ক্যালেন্ডার! পর্ব: ২১!

0
635

গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ২১!
লেখক: তানভীর তুহিন!

মুবিন লাগাতার ফোন করেও যখন মিছিলের নাম্বার বন্ধ পায় তখন মুবিন মিছিলের বাবার নাম্বারে ফোন করে। মিছিলের বাবার নাম্বারটাও বন্ধ পায় মুবিন। মুবিন শাওনকে ফোন করে হাসপাতালের এড্রেস দিয়ে বলে খোজ নিয়ে মুবিনকে জানাতে। শাওন জানায়, ওখানে মিছিলকে পায়নি সে। এভাবে ৪ দিন কানাডায় অস্থির মাথা খারাপ অবস্থায় কাটিয়ে দেয় মুবিন। কারন শরীরের জ্বর ছাড়ছিলোই না। জ্বর খানিক ছাড়তেই মুবিন দেশে ফিরে আসে। এয়ারপোর্টে নেমেই সোজা আহাদ শেখ এর অফিসে চলে যায় মুবিন। মুবিনকে হঠাৎ করেই নিজের কেবিনে দেখে চমকে যায় আহাদ শেখ। চেহারায় তার অবাক হয়ে যাওয়ার ছাপ স্পষ্ট। আহাদ শেখ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ” তুই সাডেন দেশে ফিরলি? ”
মুবিন আহাদ শেখের প্রশ্নের পিঠে জবাব না দিয়ে বলে, ” আমার গাড়ির চাবিটা দিন! ”
– ” হ্য দিচ্ছি। তোকে অস্থির লাগছে কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছে? সাডেন দেশে ফিরলি কিছু জানালি না তো! ”
– ” প্লিয গাড়ির চাবিটা দিন তো আমার কাজ আছে। ”
আহাদ শেখ আর কথা না বাড়িয়ে ম্যানেজারকে ফোন করে মুবিনের গাড়ির চাবিটা নিয়ে আসতে বলে। এর মধ্যেই আহাদ শেখের সেক্রেটারি আহাদ শেখের রুমে ঢুকে। সেক্রেটারি রুমে ঢুকতেই মুবিন জিজ্ঞেস করে, ” আপনাকে মিছিল কোনো কারনে ফোন-টোন করেছিলো? ”
– ” না তো। কিন্তু স্যার আপনি কখন ফিরলেন? আমায় তো টিকেট বুক করতে বলেননি! ”
মুবিন সেক্রেটারিকে জবাব না দিয়ে চেয়ার টেনে বসে দুশ্চিন্তার শ্বাস ফেলে। আহাদ শেখ মুবিনকে অস্থির দেখে জিজ্ঞেস করে, ” মিছিলের সাথে ঝগড়া হয়েছে তোর? শুনলাম মিছিল ৩-৪ দিন আগেই দেশে ফিরলো। ওর তো বাবা অসুস্থ ছিলো নাকি…”
আহাদ শেখ পুরো কথা শেষ করার আগেই ম্যানেজার এসে কেবিনের দড়জায় টোকা লাগায়। মুবিন উঠে গিয়ে ম্যানেজারের হাত থেকে চাবিটা ছো মেরে নিয়ে বেড়িয়ে। ম্যানেজার বেচারার সালাম অর্ধেক মুখেই আটকে থাকে। ছেলের এই ব্যাবহারে খানিক দুঃখ পেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে আহাদ শেখ।

মুবিন আহাদ শেখের অফিস থেকে বেড়িয়ে গাড়ি ছুটিয়ে সোজা চলে আসে হসপিটালে। হসপিটালে এসে যা জানতে পারে তা জেনে মুবিনের হৃদস্পন্দনই থমকে যায়। মুবিন হসপিটালে এসে জানতে পারে, ” যেদিন মিছিল দেশে ফিরেছে তার পরের দিনই মিছিলের বাবা মারা গেছে। ”

মিছিলের বাবা মারা গেছেন কথাটা শুনে মুবিন যতটা না হতবাক হয়েছে তার চেয়েও বেশি আশ্চর্য হয়েছে এটা ভেবে যে মিছিলের বাবা মারা গেছে এই অথচ এই কথাটা মিছিল তাকে বলেনি। তাহলে কী মিছিলও অসুস্থ হয়ে পড়লো? মুবিন মিছিলের বাবার প্রাইভেট ডাক্তারের কাছে মিছিলের সমন্ধ্যে জানতে চাইলে ডাক্তার জানায় সে মিছিলকে তার বাবার লাশ হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাবার সময়ই শেষ দেখেছে। মুবিন দেরী না করে সোজা মিছিলদের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে। সেখানে গিয়ে যেনো মস্তিষ্কের স্বাভাবিক গতিই থেমে যায় মুবিনের। ফ্ল্যাট টা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। যার কাছে বিক্রি করেছে তার কাছে মুবিন বিক্রেতার নাম জানতে চাইলে সে জানায় ফ্ল্যাটের দলিল সই করিয়ে কোনো ব্রোকার দিয়ে গেছে। আর ফ্ল্যাটের টাকা সে কোনো ব্যাংক একাউন্টে অনলাইন ট্রানজেকশন করিয়ে দিয়েছে। এমন অদ্ভুত আর অবাক করা হাউজ ডিলিং এর কথা শুনে মুবিন ফ্ল্যাটের প্রেজেন্ট অউনার কে জিজ্ঞেস করে, ” আপনি এভাবে কীভাবে ফ্ল্যাট কিনে ফেললেন? আপনার কোনো ডাউট হয়নি? ”
ওপাশে সোফায় বসে বিজ্ঞ ভঙ্গিতে পায়ের ওপর পা তুলে ব্যাক্তিটি বলে, ” ডাউট তো একটু হয়েছিলো। কিন্তু আমি বর্তমান বাজারের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম দামে কিনেছি ফ্ল্যাটটা তাই আর ডাউট-ফাউট কেয়ার করিনি! ”
– ” আপনার ফ্ল্যাটের দলিলটা দেখান। ”
ফ্ল্যাটের দলিল দেখে বেশ অবাক হয় মুবিন। প্রায় ২-৩ মিনিট খুটিয়ে খুটিয়ে সাইনটা দেখতে থাকে মুবিন। দলিলের সাইনটা মিছিলেরই। কিন্তু মিছিল হঠাৎ ফ্ল্যাট বিক্রি করতে গেলো কেনো?

এর উত্তর সামনে থাকা ব্যাক্তির কাছে প্রশ্ন করেও পায়না মুবিন। মুবিন ওই হাউজ ব্রোকারকে ফ্ল্যাটের প্রেজেন্ট ওনার দিয়ে ফ্ল্যাটে ডাকায়। হাউজ ব্রোকার জানায় যে মিছিল কে ও জানে না। সমস্ত কথাবার্তা ওর ফোনেই হয়েছে আর ওর সাথে কথা কোনো ছেলে বলেছে তবে ও সেই ছেলের নাম জানে না। এমনকি ও ওর পুরো কমিশনও অনলাইন ব্যাংকিং এর মাধ্যমে পেয়েছে।

মিছিল ফ্ল্যাট বিক্রি করলো? তাও এমন একটা পরিস্থিতিতে? আর সেই ফ্ল্যাটের ডিল হলো এমন অদ্ভুদ উপায়ে তাও কিনা ডিলিং করলো একটা ছেলে? মুবিন ব্রোকারের কাছ থেকে ঐ ছেলের নাম্বারটা নিয়ে বেরিয়ে সোজা মিছিলের নানুর বাসায় চলে যায়। সেখানে গিয়ে কয়েকশত প্রশ্নের উত্তরের খোজে দিশেহারা হয়ে যায় মুবিন।

মিছিলের নানু বলে, মিছিলকে মিছিলের বাবার জানাজা নামাজের পর থেকেই পাওয়া যাচ্ছে না। একদমই উধাও হয়ে গেছে মিছিল।
মুবিন মিছিলের নানুর কাছে জানতে চায় সে ফ্ল্যাট বিক্রির ব্যাপারে কিছু জানে নাকি। মিছিলের নানু বলে, শুধু ফ্ল্যাট না মিছিলের নামে যেসব প্রোপার্টি ছিলো সবই কমদামে বিক্রি হয়ে গেছে। পুলিশ কমিশনারকে সাথে নিয়ে সে সব প্রোপার্টির ডিলিং এর্টনি পেপার দেখেছে। প্রত্যেকটা পেপারে মিছিলের সাইনই ছিলো।
মিছিলের নানুর কথা শুনে মুহুর্তেই যেনো মুবিনের শরীর পুরো অবশ হয়ে যায়। মাত্র দুদিনের মাথায় এতসব কিছু? কোথায় মিছিল? মিছিল নিজের বাবার মৃত্যুশোক পালন করেছে নাকি প্রোপার্টি ডিলিং করেছে? কিচ্ছু মাথায় ঢুকছেনা মুবিনের। মুবিন মিছিলের নানুর বাসায় থাকতেই শাওনকে ফোন করে বলে, ” একটা নাম্বার পাঠাচ্ছি এটার এক্সট্রিমড ক্রসড ডিটেইল পাঠা আমায় আর্লি। ”

তখন প্রায় রাত ১০ টা বাজে। শাওন অফিস থেকে ফিরে খাচ্ছে আর মুভি দেখছে। শাওন-সীমান্ত দুজনেই নিজের বাবার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি দেখাশোনা করছে এখন। অথচ পেশায় দুজনেই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। শাওন মুবিনের কথা গায়ে না মেখে বলে, ” আমি এখন মাত্র অফিস থেকে এসেছি প্রচুর টায়ার্ড আমি। তুই করছিস না কেনো? ”
– ” প্রচুর কাজ আছে তুই খেতে খেতে সীমান্তকে নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে আয় আমি পৌছাচ্ছি ! ”
– ” ফ্ল্যাটে আয় মানে? তুই দেশে কখন ফিরলি? বিয়ে করছিস নাকি মিছিলের সঙ্গে? এই আচ্ছা মিছিলকে তো ওইদিন হাসপাতালে পাইনি ওর বাবা ঠিক আছে তো এখন? ”
– ” অনেক কথা আছে তুই মুড সিরিয়াস করে ফ্ল্যাটে যা। আমি আসছি! ”
বলেই ফোন রেখে মুবিন মিছিলের নানুকে জিজ্ঞেস করে, ” মিছিলের মিসিং কেস ফাইল করেছেন? ”
মিছিলের নানু বলে, ” হ্যা। কমিশনার বলছে কোনো ক্লু’ই নাকি পাচ্ছে না মিছিলকে ট্র‍্যাক করার। ”

মুবিন আর কিছু না বলে গাড়ি টেনে ফ্ল্যাটে এসে পড়ে। ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখে শাওন-সীমান্ত দুজনেই হতভম্ব হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। মুবিন কারন জানতে চাইলে শাওন বলে, ” ভাই তুই খালি সিরিয়াস হইতে বলছিস আমায়? এই সিমের ডিটেইলস তো আমায় সিরিয়াস হওয়াই ভুলিয়ে দিয়েছে। ”
– ” মানে? ”
– ” এই সিমটা গত ৩ দিন আগে এক্টিভেট করা হয়েছে। আর যার ডিটেইলস দিয়ে এই সিম কেনা হয়েছে সে ৮ বছর আগে মারা গেছে। ”
– ” সিম কোম্পানির ডাটাবেজ হ্যাক করে ফিঙ্গারপ্রিন্টটা নে ওইটা ন্যাশনাল ডাটাবেজ এর সাথে ম্যাচ করবো। ”
– ” অলরেডি হ্যাক করে ফেলেছি কিন্তু ওই সিমের অউনার এর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই ডাটাবেজে। ”

তারপর মুবিন হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শুরু করে, হাসপাতালের ট্রানজেকশন ডাটাবেজ, ব্যাংকের ট্রানজেকশন ডাটাবেজ সব হ্যাক করে ক্লু খুজেছে কিন্তু কিচ্ছু খুজে পায়নি। হসপিটালের স্পেসিফিক কিছু কিছু টাইমের সিসিটিভি ফুটেজ কারাপ্টেড। আর এমনভাবে কারাপ্টেড যে হাসপাতালের স্টোরেজ আর্কাইভ থেকেও তা রিকোভার করা যায়নি। প্রোপার্টি ডিলিংয়ের টাকা যে ব্যাংক একাউন্টে ঢুকেছিলো সেটা এমন একজনের যে প্রায় আড়াইবছর আগে মারা গেছে। আর তার একাউন্ট প্রায় বন্ধই। সে একাউন্ট থেকে টাকা প্রায় ৮০ টা ভিন্ন ভিন্ন একাউন্টে ছোট ছোট এমাউন্টে ভাগ করে তারপর উইথড্র করা হয়েছে। মিছিল দেশের বাইরে কোথাও গিয়েছে কিনা সেটা জানার জন্য মুবিন ইমিগ্রেশন ডাটাবেজও হ্যাক করে ফেলে কিন্তু ডাটাবেজ অনুযায়ী জানতে পারে যে মিছিল লাস্ট কানাডা থেকে বাংলাদেশেই ফ্লাই করেছে।

সবদিক থেকে নিরাশ হয়ে অবশেষে মুবিন নিজের মা আলেয়া শিকদারের ন্যাশনাল নিউজ চ্যানেলে মিছিলের মিসিং নিউজ টেলিকাষ্ট করায়। কিন্তু তাতেও কোনো খোজ পাওয়া যায় না মিছিলের।

আজ প্রায় ১২ দিন যাবৎ মিছিল উধাও। কেউ কিডন্যাপ করেছে নাকি সোজা মেরে দিয়েছে তা জানে না মুবিন। কোনী সুত্রই খুজে পায়নি এই অবধি। সবটা আবারো ভাবতেই মিছিল নিজের কাছে নেই এটা তীব্রভাবে অনুভব করে মুবিন। মিছিলকে হারানোর আর মিছিলকে খুজে না পাবার ক্ষোভে আবারো নিজের মাথাটাকে বাথটাবের পানিতে ঢুকিয়ে চুবিয়ে ধরে মুবিন।

চলবে!
#thetanvirtuhin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে