তপ্ত সরোবরে পর্ব-৩৬

0
491

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৩৬.

বাড়িতে অতিথিদের আনাগোনা চলছে গতদিন থেকে। পুরো বাড়ি লাইটিং করা হয়েছে। সামনের খোলা চত্বরের সামনে ডেকোরটরের চাদোয়া দিয়ে ফটক তৈরী করা হয়েছে। এত বড়ো আর জাঁকজমক অনুষ্ঠান এ বাড়িতে আগে হয়নি বোধহয়! বৃহস্পতিবার রাতে লাবন্য বহুবার দ্বিজাকে মেহেদী দিতে বসার সুযোগ খুঁজেছে। হয়ে ওঠেনি, সেই মেহেদী লাগাতে বসিয়েছে সকাল নয়টার দিকে। একটু আজব বিয়ের ঘটা, বউভাতে বউয়ের গায়ে হলুদ হবে। হলুদ, মেহেদী পাতা, চন্দন ইত্যাদি বাটা হচ্ছে, পাশেই বসেছে দ্বিজা মেহেদী নিতে। হলুদ শাড়ি, গলায় লাল টুকটুকে গামছা, লজ্জায় নোয়ানো নজর, চোখে মুখে উপচে পড়া লাবন্য জ্যোতি! কী যে স্নিগ্ধ লাগছে দ্বিজাকে দেখতে। আমেনা বেগম বহুবার এ অবধি মন্তব্য করে বসেছেন ওর থুতনি ধরে, “বিয়ের পানি গায়ে পড়লে মাইয়াগো রূপ যৌবনে দেখছিস কেমনে তেলতেলে সৌন্দর্য্য দেখা যায়! হলুদ গায়ে না-ই ছোঁয়াইতেই দেখছিস চেহারায় ঝিলিক দিতেছে!ʼʼ

দ্বিজা লজ্জায় আর তাকাতে পারেনি। তার বিয়ে তো সে-ই কবে হয়েছে! আজ কেন এমন নতুন নতুন লাগছে সবকিছু? মনেই থাকছে না সে কতদিন আগেই তো বিয়ে হয়ে পুরোনো হয়ে গেছে! চারদিকে কেমন ভাঁটা পড়া সুখে যেন জোয়ারের পানি ঠলকাচ্ছে! একটুও মনে থাকছে না, ওই গোমরামুখো মানুষটাকে সে পেয়েছে, তাকে যেন এইবার, এই প্রথমবার পেতে চলেছে এত ঘটা করে এই ভেবে আনন্দে বারবার শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে উঠছে! উত্তেজনায় দম আটকে আটকে আসছে বারবার!

বাড়িতে একটা ব্যাপার লাগলে তখন ফারজাদকে দেখা যায় গ্রাম্য, কর্মঠ এক শক্তিমান পুরুষ হিসেবে! দ্বিজার মনে হয়–এই লোকের এই রূপেই সে ঘায়েল হয়েছিল ছোট্ট বয়সের কোনো এক কালে। সাদা ফফফকা পরনের লুঙ্গিটা বাঁ হাতে উচিয়ে ধরা, কালো-খয়েরী শার্টের ওপরের বোতাম খোলা, গলায় গামছা ঝুলছে। এদিক-ওদিক দৌড়ে তদারকী করে বেড়াচ্ছে! কে বলবে, তার বুকের ক্ষততে এখনও ঘা দেখা যায় একটু-আধটু! ফারিন ডাকল, “এ শোন এদিকে আয়!ʼʼ

একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো ফারজাদ। ডেকোরটের টেবিল বসছে বাগানে। পেছনের বেড়ার একপাশ খুলে দেয়ায় দেখা যাচ্ছে। ফারিন আবার চেঁচাল। বিরক্ত মুখে এসে দাঁড়াল, “কী সমস্যা?ʼʼ

-“খেয়েছিস সকাল থেকে? ওষুধগুলো আমি খাই?ʼʼ

-“আচ্ছা, খা। তবে দেখিস সাইড ইফেক্ট খারাপ না হয়ে যায়!ʼʼ

দাঁত খিঁচল ফারিন, “ফাজিল! মেহেদী বেটেছি, খেয়ে নে, লাগিয়ে দিই হাতে।ʼʼ

ফারজাদ মুখ বিকৃত করল, “ফেসিয়াল, মেকাপ, হেয়ার স্টাইল এসব করাবি না? শুধু মেহেদীতে কাজ চলবে?ʼʼ

মুখ গোজ করল ফারিন, “তো বিয়েতে বরেরা মেহেদী লাগায় না? লাগালে সমস্যা কী?ʼʼ

আফসানা বেগম ফারজাদকে খাবার ভর্তি প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “তোমারও আক্কেল নাই, ফারিন! টকালারে চুল আচড়াইতে কও কোন দুঃখে?ʼʼ

হেসে উঠল সকলে, ফারিন বলল, “কথা ঠিক বলেছ, বৌমা। হাদারাম কোথাকার!ʼʼ

দ্বিজার পাশেই খেতে বসল ফারজাদ। আড়ষ্টতায় সংকুচিত হয়ে বসে আছে দ্বিজা! কেন জানি এই চেনা পরিচিত মহলটাও আজ তার জন্য নতুন এবং শিহরণের স্থান লাগছে। তার ওপর এই লোক এসে পাশে এত কাছে বসবে কেন? দু লোকমা খাবার খেয়ে তৃতীয় লোকমাটা তুলে বিনা কোনো শিরোনামে দ্বিজার মুখের কাছে ধরল। জিজ্ঞেস করল না, খেয়েছিস? মেহেদী তুলবি কখন, খাবি কখন? কোনোরকম প্রস্তুতি বা খবর দিলো না।

দ্বিজার চমক, আর সবার অদ্ভুত চাহনি আটকে রইল সেদিকে। দ্বিজা তাকিয়ে আছে হতবিহ্বল চোখে, ফারজাদ খাবার ইশারা করে ভ্রু জড়িয়ে মৃদু ধমকাল, “হুউউ!ʼʼ

দ্বিজা আস্তে করে মুখে খাবার তুলৃ নিলো। তার দু’হাতের চারপাশ ভর্তি মেহেদী। হাত দুটো উচু করে ধরে রেখে খাবার চিবোতে লাগল। সকলে ঘুরে ঘুরে দেখছে ওদের, বউভাতে বর বউকে খাইয়ে দিচ্ছে বসে। অনবদ্য দৃশ্য এ এক! নিশ্চিন্তে, অমনোযোগে, অ-বিশেষ ধরণে নিজে একবার খাবার নিচ্ছে, নিয়ম করে দ্বিজাকে পরের লোকমা দিচ্ছে। দুজনে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে ভরা মজলিসের উঠোনের এক প্রান্তে বসে খাচ্ছে, টুকটাক আস্তে আস্তে কথা বলছে। সকলে চোখ ভরে দেখল দৃশ্যটা। মানুষবিদ্বেষী ফারজাদের নির্বিকার চিত্ত! আর সেই নির্বিকার চিত্তে কী যে মহিমান্বিত আকার ও বিকারত্ব! তাকে চোখে মুখে প্রেম নেই, মুগ্ধতা নেই, বিশেষ অভিব্যক্তি নেই। অথচ একেক লোকমা যখন গালে তুলে দিচ্ছে দ্বিজার, দেখে মনে হয়–কত জনমের এই কর্তব্যনপরায়নতা তার, কতকালের অভ্যস্ত দুজনে এভাবে আহার গ্রহন করে, কত যে মায়া মিশে আছে সেই একেক লোকমা খাবারের মাঝে। সাধারণ খাবার গ্রহনের দৃশ্য থেকে এটা আলাদা, একটু আলাদা, একটু দুর্লভ আর দুর্বোধ্য!

খাবার শেষে প্লেট নিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উঠে গেল ফারজাদ। কলপাড়ে প্লেট রেখে হাত ধুয়ে, গ্লাস ভরে পানি খেল। এরপর এক গ্লাস পানি ভরে এনে তা এগিয়ে দিলো দ্বিজার মুখে কাছে। দ্বিজার দুহাতে মেহেদী ভরা, গ্লাস ধরার উপায় নেই। ফারজাদ ধরতে বলল না। সরাসরি মুখের কাছে এগিয়ে দিলো গ্লাসটা, পানি খেলো দ্বিজা। গ্লাসটা ছোটো চাচির দিকে এগিয়ে দিয়ে ইরফানকে ডাকল কয়েকবার। খেয়ে ভেতর থেকে বের হলো ইরফান। তারা দুজন যাবে এখন দইয়ের ভাঁড় এবং সফ্ট ড্রিংস আনতে।


লাল শাড়ির সোনালী পাড়। চুলগুলো খোলা রাখা হয়েছে, মাঝে সিঁথি করে একটা ভারী টিকলি পরানো হয়েছে, গলায় ভারী হার, সাথে স্বর্ণের সীতা-হাল রয়েছে। হাত ভর্তি সোনালী-লাল চুড়ি। গরম আজ ভালোই পড়ছে, এ বাড়িতে ফারজাদের রুমে এসি লাগানো আছে, তবে সেটার সার্ভিসিং করাতে হবে। বাসর সাজিয়েছে কাঁচা ফুলে। দ্বিজার ইচ্ছে করল বাসরের লাল টুকটুকে ফুলগুলো ছিঁড়ে নিয়ে দু একটা কানে গুজে ফেলতে। নিলো না, সাঁজ নষ্ট হয়ে যাবে। বাসর সাজিয়েছে গত মাঝরাতে ইরফান। জুমার খুৎবা শোনা যাচ্ছে। বাড়িটা এখন একটু শান্ত, সকলে যে যার মতো গোসলে ঢুকেছে, পুরুষেরা নামাজে চলে যাচ্ছে। বাবুর্চিরা খাবার পাত্রে সার্ভ করছে।

ফারজাদ গোসল করে বের হলো, পরনে হাফ-প্যান্ট। দ্বিজা খোঁচা দিলো, “এই লোক যাবে নামাজ পড়তে, যার কাপড়চোপড়ের ঠিক নেই!ʼʼ

নিজের খালি গা, এবং হাঁটুতে নজর বুলিয়ে বলল ফারজাদ, “কেন? খুব বেশি নেকড লাগছে? তুই আকর্ষণ বোধ করছিস নাকি?ʼʼ

দ্বিজা নাক কুঁচকাল, “ছিঃ!ʼʼ

ফারজাদ পাঞ্জাবী গায়ে চড়াতে চড়াতে তাকাল দ্বিজার দিকে। থামল ক্ষণিকের জন্য, সেদিকে আটকানো চোখে চেয়ে আনমনে পাঞ্জাবীর হাতায় হাত দিলো। ফ্যানের বাতাসে দ্বিজার স্ট্রেইট করা চুল উড়ে উড়ে সামনে আসছে, সেটা আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে আবার। ফারজাদ কাছে গিয়ে দাঁড়াল, ডানহাতের আঙুলে চুল সরাতে সরাতে বলল, “এরকম পেত্নি সেজে ভর দুপুরে সামনে আসতে নেই মেয়েদের।ʼʼ

-“তাতে কী হয়, ভুতে ধরে?ʼʼ

-“ভুতে যদি নাও ধরে, পুরুষে ধরে।ʼʼ

দ্বিজা মাথা নত করল। ফারজাদ ওর থুতনি তুলে ধরে বলল, “কোথায় জানি শুনেছিলাম বউকে চুমু খেয়ে নামাজে যেতে হয়, তাইলে স্বামীর দোয়া ভালো কবুল হয় সৃষ্টিকর্তার কাছে।ʼʼ

গাঢ় লিপস্টিকে রাঙা ঠোঁটের কাছে নত হলো লম্বাটে ফারজাদ। দুটো গাঢ় চুম্বন করল সেখানে। ঠোঁট সরিয়ে তা কপালে তুলল, মৃদু শব্দে গাঢ় একটা চুম্বন করল কপালেও। দ্বিজা আবেশে চোখদুটো বুজে নিলো চেপে, ভেজা ঢোক গিলল একটা। পুরুষেরা বোধহয় কোনোদিন বুঝবে না, এই যে তাদের তপ্ত ঠোঁটের স্পর্শ যখন কোনো নারীর কপাল স্পর্শ করে সেই নারীর স্বর্বস্বে সেই মুহুর্তে কত বড়ো ধ্বংস খেলে যায়। এ যে কতটা ভয়াবহ ক্ষয়কারী, তা কোনোদিন জানবে না। দ্বিজার গলাটা আটকে এলো, চোখের কাজল নষ্ট হবে বোধহয় এবার! কী দরকার ছিল চুমুটা কপালে দেবার? পুরুষের জন্য নারীর কপালে চুম্বন নিষিদ্ধ করা হোক, নিষিদ্ধ হোক নারীর সর্বনাশের এই অনিন্দ্য পন্থা, এই অধঃপতন মানার নয়!

ফারজাদ সরে দাঁড়াল, মুখ চোখ বিকৃত করে বলল, “ছিহ! কী বিচ্ছিরি স্বাদ লিপস্টিকের! ওহ ছিঃ! এই মাল ঠোঁটে ঝুলিয়ে ঘুরিয়ে বেড়াস তোরা? তোদের তো অত্যন্ত পর্যায়ে রুচির অভাব!ʼʼ

পায়জামার নিচের দিকে গুটিয়ে টাখনু বের করতে করতে তার কিছু মনে পড়েছে, এমন ভঙ্গিতে দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়াল, “এই! আমার কী আবার ওযু করতে হবে? চুমু খেলে কি ওযু ভেঙে যায়?ʼʼ

হাতের টিস্যুটা নাকে ঠেকিয়ে হেসে ফেলল দ্বিজা। তা দেখে চমৎকার হাসল ফারজাদ। টুপিটা হাতে নিয়ে পাঞ্জাবীর বোতাম লাগাতে গেল, দ্বিজা এগিয়ে গেল। পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বোতামগুলো লাগিয়ে দিলো সন্তর্পণে। ততক্ষণ কেমন করে যেন চেয়ে রইল ফারজাদ, দ্বিজা নত চোখে তার বুকে মনোযোগ সহকারে চেয়ে পাঞ্জাবীর বোতাম লাগাচ্ছে। শেষ হলে একটু সরে দাঁড়াল। আপাদমস্তক চেয়ে দেখল স্বামীর দিকে। মুচকি হেসে মাথা নামিয়ে নিলো। তার মনে বেজে উঠল তিনটে লাইন, তাও আবার উল্টো তালে,

দেখিতে সোনার নাগর গো, চান্দেরও সমান
কোন বা দেশে থাকে ভোমরা, কোন বাগানে বসে..
কোন বা রঙ্গের মধু খাইতে উইড়া উইড়া আসে..

জুমার দুই রাকাত ফরজ শেষে ফারজাদ চার রাকাত সুন্নতের নিয়ত বাঁধল। দ্বিতীয় রাকাতের সেজদায় গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেরি করল সে। হাতদুটো মেঝেতে চেপে কপালটা ঠেকাতেই কেমন অদ্ভুত সুখ জ্বালা এসে ভর করল তার ওপর। সেজদার তাসবীহ তিনবার ছাপিয়ে সাতবার পাঠ করল। মাথা তুলল না। চোখ দুটো বুজে কল্পনা করল সে সৃষ্টিকর্তার পায়ে পড়ে আছে। জীবনের সকল চাওয়া-না পাওয়া, অতীত বর্তমানের গড়মিলে হিসেব সামনে এসে দাঁড়াল। একটু অভিযোগ, অনেকটা ব্যর্থতা, নিজের ভুলগুলো, অপ্রান্তি সবের স্বগোতক্তি করে বসল রবের কাছে। চোখের সম্মুখে ভেসে উঠল আজকের নতুন শুভযাত্রার এক অবিচ্ছেদ্য সঙ্গীনীর সরল মুখখানি। চোখের পাপড়ি ভিজেছে, পানি গড়ায়নি বেয়ে। উঠে পড়ল সেজদা থেকে। চোখ লুকোতে মাথা নত করে সোজা হয়ে বসে দ্বিতীয় সেজদায় গেল। শক্ত করে বুক টেনে এক সুদীর্ঘ শ্বাস নিলো শব্দ করে।

চার রাকাতের মোনাজাতে হাতদুটো তুলে একদৃষ্টে চেয়ে রইল নিজের হাতের দিকে। মাথাটা নত ফারজাদের। কী চাইল, কে জানে! বেশ অনেকক্ষণ ধরে চাইল কিছু মালিকের কাছে। আবার চোখে সিক্ততা টানছে, নাক শিউরে, গলার রগ টান করে হাঁ করল, উপরের দিকে তাকিয়ে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল। মসজিদের ছাদে আড়াল হয়ে আছে তেজী সূর্য রশ্মিতে ছেয়ে থাকা আকাশটা।


ফারজাদের পরনে লুঙ্গি, পুরাতন শার্ট, গলায় ঝুলছে বাবুর্চিদের গামছা। জমজমাট খাওয়া চলছে চারদিকে, যথাসাধ্য পেটপুরে ভোজ হচ্ছে সবার। দুপুরের রোদকে বাঁধ সাধার ক্ষমতা হলো না বোধহয় চাদোয়ার। সকল টেবিলের পাশে বড়ো স্ট্যান্ড ফ্যান লাগিয়ে দেয়া হয়েছে, তবে যারা খাবারের তদারকি করছে তাদের অবস্থা কাহিল। আজাদ সাহেব কোথা থেকে যেন ছুটে এলেন। টেনে ধরলেন ফারজাদকে, “গরম গায় লাগে না, না? কয়দিন আগে উঠছিস অসুখ থেকে, এখন আবার ঘামে ভিজো, এরপর জ্বর বাধাইও আবার। শার্ট খুলে রাখা যায়না? নিচে গেঞ্জি নাই?ʼʼ

বোতামগুলো এক এক করে খুলে শার্টটা টেনে খুলে নিলেন। ঘামে ভিজে চুপচপে হয়ে আছে শার্টের পিঠ, বুক। ফারজাদ কথা বলল না কোনো, তার চোখে-মুখে বিরক্তি। লোক বসে আছে খাবারের জন্য, তার হাতে ভাতের পাত্র!

ওই বাড়ি থেকে আসার মতো সব দ্বিজার বাবার আত্মীয়রা, মায়ের আত্মীয় সব এই পক্ষের হয়ে এসেছে। এখানেও উল্টো বিষয়। আগের দিন বউভাত খেয়ে দ্বিজাকে নিয়ে যাবেন ও বাড়িতে, পরেরদিন এখান থেকঃ লোক যাবে, সেদিন খাওয়াবেন হাবিব সাহেব, এবং দ্বিজাকে তুলে দেবেন। হাবিব সাহেব বহুদিন পর এলেন এ বাড়িতে, এবার আর নিজে জামাই হয়ে নয়, বরং জামাইয়ের বাড়িতে। কেমন নতুন আর আজব অনুভূতি হচ্ছে। একটু সংকোচ ও দ্বিধাও কাজ করছে। অসুস্থ থাকার সময়গুলোতে ফারজাদ কারও সাথে কথা বলেনি, তার সঙ্গে তো না-ই! সেই ছেলেটার প্রতি আজ আর ক্ষোভ নেই, রাগ নেই, অভিমান নেই, অথচ বাজে কিছু স্মৃতি রয়ে গেছে, যেখানে বরাবর সে লজ্জিত। মানুষ বাঁচেই বা ক’দিন? এত ক্ষোভ, রাগ, অভিমান চিরস্থায়ী তো হবার নয়! তাহলে কী লাভ ভেতরে পুষে বহর বাড়িয়ে?

তিনি নিজেই আজাদ সাহেবের কাছে গেলেন কথা বলতে। দ্বিজার সাথে দেখা করলেন। খাওয়া দাওয়া হলো। বিপত্তি হলো যাওয়া নিয়ে। ফারজাদ যাবে না, তার বুকে ব্যথা। একটা অপ্রস্তুত ঘটনা! আজাদ সাহেব ধমকালেন, “সারাদিন করো কাজ, আরও করো। আমার তো লোকের অভাব কাজের!ʼʼ

ফারজাদ জবাব দিলো না। চেয়ার পেতে বসে আছে উঠোনের মাঝখানে সে খড়খড়ে শুকনো মাটির দিকে তাকিয়ে। তাকে ঘিরে বাড়ির লোকের ভিড়। সে নির্লিপ্ত, চুপচাপ। তার বুকে ব্যথার বিশেষ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, আর দেখা যাওয়াটাও জরুরী না ওর জন্য। ওর শরীরে এমনিতেই ব্যথা নেই বলেই ধারণা সবার। হাবিব সাহেব বসলেন ফারজাদের ডানপাশে। সামনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “রাগ কমে নাই, তাই না?ʼʼ

-“কীসের রাগ, ফুপা? রাগ থাকলে কমা, বাড়ার প্রশ্ন ছিল। ব্যথা ছিল, ব্যথা বেড়েছে।ʼʼ

হাবিব সাহেব স্মিত হাসলেন, “কোথাকার ব্যথা?ʼʼ

-“বুকের ব্যথা।ʼʼ

ঘাঁড় নাড়লেন হাবিব সাহেব, “কথা সত্য, বুকের ব্যথা। তবে বুকের ব্যথা একপাক্ষিক কেন বলতে পারবা?ʼʼ

-“একপাক্ষিক?ʼʼ

-“তাছাড়া কী? এই বাড়িতে আসো নাই? এইটা বাপের বাড়ি এই জন্যে? তুমিও তো আমার মেয়ে নিয়ে চলে গেছিলা, তা ধরে রাখলে রাখতে পারতাম না আমি? ধরি নাই তো! কারণ, আমি বাপ, বুঝলা! তুমি যতই বলো, আমার বাপ হবার যোগ্যতা নাই। আমি জানি, আমি দ্বিজার বাপ, এই যে আর সপ্তাহখানেক পর দেশ ছাড়তেছি। মেয়েটারে নাহয় নিয়ে যাব, কাছে একটা দিন থাকবে। তুমি না গেলে একটা অ-পুরা ভাব থেকে যাবে না? ওইটা খচখচ করবে মনে চিরদিন, বুঝলা! মেয়েও কি ভালো থাকবে? বিয়ে তো একবারই হয়, এইদিন যা হবে, চিরকাল মনে থাকবে। তুমি ভোলো নাই কিচ্ছু, আমি ভুলছি। ক্যান জিগাবা না? ওরে মানুষ করার জন্যে এত বছর দূরে থাকছি, আবার যাব চলে, আবার দেখা ধরো না-ই বা হইলো! কবে ফিরি না ফিরি। তোমার হাতে দিয়ে যাব। আজ যখন একা বাড়ি ঢুকবে, কাল একা বের হয়ে এই বাড়িত আসবে, তখন বাপের মনে খুব অসহায় লাগবে, মেয়েটারে মনেহয় একা একাই ছেড়ে দিলাম কোথাও! এই জন্যে বাপ আমি। তুমি যা-ই কও, আমি বাপই!ʼʼ

ফারহানা বেগমের গলা বেজে উঠল, মুখে ওড়না চেপে ধরেছেন। উপস্থিত সকলের চোখ ভেজা। অনড় বসে আছে ফারজাদ, চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে। শোক শোক গন্ধ বেরিয়েছে যেন! আজাদ সাহেব দূরে সরে গেলেন। ফিরোজা সরে গেল। ফারহানা চেয়ে আছেন ছেলের দিকে। কতদিন ‘আম্মাʼ বলে ডাকে না ফারজাদ। একবার সাড়ে চার বছর খানেক ডাকতো না ‘আম্মা-আব্বুʼ বলে। আজ কতমাস ডাকে না! বোঝে না এই ছেলে, বাপ-মার ভিতরের জ্বালা। এই দুটো শব্দের মানুষগুলোর মনে কত যে রূপরেখা, কত যে মায়া, কত হাহাকার তা বোঝে না সন্তান!

ইরফানের গলা শোনা গেল, “ফারজাদ ভাই! এদিকে আসেন তো! সফট ড্রিংসের ঝুড়ি খালি, আরেকটা কই রাখছেন?ʼʼ

ফারজাদ উঠে দাঁড়াল। হাবিব সাহেব বসে আছেন মাথা নুইয়ে। ফারজাদ দুই হাত মুঠ পাকিয়ে মাথার উপরে তুলে অলস ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভাঙল, “আজ বলেছি যখন ‘নাʼ। তাইলে আর যাই কেমনে! আপনি ভালো ব্যবস্থা করবেন সবকিছুর, যান। কাল আমি আর দ্বিজা দুপুরে আসব দাওয়া খেতে, সবাই যাবে আগে। আর আমার একটা শেরওয়ানী পাঠাবেন সকালে, ওটা পরে আসব, আমার শেরওয়ানী কেনা হয়নি।ʼʼ

ডাহা মিথ্যা কথা। আজাদ সাহেব শেরওয়ানী, লুঙ্গি, পাঞ্জাবী, গামছা–সব কিনে এনে দিয়েছেন। সে আজ সারাদিন শুধু লঙ্গি পরে, গামছা গলায় করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেরওয়ানী পরেনি, তাতে নাকি গরম বেশি, আর আরাম কম, তাছাড়া দাগ লাগার সম্ভাবনা আছে। বরের কোনো বালাই রাখেনি শরীরে। কেউ ওকে না চিনলে বলবে না— তার বিয়ের অনুষ্ঠান আজ।


রাত দশটার দিকে রুমে ঢুকল ফারজাদ। ঠেলেঠুলে ঢুকিয়ে দিলো ইরফান, দরজায় পা রাখার সময় পেছন থেকে বলল, “যদিও আপনাকে দেখে বরের কাজের খালুও মনে হচ্ছে না, তবুও অল দ্য বেস্ট!ʼʼ চোখ মারল ইরফান, “শালি আমার ছোটো, রয়েসয়ে, কেমন! শুভকামনা আপনার জন্য!ʼʼ

ফারজাদ ঘাঁড় ঘুরিয়ে চারদিকে কিছু খুঁজল ছুঁড়ে মারার মতো। হো হো করে হেসে ফেলল ইরফান। ফারজাদ কপালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে হেসে উঠল। গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জিতে বিভিন্ন দাগ, কালি। লুঙ্গিতে নোংরা! দরজার ছিটকিনি আটকে পেছন ফিরল, দ্বিজা বসে আছে খাটের ওপর। মাথায় ঘোমটা নেই, শুধু শাড়ি, খোলা চুল উড়ছে। ফারজাদের মাথা থেকে পা অবধি চোখ বুলিয়ে দেখল গম্ভীর দৃষ্টিতে। অতিষ্ট ভঙ্গিতে ঘাঁড় ঝাঁকাল দুপাশে, এই লোকের কাছে স্বাভাবিক কিছু আশা করা পাপের সমান। এটা বর? হায় কপাল! লুঙ্গি, গেঞ্জি, গলায় গামছা পরে সে ঢুকছে বাসর ঘরে! গলা থেকে গামছা খুলে ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। ফ্যানের নিচে এসে দাঁড়িয়ে গেঞ্জিটা খুলে ফেলল। ঘর্মাক্ত উদাম শরীরে দু-তিন হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে ফারজাদ। সে চোখ নামাল। ফারজাদ ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, “অবশেষে আমিও বলির পাঠা! বাসরে ঢুকলাম!ʼʼ

ঠ্যাস মেরে বলল দ্বিজা, “বাসরে ঢুকলেন? মনে হচ্ছে মাটি কাটতে এসেছেন!ʼʼ

-“সে তোর যাই মনে হোক! আমি বাসরেই ঢুকেছি।ʼʼ

বিরবির করে স্বগতোক্তি করল দ্বিজা, “এমন ভাব করছে যেন প্রথমবার বাসর করছে!ʼʼ

ফারজাদ সিলিং ফ্যান থেকে চোখ নামিয়ে তাকাল, “সে তো আনঅফিশিয়ালি আনকন্ট্রোলেবল হয়ে গেছিল, সেখানে তোর দোষ ছিল, একঘরে না থাকলে কিছু হতো না। কিন্তু আজ হবে অফিশিয়াল!ʼʼ

-“ছিহ! অশ্লীল!ʼʼ

হেসে ফেলল ফারজাদ, ঘাঁড়ে হাত বুলাতে বুলাতে “তোহ! গোসলটা সেরে ফ্রেস হয়ে আসি!ʼʼ

তোয়ালে কাধে ঝুলিয়ে যেতে গিয়েও আবার ফিরল, “ওয়েট! গোসল তো করা যাবে না আগে, ডাবল খাটুনি!ʼʼ

দ্বিজা হাতের মুঠোয় মাথা ঠুকল, “আল্লাহ! এর আজ মাথা গেছে নাকি?ʼʼ

ফারজাদ ওয়ারড্রোবের ওপরের ড্রয়ার খুলল, একটা লালরঙা ছোট্ট বাক্স বের করে আনল। বসল এসে বিছানায়। দ্বিজা সরে গেল কিঞ্চিৎ! ফারজাদ চোখ তুলে তাকাল, “হাত দে!ʼʼ

ছোট্ট একটা আংটি, চকচকে সোনালী রঙা! দ্বিজার অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিলো ফারজাদ। পরাতে পরাতে বলল, “এইটা কিন্তু তোর মামা দেয়নি, ফারজাদের কামাই করা টাকায় বানানো!ʼʼ

দ্বিজা ভ্রু কুঞ্চিত করল, সকালেও সে ড্রয়ার খুলেছিল, তখন তো দেখিনি দইয়ের ভাড় আনতে গিয়ে তুলে এনেছে নাকি? তাহলে বানাতে কবে দিয়েছিল? চোখ তুলে তাকাল, “আজ এত বদলে যাওয়া লাগছে কেন আপনাকে? নেশা করেছেন?ʼʼ

-“ইচ্ছে ছিল, ইরফান ভাই করতে দেয়নি।ʼʼ দ্বিজার কোলে মাথা রেখে পায়ে পা উঠিয়ে শুয়ে পড়ল। এরপর দ্বিজার দিকে তাকিয়ে বলল, “মেয়ে পছন্দ হলে সব ছেলেই পানসে থেকে মিষ্টি, অতীত ভুলে বর্তমানে, আর আনরোমান্টিক থেকে রোমান্টিক হয়ে যায়! ক্ষণিকের জন্য হলেও বদলায়, হতে পারে সকালে আবার নিজস্ব সত্তায় ফিরে এলো!ʼʼ

দ্বিজা কপাল জড়াল, “স্বার্থপরের দল!ʼʼ

ফারজাদ চোখ বুজল। দ্বিজা এবার হাসল একটু, চেয়ে রইল ফারজাদের দিকে। আস্তে করে চুলে হাত গুজল। গতকাল চুল-দাড়ি কেটে এসেছে ফারজাদ। চুলগুলো মনোযোগ দিয়ে নাড়তে নাড়তে নজরে এলো কালো চুলের পেখমের ভাজে ভাজে ভেসে ভেসে উঠছে সোনালী রঙা আংটিটা! এত সুখ সুখ কেন লাগছে বেঁচে থাকতে! এই মানুষটাকে হাসিল করতে তার যতখানি চোখের পানি ঝরাতে হয়েছে, তার সবটা আজ এই এক মুহুর্তে উসুল হয়ে গেছে! এই যে সুখটুকু অনুভব হচ্ছে, মনে হচ্ছে কান্নার পানির চেয়ে পরিমাণে বেশিই বোধহয় হয়ে গেল! এই এক চিলতে পরিমাণ সুখের জন্য দ্বিজার আরও একবার কাঁদতে ইচ্ছে করছে এই পুরুষের বিরহে! কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে থাকা পুরুষটির বিরহে ক’দিন কেঁদে যদি এই অক্ষয় সুখের দেখা মেলে, সে বহুযুগ যুগ কাঁদতে চায়, তারপর একবার চোখ মুছে এভাবে একরত্তিখানিক সুখ চায়! একবার ফারজাদের চুল নিয়ে আনমনে খেলতে চায়, আর দেখতে চায় চোখ বুজে থাকা শ্যামলা চেহারার গম্ভীর, আজব অভিমানী পুরুষটিকে!

চলবে..

[রিচেইক করিনি, ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে