তুমি_আছো_হৃদয়ে পর্ব-০৩

0
2605

#তুমি_আছো_হৃদয়ে
#পর্ব-৩

আমি নুসরাতকে দেখে যতোটা না সারপ্রাইজড হয়েছি তার থেকে অনেক বেশি নুসরাত আমাকে দেখে অবাক হয়েছে। সে নিশ্চয় আমার সম্পর্কে তাঁর কাজিন কিংবা তাঁর বাবা মায়ের কাছ থেকে সব জেনেছে। যে ছেলেটা কখনো পড়ালেখায় সিরিয়াস ছিলো না সেই ছেলেটাই আজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত। আমি তখনও চুপ করেছিলাম। তবে নাটক সিনেমার মতো নুসরাতকে দেখে আমার ভিতরে কোনো আবেগ কাজ করেনি,আমি স্বাভাবিকই থাকার চেষ্টা করেছি।

আমি যে মেয়েটাকে দেখতে এসেছি তাঁর নাম রোদেলা। ঢাবিতে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। আমার মেয়েটাকে প্রথম দেখেই কেমন জানি সন্দেহ হয়েছিলো। এতো সুন্দর একটা মেয়ে কি আর সিংগেল থাকে? তাও আবার ঢাবিতে দুই বছর রানিং। আমি নিশ্চিত এই মেয়ের বয়ফ্রেন্ড আছে। ইদানীং এই বিষয়টা খুব হচ্ছে, বিয়ের কয়েকদিন আগে মেয়ে পালিয়ে যায়,অথচ বিয়ে করার জন্য সে ঠিকই রাজী থাকে।

জগতের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী আমাদের দুজনকে আলাদা রুমে কথা বলার জন্য পাঠানো হয়েছে। সবার কথা বিয়ের আগে ছেলে মেয়ের আলাদা কথা বলার দরকার আছে,আর তাছাড়া তারা এ যুগের ছেলে মেয়ে। ছেলে মেয়ে বিয়ের আগে পারসোনাল ভাবে কথা বলবে না এমনটা হতেই পারে না। আমার বেলাও হবে সেটা জানতাম।

আমি অজানা অপরিচিত একটা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কি বলবো কিছু ভাবতে পারছি না। কিছুটা নার্ভাস ফিলও করছিলাম। এমনটা হওয়ার কারণ বুঝতে পারলাম না। নীরবতা ভেঙে রোদেলাই প্রথম কথা বলল।

“আপনার কয়টা গার্লফ্রেন্ড ছিলো?”

মেয়ের মুখ থেকে এমন একটা প্রশ্ন শুনে থতমতো খেয়ে গেলাম। আসলে এমন কোনো কিছুর উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমি। এখন যদি বলি আমি কখনো প্রেম করিনি,আর আমার কোনো গার্লফ্রেন্ডও ছিলো না,আর সে যদি নুসরাতের কাছ থেকে সব শুনে তাহলে আমার কাছে ব্যপারটা লজ্জাজনক হবে। তাই সাহস করে বললাম।

একটা করেছিলাম।
– মাত্র একটা?
– তো কয়টা করবো? এগুলো কি খাওয়ার জিনিস নাকি যে অনেকগুলো করবো। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি অনেকগুলো করছেন?
– না,আসলে সবাই ভাবে আমার হয়তো বয়ফ্রেন্ড আছে, আমি সিংগেল নাই। তাই কেউ প্রোপোজ করে না। সুন্দরী মেয়েদের এটাই সমস্যা। সবাই ভাবে এতো সুন্দর একটা মেয়ে সিংগেল থাকার কোনো চান্সই নাই। এটা ভেবেই অনেকে প্রোপোজ করে না।
– ভালো তো।
– হুম,আমি বিয়ে করবো না,আবার বাড়িতে নাও বলবো না। আপনি না করে দিবেন। বলবেন মেয়ে আমার পছন্দ হয়নি।
– এটা বললে সবাই আমাকে পাগল ভাববে।
– কেনো কেনো? এটা ভাববে কেনো?
– এতো সুন্দর নিষ্পাপ একটা মেয়েকে আমার পছন্দ হয়নি এটা শুনলে তো সবাই পাগলই বলবে।
– ফ্লাট করছেন?
– না,সত্যি বলছি।
– আমার এই উপকারটা করেন।
– আমি এই বিয়েটা করতে চেয়েছি আমার মায়ের জন্য। আপনার থেকে আমার মাকে খুশি করা খুব বেশি দরকার। যেহেতু সমস্যাটা আপনার সেহেতু আপনি আপনার পরিবারকে বুঝান,তাদেরকে বলেন আপনার ছেলেকে পছন্দ হয়নি। এতো ভালো মানুষ নই আমি যে আপনাকে সাহায্য করে মায়ের কাছে অপরাধী হবো।
– আপনি তো শিক্ষিত, এই সাধারণ জিনিসটা কেনো বুঝেন না। বিয়ের পরেও তো আমি আপনাকে ছেড়ে দিতে পারি। আর আমাদের বিয়েটাতে আমরা কেউ সুখী হতে পারবো না।
– আমি এতো সমীকরণ বুঝি না। আমি আমার মাকে দুঃখ দিতে পারবো না। আপনি আপনার বাবাকে বলেন।
– আরে ভাই,আমার বাবা হার্টের রোগী। আমার এমন সিদ্বান্তে কোনো দূর্ঘটনা ঘটে গেলে নিজেকে সারাজীবন অপরাধী মনে হবে।
– তাহলে আর কি করার। দেখা যাক কি হয়। আজকেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। অনেক সময় পাবেন। যা করার আপনাকেই করতে হবে। বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে আমি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারবো না।

আমরা চলে আসি। নুসরাতের সাথে আমার কোনো কথা হয় না। দুজন দুজনের দিকে শুধু অপলকে কিছু সময় তাকিয়ে ছিলাম। সত্যি বলতে কথা বলার কোনো সুযোগই পাইনি। তবে আজ কেনো জানি আমার মনে হলো আমি মন থেকে নুসরাতকে ভুলে গিয়েছি।

বাসায় আসার পর মা যখন,
“বলল মেয়ে কি পছন্দ হয়েছে?”
তখন মাকে বললাম,
মেয়ে মনে হয় আমাকে পছন্দ করবে না?
– কেনো? আমার ছেলে কি কম সুন্দর নাকি?
– মেয়ের ভাব টাব দেখে এটাই বুঝা গেলো।
– ওসব কিছু না। একটু লজ্জা পেয়েছে হয়তো। পছন্দ না করলে তো বলেই দিতো। মেয়ের বাবা মা তোকে খুব পছন্দ করেছে। তারা বিয়েটা খুব তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করতে চায়।
– তার মানে কি? আমাকে না বলেই বিয়ে ঠিক করে ফেলেছো?
– আরে গাধা, না। তুই বুঝবি না।

আমি আসলেই কিছু বুঝলাম না। বুঝার চেষ্টাও করলাম না।

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাহিরের প্রাকৃতিক দৃশ্য গুলো অনুভব করছিলাম। বাহিরে কি সুন্দর ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি একজন মানুষের খুব প্রিয় ছিলো। হয়তো বা এখনো আছে কিংবা এখন আর তাঁর বৃষ্টি ভালো লাগে না। এই বিয়েটা হয়তো হয়ে যাবে। মাকে অনেক খুশি দেখলাম আজ। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে মা মেয়েটাকে আমার বউ করে আনতে চায়। আমিও কি চায়? এই প্রশ্নের উত্তর জানা নাই। তবে যদি ভালোবাসার মানুষ থাকতো তাহলে বাবা মায়ের সুখের জন্য তাকেও ছেড়ে দিতে দ্বিধাবোধ করতাম না। আর সেখানে আজ আমি নিঃস্ব, আমার ভালোবাসার কোনো মানুষ নেই,ভালোবাসার মানুষ বলতে দুইজন মানুষই আছে যারা আমাকে জন্মদিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীতে এনেছেন। তাই মায়ের কথা আমি ফেলতে পারি না। আগে বুঝতাম না তাই মায়ের অবাধ্য ছেলে হিসেবে জীবন চালিয়েছি কিন্তু এখন সব বুঝি,সব জানি। তাই জীবনের বাকিটা সময় বাবা মায়ের বাধ্য ছেলে হয়েই বেঁচে থাকতে চাই।

হঠাৎ করেই ফোনটা কেপে উঠে। বুঝলাম কেউ ফোন দিয়েছে। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই বহু দিনের পরিচিত সেই নাম্বারটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। নাম্বারটা এখনো খুব যত্ন করে সেভ করে রেখেছি এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না। যে মানুষটা অনেক আগেই নিজের মন থেকে ডিলিট হয়ে গেছে,সেই মানুষটার নাম্বারটা আজও রয়ে গিয়েছে। ফোনটা ধরতেই ওপাশের সেই আগুন ঝরা কণ্ঠটা শুনতে পেলাম। যেই কণ্ঠটা শোনার জন্য একসময় পাগল ছিলাম।

কেমন আছো?
– ভালো আছি,তুমি কেমন আছো?
– চিনতে পেরেছো তাহলে?
– না চেনার তো কোনো কারণ নেই।
– বিয়ে করছো?
– হুম কতোদিন আর সিংগেল থাকবো বলো।
– সেদিন তো বলেছিলে,তুমি আমাকে ছাড়া বাঁচবে না,বিয়ে করলে আমাকেই করবে। আমি তোমার অক্সিজেন। আমি তোমার প্রতিটা নিঃশ্বাসে থাকবো সবসময়। তাহলে সব কি মিথ্যা ছিলো?
– তুমি কি সত্যিই আমার অক্সিজেন ছিলে? যদি তাই হয়তো তাহলে কি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারতে? তুমি তো জানতে অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না,তার পরেও কিভাবে আমাকে ছেড়ে চলে গেলে?
– এতোটা দিন গিয়েছে একটা বার খোঁজও নাওনি।
– তুমি নিয়েছো? আমি ভেবেছিলাম কোনো একদিন তুমি ফোন দিবে। তবে ভাবিনি এতোটা দেরি করবে।
– তুমি কি ভাবছো? আমি আবার তোমার সাথে নিজেকে জড়াতে চাই তাই ফোন দিয়েছি? এটা ভাবলে ভুল করবে।
– হ্যালো,ম্যাডাম। আমি আপনাকে অনেক আগেই ভুলে গিয়েছি। সো এসব নিয়ে আমিও ভাবি না। আর আমি জানি আমার সাথে ব্রেকআপ হওয়ার পর তুমি রিলেশনে জড়াবে। কারণ তুমি ছিলে মেডিক্যালে পড়া আপডেট মেয়ে।
– উপহাস করছো?
– না,তা করবো কেনো? যেটা সত্যি সেটাই বললাম। সেদিনের পর তুমি খুব ভালোই ছিলে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ঘোরাফেরা। আরও কতো কি? ভালো থাকার জন্য এগুলো কি যথেষ্ট না?
– বাহির থেকে দেখে সবকিছু বোঝা যায় না। যাইহোক ভালো থাকো। বিয়ের জন্য শুভকামনা।
– তুমিও ভালো থাকো।

আমি ভেবেছিলাম এরকম কিছু একটা হবে। নুসরাত আমাকে ফোন দিবে। তবে মেয়েটার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আজও আগের মতোই আছে। নিজের জেদটাকেই বড় করে দেখে। তবে আমি খুব খুশি সে আমাকে ভুলে গিয়েছে। নাটক সিনেমার মতো সে আবার আমার জীবনে ফিরে আসতে চায়নি।

রাতে ঘুমানোর আগে অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে ফোন পেলাম,ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম কেউ একজন বলছে।

আমি রোদেলা,আপনার হবু বউ। আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। কাল বিকেলে দেখা করতে পারবেন?
– হ্যাঁ পারবো। কখনো কোথায় আসতে হবে বলেন।
– আমি মেসেজ করে দিয়ে দিবো নি।
– আমিও ফোনটা রেখে ঘুমিয়ে গেলাম। তবে আমার কেনো জানি মনে রোদেলার সাথে দেখা করতে গিয়ে তাঁর বয়ফ্রেন্ডকে দেখতে পাবো। জানি না এমনটা হবে কি না। তবে হওয়াটা অসম্ভব কিছু না।

চলবে………..

লেখাঃ আমিনুর রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে