তপ্ত সরোবরে পর্ব-০১

0
748

#সূচনা_পর্ব
#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মর্তুজা

“ছেঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে গেছে তোমার ছেলে। এজন্যই তো বিয়ে শাদি করতে চায় না, বড়ো মামি।ʼʼ

দ্বিজার কথায় ফারজাদ শক্ত মুখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “মূর্খ, ওটা ‘ব্যাঁকা’ না ‘বাঁকাʼ হবে। বাই দ্য ওয়ে, তোর মতো ফালতু সময় আমার হাতে কোথায়, দ্বিজা! আপাতত আমি যতদিন আছি, নিজের বাপের বাড়ি গিয়ে থাক।ʼʼ

ফরহানা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন একটু, “তুই চটে যাইতেছিস ক্যান? দ্বিজা কী সত্যি বলতেছে, বাপ? আমার বিশ্বাস তোর মতো পানসে ছেলেরে দিয়ে ওসব হইত না ইহজনমেও।ʼʼ

ফারজাদ নিরস মুখে বলল, “আম্মা! আপনাদের মতো সারাদিন এসব সস্তা ভাবনা নিয়ে পড়ে থাকার জীবন না আমার। আপনাদের এই ভাঙা রেডিওর ফ্যাচফ্যাচানির জন্য দু-একদিন ছুটি পেলেও বাড়ি আসতে ইচ্ছে করে না।ʼʼ

দ্বিজা চেয়ে আছে ফারজাদের বিরক্তি মাখা মুখটার দিকে। ওভাবেই একটু ভেঙচি কাটল, যদিও ফারজাদ দেখল না তা। ফারহানা বেগম অস্পষ্ট চিত্তে বললেন, “তার মানে তুই বুঝাইতেছিস–আমরা কোন কাজ করিনা, শুধু উল্টাপাল্টা ভাবনা ভাবি?ʼʼ

ফারজাদ সিদ্ধ ডিমের কুসুমটা ছড়িয়ে রেখে সাদা অংশটা মুখে পুরে নিলো। তা গিলে পানির গ্লাস এগিয়ে নিতে নিতে বলল, “এক্সাক্টলি!ʼʼ

“এই-তো ছিল আমার কপালে। বউ না আসতেই মা অপদার্থ হয়ে গেছে। হায়, হায়!ʼʼ

ফারজাদ বিরক্ত হয়ে উঠল, “কী সমস্যা, আম্মা! এজন্যই সকাল সকাল টেনে তুলে আনলেন নাকি— নাকে কাঁদার জন্য?ʼʼ

ফারহানা বেগম অবাক হওয়ার ভান করলেন, “তুই ফিরে আয় তো, বাপ। তোর আর সরকারের ফরমায়েশ খাটা লাগত না। এমনিতেই ছোটোকাল থেকে রসকস নাই তোর ভিতরে। আরো কঠোর হই যাইতেছিস দিনকে দিন।ʼʼ

ফারজাদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “সকাল সকাল কী শুরু করলেন? যান, নিজের কাজে যান। আমার নিজের জ্ঞান আছে নিজের জীবন নিয়ে ভাবার?ʼʼ

“তাই বলে তোর বিয়ে নিয়ে ভাবার হক নাই আমাদের?ʼʼ

“আছে, তবে আপাতত এখন না। এক কথা বলতে বলতে কত ক্যালোরি লস করে ফেলেছি—তবুও তা মগজে ঢুকে নি আপনাদের!ʼʼ

“ফারজাদ, তুই একটা যা-তা হয়ে ফিরছিস এইবার।ʼʼ

ফারজাদ কফির মগটা হাতে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল বাড়ির পেছনের খোলা জায়গাটাতে। দ্বিজা পেছন পেছন উঠে যায়। ফারজাদ গিয়ে দাঁড়াল ভিটির ওপর। রাস্তার ওপারে মাঠ। কুয়াশায় ঢেকে আছে মাঠের প্রান্তর। ক’দিন আগেই ধান কাটা হয়েছে। খুব শীঘ্রই সরিষার বীজ ছিটানো হবে হয়ত। এসবের টানেই ফারজাদ গ্রামে আসে কয়েকদিন ছুটি পেলেই। ঢাকার যান্ত্রিক শহরটা বড্ড প্রাণহীন লাগে তার কাছে।

“একটা জ্যাকেট নিয়ে আয় তো আমার রুম থেকে।ʼʼ

দ্বিজা নিঃশব্দে এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে। অথচ তা ফারজাদ টের পাওয়ায় ভ্রুটা কুঁচকে ফেলল দ্বিজা। এজন্যই বোধহয় এরা পুলিশ-প্রশাসনের লোক! শরীরের চারদিকে চোখ। মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে ভেতরে গেল দ্বিজা। ফিরে এলো একটা চাদর হাতে, দ্বিজারই চাদর। সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার সব কাপড় তো লাগেজে ভরা। এটা দিয়েই চালাও।ʼʼ

ফারজাদ কিছু বলল না। চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিলো। সকাল সাতটার মতো বাজে। বাড়ির কর্তা তো সেই ভোর সকালে বেরিয়ে গেছে। তবে বাকি সদস্যরা ঘুমে কাত। ফারজাদের অভ্যাসবসত সে উঠে ল্যাপটপে বসেছিল। ফারহানা এসে টেনে নিয়ে গেছেন নাশতার জন্য। দ্বিজা শীত লেগে মুখ দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করছে আর হাতের সঙ্গে হাত ঘষছে। ফারজাদ একবার তাকাল, বলল, “এত সকালে উঠেছিস কেন? যা ঘরে গিয়ে ঘুমা, আ’ম সিওর সারারাত ঘুমাস নি। সূর্য উঠলে উঠিস, যা।ʼʼ

“উহু, প্রতিদিন তো বাড়ি থাকলে উঠতে বহুত বেলা হয়। আজ যখন সকালে ওঠার সুযোগ পেয়েছি, ভালোই লাগছে।ʼʼ

ফারজাদ জিজ্ঞেস করল, “পড়ালেখা কেমন চলছে? নাকি ফাঁকি টাকি দিস?ʼʼ

“আগে দিতাম নাকি?ʼʼ

“মানুষ ছোটোবেলায় সবাই পড়ালেখায় ভালো থাকে। পড়ালেখা নষ্ট হয় বয়স বাড়ার সাথে সাথে?ʼʼ

“তা কেন?ʼʼ

“এখনও পড়ালেখার প্রতি মনোযোগ সরেনি, তবে সময় হলে বুঝবি জীবনটা টুইস্টেড। যখন-তখন পাল্টি খায়, সব উলট-পালট হয়ে যায়। এখন বুঝবি না।ʼʼ

“তোমার আমাকে এখনও ছোটো মনে হয়? ইন্টারমিডিয়েট শেষ করব ক’দিন পর।ʼʼ

“তো কী? বুড়ি হয়ে গেছিস?ʼʼ

ফারজাদ একটু এগিয়ে গেল ডানদিকে। বাড়ির সীমানা ঘেঁষে সামনে বাঁশের চ্যাগারের প্রাচীর, তার মাঝে নানান ফল ও কাঠের গাছপালা, নিচে শিশিরভেজা ঘাস। দ্বিজাকে বলল, “একটা চেয়ার নিয়ে আসতে পারবি?ʼʼ

দ্বিজা মুখ ফোলায়, “বড়ো মামি একটুও ভুল বলেনি। তুমি একদম পাথুরে হয়ে গেছো, ফারজাদ!ʼʼ

ফারজাদ চোখ ফিরিয়ে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিজা বলে ওঠে, “ভাই!ʼʼ

একটু অপ্রস্তুত দেখায় দ্বিজাকে। এই এক সমস্যা তার, তার কথার ব্যালেন্স নেই। ভদ্র ভাষা বলতে বলতে আঞ্চলিকে চলে যায়, আর ফারজাদকে ‘ভাইʼ বলতে পারে না, সাথে আপনি-তুমি সম্বোধনে গুলিয়ে ফেলে। ফারজাদ মৃদু হেসে ফেলল দ্বিজার দিকে তাকিয়ে। দ্বিজা পুলকিত হয়ে ওঠে। ওই গোমরামুখোটা হেসেছে। সে নিজেও উজ্জ্বল এক হাসি দিয়ে বলল, “স্বার্থপর! একটা চেয়ারের কথা বলছো? আমি বসব না? নাকি আমায় বসতে বারণ করে দিলে ইনডাইরেক্টলি?ʼʼ

ফারজাদ ‘চ্যাহʼ এত অস্পষ্ট উচ্চারণ করে বলল, “আচ্ছা বসবি তুইও, এবার অপ্রয়োজনীয় কথা খরচা না করে দুটো চেয়ার আন, যা।ʼʼ

চেয়ার এনে দিলে ফারজাদ বসল। নিজের চেয়ার টেনে নিয়ে দ্বিজা বসতে যাবে তখনই ফারজাদ আবার বলে, “আমার ল্যাপটপ আর একটু টুল এনে দে তো, দ্বিজা!ʼʼ

দ্বিজা সে কথায় পাত্তা না দিয়ে আরাম করে বসে ত্যাড়ামি করে বলল, “আর এক আনার কথাও শুনতে পারতাম না আমি আপনার। বহুত খাটিয়েছেন সকাল থেকে।ʼʼ

ফারজাদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়, “ওই! তোর সাথে দেখা হয়েছে দশ মিনিট খানেক, আর বহুত কখন খাটালাম? বড়ো ভাই আমি তোর, সিনিয়রদের কথা শুনতে হয় জানিস না? নাকি কলেজে রেগিং খাসনি এখনও?ʼʼ

সে যাই হোক, কথাটা কেন জানি শুনতে মোটেই ভালো লাগল না দ্বিজার। কেন লাগল না, সে জানে না। কেবল উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “ভাই না তুমি, সরি আপনি, আপনি আমার শিক্ষক।ʼʼ

দ্বিজা চলে যায় বাড়ির ভেতরে। বেশ কিছুক্ষণ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দ্বিজা ফিরল না আর। ফারজাদ বিরক্ত হয়ে ডাকল মাকে, “আম্মা! আম্মা! আমার ল্যাপটপটা পাঠান তো কাউকে দিয়ে।ʼʼ

অতঃপর মনে পড়ল, তার আরও একটা জিনিস দরকার এখন। যা আর কাউকে দিয়ে আনানো না। ফারজাদ উঠে গেল ভেতরে। নিজের রুমে গিয়ে পড়ার টেবিলের ড্রয়ার খুলে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে লাইটার খুঁজল। না পেয়ে বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। রান্নাঘরে সিলিন্ডার গ্যাসে রান্না বসিয়েছে ফারহানা বেগম ও আফছানা বেগম। ফারজাদকে দেখেই আফছানা মাথায় ঘোমটা তুলে দিলেন। হাজার হোক ভাসুরের ছেলে। মিষ্টি হেসে বললেন, “রাতে আইলা, দেখা তো করলা না!ʼʼ

ফারজাদ বলল, “অভিযোগগুলো সব বস্তা বেঁধে রাখো, বউমা! এসেছিই প্রায় মাঝরাতে। খাওয়ার টেবিলে কথা হবে। আম্মা, দিয়াশলাই দিন তো!ʼʼ

ফারহানা বেগম চোখ গরম করে তাকালেন, “তোর বাপ আসুক, বলব আমি। সকাল সকাল ধোঁয়া উড়াবা তুমি? বজ্জাত ছেলে!ʼʼ

ফারজাদের মুখে বিরক্তি, “সে আব্বু আসুক, আসলে বলবেন না হয়। এখন দিয়াশলাই দিন।ʼʼ

ফারজাদ চলে যায় বাড়ির পেছনে। এই ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় গরম গরম সিগারেট, জমবে খুব। পেছনে ফারহানা বেগম গোমরা মুখে চেয়ে রইলেন। এ কী ধরণের ছেলে জন্মেছে তার ঘরে? যার কোন ধরণ-ই নেই। এ গ্রাম কেন, দশ গ্রামেও এমন একটা গোমরামুখো নেই বোধহয়।

ফারজাদ সিগারেট ধরিয়ে বাঁ-হাতের আঙুলের ভাজে চেপে ধরে ডান-হাতে ল্যাপটপ খুলে কোলের ওপর চড়িয়ে পা দুটো ভাজ করে রাখল দ্বিজার চেয়ারে। দ্বিজা তা দেখল দোতলার পেছন বারান্দা থেকে। মুখ শক্ত করে নাক-মুখ কুঁচকে নিলো। মনে মনে আওড়ায়, “ওরে ব্যাটা সিনিয়র! আমাকে সভ্যতা শেখাচ্ছিলে না খুব? আজ বড়ো মামা আড়ৎ থেকে আসুক একবার। প্রমাণসহ তোমার সভ্যতা বের করছি। আমায় তুলে দিয়ে সেই চেয়ারে পা দুলিয়ে সিগারেট খাওয়ার সুখ দুঃখে পরিণিত করব আমি।দ্বিজাকে চেনো না তুমি!ʼʼ

দাঁত দিয়ে জিহ্বা কাটল। অস্পষ্ট স্বরে বলল, “পরিণতি।ʼʼ
হঠাৎ-ই মনে পড়ে—এ-কথা ফারজাদ শুনলে নিশ্চয়ই বলত, “মূর্খ, পরিণিতি না, পরিণতি।ʼʼ

আবার একবার তাকায় দ্বিজা নিচের দিকে—ঘিয়ে রঙের একটা শাল চাদর গায়ে জড়িয়ে, সাদা লুঙ্গি ও সাদা চশমা পরিহিত এক যুবক বসে আছে বাগানের মাঝখানটায়।গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, সরু নাক, সিগারেটে পোড়া কালচে ঠোঁট –রহস্যজনক এক গড়ন পুরুষটির। না অভদ্রলোক বলা যায়, আর ভদ্রলোক তো মোটেই বলা যায় না। সাহেবী ভঙ্গিতে চেয়ারে পা তুলে সিগারেট মুখে দিয়ে ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। অজান্তেই স্মিত হেসে ফেলল দ্বিজা। ধীরে ধীরে সেই হাসি প্রসারিত হয়ে মুচকি হাসিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে