Saturday, June 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 98



ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৭

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৭

ফারহান মনোযোগ দিয়ে মিতুলের প্রোফাইল দেখতে থাকে। তুলতুলের বিয়ের সময় থেকে এ পর্যন্ত পোস্ট করা ছবি, স্ট্যাটাস নানা অনুভূতির শেয়ার সব খেয়াল করে মনোযোগ দিয়ে। এর আগের বেশিরভাগ পোস্টই কলেজ লাইফ নিয়ে, সদথে নানা মিম শেয়ার। তুলতুলের বিয়ে পরবর্তী সময়ের পোস্টগুলো আলাদা। বেশকিছু সুন্দর সুন্দর ছবি আপলোড করা। সুন্দর ক্যাপশন দেওয়া ছবিগুলোতে। ছবিগুলো নিঃসন্দেহে আরমানের তোলা। একক ছবি আছে অনেক।।বন্ধুদের সাথে ফুচকা পার্টির ছবি আছে, লেকের ধারে এত চমৎকার কিছু এস্থেটিক ছবি তোলা। যা বোঝাই যাচ্ছে প্রফেশনাল কারও তোলা। ছবিগুলোতে আরমানের রিঅ্যাকশনও আছে। মিতুলের ইদানীংকার পোস্টগুলো কেমন বিষণ্ন। ফারহান হঠাৎ কেমন অস্থিরতায় ভোগে। এতদিন তার প্রতি মিতুলের অনাগ্রহ বা দূরত্বের কারণটা ফারহাকেই ভেবেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ফারহাই সত্যি কথা বলেছে। ফারহা এই ইঙ্গিত অনেক আগেই দিয়েছিল। বলেছিল মিতুলের পছন্দ ফারহান নয়। মিতুল শুধুমাত্র পারিবারিক চাপে এই বিয়েতে মত দিয়েছে। যদিও ফারহানের নার্সাসিস্ট মন তখন এই কথাটাকে গুরুত্বই দেয়নি। ধরেই নিয়েছিল ফারহা জেলাস হয়ে এইসব বলছে। এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল যো মিতুল ফারহানকে পছন্দ না করার প্রশ্নই আসে না। তাই তো মিতুলের ঠান্ডা আচরণ, নিষ্প্রভ মুখ সবকিছু তার নজর এড়িয়ে গিয়েছে। আজ আরমান সামনে না আসলে তা নজরে আসতোও না। ফারহানের পাশে মিতুল ছিল, আর আরমানের পাশে মীরা। অথচ পুরোটা সময় যেন মিতুল আর আরমানের চোখই কথা বলে গেল। আরমানকে ফারহানের ইচ্ছে করে করা অপমানগুলো মিতুলকে বিচলিত করছিল তা স্পষ্ট বুঝতে পারছিল। বোঝাই যাচ্ছে আরমান আর মীরার মাঝেও সেই টানের অনুপস্থিত যা বিয়ে ঠিক হওয়া জুটির মাঝে থাকা উচিত। এমন নয় তো মিতুলের সাথে ফারহানের বিয়ে হচ্ছে বলে, শুধু তাকে দেখাতেই আরমান আর মীরার বিয়ে? যেন মিতুল জেলাসের বশে হলেও এই শৃঙ্খল ভেঙে বের হয়?

ফারহানের রোখ চেপে যায়। না, এটা সে হতে দিবে না। নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে সে মিতুলকে বিয়ে করতে এগিয়েছে। শর্মিলা আহমেদ তো শুরু থেকেই এই বিয়েতে নিজের অমতে রাজি তা ফারহান জানে। মিতুলের সাথে তার বিয়েটা এখন আর আবেগে সীমাবদ্ধ নেই। এমনিতেই মিতুলের নিষ্প্রাণ আচরণ তাকে ক্ষুদ্ধ করে দিয়েছে। সবসময় সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ফারহানের জন্য এ অভিজ্ঞতা নতুন। মিতুলকে সময় দেওয়া যাবে না। ফারহা বা অন্য কারও কাছে নিজেকে ছোটো করা যাবে না। রোখ চেপে যায় ফারহানের। মিতুলকে ফোন দিতে গিয়েও দেয় না। নাহ,এখন কিছুই বলবে না। মিতুল এই ধারণা নিয়েই তার জীবনে প্রবেশ করুক যে ফারহান কিছুই জানে না, কিছুই বুঝেনি। কিন্তু ফারহানের বদলে অন্য কাউকে পছন্দ করার ক্ষোভও সে ভুলবে না। মিতুলের ইচ্ছে থাক না থাক বিয়ে হবেই। কাউকে হাসাহাসি করার সুযোগ সে দিবে না। বিয়ের পর সে মিতুলকে বোঝাবে অবহেলা, তাচ্ছিল্য আর অনাগ্রহ কাকে বলে। হেলা ফেলায় পড়ে থেকে হলেও তারই সংসার করতে হবে। এর থেকে মিতুলের মুক্তি নেই, যতদিন না ফারহান নিজে তাকে মুক্তি দিচ্ছে।

***

তুলতুল আর সায়েম বাড়ি ফিরে দেখে শেলী এসেছে। তুলতুল একটু ভয়ই পায় মনে মনে। মীরা অভিযোগ করেনি তো। যতই হোক, ফারহান তার বোনের হবু বর। তুলতুলের পক্ষের আত্মীয়। সামান্য বিষয়টাও তখন বড়ো হয়ে যাবে।

“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। আসসালামু আলাইকুম আপু।”

“ওয়ালাইকুম সালাম। এত দেরি যে তোমাদের? মীরা তো কখন বাসায় পৌঁছে গেল। তোমাদের সাথে নাকি দেখা হয়েছে যমুনায়। একসাথে খেলে তোমরা।”

“জি। ঐ মিতুলকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতে দেরি হলো।”

“সায়েম, কেমন দেখলি ছেলেকে?”

“ভালোই। দেখতে শুনতে ভালো। ভালো পজিশনে আছে। পারিবারিক অবস্থানও ভালো।”

“বাহ্ সব ভালো। যতই ভালো হোক, আমার ভাইয়ের চেয়ে ভালো পাওয়া সম্ভব না।”

যুবায়ের শেলীর দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকায়। সবকিছুতে অযথা খোঁচাখুঁচি ভালো লাগে না।

“আরে আমাকে এমন করে দেখছ কেন? দুষ্টুমি করলাম। আমার ভাই ভালো না? এই যে সারাদিন শ্বশুর বাড়ির ডিউটি করলো। শ্যালিকার জন্য খরচ করছে। কয়জন পাবে এমন?”

যুবায়ের কিছু বলার আগেই সায়েম বলে,

“আমার কোনো খরচ হয়নি আপু। খাবারের বিল ফারহানই দিয়েছে। আর করে না কে বললো। আমার দুলাভাই কম করে নাকি।”

শেলী কথা এড়াতে তুলতুলের দিকে মন দেয়।

“তুলতুল, বসো। হাতে শাড়ির ব্যাগ নাকি? কে দিলো?”

“ফ্রেশ হয়ে আসি আপু। একবারে ফ্রেশ হয়ে এসে বসছি।”

“শাড়ি কে দিয়েছে বললে না তো?”

“শাড়ি আপনার ভাই পছন্দ করে কিনে দিয়েছেন।”

“সায়েম? বাহ্ সায়েম শাড়িও কিনতে পারে? দেখেছ আম্মু আজ পর্যন্ত তোমার আমার জন্য কখনো কিনেছে?”

“তোমরা ওর পছন্দে শাড়ি কিনেছ কোনোদিন? বলো টাকা দিয়ে দিতে।”

“আচ্ছা তোমার সমস্যা কী? তুমি আমাকে খোঁচাচ্ছ কেন? তুলতুল দেখি সায়েমের শাড়ির পছন্দ কেমন?”

জলপাই রঙের শাড়িতে গোল্ডেন স্ট্রাইপ। খুব সিম্পল, কিন্তু খুবই অভিজাত।

“সত্যি এই শাড়ি সায়েম পছন্দ করেছে!মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ। এমনি এমনি বলি আমার ভাইয়ের কথা। দেখ জীবনে এত সুন্দর শাড়ি বৌয়ের জন্য এনেছ?”

যুবায়ের হাত উঠিয়ে নেয়। জান্নাত আরাও স্বীকার করেন আসলেই শাড়িটা দারুণ হয়েছে।

***

“ধন্যবাদ মীরা, আপনি বাসায় কিছু বলেননি।”

“আপনি না করায় যে বলিনি তা শুধু নয়। এমনিতেই বিষয়টা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে ছিল না। একজনের নীচু মানসিকতার উত্তর দিতে যদি আরেকজনের বাসায় সমস্যা সৃষ্টি করি। সেটা তো একই আচরণ হলো। তবে… ”

“তবে কী?”

“আমার মনে হলো আপনি তুলতুল ভাবি, মিতুলের জন্য অনেক বেশি কনসার্ন।”

আরমান চুপ করে থাকে।

“কী হলো চুপ করে আছেন যে? আচ্ছা বাদ দিন।বলুন আমরা কবে শপিং এ যাব? আঙটি কিনে ফেলি। এনগেজমেন্টের বাকি আর এক সপ্তাহ। নাকি আঙটি নিজেদের মতো কিনে ফেলতে বলবো আম্মাকে?”

“মীরা আমি আঙটি কিনে নেব।”

“আমি সাথে যাব না?”

“দেখি।”

“আরমান, আপনি কি চিন্তিত?”

“মীরা আমি পরে ফোন দিচ্ছি। রাখি হ্যাঁ।”

***

“কী বলেন আপনি? তিনদিন পরই আকদ মানে? এত তাড়াতাড়ি?”

“আরে আমরাই তো বলছি আলাদা করে এনগেজমেন্ট করার দরকার নাই। ছোটো করে অনুষ্ঠান হোক। এখন নাকি ফারহান বলতেছে তাহলে এনগেজমেন্ট না করে আকদ করে ফেলতে। আমাদের উপর চাপ পড়লো না। পরে ছেলে পক্ষের রিসেপশন বড়ো করে হবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম।”

“রাজি হয়ে গেলেন?”

“হ্যাঁ না করার কী আছে। এই বাসার ছাদেই আয়োজন করে ফেলব। ক্যাটারিং এর লোক ডেকে ছোটো স্টেজ করে ফেলব। শোনো জেসমিন আর শফিকরে দাওয়াত দিতে হবে। আপন চাচা চাচী বিয়েতে না থাকলে খারাপ দেখায়। আম্মাকে সাথে নিয়ে যাব ওদের বাসায়। মিতুলকেও বিষয়টা জানিয়ে দিও। তুলতুলের শাশুড়ির সাথে কথা বলে তুলতুলকে আনাও। এই কয়দিন এখানে থাকুক বোনের সাথে।”

“তুলতুলের বাড়িতেও তো আয়োজন।”

“আরে সেটা তো তুলতুলের ননাসের বাড়িতে। তুমি বেয়াইনের সাথে কথা বল।”

***

“মা ডেকেছিলেন?”

“হ্যাঁ বসো তুলতুল।”

জান্নাত আরা এসময় ডেকে নেওয়ার কারণ তুলতুল আন্দাজ করতে পারছে। সায়েমের শাড়ি কিনে দেওয়ার বিষয়টা হয়তো হজম হয়নি। এতদিনে এইটুকু বোঝার ক্ষমতা ওর হয়েছে।

“সায়েম তোমাকে শাড়ি কিনে দিয়েছে খুবই ভালো। আমি ঐ সব শাশুড়ির মতো না যে ছেলে, ছেলের বৌকে কিছু দিলো আর তাতে কলিজা কালো করব। আমার ছেলেও দিল খোলা হাত খোলা।”

তুলতুলের হাসি পায়। এতদিনে এই প্রথম সায়েম কিছু নিজ থেকে কিনে দিয়েছে। তবু মাথা নেড়ে সায় দেয়।

“কিন্তু তুলতুল। সায়েমের মনে না থাকলেও তোমার তো মনে রাখা উচিত ছিল এই ছেলেটা কোথা থেকে এসেছে। তার মা আছে, বোন আছে। আমি বুড়ো হয়ে গিয়েছি, আজ আছি কাল নাই। এতকিছুর চাহিদা রাখি না আর। মনেও রাখি না। ছেলের টাকা শুধু শুধু নষ্ট করতেও চাই না। কিন্তু শেলীও তো সায়েমের কিছু হয় তাই না? তারও তো হক আছে। আমি না হয় মা হক ছেড়ে দিলাম। বোনকে কিভাবে ছাড়তে বলি? কিছু যখন কিনবা, তখন স্বামীকে মনে করিয়ে দিতে হয় এসব। ঘরের সবার মনের কথা ঘরের বৌকে মনে রাখতে হয়।”

“মা, সবার মনের খবর রাখতে গেলে তো সায়েমেরই সমস্যা হয়ে যেত। আপনি না হয় নিবেন না। কিন্তু যুবায়ের ভাই, দাদী, বাবা, বাবু সবার জন্য তো কিছু না কিছু নিতে হতো। আমি তাই কিছু বলিনি। আমিও নিতে চাইনি। উনি বললেন মিতুলের বিয়েতে পরতে পারব। বিয়ের পর তো কেনাকাটা করা হয়নি।”

“বোনের বিয়েতে এত হালকা কেন পরবা? তোমার বিয়ে হলো কয়দিন। কাতান পরবা। তুমি নতুন বৌ, এখন জমকালো শাড়ি পরবা, সাজবা। এসব হালকা শাড়ি হলো তোমার চেয়ে যাদের বয়স সামান্য বেশি, তাদের জন্য। দেখ আমি এই শাড়ি বের করছি।”

জান্নাত আরা একটা লাল কাতান শাড়ি বের করে দেন।

“এটা পইরো। নতুন বৌ। তুমি বরং ঐ শাড়িটা নিজের হাতে শেলীকে দিয়ে দাও। তুমি দিচ্ছ বলে। দেখবা কত খুশি হবে।”

তুলতুল শাড়ি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। জান্নাত আরা সন্তুষ্টির হাসি হাসেন। তুলতুল এত সহজে মেনে নিবে ভাবেননি।

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৬

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৬

ওয়াশরুম থেকে বের হতে না হতেই আরমানের মুখোমুখি হয় মিতুল। মিতুলের চোখের কাজল লেপটে গিয়েছে। আলগোছে কান্নার জল মোছা হয়েছে বুঝতে পারছে আরমান।

“মিতুল কিছু হয়েছে? তুমি কাঁদছিলে?”

“কই না তো। আপনি এখানে কী করেন?”

“সায়েমের সাথে দেখা করতে এসেছি। মিতুল, তোমার সাথে কি ঐ লোক কোনো অসভ্যতা করেছে? করলে নির্দ্বিধায় বল।”

আরমানের চোয়াল শক্ত হতে দেখে অবাক হয় মিতুল। আরমান হঠাৎ রেগে যাচ্ছে বুঝতে পারছে। মিতুলের দেরি হচ্ছে কেন দেখতে তুলতুলও এগিয়ে আসে। তুলতুলকে আসতে দেখে মিতুল তাড়াতাড়ি বলে, “কিছু হয়নি। চোখে কী যেন পড়েছে। আমি বরং মুখ ধুয়ে আসি।”

“কী হলো আরমান ভাই? হাত ধোয়া হয়েছে? মিতুল কই? আবার ওয়াশরুমে গেল?”

“হ্যাঁ, চোখে কী নাকি পড়েছে। মুখ ধুতে গেল। আপনি নক দিয়ে একটু দেখুন।”

***

খাবারের টেবিলে সব স্বাভাবিকই হয়েও হলো না। মীরা বুঝতে পারছে না হঠাৎ আরমান এত থমথমে হয়ে আছে কেন। এখানে আরমানেরই মীরার খেয়াল রাখার কথা। অথচ মীরা যেন এখানে আরমানের পাশে থেকেও নেই। তুলতুল সবার সাথে মীরার পরিচয় করিয়ে দেয়। মীরা ও আরমান অবশ্য একসাথে খেতে চায়নি। কিন্তু ফারহান আর সায়েম কিছুতেই তাদের আলাদা বসতে দিবে না।

“তো আরমান ভাই, কী করছেন?”

“খাচ্ছি।”

ফারহান থতমত খায়।

“না মানে, জব না ব্যবসা। কোন প্রফেশনে আছেন?”

“ছবি তুলি।”

“ছবি তোলেন? আচ্ছা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের বিজনেস।”

“না ভাই। ছবিই তুলি। ওয়েডিং ফটোগ্রাফার না। তবে সায়েমের বিয়ের ছবি আমারই তোলা।”

“ওহ, তাই নাকি। বিয়ের ছবিগুলো আমি দেখেছি মিতুলের ফেসবুকে। দারুণ তুলেছেন। মিতুলের সিঙ্গেল ছবিগুলোও তাহলে আপনার তোলা। ইসস প্রফেশনালি নিতেই পারতেন। আয় খারাপ না। আমিও আপনাকেই বুক করতাম। আমার বাজেটও বড়ো। তবে আপনার হবু ওয়াইফ মানে মীরা আপু ভাগ্যবান। পার্সোনাল ফটোগ্রাফার পেয়ে যাচ্ছেন। আপু করেই বললাম। মাইন্ড করেননি তো। সময়বয়ী বা বয়সে আমার বড়ো হবেন মনে হলো।”

সায়েম আর তুলতুল বিব্রত বোধ করে। যদিও ফারহান হেসে হেসেই কথা বলছে। তবু কথাগুলো অপমানজনকই লাগছে। মীরা অস্বস্তিতে ভুগছে বোঝাই যাচ্ছে।

“আরমান। আম্মু ফোন দিচ্ছেন। সন্ধ্যা হচ্ছে তো। বাসায় যাব। কেনাকাটা আরেকদিন করব। বাসায় কী জানি ইমার্জেন্সি আছে।”

তুলতুলের দিকে তাকায় সায়েম। তুলতুল বিষয়টা বুঝতে পেরে বলে।

“আরে এখনই তো গয়নার দোকানে যাচ্ছি আমরা। আঙটি পছন্দ করে যান আপু। চলেন যাই।”

“না তুলতুল ভাবি। আমার আলাদা পছন্দ এমনিও নাই। আরমানের কাছে মাপ দেওয়া আছে। ও পছন্দ করে তার বাজেটে যা নিবে তাই চলবে।”

“বাহ আপু, আরমান ভাই তো ভাগ্যবান। এত বুঝদার স্ত্রী পাচ্ছেন। আপনিও ভাগ্যবান।”

“আমি কেন ভাগ্যবান? এই বয়সে বর পাচ্ছি বলে? আপনি আমার বয়স যত ভাবছেন তত না ভাইয়া। আমি আপনার চেয়ে ছোটো না হলেও সমবয়সীই হব। কিন্তু এখনো মেয়েদের সবাই কুড়িতে বুড়িই ধরে নেয়।”

“আরে না না। আপনি কী বলেন এসব।”

“দুষ্টুমি করলাম। দুষ্টুমি কী আপনি একাই করতে পারেন নাকি।”

মীরা বের হতে উদ্যোত হলে আরমানও উঠে যায়।

“ঠিক আছে। আপনারা কেনাকাটা করেন। আমি মীরাকে নামিয়ে দিয়ে আসি।”

মীরার মন খারাপটা কিছুটা হলেও ভালো হয়ে যায়। আরমান তার সাথে উঠে না আসলে মীরার খুব অপমানবোধ হতো।

***

“তুলতুল কেমন লাগছে ছেলে? সায়েম বাবা কী বলে?”

“আমি বললে বিশ্বাস করবেন না। সায়েম বাবার কথা বিশ্বাস করলে বলি, ছেলে কিঞ্চিৎ অভদ্র। আর আপনাদের যা ধারণা, মিতুলকে খুবই পছন্দ করে বিয়ে করতে চাইছে। মাথায় করে রাখবে। তাও মনে হলো না। তিনি তো নিজের প্রেমেই মগ্ন। বাপরে নিজে নিজে এত বিশেষ ভাবতে কাউকে দেখিনি। নিজেকে বড়ো দেখাতে সামনের মানুষটাকেও অপমান করে ফেলে। আমার ননাসের ননদের সাথে দেখা হয়েছে সেখানে। সায়েমের কাজিনের সাথেই বিয়ে ঠিক হয়েছে। ওনাদের কেমন ছোটো করলেন খাওয়ার টেবিলে। তাছাড়া আমার মনে হলো মিতুলও এই বিয়েতে খুশি না। মিতুলকে আমি একটুও হাসতে দেখিনি। বরং মনে হলো ওয়াশরুমে গিয়ে কান্নাকাটি করেছে। আমি ভাবতাম আমার কপালেই ঠোকর খাওয়া লেখা আছে। এখন মনে হচ্ছে মিতুলের কপালও খুব একটা সুবিধার হবে না।”

ফরিদা বেগমের খুবই বিরক্ত লাগে। মেয়েগুলো এমন হয়েছে কোথা থেকে।

“খারাপ কী দেখলি? মিতুলকে কত সুন্দর শাড়ি কিনে দিলো। খাবারের বিলও নাকি সে দিয়েছে।”

“কী রঙের শাড়ি? মিতুলকে জিজ্ঞেসও করেনি তার পছন্দের রঙ কি। নিজের পছন্দে কিনে হাতে ধরিয়ে দিলো।”

“এটাও দোষ? মন বড়ো না হলে বিয়ে হওয়ার আগেই কেউ এভাবে কেনাকাটা করে দেয়? তোর জামাই দিয়েছিল। মন থাকতে হয়।”

“আচ্ছা। তাহলে এখন আপনাদের সাধের বড়ো জামাইয়ের মন ছোটো হয়ে গেল। এই সেই, যার সাথে রাগ দেখিয়েছি বলে বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি দুটোই আমার জন্য…। ”

“তোর জন্য কী? তোর সমস্যা নিজের কারণে হয়েছে। এই চটাং চটাং কথা। এগুলো বাবার বাড়িতে মানে, শ্বশুর বাড়িতে না। আড কথা ঘুরাস না। কাল পর্যন্ত সায়েমের এই ঐ কত দোষ ছিল।।আজ আমি একটু বলতেই তুইও কি ফোঁস করিস নাই? এটাই স্বামী স্ত্রীর টান। আর বুঝলাম না তোদেরও কী দরকার ছিল তোর শ্বশুর বাড়ির মানুষদের একসাথে নিয়ে বসার। সায়েম যে হিসাবি এটা তুইও জানিস। আরমান তো মনে হয় না কিছু করে। এতজনের বিল ঐ ছেলে হাসিমুখে দিলো। তাও খারাপ বলার মানেই হলো হিংসা।”

“কে হিংসা করে আম্মু? আমি মিতুলকে? না সায়েম ফারহানকে? বোনের বড়োলোক ঘরে বিয়ে হলে আমি হিংসা করব? না করি না। বোনের ভাগ্য যদি আমার চেয়ে ভালো হতে দেখতাম। তাহলে হয়তো মনের ভেতর একটা দীর্ঘশ্বাস জাগলেও জাগতে পারতো। কিন্তু হিংসা না।”

***

“মিতুল, যাচ্ছি রে।”

“আজ থেকে যাও না আপু। বিয়ের পর তুমি একদিনও থাকলে না।”

“আজ সারাদিন বাইরে ছিলাম। তাও আবার সায়েম কে নিয়ে। জানি না বাসায় সবাই কেমন গাল ফুলিয়ে আছে। এর মাঝে যদি মীরা আপু বাসায় গিয়ে কোনো কথা লাগায় তাহলে তার ঝাঁঝও আমাকেই নিতে হবে।”

“তুমি তো তাহলে ঝামেলায়ই পড়ে গেলে।”

“আরে ঝামেলার কিছু নাই। এসব স্বাভাবিক। মিতুল, শোন আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে। আমাকে বলতো ফারহান কি তোর সাথে অসভ্যতা করেছে? করলে বল আমি সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব বিয়ে ভাঙতে। দেখি কে বিয়ে করায়।”

“না তো আপু। সত্যি এমন কিছু করলে আমিই থাপ্পড় মেরে দিতাম। হাত উঠে যেত আমারই। এমনিতেই ওনাকে আমার ভালো লাগে না। আচ্ছা, তুমি এটা কেন জিজ্ঞাসা করছ?”

“জানি না আরমান ভাই আমাকে ম্যাসেজ দিলেন। ওনার মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই। আমারও মনে হয়েছে তুই খুব চুপচুপ ছিলি।”

“আরমান ভাই বেশি বুঝে। এমন কিছু না। আমাকে না দেখে ওনার হবু বৌকে দেখুক। আর ওনার হবু বউটাকে দেখেছ। তিনিও তো আমাদের সাথে ফ্রি হতে পারছিলেন না। শুধু অন্য লোকের দোষ ধরে লাভ আছে?”

“বাব্বাহ, তুই দেখি ফারহান সাহেবের সাইড নিচ্ছিস। শোন, মীরা আপু অস্বস্তি বোধ করা স্বাভাবিক। তিনি আমাদের কাউকে ভালো করে চেনেন না। হবু বরকে নিয়ে আমাদের সাথে বসে আছেন স্বস্তি বোধ না করতেই পারেন। কিন্তু আপনার হবু বর সত্যি বলতে ভদ্র ভাষায় সামনের মানুষটাকে ছোটো ফিল করান। আমরা কি ওনাকে বলেছি বিল দিতে? নিজে জোর করে বিল দিলেন, সেটা আবার জানিয়েও দিলেন।”

“লোকটা শো অফ করতে পছন্দ করে আপা।”

“আচ্ছা মিতুল, তোর কি অন্য কাউকে পছন্দ?”

“নাহ। আর পছন্দ হলেও কী। আমার পছন্দের মানুষও যদি আমাকে পছন্দ করতো তাহলে তো এই নার্সাসিস্টকে বিয়ে করতাম না। বিয়ে যেহেতু এখানে করছি তখন অন্য সব প্রশ্ন অবান্তর।”

“তুই যাকে পছন্দ করেছি তাকে কি শুধুই পছন্দ করেছিস না ভালবেসেছি?”

“জানিনা আপু। মোহও হতে পারে।”

“তা সেই লোকটা কি জানে তুই তার মোহে মোহাবিষ্ট?”

“সেটাও জানি না। তাছাড়া ওনার সাথে আমার কোনো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।”

“কেন নেই? বিবাহিত?”

” বলা যায়।”

” বলা যায় মানে? একটা উত্তর হবে। হয় বিবাহিত না হলে অবিবাহিত। বলা যায় মানে কী? মিতুল আমাদের এ জীবনটা কত অনিশ্চিত জানিস না? এখানে বলা যায়, ভাবা যায়, হতে পারে নাও পারে এসব সম্ভাবনা অসম্ভাবনার জায়গাযই থাকা উচিত না। তাকে ভালবাসলে মুখ ফুটে বলে দে। উনি করে বলছিস। তোর চেয়ে অনেক বড়ো? কলেজের স্যার?”

“আরে নাহ। একটু বড়ো। তবে স্যার না।”

“শোন, বড়জোর কী করবে? না করে দিবে তোকে। তাও ভালো। তুই তো তুই জেনে মরবি যে যাকে তুই ভালোবেসেছিস সে তোকে ভালোবাসিনি। কিন্তু যাকে তুই ভালোবেসেছিস সে হয়তো তোকে ভালোবেসেছিল অথবা হয়তো বাসেনি। এমন হয়তোর ভাবনা তোকে সারা জীবন খুঁচিয়ে যাবে। ভালবাসলে বলতে হয়। কে আগে বললো কে পড়ে এসব হিসাব করলে চলবে না। এই ফারহান নামক নার্সাসিস্ট কে জীবনে আসতে দেওয়ার আগে একবার যার জন্য ভালোবাসা মনে এসেছে তাকে বলেই দেখ।”

“পারবো না আপু। এ এখন আর হয় না।”

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৫

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৫

“শর্মিলা, তুমি যা ভেবেছিলে তা তো হয়নি। বিষয়টা এখন এনগেজমেন্টে চলে এসেছে। রফিক সাহেবের ফ্যামিলি তো মনে হচ্ছে এনগেজমেন্ট না সরাসরি আকদ করিয়ে ফেলতে আগ্রহী।”

“মানে?”

“আমাকে ফোন দিয়েছিলেন রফিক সাহেব। বললেন এনগেজমেন্ট আলাদা করে না করে সেই দিনটাতেই ছোটোখাটো অনুষ্ঠান করতে চান। মানে মৌলানা ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার কথা বললেন।”

“কেমন ছোটোলোক। আমি ভেবেছিলাম বিষয়টা আর আগাবেই না। ওনারাই না করে দিলে ফারহানকে বোঝানো সহজ ছিল।”

“ওনাদের দোষ কোন দিচ্ছ? এই বিয়ের জন্য তোমার ছেলের আগ্রহটাই মূল কারণ। আর বরাবরের মতো তুমি ছেলেকে সরাসরি না করতে পারবে না অথচ তুমি ছেলের ইচ্ছা মানতেও পারছ না। শর্মিলা, হয় তুমি ছেলে কে স্পষ্ট করে এখান থেকে ফিরে আসতে বলো। কারণ বুঝিয়ে বলো কেন তোমার এই সম্পর্ক পছন্দ না। আর না হয় স্বাভাবিকভাবে মেনে নাও। নতুন পরিবার শুরু হওয়ার আগেই পারিবারিক দ্বন্দ্ব ভালো লাগছে না।”

“আমি ওনাদের আকারে ইঙ্গিতে স্পষ্ট বুঝিয়েছি যে আমার ছেলের পছন্দে এই বিয়েতে আগানো।।আমার কোনো আগ্রহ নেই। ওনাদের এতটুকু আত্মসম্মান থাকবে না? পরিবারেরই এক মেয়েকে রেখে আরেক মেয়েকে কী সুন্দর তুলে দিতে রাজি। আশ্চর্য।”

“এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নাই। মানুষ যেখানে নিজের আপন মেয়ের ক্ষেত্রেও মেনে নেয়, সেখানে এ তো কাজিন। কত ঘটনা আছে এমন, বড়ো মেয়েকে দেখতো গিয়ে ছোটো মেয়েকে পছন্দ করে। বাবা মা নির্লজ্জের মতো সেই ফালতু প্রস্তাবেও রাজি হয়ে যায়। পাত্র হাতছাড়া করতে চায় না। আর এখানে তো কাজিন।মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় আত্মসম্মানের এক অদ্ভুত পারদ আছে। ছেলেমেয়ে নিজের পছন্দে যোগ্য সঙ্গী বিয়ে করলেও তাদের ইজ্জত চলে যায়। অথচ নিজের পছন্দে মেয়েকে চরম অযোগ্য লোকের হাতে তুলে দিলেও বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয় না। সব মেয়ের ভাগ্য বলে চালিয়ে দেয়।”

***

তুলতুল আর সায়েম শপিং মলের সাইডে একটু কেনাকাটা আছে বলে মিতুল আর ফারহানকে একা কিছুক্ষণ রেস্টুরেন্টে বসার সুযোগ করে দেয়। অর্ডার করার আগে আগে চলে আসবে তারা। বিশ মিনিট দুজন একটু আলাদা কথা বলুক। ইচ্ছেটা ফারহানেরই। তুলতুল আর সায়েমও মানা করে না।

“মিতুল, তোমার সমস্যা কি?”

“জি?”

“আমি আসার পর থেকে দেখছি, তুমি কেমন অন্যমনস্ক। দেখ মিতুল, আমি তোমার অস্বস্তি বুঝতে পারছি। তবে তুমি তোমার কাজিনের বিষয়টা নিয়ে ওভারথিংক করছ। এটা খুবই সিম্পল সহজ ঘটনা। তোমার কাজিনের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। পারিবারিক ভাবে দেখেছি। জানার বোঝার জন্য ফেসবুকে এড হয়েছি। চ্যাট করেছি। এবং ফিল করেছি ও আমার টাইপ না। ব্যস। এখানে তোমার কাজিন যেমন প্রিটেন্ড করছে যেন আমি ওকে কথা দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করছি। বিষয়টা একদমই তা নয়।”

“আমি তো এসব বিষয়ে আপনাকে কিছু বলিইনি। ফারহা আপুর সাথে আমার কথাই হয় না এখন বলতে গেলে। আপুও আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন আপু এমনটা ভাবে বা বলে যে একজনকে কথা দিয়ে অন্যজনকে বিয়ে করছেন? আপনাদের এখনো কথা হয়?”

“কথা হয় বলতে কী বোঝাচ্ছ? দেখ আমি আগেও বলেছি, আমি মেয়েদের এমন এটেনশন পেয়ে অভ্যস্ত। আমার একটা আলাদা চার্ম আছে। মেয়েরা আমার প্রতি এট্রাক্ট হয়, এতে আমার কোনো হাত নেই।”

মিতুলের বিরক্ত লাগে। এই লোকটা এত আত্মকেন্দ্রিক। আমি, আমি রোগে আক্রান্ত।

“আপনি কী প্রশ্নের কী জবাব দিচ্ছেন? আচ্ছা আমার সাথে তো আজ আপনার প্রথম এভাবে দেখা করা। পারিবারিক ভাবে দেখাও হয়নি। ছাদে না কোথায় যেন আমাকে দেখে আপনার পছন্দ হয়েছে। তারপর সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো। দুটো বিষয় কেমন আলাদা হয়ে গেল না? ফারহা আপুকে দেখে, কথা বলে আপনার মনে হলো আপু আপনার টাইপ না। অথচ আমাকে না জেনেই মনে হলো আমি টাইপ! এইজন্য মনে একটু প্রশ্ন আসলো। আর কিছু না। আপনার জানার আগ্রহ হয় না আমাকে?”

“তুমি কিন্তু নিজেকে একটু বেশিই প্রায়োরিটি দিচ্ছ। লেট মি ক্লিয়ার ইউ, আমার অনেক মেয়ে বন্ধু ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। আমি যে ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে বিলং করি সেখানে ছেলে মেয়ের বন্ধুত্ব থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করার সময় আমার কিছু আলাদা ক্রাইটেরিয়া আছে। আমি ওভার স্মার্ট মেয়ে সঙ্গী হিসেবে চাই না। তাদের সাথে আমি অলরেডি মিশেছি। আমি জানি তাদের সাথে পরবর্তী জীবন কেমন হতে পারে। হানি শুধু এই জন্য তুমি আমার টাইপ হয়েছ। তোমাকে পছন্দ করার কারণ যদি তুমি ভাবো যে তুমি খুব সুন্দর, খুবই আকর্ষণীয় কেউ। আমি তোমার প্রতি লাড্ডু হয়ে গিয়েছি তাহলে তুমি ভুল। আমার কাছে তোমাকে সিম্পলি একটা ওয়াইফ মেটেরিয়াল মনে হয়েছে। এর বেশি কিছু না। তুমি যদি এর বেশি বুঝতে চাও বা নিজেকে এর বেশি মনে কর, তাহলে তোমার কাজিনের মত তোমাকেও ছাড়তে আমার সময় লাগবে না। ফারহানকে রাগিও না। ফারহান তার বাবা-মার রাগের ধার ধরে না। তোমার নখরা যথেষ্ট দেখেছি। আর না। শুধু এটা বোঝানোর জন্যই আজ আলাদা করে ডাকা। তোমার বাবা মা আমার পরিবার থেকে প্রস্তাব পেয়ে বর্তে গিয়েছেন। তোমার কাজিন এখনো আমি ডাক দিলে হাজির হয়ে যাবে। এরপরও তুমি নিজের এটিটিউট ঠিক না করলে পস্তাতে তোমাকে হবে। আমার সাথে রাগ দেখাতে আসবে না।”

***

“নবরূপায় ঢুকি চল। এলোমেলো হেঁটে কী হবে।।কী কিনবা?”

“আমার কোনো কেনাকাটা নেই। কেনার প্ল্যান করে তো আসিনি।”

“সবসময় প্ল্যান করার কিছু নেই। বিয়ের পর তো তোমাকে শপিং এ আনা হয়নি। আজ কিনে দেই চল। মনে মনে তো আমাকে কিপটা উপাধি দিয়ে বসে আছ নির্ঘাত। নিজেও তো পছন্দ করে কেনাকাটা করতে পারো।

“কিছু লাগলে চেয়ে নিতে বলেছিলেন। চেয়ে চেয়ে জরুরি জিনিস নেওয়া যায়। শপিং তো করা যায় না। নিজে পছন্দ করে যে কিনব, আমার হাতে তো টাকা থাকে না। ভার্সিটিতে যাওয়ার হিসাবের ভাড়ার বাইরে আমার ব্যাগ ফাঁকা।”

“তুলতুল, অনেককিছুই আমি বুঝি না। আমার আসলে মা আর বড়ো বোনের বাইরে বন্ধু ধরনের কোনো মেয়েদের সাথে সম্পর্ক ছিল না। বড়ো বোনও মা সম। ছোটো বোন হলে হয়তো মেয়েদের আচরণটা ভালো বুঝতাম। তারপরও আমি স্বীকার করি, আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেইনি। আমার মা, বোন, স্ত্রী সবার জায়গাটা আলাদা রাখা দরকার ছিল। কিন্তু তুমিও যদি অভিমান পেলেপুষে রাখ। সম্পর্ক সহজ হবে না। চেয়েই নাও। আমি তো দিতে না করিনি।”

***

“সায়েম কোথায় আছ ভাই? আমি আর মিরা যমুনাতে ঢুকলাম। তোমরা আছ না চলে গিয়েছ?”

“না আছি। নিচেই আছি। ইনফিনিটি সামনে। আসবা?”

“হ্যাঁ দাঁড়াও আসতেছি। মীরা, আমার কাজিন সায়েম আর ওর ওয়াইফ তুলতুল ভাবিও আছে এখানে। আপনি তো চেনেন ওনাদের।”

“হ্যাঁ। সায়েম ভাই তো আমার ভাইয়ার শ্যালক। না চেনার কী আছে।”

“চলেন যাই তাহলে। ওদের সাথে দেখা করি।”

মীরার যদিও ইচ্ছে ছিল আজকের দিনটা আরমানের সাথে একদম একা কাটানোর। তাই কাউকে সাথেও আনেনি। মনে হয়েছিল একা কিছুক্ষণ সময় কাটানো দরকার। তাহলে আরমানকে বুঝতে তার জন্য সহজ হতো। কেন জানি মিরার মনে হচ্ছে আরমানের সাথে কোথায় জানি একটা গ্যাপ রয়ে যাচ্ছে। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে প্রেমের বিয়ের মত অতি আবেগ থাকবে না স্বাভাবিক। কিন্তু এতটা নীরাবেগও কি স্বাভাবিক? তাই যখন আরমান এখানে আসার প্রস্তাব করে মীরার ভীষণ ভালো লেগেছিল। মনে হয়েছিল সে আসলে একটু বেশিই ভাবছে। আরমানও হয়তো তাদের বিষয়টা সহজ করতে চায়। তাই একা দেখা করতে চেয়েছে। এখানে এসে আবার কাজিন, তাদের ওয়াইফকে নিয়ে ব্যস্ত হলে নিজেদের সময় কাটানো হবে কী করে!

***

আরমান আর মিরাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের অংশে চলে আসে সায়েম এবং তুলতুল। মিতুল ওয়াশরুমে গিয়েছিল। ফারহানের কথাগুলো খুব গায়ে লেগেছে। ফারহান অবশ্য কড়া কথাগুলোর পরই আই লাভ ইউ বলেছে। অথচ লাইনটা শুনে মিতুলের গায়ে শিহরণের বদলে কানে সিসা ঢেলেছে। এখন তবে এমন ভাবেই ভালোবাসা পেতে হয়? কারও মনের মতো হয়ে মন পেতে হয়? মিতুল ফারহানকে কিভাবে বলবে, মিতুল জেদী, রাগী মেয়ে নয়। অভিমানী। অভিমানী মেয়েরা রাগী হয় না। ঝগড়ার সময়ও তাদের রাগী কণ্ঠের আগে চোখে পানি চলে আসে। মনে নিদারুণ কষ্ট, চোখের কোণে জল, আর কান্নায় লাল হয়ে যাওয়া নাক নিয়ে তারা অপেক্ষায় থাকে কখন মনে কষ্ট দেওয়া মানুষটা বুকে টেনে নেবে।

কিন্তু এই অভিমানী মেয়েগুলোই সবচেয়ে বেশি দৃঢ় হয়। মান অভিমানের পালা শেষে যদি তারা ভালোবাসা না পায়। তবে তাদের নরম কাঁদা মাটির মনটা পাথরের মতো শক্ত হতেও সময় লাগে না। এদের ভালোবাসা পেতে হলে ভালোবাসতে জানতে হয়। জোর খাটিয়ে আদায় করা যায় না।

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৪

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৪

“মিতুল, কী হইছে তোর?”

“কী আম্মু?”

“তোর চেহারার এমন হাল কেন? এমনি তো সবসময় সাজগোজের মাতামাতির শেষ নাই। রান্নাঘরে যা পাবি নিয়ে মুখে মাখবি। এই জন্য মানা করি সব মুখে দিতে না। ব্রণ উঠছে কয়টা দেখছিস? নাকের ডগায় ব্রণ বসে আছে। সারারাত মোবাইল টিপিস। চোখের নিচে কালি পড়ছে কেমন। চুল আঁচড়াস না কয়দিন?”

“পরীক্ষার চাপ আম্মু। রাত জেগে পড়ছি।”

“কী পরীক্ষা?” জীবনে কোনোদিন এমনে পড়ালেখা করতে দেখি নাই। এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষার মত পরীক্ষার আগে তোকে কখনো এরকম রাত জেগে পড়তে দেখছি মনে পড়ে না। কত চিল্লাইসি পড়ার জন্য। এখন অনার্সে কী এমন লেখাপড়া করতেছিস? সত্যি করে বল মিতুল তোর কোনো কাহিনী আছে? মতিগতি আমার ভালো ঠেকতেছে না ক্যান?”

“আমার আবার কিসের মতিগতি? আর এখন পড়ালেখা করলে খারাপ? এইচএসসির সময় পর্যন্ত পড়ার জন্য মার খেলাম। সেই পড়ালেখার চেয়ে এখন চেহারা দামী? তাহলে তখন ভালো রেজাল্টের জন্য মারতে কেন?”

“পড়ালেখা করা খারাপ এই কথা তো বলি নাই। তোর চালচলনের কথা বলছি। কী বুঝাইছি তুই বুঝতে পারিস নাই এই কথা বলিস না। তোরা দুই বোন অ বললে অজগর বুঝিস। মিতুল সত্যি করে বল কলেজে কারো সাথে কোনো সম্পর্ক হয়েছে তোর? বিয়ের কথা শুরু হওয়ার পর থেকে এমন মরা চেহারা করে আছস। অথচ তোর এসব নিয়ে বেশি লাফালাফি করার কথা ছিল।”

“তাহলে এখন আমি আমার নিজের বিয়ে নিয়ে লাফালাফি করব? তখন তোমরাই বলবা আমি বেশরম।”

“শোন মিতুল, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দেই তুই আর এটা ভাবিস না যে তুলতুলের বাহানায় তুই আমাদের চাপ দিবি। তোর ইচ্ছামত কাজ হবে। শোন, বাবা-মা কখনো খারাপ চায় না। তুলতুলের খারাপ কিছু হইছে? শুরুতে যা একটু সমস্যা হইছে সেটা তুলতুল নিজের ঘ্যাড় তেড়ামির কারণেই হইছে। এখন কী সুন্দর সংসার করতেছে। বাবা-মার কথা শুনলে কেউ খারাপ থাকে না।”

“আপু তাহলে ভালো আছে? যদি ভালো থাকার মানে এটা হয় যে বাবার বাড়ির পথে ভুলে যাওয়া, কথা বলতে ভুলে যাওয়া। তাহলে আপু ভালই আছে। আর আমিও তাহলে ভালোই থাকব। আপনাদের কাছে যদি ভালো থাকা এটাই হয় আমারও কোন সমস্যা নাই। আমরা অ তে অজগর বুঝি আর যাই বুঝি, আপনারা তো বোঝেন আমাকে নিয়ে সন্দেহ করার কিছু নাই আম্মু।”

“না থাকলেই ভালো। শোন আমি না, রাতুল তোর সাথে যাবে।”

“রাতুল তো ছোটো মানুষ।”

“সেটাই তো। কিন্তু ফারহান বাবা মনে হয় মুরুব্বী কেউ যাক চায় না।”

“এই কথা কি উনারাই জানিয়েছেন?”

“ফারহানের মা বললেন। ফারহান এখন একটু একা কথা বলতে চায়। আমিও বললাম একদম একা তো পাঠাতে পারব না। রাতুলকে দেই।”

“রাতুল না আম্মু। আমি গেলে আপুকে সাথে করে নিয়ে যাব।”

“এটা ভালো বলছিস।তাহলে তুই তুলতুলের সাথে কথা বলে দেখ। আমিও তাহলে মনে হয় শান্তি পাই। একদম একা পাঠাতে চাই না। আমার তো এসব ঢং ই ভালো লাগে না। বিয়েশাদিতে মুরুব্বিরা যা ঠিক করবে তাই তো শেষ কথা। ফারহানের মাও কেমন গা বাঁচিয়ে চলে।”

“এসব ঢং মনে হলে বাদ দেওয়া যায় নাআম্মু? এমনিতেও তো এই প্রস্তাব নিয়ে দেখ কত অশান্তি। চাচা চাচী তো আমাদের ঘর আসাই বন্ধ করে দিয়েছেন একরকম। ফারহা আপু আমার সাথে আগের মতো কথা বলে না।”

“না বললে নাই। জেসমিন সারা জীবন বহুত নাটক দেখাইছে। আমি চুপচাপ দেখছি না। এখন সেও একটু দেখুক। একটু ভালো চাকরি, পড়ালেখা করে যে ভাব নিতো। আমি অল্প শিক্ষিত, গৃহিণী। আমি দিন দুনিয়ার কিছু জানি না। এমন ভাব যেন তার মেয়ে কোনো রাজকন্যা। দেখুক এখন, আমার মেয়েরাও কম না।সেদিন কত কথা শুনালো আমাকে। হইছে কে কী ভাবতেছে এসব তোর লাগবে না। তুই তুলতুলকে ফোন দে। মাথায় একটু তেল দিয়ে শ্যাম্পু টেম্পু কর। চুল তো চুল, চেহারা কেমন দেখা যাইতেছে তোর।”

চাচী আর মায়ের মাঝে এই দূরত্ব মিতুলকে যতটা না অবাক হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি অবাক হচ্ছে নিজের নরম সরম মায়ের এই রূপ দেখে। ফরিদা বেগম যে মনে মনে জেসমিনের প্রতি এমন একটা মনোকষ্ট পুষে রেখেছেন, হাসিমুখের আড়ালে তা চাপা দিয়ে রেখেছেন। আজ বুঝতে পারছে।

***

আরমান, মিতুলের ছবিগুলো ডিলিট করতে গিয়েও পারিনি। নিজের বিয়ে ঠিক হয়েছে, যার ছবি দেখছে দু’দিন পর সেই মেয়েও অন্যের স্ত্রী হবে। এভাবে তার ছবি দেখা অন্যায়। অথচ ডিলিট বাটন টিপতে গিয়েও পারে না। থাকুক কিছু সুন্দর স্মৃতি। ল্যাপটপের কোনো এক গোপন ফোল্ডারে।

মিতুলের চোখের উপর আঙ্গুল বুলিয়ে যায় আরমান। যদি বাস্তবেও এই চোখের পাতা ছুঁয়ে দেওয়া যেত। সেদিন বৃষ্টিতে মিতুলের চোখের পাতা ছুঁয়ে জল নামছিল। আরমানের অবাধ্য দু ঠোঁট তা ছুঁয়ে দিতে উন্মাতাল ছিল। কিন্তু নিজের অন্যায় খায়েশের লাগাম টানতে জানে আরমান। তবুও সেই তৃষ্ণা তো ভোলা যায় না। ফিতে কাটা টেপরেকর্ডারের মতো মাথার ভেতর বারবার সেই মুহুর্ত ঘুরতে থাকে। মিরার কথায় মন দেওয়া হয় না। বিয়ে নিয়ে মিরা আলোচনা করতে চায়। আঙটির জন্য আঙ্গুলের মাপ চাই। শেরওয়ানির রঙটা কেমন হবে? শাড়ি কি লাল নেবে না সোনালি। অথচ নতুন সূচনার এই গান নয়, বিচ্ছেদের বেহালার সুরই শুধু কানে বাজে।

এই শহরটাই বিচ্ছেদের। এখানে ধরে রাখার চেয়ে মানুষ ছেড়ে বাঁচাটাই আগে শিখে। প্রিয়র হাত আঁকড়ে ধরে রাখতে চাওয়া ব্যক্তিটাই এই শহরে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। ধরে রাখতে গেলেই এখানে ব্যথা পেতে হয়। নিঃস্ব হতে হয়। তাই এখানে মানুষ ছেড়ে দেওয়াটাই আগে শিখে। বেঁচে থাকা তখন সহজ হয়ে যায়।

***

“ম্যাসেনজার দেখেননি?”

“না তো। কেন?”

“আঙটির ডিজাইন পাঠালাম। কোনটা পছন্দ হয় দেখেন। একসাথে গিয়ে কিনতেও পারেন। বিকেলে স্বর্ণের দোকানে যাব।”

“আমি এসব বুঝি না। তাছাড়া ছেলেদের এমনিও গোল্ড পরা নিষেধ।”

“কিন্তু এনগেজমেন্টের জন্য তো লাগবে। আকদ হয়ে যাবে ঐদিন। ফর্মালিটির জন্য তো লাগে। আচ্ছা আমার আঙুলের মাপও দিয়েছি। আমার আঙুল ভারী। মাপ মতো না নিলে হবে না। শুনছেন কী বলছি?”

“হ্যাঁ। আসলে এসব তো মা দেখবেন।”

“আপনি আসবেন না? বসুন্ধরায় যাব।”

***

“কী ভাই? হঠাৎ আজ আমাকে ফোন?”

“ভাই এই কথা বলো না। কাজিনদের ভেতর একমাত্র তুমিই সেই যার সাথে নিয়মিত কথা বলি।”

“হুম। সেটা তখন যখন তুমি মিয়া কোনো চিন্তায় থাক।”

“তুমি তো জানো, আমার ঐ ভাবে কখনো কোনো বন্ধু হয়ই নাই। আম্মা এত বেশি আগলে আগলে রাখেন স্কুলে। এরপর কলেজ, ভার্সিটি পর্যন্ত সেই রেশ টেনে গেলাম। যা দরকার আম্মা করে রাখতেন। বাকি বিষয়গুলো আপা দেখতেন। আমি কবে এমন একা হয়ে গেলাম নিজেই বুঝিনি। তুমি ব্যস্ত হলে থাক।”

“আরে সায়েম। আমি মজা করলাম ভাই। কী হয়েছে বল। স্যরি স্যরি।”

“না ঠিক আছে ভাই। তোমারও সামনে বিয়ে। কাজ আছে অনেক।”

“কোনো কাজ নাই। এমনিতে আমার নিজেরও কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল।”

“তোমার কী হয়েছে? বিয়ে নিয়ে আপত্তি আছে?”

“এমনি গল্প করতে ইচ্ছে করতে পারে না? কিন্তু বারবার বিয়ের কথা টানার কারণ কী? ভাবির সাথে কোনো সমস্যা?”

“সমস্যা আমার নিজের। আসলে তুমি তো জানো। আম্মু, আপা সবসময় এত আদরে রাখছেন। আমি আসলে আহ্লাদ পেয়ে অভ্যস্ত। বিবাহিত জীবনটা এমন মনে হচ্ছে না।”

“হওয়ার কথাও না। সারাজীবন লেখাপড়া নিয়ে থাকা, কোনো প্রেম ঘটিত ঘটনায় না থাকা তুমি আইডিয়াল ছেলে। কিন্তু মেয়েদের কাছে আইডিয়াল স্বামী হওয়ার ক্রাইটেরিয়া মনে হয় এটা না। এ বিষয়ে যদিও আমার কোনো অভিজ্ঞতা নাই। আমার অবস্থা তোমার চেয়েও খারাপ। কিন্তু এটা বুঝি, মা বোনের ভালোবাসা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আসে। পার্টনারের ভালোবাসাটা অর্জন করে নিতে হয়। তেমার মনে যেহেতু ভালোবাসার চাহিদা জেগেছে এ পর্যায়ে এসে। তাহলে দাম্পত্যে তুমি তার কমতি অনুভব করছ। সময় দাও ভাই নিজেদের। স্ত্রীকে সময় দেওয়ার মানে মা বোনকে অবহেলা না। ভাবি তোমার সময় ডিজার্ভ করে। আজ তো ছুটিরদিন। বাইর কোথাও যাও।”

“আমিও তাই ভাবছি। কেমন জানি একটা মানসিক দূরত্ব। তুলতুল মেয়ে খারাপ না। আমিও ভাই ছেলে খারাপ না। কিন্তু মাঝেমাঝে রাগের বশে হার্ট করে ফেলি।”

“রাগটা কোথায় দেখাও এটাও বিষয়। আমার মনে হচ্ছে তুমি চাচী, শেলী আপা ওনাদের সামনে ভালো থাকতে স্ত্রীর উপর চোটপাট কর। ভুল বললাম? এটা কর না। সবারই আত্মসম্মান আছে।”

“থ্যাংক ইউ ভাই। মন হালকা লাগছে। আজ এমনিও বাইরে যাওয়ার সুযোগ আছে। তুলতুলের ছোটো বোন মিতুলের বিয়ের কথা চলছে। আজ বিকেলে যমুনায় যাওয়ার কথা। আঙটি পছন্দ করবে, ছেলে একটু বসে কথাও বলতে চায়। এটা ভালো আসলে। আমার বিয়ের সময় এসব বুঝিই নাই। আম্মু আর আপা পছন্দ করলেন। গিয়ে বিয়ে করে ফেললাম। আজকাল কেউ এমন করে? অন্ততঃ ফোনে তো কথা বলা দরকার ছিল। সম্পর্কের শুরুই হলো মানসিক দূরত্ব দিয়ে।”

“যনুনায় যাচ্ছ তাহলে? কোন জুয়েলার্স?”

“জড়োয়া হাউসে।”

“আমারও তো মিরার সাথে যাওয়ার কথা। আঙটি দেখতে।”

“তাই? ভালোই হলো। দেখা হবে হয়তো তাহলে।”

“হ্যাঁ দেখা হবে।”

ফোন রেখে আরমান মিরাকে টেক্সট করে, “বসুন্ধরা না, চলেন যমুনায় যাই। জড়োয়া হাইসে। ওখানে চা কফি খাওয়ার ভালো প্লেস আছে। দূরে মনে হলে আপনি চাইলে সাথে কাউকে নিয়ে আসতে পারেন।”

মিরা ফিরতি টেক্সটে জানায়, “আপনি বাইক নিয়ে এসে নিয়ে যেতে পারবেন না? আমি মেইন রোডেই দাঁড়ালাম।”

“ওকে।”

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৩

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৩

(এই পর্বকেও রোমান্টিক বলাই যায়? নাকি মান অভিমানের?)

“চা খাবে?”

“চা? আচ্ছা দাও।”

তুলতুল নিজ থেকে চা দিতে চাওয়ায় সায়েম অবাক হয় একটু। ইদানীং খেয়াল করছে শুরুর দিনগুলোর মতো তুলতুল আর গায়ে পড়ে সায়েমের কোনো কাজ করে না।
না সেই ক্ষুব্ধ ভাব, অভিমানী চোখ, অযথা ঠোঁটের ভাঁজে রাগের কিছুই আর নেই। বরং বড়ো বেশি শান্ত, নির্মোহ, নিস্পৃহ। যেন সায়েমের কাছে নিজেকে আলাদা করে প্রকাশ করার কিছু নেই। অথচ বিরহে আছে তাও নয়। গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে তুলতুলকে চুল আঁচড়াতে দেখেছে বহুবার। তুলতুলের দীঘল কালো চুলে নাক ডুবিয়ে সেই গান শুনতে সায়েমের মনে যে কখনো খায়েশ হয়নি তা নয়। সে তো সাধুসন্ন্যাসী নয়। কিন্তু শারীরিক বিষয়ে তুলতুলের সেই রূপ খুঁজে পায় না। না ঠেলে সরিয়ে দেয়, না প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে। স্ত্রীর কাছ থেকে গভীর আলিঙ্গনের সময় পাওয়া এমন নিষ্প্রাণ আচরণ মাঝেমাঝে সায়েমকে বিরক্ত করে তোলে, কখনো হতাশ। অথচ অন্য সময় তুলতুলকে এমন লাগে না। ছবি দেখছে, হাসছে সবকিছু স্বাভাবিক। তার জীবনে যেন সায়েমের আলাদা করে কোনো প্রয়োজন নেই। সায়েম না থাকলেও সে যেমন খুশি, সায়েম থাকলেও তেমন। সায়েমের উপস্থিতি আলাদা কিছু নয়। সায়েম সন্দেহ করার মতো কিছু পায় না। তবুও গোপনে ফোন ঘাটে। তুলতুলের ফোনে যেন গোপন কিছুই নেই। কোনো পাসওয়ার্ড দেওয়া নেই। চ্যাটবক্সে মিতুলের সাথে ফোনে কথা বলার হিস্ট্রি। বান্ধবীদের কাছ থেকে ক্লাস নোট নেওয়ার ছবি। এর বাইরে কিছু নেই। তুলতুলের ফেসবুকেও যেন নেই সায়েম। সেই বিয়ের ছবিটা প্রোফাইল পিকচারে দেওয়া। বাকি নৈমিত্তিক সব গাছ, ফুল, নিজের দৈনন্দিন জীবননামা। যাতে সায়েমের অস্তিত্ব নেই।

অবশ্য সায়েম কিছু করতে বললে তুলতুল অবহেলা করে না। কিন্তু ঐ যে বলতে হয়। বললেই শার্ট প্যান্ট আয়রন হয়। আলমারি গুছিয়ে দেয়। চা বানিয়ে আনে, পানির জগটা ভরে এনে কামরার দরজা লাগায়। না বললে দরজাটাও লাগায় না। সারাদিন হাট করে খোলা থাকে। যেন তাদের মাঝে প্রাইভেসির কোনো বালাই নেই, প্রয়োজন নেই।

“চা।”

তুলতুলের বাড়ানো চায়ের কাপে সায়েমের ধ্যান ভাঙে।

“আজ কী হলো হঠাৎ। না চাইতেই চা। এমনিতে তো এই রুমে যে একজনের অস্তিত্ব আছে। তুমি বোধহয় তাই ভুলে যাও।”

“এমন কেন বলছেন? কিছু লাগবে? বললেই তো করে দেই। চা দিতে মা বললেন। বললেন জিজ্ঞেস করতে চা খাবেন কিনা?”

“তাই তো বলি, তুমি নিজ থেকে কেন খেয়াল করবে। চাইতে হবে। কাজ থেকে আসি যখন মাথা ভার হয়ে থাকে। চা পেলে ভালো লাগে।”

“আপনি চান খেয়াল রাখি? চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পছন্দ হলো না যে। প্রথম প্রথম নিজ থেকে চা বানিয়ে আনতাম। মা বিরক্ত হতেন। অসময়ে সন্ধ্যায় চা খেলে আপনার ঘুম হবে না বলতেন। আপনি তো তখন বলেননি যে চা খেলে ভালো লাগে। অথচ আমার মনে হতো অফিস থেকে ফিরে এককাপ চা পেলে আপনার ভালো লাগবে। কিন্তু বুঝেছিলাম ভুল ভাবছি। এরপর দেখতাম আপনিই চা চান। কিন্তু আমার কাছে না, মায়ের কাছে। মা আমাকে বানিয়ে দিতে বলে। আমি বানিয়ে আনি। বাকি বিষয়গুলোও তাই। খেয়াল ভেবে যা করি, তা বিরক্তির কারণ হয়ে যায়। গুছিয়ে রাখলে খুঁজে পান না। মা হাত না দিলে তা ঠিক মনে হয় না। এভাবে খেয়াল রাখা যায়?”

সায়েম একটু বিব্রত হয়ে যায়। মনে পড়ে একদিন একটু রাগ দেখিয়েই বলেছিল, ওর কাজগুলো করার আগে তুলতুল মাকে দেখিয়ে নেয় না কেন। জিনিস নতুন জায়গায় রাখলে সায়েম খুঁজে পায় না। তুলতুল বলেছিল সায়েম কী কিভাবে চায় তা বললে সে সেভাবে অবশ্যই করবে। কিন্তু সায়েমই এ নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। ঘরোয়া কাজ মেয়েলী মনে হয়। তুলতুল নিজ থেকে করতে গেলে জান্নাত আরার ঠিক মনে হয় না, একই কাজ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নেড়ে চেড়ে বলবেন এবার ঠিক হলো। তাই এখন তুলতুল না বললে হাতই দেয় না।

জান্নাতের আরা ভেবেছিলেন তুলতুল শাশুড়ির সাথে পাল্লা দিতে স্বামীর কাজে ভাগ চাইবে। যেভাবেই হোক সায়েমের পছন্দের রান্না, সায়েমের কাজগুলো করে হলেও সায়েমের কাছাকাছি যেতে চাইবে। যেভাবে দশজন মন জেতার চেষ্টা করে। কিন্তু তুলতুল সেদিকে হাঁটলই না। শাশুড়ির সংসার নিজের করে পাওয়ার চেষ্টা অথবা সায়েমকে জয় করার লড়াইয়ে নামার বদলে বরং নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হলো। এমন না যে সংসারের কাজ করে না। কী করতে হবে তা নির্ধারিতই থাকে। বাকিসময় নিজের মতো করে রুম গোছায়। জান্নাত আরা সেখানেও হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তুলতুল কোনো চাদর বিছালে বলতেন মানায়নি। অযথাই বদলাতেন। অথচ তুলতুলকে দেখে মনেই হতো না এতে তার কিছু আসে যায়। অযথাই জান্নাত আরার পরিশ্রম পণ্ডশ্রম। অবসরে বারান্দার গাছের যত্ন নেয়। নিড়ানি দেয়, পানি দেয়। সায়েমের সাথে গল্প করার যেন কোনো আগ্রহই আর বাকি নেই। সায়েম মায়ের রুমে গিয়ে গল্প করে। মাঝেমাঝে আগ্রহ নিয়ে দরজায় তাকিয়ে দেখে তাদের গল্পের মাঝে অনাহূত অতিথি হয়ে তুলতুল কি আসতে চায় কিনা। কিন্তু না, তুলতুল সেই সময়টা পড়তে বসে। মাঝেমধ্যে জান্নাত আরা নিজেই ডেকে এটা সেটা দিতে বলেন। তুলতুল দিয়ে চলে আসে। দাদী শাশুড়ি তুলতুলকে বোঝার চেষ্টা করেন। নাত বৌয়ের এই নিরামিষ আচরণ দেখে হতাশও হন। ভেবেছিলেন বৌ শাশুড়ি ভালো দ্বন্দ্ব দেখবেন। অথচ এই মেয়ে যেন উল্টো পথে হাঁটে।

স্বস্তিতে জান্নাত আরা নিজে আছেন তাও নয়। তুলতুল কয়েকদিন নিজের মতো রাঁধতে গিয়েছিল। আগে কিছুই বলতেন না। খেতে বসলে বলতেন সায়েম এই খায় না, তিনি আজ এটা খাবেন না মুখে রুচি নেই, একটু জলদি ভর্তা করে নিতে। এখন কী রান্না হবে তুলতুল তা জান্নাত আারাকে আগেই জিজ্ঞাসা করে নেয়। সায়েমকে ম্যাসেজ করে জানায় এই এই রান্না হবে, খাবে কিনা না অন্য কিছু রাঁধবে। বিষয়টা আপাত দৃষ্টিতে স্বস্তিদায়ক মনে হলেও ঠিক তা নয়। এ যেন মুখোমুখি না দাঁড়িয়েও এক ধরনের বিরোধিতা করা। অপরপক্ষে যতই কোমরে আঁচল গুঁজে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হোক না কেন এ পক্ষ ততটাই নিঃস্পৃহ।

“তুলতুল, দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসো। আচ্ছা না থাক। তুমি বসো। আমিই লাগিয়ে দিচ্ছি। আজ তোমার সাথে চা খাই।”

এসময়টা চা হাতে সায়েমের মায়ের ঘরে গল্প করতে যাওয়ার কথা। সায়েমের জন্য চা বানানোর সময় নিজের জন্যও এককাপ বানায় তুলতুল। পড়তে পড়তে চা খেতে ওর ও ভালো লাগে। নিজেকে ভালো রাখার এই পথগুলো তুলতুল নিজেই আবিষ্কার করে নিয়েছে। সেদিনের সেই রিকশাওয়ালা মামার কথার পর থেকে তুলতুলের মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। যাদের কাছে তার চোখের পানির মূল্য তৈরি হয়নি, তাদের নেক নজর পাওয়ার জন্য কান্না করে অর্থ শুধু নিজের উপর জুলুম করা।

“আজ আমার সাথে চা খাবেন যে?”

“চা খাব না। গল্প করব। তুমি তো অনেক গল্প করতে পারো। তোমার বান্ধবীরা বলেছিল তুমি নাকি মারাত্মক বুদ্ধিমতী, বাকপটু। এত মজা করে গল্প বল যে হেসে পেটে খিল ধরে। মিতুলের সাথে ফোনে গল্প করার সময় কী চমৎকার করে হাসো। আমার সাথে তো এমন করো না। তাছাড়া বিয়ের এতোদিনেও তুমি করে বললে না। কেন?”

“কেন? আমি যদি বলি আজ হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। সেটা বেয়াদবি হিসেবে গণ্য হলো। আমার বুদ্ধি আমারই জন্য কাল হলো। বেশি বোঝা শুরু করলাম। কিন্তু সঠিক সময়ে তার লাগাম আপনিই টেনেছেন। আপনিই বুঝিয়েছেন আপনার উপর আমার অধিকার কতটুকু। ততটুকু যতটুকু না দিলে আপনি থেকে তুমিতে আসা যায় না। আমাদের কথা বলার জন্য ঘরের দরজা বন্ধ করার দরকার কোনোদিনই ছিল না। কেননা সম্পর্কের ভেতর কিছু আগল থাকলেই চলে। আমার জন্য আপনার শাসন বারণ এই দরজার এপাশেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারতো। তাকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গিয়ে সবার কিন্তু আপনিই করেছেন।”

“তুমি তাহলে মনের ভেতর এসব পুষে রেখেছ?”

“পুষে রাখিনি। তবে নিজের সীমা কতটুকু তা মনে রেখেছি।”

“এতো অভিযোগ হলে এত কাছাকাছি থাকা কেন। একই বিছানায়। বাহুডোরে? ভালোবাসা নেই তাতে?”

“সেই বাহুডোরে ভালোবাসা টের পান? কিছু বিষয় দায়িত্বের সাথে সাথে। অধিকারের সাথে আসে। আর তাতে ভালোবাসা আছে কিনা তা জোর গলায় বলা যায় না। প্রত্যেকটা মানুষের ভালোবাসার একটা আলাদা রূপ আছে। কেউ ঝগড়ার মাঝেও ভেজা চোখে ভালোবেসে যায়। কেউ দৈনন্দিন সব কাজের ফাঁকে নিজের মানুষটার চোখে একটু ভালোবাসার খোঁজ পেতে নানা ছুতোয় বারবার সামনে আসে। অযথাই কপালের টিপটা ঠিক করে। আঁচড়ানো চুল আবার আঁচড়ায়। ঘর্মাক্ত নিজের মানুষটা যখন দিনশেষে ঘরে ফিরে, তার কপালে জমে থাকা ঘামের ফোঁটায়ও কিন্তু ভালোবাসা থাকে। ভালোবাসার জন্য শরীর কাছে আসা লাগে না সবসময়। তবে হ্যাঁ গভীর ভালোবাসার পর যখন শরীর কথা বলে, তার ভাষা অনেক বেশি সুন্দর হয়। আহ্লাদী তরুণী হোক, বা বাস্তবতার আঘাতে ক্লিষ্ট তরুণ। দিনশেষে সবাই ই নিজের মানুষটার কাছ থেকে শুধু শারীরিক স্পর্শ না, বরং উষ্ণ অভ্যর্থনা চায়। একটা আদুরে আলিঙ্গন চায়। সবার সামনে প্রয়োজন নেই। ভালোবাসা লোক দেখিয়ে করতে হয় না। আড়ালেই একটু জড়িয়ে ধরা, কপালের ঘামটুকু মুছে দেওয়া, কখনো একটা নির্দোষ চুমু। এইটুকু নিয়েই জীবন কাটানো যায়। রোজ ঘড়ি ধরে গল্প করতে হয় না। কাজের ফাঁকে একটু খুনসুটি, এক কাপ চা খেতে খেতে দুটো ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতে পরিবারের বাকিদের ভুলেও যেতে হয় না। হানিমুনে না নিলেও চলে। কিন্তু মাঝেমধ্যে বাইকের পেছনে বসিয়ে একটু বাইরে গলি পর্যন্ত নিয়ে যেতে, হুড খোলা রিকশায় বসে বৃষ্টি বিলাস করতে, ছাদে বসে চাঁদ দেখতে কিংবা মোড়ের টং এ চা খেতে খরচ লাগে না। লাগে একটু ইচ্ছে। এইটুকু করতে পারলে ভালোবাসা কারও চেয়ে নিতে হয় না। এমনিই আসে। হুড়মুড়িয়ে বর্ষার হঠাৎ বৃষ্টির মতো।”

তুলতুল উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

“যান, মা ডাকছে। অপেক্ষা করছেন আপনার।”

ডাকটা সায়েমের কানেও গিয়েছে। কিন্তু আজ কেন জানি উঠে যেতে ইচ্ছে করছে না। নিজের হেলায় সুন্দর কিছু অনুভূতি কি জীবন থেকে হারিয়ে ফেলছে?

এতদিন মনে হতো নারীদের অস্ত্র হলো অযথা দুর্বোধ্য অভিমান, আর চোখ ভরা জল। অথচ আজ মনে হচ্ছে কিছু অভিমানের ভাষা বোঝা খুব কঠিন কিছু না। তবে একটু সময় নিয়ে চিনতে হয়। যদি একটু নরম হলে, একটু আদরে জড়িয়ে নিলে কিছু অভিমান ইতি হয়। তবে সেইটুকু না করাটাই অপরাধ।

সঙ্গমের সময় সঙ্গীকে বুকে জড়িয়ে নেওয়াটাই ভালোবাসা নয়। বরং মাঝেমধ্যে এমনিতে বুকে জড়িয়ে সঙ্গীর না বলা শব্দগুলো বুঝে নিতে হয়। এতে সম্পর্ক সহজ হয়, একে অপরকে তখন ভালোবাসতে শুরু করে। সম্পর্কে পালতে হলে ভালোবাসাটাই পালতে হবে, অভিমান নয়। এতে বরং সম্পর্কটা ক্ষয় হয়।

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২২

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২২

মিতুল কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় একটাও খালি রিক্সা পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ বাসায় তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। মায়ের শরীরটা ভালো না। আজ কলেজে আসতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার ডেট ছিল আজ। ডেট মিস করলে মার্কস কাটা যাবে। তাই বাধ্য হয়ে এসেছে। ভেতরে ভেতরে একটু অস্থিরতা বোধ করছি মিতুল। গতকাল রাতে রফিক সাহেব জানিয়েছেন ফারহান মিতুলের সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চায়। কোনো একটা রেস্টুরেন্টে বসতে চায়। মিতুলকে ফরিদা বেগম নিয়ে যাবেন।

যদিও আলাদা করে কথা বলার কী আছে রফিক সাহেব বোঝেন না। বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে মুরুব্বিরা যা ঠিক করবেন তাইতো হবে। হ্যাঁ ছেলের অবশ্যই মেয়ে পছন্দ করার বিষয় আছে। কিন্তু এই ছেলে মেয়ে আলাদা করে কথা বলার তর তরিকা উনার পছন্দ না। কিন্তু তুলতুলের ঘটনার পর জোর গলায় নাও করতে পারছেন না। যদিও এখন মনে হচ্ছে স্ত্রী ফরিদা ঠিকই বলেছেন। এসব তো ভাগ্যের বিষয়। কার স্বামী রগচটা না হয়ে ঠান্ডা হবে কার স্ত্রী শুধু দেখতেই ভালো না, সাথে গুণবতীও হবে, এগুলো তো মানুষের হাতে থাকে না। কিছু জিনিস কপালেও থাকে। আর সায়েম তো খারাপ ছেলে নয়। বরং ছেলে মানুষ তো এমনই হয়। আজকাল মেয়েদের ভেতরেই বরং ধৈর্য কমে গেছে। এই যে এখন তুলতুল ধৈর্য ধরে সংসার করছে, সব কী সুন্দর ঠিক হয়ে গেছে। তুলতুলের কোনো অভিযোগ নাই, ওকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ির নালিশ নাই। মিতুলের ক্ষেত্রেও তাই হবে যদি মিতুল ফারহার বিষয়টা গুরুত্ব না দিয়ে বিয়ের পর স্বামীকে নিজের করে নিতে পারে। তাহলে অন্য কিছুতে কিছু যায় আসে না। মিতুল আর ফারহার আলাদা জায়গায় বিয়ে হয়ে গেলে কয়েকবছর পর এসব কারও মনেও থাকবে না। দেখাই হবে কয়দিন। আপন বোনে দেখা হয় না মাসে। এখানে তো চাচাতো বোন। শুরু শুরুতে একটু পারিবারিক গ্যাদারিং গুলো এড়িয়ে গেলেই হবে।

আর ভাই ভাই একদিন এমনিতেই আলাদা হয়। তিনি আর শফিক সাহেব তো আগেই আলাদা হয়েছেন। এখন সামান্য মন কষাকষিতে কী যায় আসে। যার যার আলাদা পরিবার। বরং ফারহানের পরিবারের জাঁকজমক দেখে মনে মনে রফিক সাহেব সন্তুষ্ট। সায়েমের চাইতেও ভালো পরিবারে বিয়ে দিচ্ছেন ছোটো মেয়ের। সায়েমের পরিবার তো নিজেদেরকে হনু ভেবে একটা ভাব দেখাচ্ছিল। এখন তারাও বুঝবেন তাদের চাইতেও ধনী পরিবার, যোগ্য ছেলে উনার মেয়েদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করতে আগ্রহী। এটা কি কম বড় জবাব দেয়া হলো? বাকি অন্যদের ইচ্ছা অনিচ্ছাটা এখানে বড় কোন বিষয় না। তারপরও ছেলে যখন চাইছে আলাদা করে বসুক একদিন। মিতুলের মা না হয় সাথে যাবে। ছেলেও কি আর একা আসবে? পরিবারে কেউ তো সাথে আসবেই নিশ্চয়ই। তাই নিমরাজি হয়েছেন।

এদিকে মিতুলের অবস্থা খারাপ। এটা কি প্রেম নাকি শুধুই পাগলামি অনুভূতি জানা নেই। তবু সেই অজানা অনুভূতির জ্বালায় মিতুলের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। সেদিনের পর থেকে আরমানের নামের পাশে সবুজ বাতি জ্বলে না। যখন তখন হুটহাট ম্যাসেজ আসে না। মিতুল এলোমেলো কথা লিখে, একা একা বিশাল বিশাল রচনা লিখে, ঝগড়া করে গদ্য লিখে। কিন্তু সেন্ড বাটনে চাপ দেওয়া হয় না। আরমানের মনে কষ্ট দিয়েছে, ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু স্যরির কথা লিখতে গেলেই কেমন ভালোবাসার কথামালা হাত জড়িয়ে নাকি কান্না করতে থাকে।

“ওদিন আমি কথাটা এভাবে বলতে চাইনি। আমার ভুল হয়েছে। আপনাকে মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করে দিয়েন।” এই লাইন লিখতে গিয়ে মিতুল লিখে,

“এই ব্যাটা, এত ভাব কেন? কী এমন বলছিলাম যে ভাব নিচ্ছ? জানো না মেয়েদের সাথে ভাব নেয় কাপুরুষেরা। মেয়েরা রাগ করলেও তাদের সাথে গরম হতে নেই। এই কথাটা কেউ আপনাকে বলেনি? আমি তো রেগে ছিলাম। আপনি বুঝি একটু ভালোবেসে কথা বলতে পারেননি। আমাকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে এলোমেলো কথা বলানোর দরকার ছিল? এখন আবার কথা বন্ধ রেখেছেন। আমার কষ্ট হয় না? আমায় অন্য কেউ নিজের করে নিয়ে গেলে তখন বুঝবেন। অবশ্য কী আর বুঝবেন। আপনি তো এখন মিরার স্বপ্নে বিভোর।”

এসব কী লিখছে দেখে হতভম্ব হয় মিতুল। অতঃপর ম্যাসেজও আর পাঠানো হয় না।

*** মিতুল রাস্তা ধরে এগিয়ে যায়। মেইনরোডে গিয়ে দেখতে হবে কী আছে। ছাতার পক্ষে এই বৃষ্টির ছাট আটকানো অসম্ভব। ভিজে যাচ্ছে মিতুল। হঠাৎ একটা বাইক এসে পাশে ব্রেক কষে। মিতুল ভয় পেয়ে যায়। বখাটে কেউ নয়ত? মাথা থেকে হেলমেট খুলে আরমান বলে,

“কিছু পাবে না এখন। বাইকে উঠো। নামিয়ে দেই।”

মিতুলের মন চায় লোকটাকে দুটো লাগাতে। অথচ বিনা বাক্য ব্যয়ে সুর সুর করে বাইকে উঠে বসে।

“একদিন বোধহয় শিখিয়েছিলাম, বাইকে কিভাবে বসতে হয়। ভুলে গিয়েছ বোধহয়। অবশ্য সামনে চার চাকার মালকিন হবে। বাইকে বসা না শিখলেও চলবে।”

মিতুল নেমে দাঁড়িয়ে যায়।

“ঠিকই বলেছেন। আপনি বরং মিরাকে শেখান।”

আরমান মিরার কথা শুনে অবাক হয়। মিতুল মিরাকে হিংসে করছে?

“সে তুমি বিয়ের পর শিখে নিও। আমিও যাকে শেখানোর শিখিয়ে নেব। এখন আপাততঃ এই দুই চাকার বাইকে বস।”

মিতুল সামনের দিকে হাঁটা শুরু করছে দেখে আরমান মিতুলের হাতটা টেনে ধরে। বিদ্যুৎ চমক খেলে যায় মিতুলের দেহ মনে। এক মুহূর্তের জন্য অবশ লাগে শরীর।

“আই অ্যাম স্যরি। আচ্ছা আর কিছু বলব না। যেভাবে বসার বস। আসো নামিয়ে দেই। তুমি বৃষ্টির পানি সহ্য করতে পারো না। নির্ঘাত জ্বর বাঁধাবে।”

এরপর আর না করা যায় না। মিতুল উঠে বসে। আরমান বাইক টান দিতেই শার্টের কোনা খামছে ধরে।

“এই জন্য ঠিক করে বসতে বলেছি। ব্যাগটা মাঝে দিয়ে বস। গায়ে গা লাগবে না। তুমিও অস্বস্তি অনুভব করবে না। আমিও নিজের মতো চালাতে পারব। ভয় পেও না, আমি তোমাকে পড়তে দেব না।”

মিতুল মনে মনে বলে, “আমি তো পড়তেই চাই। প্রেমে পড়তে চাই। অথচ আপনিই মাঝে দেওয়াল তুলে দিয়ে বলছেন পড়তে দিবেন না। ঠিক আছে দিয়েন না।”

মিতুলের মনের কথা তো আর আরমানের শোনা হয় না। বাইকের গ্লাসে শুধু এক তরুণীর বৃষ্টি ভেজা নির্মল মিষ্টি মুখ আড় চোখে দেখে আর ভাবে,

“আমি ভবঘুরে একজন মিতুল। আমার সাথে তেমার জীবন অনিশ্চিত ভেলা। তোমার সিদ্ধান্তই সঠিক। এত মিষ্টি সুন্দর একটা মেয়ে তুমি। তুমি এমন কাউকেই ডিজার্ভ কর যে এমন বৃষ্টির দিনে তোমাকে লং ড্রাইভে নিয়ে যেতে পারবে। বৃষ্টির একটা ছাটও তোমার গায়ে লাগতে দিবে না। ভিজে জ্বর উঠতে দিবে না। তবু আজ এই বৃষ্টির দিনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। রোজ তোমার কলেজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকার কী এক অদ্ভুত রোগে পেয়েছিল। হয়তো আজকের এই দিনটির জন্যই। এমন একটা দিন পাব বলেই। এক তরফা ভালোবাসতে সবাই পারে না মিতুল। তবে আমি খুব ভালো করেই পারব। হয়তো একটা সময় আমাদের সমস্ত যোগাযোগ পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের সম্পর্ক কোনো নাম পাওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। তবু তখনও আমি তোমাকেই ভালোবেসে যাব।’

***

” আপনি এখানে কী করছিলেন?”

“একটা অকাজে এসেছিলাম।”

“অকাজে? বুঝেছি। আচ্ছা আপনি আমার সাথে স্বাভাবিক কথা বললে কী হয়?”

“আরে সত্যি অকাজে এসেছিলাম। এক বন্ধুর বাসায় আড্ডা দিলাম। আমার অনেক ফ্রি টাইম যে।”

“আপনার পেজ দেখেছি। অনেক সুন্দর হয়েছে আলতা দীঘির ছবিগুলো। আপনার তো অনেক ফলোয়ার।”

“আমার না, ছবির ফলোয়ার।”

“ছবি তো আপনার তোলা। আপনি ছবি তোলা পেশা হিসেবে নেন না কেন?”

“নিয়েছি তো। তবে আমার পেশাটা আলাদা। আমার রুটিন জব ভালো লাগে না। আমি যাযাবর ধরনের মানুষ।”

“যাযাবর রা তো সংসারী হয় না। আপনি তো বিয়ে করছেন।”

“বিয়ের পর বৌ যায়াবরের সংসার হবে। বেদেদের মতো একবার এক জায়গায় খুঁটি গাড়ব।”

মিতুলের খুব কান্না পায়। বলতে ইচ্ছে করে, “এই খারাপ লোক শোনেন। ছোটোবেলা থেকে আমারও খুব জিপসি হওয়ার শখ। আমাকে আপনার সঙ্গী করে নেন। আপনার সাথে সূর্য ডোবা দেখব। আলতা দীঘি দেখব। খোলা মাঠের শিশিরে পা ভিজিয়ে হাঁটব। এমন বৃষ্টির দিনে খুব ভিজব। ভিজে জ্বর বাঁধাব। আপনি আমাদের অস্থায়ী কুটিরে আমার মাথায় জলপট্টি দিয়ে সেই জ্বর নামাবেন। আমার চার চাকা চাই না। আপনার সাথে এই দুই চাকার বাহনেই সংসার পাতব।”

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২১

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২১

আরমান শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসে। মিরাকে এত আয়োজন করে দেখতে আসবে না

“আমার পছন্দ অপছন্দের কিছু নাই মা। তোমার যদি মনে হয় মেয়ে ভালো, এবং তোমার অপদার্থ ছেলেকে জেনেশুনে বিয়ে করতে রাজি। তাহলে আমারও কোনো আপত্তি নেই।”

“এসব কী কথা আরমান। তুই আবার পিছলাতে এসব বলছিস। একটা বার মেয়ে দেখ। কথা বল। ভালো না লাগলে জোর করব না সত্যি।”

আরমান মায়ের হাতটা ধরে বলে,

“মজা করছি না মা। সত্যি বলছি। আমার ভালো খারাপ লাগার কিছু নেই। আমাকে ভালো লাগে কিনা সেই প্রশ্ন হলে আমি অবশ্যই যাব।”

“তুই কি হেঁয়ালি শুরু করলি।”

“আচ্ছা চলো, তুমি যেহেতু আমাকে ছাড়া মানবেই না।

***

“মিরা আপনার সাথে আমার পরিচয় নেই। শেলী আপার বিয়ের সময় হয়তো এক দুই বার দেখা হয়েছ। পারিবারিক আয়োজনে হয়তো চোখাচোখি হয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে আপনার বিষয়ে আমার কোন ধারণা ছিল না। হয়তো আমার বিষয়েও আপনার কোন ধারণা নেই। হয়তো আমাদের দুজনেরই দুজনের বিষয়ে কখনো কোনদিন কোনো আগ্রহ ছিল না বলেই এমনটা হয়েছে। তবু আজ দুজন এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম আমি আপনাকে বলতে চাই যদি আপনার পরিবারের চাপ থাকে তাহলে আমাকে পরিষ্কার বলতে পারেন।”

“কী ধরনের চাপের কথা বলছেন? জোর করে বিয়ে দেওয়ার? এই বয়সের মেয়েদের আর জোর জবরদস্তি করতে হয় না। তারা নিজেরাই ভাবে বিয়ে করে বাবা মাকে উদ্ধার করি। ভাইকে চিন্তা মুক্ত করি। ভাবির ভ্রু কুঞ্চন থেকে মুক্তি পাই।”

“আমাদের দেশের মানুষের একটা সমস্যা আছে। বিয়ের একটা প্রাথমিক বয়স তারা মাইন্ড সেট করে ফেলে। সেই বয়সে সবচাইতে স্ট্যান্ডার্ড কিছু ক্রাইটেরিয়া তারা সেট করে। যে ক্রাইটেরিয়া ছাড়া পাত্র-পাত্রী মিলে না। মানে পাত্র পাত্রীর গুণ মিলে না। পাত্রী লম্বা ফর্সা সুন্দর ধর্মপরায়ণ আধুনিকা সুরাঁধুনি এসব গুন থাকতে হয় আর পাত্রের জন্য মূল ক্রাইটেরিয়া হলো তার ক্যারিয়ার। বিসিএস হলে সবচাইতে বেস্ট। এবারে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হয় ভালো ব্যবসায়ী। আপনাকে বলি আমি সেই ক্রাইটেরিয়া তে পড়িই না। বলার মত কোন কাজই করি না। তবে পেট চলে যায়। সেদিক থেকে ভাবলে আমার মত ছেলে কারও ড্রিমবয় টাইপ স্বামী হওয়া সম্ভব না। এভাবেই অ্যারেঞ্জ বিয়ে করতে হবে আমাকে। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে তো বিষয়টা তা নয় আপনি কারো প্রেসারে পড়ে কিছু করার দরকার নেই।”

মীরা কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে তারপর আরমানকে বলে,

“আমার জন্য বিষয়টা আলাদা মনে হওয়ার কারণ?আদর্শ পাত্রীর যে বর্ণনা দিলেন সে অনুযায়ী তাহলে আমিওআদর্শ পাত্রীর ক্রাইটেরিয়াতে পড়ি না। আমার শ্যামলা বর্ণ, খাটো হওয়া কোনটাই বোধহয় আমার পারদ কে উঁচু করে না। পড়ালেখাও গড়পড়তা মানের। সব কোনোমতে চলে ধরনের। তবু পরিবার চেয়েছিল আপনার বর্ণনা মতে একজন আদর্শ পাত্রের সাথে বিয়ে হোক। সেই খোঁজে বেলা পার হয়েছে। এখন সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে বিবাহ উত্সব অনুষ্ঠিত করার প্রয়াস।”

“তাহলে কি তুমি সেজন্যই বিয়েতে রাজি? কেউ না পেলে কেউ হলেই চলবে বলে?”

“বলতে পারেন। আপনার জন্য হয়তো বিষয়টা তা নয়। ত্রিশ প্লাস বয়স ছেলেদের জন্য কিছু না।”

“কিন্তু পছন্দের মেয়ের পাণিপার্থী হওয়ার মতো যোগ্যতা আমার নেই।”

“তাহলে আমরা দু’জনই তবে দু’জনের জন্য যথাযথ। কেউ না পাওয়ার চেয়ে কেউ পেলেও ভালো।”

“কেন এতে লাভ কী হবে? ”

” এতে ক্ষতি বা কী? বিয়ে তো করতেই হবে। প্রথমে সবাই সেরাই খোঁজে।’

“না পেলে চলনসই হলেও নিতে রাজি?”

“ছেলেদের আবার চলনসই কী? ছেলেদের মুখে এসব কথা কখনো শুনিনি। রিজেকশন পেলে ছেলেদের অনুভূতি কেমন হয় আমি জানি না। তবে নারী হিসেবে আমার রিজেকশন পাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে আর তাতে দেখেছি বেশিরভাগ ছেলেরাই ভাবে সোনার আংটি বাঁকাও ভালো।”

“তাহলে আমি বাঁকা হলেও ভালো বলে মনকে বুঝ দিচ্ছেন? ”

“আপনিও তো আমাকে… ”

“থামলেন যে?”

“বাদ দিন। অন্য আরেকদিন।”

“আচ্ছা তাহলে অন্য আরেকদিন।”

***

“আপু, তোমার দেবরের কী খবর?”

“আরমান ভাইয়ের?”

“হুম। বিয়ে ঠিক?”

“হ্যাঁ বিয়ে তো ঠিকই।”

“হ্যাঁ বলে দিয়েছেন?”

“ওটা তো একরকম হ্যাঁই ছিল। বাকিটা ফর্মালিটি।”

“ওহ। বিয়ে কবে?”

“আগে তো এনগেজমেন্ট হবে।”

“কবে?”

“এই তো এই মাসের বাইশ তারিখ। ছোটো করে ঘরোয়া অনুষ্ঠান হবে। আসবি তো সবাই। বাসায় দাওয়াত দিবে। শেলী আপা তো খুশি। অল্পতে ননদ পার হচ্ছে। যা দেখলাম মেয়েদের অল্পতে পার করতে পেরে সবাই খুশি হয়। আচ্ছা এদের কথা বাদ দে। বাড়িতে এত কাহিনি হলো সে নিয়ে বল। আম্মু আর চাচীর কি মুখ দেখাদেখিও বন্ধ?”

“বন্ধই তো। ফারহা আপু এসে আমাকে কত কথা শুনিয়ে গেল। আমি নাকি হিংসা করে ঐ লোককে পটিয়েছি।”

“তুই কী বললি?”

“একবার ভেবেছিলাম সব ব্যাখ্যা করব। পরে বাদ দিলাম। বললাম ভাই যা ভেবে খুশি হও মনে শান্তি পাও তাই ভেবে নাও।”

“বাহ রে এত সহজে তুই ছেড়ে দিলি? দোষ না করে দোষী বানালো তুই কিছুই বললি না?”

“কী বলবো আপু। ফারহাপুর জায়গা আমি থাকলে আমিও বোধহয় এ ভাবেই রিয়েক্ট করতাম।”

“ছেলেটার সাথে ফারহার সম্পর্ক কেমন ছিল জানা উচিত। তোদের আর কথা হয়েছে?

” ফারহানের সাথে? হ্যাঁ নক করেছিল।”

“কী বললি?”

“বললাম বিষয়টা এভাবে জটিল না করলে ভালো হতো। আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে।”

“সে কী বলে?”

“বলে এসব তার চিন্তার বিষয় না। তাকে অনেকেই চায়। ভংচং এসব কথা। নার্সাসিস্ট একটা।”

“ছেলেটাকে খুবই ইনসেনটিভ মনে হচ্ছে। ফারহার সাথে আসলেই ঠিক হয়নি। আব্বু আম্মু তাও গোঁ ধরছে!”

“ছেলে মানুষ তো এমনই।”

“সেটাও ঠিক। সায়েমকেই দেখ না।”

“আপু সায়েম ভাইয়ের সাথে মিটমাট করবি না?”

“করব। ইনফ্যাক্ট করা শুরু করেছি।”

“গুড।”

“গুড ব্যাডের কিছু নেই। বনে বেঁচে থাকতে হলে শিকারি হতেই হয়।”

“মানে?”

“মানে পালিয়ে পালিয়ে চললে নিজেই শিকার হয়ে যাব। তাই শিকারি হয়েই মাছ শিকার করব।”

“তোমার কথা কিচ্ছু বুঝি না। বিয়ের পরে আর রহস্যময়ী হয়ে যাচ্ছে। ”

“আমি বুঝে ফেলেছি।”

“কী?”

“পুরুষের দুর্বলতা।”

“মানে?”

“সায়েমের নখরামি স্বভাব পূরণ করার জন্য মা বোন আছে। কিন্তু দরজা বন্ধ হলে অন্য আরেকটা দুনিয়া। এই দুনিয়ায় ওর আমাকে প্রয়োজন। আমারও এখন প্রয়োজন থেকে প্রিয়জন হতে হবে। যেহেতু বের হয়ে আসবো না। তাই সেখানেই থাকার জায়গা বানাতে হবে। ”

“আপু একটা কথা বলব?”

“জানি কী বলবি। তুই আমাকে কী বুঝবি আমি নিজেই নিজেকে বুঝতে পারছি না। আচ্ছা আগে সফল হই তারপর তোকে বুঝিয়ে বলব। ঠিক আছে?

“আপু আমি ফারহানকে বিয়ে করতে চাই না। অথচ আব্বু আম্মুর কেমন রোখ চেপে গিয়েছে। চাচার উপর রাগ করে হলেও এখানে বিয়ে দিবে।”

“অপেক্ষা কর।”

“কিসের?”

“পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। আগে কিছু বলার দরকার নেই। তোর যেহেতু কোনো পছন্দ নেই তাই আগে কিছু বলতে যাস না। বাকিটা অপেক্ষা কর।”

“যদি সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে যায়?”

“শোন বিয়ে যদি করতেই হয় এমন ছেলে কে করবি যে অন্যের কথাও চলে না, নিজের জিদেও চলে না। যার একটা ভালো মন আছে। যে সম্মান দিতে জানে। যে অন্যের মতে চলে তার পা অন্যের মর্জিতে চলে। যে নিজের জিদে অন্যকে চালিত করে সে স্বার্থপর হয়। জীবনসঙ্গী সহমর্মী হওয়া উচিত প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। খুব কষ্ট বিষয়টা। আমার খুব কষ্ট হয়। তুই এই কষ্টটা পাস তা আমি চাই না।”

“আমিও না আপু। কিন্তু আমি যাকে চাই সে যদি আমাকে না চায় তাহলে তো নিয়তি কে মেনে নিতে হয়।

“তুই কাকে চাস?”

“কথার কথা।”

“সত্যি?”

“সত্যি।”

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২০

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২০

“তুলতুল।”

“জি আপু।”

“মুখ ফুলে গিয়েছ দেখি। আমাদের বাসার আলো বাতাসে মাশাল্লাহ স্বাস্থ্য ভালো হচ্ছে।”

“জি আপু আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আপু দেখেন হাত, পা, মুখ সব ফুললেও ওজন গিয়েছে কমে। বিয়ের আগে ছিলাম একান্ন কেজি। এখন আটচল্লিশ।”

“মেশিন নষ্ট নাকি দেখ।”

“চলেন দেখি।”

তুলতুল সত্যি সত্যি ওজন মাপার মেশিন নিয়ে আসে।

“আপু আপনার ওজন কত? মেপে দেখলে বুঝব মেশিন ঠিক আছে না ভুল।”

“বাদ দাও। আমি তো থাইরয়েডের রোগী। ডায়েট করলেও ওজন কমে না। আমার ওজন বেশিই দেখাবে। আর তুমি কিন্তু মোটা হও নাই।।বিয়ের পর মেয়েদের চোখমুখ একটু ফুলে, এতে আরও সুন্দর লাগে। তোমাকেও লাগছে।”

শেলীর বিরস মুখের প্রশংসা তুলতুল গায়ে মাখে না। মেশিনটা নিয়ে রেখে আসে। মানুষের চিন্তা করার অনেক সময় থাকে। তুলতুলের চিন্তা করার সময় হলো গোসলঘর। মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালতে ঢালতে তুলতুল ঘটনাপ্রবাহ ভাবে। কী হলে কী হতে পারে। নতুন বিয়েতে মেয়েদের সবচেয়ে বড়ো আতংক এই থাকে যে কোন অপরাধে জানি বাবার বাড়িতো নালিশ পৌঁছে যায়, যার সর্বশেষ পরিণতি হতে পারে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া না হলে চলে যেতে বাধ্য করা। যে অপরাধে এই শাস্তি এই সমাজে হয় সেই অপরাধের কিছুই না করে সেই ধরনের মানসিক শাস্তি ইতোমধ্যে পেয়ে গিয়েছে। বাবা মায়ের মনেও সর্বোচ্চ ভয় এটাই যে মেয়ে বাড়িতে ফিরে আসবে। তো এরচেয়ে খারাপ হওয়ার আর কিছু নেই। যখন সর্বোচ্চ খারাপের দর্শন আর অনুভব হয়েই গিয়েছে। তখন আর কিসের পরোয়া? বলে না ‘সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কী ভয়’। নিজের সংসার খারাপ না করেই সায়েমকে বোঝাতে হবে শুধু মায়ের ছেলে হলেই ভালো ছেলে হওয়া যায় না। বোনের জন্য ভালো ভাইয়ের মতো স্ত্রীর জন্য যোগ্য স্বামীও হতে হয়।

***

“মিতুল, তোর চোখ মুখ ফুলে এ কী অবস্থা হইছে! ভাতও খাস নাই। বুঝছি বোন চলে যাওয়ায় খুব কষ্ট হইছে। এখন তুইও আমারেই দোষ দে। রাগ দেখা।”

“আম্মু, আপনার আর আব্বুর সাথে আমরা কোনো দিন আগে রাগ দেখাই নাই। এখনো দেখাব না। আপু কেন গিয়েছে জানেন না? আপুর শাশুড়ি কড়া হলেও সমস্যা ছিল না, যদি ভাইয়া আপুকে একটু বুঝত। আর ওনারা তো আপনাদের ডেকে নিয়ে বিচার বসায়। আপুর কত অপমান লাগে এসব। এজন্য চলে গিয়েছে। অযথা আপনাদেরও ছোটো করতে চায় নাই।”

“তোরা এখন কী চাস? আমরা সমানে সমান গলাবাজি করব? বয়স কম, বুঝ নাই। একপক্ষ আগুন হলে আরেকপক্ষ পানি হতে হয়। না হলে চলে না। যা হাতমুখ ধো। এত নরম হলে দুনিয়ায় চলবি কিভাবে?”

মিতুল স্বস্তি বোধ করে অবশ্য। মা যে তুলতুলের বিষয়টা ছাড়া অন্য কিছু ভাবেনি এতেই শান্তি। না হলে কান্নার কী ব্যাখ্যা দিত মিতুল। স্বস্তির স্থায়ীত্ব অবশ্য বেশিক্ষণ হয় না। মিতুলের দাদী বাড়ি ফিরেছেন থমথমে মুখে। ফিরেই ছেলে আর ছেলের বৌয়ের বিচার বসিয়েছেন। অভিযোগকারী মিতুলের চাচা চাচী। অপরাধী মিতুলের বাবা মা।

“আম্মা ঘটনা কী তাই তো বুঝলাম না? শফিক কী হইছে?”

“কী হয়েছে তা তো আপনি আর ভাবি জানেন বড়ো ভাই।”

“সেটাই তো জানতে চাইছি। বিষয়টা কী?”

“বিষয়টা বিশ্বাস ভাঙার। আমি কোনোদিন ফারহা আর মিতুলকে আলাদা চোখে দেখি নাই। ফারহার জন্য সুন্দর কিছু, ভালো কিছু কিনলে মিতুল আর তুলতুলকেও দেওয়ার চেষ্টা করছি। যেন না পেয়ে ওদের মন ছোটো না হয়। ফারহার জিনিস, আমার জিনিস কোনো ব্যবহার করতে দিয়েছি। যেন বোনে বোনে হিংসা না জাগে। বুঝতেই পারি নাই হিংসা তো অন্যদিক থেকেও আসতে পারে।”

“আহ্ জেসমিন। কী শুরু করলে। কোন কথা বলতে কোন কথা টানছ।”

শফিক সাহেব স্ত্রীকে থামিয়ে দেন।

“থামালে কেন ভাই। শুনি একটু। কী কী দয়া করলে তোমরা। ফারহার জন্য নতুন পুতুল আসলে পুরানো পুতুল ফেলে না দিয়ে মিতুল, তুলতুলকে দিয়েছ। জেসমিনের দামি শাড়ি পরতে দিয়েছ। কখনো কখনো ফারহার জামা জুতো একবেলা পরতে দিয়েছ। ফারহার জন্য কেনা দামি দামি জিনিস দেখতে দিয়েছো, ধরে খেলতেমদিয়েছ। আর কী?”

“আর কিছু না ভাবি?”

“আমি তো তাই জিজ্ঞাসা করলাম। আর কী?”

“আলাদা সংসার হওয়ার আগে-পরে আপনাদের দায়দায়িত্ব শফিক নেয়নি? বাসাও আপনাদের ছেড়ে দিলাম।”

“বাসা ছাড় নাই জেসমিন। পুরানা বাসায় থাকবা না বলে উপরে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছ। আর এই সাজানোর টাকা পয়সা এই সংসারে বসে গুছিয়েছ। একসাথে সংসার থাকার সময় তুলতুলের আব্বা তোমাদের কাছ থেকে একটা পয়সা বাজার খরচ নেয় নাই। সেটা হিসাব করছ কয় টাকা হয়?”

“তুমি খাবারের খোটা দিচ্ছ ভাবি? অথচ সবাই জানে ভাইয়া কী হিসাবি মানুষ। আমাদের এমনি এমনি কেউ টানেনি। আমরা দু’জনই আয় করা মানুষ। দুই হাতে খরচ করছি। আমি এভাবে চিন্তাই করি নাই এই যে হিসাব রাখতে হবে। কিন্তু মনে করে দেখ আম্মার কয়দিন আগে অপারেশন হলো। পিত্তের পাথর ফেলা লাগলো। সেই টাকা কে দিয়েছে? আম্মার ওষুধের টাকা কে দেয়?

” হ্যাঁ এখন তোমরা দাও। অথচ এর আগে আব্বার সমস্ত চিকিৎসা তুলতুলের বাবাই করিয়েছেন।
আম্মাকেও নিয়েও ডাক্তারের কাছে কম দৌঁড়াদৌঁড়ি করছেন।”

“হুম কে যে কত করার মানুষ সবাই জানে। কার হাতের ফাঁকে দিয়ে পানি পড়ে না এই কথা অন্তত কারও অজানা না। ফারহার বাবা আম্মাকে প্রাইভেট চেম্বারে দেখায়। বিশ ত্রিশ টাকার টিকেটে সরকারি হাসপাতালে না।”

রফিক সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কথা যত বাড়ছে, এক অপরকে তত আঘাত দিয়ে নগ্ন আক্রমণ করছে। তিনি সইতে না পেরে একটা ধমক দিয়ে ফরিদাকে চুপ করতে বলেন। শফিক সাহেবও জেসমিনকে মুখ বন্ধ করতে বলেন। রফিক সাহেব ভাইকে বলেন,

“শফিক এ বাড়িতে মহিলাদের এত মুখ চলা কবে থেকে শুরু হলো? ভাইয়ে ভাইয়ে যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে ভাই ভাই কথা বলে সমাধান করি। আম্মা মুরুব্বি জীবিত আছেন। আম্মা বলুক কী হয়েছে। বাকিরা চুপ থাকবে। আম্মা আপনি বলেন কী সমস্যা?”

“ঠিক আছে আমি বলতেছি। তোরা আগে চুপচাপ শোন। তারপর বলবি কার কী কথা আছে। রফিক ফারহার জন্য যে ছেলে দেখতেছে জেসমিন আর শফিক সে কথা তুই জানোস?

রফিক সাহেবের আগে শফিক সাহেবই উত্তর দেন,

“জানার তো কথা। আমি তো ভাইয়ের সাথে আলোচনা করছিলাম।”

রফিক সাহেব মাথা নাড়েন।

“জি আম্মা বলছিল শফিক।”

“সেই ছেলে কে সেটা জানোস?”

“তখন জানতাম না। এখন জানি।”

“কবে থেকে জানোস? মিতুলের জন্য একই ছেলে দেখার আগে না পরে?”

রফিক সাহেব চুপ করে থাকেন। শফিক সাহেব বলেন,

“দেখলেন আম্মা, আমি বলছি না ভাইজান সব জানেন। আপনি বলেন এসব করা কি খুব দরকার ছিল? এক বোনের জন্য কথা চলার সময় গোপনে আরেক বোনকে দেখানো। এসব কেমন আচরণ?”

যদিও জেসমিনকে চুপ থাকতে বলা হয়েছিল তবুও জেসমিন উত্তর না দিয়ে পারেন না। বলেন,

“ভাইকে জিজ্ঞাসা না করে ভাবিকে জিজ্ঞাসা করেন। আমরা বাড়িতে থাকব না এমন দিনে উনাদেরকে ডেকে মেয়ে দেখানো এসব ঘরোয়া রাজনীতির বুদ্ধি মহিলাদের মাথা থেকে আসে, পুরুষের না।”

ফরিদাও সমান বেগে উত্তর দেন,

“আমি কোনো বুদ্ধিও করি নাই রাজনীতিও করিনি। উনারাই আমাদের সাথে যোগাযোগ করলেন। রাহেলা জানাইছে যে মিতুলকে উনাদের ছেলের বেশি পছন্দ হয়েছে। উনারা ফারহার ব্যাপারে আগ্রহী না। মিতুলকে ওনারা একটু বাসায় এসে দেখতে চায়। আমরাও না করতে পারি নাই। ফারহার সাথে কি কোনো পাকা কথা হইছে? না তারা পাকা কথা দিয়েছে? তাদের ফারহাকে পছন্দ হয় নাই। মিতুল আর ফারহা তো আপন বোন না। তারা যদি মিতুলকে পছন্দ করে এতে অন্যের জ্বলে কেন?”

কথায় কথা বাড়ে সমাধান আসে না। মিতুল বা ফারহা বড়োদের এসব কথার মাঝে আসে না ঠিকই। কিন্তু দু’জনের মনেই কেমন একটা বিপরীতমুখী বিতৃষ্ণা। ফারহার অপমানে অন্তর জ্বলে যাচ্ছে। এভাবে তাকে ছোটো করতে পারলো ফারহান। আর মিতুলের মনে হচ্ছে ঐ লোকটা প্রস্তাব পাঠালো কেন। ঘর তো বটেই, আরমানের সাথেও তার জটিলতা তৈরি হয়েছে তার জীবনে ফারহানের উপস্থিতিতে। তার জীবনে ফারহানের অস্তিত্ব না থাকলে আজ আরমানকে এই কথা বলতোই না। চারদিকে কেমন জানি অশান্তির জাল বুনেই চলছে।

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-১৯

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ১৯

“তোর আব্বু কষ্ট পাবে।”

“আমার তো আসার কথাই ছিল না। হুট করে আসলাম।”

“তুলতুল, খেয়ে যা অন্ততঃ। এত জেদ ভালো না। বিয়ের পর মাথা ঠান্ডা করতে হয়। তোর উল্টো গরম হয়ে গিয়েছে।”

“আম্মু, আগেও আমরা ঠান্ডা ছিলাম। এখনো ঠান্ডা। আর জেদি হলে যেতাম না। জেদি নয় বলেই যাচ্ছি। না বলে এখানে এসে যদি ও বাসায় ফিরতে দেরি হয়। তাহলে কত কথা শুনতে হবে সেটা আমিই জানি। আপনি আর দাদিই বলছেন, কথায় কথায় নালিশ করতে না। তাই কথা গিলে খাওয়ার অভ্যাস করছি।”

মিতুল নিচে নেমে আসে। তুলতুলকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে চোখ মুছে দেয়।

“আপু খেয়ে গেলে পারতা। তুমি না খেয়ে চলে গিয়েছ জানলে আব্বুও খেতে পারবে না। তুমি জানো ঐ বাড়ি থেকে আসার পর থেকে আব্বু ঠিক মতো খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না। স্বীকার করেন না, কিন্তু বোঝা যায়। আম্মু কী বলল না বলল তাতে তুমি রাগ করে চলে যাচ্ছো?”

“ধ্যুত। তোর মনে হয় আমি রাগ করে যাচ্ছি? আমাকে এমনিতেই যেতে হবে। বাসায় বলা হয়নি। দেরি হলে সমস্যা হবে। শেলী আপু আসবে তার ননদের বিয়ের আলোচনা করতে। তুই জোর করলি আমিও হুট করে চলে আসলাম। এভাবে আর এখন আসা উচিত না। মিতুল, তোর সাথে অনেক কথা আছে। ফারহানের সাথে কথা বলতে সাবধান হু হ্যাঁ ছাড়া উত্তর দিবি না। কলেজে আবার আসলে দেখা হবে তোর সাথে।”

“বাহ তোমার ননদের ননদের বিয়ে তা এবাসায় কেন? উনাদের বাসায় হবে না?”

“বিয়ে না, বিয়ের আলোচনা। আরমান ভাইয়ের সাথে। আরমান ভাই সায়েমের কাজিন হয় না। আচ্ছা আর কথা বলার সময় নেই। পরে কথা হবে।”

***

তুলতুল চলে গিয়েছে শুনে রফিক সাহেব খুব মনে কষ্ট পেয়েছেন স্ত্রী ফরিদাকেও ঝাড়লেন কিছুক্ষণ।

“মেয়েটা বাসায় ঢুকতে না ঢুকতে তোমার এসব বলার দরকার ছিল?”

“আমি খারাপ কী করছি? আপনি আর আপনার মেয়ে তো মনে হয় যেন আমাকেই দোষী করতেছেন? বিয়ে আমি দিয়েছি? নিজে পাত্র ঠিক করেছেন। আজ যদি সত্যি সত্যি তুলতুল রাগ করে চলে আসতো? তাহলে তখন আপনার মা আমাকেই দোষ দিতেন। বলতেন মেয়ে মানুষ করতে পারি নাই। মেয়েদের কড়াকড়ি দিলেও দোষ, না দিলেও দোষ। এখন মেয়ের কাছেও খারাপ, মেয়ের বাপের কাছেও খারাপ।”

দুপুরে রাগ করে কেউই খেল না। মিতুলও খায়নি। ফরিদা ভাবলেন মা বাবা খায়নি দেখে মিতুলও খেতে পারছে না। রাতুল শুষ্ক মুখে ঘুরছিল দেখে ডেকে খাইয়ে দিলেন। মিতুলকেও খেয়ে নিতে বললেন। মিতুল এমনিতে খিদে সইতে পারে না। অথচ আজ কেমন খিদে মরে গিয়েছে মনে হচ্ছে। আরমানের বয়স হয়েছে। বিয়ে হবে এটাই স্বাভাবিক। তারও তো বিয়ের কথা চলছে। দু’জনের মাঝে নেই কোনোরকম সম্পর্ক। অথচ মিতুলের বুকে কেমন চাপ চাপ কষ্ট হচ্ছে। ফেসবুকে গিয়ে শেলীর প্রোফাইল খোলে। শেলীর প্রোফাইল থেকে তার ননদের খোঁজ পায়। ভালোই দেখতে শুনতে। মিতুলের চেয়ে বড়ো। ফারহান, যাকে মিতুল চেনেই না। সে নাকি মিতুলকে পছন্দ করে বসে আছে। আর এই লোকের সাথে এত কথা হলো, অথচ সে…।
নিজের উপর বিরক্ত লাগছে মিতুলের। এত উতলা হওয়ার কিছু নেই। আসলেই কিছু নেই। তাহলে তার বিরক্ত লাগছে কেন? আরমানকে ফোন দিয়ে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। কী হাস্যকর!

***
আরমানের ম্যাসেজ দেখে মিতুলের গা জ্বলে যায়।।ফটকা লোক একটা। সব পুরুষ এক। একসাথে কয়েকটা মেয়ের সাথে কথা না বললে চলে না।

“কী করছ? কোনো খোঁজ খবর নেই। নক করলাম কয়েকবার।”

রিপ্লাই দিবে না দিবে না করেও রিপ্লাই দেয়।

“তাই? খেয়াল করিনি। ব্যস্ত ছিলাম।”

“বাহ্ এত কী ব্যস্ততা?”

“ফারহানের সাথে কথা বলছিলাম।”

ইচ্ছে করে ফারহানের নাম টেনে আনে মিতুল। যদিও সে মোটেও ফারহানের সাথে কথা বলছিল না।

“ফারহান। কে উনি?”

“আমার জন্য যে পাত্র দেখা হচ্ছে। তিনিই ফারহান। আসলে তিনি আমার কাজিন ফারহা আপুকে দেখতে এসে আমাকে পছন্দ করে ফেলেছেন।”

আরমান ম্যাসেজ বাদ দিয়ে কল দেয়। মিতুল ইতস্তত করে উঠে রুমের দরজা বন্ধ করে। তারপর ফোন রিসিভ করে।

“হ্যালো।”

আরমান কুশল বিনিময়ের দিকে যায় না।

“এ কেমন কথা! কাজিনকে দেখতে এসে তোমাকে পছন্দ করেছে মানে?”

“মানে আমাকে বেশি সুন্দর লেগেছে।”

“আর তুমি তাতে গর্ব অনুভব করছ?”

মিতুল থমকে যায়। আরমানের গলার স্বর কেমন অন্য রকম লাগছে।

“গর্বের কী দেখলেন?”

“তাহলে তুমি আত্মসম্মানহীন একটা মেয়ে। অথচ আমি অন্য রকম ভেবেছিলাম।”

“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?”

“আত্মসম্মান থাকলে তুমি খুশি খুশি এই কথা বলতো পারতে? তোমার বোন, হোক কাজিন। তোমার বোনের জন্য দেখা পাত্র তোমাকে পছন্দ করেছে। তোমার তাতে সমস্যা যদি না থাকে তাহলে হয় তুমি আত্মসম্মানহীন লোভী। না হলে অন্যকে ছোটো করে আত্ম অহামিকায় ভুগছ। তুমি খুব মূল্যবান মিতুল। কারও কাছে নিজেকে সস্তা করা কি ঠিক? হয়তো সেই ব্যক্তি ভালো চাকরি করে অথবা ধনী ঘরের ছেলে। হয়তো খারাপ কেউ নয়। কিন্তু তার মানসিক দৃঢ়তার সমস্যা নিশ্চয়ই আছে। একজনের জায়গায় আরেজনকে জীবনসঙ্গী করতে চাওয়া একধরনের ছলনা।”

“ছলনার কী? ওনার তো ফারহা আপুর সাথে প্রেম ছিল না। ওনার পরিবার ফারহা আপুকে পছন্দ করেছিল। আর ওনার আমাকে পছন্দ হয়েছে।”

“এন্ড ইউ আর ওকে উইত দিস এটিটিউট?”

“আপনিও তো আমার সাথে কথা বলেন। কিন্তু বিয়ে করছেন শেলী আপুর ননদকে?”

“কী?”

“ভুল বললাম? আজ আপনার বিয়ের আলোচনা হওয়ার কথা না?”

“কিন্তু আমার সাথে তো তোমার বিয়ের আলোচনা চলছিল? আমি তো তোমাকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে যাচ্ছি না। আচ্ছা তুমি কি এমন কিছু ভেবে মাথা গরম করে আছ? সত্যি কর বলো।”

“আপনাকে বিয়ে করব কেন? আপনি চাকরি বাকরি কিছু করেন না। আপনার সাথে আমার বয়সের গ্যাপও কত বেশি। দশ বছর! আমি এমন কিছু কেন ভাবব। আমি রাখি।”

“তুমি ঠিকই বলেছ মিতুল। আই এম স্যরি। যা ভেবেছিলাম সব ছিল ভুল, ক্ষমা করে দিও মিতুল।”

মিতুল থতমত খেয়ে গিয়েছিল আরমানের প্রশ্নে। কী উত্তর দেবে এমন সরাসরি প্রশ্ন। উল্টো তার রাগ উঠে যায়। আরমানের এত কর্কশ করে কথা বলার কী আছে। সে তো সত্যি সত্যি ফারহানকে বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছে না। হঠাৎ ঝোঁকের বশে আরমানকে এসব বলে বসলো। মনে হয়েছিল আরমান জেলাস হবে। যদিও সে কেন আরমানের জেলাসি চায় নিজেই জানে না। আরমান তার সাথে কোনো ছলনা করেনি। বরং সত্যি বলতে ফারহান আসলেই ফারহার সাথে একধরনের ছলনাই করছে। কিন্তু এখন কী করবে। কী এসব আজেবাজে কথা বলে ফোন রেখে দিলো। আরমান হয়তো আর কখনোই তার সাথে কথা বলবে না। মিতুলের চোখে বাঁধ ভেঙে জল নামে। কী অজানা কারণে এত কষ্ট হচ্ছে, কার জন্য কষ্ট হচ্ছে জানা নেই। তবু কষ্টে মিতুলের বুকটা ভেঙে যাচ্ছে।

***

তুলতুল আজ পুরো রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। রিকশা ওয়ালা এলাকার মুখ চেনা। মিতুল, তুলতুলকে নিয়মিত কলেজে নিয়ে যেত। তাই তুলতুলকে এভাবে কাঁদতে দেখে কয়েকবার অবাক হয়ে পেছন ঘুরে দেখে। তারপর বাসার কাছাকাছি এসে রিকশা থামায়।

“কী হলো মামা এখানে রাখলেন কেন? বাসা আরও ভেতরে।”

“পানি আইনা দেই মামা। মুখে একটু পানি দেন।”

“দিন মামা।”

তুলতুল মুখ ধুয়ে ধাতস্থ হয়।

“ধন্যবাদ মামা।”

“মামা, নতুন নতুন বিয়া হইলে বাপের বাড়ির লাইগা পরাণ পোড়ে। মাইয়া কান্দে। কিনতুক আপনের কান্দন পরাণ পোড়নের কান্দন না। শুনেন এখখান কথা কই। চোখের পানির দাম মেলা। যারে তারে এই পানি ফেলতে দিয়েন না।”

তুলতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এক পলকে অর্ধশিক্ষিত একজন রিকশাচালক মামা ওর কষ্টটা বুঝে ফেলেছে। অথচ ওর নিজের মানুষেরা বুঝতে পারছে না। আসলেই তাদের জন্য কান্না মানায় না। শক্ত হতে হবে। অনেক শক্ত।

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-১৮

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ১৮

“চল ফুচকা খাই।”

“শুধু ফুচকা? আর কিছু খাওয়াবে না?”

“এক হাজার আছে ব্যাগে। কী খেতে চাস এর ভেতর?”

“পাগল! এক হাজার খেয়ে নষ্ট করব কেন? তিনশো টাকায় খাব। সাতশো দিয়ে জুতা কিনে দাও। তোমার বিয়ের সময় জুতা নিয়ে কী কেলেঙ্কারি হইছে জানো না তো।”

“কী হইছে, চল বসি। তারপর বলবি ডিটেইলসে। আর সাতশোয় ভালো জুতা পাবি না। এখন তো আমি মাঝেমধ্যেই আসব কলেজে। পরীক্ষাও দেব। তোকে মসজিদ মার্কেটে নিয়ে যাব। জুতা কিনব।”

“বাহ্ খুব বড়োলোক হইছ না? হাজার টাকায় খাওয়া, জুতা কিনে দেওয়া।”

তুলতুল হাসে,

“কেন, তুই না বলতি আমার বিয়ের পর এটা সেটা কতকিছু একমাত্র দুলাভাইয়ের কাছ থেকে আদায় করবি।”

“হ্যাঁ বলতাম কী, এখনো বলি।”

“করেছিস কিছু আদায়?”

মিতুল হাসি মুখেই জবাব দেয়,

“তো, নেবই তো। তুমি হিংসা করলেও নেব। সময় আসুক।”

মিতুলের অভিনয়ে তুলতুলের চোখ ভারী হয়ে যায়। তুলতুল ভালো নেই মিতুল জানে। এই দুলাভাই যে অযথা আব্দার করার দুলাভাই না এটা মিতুল বিয়ের দিনই বুঝেছে। এমনকি রাতুল পর্যন্ত বুঝে নিয়েছে। সারাদিন বোনদের পেছনে এটা সেটার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকা রাতুল সায়েমকে কোনো বিরক্ত করেনি। অথচ সায়েম ওদের বাসায় আসার আগে রাতুল দুলাভাইয়ের সাথে কী কী করবে সব লিস্ট করে ফেলেছিল।

“সায়েম ছেলে খারাপ না মিতুল। আসলে ও পারিবারিক, সামাজিক বিষয়গুলো কম বোঝে। তোদের খোঁজ খবর আমার কাছে নেয়। অনেকদিন বলেছে রাতুলকে নিয়ে যেন আমার শ্বশুর বাড়িতে যাস। তোদের নিয়ে একদিন বেড়াতে যাবে। শেলী আপু আসবে সামনে। তখন ডাকব। আসিস।”

“আসব আপু। তোমার শ্বশুর বাড়ি যেদিন তোমার নিজের বাড়ি হবে সেদিন আসব। আর ভাইয়া ফোন দেয় না তো কী হয়েছে? আমিও তো দেই না। লজ্জা লাগে। লজ্জা ভেঙে গেলে দাবি দাওয়া নিয়ে হাজির হব। এখন খাওয়ায় কী খাওয়াবা। আমার কিন্তু ক্ষুধা নাই। এক প্লেট ফুচকা আর এক প্লেট চটপটি। ব্যস।”

মিতুল কেন দামী কিছু খেতে চাইছে না তুলতুল বুঝে ফেলেছে। তুলতুলের ব্যাগে কত টাকা থাকে সে আন্দাজ হয়ে গিয়েছে মিতুলের। বিয়ে হলেও পরিস্থিতি বদলায় নি। আগে বাবা গুণেগুণে টাকা দিতেন যেন সন্তান হিসাবে করে চলা শিখে। এখন স্বামী গুণে গুণে টাকা দেয়, যেন স্ত্রী অবুঝের মতো অপচয় না করে। ব্যাগের এক হাজার টাকা সায়েমের দেওয়া নয়। এটা বিয়েতা পাওয়া সালামির টাকা। সায়েম টাকা দেয়নি তা নয়। ভাড়া দিয়েছে দু’শ টাকা। সায়েম কোনো হাত খরচ দেয় না। কিছু লাগলে বলতে বলেছে। এনে দিবে। আলাদা করে হাতখরচের কী আছে? এই দু’শ টাকাও তুলতুল চায়নি। জান্নাত আরা জিজ্ঞেস করেছিলেন কী কী কাজ কলেজে। অনেকগুলো নোটস ফটোকপি লাগবে বলায় বললেন নোট নিয়ে আসতে বাসায়। সায়েম করিয়ে দিবে ফটোকপি। ভাড়া হিসেবে দু’শ দিয়েছেন। তুলতুল একবার ভেবেছিল নেবে না। কিন্তু জানে, না নিলে আরেক অশান্তি হবে। সময় মতো তুলতুল জবাব দিবে। এখন অযথা কলহ এড়িয়ে যাচ্ছে।

***

ফারহান মিতুলকে নক করেছিল। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলো, মিতুল তার সম্পর্কে কিছুই জানে না। ফারহানের ধারণা হয়েছিল এমন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, ফারহানের মতো হ্যান্ডসাম ছেলে নিজ থেকে বিয়ে করতে আগ্রহী জানলে মিতুল খুশি হয়ে যাবে। ফারহানের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করেও সারাদিনে মিতুল কোনো রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি ফেসবুকে। যেভাবে ফারহা নিজ থেকে এগিয়ে এসেছিল, মিতুলের ক্ষেত্রেও তাই আশা করেছিল। তবে মিতুলের তরফ থেকে কোনোরকম সাড়া না পেয়ে একটু অবাকই হয়েছিল। তবে কী মিতুল কিছু জানে না? নিশ্চিত হতেই ফারহান মিতুলকে নক দেয়।

“হ্যালো। আছেন?”

“আসসালামু আলাইকুম। জি আছি।”

“কেমন আছেন? কী করছেন?

“ভালো, আলহামদুলিল্লাহ। আমি অপরিচিত কারও সাথে আসলে কথা বলি না। আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না। ফারহা আপুর কমন ফ্রেন্ড দেখে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করলাম।”

“তুমি সত্যি আর কিছু জানো না?”

“স্যরি। কিন্তু আমাকে হুট করে অচেনা কেউ তুমি বললে ভালো লাগে না। যদিও আপনি হয়তো আমার চেয়ে বড়ো। তবুও।”

“দুঃখিত। অনেকটা উত্তেজিত অবস্থায় তুমি বের হয়ে গিয়েছে। না হলে গায়ে পড়ে কোনো মেয়ের সাথে আমিও কথা বলি না।”

“এখন তো বলছেন।”

“এক্সকিউজ মি। তুমি আমাকে চেনো না। তাই এভাবে বলার স্পর্ধা করলে। আমিও তোমাকে মাফ করলাম। কেননা একদিক থেকে তোমার এই আচরণটা ভালো। আমি স্মার্ট মেয়ে পছন্দ করলেও, ওভার স্মার্ট পছন্দ করি না। সহজেই ছেলেদের গায়ে ঢলে পড়ার মেয়ে নয় বলে মনে হওয়ায় তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। না হলে ফারহান আহমেদকে মেয়ে খুঁজতে হয় না। মেয়েরাই ফারহান আহমেদকে খুঁজে নেয়।।বিশ্বাস না হলে তোমার কাজিন ফারহাকে জিজ্ঞেস কর। আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে আছে।”

“তাহলে আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন কেন?”

“আমার চয়েস। আমাকে কে বিয়ে করতে চায় সেটা আমার দেখার বিষয় না। আমাকে অনেকেই চায়।”

“কেন?”

“কেন? সেটা আমার সাথে সরাসরি কথা আর দেখা হলেই বুঝবে।”

***

মিতুল, তুলতুলকে অনেকটা জোর করে বাড়িতে ধরে এনেছে। তুলতুল তো আসবেই না। কিন্তু মাত্র এক ঘণ্টার জন্য বলে মিতুল তুলতুলকে নিয়ে এসেছে। যদিও তুলতুলের মনে অনেক অভিমান ছিল তবু বাবার বাড়ি, মা বাবা ভাইয়ের প্রতি মেয়েদের এক অদম্য ভালোবাসা কাজ করে। চাইলেও অভিমান ধরে রাখা যায় না। তুলতুলও তাই নিজের নেওয়া দৃঢ় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে বাসায় চলে আসে। ভাবছে অল্প কিছুক্ষণ থাকবে। নিজের পরিচিত বিছানায় ঘাপটি মেরে গুটিসুটি হয়ে। নিজের বিছানার ঘ্রাণ নেওয়া হয় না কতদিন। নিজের পড়ার টেবিল, গল্পের বইয়ের তাক, আলমারির দুটো ড্রয়ার যেখানে নিজের রাজ্যের জিনিস জমিয়ে রাখতো।।সবকিছু বড়ো বেশি মনে পড়ে। সেই মনে করার টানেই হঠাৎ চলে আসা হয়। তুলতুলকে এই অবেলায় হঠাৎ দরজার সামনে দেখে ফরিদা ভীষণ খুশি হয়ে যান। কতদিন পর মেয়ের চেহারা দেখা। তুলতুলকে আনতে লোক পাঠাতে চাইলেও, তুলতুলই মানা করেছিল। আজ কোনো খোঁজ খবর ছাড়া হাজির। কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি ভয় পেয়ে যান। তিনি তো আর জানেন না তুলতুলকে মিতুল নিয়ে এসেছে।

মিতুল, তুলতুল কারও কাছে ভাঙতি নেই। খুচরা টাকা খরচ করে ফেলেছে। মিতুল তুলতুলকে উপরে যেতে বলে সামনের দোকানে টাকা ভাঙতি করতে গিয়েছে। রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে ভাঙতির জন্য। তুলতুল একাই উপরে উঠে এসেছে।

“তুলতুল, তুই এই ভরদুপুরে? কী হইছে? বাসা থেকে রাগ করে আসছিস?”

“মানে?”

“মানে কোনো খোঁজ খবর ছাড়া হঠাৎ এই সময় বাসায়? সত্যি করে বল শাশুড়ির সাথে ঝামেলা করে আসছিস না জামাই বাবার সাথে?”

“এমনও তো হতে পারে আম্মু যে তোমার জামাই বাবা বাসা থেকে এক কাপড়ে বের করে দিয়েছে।”

“ও তোকে এককাপড়ে বের করবে কেন?”

“বারে গতবার বললো না এরপর সালিশ বসবে না।এককাপড়ে বের করে দিবে।”

“তুই কী করছিস? আয় বয় আগে। আমাকে খুলে বল কী হইছে।”

“অনেক ক্লান্ত আম্মু। ঘরে যাই। হাতমুখ ধুই। তারপর বলি?”

“তুই এখন বল।”

তুলতুল মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে ঘরের ভেতর চলে যায়। ফরিদার মাথায় হাত। মেয়ে কী করে আসছে আল্লাহ জানে। যদি ওরা আর ফেরত না নেয়! ছিছি মানুষ কী বলবে। কয়দিনও সংসার করতে পারলো না। ছোটোটার বিয়ে কিভাবে দিবেন? রফিক সাহেবকে কিভাবে জানাবেন? রান্না মাথায় উঠেছে ফরিদা বেগমের। শাশুড়ি বাসায় নেই। রফিক সাহেব দোকানে। কার সাথে আলোচনা করবেন?

***

“আম্মু, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছেলের পরিবারে দেখবেন, বৌ জামাইয়ের ঝগড়া হলে তারা মিটমাট করার জন্য আগাবেও না, শান্ত করা চেষ্টাও করবে না। ছেলের কোনো দোষ তো দেখবেই না। এমনকি বৌ থাকুক না থাকুক এটা নিয়েও খুব একটা মাথা ঘামাবে না।।বরং ছেলেকে বলবে শক্ত থাকতে। বৌকে পাত্তা দিতে না। গেলে যাক।

আর বেশিরভাগ মেয়ের বাড়িতে দেখা যায় উল্টা। তারা পারলে জামাইয়ের পূজা করবে। কোনো দোষ চোখেই দেখবে না। দেখলেও নিজেদের মেয়ের দোষই দেখবে। এবং যেভাবেই হোক, জোড়াতালি দিয়ে হলেও মিল করানোর চেষ্টা করবে। এটা এজন্য না যে তারা খুব চায় যে মেয়েটার সংসার হোক। বরং এজন্য যে মেয়ে এসে আবার কাঁধে না উঠুক। বিয়ে দিয়েছে মানে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। ছেলের পরিবারে খুশি হয় যে যাই হোক ছেলেটা তাদেরই থাকুক। মেয়ের পরিবারে উল্টো। তারা ভাবে যাই হোক মেয়ে ফিরে না আসুক।।আসলেও কাফনের কাপড়ে আসুক। এর আগে মেয়ে যতই কষ্ট পাক, কান্না করুক তাদের কানে তালা পড়ে থাকে। এরপর একদিন টুক করে মরে গেলে তখন খুব লোক দেখানো কান্নাকাটি করে। অথচ মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবে, যাক বাবা আমার ছেলের সম্পদে ভাগ বসাতে জীবিত তো এসে হাজির হয় নাই।”

“তুই কী বলতে চাস?”

“তুমি ঠিকই বুঝেছ কী বলেছি। একটু আগে তোমার প্রেশার হাই হয়ে যাচ্ছিল। আব্বু দোকান থেকে রওনা দিয়ে দিয়েছেন। এখন যখন শুনলে যে এসব কিছু না। আমাকে মিতুল জোর করে আনছে, তুমি স্বাভাবিক হয়ে গেলে।”

“এটাই কি স্বাভাবিক না? আমি তোর ঘর ভাঙার চিন্তা করব না? মা বাবার চিন্তা কি বুঝিস?”

“না বুঝি না। মা হলে হয়তো বুঝব। তবে এইটুকু সন্তান হিসেবে বুঝে ফেলেছি যে আমি আসলে এখন আসতে হবে মেহমান হয়ে। মেয়ে হয়ে নয়।”

(চলবে)