ওয়ারদূন আসরার পর্ব-১৭

0
1213

#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব – ১৭ ||

ফজরের আযানের সময় যীনাতের ঘুম ভেঙে গেলো। পাশে ফিরতেই খেয়াল করলো জাইফ গভীর ঘুম দিচ্ছে। যীনাত একটা মুচকি হাসি দিয়ে বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুম চলে যায় ফ্রেশ হতে। ওযু সহ করে বেরিয়ে আসলো এবং মাথায় ওড়নাটা ভালোভাবে পেচিয়ে নেয়। তারপর জাইফকে আস্তে আস্তে ডাকতে লাগে,”এইযে শুনুন!”

———————

– এইযে??? উঠুন!

——————–

এবার যীনাত সাহস করে জাইফের কাধে হাত দিয়ে একপ্রকার ঝাকিয়ে বলে,”এইযে শুনছেন? উঠুন নামাজের সময় হয়ে গেছে।”

জাইফ ঘুমের ঘোরে ” হুম” বলে অন্যদিকে ফিরে আবার ঘুমিয়ে যায়। এবার যীনাতের মাথায় রাগ চেপে বসে। এখন উঠাবে কি করে জাইফও যে নাছোড়বান্দা এতো সহজে উঠবে না। পরে উপায় না পেয়ে যীনাতের ওড়নায় থাকা ছোট ছোট ঝুলি দিয়ে জাইফের নাকে শুড়শুড়ি দিতে লাগে। জাইফ জোরে একটা হাঁচি দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসে। জাইফের কান্ডে যীনাত ফিক করে হেসে দেয়। জাইফ গাল ফুলিয়ে বলে,”এটা কি হলো?”

– কোথায় আবার কি হলো?(বুঝেও না বুঝার ভান ধরে)

– এইযে এভাবে শুড়শুড়ি দিয়ে কেউ ঘুম থেকে উঠায়?

– তো আপনি বুঝি ভালো কথায় ঘুম থেকে উঠেছেন? তাই উপায় না পেয়ে এভাবেই উঠালাম। আসলে কথায় আছে না “সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বালা করতে হয়!”।

– এই বলে এভাবে আমার ঘুমে জল ঢালবা?

– ওয়াশরুম থেকে মগভর্তি ঠান্ডা পানি এনে যে আপনার উপরে ফেলিনি এটা আপনার সৌভাগ্য! অনেক দেরি করেছেন এখন যান গিয়ে ওযু করে আসেন একসাথে নামাজ পড়বো।

জাইফ নাক, গাল ফুলিয়ে হনহন করে ওয়াশরুম চলে গেলো। আর যীনাত মুখ টিপে হেসেই চলেছে। জাইফ আসলেই দুইজন একসাথে নামাজ আদায় করে। যীনাত মোনাজাতে আল্লাহর দরবারে অসংখ্য শুকুরিয়া আদায় করলো তার স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। নামাজ শেষ হতেই জাইফ কিছু না বলে নিজের রুমে গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। যীনাত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে জাইফের ঘরে জাইফকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখছে আর হাসছে। ছেলেটা সত্যি-ই একটা পাগল! এমন ঘুমকাতুরে কেউ হয়? তবে এতোদিনের খাটনি কি কম? অনেক খেটেছে বেচারা তাই হয়তো ক্লান্ত। হঠাৎ যীনাতের দরজায় নক পড়লো। যীনাত তড়িঘড়ি করে গিয়ে দরজা খুললো এবং দেখলো মল্লিকা দেবী দাঁড়িয়ে। যীনাত মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলে,” আরে আন্টি আপনি?”

– হুম আমি তা যীনাত এখন কেমন আছো তুমি? রাতে কাজ করায় এতো ব্যস্ত ছিলাম যে তোমার খবরটা অব্দি নিতে পারিনি তাই এই ভোরেই তোমার কাছে ছুটে এসেছি।

– আমি ঠিক আছি আন্টি। তা সবাই কি এখনো আসেনি?

– না এখনো আসেনি ঘন্টাখানেকের মাঝে ওরা রওনা দিবে। আর তুমি কি কিছু খাবে খেলে আমার সাথে এসো!

– না আন্টি এখন রুমেই থাকবো আপনি যান। আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না।(মুচকি হেসে)

মল্লিকা দেবী মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে যীনাতের থুতনীতে হাত ছুয়ে চলে গেলো। মল্লিকা দেবী চলে যেতেই যীনাত দরজা লাগিয়ে দেয় আর তড়িঘড়ি করে বারান্দায় চলে যায়। এখনো চারপাশের অন্ধকার ঠিক ভাবে কাটেনি। চারপাশে পাখিদের গুণগুণে বুঝিয়ে দিচ্ছে সকাল হতে যাচ্ছে। আকাশে অস্পষ্ট নীল আভা! আবছা আলোয় বেশি দূর দেখা যাচ্ছে না।

যীনাত বেলকনি চুপচাপ বসে সূরা ইখলাস আর আয়াতুল কুরসি পড়লো তারপর ওয়ারদূন আসরার কে স্মরণ করতে থাকে৷ কিন্তু কোনোরকম সাড়াশব্দ নেই। যীনাত আবার চেষ্টা করলো এবারও সব বিফলে গেলো। কয়েকবার চেষ্টা করেও ওয়ারদূন আসরার এর নাম নিশানাও পেলো না। যীনাত হতাশ হলো কারণ ওয়ারদূন আসরারই তাকে অনেক কিছু জানাতে পারতো আর সাপটা? সে তো তার কথাই বুঝতে পারেনা। হয়তো তারা আরবি বুঝে কিন্তু যীনাত তো আরবি ভাষায় দক্ষ নয়। যীনাত প্রথম থেকে একে একে সবটা ভাবতে শুরু করে। হঠাৎই মনে পড়ে যায় একটা কথা। যদি কিশোর মারাই যেতো তাহলে এতো বছর পর পাগল হয়ে কি করে ফিরে আসলো? কেন সে এভাবে পাগলের মতো ঘুরছে? আর যীনাত যতোটুকু জানে কিশোর একজন কালোজাদুকর এবং তার বিভিন্ন ভয়ংকর এবং খারাপ জ্বীনের সাথেও পরিচয় আছে। আচ্ছা তারা তাকে বাচিয়ে দেয়নি তো? কিন্তু কিশোর কে মারার চেষ্টা করলোই বা কে? কারো তো এতো সাধ্য নেই কিশোরের মতো একজন শয়তান পূজারীকে মারার। প্রশ্ন! সব জায়গাতেই প্রশ্ন আছে কিন্তু তার উত্তর মিলছে না। কবে পাবে সব প্রশ্নের উত্তর? এখনো কি সবটা জানার সঠিক সময় আসেনি? যীনাতের মনে পরে যায় ওয়ারদূন আসরারের একটা কথা,”আমাকে রাজকুমারকে খোজার বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি কি আদৌ সক্ষম হবো সেই বিষয়ে ভাবাচ্ছে। আমি কখনো হারিয়ে গেলেও আমাদের রাজকুমারই আমাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে যেখানেই থাকি না কেন। কিন্তু সে কোথায় তাও জানিনা!”

হ্যাঁ রাজকুমার! কিন্তু এখন সে রাজকুমারকে পাবে কোথায়? এসব নানান চিন্তাভাবনা তার মাথায় জট পাকিয়ে রেখেছে। যীনাতের ভাবার মাঝেই কখন যে সকাল হয়ে গেলো সে টেরই পেলো না। হঠাৎ খুব বাজনা আর শাক বাজার আওয়াজে যীনাতের ধ্যান ভাঙে এবং বারান্দা দিয়ে দেখে বর-কনেকে নিয়ে বাড়ির সদর দরজার দিকে যাচ্ছে। যীনাত তখনই রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। যীনাত বেরোতেই খেয়াল করে জাইফ ধূসর রঙের একটা টিশার্ট পরে চোখ কচলাতে কচলাতে নিচের দিকে যাচ্ছে। যীনাত উপরে দাঁড়িয়েই নিচের কাহীনি দেখতে লাগে। আনুস্কা আর রিকেশ বর-কনে সাজে আর তাদের সামনে মল্লিকা দেবী তাদের সযত্নে বরণ করছে। আশেপাশের মহিলা রা উলু দিচ্ছে আর একজন শাক বাজাচ্ছে। সকল রীতি শেষ করে বর-কনে কে ভেতরে আনা হলো। আপাতত লিভিং রুমের ফ্লোরে বিছানো বড় মোটা তোশকে বসলো তারা এবং তাদের চারপাশে তাদের কাজিনস, ফ্রেন্ডস আর কমলা দেবী। জাইফও বসলো রিকেশের পাশে। সকলেই জাইফকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে কেন সে বিয়েতে অনুপস্থিত ছিলো। জাইফ কোনোরকমে সকলকে অফিসের কাজের বাহানা দিয়ে বুঝালো পরে আর কেউ কিছু বলে না। যীনাত উপর থেকে স্পষ্ট শুনতে না পেলেও এইটুকু বুঝলো বিয়েতে না যাওয়ার জন্যই প্রশ্ন করতে হয়তো। সকলে বেশ আড্ডা দিচ্ছে আর যীনাত উপর থেকে দেখছে সবটা। নিচে গেলে নানান মানুষদের আনাগনায় তার অস্বস্তি ফিল হবে ভেবে সে আর নিচে যায়নি। হঠাৎ তার কাধে কেউ হাত রাখলেই যীনাত চমকে পিছে ফিরে তাকায় এবং দেখে তিশানা দাঁড়িয়ে।

– আরে তিশানা!

– হুম আমি এখানে কেন একা একা দাঁড়িয়ে আছো নিচে চলো।

– নাহ আমি এখানেই ঠিক আছি।

– হুম তা তো দেখতেই পাচ্ছি। চলো বলছি এখানে একা দাঁড়িয়ে কোনো কাজ নেই।

বলেই একপ্রকার জোর করেই যীনাতকে নিচে নিয়ে আসে। যীনাতকে দেখে জাইফের কাজিনদের মধ্যে একজন বলে উঠে,”এটা কে রে?”

রিকেশ জবাব দিলো,”দাদুর বন্ধুর নাতিন আর আমার বোনও বলা যায়।”

– ও আচ্ছা।

তারপর তিশানা একে একে সকলের সাথে যীনাতকে পরিচয় করিয়ে দেয়। এর মাঝে সোভন(কমলা দেবীর ছেলের বড় ছেলে) যীনাতের দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যীনাত প্রথমে ব্যাপারটা খেয়াল করলেও বিষয়টা তেমন পাত্তা দিলো না। অনেকক্ষণ পর আবারও দেখলো এবং সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলে। কমলা দেবী বলে,” আনুস্কা তুই কিন্তু আর সতীন তাই আর লগে ঠিক কইরা কথা কবি!”

রিকেশ অবাক হয়ে বলে,”ওগো কমলা সুন্দ্রী তুমি আবার কবে আমারে সোয়ামি কইরা ডাক দিলা?”

– যাহ বদ পোলা তোরে আমি সোয়ামী কইনা দেইখা তুই কি আর সোয়ামী না?

– কয়ডা লাগে তোমার কমলা রানী?(জাইফ)

জাইফের কথায় সবাই হেসে দিলো। কমলা দেবী বলে,”যেইডা ভাল্লাগবো ওইডাই লাগে বুজ্জিস?”

আনুস্কা এবার মজার সুরে বলে,”আমাদের বাসররাতে তোমারে ঢুকতে দিমু না গো সতীন!”

আনুস্কার কথায় সবাই আরও জোরে জোরে হেসে দিলো। আনুস্কার এতোক্ষণে ধ্যান আসলো, আসলে সে বললো কি এসব? ভেবেই লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে আনুস্কার। এতো মানুষের সামনেও তো তার কিছুটা নিজেকে সামলে নেয়া উচিত। রিকেশ কি তাকে সাধে বলদি বলে।

এদিকে বেচারা রিকেশও লজ্জায় পরে যায় আনুস্কার কথায়। তারপর মুহূর্তেই আড়চোখে রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আনুস্কার দিকে। আনুস্কা রিকেশের চাহনীতে ভয়ে কাচুমুচু হয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়েআথা নিচু করে ফেলে। এমন সময়ই স্বর্ণা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে,”সরি গাইস সরি আসলে ফ্রেশ হতে কিছুটা লেট হয়ে গেলো।”

মল্লিকা দেবী মেয়ের কাছে এগিয়ে আসতে চাইলে স্বর্ণা মল্লিকা দেবীকে পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে আসে এটা কারো দৃষ্টি-ই এড়ায়নি। কমলা দেবী রেগে বএল,”ওই ছ্যামড়ি মায়ের লগে কথা ক্যান কস না তুই?”

– ওহ কাম অন ঠাম্মি তোমাকে কে বললো আমি মমের সাথে কথা বলিনা?

– তইলে তার এড়ায় আইলি ক্যান?

স্বর্ণা একপলক মল্লিকা দেবীর দিকে তাকিয়ে আবার কমলা দেবীর দিকে ফিরে বলে,”ওহ সরি খেয়াল করিনি।”

স্বর্ণার কথায় মল্লিকা দেবী বেশ অপমানিত হলো। এ কেমন মেয়ে যে নিজের মাকে এভাবে অপমান করে? মল্লিকা দেবী মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে গেলো। এতে যেনো স্বর্ণার কোনোরকম মাথা ব্যথা নেই। যীনাত চোখের সামনে সবটা দেখেও কিছু বলতে পারলো না। সে ভেবে নিয়েছে স্বর্ণাকে ভালোভাবে বুঝাবে কিন্তু কি করে? জাইফ রেগেমেগে সেখান থেকে হনহন করে উপরে চলে গেলো৷ এই স্বর্ণা নিজেকে কি মনে করে যে উঠতে বসতে তার মাকে কথা শুনাবে! রিকেশও চরম ক্ষেপে আছে স্বর্ণার উপর কিন্তু সে পারলো না সেখান থেকে উঠে যেতে। সবাই চুপ থাকলেও আনুস্কা মুখ খুললো,”দেখো ননদীনি তুমি আমার থেকেও অনেকটা ছোট তাই তোমাকে কিছু কথা বলছি, যে মা তোমাকে ১০মাস ১০দিন পেটে ধরেছে হাজারো কষ্ট ব্যথা যন্ত্রণা সহ্য করে তোমায় প্রসব করেছে তাকে কি করে তুমি এভাবে অপমান করতে পারলে? আর জম্মের কথা তো বাদই দিলাম খাইয়ে পড়িয়ে কতো কষ্টে তোমায় এই বয়সে নিয়ে এসেছে ভাবতে পারছো? একজন মা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা তারাই বুঝে যাদের মা নেই সেখানে তোমার মা থেকেও তাকে এভাবে অবহেলা করছো অপমান করছো একটিবারের জন্যেও লজ্জা করলো না?”

আনুস্কা কথাগুলো বলার সময়ই তার চোখ বেয়ে পানি ঝরে গেলো। তারও যে মা নেই। মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা যে কতো করে চায় সেটা একমাত্র সেই ভালো বুঝে। যীনাতেরও মনে পড়ে গেলো তার মায়ের কথা।

স্বর্ণা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,”জাস্ট শাট আপ ভাবি এতো জ্ঞানের আমার দরকার নেই ওকে। তুমি মাত্র এই বাড়িতে পা দিয়েছো কতোটুকু জানো তুমি ওই মহিলার ব্যাপারে? আর এখনো এক ঘন্টাও পার হয়নি বাড়িতে এসেছো এতেই এতো চ্যটাং চ্যটাং কথা বলছো? লিমিটের মধ্যে থাকার চেষ্টা করবা। আমার মা আমি করবো না করবো সেটা আই থিংক আমি তোমার থেকে শিখবো না। সব কিছু বোঝার ক্ষমতা আমার যথেষ্ট আছে ওকে?

স্বর্ণার কথায় রিকেশ আরও ক্ষেপে যায় এবং জোরে ধমক দিয়ে বলে,”স্বর্ণা!!!”

———————————

চলবে!!!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে