জোড়া শালিকের সংসার পর্ব-২০

0
1993

#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_২০

দরজার কাছে কারো পায়ের আওয়াজ হতেই খেয়া সটান শুয়ে কম্বল দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলল।ছি!সে নির্ঝরকে মুখ দেখাবে কি করে?

নির্ঝর হাতের নাস্তার প্লেটটা সেন্টার টেবিলে রেখে খেয়ার দিকে তাকালো।খেয়া মাথা ঢেকে এখনো শুয়ে আছে।নির্ঝরের সারামুখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো।

__’খেয়া!এই খেয়া?’

খেয়া মরা কাঠের মতো ঘাপটি মেরে আছে।সে উত্তর দিল না।

নির্ঝর আলতো হাতে কয়েক পা এগিয়ে খেয়ার মাথার কাছের কম্বল টেনে সরাতে চাইলো।কিন্তু পারলো না।খেয়া হাত মুঠ করে শক্ত করে কম্বল ধরে রইলো।সে কিছুতেই নির্ঝরকে মুখ দেখাবে না।ইশ!কি লজ্জা!

খেয়া যে জেগে রয়েছে তা বুঝতে নির্ঝরের অসুবিধা হলো না। সে কম্বলের উপর দিয়েই খেয়ার মাথায় ঠোঁট ছোঁয়ালো।তারপর মুচকি হেসে সরে আসলো।সে বেশ বুঝতে পারছে আজ সারাদিন খেয়া লজ্জায় তার সামনে আসবে না।আজব তো!এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে?তারা তো স্বামী-স্ত্রী!

সে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।শেষ রাতে বৃষ্টি থেমে গেছে।এখন ঝকঝকে আকাশ।গাছ-গাছালীর সব পাতা একদম পরিষ্কার।আকাশের মতোই ঝকঝকে!প্রকৃতির সবুজ রঙ যেন ঠিকরে পড়ছে।সে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো।আজ সব কিছুই তার ভালো লাগছে।অনেক বেশি ভালো লাগছে!সত্যিই জীবন এত সুন্দর কেন?

এত সুন্দর জীবন!অথচ কত ক্ষনস্থায়ী সময়ের জন্য আসা!সৃষ্টিকর্তা মানুষের আয়ু আর একটু বাড়িয়ে দিলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো?কচ্ছপের মতো ধীরস্থির একটা প্রাণী আড়াই’শ বছর বাঁচে।আর মানুষ এত বুদ্ধিমান প্রাণী, সৃষ্টি জগতের সেরা জীব হয়েও এত অল্প আয়ুর কেন?

পরমুহূর্তে নির্ঝরের মনে হলো মানুষের জীবন অনেক স্বল্প সময়ের বলেই প্রতিটা ক্ষণে ক্ষনে আনন্দ, সুখ কুড়াবার চেষ্টা করে।জীবন অনেক দীর্ঘ হলে তার প্রতি বিরক্ত এসে যেতো।প্রতিটা মুহূর্ত মূল্যবান মনে হতো না।

নতুন একটা মিষ্টি সকাল শুরু হয়েছে।নির্ঝর মনে মনে প্রার্থনা করলো, বাকি জীবনটাতে প্রতিটা সকাল যেন আজকের মতোই সুন্দর আর ভালোবাসায় ভরপুর থাকে।প্রতিটি সকাল যেন তার খেয়াতরীকে পাশে পায়!

সে বিড়বিড় করে বলল,ভালোবাসায় এত সুখ কেন?এত সুখ পেলেই তো হারানোর বড্ড ভয় হয়!তার খেয়াতরীকে সে হারিয়ে ফেলবে না তো?

সে পারবে না খেয়াকে ছাড়া বাকি পথটুকু পাড়ি দিতে।খেয়াকে ছাড়া সে সত্যিই ডাইনোসরের মতো বিলীন হয়ে যাবে এ পৃথিবী থেকে!

খেয়া সামান্য একটু কম্বল সরিয়ে এক চোখ বের করে পুরো রুমে চোখ বুলালো।নির্ঝর রুমে নেই।হয়তো বেলকনিতে!

নির্ঝর আসার আগেই সে এক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।ওয়াশরুমের ছিটকিনি লাগানোর পর মনে পড়লো ওয়ারড্রব থেকে ড্রেস বের করতে হবে!

তার চিৎকার করে কান্না করতে মন চাচ্ছে।এবার যদি নির্ঝরের মুখোমুখি হয়ে পড়ে?নির্ঝরের সামনে কেমনে যাবে?

পুনরায় ছিটকিনি খুলতেই ভালো করে ওয়াশরুমে তাকিয়ে দেখে টকটকে লাল রঙের সিল্কের শাড়ি ঝুলছে।

খেয়া বুঝতে পারলো নির্ঝর তার প্রয়োজনীয় সব জিনিস ওয়াশরুমে আগে থেকেই রেখে দিয়েছে।

এক চিলতে হাসি ঠোঁটে উৎপন্ন হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো!

২৯.

মিতুর কলেজে যাওয়ার আগে নুহাকে স্কুলে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পড়েছে।তার খেয়া আপার হালকা জ্বর।সেজন্য সে নিজে থেকেই দায়িত্বটা কাঁধে নিয়েছে।

নুহার স্কুল আর তার কলেজের মধ্যবর্তী দূরত্ব বেশি নয়।খেয়া তবুও আজ দেড় ঘন্টা আগে রওনা দিয়েছে।

__’আন্টি,তুমি মায়ের মতো সাজুগুজু করো না।কেন করো না?’

নুহার প্রশ্নে মিতু তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দেয়।বলে,

__’কেন?সাজুগুজু না করলে কি ভালো লাগে না আমাদের?খেয়া আপা তো এমনিতেই কত সুন্দর!জানো, আমার প্রথম দিন তোমার মায়ের চেহারা দেখে হিংসে হয়েছিল।মানুষ এত সুন্দর কিভাবে হয়?’

নুহা খিলখিল করে হাসে।মিতুও তার হাসিতে তাল মেলায়।

কয়েক মিনিটের মাথায় ড্রাইভার গাড়ি থামায়।নুহার সাথে সাথে মিতুও গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।নুহার স্কুলে সে আজ প্রথম এসেছে। বাইরে থেকে স্কুল দেখেই অবাক হয়ে যায় সে!বাচ্চাদের স্কুলও এত সুন্দর হতে পারে?গেটের সামনে কি সুন্দর ফুল গাছ!সে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে।

__’চাচা,আপনি গাড়িটি পাঁচ মিনিটের জন্য একটু সাইড করুন।আমি নুহার স্কুলের ভেতর থেকে ঘুরে আসি!’

মিতুর কথায় ড্রাইভার মাথা নেড়ে বলে,

__’আচ্ছা!’

মিতু খুশিমনে নুহার হাত ধরে ভেতরে পা রাখে।স্কুলের ভেতরের পরিবেশ দেখে সে আরো মুগ্ধ হয়।
কিছু মানুষ আছে যারা জগতের সবকিছুতেই মুগ্ধতা খুঁজে পায়।তাদের সামনে কর্কশ গলার কাকও অবিরত কা কা করে গেলে তারা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে!ক্ষণে ক্ষণে বিস্ময় প্রকাশ করে।

আর কিছু মানুষ আছে জগতের সবকিছুতে তাদের অনীহা।বড় বড় ঘটনাও তাদের বিন্দুমাত্র বিস্মিত করে না।তাদের সামনে যদি সহস্র কোটি বছর আগের বিলুপ্ত ডাইনোসর এনেও রাখা হয়,তারা বিচলিত হবে না।মুগ্ধ হবে না!মুখটা স্বাভাবিক রেখেই বলবে,”অহ, আচ্ছা!এটা ডাইনোসর।’এমন ভাব করবে যেন জীবন্ত ডাইনোসর দেখা কোনো বিশাল কোনো ঘটনা নয়!

এদের মধ্যে মিতু প্রথম ক্যাটাগরির।সে মানুষটাই এমন।বিস্মিত হওয়ার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে।যা দেখে তাতেই বিস্মিত হয়!

নুহাকে ক্লাসে পাঠিয়ে সে স্কুলের বেশ কিছু অংশ ঘুরে ঘুরে দেখল।ঘড়ির দিকে নজর দিতেই আঁতকে উঠলো।কলেজ শুরু হওয়ার আর বেশি দেরি নেই!

ক্ষীপ্রপায়ে গেট দিয়ে বের হতে গিয়ে আজকেও কারো সাথে ধাড়াম করে বাড়ি খেল।কপাল কুঁচকে সামনে তাকিয়ে দেখে রাহাত নামক সাড়ে ছয় ফিট লম্বা বাঁদরটা!মুহুর্তে মিতুর মনটা খারাপ হয়ে গেল।এই মানুষটা এখানেও?

সে আরেক নজর রাহাতের দিকে তাকাল।রাহাতের ডান হাতে প্যাকেট।আর দু চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।হয়তো তাকে এই জায়গাটাতে এক্সপেক্ট করেনি।

সে বিস্ময় মাখা কন্ঠেই বলল,

__’তুমি এখানে?’

মিতু উত্তর দিল না।পাশ কাটিয়ে এক পা হাঁটতেই বুঝতে পারলো আজকেও এক পায়ের স্লিপার ছিঁড়ে গেছে।কোন কুক্ষণে এই মানুষটার সাথে তার দেখা হয়?আর হলেই কি এভাবে জুতা ছিঁড়তে হবে?ধুর ছাই!

__’কি হলো?তুমি এখানে কি করছো মিতু?’

মিতু কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিল,

__’কিছু না।’

__’বিজ্ঞানের ভাষায় নাথিং বলতে কোনো ওয়ার্ড নেই।নাথিং শব্দটা আপেক্ষিক।নিশ্চয়ই তুমি এখানে কিছু করতে এসেছিলে।’

মিতু বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল,

__’আমি যদি কিছু করতেও আসি সেটা কি আপনাকে বলতে বাধ্য আমি?’

রাহাত থতমত খেয়ে বলল,

__’না, মানে সেরকম কিছু নয়।আসলে সারাজীবন একসাথে থাকতে হবে আমাদের।একটু পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করছি।কিন্তু তুমি তো!আচ্ছা মিতু,আমার জন্য কি তোমার হার্টে একটুও লাভ নেই?’

__’জি না!আপনার জন্য আমার হার্টে হেট আছে!’

বলেই মিতু ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে গাড়িতে গিয়ে উঠলো।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গাড়ি সাঁই করে রাহাতের সামনে দিয়ে চলে গেল।

যতক্ষণ গাড়ি দেখা গেল,রাহাত ততক্ষণ তার দিকে চেয়ে রইলো।দৃষ্টির অগোচর হতেই সে মুচকি হেসে গেট দিয়ে স্কুলে ঢুকলো।সকাল সকাল বেলা তার রাগিনির সাথে দেখা হয়েছে।আজকের দিনটা তার অনেক ভালো যাবে।ভালো যেতেই হবে!

সে খুশিমনে হেঁটে দিশানের ক্লাসে ঢুকলো।দিশানের এবার ক্লাস ওয়ানে থাকার কথা।কিন্তু এত দুষ্টু হয়েছে!পড়াশোনা কিছুই করে না।প্লে তে রয়েছে দু বছর হলো!

সে দিশানের টেবিলে একটা প্যাকেট রেখে বলল,

__’তেলাপোকা, তোর টিফিনের খাবার।খেয়ে নিস।আর খবরদার কাল থেকে আমাকে জ্বালাবি না।তোর স্কুলে আমি আর আসতে পারবো না।’

দিশান খাবারের প্যাকেটটা সরিয়ে বলল,

__’কাকু, তোমায় আজ হাসিখুশি লাগছে।ব্যাপার কি?’

__’তোর কাকির সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিল রে।’

__’কাকি?’

__’কিছু না।এমনিই বললাম।পড়তে থাক।’

__’তোমার হাতের বাকি খাবারের প্যাকেটটা দিয়ে কি করবে কাকু?আমায় দিয়ে যাও!আমি খাই!’

রাহাতের দিশানের মাথায় চাটি মেরে বলল,

__’তেলাপোকা, তুই এত খাবার একা কেমনে খাবি?এটা তোর টিকটিকি ফ্রেন্ড নুহার জন্য।দেখ তো ক্লাসে এসেছে কি না।’

দিশান পুরো ক্লাস মাথা উঁচু করে এক নজর দেখে খুশি হয়ে বলল,

__’কাকু,ওই তো আমার টিকটিকি!জানালার পাশে বসে।’

রাহাত বিরক্ত হয়ে বলল,

__’তোর টিকটিকি মানে?মেরে পিঠের ছাল তুলে দিবো।ওকে আর টিকটিকি ফিকটিকি বলবি না।ওর বাপ অনেক ড্যানজারাস মানুষ।জানতে পারলে আমার হালুয়া টাইট করে দিবে।যাকে বলে রাম ক্যালান ক্যালাবে।’

বলেই রাহাত নুহার দিকে এগিয়ে গেল।নুহার টেবিলে খাবারের প্যাকেট রেখে বলল,

__’নুহা পরী!কাকু খাবার দিয়ে গেল।টিফিনে খেয়ে নিয়ো।’

নুহা রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

__’কাকু,মা তো বাসা থেকে টিফিন দিয়ে দিয়েছে।’

__’তাতে কি!আমি যেটা দিলাম এটাও খাবে।’

নুহা মাথা নেড়ে হুঁ বললো।রাহাত মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে দিশানকে হাত নেড়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল।

নুহা খাবারের প্যাকেটটা টেবিল থেকে সরিয়ে বই বের করলো।ফের খাতা বের করতেই দিশান ব্যাগ নিয়ে এসে তার পাশে বসলো।নুহা মুখ ফুলিয়ে তার দিকে তাকাল।

দিশান খিলখিল করে হেসে বলল,

__’টিকটিকি।আজ থেকে ডেইলি তোমার সাথে বসবো।’

__’কেন?তুমি আমার সাথে বসবে কেন?’

__’কারণ টিকটিকিকে জ্বালাতে আমার অনেক ভালো লাগে।আমি ভেবে রেখেছি বড় হয়ে টিকটিকি কে বিয়ে করবো।’

নুহা ভ্রু কুঁচকে তাকায়।বলে,

__’আমি কিন্তু মাকে আর বাবাইকে সব বলে দিবো দিশান।’

দিশান হেসে কুটিকুটি হয়।

৩০.

নির্ঝর অফিস থেকে ফিরেছে বিকেল বেলা।উপরে উঠার সময় নুহার রুমের দরজায় এক নজর খেয়াকে দেখেছিল।চোখে চোখ পড়তেই লজ্জা মিশ্রিত মুখে দরজা বন্ধ করেছে।আর দেখা মেলেনি।

সে ভেবেছিল ডিনারের সময় দেখা পাবে।কিন্তু না!ডিনারের সময়ও তার থেকে লুকিয়ে থেকেছে।নুহাকে সাথে নিয়ে সে ডিনার শেষ করেছে।

এখন রাত দশটা বাজে প্রায়।নির্ঝর বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।খেয়া কি রাতেও রুমে আসবে না?অন্তত ঘুমানোর জন্য আসার কথা!

সত্যি সত্যি আজ সারাদিন খেয়া তার মুখোমুখি হয়নি।অফিস যাওয়ার সময় সে বেশ কয়েকবার তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে।কিন্ত খেয়া নাছোড়বান্দা।কথা বলা তো দূরে থাক।দেখাও করেনি।সে যেন ছায়ামানবীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।এক নজর দেখে তো, চোখের পলক ফেললেই উধাও!

সে দিনে বিশটার মতো মেসেজ দিয়েছে তাকে।পুনরায় জ্বর এসেছে কি না জানার জন্য।কিন্তু খেয়া উত্তর দেয়নি।পরে বাসায় ফেরার পর জমিলা খালার থেকে শুনেছে আর জ্বর আসেনি এবং এখনো মেডিসিন খাচ্ছে।

আস্তে করে দরজা ভেড়ানোর শব্দে নির্ঝর বেলকনি থেকে রুমে তাকাল।খেয়া নখ কামড়াতে কামড়াতে রুমে ঢুকেছে।তার চোখ এদিক ওদিক কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।কয়েক পা এগিয়ে খেয়া ওয়াশরুমের দরজায় কান পাতলো।হয়তো সে ভেতরে আছে কি না বোঝার চেষ্টা করছে।

খেয়ার কর্মকান্ডে নির্ঝরের বড্ড হাসি পেল।সে পা টিপে টিপে রুমে প্রবেশ করলো।

খেয়ার পেছনে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে তাকে পেছন থেকেই জড়িয়ে ধরলো।কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

__’কাকে খুঁজছে আমার খেয়াতরী?’

খেয়া লজ্জায় লাল,নীল,বেগুনি হয়ে চোখ বন্ধ করলো।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে