অধিকার পর্ব-১২

0
2911

#অধিকার
#দ্বাদশ_প্রহর
#লিখাঃ #Yasira_Abisha (#Fatha)

“আগে আমরা হানিমুনে এসেছি তারপর বিয়ে হয়েছে,, ব্যাপারটা কত রোমাঞ্চকর! ” কথাটা মনে মনে বলেই রুহি খিলখিল করে হেসে দিলো,,
ইরাদ ওর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছে।
রিকশায় পাশাপাশি বসে আছে ওরা,, তারপরেও মুখে কিছু না বলে আনমনে হাসা শুধু রুহির পক্ষেই সম্ভব,, মেয়েটার মনে কখন কি চলে ইরাদের মাথায় ঢুকে না। তবে ভালোই তো লাগে এসব।
“দিনে দিনে মেয়েটা আমাকে তার প্রতি দুর্বল করে তুলেছে,, এখন ওক মুহুর্ত ও ভালো লাগেনা ওকে না দেখলে। যেমন নতুন এক শহরে এসেছি সবাই রিকশায় উঠে ঘুরে আশেপাশের প্রকৃতি দেখার জন্য আর আমি আমার বউকে দেখছি ”

পড়ন্ত বিকেলে সোনালী রোদ ঝিলমিল করছে। রাস্তার পাশের ফুল গাছ গুলোতে রঙিন ফুল ফুটেছে,, রক্তলাল বর্ণ ধারণ করা জবা গুলো রোদের আলোতে চকচক করছে,, ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে চারিদিকে, সব মিলিয়ে এক মনোরম দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। সারাদিন বাইরেই কেটেছে আজকে রুহি আর ইরাদের। বেশ কিছু ছবিও ওরা তুলেছে,, অবশ্য রুহির ক্যান্ডিড ছবিই ইরাদ বেশি তুলেছে নিজে থেকে, তবে একসাথে ছবি তুলতেও মিস করেনি। ওদের জড়তাও কেটে গেছে অনেকটা,, মনের অনেক কথা আছে বলার কিন্তু দুই জনেরই অসম্ভব পরিমাণে ধৈর্য্য,, ঢাকা ফিরেই মনের না বলা কথা একে অপরের সাথে বলবে।

ইরাদের ম্যানেজার লোকটা খুবই ভালো ওকে যথেষ্ট সম্মান করে আর সাহায্য করে,, যেমন যেই কাগজটা সই করার জন্য ইরাদের ঢাকা যেতে হতো সেটা তিনদিন আগেই সে সাইন করিয়ে নিয়ে গেছে। নতুন বিয়ে করেছে বলে স্যারকে সময় দিতে চাচ্ছে ওর ম্যানেজার আসিফ। রুহি ইরাদের সুন্দর সুন্দর মুহুর্ত সংরক্ষণ করতে করতেই আরো পাচ দিন কেটে গেলো,, আজ রাতেই ওরা ঢাকা ফিরে যাবে। আরিশা পিয়াল ওরা আরো ২দিন আগেই বাড়ি ফিরে গেছে। রুহির সাথে আরিশার ভাব খুব হয়েছে প্রতিদিন ওদের কথা হয় টুকটাক। রুহি ভেবে নিয়েছে আরিশার সাথে মিলে একটা প্ল্যান বানিয়ে ইরাদকে প্রপোজ করবে। মনের কথা না বলে আর থাকতে পারছেনা রুহি। কিছু একটা তো ইরাদ বলবেই আর এই কয় দিনে ও লক্ষ্য করেছে ইরাদ ওর দিকে তাকিয়েই থাকে যখন ও কিছু নিয়ে ব্যাস্ত থাকে তখন ইরাদ ওকে দেখতে ব্যাস্ত থাকে,, একটা মেয়ে শত হলেও পুরুষের চোখের চাহনি বুঝতে পারে কে ওর দিকে কোনভাবে তাকায় তা কিছুটা হলেও আচ করতে পারে মেয়েরা। রুহির মনে একটা ধারণা এসেছে হয়তো ইরাদ ওকে একটু হলেও চায়।

