আমার প্রথম সকাল পর্ব-০৮

0
338

#আমার_প্রথম_সকাল (০৮)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
” একটা কথা জিজ্ঞেস করব? ”
” নির্দ্বিধায় করতে পার! ”
” আপনার না সপ্তাহ খানেক পরে আসার কথা? আগে এলেন যে? ”
জুনাইদ জবাব দিল, ” বিয়ের পর তোমার সাথে এটাই আমার প্রথম ঈদ। সামনে ছুটি তো আছেই। ভাবলাম দশদিন পর না নিয়ে নাহয় আগেই নিয়ে নেই। তাই অফিস থেকে আগেভাগে ছুটি নিয়ে নিয়েছি। ”
পরদিন সকাল সকাল জুনাইদের বোন অর্থ্যাৎ আমার ননদ নিজের বাপের বাড়ি চলে এলো। শ্বাশুড়ি অবশ্য আমাকে গতকালই কথাটা জানিয়ে রেখেছিলেন। এসেই মায়ের ঘরে ঢুকে পড়ল। মা মেয়ে মিলে শলাপরামর্শ জুড়ে দিল৷ সোমা আর আমি কিছুক্ষণ পর শ্বাশুড়ির ঘরের দিকে রওয়ানা হলাম। হাতে করে সামান্য নাস্তা পানীয় নিয়ে। সালাম দিতে সোমাকে তিনি নিজের পাশে বসালেন। নানান কথা জিজ্ঞেস করলেন। এদিকে আমি সেই তখন থেকে নাস্তার ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছি সেটা দেখেও তারা দুই মা মেয়ে দেখেও না দেখার ভাণ করে আছেন। সোমার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে শ্বাশুড়ি আমাকে ধমকে উঠলেন, ” তুমি এখানে দাঁড়ায়া আছো কেন? কী শুনতে আসছ? এখান থেকে শুনে গিয়ে আমার ছেলের কান ভারী করবা ভাবছো? ”
” আমি তো আপার জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি! ”
” নাস্তা আনলে রাইখা যাও। কথা গিলবা কেন? এসব ছোটলোকি কাজ কারবার নিয়া আমার ঘরে আর আসবা না কইলাম! ”
ননদের এতোক্ষণে হদিস হলো। তিনি এদিকে তাকিয়ে বললেন, ” তোমার কি অবস্থা ভাবী? ”
” কি আর অবস্থা হবে দেখস না? জিজ্ঞাস করার কি আছে? ” শ্বাশুড়ি ধমকে বললেন।
” আহা মা তুমি থামো। ভাবী তুমি যাও তো। মায়ের মাথাটা ঠিক নেই। ”
” কবে ঠিক ছিল আপনার মায়ের মাথা? ” কথাটা মনে মনে বললেও মুখে বলার সাহস হলো না। নিরবে প্রস্থান করলাম ও ঘর ছেড়ে।
.

.
যতদিন যাচ্ছে সোমাকে নিয়ে শ্বাশুড়ির ততই আহ্লাদ বাড়ছে। সোমার যত্নের কোনো কমতি রাখছেন না তিনি। সোমার গর্ভে বংশের প্রদীপ তাকে তাই যত্ন করাটাও স্বাভাবিক। এদিকে বাড়ির সবার কাজের পাশাপাশি সোমার কাজও আমাকে দিয়ে করাচ্ছেন শ্বাশুড়ি। একই বাড়ির বউ দু’জনেই। একটা বাচ্চার অভাবে সোমা রাজরানী আর আমি চাকরানী। জুনাইদ ঈদের একদিন পর জরুরী কাজে ঢাকায় গিয়েছে। বলে গেছে ফিরতে সপ্তাহখানেক দেরি হতে পারে। এ সুযোগটাকে শ্বাশুড়ি ইচ্ছে মতো কাজে লাগাচ্ছেন। জুনাইদ বাড়ি থাকলে তাকে খুব একটা ঘ্যানঘ্যান করতে শোনা যায় না। দুচারটে ব্যাপার জুনাইদ আসার পর লক্ষ্য করে নিজের মাকে বারণ করেছে। তাতে শ্বাশুড়ি নিজের ছেলের সামনে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলেও শোধ তুলছেন আমার ওপর দিয়ে।

এক গাট্টি কাপড়চোপড় নিয়ে পুকুর পাড়ে বসে আছি। গতকাল রাত থেকে শরীরটা বেশ খারাপ যাচ্ছে। জ্বর এসেছে সম্ভবত। গলা ব্যথা, কাশি অধিক পরিমাণে বেড়েছে। চলার মতো শক্তিটাও গায়ে অবশিষ্ট নেই। শ্বাশুড়ি এসব দেখেও দেখেননি৷ জামাকাপড় নিয়ে আসার সময় বলেছিলাম, ” মা আমার শরীরটা ভালো নেই। একটু কষ্ট করে নিজেদেরটা নিজেরা আজ করে নিন! ”
বসে যাওয়া গলা থেকে বেরিয়ে আসা কাকুতির স্বর শ্বাশুড়ির মনে দয়া মায়া জন্মাল না। বরং বলা মাত্র ওমনি তিনি হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ” এতোটুকুতে মানুষ ম’রে যায় না। এর থেকে বেশি কষ্ট আমরা করেছি। আজ যদি পোয়াতি হইতা তাও মানা যাইত৷ বিয়ের এতোদিন হইল এখন অব্দি একটা বাচ্চার মুখও তো দেখাইতে পারলা না আবার আবদার কর কোন মুখে? লাজ হায়া সব কি বস্তা বাইন্ধা মার কাছে রাইখা আইছো? কিছু আনো নাই সঙ্গে কইরা? ”
অগত্যা বাধ্য হয়ে অসুস্থ শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসতে হলো পুকুরঘাট অব্দি। কষ্ট করে যতটুকু পারছি করছি। কিছুক্ষণ বাদে আমার সঙ্গে যুক্ত হলো নীলা। সম্ভবত গোসল সেরে বেরিয়েছে। জামাকাপড়ের বালতি নিয়ে সিড়িতে আমার বরাবর বসল৷ ” কি ব্যাপার ভাবী? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি অসুস্থ? ”
জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, ” এইতো একটু! ”
” একটু না ভাবী। আপনার চোখ মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে অনেকখানি। কি হইছে? ”
” তেমন কিছু না বোন। জ্বর, আর গলা ব্যথা! ”
” ওওও। ”
” এই জ্বরের মধ্যে এগুলো ধুতে চলে এলেন যে? বাড়িতে আর কেউ নেই? ”
” আমি ছাড়া আপাতত কেউ নেই৷ ”
” ভাইয়া আসবে কবে ভাবী? উনার না আসার কথা আজকে? ”
” শুনেছিলাম তো এমনটাই। হয়তো রাত হবে আসতে আসতে। ”
” বুঝছি। ভাইয়া নাই তো তাই আপনাকে দিয়ে চাচী আম্মা জ্বরের মধ্যেও এগুলো করাচ্ছে। ভাইয়ারে সম্পর্কে জানি তো। আমার শ্বাশুড়ির মুখে শুনেছি উনি কেমন মানুষ। শুধু বাপ মা’র মুখের ওপর কথা বলার সাহস একটু কম। ” কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে নীলাও আমার সাথে হাত লাগিয়েছে। নিষেধ করা সত্ত্বেও মেয়েটা শোনেনি আমার কোনো কথাই। ওর সাহায্য পেয়ে আমার সে মুহূর্তে আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করতে হয়েছে। নীলার জন্য তখন মনে থেকে আপনাআপনি দোয়া চলে এলো। জীবন বড় বিচিত্রময়। যাদের আমার কষ্টের কথা বোঝার কথা তারা বোঝেনি, নাটক ভেবে বসেছে। অথচ নীলা আমার চোখমুখ দেখেই বুঝে ফেলল।

জামাকাপড় মেলে দিয়ে ঘরে আসতে দেখলাম জুনাইদ ঘরে বসে আছে। তাকে দেখামাত্র মনটা ভেতর থেকে কেঁদে উঠল। ইচ্ছে করল তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেই। ইচ্ছে করছে তার হাতে পায়ে ধরে কেঁদেকেটে বলতে, ‘ করুণা করে হলেও আপনি দয়া করে আমার জন্য কিছু করুণ। আমার যে এতো দখল আর সহ্য হচ্ছে না। ‘
কিন্তু ভেতরকার কোথাও এক অদৃশ্য জড়তা এসে আমাকে গ্রাস করে ফেলেছে। জুনাইদের পরিবারের মানুষগুলোর আচরণের কারণে দু’জনের মধ্যকার দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে। জুনাইদ কি সেসব বুঝতে পারছে না? জুনাইদের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিলাম। তখন তার কণ্ঠস্বরে আমার ভাবনার ছেদ ঘটল।
” কোথায় ছিলে এতোক্ষণ.? ”
” কাপড় ধুতে গিয়েছিলাম। ”
” আচ্ছা! ” এতটুকু বলে জুনাইদ মৌনতা বজায় রাখল কিয়ৎক্ষণ। পরক্ষণে বলে উঠল, ” তোমার চোখ লাল কেন.? এদিকে আসো। ”
জুনাইদের স্থির দৃষ্টির দিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম। কাছে যেতে সে আমার হাত ধরে চমকে গেল। ছেড়ে দিতে নিয়েও আর ছাড়ল না। পাশে বসতে বলে কপালে হাত দিয়ে পরখ করে নিল। এতোক্ষণে ঠাওর হলো আমার শারীরিক অবস্থা।
” গায়ে তো প্রচুর জ্বর! ঘরে কি প্যারাসিট্যামল আছে? ”
আমি না সূচক মাথা নাড়ালে সে বলল, ” ঠিক আছে থাকো। আমি এক্ষুনি আসছি। ” কালবিলম্ব না করে ছুটে গেল জুনাইদ। সে চলে যেতে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না কোনো মতেই। কিছুসময় পর ঘুমের ঘোরে আবছা বোঝা গেল জুনাইদ ফিরেছিল হাতে করে ঔষধের প্যাকেট নিয়ে।
.

.
জ্বরের ঘোরে কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা। যখন চোখ খুললাম তখন পাশে জুনাইদের উপস্থিতি টের পেলাম। এদিকটা ফিরে শুয়ে আছে। অনুভব করলাম আগের চেয়ে অনেকটা সুস্থবোধ করছি। তখনি বাহির থেকে দরজা ধাক্কানোর শব্দ শোনা গেল। শ্বাশুড়ি ডাকছেন, ” সকাল, এই সকাল! ক’টা বাজে হ্যাঁ? বিকেল থেকে ঘরে বসে ছিলে কিছু বলিনি দেখে কি এখনো দরজা বসে থাকবে নাকি? ঘরের বাকি কাজগুলো কে করবে? রাতের রান্নাবান্না কার জন্য রাখছো হ্যাঁ? ”
শ্বাশুড়ির চেঁচামেচিতে জুনাইদের ঘুম ভেঙে যায়। আমি উঠতে নিলে জুনাইদ পেছন থেকে হাত ধরে বাঁধা দেয়। তার দিকে ফিরতে সে ইশারা করে, ” বেশিক্ষণ হয়নি। চিন্তা করবে না। তুমি বিশ্রাম কর। ততক্ষণে আমি মায়ের কাছ থেকে আসছি। ”
.

.
সকাল সকাল সেদিনের মতো আজও তৈরি হয়ে বসে আছি জুনাইদের অপেক্ষায়। তবে আজ আর জুনাইদ খুব বেশি দেরি করল না। ফিরে এসেছে খুব কম সময়ের মধ্যে। বাড়ির সামনের দিকটায় রিক্সা দাঁড় করানো নজরে পড়ল। জুনাইদ আমাকে নিয়ে মায়ের কাছে যাবে বলে জানাল। অনেকদিন পর মাকে দেখতে পাবো ভাবতেই মনটা খুশিতে ফুরফুরে হয়ে উঠল৷ কিন্তু ভুলে গেছিলাম আমার যে খুশি হওয়া বারণ! জুনাইদ আমাকে নিয়ে বের হওয়ার সময় শ্বাশুড়ির মুখে এক প্রশান্তির হাসি দেখা গেল। উনাকে এমনভাবে দেখে বেশ অবাক লাগল৷ ভাবলাম হয়তো জুনাইদ গতরাতে বোঝানোয় তিনি বুঝেছেন অন্যথায় ভাণ ধরে আছেন। বাড়িতে তখন তিনি ছাড়া কেউ ছিল না। সোমাও নিজের ঘরে। উনাকে বলে আসতে নিলে তিনি আগ বাড়িয়ে নিজে থেকে এগিয়ে এলেন। বললেন, “তুমি পুরোপুরি সুস্থ হইলে তালাকনামা পাঠাবে জুনাইদ। তোমার মাকে বলিও প্রস্তুত থাকতে। আমাদের তো ঠকিয়ে তোমার সংসার ভাঙল এরপর যেন এমন ভুল আর না করেন। আরেকটা কথা, কি জন্য এক বছরের মাথায় তোমার বিয়ে ভাঙল সেটাও লুকিয়ে রাখিও না মানুষের কাছে। নাহলে পরে দেখা যাবে যেখানে গিয়া পড়বা সেটাও টিকবে না। ” শ্বাশুড়ির বলা কথাগুলো কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌছুতে আমার মনে হলো আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল৷ কেউ যেন আমার কানে গরম সীসা এনে ঢেলে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাহলে তিনি আমাকে বিদায় করে তবেই ক্ষ্যান্ত হলেন! কতটা পাষণ্ড মহিলা! একজন মেয়ের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তিনি শেষমেশ সংসার ভেঙেই ছেড়েছেন। এদিকে জুনাইদকে দেখলাম থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কেন জানি না, তার কপালের রগগুলো ইতিমধ্যে ফুলে উঠেছে। ছলছল করুণ চোখে তার দিকে তাকালাম। সে বুঝল তবে সেভাবেই গম্ভীর স্বরে বলল, ” রিক্সায় ওঠো সকাল। দেরি হচ্ছে! ”
চোখের পানি আড়াল করে রিক্সার দিকে অগ্রসর হলাম। নিয়তিকে মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। জানিনা মা’কে গিয়ে কি জবাব দেবো৷ যখন শুনবেন শ্বশুরবাড়ির লোককে একটা সন্তানের সুসংবাদ না দেখাতে পারার ব্যর্থতায় অকালে সংসার ছাড়া হয়েছে তার মেয়ে। মা আদৌও ঠিক থাকতে পারবেন তো?

চলবে……

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে