একদিন কাঁদবে তুমিও পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
504

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_২৫
#Saji_Afroz

জীবনে কী খুব বেশি কিছু চেয়েছে মানতাশা? না তো! একটা ধনী পরিবারের বউ হতে চেয়েছে সে। আরশানকে সে পেয়েছে। ধনীর বউ হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতে চললেও অন্যদিকে যে সে হেরে যাচ্ছে! আরশানের আচরণে হতাশ সে। বিয়ের পরেও এমন চললে কীভাবে সুখে থাকবে সে?

বাড়ি ফেরার পথে মা এর সাথে শপিংমল এ নেমেছে মানতাশা। তার মা একটা শাড়ি নেবেন বলেছেন। শাড়ির দোকানেই বসে আছে তারা। আর সেখানেই একটি দম্পতি দেখতে পায় মানতাশা।
পাশের মেয়েটি অনেকক্ষণ ধরে শাড়ি দেখে যাচ্ছে। একটি শাড়ি তার খুব পছন্দ হয়। কিন্তু দাম শুনে মেয়েটির মুখ মলীন হয়ে যায়। পছন্দের শাড়িটি হাত থেকে রেখে দেয় সে৷ স্বামীর দিকে তাকিয়ে সে বলল, আরেকটি দেখছি।

মেয়েটির স্বামী বলল, দাম শুনে বলছ? সমস্যা নেই। ভালো লাগলে নাও।
-পরের মাসে তুমি সেলারি পেলে নেব।

স্বামীও আর জোর করলো না। মেয়েটি কম দামের মধ্যে শাড়ি দেখা শুরু করে।

টাকার অভাবে পছন্দের জিনিস না নিতে পাওয়ার দুঃখ মেয়েটি প্রকাশ না করলেও তার মুখে ফুটে উঠেছে হতাশার ছাপ!
এমন জীবন তো মানতাশা চায়না! তাই তো এজাজকে ছেড়ে আরশানকে বেছে নিয়েছে৷ এখন আবার পিছপা হতে চাচ্ছে কেন! নাহ, আর পিছপা হওয়া চলবে না। সে যা চায় তা তো পেতে চলেছেই। আরশানের টাকাই তার দরকার। টাকাই জীবনে সব!
এসব ভেবে মনকে শান্ত করলো মানতাশা।
.
.
.
-রিসোর্ট এ এসে ঘুরাঘুরি খাওয়াদাওয়া অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু আবার রুমও বুকিং করলেন যে?

আজরার প্রশ্নের জবাবে ইনতিসার বলল, তোমার সাথে আলাদাভাবে সময় কাটানোর জন্যে।
-কিন্তু রুমের মাঝে তো আমরা সবসময় আলাদা সময় কাটাই।

তার কথা শুনে হেসে ফেললো ইনতিসার। বলল, আহ চলো তো রুমে! সব প্রশ্নের উত্তর সেখানে দেব।

রুমের ভেতরে এসে অবাক হয়ে যায় আজরা। ফুল দিয়ে সাজানো রুমটি দেখে বলল সে, আজ কী স্পেশাল কোনো ডে?

দরজা বন্ধ করতে করতে ইনতিসার বলল, তোমার সাথে প্রতিটা মুহুর্তই আমার স্পেশাল।
-সে তো আমারও। কিন্তু এভাবে রুম সাজিয়েছেন বলে জিজ্ঞাসা করলাম।
-তোমাকে হুটহাট সারপ্রাইজ দিতে ভালো লাগে। এখন ওয়াশরুমে যাও।
-কেন?
-ওখানে আমার প্রিয় রঙের একটি নাইট ড্রেস রাখা আছে ওটা পরে এসো।

আজরা লজ্জা পেয়ে যায়। মুচকি হাসে ইনতিসার। ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আজরা আপনমনে বলল, এমন সারপ্রাইজ আমি নিত্যদিনই চাই!
.
.
.
নাবীহা নিজের রুমের মাঝে বসে আছে। হঠাৎ সেখানে আগমন ঘটে নাফিসার। তার মুখের দিকে তাকিয়ে নাবীহার বুকটা ধুক করে উঠলো৷ এমন মলীন কেন হয়ে আছে নাফিসার মুখটা?
সে বোনকে কাছে ডাকে। নাফিসা এসে বসে তার পাশে৷ নাবীহা তাকে কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, মধ্যবিত্তদের জীবনটাই কেমন তাইনা? শখ আহ্লাদ প্রচুর থাকে। কিন্তু পূরণ করার সাধ্য নেই।
-কী হয়েছে আপু খুলে বলো তো?
-ছোটো থেকে ইচ্ছে ছিল, কোনো এক রাজকুমারের ঘরের বউ হব। যে স্বপ্ন গুলো বাবার বাড়িতে পূরণ হয়নি সেসব স্বামীর বাড়িতে পূরণ হবে। কিন্তু হলো টা কী? মা বাবার পছন্দে বিয়ে করেও সুখ পেলাম না। স্বপ্ন পূরণ করা দূরের কথা! নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও সে দিতো না। আমারও ইচ্ছে হত একটা পছন্দের শাড়ি নিই, ভাই-বোন বা মা বাবার জন্য কিছু নিই। নাহ! তা হবে কেন? সে যা দেবে তাই শুধু আমার। আমার নিজের কোনো চাহিদা থাকতে পারে না। কারণ আমার বাবার কম আছে। তাই আমার মূল্য নেই। যদি বাবা বিত্তবান হত তবে আমারও মূল্য থাকতো।
-এমন কিছু না আপু। ওরা ভালো মানুষ না সেটা বল। নাহয় ভাইয়া ভালো জব করার পরেও সবসময় বাবার টাকার দিকে চেয়ে থাকতো না।

নিশ্চুপ নাফিসাকে দেখে নাবীহা বলল, ছাড়ো না ওসব! আলাদা তো হয়েই যাচ্ছ। দেখবে একজন ভালো মানুষ আসবে তোমার জীবনে।
-আসবে না।
-মানে?

তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে নাফিসা বলল, একজন পাশে দাঁড়িয়েছিল। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে বলেছিল মা এর কাছে।
-এটা তো ভালো খবর।
-ওতটুক হলেই ভালো হত। কিন্তু সে আমাকে বিয়ে করার বিনিময়ে এই বাড়ির ভাগ চায়। সাথে চায় আমার কাবিনের টাকা গুলো।

এই বলে কেঁদে ফেললো নাফিসা। নাবীহা বলল, কে সে?

তার নাম বলল না নাফিসা। নাবীহা বলল, যদি তুমি তাকে পছন্দ করো তবে এসব করতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই।
-এই বাড়ি আমার বাবার কষ্টে গড়া বাড়ি। তার ভাগ অন্যকে দিয়ে আমি খুশি হব? আর সে ভালো মানুষ হলে শর্ত জুড়ে দিতো না।

বোনকে কী বলে শান্তনা দেবে খুঁজে পায়না নাবীহা। নাফিসা বলল, আসল জীবনে কোনো রাজপুত্র আসে না রে! এসব সবই কল্পনার জগতে বিদ্যমান থাকে।

এই বলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায় নাফিসা। নাবীহা তার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। বোনকে কী বলে শান্তনা দেবে সে জানেনা!
.
.
.
সকাল সকাল ঘুম ভাঙতেই রান্নাঘরে আসলো নাবীহা৷ সকলের জন্যে নাস্তা বানিয়ে নিলো সে। আজ বোনের পছন্দের নাস্তা বানিয়েছে নাবীহা। তার মনের অবস্থা ভালো না। আজ অন্তত পছন্দের খাবার বোনকে খাইয়ে একটু হলেও মুখে হাসি ফোটাতে চায় নাবীহা। তাই সে এত ভোরে উঠে গরুর কালো ভুনা ও খিচুড়ি রান্না করেছে৷ সাথে টমেটোর সালাদও করেছে।
রান্না শেষে ফ্রেশ হয়ে নেয় নাবীহা। নাফিসার রুমে গিয়ে দরজা নক করলে ভেতর থেকে কোনো সাড়া পায় না সে। ভেবেছে, নাফিসা হয়তো ওয়াশরুমে রয়েছে। যার কারণে নাবীহার ডাক শুনতে পাচ্ছে না। তাই তাকে আর না ডেকে নাবীহা মা ও ভাই কে ডাকতে যায়। তারা ফ্রেশ হয়ে খেতেও চলে আসে ডাইনিং রুমে। নাবীহা আবারও ডাকতে যায় নাফিসাকে। এদিকে জহির খিচুড়ি খাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে৷ কিন্তু নাবীহার কড়া নিষেধ, নাফিসা না আসা অবধি কেউ যেন পাতিলে হাত না দেয়! তাই নাফিসার জন্য অপেক্ষা করছে জহির।
এদিকে বেশ কিছুক্ষণ দরজায় কড়া নাড়লেও কোনো সাড়া না পেয়ে কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে নাবীহার। এতক্ষণ ওয়াশরুমে থাকার কথা তো নয়!
সে নিজের রুমে ছুটে যায়। ফোন নিয়ে ফিরে আসে। ফোন করে নাফিসাকে৷ ভেতর থেকে রিং পড়ার শব্দ সে শুনতে পায়। তবে নাফিসা কেন ফোন তুলছে না?
মুহুর্তের মধ্যেই নাবীহার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে থাকে। কাপা কণ্ঠে মা ও ভাইকে ডাক দেয় সে। তারা আসে। নাবীহার কাছে সবটা শুনে তারাও দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে। নায়লা খাতুন কান্নাকাটি শুরু করেন। জহিরও “আপু আপু” বলে চিৎকার করতে থাকে।
নাবীহা নিজেকে শক্ত করে নেয়। সিদ্ধান্ত নেয় দরজা ভাঙার। কিন্তু তার একার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। তাই সে পাশের বাসার চাচাকে ডাকতে সেদিকে ছুটে যায়।
পাশের বাড়ির জামাল মিয়া ও তার বড়ো ছেলে ছুটে আসলেন। দু’জনে মিলে দরজাটা ভেঙে ফেললেন। ভেতরে এমন একটি দৃশ্য দেখবে ভাবেনি কেউ। সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলছে, নাফিসার মৃত দেহ! যা দেখে জহির চ্যাঁচিয়ে উঠে আর নায়লা খাতুন জ্ঞান হারান। নাবীহা নিজের জায়গায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কী করবে ভেবে পায় না সে!
বোনের মৃতদেহটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নাবিহা৷ মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিল সে। কেননা তাকেই এখন শক্ত হতে হবে। মা আর জহিরকে সামলাতে হবে। এই ভেবে সে ফোন দিলো সাজিরকে। কারণ সাজিরকে এখন তার খুব প্রয়োজন।

কিছুদিন পর…

নাবীহার পাশে বসে রয়েছে মানতাশা ও আজরা৷ সকলের মুখ মলীন হয়ে আছে।
কয়েকদিন হলো নাবীহার বাবা মারা গেছেন। আর এখন বড়ো বোন! তাকে কী বলে শান্তনা দেবে খুঁজে পাচ্ছে না তারা।
খানিকবাদে সেখানে হাসনা এসেও উপস্থিত হয়।
হাসনা নাবীহার হালচাল জিজ্ঞাসা করে বলল, আপু এমন কেন করলো কিছু জানতে পারলি?

সবটাই জানতো নাবীহা। কিন্তু যে ছেলের ওমন আচরণে তার বোন প্রাণ দিয়েছে তার সম্পর্কে অজানা তার। নাফিসার টেবিলে তার লেখা একটি চিঠি পাওয়া যায়৷ যেখানে লেখা রয়েছে-
আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।

যদিও নাবীহা বোনের ফোন ঘেটে ছেলেটির পরিচয় জানতে চেয়েছিল। কিন্তু নাফিসা সবই ডিলিট করে দেয়। পুলিশ আসলেও বোনের বদনাম হবে এই ভেবে তাদের কিছু জানায় না নাবীহা। কারণ এই সমাজ শুধু মেয়েদের কেই অপবাদ দিতে জানে। তাদেরও কোনো অভিযোগ নেই জানিয়ে পুলিশকে বিদায় জানানো হয়।

-কী হলো?

হাসনার ডাকে ঘোর কাটে নাবীহার। সে বলল, জানি না রে।
-আমার তো মনেহয় উনি নিজেকে বোঝা মনে করছিলেন! প্রথমে তোর বাবা গেল, এখন বোন। এসব দেখে অন্তত কিছু শিখ!