প্রায় রাত ১০ঃ৩০ বেজে গেলো বাসায় ফিরতে ফিরতে ওদের,, বাসা একদ তকতকে ঝকঝকে,, আর হবেই না কেন? কাজের মহিলাকে রুহি বিকেলে ফোন করে বাড়ি পরিষ্কার করে রেখে যেতে বলেছিলো,, ইরাদ তখন ল্যাপটপে বসে বসে কাজ করছিল আর রুহির দিকে এক নজর দেখে অবাক ও হলো কারণ ওর প্রায় আচরণে একদম গিন্নি গিন্নি একটা ভাব চলে এসেছে। যেমন এই সময়েও ইরাদের প্রায় কাজ পরে গিয়েছিলো,, এমনিতে ইরাদের কাজের চাপ পরলে ও রাত জেগে করে কিন্তু বেশি রাত পর্যন্ত ইরাদের কাজ করা রুহির পছন্দ না তাই রাতে তাড়াতাড়ি ওরা বিকেলে ঘুরাঘুরি শেষ করে সন্ধ্যা থেকে ইরাদ ওর কাজে বসতো আর রুহি কানে হেডফোন গুজে চুপচাপ ফোন দেখতো। যে কোনো জায়গায়ই রুহি বাড়ির মত একটা পরিবেশ খুব সুন্দরভাবেই বানিয়ে নিতে পারে। মেয়েটার মধ্যে যে কাউকে খুব সহজে আপন করে নেওয়ার এক অসীম ক্ষমতা আছে।

রুহি নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলো আর ইরাদও ওর ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হলো। ইরাদ ভাবছিলো রুহিকে বেড রুমে এসে থাকতে বলবে কিন্তু রুহি মাইন্ড করবে কি না এই ভেবে আর বলা হয়নি।
এদিকে রুহির মনেও একই সংকোচ,, ইরাদ যদি ওকে নিজে না বলে তাহলে ও যাবে কেমন করে?
যদি কিছু মনে করে??

এসব ভাবতে ভাবতেই রুহি মোবাইলটা হাতে নিয়ে গ্যালারিতে গেলো,, ওর আর ইরাদের এই কয়দিনের বেশ কিছু সুন্দর ছবি আছে,, অনেক গুলো আরিশা আর পিয়াল তুলে দিয়েছে একদম কাপল পোজ দেওয়া,, একটা ছবি হামহাম জলপ্রপাতে তোলা ক্যান্ডিড,, রুহি পানির দিকে তাকিয়ে হাসছে আর ইরাদ ওর দিকে তাকিয়ে আছে,, ওই ছবিটা রুহির সব থেকে বেশি প্রিয়,, সেটাই ও মোবাইলের ওয়ালপেপার দিয়ে রাখলো,, আর ইরাদের সাথে অন্য একটা ছবি লকস্ক্রিনে দিয়ে রাখলো।
ব্যাটারি লো হয়ে গেছে, হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রুহি উঠে ফোনটা চার্জে বসিয়ে দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে,,

রাত প্রায় ১২ঃ৪৫ ইরাদ হয়তো আসবেনা। তাহলে আজ রাতটা বাসায় থাকাএ অন্যদিনের মত জেগেই কাটাতে হবে আর বিছানায় গেলে ঘুম আসবে না এভাবেও। এখন ইরাদকে ছাড়া বিছানাটা খালি খালি লাগে।
” ইরাদ কি ঘুমিয়ে পরেছে কি না একবার গিয়ে কি দেখে আসবো? নাকি যাবো না? হয়তো ঘুমিয়ে গেছে,, থাক সকালে যাবোনে”
রুহির মনটা খারাপ লাগছে,, শত হলেও তো ইরাদ ওর স্বামী এভাবে দূরে দূরে থাকতে ভালো লাগেনা।

-সরি একটু লেট হয়ে গেলো,, কিছু ফাইল ছিলো চেক করে আসলাম।
পেছন থেকে ইরাদের আওয়াজ পেয়ে রুহি চমকে উঠে।
-ঘুমান নি?
-না,,কাজ করছিলাম,, আসলে ঘড়ির দিকে দেখিনি,, আমার কারণে আপনার ঘুমাতে লেট হয়ে গেলো,,
– না ঠিক আছে।
রুহির মনটা ভালো হয়ে গেলো মুহুর্তের মধেই। ইরাদ তাহলে ওকে ভুলে যায় নি।ইরাদ পাশে আসায় যেন রুহির ঘুম এসে গেলো। ইরাদ ভেবে নিয়েছে রুহিকে ও নিজের সমস্যার কথা আজকে বলে দিবে সাথে এটাও বলে দিবে ও রুহিকে ভালোবাসে।
যদি রুহি চায় সংসার করতে তাহলে তো হলোই,, আর যদি না চায় তাহলে রুহির ভবিষ্যত ও নিজে সিকিউর করে সরে যাবে ওর থেকে। কারণ ওর বাবা না হতে পারা নিজেরই মেনে নিতে কষ্ট আর এটা রুহি মেনে নিবে এমন কোনো কথা তো নেই।

ইরাদ অফিসে চলে গেছে আজ সকাল সকাল রুহির ঘুম থেকে উঠার আগেই,,
রুহি উঠেই ফ্রেশ হয়ে ইরাদকে খুজলো কিন্তু পেলো না। বুঝতে পেরেছে যদিও ও অফিসে চলে গেছে।

ফোনটা হাতে নিয়ে আরিশা কল দিলো ও দুই বার রিং হওয়ার সাথে সাথেই আরিশা ফোন ধরলো,,
-আসসালামু আলাইকুম আপু
-ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাবী, কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ আপু, তুমি ভাইয়া ভালো?
– হুম আলহামদুলিল্লাহ।
– আপু আমি ভাবছি আজকে উনাকে বলে দিবো আমার মনের কথা,,
– হ্যাঁ বলে দাও ভাবী। অনেক দিন তো হলো, এভাবে আর কয়দিন চলবে?
-কিন্তু উনি যদি এটা পছন্দ না করে??
– পছন্দ করবেনা কেন ভাবী বলো তো?? তোমাদের বিয়ে কি নিজেদের অমতে হয়েছে?
রুহি সবটা খুলে বললো আরিশাকে।
-ভাবী তাহলে তোমাদের বিয়ে সেদিন রাতে হয়েছে?
-হুম। ওয়াও সো এক্সাইটিং। আমি তো জানতামই না। তোমরা আগে হানিমুনে আগে আসছো তারপর হানিমুনে গেসো।
বলেই আরিশা হেসে দিলো
রুহিও সাথে হাসলো।
-আপু আমার টেনশন লাগছে,, আর ভয় হচ্ছে।
-ভয় কেন পাচ্ছ? ইরাদ তোমাকে ভালোবাসে এটা একদম বুঝা যায়। তুমি সুন্দর একটা শাড়ি পরে ওকে সারপ্রাইজ দাও আজকে। এরপর ডিনারের পরে রাতের বেলা সুন্দর করে নিজের মনের কথা প্রকাশ করো।
-আচ্ছা।
-ঠিক আছে ভাবী বেস্ট অফ লাক।

ফোনটা রেখে রুহি ড্রেসিং টেবিলের সামনে আসতেই দেখে একটা চিরকুট পাশে রাখা।
“আজ সন্ধ্যা হবে আমার ফিরতে,, আপনার সাথে একটা জরুরি কথা আছে যা এসে বলবো,, ফ্রী থাকবেন”

রুহি চিরকুটটা পরে ভাবতে লাগলো কি বলতে পারে ইরাদ। সারাদিন যেন কাটতে চাইছেনা,, বুয়াও আজ শেষ করে তাড়াতাড়ি চলে গেছে।
দুপুরের সময় সুরাইয়া দাদু আসলো,, রুহি মাত্র গোসল করে নামাজ পরে উঠেছে।
এমন সময় গেইটে নক পরতেই দেখে দাদু এসেছেন,,
-আসসালামু আলাইকুম দাদু। ভিতরে আসুন
– ওয়ালাইকুম আসসালাম কেমন আছো দিদিভাই?
– আলহামদুলিল্লাহ আপনি?
– আমিও আলহামদুলিল্লাহ
অনেক কথাই হলো আজকে দাদুর সাথে রুহির। দাদু খুব ভালো মানুষ রুহিকে খুব আদর ও করে।
এক কথা দুই কথায় রুহি মাহিরার কথা তিনি তুললেন।
রুহিকে বললেন ইরাদ কতটা মাহিরাকে ভালোবাসতো আর ওর জন্য কত পাগলামি করেছে এই পর্যন্ত। কথা গুলো রুহির মনে অনেক আঘাত করলো। কারণ ইরাদ তো এখন ওর স্বামী,,
সুরাইয়া জানেনা ওদের বিয়ের কথা তাই হয়তো ওকে সব বলেছেন। রুহির মনে কালো মেঘ এসে যেম ভর করলো,, এত ভালোবাসার মাঝে কি কিছুদিনের আগত রুহির জায়গা ইরাদের মনে হবে?? ইরাদ কি ওকে মেনে নিবে?? সবটা চিন্তাই যেন ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।

প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে সুরাইয়া বিকেলেই চলে গেছে,, রুহি তারপরেও মনে সাহস জুগিয়ে একটা ক্রিম কালারের শাড়ি পরে হালকা গোলাপি লিপস্টিক দিলো ঠোঁটে। ফর্সা মানুষ এই কালারে ওকে বেশ দেখাচ্ছে আর সিল্কি লম্বা কালো চূল গুলো হাত খোপা করে নিলো। কিছু কিছু চুল মুখের সামনে পরে আছে,,
ছিপছিপে গড়নের মেয়েটাকে না সাজাতেও দেখতে বেশ লাগছে,, রুহি কয়েকবার নিজেকে আয়নায় দেখে নিলো,, হ্যাঁ এভাবেই ভালো দেখাচ্ছে,, ইরাদের বাড়ি ফেরার প্রতিক্ষা আর যেন রুহির সহ্য হচ্ছেনা।

প্রায় ঘন্টা খানিক পরে গেইটে কে যেন এসেছে রুহি তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দেখলো,,
একটা মেয়ে এসেছে,, বেশ স্মার্ট,, দেখতেও সুন্দর।
রুহিকে দেখে অবাক হয়ে তাকালো
রুহি নিজে থেকে প্রশ্ন করলো,,
– জ্বি আপনি কে??
ভ্রু কুচকে মেয়েটা উত্তর দিলো
– মাহিরা,, ইরাদ কোথায়??
রুহি তো মাহিরা নাজিমকে দেখেনি, ও ভেবে নিলো তাহলে উনিই এসেছে।
– ওহ আপনি,, আসুন ভেতরে,, উনি অফিসে।
মেয়েটা কিছু না বলেই ঘরে ঢুকে গেলো
কেমন যেন কর্কশতা আছে ওর মাঝে।
রুহি নিজ থেকেই বললো,,
-উনি বলেই নি আপু আপনি আজ আসবেন
-আমার হাসবেন্ড এর বাসায় আমার যখন ইচ্ছে আসবো সেটা কি কাউকে আমাদের বলা লাগবে নাকি? তুমি কে??

এমন সময় মাহিরার ফোন বেজে ওঠে। রুহির মাথায় তো আকাশ ভেংগে পরেছে একদম। এটা লয়্যার মাহিরা নাজিম না,, এটা ইরাদের প্রাক্তন স্ত্রী মাহিরা।
মেয়েটা ফোন রিসিভ করতে করতে হেটে সোজা ইরাদের বেড রুমে চলে গেলো।
রুহির বুক ফেটে কান্না আসছে,, ও কি এটা স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি??

ইরাদ কলিং বেলে চাপ দিতে যাবে তখনই দেখলোদরজা খোলা,, খানিকটা অবাক ও হলো এমন দেখে,,,
ভেতরে ঢুকে দেখে দরজা লাগিয়ে রুহির ঘরে গিয়ে দেখে
রুহি ওয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে,, কেমম যেন চেহারাটা শুকনা লাগছে।
ইরাদের বুক কেপে উঠে,, হাতের কয়েকটি শপিং ব্যাগ ছিল এগুলো। মাটিতে ফেলেই ও রুহিকে জিজ্ঞেস করলো
-কি হয়েছে আপনার?? শরীর খারাপ??
-মাহিরা এসেছে।
– কে?
-আপনার প্রাক্তন স্ত্রী,, সে আপনার বেড রুমে এখন।

কথাটা শুনে ইরাদ হতভম্ব হয়ে যায়। এবং সাথে সাথে ওর ঘরের দিকে পা বাড়ায়

(চলবে…)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে