ক্যালেন্ডার! পর্ব: ২০

0
632

গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ২০!
লেখক: তানভীর তুহিন!

রাত প্রায় দেড়টা। শহরের সবচেয়ে নিরিবিলি রাস্তাটা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরছে মুবিন। গাড়ির ভেতরে গিয়ারবক্সের ঠিক পাশেই একটা উইস্কি-র বোতল রাখা যেটায় খানিক বাদে বাদে চুমুক দিচ্ছে মুবিন। বাম হাত দিয়ে স্টিয়ারিং সামলাচ্ছে আর ডান হাত দিয়ে সিগারেট ফুকছে মুবিন। প্রায় ১৫-২০ মিনিট যাবৎ ধরে চলছে এই প্রক্রিয়া। সোডা আর পানি ছাড়া খালি উইস্কি পান করায় বেশ কড়া নেশায় ধরেছে মুবিনের। স্টিয়ারিং টা বেসামাল হচ্ছে ধীরে ধীরে!

স্টিয়ারিং পুরোপুরি বেসামাল হবার আগেই মুবিন নিজের এপার্টমেন্ট এর নিচে এসে পৌছায়। লিফট বেয়ে নিজের ফ্লোরে উঠতে উঠতে আরেকটা সিগারেটের বংশ নির্মুল করে দেয় মুবিন। একটু উইস্কিও চাচ্ছিলো গলাটা, কিন্তু দিতে পারেনি মুবিন। কারন উইস্কির বোতলটা ভুলক্রমে গাড়িতেই ফেলে এসেছে সে।

রুমে ঢুকে লাইট জ্বালাতেই প্রায় চোখ ঝলসে যায় যায় অবস্থা মুবিনের। মুবিনের চোখ স্বাভাবিক হতেই গায়ে থাকা ঘামে ভিজে যাওয়া শার্টটা খুলে ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে মুবিন। ফ্রিজ থেকে একটা ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে, মুখ উচিয়ে চেহারায় খালি করে দেয় পুরো এক বোতল ঠান্ডা পানি। তারপর ফ্রিজ থেকে একটা লেবু নিয়ে দাত দিয়েই ছিলে ফেলে লেবুটা। দাত দিয়ে লেবু ছিলে ফেলার ফলে লেবুর ছোলার তিক্তস্বাদে ভরে ওঠে মুবিনের মুখ। মুখের তিক্তস্বাদ এবং মস্তিষ্কের অনিয়ম লাইভাব কাটানোর জন্য মুবিন পুরো লেবুটাকে মুখে পুড়ে চেপে ধরে। লেবুর প্রবল টক রসে পুরো শরীর শিরশির করে ওঠে মুবিনের। টক সহ্য করতে না পেরে লেবুটা মুখ থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ফ্রিজের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ে মুবিন। পেছনে কোমড়ে থাকা রিভলভারটা ফ্লোরে রেখে কিছুক্ষন চুপচাপ হাটুতে হাত রেখে ঝিম ধরে বসে থাকে মুবিন। তারপর বসা থেকে উঠে সোজা বাথরুমে ঢুকে যায় মুবিন। বাথরুমে ঢুকে সোজা বাথটাবের পানিতে পুরো মুখটা ঢুকিয়ে দেয় মুবিন। মাথাটা এখন বেশ ঠান্ডা লাগছে। শ্বাসগুচ্ছ দলাপাকিয়ে ফুসফুসে আটকে আছে,শ্বাসগুচ্ছ ফুসফুস থেকে মুক্তি পাবার জন্য আকুল আবেদন জানাচ্ছে মুবিনের কাছে। কিন্তু মুবিন সে আবেদনকে সম্পুর্ন নজরান্দাজ করে নিজের মুখটাকে বাথটাবেই ঢুকিয়ে রেখেছে। দীর্ঘক্ষণ শ্বাস আটকে বাথটাবে মুখ ঢুকিয়ে রাখার ফলে মুবিনের মুখের মাথার শিরা-উপশিরা গুলো চরমভাবে মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে। মুখটা রক্তিম লাল হয়ে উঠেছে, দেখে মনে হচ্ছে মুবিনের পুরো শরীরের রক্ত যেনো এসে তার মুখেই ঘাটি গেড়েছে।

বাথটাবের থেকে মাথা উঠিয়ে অশান্তির শ্বাস ছাড়ে মুবিন। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না সে। পুরো দুনিয়াটাই যেনো অশান্তিতে ভরে গেছে আজ, কোথাও খানিক শান্তির চিহ্ন আছে বলে মনে হচ্ছে না মুবিনের। বসা অবস্থায় মাথার উপরের ঝরনাটা ছেড়ে দিয়ে কাদতে থাকে মুবিন। কান্না ছাড়া অন্য কোনো শান্তিবস্তুর খোজ জানা নেই মুবিনের। যদি এই কান্নাই তাকে একটু শান্তি এনে দিতে পারে এই মুহুর্তে। কাদতে কাদতে সুত্র খুজতে থাকে মুবিন, সুত্রের সন্ধানে পুরো ঘটনাটা আবার সাজিয়ে ভাবতে থাকে মুবিন।

প্রতিদিনের মতো আজও মুবিনের আগেই ঘুম থেকে উঠেছে মিছিল। ঘুম থেকে উঠেই নিয়মমাফিক গোসল সেড়ে নিয়েছে। তারপর নাস্তা বানাতে কিচেনে চলে গেছে। অন্যদিন হলে নাস্তা বানানোর আগে মুবিনকে ডেকে উঠিয়ে নিজের সাথে কিচেনে নিয়ে যেতো মিছিল। কিন্তু মুবিনের জ্বর থাকায় আজ আর মুবিনকে ডাকেনি মিছিল। নাস্তা বানিয়ে যখনই মুবিনকে ডাকতে বেডরুমে যাবে মিছিল তখনই মিছিলের ফোন বেজে ওঠে। ফোন হাতে নিতেই দেখে বাংলাদেশ থেকে ডাক্তার ফোন করেছে। এই ডাক্তার মুলত মিছিলের বাবার পার্সোনাল ডাক্তার। মিছিলের বাবার বেশ কিছুদিন ধরেই হার্টের গুরুতর সমস্যা দেখা দিচ্ছিলো। আর সমস্যা এতোটাই গুরুতর হয়ে উঠেছিলো যে হার্ট ট্র‍্যান্সপ্ল্যান্ট অবধি গড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা। মিছিল ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ডাক্তার বলে, ” হ্যালো মিছিল বলছো? তোমার বাবার অবস্থা খুবই গুরুতর। যেকোনো সময় মারা যেতে পারে। তুমি যত শিঘ্রই সম্ভব দেশে চলে আসো! ”
কথাটা শুনতেই মাথা ঘুরে যায় মিছিলের। এখন দেশে যাবে কীভাবে? মুবিনের যে অবস্থা, ও এই অবস্থায় ফ্লাই তো করতে পারবে না। আর মুবিন তো ওকে একা দেশেও যেতে দেবে না। ওদিকে বাবার এই অবস্থা!
মিছিল আর সাতপাঁচ না ভেবে মুবিনকে গিয়ে ঘুম থেকে উঠায়। মুবিন সবটা শুনে মুবিনও মিছিলের সঙ্গে যেতে চায়। মিছিল বলে, ” তুমি তোমার এই হেলথ কন্ডিশনে ফ্লাই করতে পারবা না। এমনিতেই তোমার ফ্লায়িং ফোবিয়া আর হাইট ফোবিয়া আছে! ”
– ” তো কী হয়েছে? তুমি তো আছো! ”
– ” উফ প্লিয মুবিন এই সময়ে অন্তত এরকম সেন্টিমেন্টাল ফুল মার্কা কথাবার্তা বইলো না। আমার দেশে যেতে হবে আর আজকেই যেতে হবে। তুমি আমার জন্য আর্জেন্ট টিকেট বুক করে দাও! ”
– ” তুমি একা যাবা? ওদিকে যদি কোনো সমস্যা হয়? আমিও আসি না। জ্বর ফ্লাইট দেশে ল্যান্ড করতে করতেই সেরে যাবে! ”
মিছিল মুবিন কপালে গলায় হাত দিয়ে জ্বর দেখে বলে, ” প্রচুর জ্বর। প্লিয এইরকম কইরো না, এমনিতেও তোমার জ্বর। নিজের যত্ন তো নিজে নেবে না। এই অবস্থায় তোমায় একা রেখে যেতে আমারও মন চাচ্ছে না। কিন্তু কী করবো বলো বাবার অবস্থা মারাত্মক। প্লিয আর কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করিও না! ”
মুবিন আর কিছু বলে না। আহাদ শেখ এর সেক্রেটারিকে ফোন দিয়ে কানাডা টু বাংলাদেশ এর একটা এয়ার টিকেট বুক করিয়ে নেয়। মিছিল তাড়াহুড়ো করে শুধু কয়েকটা জামাকাপড় নিয়ে লাগেজ প্যাক করে নেয়। কানাডার সময় অনুযায়ী সকাল ৯ টায় ফ্লাইট পেয়ে যায় মিছিল। তাই আর দেরী না করে বেড়িয়ে পড়ে মিছিল।

সামনেই ইমিগ্রেশন। মিছিলের কাধে মাথা এলিয়ে মিছিলকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে মুবিন। মুবিনের মন একদমই ছাড়তে চাইছে না মিছিলকে একা। কিন্তু পরিস্থিতির টানাপোড়নে না ছেড়ে উপায়ও নেই। মিছিল মুবিনের মাথা উঠিয়ে মুবিনের গালে, ঠোটে, কপালে চুমু খেয়ে বলে, ” একটু যত্ন নিও নিজের। ঔষধ গুলো নিয়মিত খেলে ৩-৪ দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবা। সুস্থ না হলে কিন্তু ফ্লাই করবা না তুমি। পুরো সুস্থ হলে দ্যান আইসো। আর আমি ফ্রি টাইমে ভিডিও কলে কথা বলে নিবো! ”

মুবিন মিছিলের কপালে চুমু খেয়ে বলে, ” ওদিকে কোনো দরকার হলে আমায় অথবা শেখ সাহেবের সেক্রেটারিকে জানিও। আর আমি তাড়াতাড়ি এসে পড়বো ডোন্ট ওয়ারি! ”
মিছিল আরেকবার মুবিনের কপালে একটা গভীর চুমু খেয়ে বলে, ” আসছি, আল্লাহ হাফেজ। টেক কেয়ার! ”

সেদিনই মিছিলকে শেষবারের মতো দেখেছিলো মুবিন। আর দেখেনি মিছিলকে, মিছিলের ছায়ার দেখাও পায়নি আর মুবিন। সেদিন বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে নামার পর শেষবারের মতো ফোনে কথা হয়েছিলো মুবিনের মিছিলের সঙ্গে। মিছিল ফোন করে বলেছিলো, ও এয়ারপোর্টে এসে পৌছেছে। এখন হসপিটালে যাচ্ছে, ওখানে গিয়ে বাবাকে দেখে তারপর ফোন করবে মুবিনকে। কিন্তু মিছিল আর কোনো ফোন করেনি মুবিনকে। মুবিন ফোন দিয়েও মিছিলের নাম্বার বন্ধ পেয়েছে।।

চলবে!
#thetanvirtuhin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে