#আমার_প্রথম_সকাল (০৬)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
ভোরের আলো সবে মাত্র ফুটতে শুরু করেছে। চারপাশে ঝিঝি পোকার ঝি ঝি ডাকাডাকির প্রতিধ্বনি। অন্য সময় কাঁচা ঘুমের কারণে এটি বিরক্তি দায়ক মনে হলেও আজ ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোখ মেলতেই মুখের ওপর ঝুঁকে থাকা মানুষটির চেহারাটি অক্ষিপটে ভাসমান হওয়া মাত্র বিস্ময়ে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। সে অবস্থায়ই বিছানায় জমে গেলাম যেন। শুরুতে ভীতি আমাকে ঝেঁকে বসলেও এখন সেটি কেটে গিয়ে ভর করেছে বিস্ময়। মেলাতে চেষ্টা করছি আদৌও নিজের চক্ষে যা দেখছি তা সত্যি কিনা। মোটেও বিশ্বাস করতে পারছি না গত এক বছরের মাথায় দেখা ফর্সা মতন সুদর্শন যুবকটি আমার চোখের সামনে। সেও কিনা ঝুঁকে আছে মুখের ওপর। কিয়ৎক্ষণের জন্য হলেও মনে হচ্ছিল আমি বুঝি স্বপ্ন দেখছি! আমাকে ভীত-সন্ত্রস্ত চাহনিতে তাকাতে দেখে ভ্রু কুঁচকে আমায় ইশারা করল জুনাইদ। তার হাবভাবে মনে হলো কিছুই ঘটেনি। ধড়পড় করে আমি উঠে বসলাম। ভাবলাম আমি বোধহয় ভ্রমের মধ্যে রয়েছি। ওঠে বসলে সঙ্গে সঙ্গে চলে যাবে কিন্তু না। ভ্রম আমার কাটলো ঠিকই তবে সেও জুনাইদের ঘর কাঁপান হাসিতে। বুঝতে পারা মাত্রই আমি এবার ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে সালাম দিলাম। সালামের জবাবের অপেক্ষা না করেই ফের জানতে চাইলাম, ” কখন এলেন? ”
জুনাইদ এবার স্বাভাবিক হলো। সালামের জবাব দিয়ে জানাল, ” ঘন্টাখানেক আগে। ”
” ওহহ! ”
জুনাইদকে প্রফুল্ল দেখালেও চেহারা জুড়ে ক্লান্তির চাপ গেঁথে আছে। বোঝা যাচ্ছে লম্বা সময় ধরে সফর করার কারণে তার শরীরটা ভেঙে আসার জোগাড়। অপেক্ষা না করে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে জুনাইদের ঠান্ডা হওয়ার ব্যবস্থা করতে লেগে পড়লাম। বাহিরে যেমন গরম পড়ছে তাতে করে ব্যবহৃত সুগন্ধি এবং ঘাম দুয়ের গন্ধ এক হয়ে গা থেকে এক অন্যরকম গন্ধ ভেসে আসছে। রমজানের সময়টা হওয়ায় নাস্তা বা খাওয়া দাওয়ার চিন্তা করতে হলো না। তবুও মনে হতে জিজ্ঞেস করলাম, ” আপনি কি সেহরি করেছিলেন? ”
” কোথায় আর করলাম? সময় পেলে তবেই না করব! ”
” আচ্ছা। তাহলে আপনি ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম করুন। কিছুর দরকার হলে জানাবেন। ”
জুনাইদ স্নানাগারে ঢোকার আগ মুহূর্তে বলল, ” তুমি কোথাও যাবে নাকি? ”
” নাহ। আমি এখানেই আছি। ”
” ঠিক আছে! ”
জুনাইদ একেবারে গোসল সেরে বেরিয়ে এলো। এসে সেরকম কোনো কথা বলেনি। বিছানায় গা এলিয়ে দিতে ঘুনের দেশে তলিয়ে গেল। এদিকে আমার মন নিজেকে নিজে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলছে, জুনাইদের দেশে ফেরার কথা তো আরো এক সপ্তাহ পরে! অর্থ্যাৎ ঈদের পরপর এমনটিই বলেছিল। অথচ চলে এলো আগে কিন্তু একটিবার আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করল না! জিজ্ঞেস করার জন্য মন বারবার চটপট করলেও পরক্ষণে দমিয়ে রাখলাম নিজেকে। কাঁচা ঘুম থেকে কাউকে জাগানো ঠিক না। পরে ঠিকই জানা যাবে।
.
★
.
ভোর রাতের পর আর চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। সকাল হতেই কাজে লেগে পড়লাম। আগামীকাল ঈদ সেই সঙ্গে জুনাইদ ফিরেছে, সব মিলিয়ে কাজও বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। এদিকে শ্বাশুড়ি মা এসেও তাড়া দেওয়া শুরু করলেন, জুনাইদ ঘুম থেকে ওঠার আগেই যেন ঘরদোর ঝাড়ামোছা সমেত ঘরের যাবতীয় কাজ যেন শেষ করে ফেলি। তার আবার অপরিষ্কার বাড়িঘর অপছন্দ সেটাও মনে করাতে ভুললেন না। কাজ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে জুনাইদ নিজের ঘর ছেড়ে বেরুলো। তখন আমি মেঝেতে বসে বালতিতে কাপড় ভিজিয়ে ঘর মোছার কাজ করছিলাম। যুগ পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের কাজের উপকরণ পরিবর্তন হয়ে কাজকে সহজ করে দিলেও আমার ক্ষেত্রে শ্বাশুড়ি সেটি হতে দেননি। এখনকার সময় কেউ আর আগের মতো মেঝেতে বসে মোছার কাজ কারবার করে না। কেবল মাত্র আমি ছাড়া। জুনাইদ মাস শেষে বেশিরভাগ টাকা পাঠায় শ্বাশুড়ির একাউন্টে। শ্বশুর সেগুলো তুলে এনে বাজার সদাই হতে যাবতীয় খরচা করেন। আমার নামে একাউন্ট করা হয়নি। বলা বাহুল্য করতে চাইলেও করতে পারেনি জুনাইদ সময়ের অভাবে। জুনাইদ বলে দিলে শ্বশুর মাঝেমধ্যে ডেকে নিয়ে গিয়ে হাজার দু’য়েক টাকা হাতে তুলে দেন। শ্বাশুড়ি সেসব ভালো চোখে যে দেখেন না তা বোঝার অবকাশ নেই। তিনি ভাবেন উনার ছেলের টাকা আমি আমার বাপের বাড়ি পাঠাই। আমার বাপের বাড়ির লোক অভাবী, ফকিন্নির বাড়ির মেয়ে আমি পাঠালে পাঠাতেও পারি। তাই তিনি সেসবেও কথা শোনাতে ছাড় দেন না। মাত্র হাজার দু’য়েক টাকার জন্য তিনি হাজারটা কৈফিয়ত চান। কোথায় খরচ করলাম, কিসের খরচ আমার, খাচ্ছি দাচ্ছি সব তো এখানেই, আমার কি কোন জিনিসের অভাব হচ্ছে নাকি? আমায় আলাদা করে খরচ দিতে হবে কেন? শ্বশুরকেও ধোলাই দেন বেশ আচ্ছা মতো। শুনে অশ্রু এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর যে উপায়ও নেই। অথচ আমার স্বামীর টাকায় আমার হক থাকলেও সে টাকা খরচ করা আমার রুচিতে কুলোয় না। ছোট বোনটাকে ইচ্ছে করে কিছু দেই। পরক্ষণে শ্বাশুড়ির কথার জন্য ইচ্ছেটাকে আমার তাৎক্ষণিক মাটি চাপা দিতে হয়।
জুনাইদ খুব সম্ভব শ্বাশুড়ির ঘরের দিকে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলে ওঠল, ” সকাল তুমি মেঝেতে কি করছ? আর রোজা রেখে এভাবে কাজ করছ কেন? ”
জুনাইদের কথা শেষ হওয়া মাত্র শ্বাশুড়ির ঘর থেকে আওয়াজ এলো, ” কি ব্যাপার? বেলা কয়টা বাজে? এতটুকু কাজ করতে এতো সময় লাগে কেন হ্যাঁ? এতো ধীর গতিতে কাজ করলে বাকি কাজগুলো কে করবে শুনি? ”
জুনাইদ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকায় তার চেহারার হাবভাব বোঝা গেল না। তবে নিঃশব্দে দ্রুত পায়ে হেঁটে যেতে দেখা গেল।
.
★
.
পুরো রমজান মাস শেষে ঈদের দিন বিকেল বেলায় একটুখানি জিরবার সুযোগ পেলাম। সারাদিন কাজ শেষে গোসল গা ধুয়ে বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিতে জুনাইদ বাহির থেকে এসে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ” সকাল রেডি হয়ে নেও! ”
প্রতিত্তোরে জানতে চাইলাম, ” কেন? ”
” তোমাকে নিয়ে বের হব। দেরি করবা না বলে দিলাম। ” বলেই আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জুনাইদ তাৎক্ষণিক বেরিয়ে গেল।
মনের ভেতরকার দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে জুনাইদের কথা মতো রেডি হয়ে নিলাম। জুনাইদ বেরিয়েছে ঘন্টাখানেক হলো। এখনো ফেরেনি। ইতিমধ্যে শ্বাশুড়ির কক্ষে ডাক পড়ল,
” নবাবের বেটি কই গেলা? এদিকে যে ডাকি কানে কি কালা হয়ে গেলা? ”
তড়িঘড়ি করে গেলাম শ্বাশুড়ির ডাকে সাড়া দিতে। আমাকে দেখে তিনি মাথা থেকে পা অব্ধি পরখ করলেন। হুট করে তাদের না জানিয়ে তৈরি হতে দেখে তার চোখে বিস্ময় প্রকাশ পেল। বদনখানি গম্ভীর করে বললেন, ” কই যাও কাউরে না জানায়া? এতো রংঢং কিসের জন্যে? ”
” আম্মা আপনার ছেলে বলল রেডি হতে তার জন্যই। ”
” বাহ্ বাহ্! জুনাইদ বলল আর তুমিও ড্যাং ড্যাং কইরা রেডি হইয়া গেলা? ”
যে বাড়িতে সব কাজ শ্বাশুড়ির হুকুমে ঘটবে সে বাড়িতে স্বামীর মতও যে প্রাধান্য পাবে না সেটা আগেই আমার বোঝা উচিত ছিল। শ্বাশুড়ি নিজের মতো বলে চলল, ” কোথাও যাওয়া হবে না তোমার। কাল আমার মেয়ে আসবে। তুমি এখন গেলে ওদের কে রেঁধে বেড়ে খাওয়াবে শুনি? ”
” কিন্তু মা….
শ্বাশুড়ি জোর গলায় ধমকে বলে উঠলেন, ” আবার কিসের কথা? আমি বলছি হয় নাই? জুনাইদ আমার ছেলে ওরে আমি খুব ভালো করে চিনি। তুমি নিজেই ওরে বলছ বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা। নইলে জীবনেও আমার অনুমতি ছাড়া একটা কাজও সে করে না। বাড়ি ফিরতে ফিরতেই আঁচলে বান্ধার ধান্দা করতেছো! ভাবছো বুঝি না কিছু তাই না? কতদিন এমনে চলবা? যদি একটা বাচ্চার মুখ দেখাইতা তাও তো মানা যাইত। সেটাও তো পারলা না। ”
শ্বাশুড়ির কথা শেষ হওয়ার আগেই সরে এলাম। জানি উনার মেজাজ তুঙ্গে চড়েছে। এখানে থাকলে আরো কিসব শুনতে হবে তারচে চলে আসাই ঢের ভালো মনে হলো। উনার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই উঠানে দেখতে পেলাম…..
চলবে…..
[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]