নাবীহা অবাক হয়ে বলল, কী শিখব?
-মানতাশা ও আজরার থেকে শেখ! তারা বড়ো ঘরে বিয়ে করছে। আর তুই? সাজিরের ঘরে যাচ্ছিস। এখন অন্তত ওকে ছেড়ে ভালো কাউকে খুঁজে নে। ইনতিসার কে বিয়ে করলে লাইফ টাই অন্য রকম হত তোর। বাবা, বোন কাউকেই হারাতে হত না।

তার এসব কথা শুনে আজরা ভাবনায় পড়ে যায়। আসলেই তো! ইনতিসারের সাথে বিয়েটা হলে নাবীহার জীবন হয়তো অন্যরকম হয়ে যেত।
এদিকে এসব কথাতে বিরক্ত হয়ে মানতাশা থামতে বলে হাসনাকে। সে নাবীহার হাত ধরে বলল, আমি জানি তোর মনের অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু আমার বিশেষ দিনে তুই থাকবি না! এটা কীভাবে হয় বল? পরশু থেকে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু আমার। তোকে অবশ্যই থাকতে হবে। থাকবি না বল?

নাবীহা শান্তস্বরে বলল, চেষ্টা করব।

আজরা বলল, আমিই ওকে নিয়ে যাব। তুই ভাবিস না।

কীভাবে নাবীহা তাদের বোঝাবে! এসব কিছুই যে ভালো লাগছে না তার। ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও চলে যেতে। যেইখানে একটু শান্তির দেখা সে পাবে…
.
.
.

-এত ভালো একটা প্রস্তাব হাত ছাড়া করবেন আপা? একটা মাত্র ছেলে আপনার। বিষয়টা যদি ভেবে দেখতেন?

জহিরা খাতুনের কথা শুনে কোনো চিন্তা না করেই সাজেদা বেগম বললেন, এটা সম্ভব নয় আপা। সাজিরের বিয়ে তো ঠিক হয়ে আছে। আপনি জানেন সব।
-আমি জানি। কিন্তু মেয়ের পরিবার তো সে কথা জানেনা! মেয়ের বাবা তার একমাত্র মেয়ের জন্য একটা সুন্দর, শিক্ষিত ছেলে খুঁজছেন। মসজিদে সাজিরকে দেখে তার পছন্দও হয়েছে। আমাকে বলাতে আপনাকে বলতে আসলাম।
আমি ভালোর জন্যই এসেছি। আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন। সেই সুবাদে আমিও নাহয় করলাম! এক বাপের এক মেয়ে সে। সবকিছু সাজিরের হবে। ভেবে দেখবেন বিষয়টা!

সাজেদা বেগমের কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। নিজের ভালো কে না চায়! একটু কী স্বার্থপর হবেন তারাও?
.
চলবে

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_২৬
#Saji_Afroz

এসব তুমি কী বলছ মা! এটা কখনোই সম্ভব না।

সাজিরের কথা শুনে সাজেদা বেগম বললেন, কেন নয়? তোর সাথে নাবীহার বিয়ে তো হয়ে যায়নি!
-আমি ওকে ভালোবাসি। তাছাড়া আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
-ঠিক হওয়া আর হয়ে যাওয়ার মাঝে তফাৎ বিদ্যমান।
-নাবীহার পরিস্থিতি টা ভাবো একবার! আমরা ছাড়া কে আছে ওর?
-সেটাই তো। কী আছে ওর? ওই ছোটো বাড়িটা ছাড়া কিছু পাবি ওকে বিয়ে করলে? পাবি না। এর চেয়ে বরং ওর জন্য ভালো একটা ছেলে খুঁজে দেব। তুই তাসফিয়াকে বিয়ে করে নে।

বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে সাজির৷ কর্কশ কন্ঠে বলল সে, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে মা। নিজের ভাই এর মেয়ের সাথে এটা তুমি কীভাবে করতে পারো?
-নিজের ভাই এর মেয়ে হলে হয়তো এটা আমি করতাম না।
-মানে?
-মানে নাবীহা ওর মেয়ে নয়।

সাজির অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মা এর দিকে। সাজেদা বেগম বললেন, এটাই সত্যি!
জাকির ওকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। ওর আসল মা-বাবা কে কেউই জানেনা। নিজের মেয়ের মতো নায়লা ও জাকির লালন পালন করে তাকে। জাকির থাকতে আমিও এতকিছু ভাবিনি! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, অহেতুক অন্য কারো মেয়েকে নিজের ঘরের বউ করে এনে লাভ কী? তার চেয়ে বরং সোনার হরিণ পায়ে ঠেলে না দিই! তাসফিয়াকে বউ করে আনি।

সবকিছু যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সাজিরের। সে বলল, আমি কিছুই বুঝছি না মা!
-কিছু বুঝতে হবে না তোর৷ আজ আমরা তাসফিয়ার বাড়িতে যাব। একবার মেয়েটাকে অন্তত দেখি। যদি ভালো লাগে তারপর নাহয় বাকিটা হবে।

মা এর কোনো কথাই যেন কানে ঢুকছে না সাজিরের। এসব কী জানলো সে! নাবীহা পালক সন্তান!
.
.
.
রুমের মাঝে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম নায়লা খাতুনের। তিনি বিছানা থেকে উঠে এগিয়ে গেলেন নাবীহার রুমের দিকে৷ নাবীহা নিজেদের একটি ফ্যামিলি ফটো হাতে নিয়ে কেঁদে চলেছে। বাবা আর বোন দু’জনেই ওপারে চলে গেছে৷ চরম সত্যিটা মানতে যেন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।
নায়লা খাতুন কেন যেন ভেতরে যেতে পারলেন না! আবারও ফিরে এলেন নিজের রুমে। ভাবতে লাগলেন সেদিনের কথা, যেদিন নাবীহা এই বাড়িতে এসেছিল….

একটু বাদেই জাকির আসবেন কাজ থেকে। তাই তার জন্যে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত নায়লা খাতুন। নাফিসা ঘুমিয়ে আছে। ছোট মেয়েটার বড্ড বদ অভ্যাস হয়েছে। সারা রাত সে ঘুমোবে না। কিন্তু সন্ধ্যায় ঘুমোবে। এই অভ্যেসটা কিছুতেই বদলানো যাচ্ছে না। যার কারণে নায়লা খাতুনেরও রাত জাগতে হয়।
নাস্তা বানানো হয়ে যায়। জাকির এখনো আসলো না। আজ এতটা দেরী হচ্ছে কেন? খানিকবাদে কলিং বেলের শব্দ কানে বাজলে তিনি বুঝতে পারলেন, জাকির এসেছেন৷ তড়িঘড়ি করে দরজা খুলতে এগিয়ে গেলেন৷ দরজা খুলেই স্বামীর দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন তিনি। এ কী! জাকিরের কোলে রয়েছে ছোট্ট এক শিশু! নায়লা খাতুন বললেন, কে বাচ্চাটি?

তাকে নিয়ে জাকির ভেতরে এসে বলল, রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি তাকে। সাথে সাথেই হাসপাতাল নিয়ে যাই। বাচ্চার শারীরিক অবস্থা ভালো। ডাক্তার ধারণা করছেন বাচ্চাটির বয়স ৭-৮দিন হবে।
-কিন্তু এত ছোটো শিশুকে কেন রাস্তায় ফেলে গেছে?
-সেটা তো আর আমি জানিনা।

বাচ্চাটি কেঁদে উঠে। তাকে নিজের কোলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে নায়লা খাতুন। সে শান্ত না হলে নিজের বুকের দুধ পান করিয়ে তাকে শান্ত করা হয়। এরপর ঘুম পাড়িয়ে তাকে নাফিসার পাশে রাখা হয়। নায়লা খাতুন বললেন, কী করবে ভাবছ?
-খবরের কাগজে বাচ্চাটিকে নিয়ে লেখা ছাপাব, থানায় যাব৷ দেখি বা মা বাবার খোঁজ পাওয়া যায় কিনা!
-সেই ভালো।

মাস খানেক তার পরিবারকে খোঁজার চেষ্টা চালানো হয়। পুলিশও কোনো হদিস দিতে পারেননি। পরবর্তীতে তারা পরামর্শ দেন, বাচ্চাটিকে কোনো এতিম খানায় দিয়ে দেওয়ার জন্যে। তারাও এমনটা ঠিক করেন। কিন্তু এ ক’টা দিনে বাচ্চা মেয়েটির প্রতি ভালোবাসা তৈরী হয়ে যায় তাদের। ছোট্ট নাফিসাও তার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে করে হেসে খেলে৷ জাকির নায়লা খাতুনকে বললেন, মেয়েটিকে আমরা রেখে দিই আমাদের আরেকটি মেয়ে মনে করে? এত মানুষ থাকতে তাকে আমিই খুঁজে পেয়েছি। নিশ্চয় আল্লাহও চান, সে আমার কাছেই থাকুক। তাইতো এত মায়া অনুভব করছি ওর জন্যে।

নায়লা খাতুন মুচকি হেসে বললেন, আমার মনের কথা বলেছ তুমি।

দু’জনে সিদ্ধান্ত নেয়, মেয়েটিকে নিজেদের পরিচয়ে বড়ো করার। আর তার নাম দেয় নাবীহা। সেই নাবীহাই আজকের এই নাবীহা! যে কিনা নিজের পরিচয় সম্পর্কে অবগত হয়। নায়লা খাতুন চান না সে সবটা জানুক। একটা মেয়েকে হারিয়েছেন তিনি। চান না এই মেয়েটিও তার পর হয়ে যাক। সত্যটা জানলে যে এমনি কিছু হবে!
.
.
.
মা এর জোরাজোরিতে তাসফিয়ার বাসায় আসতে বাধ্য হয় সাজির। সাথে এসেছে তার বোন সানজিদা।
তাসফিয়ার মা তাহমিনা ও বাবা আবদুল মান্নান বসে রয়েছে তাদের সাথে। সাজিরকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে ব্যস্ত তারা। সাজির বিরক্ত হয় এসবে। তবুও ভদ্রতার খাতিরে চুপচাপ উত্তর দিয়ে যাচ্ছে সে।
এদিকে সাজেদা বেগম আশেপাশে তাকাতে থাকেন। বড়সড় না হলেও ডুপ্লেক্স বাড়িটা বেশ সুন্দর! তাদের একটি গাড়িও আছে। আবদুল মান্নান সাহেব বিত্তবান না হলেও টাকা পয়সা ভালোই রয়েছে। জায়গা সম্পত্তিও আছে। এসব গড়াতে হলে সাজিরের আরও অনেক বছর কষ্ট করতে হবে। এসব সবই তাসফিয়ার হবে। যেহেতু তার আর কোনো ভাই বোন নেই। যে তাসফিয়াকে বিয়ে করবে সব তার! কষ্ট ছাড়া এত সম্পদের মালিক হলে ক্ষতি কী?
তাসফিয়ার দিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ সরাতে পারলো না সাজির। তাসফিয়ার ব্যাপারে শুনেছে সে। সুন্দরী অনেক! এখন চোখে দেখেছে। কথাটি মিথ্যে নয়। বরং ভাবনার চেয়েও বেশি সুন্দরী সে!
তাকেও প্রশ্ন করতে থাকে সাজেদা খাতুন। সাজির আড়চোখে দেখতে থাকে তাসফিয়াকে।
এক পর্যায়ে তাদের আলাদা কথা বলতে দেওয়া হয়। শুরুতে মুখ খুললো তাসফিয়া। সে বলল, কিছু বলতে চাই।
-হ্যাঁ বলুন?
-আসলে আমার রিলেশন ছিল। ব্রেকআপ হয়েছে আমাদের। কারণ মা বাবার তাকে পছন্দ নয়। আর মা বাবার অমতে বিয়ে করে আমি সুখী হব না। তাই ব্রেকআপটা আমিই করেছি।

সাজিরের মনে একটি কথা গেঁথে যায়৷ আর সেটা হলো, মা বাবার অমতে বিয়ে করলে সুখী হওয়া যায় না।

তবে সাজিরের কী করা উচিত? তারও কী মা বাবার পছন্দে বিয়ে করে নেওয়া উচিত?
.
চলবে

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_২৭
#Saji_Afroz

-তাসফিয়াকে কেমন দেখলি?

বাসায় আসতেই মা এর করা প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হয় সাজির। সে বলল, ভালোই।
-তবে কী কথা আগাতে পারি আমরা?

কোনো কিছু না ভেবেই সাজির উত্তর দিলো, নাহ।

সাজেদা বেগম ভ্রু কুচকে বললেন, না মানে?
-না মানে না! জেদ করেছ বলে গিয়েছি। ওতটুকুতেই পুরোটা বিষয় শেষ চাই।

এই বলে নিজের রুমে চলে আসে সাজির৷ ও বাড়ি থেকে আসার পথে অনেকটা ভেবেছে সে। হতে পারে নাবীহার মা বাবার পরিচয় সে জানেনা৷ কিন্তু তার মামার কাছেই তো বড়ো হয়েছে সে। তাছাড়া নাবীহাকে ভালোবাসে সাজির৷ বিয়ে অবধি ঠিক হয়ে আছে তাদের। এই মুহুর্তে এসে এমন কিছু সে করবে না, যাতে নাবীহা কষ্ট পায়! বিয়েটা নাবীহা কেই করবে সে।
.
.
.
দেখতে দেখতে মানতাশার হলুদের দিন চলে এল। আয়োজনে কোনো কমতি রাখেননি মানতাশার বাবা। বাড়িতেই হলুদের আয়োজন করার কথা থাকলেও হলো না। আরশানের ভাবী চায় কোনো বড়ো কমিউনিটি সেন্টারে হলুদের আয়োজন হবে। কেননা তারাও এই আয়োজনে সামিল হতে চায়।
তাদের কথানুযায়ী কমিউনিটি সেন্টারে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়।
একে একে সবাই আসলেও নাবীহা ও আজরা এখনো আসেনি। মানতাশা তাদের বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে। আজরা রিসিভ করলেও নাবীহা করেনি। তাই মানতাশা আজরাকে ওর খবর নিতে বলল।

এদিকে নাবীহার বাড়ির সামনে কার এ বসে রয়েছে ইনতিসার। আজরা তাকে গায়ে হলুদে নেওয়ার জন্যে এসেছে। কিন্তু প্রায় ত্রিশ মিনিট হবে ইনতিসার এখানে বসে রয়েছে। এখনো কারও দেখা নেই। তবে কী অনুষ্ঠানে যেতে রাজি হয়নি নাবীহা? স্বাভাবিক! তার মনের অবস্থা বেশ বুঝতে পারছে ইনতিসার।
-তুই না গেলে মানতাশা কতটা রাগ করবে ভেবে দেখেছিস?

আজরার করা প্রশ্নে নাবীহা বলল, আমার মনের অবস্থাটা তোরা বুঝবি না?
-বুঝছি বলেই তো নিতে এসেছি তোকে। চল না প্লিজ!

রুমের মাঝে আসলেন নায়লা খাতুন। আজরা এসেছে অনেকক্ষণ হলো। নিশ্চয় নাবীহাকে রাজি করাতে পারছে না। পরপর প্রিয় দু’জন কে হারিয়েছেন নায়লা খাতুন। আর কাউকে হারাতে চান না তিনি। নাবীহা এভাবে মনমরা হয়ে বসে থাকলে মানসিক অশান্তিতে ভুগবে। যেটা তার জন্যে ক্ষতিকর।

নায়লা খাতুনকে দেখে আজরা বলল, আন্টি দেখুন না? ও কিছুতেই যেতে রাজি হয় না।

নায়লা খাতুন মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, নাফিসা যেমন তোর বোন ছিল মানতাশাও ঠিক তেমনি তাইনা? একজনের জন্য অন্যজনের মন খারাপ করাবি? যা মা। জহিরকেও নিয়ে যা৷ ওর ও মনটা ভালো হবে।

মা এর কথা শুনে যেতে রাজি হয় নাবীহা। আসলেই তো! মানতাশাও তার কাছে প্রিয়জন৷ তার মন কীভাবে খারাপ হতে দেয়। এই ভেবে উঠে দাঁড়ায় সে।

আজরা বলল, আয়। আমি তোকে তৈরী হতে সাহায্য করি।

নাবীহা তৈরী হলে তাকে ও জহিরকে নিয়ে বেরুলো আজরা৷
নাবীহা হলুদ রঙের সুতি একটা শাড়ি পরেছে। কোনো সাজসজ্জা নেই তার। চুলে খোপা করেছে।
এভাবেই বের হয়ে আসে। ইনতিসারের সাথে তাকে কথা বলিয়ে দিলো আজরা। এরপর তারা গাড়ির ভেতরে এসে বসলো।
নাবীহাকে দেখে মনে হচ্ছে, তার খোপায় ফুল থাকলে ভালো হত। ফুল ছাড়া খোপার সৌন্দর্য্য ফুটে উঠছে না। কিন্তু একথা সে বলল না। কারণ তার পাশেই বসে রয়েছে আজরা।
পথিমধ্যে একটি ফুলের দোকান চোখে পড়লে গাড়ি থামালো সে। আজরা বলল, গাড়ি থামালে যে?
-ফুলের দোকান দেখে।
-ফুল কেন?
-তোমার বেণি তে ফুল দিলে ভালো দেখাবে।

আজরা হেসে গাড়ি থেকে নামে। এরপর এগিয়ে যায় ফুলের দোকানের দিকে। ইনতিসারও গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, তোমার খোপাতেও ফুল থাকলে মন্দ হত না।

এই বলে ইনতিসার নেমে পড়ে। নাবীহা তার কথাতে একটু চমকালেও পরক্ষণে সেও গাড়ি থেকে নামে। তাকে দোকানে দেখে আজরা বলল, তোকে ডাকতে যাচ্ছিলাম। ফুল নিবি?

হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নাড়লো নাবীহা। আজরা গোলাপ ফুল দেখতে চাইলে ইনতিসার বলল, বেলী ফুল ভালো লাগবে।

আজরা হেসে বলল, আসলেই।

বেলী ফুল নিয়ে নাবীহার খোপাতে গুজে দেয় আজরা। এরপর বলল, এখন একদম পারফেক্ট।

আড়চোখে নাবীহার দিকে তাকিয়ে ইনতিসার আপনমনে বলল, আসলেই পারফেক্ট।

অনুষ্ঠানে চলে আসে তারা। মানতাশা বেশ খুশি হয়। কেক কাটার পর্ব শুরু করা হয়। এক পর্যায়ে মানতাশার হবু বর আরশান আসে তার ভাই ভাবী ও আত্মীয় সজনদের নিয়ে।
কেক খাওয়া ও হলুদ ছোঁয়ানোর পর্ব শেষ হলে গানের তালে অনেকেই নাচতে থাকে। মানতাশাও সকলের সাথে যুক্ত হয়। যা দেখে মালিহা আরশানের উদ্দেশ্যে বলল, মেয়ের কমনসেন্স বলতে কিছু নেই? শশুরবাড়ির লোকজন দের সামনে কেউ এভাবে নাচে?

যা শুনে ক্ষেপে যায় আরশান। মানতাশার উপরে প্রচন্ড রাগ হয় তার। রাগে তার দিকে এগিয়ে যায়। এরপর তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে তাকে। তার এমন কাণ্ডে অবাক হয় মানতাশা। তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আরশান?

সবাই মজা করলেও একপাশে বসে রয়েছে নাবীহা। সাজিরকে দাওয়াত দিয়েছিল মানতাশা৷ এখানে আসার আগে তাকে ফোন করে নাবীহা। আসতে বলেছিল সাজিরকে। কিন্তু সে হ্যাঁ, না কিছুই বলেনি। সময় পেলে আসবে জানিয়েছে। এখনো বেশ কয়েকবার তাকে ফোন দেয় নাবীহা। কিন্তু রিসিভ করে না সাজির।
ইদানীং সাজিরের মাঝে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সে। মনমরা মনেহয় তাকে। আর তার ফুফুও আসেননি তাদের বাড়িতে। একমাত্র আপন ছিল এই ফুফুর পরিবার। তারাও হঠাৎ এমন নীরব ভূমিকা পালন করছে কেন? এসব নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে নাবীহা।

স্টেজের পেছনে মানতাশা কে নিয়ে আসে আরশান। মানতাশা মুখে শব্দ করে বলে উঠলো, হাত ছাড়ুন। লাগছে আমার!

আরশান বলল, সামান্য হাত ধরেছি তাতেই লাগছে। হাত তুললে কতটা লাগবে ভেবে দেখেছ?

মানতাশা অবাক হয়ে বলল, মানে?
-আমাদের বংশের মেয়ে বউরা এভাবে শশুরবাড়ির সামনে বেহায়াপনা করে না।
-আমি কী করেছি?
-সবার সামনে নেচে নেচে বেহায়াপনা করোনি তুমি?
-আজকের দিনটা আমার! মজা করাটাও কী দোষের?
-শশুরবাড়ির সামনে করাটা দোষের।
-শশুর, শাশুড়ী কেউ তো নেই। মা বাবা থাকলে…

তাকে থামিয়ে আরশান বলল, ভাবী আমার মা এর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কথাটি মাথায় ঢুকিয়ে নাও। ও বাড়িতে থাকতে হলে তার কথা মতোই চলতে হবে। আর যদি না পারো এখুনি জানিয়ে দাও৷ সময় আছে এখনো। দেরী হয়নি। চাইলে শেষ করতে পারো সব।

এই বলে আরশান চলে যায়। মানতাশা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছলছল নয়নে। অন্তত আজকের দিনে এমন কিছু আশা করেনি সে!
.
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে