অনুভবে পর্ব-১৮+১৯

0
454

অনুভবে
পর্ব-১৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সারাদিনে তার মজার, রাগের, বিরক্তির যা হয় সবই ইনারাকে ঘিরে। সত্যিই কী সে আজকাল কেবল ইনারার কথা বলে বেড়ায়। তার মাথায় কী শুধু তার কথাই ঘুরে? না, এটা তো ভালো লক্ষ্মণ নয়!

সভ্যের মা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, “বল না, মেয়েটা কে? পছন্দ করিস? ভালোবাসিস?”
কথাটাতেই ক্ষেপে উঠে সভ্য, “মা প্লিজ! ক’দিনের দেখাতে কাওকে ভালোবাসা যায় না।”
“পছন্দ তো করা যায়।”
“এই পাগল মেয়েকে আমি পছন্দ করবো? অসম্ভব!”
তুমি বুঝতে পারছো না মা, মেয়েটা আসলেই আজব। সারাদিন উল্টাপাল্টা কাজ করতে থাকে আর আজব আজব কথা বলতে থাকে তাই ওর কথাই বেশি বলা হয়। এমন কার্টুন আমি জীবনে আগে দেখি নি।”
মা মিষ্টি হাসে। বলে, “আচ্ছা তুই নিজেকে যা বুঝ দিস, তোর ব্যাপার। কিন্তু কখনো নিজের অনুভূতিগুলোকে এড়িয়ে যাবি না। যেকোনো মানুষকে ভালোবাসা যায়, ভালোবাসা বাছাই করে হয় না। এছাড়া ওর কথা শুনে খুব মিষ্টি মেয়ে মনে হচ্ছে। ছবি দিবি। এখন খেয়ে নে, আমিও সবাইকে খাবার দিতে যাই। ঘুমানোর আগে আবার কল দিব।”
“আচ্ছা মা।”

সভ্য কল কেটে কোলের থেকে গিটারটা সরায়। যায় বাহিরে। বারান্দায় দাঁড়াতেই তীব্র হাওয়ার কারণে বৃষ্টির পানিতে সে অধো ভিজে গেল। সে একবার ভাবলো ইনারাকে কল দিবে। আজ তাকে মাঝরাস্তায় এভাবে ছাড়ার পরই বৃষ্টি শুরু হয়। সে দ্রুত ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরাতে বলে। কিন্তু যেয়ে দেখে ইনারা আর নেই। কিন্তু মেজাজ গরমে আর কল দেয় না সে। মেয়েটা কীভাবে ভাবতে পারে তার এবং ঐশির মাঝে কিছু চলছে। নিজের ছেলে বন্ধু কেবল বন্ধু হতে পারে অথচ সে এবং ঐশি কেবল বন্ধু হতে পারে না?

নিজের রাগের অনুভূতির কারণে আবারও অবাক হয় সভ্য। হাজারো মানুষ তাকে এবং ঐশিকে নিয়ে এমনই ভাবে। এসবে তার সহজে রাগ উঠে না। তবে ইনারার ব্যাপারে তার এমন রাগ উঠলো কেন?”
.
.
“ওই বেয়াদবটাকে মেরে মেরে তক্তার ভর্তা বানিয়ে আমি রাস্তার কুকুরদের খাওয়াব। কত বড় সাহস আমাকে মাঝরাস্তায় নামায় দিলো।” ইনারা বলল। সে কিছুক্ষণ আগেই সুরভীর বাসায় এসেছে। একদম ভিজে জবজবে হয়ে ছিলো সে। তারপর সুরভি গরম পানি করে তাকে গোসল করতে দেয়। তার হাতে একমগ গরম চা দিয়ে নিজে তোয়ালে দিয়ে তার চুল মুছতে মুছতে বলে, “তোরই তো দোষ। না জেনেশুনে তোকে বকবক করতে বলেটা কে?”
“তুই ওই অসভ্যের গুনগান গাইবি না, নাইলে তোকেও ওর মতো মেরে ভর্তা বানিয়ে দিব।”
“সভ্যের জন্য তো আমি ভর্তা হতেও রাজি।”
ইনারা চোখ ঘুরিয়ে তাকায় তার দিকে। বলে, “সারাদিন আমাকে বলোস আমি জোহান জোহান করি। এখন তুমি কি করতেছো?”
“আমি তো কেবল ভক্ত হিসেবে করি কিন্তু তুই তো অতিরিক্ত। জোহান কারে চুম্মা মারছে এতেই তোর কান্না পায়, ধ্যুর!”
ইনারা উঠে লাথি মারে তাকে আর বলে, “জ্বলায় লবণ মরিচ সব মার। শালী। প্রিয়রে ফোন করে বল আইস্ক্রিম আনতে আমার জন্য। আমি ছ্যাঁকা খাইসি।”
“ছেলেটা মাত্র কাজ করে বাসায় গেছে সম্ভবত। এখনই আনাবি?”
“হো। আমার মন খারাপ বল। এক দৌড়ে নিয়ে আসবে।”
“আচ্ছা দাঁড়া কল দেই। আমারও খেতে মন চাইছে। তোর ছ্যাঁকা খাওয়ার খুশিতে। হি হি।”

ঠিক তাই হয়। প্রিয়কে বলার সাথে সাথে সে দশ মিনিটের মাঝে তাদের জন্য আইস্ক্রিম নিয়ে আসে। তারপর তিনজন মধ্যরাত পর্যন্ত ছাদে আড্ডা দেয় আইস্ক্রিম খেতে খেতে।
.
.
চারপাশ লাল রঙে ভেজা। মেঝেতে ভেসে আছে সে লাল রঙ। এ কী রক্ত! হ্যাঁ, রক্ত। পাশে শুয়ে আছে এক মহিলা। তার মাথা দিয়েই রক্ত বের হচ্ছে। তার পাশে দাঁড়ানো কয়েকটি লোক। হঠাৎ এক ছোট্ট মেয়ে ‘মা’ ‘মা’ করে দৌড়ে ঢুকলো দরজা দিয়ে। তার এই বাড়িতে সহজে এত লোক থাকে না। তাই হঠাৎ এত লোক দেখে সে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। পরক্ষণেই তার চোখ পরে মেঝেতে পরা সে রক্তাক্ত দেহটার উপর। মুহূর্তে তার দেহ শিউরে উঠে তার। মা’য়ের শরীর মাখা রক্ত দেখে তার বুকের স্পন্দন বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সে নিজের হাতের ব্যাগগুলো সেখানেই ফেলে দৌড়ে যায় তার মা’য়ের কাছে। তার পাশে বসে কাঁদোকাঁদো গলায় বলে, “মা…মা… তোমার কী হয়েছে? তুমি ব্যাথা পেয়েছে? কিছু বলো না মা।”

সে আবার আশেপাশে তাকিয়ে বলে, “আমার মা ব্যাথা পেয়েছে আপনারা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান না কেন?” আবার সে তার মা’কে বলে, “মা আমি তোমাকে নিয়ে যাব। তুমি চিন্তা করো না। কিছু হবে না তোমার। কিছু হবে না। উঠো তুমি, উঠো।”
মা উঠে না। তাকে টেনে সরানো হয়। তার বাহু ধরে টেনে দূরে নিয়ে আসা হয়। তাকে বলা হয়, ‘তার মা আর নেই।”

সে অনেক ডাকে মা’কে, ‘মা… মা… উঠো। তুমি না উঠলে আমি কিন্তু খাব না। আমি অনেক কাঁদব। অনেক। তোমার আমার চোখের পানি না অপছন্দ? তাহলে উঠো না কেন?’

তার মা তুঠে এসে আর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় না, তাকে জড়িয়ে ধরে না, তার কপালে চুমু দেয় না। সে কাঁদতে থাকে। চিৎকার করতে থাকে। তাকে যেতে দেওয়া হয় না তার মা’য়ের কাছে। বসতে দেওয়া হয় না তার মা’য়ের কাছে।

ঘুম ভাঙে ইনারার। তার মাথায় ঘাম জমে আছে। সে আশেপাশে তাকাল। পাশে দেখতে পেল ঘুমানো সুরভীকে। এটা স্বপ্ন ছিলো? তার জীবনের জঘন্যতম দুঃস্বপ্ন। এই জঘন্যতম দুঃস্বপ্নটাই তার বাস্তবের এক অংশ।

হঠাৎ নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হলো ইনারার। দম আটকে আসতে শুরু করলো। সে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে দাঁড়ায় ব্যালকনিতে। চারপাশ নিরবচ্ছিন্ন। আকাশে বিশাল এক চন্দ্রিমা আঁকা। ইনারা যেয়ে বসলো ব্যালকনির এক কোণে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো চন্দ্রিমাটির দিকে। হঠাৎ করেই গালের এক কোণে দিয়ে বয়ে পড়ে নোনাপানি। দুঃখের জল। আর থামে না। সে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে। অভিযোগের সুরে বলে, “মা তুমি কেন আমাকে ছেড়ে গেলে? কেন?”
হাতটা খামচে ধরে সে। এতটা জোরে খামচে ধরে যে রক্ত জমে যায়। তাও ছাড়ে না। তার চোখ কাঁপে, ঠোঁট কাঁপে, শরীর কাঁপে। তাও কষ্ট কমে না। এত বছর হয়ে গেল তার মা নেই, আজও কষ্টটা কমে না কেন?
.
.
সকালে ইনারা কাজে যেতেই দেখে রুমে সকলে উপস্থিত। সাঈদ ভাইয়াও। সকলে যেন খুব ব্যস্ত। হঠাৎ সকাল-সকাল এমন ব্যস্ততা দেখে ইনারা সামিকে জিজ্ঞেস করে,
“কী হচ্ছে? সবাই এত চিন্তিত কোন দুঃখে?”
“বলো না ঐ টাকলা মামা…সরি মানে মিস্টার হক আছে না? সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী সাপ্তাহে কোম্পানির পঞ্চম বার্ষিকীতে আমাদের লাইভের নাচ প্রদর্শনটা সবার আগে করা হবে। হুটহাট করে। আমাদের প্রাক্টিস শুরু হলো সবে গতকাল। কী করে সম্ভব? এর উপর গানও প্রদর্শন করা হবে। আবার এলবামের কাজ। এখন সব গুছাতে হচ্ছে। কী যে বাজে অবস্থা! সভ্য সিডিউল মিলাচ্ছে।”
“ওহ।”

ইনারা সভ্যের দিকে তাকায়। সভ্য তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। অথচ তাকে দেখতেই কেমন একটা ভাব নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ইনারা তো হতভম্ব। সে মনে মনে বলে, “দেখেছ কত বড় অসভ্য! নিজে আমাকে বৃষ্টি মধ্যে ফেলে আসছে এখন আবার এটাটিউড দেখায়। মানুষ তো না যেন এটাটিউডের খনি। কম পরে না। শালা অসভ্যের দলের রাজা, হনুমান, ব্যাঙের ছাতাকে ভর্তা বানাবো শুধু। সে কী ভাবে তার শুধু এটাটিউড আছে? আমি দেখেচ্ছি তাকে এটাটিউড কাকে বলে।”
সে নিজেও ভেংচি কেটে সামনের সোফায় যেয়ে বসে। আকস্মিকভাবে তার পাশে এসে বসে জোহানও। এসেই সে জিজ্ঞেস কঅরে, “কাওকে বলো নি তো?”
ইনারা বুঝতে পারে না কি বলছে জোহান, “কী?”
“আমার আর দীপার কথা?”
“মুড হয় নি বলার।”
“দেখ আমি তোমাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি….” ইনারা কথা কেটে বলে, “খবরদার হুমকি দেবার চেষ্টা করলেই মুড চেঞ্জ হয়ে যাবে বলে দিলাম।”
“আচ্ছা বাবা, তাহলে কী বললে আমাদের কথা জানাবে না তা বলো। তোমার কী লাগবে বলো?”
“বলব না।”
জোহানের মাথায় তখন সে কনসার্টে দেখা মেয়েটার কথাও ঘুরছিলো। তাই সে এই ফাঁকে জিজ্ঞেস করে নেয়, “আচ্ছা তোমার বোনের সাথে দেখা করবো আমি। সাথে সবাইকে দেখা করাবো। এটাতে খুশি? চলবে?”
জোহানের উদ্দেশ্য ছিলো এক তীরে দুই স্বীকার করার। কিন্তু ইনারা তার ইচ্ছা পূরণ হতে যেন দিবেই না। সে বলে, “আর আপনাকে কে বলল সে আপনার ফ্যান?”
“সারাদেশ আমাদের ফ্যান। সে হবে না? আচ্ছা সে কি আমাদের কোনো কনসার্টে আসে নি আগে?”
“বলব না।”
” আচ্ছা এটা না হলে তোমার চুপ থাকতে কী লাগবে তা তো বলো।”

ইনারার তো এত সহজে ছেড়ে দেবার মানুষ না। তাই সে কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। অন্যদিকে আজ জোহান কথা বলেই যায়। তাকে মানানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। অথচ প্রতিদিন সে জোহানের সাথে কথা বলতে থাকে। কিন্তু জোহান উত্তর দেয় না। আজ ব্যাপারটা কেমন উল্টো। কিন্তু তার ব্যাপারটা ভালো লাগছে। কেমন যেন পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে সে।

সে এক ফাঁকে চোখ তুলে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্য তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। গতকালের কথা মনে করতেই সে ভেংচি কাটলো। দূর থেকেই ভেঙাতে শুরু করে। সভ্য বিরক্ত হয়ে চোখ নামিয়ে নিজের কাজ শুরু করতে থাকে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই আবার তাকায় তার দিকে।

জোহান ইনারার ভেঙানিটা দেখে সভ্যের দিকে তাকায়। দুইজনকে দেখেই কপাল কুঁচকে নেয় ইনারা। সে যে সভ্যকে চিনতো তার তো এমন ব্যবহার পছন্দ ছিলো না তাহলে এই মেয়ের এমন ব্যবহার সে সহ্য করছে কেন?”

~আগামী আরেক পর্ব দিব বলে আজ একটু ছোট দিলাম~

চলবে…..

অনুভবে
পর্ব-১৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“ইনারা শুনো তো।” হঠাৎ সাইদ ডাকে তাকে। ইনারা উঠে যায়, “জ্বী ভাইয়া?”
“আইজাকে এই ইনভেটেশন দিও তো।”
“এটাতে কী?”
“ওহ তোমাকে তো বলাই হয় নি। আইজা এই কোম্পানিতে যুক্ত হচ্ছে। অভিনেত্রী হিসেবে। এখন থেকে এই কোম্পানি তার সকল প্রজেক্ট সামলাবে।”
“কী!” চমকে উঠে ইনারা, “কিন্তু আপু তো আমাকে কিছুই বলে নি। এতকিছু হয়ে যাচ্ছে অথচ আমি কিছুই জানি না।”
সাইদ খামটা ইনারার হাতে দিয়ে বলল, “প্লিজ খামটা ওকে দিয়ে দিও। আপাতত কথা বলার সময় হচ্ছে না। অনেক কাজ বাকি, একটু বুঝো।”
এই বলে সাইদ অন্যদিকে ছুটে গেল।

যেহেতু জোহান পাশেই বসে ছিলো সে সম্পূর্ণ কথা শুনে। মনে মনে অনেক খুশিই হয় সে। তার আর কষ্ট করতে হচ্ছে না। সে যে মেয়েকে এতদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে মেয়েটা নিজেই তার কাছে চলে আসছে। হঠাৎ করেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল তার। সে দাঁড়িয়ে ইনারাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার বোন আমাদের কোম্পানি জয়েন করছে?”
“আপনার কী? আপনি থাকুন না নিজের দীপার সাথে।”
ইনারা ক্রোধিত গলায় বলে চলে গেল। সে এই মুহূর্তে দ্রুত বাসায় যেতে চাইছিলো তা আর সম্ভব না। আজ প্রচুর কাজ আছে তার। হঠাৎ এমন প্লানিং পরিবর্তের কারণে সব সিডিউল তাকে নতুন করে করতে হবে। এ কয়দিনে পঞ্চসুরের এলবাম বাছাই করা, তাদের কতগুলো ফটোস্যুট আছে, ইন্টারভিউ আছে৷ আবার তাদের আলাদা আলাদাও অনেক কাজ আছে। এতদিন ধরে তো কেবল রিহার্সালের জন্য ইনারা কাজের চাপ টের পায়নি। কিন্তু এখন সিডিউল তৈরি করতে যেয়েই তার ভয় লাগছে।

সারাদিনে সব কাজ সেরে জলদি বাসায় এলো সে। আগামী কয়দিন অনেক কাজ আছে। তাই আজ আরাম করতে এলো সে। এসে দেখে সোফাতেই যেন এক পার্লার তৈরি হয়ে গেছে। কিছু মহিলা ফুপি এবং আইজা আপুর মেনিকিওর, পেডিকিওর এর কাজ করছে। আইজা আপুর মুখে ফেসমাস্কও লাগানো। এসব দেখে ইনারা চোখ বড় বড় করে নেয়। ফুপি তার দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে, “আরে ইনু, তুই কখন এলি?”
“এইত্তো ফুপি, মাত্র। কিন্তু তোমাদের এই অবস্থা দেখে ভয়ে এক মুহূর্তের জন্য হার্ট অ্যাটাকই করতাম। ভাবলাম এই সন্ধ্যাবেলায় ভূতেরা আমার বাসায় আড্ডা মারতে এলো কেন? আর আপুর হাত পা ভরে এই সাদা কী লাগিয়ে রাখসো?”
“আরে ফিল্মে চান্স পেলো, অভিনেত্রী হবে, একটু সুন্দর লাগতে হবে না ওকে?”
“আমার আপু তো মাশাল্লাহ সবচেয়ে বেশি সুন্দর।” ইনারা আইজার দিকে হেসে বলে। আইজাকেও অনেক খুশি দেখায় তার প্রশংসা শুনে। ফুপি এবার কাঠখোট্টা গলায় বলে উঠে, “হইসে। ওর মন রাখার জন্য আর এসব বলতে হবে না। এতদিন তো কেবল আমরা দেখে এসেছি, এখন তো সারাদেশ দেখবে। এখন আর এই অহেতুক সান্ত্বনা চলবে না। এই ট্রিটমেন্ট এর পর ওর রং তোর মত না হলেও একটু তো ফর্সা হবে।”
“উফফ ফুপি! তুমি আবার শুরু করলে? তোমাকে না বলেছি এই রং টং মেটার করে না। মানুষ কেমন তা মেটার করে। আর আমার আপু সবচেয়ে ভালো।”
“এসব মুখের কথা। সমাজে মানুষ সবার আগে মানুষের চেহারাই দেখে। আর মিডিয়া জগৎ-এ চেহেরাই জরুরী কেবল। তুই বুঝবি না। তোর এসব সহ্য করতে হয়েছে না’কি? ভাগ্য নিয়ে জন্ম নিয়েছিস তুই। তোর মা’য়ের রূপের প্রশংসাও দেশ বিদেশে হতো। যাদের রঙ কালো তাদের কতকি শুনতে হয় তুই কীভাবে বুঝবি? তুই এই’যে এমন এলোমেলোভাবে থাকিস তাও ওর পাশে দাঁড় করালে সবাই তোরই প্রশংসা করবে। এটাই নিয়ম। আমি যেমন মানুষের কথা শুনেছি আমার মেয়েকে তেমন শুনতে দিব না। তুই যা তো। এখানে তোর কাজ নেই। বিরক্ত করিস না।”
ইনারা বিরক্ত হয়ে বলে, “মানুষ তো তখন বলবে যখন তুমি বলা বন্ধ করবে। সারাক্ষণ আপু তোমার মুখ থেকেই খোঁটা শুনে আসছে। মানুষ আর কী বলবে বলো?”
“তুই বের হ তো। বের হ।”

ইনারা বিরক্ত হয়ে আইজার কাছে যেয়ে তার হাতে সাইদের দেওয়া খামটি দিয়ে বলে, “সাইদ ভাই তোমাকে দিতে বলেছে।”
আইজার মন খারাপ ছিল তার মায়ের কথাগুলো শুনে। কিন্তু সাঈদের দেওয়ার জিনিস দেখেই তার ঠোঁটের কোনে হাসি এঁকে উঠে। সে হাত বাড়িয়ে খামটা নেওয়ার পূর্বেই তার মা ইনারার হাত থেকে খামটা নিয়ে নেয়। আর রাগান্বিত সুরে বলে, “তুই এখনও ওই মিডেলক্লাস ছেলের সাথে কথা বলিস? তুই সেলিব্রিটি হবি আইজা। এসব মানুষের সাথে কথা বলার প্রয়োজন নেই। আর তোকে কী দিয়েছে ও? কেন দিয়েছে?”
ইনারা বিরক্ত হয়ে বলে, “আপু না’কি ‘এইচ এম’ কোম্পানিতে জয়েন করেছে। আগামী সাপ্তাহে তার পঞ্চম বছর বার্ষিকী। তারই ইনভেটেশন কার্ড।”
“বলিস কী! যাক ছেলেটা কোনো কাজে তো লেগেছে।” ফুপির চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠে। সে উঠে দাঁড়িয়ে পার্লারের মহিলাগুলোকে বলে, “তোমাদের যত ভালো ট্রিটমেন্ট আছে সব ওর উপর করো। আরও সুন্দর করো ওকে। পার্টিতে যেন সবার নজর আমার মেয়ের উপর থাকে।”
বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে ইনারা। চলে যায় নিজের রুমে। তার ফুপিকে কিছু বলা আর পাথরকে মায়া শিখানো এক কথা।
.
.
“দেখ তো এই স্যুট ঠিক আছে না’কি? ” জোহান সামিকে জিজ্ঞেস করে। সামি বিছানায় বসে মোবাইল চালাচ্ছিল। জোহান আজ তাকে সাথে নিয়ে এসেছে কিছু বিশেষ কাজে। অথচ আনার পরপরই সে তার সকল স্যুট দেখাতে শুরু করে। সামনের সপ্তাহের পার্টিতে পরার জন্য। সামি সহজে বিরক্ত না হলেও আজ হলো, “ভাই তুই এ নিয়ে তেরো নাম্বার স্যুট দেখাচ্ছিস। সবই সুন্দর লাগে তোর উপর। এভাবে আমাকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে এখানে ফ্যাশন শো করে দেখানোর মানে হয় না। তুই আগে তো এমন করিস নি।”
“আগে তো কোনো মেয়ের উপর এভাবে আমার মনও আসে নি। আর তাকে আমি এত খুঁজিও নি।”
“কার কথা বলছিস?”
“ওই কনসার্টে যে মেয়ের দেখা পেয়েছিলাম। আবছা আলোতে তাকে ভালো করে দেখতেও পারি নি তবুও মনে তার প্রতিচ্ছবি এঁকে আছে। তাকে এক নজর দেখার পর থেকে তার স্বপ্নই আমাকে জ্বালায়। আমার স্বপনচারিনী।”
“বলিস কী! সে পার্টিতে আসছে?”
“সম্ভবত। আমার সন্দেহ সে ইনারার বোন হতে পারে। আমার স্বপনচারিনীর চেহেরা কিছুটা ইনারার সাথে মিলে। কি! ও আমার স্বপনচারিনী কিছুতেই হতে পারে না। তারপর শুনলাম ওর বোন আছে। মেয়েটা মার্জিত এবং শোভন। নিশ্চয়ই সে আমার স্বপ্নচারিনী হবে। অপরূপ সুন্দরী এবং মার্জিত।”
“ইনারার সাথে চেহেরা মিলে অথচ ও হতে পারবে না। কেন? ভাই ও মারাত্মক সুন্দর। অনেকটা ছেলেদের মতো চলাফেরা করে বলে মেয়ে মেয়ে ফিল আসে না। তাই আকর্ষণীয়ও লাগে না। কিন্তু মেয়েটার চেহেরা অনেক সুন্দর। ওর ছবি মা’কে দেখিয়েছিলাম। মা তো দেখে বলে ওর চেহারা নায়িকা সাইয়ারার মতো। তাদের যুগের সবচেয়ে সুন্দর নায়িকা।”
“বলিস কী! তোর মা’কে দেখাতে গেলি কেন?”
সামি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন কী হলো?”
জোহান পড়ে যায় চিন্তায়। সে তার স্যুট আলমারিতে রেখে বিছানায় এসে বসে সামির সামনে, “আরে ও সুরু আন্টির মেয়ে।”
“সুরুটা কে?”
“সুরু আন্টি মা’য়ের বান্ধবী। তার মেয়েই ইনারা। দুইবছর আগে যার সাথে শ্রীমঙ্গল গিয়েছিলাম। এক নাম্বারের গাঁধা ছিলাম তখন। না বুঝে শুনে খাতির করে বসলাম। একমাস পর শুনি মা ওর সাথে আমার বিয়ের কথা বলছে। ওর সাথে! বুঝতে পারছিস? ভাগ্যিস মা’য়ের সাথে আর যোগাযোগ হয় নি ওই বেয়াদব মেয়েটার,নাহয় কী হতো! যদিও বাবা কিছুতেই রাজি হতেন না ওর সাথে বিয়ের জন্য। তবুও মেয়েটা পাগলামি করলে আমার রেপুটেশন এর কী হতো? একারণেই তো এখনও ওকে না চেনার ভান করে আছি। দেখিস না চিপকুর মতো কেমন পিছু পিছু ঘুরে।”
“বলিস কী ইনারার সাথে তোর বিয়ে…” কথাটা সম্পন্ন করার আগেই জোহান তার মুখে হাত দিয়ে চুপ করায়। আর বলে, “ভুলেও মা’কে জানতে দিবি না। ওই মেয়ের কথা মা জানলে আবার কাহিনী করবে, ইমোশনাল ড্রামা শুরু করবে।” বলে সে উঠে দাঁড়ায়। আবার আগের স্থানে যেয়ে একটা জ্যাকেট হাতে নেয়।

সামি বলে, “ওর মন কিন্তু অনেক ভালো। ঠিকাছে অনেকটা এলোমেলো ধরনের। তবে খাঁটি মনের মানুষ বুঝা যায়। মামীর যেহেতু পছন্দ একবার ট্রাই করে দেখ।”
“এত পছন্দ হলে তুই বিয়ে করে নে।”
“ওর সাথে আমার ব্রো জাতীয় সম্পর্ক। এসব বলিস না।”
“ওইতো। ওকে তোর মেয়ের মতো লাগে না আর আমি বিয়ে করবো? ইন্ডাস্ট্রির এত সুন্দরীদের ডেট করার পর। আমার স্টান্ডার্ড বুঝে কথা বল।”
“ইনারা কিন্তু সেদিন কনসার্টে গিয়েছিলো।”
“তাই? তাহলে হয়তো ওর বোনও এসেছিলো। সন্দেহটা বাস্তবতার দিকে এগোচ্ছে।”
“মেয়েটা যদি ইনারা হয়?”
“অসম্ভব। আমার নজর কেবল সৌন্দর্য বুঝে। এমন মেয়ে পৃথিবীর চোখে সুন্দর হতে পারে, আমার না।” জোহান তার জ্যাকেট পরে আবার বলল, “আচ্ছা আমি যাই।”
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“দীপার বাসায়। ও না’কি আমার জন্য আজরাতে বিশেষ কিছু করেছে।” জোহান চোখ টিপ মেরে বলে, ” ইউ নো হোয়াট আই মিন রাইট?”
সামি বিরক্তির সুরে বলে, “তুই এক মেয়েকে স্বপ্নচারিণী বলে অন্য মেয়ের সাথে রাত কাটাতে যাস? আর ইউ সিরিয়াস?”
“ব্রো যাকে পাই নি তার জন্য তো জীবনের সব এনজয়মেন্ট বিলীন করতে পারি না। আমি গেলাম।”
বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না জোহান। দৌড়ে যায়। সামি সেখানে বসেই তাকে উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে আমাকে আনলি কোন দুঃখে?”
.
.
সকালে রিহার্সাল, বিকেলে ফটোস্যুট এবং রাতে ইন্টারভিউ। এই সিডিউল পঞ্চসুরের। সারাদিন আজ ব্যস্ততায় ভরা। পঞ্চসুর থেকে বেশি ইনারার। সে এত কাজ আগে কখনো সামলায় নি। বিশেষ করে পাঁচজকে আলাদাভাবে সামলানোটা কঠিন। কেমন দ্বিধায় পড়ে গেল সে। কোনটা ছেড়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। সভ্য তা খেয়াল করে তাই একজন স্টাফবয়কে দিয়ে তার জন্য সিডিউল বানিয়ে পাঠায়। কিন্তু কে দিলো তা বলে না। এরপর দুপুরে খেয়েই সকলে ফটোশুটের জন্য রওনা দেয়। জোহান, সামি এক গাড়িতে আসে। ইরফান ঐশি অন্যগাড়িতে। সকল গাড়িতে তাদের সুরক্ষার জন্য একটি করে বডিগার্ড আছে। যেহেতু তারা আজ এতদিন পর জনগণের সামনে যাচ্ছে। সামনের দুই গাড়ি চলে যাওয়ায় ইনারা দ্বিধায় পরে যায়। সে কী এখন সভ্যের সাথে যাবে? অসম্ভব! গতপুরশু যেভাবে তাকে একা ফেলে রেখে গিয়েছিল তার পর তো কিছুতেই নয়।

সভ্য বলে, “তোমাকে কি নিমন্ত্রণ পাঠাতে হবে? উঠছো না কেন?”
ইনারা হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে ভেংচি কেটে বলে, “কেন সেদিন মতো মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিবেন বলে উঠবো?”
“এখন এখানে ঢং শুরু করবে না। উঠো।”
“আমি ঢং করি? আমি? আপনি আমাকে লাস্ট টাইম রাস্তায় নামিয়ে ঠ্যাংঠ্যাং করে চলে গেলেন। এদিকে আমার সাথে কি হয়েছে তার খেয়াল ছিলো আপনার? আমি উঠব না আপনার সাথে, যান।”

সভ্য আর কথা না বাড়িয়ে ইনারার হাত ধরে তাকে টেনে ভিতরে ঢুকায়। কিন্তু ইনারা তো আরও জেদি। সে আবার নেমে যেতে নেয়। সভ্য না পেরে তার হাত ধরে গাড়ির দরজা বন্ধ করতে নেয়। আর বলে, “এবার দেখি কোথায় যাও। ড্রাইভার, গাড়ি চালু করেন।”
“আপনি এত অসভ্য কেন? ছাড়ুন আমাকে, ছাড়ুন বলছি।”
ইনারা দ্রুত হাত পা নাড়াতে থাকে। এবার সভ্যের ভালোই রাগ উঠে। একতো সেদিন ভুল ছিলো ইনারার তাকে সরি বলে নি। আর এখন ফাজলামো করছে তার সাথে? সে ইনারার পাশে বসা ছিলো। হঠাৎ করে তার সামনের দিকে মুখ এনে তার ঠোঁটের উপর হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে বলে, “একদম চুপ। আর একটা শব্দ মুখ দিয়ে বের করলে খারাপ হবে। আর স্থির হয়ে বসো। একদম নড়াচড়া করবে না।”
প্রথমে তো ইনারা ঘাবড়ে যায় সভ্যের হঠাৎ এমন পরবর্তে। সভ্য কাছে আসায় অকারণে লজ্জাও পায়। চোখ নামিয়ে নেয়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে আগের রূপে চলে যায়। বলে, “দে..দেখেন ভালো হচ্ছে না কিন্তু। সরেন আপনি।”
ইনারা সভ্যের বুকে হাত রেখে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলতে নিলেই সভ্য তার কোমরে হাত রেখে টান দেয়। চমকে উঠে ইনারা। শিউরে ওঠে সে। এক মুহূর্তের জন্য যেন নিশ্বাস ফেলতে ভুলে যায়।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে