আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি পর্ব-০৮

0
937

#আমি_দূর_হতে_তোমারে_দেখেছি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৮

” ইহানের সাথে তোর সম্পর্ক তৈরি না হলে আমাকে বল, মা। একটা ভুল তো করেছি সেই ভুল সারাজীবনের জন্য তোকে বয়ে বেড়াতে হবে না। আমি রাইয়ানকে বলেছি, ও ডিভোর্সের সব ব্যবস্থা করে দেবে। তুই চাইলে এখানে থেকে যেতে পারিস, তোকে কেউ বাধা দেবে না।”

মায়ের কথায় ভ্রু কুচকে তাকায় রায়া। রাবেয়া বেগম বুঝতে পারছেন না তিনি ভুল কিছু বললেন কি না।

রায়া পিছন থেকে চুলগুলো গুছিয়ে সামনে আনতে আনতে বলে, ” মা এতগুলো দিন পর এ বাড়িতে এসেছি মনটা ভালো করতে। আজেবাজে কথা বলে প্লিজ মেজাজের বারোটা বাজিও না। রেগে কিছু বললেই বলবা আমি আগের মতোই বদমেজাজি আছি, নিজেকে বদলে ফেলি নি। আর তোমার ছেলেকে নিষেধ করে দিও আমার লাইফে যেন নাক না গলায়। এতদিন তো তোমাদের কোন খোঁজ খবর নেয় নি। আমার প্রতি এত দরদ তোমার ছেলের দেখাতে হবে না। আমি যেমন আছি সেরকমই ভালো আছি।”

রাবেয়া বেগম করুণস্বরে বলেন, ” তুই এখনো আমাদের ওপর রেগে আছিস, তাই না?”
” রেগে থাকব কেন? রেগে থাকার মতো কিছু করেছ তোমরা?”
” অন্যা*য় তো প্রথমে করেছিলি তুই। আমরা তো শুধরে দিয়েছি।”
” তাহলে তো ভালোই করেছ। এবার এসব বাদ দাও।”
” তোর আর ইহানের সম্পর্ক আসলেই ঠিক আছে? আমি তোর মুখে সত্যিটা শুনতে চাই রায়া।”
” আমি ভালো আছি মা। ভালো থাকার চেষ্টা করছি অনেক। দেখছ না এক মাসের বেশি সময় ধরে ও বাড়িতে গিয়েছি। তুমি তো দেখেইছো সবাই কত ভালোবাসে আমাকে। ”
” আমি কীভাবে দেখব?”
” তুমি প্রায় প্রায়ই ও বাড়িতে যাও আমার ঘুমের সময়, আমি জানি। তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শুই? অনেকদিন হলো মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও না। তোমার বর কোথায়? তিনি রাগ করে বসবেন না তো?”

রাবেয়া বেগম মুচকি হেসে মেয়েকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসলে রায়া মায়ের কোলে মাথা রাখে। রাবেয়া বেগম মেয়ের মাথায় বিলি কেটে দিতে থাকেন। রায়া অনেকদিন পর চোখ বন্ধ করে মায়ের কোলে শুয়ে আছে।

রাবেয়া বেগম বিলি কাটা থামিয়ে হঠাৎ বলে ওঠেন, ” এই রায়া, মাহমুদের আগামী সপ্তাহে বিয়ে। তোর বাবাকে কল করে সকালে বলল। হয়তো দুই একেই বিয়ের জন্য দাওয়াত দিতে আসবে।”

রায়া একলাফে উঠে বসে উৎসুক চোখে জিজ্ঞেস করে, ” কার সাথে বিয়ে? মালিহা আপুর সাথে?”
” তুই মেয়ের নাম জানলি কীভাবে?”
” আমি জানব না তো কে জানবে? মাহমুদ ভাইয়া তো আমাকে সাথে নিয়ে তিনবার মালিহা আপুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। কি মাখো মাখো প্রেম বাবাহ!”
” তুই তাহলে আগে থেকেই এসবে আছিস!”
” আমি থাকবো না? মাহমুদ ভাইয়া যখন মালিহা আপুর জন্য কিছু কিনতো তখনও আমাকে ছবি পাঠাতো,আমি পছন্দ করলে তবেই সেটা কিনতো। সামনে শুক্রবারেই বিয়ে? আমি তো ভাইয়ার বিয়েতে বরযাত্রী যাব। ”

রায়ার এত এত কথায় রাবেয়া বেগমের মন ভালো হয়ে যায়। কতগুলো দিন মেয়ের সাথে খোলামেলা কথা হয়নি। রায়া না থেমে কথা বলেই যাচ্ছে আর রাবেয়া বেগম নিষ্পলক মেয়েকে দেখে যাচ্ছেন। মেয়েটা এতদিন রুমবন্দি হয়ে গুমড়ে গুমড়ে ম*রছিল।
___

দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়া করে সবাই ঘুমিয়েছে। রায়া ফোনে গরুর মাংস রান্নার রেসিপি দেখে সেটা রান্না করতে গিয়েছে। ইহানের মা কথায় কথায় সেদিন বলেছিল পুরুষ মানুষের মন ভালো ভালো রান্না খাইয়ে বশে রাখা যায়। ইহান কোন কাজে সকালে নাশতা করে বেরিয়েছে কিন্তু এখনো বাসায় এসে পৌঁছায়নি। সেদিনের ঘটনার পর থেকে রায়া নিজেই ইহানের কাছাকাছি আর থাকতে পারছে না। ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। কী করে যে সেদিন ওরকম একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছিল সেটা সে নিজেও জানে না।

রায়া অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন রান্না শেষ হবে! ইহান আসার আগে রান্না শেষ হয়ে গেলে তাকে দিয়েই টেস্ট করানো যেত ভেবেই চুলায় গতি বাড়িয়ে দেয়।

” কী করছিস রান্নাঘরে?”

হঠাৎ পুরুষালি কণ্ঠ শুনে চমকে ওঠে রায়া। সাথে সাথে পিছনে ফিরে দেখে ইহান দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে একটা জোরে শ্বাস ফেলে রায়া।

আবার রান্নার দিকে ফিরে বলে, ” রান্না করছি।”
” তুই রান্না পারিস?”
” না পারলে রান্না করছি কীভাবে?”
” আমি কি তাহলে ভুল জানি?”
” হ্যাঁ। ”
” কী রান্না হচ্ছে?”
” আপনি ফ্রেশ হয়ে টেবিলে আসুন তখন দেখতে পাবেন।”
” এখন দেখলে কী সমস্যা?”
” না, আমি দেখাবো না।”

ইহান রায়ার কাছাকাছি এসে কোমরে চিমটি কা*টতেই রায়া লাফিয়ে ওঠে। রায়া লাফিয়ে ওঠার সাথে সাথেই গরম কড়াইয়ে হাত লেগে যায়। রায়া ছিটকে পিছিয়ে আসতেই ইহানের সাথে ধাক্কা লেগে ইহানও টাল সামলাতে না পেরে পিছনে সরে যায়। রায়া হাত উঁচু করে হাতে ফু দিতে থাকে। ইহান সাথে সাথে রায়ার হাত ধরতে রায়া ইহানের দিকে তাকায়। ইহান খেয়াল করে রায়ার চোখ টলমল করছে। রায়ার হাত লালবর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে।

ইহান রায়ার চোখে চোখ রেখেই বলে, ” স্যরি রায়া, আমি বুঝতে পারি নি এমন কিছু হবে। আ’ম স্যরি জান। খুব জ্ব*লছে?”

রায়া মাথা নাড়িয়ে বুঝায় তার হাত খুব জ্বা*লাপো*ড়া করছে। রায়াকে টেনে নিজের বুকে রায়ার মাথা জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকে। কিছু একটা মনে হতেই চুলা বন্ধ করে রান্নাঘরের তাক থেকে ভ্যানিলা এসেন্স বের করে। ইহানের হাতে ভ্যানিলা এসেন্স দেখে রায়া বলে, ” কী করবেন এটা?”
” এটা হাতের যেখানে লেগেছে ওখানে নিলে কষ্ট কমবে।”
” বেশি জ্ব*লবে না?”
” উহু একদম না।”

রায়া ইহানের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। ইহান এক হাত দিয়ে রায়ার হাত ধরে অন্য হাত দিয়ে রায়ার হাতে এসেন্স লাগিয়ে দেয়৷
রায়াকে নিয়ে নিজেদের রুমে চলে যায়। রায়াকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে, ” তুই এখানে একটু বসে থাক, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। একদম আর রান্নাঘরে যাবি না। আমি রান্নাঘর থেকে ওটা খাবার টেবিল পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারব।”
” ঠিক আছে। আমি কোথাও যাচ্ছি না।”
” আচ্ছা, আমি আসছি।”

ইহান ওয়াশরুমে চলে গেলে রায়া পা তুলে খাটের ওপর বসে। বসে বসে ইহানের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রায়া ফোনে একটা গান ছেড়ে দেয়। গান ছেড়ে চোখ বন্ধ করে খাটে হেলান দিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে।

ইহান কিছুক্ষণ পরই গোসল শেষ করে। চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। আয়নার সামনে এগিয়ে আসতে আসতে খেয়াল করে রায়া তাকে আড়চোখে দেখছে। ইহান হেসে বলে, ” সুন্দর লাগছে?”
” এ্যা?”
” আমাকে সুন্দর লাগছে না?”
” আপনি তো সুন্দর-ই। ”
” তোর তো গর্ব করা উচিৎ। গোসল করে বের হয়েছি। গা ঠান্ডা, জড়িয়ে ধরবি?”
” আসলেই?”
” না থাক, চল খেতে বসি। ক্ষিধে পেয়েছে খুব।”
” চলুন।”

রায়া বিছানা থেকে নেমে আসে। ইহানের আগে আগে রায়া রান্নাঘরে যেতে লাগলে ইহান ডেকে খাবার টেবিলের ওখানে গিয়ে বসতে বলে। রায়াও ত্যাড়ামি না করে চেয়ারে গিয়ে বসে। ইহান গিয়ে মাংস বাটিতে বেড়ে খাবার টেবিলে রেখে নিজেও চেয়ারে বসে। প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বলে, ” দুপুরে খেয়েছিলি?”
” হ্যাঁ খেয়েছিলাম তো।”
” এখন আমার সাথে আবার খাবি।”
” কী খাব? চুমু? এখনই খাব?”
” চুমু খাবি? আমার বউ এত রোমান্টিক কবে থেকে হলো?”
” আপনার অতি ভালোমানুষিতে আমার সন্দেহ হচ্ছে।”
” ভালো মানুষি কোথায় দেখালাম?”
” এই যে এত ভালো করে কথা বলছেন। আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে?”
” ওহ আচ্ছা, আমার ভালো ব্যবহার আপনার ভালো লাগছে না?”
” আমি এটা বললাম নাকি! বাদ দেন এসব। দেন খাইয়ে দেন।”
” হ্যাঁ এখন ভাত খেয়ে নে পরে চুমু খেয়ে নিস।”

ইহানের কথায় রায়া লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। ইহান রায়ার কপালে একটা চুমু দিয়ে রায়াকে ভাত খাইয়ে দেয়।
রায়া ভাত খেতে খেতেই বলে, ” আমার থেকে প্লিজ আর নিজেকে দূরে সরিয়ে নিবেন না। আমি ছোটবেলা থেকে অনেককিছু হারাতে হারাতে আপনার কাছে এসে ঠেকেছি। আপনি হারিয়ে যাবেন না প্লিজ।”

#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে