তিক্ত ভালোবাসা পর্ব-২২ এবং অন্তিম পর্ব

0
1940

#তিক্ত_ভালোবাসা
#Tafsia_Meghla
#পার্টঃ২২ (শেষ)

বিয়ে বাড়ি যেমন মরা বাড়িতে পরিনত হয়েছে৷
তবে এটা শুধু রাজি বেগমের জন্য, দুপুর থেকে মরা কান্না জুরে দিয়েছে কাল মেহেন্দির পর একবার ও ছেলেকে দেখেনি৷

রাজি বেগমের এমন মরা কান্না দেখে রেহানা বেগম বিরক্ত নিয়ে বলে,
— “আহহ রাজি!!
এমন করছিস কেন? তুই তো জানিস তোর ছেলে দু-দিন এর বেশি ঢাকা থাকে না হ্যাঁ মানলাম সে মেঘলা আর শোভনের বিয়ে খেতে এসেছিলো৷
হয়তো আর ভালো লাগছে না তাই চট্টগ্রাম চলে গেছে৷ ”

রাজি বেগম আবার জোরে জোরে কান্না করে বলে,
— “মানলাম চলে গেছে কিন্তু ফোন কেন ধরছে না৷ ”

— “তোর ছেলে কবেই বা তোর ফোন ধরেছে?
থাকে তো সারাদিন রাজনীতি নিয়ে তোকে কতদিন দু-দন্ড সময় দিয়েছিলো৷ ”

শোভনের এবার বেশ বিরক্ত লাগছে এমন ভরপুর হলুদের অনুষ্ঠানে মা আর চাচি মিলে এমন শুরু করেছে৷
আর চাচি তো মরা কান্নাই জুরে দিয়েছে৷
শোভন এতোক্ষন স্টেজে বসে ফোন টিপছিলো মেঘলাকে এখনো স্টেজে আনা হয়নি শোভন বিরক্ত মাখা কন্ঠে বলে,
— “কি শুরু করেছো তোমরা?
এইসব নাটক এখন এখানে বন্ধ না করলে আমি এখান থেকে চলে যাবো, আমি চাই না আমার বউ এর এসব নিয়ে মন খারাপ হোক৷ ”
বলেই স্টেজ থেকে নেমে মেঘলার রুমের উদ্দেশ্যে পা বারায়৷

মেঘলার সাজ প্রায় শেষ আলতা পরানো বাকি, বাসন্তি রাঙা লাল পারের শাড়ি পরানো হয়েছে মেঘলাকে কাচা ফুলের গয়না রুপ মহিনী লাগছে মেঘলাকে৷ মেঘলার পরনের সব জিনিস নিজ হাতে কিনেছে শোভন৷
শোভন রুমে প্রবেশ করতেই সারা, ঐশী সহ সবাই বেরিয়ে যায়৷ আলতা পরানো ও হয়নি৷
প্রথমবার হলুদের কনে সাজে শোভনের সামনে মেঘলা একটু বেশি লজ্জা পাচ্ছে লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে,
— “আলতা না পরিয়েই চলে গেলো এবার পরবো কি করে৷ ”

মেঘলার লজ্জা নুয়ে থাকতে দেখে ঠোঁট এলিয়ে হাসে শোভন, এইভাবে তার হুর পরি তাকে দেখে কতই না লজ্জা পাচ্ছে৷
ধীর পায়ে হেটে মেঘলার সামনে গিয়ে পা বরাবর বসে শোভন, শোভন কে বসতে দেখে মেঘলা চাপা স্বরে বলে,
— “এখানে বসলে কেন?
উপরে বসো৷”

মেঘলার কথার উত্তর না দিয়ে আলতাটা হাতে নিয়ে মেঘলার পায়ে লাগিয়ে দিতে থাকে৷ মেঘলার এবার অসস্তি হচ্ছে এমন টা কেউ করে ও পায়ে হাত দিবে কেন? তা ভেবে মেঘলা বলে,
— “তুমি এভাবে পায়ে হাত দিচ্ছো কেন?
ওটা রাখো আমি একাই দিতে পারবো৷ ”

মনে হলোনা মেঘলার কথায় শোভনের মধ্যে কোনো ভাবান্তর বা প্রতিক্রিয়া হয়েছে সে নিজের মতো মেঘলার পা চেপে ধরে আলতা দিতে ব্যাস্ত মেঘলা অসহায় ভাবে আবারো বলে,
— “কেউ দেখে ফেললে খারাপ ভাববে৷ ”

তাও শোভন রাখলো না৷ পা দুটো আলতা দিয়ে রাঙিয়ে আলতাটা সাইডে রেখে ঘোর লাগা চাওনি দিয়ে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,
— “কে কি ভাবলো কে কি বললো তা নিয়ে পরোয়া আমি করি না হুর পরি,,, আমার জন্য সবার আগে তুমি নামক মানুষটা প্রিয় আর মূল্যবান৷
এতোটা প্রিয় যে বাকি সব কিছু আমার কাছে তুচ্ছ৷ ”

শোভনের কথায় মেঘলার মনে অদ্ভুত এক শিহরন বয়ে গেলো, অদ্ভুত অনুভূতি মনের কোনে নারা দিচ্ছে৷
ভালোবাসার মানুষের মুখের ভালোবাসা মাখা কথা কি এতোটা শিহরন জাগিয়ে দেয়?
ভালোবাসার মানুষটার কথা গুলো এতো ভালো লাগা কাজ করে?
এ অনুভূতি যে সব কিছু অগোছালো করে দিচ্ছে মেঘলা কে তা কি শোভন বুঝে না?

মেঘলা লজ্জা মাখা চোখে শোভনের দিকে তাকিয়ে আছে৷
শোভন দুষ্টু হেসে দাঁড়িয়ে মেঘলাকে দাড় করিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফিস ফিস করে বলে,
— “এমন ভাবে তাকিয়ে থাকলে কালকে রাত অব্দি আর অপেক্ষা করতে পারবো না আজই,,,,৷ ”

শোভন আর কিছু বলতে পারলো না মেঘলা মুখ চেপে ধরে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বলে,
— “তুমি বড্ড বেশি নির্লজ্জ হয়ে গেছো জানো?
যা মুখে আসে তাই বলো৷ ”

শোভন হেসে বলে,
— “অন্য কাউকে তো আর বলি না নিজের বউ কেই বলি৷ ”

মেঘলা শোভন কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে,
— “উপরে সবাই অপেক্ষা করে আছে৷ ”

শোভন পকেট থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে তার থেকে হলুদ বের করে আবার মেঘলার কোমর চেপে ধরে নিজের কাছে এনে কপালে আলতো করে হলুদ লাগিয়ে দেয় তারপর মুক্ত কোমরে কিছুটা লাগিয়ে বলে,

আমার ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দিয়ে
রং তুলি দিয়ে আকবো ছবি
যতন করে বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখবো আপন করে💜

_তাফসিয়া মেঘলা

শোভন মেঘলাকে আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে দাড় করিয়ে বলে,
— “আমি চাইনি আমার হুর পরিকে আমার আগে কেউ হলুদ দিয়ে রাঙাক তাই আমি আগে দিয়ে দিলাম৷ ”

মেঘলা লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে শোভন কে জড়িয়ে ধরে,
শোভনও পরম আবেশে নিজের প্রেয়সীকে বুকে মুশিয়ে নেয়৷

________________

খোলা আকাশের নিচে উচু বেঞ্চিটিতে বসে চন্দ্র বিলাশ করছে শোভন মেঘলা,
বিয়ের অনুষ্ঠান একটু আগেই শেষ হলো, ভালো করেই সব কিছু মিটলো৷ বাড়িতে সবাই নাচতে উঠেছে৷
আর বেশি সোর সারাবার জন্য মেঘলার মাথা ব্যাথা
করছিলো আর দুই দিন যাবত রাজি বেগমের ফ্যাচকা কান্না তো ছিলোই৷
শোভন চায় না এসব নিয়ে মেঘলার আজকের দিনটা নষ্ট হোক তাই নিজেদের মতো একা সময় কাটানোর জন্য এখানে নিয়ে এসেছে৷

চৈত্র শেষ হতে আর কয়েকটা দিনই বাকি গরম টা বেরেছে কিন্তু খোলা আকাশের নিচে প্রান প্রেয়সীর সাথে চন্দ্র বিলাশ সবারি বেশ মোহনীয় লাগে৷
আবছা আবছা বাতাস বইছে৷
লেক পার্কটা বাড়ি থেকে একটু দূরে জায়গাটা বরাবরই মেঘলার খুব প্রিয়,
বেঞ্চি থেকে লেক পার্কটার শেষ বরাবর একটা চায়ের টং যেখানে বয়ষ্করা নিজেদের আড্ডায় মেতে উঠেছে৷
পাশেই একটা ফুচকা আর আইস্ক্রিমের স্টল৷

দুজনের মাঝেই পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিলো নিরবতা ভেঙে মেঘলা মৃদু স্বরে শোভনকে প্রশ্ন ছুরে দেয়
— “ছোট ভাইয়া কোথায়?”

মেঘলার এমন প্রশ্নে শোভন একটুও অবাক হলো না বরং মুখে বাকা হাসির রেখা ঝুলিয়ে বলে,
— ” মেরে দিয়েছি৷

শোভনের খোলা মেলা উত্তরে মেঘলার কোনো ভাবান্তর হলো না বরং দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কারন সে জানে যত দিন বেঁচে থাকবে শোভনের #তিক্ত_ভালোবাসা নিয়ে থাকতে হবে৷

নীল আকাশে অজস্র তারার ভিড়ে, মন শুধু সারাক্ষন তোমাকেই খোজে ফেরে৷ সেই অনীল আকাশে তোমাকে নিয়ে মেতে থাকতে চাই চন্দ্র বিলাশী হয়ে, কিছু কথন বানিয়ে দিক না আমায় প্রেমবিলাশি৷ তোমাকে নিয়ে হারাতে চাই ভালোবাসার মায়ায়, যে মায়া করে দিবে আমায় তোমার ভালোবাসার মায়াবিনী৷ শীতের সকালে দুটিতে হাটবো হাতে হাত রেখে শিশির ভেজা ঘাসের উপর৷ কোন এক বর্ষনের রাতে তোমায় নিয়ে ভিজবো আমি বৃষ্টি বিলাশি হয়ে৷ গূধুলির আলো-আধার মাখা শেষ প্রহরে জড়িয়ে ধরে বলবো আমি থাকবেতো তুমি আমার হয়ে৷ সীমাহীন ভালোবাসার অসীম আগ্রহ নিয়ে বলবে আমায়, “ওহে প্রেয়সী আমিও যে ভালোবাসি তোমায়”৷ ❤️

_তাফসিয়া মেঘলা

আচমকা মেঘলার এমন কথায় কেঁপে উঠে শোভন৷
মেঘলা একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবার বলে,
— ” ভালোবাসি,
খুব বেশি ভালোবাসি হয়তো তোমার মতো করে নয় তবে তোমার চেয়েও কম নয়৷ সারা জীবন তোমার #তিক্ত_ভালোবাসা নিজেকে রাঙিয়ে রাখতে চাই৷

শোভন আচমকা মেঘলাকে জড়িয়ে ধরে কয়েক বার জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,
— “ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি৷ ”
এভাবেই কতক্ষন দুজন দুজনকে জড়িয়ে ছিলো তাদের খেয়ালি নেই, কিছুক্ষন পর মেঘলা নিরবতা ভেঙে
মিষ্টি হেসে ফুচকার দোকানটা দেখিয়ে শোভন কে বলে,
— “ফুচকা খাবো৷ ”

শোভন একবার ফুচকার দোকান টা দেখে মেঘলার দিকে ব্রু কিঞ্চিত কুটি করে তাকিয়ে কিছু বলবে এর আগেই মেঘলা বলে,
— “প্লিজ না করো না৷ ”

এমন পরির মতো বউ সাজা অবস্থায় এতো সুন্দর করে কেউ যদি আবদার করে তা কখনো কেউ কি ফেলতে পারে?
শোভন দাঁড়িয়ে মেঘলাকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
— “চলুন মহারানী আপনার খুকুম শীরধার্য৷ ”

৪ বছর পর,,,,,,

বিচ্ছিরি রক্ত মাখা লাশের সামনে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছে মেঘলা,
পাশেই হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার তিন বছরের ছেলে নূর৷
বাগানেই ছেলেকে নিয়ে খেলছিলো মেঘলা আর সারা৷
ছেলে ছোট বিড়ালের পিছে ছুটতে ছুটতে পাশের বাড়ির গেটের সামনে এসে পরে৷
আর এখানে লাশের সামনে বসে কাঁদছে মৃত ছেলেটির মা৷
ছেলেটি নাকি এক্সিডেন্ট করেছে গাড়ি সহ খাদে পরে গিয়েছিলো৷
এই ছেলেটা প্রতিদিন ছাদে গেলে পাশের বাড়ির ছাদ থেকে তাকিয়ে থাকতো কাল তো ছাদে কিছু লিখে কাগজ দিয়ে মুড়ে মেঘলা কে পাঠিয়েছিলো কিন্তু এর এমন অবস্থা কি করে?
কে এমন করলো?
সত্যি কি এটা এক্সিডেন্ট? পাঁচ বছর আগে আকাশের এমন অবস্থা হয়েছিলো তাহলে কি শোভন? কিন্তু শোভন তো এসব করে না আর ছেলে হওয়ার পর বদলে গেছে,
মেঘলা ঘাম গুলো আচল দিয়ে মুছে ছেলেকে নিয়ে চলে আসে৷
বাড়িতে আসতেই নূর কে নিয়ে সারা ছাদে চলে যায়, আনমনে হাটছিলো হঠাৎ কেউ হাতে টান দিয়ে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে খামছে মেঘলার কোমর চেপে ধরে৷
মেঘলা জানে এটা শোভন তার তিক্ত প্রেমিক৷
মেঘলা চোখ বন্ধ রেখেই বলে,
— “মেরেছো কেন?”

শোভন বাকা হেসে বলে,
— “বলেছি না? তোমার দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেও তাকে বাঁচতে দিবো না৷”

বলেই জোরে জড়িয়ে ধরে৷
মেঘলাও কিছু বললো না সে জানে শোভন কখনোই পাল্টাবে না ওর #তিক্ত_ভালোবাসা দিয়ে সবসমই জড়িয়ে রাখবে৷

—————— সমাপ্ত——————–

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে