তপ্ত সরোবরে পর্ব-০৩

0
468

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মর্তুজা

৩.

সকাল সকাল বাড়িতে খুব তোড়জোড় চলছে। রান্নাবান্না, ঘরবাড়ি পরিষ্কারে বাড়ির মহিলারা খুব ব্যস্ত। এরই মাঝে চলে এলো বাড়ির বড়ো দুই মেয়ে— ফিরোজা আর ফারিন। এ দুজনের নাম ওদের দাদি সাজিদা বেগম রাখলেও ফারজাদের নামটা রেখেছিলেন ফারজাদের নানা। ফারহানার ‘ফার’ আর আজাদ এর ‘জাদ’ মিলে ফারজাদ।
ফারজাদ ফারিনের বড়ো হলেও ফিরোজার ছোটো। ওরা এসে পৌঁছেছে বেলা দশটার দিকে। এ সময়টায় সকলে ঘুম থেকে উঠে সকালের খাওয়া সেড়ে নিলেও ফারজাদ ঘুমাচ্ছে। এমনকি তাকে গিয়ে ডাকার উপায় নেই কারও। বাড়ির বড়ো ছেলে হওয়ার সুবাদে বহু আশকারাতেই মানুষ হয়েছে ফারজাদ।

ফারহানা বেগম রুই মাছ কাটতে বসেছেন উঠানের একপাশে। ফারজাদদের বাড়িটা একটু অদ্ভুত। দোতলা আধুনিক বাড়ি হলেও বাড়ির ভেতরটাই কেবল আধুনিক। বাড়ির পেছন সদর দরজা থেকে বেরিয়ে বাহির আঙিনার পেছনেথ ফটক অবধি মাঝারী এক উঠান, তার চারপাশ জুড়ে বিশাল গোয়াল, খড়ির ঘর, পুরোনো রান্নাঘর, কলপাড়, আর একটা বাংলাঘরও আছে। উঠানের গেইট পেরোলে বাড়ির পেছনে যাওয়া যায়। আর বাড়ির সামনের দিকটায় গ্রামের রাস্তা।

ফারজাদ লুঙ্গির গিট্টু একহাতে চেপে ধরে অপর হাতে একটা সাদা পাঞ্জাবী ধরে ফারহানার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। লাবন্য পাশেই বসে চাউল খুঁটছে। ফারজাদ পাঞ্জাবীটা ফারহানার কাধের ওপর রেখে লুঙ্গিটা শক্ত করে বেধে নেয়। ঢাকায় থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে অভ্যাস, এখানে এলে লুঙ্গি সামলাতে চাপ নিতে হয় বেচারাকে। লুঙ্গি বেঁধে বলল, “আম্মা, পাঞ্জাবীটা ধুয়ে দেবেন তাড়াতাড়ি। এটা পরে জুমা পড়তে যাব।ʼʼ

ফারহানা মাছের আঁইশ মাখা হাতে অসন্তুষ্ট চাহনিতে তাকায়। নজর যেন কথা বলছে—দেখতেছিস না হাতে নোংরা। আর তোর কী কাপড়ের আকাল পড়ছে, এইটা পরে যেতে হবে!

ফারজাদ তো অন্তর্যামী। ঠোঁট বাঁকিয়ে ‘চ্যাহ’ এর মতো করে নাক-মুখ কুঁচকে বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা। ঠিক আছে, বুঝেছি।ʼʼ

লাবন্য অদ্ভুত নজরে চেয়ে আছে সদ্য ঘুম থেকে উঠে আসা সাহেব পুরুষটির দিকে। ফারজাদের চোখ তো ক্যামেরা। দ্রুত চোখ নামিয়ে বলল, “আমি ধুয়ে দিচ্ছি, দেন পাঞ্জাবীটা।ʼʼ

পাঞ্জাবীটা দিয়ে ফারজাদ বলে, “আপনি আমার পাঞ্জাবী না ধুয়ে আগেই মাছ কাটতে বসেছেন কেন? কাহিনি কী? বাড়িতে কোন শোক পালন হবে নাকি?ʼʼ

সাজিদা বেগম হেসে বললেন, “হারামজাদা! তোর কথাবার্তা জীবনে বদলাইলো না। শোক ক্যান হইব, খুশির কতা। লাবনীরে দেখতে আইতেছে, কাইল কইলাম না তোরে!ʼʼ

ফারজাদের বিরক্তিমাখা মুখটা বদলে একটু ভ্রুটা জড়িয়ে গেল। নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল, কিঞ্চিত হাসিমুখেই লাবন্যর দিকে তাকিয়ে এক ভ্রু নাচিয়ে, ঠোঁট উল্টালো। মৃদু মাথা দুলিয়ে বলল, “শুভেচ্ছা!ʼʼ

লাবন্য সৌজন্যমূলক সামান্য ঠোঁট বাঁকায়। অথচ চেয়ে রইল রহস্যজনক ওই পুরুষটির চলে যাওয়ার পানে। সাদা লুঙ্গি আর তার ওপর চওড়া এক শাল গায়ে। হাঁটছে লুঙ্গিটা বাঁ-হাতে উচিয়ে তুলে ধরে। মাথায় ঘন চুল, উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের ওই পুরুষটা এমন অনুভূতি শূন্য কেন? সব বোঝে সে—তা জানে লাবন্য। অথচ তবুও কেমন কঠোর তার অবুঝের ভান। এই ছেলেটার কোথায় আটকে যায় মানুষ? নিষ্ঠুর, দায়সারা ভাব ছাড়া আছে কী তার মাঝে? তবুও লাবন্য আটকে গেছিল বহুবছর আগে এই রহস্যজনক পুরুষটির মাঝে। তার চোখের বিরক্তি, মুখের দুর্লভ হাসি, বিচক্ষণ ভাবনা, আর নিখুঁত চলন। অথচ তাকে চাইতে শুরু না করলে কেউ বুঝতেই পারবে না– কতখানি ধারাল এই পুরুষের বেপরোয়া পদক্ষেপ আর বহুরূপি আচরণের নিষ্ঠুরতা। সর্বোচ্চ মারাত্মক–নীরবে এড়িয়ে চলার পদ্ধতি!

ফারজাদকে খাবার বেড়ে দিলো ফিরোজা। ফারজাদ খেতে শুরু করলে পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, “বিয়ে শাদি করবি কবে? বিয়ের বয়স তো পার হয়েছে বহু আগে।ʼʼ

ফারজাদ খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে থামল। ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল, “ আসলেই পার হয়েছে? আচ্ছা, আমার খেতে বসায় সমস্যা, নাকি তোদের খেতে দেওয়ায়? যখনই টেবিলে এসে বসছি, কারও না কারও ভাঙা রেডিও অন হয়ে যাচ্ছে।ʼʼ

ফিরোজা প্রতিবাদ করে ওঠে, “কেন, তোর ভেতরে দোষ নেই? মানুষ তোর মতো আছে, ফারজাদ? তুই নিজেই বলতো তুই কেমন?ʼʼ

ফারজাদ গালে থাকা খাবারটুকু গিলে বলল, “কেমন?ʼʼ

“তোকে আব্বা প্রশাসনে দিয়ে ঠিক করেনি।ʼʼ

“আব্বা দেয়নি, আমি গেছি।ʼʼ

“গেছিস কেন? দিন দিন আরও রহস্যজনক হয়ে উঠছিস।ʼʼ

ফারজাদ বিরক্ত হয়, “কীসের রহস্য দেখতে পাচ্ছিস আমার ভেতরে? রহস্য বলতে যা বোঝায়, বুঝিস তা?ʼʼ

“থাক, তা না-ই বা বুঝলাম। এই-যে মৃত মানুষের মতো চলাফেরা তোর, কোনরকম চিন্তা, চমকানো, মানুষের কথার ঠিকঠাক জবাব—কোন্ স্বাভাবিকতা আছে তোর মাঝে? মনে হয় যেন নরক থেকে নেমে আসা এক নিষ্ঠুর দেবতা তুই। যে সব বোঝে চোখের পলকে অথচ, থাকে নির্বিকার।ʼʼ

ফারজাদের সঙ্গে ফারজাদের মতো করে কথা একমাত্র ফিরোজা বলতে পারে। ফারজাদকে খুব করে চেনে আর জানে একমাত্র এই মানবী। ফারজাদ ভাবলেশহীন ভাবে বলল, “তারপর?ʼʼ

ফিরোজা ক্ষেপে উঠল, “তারপর কী? এভাবে কতদিন? কী করছিস, কী চলছে তোর জীবনে? কেমন তুই বলতো? কত রকমের তুই? প্রতি মুহূর্তে এক একটা তুইকে খুঁজে পাওয়া যায়।ʼʼ

ফারজাদ হাসল, “দেখ, কিছু কিছু মানুষের ভেতরটা হয় ফাঁপা, আসলে কিছুই নয়, শুধু ভং ধরে থাকে—তাতে মনে হয় সে কী না কী! অথচ সবটাই আসলে নিজের উদাসীন স্বভাব ছাড়া আর কিছু না। আমি হচ্ছি সেই জাতের পাবলিক—যার জীবনে কোন রহস্য নেই, অথচ আমার ভাবাবেগহীন চালচলন তোদের এত এত ভাবতে বাধ্য করে। আচ্ছা, আমি কি স্বাভাবিক না?ʼʼ

“ফারজাদ! ভালো হ। আর পাঁচটা মানুষের মতো চললে সমস্যা কোথায় তোর?ʼʼ

ফারজাদ যেন শুনতেই পেল না সেই কথা। বলল, “ছাদে আমার টিশার্ট শুকাতে দেওয়া, তুলে আন। আব্বা বাজারে যেতে বলেছে।ʼʼ

ফিরোজা বিরক্ত হয়ে উঠে যায়।


বাজার থেকে ফিরল ফারজাদ মিষ্টি, দই, কয়েক বোতল কোক আরও কিছু মশলাপাতি নিয়ে। বারোটা পার হয়ে গেছে। আজাদ সাহেব তাড়া দিলেন ফারজাদকে, “জলদি গোসল কর, নামাজে যাইতে হইব তো!ʼʼ

ফারজাদ বলল, “এতে এত ব্যস্ত হওয়ার কী আছে। যেতে হবে, হবে। চিৎকার করে বাড়ি মাথায় না তুললে হয় না যাওয়া?ʼʼ

আজাদ সাহেব হতাশ শ্বাস ফেললেন, “তোর মতোন মরা তো আর না কেউ। তোর ভিতরে জান আছে নাকি? সবকিছুতে বিরক্ত হোস, কী ভালা লাগে তোর, ক তো?ʼʼ

ফারজাদ বলল, “কখন আসবে মেহমান।ʼʼ

আজাদ সাহেব বললেন, “তোর আম্মা নইলে বউমারে জিগা।ʼʼ

এখনও মসজিদে খুৎবা শুরু হয়নি। ফারজাদ নিজের রুমের বাথরুমে গোসল করার উদ্দেশ্যে ঢুকল। গোসল শেষে দেখল কিছুই সে নিয়ে আসেনি কলপাড় থেকে। বাথরুমের দরজা খুলে চিৎকার শুরু করে, “আম্মা! আমার তোয়ালে আর লুঙ্গি দিয়ে যান।ʼʼ

ফারহানা বেগম অতিষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। এই ছেলেকে নিয়ে তার হয়রানীর শেষ নেই। রান্নাঘরে দ্বিজা দাঁড়ানো। তাকে বললেন, “যা তো দ্বিজা, সাহেবের তোয়ালে দিয়ে আয়।ʼʼ

তোয়ালেটা কলপাড়ে পেলেও, লুঙ্গি শুকাতে দেওয়া হয়েছে বাগানে। বাগানে ঢুকেই দ্বিজার চোখ যায় গতরাতের পড়ে থাকা ছাইয়ের দিকে। চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। কাল রাতে প্রায় অনেকক্ষণ ফারজাদের সঙ্গে বসে ছিল সে আগুনের পাশে। সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে লুঙ্গিটা তুলে নিয়ে চলে এলো ফারজাদের রুমে। বাথরুম থেকে পানির আওয়াজ আসছে। ফারজাদের হাতে লুঙ্গি ও তোয়ালে দিলে, তা নিয়ে ফারজাদ দরজা আটকে দেয় বাথরুমের।

ফারজাদের রুমটাও ফারজাদের মতোই ভিন্নরকম। বিভিন্ন রকম বইয়ে ঠাসা চারপাশ। তার মাঝে বেশি হলো ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট টাইপ বই। বিছানার ওপর ল্যাপটপটা পড়ে আছে। বিছানার চাদর অগোছালো, জানালা খোলা থাকলেও পর্দাটা টেনে দেওয়া। যার কারণে রুমটা অন্ধকার আর বিস্তর এলোমেলো লাগছে। দ্বিজা বিছানাটা ঝেরে, জানালার পর্দাটা সরিয়ে রাখল। ল্যাপটপটা ডেস্কটপ টেবিলের ওপর রেখে, পুরো ঘরটা গুছিয়ে শেষে ঝাড়ু দিল। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পুরো ঘরটা একবার দেখল—এবার ভালো লাগছে দেখতে। তখনই ফারজাদ বের হয় বাথরুম থেকে। পরনে সাদা লুঙ্গি, ঘাঁড়ে তোয়ালে ঝুলছে, খালি গা, এখন চোখে সাদা চশমা নেই। দ্বিজা সেদিকে তাকাতেই গা’টা কেমন শিহরিত হয়ে উঠল তার। দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে চঞ্চল পায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। ফারজাদ সেদিকে শান্ত দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে, তোয়ালেটা ছুঁড়ে ফেলল কাউচের ওপর।


দুপুর তিনটার দিকে এলো লোকজন। তারা এসে বসার ঘরে বসে আছে। এদিকে লাবন্যকে শাড়ি পড়ানো হয়েছে, আফছানা বেগম নিজের কিছু গহনা বের করে দিলেন। আমেনা বেগমের মতে—পাত্রপক্ষের সামনে মেয়েদের নতুন বউয়ের রূপে উপস্থাপন করলে, পাত্রপক্ষের লোকের চোখে ধরে ভালো। ফারিন সাজিয়ে দিলো লাবন্যকে। দ্বিজা নিজেও একটা শাড়ি পড়েছে খয়েরী রঙা, বড়ো মামির শাড়ি। সে নিজে সাজতে ব্যস্ত। ফারজাদ ও লাবন্যর বাবা আলম সাহেব এসে তাড়া দিলেন মেয়েকে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসতে। লাবন্যকে যতটা সাজানো হয়েছে সাধারণ, মার্জিত বলা চলে। তবে দ্বিজা ভারী সেজেছে। যে কারণে তার সাজ শেষই হচ্ছে না।

লাবন্যর মুখে চাঞ্চল্য নেই। চোখটা গভীরে হারিয়ে আছে, চোখের দৃষ্টি যেন ইহজগতে নেই তার। রোবটিক লাগছে দেখতে, যেভাবে চালানো হচ্ছে চলছে। তাকে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামিয়ে আনা হলো। বসানো হলো পাত্রের মুখোমুখি। ফারজাদ দাঁড়িয়েছে পাত্রের পেছনে। পাত্রের চাচাতো ভাই, চাচি, বাবা, মা,পাত্র ও তার বড়ো বোন এসেছে। বেশ অনেকেই বলা চলে। আমেনা বেগম প্রথমেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, “নাম কী গো তোমার?ʼʼ

“ইরফান হোসাইন।ʼʼ স্পষ্ট কণ্ঠস্বর। দ্বিজা নেমে এলো সে সময় রিনঝিনে পায়ে। তাকে দেখতে বেজায় চঞ্চল আর মিষ্টি লাগছে। সকলে একসঙ্গে তাকায় সেদিকে। সামনে গিয়ে বসতে যায়, দিলরুবা চোখ রাঙালেন। দ্বিজা আড়ালে মুখ ভেঙচিয়ে এসে ফারজাদের পাশে দাঁড়াল। ফারজাদ আস্তে করে বলল, “বিয়েটা কার, দ্বিজা? তুই এমন ভূত সেজেছিস কেন?ʼʼ

দ্বিজা মুখ ভেঙচায়, “আপনার মতো অশরীরী এসব বুঝবেনা। বাড়িতে লোক এসেছে। ক’দিন পর অনুষ্ঠান হবে বড়ো করে। আর একটা সুযোগ যখন পাইইছি সাজার, হাতছাড়া করব কেন?ʼʼ

ফারজাদ সামনের দিকে তাকিয়ে মাথাটা দ্বিজার দিকে সামান্য এগিয়ে নিয়ে আস্তে করে বলে, “পাইইছি না, পেয়েইছি।ʼʼ

ইরফানের মা রিনা বেগম লাবন্য কে জিজ্ঞেস করলেন, “নাম কী তোমার?ʼʼ

“লাবন্য সুলতানা।ʼʼ

“পড়ালেখা কোথায় করছো?ʼʼ

“কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অনার্স সেকেন্ড ইয়ার।ʼʼ

“যাতায়াতে সমস্যা হয় না?ʼʼ

“নিয়মিত ভার্সিটিতে যাই না।ʼʼ

হঠাৎ-ই এক অবাঞ্ছিত প্রশ্ন করে বসলেন রিনা বেগম, “কোথাও পছন্দ আছে তোমার? থাকলে বলতে পারো, লুকানোর কিছু নেই।ʼʼ

আফছানা বেগম একটু সপ্রতিভ হয়ে তাকালেন মেয়ের দিকে। লাবন্য মেঝের দিকে চেয়ে ছিল, আস্তে করে মাথাটা তুলে ইরফানের দিকে তাকাল মুহূর্ত খানেকের জন্য। পেছনেই ফারজাদ দাঁড়ানো। ফারজাদ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ে আছে লাবন্যর দিকে। দ্বিজা নজর থেমে যায় লাবন্যর দৃষ্টিতে। জহুরী নজরে চেয়ে রইল সেও, লাবন্যর দৃষ্টি অনুসরণ করে সন্ত্রপণে সেও তাকায় ফারজাদের দিকে। লাবন্য ফারজাদের চিকন সাদা চশমার ফাঁকে নির্বিকার ওই চোখে গাঢ় দৃষ্টি রেখে শক্ত মুখে মৃদু ঘাঁড় নাড়ে, “উহু, নেই পছন্দ।ʼʼ

আফছানা বেগম সহ বসার ঘরে উপস্থিত সকলে আটকে রাখা শ্বাস ছাড়ল এতক্ষণে। লাবন্য স্পষ্টভাষী মেয়ে, বেশ গম্ভীর আর স্বাধীনচেতা। তার ওই গম্ভীর চোখে সামাজিক ভীতি নেই। পছন্দ থাকলে হয়ত বলতে দ্বিধা করত না। ইরফানের বাবা জিজ্ঞেস করল, “আমাদের কাছে কোন চাওয়া আছে তোমার, যেটা তুমি পূরণ করতে চাও।ʼʼ

কিছুক্ষণ সময় নেয় লাবন্য। লাবন্য আড়চোখে আবার ফারজাদের দিকে তাকায়। ফারজাদ সাদা পাঞ্জাবী পরেছে, হাতদুটো বুকে বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে আড়চোখে তাকালে ফারজাদের বুক অবধি দেখা যায়। সে আজ আর ফারজাদের ওই দুর্বোধ মুখটা দেখতে চেষ্টা করল না। সেখানে কী আছে–গভীর নিষ্ঠুরতা ছাড়া? আস্তে করে বলল, “পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চাই আমি।ʼʼ


রাত দশটার মতো বাজে। মেহমান চলে যেতেই দ্বিজা শাড়ি খুলে ফেলেছে, সকল সাজ ধুয়ে ফেলেছে, অথচ কথা ছিল বিকেলে সে ঘুরতে যাবে, ছবি তুলবে। মুখের সেই চঞ্চলতা নেই তার, লাবন্যর ঘরের ছোট্ট সোফার ওপর পা তুলে বসে আছে নির্বিকার। লাবন্য বাথরুম থেকে বের হয়ে এলো, তার দিকে তাকায় দ্বিজা। চোখের শিরাগুলো লালচে হয়ে আছে। দ্বিজার মুখটা গম্ভীর। লাবন্য কান্না লুকাতে মুখ ধুয়েছে। অথচ জানে না বোধহয়—মুখে পানি ছিটিয়ে চোখের আর্তনাদ ঢাকা যায় না। লাবন্য এসে বিছানায় বসে মৃদু হাসে দ্বিজার দিকে তাকিয়ে। দ্বিজার মুখভঙ্গির কোন পরিবর্তন হলো না। কেমন রসকষহীন স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“বিয়ে কেন করছিস, লাবন্য আপু?ʼʼ

দ্বিজার প্রশ্নটা যেন বুঝতে পারেনি, সেভাবে তাকায় লাবন্য দ্বিজার দিকে। দ্বিজার চোখে-মুখ অন্যরকম লাগছে দেখতে। একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “মানে বুঝলাম না।ʼʼ

“কাউকে পছন্দ করিস, তা বলিস নি কেন?ʼʼ

“কে বলেছে তোকে এসব? আর কাকে বলব?ʼʼ

দ্বিজা বিরক্ত হলো এবার, “ন্যাকামি করছিস কেন?ʼʼ

লাবন্য চুপ হয়ে গেল হঠাৎ-ই, নজর ঝুঁকিয়ে মাথাটা নত করে নিলো সামান্য। দ্বিজা আবার বলে, “কবে থেকে পছন্দ করিস ফারজাদকে?ʼʼ

লাবন্যকে একটু অপ্রস্তুত দেখাল এবার। হঠাৎ-ই দ্বিজার কথাবার্তা অন্যরকম লাগছে শুনতে। লাবন্য আস্তে করে বলে, “মনে নেই।ʼʼ

দ্বিজা ভ্রুটা কুঁচকে নিলো, এলোমেলো নজরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে তো বহুদিনের প্রেম কাহিনি তোদের?ʼʼ

লাবন্য মলিন হাসে, “আমাদের? উহু, আমার, আমার একার, আমার এক-তরফা প্রেমকাহিনি। ফারজাদ ভাই তো পাথুরে উপাদানে গড়া, দ্বিজা। যার ভেতরে রক্তের বদলে হয়ত নির্জীব কোন পদার্থ প্রবাহিত হয়। এটার সত্যতাও জানি না। তবে, আসলে আমি তো কোনদিন বুঝতেই দিতে চাইনি। তারপর যখন একসময় নিজে থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল আমার লুকানো অনুভূতি, তখনও ফারজাদ ভাই কী সুন্দর নির্বিকার এড়িয়ে চলেছে সব। জানিস, সে আসলেই ফিট সবদিকে। কোন ব্যাপারকে সে অনুভূতিহীন ভাবে এড়িয়ে যাবে, অথচ তুই তার দোষ দেওয়ার ফাঁক পাবি না। যেমন রাস্তায় বেরিয়ে দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে লোকে কখনও আজরাইলকে দোষ দেয় না। বরং বলে— গাড়ি আস্তে চালালে এক্সিডেন্ট হতো না, মরত না বেচারা।ʼʼ

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে