ওয়ারদূন আসরার পর্ব-২২

0
1138

#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব – ২২ ||(রহস্য ফাঁস)

– তিশানা!

– হ্যাঁ বৌদি বলো।

– আমার কি মনে হয় জানিস?

– কি?

– জাইফ আর যীনাতের মধ্যে কিছু একটা চলছে।

– মানেহ? তোমার মাথা কি পুরো গেছে?

– আরে না সত্যি বলছি। আর তার চেয়ে বড় কথা ও জানলো কি করে আমরা যীনাতকে নিয়ে বেরিয়েছি + ও নিখোঁজ! তুই বা আমি তো জাইফকে ফোন করে বলিনি যীনাতের কথা।

এবার তিশানা ভাবতে লাগে হ্যাঁ সত্যি তো। জাইফ জানলো কি করে যে যীনাত নিখোঁজ হয়েছে আর এখানেই বা আসলো কি করে? ঠিকানা জানারও তো কথা নয়। আনুস্কা আবার বলা শুরু করে,”যখন শুনেছে যীনাতের নিখোঁজ হওয়ার কথা জাইফ শুনলো তখনই আমি জাইফের চোখে কোনো কিছু হারানোর ভয় স্পষ্ট দেখেছি। এবং বাড়িতেও অনেকবার খেয়াল করেছি ওদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ সবটা। কিন্তু ডাউট ছিলো তাই কাউকে কিছু বলিনি এবং আজ তোমায়ও বলতাম না বাট না বলে থাকতে পারছিলাম না।”

– না ভাবি তুমি মন্দ বলোনি বিষয়টা আমিও খেয়াল করেছি কিন্তু পাত্তা দিতাম না। আমারও এখন মনে হচ্ছে ওদের দুজনের মাঝে কিছু না কিছু আছেই। যাইহোক দাভাই আসুক তুমি আমি একসাথে পেচিয়ে ধরবো।

– হ্যাঁ সেই ভালো। দু’জন একসাথে ধরলে না বলে থাকতে পারবে না।

তারপর দুজন মিলে প্লান করলো কিভাবে সত্যটা বের করবে। তখনই জাইফ যীনাতকে নিয়ে ফিরলো। যীনাতের চোখ মুখের অবস্থা দেখে তিশানা আনুস্কার মনে ভয় ঢুকে যায়। দুজন জাইফের প্রশ্নের কথা ভুলে যীনাতের কি হয়েছে জানতে চাইলো কিন্তু জাইফ কিছু বললো না শুধু এইটুকু বললো বাড়ি গিয়ে সব বলবে।

যীনাত শান্ত দৃষ্টিতে জাইফের দিকে তাকিয়ে আছে কারণ সে জানতে চায় জাইফের সবকিছু। কেন সে একজন জ্বীন হয়ে এই হিন্দু পরিবারে থাকতো কিভাবে কি হলো সবটা সে জানতে চায়। জাইফ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে,”আমি তোমায় সবটা বলবো, তোমার সবটা জানার অধিকার আছে কারণ তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী!”

বলেই জাইফ থামলো। এখন তারা আছে সেই নদীর পারে। এই নদীর পারটা বেশ পবিত্র এবং জাইফের সবচেয়ে বড় সুরক্ষিত জায়গা। এখানে তার অনুমতিতে সব হয়। জাইফ আবার বলা শুরু করে,

– আমি জাইফ আহরার ইজায। জ্বীনরাজ্যের বাদশাহ সুলায়মান এবং তার স্ত্রীর একমাত্র সন্তান। আমি যখন ৫মাসের ছোট শিশু ছিলাম তখনই হঠাৎ আমাদের রাজ্যে এক বিপর্যয় চলে আসে। ইফ্রিত জ্বীনরা জানতে পারে আমি অঢেল শক্তির অধিকারী হবো। সেই সুবোধে যদি তারা আমায় তাদের শয়তানের কাছে বলি দিতে পারে তাহলে তারা আরও হাজারগুণ শক্তিশালী হয়ে যাবে। তার উপর ছিলো ওয়ারদূন আসরার। বলা যায় এক ঢিলে দুই পাখি মারতেই তারা আমাদের রাজ্য আক্রমণ করে। সে কি এক লোমহর্ষক যুদ্ধ ছিলো। শেষে আমার দাদীমা রাজমাতা ফিরোজি আমাকে একটা হিন্দু পরিবারের সন্তানকে বদল করে আমাকে তার জায়গায় দিয়ে দেয়। সেই সন্তানটা আইসিউতে জীবনের সাথে পাঙ্গা লড়ছিলো তাই কেউ-ই তার চিকিৎসা চলাকালীন তাকে দেখতে পায়নি। আমার দাদীমা সেই সুযোগটাই নিলো। সেই সন্তানকে দাদীমা সম্পূর্ণ সুস্থ করে দেয় এবং এক বিশ্বস্ত সহকারীর মাধ্যমে সে ছেলেটাকে আরেক পরিবারে পাঠিয়ে দেয়। বাকি ছিলো ওয়ারদূন আসরার। ওয়ারদূন আসরারকে ঠিক কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলো সেটা আমি জানিনা তবে এইটুকু শুনেছি ওয়ারদূন আসরার নিজেকে খুব শক্তভানে গুটিয়ে নিয়েছিলো। আস্তে আস্তে আমি বড় হতে লাগি সেই হিন্দু পরিবারে। ও হ্যাঁ আরেকটা কথা। আমার এক চাচা ছিলো দাদুর বন্ধু। সেই সুবাধে দাদুকে সে জানিয়েছে আমি মুসলিম ঘরের ছেলে এবং অনেকটা বিপদে পরেই আমাকে অদলবদল করেছে এরকম ভাবে ভেঙে বলে। দাদু তাকে জানায় যেনো সে নিশ্চিন্তে থাকে সে বেচে থাকতে আমার গায়ে কোনো আচ লাগতে দিবে না। আমি যখন ১০ বছর বয়সী হই তখন থেকে অদ্ভুর অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। বলা যায় সেই স্বপ্নগুলোর মাঝেই আমি আমার পরিচয়, শক্তি সব সম্পর্কে জানতে পারি। শুনতে অদ্ভুত লাহছে তাইনা? তবে এটাই সত্যি। স্বপ্নের মাঝেই সবার সম্পর্কে অনেককিছু জানতে পারতাম। এভাবে আমি তোমার সাথে বিয়ের হওয়ার আগ পর্যন্ত তেমন কিছুই হয়নি। তোমার বিয়েতে এটেন্ড করার আগেই কোনো এক বিশেষ কারণে আমার পরিচয়, শক্তি স্মৃতি থেকে মুছে যায়। কিন্তু আমার নতুন স্মৃতিতেও আমি আমার প্যারানরমাল প্রব্লেম ফেস করতাম।তোমার সাথে খুবই অদ্ভুতভাবে আমার বিয়ে সম্পূর্ণ হয়। আস্তে আস্তে তোমায় ভালোবেসে ফেলি কি করে আমি জানিনা। আর সেদিন ঘুমের মাঝে হঠাৎ-ই আমায় ওয়ারদূন আসরার আমার স্মৃতি ফিরিয়ে দেয় এবং বলে যেনো আমি তাকে নিজের হাতে নিয়ে আসি নইলে খুব বড় বিপদ হয়ে যাবে। তখনই আমি আমার শক্তি দ্বারা ওয়ারদূন আসরারকে নিজের কাছে নিয়ে আসি। তখনই তোমার বিপদ হয় এবং আমি তোমায় গিয়ে রক্ষা করি এমন কি তোমার ভাই কে যে বা যারা মেরেছে তাদেরও আমি সেই রাতে শেষ করে দেই চিরতরে।(চোখ মুখ গরম করে)

যীনাত চমকে জাইফের দিকে তাকায় তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”আ…আমার ভাভাই!!”

– হুম তোমার ভাইকে ইফ্রিতদের সর্দারের এক দূতই তাকে হত্যা করে।

যীনাত ছলছল চোখে জাইফের দিকে তাকালো। তার প্রিয় ভাইটার কথা যে বড্ড মনে পরছে সাথে তার পুরো পরিবারকে। জাইফ যীনাতের চোখ মুছে দিয়ে বলে,”এভাবে কেঁদো না সবটাই যে আল্লাহ’র ইচ্ছা। আর তোমার পরিবারকে যেদিন বোম ব্লাস্ট করে মারা হয় সেদিন তুমিও সাথে মরতে যদি না ওয়ারদূন আসরার তোমাকে বাহিরে নিয়ে আসতো।”

যীনাতের বিস্ময়ের সাথে জাইফের দিকে তাকিয়ে বলে,”মানে?”

– তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে তুমি যখন সদর দরজার কাছে এসেছিলে তখন একটা ফুটফুটে বাচ্চাকে দেখেছিলে?

– হ্যাঁ তো?

– সেটা আর কেউ না ওয়ারদূন আসরার ছিলো। ওয়ারদূন আসরার এর পাওয়ার অনেক অনেক বেশি যা আমাদের ধারণার বাইরে।তাইতো এটা আমাদের রাজ্যের অমূল্য সম্পদ এবং তাকে সুরক্ষার সাথে রাখতে হয়।

যীনাত অবাক হয়ে জাইফের দিকে তাকালো। তার মানে সেদিন যদি ওয়ারদূন আসরার না আসতো তাহলে সেও…. সত্যি আল্লাহ চাইলে কি না করতে পারে কিন্তু যীনাত যে নিজের পরিবারকে হারিয়ে ফেলেছে চিরতরে৷ হঠাৎ তার সাপটার কথা মনে পড়ে যায়। যীনাত উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে,”আচ্ছা সাপটা কে? কেন আমাকে সবসময় সে সাহায্য করে?”

জাইফ মুচকি হেসে বলে,”ওটা আমারই পোষা জ্বীন নূরা’স। আমি চলে আসার পর সর্দার তাকে অনেক কুৎসিত করে দেয় তাদের জাদু দিয়ে৷ সে ভয়ে আমার ধারে কাছে আসতো না যদি আমি তাকে ভুল বুঝে মেরে ফেলি তাই। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় কি জানো। সে নাকি তোমাকে আর আমাকে একসাথে পেতেই যখন চলে যেতে নিতো এমন সময়ই অদ্ভুত কারণে সে আবার আগের মতো রূপসী হয়ে যায়। আর যখন থেকে তোমার হাতে ওয়ারদূন আসরার ছিলো তখন থেকেই সে তোমায় দূর থেকে হেফাজত করতো। তার সবচেয়ে বড় কাজ তোমার কষ্টগুলো ভুলিয়ে দেয়া। যখন তুমি তোমার পরিবার হারিয়েছো তখন থেকেই সে তোমার কষ্টগুলো বিষের মতো শুষে নিতে থাকতো তাই তোমার নিজেকে হালকা লাগতো। আর সেদিন যখন তুমি তাকে দেখলা তখন তোমার মাথায় তার মণিটা ঢুকানোর পর….

-(থামিয়ে দিয়ে) মণি মানে?

জাইফ তখনই যীনাতের মাথা থেকে বের করে নিজের হাতে রাখলো। যীনাত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মনিটার দিকে। আল্লাহ জানে আর কতো তার জন্য চমক রয়েছে, এগুলোই যে সে হজম করতে পারছে না। মনিটা সত্যি-ই দারুণ। জাইফ মনিটা আবার যীনাতের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। এতে যীনাতের মাথা কেমন চক্কর দিলেও যীনাত নিজেকে সামলে নেয়। জাইফ আবার বলা শুরু করে,”মনিটা ঢুকানোর ফলে তোমার আগের জমানো কষ্টগুলো আবার ঝেকে বসে তোমার মনে তাই তুমি সেইরকম ভাবে ভেঙে পড়েছিলে। কিন্তু দেখো এখন সব ঠিক আছা আলহামদুলিল্লাহ।”

– আচ্ছা আমার সাথে এমন প্যারানরমাল ঘটনা কেন ঘটছে আমি যে সামান্য একজন মানুষ।

– হ্যাঁ তুমি মানুষ কিন্তু তুমি মন থেকে আল্লাহ বিশ্বাসী, ইমানদার, সৎ এবং ঠান্ডা স্বভাবের৷ যা ফলে একমাত্র বিশ্বাসী হিসেবে ওয়ারদূন আসরার তোমায় বেছে নিয়েছিলো তাইতো তোমার গোলাপ ফুলের টবে কোনো এক গোলাপের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলো এবং সময় বুঝে তোমার সাথে বন্ধুত্বও করে নিয়েছিলো।

– আপনি তো দেখছি সব জানেন।

জাইফ শুধু মুচকি হাসলো তারপর বলে,”তোমার পেটে কি আর কোনো প্রশ্ন আছে?”

– হুম আছে।

– তো বলে ফেলুন ম্যাডাম আমি আপনার উত্তর দেয়ার অপেক্ষায় রইলাম।

– দাদু কি জানে আপনি একজন জ্বীন।

– নাহ কেউ জানেনা একমাত্র তুমি ছাড়া। এখন কি আমায় ছেড়ে চলে যাবে আমার পরিচয় জেনে?(মলিন সুরে)

যীনাত মুচকি হাসি দিয়ে জাইফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,”কখনোই না এমন একজন হৃদয়হরণ রাজকুমারকে ছাড়া যে আমার জীবন্টাই বৃথা। যার জন্য এতো এতো লড়াই করলাম তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য এতোটা পথ লড়াই করেছি নাকি? যদি আপনি নামক জীবনসঙ্গী টা না থাকতো তাহলে আমি সেই কবেই তো পরাপারে চলে যেতাম।”

জাইফ একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে যীনাতকে নিজের সাথে আরও শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,”তাহলে ভালোবাসো আমায়?”

– নিজের থেকেও বেশি।

জাইফ চোখের পলকে যীনাতকে বুকে নিয়েই যীনাতের রুমে এসে পৌঁছালো। কমলা দেবী জাইফের রুমেই যাচ্ছিলো হঠাৎ কি মনে করে যেনো যীনাতের রুমে উঁকি দিলো। দুর্ভাগ্যবশত যীনাতের রুমের দরজা খোলা ছিলো। উঁকি দিয়ে জাইফ আর যীনাতকে একসাথে দেখে কমলা দেবীর চোখ চড়কগাছ। সে দ্রুত দরজা মেলে ঘরে ঢুকে জাইফ যীনাতকে আলাদা করে যীনাতের গালে জোরে চড় বসিয়ে দিলো।

———————————-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে