে বলছে? কাসফির বাচ্চামো দেখে আয়াত নিজেও হেসে দিলো। জানালার পর্দা লাগিয়ে আবার শুতে যাবে তখনি কাসফি ছুটে কোথাও যেনো গেলো, তা দেখার জন্য আয়াত আবার তাকালো৷ আয়াত দেখলো কাসফি মেহেরকে টেনে ছাদে নিয়ে আসছে আর মেহের মানা করছিলো।
“কি ভেবেছো এত ভোরে তোমাকে কি ডেকে এনেছি ছাদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য? জি না আমার সাথে মজা করার জন্য।”
“পাগল হয়ে গেছিস কাসফি তোর ক্লাস আছে কাল ঠান্ডা লেগে যাবে তো?”
“কিচ্ছু হবে না আপু আসো অনেক মজা লাগছে।”
এতক্ষণে মেহেরও পুরো ভিজে গেছে। মেহেরও আর কিছু না বলে বৃষ্টির প্রতিটি ফোটার অনুভূতি নিচ্ছে। চোখ বন্ধ করেই হাত দুটি প্রসারিত করে আছে। তার মন যেনো হঠাৎ আন্দোলিত হয়ে উঠেছে। না চাইতেও দুটি চোখ মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভোর বেলার এই বৃষ্টি তার বুকে ঝড় তুলে আনবে কে জানত! পরনের মেরুন রঙের শাড়ি যেনো বৃষ্টিতে ভিজে পুরো লেপ্টে আছে শরীরে। মেদহীন শরীরের সাথে কাপড় লেপ্টে থাকায় মেহেরের শরীরের প্রতিটি ভাজ দৃশ্যমান। খোলা লম্বা লতানো চুলগুলো তার সৌন্দর্য ঢাকতে ব্যস্ত। বারবার চোখ ফিরিয়েও আয়াত আবার মেহেরের দিকে তাকাচ্ছে। বেহায়া মন আরেকটু দেখার জন্য ছটফট করছে। তবুও নিজের মনকে বাধা দিয়ে জানালার পর্দা টেনে শুয়ে পরলো আয়াত৷ রীতিমতো ঘামছে সে৷ মেহেরকে আগে কখনো এতটা মোহনীয় রূপে দেখে নি সে৷ চেষ্টা করেও দু চোখের পাতা আর বন্ধ করতে পারে নি আয়াত৷ বারবার মেহেরের মুখটা ভেসে উঠছিলো তার সামনে। তাই আর ঘুমানোর চেষ্টা না করে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে জানালা খুলে দেখে বৃষ্টি থেমে গেছে৷ তাই দরজা খুলে ছাদে এসে দাড়ালো। কাসফি আর মেহের নেই হয়তো তারা নিচে চলে গেছে। ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবছিলো। আর ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ফুটে উঠে আয়াতের৷
“ভালোবাসি কেন বুঝো না?”

পাঁচ দশ মিনিট আগে নিচে এসেছে মেহের আর কাসফি। দুইজনে নিজেদের ঘরে গিয়ে কাপড় বদলে নেয়। মেহের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের লম্বা চুলগুলো মুছছে। কলা পাতা রঙের শাড়ি পরে আছে। মেহের হাতের গামছাটা বারান্দায় ছড়িয়ে দিয়ে কাসফির ঘরে গেলো। গিয়ে দেখে দরজা চাপানো। হাত দিয়ে হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। মেহের ভেতরে ঢুকে দেখে কাসফি কাথা মুরি দিয়ে শুয়ে আছে৷ মেহের কাছে গিয়ে কাথা সরিয়ে দেখে কাসফি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে৷ মেহেরকে দেখে কাসফি উঠে বসলো। মেহের দেখলো কাসফির চুলগুলো এখনো ভেজা। তাই ড্র‍য়ার থেকে গামছা বের করে কাসফির পেছনে গিয়ে বসলো৷ আর কাসফির চুল মুছে দিতে লাগলো।
“এভাবে ভেজা চুলে শুয়ে থাকলে তো ঠান্ডা লেগে যাবে তাই না। আর আমি বলেছিলাম বৃষ্টিতে না ভিজতে তুই তো শুনলি না।”
“আপু তুমিই বলো অনেক মজা হয়েছে না? এমন সুযোগ কি সবসময় পাওয়া যায় বলো? মা, বাবা, চাচা, চাচী সবাই ঘুম তাই আমাদের বকা দেওয়ার মতোও কেউ নেই। আমার কাছে তো আজকের সকালটা খুব আনন্দের ছিলো।”
“সত্যি বলতে আমারও ভালো লেগেছে।”
“দেখলে তোমারও ভালো লেগেছে।?
” আচ্ছা কাসফি একটা কথা জিজ্ঞেস করি তোকে?”
“বলনা আপু কি বলবে?”
“তুই তো আগে সবসময় আমার ঘরে ঘুমাতি এখন ঘুমাস না কেন?”
“আপু তুমিও না আমি তো তোমার সাথেই থাকি। তবে বলতো এখন একটু পড়তে হয় রাত অবদি তাই আসি না তোমার কাছে। আর যেদিন ভয় করবে সেদিন তো আমি তোমার কাছেই ঘুমাব। আচ্ছা আপু তোমার কি চুল মোছা হয় নি?”
“এইতো হয়ে গেছে।”
“আপু একটা কথা বললে রাগ করবে নাতো?”
“রাগ করবো কেনো বলনা।”
“আপু আয়াত ভাইয়া সত্যি তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি রাজি থাকলেই কিন্তু বাসার সবাই রাজি হয়ে যাবে। আর দেখেছো ভাইয়ার মনটাও কত খারাপ কাল থেকে। কাল আমি ভাইয়ার সাথে ছিলাম। ভাইয়াকে অন্যদিনের মতো খুশি দেখায় নি। তবে আমাকে অনেক কিছু খাইয়েছে জানো তো।”
“ওহ ভালো।”
“আর দেখো ভাইয়া কাল থেকে কিভাবে সবার আড়ালে আড়ালে থাকে।”
“কাসফি তুই ঘুমা আমি নিচে গিয়ে কিছু কাজ করে আসি। আবার মাহি উঠে গেলে কাজে হাত দিতে পারব না।”
কাসফিকে ঘুমাতে বলে মেহের নিচে চলে এলো। বৃষ্টি হওয়াতে ঠান্ডা আবহাওয়া পেয়ে এখনো কেউ ঘুম থেকে উঠেনি হয়তো। তাই মেহের ভাবলো আজ সকালে সবার নাস্তার জন্য খিচুড়ি, ইলিশ ভাজা, গোল করে কেটে বেগুন ভাজা আর ঝাল করে গরুর মাংস করবে৷ যেই ভাবনা সেই কাজ শুরু করে দিলো। খিচুড়ি হয়ে গেছে, বেগুন ভাজাও হয়ে গেছে চুলায় মাংস রান্না আর ইলিশ ভাজা হচ্ছে। সেই মুহূর্তে মেহেরের মা আর চাচী দুইজনে রান্নাঘরে ঢুকলো। এসেই রান্নার এত সুন্দর সুবাসে তারা বললো,
“আরে মেহের তুই তো সকালের রান্না করে ফেলেছিস প্রায়। কখন উঠলি? আর এদিকে আমরা দুইজন ঘুমাচ্ছিলাম।”
“সমস্যা নেই চাচী আমার মন চাইছিলো সকালের খাবার আমিই তৈরি করি তাই রান্না করতে চলে এলাম। আর দেখো আজ বৃষ্টি পরছে বলে খিচুড়ি, ইলিশ ভাজা, বেগুন ভাজা আর গরুর মাংস রান্না করছি।”
“এতো খুব ভালো রান্না হচ্ছে। বাসার সবাই খুশি হয়ে যাবে। বিশেষ করে আয়াত। ওর তো এসব খুব পছন্দের খাবার। কিন্তু তুই প্রতিদিন এতো খাটা খাটুনি করিস কই আজ একটু ঘুমাবি আজ ছুটির দিন তাও তুই কাজ করছিস।”
“আমার তো ভালোই লাগে চাচী।”
“আচ্ছা এক কাজ করি আয়াত এদিকে তুই এগুলো সামলা আমি আর চাচী বরং তোর বাবা আর চাচাকে ডেকে নিয়ে আসি। আর চল ছোট দেখে আসি আয়াত আর কাসফি উঠলো কিনা?”
“আচ্ছা ভাবি চলো।”
মেহেরের মা আর চাচী চলে যাওয়ার পর মেহের আবার রান্নায় মনোযোগ দিলো৷ আর ভাবলো,
“সত্যি তো আয়াতকে আমি কাল থেকে ভালো করে দেখিই নি৷ আজ আয়াতের পছন্দের সব খাবার দেখে হয়তো মনটা একটু খুশি হয়ে যাবে।”

প্রায় ৩০মিনিট পর সবাই খাবার টেবিলে এসে জড়ো হচ্ছে৷ মেহেরের সাথে মেহেরের চাচীও সবকিছু টেবিলে আনতে সাহায্য করছে। আয়াত সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে মেহেরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। কোমড়ে শাড়ির আচল গুজে ঘামযুক্ত মুখশ্রী টা বেশ আবেদনময়ী লাগছিলো আয়াতের কাছে। যেনো কোনো ঘরের গিন্নি সবটা নিজ হাতে সামলাচ্ছে।

চলবে,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে